১০.
মুসলিম রাজনীতিতে নবচেতনা
বঙ্গভঙ্গ রদ বাংলার মুসলমানদের নব অংকুরিত আশা-আকাঙ্ক্ষা স্লান করে দেওয়ার প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তরুল মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে। তারা ব্রিটিশ-রাজের বিরুদ্ধে ‘সক্রিয় কর্মপন্হা’ অবলম্বনের পক্ষে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বঙ্গভঙ্গের ঘটনা ‘আলোকপ্রাপ্ত’ মুসলিম নেতৃবৃন্দের রাজানুগত্যে ফাটল সৃষ্টি করে। মুসলিম ভারতের প্রবীণ নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের ওয়াদাভঙ্গের কারণে সৃষ্ট মনোবেদনা নিয়েও ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আহ্বান জানান। সদ্য বিকাশমান দীর্ঘ অবহেলিত মুসলমানদের তৎকালীন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পশ্চাৎপদতার কথা বিবেচনা করে তাঁরা একদিকে পূর্ণ বিকশিত বর্ণহিন্দু, অন্যদিকে ব্রিটিশ রাজশক্তি- এ দুই প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া অসময়েঅচিত বিবেচনা করেন। তাছাড়া বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা স্বয়ং সম্রাট পঞ্চম জর্জের মুখ থেকে আসায় তার বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জে যাওয়া শাসনতান্ত্রিক বিধিবদ্ধতার কারণে তাঁরা ঠিক মনে করেননি। তাই অনন্যোপায় কর্মপন্হা হিসেবে ব্রিটিশ আনুগত্য বজায় রেখেই জাতির দাবি-দাওয়া আদায়ের বলিষ্ঠ পথ বেছে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত তরুণ একদল মুসলিম রাজনীতিক এ সময় ব্রিটিশানুগত্যের উর্ধ্বে উঠে বঙ্গভঙ্গ রদের বিরুদ্ধে সক্রিয় কর্মপন্হা গ্রহণের লক্ষ্যে মুসলিম বাংলার জন্য স্বতন্ত্র একটি রাজণৈতিক দল গঠনের মনোভাব ব্যক্ত করতে শুরু করেন।
প্যান-ইসলামবাদী নেতা আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গভঙ্গ রদ সম্পর্কে তাঁর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেনঃ
“I f we are silent and less vocal, our silence is silence of anger and sorrow and not that of acquiecense, In proportion to our devotion to the person on Throne of His Majesty is the intensity of our resntment at the cowardly device of putting the announcement in the mouth of the King Emperor and muzzling us effectively.” (Matiur Rahman: Fron Consultation to Confrontation. P. 219)
বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রবীণ ও তরুণ মুসলিম নেতৃত্বের মধ্যে যে দু’টি ধারা সৃষ্টি হয়, নওয়াব সলীমুল্লাহ এই দুই শিবিরের মনোভাবের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন। (ডক্টর মুহাম্মদ আবদুল্লাহ: নওয়াব সলীমুল্লাহ) ১৯১২ সালের ৩ ও ৪ মার্চ কলকাতায় মুসলিম লীগের অধিবেশনে নওয়াব সলীমুল্লাহর ভাষণ বঙ্গভঙ্গজনিত কারণে সৃষ্ট তাঁর গভীর মর্মবেদনার স্মৃতিচিহ্ন। এরপরই তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর পরিস্থিতির নিরিখে বলা হয়েছিল ‘আত্মনির্ভরতা’ বা Self Reliance- এর কথা। আর এখন বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্যান-ইসলামী ভাবধারায় উদ্বদ্ধ মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে ‘স্বাধিকার আদায়ে’র বাসনা জোরদার হয়ে ওঠে। ১৯১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাঁকিপুরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল তার সদ্য প্রণীত গঠনতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসনের (Self Government) দাবি অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯১৩ সালের ২২ মার্চ মুসলিম লীগের লাখনৌ অধিবেশনে তা অনুমোদিত হয়। এভাবে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়ার পথ ধরেই মুসলিম বঙ্গ ও মুসলিম ভারতের রাজনীতি স্যার সৈয়দ আহমদ, নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী ও নওয়াব সলীমুল্লাহর রাজনীতির ধারা অতিক্রম করে সক্রিয় রাজনীতিতে পদার্পন করে।
রাজনীতি থেকে নওয়াব সলীমুল্লাহর অবসর গ্রহণের পটভূমিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও সক্রিয়পন্হিগণ মুসলিম বঙ্গে নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের হাল ধরলেন। এই তরুল দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন সলীমুল্লাহর মানস-পুত্র আবুল কাসেম ফজলুল হক। সলীমুল্লাহর জীবদ্দশাতেই আবুল কাসেম ফজলুলু হক তাঁর যুগপ্রবর্তনের ধারা চিহ্নিত করে ১৯১৩ সালের ৪ এপ্রিল কলকাতার ব্যবস্থাপক সভায় বাজেট বক্তৃতায় প্রবীণ নেতাদের ‘আবেদন-নিবেদনের করজোড়-নীতি’ ভঙ্গ করে বলিষ্ঠ ভাষায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। মুসলমানদের দাবি-দাওয়া পূরণে বারবার ব্যর্থ হলে ইংরেজ রাজশক্তিকে এজন্য খেসারত দিতে হবে বলে তিনি সাবধান করে দেন। তাঁর এই উক্তি বাংলার রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে নতুন যুগের এই নেতার হাতেই বাংলার মুসলিম রাজনীতি এক নতুন রূপ লাভ কর। (J. H. Broomfield : Elite conflict. P-64)
মুসলিম লীগের জন্মঃ নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা
বঙ্গভঙ্গের ব্যাপক ঘটনা-প্রবাহে কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহ্দিু সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানদের যে দ্বন্দ্ব, তার পটভূমি যেমন বিস্তীর্ণ, তাৎপর্যও তেমনি গভীর। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বর্ণহিন্দুদের সাথে যে মানসিক বিচ্ছেদ তা কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না।
ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়ঃ
“যদিও তারা একই দেশের মানুষ ছিল, তবুও এক ভাষা ছাড়া অন্য সব ব্যাপারে তারা বিভিন্ন ছিল। ধর্মে, শিক্ষায়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে আটশ’ বছর ধরে তারা বাস করেছে যেন দু’টি ভিন্ন পৃথিবীতে”। (নিরোদচন্দ্র চৌধুরীঃ অটোবায়োগ্রাফী অব এন আননোন ইন্ডিয়ান, পৃষ্ঠা ৫০৪)
মুসলিম শাসনের শুরু থেকে কয়েক শতাব্দী বাংলাদেশের মুসলমান ও হিন্দুগণ, অভিন্ন ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় নিজেদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবনাচরণ পদ্ধতি নিয়ে ধর্মীয় জীবনের স্বাতন্ত্র্য-চেতনা সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য অর্জনে আপাতদৃষ্টিতে বড় রকমের কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করেনি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালে হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় পার্থক্য তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বিস্তার লাভ করে। ব্রিটিশ শাসনকে হিন্দুরা নিছক শাসক-বদলের ঘটনারূপে গ্রহণ করে। ইংরেজদের আস্থা ও অনুগ্রহ লাভের জন্য তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। রাতারাতি তাদের একটি শ্রেণী বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়। অন্যদিকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীব্র। তারা এই শাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে ‘রানীর বিদ্রোহী প্রজা’ রূপে অভিহিত হয়। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মুসলমানরা দরিদ্র হয়ে পড়ে। হিন্দুরা ইংরেজদের সমর্থনে পুষ্ট হয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন পরিচালনা করে। মুসলমানদের সংগ্রামে হিন্দুদের কোন সহানুভূতি ছিল না।
উনিশ শতকের হিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দুদের মাঝে সাম্প্রয়াদিক স্বাতন্ত্র্যবোধ তীব্র হয়। মুসলমানদের শক্ররূপে চিহ্নিত করে তাদের ওপর তারা নানামুখী হামলা পরিচালনা করে। কুড়ি শতকের শুরুতে প্রশাসনিক কারণে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার ফলে বাংলাদেশের মুসলমানদের অবস্থার উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তার বিরুদ্ধে হিন্দুদের মারমুখী সংগ্রাম হিন্দু-মুসলিত জাতি-স্বাতন্ত্র্যের দিকটিকে আরো প্রকটভাবে উপস্থিত করে।
বস্তুত ব্রিটিশ শাসনামলের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ মুসলিম চিন্তা-চেতনায় যে সকল ঘাত-সংঘাত সৃষ্টি করে সে পটভূমিতেই উনিশ শতকের শেষের দিকে মুসলিম রাজনীতি নিজস্ব স্বতন্ত্রধারা রচনায় অগ্রসর হয়। ভারতীয় শাসনতন্ত্রে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য একটি রক্ষাকবচের ব্যবস্থা অর্জন করা ছিল মুসলিম নেতৃবৃন্দের একটি আশু বিবেচ্য বিষয়। সৈয়দ আমীর আলী সর্বপ্রথম তাঁর বক্তৃতা ও লেখায় মুসলমানদেরকে একটি ‘স্বতন্ত্র জাতি’ (Nationality, Nation) নামে অভিহিত করে তাদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের দাবি করেন। এর আগে সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদেরকে ‘কওম’ নামে অভিহিত করলেও আমীর আলীর দাবি ছিল অধিকতর রাজনৈতিক তাৎপর্যমণ্ডিত। ১৮৮৩ সালে আমীল আলী ‘মিউনিসিপ্যালিটি বিলে’ সংখ্যালঘুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন। এ সময় থেকেই মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন কায়েমের প্রয়োজনও অনুভূত হচ্ছিল। ১৯০১ সালের অক্টোবরে নওয়াব ওয়াকার উল মূলক লাখনৌতে মুসলমানদের এক ঘরোয়া বৈঠকে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ১৯০৩ সালে সাহারানপুরে একটি মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। ১৯০৬ সালের ফ্রেরুয়ারি মাসে পাঞ্জাবে ফযল-ই-হুসাইন ‘মুসলীম লীগ’ নামে একটি সংগঠন কায়েম করেন।
এ সময় ভারত সচিব লর্ড মর্লি পার্লামেন্টে আভাস দেন যে, ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয় বিবেচনা করছেন। এই নতুন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার দাবি নিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক প্রতিনিধি দল আগা খানের নেতৃত্বে ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর সিমলায় বড় লাট মিন্টোর সাথে সাক্ষাত করেন। নওয়াব সলীমুল্লাহর অসুস্থতার কারণে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সিমলা ডেপুটেশনে যোগ দেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও আবুল কাসেম ফজুলল হক। তাঁরা নওয়াব সলীমুল্লাহর সর্বভারতীয় মুসলিম কনফেডারেসী গঠনের খসড়া পরিকল্পনা সাথে নিয়ে যান। একই বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সৈয়দ আমীর আলী তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধে ভারতীয় মুসলমানদেরকে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা থেকে বেরিয়ে এসে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠনের উদাত্ত আহবান জানান।
মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের সলীমুল্লাহর পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিনিধিদলের সদস্যগণ সিমলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। তাঁরা ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য শিক্ষা সম্মেলনে কনফেডারেসী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এরপর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দু জমিদার, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রবল আন্দোলনের পটভূমিতে ঢাকায় ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন শেষে সর্বভারতীয় মুসলিম প্রতিনিধিদের এক বিশেষ সভায় নওয়াব সলীমুল্লাহর প্রস্তাবক্রমে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর রবিবার ঢাকার শাহবাগে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের আটশ’ প্রতিনিধির এই ঐতিহাসিক অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করা হয় এবং বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এভাবেই ভারতীয় মুসলমানগণ একটি নতুন রাজনৈতিক যুগে প্রবেশ করেন। এ রাজনৈতির ভিত্তি হলো জাতিস্বাতন্ত্রভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদ।
মুসলমানদের অবিচল ও অব্যাহত দাবির মুখে ১৯০৯ সালের ভারতীয় শাসন-সংস্কার পরিকল্পনায় স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়। স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে ভারতীয় মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতীয়তা স্বীকৃতি লাভ করে। এর ফলে তাদের রাজনৈতিক উন্নতির পথও সুগম হয়।
ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে ১৯১১ সালের ১১ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করার পর কংগ্রেসপ্রেমিক মুসলমানদের অনেকেই স্বপ্নভঙ্গ হয়। সৈয়দ আমীর আলীর আহ্বানে এ সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দেন। জিন্নাহর চেষ্ঠায় ১৯১৩ সালে ‘ওয়াকফ বিল’ পাস হয় এবং ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলমানদের শিক্ষার কাজে নিয়োগের বিধান করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাঃ বিজাতীয় প্রতিক্রিয়া
বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ববাংলার মুসলিম জন-মানস দারুণভাবে আহত ও ক্ষুব্ধ হয়। প্রতিবাদমুখর মুসলিম নেতৃবৃন্দকে শান্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারি তিন দিনের জন্য ঢাকায় আসেন। ৩১ জানুয়ারি নওয়াব সলীমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের এক মুসলিম প্রতিনিধিদল বড়লাটের সাথে দেখা করে একটি মানপত্র প্রদান করেন। মানপত্রে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যায়ল প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করা হয়। এটি ছিল নওয়াব সলীমুল্লাহর একটি পুরনো দাবি। বড় লাট ঢাকার মুসলমান নেতৃবৃন্দের এই দাবি মেনে নিয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন এবং এটিকে পূর্ববাংলার জনগণের জন্য তাঁর পক্ষ থেকে ঘোষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কায়েমের প্রস্তাব প্রকাশ করার সাথে সাথে কলকাতা ও ঢাকার হিন্দু নেতৃবৃন্দ এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা শুরু করেন। তারা বলেনঃ
“এর ফলে বাঙালি জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যে বিরোধের তীব্রতা বেড়ে যাবে। পূর্ববাংলার মুসলমানরা অধিকাংশই কৃষক, তাই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র থেকে আদৌ কোন উপকার লাভ কতে পারবে না”।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে হিন্দু নেতৃবৃন্দ ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায়, ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ফরিদপুরে এবং ১১ ফেব্রুয়ারি মোমেনশাহীতে সভা করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি বর্ধমানের রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল ভাইসরয়ের সাথে দেখা করে বলেনঃ
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে অভ্যন্তরীণভাবে বঙ্গবিভাগের সমতুল্য; তাছাড়া পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা প্রধানত কৃষক, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তারা কোন মতেই উপকৃত হবে না”।
৫ ও ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উকিল লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত দু’টি প্রতিবাদ সভায় সভাপতি ছিলেন বাবু ত্রৈলোক্যনাথ বসু। সভা দু’টিতে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়ঃ
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে শিক্সার অবনতী হবে। তাই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন দরকার নেই”।
২৬ মার্চ কলকাতা টাউন হলে ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়ঃ
“কোন স্কুল-কলেজের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অধিকার থাকতে পারবে না এবং পূর্ববঙ্গের কোন বিশেষ শিক্ষা কর্মসূচিও থাকতে পারবে না”।
সিলেটের বিপিনচন্দ্র পাল বলেনঃ
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অশিক্ষিত ও কৃষকবহুল পূর্ববঙ্গের শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের শিক্ষানীতি ও মেধার মধ্যে কোন সামঞ্জস্যই থাকবে না”।
পূর্ববাংলার মুসলমানদের যে-কোনও ধরনের কল্যাণ ও উন্নয়নের ব্যাপারে বর্ণহিন্দুদের এরূপ অসহিষ্ণু বিজাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিপত্য ও গুরুত্ব হ্রাস পাবে এবং সেই সাথে এর দ্বারা দীর্ঘ দিনের অবহেলিত মুসলমানদের কল্যাণ হবে, এটাই ছিল বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দের আশঙ্কার কারণ। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে পূর্ববাংলার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেরই কল্যাণ নিহিত ছিল। কিন্তু হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে এই নেতৃবৃন্দ এক সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ধারক ছিলেন। তাঁরা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তে হৃদয়ের এতটুকু প্রসারতা দেখাতে পারলেন না। ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার সম্পদ লুণ্টন করেই গড়ে উঠেছে এবং বেড়ে উঠেছে কলকাতার সব কিছু। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে কোন ‘অসাম্প্রদায়িক মানবহিতৈষী’ ব্যক্তিকেই সেদিন এই হিন্দু মানসিকতার বিরুদ্ধে কোন আওয়াজ তুলতে দেখা যায়নি।
১৯১২ সালে ঘোষণা দেওার পর দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কোন বাস্তব উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯১৭ সালের ৭ মার্চ সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিষয়টি ইম্পোরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে উত্থাপন করন। এরপর ২০ মার্চ তিনি সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিল পাস করার প্রস্তাব পেশ করেন। কাউন্সিল জানায় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার খসড়া বিল তৈরি হয়েছে এবং যুদ্ধের পর যথাসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। ১৯১৭ সালে এ ব্যাপারে ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ গঠন করা হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত ন্যাথনে কমিটির রিপোর্ট উক্ত কমিশনে অনুমোদন লাভের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট পাস হয়। ভাইসরয় কাউন্সিলের হিন্দু সদস্যগণ এই কমিশনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করেন। এত কিছুর মধ্য দিয়ে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো তার কোন এফিলিয়েটিং ক্ষমতা বা কর্তৃত্বই থাকলো না। কলকাতার বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে নিছক একটি ‘আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে’র মর্যাদা দেওয়া হলো। নওয়াব সলীমুল্লাহর দান করা কয়েকশ’ বিঘা জমির ওপর ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জুলাই মাসে এখানে ক্লাস চালূ হয়। ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের নিজস্ব আবাসভূমিরূপে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসহ পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেনঃ
“I was very closely and actively associated with all the plans and schemes and I know the difficulties which we Muslins has to face and the obstinate opposition we had to overcome at the time in pushing the scheme fov the establishment of Dhaka University.”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বৈঠকেই আবুল কাসেম ফজলুল হক নওয়াব সলীমুল্লাহর প্রতি পূর্ববাংলার জনগণের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞপন করে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে পূর্ববাংলায় উচ্ছশিক্ষার দ্রুত বিস্তার ঘটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে পূর্ববাংলায় উচ্চশিক্ষার দ্রুত বিস্তার ঘটে। একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান এই বিশ্ববিদ্যালয়ই ত্বরান্বিত করে। হিন্দু নেতৃবৃন্দ এটিকে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘ফাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে কটাক্ষ করেন। তাদের সকল পরিহাস উপক্ষো করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই বাংলাদেশের প্রতিভাবান রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, আইনবিদ তৈরির কারখানারূপে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার মুসলমানদের জাতিসত্তার বিকাশে তাৎপর্যপূর্ণ, গভীর ব্যাপক অবদান রাখে।