৭
বাংলায় জন-বিদ্রোহ
ইংরেজ কোম্পানি এবং তার এ দেশীয় দালাল শ্রেণীর সর্বাত্মক নিপীড়ন, নির্যাতন ও লুণ্ঠন-শোষণের মুখে বাংলার মুসলমানদের সামনে পথ ছিল দু’টি : অনিবার্য ধ্বংসের কাছে আত্মসমর্পণ; কিংবা বিদেশী দখলদার ও তাদের এদেশীয় কোলাবোরেটরদেরকে উচ্ছেদ করার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম। দ্বিতীয় পথটি ছিল মুসলমানদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ। বিদ্রোহ ও বিপ্লবের রক্ত-পিচ্ছিল রাজপথে তাই শুরু হয় তাদের পথ চলা।
পলাশীর পতনের ছয় বছরের মাথায় ১৭৬৩ সালে বিদ্রোহের সূচনা করেন ফকির মজনুশাহ। আযাদী পুনরুদ্ধার ও অর্থনৈতিক মুক্তির এই প্রথম গণসংগ্রাম ১৮০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আটত্রিশ বছর স্থায়ী হয়। এ সময় থেকেই একের পর এক সংঘটিত হয় ত্রিপুরা জেলায় শমশের গাযীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), সন্দীপে আু তোরাবের বিদ্রোহ (১৭৬৯), ফকীর করম শাহের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম-চাষীদের বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৯), রংপুর-দিনাজপুরে নূরলদীনের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩), ফকীর বোলাকী শাহের নেতৃত্বে বাকেরগঞ্জে কৃষক বিদ্রোহ (১৭৯২), মোমেনশাঞী ও জাফরশাহী পরগণায় জমিদার-বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২), হাজী শরীয়তউল্লাহ ও দুদু মিয়ার নেতৃত্বে দক্ষিণ-পূর্ববাংলায় ফরায়েজী আন্দোলন (১৮১৮-৭০), উত্তরও পশ্চিমবঙ্গে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর অনুসারীদের জিহাদ আন্দোণ ও তিতুমীরের নেতৃত্বে জিহাদপন্হি কৃষক বিদ্রোহ (১৮২১-১৮৭০), সিপাহী বিপ্লব (১৮৫৭), সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩), টিপু পাগলার নেতৃত্বে পাগলপন্হি গারো বিদ্রোহ (১৮৩৭-৮২) ইত্যাদি। লর্ড ক্যানিং-এর ভাষায়, ব্রিটিশ শাসনের প্রথম একশ’ বছর পর্যন্ত মুসলমান মানেই ছিল ‘রাণীর বিদ্রোহী প্রজা’।
ফকীর ও কৃষক বিদ্রোহ
পলাশীর বিপর্যয়ের ছয় বছরের মাথায় মীর কাসিমের নেতৃত্বে দেশীয় সৈন্যগণ যখন ১৭৬৩ সালে পাটনায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধরত, বাংলা ও বিহারের ইংরেজ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সে সময় বিদ্রোহের ঝান্ডা তোলেন ফকীর মজনু শাহ। বেতনভুক সৈনিকদের শক্তির ওপর ভরসা করে পরিচালিত মীর কাসিমের সংগ্রাম অল্প সময়ের মধ্যে ব্যর্থ হয়। কিন্তু মজনু শাহের নেতৃত্বে ফকীর বিদ্রোহ নামে পরিচালিত এদেশের প্রথম জন বিদ্রোহ প্রায় চার দশক ধরে অব্যাহতভাবে পরিচালিত হয় এবং দেশের জনগণের মধ্যে অধিকার ও আযাদীর দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে তোলে। মাত্র হাজার খানেক লোক নিয়ে মজনু শাহ বিদ্রোহের সূচনা করেন। কয়েক বছরে তাতে বিদ্রোহীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় পঞ্চাশ হাজার। জমিহারা-গৃহহারা নিরন্ন চাষী, দিন মজুর, শিল্প ধ্বংসের ফলে বিভিন্ন পেশা থেকে বঞ্চিত কারিগর, বেকার তাঁতী, চাকুরীচ্যুত বুভুক্ষু সৈনিকসহ সকল স্তরের মানুষ শরীক হয় এই বিদ্রোহে। আযাদী পুনরুদ্ধার, ঈমানের হেফাযত এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও শোষণ মুক্তির এই সংগ্রাম ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বেশির ভাগ সময় রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, মালদহ, পাবনা ও মোমেনশাহী এবং মাঝে মধ্যে ঢাকা ও সিলেটে বিদ্রোহীদের অভিযান পরিচালিত হয়। একেকটি অভিযানে কখনো কখনো কয়েক হাজার সশস্ত্র বিদ্রোহী অংশ নিতেন। ১৭৬৩ সালে ইংরেজদের ঢাকা কুঠি হামলার মধ্য দিয়ে এ বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। কৃষক ও কারিগরদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে সমগ্র বাংলা ও বিহার কিছুদিনের মধ্যেই মহাবিদ্রোহের রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই বিদ্রোহ সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ রাজত্বের জন্য এবং তাদের নব্যসৃষ্ট দালাল জমিদার গোষ্ঠীর জন্য মহা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল এবং তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে সমর্থ হয়েছিল। ইংরেজ সৈন্যরা বিভিন্ন স্থানের ফকীর বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে বারাবার পরাজিত হয়। দালাল জমিদাররা তাদের এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিদ্রোহীদের তৎপরতার ফলে কোন কোন অঞ্চলে রাজস্ব আদায় কার্যত বন্ধ হয়ে যায় এবং বিভিন্ন স্থানে জমিদারদের কাচারী বারবার লুণ্ঠিত হয়। ফলে ঐসব স্থানে ইংরেজদের রাজস্ব ঘাটতি ও জমিদারদের অথসংকট দেখা দেয়। ইংরেজ ও মজনু শাহের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকালে গ্রামবাসীরা অনেক সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহীদের পক্ষ অবলম্বন করেছেন এবং পলায়নপর ইংরেজ সৈন্যদের হত্যা করে তাদের অস্ত্র মুক্তি সংগ্রামীদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
১৭৮৬ সালে ১৯ ডিসেম্বন মজনু শাহ ইংরেজ সেনাপতি ব্রেনানের সাথে এক যুদ্ধে আহত হন। এরপর ১৭৮৭ সালের মার্চ কিংবা মে মাসে তিনি ইনতেকাল করেন। মজনু শাহ-এর আসল নাম ও প্রকৃত পরিচয় রহস্যাবৃত। ইংরেজদের চোখ এড়ানোর জন্যই তিনি মজনু (পাগল) শাহ নামের আশ্রয় নিয়েছেন। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে তাঁর পরিচয় বাকের মুহাম্মদ বা নূরউদ্দীন বাকেরজঙ্গ নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। মজনু শাহের প্রধান সাথীদের মধ্যে ছিলেন চেরাগ আলী শাহ, ফেরাগুল শাহ, সুবহানী শাহ, করম শাহ, মাদার বখশ, জরিফ শাহ, রমযান শাহ ও রওশন শাহ। মজনু শাহের মৃত্যুর পরও চৌদ্দ বছর পর্যন্ত তাঁরা এই বিদ্রোহ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ফকীর বিদ্রোহের সমসাময়িককালে ১৭৬৭-৬৮ সালে ত্রিপুরা জেলায় শমশের গাজী বিদ্রোহ সংগঠিত করেন। ১৭৬৯ সালে সন্দ্বীপ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দান করেন আবূ তোরাব। ১৭৭৫ সালে মোমেনশাহীর সুসংগ ও শেরপুর জমিদারী এলাকায় ফকীর করম শাহের নেতৃত্বে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৭৭৬ সাল থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত এক যুগেরওর বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম চাষীদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান করেন শের দৌলত খাঁ, রামু খাঁ ও জান বখশ খাঁ। ১৭৮৩ সালে দিনাজপুরে কোম্পানির ইজারাদার ‘রাজা’ দেবী সিংহ ও তার ‘দেওয়ান’ হরেরামের বিরুদ্ধে নুরুলদীনের নেতৃত্বে পরিচিালিত হয় কৃষক বিদ্রোহ। ১৭৯২ সালে ফকীর বোলাকী শাহের নেতৃত্বে বাকেরগঞ্জে কৃষকদের বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এভাবে একটির পর একটি গণবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে পলাশী বিপর্যয়ের মসীলিপ্ত ইতিহাস রক্ত রঞ্জিত, গৌরবময়, উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে।
১৭৯৮ সালে ফতেহ আলী টিপু মহীশূরের আযাদী হেফাযত করার জন্য যখন জীবন বাজী রেখে লড়াই করছিলেন এবং ইংরেজ শাসকদের জন্য এক ভীতিকার অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন, বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় তখন মজনু শাহের অনুসারীগণও আযাদী সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। আর তখন ইংরেজদের এই বিপদের দিনে কলকাতাকেন্দ্রিক সদ্য বিকশিত বর্ণহিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ী শ্রেণীটি বিদেশী কোম্পানি শাসনের প্রতি তাদের প্রকাশ্য সমর্থন ঘোষণা করে ইংরেজদের সন্ত্রস্ত মনে সাহস বজায় রাখার চেষ্টা করছিল। ১৭৯৮ সালের ২৯ আগস্ট কলকাতায় অনুষ্ঠিত এরূপ একটি সভায় কলকাতার নব্যসৃষ্ঠ ধনিক গোষ্ঠীর প্রতিভূ গৌরচন্দ্র মল্লিক, নিমাইচরণ মল্লিক, গোপিমোহন ঠাকুর, কালিচরণ হালদার, রসিকলাল দত্ত, গোকূল চন্দ্র দত্ত প্রভৃতিরা এক সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রিটিশরাজের প্রতি তাদের পূর্ণ আনুগত্য ও সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। ১৭৯৯ সালে ৪ মে মহীশূরের বাঘ টিপু সুলতান দেশের আযাদীর জন্য শাহাদাত বরণ করলেন। বাংলার পথে-প্রান্তরে তখনো ফকীর বিদ্রোহীগণ তাঁদের বিদ্রোহের ঝান্ডা উঁচু রেখেছেন। অন্যদিকে মহীশূর থেকে বিজয়ীর বেশে কর্ণওয়ালিস কলকাতায় ফিরে এলে শহরের নব্যসৃষ্ট বর্ণহিন্দু প্রধান ব্যক্তিরা তাকে বাংলা ও ফারসি ভাষায় মানপত্র দিয়ে বরণ করে নেয়।
ফরায়েজী ও জিহাদ আন্দোলন
ইংরেজ শাসনের প্রথম একশ বছর ধরে বাংলার মুসলমানদের যেসব আপসহীন মুক্তি সংগ্রাম পরিচালিত হয়, তার মধ্যে ফরায়েজী আন্দোলন ও জিহাদ আন্দোলন ছিল সবচে ব্যাপক ও সুসংহত এবং বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তারক। হাজী শরীয়তউল্লাহর (১৭৬৪-১৮৪০) নেতৃত্বে ১৮১৮ সালে পূর্ববাংলায় ফরায়েজী আন্দোলনের সূচনা হয়। জিহাদ আন্দোলন ছিল শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২) ও তাঁর পুত্র শাহ আবদুল আযীযের (১৭৪৬-১৮৪৩) বিপ্লবী ভাবধারায় উৎসারিত। শাহ আবদুল আযীয খেলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সংগঠন কায়েম করেন। এ সংগঠনের প্রবীণদের মধ্যে তাঁর তিন ভাই শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল, মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসহাক ও সৈয়দ আহমদ বেরেলভী (১৭৮৬-১৮৩১) শামিল ছিলেন। শাহ আবদুল আযীয শেষোক্ত তিনজন আলেমকে সামনে রেখেই উপমহাদেশীয় মুসলিম গণবাহিনী গঠন করেন। এর আগে তিনিই ১৮০৩ সালে ইংরেজ পদানত হিন্দুস্থানকে সর্বপ্রথম ‘দারুল হরব’ বলে ঘোষণা করেন এবং আযাদী পুনুরুদ্ধারের জন্য জিাহদের আহবান প্রচার করেন। এই আন্দোলন ‘তরীকয়ে মুহাম্মদিয়া’ বা ‘জিহাদ আন্দোলন’ নামে পরিচিত হয়। সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী ১৮২১ সাল থেকে জিহাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছিল সারা উপমহাদেশ জুড়ে।
জিহাদ ও ফরায়েজী আন্দোলনের উৎসভূমি, সংগঠন-কাঠামো ও কর্মসূচিতে পার্থক্য ছিল। কিন্তু মুসলমানদের ঈমান-আকীদা, আচার-আচরণ, নীতি-প্রথা ইসলামের আলোকে পুনর্গঠন, তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে বিজাতীয় কুসংস্কার, কুপ্রথা ও বিদআত থেকে মুক্ত করা এবং ইসলামের আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে থেখে ইংরেজদের উৎখাত করার ব্যাপারে তাঁদের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। জিহাদপন্হিগণ তাঁদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন এবং মুসলমানদের অন্য সকল শক্রর বিরুদ্ধেও প্রত্যক্ষ সশস্ত্র যুদ্ধে প্রবৃত্থ করেছেন। বাংলাদেশেই ইংরেজ শাসন সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে এবং এখানেই বর্ণহিন্দু জমিদারদের জুলুম-শোষণ ব্যাপকতর ও গভীরতর হওয়ার কারণে বাংলার মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক অর্থনৈকি জীবনের অবক্ষয় ছিল সবচে বেশি। ফরায়েজী নেতৃবৃন্দকে বাংলার মুসলমানদের সেই ক্ষতস্থানগুলোর পরিচর্যা করতেই অধিক সময় ব্যয় করতে হয়। জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির পরই তাঁরা সশস্ত্র লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
ফরায়েজী নেতৃবৃন্দের প্রাথমিক কর্মসূচি ছিল ফরয প্রতিষ্ঠা, শিরক-বিদআতের মূলোৎপাটন, তওবার, আন্দোলন, মুসলমানদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যও আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার এবং বিধর্মীয় নাম, পোশাক ও আচার-অনুষ্ঠান বর্জন, ধর্মের নামে কুসংস্কার ও গোঁড়ামী নির্মূল, মানুষে মানুষে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন, সামাজিক ভে-বৈষম্য দূরূকরণ। দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচি ছিল জমিদার-মহাজন-নীলকরদের জুলুম নির্যাতনের প্রতিকার, সামন্ত-প্রথার উচ্ছেদ সাধন ও ভূমি-ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, ইংরেজদের হাত থেকে আযাদী পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ইংরেজ কবলিত ভারতকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা, দেশ শক্রমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জুমুআ ও ঈদের নামায বর্জন এবং মুক্ত স্বদেশে স্বাধীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা। অল্পদিনের মধ্যেই শরীয়তউল্লাহর নেতৃত্বে বারো হাজার কৃষক সংগঠিত হয়। ঢাকা, পাবনা, বরিশাল, নোয়াখালী, নদিয়া ও মোমেনশাহীতে তাঁর আন্দোলনের প্রভাব বেশি ছিল। সবচে বেশি প্রভাব ছিল কৃষক ও তাঁতীদের মধ্যে। এসব আন্দোলনের কারণে হিন্দু জমিদার-মহাজনরা ক্ষেপে যায়।
১৮৩১ সালে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী যখন বালাকোটের প্রান্তরে এবং তিতুমীর নারকেলবাড়িয়ায় চূড়ান্ত সংগ্রামে লিপ্ত, ঠিক সে বছরই হাজী শরীয়তউল্লাহ পূর্ববাংলায় প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ সময় জিহাদ আন্দোলনের পূর্ব-ভারতীয় নেতা মওলানা ইনায়েত আলী (১৭৯৪-১৮৫৮) ‘কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য’ পল্লী বাংলার জনগণকে প্রকাশ্যে আহ্বান জানান এবং ইসলামের হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধার ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। অন্যদিকে ফরায়েজীগণ ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে কৃষকদেরকে সংগঠিত করে ব্যাপক বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। ফরায়েজী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয় এক অভূতপূর্ব প্রজাবিপ্লব। প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে ফরায়েজী নেতাদের সংগ্রামের কাহিনী বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অতি রোমাঞ্চকর অধ্যায়। প্রজাদের জন্য ‘পিতার দরদ’ এবং অবিচারের বিরুদ্ধে ‘মুজাহিদের তেজ’ নিয়ে প্রতিপত্তিশালী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তাঁরা সংগ্রাম পরিচালনা করেন। শান্তিপূর্ণ সকল প্রচেষ্টা ব্যার্থ হওয়ার পরই তাঁরা প্রজাদের সংগঠিত শক্তিকে অস্ত্রবলে বলীয়ান করেন। তাঁদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের কাছে অত্যাচারী জমিদাররা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। হাজী শরীয়তউল্লাহর পুত্র দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২) ঘোষণা করেন : “সব মানুষ ভাই ভাই। পৃথিবী আল্লাহর : সৃষ্টি যার শাসনও চলবে তাঁর”। তাঁর স্লোগান ছিল : “লাঙ্গল যার, জমি তার”, “সৃষ্টি যার, আইন তাঁর”। বস্তুত জিহাদ ও ফরায়েজী আন্দোলনের বক্তব্যের মূল সুর ছিল অভিন্ন।
জিহাদ আন্দোলনের সাথে সাথে বাংলার জনগণ একেবারে শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন। ১৮২১ সালে হজ্জ সফর উপলক্ষে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী কলকাতায় আসেন। বাংলার ওলামায়ে কেরাম ও সচেতন জনগণের একটি বিরাট অংশ সে সময় সরাসরি তাঁর সান্নিধ্যে এসে জিহাদ আন্দোলনের বাইআত বা শপথ গ্রহণ করেন। তিতুমীর তাঁদের অন্যতম ছিলেন। ১৮২৫ সালে সাইয়েদ আহমদ বেরলভীর প্রত্যক্ষ লড়ইয়ের অংশীদার পাঁচ-ছয় হাজার মুজাহিদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই যোগ দিয়েছিলেন বাংলা থেকে। তাঁদের মধ্যে অন্তত চল্লিশ জন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সীমান্ত প্রদেশে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সরকারের ‘মজলিসে শূরা’ বা মন্ত্রীসভার প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন পূর্ববাংলার বিপ্লবী মুজাহিদ নেতা ইমামউদ্দিন বাঙালি। ১৮২৮ সালে জিহাদ আন্দোলনের কঠিন সংকটকালে জনশক্তি ও আর্থিক সাহায্য বাংলাদেশ থেকেই প্রথম গিয়ে পৌঁছেছিল। জিহাদ আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্য বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকার স্বাধণতাকামী মুসলমানদের ঘরে ঘরে মুষ্টি চাল রাখঅর ব্যবস্থা ছিল। অনেক সময় মা-বোনেরা তাঁদের অলংকার এবং অনেকে তাঁদের গরু-বাছুর বা জমি বিক্রি করে জিহাদের জন্য সাহায্য পাঠিয়েছেন। ১৮৩১ সালে ৬ মে বালাকোটের প্রান্তরে সাইয়েদ আহমদ বেরলভী ও মওলানা শাহ ইসমাঈল-এর সাথে দুই শতাধিক মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় অন্তত নয়জন বাঙালি মুসলমানের নাম এ পর্যন্ত জানা গেছে। ইমামউদ্দীন বাঙালিসহ বাংলার প্রায় চল্লিশ জন মুজাহিদ বালাকোটের লড়াইয়ে আহত হন। বালাকোট-এর ময়দান থেকে ফিরে এসে তাঁরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জিহাদ আন্দোলন সংগঠিত করেন।
এই সময় বাংলার জিহাদ আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকার বংশালে। পাটনা ছিল মূল কেন্দ্র। ফরায়েজী আন্দোলনের বেশি প্রভাব ছিল মোমেনশাহী থেকে বাকেরগঞ্জ পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে। আর জিহাদ আন্দোলন বেশি শক্তিশালী ছিল উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গে। ফলে ভৌগোলিক দিক দিয়ে সে সময় ইংরেজ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে এই দু’টি আন্দোলনের মিলিত প্রভাব বাংলার প্রায় সবটা এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বাইরে থেকে অনেকের চোখেই এই দু’টি আন্দোলনের পার্থক্য ধরা পড়তো না। উভয় আন্দোলনকে ইংরেজ ও তাদের সমর্থকরা ‘ওয়াহাবী আন্দোলন’ নামে চিহ্নিত করত।
জিহাদপন্হি তিতুমীরের লড়াই
মওলানা সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১) ১৮২১ সালে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর সাথে মক্কা, মদীনা, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ সফর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম মনীষীর সাথে সাক্ষাত এবং মুসলিম দুনিয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে দেশে ফিরে তিনি সাইয়েদ সাহেবের একজন খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে বাংলায় জিহাদ আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের সমসাময়িককালে পরিচালিত তিতুমীরের আন্দোলনের সামাজিক পটভূমি ছিল অভিন্ন। মারাঠা-বর্গীদের দ্বারা লুণ্ঠিত পশ্চিমবাংলায় হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের দ্বারা নিষ্পেষিত জনগণ অথনৈতিক ও সামাজিকভাবে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছিল। মুসলমানদের ওপর কায়েক হয়েছিল হিন্দুদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য। তহবন্দ-এর পরিবর্তে ধুতি, সালামের পরিবর্তে আদাব-নমস্কার, নামের আগে শ্রী ব্যবহার, মুসলমানী নাম রাখতে জমিদারের পূর্বনুমতি ও খারিজানা, হিন্দুদের পূজার জন্য পাঁঠা যোগানো ও চাঁদা দেওয়া, দাড়ির ওপর ট্যাক্স, মসজিদ তৈরি করলে নজরানা, গরু জবাই করলে ডান হাত কেটে নেওয়া প্রভৃতি জুলুম ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। এই পটভূমেই জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত মওলানা তিতুমীল কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে তিনি জনগণকে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। ধর্মীয় অনুশাসনসমূহ পূর্ণরূপে অনুসরণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রেরণায় তিনি সকলকে উজ্জীবিত করেন। বিরান হয়ে যাওয়া মসজিদসমূহ তিনি সংস্কারের ব্যবস্থা করেন এবং সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রচলন করেন। তিনি পূজার চাঁদা দান বা তাতে অংশগ্রহণের মতো কাজ বন্ধ করেন। শিরক-বিদআত বন্ধ করেন। মুসলমানী নাম রাখা, ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পরা, এক আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করা, পীরপূজা ও কবরপূপা বন্ধ করা, কুসংস্কার ও অনৈসলামী কাজের মূলোচ্ছেদ তথা কুরআন-হাদীসের খেলাফ কোন কাজ না করা ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পুনর্গঠন তাঁর র্কসূচির অন্তর্ভুক্ত।
তিতুমীরের আন্দোলনের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলমানগণ এবং বহু অমুসলমান কৃষক দ্রুত জোটবদ্ধ হলেন। তিতুমীরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এক বিরাট ইসলামী জামাত। তিতুমীরের সংগ্রাম ছিল জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে। তাঁর স্লোগান ছিল ‘লাঙ্গল যার জমি তার’। তাঁর বক্তব্য ছিল ‘প্রত্যেকের শ্রমের ফসল তাকে ভোগ করতে দিতে হবে’।
এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার শ্রীদেবনাথ রায়, ধান্যকুড়িয়ার জমিদার শ্রীরায়বল্লভ, তারাবুনিয়ার জমিদার শ্রীরামনারায়ণ নাগ, নাগরপুরের জমিদার শ্রীগৌরপ্রসাদ চৌধুরী, সরফরাজপুরের জমিদার শ্রী কে পি মুখার্জী ও কলকাতার গোমস্তা লাটু বাবুরা ঐক্যবদ্ধ হয়। ইংরেজ নীলকররাও ছিল তাদের পক্ষের শক্তি। একদিকে তিতুমীরের নেতৃত্বে মুসলমানগণ সংঘবদ্ধ হচ্ছিলেন, অন্যদিকে জমিদারদের জুলুমের মাত্রা বাড়ছিল তীব্র গতিতে। তিতুমীরের একজন পত্র-বাহককে পুঁড়ার জমিদার নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে। জমিদারের লোকেরা বশিরহাটের জামে মসজিদ পুড়িয়ে দেয়। মুসলমানদের ঘরবাড়ি তারা লুট করে। এভাবেই একটির পর একটি ঘটনা ঘটতে থাকে।
এই অত্যাচারের প্রতিকারের জন্য মুসলমানগণ তিতুমীরের নেতৃত্বে রুখে দাঁড়াতে থাকেন নানা জায়াগায়। এরূপ পটভূমিতে তিতুমীরের বাহিনীর সাধারণ সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নারিকেলবাড়িয়ার এক বিরান মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের দুর্গ। গড়ে ওঠে বাঁশের কেল্লা। তিতুমীরের বাহিনী নদিয়া ও চব্বিশ পরগণা জেলার অধিকাংশ ভূখণ্ড মুক্ত করে। এই সীমিত ভূখণ্ডে মুসলমানদের স্বরাজ কায়েক হয়। এভাবেই তিতুমীরের শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন মাতৃভূমি আযাদ করার রক্ত-পিচ্ছিলপথে এগিয়ে যায়। বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে জমিদার ও ইংরেজদের পরাজয় হয়।
এরপর পূর্ণাঙ্গ লড়াই। বড়লাট লর্ড ব্যান্টিঙ্কের নির্দেশে ১৮৩১ সালের নভেম্বর মাসে মেজর স্কট হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট, ক্যাপ্টেন সাদারল্যান্ড, ক্যাপ্টেন শেক্সপীয়রসহ ইংরেজদের অশ্বারোহী, পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনী হামলা চালায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায়। ১৯ নভেম্বর ফযরের নামাযের পর তিতুমীর স্বভাবসিদ্ধ ওজস্বী ভাষায় অনুসারীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি জাতির ঈমান, অধিকার ও আযাদী রক্ষার সংগ্রামে শাহাদাতের পেয়ালা পান করার জন্য তাদেরকে বুলন্দ আওয়াজে আহ্বান জানালেন।
যুদ্ধ শুরুর আগে ইংরেজ সেনাপতি ও তিতুমীরের মধ্যে রামচন্দ্র নামক একজন দোভাষীর মাধ্যমে আলোচনা হয়। দোভাসী উভয় পক্ষের বক্তব্য বিকৃতভাবে পরিবেশন করে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইংরেজদের কামানের গোলার আঘাতে তিতুমীর, তাঁর পুত্র মীর জওহর আলী ও আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ময়েজউদ্দীন বিশ্বাসসহ বহু যোদ্ধা বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন। তিতুমীরের দুই পুত্র মীল তোরাব আলী ও মীর গওহার আলী এবং সেনাপতির ভাগ্নে গোলাম মাসুমসহ বন্দী হন সাড়ে তিন শত মুক্তিযোদ্ধা। গোলাম মাসুমকে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলা হলে তিনি ঘৃণার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেন। কেল্লার পুব পাশে গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দিয়ে শহীদ করা হয়। এ্ই যুদ্ধ সম্পর্কে ইংরেজ সেনাপতি মেজর স্কট মন্তব্য করেছেনঃ
“যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি, কিন্তু জীবন দিয়েছেন একজন ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক মহাপুরুষ”।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব
পলাশী বিপর্যয়ের ঠিক একশ বছর পর ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। শত বছর ধরে এদেশের আযাদী পাগলা মুসলমানরা যে নিরন্তর বিদ্রোহ পরিচালনা করে ‘ রাণীর বিদ্রোহী প্রজা’ অভিধা লাভ করেছিলেন, সিপাহী বিপ্লব নামে পরিচিত আযাদীর লড়াই ছিল তারই অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়কগণই ছিলেন সিপাহী বিপ্লবের মূল শক্তি ও অনুপ্রেরণা। ১৮৩১ সালে বালাকোটের সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর বাহিনীর বিপর্যয়ের পর জিহাদের বিপ্লবী ভাবধারায় উজ্জীবিত নেতৃবৃন্দ উপমহাদেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এই কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর অন্যতম অনুসারী হাফিয কাসিম।
জিহাদী নেতৃবৃন্দের মধ্যে জেনারেল বখত খান, মওলানা আহমদ উল্লাহ শাহ ও মওলানা ফজলে হক খায়বাদী দিল্লী কেন্দ্রে, হাজী ইমদাদউল্লাহ ও তাঁর অনুসারীগণ শামেলী, সাহারানপুর ও থানাভবনে সক্রিয় ছিলেন। হাফিয কাসিমের অনুসারী নেতৃস্থানীয় মুজাহিদদের মধ্যে দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলানা কাসিম নানুতুভী, মওলানা রশীদ আহমদ গাংগোহী, মওলানা মোহাম্মদ মুনীর প্রমুখ বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের অনুপ্রেরণা ও নেতৃত্বে উত্তর প্রদেশ,দিল্লী ও কানপুরসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এসব কেন্দ্রের মধ্যে এক সুগ্রন্হিত যোগসূত্র বিদ্যমান ছিল।
জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়ক মওলানা আহমদউল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮৬৫ সাল থেকেই বিপ্লব ও বিদ্রোহের সংকেতবাহী চাপাতি রুটি ও রক্তজবা ফুল বিতরণ শুরু হয়ে যায়। এক গ্রামের নেতার হাত থেকে দ্রুত অন্য নেতার হাতে ঘুরছিল বিপ্লবের ইঙ্গিতবাহী চাপাতি রুটি। এক সৈন্য আরেক সৈন্যের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিলেন রক্ত-রঙিন আযাদী বিপ্লবের ইঙ্গিতবাহী জবা ফুল। সে কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত। দিল্লী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সবখানে বিপ্লবীদের কার্যক্রমের খবর প্রতিদিনই সতর্কতার সাথে পৌঁছে যাচ্ছিল।
১৮৫৭ সালের এপ্রিল মাসে মওলানা আহমদউল্লাহর বিরুদ্দে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারপত্র বিলির অপরাধ প্রমাণ করে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ৈ শহীদ করা হয়। তার আগে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ভ ও সংগঠিত করেন। ১৮৫৭ সালের জানুয়ারিতে মাদ্রাজে এক বক্তৃতায় তিনি বলেনঃ
“দেশবাসী, আপনারা জেগে উঠুন। ফিরিঙ্গি কাফেরদের উৎখাত করতে আপনরারা সংঘবদ্ধ হোন। এই কাফেররা ন্যায়ক পদদলিত করেছে, আমাদের স্বরাজ্য তারা লুণ্ঠন করেছে। এই কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য আমাদেরকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সে সংগ্রাম হবে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য জিহাদ”।
জিহাদ আন্দোলনের অসংখ্য বিপ্লভী নেতা এ সময় হিন্দুস্থানের প্রত্যন্ত এলাকায় এমনিভাবে দেশবাসীকে আযাদী পুনরুদ্ধারের লড়ইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্বদ্ধ করছিলেন। দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ যাফরও জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়কদের সংগ্রাম দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে এ সময় এক ঘোষণাপত্র প্রচার করেন এবং বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানান।
১৮৫৭ সালে সারা ভারতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিদ্রোহের সূচনা হয় ইংরেজ শাসনের রাজধানী কলকাতার ব্যারাকপুরে। বাংলায় সে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, যশোর প্রভৃতি স্থানে। ঢাকার বিদ্রোহ চলাকালে একজন ইংরেজ সৈন্য নিহত ও চারজন আহত হয়। অন্য দিকে ৪০ জন দেশীয় সিপাহীসহ বহু আহত হয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য ১৮৫৭ সালে লালবাগের যে স্থানটিতে সেদিন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রক্ত ঝরেছিল, সে স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য ইংরেজরা সেখানে কারাগার নির্মাণ করে, যা এখনো বিদ্যমান। ইংরেজদের হাতে বন্দী বিপ্লবী মুসলমান সিপাহীদের ষাট জনকে সদরঘাটের অদূরে ‘আন্টাঘর ময়াদনে’ গাছের শাখায় ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁদের লাশ মাসের পর মাস সেভাবেই রেখে দেওয়া হয়েছিল বিপ্লবকামী জনগণকে আতঙ্কিত করার জন্য। সেই আন্টাঘর ময়দানই এখন ‘বাহাদুর শাহ পার্ক নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি স্মৃতির মিনাররূপে তা আজো আমাদের পূর্বপুরুষদের মহান আত্মদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
১৮৭৫ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় ইংরেজরা ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা দুদু মিয়াকে প্রেফতার করে এ জন্য যে, তাঁর আহ্বানে যে কোন মুহূর্তে পঞ্চাশ হাজার লোক সাড়া দিতে এবং তিনি তাদেরকে যা আদেশ দেবেন, তারা তাই করতে প্রস্তুত ছিল।
১৮৫৭ সালের আযাদী সংগ্রামকে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে বিকৃত করার চেষ্টা করা হলেও এই বিদ্রোহের পেছনে আযাদী পাগল বেসামরিক মুসলিম বিপ্লবীদের ভূমিকাই মুখ্য ছিল। একথা কোন কোন ইংরেজ লেখকও স্বীকার করেছেন। স্যার জেমস আউটরামের মতেও বিপ্লবী মুসরমানগণই ছিলেন এই বিদ্রোহের মূল শক্তি। বিদ্রোহ দমনের কাজে নিয়োজিত দু’জন ইংরেজ সৈন্য ১৮৫৭ সালে বেনামীতে লেখা বিদ্রোহের ইতিহাস বইয়ে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলীকে এই ঘটনার সাথে যুক্ত করেছেন। তাঁরা লিখেছেনঃ
“রাজ্যচ্যুত নবাব ওয়াজেদ আলী ১৮৫৬ সালের এপ্রিলে কলকাতায় নির্বাসিত হন এবং তিনি ব্রিটিশ শাসন উৎখানের উপায় তালাশ করতে থাকেন। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং সৈন্যদের সমর্থন আদায়ের জন্যী তিনি চেষ্টা চালাতে থাকেন। অযোধ্যার নবাবের সভাসদ ও অনুচরগণ সন্দেহাতীতভাবে এই বিদ্রোহে যুক্ত ছিলেন”।
১৮৫৭ সালের আযাদী সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার পর ইংরেজরা জনগণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর নির্যাতন শুরু করে। বিদ্রোহের শাস্তিস্বরূপ কতজনের যে ফাঁসি হলো, কত লোকের হলো কারাবাস, সে হিসাব পাওয়া এখন আর সম্ভব নয়। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরবাসে দণ্ডিতদের সংখ্যাই ছিল দশ হাজারের বেশি।
জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়ক আন্দামান-বন্দী মওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী লিখেছেনঃ
“স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তবেই কোন হিন্দুকে আটক করা হতো, কিন্তু পালাতে পারেনি এমন একজন মুসলমনাও সে দিন বাঁচেনি”।
আপসহীন বিপ্লবী ধারার অবসান
সিপাহী বিপ্লবের পর ১৮৫৮ সালে জিহাদ আন্দোলনের নেতা মওলানা ইনায়েত আলী এবং ১৮৬২ সালে ফরায়েজী আন্দোলনের নায়ক দুদু মিয়া ইন্তেকাল করেন। বিপ্লবোত্তর ব্যাপক মুসলিম নির্যাতনের পটভূমিতে এবং আন্দোলনের দুই প্রধান কান্ডারীর ইনতেকালের পর এই দু’টি আন্দোলনের ধারা কিছুটা দুর্বলভাবে হলেও আরো বহু দিন অব্যাহত থাকে। ১৮৬৬ সালে জিহাদী বিপ্লবীগণের উদ্যোগে তাঁদের আন্দোলনের প্রধান ঘাঁটিরূপে দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদরাসাকে কেন্দ্র করেই জিহাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চলতে থাকে। অন্যদিকে দুদু মিয়ার পুত্র গাজীউদ্দীন হায়দার ১৮৬২ সাল পর্যন্ত এবং আবদুল গফুর ওরফে নয়া মিয়া ১৮৬৪ সাল থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন। এ সময়ও ফরায়েজী আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান ছিল।
১৮৬৪ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত পরিচালিত তথাকথিত ‘ওয়াহাবী মামলাগুলো থেকে জানা যায় যে, সে সময় পর্যন্ত বাংলায় জিহাদ ও ফরায়েজী আন্দোলনের ধারা চালু ছিল। এ সময়ও বিভিন্ন গ্রামে ফরায়েজীদের একজন করে প্রতিনিধি নিযুক্ত ছিলেন এবং বিচার-ফয়সালা থেকে শুরু করে জনগণের শাসনকার্যের বিরাট অংশ তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯০১ সালের জনসংখ্যা জরিপে দেখানো হয়েছে যে, বগুড়ায় ফরায়েজীরা তখনো সক্রিয়। সরকারবিরোধী জিহাদের জন্য তাঁরা চাঁদা তুলতেন এবং প্রতিটি ফরায়েজী পরিবারে জিহাদের জন্য মুষ্টি-চাল রাখা হতো।
নয়া মিয়ার পুত্র খান বাহাদুর সাঈদউদ্দীন আহমদ ১৮৮৩ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত এবং এর পর তাঁর পুত্র আবু খালিদ রাশিদউদ্দিন ওরফে বাদশাহ মিয়া (মৃ. ১৯৫১) ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সাঈদউদ্দীন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ভূমিকা পালন করেন। বাদশাহ মিয়া খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যোগ দেন।