১২.
লাহোর প্রস্তাবঃ জাতীয় ইতিহাসের নতুন মাইলফলক
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে মুসলিম স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা অমূলক বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশগুলোতে মুসলমানদের প্রতি অবিচার মুসলিম নেতৃত্বকে বিচলিত করে তোলে। এসব প্রদেশের কংগ্রেস সরকার ওয়ার্ধা শিক্ষা-পরিকল্পনা, বিদ্যামন্দির শিক্ষাব্যবস্থা, বন্দে মাতরম সংগীত, শ্রীপদ্ম প্রতীক এবং হিন্দুয়ানী পাঠ্যপুস্তক চালু করেন। ফলে হিন্দুপ্রতিভাবিত রাজ্যে নিজেদের আদর্শ সম্পর্কে মুসলমানদের স্বপ্রভঙ্গ হয়। মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আওয়াজ ক্রমেই জোরদার হয়ে ওঠে। এ পটভূমিতেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ গ্রহীত হয়। ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে অভিহিত লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই ঐতিহাসিক প্রস্তাব উত্থাপনকালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্র আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেনঃ
“১৯০৬ সালে বাংলাদেশেই প্রথম মুসলিম লীগের নিশান উত্তোলিত হয়েছিল। এখন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকেই মুসলমানদের জন্য আমি আবাসভূমি স্থাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করার অধিকার পেয়েছি”।
লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের পর পাক-ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে মুসলমানদের চিন্তাধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। তাঁরা অখণ্ড ভারতের চিন্তা থেকে দ্রুত সরে আসেন। কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাগণ এবং ব্রিটিশ সরকার ভারত বিভাগের বিরোধিতা করেন। ফলে মুসলিম লীগ নেতৃত্বকে এ দাবি আদায়ে প্রবল বাধার মোকাবিলা করতে হয়।
মুসলিম লীগের শক্তির উৎস বাংলাদেশ
ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্বের দাবি যাচাইয়ের জন্য ১৯৪৫ সালে নভেম্বরে কেন্দ্রীয় আইন সভা এবং ১৯৪৬ সালের মার্চে প্রদেশিক আইন সভার নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় প্রতিষ্ঠানরূপে নিজেদের দাবি প্রমাণ করার লক্ষ্যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবির ভিত্তিতে এই নির্বাচনে অংশ নেয়। মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা, শক্তি ও সংহতি এবং স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ভিত্তিতে পৃথক আবাসভূমির দাবির প্রতি মুসলমানদের সমর্থন এই নির্বাচনে সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত হয়। সর্বভারতীয় মানচিত্রে সর্বাধিক মুসলিম জন-অধ্যুষিত বাংলাদেশের মুসলমানগণ এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করেন যে, এ প্রদেশই ‘মুসলিম লীগের শক্তির প্রধান উৎস’ এবং ‘ভারতীয় মুসলমানদের শক্তির দুর্ভেদ্য দুর্গ’। কেন্দ্রীয় আইন সভার সবক’টি আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থীগণ বিজয়ী হন। প্রাদেশিক আইন সভায়ও ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৩ টিতে মুসলিম লীগ প্রার্থগণ জয়ী হন।
নির্বাচনের গণরায়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যেই পাকিস্তান অর্জনের জন্য সর্বাধিক সংহতি ও সংকল্পের এবং অবিচল দৃঢ়তার প্রকাশ ঘটে। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসবা গঠিত হয়। তখনকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে এটিই ছিল মুসলিম লীগের একমাত্র মন্ত্রিসভা। বাংলাদেশে মুসলিম লীগের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও তাদের অতুলনীয় সাফল্যের মূলে কাজ করেছে এদেশের জনগণের সামাজিক, সাংস্কৃতিকও ধর্মীয় পটভূমি এবং ইংরেজ ও তাদের প্রসাদভোগী হিন্দু মধ্যশ্রেণীর শোষণের মধ্য দিয়ে অর্জিত এদেশের কৃষক-প্রজাদের দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতা। এদেশেই ইংরেজ শাসন সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে এবং শোষকশ্রেণীর সাক্ষাত প্রতিভূ হিসেবে ইংরেজদের চাইতেও তাদের দালাল হিন্দু জমিদারদের সাথেই পুরুষানুক্রমে মুসলমানদের মোকাবিলা হয়েছে। জমিদার ও সুদখোর মহাজনরা প্রায় সবাই ছিল হ্দিু। আর মজলুম কৃষক-প্রজার অধিকাংশই মুসলমান। এই কৃষক-প্রজারা তাদের গর্দানকে জমিদার-মহাজনদের জুলমের জিঞ্জীর থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। সেই সাথে জিহাদ ও ফরায়েজী আন্দোলনের ঐতিহ্যে লালিত এই কৃষক-প্রজরা স্বপ্ন দেখেছিল দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত ইসলামী হুকমত।
১৯৩৭ সালে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের সমন্বয়ে প্রজা-লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলার মুসলমানগণ দু’শ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো শাসন ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার গৌরবময় উপলব্ধি অর্জন করেন। এই শাসনামলে ১৯৩৮ সালে ‘বঙ্গীয় কৃষি খাতক আইন’ পাস হয়। ফলে বাংলাদেশে ষাট হাজার ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’ গঠিত হয়। এই বোর্ড মহাজনদের ঋণের দাবি ৯০০ কোটি টাকা থেকে ৬০ কোটিতে নামিয়ে আনে। মহাজনের কবল থেকে কৃষকদের রক্ষার ভবিষ্যত গ্যারান্টিরূপে কুসীদজীবী আইন পাস করে সুদী কারবারের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ১৯৩৮ সালে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব সংশোধন আইন’ পাস করে প্রজাদের ওপর জমিদারী স্বেচ্ছাচার বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে কৃষকদের বুকের ওপর থেকে প্রায় দু’শ বছর চেপে থাকা জগদ্দল পাথরগুলো একের পর এক অপসারিত হতে থাকে। মুসলমানদের শিক্ষার উন্নতি এবং সরকারি চাকরিতে তাদের নিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই আমলে অনেকগুলো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। স্ব-শাসনের এই সুফলগুলো বাংলাদেশের মুসলমানদের স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংকল্পের পক্ষে ইতিবাচকরূপে কাজ করে।
প্রজা-লীগ মন্ত্রিসভা গঠনের পরপরই এ কে ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগ দেন। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ও সোহরাওয়ার্দী কর্ম-সচিব নিযুক্ত হন। ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা ও সোহরাওয়াদীর্র সাংগঠনিক দক্ষতা এবং আলেম সমাজের ব্যাপক সামাজিক যোগাযোগ ও প্রচার অভিযান মুসলিম লীগের প্রতি জনসমর্থনের ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি করে। গণজোয়ারের এই উত্তাল তরঙ্গের মুখে হিন্দু ও ইংরেজদের মিলিত প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমিরূপে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বিশ্ব-মানচিত্রে অস্তিত্ব লাভ করে। গৌরবময় অতীতের আলোকে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত রচনার লক্ষ্যে নিজস্ব জাতিসত্তার বুনিয়াদের ওপর স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমি অর্জনের সুতীব্র প্রেরণাই জনগণকে ব্যাপকভাবে পাকিস্তান ইস্যুতে মুসলিম লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।
লাহোর প্রস্তাব থেকে দিল্লী প্রস্তাব
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল না। লাহোর প্রস্তাবের দু’টি দিক ছিল। এক, উপমহাদেশকে হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চলের ভিত্তিতে বিভক্ত করা, দুই. উপমহাদেশের দক্ষিণ ও পর্বাঞ্চলের মুসলিম এলাকাসমূহের সমন্বয়ে একাধিক পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। এই প্রস্তাবের খবর পরিবেশন করতে গিয়ে হিন্দু সংবাদপত্রগুলোই এটাকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে উল্লেখ করে। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ এই নামকরণ মেনে নেয়।
১৯৪৬ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লেজিসলেটর্স কনভেনশনে লাহোর প্রস্তাব আংশিক সংশোধন করে উপমহাদেশের দুই প্রান্তের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে একটিমাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সে সময় উপমহাদেশের মুসলমানদের দাবি-দাওয়ার বিরুদ্ধে হিন্দু-ব্রিটিশ অশুভ আঁতাতের মোকাবিলায় বৃহত্তর মুসলিম সংহতির প্রয়োজনে এই সংশোধনীর প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন এই প্রস্তাবের উত্থাপক।
বঙ্গভঙ্গের দাবি তুলল হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস
মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে অবিচ দৃঢ়তার সাথে আন্দোলন পারিচালনা করে। এ পটভূমিতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতাগণ বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত করার প্রস্তাব করেন। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও হিন্দু মহাসভার অন্যান্য নেতা ছিলেন বাংলাকে ভাগ করার দাবির প্রথম উত্থাপক। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি থেকে এ ব্যাপারে কংগ্রেস মহলও সক্রিয় হয়ে ওঠে। যে যুক্তিতে তারা অখণ্ড ভারতের দাবিতে সোচ্চার ছিল, বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত করার দাবি ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সাম্প্রদায়িকতা বা দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতার নামেই তারা ভারত-বিভক্ত রোধ করতে চেয়েছিল। আর সেই সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধিই তাদেরকে বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্তির মত সংকীর্ণ দাবির পথে টেনে নিয়ে গেল।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেসের বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব বিভক্তির দাবিকে চক্রান্তমূলক বলে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, মুসলমানগণ পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু প্রদেশ, বালুচিস্তান, বাংলাদেশ ও আসাম নিয়ে তাদের আবাসভূমি ও জাতীয় রাষ্ট্র স্থাপনের দাবি করেছে। পাঞ্জাব ও বাংলাদেশকে বিভক্ত করা হলে এ নীতিতে অন্যান্য প্রদেশকেও ভাগ করতে হবে। এ ধরনের বিভাজন প্রদেশগুলোর প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের মূলে আঘাতের শামিল হবে।
বাংলাদেশ বিভাগের জন্য হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে এই ব্যাপারে মতানৈক্য দেখা দেয়। পশ্চিম বাংলার কংগ্রেস নেতারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ থেকে আলাদা হয়ে পৃথক প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব করেন। অন্যদিকে পূর্ববাংলার কংগ্রেস নেতারা এ দাবি অযৌক্তিক বিবেচনা করেন। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের প্রতিক্রিয়াও এভাবে বিভক্ত ছিল। তফসিলী সম্প্রদায়ের হিন্দুরা অখণ্ড বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ়ভাবে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১৯০৫ সালে যে হিন্দু নেতাগণ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সারা বাংলার বিক্ষোভ ও সন্ত্রাসের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, ১৯৪৭ সালে এসে তাঁরাই হলেন বাংলা বিভাগের অনমনীয় প্রবক্তা। অন্যদিকে ১৯০৫ সালে যে মুসলমান নেতাগণ বঙ্গভঙ্গের কারণে খুশি হয়েছিলেন, তাঁরা ১৯৪৭ সালে ছিলেন বাংলাদেশ বিভাগের বিরুদ্ধে। এর পেছনে যে মনস্তত্ব কাজ করেছিল, সেটিই এদেশের ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
মুসলিম লীগঃ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার পরিকল্পনা
উপমহাদেশের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের পটভূমিতে তখনকার বাংলাদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের অখণ্ডতা বজায় রেখে পাকিস্তানের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকাকেই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু হিন্দু নেতারা বাংলাদেশকে বিভক্ত করার আন্দোলন শুরু করলে মুসলিম নেতৃবৃন্দের অনেকেই অখণ্ড বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রস্তাব করেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দিল্লী প্রস্তাবের উপস্থাপক বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কর্ম-সচিব আবুল হাশিম প্রস্তাব করেন যে, পাকিস্তান কিংবা হিন্দুস্তান কোন রাষ্ট্রেই বাংলাদেশ যোগ দেবে না। এটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিম নেতাই সে সময়ে এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন। রাষ্ট্রীয় আইন সভার স্পীকার নূরুল আমীন ১৯৫৭ সালের ১৬ মার্চ দিনাজপুরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সম্মেলনে বলেনঃ
“আমরা স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। এই স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম পূর্ব-পাকিস্তান হোক অথবা বঙ্গ-আসাম তাতে কিছু আসে যায় না। মুসলমানরা এই স্বাধীন রাষ্ট্র শাসন করবে। আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অথবা কেন্দ্রীয় সরকাররূপী কোন প্রকার সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপস করব না; আমরা আমাদের জন্মগত অধিকারের ওপর কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেব না”। (ডন, ২৭ মার্চ, ১৯৪৭ ইন্ডিয়ান রেজিস্টারঃ ১ম খণ্ড, ১৯৪৭)
বাংলাদেশের মর্যাদা সম্পর্কে খাজা নাযিমউদ্দীন ১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল বলেনঃ
“আমর সুচিন্তিত অভিমত এই যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ তার হিন্দু-মুসলমান সকল অধিবাসীর সমস্বার্থের অনুকূল হবে এবং আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, বাংলাদেশ বিভক্ত হলে বাঙালিদের মারাত্মক ক্ষতি হবে”। (পূর্বোক্ত)
এর আগে ১৯৪৭ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ত্রিপুরা জেলার কিষাণপুরে এক জনসভায় বলেন, “মুসলমানরা অবশ্যই বাংলাদেশ পাবে এবং বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভক্ত হবে”। তিনি বাংলাদেশ বাগ করার দাবির নিন্দা করে বলেন, “বাংলাদেশ বাঙালিদের এবং এটি অবিভাজ্য”। কিন্তু হিন্দু নেতাদের আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশ বিভাগ অনিবার্য হয়ে হড়ার পর তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার পরিকল্পনা করেন। ৮ এপ্রিল এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমি সব সময় অখণ্ড বাংলা ও বৃহৎ বাংলার পক্ষপাতি”। তিনি আশা করেন যে, বঙ্গভঙ্গের নতুন উদ্যোক্তরা নিজেদের নাক কাটার আগেই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন এবং আন্তরিকভাবে মীমাংসায় আসার চেষ্টা করবেন। ২৭ এপ্রিল দিল্লীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দী বলেনঃ
“হিন্দুগণ সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলা নীতিগতভাবে মেনে নিলে আমি তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বহু দূর পর্যন্ত যেতে রাজি আছি”।
ড. শ্যামাপ্রসাদসহ কয়েকজন হিন্দু নেতা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কথা প্রকাশ করেন। তার জবাবে সোহরাওয়ার্দী ৭ মে এক বিবৃতিতে মুসলমান ও হিন্দু নেতাদের যুক্ত বৈঠক আহ্বানের প্রস্তাব করেন।
তিনি এই চমৎকার সুযোগ নষ্ট না করার আবেদন জানিয়ে বলেনঃ
“বাংলাদেশ (অখণ্ডরূপে) স্বাধীন না হলে বাংলার হিন্দুদের বিশেষ মর্যাদা থাকবে না। (ভারতে) তাদের ভাষা ও কৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অন্যান্য প্রদেশ বাংলাদেশকে শোষণ করবে”। (ডন, ৯ মে, ১৯৪৭)
সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও বগুড়ার মুহাম্মদ আলী ১২ মে সোদপুর আশ্রমে গান্ধীর সাথে দেখা করে স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলাদেশ পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করেন। ১৪ ও ১৫ মে সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহের সাথে দিল্লীতে আলোচনা করেন। তিনি ১৬ মে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ইঙ্গিত দেন যে, অবিভক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনার প্রতি মুসলিম লীগ হাই কমান্ডের সমর্থন রয়েছে।
এ সময় মওলানা আকরাম খাঁ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ও আবুল হাশিম কর্ম সচিব ছিলেন। বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নের ব্যাপারে কংগ্রেস নেতাদের সাথে আপস মীমাংসার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কার্যনির্বাহী কমিটিএকটি সাব কমিটি গঠন করে। এই কমিটি কংগ্রেস নেতাদের সাথে কয়েকটি যুক্ত বৈঠকে মিলিত হয়। এরপর সোহরাওয়র্দীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক যুক্ত সভায় দুই দলের এক যুক্ত কমিটি গঠন করা হয়। সোহরাওয়ার্দী, নাযিমউদ্দিন, আবুল হাশিম, ডাঃ এ এম আবদুল মালিক, ফজলুর রহমান ও অপর একজন মুসলিম লীগ নেতা এবং শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শঙ্কর রায় ও অপর চার জন কংগ্রেসের প্রতিনিধি এই যুক্ত কমিটির সদস্য ছিলেন। এই কমিটিকে বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমানদের গ্রহণযোগ্য একটি শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা রচনার ভার দেওয়া হয়। ২০ মে শরৎ বসুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় যুক্ত কমিটির সদস্যরা একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ২৩ মে শরৎ বসু গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে এ চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করেন।
‘কীটদষ্ট ও সঙ্কুচিত’ পাকিস্তান
কংগ্রেস অবিভক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অনমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। শরৎ বসুকে ৮ জুন লিখিত এক চিঠিতে গান্ধী জানিয়ে দেন যে, তিনি বাংলাদেশ পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে নেহেরু ও প্যাটেলের সাথে আলোচনা করেছেন এবং এর প্রতি তাঁদের সম্মতি নেই। গান্ধী শরৎ বসুকে তাঁর পরিকল্পনা ত্যাগ করে বাংলাদেশ বিভাগের বিরোধিতা হতে বিরত থাকার উপদেশ দেন। এভাবেই স্বাধীন অখণ্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্ঠা ব্যর্থ হয়। ভারত বিভাগের সাথে বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব বিভাগের ব্যবস্থা করা হয়। ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ এক অনন্যোপায় ব্যবস্থা হিসেবে তা মেনে নিতে বাধ্য হন। ১৯৪৭ সালের ৯ জুন দিল্লীতে ইম্পেরিয়েল হোটেলে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ পরিষদের সভায় বাংলাদেশ ও পাঞ্জাবের বিভক্তি স্বীকার করে নিয়ে পাকিস্তান-এর পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মওলানা আকরাম খাঁ, সোহরাওয়ার্দী, নাজিমউদ্দিন ও আবুল হাশিমসহ বাংলাদেশর ষাট জন প্রতিনিধি এই বৈঠকে যোগদান করেন।
মুসলিম লীগ পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনি করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ২০ জুন যে বিবৃতি দেন তার এক স্থানে তিনি বলেনঃ
“পশ্চিম বাংলার জনসাধারণকে আমি আশ্বাস দিচ্ছি যে, তাদের অধিকার ও স্বার্থ কোর রকমেই বিপন্ন হবে না। মুসলিম জগেত তাদের নিকট থেকে এত বেশী দূরে নয় যে, সেখানে তাদের আওয়াজ পৌঁছবে না এবং সেখান থেকে তাদের কাছে সাহায্য আসবে না”। (ডন, ১১ জুন, ১৯৪৭)
খণ্ডিত বাংলাদেশ ও খণ্ডিত পাঞ্জাব নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষায় ‘কীটদষ্ট ও সংকীর্ণ’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এই হলো পটভূমি।
ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলায় জাগরণের ধারা
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলার জাতীয় জীবন নতুন আশা ও প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। নব-নির্মাণের আনন্দ-উত্তেজনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন দেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষক-কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-গায়ক-শিল্প-ক্রীড়াবিদ তথা সমাজের সকল স্তরের মানুষ। বলা চলে একবারে শূণ্য থেকে শুরু হয় এ নবনির্মানের আয়োজন। দু’শ বছর কলকাতাকেন্দ্রিক ‘টাওয়ার বাংলা’র শোষণ ও লুণ্ঠনক্ষেত্ররূপে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলা একেবারেই নির্জীব হয়ে পড়েছিল। অফিস আদালত, পার্লামেন্ট বসানোর জন্য ভবন নেই। টেবিল-চেয়ার পর্যন্ত নেই। কিন্তু কোন কিছুই দমিয়ে দিতে পারল না সেই প্রেরণা। পিন-আলপিনের বদলে বাবলা কাটাঁয় কাগজ জুড়ে দিয়ে কাজ এগিয়ে চলল।
সাতচল্লিশের আগে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলায় একটি মাত্রত বিশ্ববিদ্যালয় ছিল- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতার প্রবল বিরোধিতা মোকাবিলা করে ১৯২১ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও এর কোন এফিলিয়েটিং মর্যাদা ছিল না। এফিলিয়েটিং মর্যাদা না দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কার্যত পঙ্গু করে রাখা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৪৭ সালের এক সরকারি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ববাংলার সকল কলেজ অধিভুক্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে পূর্ববাংলার কৃষক-মুসলমান পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার ভরকেন্দ্র রাতারাতি কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।
১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬১ সালে মোমেনশাহী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সংশ্লিষ্ট দুটি বিভাগের কলেজগুলো যথাক্রমে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও মোমেনশাহীতে মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কায়েম হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে। ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় বহু সংখ্যক স্কুল, কলেজ, মক্তব, মাদরাসা, পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলেই পূর্ববাংলার শিক্ষার ক্ষেত্রে এ সময় নবযুগের প্রবর্তন হলো এবং নবচেতনায় জাগরণ ঘটলো।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা থেকে মুসলমান কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সঙ্গীতশিল্পীগণ ঢাকায় চলে আসেন। পূর্ববাংলার জীবনপ্রবাহে এ সময় নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয়। ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলায় ‘এগ্রিকালচার’- এর সাথে ‘কালচার’ তখন থেকেই সমান তালে পা মিলিয়ে চলতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের আগে বাংলাভাষী অঞ্চলের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি বিকশিত হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৃষ্ট নগর-কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকাকে ঘিরে। দুই শতাব্দীর মধ্যবিত্তের উত্তরাধিকার নিয়ে কলকাতা ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির এক নতুন বদ্বীপ। নাটকে-উপন্যাসে-সঙ্গীতে-কবিতায় সে ভুবন দ্রুত সমৃদ্ধ হয়ে উঠল।
আগে শিল্প-অর্থনীতির যা কিছু বিকাশ ঘটেছিল, সবই কলকাতাকে কেন্দ্র করে। এখন ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার ‘খামার বাড়ী’তেও গড়ে উঠতে লাগল পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকল, কাগজকলসহ নানা কলকারখানা। স্বর্ণসূত্র নামে অভিহিত পাটের প্রধান উৎপাদক এলাকা হিসেবে গর্বিত পূর্ববাংলায় সাতচল্লিশের আগে একটিও পাটকল ছিল না। পূর্ববাংলার কৃষকরা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক ‘টাওয়ার বাংলা’র পাটকলগুলোর কাঁচামালের যোগানদার। স্বতন্ত্র আবাসভূমি অর্জনের মাধ্যমেই তারা পাটকল প্রতিষ্ঠারও অধিকার অর্জন করল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই এখানে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পেরও বিকাশ ঘটল। এ সম্পর্কে শামসুল হক লিখেছেনঃ
“মুদ্রণ ও প্রকাশনাক্ষেত্রে কলকাতা ১৭৮৮ থেকে যে ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিল, সে ঐতিহ্য ঢাকার ছিল না। এক্ষেত্রে ঢাকা ছিল প্রায় অবহেলিত। মফস্বল শহরের দীনতার মধ্যে সে যতটুকু নিজেকে সাজাতে পেরেছিল, তার বেশি কিছু ছিল না। ,,,,,,,, যাও বা ছিল, তাদের অনেকেই দেশ বিভাগের পর কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছিল। প্রকাশকের সংখ্যাও ছিল নগণ্য। প্রেসের মতো এরাও পাততাড়ি গুড়িয়ে চলে গেলেন ইন্ডিয়া”। (বাংলা সংস্কৃতির শতবর্ষঃ প্রকাশনা, পৃষ্ঠা ৩৮৭)
এই শূন্যতা পূরণের জন্য মেতে উঠল ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন প্রজন্ম। মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হলো নতুন জাগরণ। ফলে কাব্য, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, প্রবন্ধ-সাহিত্য, শিশু সাহিত্য, সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে এখানে উন্মোচিত হলো নবযুগের নুতন দিগন্ত। ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ববাংলার মৃত্তিকা-সংলগ্ন কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের জাগরণ ঘটলো এবং তাদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটলো সহস্রধারায়। ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণ-ফসল বাংলা একাডেমি ও বাংলা উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলার রেনেসাঁ একটি সংহত রূপ লাভ করল।
অন্নদাশংকর রায় ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলার এই জাগরণকেই ‘দ্বিতীয় রেনেসা’ বলে উল্লেখ করে লিখেছেনঃ
“এতকাল আমরা যেটাকে বাংলার রেনেসাঁ বলে ঠিক করেছি বা ভুল করেছি, সেটা ছিল অবিভক্ত বাংলার ব্যাপার। পার্টিশনের পর পূর্ববাংলা- এখন তো বাংলাদেশ- নতুন করে জেগে ওঠে। সেখানে দেখা দেয় দ্বিতীয় এক রেনেসাঁস। প্রথম রেনেসাঁসে নায়কদের মধ্যে ইউরোপীয় ছিলেন, খ্রিস্টান ছিলেন, কিন্তু মুসলমান ছিলেন না। দ্বিতীয় রেনেসাঁয় নায়করা প্রায় সকলেই মুসলমান। এবার তারা পা মিলিয়ে নিচ্ছেন। প্রথম রেনেসাঁসের ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। দ্বিতীয় রেনেসাঁস হচ্ছে ঢাকাকেন্দ্রিক। এর পূর্বাভাস পূর্বেই সূচিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনতিকাল পরে”। (বাংলার রেনেসাঁস, ভূমিকা, মুক্তধারা, ঢাকা ১৯৮৪)