[তের]
সাক্ষ্য কিংবা নিজ স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে
চোরের হাতকাটা প্রসঙ্গ
সাক্ষ্য কিংবা চোরের আপন স্বীকারোক্তির দ্বারা চুরি প্রমাণিত হলে, অনতিবিলম্বে তার হাত কেটে দিতে হবে। কারারুদ্ধ করা অথবা অর্থের বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেয়া অবৈধ।
চোরের হাত কাটা ওয়াজিব। কুরআন, হাদীস ও ‘ইজমা’ দ্বারা এটা সুপ্রমাণিত। মহান আল্লাহ বলেছেন-
********আরবী
“ পুরুষ চোর এবং নারী চোর উভয়ের হাত কেটে দাও, আল্লাহর পক্ষ থেকে এদের কৃতকর্মের এটা শাস্তিমূলক বিধান। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়। অপরাধ করার পর যে ব্যক্তি তওবা ও নিজেকে সংশোধন করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। কেননা, আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও মহা দয়ালু”। (সূরা মায়েদাঃ ৩৮-৩৯)
সাক্ষ্য কিংবা নিজ স্বীকারোক্তির পর চুরির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর অনতিবিলম্বে তার উপর ‘হদ্দ’ জারি করে নির্ধারিত সাজা কার্যকর করতে হবে, বিলম্ব করা জায়েয নয়। কারাগারে আটক কিংবা ‘ফিদ্য়া’ তথা অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া যাবে না। নির্দিষ্ট সময়ে দিবালোকে তার হাত কাটতে হবে। কেননা, আল্লাহর পথে জিহাদ করা যেমন ইবাদত, তেমনি ‘হদ্দ’ কার্যকর করা ইবাদতের মধ্যে গণ্য আর অন্তরে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, হদ্দ কার্যকর করাটা মানুষের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ।
সুতরাং শাসনকর্তা, বিচারপতি এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলগণ এ ব্যাপারে মায়া-দয়া না দেখিয়ে কঠোর হওয়া উচিত এবং হদ্দ কিছুতেই বাতিল করা চলবে না। তারা মনে মনে এ বিশ্বাসই পোষণ করবেন যে, জনগণের উপর আল্লাহ্র অনুগ্রহ স্বরূপ এবং অসৎ কাজ থেকে অপরাধপ্রবণ লোকদের বিরত রাখার উদ্দেশ্য আমরা ‘হদ্দ’ জারি করার পদক্ষেপ নিয়েছি-অহংকার কিংবা ক্রোধ বশতঃ নয় বরং পিতা যেভাবে পুত্রকে শিক্ষা দেয়। সন্তানকে সুসভ্য করা থেকে গা বাঁচিয়ে পিতা যদি পুত্রকে মায়ের হাওলা করে দেয়, তাহলে মাতৃত্বসুলভ কোমলতার কারণে তার পক্ষে পুত্রকে গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। ফলে ছেলের চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। বস্তুতঃ পিতার কড়া শাসনেই পুত্র সভ্য-শান্ত, শিক্ষিত ও চরিত্রবান হয়ে গড়ে ওঠে। এটাই হল পিতৃত্বের মূল দায়িত্ব এবং ছেলের প্রতি তার সত্যিকার অনুগ্রহ। ১ (১.টীকাঃ চুরির দায়ে হাত কাটাকে আধুনিক বিশ্বের অগভীর চিন্তার কোনো কোনো মানুষ একটা বর্বর আইন ও কঠোর সাজা বলে মন্তব্য করে থাকে। কিন্তু বাস্তুব সত্য এ ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত স্বাক্ষরই বহন করে থাকে। যে গ্রাম-সমাজ-জনপদে চুরি হয়, সেখানকার দু’একজনের হাত কাটা গেলে গোটা জনপদ শান্তি ও নিরাপদ হয়ে যায়, পুনরায় কেউ চুরি করতে সাহসই পায় না। সুতরাং দেখা যায়, এ হাত কাটা সমাজের জন্য অশেষ কল্যাণ বয়ে আনে। পক্ষান্তরে আজকাল মানব উদ্ভাসিত আইনে চুরির যে সাজা প্রবর্তন করা হয়েছে তা কবির ভাষায় তীব্র হলো পাপের নিশা-সাজা পাওয়ার পরে……”। এ ধরনের সাজায় সমাজের ক্ষতিই হয়, লাভ কিছুই হয় না। জেলে গিয়ে পুরান চোরদের সাথে মিশে নতুন চোর দক্ষ হয়ে আসে। অথচ ইসলাম যে শাস্তির বিধান দিয়েছে তা কার্যকর হলে চুরির সম্ভবনা একেবারেই মিটে যায়। আল্লাহও রাজি থাকলেন। উপরন্তু সমাজে, শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বস্তিও নেমে এল। আর হদ্দের উপকারিতা ও মূল রহস্য জানতে পেরে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিও এই মনে করে সন্তুষ্ট যে, আখিরাতের কঠিন সাজা থেকে মুক্তি লাভের একটা উপায় তো হলো। এতেও অপরাধীর তাকওয়া অবলম্বন করার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজে ও রাষ্ট্রে।
মোটকথা, শরীয়তী বিধান ‘হদ্দের’ মধ্যে অশেষ বরকত ও বিবিধ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জীবনে শান্তি ধারা নেমে আসে। বিশ্ববাসীকে আল্লাহ বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধির তৌফিক দেন। সারা বিশ্ব না হোক অন্ততঃমুসলিম দেশগুলো ইসলামের এ দন্ড বিধানটি বাস্তবায়িত করে এর সুফল ভোগ করার সুযোগ লাভে যেন সচেষ্ট হয়। ) অথবা তারা হলে সে সহৃদয় চিকিৎসকের ন্যায় যিনি রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে রোগীকে তিক্ত ঔষধের ব্যবস্থা দেয়। কিংবা মানব দেহের পচনশীল সে অঙ্গের ন্যায় অস্ত্রোপাচারের দ্বারা যেই অঙ্গ দেহ থেকে বিছিন্ন করে দিলেই দেহের বাকী অংশ রক্ষা পায়। কিংবা সিঙ্গা লাগিয়ে দূষিত রক্ত বের করার আশায় যেমন শরীরে জখম করা হয় আর ভবিষ্যতের মঙ্গল চিন্তা করে সাময়িক এ যাতনা সহ্যও করা হয়। মোটকথা ব্যাধির উপশম ও সুখের জন্যই মানুষ এতসব কষ্ট সহ্য করে। হদ্দের রহস্যও তাই যে, সাজার মাধ্যমে অপরাধী যেন চির শান্তি লাভ করতে পারে।
হদ্দ কার্যকর করাতে শাসনকর্তা ও বিচারপতি উদ্দেশ্য এটাই হওয়া উচিত যে, জনগণের সার্বিক কল্যাণ, দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালনের কল্যাণ অর্জন করা। উপরন্তু এটাও নিয়্যাত হওয়া উচিত যে, এদ্বারা একে তো আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়িত করা হলো, দ্বিতীয়তঃ এ শাস্তিই যেন অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়- আখিরাতে মুক্তির উপায় হয়। কেননা এদ্বারা তার আত্মিক পরিশুদ্ধি হয়ে যাচ্ছে। এমনিভাবে হদ্দ জারি অর্থাৎ ইসলামের অপরাধ দন্ড বিধি কার্যকর করাটা সবার জন্য আল্লাহর সরাসরি অপার অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়।
পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য যদি হয় আল্লাহর বান্দাদেরকে গোলাম বানানো, স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখা, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করা,ব্যক্তি, গোষ্ঠী স্বার্থ ও আর্থক সুবিধা আদায় করা তাহলে এর পরিণতি বিপরীত হয়ে দাড়াঁবে। মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে হদ্দের আসল উদ্দেশ্য দূরে সরে যাবে।
বর্ণিত আছে, হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ) খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে ওলীদ ইবনে আবদুল মালিকের পক্ষ থকে মদীনার শাসনকর্তা ছিলেন। শাসন ও জনসেবায় তিনি যথাযথ দায়িত্ব পালনে আত্মনিয়োগ করেন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ একবার ইরাক থেকে মদীনা পৌঁছে স্থানীয় লোকদের তিনি হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয সম্পর্কে প্রশ্ন করেন- *******আরবী
“ তোমাদের উপর তাঁর প্রভাব কিরুপ?” লোকেরা বললঃ “ তাঁর প্রভাবের কথা আর কি বলবো, আমরা তো ভয়ে তাঁর প্রতি তাকাতেও পারি না”। হাজ্জাজ ****আরবী “ তাঁর প্রতি তোমাদের ভালবাসা কীরূপ” তারা জবাব দিলঃ *******আরবী “নিজেদের পরিবার-পরিজন থেকেও তিনি আমাদের প্রিয়”। হাজ্জাজ-*******আরবী “তোমাদের প্রতি তাঁর শাসনগত আচরণের কি অবস্থা?” তারা বললঃ “তিন থেকে দশ কোড়া পর্যন্ত তিনি লাগিয়ে থাকেন”। অতঃপর হাজ্জাজ বললেন-
“ এ ভালবাসা, ভয় ও প্রভাব এবং শাসনগত আচরণ আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, আল্লাহর বিধানও তাই”।
হাত কাটার পর সাথে সাথে কর্তিত স্থানে গরম তেলের সেক দেয়া বাঞ্ছনীয়।১ (টীকা-১ঃ আজকাল এর জন্য অন্যান্য ঔষধ ব্যবহার করা হয়। মূলতঃ রক্ত বন্ধ হওয়া এবং রক্ত ক্ষরণজনিত কারণে প্রাণহানি না ঘটাই এর উদ্দেশ্য।) আর বিচ্ছিন্ন হাত তার গলদেশে ঝুলিয়ে দেয়া মুস্তাহাব। দ্বিতীয়বার চুরি করলে তার বাঁ পা কাটতে হবে। তৃতীয়বার চুরি করলে সাজার ধরন কিরুপ হবে-এ সম্পর্কে সাহাবী ও পরবর্তী ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞগণের মদ্ধে দ্বিমত লক্ষ্য করা যায়। কিছু সংখ্যক লোকের মতে তৃতীয় ও চতুর্থবার চুরি করলে তার বাম অথবা ডান হাত কেটে দিতে হবে। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) ইমাম শাফেঈ এবং এক রেওয়ায়েতে ইমাম আহমদ এ মতের সমর্থনকারী। ইমাম আহমদের দ্বিতীয় মত হলো, তাকে কারারুদ্ধ করে রাখতে হবে। হযরত আলী (রা) এবং সূফীগণ এ মতের পক্ষপাতী। ১ (টীকা-১ঃ এ ব্যাপারে হযরত আবু হানীফার মত হলো, হাত কাটার মামলায় আর্থ-সামাজিক অবস্থা লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সমাজে অর্থনৈতিক সুষম বন্টন ব্যবস্থা আছে কি না? এছাড়া চৌর্যবৃত্তিটা অভাবজনিত না অভ্যাস তাড়িত?)
হাত তখনই কাটতে হবে যখন চুরির ‘নিসাব’ পূর্ণ হয়। ইমাম মালিক, ইমাম শাফি’ঈ, ইমাম আহমদ প্রমুখ, উলামা, হিজাযবাসী এবং হাদীসবিদগণের মতে এর পরিমাণ হল- (এক চতুর্থাংশ) দীনার অথবা ৩ (তিন) দিরহাম। কারো কারো মতে, হাত কাটার নিসাবের পরিমাণ এক দীনার অথবা দশ দিরহাম। বুখারী-মুসলিমে হযরত ইবনে উমর (রা) নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সা) তিন দিরহাম মূল্যের একটি ‘মিজান্ন’ তথা একটি ঢাল চুরিরি দায়ে হাত কাটার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং মুসলিমের ইবাদত হল-
************আরবী
“তিনি তিন দিরহাম মূল্যের একটি ঢাল চুরির অপরাধে চোরের হাত কেটেছিলেন”। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেন-
*******আরবী
“ এক চতুর্থাংশ দীনার কিংবা এর চেয়ে অধিক পরিমাণ চুরির জন্য হাত কাটতে হবে”। একই মুসলিমে আরো বর্ণিত আছে-
**********আরবী
“ এক চতুর্থাংশ দীনার’ কিংবা এর চেয়ে অধিক মূল্যের বস্তু চুরি করার জন্যই কেবল চোরের হাতকাটা যাবে”।
বুখারীর এক রেওয়ায়েত নবী করীম (সা) বলেছেন-
*******আরবী
“ এক চতুর্থাংশ দীনার চুরির দায়ে তোমরা হাত কাটো, এর চেয়ে কমের দায়ে কাটবে না”। তখনকার সময়ে দীনার মূল্য ছিল তিন দিরহাম আর পূর্ণ দীনারের মুদ্রামান ছিল ১২ দিরহামের সমান।
আর কোন সুরক্ষিত মাল অপহরণ করার পরই কেবল চুরির অপরাধ সাব্যস্ত হবে।
যেমন, কোন বিনষ্ট, অরক্ষিত মাল কিংবা মাঠে-ময়দানে প্রাচীর ঘেরা বা বেড়াবিহীন বৃক্ষের ফল-ফুল অথবা রাখাল বিহীন পশু ইত্যাদি অপহরণ করাকে হদ্দ যোগ্য চুরি বলা হবে না। সুতরাং এমন সব দ্রব্য অপহরণের দায়ে হাতকাটা যাবে না। অবশ্য হরণকারীকে ‘তাযীর’ তথা শাসনমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে, যেমন হাদীসে বলা হয়েছে।
ক্ষতিপূরণের মাত্রা কি হবে, সে সম্পর্কে আলিমগণের দ্বিমত রয়েছে। হযরত রাফি’ ইবনে খাদীজ (রা) বর্ণনা করেন, আমি নবী করীম (সা)-কে ইরশাদ করতে শুনেছি। তিনি বলেছেন- ********আরবী “ফল এবং পাকা খেজুরে হাতকাটা যাবে না”। (সুনান)
আমর ইবনে শুআইবের দাদা বলেনঃ বনী মূযাইন গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে আমি নবী করীম (সা)- কে প্রশ্ন করতে শুনেছি-
*******আরবী
“আমি নিখোঁজ উট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য আপনার নিকট হাজির হয়েছি”।
তিনি বললেন-
*******আরবী
“আহারের ব্যবস্থা তার সাথেই রয়েছে, বৃক্ষ লতা খাবে আর ঘাটে পানি পান করবে। তাকে ছেড়ে দাও, তালাশকারী যেন এর কাছে পৌঁছে যায়”।
লোকটি বলল- *******আরবী “নিখোঁজ বকরী সম্পর্কে আপনার কি হুকুম?” হুজুর (রা) বললেন-
********আরবী
“তোমার জন্য, তোমার ভাইয়ের অথবা বাঘের জন্য হবে, এর সন্ধানকারী আসা পর্যন্ত একে হেফাজত কর”। সে বলল-
******আরবী
“ হারীসাহ’ অর্থাৎ রাখালের হেফাজত থেকে যা নিয়ে যাওয়া হয়”। তিনি বললেন-
*******আরবী
“ এর দ্বিগুণ মূল্য দিতে হবে এবং ‘তাযীর’ করতে হবে। আর গোয়াল থেকে অপহৃত জন্তুর মূল্য যদি ঢালের মূল্যের সমান হয়, তবে হাত কাটাতে হবে”।
সে ব্যক্তি প্রশ্ন করলঃ হে রাসূলুল্লাহ! যদি ফল মূল চুরি করে তবে? হুজুর (রা) উত্তর দিলেন-
*********আরবী
“ যে ব্যক্তি খোসা ছাড়া নিজ মুখে এসবের কিছুটা পুরে দেয় এর জন্য কোন সাজা হবে না। কিন্তু যদি নিজের সাথে করে কিছুটা নিয়ে যায়, তবে দ্বিগুণ মূল্য দিতে হবে এবং ‘তাযীর’ করতে হবে। কিন্তু যদি ঝোপসহ নিয়ে যায়, তবে এর মূল্য ঢালের মূল্যের সমান হয়, তবে হাত কাটতে হবে, আর যদি এর দাম ঢালের দামের চেয়ে কম হয়, তবে দ্বিগুণ জরিমান দিতে হবে এবং কোড়ার আঘাতে তাকে তাযীর করতে হবে”। (সুনান)
অতঃপর তিনি আরো বলেন-
*******আরবী
“লুটকারী, ছিনতাইকারী এবং খেয়ানতকারীর হাতকাটা যাবে না”।
পকেটমার, রুমাল কিংবা আস্তিনে রক্ষিত মাল অপহরণকারীকে আলিমগণের বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী হাতকাটা যাবে।
[চৌদ্দ]
ব্যভিচারী ও সমকামীদের প্রস্তরাঘাতে সাজা
ব্যভিচারীর সাজা, প্রস্তরাঘাতে বিবাহিত ব্যভিচারীর প্রাণ সংহার করা। ‘লাওয়াতাত’ অর্থাৎ, সমকামিতার সাজা। যে সমকামী এবং যার সাথে এই ঘৃণ্য কাজ করা হবে, উভয়কেই হত্যা করা।
‘রজম’ তথা প্রস্তরাঘাতে হত্যা করাই হলো বিবাহিত ব্যভিচারীর সাজা। রাসূলুল্লাহ (সা) মায়েয ইবনে মালিক আসলামী, ‘গামেদিয়া’ মহিলা* (*টীকাঃ ‘গামেদিয়া’ বলে হাদীসে উল্লেখিত জনৈকা সাহাবিয়া মহিলার দ্বারা ব্যভিচারের কর্ম সংঘটিত হয়। এ বিষয়ে অন্য কারো খবর বা কল্পনাও ছিল না। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল, আমার অপরাধ সম্পর্কে মহান আল্লাহ জ্ঞাত রয়েছেন, তাঁর আযাব দুনিয়ার যাবতীয় কষ্টের চেয়ে ভীষণ পীড়াদায়ক। তাই হুযূর (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে নিজের কৃত অপরাধ সবিস্তার বর্ণনাপূর্বক আবেদন করলেনঃ “ যথাযোগ্য শাস্তি দিয়ে আমাকে পবিত্র করুন”। হুযূর (সা) এটাকে তেমন গুরুত্ব না দেয়াতে পুনরায় আরয্ করলেনঃ হুযূর! আমার একথা কোন পাগলের প্রলাপ নয়। স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে আমি এ বক্তব্য রাখছি। আমাকে রজম করিয়ে দিন, যেন পরকালের আযাব থেকে নিষ্কৃতি পাই”। তিনি আরো বলেনঃ “অবৈধ মিলনের ফলেই আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি বলে আমার বিশ্বাস। “বিবরণ শুনে হুযূর (সা) বলেনঃ “যদি তাই হয় তবে, এখন তোমার উপর হদ্দ জারি করা যাবে না। প্রসবের পর আসবে”।
প্রসবের পর সন্তান কোলে নিয়ে আল্লাহর সে বান্দী হুযূরের (সা) খিদমতে হাজির হয়ে আবেদন জানালেন “হুযূর! আমি অমুক অপরাধিনী মহিলা। সন্তান প্রসব হয়ে গেছে, তাই শাস্তি দানে আমাকে নির্মল করুন”। হুযূর (সা) বললেনঃ বাচ্চা এখনো মায়ের দুধের উপর নির্ভরশীল। দুধ ছাড়িয়ে যখন রুটি খেতে শুরু করে তখন আসবে”। অতঃপর বাচ্চাটি রুটি খাওয়ার যোগ্য হওয়ার পর তার হাতে রুটির টুকরা দিয়ে হুযূরের (সা) নিকট হাজির হন। বাচ্চাটি তখন রুটি চাবাচ্ছিল। আবেদন করলেনঃ “হুযূর! আমি সেই অপরাধিনী। আমার বাচ্চার এখন দুধের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। দেখুন রুটি খাচ্ছে। এখন একে কারো হাতে সোপর্দ করে পরকালের আযাব থেকে আমার মুক্তির ব্যবস্থা করুন”।
সুতরাং মহিলাটিকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হল। পাথর নিক্ষেপকারীগণের মধ্যে এ একজন বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। হুযূর (রা) একথা জানতে পেরে উক্ত সাহাবীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি এরূপ কেন করলে? তুমি জান কি, সে এমন তওবাই করেছে যে, মদীনাবাসীদের সকলের মধ্যে তা বন্টন করে দিলে তাদের সবার নাজাতের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহু আকবার ! পরকাল চিন্তার কি অপূর্ব নিদর্শন।)
এবং কোন কোন ইহুদীকে ‘রজম’ করিয়েছিলেন। তাঁর পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদীন এবং মুসলমানগণ যিনার শাস্তিস্বরূপ ‘রজম’ করেছেন।
এখন ‘রজমের’ পূর্বে একশ কোড়া লাগিয়ে পরে ‘রজম’ করা হবে কিনা? এ ব্যাপারে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ)-এর মযহাবে দু’ধরনের মত পরিলক্ষিত হয়।
(১) যিনাকারী যদি মুহসিন (বিবাহিত) না হয়, তবে কিতাবুল্লাহর বিধান মতে একশ কোড়া লাগাতে হবে।
(২) নবী করীম (সা)-এর হাদীসের নির্দেশ মতে একশ কোড়ার সাথে সাথে এক বৎসরের জন্য দেশান্তরিত বা নির্বাসনের হুকুম দিতে হবে। অবশ্য কোন কোন আলিমের মতে এক বছরের নির্বাসন দেয়া জরুরী নয়।
অধিকাংশ ইসলামী আইনবিদের মতে চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ অথবা সে নিজে চারবার স্বীকার না করা পর্যন্ত যিনাকারীর উপর হদ্দ (শাস্তি) জারী করা যাবে না। কিন্তু কোন কোন আইনবিদ বলেন- চারবার স্বীকার করা বিশেষ জরুরী নয়। বরং একবার স্বীকার করাই যথেষ্ট। কেউ যদি প্রথমবার স্বীকার করার পর, পরে অস্বীকার করে বসে? এক্ষেত্রে কোন কোন আলিমের মতে তার থেকে হদ্দ (যিনার শাস্তি) রহিত হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে, কারো কারো মতে হদ্দ রহিত হবে না (বরং তা কার্যকরী করতে হবে)।
‘মুহসিন’ তাকেই বলা হবে, যে ব্যক্তি ‘আযাদ’, ‘হুর’ মুকাল্লাফ (শরীয়তের বিধান পালনের যোগ্যা) এবং বৈধ বিবাহএর পর আপন স্ত্রীর সাথে নূন্যতম একবার মিলিত হয়েছে।
আর যার সাথে সহবাস করা হয়েছে উপরোক্ত শর্তাবলী পাওয়া যাওয়া সাপেক্ষে সে মুহসিন পর্যায়ভুক্ত কিনা? এ প্রশ্নও এখানে উত্থাপিত হয়। এ ব্যাপারে আলিমগণের মধ্যে দু’ধরনের মত লক্ষ্য করা যায়।
(১) মেয়ে ‘মুরহেকা’ (বালেগ হওয়ার নিকটবর্তী) কিন্তু বালেগ পুরুষের সাথে যিনা করেছে। কিংবা পুরুষ ‘মুরাহেক’ (বালেগ হওয়ার নিকটবর্তী) বালেগা নারীর সাথে যিনা করেছে।
অতঃপর জিম্মিদের বেলায়ও একই হুকুম। যদি সে ‘মুহসিন’ হয় তবে, অধিকাংশ আলিমের মতে ‘রজম’ করা হবে। যথা- ইমাম শাফি’ঈ ও ইমাম আহমদ প্রমুখদের এই মত।
কেননা নবী করীম (সা) আপন মসজিদের দরজার সামনে ইহুদীদের ‘রজম’ করিয়েছেন আর ইসলামে এটাই ছিল প্রথম ‘রজম’।
স্বামীহারা কোন নারীকে যদি গর্ভবতী অবস্থায় পাওয়া যায়। অধিকন্তু তার কোন মনিব বা প্রভু বর্তমান না থাকে এবং গর্ভে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ না থাকে তবে, ইমাম আহমদ (রহ) প্রমুখের মযহাবে দু’ধরনের মত পরিলক্ষিত হয়।
(১) তার উপর হদ্দ জারী করা যাবে না। কেননা হতে পারে বলপূর্বক তার সাথে যিনা করার পরিণামে সে গর্ভবতী হয়েছে। কিংবা জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অথবা আপন স্ত্রী সন্দেহে কোনো অবস্থায় তার সাথে সহবাস করা হয়েছিল।
(২) তার উপর হদ্দ জারী করতে হবে। খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে রেহাই প্রমাণিত এবং এটা শরীয়তের উসূলের অনুকূল, অধিকন্তু মদীনাবাসীদের মযহাবেও এটাই। কেননা এটা বিরল সম্ভাবনা। আর এ ধরনের বিরল সম্ভাবনার প্রতি গুরুত্ব দেয়া সমীচীন নয়।
যেমন- সে মিথ্যা স্বীকারোক্তি করেছিল অথবা সাক্ষীগণের সাক্ষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা।
‘লূতী (পুং মৈথুনকারী) এবং ‘লাওয়াতাত’ (পুং মৈথুন) এর শাস্তি সম্পর্কে কোন কোন আইনবিদ বলেন- যিনার অনুরূপ হদ্দ অর্থাৎ সাজা তার উপরও প্রয়োগ করতে হবে। কারো কারো মতে, লাওয়াতাত তথা সমকামিতার অপরাধে যিনার চেয়ে অপেক্ষাকৃত লঘুদন্ড প্রদান করা বিধেয়। অপর দিকে সাহাবা কিরাম (রা) সকলেরই এক ও অভিন্ন মত যে, মুহসিন কিংবা গায়র মুহসিন পুং মৈথুনকারী এবং পুং মৈথুনকৃত ******আরবী উভয়কে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। কেননা হাদীসে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত- নবী করীম (সা) বলেছেন-
********আরবী
“যাকে, কওমে লূতের অনুরূপ কর্মরত দেখতে পাও (পুং মৈথুনকারী ও কৃত) উভয়কে প্রাণদন্ড দেবে”।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর রেওয়ায়েতক্রমে আবূ দাঊদ বর্ণনা করেনঃ অবিবাহিত লূতী বালককে যদি কোন নারীর সঙ্গে পাওয়া যায় তবে,তাকে ‘রজম’ করতে হবে। এ সম্পর্কে হযরত আলী (রা)- ও একই মত পোষণ করেন। কিন্তু অন্যান্য সাহাবী (রা) তার কতলের ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন এবং বিভিন্ন প্রকার মত ব্যক্ত করেছেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা) তাকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
আর অন্যান্য সাহাবীগণ (রা) বলেন- তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হোক। কেউ বলেছেন- প্রাচীর চাপা দিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। কেউ বলেছেন- কোনও পচা দুর্গন্ধময় স্থানে তাকে বন্দী করে রাখতে হবে, যাতে এ অবস্থায়ই সে মারা যায়। কেউ বলেন, এলাকার সর্বোচ্চ প্রাচীর চূড়া থেকে ভূ-তলে নিক্ষেপ করে উপর থেকে তার উপর প্রস্তর নিক্ষেপ করতে হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক তদ্রুপ কওমে লূতকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। এটা ইবনে আব্বাস (রা)-র এক রেওয়ায়েত।
তাঁর অপর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তাকে রজম (প্রস্তারাঘাতে প্রাণদন্ড) দিতে হবে। অধিকাংশ সল্ফে সালেহীনের অভিমতও এটাই। এ মতের প্রমাণস্বরূপ তাঁরা বলেন- মহান আল্লাহ তায়ালা কওমে লূতকে রজম করেছেন এবং এর সাথে সামঞ্জস্যের ভিত্তিতেই রজমের দ্বারা যিনাকারীর শাস্তি বিধান করা হয়েছে। আর পুং মৈথুনজনিত পাপাচারীদ্বয় উভয়ে আযাদ হোক কিংবা গোলাম অথবা একজন কারো ক্রীতদাস হোক, এরা বালেগ হলে তাদের দু’জনকেই রজম করতে হবে।
তবে পুং মৈথুনকারী কিংবা কৃত তাদের উভয়ের একজন নাবালেগ হলে তাকে মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে নিম্নতর সাজা দিতে হবে। পক্ষান্তরে বালেগকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।
[পনের]
মদ্যপায়ীদের সাজা
মদ্যপানের সাজা নবী করীম (সা)-এর হাদীস এবং ইসলামী আইনজ্ঞদের ‘ইজমা’ (ঐক্যমত্য)-এর ভিত্তিতে প্রমাণিত। যে ব্যক্তি শরাব পান করবে, তাকে বেত্রাঘাত করতে হবে। পুনরায় পান করলে দ্বিতীয়বার তাকে কোড়া লাগাতে হবে। নবী করীম (সা) থেকে বর্ণিত যে, মদ্যপায়ীকে তিনি বারংবার বেত্রাঘাত করেছেন। অধিকন্তু খোলাফায়ে রাশেদীন, ইজমা এবং অধিকাংশ উলামার অভিমতও এটাই।
মদ্যপানের শাস্তিঃ মদ্যপানের সাজা নবী করীম (সা)-এর সুন্নত এবং মুসলমানদের ‘ইজমা’ (ঐক্যমত) দ্বারা প্রমাণিত।
এ পর্যায়ে হাদীস বিশারদ এবং রেওয়ায়েতকারীগণ বিভিন্ন সূত্রে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। নবী করীম (সা) বলেন-
********আরবী
“যে ব্যক্তি শরাব পান করবে তাকে কোড়া লাগাও, দ্বিতীয় বার পান করলে পুনরায় বেত্রাঘাত কর, আবার পান করলে আবারও কোড়া লাগাও, অতঃপর চতুর্থবার পান করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দাও”।
অধিকন্তু নবী করীম (সা) মদ্যপানের অপরাধে একাধিকবার বেত্রদণ্ড প্রদান করেছেন। তদুপরি পরবর্তীকালে খোলাফায়ে রাশেদীন এবং মুসলমানগণ একই অপরাধে বেত্রাঘাতের শাস্তি প্রদান করেছেন। সুতরাং এরই ভিত্তিতে মদ্যপানের অপরাধে হত্যার সাজা রহিত হয়ে গেছে বলে আলিমগণ অভিমত ব্যক্তি করে থাকেন। কিন্তু কারো কারো মতে এ সাজা ‘মুহকাম’ তথা স্থায়ী বিধান। পক্ষান্তরে কারো কারো মতে হত্যার মাধ্যমে দণ্ড দান করা ছিল একান্ত ‘তা’যীর’ অর্থাৎ শাসনজনিত সমাধান। সুতরাং প্রয়োজনবোধে ইমাম, রাষ্ট্রপতি কিংবা বিচারপতি এ দণ্ড বিধানেরও অধিকারী।
মহানবী (সা) থেকে প্রমাণ রয়েছে যে, তিনি শরাব পানের অপরাধে চল্লিশটি বেত্রাঘাত এবং জুতার দ্বারা প্রহার করেছেন। অনুরূপ সিদ্দীকে আকবর (রা) এ অপরাধে চল্লিশটি বেত্রাঘাত করেছেন। অপরপক্ষে হযরত উমর (রা) আপন খেলাফতকালে কোড়া মেরেছেন। কিন্তু হযরত আলী (রা) কখনো চল্লিশ (অবস্থাভেদে) আবার কখনো আশি কোড়ার হুকুম দিয়েছেন। কোন কোন আলিম বলেছেন, চল্লিশটি বেত্রাঘাত করা ওয়াজিব। কিন্তু মানুষ যদি মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং চল্লিশ বেত্রাঘাতে সাবধান না হয়, তবে এর অধিক বেত্র দণ্ড ইমাম কিংবা বিচারপতি রায়ের উপর নির্ভরশীল। অথবা অনুরূপ অন্য কোন কারণ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় চল্লিশের অধিক আশি ঘা বেত মারবে। আর যদি পানকারীদের সংখ্যা অল্প হয় অথবা ঘটনাক্রমে কেউ কখনো কদাচিৎ পান করে ফেলেছে তবে, এক্ষেত্রে চল্লিশ কোড়াই যথেষ্ট। বস্তুতঃ এ মতই অধিকতর বাস্তবমুখী ও যুক্তিসঙ্গত। ইমাম শাফি’ঈও (রহ) এ মতের সমর্থক। এক রেওয়ায়েত অনুযায়ী ইমাম আহমদও (রহ) এ মতই পোষণ করেন।
হযরত উমার (রা)-এর খেলাফতকালে মদ্যপানের অভিযোগ অধিকতর পরিমাণে আসতে থাকায় তিনি এর শাস্তির মাত্রাও বাড়িয়েছিলেন। এ জন্যে কাউকে দেশান্তরিত করেছেন আর কারো মাথা মুড়িয়ে অপমান করেছেন। সুতরাং এগুলো ছিল তাঁর শাসনমূলক অতিরিক্ত সাজা। শরাবীকে চল্লিশটি করে দু’বার বেত্রাঘাত করার পরও যদি ‘তা’যীর’ (অতিরিক্ত সাজা) করার প্রয়োজন পড়ে তবে তার খোরাক বন্ধ করে দিয়ে তাকে দেশান্তরিত করাই উত্তম।* (*টীকাঃ হযরত আবূ শাহ্জান সকফী (রহ) এক কালে মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিলেন। হযরত উমর (রা) শরীয়তের বিধান অনুযায়ী তাঁকে বেত্রাঘাত করেন; কিন্তু তিনি বিরত হননি। পুনরায় পান করেন; হযরত ফারুক আযম (রা)ও একই নিয়মে তাঁর উপর দ্বিতীয়বার শাস্তি প্রয়োগ করেন। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হল না; বার বার অভ্যাস মত তিনি শরাব পান করতে থাকেন আর কোড়ায় আঘাত সইতে থাকেন। অবশেষে হযরত উমর (রা) তাঁকে কয়েদ এবং দেশান্তর করে রাখার নির্দেশ দান করেন। এ পর্যায়ে তাঁকে হযরত সা’আদ (রা)-এর নিকট সোপর্দ করেন যে, যেখানেই তুমি থাকবে অথবা যাবে তাকে সঙ্গে রাখবে। তদুপরি বেড়ি লাগিয়ে তাকে পৃথকভাবে বসিয়ে রাখবে। হযরত সা’আদ (রা) আবূ শাহ্জানকে নিজের সঙ্গে নিয়ে তার পায়ে বেড়ি লাগিয়ে দিলেন। এখন যেখানেই তিনি যান তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। এমনিভাবে এক পর্যায়ে বিভিন্ন মনযিল অতিক্রম করে তিনি সুদূর ইরানের কাদেসিয়ার রণক্ষেত্রে উপনীত হন।
কাদেসিয়ার এ ভয়াবহ সময় হযরত সা’আদ (রা) ছিলেন মুসলিম বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। এ ঘোরতর লড়াইয়ে শত্রুপক্ষ প্রাধান্য বিস্তার করে মুসলিম বাহিনীর উপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে মুসলিম সেনাদল তিনশ ষাট মাইল পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এ পশ্চাদপসরণের আড়ালে নতুন প্রেরণায় বলীয়ান হয়ে ইসলামী বাহিনী চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সেনাপতি হযরত সা’আদ (রা) ইতিপূর্বে সামান্য জখম হওয়ার কারণে মূল রণাক্ষনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। অবশ্য একটি ভবনের ছাদে বসে তিনি যুদ্ধের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকনে। এরি মধ্যে এক পর্যায়ে লড়াই প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে। শত্রুপক্ষের প্রচণ্ড আক্রমণের মুকাবিলায় টিকতে না পেরে মুসলমানগণের পশ্চাদপসরণ লক্ষ্য করে পরিতাপের সুরে তিনি বার বার- ********আরবী
“শক্তি সঞ্চালনী এ দু’আটি উচ্চারণ করতে থাকেন”। ঘটনাক্রমে হযরত আবূ মাহ্জান (রা) এ সংকটজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারেন। কেননা হযরত সা’আদ (রা) যে বাড়ীতে বাস করছিলেন তার নীচ তলায় শিকল বেঁধে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল। মুসলমানদের এ শোচনীয় অবস্থা দৃষ্টে তিনি অধীর আবেগে কান্না বিজড়িত কন্ঠে সে কবিতাটি বারংবার আবৃত্তি করতে থাকেন। তাহলো- ********আরবী
“ আজ আমার অন্তহীন দুঃখ-বেদনা এবং সীমাহীন জ্বালা-যন্ত্রণার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, দুশমনের মুকাবিলায় রণক্ষেত্রে অন্যরা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে আর আমি শিকল বাঁধা পায়ে হা হুতাশ করে মরছি”। এমনি ছড়া ছন্দ আবৃত্তির আড়ালে তিনি চোখের পানি ফেলতে থাকেন। কিন্তু কি করবেন কোন উপায় নাই। মর্ম জ্বালায় টিকতে না পেরে অবশেষে হযরত সা’আদ (রা)-এর স্ত্রীর নিকট আবেদন করলেন- হে পুণ্যবতী মহিলা! হে হাফসা তনয়া! আল্লাহর নামে আমায় মুক্ত করে দিন আর পায়ের শিকল খুলে দিন। কেননা মুসলমানরা লড়ে যাচ্ছে অথচ আমি জিহাদের ফজীলত ও এর পুণ্য সুফল থেকে বঞ্চিত। মুসলমানদের উপর কঠিন সংকট আপতিত আর আমি শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় সময় কাটাচ্ছি। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি- যুদ্ধের ময়দান থেকে যদি নিরাপদে ফিরে আসতে পারি তবে পুনরায় নিজ হাতে আপন পায়ের শিকল জড়িয়ে নেব। আর বর্তমানের ন্যায় এমনিভাবে আমাকে শিকল পরিয়ে দেবেন। অতঃপর হযরত সা’আদ (রা)-এর স্ত্রী স্বামীর অসন্তুষ্টির পরোয়া না করে আবু মাহ্জানের পায়ের বেড়ী খুলে দেন।
সদ্যমুক্ত আবূ মাহ্জান আবেদন করলেন- হে পুণ্যবতী নারী! সওয়ারীর উদ্দেশ্যে আমার জন্য একটি ঘোড়ার বন্দোবস্ত করে দিন। সুতরাং হযরত সা’আদ-পত্নী স্বামীর বিনা অনুমতিতেই হযরত সা’আদ (রা)-এর ‘আবলক (স্বেত-কৃষ্ণ) ঘোড়া’ লৌহ বর্ম, বর্শা এবং তাঁর তরবারী এনে হযরত আবূ মাহ্জান (রা)-এর হাতে সোপর্দ করে দিলেন। হযরত আবূ মাহ্জান (রা) তৎক্ষণাৎ অশ্বে আরোহণ করে অশ্ব ছুটিয়ে চোখের পলকে রণ’ঙ্গনে পৌঁছে গেলেন এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হযরত আবূ মাহ্জান বীর বিক্রয়ে শত্রু পক্ষের রক্ষাবুহ্য ছিন্ন করে প্রচণ্ড আক্রমণে তাদের কচু কাটা করতে শুরু করলেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ, অপ্রতিরোধ্য আঘাতের ফলে শত্রু বাহিনী ছত্র ভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং শোচনীয় পরাজয়ের মুখে তাদের দেখতে হয়। এতক্ষণে উপস্থিত সকলে পরস্পর বলাবলি করতে থাকে- মুসলমানদের সাহায্যে আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে ফিরিশতা নাযিল করেছেন এবং তিনি আলৌকিক কার্য করে যাচ্ছেন। এদিকে সেনাপতি হযরত সা’আদ (রা)ও এক অসাধারণ যুদ্ধের বীরত্ব পূর্ণ খেলা প্রত্যক্ষ করে বলতে থাকেন-
**********আরবী
“ অশ্বের তীব্রগতি এবং বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া দৃষ্টে মনে হয় এটি আমারই আবলাক ঘোড়া আর সাফল্য ও বিজয়ের প্রতি লক্ষ্য করলে মনে হয় এ যেন আবূ মাহ্জানেরই বিজয়। অথচ আবূ মাহ্জান শৃংখলাবদ্ধ অবস্থা এবং বন্দীদশায় দিন গুনছে”।
পরিশেষে এ যুদ্ধে মুসলমানদের অভাবনীয় বিজয় লাভ হয়। পক্ষান্তরে শত্রু পক্ষের শোচনীয় পরাজয় ঘটে- যা ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এদিকে আবূ মাহ্জান (রা) রণক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তন করে কথানুযায়ী পায়ে শিকল বেঁধে যথাস্থানে বসে পড়েন। কিন্তু হযরত আবূ মাহ্জানের কৃতিত্ব এবং ঐতিহাসিক ঘটনা গোপন থাকার বিষয় নয়। হযরত সা’আদ (রা) এতক্ষণে বাড়ীর ছাদ থেকে নীচে নেমে আপন স্ত্রী বিনতে হাফসাকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন- মুসলমানগণ নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে ছিল কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে ফিরিশতা নাযিল করায় তাদের যে পরাজয় বিজয়ে রূপ লাভ করে। কিন্তু তার ঘোড়াটি ছিল আমারই ঘোড়ার ন্যায়। আর বর্শা, বর্মও ছিল আমার অশ্বগুলোরই অনুরূপ। ময়দানে নেমেই সে এমনভাবে শত্রু নিধন করে যার ফলে শত্রু বাহিনীতে মাতম শুরু হয় এবং তারা ছত্র ভঙ্গ হয়ে পড়ে। অতঃপর সে ফিরিশতা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়।
হযরত সা’আদ (রা)-র স্ত্রী বিনম্র বদনে আবেদন করলেন- আপনি কি চিনতে পারছেন সে কে ছিল? ইনি সেই বীর পুরুষ যাকে আবূ মাহ্জান বলা হয় আর সে শৃংখলাবস্থায় আপনার ঘরে দিন গুনছে। মুসলমানদের পরাজয় সংবাদ শুনে কসম খেয়ে আমাকে বলতে থাকে- “ আমায় মুক্ত করে জিহাদের ময়দানে যুদ্ধ করতে দিন। জীবিত থাকলে ফিরে এসে আপন পায়ে নিজ হাতে শিকল পরে নেব। তার কথায় আস্থা রেখে আমি তার বন্ধন খুলে দেই। অতঃপর সে আপনার ঘোড়াটি প্রার্থনা করলে আমি তাকে আপনার ঘোড়া প্রদান করি। আর আপনার তরবারী বর্শা, বল্লম ইত্যাদি অস্ত্র শস্ত্রের আবেদন করলে, সেই সবই আমি তার হাতে অর্পণ করি। যাবতীয় অস্ত্র হাতিয়ার সহ সে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতঃপর মুসলমানদের জয় লাভের পর ফিরে এসে সে নিজ পায়ে শিকল বেঁধে যথাস্থানে বসে যায়। সেনাপতি হযরত সা’আদ (রা) আবূ মাহ্জান (রা)-র সাহসিকতা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের বাস্তব ঘটনা শুনে চিৎকার দিয়ে উঠেন। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলতে থাকেন- আবূ মাহ্জানের ন্যায় বীর বাহু খলীফার নির্দেশে সর্বক্ষণ শিকল বেঁধে আটক পড়ে থাকবে এটা কেমন কথা? তৎক্ষণাৎ তিনি হযরত আবূ মাহ্জান (রা) সকল বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করে আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা)-র খিদমতে পত্র প্রেরণ করেন। হযরত উমর (রা) পত্র পাঠে বিস্তারিত বিষয় অবহিত হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে হযরত আবূ মাহ্জান (রা)-র নামে চিঠি লিখেন-
*********আরবী
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর বান্দা উমরের পক্ষ হতে আবূ মাহ্জান বরাবরে। আল্লাহ (তোমায় আরও তাওফীক দিন) হে আবূ মাহ্জান!”।
সেনাপতি হযরত সা’আদ (রা) অবাক হয়ে বলতে থাকেনঃ আল্লাহর কসম! এমন ব্যক্তিকে কখনো আমি প্রহার করবো না। দ্বিতীয়তঃ আর কখনো শিকল বেঁধে রাখাটাও সমীচীন নয়। তোমরা লক্ষ্য করে থাকবে, মুসলমানরা কি দারুণ সংকটে পরিবেষ্টিত ছিল, ইসলাম ও কুফরের মধ্যে ছিল এক আপোষহীন সংগ্রাম। এমনি কঠিন পরীক্ষার চরম মুহূর্তে আবূ মাহ্জানের আত্মত্যাগ নিষ্ঠাপূর্ণ কৃতিত্ব ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। এমনি সপ্রশংসা উক্তির পর পরই হযরত আবূ মাহ্জানন (রা) বলে উঠেন- আল্লাহর কসম! জীবনে আর কখনো শরাব পানের নামও নেব না, এখন থেকে জীবনের তওবা করছি। বাকি জীবনের জন্য, আমি মদ বা শরাব স্পর্শ না করার প্রতিজ্ঞা এবং তওবা করছি। পরবর্তীকালে আল্লাহ তায়ালা হযরত আবু মাহ্জান (রা)-কে আপন তওবায় আমরণ সুদৃঢ় অটল থাকার তৌফিক দান করেছিলেন। )
কোন কোন নায়েব বা প্রতিনিধি মদের প্রশংসায় কবিতা, ছন্দ রচনা করেছেন- এ মর্মে সংবাদ পাওয়ার পর হযরত উমর (রা) তাকে পদচ্যুত করেছেন। নবী করীম (সা) যে মদ ‘হারাম’ ঘোষণা করেছেন এবং সে মদ পান করলে কোড়া লাগিয়েছেন তা হলো যদ্দারা নেশা হয় আর আক্ল-বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়, এর উপাদান যাই থাকুক এবং যে কোন জিনিস দ্বারাই তা প্রস্তুত করা হোক না কেন। যেমন আঙ্গুর, খেজুর, আঞ্জীর ইত্যাদি। অথবা তরকারী বা সবজি থেকে। যথা, গম, যব ইত্যাদি। কিংবা মধু ইত্যাদি জাতীয় তরল পদার্থ থেকে তৈরী করা হোক। কিংবা পশুর দুগ্ধ দ্বারা তৈরী করা হোক।
সকল প্রকার মদ নিষেধের অন্তর্ভুক্ত। অধিকন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) –এর উপর শরাব হারামকারী কুরআনের আয়াত যখন নাযিল হয়, তখন মদীনা শরীফে আঙ্গুরের নাম গন্ধও বর্তমান ছিল না।
সিরিয়া কিংবা অন্যান্য দেশ থেকে আঙ্গুর আমদানী করা হতো। তৎকালীন আরবে সাধারণতঃ খেজুর কিংবা খেজুর ভিজানো পানি থেকে শরাব প্রস্তুত করা হত। কিন্তু এ সম্পর্কে নবী করীম (সা)-এর সহীহ হাদীস খোলাফায়ে রাশেদীন এবং সাহাবা কিরামগণ থেকে যা প্রমাণিত রয়েছে, তাহলো নেশা জাতীয় প্রত্যেক জিনিসই হারাম। মহানবী (সা) নেশা জাতীয় এমন প্রতিটি বস্তু হারাম ঘোষণা করেছেন, যা সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির বিলুপ্তি ঘটায় এবং জ্ঞান বা চিন্তা শক্তি বিনষ্ট করে দেয়। বস্তুতঃ সাহাবায়ে কিরাম স্বভাবতঃ সুমিষ্ট ‘নবীযে তমর’ (খেজুর ভিজানো পানি) পান করতেন যার প্রস্তুত প্রণালী ছিল খেজুর কিংবা অযুর পানিতে ভিজিয়ে রাখা হত এবং নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রয়োজন মত তা পান করতেন। কেননা হিজাযের পানি সাধারণতঃ লবনাক্ত এবং সুপেয় পানি এখানকার জনজীবনে ছিল এক দুর্লভ বস্তু। কিন্তু নবীয পান করা ততক্ষণ পর্যন্তই জায়েয, যতক্ষণ পর্যন্ত তাতে নেশা বা মাদকতার আমেজ না ঘটে। সকল মুসলিম মনীষী এবং গোটা মুসলিম উম্মাহর এটাই সর্ববাদীসম্মত অভিমত। কেননা তাতে নিশা হয় না। আঙ্গুরের শিরা নিশা ধরার পূর্ব পর্যন্ত পান করা জায়েয। নবী করীম (সা) কাষ্ঠ নির্মিত পাত্র অথবা কালাই করা ধাতব ভাণ্ডে নবীয তৈরী করতে নিষেধ করেছেন। বরং তিনি এমন কাঁচা পাত্রে নবীয তৈরী করার হুকুম দিয়েছেন যার মুখ আটকিয়ে রাখা যায়। এর অন্তর্নিহিত কারণ হল, নিশাদার হলে পর এসব কাঁচা পাত্র ফেটে যায়। যার ফলে সহজেই বুঝা যায় যে, রক্ষিত নবীয নিশাদার হল কি না। পক্ষান্তরে কালাই করা ধাতব পাত্রে নবীযে নিশা আশার পর ফাটে না কিংবা বাহ্য দৃষ্টিতে তাতে কোনরূপ চিহ্নও ফুটে উঠে না।
সুতরাং পানকারীর ধোকায় পড়া কিংবা ভুল করার কোন আশংকা বিদ্যমান থাকে না। অবশ্য অপর এক রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (সা) পরবর্তীকালে কালাইকৃত ধাতব পাত্রে নবীয তৈরীর অনুমতি দান করেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা) ফরমান-
***********আরবী
“ আমি তোমাদেরকে কালাইকৃত ধাতবপাত্রে নবীয তৈরী করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু (এখন) তোমরা তাতে তৈরী কর, অবশ্য নেশাদার হয়ে গেলে তোমরা তা পান করো না”।
এ সম্পর্কে সাহাবী এবং পরবর্তী যুগের আলিমগণের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। পূর্ববর্তী হুকুম বাতিল হওয়ার সম্পর্কে যারা অবহিত ছিলেন না কিংবা যাদের নিকট এ জাতীয় পাত্রে নবীয তৈরী করা প্রমাণিত হয়, তাঁদের মত হল এ জাতীয় পাত্রে নবীয তৈরী করা নিষিদ্ধ।
অপরপক্ষে যারা মনে করতেন, পূর্ব হুকুম বাতিল হয়ে গেছে, তারা এসব পাত্রে নবীয তৈরী করার অনুমতি দিতেন।
অপরদিকে ফকীহগণের এক দল যখন জানতে পারলেন যে, কোন কোন সাহাবী নবীয পান করতেন- তখন তাঁরা মনে করলেন যে, নেশাযুক্ত নবীয পান করতেন। কাজেই তাঁরা বিভিন্ন প্রকারের শরবত বা পানীয় পান করার অনুমতি দান করেন। কিন্তু তা যেন আঙ্গুর ও খেজুর ইত্যাদি দ্বারা প্রস্তুত না হয়। পক্ষান্তরে নেশাযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত নবীযে তমর’ ও কিসমিসের শিরা বা রস পান করার অনুমতি দান করেন।
কিন্তু বিশুদ্ধ ও সঠিক পন্থা এটাই- যা গোটা মুসলিম উম্মাহ্ তথা জমহুরের সর্ববাদী সম্মত মত, আর তা হলো নেশাদার জ্ঞান লোপকারী প্রত্যেক জিনিসই ‘খমর’ তথা মদ হিসেবে গণ্য। আর তা পানকারীর উপর হদ্দ জারী করতে হবে, চাই এক কৌটাই পান করুক কিংবা ঔষধ হিসাবেই পান করে থাকুক। কেননা নবী করীম (সা) ‘খমর’ ব্যতীত অন্য কোন ঔষধ যদি না পাওয়া যায় তবে? প্রশ্নের জবাবে ইরশাদ ফরমান-
******আরবী
“এটাতো রোগ- ঔষধ নয় এবং নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ আমার উম্মতের রোগ মুক্তি হারাম বস্তুতে নিহিত রাখেননি”।
মদ্যপানের সাক্ষী পাওয়া গেলে অথবা মদ্যপায়ী নিজে স্বীকার করলে শরাব-খোরের উপর হদ্দ জারী করা ওয়াজিব। কিন্তু মুখ থেকে মদ বা শরাবের দুর্গন্ধ বের হয় কিংবা মানুষ তাকে বমি করতে দেখেছে অথবা মদ্যপানের অন্য কোন নিদর্শন তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, তাহলে এমতাবস্থায় বলা হয়েছে যে, তার উপর হদ্দ জারী করা যাবে না। কেননা, এটা নেশাবিহীন শরাব অথবা সে অজ্ঞাতসারে পান করেছে কিংবা বলপূর্বক তাকে পান করানো হয়েছে ইত্যাদি সম্ভাবনা এসব ক্ষেত্রে বিদ্যমান রয়েছে। বরং শরাব নেশাযুক্ত হলে তাকে কোড়া লাগাতে হবে। খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবা কিরাম বা হযরত উসমান, হযরত আলী এবং হযরত ইবনে মাসউদ (রা) প্রমুখ এ মতের সমর্থনকারী। সুন্নতে নববীও এরই প্রতি ইঙ্গিত বহন করে, মানুষের বাস্তব আমলও অনুরূপ। অধিকন্তু ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ (রহ)- এর মযহাবও এটাই এবং তাঁরা এর বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দান করেছেন।
আঙ্গুর এবং খেজুর পাক করে যে শরাব তৈরী করা হয় সেটাও হারাম আর এর পানকারীকে বেত্রদণ্ড দিতে হবে। এটা খমর বা মদের চেয়েও অধিক নিকৃষ্টতর। কেননা, এ দ্বারা জ্ঞান ও মন-মেযাজ উভয়ই নষ্ট হয়। এমনকি এর প্রভাবে সুস্থ মানুষ ক্লৈবত্বের শিকার হয় এবং চরিত্রে সৃষ্টি হয় দায়ূছী স্বভাব। দ্বিতীয়তঃ শরাব বা মদ অধিক অনিষ্টকারী ও খবীস এ জন্যে যে, এর ফলে লোক সমাজে কলহ বিবাদ, মারামারী হানাহানির ন্যায় মারাত্মক সামাজিক তিক্ততার সৃষ্টি হয় এবং চারিত্রিক ঘৃণ্য ব্যাধি জন্ম নেয়। অধিকন্ত এটা যেমন বান্দাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখে, তদ্রূপ নামায থেকে ঐ ব্যক্তিকে দূরে সরিয়ে নেয়।
পরবর্তী যুগের কোন কোন ফকীহ মদ্যপানের অপরাধে হদ্দ জারী করা থেকে নিরবতা অবলম্বন করেছেন। তাঁদের মতে হদ্দের চেয়ে নিম্নতর সাজা অর্থাৎ তা’যীর করতে হবে। কেননা এর দ্বারা জ্ঞান ও চরিত্রের বিকৃতির সম্ভাবনা বিদ্যমান, যা ভাং পানের সমতুল্য। অপরদিকে মুতাকাদ্দিমীন (প্রাথমিক যুগের) ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ওলামাগণ থেকে এ সম্পর্কিত কোন সিদ্ধান্ত বা মীমাংসার প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ এ ঘাস-পাতা এরূপ নয় বরং মানুষ মনের আনন্দে এগুলো খেয়ে থাকে এবং এমন আগ্রহ নিয়ে থাকে যে, পরিমাণে আরও বেশী বলে আরও খাবে যেমনটি শরাব ও খমরের বেলায় করে থাকে। এতে অধিকাংশ সময় আল্লাহর স্মরণে অনাসক্তি ইত্যাদি ত্রুটি এসে যায়। আর পরিমাণে বেশী হলে নামাযেও ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয়। অধিকন্তু দায়ূছী, ক্লৈবত্ব’ সৃষ্টি হয় এবং জ্ঞান-বুদ্ধি ও মন-মগজে বিনষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু এটা যদি গাঢ় ও কঠিন হয়, আনুষঙ্গিক খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং মদের প্রকারভুক্ত না হয়, এমতাবস্থায় এর নাপাক বা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে তিন ধরনের অভিমত লক্ষ্য করা যায়।
(১) ইমাম আহমদ (রহ) ও অন্যান্যের মযহাব অনুযায়ী মদের ন্যায় এটিও নাপাক। এ মতই বিশুদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য।
(২) কারো কারো মতে জামেদ তথা কঠিন হওয়ার কারণে এটা নাপাক নয়।
(৩) কেউ কেউ কঠিন ও তরলের মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করেছেন। মোটকথা, এটাও আল্লাহ ও নবী করীম (সা) কর্তৃক হারাম কৃত জিনিসের শামিল।
কেননা, শাব্দিক ও আর্থিক উভয় দিক থেকেই এটা মদ, শরাব, খমর ও নেশাযুক্ত বস্তু।
হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি মহানবী (সা)-এর খিদমতে আরয করেন, হে রাসূলুল্লাহ! আমাদের ইয়ামানে প্রস্তুত ‘তুবা’ ও ‘মীযার’ নামীয় দু’ধরনের মদ সম্পর্কে ফয়সালা দান করুন। ‘তুবা’ মধু থেকে তৈরী করা হয়। এগুলোর মধ্যে তেজী ভাব এলে নেশার পর্যায়ে পৌঁছে, তখন এসবের হুকুম কি? মহানবী (সা) অল্প কথায় অধিক অর্থবোধক বাক্যের অধিকারী ছিলেন। সুতরাং উত্তরে তিনি বলেন-
********আরবী
“ প্রত্যেক নেশাদার বস্তুই হারাম”। (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত নু’মান ইবনে বশীর (রা) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা) বলেছেন-
*********আরবী
গম থেকে এক প্রকার শরাব প্রস্তুত করা হয়। আর যব, কিসমিস, খেজুর এবং মধু থেকেও প্রস্তুত করা হয়। আমি নেশা ও মাদকতা সৃষ্টিকারী প্রত্যেক বস্তু হারাম ঘোষণা করছি। (আবু দাঊদ)
কিন্তু উক্ত রেওয়ায়েত বুখারী ও মুসলিমে হযরত উমর (রা)-র উক্তিরুপে চিহ্নিত। আর নবী (সা) করীম (সা)-এর মিম্বরে দাঁড়িয়ে তিনি মন্তব্য করেন-
******আরবী
“খমর সেটাই- যা জ্ঞান লোপ করে দেয়”।
অপর এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত…
******আরবী
“নেশা সৃষ্টিকারী প্রতিটি বস্তুই খমর আর সর্বপ্রকার খমর হারাম”। ইমাম মুসলিম তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থ সহীহ মুসলিমে দুটি রেওয়াতেই বর্ণনা করেছেন।
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন-
*******আরবী
“নেশা সৃষ্টিকারী প্রত্যেক বস্তুই হারাম। আর যে বস্তু এক মটকা পরিমাপ পান করলে নেশা ধরে, তার এক আজঁলা পরিমাণও হারাম”।
হাদীস বিশারদগণ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (সা) বলেছেন-
*******আরবী
“ যে জিনিস অধিক পান করলে নেশা ধরে, তার কিঞ্চিৎ পরিমাণও হারাম”।
হাদীসবিদগণ রেওয়ায়েতটি বিশুদ্ধ বলে স্বীকার করেছেন।
হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত- কোন ব্যক্তি মহানবী (সা)-কে প্রশ্ন করলঃ “আমাদের অঞ্চলে মীযর নামে এক প্রকার বীজ থেকে তৈরী করা হয়। এ সম্পর্কে আপনার হুকুম কি?” জবাবে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন-
*********আরবী
“উহা কি নেশা সৃষ্টি করে?”
লোকটি বললেনঃ জি-হাঁ।
হুযূর (সা) ইরশাদ করলেন-
*******আরবী
“নেশা সৃষ্টিকারী প্রত্যেক বস্তু হারাম। আর যে ব্যক্তি নেশা সৃষ্টিকারী পানীয় পান করবে- আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে ‘তীনাতুল খাবাল’ পান করাবার হুমকি রয়েছে”। সাহাবীগণ আরয করলেন-
******আরবী
“ হে রাসূলুল্লাহ! ‘তীনাতুল খাবাল’ কি জিনিস?” হুযূর (সা) ইরশাদ করেন-
*******আরবী
দোযখীদের (দেহ থেকে নির্গত)ঘর্ম, অর্থাৎ তরল দুর্গন্ধময় পদার্থ”। (সহীহ মুসলিম)
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা) বলেছেন-
*******আরবী
“নেশা সৃষ্টিকারী জিনিস মাত্রই খমর আর প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারীই হারাম”। (আবূ দাঊদ)
মোটকথা, এ সম্পর্কিত অগণিত হাদীস বর্ণিত রয়েছে। হুযূর আকরাম (সা)-এর কথা যেহেতু ‘জাওয়ামিউল কালিম’ (ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য), তাই সব কিছুকে সংরক্ষিত আকারে প্রকাশ করাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর উক্তি হলো, জ্ঞান বুদ্ধি লোপকারী এবং নেশা সৃষ্টিকারী প্রতিটি বস্তু হারাম। চাই সে খাদ্য হোক কিংবা পানীয়।১ (টীকা-১ঃ মানব দেহের জন্যে চরম ক্ষতিকারক মাদকদ্রব্য এদেশ সহ কত দেশের কত পরিবারের মেধাবী সুস্থ সন্তানদের জীবন বিনষ্ট করেছে, বাংলাদেশের সমাজ জীবনে এবং বিভিন্ন পরিবারে এর ভয়াবহ ও যন্ত্রণাদায়ক দৃষ্টান্ত থেকে অনুমেয়।) তাই, শরাব বা খমর নেশা সৃষ্টি করে বলেই হারাম। মুতাকাদ্দিমীন এর কোনো গুণাগুণ সম্পর্কে আলোচনা করেননি। কেননা হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দী কিংবা তার নিকটবর্তী কোনও এক সময় এর উৎপাদন শুরু হয়। যেমনি ভাবে বহু প্রকার মদ নবী করীম (সা)-এর পরবর্তী যুগে তৈরি হতো। কিন্তু তা সবই সে অভিন্ন কারণ ও ‘ব্যাপক কার্যবোধক’ মহান বাক্যের আওতায় এসে যায়, যেগুলো কুরআন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।