[ষোল]
অপবাদের শাস্তি
অপবাদ দেয়ার (কাযাফ) শাস্তি, চরিত্রবান ব্যক্তির উপর যিনার মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা এবং দোষারোপকারীকে বেত্রাঘাতের সাজা প্রদান-
যে সকল হদ্দ বা সাজা সম্পর্কে কুরআন হাদীসের প্রমাণাদি বিদ্যমান, অধিকন্তু যার উপর মুসলিম উম্মাহর ‘ইজমা’ তথা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ‘হদ্দে কযফ’ ও সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত। কোনও চরিত্রবান ব্যক্তির (মুহসিন)-উপর কোন লোক যিনা কিংবা লাওয়াতাত (সমকামিতা)-এর মিথ্যা অভিযোগ আনলে, উক্ত দোষারোপকারী লোকটিকে বিচারক কর্তৃক আশিটি বেত্রদণ্ড প্রদান ওয়াজিব হয়ে যায়। এক্ষেত্রে, ‘মুহসিন’ অর্থ মুক্তজ স্বাধীন এবং নির্মল নিষ্কলংক চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি। পক্ষান্তরে যিনার শাস্তির ক্ষেত্রে উল্লেখিত ‘মুহসিন’ শব্দের তাৎপর্য হল, শরীয়ত পদ্ধতিতে বৈধ বিবাহের ভিত্তিতে আপন স্ত্রীর সাথে সহবাসকারী ব্যক্তি। (ইতিপূর্বে যার আলোচনা হয়েছে।)
[সতের]
যেসব অপরাধের সাজা অনির্ধারিত
এবং শাসক ও বিচারকের ইচ্ছাধীন
যে সকল গুনাহ বা অপরাধের সাজা অনির্দিষ্ট অধিকন্তু কাফ্ফারারও কোন উল্লেখ নেই, সেগুলোর দণ্ড বা সাজা, শিক্ষামূলক শাস্তি বিচারক কিংবা শাসনকর্তার রায়ের উপর নির্ভরশীল। স্থান কাল পাত্র ভেদে এবং ক্ষেত্র বিশেষে এর যথাযোগ্য দণ্ড বিধানে তাদেরই ভূমিকা এই পরিচ্ছেদের আলোচনা।
যে সকল অপরাধের নির্দিষ্ট শাস্তি কিংবা কাফফারার কোন উল্লেখ নেই যেমন কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক কিংবা পরনারীকে চুমো খাওয়া, একমাত্র সহবাস ছাড়া মিলন পূর্ব আনুষঙ্গিক ক্রিয়া কলাপে লিপ্ত হওয়া, হারামবস্তু যথা প্রবাহিত রক্ত, মৃতজন্তুর গোশত ইত্যাদি খাওয়া, যিনা ব্যতীত মিথ্যা অপবাদ, অরক্ষিত বস্তু চুরি করা, ‘নিসাব’১ (টীকা-১ঃ নিসাব বলা হয় ঐ পরিমাণ অর্থ-সম্পদ কেউ যার মালিক হলে, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়।) অপেক্ষা কম বস্তু চুরি করা, আমানতের খেয়ানত (বিশ্বাস ভঙ্গ) করা, যেমনটি করে থাকে বায়তুল মালের কোষাধ্যক্ষ এবং মুতাওয়াল্লী, ওয়াকফ সম্পত্তির মুতাওয়াল্লী কিংবা পিতৃহীন ইয়াতীমের অভিভাবকরা অথবা যৌথ ব্যবসায়ের অংশীদাররা। দৃষ্টান্তস্বরূপ যেমন-বিশ্বাস ভঙ্গ, আচার-ব্যবহার এবং আদান-প্রদানে প্রতারণা করা, খাদ্যবস্তু, ভোগ্যপণ্য কিংবা কাপড়ে প্রবঞ্চনা করা, মাপে কম বেশ করা, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানে উৎসাহ দেয়া, ঘুষ খাওয়া, আল্লাহ্র হুকুমের বিপরীত হুকুম দেয়া, প্রজা কিংবা জনসাধারণের উপর অন্যায়-অত্যাচার অবিচার উৎপীড়ন করা, জাহেলী যুগের বাক্য উচ্চারণ কিংবা জাহেলী যুগের দাবী উঠানো, শরীয়তের নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। এ জাতীয় অপরাধীদের সাজা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও চরিত্র গঠন, সংশোধনমূলক শিক্ষণীয় দণ্ড বিধান করা, এই সবগুলো বিষয় বিচারক কিংবা শাসনকর্তার ইখতিয়ারভূক্ত। এসব ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা অধিক কি অনাধিক ইত্যাদি পরিস্থিতি যাচাই করে তাঁরা শাস্তি বিধান করবেন। অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেলে কিংবা স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে, শাস্তির পরিমাণ অধিক ও কঠোর হওয়া বাঞ্চনীয়। কিন্তু অপরাধমূলক ঘটনাবলীর পরিমাণ ও মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থার আওতায় থাকলে, শাস্তিও সে অনুপাতে হালকা বা লঘু হওয়া উচিত। মোটকথা, জনগণ ব্যাপকহারে অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে থাকলে এবং অভ্যস্ত হয়ে পড়লে শাস্তিও কঠোর এবং গুরুদণ্ড হওয়া বাঞ্চনীয়। পক্ষান্তরে ছোটখাট ও স্বল্প মাত্রার অপরাধে লঘুদণ্ডই বিধেয়।
বড় ছোট অপরাধের আনুপাতিক হারে সাজা নির্ধারিত হওয়া উচিত। যেমন, ঘটনাক্রমে একজন মহিলা কিংবা একটি বালককে অসৎ উদ্দেশ্যে উত্যক্তকারী অপরাধীর দণ্ড ঐ ব্যক্তির তুলনায় কম হওয়া উচিত, যে ব্যক্তি সদাসর্বদা নারী ও বালকদের অসৎ কাজে প্ররোচিত ও উত্যক্ত করে থাকে। এখন ‘তাযীর’ তথা শিক্ষা, শাসন ও দৃষ্টান্তমূলক সাজার পরিমাণ কি হবে? নির্দিষ্টভাবে তার কোন উল্লেখ নেই। তাযীরের মূল উদ্দেশ্য হলো কষ্ট ও পীড়া দেয়া। এখন কথা বা কাজের দ্বারা, বাক্যালাপ বন্ধ করে কিংবা তার সাথে পূর্ব যে ধরনের আচার-আচরণ করা হতো, সে ধরনের আচার ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে হোক কিংবা আদেশ-উপদেশের মাধ্যমে অথবা ভীতি প্রদর্শন এবং সাবধান ও হুশিয়ারী উচ্চারণের দ্বারা তাযীর সম্পন্ন করবে। মোটকথা, তাকে এমন কষ্ট দেয়া যার ফলে তাযীর বা শাসনের কাজ হয়ে যায়। অধিকন্তু কোন কোন সময় সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সালাম কালাম কথা বার্তা বন্ধ করার দ্বারাও এ উদ্দেশ্য সাধন হতে পারে।
বস্তুত এর উদ্দেশ্য হল, অনুরূপ কার্যকলাপ থেকে তওবা না করা পর্যন্ত তাকে তাযীর করা উচিত। যেমন মহানবী (সা) জিহাদে শরীক না হওয়ার কারণে তিনজন সাহাবীর সালাম কালাম এবং কথা বার্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ১ (টীকা-১ঃ উক্ত তিনজন সাহাবী হলেন- হযরত কা’ব ইবনে মালিক, হেলাল ইবনে উমাইয়্যা এবং মুরারাহ ইবনে রবী (রা)। এ তিন জনের তওবা কবুল হওয়া সম্পর্কে কুরআনে করীমের ইরশাদ হচ্ছে-
*******আরবী
“আর ঐ তিন জন যাদের ব্যাপারে ফয়সালা আল্লাহ্র নির্দেশের অপেক্ষায় মূলতবী রাখা হয়েছিল তাদেরও অবস্থা এই যে, আল্লাহ্র যমীন বিশাল-বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তাদের উপর তা সংকীর্ণ ও সংকুচিত হয়ে যায় এবং নিজেদের জীবনের প্রতিও তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। অধিকন্তু তাদের বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয় যে, আল্লাহ্র পাকড়াও থেকে মুক্তির ব্যাপারে তিনি ছাড়া তাদের দ্বিতীয় কোন আশ্রয়স্থল নেই। অতঃপর আল্লাহ তাদের তওবা কবূল করেন যেন তারা তওবায় অটল থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতিশয় তওবা গ্রহণকারী এবং পরম দয়ালু”। (সূরা তওবাঃ ১১৮)
মহানবী (সা) এ তিনজন সাহাবীর সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করে কার্যতঃ তাদেরকে বয়কট করার জন্য সকলের প্রতি নির্দেশ দেন। তাদের সালাম কালাম, কথা বার্তা বন্ধ করে দেন। এমনকি পরিবারস্থ লোকজন পর্যন্ত তাদের সাথে চলা-ফেরা আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দেয়। ফলে তাদের অবস্থা দাঁড়ায় এই, যা উল্লেখিত আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারটা ঘটেছিল হিজরী দশম সালে সংঘটিত ‘তবুক যুদ্ধের সময়। তবুক যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য কঠিন পরীক্ষার বিষয়। কেননা একদিকে প্রচণ্ড গরমের মৌসুম, সফর ছিল অতি দূর দূরান্তের। সহায় সম্বল বলতে কিছুই ছিল না। তদুপরি মদীনাবাসীদের গোটা বছরের খাদ্যের ব্যবস্থা খেজুর কাটার পুরা মৌসুম। ফলে সবাই চিন্তিত ছিল যে, এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধ যাত্রা কিভাবে সম্ভব?
সুতরাং এ যুদ্ধে মদীনাবাসীরা পাঁচ দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। (১) মহানবী (সা) মুহাজির এবং আনসারগণ। যে কোন পরিস্থিতিতে তাঁরা যুদ্ধ যাত্রার দৃঢ় সংকল্পে সর্বোতভাবে প্রস্তুত হয়ে যান। (২) মুহাজির ও আনসারদের যে সকল লোক, প্রথমতঃ যুদ্ধ যাত্রায় দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। কিন্তু পরিশেষে যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে তাঁরা প্রস্তুত হয়ে যান এবং রওনা দেন। (৩) এ দলে মাত্র তিনজন ছিলেন। অবহেলা ও অলসতার দরুন যারা যুদ্ধ যাত্রা থেকে বিরত থাকেন। নবী করীম (সা) যুদ্ধ থেকে মদীনা প্রত্যাবর্তনের পর এরাও হুযূর (সা)-এর খিদমতে হাজির হন। তাদেরকে জিহাদের শরীক না হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে তারা সত্য সত্য ঘটনাই ব্যক্ত করেন যে, আমাদেরই অপরাধ, বিনা কারণে আমরা জিহাদের গমন করা থেকে বিরত ছিলাম। আদালতে নববী থেকে এ তিনজনের সাথে সামাজিক বয়কটের নির্দেশ আসে। হুযূর (সা) তাদেরকে বলেন, ওহীর অপেক্ষা করতে থাক। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যা হুকুম হবে, তার উপরই আমল করা হবে। (৪) চতুর্থ দল ছিল মুনাফিকদের। সূরা ‘তওবায়’ তাদের কঠোর ভাষায় তিরস্কার ও ভর্তসনা করে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। (৫) ঐ সকল লোক, যারা কোন ওযর বা অক্ষমতার কারণে ঐ যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। এ আয়াতে আল্লাহ্র ফযল ও করুণার উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং প্রত্যেকেরই নিজ নিজ অবস্থা অনুযায়ী আল্লাহ্র ফযল, রহমত ও করুণার অংশ দেয়া হয়েছে। নবী করীম (সা) মুহাজির ও আনসারদের উপর আল্লাহ তা’আলার দান- ‘ফযল’ এই হয়েছে যে, যুদ্ধ যাত্রা সম্পর্কে আদৌ তাঁরা দ্বিধান্বিত হন নাই। বরং তাঁরা ছিলেন দৃঢ় সংকল্প এবং অটুট অনড় ইচ্ছার অধিকারী। আর যারা ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত, তাঁদের উপর আল্লাহ্র অনুগ্রহ হয়েছে এই যে, শেষ পর্যন্ত তাঁরা পয়গম্বর (সা)-এর সঙ্গীরুপে যুদ্ধে গমন করেন। অধিকন্তু কা’ব (রা), হেলাল (রা) এবং মুররাহ (রা) এ তিনজনের উপর আল্লাহ্র অনুগ্রহ হলো যে, তাঁরা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেন। আর আল্লাহ তা’আলা তাদের তওবা কবুল করেন।
মোটকথা, সামাজিক বয়কটের ফলে অপরাধী যদি শিক্ষা গ্রহণ করে এবং অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে তবে, এটাও (আদালতে) কার্যকর হলে বিবেচিত হতে পারে।
অতএব সার কথা হল- যে সমস্ত অপরাধের হদ্দ বা সাজা নির্ধারিত নেই অথচ তাকে তাযীর করা উদ্দেশ্য, এ ক্ষেত্রে ইমাম, শাসনকর্তা বা বিচারপতির কর্তব্য হলো অপরাধীর অবস্থানুযায়ী তাযীর করা বা সাজা দেয়া এবং তাকে অপরাধ থেকে নিবৃত রাখা।)
আর তত্ত্বাবধায়ক, হাকিম কিংবা শাসনকর্তা দ্বারা যদি এমন কোন অপরাধ সংগঠিত হয়, যার উপর কোন হদ্দ নির্ধারিত নেই, তবে খলীফা তথা সরকার প্রধান কর্তৃক তাকে পদচ্যুত করে দিতে হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) এবং সাহাবীগণ (রা) করেছিলেন। ক্ষেত্র বিশেষে আবার সাময়িক খিদমত থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে তাযীর করা উচিত। কেউ হয়ত মুসলমানদের সামরিক ও দেশরক্ষা বাহিনীতে কার্যরত ছিল যে, যে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, সামনা-সামনি তরবারী চলছে, এমতাবস্থায় মুসলিম সেনাবাহিনীর কেউ পলায়ন করল অথচ যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা কবীরা গুনাহ’। সুতরাং এ পরিপ্রেক্ষিতে তার বেতন-ভাতা, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়াটাও এক প্রকার তা’যীর বা শাসন।
এমনিভাবে আমীর, বিচারক কিংবা শাসনকর্তা যদি এমন কোন কাজে লিপ্ত হয়, সমাজে যা ঘৃণিত ও অপছন্দনীয় হিসাবে চিহ্নিত, তাহলে এমতাবস্থায় তাকে পদচ্যুত কিংবা ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে’। তার জন্যে এটাই তাযীর’ হিসাবে পরিগণিত হবে।
এমনিতর কখনো অপরাধীকে জেলখানায় বন্দী করে তাযীর করতে হবে। ক্ষেত্র ও পাত্রভেদে অপরাধীর’ মুখে চুন কালী মাখিয়ে’ উল্টোমুখী গাধায় সওয়ার করে’ বাজারে-বন্দরে, তথা লোকালয়ে ঘুরিয়ে তাকে জনসমক্ষে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে তাযীর করতে হবে। যেমন হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, মিথ্যা সাক্ষ্য দানকারীকে তিনি এ ধরনের তাযীর করেছিলেন। মিথ্যাবাদীর মিথ্যা কথার দ্বারা নিজের মুখে সে নিজেই কালি মেখেছে। কাজেই কর্মফলস্বরুপ তার মুখমণ্ডল কাল করে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সরল সোজা কথাকে যেহেতু সে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে, সেহেতু তাকেও গাধার পীঠে উল্টোমুখী সওয়ার করে সাজা দেয়া হয়েছে।
তাযীরের ক্ষেত্রে অনুর্ধ্ব দশটি দণ্ড দিতে হবে এর অধিক নয়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞের মতে তাযীর এ পরিমাণ হওয়া উচিত, যাতে হদ্দের সীমা পর্যন্ত না পৌঁছে। অতঃপর তাযীর সম্পর্কেও তাদের মধ্যে দু’ধরনের মত পরিলক্ষিত হয়। কারো কারো মতে সীমা পর্যন্ত পৌঁছানো চাই। আযাদ ব্যক্তির হদ্দ হচ্ছে ন্যূনতম চল্লিশ কোড়া কিংবা আশি কোড়া। কাজেই তাযীরে উক্ত সংখ্যক কোড়া লাগানো ঠিক নয়। বস্তুত গোলামের তাযীর গোলামের নিম্নতম পরিমাণের সমান না হওয়া সংগত। যেমন, গোলামের হদ্দের পরিমাণ বিশ কিংবা চল্লিশ কোড়া। কাজেই তাযীর এর সমসংখ্যক হওয়া উচিত নয়।
পক্ষান্তরে কেউ বলছেন, অপরাধী ব্যক্তি স্বাধীন হোক বা গোলাম, তাযীর গোলামের হদ্দের পরিমাণ হওয়া সমীচীন নয়। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ বলেন- স্বাধীনদের তথা তাযীর তাদের হদ্দের সমপরিমাণ হওয়া উচিত। যে প্রকার এবং যে জাতীয় তাযীর ক্রয়া হবে, তা যেন হদ্দের চেয়ে মাত্রাধিক না হয়ে যায়। যেমন, কোন চোর যদি অরক্ষিত কোন স্থানের মাল চুরি করে তবে শাস্তিস্বরূপ তার হাত কাটা হবে না, অন্যভাবে তাযীর করতে হবে। সে তাযীর যদিও ‘হদ্দে কযফ’ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। প্রয়োজন হলে তাকে ‘হদ্দে কযফে’র চেয়ে অধিক পরিমাণে বেত্রদণ্ড দিতে হবে। যেমন, কোন ব্যক্তি যিনা তো করেনি কিন্তু তার আনুষঙ্গিক কাজগুলো করেছে, চুমো খেয়েছে, তাকে নিয়ে শয্যায় শুয়েছে অথবা যিনার এ জাতীয় অন্য কোন আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকাণ্ড করেছে। সুতরাং এর তাযীর একশ কোড়া হতে পারবে না। অবশ্য কযফের চেয়ে অধিক হওয়াও বাঞ্ছনীয়। যেমন, বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর (রা)-এর যামানায় এক ব্যক্তি নকশী করা একটি আংটি তৈরী করেছিল। বাইতুল মাল থেকে কিছু মাল চুরি করে সে তাতে লাগিয়েছিল। এটা প্রমাণিত হওয়ার পর হযরত ওমর (রা) প্রথম দিন তাকে একশ কোড়া লাগানো হয়। খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে বর্ণিত আছে-একদা রাত্রিকালে কোনও এক ব্যক্তিকে জনৈকা পরনারীসহ একই লেপের নীচে শয্যাশায়ী অবস্থায় পাওয়া যায়। অতঃপর এর দণ্ডস্বরূপ উভয়কে একশ করে কোড়া লাগানো হয়েছিল।
হযরত নবী করীম (সা) থেকে বর্ণিত- কোন ব্যক্তি আপন স্ত্রীর বাঁদীর সাথে যদি সহবাস করে, তবে তাকে রজম বা প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। এটা ইমাম আহমদ (রহ)-এর অভিমত। আর প্রথমের দুটি ধারা ইমাম শাফিঈ (রহ)-এর মযহাব অনুযায়ী। ইমাম মালিক (রহ) এবং অন্যান্য থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, কোন কোন অপরাধ এমনও রয়েছে, যার সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন ‘হদ্দ’-এর উল্লেখ নেই। কিন্তু তার তাযীর বা সাজা প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। ইমাম আহমদ (রহ)-এর কোন কোন শাগরিদও এ মতের অনুসারী। যেমন, কোন মুসলমান যদি কাফির ও দুশমনের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত হয়, যার ফলে মুসলমানদের জান মালের ক্ষতির আশংকা দেখা যায়, এমতাবস্থায় ইমাম আহমদ (রহ) কোন মত ব্যক্ত না করে নীরবতা অবলম্বন করেন, কিন্তু ইমাম মালিক (রহ) এবং ইবনে ‘উকায়লীর ন্যায় কোন কোন হাম্বলী ইমামের মতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফা (রহ), ইমাম শাফিঈ (রহ) এবং আবুয়ালীর ন্যায় অপর কোন হাম্বলী ইমামের মতানুসারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দান সমীচীন নয়।
কোন ব্যক্তি যদি কুরআন হাদীসের পরিপন্থি কোন বিদ’আত ও শরীয়ত বিরোধী প্রথা চালু করে কিংবা এর প্রতি মানুষকে আহ্বান জানায় ও তার অনুকূলে প্রচারণা চালায় তবে তাকে আদালত মৃত্যু দিতে পারবে। ইমাম মালিক (রহ)-র বহু শিষ্য-শাগরিদও এ মতের সমর্থনকারী। পক্ষান্তরে ইমাম মালিক (রহ) ও অন্য ইমামগণ ‘কাদরিয়্যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দানের হুকুম দিয়েছেন। তাঁদের এ হুকুম কাদরিয়্যাদের ‘মুরতাদ’ (ইসলাম ত্যাগী) হওয়ার ভিত্তিতে নয়, বরং এদের দ্বারা ‘ফাসাদ ফিল আরদ’ অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করার কারণে দেয়া হয়েছে।
এমনিভাবে কেউ কেউ যাদুকরদেরও মৃত্যুদণ্ড দানে মত ব্যক্ত করেছেন। আর অধিকাংশ আলিমও একই মত পোষণ করেন। এ পর্যায়ে হযরত ‘জুন্দুব’ (রা) থেকে মওকূফ’ ও ‘মরফু’ উভয় সূত্রে রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে।১ (টীকা-১ঃ হযরত ‘জুন্দুব (রা)-র ঘটনা আবুল ফারাজ ইসফাহানী রচিত আল আগানী গ্রন্থে সনদসহ (রেওয়ায়েত সূত্র) বর্ণনা করা হয়েছে। ঘটনার বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে-
ওলীদ ইবনে ওকবার দরবারে একবার কোন এক যাদুকর উপস্থিত হয়। যাদুমন্ত্র বলে যে গাভীর উদরে অনায়াসে প্রবেশ করত এবং বেরিয়ে আসত। ঘটনাক্রমে হযরত জুন্দুব (রা) সেখানে উপস্থিত হয়ে ব্যাপারটি লক্ষ্য করেন। সবার অলক্ষ্যে উঠে গিয়ে ঘর থেকে তিনি তরবারী হাতে ফিরে আসেন। খেলার এক পর্যায়ে যাদুকর গাভীর পেটে ঢুকতেই তিনি তরবারীর এক প্রচণ্ড আঘাতে যাদুকরসহ গাভীটি দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেন। আর মুখে তিলাওয়াত করতে থাকেন-
*******আরবী
“ তোমরা কি জেনে শুনে যাদু চর্চায় এসেছ?” (সূরা আম্বিয়াঃ ৩)
পরিস্থিতির নাজুকতা অনুধাবন করে উপস্থিত সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ইরাক শাসক ওলীদের নির্দেশে জুন্দুবকে গ্রেফতার করে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর বিস্তারিত ঘটনা লিপিবদ্ধ করে খলীফা উসমান (রা)-র নিকট পত্র প্রেরণ করা হয়। ঘটনাক্রমে সে কারাগারে ছিল খৃষ্টান দারোগা। হযরত জুন্দুব (রা) গভীর রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ছেন এবং দিনের বেলা রোযা রাখছেন। এ অবস্থা দেখে খৃষ্টান কারারক্ষী মনে মনে বলতে থাকে- “ আল্লাহ্র কসম! যে জাতির অপরাধ-প্রবণ ও প্রতারক দুষ্ট লোকদের অবস্থা এই, সে জাতি সে ধর্ম অবশ্যই সত্য ও নির্মল”। অন্য একজনের উপর কারাগারের দায়িত্ব অর্পণ করে সে নিজে ‘কুফা’ চলে যায়। এখানে লোকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে এবং স্থানীয় লোকদের নিকট এখনকার সবচেয়ে সৎ ও পুণ্যবান ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে থাকে। তারা জবাব দিল সে ব্যক্তি হচ্ছে ‘আশআছ বিন কায়স’। সে তাঁর বাড়ীতে অতিথি হলো। আর লক্ষ্য করল যে, তিনি রাতে ঘুমান এবং সকালে আহার করেন। অতঃপর কুফবাসীদেরকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল ‘এখানে সব চেয়ে উত্তম ব্যক্তি কে?’ উত্তরে তারা বলল- জারীর ইবনে আবদুল্লাহ’। উক্ত খৃষ্টান তাঁকে হযরত ‘আশআছ ইবন কায়স-এর অনুরূপ দেখতে পেল। অতঃপর কেবলামুখী হয়ে সে ঘোষণা করতে থাকে-
*********আরবী
“জুন্দুবের যিনি প্রভু- আমারও তিনি প্রভু-পালনকর্তা আর জুন্দুবের দ্বীনই আমার দ্বীন’। এ মন্তব্য করার পরক্ষণেই তিনি কালিমা তাইয়্যেবা পাঠ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ‘সুনানে কুবরাতে ইমাম ‘বায়হাকী’ সামান্য পরিবর্তনসহ ঘটনাটি এভাবে উল্লেখ করেনঃ ওলীদ ইবন উকবা তখন ইরাকের শাসনকর্তা। তাঁর নিকট একজন যাদুকর উপস্থিত হয়ে নিজের মন্ত্রবলে সে খেলা দেখাতে শুরু করে। সে এক ব্যক্তির গর্দান উড়িয়ে দেয়। অতঃপর নিহত ব্যক্তির নাম করে সজোরে চিৎকার করে। এতে নিজে নিজেই তার ছিন্ন মস্তক এসে দেহের সাথে জোড়া লেগে যায় এবং সজীব হয়ে উঠে। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনতা বিস্মিত ও আশ্চর্য কণ্ঠে বলে উঠে **********আরবী “সুবহানাল্লাহ! এ তো মৃতকে জীবন দান করে দেখছি”। এহেন অবস্থা দেখে এর পরবর্তী দিন মুহাজিরদের মধ্য থেকে এক জন তরবারী হাতে ঘটনাস্থলে হাজির হন। যাদুকর পূর্ব দিনের ন্যায় যথারীতি তার ভেল্কীবাজী শুরু করলে তিনি জনতার মধ্য থেকে এগিয়ে আসেন এবং তরবারীর একই আঘাতে দেহ থেকে তার মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। আর মন্তব্য করতে থাকেন- “সে যদি সত্য সত্যই মৃতের জীবন দানে সক্ষম হয়ে থাকে, তবে নিজে নিজেই জীবিত হয়ে উঠুক”। ওলীদ তখন দীনার নামক কারারক্ষীর প্রতি তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করার হুকুম দেন। মোটকথা, যাদু বিদ্যা ইসলাম বিরোধী কাজ। কেননা এদ্বারা মানুষ ধোকায় পড়ে যায়। সুতরাং সত্য ও দ্বীনের মাপকাঠি একমাত্র আল্লাহ্র কিতাব এবং সুন্নতে রাসূল (সা), যা কিছু এ দুয়ের সাথে মিল খাবে তা সত্য। পক্ষান্তরে এর বিপরীত সব কিছুই গোমরাহী বলে প্রতিপন্ন হবে। এ কারণেই ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ আলিমগণ যাদুকরের প্রাণদণ্ডে অনুকূলে মত দিয়েছেন। এখানে কারাগারে প্রেরণের ঘটনাটি আইন হাতে তুলে নেয়ার।)
*****আরবী
“যাদুকরের হদ্দ বা সাজা হল তরবারীর আঘাতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা”। (তিরমিযী)
হযরত ওমর (রা), হযরত উসমান (রা), হযরত হাফসা (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবন ওমর (রা) এবং অন্যান্য সাহাবীগণের মতে যাদুকরের সাজা হলো তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া। অবশ্য এর কারণ সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন আলিমের মতে যাদুকর সেও কাফির হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। আর কেউ বলেছেন, যাদুকর ঠিকই হত্যার যোগ্য তবে, তা ফাসাদ ফিল আরদ’ ****আরবী সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির কারণে। কিন্তু জমহূর উলামা তথা অধিকাংশ আলিম এর মতে, শরীয়তী হদ্দের ভিত্তিতেই সে হত্যা যোগ্য অপরাধী।
এমনিভাবে যে সকল অপরাধের শাস্তিতে প্রাণদণ্ড প্রদান ওয়াজিব হয়ে পড়ে, সে জাতীয় অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে ‘তাযীরস্বরুপ ইমাম আবূ হানীফা (রহ) প্রাণদণ্ডের অনুকূলে মত ব্যক্ত করেন। যেমন, কোন ব্যক্তি যদি বারংবার ‘লাওয়াতাত’ বা পুং মৈথুন করতে থাকে অথবা কেউ মানুষকে ধোকা দিয়ে, প্রবঞ্চনার আশ্রয়ে অর্থ কড়ি হাতিয়ে নেয়, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দান ওয়াজিব। এমনিভাবে কারো সম্পর্কে যদি এটা প্রমাণিত হয় যে, হত্যা করা ব্যতীত আর অনিষ্টকারী কার্যকলাপ এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই, এমতাবস্থায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।
ইমাম মুসলিম তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ সহীহ মুসলিমে হযরত ‘আরফাজা আল আশজাঈ’ (রহ)-র রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে শুনেছি-
******আরবী
“ যে ব্যক্তি তোমাদের সমাজে বিভে-বিশৃঙ্খলা এবং অনৈক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে আমগণ করে, তবে সে মৃত্যুদণ্ড পাবার যোগ্য”।
অপর এক হাদীসে রয়েছেঃ
********আরবী
“একের পর এক ফিৎনা সৃষ্টি হতে থাকবে তখন, যদি কোন ব্যক্তি এ জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির দুরভিসন্ধি করে আর তোমাদের ঐক্য-সংহতি নষ্ট করার প্রয়াস চালায়, সে যেই হোক না কেন (তার বিচার করে) তরবারীর আঘাতে তাকে প্রাণদণ্ড দিতে হবে”
শরাব পানের ব্যাপারেও অনুরূপ কথাই বলা হয়েছে যে, কয়েক বারের তাযীর সত্ত্বেও যদি নিবৃত না হয়, তখন চতুর্থবার তাকে প্রাণদণ্ড দিতে হবে। এ মতের সমর্থনে গ্রন্থে ইমাম আহমদ কর্তৃক দাইলাম আল হিমায়ারী (রা)- কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, হযরত দাইলাম (রা) প্রশ্ন করেন, হে রাসূলুল্লাহ! আমি এমন এলাকা থেকে আগমন করেছি, যেখানে মদের সাহায্যে বড় বড় কার্য সমাধা করা হয়। এর দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। আমরা গম থেকে শরাব প্রস্তুত করি, মদ দ্বারা আমরা উল্লেখযোগ্য শক্তি লাভ করি। এ ব্যবসাতে আমরা বেশ সাফল্যও লাভ করে থাকি। অধিকন্তু আমাদের অঞ্চলে তীব্র শীত পড়ে থাকে। এর দ্বারা শরীর গরম রাখা হয়। হুযূর (সা) বলেন-
“তাতে নেশা ধরে? আমি বললাম হাঁ। তিনি বললেন- “ এ থেকে বেঁচে থেকো”। আমি পুনরায় আরয করলাম- “হুযূর ! মানুষ এটা কিছুতেই বর্জন করবে না”।
এবার নবীজি ইরশাদ ফরমান- ********আরবী
“ যদি তারা তা বর্জন না করে, তবে তাদের ( এ সমাজ বিরোধী খোদাদ্রোহীদের) মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে”।
বস্তুতঃ এ নির্দেশের মূল কারণ হল, এ দ্বারা সমাজে ফিৎনা-ফাসাদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। (মানবদেহের ক্ষতিসহ অন্যান্য ক্ষতিতো আছেই।) দ্বিতীয়ত, এটা হচ্ছে ক্ষতিকর আক্রমণকারীর অনুরূপ। তাই আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে হিংস্র আক্রমনকারীকে হত্যা যেমন বৈধ ও জরুরী, তদ্রূপ মাদক দ্রব্যের ব্যাপক ক্ষতির প্রেক্ষিতে এর হুকুমও একই পর্যায়ের। সাজা দুই প্রকারঃ এ ব্যাপারে সবাই একমত। (১) অতীত অপরাধ কর্মের সাজা, যা সে ইহজগতেই ভোগ করে যায় এবং আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি থেকে মুক্তি লাভ করে। যেমন, শরাবখোর ও মিথ্যা অপবাদ দানকারীকে কোড়া লাগানো। বিদ্রোহী এবং চোরের হাত কাটা ইত্যাদি। (২) নিজের উপর ওয়াজিব হক আদায় না করা। অনবরত গুনাহ করতে থাকা। এমন অপরাধীকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্য হল- তার নিকট যা প্রাপ্য তা আদায় করা আর ভবিষ্যতে সে যাতে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, সে ব্যাপারে তাকে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণে বাধ্য করা। যেমন ইসলাম ত্যাগকারী মুরতাদ। প্রথমতঃ তওবা এবং ইসলাম গ্রহণের জন্য তাকে আহ্বান জানাতে হবে। ডাকে সাড়া দিয়ে তওবার মাধ্যমে সে যদি মুসলমান হয়ে যায়, তবে তো উত্তম, অন্যথায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। আর যেমন নামায, রোযা বর্জনকারী এবং যে ব্যক্তি পরের হক আদায় করে না কিংবা নষ্ট করে, এসব ক্ষেত্রে হক ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করার জন্য তাকে সুযোগ দিবে। আর ব্যতিক্রম অবস্থায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সুতরাং দ্বিতীয় প্রকারের অপরাধে প্রথম প্রকারের চেয়ে কঠোর হস্তে তাযীর করতে হবে। তাই নামায, রোযা বর্জনকারীকে তার উপর আবর্তিত ওয়াজিবগুলো আদায় না করা পর্যন্ত, বার বার প্রহার কার্য করে তাকে শাসন করতে হবে।
আর এ বিষয়ে বুখারী ও মুসলিমের হাদীস নিন্মে উদ্ধৃত করা হলো। মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“ আল্লাহ্র নির্ধারিত হদ্দ ব্যতীত দশটির অতিরিক্ত কোড়া লাগানো যাবে না”। আর ব্যাখ্যায় আলিমগণের একাংশের অভিমত হলো, উক্ত হাদীসের মর্ম হলো আল্লাহ্র নির্ধারিত হদ্দসমূহ আল্লাহ্র হকের জন্য হারাম করা হয়েছে। কেননা কুরআন হাদীসে উল্লেখিত হদ্দের অর্থ হলো হালাল-হারামের মধ্যবর্তী সীমারেখা। অর্থাৎ হালালের শেষ সীমা এবং হারামের প্রথম সীমার মধ্যখানে অবস্থিত সীমারেখা। হালালের শেষ সীমা সম্পর্কে আল্লাহ ফরমান-
***********আরবী
“ এ হলো আল্লাহ্র নির্ধারিত সীমারেখা। তাই তোমরা এগুলো অতিক্রম করবে না”। পক্ষান্তরে হারামের প্রারম্ভিক সীমা সম্পর্কে আল্লাহ্র বাণী হলো-
********আরবী
“এগুলো হলো আল্লাহ্র ঘোষিত সীমা চিহ্ন। সুতরাং এর নিকটেও তোমরা যাবে না”।
এখন কথা হল, উক্ত সাজাকে হদ্দ কেন বলা হয়? এর উত্তরে বলা যায় যে, এটা একটা নতুন পরিভাষা। এর তাৎপর্য ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।
উল্লেখিত হাদীসের উদ্দেশ্য হল- কেউ নিজের প্রাপ্য আদায় করার জন্য- সমস্যাটা যদি আঘাত ও মারপিটের ঘটনা পর্যন্ত গড়ায়, তা হলে দশটির অধিক আঘাত করা তার জন্য বৈধ হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, যেমন কারো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়ে গেল, ফলে কোন এক পক্ষ থেকে অন্যায়-বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হলো, এহেন পরিস্থিতিতে মজলূমের অধিকার আদায়কল্পে অন্যায়কারীকে দণ্ডিত করা জরুরী। তবে বেত্রদণ্ডের ক্ষেত্রে দশের অধিক নয়।
[আঠার]
যে ধরনের কোড়া দ্বারা অপরাধীকে শাস্তি দেবে
এবং যেসব অঙ্গে কোড়া মারা যাবে না
শরীয়তের বিচারে অপরাধিকে যে কোড়া লাগানোর নির্দেশ রয়েছে, তা মধ্যম মানের হতে হবে। কেননা মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন,
******আরবী
“অর্থাৎ মধ্যমপন্থা অবলম্বন করাই উত্তম”।
হযরত আলী (রা) বলেন- আঘাত খুব শক্তও হানা যাবে না, আবার একবারে লঘুও নয়। বেতটি অতি বড়ও নয় আবার একেবারে ছোটও হওয়া উচিত নয়। কাষ্ঠখণ্ডের দ্বারা প্রহার করা যাবে না, কাটাঁযুক্ত জিনিস দিয়েও না। এ ক্ষেত্রে দোররা যথেষ্ট নয়, বরং দোররা ব্যবহার করতে হবে তা’যীর তথা শিক্ষামূলক শাস্তিতে। ‘হদ্দে শরীয়া’র ক্ষেত্রে কোড়া দ্বারাই দণ্ড দিতে হবে।
হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা) কাউকে আদব শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে দোররা ব্যবহার করতেন। কিন্তু ‘হদ্দে শারঈ’ কার্যকর করার কালে কোড়া আনিয়ে নিতেন। কোড়া মারার সময় অপরাধীর পরিধেয় সকল বস্ত্র খুলে নেয়া যাবে না, বরং সে পরিমাণ বস্ত্রই খোলা যাবে, যা প্রহারের তীব্রতা রোধ করে। লক্ষ্য রাখতে হবে, প্রহারের ক্রিয়া যেন রগ কিংবা অন্ত্রে না পৌঁছে। বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বাঁধা যাবে না। অপরাধীর মুখমণ্ডলে আঘাত করা যাবে না। আসল উদ্দেশ্য হল,তাকে শিক্ষা দেয়া, তার প্রাণ সংহার করা নয়। প্রহার এ পরিমাণ করতে হবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন টের পায়, ব্যথায় জর্জরিত হয়। উদাহরণতঃ পিঠ, কাঁধ এবং রানের উপর প্রহার করতে হবে।