৩
মুসলিম শাসনঃ বাংলার ইতিহাসের গঠনমূলক যুগ
ইসলাম প্রচারক আলেম, দরবেশ ও মুজাহিদগণ জনগণকে সাথে নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন-রাজত্বের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম পরিচালনা করেন। তার মধ্যে দিয়ে ইসলামের প্রতি জনগণের সমর্থন গড়ে ওঠে। জনসমর্থনের সে দৃঢ় ভিত্তির ওপর ১২০৩ সালের মার্চ মাসে সম্পন্ন হয় ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর ঐতিহাসিক বিজয়। তিব্বতীয় বৌদ্ধ-ভিক্ষু লামা তারানাথ তাঁর ষোল শতকের বিবরণীতে জানান, বৌদ্ধরা মুসলমানদের বিজয়কে অভিনন্দিত করেছিল এবং ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীকে বিজয়ে সাহায্য করেছিল। শ্রীচারু বন্দোপাধ্যায় ও প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, বৌদ্ধরা মুসলমান বিজেতার সাহায্যে হিন্দুদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়ে কিছুটা শান্তি লাভ করেছিল।
লাখনৌতিকে কেন্দ্র করে বাংলার নব প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের সীমানা ছিল উত্তরে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পুর্নিয়া শহর, দেবকোট থেকে রংপুর শহর, পুব ও দক্ষিণ-পুবে তিস্তা ও কারতোয়া, দক্ষিণে গঙ্গার মূলধারা (পদ্মা) এবং পশ্চিমে কুশী নদীর নিম্নাঞ্চল থেকে গঙ্গার কিনারায় রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। পরবর্তী একশ’ বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় সমগ্র এলাকা মুসলিম শাসনাধীনে আসে।
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছরের মুসলিম শাসনের মূল্যায়ন এখানে সম্ভব নয়, এখানে তা উদ্দেশ্যও নয়। তবে এখানে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলার মুসলিম বিজয় ছিল জনগণের দীর্ঘকালীন সংগ্রামেরই সাফল্য, যা তাদরে সামনে বহুল প্রত্যাশিত এক মুক্তির দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল। ভারতে মুসলিম বিজয় সম্পর্কে গোপাল হালদার মন্তব্য করেনঃ
“ইসলামের বলিষ্ঠ ও সরল একেশ্বরবাদ এবং জাতিভেদহীন সাম্যদৃষ্টির কাছে ভারতীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতির………. এ পরাজয় রাষ্ট্র-শক্তির কাছে নয়, ইসলামের উদার নীতি ও আত্ম-সচেতনতার কাছে। ………. কারণ ইসলাম কোন জাতির ধর্ম নয়, প্রচারশীল ধর্ম। ইহা অন্যকে জয় করেই ক্ষান্ত হয় না, কোলে তুলে নেয়”।
(সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃষ্ঠা ১৯৬)
ভারতে বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির ব্যর্থতা ও ইসলামী সংস্কৃতির বিজয়ের কারণ চিহ্নিত করে কমরেড এম. এন. রায় ‘ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’ নামক গ্রন্হে লিখেছেনঃ
“ভারতে বৌদ্ধ বিপ্লবের পরাজয় ঘটেনি বরং তার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার জন্যই তা ব্যর্থ হয়েছে। সেই বিপ্লবকে জয়ের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমাজ-শক্তি তেমনভাবে দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। তার ফল হলো এই য, বৌদ্ধ মতবাদের পতনের সঙ্গে-সঙ্গেই সমগ্র দেশ অর্থনৈতিক দুর্গতি, রাজনৈতিক অত্যাচার, বিচার-বুদ্ধির স্বেচ্ছাচারিতা আর আধ্যাত্মিক স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে ডুবে গেল। বাস্তবিকপক্ষে সমগ্র সমাজ তখন ধ্বংস ও বিলুপ্তির ভয়াবহ কবলে পড়ে গেছে। এজন্য নিপীড়ত জনগণ ইসলামের পতাকার নীচে এসে ভীড় করে দাঁড়াল……….। ইসলামের সমাজ ব্যবস্থা ভারতীয় জনগণের সমর্থন লাভ করল। তার কারণ তার পিছনে জীবনের প্রতি সে দৃষ্টিবঙ্গি ছিল, হিন্দু দর্শনের চাইতে তা ছিল শ্রেয়; কেননা হিন্দু দর্শন সমাজদেহে এনেছিল বিরাট বিশৃঙ্খলা আর ইসলামই তা থেকে ভারতীয় জনসাধারণেকে মুক্তির পথ দেখায়”।(পৃষ্ঠা ৬১-৬২)
মুসলিম শাসন আমল বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গঠনমূলক যুগ হিসেবে ঐতিহাসিকদের বিবেচনা লাভ করেছে। এ জনপদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ যুগেই একটি উন্নত ও সংহত রূপ লাভ করে। রাজনৈতিকভাবে এ যুগেই বাংলার জনগণ একটি আদর্শের ভিত্তিতে সামাজিক ঐক্যমঞ্চে সংঘবদ্ধ হয়। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের ভিত্তিও এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. এম এ রহীমের মন্তব্যঃ
“যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এ প্রদেশে আর কয়েক শতকের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন অব্যাহত থাকত, তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত এবং অথীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো”। (বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ভূমিকা)
গণেশের রাজনৈতিক ‘অভ্যুত্থান’
১২০৬ সালে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর ইনতিকালের পর থেকে ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত ১৩২ বছরে অন্তত ২৩ জন মুসলিম শাসনকর্তা বাংলাদেশ শাসন করেন। দিল্লীর মুসলিম সালতানাতের প্রতি এই শাসকদের আনুগত্য ছিল নামমাত্র। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ সোনারগাঁয়ের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সেই নামমাত্র সুলতানী শাসনামল হিসেবে চিহ্নিত। শের শাহের সময় (১৫৪০-৪৫) কয়েক বছর বাংলাদেশ দিল্লীর সাথে যুক্ত ছিল। ১৫৭৬ সালে বাজমহলের যুদ্ধে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত দাউদ খান কররানী স্বাধীন সুলতানরুপেই বাংলাদেশ শাসন করেন। স্বাধীন সুলতানী শাসনামলের মধ্যভাগে দিনাজপুরের ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশের নেতৃত্বে হিন্দু অমাত্যদের ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলার ইতিহিাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ শাহাদাতবরণ করেন। এরপর ১৪১০ থেকে ১৪১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ইলিয়াশাহী বংশের সাইফউদ্দীন হামজা শাহ, শিহাবউদ্দীন বায়েজিদ শাহ ও আলাউদ্দীন ফিরূজ শাহ একের পর এক বাংলার শাসনমঞ্চে আবির্ভূত হন। গণেশের চক্রান্তে তারা সকলেই নিহত হন। শিহাবউদ্দীনকে হত্যা করার পর গণেশ তাঁর বালকপুত্র আলাউদ্দীন ফিরূপ শাহকে রাজা হিসেবে খাড়া করে এ সময় নিজেই কার্যত রাজা হয়ে বসেন। এরপর যখন বুঝতে পারেন, কাউকে আর শিখণ্ডী না রাখলেও চলবে, তখন ফিরুজকে হত্যা করে গণেশ ১৪১৫ সালে সিংহাসন দখল করেন।
রাজা গণেশের সিংহাসন দখলের মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনের অবসানকামী ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুদের দু’শতাধিক বছরের পুঞ্জীভূত আক্রোশ উচ্ছাসিত হয়ে ওঠে। গণেশ মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার সংকল্প করেন। বাংলাদেশ থেকে ইসলামের মূলোচ্ছেদ করাই হয়ে দাড়ায় তার প্রধান লক্ষ্য। রমেশচন্দ্র মজুমদার গণেশের স্বল্পকাল-স্থায়ী শাসনামলকে ‘হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা ও হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য স্থাপনের প্রচেষ্ঠা’ বলে উল্লেখ করেন। সে সময়ের বহু ইসলাম প্রচারক আলিম ও দরবেশকে গণেশ পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেন। বিখ্যাত আদিনা মসজিদকে তিনি পরিণত করেন কাচারি বাড়িতে।
রাজা গণেশের নেতৃত্বে বর্ণহিন্দুদের এই রাজনৈতিক অভ্যূত্থানের মোকাবিলায় তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আলিমগণ মৃত্যু-ভয় তুচ্ছ করে জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করেন। বাংলার এই ভয়াবহ দুর্দিনে শায়খ আলাইল হকের পুত্র সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ আলিম নূর কুতুব-উল-আলম মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করেন। তাঁর আহ্বানে জৌনপুরের সুলতান ইবরাহীম শর্কী এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে গণেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। বিপদ বুঝে গণেশ বিনা যুদ্দে আত্মসমর্পন করেন। গণেশের পুত্র যদু নূর কুতুব- এর কাছে ইসলাম কবুল করেন এবং জালালউদ্দীন মুহাম্মদ শাহ নাম ধারণ করে বাংলার শাসক হন।
শ্রীচৈতন্যের সাংস্কৃতিক আন্দোলন
গণেশের রাজনৈতিক অভ্যূত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর বর্ণহিন্দুরা সাংস্কৃতিত পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু করে। সুলতানী আমলের শেষদিককার বিদ্যাৎসাহী মুসলিম সুলতানগণ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্হাদি বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারে বিপুল উৎসাহ প্রদান করেন। শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্য, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্হ মুসলিম শাসকদের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃত থেকে ভাষান্তর ও বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা হয়।
সমসাময়িক দুনিয়ার সবচে’ সমৃদ্ধ ভাষা আরবীতে তখন তাফসীর, হাদীস. উসুল, তর্কবিদ্যা, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থণীতি, কাব্য সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিপুল গ্রন্হরাজি মজুত ছিল। মুসলমানদের সুষ্ঠু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠনের উপযোগী এই বিশাল জ্ঞান-ভাণ্ডার জনগণের সামলে তুলে ধরার কোন ব্যবস্থাই এ সময় করা হয়নি। সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণের মুখের ভাষা বাংলা যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করে। কিন্তু তাদের তৈরি বাংলা সাহিত্য এমন একটি রূপ লাভ করল, যেখানে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের যথার্থ প্রতিফলন ছিল না।
সুলতানদরে পৃস্ঠপোষকতায় সৃষ্ট মঙ্গল-কাব্যের প্লাবনে সাধারণ মুসলিম সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়। রাষ্ট্রকে নির্মাণ করার পাশাপাশি জাতি গঠনের কাজে শাসকদের সম্যক সচেতনতার অভাবে এবং তাদের সাংস্কৃতিক অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে স্বাধীন সুলতানী আমলের শেষভাগে হিন্দুদের সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনে প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয়।
শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণববাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন এমনি পটভূমিতে পরিচালিত হয়েছিল। চৈতন্য সম্পর্কে রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর গ্রন্হ ‘বাংলাদেশের ইতিহাস: মধ্যযুগ’-এর লিখেছেনঃ
“তিন শত বছরের মধ্যে বাঙালি ধর্ম রক্ষার্তে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়ায় নাই- মন্দির ও দেবমূর্তি ধ্বংসের অসংখ্য লাঞ্ছনা ও অকথ্য অত্যাচার নীরবে সহ্য করিয়াছে। চৈতন্যের নেতৃত্বে অসম্ভব সম্ভব হইল”। (পৃষ্ঠা ২৬১)
চৈতন্যের আবির্ভাবে বাংলার হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় জাগরণ সৃষ্টি হয়। তাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এ সময় যুগান্তাকারী বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। বহু হিন্দু লেখক চৈতন্যের জীবন ও দর্শন নিয়ে সাহিত্য রচনা করেন। বৈষ্ণব-চিন্তা ও ভাবধারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমগ্র অঙ্গনকে প্লাবিত করে।
এই হিন্দু পনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের মোকাবিলায় কোন কর্মপন্হা সে সময় মুসলিম সমাজে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। এ শূণ্যতার কারণে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতাবোধেরও জন্ম হয়। এ কারণে বৈষ্ণব কবি-সাহিত্যিকদের বিরাট মিছিলে এক শ্রেণীর মুসলমান কবিও গা ভাসিয়েছিলেন। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের ভাষায় এরা ছিলেন “বাঙ্গালার বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি”।
প্রেম ও ভক্তির ধর্ম প্রচারের নামে চৈতন্যের নেতৃত্বে ‘পাষাণ্ডি’ বা মুসলমান সংহারের আওয়াজ তোলা হয়। এ ছাড়া চৈতন্যের ধর্মাদর্শের আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল আদিরস। স্বকীয়া প্রেমের তুলনায় পরকীয়া প্রেমকেই চৈতন্য বেশি ঝাঁঝালো মনে করতেন। হিংসা ও সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি এবং রজকিনী প্রেমের আদিরস সঞ্চার করে চৈতন্য নিম্নবর্ণ হিন্দুদের একটি বড় অংশকে ইসলামের প্রভাব-সীমা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হন। এ সাফল্য প্রসঙ্গে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মন্তব্য করেছেনঃ
“শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব না হলে জাতিভেদের জন্যই কিছু উঁচু-বর্ণের হিন্দু ব্যতীত সকলেই মুসলমান হয়ে যেত”।
হিন্দু সাংস্কৃতিক পনরুজ্জীবন আন্দোলনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মুসলমানদের বিরুদ্দে চরম ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রচার। শ্রী চৈতন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসার বাণী প্রচার করেন। তা তাঁর শিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার জন্ম দেয়। বাংলায় সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির এটি ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। শ্রীচৈতন্যের বড় হাতিয়ার ছিল হিংসা ও সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি, আর পরকীয়ার রজকিনী প্রেমের আদিরস সঞ্চার। চৈতন্যের হিংসানীতির শিকার হয়েছিলেন নবদ্বীপের কাজী। কাজীর বাড়িতে হামলা চালানোর মিছিলে চৈতন্য নিজেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, এ হামলা হলো ‘উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রথম ঘটনা’।
চৈতন্য তার শিষ্য রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী নামক দুই ভাইয়ের সাহায্যে সুলতাতন হোসেন শাহের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র করেন। এ ষড়যন্ত্র ধরা পড়ার পূর্ব পর্যন্ত হোসেন শাহও চৈতন্যের আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
চৈতন্যপন্হিদের সাংস্কতিক আন্দোলনের প্রকৃতি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে চৈতন্যের ব্যর্থতার ওপর আলোকপাত করে মওলানা আকরাম খাঁ লিখেছেনঃ
“ছোলতান হোসেনের প্রাথমিক দোষ-দুর্বলতার সুযোগ লইয়া, গৌড় রাজ্যের সাধু-সন্যাসীরূপী বৈষ্ণব জনতা বাংলাদেশ হইতে ইসলাম ধর্ম ও মোছলেম শাসনকে সমূলে উৎখাত করিয়া ফেলিবার জন্য যে গভীর ও ব্যাপক ষড়যন্ত্রে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, ছোলতান ও স্থানীয় মোছলেম নেতাদের যথাসময়ে সতর্ক হওয়ার ফলে তাহার অবসান ঘটিয়া যায়।……….. চৈতন্যের দেব এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বিফল মনোরথ হইয়াই বিদেশ যাত্রা করিয়াছিলেন এবং তাহার পরে এমন আশ্চার্যরূপে উধাও হইয়া গিয়াছেন যে, ভক্তরাও তাহার শেষ জীবনের ইতিহাস সম্বন্ধে কোন সংবাদই দিতে পারেন নাই। কেহ বলিতেছেন অন্তর্ধান, কেহ বলিতেছেন সমুদ্রে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া মৃত্যুবরণ ইত্যাদি”। (মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস , পৃষ্ঠা ১১০)
সাঁইত্রিশ বছরের আফগান শাসন ও স্বাধীন বারো ভূঁইয়া
স্বাধীন সুলতানী আমলের পর ১৫৩৯ সালে শেরশাহ সূর বাংলায় আফগান শাসন কায়েম করেন। ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত আফগানের ৩৭ বছরের শাসনামল বাংলার ইতিহাসে নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই আমলে মুসলিম জনজীবনকে ইসলামী আদর্শের আলোকে সংস্কারের ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শের শাহ বাংলার তিনটি ইকলিম বা প্রদেশ ‘ইকলিম সোনারগাঁও’ ইকলিম লাখনৌতি’ ও ইকলিম সাতগাঁও-কে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৯টি সরকার ও ৬৮২ টি পরগনায় ভাগ করেন।
১৫৭৬ সালে বাংলায় আফগান শাসনের অবসানের পরও প্রায় তিন যুগ পর্যন্ত পূর্ববাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মোগল কর্তৃত্বের বাইরে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১৬০৮ সালের আগে পর্যন্ত বাংলায় মোগলদের কর্তৃত্ব ছিল একেবারেই সীমিত এলাকায়, উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের কয়েকটি সেনা-ছাউনিকে ঘিরে। বাকি এলাকায় মসনদে আ’লা ঈসা খাঁ, ওসমান খাঁ লোহানী, মাসুম খান কাবুলী প্রমুখ পাঠান মুসলিম নায়কগণ নিজেদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। আকবরের ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ এবং তার দ্বীন-ই-ইলাহী নামক নতুন ধর্মমত প্রচারের বিরুদ্ধে জৌনপুরের কাজী সাহেবের ফতওয়া বাংলার বার ভূঁইয়াদের মোগলবিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। এই ফতওয়া তাদের প্রতিরোধ সংগ্রামে জনসমর্থনের ভিত্তি রচনায়ও সহায়ক হয়। আকবরের জীবদ্দশায় এই এলাকায় মোগলদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।
মোগল কর্তৃত্ব: ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ
সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে মুজাদ্দিদে আলফিসানীর অন্যতম অনুসারী সুবাদার ইসলাম খাঁ চিশতি (১৬০৮-১৬১৩) বাংরায় মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬১০ সালে তিনি আকবর নগর (রাজমহল) থেকে জাহাঙ্গীর নগরে (ঢাকা) রাজধানী স্থানান্তর করেন।
ঢাকার বিখ্যাত নবাবদের মধ্যে শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা (১৬৩৯-৬০), শায়েস্তা খান (১৬৬৪-৭৮ ও ১৬৮০-৮৮) এবং আওরঙ্গজেবের পৌত্র আজীম-উস-শানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মধ্যে শায়েস্তা খান ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ছিলেন।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সুবাদার মুর্শিদ কুলী খাঁ ১৭১৭ থেকে ১৭২৭ সাল পর্যন্ত প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলাদেশে শাসন করেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর থেকে রাজধানী মকসুদাবাদে স্থানান্তর করেন এবং মুর্শিদাবাদ নামকরণ করেন। এ কারণে পরবর্তী স্বাধীন শাসকগণ মর্শিদাবাদের নবাব হিসেবে পরিচিত হয়েছেন।
মুর্শিদ কুলী খাঁ ১৭২২ সালে শের শাহের আমলের ১৯টি সরকার ৬৮২ টি পরগণকে ১৩ টি চাকলা ও ১৬৬০টি পরগণায় পুনর্বিন্যাস করেন। মুর্শিদ কুলী খানের পর সুজাউদ্দীন (১৭২৭-৩৯), সরফরাজ খান (১৭৩ ৯-৪০), আলীবর্দী খান (১৭৪০-৫৬), সিরাজউদ্দৌলা (১৭৫৬-৫৭) নামমাত্র মোগল কর্তৃত্বের অধীনে কার্যত স্বাধীন নবাবরূপে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসন পরিচালনা করেন।