শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা
মূল
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)
অনুবাদ
মওলানা জুলফিকার আহ্মদ কিস্মতী
[ বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, প্রবীণ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক]
আমাদের কথা
ইসলাম একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের এমন কোন দিক নেই যেখানে ইসলামের কোন দিক-নির্দেশনা নেই। মানব জীবনের সকল স্তরে ইসলামের সুনির্দিষ্ট অনুশাসন বিদ্যমান। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক, চারিত্রিক প্রভৃতি অঙ্গনে ইসলামী আদর্শের একটি সুবিন্যস্ত ছাপ রয়েছে। গায়রুল্লাহর গোলামী ও মানুষের মনগড়া মতবাদের চোখ ধাঁধানো শৃঙ্খল থেকে ইসলাম মানব জাতির মুক্তি ঘোষণা করেছে এবং সর্বযুগ উপযোগী অবকাঠামো উপহার দিয়েছে। ইসলামী অনুশাসনমালার ব্যবহারিক দিক হচ্ছে শরীয়ত। শরীয়ত নির্ধারিত সীমানা বা চৌহদ্দীর মধ্যেই মুসলমানদের বিচরণ করতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার অধিকার তাদের নেই। যদি কেউ এর বাইরে চলে যায় অর্থাৎ সীমানা লঙ্ঘন করে তাহলে সে আল্লাহ্দ্রোহী বলে গণ্য হবে।
মানব জীবনের বৃহত্তর বিচরণ ক্ষেত্র ইসলামী আদর্শের বলয়ভুক্ত। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পদ্ধতিও এর বাইরে নয়। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে অদ্যাবদি রাষ্ট্র প্রশাসনকে কেন্দ্র করে যত মতবাদের জন্ম হয়েছে তা মানব মস্তিস্ক প্রসূত। একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা এর ব্যতিক্রম। এর রচয়িতা এবং নিয়ন্ত্রণকারী স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা। তাই এটা নিঃসন্দেহে নির্ভুল। জীবন পথের বন্ধুর পথ-পরিক্রমায় ধাপে ধাপে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা যেখানে প্রবল, সেখানে মানব রচিত মতবাদ যথার্থ অবদান রাখতে পারে না। কেননা তাতে ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনা প্রচুর। আল্লাহ্ প্রদত্ত নির্ভুল বিধিমালার অনুসরণই মানুষকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। আর এর প্রকৃষ্টতম উপহার হচ্ছে শরীয়ত অনুমোদিত অনুশাসন পদ্ধতি।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আলিম (মুহাদ্দিস, ফকীহ) ও মশহূর মুজাদ্দিদ (সংস্কারক)। শিরক ও বিদ’আত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম মিল্লাতকে তাওহীদের মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত করে আল্লাহ্ তা’আলার খাঁটি বান্দা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর লেখনী ছিল অত্যন্ত ক্ষুরধার। রাষ্ট্র প্রশাসন ব্যবস্থায় অনৈসলামিক ভাবধারার মূলোৎপাটন করে তিনি মুসলিম সমাজকে নির্ভেজাল ইসলামী আদর্শের নিরিখে অবগাহিত করতে চেয়েছিলেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর লেখা *****(আরবী) নামক গ্রন্থটি একটি অনবদ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থের বাংলা তরজমাই হচ্ছে ‘শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা’। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক মওলানা জুলফিকার আহ্মদ কিস্মতী-এর অনুবাদক। জনাব কিস্মতী সাহেব একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক এবং চার-পাঁচ ভাষায় ব্যুৎপত্তিশালী, বহু মূল্যবান গ্রন্থের প্রণেতা, অনুবাদক ও সম্পাদক। তাঁর অনুবাদ বেশ প্রাঞ্জল ও সাবলীল।
বর্তমান সংস্করণে অনুবাদক প্রন্থটি পুনঃসম্পাদনা করায় অনুবাদটি আরও সমৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে মৌলিক পুস্তকের অভাবকে অস্বীকার করা যায় না। শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও দন্ডবিধির মৌলবিধান সম্বলিত গ্রন্থটি এ দেশের মুসলমানদের বহু দিনের প্রতিক্ষিত একটি অভাব দূরীকরণে যথেষ্ট অবদান রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। পাঠক সমাজের হাতে এ জাতীয় একটি পুস্তক তুলে দিতে পেরে পরম করুণাময় আল্লাহ্র দরবারে লাখো শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ্ আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কবুল করুন। -আমীন।
মুহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশক
লেখকের ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা সেই মহান সত্তার জন্য, যিনি তাঁর নবী-রসূলগণকে সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণাদি সহকারে মানব জাতির নিকট প্রেরণ করেছেন। যিনি মানুষের জন্য সরল সোজা পথে চলার উদ্দেশ্যে এবং ন্যায়-নীতির অনুসারী হবার লক্ষ্যে নবী-রসূলগণের সাথে কিতাব এবং মীযান তথা ন্যায়ের মানদন্ড পাঠিয়েছেন। (সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য) যিনি লোহা ও লৌহজাত বস্তু প্রেরণ করেছেন, যার মধ্যে একদিকে রয়েছে কঠিন শক্তি ও ভীতি, অপরদিকে রয়েছে মানব কল্যাণের অসংখ্য উপকরণ।
আল্লাহ্ তা’আলাই এ ব্যাপারে সব চাইতে বেশী অবগত যে, কার সাহায্য করা এবং কাকে পয়গম্বর বানানো উচিত। তিনিই একক শক্তিমান, প্রবল পরাক্রমশালী সত্তা, যিনি হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে নবুয়্যত ধারার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন এবং তাঁকে শেষ নবী বানিয়েছেন।
*****(আরবী)
“আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পথ-নির্দেশক বিধি-বিধানসমূহ এবং সত্য জীবন ব্যবস্থা দিয়ে এজন্যে প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি সকল মনগড়া জীবন ব্যবস্থা ও ধর্ম মতাদর্শের উপর এর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেন”। (সূরা ফাতাহঃ ২৮)
মহানবীর মদদকল্পে তিনি পাঠিয়েছেন “ সাহায্যকারী বলিষ্ঠ দলীল,” জ্ঞান-প্রজ্ঞা, কলম, হিদায়াত,যুক্তি-প্রমাণ,ক্ষমতা, শক্তি-সামর্থ্য, প্রভাব প্রতিপত্তিও (শক্তির প্রতীক) তরবারী। বলাবাহুল্য, মান-মর্যাদা ও অন্যায়-অসত্যের উপর বিজয়ের জন্যে এ সকল গুণ অত্যাবশ্যক। আমি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত মা’বূদ হবার যোগ্য অপর কোন সত্তা নেই, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁর কোন সহকর্মী ও সমকক্ষ নেই। এ সাথে আরও ঘোষনা করছি যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহ্র একজন বান্দা ও রাসূল। তাঁর প্রতি আল্লাহ্র অসংখ্য রহমত বর্ষিত হোক। রহমত বর্ষিত হোক তাঁর বংশধর ও সকল সাহাবীর উপর। তাঁদের উপর নেমে আসুক শান্তি, করুণার অফুরন্ত ধারা। আমার এই ঘোষণা ও সাক্ষ্যদান হোক সেই মর্যাদার অধিকারী, যদ্দারা ঘোষণাকারী সকল সময়ের জন্যে খোদায়ী নিরাপত্তা ও তত্ত্বাবধানে চলে যায়।
গ্রন্থটি লেখার মূল প্রেরণা
মূলতঃ এটি একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ হলেও তাতে আল্লাহ্ প্রদত্ত রাজনৈতিক বিধি-ব্যবস্থা এবং মহানবীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়সমূহ পরিপূর্ণরুপে বিবৃত হয়েছে। এ থেকে সকল শাসক, শাসিত, রাজা-প্রজা কারও পক্ষেই কোন অবস্থায় আপন দায়িত্বের প্রতি ঔদাসীন্য প্রদর্শন বা তা থেকে অব্যাহতি লাভের কোন অবকাশ নেই। এ গ্রন্থ রচনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রী সকল কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা এবং দেশের নীতি নির্ধারক, পরিচালকবৃন্দকে এমন উপদেশ বা পথ নির্দেরশনা প্রদান করা, যা আল্লাহ্ তা’আলা ঐসব শাসক-পরিচালকের উপর অপরিহার্য করে দিয়েছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
*****(আরবী)
“তিনটি কাজে আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। (১) তোমরা একমাত্র আল্লাহ্রই দাসত্ব করবে, (২)তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করবে না, (৩) সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহ্র রজ্জুকে দৃঢ় হস্তে ধারণ করবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে যাদের উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন, তাদেরকে সদোপদেশ প্রদান করবে”।
“আস্সিয়াসাতুশ্ শারইয়্যা” বা শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা গ্রন্থটির মূল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহ্র কিতাবের যে সকল আয়াত, যেগুলোতে বলা হয়েছে যে-
******(আরবী)
“ (মুসলমানগণ!) আল্লাহ্ তোমাদের নির্দেশ করেছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ অর্থাৎ মানুষের অধিকারসমূহ ঐগুলোর মালিক তথা হকদারদের কাছে পৌঁছে দাও। তোমরা যখন জনগণের পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নাও, তখন ন্যায়-নীতির মধ্য দিয়ে তা ফয়সালা করো। আল্লাহ্ তোমাদের যে উপদেশ প্রদান করেন, সেটা তোমাদের জন্যে কতই না উত্তম। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ্ সব কিছুই অধিক শুনেন, অধিক দেখেন। (হে মুসলমানগণ!) তোমরা আল্লাহ্র নির্দেশ মেনে চলো এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশ মেনে চলো আর মেনে চলো তোমাদের (রাষ্ট্রীয়) দায়িত্বশীল নেতাদের নির্দেশও। অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন প্রকার মতবিরোধ দেখা যায়, আল্লাহ্ তা’আলা এবং আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের শর্ত হচ্ছে, বিরোধীয় বিষয়টির ফয়সালা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের হাওলা করো। এটা যেমন তোমাদের জন্য উত্তম, তেমনি পরিণামের জন্য অতি শ্রেয়”। (সূরা নিসাঃ ৫৮-৫৯)
শরীয়ত বিশেষজ্ঞ আলিমদের অভিমত হলো, প্রথমোক্ত আয়াতটি ****(আরবী) রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারক কর্মকর্তা এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের সাথে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। তারা যেন জনগণের অধিকারসমূহ তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন এবং মামলা-মোকদ্দমা ও জনগণের অন্যান্য অভিযোগের ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।
দ্বিতীয় আয়াতটির ****(আরবী) মধ্যদিয়ে প্রজা সাধারণ ও বিভিন্ন বাহিনীর লোকদের বলা হয়েছে, তারা যেন নিজ নিজ নেতা ও কর্মকর্তাদের কথা মেনে চলেন। এসব কর্মকর্তাই সরকারী সম্পদ বণ্টন এবং যুদ্ধের নির্দেশসমূহ জারি করেন, যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদিতে কাজ করেন। তবে যে স্তরের নেতাই হোন তিনি আল্লাহ্র অবাধ্য হওয়ার নির্দেশ দিলে তা মানা যাবে না এবং আল্লাহ্র নির্দেশের পরিপন্থী কোন আইন বা হুকুম করলে কখনও তা পালন করবে না। এ ব্যাপারে মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন যে,
****(আরবী)
“ স্রষ্টার অবাধ্যজনিত কাজের হুকুম করা হলে তা মানা জায়েয নেই”।
অতএব,যখন কোন ব্যাপারে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, তখন তোমরা মনোনিবেশ করো কুরআন ও সুন্নাহ কি বলে সে দিকে অতঃপর সে অনুযায়ীই ফয়সালা করো। বিবাদমান ব্যক্তিরা যদি এভাবে বিরোধ নিস্পত্তি না করে, তখন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উপর ফরয হলো উপরোল্লেখিত আয়াতের নির্দেশ অনুসারে কাজ করা এবং আল্লাহ্র নির্দেশকেই কার্যকর করা। আল্লাহ্র নির্দেশ হলোঃ
****(আরবী)
“ কল্যাণ এবং সংযমী হবার কাজে তোমরা একে অপরের সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে অপরকে সহযোগীতা করো না”। (সূরা মায়িদাঃ ২)
এ আয়াত অনুযায়ী কাজ করা হলে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা হবে এবং তাদের হকও যথারীতি আদায় হবে।
উল্লেখিত আয়াতের মধ্যে আমানত আদায় করা ও হকদারের হকসমূহ তার কাছে যথাযথ পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, আমানত আদায় তথা জনগণের অধিকার প্রদান করা ও তাতে ন্যায়-নীতির অনুসরণ- এ দু’টি বিষয়ই হচ্ছে ন্যায়-নীতির শাসন, সৎ নেতৃত্ব এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। এর মধ্যদিয়েই আমানত আদায় হবে।
অনুবাদকের কথা
ইসলাম এবং রাজনীতি বিষয়ক এ গ্রন্থখানা ৭ম ও ৮ম হিজরীর বিশ্ব বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, সংস্কারক শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর সুবিখ্যাত গ্রন্থ – “আস্সিয়াসাতুশ্ শারঈয়া”- এর বঙ্গানুবাদ “শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা”। পাঠক-পাঠিকাদের খিদমতে বাংলা ভাষায় এই মূল্যবান গ্রন্থখানা পেশ করতে পেরে আল্লাহ্র অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) এ গ্রন্থখানা এমন এক যুগে লিখেছিলেন যখন গোটা মুসলিম বিশ্ব তার রাজনৈতিক দৃঢ়তা, স্থিতিশীলতা প্রায় হারিয়ে ফেলে। মুসলমানদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। পরস্পর বিরোধী বহু মতবাদের প্রসার ঘটে। ইসলামী রাষ্ট্র দিনের পর দিন প্রায় দুর্বল হয়ে পড়ে।
মূলত হিজরী সপ্তক শতক ছিল মুসলমানদের জন্য একটি পরীক্ষার যুগ। এ অধঃপতনের প্রধান কারণ ছিল চরিত্র ও কর্মে কুরআন ও সুন্নাহর মৌল নীতিমালার অনুসরণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার সাধারণ ব্যাধি, রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতা আল্লাহ্র আযাবের রূপ ধরে গোটা জাতির উপর আপতিত হয়েছিল।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর কাছে এ দৃশ্য ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি শেষ পর্যন্ত আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে মসী ও অসি উভয় প্রতিরোধের অস্ত্র ধারণ করলেন। জাতির সামনে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখলেন। তাঁর সত্য ভাষণ অনেকের স্বার্থে আঘাত হানলো, অনেক সংকীর্ণ ও স্থুল চিন্তার লোক বিরুদ্ধাচরণ শুরু করলো। তিনি কোন প্রকার বিরোধিতাকে পরোয়া না করেই নির্ভীকচিত্তে ন্যায় ও সোঁতের বাণী বলে যেতে লাগলেন। অবশেষে এক পর্যায়ে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য-সংহতির ভাব জাগ্রত হতে থাকলো।
বর্তমানে মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে অনৈক্য, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও হীনমন্যতা লক্ষ্য করা যায়। হিজরী সপ্তম শতকের তুলনায় তা কিছুমাত্র অধিক নয়। এটা ঠিক যে, এখন প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুসলমানরা রাজনৈতিক ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তার প্রধান কারণ হলো, ঐ সকল মৌল নীতিমালা থেকে তাদের বিচ্যুতি, যেগুলোকে ইসলাম “আশ্সিয়াসাতুশ্ শারঈয়া” বলে উল্লেখ করা থাকে। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (র) তাঁর এ গ্রন্থে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি এ বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন যে, মানব জীবনের সকল বিভাগ- চাই সেটা প্রশাসনিক হোক, কি নৈতিক বা ব্যবহারিক, অর্থনৈতিক- এজন্য ইসলাম যে ব্যবস্থা দিয়েছে, সেটাই শাশ্বত ও চূড়ান্ত। ইসলামের প্রদত্ত এসব নীতিমালার অনুসরণ ছাড়া সমাজকে দুর্নীতি মুক্ত রাখা, এর উন্নতি, অগ্রগতি ও শ্রীবৃদ্ধি যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সরকারী প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাকে কলুষমুক্ত, শক্তিশালী ও স্থিতিশীল রাখাও অসম্ভব।
“আস্সিয়াসাতুশ্ শারঈয়া”-এর লেখক শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) এমন এক বিশ্ব বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, যাঁর পরিচয়ের অপেক্ষা রাখে না। তিনি যে বিষয় বস্তুর উপর কলম ধরেছেন, সে বিষয়েরই চূড়ান্ত আলোচনা করেছেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থরাজির সব চাইতে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, তাঁর বক্তব্য কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। বিশেষ করে তিনি বুখারী এবং মুসলিম থেকে অধিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। ছোট বড় বহু গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন।
“আসসিয়াসাতুশ শারঈয়া” গ্রন্থটি অধিক বড় না হলেও এর মধ্যে তিনি রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক মৌলজ নীতিমালাসমূহ কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে স্পষ্ট তুলে ধরেছেন।
পরিতাপের বিষয় যে, আজকের মুসলিম মিল্লাতের সামনে এ মূল্যবান গ্রন্থ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও হীনমন্যতা ও অজ্ঞাতবশতঃ মুসলমানদের কেউ কেউ রাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে অপরের দ্বারে ধর্ণা দেয়। অথচ ইসলাম রাজনৈতিক যে সকল মৌল বিধান নীতিমালার উপর দেশ শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার ভিত্তি স্থাপন করেছে, এর সাহায্যে গোটা মুসলিম দুনিয়া পুনরায় নিজের মধ্যে ইসলামের সেই প্রাণসত্তা খুঁজে পেতে পারে, যা ইসলামের সোনালী যুগে ছিল। বিশ্বের মানব রচিত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্তসার শূন্যতা ও মানব সমাজে শান্তি আনয়নে ব্যর্থতার দাবী হলো, ইসলামী মূল্যবোধ-এর সুমহান নীতিমালার ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন-প্রশাসন ব্যবস্থাকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলা।
পৃথিবীর সকল শাসক, প্রশাসক বিশেষ করে মুসলিম দুনিয়ার রাষ্ট্র প্রধান ও প্রশাসনযন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সামনে গ্রন্থটি এমন এক পথনির্দেশক গ্রন্থ, তাঁরা যদি এটি গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তাঁদের সামনে সুষ্ঠু রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনকল্যাণ রাষ্ট্র উপহার দানের লক্ষ্যে ইসলামী রাজনীতির এক বাস্তব ছবি ফুটে উঠবে। এর ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দ্বারা তাঁরা জন-সমস্যাবলীর সমাধান, তাদের জীবনমানের উন্নতি বিধানে সকলের হৃদয় জয় করতে পারেন-শান্তি পিয়াসী জগদ্বাসীকে দিতে পারেন সার্বিক শান্তি, কল্যাণ, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির নতুন পথনির্দেশনা।
গ্রন্থটির যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যাখ্যা সাপেক্ষ, সেখানে এ গ্রন্থের বিশিষ্ট ভাষ্যকার আবুল আলা মুহাম্মদ ইসমাইলের বক্তব্যকে টীকারুপে ব্যবহার করে এর গুরুত্বকে আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ইসলামের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর লিখিত আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার এ সুপ্রাচীন মূল্যবান গ্রন্থখানার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করায় “আহসান পাবলিকেশনের” প্রতি জানাই আন্তরিক শুকরিয়া ও মুবারকবাদ।
ইসলামের জন্যে নিবেদিত প্রাণ মর্দে মুজাহিদ আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (র) মানব কল্যাণের যে সুমহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ গ্রন্থখানা রচনা করেছেন, এর বঙ্গানুবাদের পেছনেও অভিন্ন লক্ষ্যই সক্রিয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে নাগরিক চরিত্রকে অপরাধ প্রবণতা মুক্ত করা, সকল প্রকার দুর্নীতির উচ্ছেদ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য চাই খোদায়ী নিরপেক্ষ আইন। শ্রেণী বৈষম্যমুক্ত এই আইন ও ব্যবস্থার অনুপস্থিতিই সমাজে আইন অন্যায় অবিচারজনিত অপরাধ প্রবণতার জন্ম দেয়। অবশেষে ঐ অপরাধ প্রবণতা সমাজ চরিত্রে আরও হাজারো অপরাধ প্রবণতাকে উস্কে দেয়। প্রত্যেক কাজে জবাবদিহিতার চেতনা সম্বলিত এই খোদায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ সবের অবকাশ নেই বলেই সৎ নেতৃত্বের অধীন এই ব্যবস্থা সমাজে, রাষ্ট্রে শান্তি কল্যাণ ও জনসমৃদ্ধি আনতে সক্ষম। “আল্লাহ্র দীনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে” এ গ্রন্থ সহায়ক হোক, এই গ্রন্থ পাঠে রাষ্ট্রীয় নীতি আদর্শের ব্যাপারে সকল বিভ্রান্তির অবসান ঘটুক, আল্লাহ্র কাছে এই মুনাজাতই রইল। – জুলফিকার আহ্মদ কিস্মতী
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
মুসলিম জাতিকে অনুকূল প্রতিকূল উভয় অবস্থার মধ্যদিয়েই সামনে এগিয়ে আসতে হয়েছে। খৃষ্টীয় তের এবং চৌদ্দ শতকের মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাস ছিল বড় করুণ ও মর্মান্তিক। সর্বত্র অশান্তি, অস্থিরতা ও ভাঙনের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। তাদের সকল ঐতিহাসিক বীরত্বের কাহিনী যেন আরব্য উপন্যাসের কাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। ভীরুতা, নিষ্ক্রিয়তা মুসলমানদের আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল।
ঠিক সে সময় অর্থাৎ তের শতকের প্রারম্ভে মঙ্গোলিয়ার মরুচারী তাতারিয়া গোষ্ঠী প্রগৈতিহাসিক যুগের অসভ্য বর্বরদের অনুকরণে তাদের দলপতি চেংগীজ খানের নেতৃত্বে মুলসিম জাহানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সর্বপ্রথম আজকের রুশ অধিকৃত বুখারার তৎকালীন শাসনকর্তা সুলতান মুহাম্মদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। জীহুন নদীর উত্তরে এক বিশাল প্রান্তরে সুলতানের চার লাখ আট হাজার সৈন্য চেংগীজ বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং প্রথম দিনের যুদ্ধেই এক লাখ ৬০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। এভাবে পরবর্তী যুদ্ধে সুলতান মুহাম্মদের সৈন্যরা নির্মমভাবে পরাজিত ও নিহত হয়। এরপর মঙ্গোলীয় তাতার সৈন্যরা মুসলিম রাজ্যগুলো একের পর এক ধ্বংস করে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অন্য দিক থেকে সুসমৃদ্ধ দামেশক ও তৎকালীন মুসলিম দুনিয়ার রাজধানী বাগদাদ নগরীও তাতারীদের অত্যাচার ও ধ্বংসের লীলাভূমিতে পরিণত হয়।
রাজনৈতিক এ পতনের সাথে সাথে মুসলমানরা ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা ও চরিত্রেও অধঃপতনের শেষ প্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়। তৎকালীন সময় শিক্ষিত বলতে সমাজের আলিমদেরকেই বুঝাতো। আলিমগণের মধ্যে ইখতিলাফ ও মতবিরোধ চরমে উঠে। সাধারণ বিষয়কে কেন্দ্র করেও একদল মুসলমান আরেক দলকে নির্মমভাবে হত্যা করতে ও তিরস্কারবানে জর্জরিত করতে দ্বিধা করতো না। আলিমদের পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ দলাদলির ফলে মুসলিম সমাজ শতধাবিভক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমানদের সেই অনৈক্যের সুযোগে দুশমনরা এ জাতির সব তছনছ করে ফেলে।
অপরদিকে ইসলামের প্রাণসত্তাকে নিঃশেষকারী বিদ’আত, শিরক,পীর পূজা, কবর পূজা ইত্যাদি কুসংস্কার মারাত্মকরূপে বিস্তার লাভ করে। তাওহীদের বাস্তব সংজ্ঞা এক রকম বিলুপ্ত হবার পথে। কুরআন, সুন্নাহ্র শিক্ষা অনুসরণের চাইতে বিদ’আতী পীর-মাশায়েখের বক্তব্যকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হতে থাকে। ইসলামের বিশুদ্ধ ধারণা ও এর নির্মল জ্যোতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। অজ্ঞতার অন্ধকার যখন এভাবে মুসলমানের ঈমানী জ্যোতিকে প্রায় নিষ্প্রভ করে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই দামেশকের আকাশে এক উজ্জ্বল সূর্যের উদয় ঘটলো। তিনিই হলেন আল্লামা তাকিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে আবদুল হালীম ইবনে আবদুস সালাম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ইবনে কাসিম শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া আল হাওয়ানী আল দামেশকী।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে আবির্ভূত হয়ে বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। তিনি এ সবের বিরুদ্ধে এক রকম জিহাদ ঘোষণা করেন। জিহাদী প্রেরণাদিপ্ত তাঁর এই সংস্কারধর্মী আন্দোলন ছিল বহুমুখী। লেখা, বক্তৃতা ও আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ সকল উপায়ে তাঁর এই প্রতিরোধ চলে। সকল প্রকার বিরোধিতা ও অজ্ঞতার মধ্যেই তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে নির্ভীকভাবে কাজ করে যান। ন্যায় এবং সত্যের বাণীকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে তাঁকে অনেক দুঃখ কষ্টেরই সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বন্দী জীবন যাপন করেন। কারা-জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা তিনি ঈমানী শক্তি বলে সহ্য করেন।
শাসকবৃন্দ রাজা-বাদশাহ, আমীর-উমারাদের অনৈসলামিক ভূমিকার প্রতিবাদ ও বিরোধিতার কারণেই তিনি তাদের রোষানলে পড়েন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) সততা, নিঃস্বার্থতা ও আল্লাহ্র পথে ঈমানী দৃঢ়তার পরিচয় দিতে গিয়ে যেই জুলুম-নিপীড়ন ও ভ্রুকুটি সহ্য করেছেন, তার নজির অতি বিরল । দীনের জন্যে আত্মত্যাগের কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি যদি “আফজালুল জিহাদ” তথা “অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায় ও সত্য কথা বলা উত্তম জিহাদ”-এর চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে সংগ্রামের পথ দেখিয়ে না যেতেন, তাহলে পরবর্তী যুগে বিভ্রান্ত অত্যাচারী মুসলিম শাসক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মারমুখো ব্যক্তিদের সামনে হক কথা বলার লোকের অভাব দেখা দিত। সংগ্রামী ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর গোটা কর্ম জীবনের প্রতি তাকালে তাঁর সম্পর্কিত এ সকল বক্তব্যকে অতিশয়োক্তি বলার কোন উপায় নেই। প্রায় আটশ বছর অতীত হয়ে যাবার পরেও তাঁর লিখিত মূল্যবান গ্রন্থসমূহের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। মিসর,হেজাজ, ইরান প্রভৃতি দেশের অসংখ্য লাইব্রেরীতে ইবনে তাইমিয়া (র)-এর গ্রন্থাবলী সংশ্লিষ্ট সমাজের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে আছে। বার্লিন, লন্ডন, ফ্রান্স ও রোমের বহু পাঠাগারের শোভাবর্ধন করছে এ সংগ্রামী মনীষীর জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থাবলী।
তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনী দ্বারা একদিকে ইসলামের “সীরাতুল মুস্তাকীম”কে যাবতীয় আবিলতা মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন, অপরদিকে সকলকে যাবতীয় বিভ্রান্তির পথ পরিহার করে আল্লাহ্র শাসন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর যুগে যে তাগুতী শক্তি ইসলাম এবং মুসলমানদের চলার পথকে অবরোধ করে এগিয়ে এসেছিল, তিনি তার বিরুদ্ধে তরবারীও ধারণ করেন। ফলে চেংগীজী বর্বরদের পাশবিক বিক্রমকেও এর সামনে প্রতিরুদ্ধ হতে হয়েছিল। বলাবাহুল্য, ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (র) যেভাবে সর্বাত্মক সংগ্রাম করে গেছেন, পরবর্তী যুগে সঠিকভাবে প্রতিটি মুসলিম দেশের ইসলামী নেতৃত্ব যদি সেই জিহাদী ভাবধারা অনুসরণ করতে পারতেন, তাহলে মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাস অন্যভাবে গড়ে উঠতো। তা না হওয়াতেই মুসলমানরা আজ সর্বত্র তাগুতী শক্তির করুণার পাত্র।
জন্ম
৬৬১ হিজরী সালে রবিউল আউয়াল মাসের দশ তারিখ হাররান নামক এক শহরে ইবনে তাইমিয়া (র)-এর জন্ম হয়। তাঁর সাত বছর বয়সে যখন এ শহরটি তাতারীদের আক্রমণের শিকার হয়, তিনি তখন তাঁর পিতার সাথে জন্মভূমি ত্যাগ করে দামেশকে চলে যান। কুরআন হিফজসহ অন্যান্য প্রাথমিক শিক্ষা তিনি ঘরেই লাভ করেন। অতঃপর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের তৎকালীন প্রাণকেন্দ্র দামেশকের বড় বড় সুদক্ষ উস্তাদদের কাছে তিনি ইসলামী শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
তাঁর জ্ঞান,বুদ্ধিমত্তা ও কর্ম-কৌশলের কথা অল্পদিনেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হাদীসশাস্ত্রে তাঁর পান্ডিত্ব এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, জনগণ এই বলে বলাবলি করতো, “ইমাম তাইমিয়া যে হাদীসকে হাদীস বলে জানেনা, তা আদৌ হাদীস নয়”। ইবনে তাইমিয়া সকল সমস্যার সমাধান কুরআনের আয়াতের আলোকে পেশ করতেন। তিনি পূর্ববর্তী যুগের তাফসীরকারকদের কোন ভ্রান্তি থাকলে, তা পরিস্কার ভাষায় তুলে ধরতেন। মাত্র বিশ বছর বয়সে, তিনি এই জ্ঞান বৈদগ্ধ ও দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল গম্ভীর, সরস ও মিষ্ট; ঐতিহাসিক ইবনে কাসীরের মতে “ইবনে তাইমিয়া (র)-এর উপদেশপূর্ণ অপূর্ব ও জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনে অনেক বড় বড় পাপী, আল্লাহ্দ্রোহীও তওবা করে সৎপথের অনুসারী হয়েছে”। শেখ সালেহ তাজুদ্দীন বলেনঃ আমি ইবনে তাইমিয়া (র)-এর অধ্যাপনা কক্ষে রীতিমতো হাযির হতাম। তিনি বন্যার গতিতে ছুটতেন, খরস্রোতা নদীর মত প্রবাহিত হতেন। শ্রোতামন্ডলী চোখ মুদে স্তব্ধ বসে থাকতো। অধ্যাপনা শেষে তাঁকে অধিক গম্ভীর ও ভয়ঙ্কর মনে হতো অথচ তিনি ছাত্রদের সাথে স্নিগ্ধ হাসি ও খোশ মিজাযে কথা বলতেন। অধ্যাপনার সময় তাঁকে মনে হতো, তিনি এক অদৃশ্য জগতে বিচরণ করেছেন এবং পর মুহূর্তে দুনিয়ার বাস্তব জগতে ফিরে এসেছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কারা-প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করলেও তাঁর স্বল্পকালীন শিক্ষকতার যুগে ছাত্রদের সংখ্যা কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর কয়েকজন ছাত্র যারা ছিলেন বিদ্যায়, জ্ঞানে, প্রতিভায়, কর্মদক্ষতায় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। যেমন, আল্লামা ইবনে কাইয়্যেম, আল্লামা যাহবী, হাফিজ ইবনে কাসীর, হাফিজ ইবনে কুদামাহ, কাযী শরফুদ্দীন, শায়খ শরফুদ্দীন প্রমুখ মনীষীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আরবী ভাষায় গ্রীক দর্শনের অনুবাদ শুরু হয় হিজরী দ্বিতীয় শতকে। তখন থেকে মুসলিম সমাজের উপর গ্রীক দর্শনের বস্তুবাদী মর্মবাদের প্রভাব পড়ে। ফলে মানুষ খাঁটি ইসলামী জীবন দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সকল কিছু চিন্তা করতে শুরু করে। আব্বাসীয় রাজত্বের শুরুতে এ যুক্তিবাদী আন্দোলন অন্ধ আবেগের রূপ নেয়। এই মু’তাযিলাবাদ “খালকে কুরআনের” ন্যায় তুমুল ঝগড়ার উৎপত্তি করে। মুতাযিলাবাদ কুরআন পন্থীদেরকে গ্রীক দর্শনের দুর্জয় প্রভাবে পরাজিত করেছিল। “কালাম শাস্ত্র” মুসলিম সমাজকে সূক্ষ্ম মানতিকী আলোচনায় ব্যস্ত রেখে বাস্তব কর্মজগত থেকে একেবারে গাফিল করে দিচ্ছিল।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) মুসলিম দুনিয়াকে এ অবাঞ্ছনীয় অর্থহীন গুমরাহীর পথে ধাবিত হতে দেখে এর বিরুদ্ধে কলম ধারণ করেন। ৬৯৮ হিজরীতে তিনি একটি কিতাব লিখে “মুতাকাল্লেমীন”-এর আকীদা ও ধ্যান-ধারণার তীব্র সমালোচনা করেন এবং একে বাতিল প্রমাণ করে কুরআন ও সুন্নাহর নির্ভেজাল আদর্শকে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেন। এ গ্রন্থ ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের বুকে তীরের আঘাত হানে। এ কিতাবের দ্বারা তিনি চিন্তা জগতে এক নতুন বিপ্লব নিয়ে আসেন। এর কারণেই তাঁর নির্যাতনমূলক জীবনের সূচনা ঘটে।
ইমামের মতবাদ সম্পর্কে মিসরের শাসনকর্তা নাসের শাহের নিকট বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হলে ৭০৫ হিজরীতে তিনি দামেশকের গভর্নরকে স্থানীয় আলিমদের একটি মজলিস ডাকার ও ইমামের মতবাদ পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দেন। একাধিক বৈঠকে ইমামের মতই প্রাধান্য লাভ করে।
সূফীদের নাম ভাঙ্গিয়ে ভন্ডপীর-ফকীর-দরবেশের পেশাধারী একশ্রেণীর লোক যেমন আজকাল অর্থোপার্জন করে এবং তাদের কাছে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়, তৎকালেও মুসলিম সমাজ এ ফিত্নায় কম ভারাক্রান্ত ছিল না। আহ্মদিয়া ও নিসারিয়া ফকীর সম্প্রদায় দুটির একটি যুক্ত দল ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর বিরুদ্ধে দামেশকের গভর্নরের কাছে তিক্ত সমালোচনা করলে, তিনি তাঁকে ডেকে পাঠান। ইমাম অকুতভয়ে জবাব দেন, এ ফকীরদের দু’তি দল রয়েছে- (১) একটি পরহিযগারী, সাধুতা, নৈতিকতা ও দারিদ্র্যের কারণে প্রশংসার যোগ্য। তবে এদের অধিকাংশই ভন্ড ফকীর। শিরক, বিদ’আত ও কুফুরী ধারণার পংকিলতায় নিমজ্জিত। ইসলামের মৌল শিক্ষা কুরআন-হাদীসকে পরিত্যাগ করে মিথ্যা ও প্রতারণাকেই জীবনের সম্বল করে নিয়েছে। এরা দুনিয়ার মূর্খ মানুষগুলোকে ধোঁকা দিয়ে নানা প্রকার বিদ’আত, শিরকের জালে জড়িত করে। নিজেদের পকেট ভর্তির জন্য সদাসর্বদা সাধুতার ভান করে থাকে। নিজেদের চারি পাশে এমন এক বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করে নেয় যে, যারাই তাদের সংস্পর্শে যেতো, তাদের মানসিক গোলামে পরিণত হতো। নিজেদের পকেট উজাড় করে সেই বিদ’আতী ফকীরদের পদমূলে সর্বস্ব ঢেলে দিত।
ইমামকে মিসরে তলব
ইমামদের সত্য ভাষণে গভর্নর নিরব থাকলেও অন্যদের পক্ষ থেকে গোপনে তাঁর বিরুদ্ধে ভীষণ চক্রান্ত চলে। নাসরুল্লাহ মুঞ্জী মিসরের রাজন্যবর্গকে ইমামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। তাঁরা দামেশকের গভর্নরের কাছে লিখে পাঠায় যেন ইমামকে মিসরে পাঠানো হয়। গভর্নর জবাবে বললেনঃ তাঁর সাথে দু’বার আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে কিন্তু তাঁর মতবাদে কোন দোষ পাইনি। অবশ্য পরবর্তীতে তাঁর প্রতি নির্দেশ এলো, “ভালো চাওতো শাহী ফরমান অনুযায়ী কাজ করতে দ্বিধা করো না”। গভর্নর মজবূর হয়ে ইমামকে মিসর পাঠান।
৭০৫ হিজরীতে ১২ই রমযান সোমবার ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) দামেশক থেকে বের হলে শহরবাসী তাঁর পেছনে পেছনে তিন মাইল পর্যন্ত গিয়েছিল। বিদায় সম্বর্ধনা আগত অশ্রুসিক্ত নয়নে ইমামের প্রতি তাকিয়ে থাকে।
মিসরে পৌঁছে তিনি কায়রো শহরে শুক্রবার দিন একটি কেল্লার অভ্যন্তরে প্রধান বিচারপতি ও রাজদরবারীদের এক সমাবেশে তাঁর মতামত নির্ভীকচিত্তে বর্ণনা করেন। কিন্তু তারপরও তিনি রেহাই পাননি। অন্য মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে আটক রাখা হয়। ৭০৭ হিজরীতে তিনি মুক্তি পান। অতঃপর তিনি জামেয়াতুল হিকাম-এর মসজিদে জুমার নামায পড়ান এবং প্রায় ৪ ঘন্টা- ‘ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন’- (অর্থাৎ “একমাত্র তোমারই দাসত্ব করি আর একমাত্র তোমার কাছেই সাহায্য কামনা করি”।) আয়াতের তাফসীর বর্ণনা করেন। এভাবে মিসরে কিছু দিন থেকে তিনি তাঁর মতাদর্শ (ইসলাম) প্রচার করতে থাকেন এবং যাবতীয় ভ্রান্ত মতবাদের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করতে লাগলেন। মুহীউদ্দীন ইবনে আরাবীর অদ্বৈতবাদের ভ্রান্তি স্বপ্রমাণ তুলে ধরতে লাগলেন। কিন্তু বিরুদ্ধাবাদীদের জন্যে এটা ছিল অসহ্য। সূফী তাজুদ্দীন সাধারণ মানুষকে সভা-সমিতির মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে তুলে তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ আনেন এবং সরকারের নিকট তাঁর শাস্তি বিধানের দাবী তোলেন। সরকার তখন তাঁকে প্রথমে নজরবন্দী এবং পরে কারাগারেই আবদ্ধ করে রাখেন। কারা-জীবনেও তিনি বসে থাকেননি। নানান প্রকার অবৈধ খেল-তামাশা ও লক্ষ্যহীন জীবনবোধে লিপ্ত কয়েদীদের মধ্যে তিনি ইসলামের শিক্ষা দান কাজ শুরু করেন। তাদের নামাযী ও চরিত্রবান করে তোলেন। এতে জেলখানার পথহারা মানুষগুলো মনুষ্যত্বের সন্ধান পায়।
কারা প্রকোষ্ঠে ইমাম ইবনে তাইমিয়া
শত্রুরা ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর এ কাজের টের পেয়ে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে আলেকজান্দ্রিয়ার জেলে স্থানান্তর করে। এখানে একটি দুর্গে ১৮ মাস থাকাকালে একাধিকবার তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যাতে মুসলিম জাহানের লোকেরা কেঁদে কেঁদে অস্থির হতো। ৭০৯ হিজরীতে বাদশাহর হুকুমে তিনি মুক্তি পেয়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো রওনা দিলে স্থানীয় জনগন এক বিরাট মিছিল করে তাঁকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করেন। কায়রোর মাশহাদ-এ তিনি অবস্থান কালে কুরআন-হাদীস ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
এ সময় (৭১১ হিঃ) জামে মসজিদে প্রতিপক্ষীয় একদল লোক এসে ইমামের উপর হামলা করে এবং তাঁকে এক নির্জন ঘরে আটক করে নির্মমভাবে প্রহার করে। শহরে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর নিকট লোকজন দলে দলে দৌড়ে আসে এবং অভিপ্রায় ব্যক্ত করে যে, হুযূর অনুমতি দিলে গোটা মিশর সহর জ্বালিয়ে দেব। কিন্তু তিনি কোনরূপ প্রতিশোধ না নিয়ে বরং বললেনঃ আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। এরপরও তিনি অনেক দিন মিসরে থেকে পরে বায়তুল মুকাদ্দাস সফর করে স্বদেশ ভূমি দামেশকে ফিরে আসেন। জনগণ আনন্দে মিছিল করে তাঁর আগমন সম্বর্ধনা জানায়।
স্বদেশ ভূমি দামেশকে প্রত্যাবর্তন
দামেশকে আসার পর তিনি দীনী শিক্ষা বিস্তার, গ্রন্থ প্রণয়ন ও মানব সেবামূলক কাজে হাত দেন। তাঁর নির্ভীক কর্মতৎপরতা ও স্পষ্ট ভাষণে কায়েমী স্বার্থবাদী কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের গা-জ্বালার সৃষ্টি হয়। তারা আবার সরকারের কাছে অভিযোগ আনলে এ মর্মে সরকারী ফরমান জারী হয় যে, ইবনে তাইমিয়া আর কোন ফতোয়া জারী করতে পারবেন না।
কিন্তু ইমাম বললেন, “ সত্য গোপন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়”। তাঁর পক্ষ থেকে সরকারী ফরমানের এহেন বিরুদ্ধাচরণে ৭২০ হিজরীতে ‘দারুস্ সাদাত’ –এ অনুষ্ঠিত এক অধিবেশনে ইমামকে পুনরায় বন্দী করার সরকারী ফরমান জারী হয়। তখন তিনি পাঁচ মাস আঠার দিন পর্যন্ত দুর্গে বন্দী ছিলেন। এক বছর পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হলে তিনি সেই পুরাতন কাজ শুরু করেন। ইমাম জ্ঞান প্রসারের কাজে নিমগ্ন হন। তিনি দেখলেন, বহু বুযুর্গের কবর পূজা হচ্ছে। মকসূদ হাসিলের জন্য হাজার হাজার মানুষ কবরে শায়িত বুযুর্গদের কাছে প্রার্থনা জানাবার জন্যে দলে দলে ছুটে আসছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া ৭২৬ সনে ফতোয়া জারী করলেন যে, “ কবর যিয়ারত করার নিয়তে দূর দেশ সফর করা জায়েয নয়। এ ফতোয়া জারীর পর তাঁর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিরুদ্ধবাদীরা বড় বড় সভা করে তাঁর বিরুদ্ধে আগুন ঝরা বক্তৃতা দেয়। মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। কেউ বলে জিহ্বা কেটে দিতে হবে, কেউ বলে চাবুক মারতে হবে। কারও মত হলো যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ করে রাখতে হবে। একদল মিসরের বাদশাহ্র কাছে দাবী তুলল, তাঁকে যেন কতল করা হয়। পরে সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেফতারকারি পুলিশ তাঁর নিকট গেলে তিনি সহাস্যে তাদের সাথে কারাগারে চলে যান। বাগদাদে এ খবর পৌঁছুলে সেখানকার তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ আলিমগণ ইমামের ফতোয়াকে ইসলামের মূল ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল বলে তাঁর প্রতি সমর্থন জানায়। তাঁরা বাদশাহর কাছে দু’খানা চিঠি পাঠান। ঐ সকল চিঠির সারমর্ম হলোঃ ইমাম ইবনে তাইমিয়া যুগশ্রেষ্ঠ শতাব্দীর মুজতাহিদ ইসলামী মিল্লাতের নেতা, পৃথিবীর সাত একলীমের ধনভান্ডারও তাঁর মূল্য দিতে অক্ষম। আশ্চর্যের বিষয় যে, জাতির এ কর্ণধার যেখানে রাজপ্রাসাদের থাকার কথা, তাঁকে রাখা হয়েছে কারাগারে। তাঁর প্রতি ভিত্তিহীন দোষারোপ করা হয়েছে। তাঁকে আশু মুক্তি দেয়া উচিত।
ইরাকীরা ইমামের কারা-নির্যাতনের কথা শুনলে সারা দেশে অন্তর্বেদনার প্রচন্ড আগুন জ্বলে উঠে। আলিমদের সম্মিলিত এক ঘোষণায় বলা হয়, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে সত্য। সুতরাং শায়খুল ইসলামকে দীনের খিদমতের জন্য মুক্তি দেয়া হোক। তাতে বিশ্ব-মুসলিমের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করা হবে। বাগদাদের শ্রেষ্ঠ ওলামা-এ-কিরামের এ চিঠি মিসর বাদশাহ্র দরবার পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি কিংবা পৌঁছুলেও তা এমন সময় যে, তখন ইসলামী দুনিয়ার শতাব্দীর এ উজ্জ্বল সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে। ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ মর্দে মুজাহিদ শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া চিরদিনের তরে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) জীবনের শেষ দিনগুলো কারাগারে ইবাদত বন্দেগী, কুরআন তিলাওয়াত ও এর গবেষণাইতেই কাটাতেন। শেষবারে ইমাম দীর্ঘ তিন বছর তিন মাস কালেরও বেশি দিন কারারুদ্ধ ছিলেন। কারাগারের এ নিষ্ঠুর বন্দী জীবনও কেটেছে তাঁর অসংখ্য মৌলিক ও মূল্যবান গ্রন্থ রচনায়।
ইসলামের শিক্ষা আদর্শ থেকে বিচ্যুতির ফলে সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানদের উপর আল্লাহ্র গযব রূপে তাতারীদের যেই হামলা আসে, তখনও মুসলিম বিশ্বে অসংখ্য আলিম ছিলেন, পীর-মাশায়েখ ছিলেন। কিন্তু আরাম-আয়েশ বাদ দিয়ে এ মহাবিপিওদের মুকাবিলা করা এবং মুসলিম জনতাকে সংগঠিত করার মতো লোক খুব কমই ছিল। উদ্ভাবনী জ্ঞান দিয়ে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন একমাত্র ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)। ইসলাম মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবের আহ্বান নিয়ে এসেছে- বাতিলের সাথে মিতালি করে চলার জন্যে নয়, ইমাম ইবনে তাইমিয়া অসহ্য কষ্ট-নির্যাতনের মধ্যদিয়ে তারই প্রমাণ রেখে গেছেন। আল্লাহ্র দীন প্রতিষ্ঠাকল্পে বাতিলের বিরুদ্ধে লেখা, বক্তৃতা ও প্রয়োজনে অস্ত্রধারণ করেছেন এবং কষ্ট ত্যাগের মধ্যদিয়েও কি করে ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার সংগ্রামী জীবন উন্মুক্ত গ্রন্থতুল্য এরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
******(আরবী)