[ঊনিশ]
শাস্তি ও শাস্তি প্রাপ্তদের শ্রেণী বিভাগ
আল্লাহ এবং আল্লাহ্র রাসূলের (সা) নাফরমানীর পরিপেক্ষিতে প্রদত্ত সাজাও দুই প্রকার। (১) এক, দুই কিংবা ততোধিক ব্যক্তির উপর এই সাজা প্রয়োগ করা হয়। ইতিপূর্বে যার বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। (২) এই সাজা বা একটি শক্তিশালী দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়। মৃত্যুদণ্ড ছাড়া যাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীন ‘জিহাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ ও আল্লাহ্র রাসূল (সা)- এর দুশমনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ এর আওতায়।
দীনের তাবলীগ ও প্রচার ব্যাপক হওয়া সত্ত্বেও যারা ইসলাম তো কবূল করেই না বরং ইসলামের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তাদের মুকাবিলায় জিহাদ করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত দীনের বিরুদ্ধে ফিৎনা ফাসাদ নির্মূল না হবে এবং আল্লাহ্র দীন প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত শত প্রতিকূলতার মাঝেও এ জিহাদ১ (১. টীকাঃ জিহাদ অর্থ আল্লাহ্র দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। প্রতি রক্ষার প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ এর প্রান্তিক অবস্থা মাত্র।) অব্যাহত রাখতে হবে।
ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মহানবী (সা)-এর প্রতি কেবল ইসলামী দাওয়াত পৌঁছানোরই আদেশ ছিল। তখনও জিহাদের অনুমতি দেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে যখন তিনি মদীনার দিকে হিজরত করলেন এবং সেখানেও ইসলামের দুশমনরা তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেল, তখনই আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সা) ও সাহাবীগণকে আত্মরক্ষামূলক পরিস্থিতিতে জিহাদের অনুমতি দান করেন।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্র বাণী হলো-
**********আরবী
“যেসব মুসলমানের সাথে কাফিররা যুদ্ধ করে, এখন তাদেরকেও কাফিরদের সাথে আত্মরক্ষারকল্পে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হলো। এ জন্য যে, তাদের উপর নিপীড়ন চলছে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম ও শক্তিশালী। এরা সেসব নির্যাতিত ও মযলূম, যাদেরকে অন্যায়ভাবে দেশ থেকে শুধু এ অপরাধে বহিস্কার করা হয়েছে যে, তাদের ঘোষণা হলো, “ একমাত্র আল্লাহই আমাদের প্রভু-পরওয়ারদিগার। আর আল্লাহ যদি মানুষের এক দলকে অন্য দল দ্বারা দমন করার ব্যবস্থা না করতেন তাহলে (খৃষ্টানদের) গীর্জাসমূহ, (ইহুদীদের) উপাসনালয়সমূহ এবং (মুসলমানদের) মসজিদসমূহ যেগুলোতে অধিক পরিমাণে আল্লাহ্র যিকির করা হয়, কবেই এগুলো বিনাশ করে দেয়া হতো। আর যেসব লোক আল্লাহ্র (দীনের) সাহায্য করবে, আল্লাহও নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ অধিক শক্তিধর এবং পরাক্রমশালী।
(মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত) আমি যদি তাদেরকে কোনো ভূখণ্ডে শাসন কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত করি তখন তারা সমাজে নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে। আর সকল কাজের ফলাফল দানের অধিকার একমাত্র আল্লাহ্র এখতিয়ারে নিহিত”। (সূরা হজ্জঃ ৩৯-৪১)
এরপর মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরয ঘোষণা করে আয়াত নাযিল হয়-
***********আরবী
“( হে মুসলমানগণ!) তোমাদের উপর জিহাদ ফরয করা হলো, যদিও সেটা তোমাদের নিকট অপ্রিয়। আর (জেনে রেখো,) কোণ জিনিস হয়তো তোমাদের অপ্রিয় অথচ পরিণামে সেটাই তোমাদের জন্য মঙ্গলকর, পক্ষান্তরে কোন বস্তু হয়তো তোমাদের অতিপ্রিয়’ কিন্তু মূলতঃ সেটা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। বস্তুতঃ আল্লাহ্ই পরিণাম সম্পর্কে জানেন তোমরা সেটা জান না”। (সূরা বাকারাঃ ২১৬)
অতঃপর মাদানী সূরাগুলোর মধ্যে জিহাদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করা হয়েছে আর জিহাদ ফরয করা হয় আর নিন্দা করা হয়েছে জিহাদ বর্জনকারীদের।
অধিকন্তু জিহাদ তরককারীকে মনের রোগী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ ঘোষণা করেন-
**********আরবী
“ হে নবী! আপনি মুসলমানদেরকে বলুন যে, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন তোমাদের উপার্জিত ধন-সম্পদ খোয়াবার, ব্যবসা-বাণিজ্যের বাজার যা মন্দা হয়ে যাওয়ার শংকাবোধ করো আর নিজেদের যেসব বাসগৃহে বসবাস করতে তোমরা ভালবাস-এই প্রত্যেকটি বস্তু যদি তোমাদের নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) এবং আল্লাহ্র পথে জিহাদ করার চাইতে অধিক প্রিয় অনুভূত হয়, তবে তোমরা অপেক্ষায় থাকো, আল্লাহ্র যা কিছু করার তিনি তাই বাস্তবায়িত করবেন। আর আল্লাহ তাঁর হুকুম অমান্যকারী লোকদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন না”। (সূরা তাওবাঃ ২৪)
আল্লাহ আরো বলেন-
*********আরবী
“খাঁটি মুমিনতো একমাত্র তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে, অতঃপর নির্দ্বিধায় আল্লাহ্র পথে জান ও মাল দিয়ে জিহাদ১ (১. টীকাঃ জিহাদের শাব্দিক অর্থ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করা। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহ্র দ্বীন ইসলামী নীতি আদর্শকে ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করা, চরমভাবে এ পথে কেউ বাধা দিলে আত্মরক্ষাকল্পে প্রতিরোধ যুদ্ধ করা এর প্রান্তিক অর্থ।–অনুবাদক।)
করবে, বস্তুতঃ তারাই সত্যবাদী, খাঁটি মুসলমান”। (সূরা হুজুরাতঃ ১৫)
তিনি আরো বলেন-
*********আরবী
“অতঃপর যদি দ্ব্যর্থহীন কোনো সূরা অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যুদ্ধের কোনো নির্দেশ থাকে, তখন হে নবী ! অন্তরে নিফাকের রোগগ্রস্ত লোকদেরকে আপনি দেখতে পাবেন যে, তারা আপনার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন, কারো উপর মৃত্যুকালীন ভীতি নেমে এসেছে। তাদের জন্য বড়ই আফসোস! তাদের মুখেতো আনুগত্যের স্বীকারোক্তি ও ভাল ভাল কথা ধ্বনিত হয়। কিন্তু যখন চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়া হলো, তখন তারা যদি আল্লাহ্র নিকট তাদের ওয়াদার ব্যাপারে সত্যবাদী হতো তাহলে এদের জন্য মঙ্গলজনক হতো। সুতরাং যদি তোমরা বিমুখ হয়ে যাও তবে কি তাহলে যমীনের বুকে ফাসাদ সৃষ্টি করার নিকটবর্তী অথবা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী হয়ে যাবে?” (সূরা মুহাম্মদঃ ২০-২২)
কুরআন পাকে এ জাতীয় বহু আয়াত বিদ্যমান রয়েছে। এমনিভাবে জিহাদ ও মুজাহিদীনদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং গুরুত্ব সূরা আস্ সাফ এর মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ আরো ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“ হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসায়ের সন্ধান দেবো, যা তোমাদেরকে আখিরাতের কষ্টদায়ক ‘আযাব থেকে মুক্তি দান করবে? তাই এই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ক্রা এবং জান-মালের দ্বারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করা। এটাই তোমাদের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণকর, যদি তোমরা প্রজ্ঞা ও বিবেকবান হয়ে থাক। (এসব কাজ করলেই) আল্লাহ তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন আর তোমাদেরকে ‘আদন’ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত, তদুপরি স্থায়ী জান্নাতের নয়নাভিরাম বাসগৃহে তোমাদের (প্রবেশ করাবেন), এটাই হল পরম সাফল্য। অধিকন্তু তোমাদের প্রাণপ্রিয় অপর একটি নিয়ামতও (দেয়া হবে সেটা হলো), আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়। (হে নবী!) মুমিনদেরকে আপনি এর সংবাদ শুনিয়ে দিন”। (সূরা সাফঃ ১০-১৩)
আল কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছেঃ
***********আরবী
“তোমরা কি হাজীদেরকে পানি পান করানো এবং মসজিদে হারাম তথা কাবা শরীফ আবাদ রাখাকে সে ব্যক্তির সমতুল্য মনে করছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র উপর ও কিয়ামত দিবসে উপর ঈমান এনেছে, আর আল্লাহ্র পথে জিহাদ করেছে? এরা আল্লাহ্র নিকট আদৌ সমমানের হতে পারে না। আর আল্লাহ কখনো জালিমদেরকে হিদায়েত দান করেন না। যারা ঈমান আনে, হিজরত করে এবং নিজের জান-মালের দ্বারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করে, আল্লাহ্র নিকট তারা অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। অধিকন্তু এরাই পরিপূর্ণ সফলকাম। তাদের পালনকর্তা তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে দয়া, সন্তুষ্টি এবং এমন উদ্যানসমূহের সুসংবাদ দান করেছেন, যেখানে তাদের জন্য চিরস্থায়ী নিয়ামত বিদ্যমান থাকবে, আর সেখানে তারা অনন্তকাল বসবাস করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্র নিকট রয়েছে বিরাট প্রতিদান”। (সূরা তাওবাঃ ১৯-২২)
মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেছেন-
******আরবী
“হে ঈমানদার লোকেরা! তোমাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের দীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ্ অতি শীঘ্রই এমন এক জাতি সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন। পক্ষান্তরে তারাও আল্লাহকে ভালবাসবেন। মুসলমানদের সাথে তাদের ব্যবহার হবে কোমল, কাফিরদের সাথে কঠোর, আল্লাহ্র পথে তারা জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দাবাদের ভয়ে তারা ভীত হবে না। এটা হচ্ছে আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন, আর আলালহ সীমাহীন উপায় উপাদানের মালিক এবং তিনি মহাজ্ঞানী”। (সূরা মায়েদাঃ ৫৪)
এ সম্পর্কে আল্লাহ্ আরো বলেন-
*******আরবী
“এটা এজন্য যে, আল্লাহ্র পথে তাদের (জিহাদকারীদের) পিপাসা, পরিশ্রম, ক্ষুধার কষ্ট পৌঁছেছে, কাফিরদের ক্রোধ উদ্রেক করে এমন পদক্ষেপ গ্রহন করা এবং শত্রু পক্ষের নিকট থেকে কিছু প্রাপ্য হওয়া উহাদের সৎ কর্মরুপে গণ্য হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ নিষ্ঠাবান সৎ লোকদের সৎ কর্মের প্রতিদান নষ্ট করেন না। আর তারা ছোট বড় যা কিছু আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে এবং (যুদ্ধকালীন) যেসব ময়দান উপত্যকা অতিক্রম করে, এসবই তাদের নামে লিখা হয়। এদ্বারা আল্লাহ্ তাদের কৃত কাজের উত্তমতর বিনিময় দান করবেন”। (সূরা তাওবাঃ ১২০-১২১)
অতঃপর এ সকল সামাজিক কার্যকলাপের ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা উল্লেখ করে জিহাদের হুকুম দেয়া হয়েছে। কুরআন-হাদীসের বহু স্থানে জিহাদের উল্লেখ করা হয়েছে। অধিকন্তু এ পর্যায়ে এও বলা হয়েছে- জিহাদ সর্বোত্তম কর্ম। এরি ভিত্তিতে আলিমগণের সর্বসম্মত ফতওয়া হাজ্জ, উমরা এবং নফল রোযার চাইতেও জিহাদ উত্তম। কুরআন-হাদীসেও এর প্রমাণ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন-
********আরবী
“ ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ, নামায তার খুঁটি আর জিহাদ ইসলামের সর্বোৎকৃষ্ট আমল”।
তিনি আরো বলেন-
*******আরবী
“ জান্নাতে একশ’টি স্তর রয়েছে, দুই স্তরের মাঝখানে আকাশ-পাতাল পরিমাণ ব্যবধান। আর এ স্তরগুলো আল্লাহ্ তায়ালা আল্লাহ্র পথে জিহাদকারীগণের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন”। (বুখারী, মুসলিম)
তিনি আরো বলেন-
*******আরবী
“আল্লাহ্র পথে একদিন, এক রাত্রি অবস্থান এক মাস রোযা (নফল) রাখা এবং এক মাস ব্যাপী রাত্রি জাগা অপেক্ষা উত্তম। এমতাবস্থায় যদি সে মারা যায়, তবে এ সম্পর্কে সুনানের রেওয়ায়েত রয়েছে। যেমন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
******আরবী
“প্রত্যেক উম্মতই ভ্রমন করে থাকে, আমার উম্মতের ভ্রমণ হল (প্রয়োজনে) আল্লাহ্র পথে জিহাদ অভিযানে বের হওয়া”।
জিহাদের আলোচনা অতি দীর্ঘ ও ব্যাপক আকার করা হয়েছে। জিহাদের তাৎপর্য জিহাদের আমল,জিহাদের প্রতিদান ও সাওয়াব এবং এর ফল, ফযীলত ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে এত অধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, অন্য কোন বিষয় ও আমল সম্পর্কে সে পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়নি। চিন্তা করলে বিষয়টি স্পষ্ট। কারণ, জিহাদের উপকারিতা ও সুফল দীন দুনিয়ার স্বয়ং মুজাহিদ এবং অন্যান্য সকলের জন্য ব্যাপক। প্রকাশ্য ও গোপন, যাহেরী ও বাতেনী যাবতীয় ইবাদত বন্দেগী এর আয়তাভুক্ত। কেননা (ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় এবং ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার প্রশ্নে) আল্লাহর মহব্বত, ইখলাস এবং তাওয়াক্কুল এসবই আল্লাহর পথে জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। নিজের জান-মাল আল্লাহর নিকট সমর্পণ করে দেয়া, ধৈর্য, পরহেযগারী, আল্লাহর যিকির এবং যাবতীয় নেক আমলই এর মধ্যে শামিল রয়েছে। জিহাদ ব্যতীত এমন কোন আমল পরিলক্ষিত হয় না, যার মধ্যে এসব আমলের একত্রে সমাবেশ ঘটেছে।
যে ব্যক্তি, যে জাতি জিহাদে আত্মনিয়োগ করে, দু’ধরনের কল্যাণ দারা তারা লাভবান হয়। (১) আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়। (২) অথবা শহীদ সাজে সজ্জিত হয়ে বেহেশতে প্রবেশ। মানুষের জন্য জীবন মরণের সমস্যাটি বড় জটিল। জিহাদের মধ্যে দীন দুনিয়ার সৌভাগ্য নিহিত। কাজেই এর মাধ্যমে এ কঠিন সমস্যাটির অতি সহজ সমাধান রয়েছে। পক্ষান্তরে জিহাদ বর্জন করার পরিণতিতে দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হতে হয় কিংবা তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোন কোন লোক কঠোর সাধনা এবং দ্বীন-দুনিয়ার কামিয়াবীর উদ্দেশ্যে কষ্টসাধ্য আমলের আশ্রয় নেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাতে লাভ অতি সামান্যই হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, জিহাদ এমন একটি আমল বা কাজ, যা অন্য সব কষ্টকর আমলের তুলনায় অধিকতর ফলদায়ক। সময় সময় লক্ষ্য করা যায় যে, মানুষ নিজের আত্মিক সংশোধন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিকল্পে জান হাতে নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখী হয়ে কঠোর সাধনায় লিপ্ত হয়। কিন্তু বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে শহীদের মৃত্যুই অপর সকল প্রকার মৃত্যুর চেয়ে সহজ ও উত্তম।
জিহাদকে শরীয়ত সিদ্ধ করাই হলো যুদ্ধ ও সংঘর্ষের মুল উদ্দেশ্য আর জিহাদের মূল কথা হল দ্বীন (তথা মানুষের পুরো জীবনের সকল কর্মকাণ্ড ও চিন্তা-মনন) একমাত্র আল্লাহর বিধান মাফিক হয়ে যাওয়া। কালিমাতুল্লাহ সর্বক্ষেত্রে সার্বকভাবে প্রাধান্য লাভ করা। সুতরাং যারা জি হাদের বিরোধিতা করে, নিষেদ করে, প্রতিরোধ সৃষ্টি করে কিংবা এর বিপক্ষে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, গোটা উম্মতের ঐক্যমত (ইজমা-এ-উম্মাহ্)-অনুসারে সরকারী কর্তৃত্বাধীন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং তাদের নির্মূল করাটাই হলো সকলের রায়। কিন্তু যারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে না, মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে জড়িত হয় না, যেমন নারী, শিশু, ধর্মীয নেতা, বৃদ্ধ, অতিবৃদ্ধ, অন্ধ, খঞ্জ, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, লেংড়া প্রমুখ জমহুর ইসলামী বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত অভিমত হলো, রনাঙ্গনে তাদের হত্যা করা যাবে না। হত্যাযোগ্য কেবল সে সকল ব্যক্তি, যারা কথায় ও কাজে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ ও যুদ্ধে লিপ্ত হয়্ অবশ্য কেউ কেউ তার বিপরীত মত ব্যক্ত করেছে। তাদের এ মতের সপক্ষে দলীল হলো, যেহেতু বিদ্রোহীরা কাফির, কাজেই তাদেরকে যুদ্ধের মাধ্যমে দমন ও প্রয়োজনে ইসলামী আদালতের বিচার মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। আর নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করবে। প্রথমোক্ত মতই সঠিক ও বিশুদ্ধ। কেননা মূলতঃ জিহাদ এটাই এ পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশ এসেছে যে, আমরা যখন দীনের দাওয়াত পেশ করি, ইসলাম প্রচার করি এবং সত্য দ্বীনের প্রচার-প্রসার দ্বারা শাস্তি প্রতিষ্ঠা করতে থাকি, তখন তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, আমাদেরকে বারণ করে এবং তাবলীগ ও প্রচার কার্যে বাধা সৃষ্টি কর।
সুতরাং মহান আল্লাহর বাণী হলো:
(আরবী*********)
“(হে মুসলমানগণ! ন্যায় সত্য প্রতিষ্ঠা) যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও আল্লাহর রাস্তায় তাদের সাথে যুদ্ধ কর। কিন্তু ইসলামী সমরনীতি লঙ্ঘন করে বাড়াবাড়ি ও সীমা অতিক্রম করো না। আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে আদৌ পছন্দ করেন না।
‘সুনানে’ বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (স) এক স্থানে কতিপয় লোকের ভীড় দেখতে পান। সেখানে একটি নারীর মৃতদেহ পড়েছিল। এমতাবস্থায় তিনি বললেন:
(আরবী*******) “এ মহিলাটিতো কাউকে হত্যা করার মত ছিল না।” অপর এক ঘটনায় মহানবী (স) এক ব্যক্তিকে বললেন-
(আরবী**********)
“যাও খালেদের সাথে গিয়ে দেখা করে তাকে বলো- ছোট শিশু, মজদুর ও গোলামদেরকে যেন হত্যা না করে।”
(একই সুনান গ্রন্থে বর্ণিত আছে, নবী করীম (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“অতিবৃদ্ধ, ছোট শিশু এবং নারীদেরকে হত্যা করো না।”
যুলুমের অবসানে সৃষ্টজগতের কল্যাণার্থেই জি হাদ বৈধ করা হয়েছে। ইসলামে (ন্যায়-নীতি শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা দানকারীদের) মৃত্যুদণ্ড দানের নির্দেশের পশ্চাতে মানব তথা সৃষ্টজগতের সার্বিক কল্যাণই উদ্দেশ্য। কেননা আল্লাহ বলেন-
(আরবী*********)
“ফিততনা, দাঙ্গাহাঙ্গামা হত্যা অপোক্ষা জঘন্যতম অপরাধ।” অবশ্য হত্যা করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু কুফুরী এবং কাফিরদের সৃষ্ট ফিৎনা-ফাসাদ তার চাইতেও বড় অপরাধ। কাজেই, দীনের প্রচার এবং ইসলামের ন্যায় বিধান প্রতিষ্ঠার কাজে যে ব্যক্তি বাধা দেয় না, প্রতিরোধ সৃষ্টি করে না, তার কুফরী কেবল তার নিজের জন্যই ক্ষতিকর, মুসলমানদের বেলায় নয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ফকীহগণ বলেছেন, কুরআন ও হাদীস বিরোধী কোন বিদআত সৃষ্টি করা, এর প্রতি মানুষকে আহ্বান করা, সেই বিদআতের প্রচার-প্রসার দান, দ্বীনের প্রত্যক্ষ অপমান ও প্রকাশ্য বিরেধিতারই নামান্তর। কাজেই বিদআতের উদ্ভাবক ও প্রচারক উভয়কেই সাজা দিতে হবে। তবে কেউ যদি সক্রিয় না হয়ে এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ বা নীরব থাকে, তাদের সাজা দেয়া যাবে না।
হাদীসে বর্ণিত রয়েছে-
(আরবী********)
“গুনাহ যদি গোপনে করা হয়, তকে কেবল সংশ্লিষ্ট গুনাহগারই ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে, কিন্তু যখন প্রকাশ্যে গুনাহ করা হয়, আর তাতে বাধা দেয়া না হয়, তবে তা ব্যাপকহারে জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে।”
এ জন্যই শরীয়ত কাফিরদরে সাথে জিহাদ করাকে ওয়াজিব করেছে। কিন্তু অক্ষম ও অসহায় লোকদের সাথে জিহাদ করা ওয়াজিব হয়নি। বরং কেউ যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন যুদ্ধ অথবা এ সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শ দেয়, নৌযান কিংবা জাহাজের নৌ পথ দেখিযে দেয়, যুদ্ধের অন্য কোন কাজ করে, মুসলমানদেরকে ভুল পথ দেখায় অথবা কোন কৌশল বাৎলে দেয়, এরূপ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত কঠোর ব্যবস্থার বদলে নরম পন্থা অবলম্বন করা ইসলামী রাষ্ট্রের নেতা তথা ইমাম, ওয়ালী অথবা শাসন কর্তার জন্য অপরিহার্য। জ্ঞান বুদ্ধির মাধ্যমেএ থেকে বেঁচে থাকার পথ গ্রহণ করবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষ নেতাকে এ কাজ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেবে। মোট কথা অপরাধের ধরন প্রকৃতির প্রেক্ষিতে সংশোধন অযোগ্র অবস্থাতে প্রয়োজন কোর্ট তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করবে। অথবা দয়াপরবশ হয়ে ছেড়ে দেবে, কিংবা জামিনে মুক্তি দান করবে কিংবা যা ভাল মনে করবে তাই করবে। এটাই অধিকাংশ ফকীহ বা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞের অভিমত, কুরআন, হাদীস দ্বারাও এটি প্রমাণিত।
অবশ্য কোন কোন ফকীহ ইহসান বা দয়া কিংবা ফিদিয়া নিয়ে ছেড়ে দেয়াকে মনসূখ ও বাতিল বলে থাকেন। কিতাবী ও মজূসী (অগ্নিউপাসক) সম্পর্কে শরীয়তের বিধান হল, তারা পরিপূর্ণভাবে ইসলাম গ্রহণ না করা অথবা জিযিয়া না দেয়া পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। উক্ত দু’জাতি ব্যতীত অন্যসব লোকের নিকট থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা সম্পর্কে ফকীহগণের মতভেদ রয়েছে। কিন্তু সাধারণ ফকীগণ অন্যদের কাছ থেকে জিযিয়া আদায় করার পক্ষপাতি নন।
ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত যে দল বা সম্প্রদায় যাদেরকে মুসলমান বলা হয়, শরীয়তের জাহেরী এবং মুতাওয়াতির (অব্যাহত) হুকুম পালনে তারা অপরকে নিষেধ করে কিংবা নিজে অমান্য করে, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ওয়াজিব। এটা মুসলমানদের সর্বসম্মত অভিমত। কিন্তু দ্বীন পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ অব্যাহত রাখা ফরয। উদাহরণতঃ যেমন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এবং সকল সাহাবী যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। যদিও প্রথমাবস্থায় কেউ কেউ দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে তারাও একমত হয়ে যান। হযরত উমর (রা) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর সামনে উক্তি করে বসেন-
(আরবী***********)
“আপনি মানুষের সাথে কিভাবে জিহাদ করবেন? অথচ নবী (স) ইরশাদ করেছেন: প্রতিপক্ষ মানুষের সাথে আমাকে ততক্ষণ তারা সাক্ষ্য না দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই এবং মুহাম্মদ (স) আল্লাহর রাসুল। তারা যখন এ সাক্ষ্য প্রদান করবে, তখনই তাদের জান-মাল নিরাপদ হয়ে যাবে। অবশ্য কারো কোন হক পাওনা থাকলে সেটার বিচার স্বতন্ত্র আর তাদের হিসাব আল্লাহর হাতে ন্যস্ত।” হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এই যুক্তির জবাবে বললেন-
(আরবী***********)
“যাকাত সে তো কালিমারই হক। আল্লাহর কসম! তারা যদি সে টুকরাটিও সরকারকে দিতে অস্বীকার করে, যা তারা রাসূলুল্লাহ (স)-এর সমীপে প্রদান করতো, তবু তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ কাজ অব্যাহত থাকবে।”
পরবর্তীকালে হযরত উমার (রা) বলতেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা যুদ্ধের ব্যাপারে হযরত আবু বকর (রা)-এর অন্তর খুলে দিয়েছিলেন। এখন আমি উত্তমরূপে উপলব্ধি করছি যে, তিনি ছিলেন সত্যের উপর।
মহানবী (স) থেকে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে যে, তিনি চরমপন্থী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের হুকুম দিয়েছেন। সুতরাং বুখারী ও মুসলিমে আলী ইবনে আবু তালিব (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (স) বলেছেন-
(আরবী************)
“শেষ যামানায় এক দল লোক বাহির হবে যারা হবে, বয়সে যুবক এবং স্বপ্নবিলাসী নির্বোধ। তারা সৃষ্টি জগতের উত্তম ব্যক্তির কথা বর্ণনা করবে বটে কিনতউ ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না, ভিতরে প্রবেশ করবে না। ধনুক থেকে তীর যেমন ছুটে বের হয়ে যায়, দ্বীনও তাদের কাছ থেকে তেমনি দ্রুত বেরিয়ে যাবে। সুতরাং (ক্ষণভঙ্গুর ঈমানের ঐ সকল লোক যখন ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব বিনাসে শসত্র হামলায় এগিয়ে আসবে,) তাদের সাথে যেখানেই মুখামুখী সংঘাতের ঘটনা ঘটবে সেখানেই সংঘবদ্ধভাবেলড়াই করবে এবং রণাঙ্গনের যেখানে পাবে মৃত্যুর ঘাটে পৌঁছিয়ে দেবে। যে ব্যক্তি তাদেরকে হত্যা করবে কিয়ামতের দিন সে সওয়াবের অধিকারী হ বে।”
সহীহ মুসলিমে হযরত আলী (রা) এর বর্ণনায় অপর এক হাদীসে আছে, তিনি বলেণ- আমি রাসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছি-
(আরবী*************)
“আমার উম্মতের মধ্য থেকে এমন একদল লোক সৃষ্টি হবে, তারা কুরআন পাঠ করবে, তাদের কিরাতের তুলনায় তোমাদের কিরাআত কিছুই নয়, তেমনি তাদের রোযার সাথেও তোমাদের রোযার তুলনা চলে না। তারা কুরআন পাঠ করবে আর ধারণা করবে যে, কুরআন তাদের সপক্ষে দলীলরূপ, অথচ প্রকৃতপক্ষে কুরআন তাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। তাদের কুরআন পাঠ কণ্ঠনালীর ভিতরে প্রবেশ করবে না। ইসলামের গণ্ডি থেকে তারা এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন ধনুক থেকে তীর বের হয়ে যায়।”
অতএব যে সেনাদলের নিকট মহানবী (স) প্রদত্ত এ সিদ্ধান্ত পৌঁছবে, তারা অবশ্যই এর তাৎপর্য উপলব্ধি করে সে অনুযায়ী আমলকরবে।
আবু সাঈদ (রা) উপরোক্ত হাদীসের সাথে অতিরিক্ত আরেক রেওয়াতে যুক্ত করে বর্ণনা করেছেন-
(আরবী************)
“তারা মুসলমানদের কতল করবে এবং (একাজে শরীক হতে) মূর্তিপূজকদেরও আহ্বান করবে। আমি তাদের সাক্ষাৎ পেলে (অভিশপ্ত) আদ সম্প্রদায়ের ন্যায় আমি তাদের কতল করতাম।” (বুখারী, মুসলিম)
মুসলিমের অপর এক রেওয়ায়েতে আছে,
(আরবী************)
“আমার উম্মত দুই দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। উভয় দলের মধ্যে থেকে ধর্মত্যাগী এক দল প্রস্তুত হবে, তখন সত্য পন্থীরা তাদের নির্মুল করে ফেলবে।”
এরা হল সেই লোক, ইরাকী এবং সিরীয়দের মধ্যে কোন্দল ও বিভেদ সৃষ্টি করার কারণে হযরত আলী (রা) যাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সাহাবীগণ তাদেরকে ‘হারুরিয়া’ নামে চিহ্নিত করেছিলেন।
নবী করীম (স) এ উভয় দলকে নিজ উম্মত থেকে খারিজ এবং হযরত আলী (রা)-এর সঙ্গীগণকে হকের উপর কায়েম সত্যপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন। উক্ত (*******) ধর্মত্যাগীদের ছাড়া হুযুর (স) এসময় (বাহ্যিক কালিমা পড়ুয়া) অন্য কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উৎসাহ প্রদান করেননি। বরং যুদ্ধ ও জিহাদ করার হুকুম তাদের বিরুদ্ধেই দান করেছিলেন- যারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে ইসলামী জামায়াত ছেড়ে দিয়েছিল এবং মুসলমানদের জান-মাল নিজেদের জন্য হালাল ও বৈধ করে নিয়েছিল।
কাজেই কুরআন হাদীস এবং “ইজমায়ে উম্মতে”র দ্বারা প্রমাণিত যে, ইসলামী শরীয়তের সীমার বাইরে চলে যাওয়া ঐ সকল মুসলমান, যদিও তারা মুখে কালিমা শাহাদাত (আরবী************) এর স্বীকারোক্তি ঘোষণা দিক, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বৈধ।
ফকীহগণ বলেন: কোন একটি বিরাট সংঘবদ্ধ দল যদি সুন্নাতে মুয়াক্কাদার বিরোধিতা ও তা অস্বীকার করে এবং পরিত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়, যেমন ফজরের সুন্নাত অস্বীকার করে তবে, উভয় মতানুযায়ী রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে। আর যদি ওয়াজিব এবং দ্ব্যার্থহীনভাবে প্রমাণিত হারামকে অস্বীকার করে তবে, সর্বসম্মত মত হলো তাদের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ সংঘবদ্ধ দল নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইসলামের বিধানগুলো যথারীতি পালন করে এবং মুহাররামাত যেমন আপন ভগ্নিকে বিয়ে করা, অপবিত্র জিনিস খাওয়া ও মুসলমানদের এসবের হুকুম করা থেকে বিরত না থাকে। এমন সব লোকদের বিরুদ্ধে সরকারীভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া ওয়াজিব। অবশ্য এ নিয়ে ওয়াজিব তখনই হবে যখন নবী করীম (স)এর দাওয়াত ও বাণী তাদের নিকট যথাযথ পৌঁছে যায়।
কিন্তু তারা যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রথমে নিজেরা যুদ্ধ শুরু করে তখন তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং বীর বিক্রমে তাদের মুকাবিলা করা সাধারণভাবে প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরয। আর মুকাবিলা এমনভাবে করতে হবে তারা যেভাবে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে এবং যেভাবে জুলুমকারীদের বিরুদ্ধে মুকাবিলা করতে য়। যথা, অত্যাচারী ডাকাত দলের বিরুদ্ধে। বরং তাদের চাইতেও ফরয হল সেসব লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, যারা যাকাত আদায় করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং শরীয়তের হুকুমের বিরোধিতা করে ও খারেজীদের ন্যায় ফিৎনার সৃষ্টি করে।
উল্লেখ্য, যুদ্ধের প্রশ্নে, আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করাটাই হল উত্তম এবং এটা ‘ফরযে কিফায়া’। কতিপয় মুসলমান জিহাদে অংশগ্রহণ করলে সকলের পক্ষ থেকে জিহাদের ফরয আদায় হয়ে যাবে। তবে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের ফযীলত ও মর্যাদা অধিক। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
(আরবী**********)
“যে সকল মুসলমান বিনা ওযরে বা কারণ ব্যতীত জিহাদে শরীক হওয়া থেকে বিরত থাকে, তারা কখনো (মর্য়যাদায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশ-গ্রহণকারীদের) সমান হতে পারে না।” (সূরা নিসা: ৯৫)
শত্রু যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে আকস্মিক আক্রমণ করে বসে, এমতাবস্থায় প্রতিটি মুসলমানের উপর সাধারণভাবে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ফরয। এ আক্রমণ প্রতিহত করা আক্রান্ত মুসলমানদের উপর ফরয হওয়ার কানণ হলো বিপণ্ণ মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসা ফরয। যেমন আল্লাহ বলেন-
(আরবী**********)
“দীনের ব্যাপারে যদি তারা তোমাদের সাহায্য কামনা করে তবে তোমাদের জন্যে তাদের সাহায্য করা অবশ্য কর্তব্য। তবে সে কাওম বা গোত্রের বিরুদ্ধে নয়, যাদের সাথে তোমাদের পারস্পরিক চুক্তি রয়েছে।”
একই প্রসঙ্গে নবী করীম (স) বলেন, (আরবী**********) মুসলমান অপর মুসলমানকে সাহায্য করবে।”
বস্তুতঃ মুসলমানদের সাহায্য করতেই হবে, এতে পারিশ্রমিক কিংবা ভাতাস্বরূপ কিছু পাওয়া যাক আর না যাক। অবশ্য সরকারীভাবে বেতন দেয়াটা উত্তম। এক্ষেত্রে ইসলামী সরকারকে সকল মুসলমানের নিজ সামর্থ্যানুযায়ী জান-মাল দ্বারা সাহায্য করা কর্তব্য। আর এ সাহায্য তাদের উপর ফরয। যার যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে, কম হোক কিংবা বেশী, পদব্রজ যেতে হোক অথবা সওয়ার হয়ে, সর্বাবস্থায় সাহায্য সহায়তা দান করা ফরয। যেমন, খন্দক যুদ্ধের সময় কাফিররা আক্রমণ করার পর প্রত্যেক মুসলমানের উপর নিজ নিজ অবস্থানুযায়ী জিহাদ ফরয হয়ে গিয়েছিল।
কোন মুসলমানের জন্যই এ যুদ্ধ যাত্রা থেকে অব্যাহতি লাভের আদৌ কোন অনুমতি ছিল না। যেমনটি ছিল না ইসলামের প্রাথমিক যুগে। আল্লাহ তা’আলা এ পরিস্থিতিতে মুসলমানদের দু’দলে বিভক্ত করে বর্ণনা করেছেন। (১) কায়ে’দ তথা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি এমন লোক (২) আর খারেজ তথা জিহাদে যোগদানকারী বেযুদ্ধা ও যোদ্ধা। এ পরিস্থিতিতেও যুদ্ধে না যাবার অনুমতি প্রার্থনা করে যারা নবী করীম (স) এর নিকট আবেদন করেছিল, তাদের ব্যাপারে তিরস্কারমূলক আয়াত নাযিল করে আল্লাহ বলেন-
(আরবী**********)
“রাসূলুল্লাহ (স) এর নিকট তাদের একজন এই বলে বাড়ী ফিরার অনুমতি চেয়েছিল যে, আমাদের ঘর-বাড়ী অরক্ষিত অথচ বাস্তবে সেগুলো অরক্ষিত ছিল না। পলায়ন করাই আসলে তাদের উদ্দেশ্য ছিল।
এই যুদ্ধ ছিল নিজেদের দীন, ইজ্জত-আব্রু, জান-মাল ইত্যাদির নিরাপত্তার জন্য একান্ত আত্মরক্ষামূলক। বাধ্য হয়েই এ যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়। পক্ষান্তরে পূর্বে উল্লেখিত যুদ্ধ ছিল ইসলামের সম্প্রসারণ এবং দীনের প্রাধান্য সৃষ্টির লক্ষ্যে; শত্রুদের উপর নিজেদের প্রভাব সৃষ্টি করা তাদের ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখা এবং দুশমন যেন কখনো মাথা তুলতে না পারে সে জন্য। তাবুক যুদ্ধ তারই বাস্তব প্রমাণ।
কাজেই এ আক্রমণমূলক ব্যবস্থা হলো সেই শক্তিশালী বিদ্রোহী দলের বিরুদ্ধে দমনমূলক পন্থা হিসাবে। কিন্তু বিদ্রোহী শক্তি যদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শক্তিশালী না হয় দুর্বল আর মাত্র বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটা ঘটনা ঘটায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা প্রযোজ্য নয়। যদি তারা শক্তিশালী হয় এবং মুসলিম জনপদ ও বস্তিতেও তাদের প্রকাশ ঘটে থাকে, আমীর বা শাসনকর্তার দায়িত্ব হলো, এ জাতীয় লোকদের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাতি, মুস্তাহাব ইত্যাদি আমল-ইবাদতে অভ্যস্ত করে তোলা এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি ও দ্বীনের প্রয়োজনীয় মাসলা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়া, এসবের উপর আমল করতে বাধ্য করা। অধিকন্তু চাল-চলন, আচর ব্যবহারে আমানত পূর্ণ করা, অঙ্গীকার ও ওয়াদপূর্ণ করা ইত্যাদি গুণাবলী অর্জনে বাধ্য করাও রাষ্ট্রয় ইমামের কর্তব্য।
সুতরাং যারা নামায পড়ে না, মহিলারা সাধারণতঃ নামাসে অলসতা করে থাকে, তাদরেকে নামাযের জন্য কড়া নির্দেশ দিতে হবে। এতদসত্ত্ত্বেও যারা নামায পড়বে না তাদেরকে সাজা দিতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নামায পড়তে শুরু করে। এটাই হল মুসলিম ফেক্হী আইন বিশেষজ্ঞদের ‘ইজমা’ বা সর্বসম্মত রায়। এছাড়া আরেক মত হলো, বেনামাযী প্রথমঃ তওবা করবে, পরে তাকে নামায পড়ার হুকুম দিতে হবে। যদি এতে কাজ হয়, সে নামায পড়তে শুরু করলে তো উত্তম, নতুবা তাকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। প্রশ্ন হলো, কোন্ অপরাধের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে? “নামায না পড়াতে সে ‘কাফির’ হয়ে গেল”- এ কারণে? নাকি সে মুরতাদ ও ফাসেক হয়ে যায়- সে কারণে?
এর উত্তরে ইমাম আহমদ প্রমুখদের মযহাব অনুযায়ী দু’ধরনের মত লক্ষ্য করা যায়। এক মত অনুযায়ী সে কাফের হয়ে যায় এব দ্বিতীয় মত অনুসারে ফাসেক। এ কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। অধিকাংশ ‘সলাফে’ তথা পূর্বসূরী বিশেষজ্ঞদের মতে, সে কাফের হয়ে যায়’ কাজেই তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া কর্তব্য। কোনো মুসলিম নাগরিকের জন্য এ দণ্ড তখন, যখন সে “নামায পড়া ফরয” এটা মেনে নিয়ে এবং মুখে স্বীকার করেও বাস্তবে নামায পড়ে না। কিন্তু সে ব্যক্তি যদি নামায ফরয হওয়াকে অস্বীকার করে, তবে সর্বম্মতিক্রমে সে কাফের।
কাজেই অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়েদেরকে সাত বছর হতেই নামাযের জন্য হুকুম দেওয়া অভিভাকের উপর ওয়াজিব। আর দশ বছর পূর্ণ হলে প্রহার ও বেত্রাঘাত করে হলেও নামাযে অভ্যস্থ করতে হবে। হুযুর (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“সন্তান সাত বছরে পৌঁছুলে তাকে নামাযের হুকুম করো আর দশ বছর পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও যদি নামায না পড়ে, তবে তাকে প্রহার কর এবং শয্যা পৃথক করে দাও।”
এমনিভাবে সন্তানাদেরকে নামাযের প্রয়োজনীয় মাসআলাসমূহ, পাক পবিত্রতা এবং জরুরী মাসআলাও শিক্ষা দেয়া কর্তব্য। নামাযের অনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর মধ্যে মসজিদ আবাদ করা, মসজিদের ইমাম নির্দিষ্ট করা ইত্যাদিও শামিল। তাদেরকে হুকুম দিতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ (স)-এর ন্যায় নামায পড়তে হবে ও পড়াতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- (আরবী**********)
“আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখ ঠিক সেভাবে তোমরা নামায পড়।” (বুখারী)
একবার তিনি সাহাবীগণকে মিম্বরের নিকট নিয়ে গিয়ে নামায পড়ালেন, অতঃপর ইরশাদ করলেণ-
(আরবী**********)
“এ ব্যবস্থা আমি এজন্য করেছি যে, তোমরা যেন আমার অনুসরণ করো এবং আমার নামায পড়ার নিয়ম পদ্ধতি শিখে নাও।”
জনগণের নামাযের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রাখাও ইমামের দায়িত্ব। যেন তাদের নামাযে কোন রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকে। ইমামত করাকালীন অবস্থায় ইমাম পরিপূর্ণরূপে নামায পড়াবেন, এটা তার দায়িত্ব। একাকী নামায পড়ার ন্যায় পড়াবে না। কেননা একাকী নামাযে ওযরের কারণে নামায সংক্ষিপ্ত হতে পারে। ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং এবং এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করা ইমামের বিশেষ দায়িত্ব।
হাজ্জের ইমামের বেলায়ও একই হুকুম যে, হাজীদের সকল সমস্যা ও প্রয়োজনের প্রতি তিনি নজর রাখবেন, তাদের হাজ্জের প্রয়োজনীয় মাসআলা শিক্ষা দানের সবন্দোবস্ত করবেন। নামাযসহ একই নীতি সেনাপতির বেলায়ও প্রযোজ্য। তার অধীনস্থ সৈনিকদের সুযোগ সুবিধা ও সমস্যার প্রতি তিনি নজর রাখবেন। এক্ষেত্রে একটি বাস্তব দৃষ্টান্তের প্রতি লক্ষ্য করলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠে। যেমন, উকীল তার মুয়াক্কিলের মাল-সম্মদ, তার ক্রয়-বিক্রয়ের ভারপ্রাপ্ত ওলী (ম্যানেজার) তার মালিকের দেখা-শোনা, রক্ষণাবেক্ষন ও তদারক করে থাকে। এই উদ্দেশ্যে তারা সর্বাপেক্ষা কার্যকর ও ফলপ্রসু পন্থায় অবলম্বন করে থাকে। এমনকি দৈবাৎ নিজের মাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিজ স্বার্থ উপেক্ষা করে মুয়াক্কিল ও মালিকের মাল-সামগ্রী ও স্বার্থ সরক্ষা করে থাকে। অধীনস্থের প্রতি কর্তৃত্বশালীর ঐ দায়িত্বের তুলনায় এটাতো আরো গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী ব্যাপার। ফকীহগণ ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করেছেন যে, দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ তথা দেশের শাসকগোষ্ঠী যখন জনগণের দীনের সংশোধন করতে থাকবে, তখন উভয়পক্ষেরই দ্বীন-দুনিয়া রক্ষা পাবে। শাসক-শাসিত, রাজা-প্রজা সকলেই সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যাবে। অন্যথায় সমস্যা গুরুতর হয়ে দাঁড়াবে এবং নেতাদের পক্ষে শাসন করা কঠিন ও অসম্ভব হয়ে পড়বে। শাসিত, প্রজা তথা তথা জনগণের জন্য মঙ্গল কামনা, আন্তরিকতা, সৎ উদ্দেশ্য পোষণে দুনিয়ার কল্যাণ ও দ্বীনের বিকাশ উভয়টিই হলো এসবের সরকথা। আর ভরসা রাখবে একমাত্র আল্লাহর উপর। কেননা ‘ইখলা’ ও ‘তাওয়াক্কুল” এমনি দু’টি গুণ, যার উপর শাসিত, শাসক- জনতা, ধনী-দরিদ্র সকলের সাফল্য ও কল্যাণ নির্ভরশীল। তাই হুকুম হয়েছে- আমরা যেন নামাযে পড়তে থাকি: (আরবী**********) “আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি। একমাত্র তোমারই নিকট সাহায্য চাই।” এ বাক্য দু’টি সম্পর্কে বলা হয়েছে- সকল আসমানী কিতাবের সার নির্যাস এ দু’টি বাক্যে নিহিত রয়েছে। সুতরাং হুযূর (স) বলেন- যখন বান্দা: (আরবী**********)
(“বিচার দিনের মালিক, আমরা তোমারই ইবাদত করি, একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাইঃ) পড়ে, তখন বান্দার কাঁধের উপর স্থাপিত মস্তক কেঁপে ওঠে। কুরআনের বহু স্থানে একই অর্থের আয়াত রয়েছে। যেমন: (আরবী**********) “একমাত্র তাঁরই ইবাদত কর, তাঁরই উপর ভরসা রাখ।” (সূরা হূদ: ১২৩)
আরো বলা হয়েছে: বলো (আরবী**********)“আমিতো তাঁরই উপর ভরসা রাখি এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করবো।” (সূরা হূদ: ৮৮)
মহানবী (স) কুরবানীর পশু যবাই করার সময় বলতেন (আরবী**********) “হে আল্লাহ! এটি তোমারই পক্ষহতে আমাকে প্রদত্ত এবং একমাত্র তোমারই জন্যে নিবেদিত।”
যেভাবে সরকার ও জনগণ আল্লাহর সাহায্য পায়
তিন জিনিসের মাধ্যমে শাসনকর্তা ও জনগণের প্রতি আল্লাহর সাহায্য অধিক পরিমাণে ধাবিত হয়ে আসে: (১) ইখলাস (নিষ্ঠা) (২) তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা) এবং (৩) দু’আ। নামাযের মধ্যে অন্তরের হিফাযত, আর (গুনাহ থেকে) দেহকে বাঁচিয়ে রাখার দ্বারাই এসব গুণাবলী অর্জিত হতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ দান খয়রাত, সাদকা, যাকাত, আর্থিক সাহায্য দ্বারা মানুষের উপকার করা, যাকে বলা হয়, ‘ইহসান’, এটাও আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার একটি মাধ্যম।
তৃতীয়তঃ কারো দ্বারা কোন কষ্ট বা আঘাত পেয়ে থাকলে ধৈর্যধারণ করা। সবরের সাথে কাজ করে যাও। এ জন্যেই বলা হয়েছে: (আরবী**********) “সবর ও নামাযের দ্বারা আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা কর।” (সূরা বাকারা: ৪৫)
আরো বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
“(বিশেষ করে) দিনের দুই অংশ তথা সকাল সন্ধা এবং রাতের প্রথমাংশে নামায আদায় করো। (অবহেলা করবে না) কেননা, সৎকাজ গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়। যারা আল্লাহকে স্মরণ করে থাকে তাদের জন্য এটা স্মারকরূপ। ইবাদতের কষ্ট সহ্য কর। নিশ্চয় আল্লাহর নেককার লোকদের প্রাপ্য বিনিময় নষ্ট করেন না।”
তিনি আরো বলেণ-
(আরবী**********)
“তাদের কথাবার্তা শুনে (বিচলিত না হয়ে) সহ্য করা। আর সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে স্বীয় পালনকর্তার প্রশংসা সহকারে তাসবীহ পাঠ করো, তাঁর স্তূতি কীর্তন করো।” (সূরা তোয়া-হা: ১৩০)
এ সম্পর্কে কুরআনে আরো ইরশাদ হচ্ছে-(আরবী**********)
“তাদের কথাবার্তার বিষয়াদি আমার উত্তমরূপে জানা। যার ফলে তুমি মনক্ষুণ্ণ হও। সুতরাং তুমিতোমার রবের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করো এবং তাঁর সামনে সিজদারত হয়ে যাও।” (সূরা হিজর: ৯৭-৯৮)
কুরআনের বহু স্থানে নামায ও যাকাতের উল্লেখ এক সাথে করা হয়েছে। বস্তুতঃ নামায, যাকাত ও সবরের দ্বারা শাসক শাসিত, ধনী-দরিদ্র সমবেতভাবে সকলেরই আত্মশুদ্ধি হাসিল হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি যখন এ অর্থটা পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়, আল্লাহর গুণবাচক নামসমূহের মহিমা বুঝতে পারে, বুঝে শুনে নামায পড়ে ও আল্লাহর যিকরে মশগুল হয়ে আল্লাহর দরবারে দু’আর হাত বাড়ায়, পবিত্র কিতাব কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে, ইখলাস ও তাওয়াক্কুলসহ নামায আদায় করে, যাকাত, সাদকা দ্বারা জনসেবা করে, আর্থ বিপন্নের সাহায্যে এগিয়ে আসে, বিপদগ্রস্ত অভাবী লোকের সাহায্য করে এবং অভাবগ্রস্তের প্রয়োজন পূরণ করে, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তার পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। বুখারী, মুসলিমে নবী করীম (স) থেকে বর্ণিত হয়েছে: (আরবী**********) “প্রত্যেক সৎকাজ ‘সাদকা’র অন্তর্ভুক্ত।”
(****) শব্দের ভিতর সর্বপ্রকার ইহসান বা সৎকাজ শামিল। হাসিমুখে কথা বলা কালিমা তায়্যিবা এবং খাল কথা বলা- এসবই ইহসানের পর্যায়বুক্ত। (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আলী ইবনে হাতিম (রা) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের সাথেই তার রব এমতাবস্থায় কথা বলবেন যে, আল্লাহ এবং তার মাঝখানে কোন দারোয়ান কিংবা কোন দোভাষী উপস্থিত থাকবে না। সে ডান দিকে তাকাবে আর তাই দেখতে পাবে, যা সে পূর্বে পাঠিয়েছে, বাম দিকেতাকাবে তো ঐসব কাজই তার দৃষ্টিগোচর হবে, যা সে পূর্বে পাঠিয়েছে। অতঃপর সম্মুখ পানে লক্ষ্য করবে তো আগুন ছাড়া কিছুই নজরে পড়বে না। কাজেই তোমাদের মধ্য থেকে যদি কেউ খেজুরের একটি টুকরো দান করে হলেওআগুন থেকে বাঁচতে চায়, তবে সে যেন তাই করে।কারো এতটুকু সামর্থ্যও না থাকলে তার উচিত, একটি উত্তম কথা দ্বারা হলেও আগুন থেকে মুক্তি লাভে তৎপর হওয়া। সুনানের এক রেওয়ায়েত অনুসারে নবী করমি (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“সৎকাজকে তোমরা তুচ্ছ মনে করো না, যদিও সেটা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাৎ আকারে হোক। আর যদিও তুমি স্বীয় পাত্র থেকে এমনি পিপাসার্তের পাত্রে পানি ঢেলে থাকো।”
সুনানে আরো বর্ণিত রয়েছে হুযূর (স) বলেন-
(আরবী**********)
“মীযানে তথা নেকীবদীর পাল্লায় ওজনকৃত জিনিসের মধ্যে সব চাইতে ভারী বস্তু হবে উত্তম চরিত্র।” একই মর্মে অপর এক হাদীসেনবী করীম (সা) হযরত উম্মে সালামাকে সম্বোধন করে বলেছেন-
(আরবী**********)
“হে উম্মে সালমা! দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় কল্যাণ মহত্তম চরিত্রই নিয়ে গেছে।”
অপরের দেয়া কষ্ট ও আঘাত সহ্য করা, ক্রোধ দমন করা, মানুষকে ক্ষমা করে দেয়া, মনের কুপ্রবৃত্তি ও কাম রিপুর বিরোধিতা করা, অন্যায় কার্যকলাপ এবং অহংকার বর্জন করা ইত্যাদি সদগুণাবলী সবরের পর্যায়ভুক্ত। এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন-
(আরবী**********)
“আর যদি আমি মানুষকে আমার রহমতের স্বাদ আস্বাদন করাই, অতঃপর তার কাছ থেকে আমি তা ছিনিয়ে নেই, তখন সে নিরাশ, অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে।আর যদি তাকে আমি আপতিত বিপদাপদের পর কোনরূপ সুখের স্বাদ গ্রহণ করাই, তখন সে অবশ্যই বলতে থাকে, আমর সব বিপদ কেটে গেছে। তখন সে অতিশয় উল্লাস প্রকাশকারী অহংকারী। কিন্তু যারা সবর করে ও সৎকাজ করে (তারা েএর ব্যতিক্রম); তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ ক্ষমা এবং বৃহৎ প্রতিদান।” (সূরা হুদ: ৯-১১)
অপর এক আয়াতে মহানবী (স) কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে-
(আরবী**********)
“হে নবী! ভাল ও মন্দ সমান নহে। আপনি অন্যায় ও মন্দ প্রবণতা দমনে যা অতি উত্তম আচরণ বা পন্থা, তা দ্বারা সেই প্রবণতা দূর করো। ফলে আপনি দেখতে পাবেন আপনার সাথে যার শত্রুতা ছিল সে প্রাণের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। এ গুণ কেবল তাদের ভাগ্যেই জুটে থাকে যারা ধৈর্যধারণ করে। আর ভাগ্যবানেরাই কেবল এ মর্যাদা লাভ করতে পারে। অধিকন্তু শয়তানের পক্ষ থেকে আপনি কোনরূপ প্ররোচনা অনুভব করলে, আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করুন। তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন।” (সূরা হা-মী-সাজদা: ৩৪-৩৬)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেণ-
(আরবী**********)
“মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দই হয়ে থাকে। অথপর যারা কষমা করে দেয় এবং সংশোধন করে নেয়, তার বিনিময় ও পুরস্কার আল্লাহ্রই যিম্মামায়। আল্লাহ জালিম লোকদেরকে আদৌ পছন্দ করেন না।” (সূরা শূরা: ৪০)
হাসান বসরী (র) বলেন-(আরবী**********)
কিয়ামতের দিন আরশের নীচ থেকে ফেরেশতাগণ আহ্বান করবেন, ঐ সকল লোক দাঁড়িয়ে থাকুন, যাদের সওয়াব ও পুরস্কার, আল্লাহর যিম্মায় পাওনা রয়ে গেছে। তখন একমাত্র ক্ষমাকারী ও সংশোধনকারীই এ ডাকে সাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারবে।”
প্রজা ও জনসাধারণের সাথে সদ্ব্যবহার ও নম্র ব্যবহার করার অর্থ এই নয় যে, তারা যৌক্তিক-অযৌক্তিক যা চাইবে তাই দিতে হবে এবং যে কোন দাবীই তাদের মিটাতে হবে। আর অন্যায অপরাধ যাই করুক নির্বিচারে ক্ষমা করে তাদের রেহাই দিতে হবে। কেননা এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন-
(আরবী**********)
“সত্য যদি কখনো ঐ লোকদের খেয়াল-খুশির পিছনে চলতো, তবে অসম্মান, যমীন ও তার অধিবাসীদের ব্যবস্থাপনা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতো।” (মুমিনূন: ৭১)
সাহাবীগণকে সম্বোধন করে আল্লাহ বলেন-
(আরবী**********)
“উত্তমরূপে জেনে রাখ, তোমাদের মাঝে আল্লাহর রাসূল বর্তমান, তিনি যদি বহু সংখ্যক ব্যাপারে তোমাদের কথা মেনে নেন, তবে তোমরা নিজেরাই সাংঘাতিক অসুবিধায় পড়ে যাবে।” (সূরা হুজুরাত: ৭-৮)
‘ইহসান’ বলা হয় দুনিয়া ও আখিরাতের পক্ষে যা কল্যাণকর সে কাজ করা। যদিও তারা সেটা পছন্দ না করুক। জনগণের পন্য এ জিনিসটা উপকারী কি ন্তু তারা সেটাকে ভাবে কারাপ। এর উপকারিতা তারা বুঝতে চায় না। এমতাবস্থায় আমীর বা শাসনকর্তার দায়িত্ব হলো নম্র ব্যবহার, মিষ্টি কথা দ্বারা বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদেরকে রাজী ও সম্মত করে নেয়া। বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত রয়েছে নবী করীম (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“কোন বিষয়ে নম্র ব্যবহার করা হলে প্রতিফলে তা মঙ্গল ও নম্রতাই বহন করে আনে। পক্ষান্তরে, কোন বিষয়ে কঠোর পন্থা অবলম্বন করা হলে, পরিণামে তা অমঙ্গল বয়ে আনে।” অপর এক হাদীসে রাসূল (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“নিসন্দেহে আল্লাহ নম্র ও দয়ালু, নম্রতাই তাঁর পছন্দ। দয়ালু ও নম্রচারী ব্যক্তিকে তিনি যা দান করেন, রূক্ষ ও মায়াহীন কঠোর প্রকৃতির লোককে তিনি তা দান করেন না।”
হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয় (র) বলেন, আমি একেকবার (বায়তুলমাল থেকে) তাদের অংশ পৃথক করে দিয়ে দেবার মনস্থ করি কিন্তু আমার ভয় হয় যে, তারা এটাকে অপছন্দ করে বসে, তাই আমি ধৈর্যধারণ করে যাই। অতঃপর যখনই আমার নিকট সুস্বাদু দুনিয়া জমা (পণ্য) হয়, তৎক্ষণাৎ আমি তাদের হক তাদেরকে আদায় করে দেই। তারা যদি তা পছন্দ না করে, তবে অন্য জিনিসে তাদের শান্ত করতে সচেষ্ট হই।
মহানবীরও (স) এমনি অবস্থা ছিল যে, কোন অভাবী তাঁর নিকট উপস্থিত হলে, তিনি তার অভাব মোচন করে দিতেন অথবা মিষ্ট ভাষায় তাকে তুষ্ট করে তাকে বিদায় দিতেন। একবার তাঁর আত্মীয়স্বজনগণ তাদেরকে ওয়াক্ফ সম্পত্তির মুতাওয়াল্লী নিযুক্ত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে বলে যে, উহা থেকে যেন তাদের জন্যে কিছু ভাতা নির্ধারিত করে দেয়া হয়। জবাবে তিনি বললেন-
(আরবী**********)
“মুহাম্মদ এবং তাঁর পরিবার-পরিজনদের জন্য সাদকা হালাল নয়।” তিনি তাদেরকে সাদকা দান করতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানান। অবশ্য ‘ফাই’ তথা যুদ্ধলব্ধ মাল থেকে কিছুদ দান করে তাদেরকে বিদায় করেন। একবার হামযা (রা) এর কন্যার প্রতিপালনের ব্যাপারে হযরত আলী (রা, হযরত যায়দ (রা) এবং হযরত জাফর (রা) এ তিনজন সমভাবে দাবী জানালেন। প্রত্যেকেই আত্মীয়তার টানে এ দাবী করলেন। নবী করীম (স) তাঁদের কারো পক্ষে রায় না দিয়ে হামযা (রা)-এর কন্যাটিকে প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে সরাসরি তার খালার হাতে অর্পণ করলেন। কেনা খালা মায়ের স্থলাভিষিক্ত। অতঃপর সকলকেই মিষ্ট ভাষণে তুষ্ট করে খুশী মনে বিদায় দিলেন। হযরত আলী (রা) কে বললেন-
(আরবী**********) “তুমি আর আমি পরস্পর একাত্ম।” জাফর (রা)কে বললেন- (আরবী**********) “তোমার মধ্যে আমার চরিত্রগত সাদৃশ্য বিদ্যমান রয়েছে।” আর যায়দ (রা) কে সম্বোধন করে ইরশাদ করলেন, (আরবী**********) “তুমি আমাদের ভাই ও বন্ধু।”
সুতরাং শাসনকর্তা, ক্ষমতাসীন ব্যক্তি এবং বিচারকগণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ বন্টন এবং অন্যান্য হুকুমের ক্ষেত্রে এমনই হওয়া কর্তব্য। কেননা, শাসনকর্তা ও বিচারকের নিকট জনগণ সকল সময়ই এমন জিনিস প্রার্থনা ও আশা করতে থাকে, যা হয়তো তাদেরকে দান করা সম্ভব বা সমীচীন নয়। যেমন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার, প্রশাসনিক ক্ষমতা, ধন-সম্পদ, সম্পদের লাভ এবং হদ্দ বা শরীয়তী শাস্তি হ্রাসের ব্যাপারে মানুষের সুপারিশ রক্ষা করা। অথচ তাদের এ দাবী পূর্ণ করা ক্ষমতার বাইরে। এমতাবস্থায় তাদেরকে অন্যভাবে ভিন্ন জিনিস দান করে খুশী রাখার চেষ্টা করা উচিত অথবা নম্রতা, ভদ্রতা, মিষ্টি ভাষা ও উত্তম ব্যবহার দ্বারা সন্তুষ্ট রাখা চাই। অযথা অবজ্ঞা অবহেলা বা কঠোর আচরণ ঠিক নয়। কেননা আবেদনকারীর প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করলে তার মনে অবশ্যই আঘাত অনুভব হয়ে থাকে। বিশেষতঃ ইসলামের স্বার্থে যাদের মন রক্ষা করা বিশেষ প্রয়োজন মনে হবে, সে সব লোকের মনে আঘাত দেয়া সঙ্গত নয়। মহান আল্লাহ বলেন-
(আরবী**********)
“আবেদন বা যাঞ্ছনাকারীকে ধমক দিয়ো না।” (সরা আদ-দুহা: ১০)
কুরআনের অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন-(আরবী**********)
“আর আত্মীয়-স্বজন, গরীব, মুসাফির এঁদের প্রত্যেকের হক আদায় করতে থাক, কিন্তু অযথা ব্যয় করে (সম্পদ) উড়িয়ে দিয়ো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের অকৃতজ্ঞ। আর যদি ওদের থেকে মুখ ফেরাতেই হয়, যখন তুমি নিজ পরওয়ারদিগারের করুণার আশায় থাক, তা হলে এ সকল গরীব অভাবীর সাথে নরম সুরে কথা বলো।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ২৬-২৮)।
কারো আবেদনের বিপরীতে হুকুম দেয়া তার মর্ম বেদনার কারণ বটে। তাই এরূপ ক্ষেত্রে কথা, কাজ এবং আচার-আচরণের দ্বারা দাবীদারকে তুষ্ট রাখাই হলো যথার্থ রাজনৈতিক শাসন ও দূরদর্শিতার পরিচয়। এর দৃষ্টান্ত হলো, চিকিৎসক কর্তৃক রোগীকে তিক্ত ঔষধ দেয়ার পর এর পরিবর্তে তাকে উত্তম বস্তু দান করার মতো, যা তার পরিপূরক হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা হযরত মূসা (আ) এবং তাঁর ভাই কে ফেরাউনের নিকট যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন-
(আরবী**********)
“তার সাথে তোমরা নরম সুরে কথা বলবে, যাতে সে বুঝতে সক্ষম হয় অথবা আমার আযাবের ভয় করে।: (সূরা তোহা: ৪৪)
(আরবী**********)
“জনগণের সাথে নম্র ব্যবহার করবে, রূক্ষ ব্যবহার করবে না, তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখবে, অসন্তুষ্টির কারণ ঘটাবে না আর পরস্পর একে অপরের সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করবে, বিভেদ করবে না।”
একবার এক গ্রাম্য মূর্খ লোক মসজিদে প্রস্রাব করে দিল, সাহাবীগণ তাকে ধমকাতে লাগলেন, কিন্তু মহানবী (স) বললেন-
(আরবী**********)
“তোমরা এর প্রস্রাব বন্ধ করো না।” অতঃপর তিনি এক বালতি পানিয়ে আনিয়ে প্রস্রাবের উপর ঢেলে দিলেন আর সাহাবীগণকে বললেণ-
(আরবী**********)
“তোমাদেরকে নম্র বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, কঠোর ও রূক্ষ করে পাঠানো হয়নি।:” (উভয় হাদীস বুখারী-মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত)
এ জাতীয় শাসন মানুষের নিজের জন্য, পরিবারবর্গের জন্য এবং শাসকগোষ্ঠীর প্রজা ও জনগণের রক্ষনা-বেক্ষণের জন্য প্রয়োজন। কেননা প্রিয় বস্তুর আশ্বাস এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের পূর্ব পর্যন্ত মানব প্রকৃতির স্বভাবতঃ সত্য কথা গ্রহণ করার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। কাজেই মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার ও সদাচরণ করাও ইবাদতে ইলাহীর অন্তর্ভুক্ত। আর এসব আচার-আচরণ আল্লাহর ইবাদতে তখন গণ্য হবে, যদি উদ্দেশ্য সৎ হয়। তোমরা কি জান না যে, অন্য বস্ত্র বাসস্থান ইত্যাদি মানব জীবনের মৌলিক চাহিদা ও অত্যাবশ্যকীয় জীবন সামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত। এমনকি নিরূপায় মানুষের জন্য (জীবন রক্ষা পরিমাণ) মৃত জীব খাওয়াও জায়েয। বরং ক্ষেত্র বিশেষে ওয়াজিবও বটে। এ ব্যাপারে আলিমগণের ফতোয়াও রয়েছে। কাজেই, উপায়হীন অবস্থায় যদি মুর্দার না খেয়ে কেউ মারা যায় তবে গুনাহগার দোযখবাসী হবে। জীবন রক্ষা ব্যতীত ইবাদত আদায় করা সম্ভব নয়। আর যে বস্তু ছাড়া ফরয আদায় করা সম্ভব নয়, তা করাও ফরয। এ কারণেই অপরের তুলনায় মানুষের নিজ পরিবার-পরিজন ও স্বীয় প্রাণ রক্ষার্থে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে খাদ্যের যোগাড় অপরিহার্য। তাই সুনানে আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: (*****) “তোমরা সাদকা দান কর।” এক ব্যক্তি আরয করলো: হে রাসূলুল্লাহ (স)! আমার নিকট একটি মাত্র দীনার রয়েছে। উত্তরে নবী করীম (স) বললেণ- (আরবী**********)
“নিজের জানের উপর সাদকা কর। সে বলল: আমার নিকট আরো একটি দীনার রয়েছে।” হুযূর (স) বললেন-(আরবী**********)
“এটা তোমার স্ত্রীর প্রয়োজনে ব্যয় কর।” লোকটি বললো: আমার নিকট তৃতীয় আরো একটি দীনার বর্তমান আছে।” হুযূর (স) বললেণ- (আরবী**********)
“তোমার সন্তানের প্রয়োজনে তা ব্যয় কর।” স বললো: আমার নিকট চতুর্থ একটি দীনারও রয়েছে। তিনি বললেন- (আরবী**********)
“এা তোমার খাদিমের পিছনে খরচ কর। লোকটি বললো: আমার নিকট সঞ্চয় আরো একটি দীনার বর্তমান রয়েছে।” নবী করীম (স) জবাবে বললন- (আরবী**********) “এটা কোথায় ব্যয় করতে হবে তা তুমিই ভাল জান।” সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“আল্লাহর রাস্তায় তুমি একটি দীনার ব্যয় করলে, এক দীনার তুমি গোলাম আযাদ করার ব্যাপারে খরচ করলে, এক দীনার তুমি দরিদ্রকে দান করলে, আর এক দীনার তুমি পরিবার-পরিজনদের প্রয়োজনে ব্যয় করলে, এর মধ্যে পরিবার-পরিজনদের প্রয়োজনে যেটি খরচ করলে, সাওয়াবের দিক থেকে সেটিই হবে অধিক।” (মুসলিম)
আবূ উমামা (রা) থেকে সহীহ মুসলিমে বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“হে বনী আদম! ধরে রাখার চাইতে অতিরিক্ত মাল খরচ করে দেয়াই তোমার মঙ্গলজনক। আর প্রয়োজন মত ব্যয় করা নিন্দনীয় নয়। যাদের ভরণ-পোষণের ভার তোমার উপর ন্যস্ত, প্রথমে তাদের জন্য খরচ কর। বস্তুতঃ উপরের হাত (দাতা) নীচের হাতের (গ্রহীতার) চেয়ে উত্তম।” (মুসলিম।
অধিকন্তু কুরআনের আয়াত রয়েছে যে, (আরবী**********)
“তারা তোমাকে প্রশ্ন করে যে, খরচ কি পরিমাণ করবে? তুমি তাদের বলে দাও, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা তাই।” এর মর্মার্থও একই।
(******) অর্থ অতিরিক্ত মাল। কেননা আপন সত্তা ও নিজ পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ করা ফরযে আইন। পক্ষান্তরে, ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’ (আল্লাহর পথে জিহাদ) ইসলামী যুদ্ধে ব্যয় করা এবং গরীবদের দান করা ‘ফরযে কেফায়া’ অথবা মুস্তাহাব। অবশ্য সময় ও ক্ষেত্র বিশেষে ‘ফরযে আইন’ও হয়ে দাঁড়ায়। তা তখনই হবে যদি অন্য কোন দানকারী বর্তমান না থাকে। কেননা ক্ষুধার্তকে অন্যদান করা ‘ফরযে আইন’। এ প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
(আরবী**********)
“যাঞ্ছনাকারী যদি সত্যবাদী হয় তবে তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেয়াতে কোন কল্যাণ নেই।”
আবূ হাতেম আবূস্তী (র) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে এক বিস্তারত ও দীর্ঘ রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন, যাতে অনেক জ্ঞানগর্ভ বিষয় রয়েছে। “আলে দাউদ (আ) এর প্রজ্ঞাময় একটি কথা এই যে, জ্ঞানী ও বিজ্ঞজনদের একটা কর্তব্য এটাও যে, তারা নিজেদের সময়কে চার ভাগে ভাগ করে নেবে। এক অংশে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত, দু’আ ও যিকরে অতিবাহিত করবে, দ্বিতীয় অংশ নিজের আত্মসমালোচনায় কাটাবে, তৃতীয অংশ বন্ধু-বান্ধবের সন্নিধ্রে ব্যয় করবে, যেন তারা তার দোষত্রুটি নির্দেশ করতে পারে, আর সময়ের চতুর্থ ভাগে নিজ প্রিয় বস্তু উপভোগের স্বাদ গ্রহণ করবে। কেননা এ অংশটি দ্বারা অপর অংশত্রয়ের সহায়তা লাভ হয়।
আলোচ্য রেওয়ায়েতের আলোকে প্রতিভাত হয়ে উঠে যে, শরীয়ত সিদ্ধ ও জায়েয চিত্ত বিনোদনের সময়ের একটা অংশ ব্যয় করা জরুরী। এর দ্বারা অন্যান্য মুহূর্তগুলোর শক্তিবৃদ্ধি ঘটে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফুকাহা বা ইসলামী চিন্তাবিদগণ বলেছেন: মনমানসিকতার সংশোধন ও কল্যাণ সাধনই ন্যায়পরায়ণতা। এর জন্য আবু দারদা (রা) বলতেন: কোন কোন সময় বাতিলের দ্বারাও আমি চিত্ত বিনোদন করে থাকি, যেন সত্য ও ন্যায়ের পথে তা আমার সাহায্য প্রাপ্তি ঘটে। বস্তুতঃ আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক প্রিয় এবং উপভোগ্য বস্তুএ জন্যে সৃষ্টি করেছেন, যেন এ দ্বারা সৃষ্টির উপকার হয়। যেমন ক্রোধকে এজন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এ দ্বারা ক্ষতিকর জিনিস থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হয়। আর কুপ্রবৃত্তি ও ভোগ বাসনা সেটাই হারাম করা হয়েছে, যা মানব জীবনে ক্ষতিকর। কিন্তু যে ভোগ বিলাস সত্যের উপর চলার সহায়ক হয় সেটা আমলে সালেহ বা সৎকাজের মধ্যে গণ্য। এ কারণেই সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (স) বলেন- (আরবী**********)
“তোমাদের স্ত্রী সম্ভোগও সাদকাস্বরূপ। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন: হে আল্লাহর রাসূল (স)! নিজেদের কামনা চরিতার্থ করাতেও কি সওয়াব?” উত্তরে হুযূর (স) বললেন-
(আরবী**********)
“তোমরা কি মনে কর, তা যদি হারাম পথে ব্যয় করা হতো তাতে কি গুনাহ হতো না?” সাহাবীগণ বললেন: কেন হবে না? অবশ্যই হবে। তিনি বললেন-
(আরবী**********)
“তাহলে তোমরা হারামের তো হিসাব লাগাও কিন্তু হালালের হিসাব করবে না।”
সাঈদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা) এর রেওয়ায়েত সূত্রে সহীহাইনে বর্ণিত আছে, নবী করীম (স) তাঁকে বলেছেন-
(আরবী**********)
“আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তুমি যা কিছু খরচ কর তাতে অবশ্যই মানমর্যাদা বৃদ্ধি পায়, এমনকি আপন স্ত্রীর মুখে তুমি যে লোকমা বা গ্রাস তুলে দাও এদ্বারাও তোমার সাওয়াব হাসিল হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
এ সম্পর্কে বহু হাদীস রয়েছে। বস্তুতঃ মুমিন বান্দা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে যদি কার্য সম্পাদন করে তবে প্রতি মুহূর্তে বিপুল সাওয়াবের অধিকারী হতে পারে।
উপরন্তু জায়েয ও শরীয়ত সিদ্ধ সৎকাজের দ্বারা নিজেদের আত্মা ও রূহের সংশোধন করে কলুষমুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে। পক্ষান্তরে মুনাফিকের কলুষিত মনের দুষ্ট প্রভাবে তার উদ্দেশ্যও কলঙ্কময় হয়ে পড়ে। অসৎ কর্মকাণ্ডের ফলেই মুনাফিক ব্যক্তির শাস্তি হয়ে থাকে। তার ইবাদত লৌকিকতায় পরিপূর্ণ হয়ে পড়ে। যার ফলে উপকারের স্থানে সেগুলো তার পক্ষে ক্ষতির হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“তোমরা সতকর্ততার সাথে জেনে রাখো, দেহের ভিতরে এমন এক খণ্ড মাংসপিণ্ড রয়েছে, যদি সেটা সুস্থ থাকে, তবে গোটা দেহ সুস্থ থাকে। পক্ষান্তরে সেটা যদি অসুস্থ ও মন্দ হয়, তবে সারা শরীর অসুস্থ ও দূষিত হয়ে যায়। জেনে রাখ, সেটা হল মানুষের কলব বা অন্তর।”
[বিশ]
ফরয–ওয়াজিবের উপর আমল ও হারাম থেকে রক্ষার জন্যেই শাস্তি
ফরয-ওয়াজিবের উপর আমল করার এবং হারাম বিষয় থেকে রক্ষার জন্যই শাস্তি দণ্ড নির্ধারিত করা হয়েছে। কাজেই এমন আকর্ষণীয় জিনিস তুলে ধরা চাই যা জনগণকে কল্যাণ ও আনুগত্যের দিকে উৎসাহিত করে। অপরদিকে মন্দের প্রতি উৎসাহ দানকারী বিষয় বস্তু থেকে জনগণকে বিরত রাখা প্রয়োজন।
হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং ওয়াজিবের উপর আমল করার জন্যই শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যের সহায়ক প্রতিটি বস্তুই শরয়তসম্মত করা হয়েছে। সুতরাং এমন পন্থা অবলম্বন করা উচিত, যদ্বারা কল্যাণকর পথ ও আনুগত্যের প্রতি উৎসাহ বৃদ্ধি পায় এবং এর সহায়ক ও সাহায্যকারী বলে প্রমাণিত হয়। জনগণকে কল্যাণ ও আনুগত্যের দিকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করাই বাঞ্ছনীয়। যথা, স্বীয় সন্তান ও পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করা আর রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও শাসনকর্তার পক্ষে জনগণের জন্য ব্যয় করা প্রয়োজন। কিন্তু তা এমন ধারায় ব্যয় করা চাই যাতে তাদের চেতনাবোধ ও উৎসাহিত ও উজ্জীবিত হয়। টাকা পয়সা ধন-সম্পদ কিংবা প্রশংসা দ্বারাই হোক অথবা বিকল্প কোন পন্থায় হোক। এ কারণেই উট-ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা, তীর-বর্শা চালানো ইত্যাদিতে শক্তি ব্যয় ও শরীর অনুশীলন করাকে শরীয়তসম্মত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মহানবী (স) নিজে এবং খোলাফায়ে রাশেদীন ঘোড় প্রতিযোগিতায় আনা হতো। মুয়াল্লাফাতুল কুলূবের অবস্থায়ও অনুরূপ যে, তাদের সাথে নম্র ব্যবহার ও শিষ্টাচার প্রদর্শন করা উচিত। এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে: এক ব্যক্তি পার্থিব নিষ্ঠাবান ও খাঁটি মুসলমানে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে যে, দুনিয়ার সকল বস্তু, সকলমানুষের তুলনায় একমাত্র ইসলাম তার প্রাণপ্রিয় বস্তুতে পরিণত হয়।
দুষ্করম ও গুনাহর বেলায়ও অবস্থা একই। কাজেই সমাজে পাপ অপরাধ প্রবণতা ও অন্যায়ের শিঁকড় নির্মূল করে ফেলা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের উচিত। অন্যায় অপরাধের সকল রাস্তা, যাবতীয ছিদ্র বন্ধ করে দেয়া একান্ত কর্তব্য। গুনাহ পাবের পথে উৎসাহ দানকারী সকল কার্যকলাপ পূর্ণ শক্তিতে রোধ করার সংগ্রাম চালু রাখা ততক্ষণ পর্যন্ত জরুরী যতক্ষণ না এর বিপরীত নিশ্চুপ বসে থাকা ও নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণের বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ পরিলক্ষিত হয়। মহানবী (স) এর বাণী থেকেই এর দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেছেন-
(আরবী**********)
“কোন পর পুরুষ কোন পর স্ত্রীলোকের সাথে নির্জন সান্নিধ্যে একত্রিত হবে না। কেননা শয়তান তাদের সঙ্গী হিসেবে তৃতীয় জন হয়ে যায়।”
তিনি আরো বলেন,
(আরবী**********)
“যে নারী আল্লাহ এবং আখিরাতের উপর বিশ্বাস রাখে, স্বামী কিংবা হারাম (যার সঙ্গে বিবাহ জায়েয নেই) ব্যতীত তার পক্ষে দু’দিনের দূরবর্তী স্থানে সফল করা যায়েজ নেই।”
নবী করীম (স) পরনারীর সাথে সাক্ষাৎ করা এবং তার সাথে একাকী সফর করা থেকে এ কারণেই নিষেধ করেছেন যেন, (সমাজ থেকে) অন্যায়, অপরাধ ও পাপাচারের মূলোৎপাটিত হয়ে যায়।
ইমাম শা’বী থেকে বর্ণিত আছে- “আবদুল কায়স” গোত্রীয় প্রতিনিধি দল হুযূর (স) এর দরবারে উপস্থিত হয়। একটি সুশ্রী সুদর্শন যুবকও তাদের দলে শামিল ছিল। তাকে দেখার পর তিনি যুবকটিকে তাঁর পেছনে বসার হুকুম দিলেন এবঙ বললেন: এ দৃষ্টিই ছিল হযরত দাউদ (আ) এর ভুলের কারণ।
ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) একবার জনৈকা মহিলার কবিতা আবৃত্তি শুনলেন, যার একটি শ্লোক ছিল-
(আরবী**********)
“পান করার মত সুরা লাভের কোন উপায় কি আছে গো…? নসর ইবন হাজ্জাজের সাক্ষাৎ লাভের কোন উপায় কি আমার হবে গো…?
হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) নসরইবনে হাজ্জাজকে তৎক্ষণাৎ ডেকে পাঠালেন- সে একজন সুন্দর সুঠাম, অমলকান্তি যুবাপুরুষ। হযরত উমর (রা) তার মাথা মুণ্ডন করেছিলেন।কিন্তু এতে তার চেহারায় উজ্জ্বল ও কমনীয়তা আরো বেড়ে গেল। অবশেষেতিনি তাকে দেশ ত্যাগের হুকুম দিলেন, যেন মদীনার রমনীকুল ফিতনায় পতিত না হয়।
অন্যত্র হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত, কোন এক লোক সম্পর্কে তিনি জানতে পারলেন যে, তার সান্নিধ্যে বালকেরা উঠাবসা করে থাকে। ছেলেদের তিনি তার নিকট বসতে এবং যাতায়াত করতে নিধে করে দিলেন।
হযরত ওমর (রা) এমন লোকের সান্নিধ্যে ও সংসর্গে গমনকরতে নিষেধ করতেন যার ফলে নারী-পুরুষের ফিতনায় পতিত হওয়ার আশংকা হতো কিংবা এর কারণ ঘটত।এমন সব বালকের অভিভাবকের কর্তব্য হলো, বিনা দরকারে তাদেরকে বাইরে যেতে না দেয়া, সেজে গুজে থাকতে ও সুগন্ধি লাগাতে নিষেধ করা, সাধারণ গোসল খানায় যেতে না দেয়া, একান্ত যদি যেতেই হয়, তবে শরীরের কাপড় যেন না খোলে এবং গান বাদ্যের আসরে শরীক হওয়া থেকে তাদের রিবত রাখে। এসব ব্যাপারে তাদেরকে কঠোর শাসন ও তদারকীকে রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
এভাবে যে ব্যক্তি সম্পর্কে প্রকাশ্য অভিযোগ পাওয়া যায় যে, সে আকাম কুকাম ও পাপাচারে অগ্রণী, তাকে সুন্দর সুশ্রী গোলামের অধিকারী বা মালিক হতে বিরত রাখতে হবে আর এ ধরনের গোলাম থেকে তাকে পৃথক করে দিতে হবে। কেননা, ফকীহগণ এ ব্যাপারে একম যে, প্রসিদ্ধ ও প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। আর তার সাক্ষ্য সম্পর্কে প্রতিপক্ষের প্রতিবাদ করার বৈধ অধিকার রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (স)-এর সম্মুখ দিয়ে এক ব্যক্তি জানাযা গমন কররে উপস্থিত লোকেতার তার প্রশংসা বাক্য উচ্চারণকরলো। তিনি বললেন: (****) “ওয়াজিব হয়ে গেছে।” অতপর অপর একটি জানাযায় গমন করলে লোকেরা মন্তব্য করল- “এ ছিল অতিশয় মন্ত লোক।” তিনি বললেন: (*****) “ওয়াজিব হয়ে গেছে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: হে রাসূলুল্লাহ। উভয়ের সম্পর্কে আপিন বললেন- (*****)-এর কারণ কি এবং কি জিনিস ওয়াজিব হলো। তিনি ইরশাদ করলেন-
(আরবী**********)
“প্রথম জানাযাটির তোমরা প্রশংসা করেছ, তাই আমি বলেছি তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় জানাযাটি সম্পর্কে তোমরা নিন্দাবাদ করেছ, কাজেই আমি বলেছি তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে। কেননা যমীনের বুকে তোমরা আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ।”
নবী করীম (স) এর যমানায় জনৈকা দূরাচারী নারী প্রকাশ্যে পাপাচার করে বেড়াতো, তার সম্পর্কে তিনি বলতেন-
(আরবী**********)
“সাক্ষী ছাড়াই কাউকে যদি আমি ‘রজম’ (প্রস্তারাঘাতে হত্যা) করতাম, তবে এ নারীটিকে আমি অবশ্যই রমজ করতাম।” এর কারণ হলো, শরীয়তে সাক্ষী কিংবা স্বীকারোক্তি ব্যতীত ‘হদ’ কায়েম করার বিধান নাই। কিন্তু এমন চরিত্রের লোকেরা সাক্ষী ও বিশ্বস্তততার ব্যাপারে চাক্ষুষ দর্শনের কোন প্রয়োজন নাই বরং এর জন্য সাধারণ জনশ্রুতিই যথেষ্ট। আর জনশ্রুতি যদি অপেক্ষাকত কম হয় তবে, তার সঙ্গী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবের প্রতি লক্ষ্য করে প্রমাণ দাঁড় করাতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন(আরবী**********)
“মানুষকে তার বন্ধু গুণে বিচার কর।”
অর্থাৎ দেখতে হবে সেই চরিত্রের লোকদের সাথে তার মেলামেশা উঠা-বসা, সে চরিত্র মানেই তার মূল্যায়ন করতে হবে। কোন্ চরিত্রের লোকেরা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু? মন্দা চরিত্রের হলে এ থেকে বেঁচে থাকা প্রয়োজন, যেমন শত্রু থেকে আত্মরক্ষা করা দরকার। এ প্রসঙ্গে হযরত উমন ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন-
(আরবী**********)
“মানুষের কু-ধারণা থেকে তোমরা বেঁচে থাক।”
এটা হযরত উমর (রা) এর নির্দেশ। তবে কু-ধারণার ভিত্তিতে কোন প্রকার সাজা দণ্ড প্রদান জায়েয নেই।
[একুশ]
অশ্লীলতা, হত্যাকাণ্ড, নিকটাত্মীয়, দুর্বল, পর সম্পদ জবর দখল থেকে দূরে থাকা
এ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় হলো, হদ ও অধিকার, বিনা কারণে কাউকে হত্যা করা, কিয়ামতের দিন সর্বাগ্রে অন্যায় হত্যার বিচার হবে, ‘কিসাস’ বা হত্যার প্রতিশোধ নেয়াতে নব জীবনের অবকাশ বিদ্যমান রয়েছে। অধিকন্তু কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির হত্যার কিংবা অধিকারের বিনিময়ে কারো প্রাণদণ্ড বিধান করা ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বাণী হলো-
(আরবী**********)
“মানুষকে আপনি বলুন, তোমরা এদিকে আসো। আমি তোমাদেরকে সে জিনিস পড়ে শুনাই যা তোমাদের পরওয়ারদিগার তোমাদের উপর হারাম করেছেন। তাহলো এই যে, তার সাথে কোন কিছুতেই শরীক করবে না, মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে, দারিদ্র্যের ভয়ে নিজেদের সন্তান হত্যা করো না, (কেননা) আমিই তোমাদের আহার যোগাই এবং তাদেরও, আর গোপন কিংবা প্রকাশ্য নির্লজ্জ কার্যকলাপের ধারে কাছেও যাবে না। আল্লাহ যাকে হারাম করেছেন এমন প্রাণ সংহার করবে না, অবশ্য ন্যায় পন্থায় (রাষ্ট্রীয় বিচার পদ্ধতিতে) হলে সেটা স্বতন্ত্র কথা। এ হলো সেসব কথা যা আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন, যেন তোমরা উপলব্ধি করতে পার। অধিকন্তু ইয়াতীমের মালের নিকটেও তোমরা যাবে না। তবে হ্যাঁ কল্যাণকর পন্থায় (যেতে পার), যতদিন না সে যৌবনে পদার্পণ করে আর ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতে তোমরা সঠিক ও পরিপূর্ণরূপে ওজন করবে এবং মাপ দেবে, সাধ্যের বাইরে আমি কারো ওপর (দায়েত্বের বোঝা) অর্পন করি না। যখন তোমরা কথা বল, তখন ন্যায় কথা বলবে, যদিও নিকটাত্মীয়ই হোক এবং আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা অঙ্গিকার পূর্ণ কর। এ হলো সেসব বিষয় আল্লাহ তা’আলা যেগুলোর হুকুম দিয়েছেন, যেন তোমরা এসব থেকে উপদেশ গ্রহণ কর। বস্তুতঃ এটাই হলো আমার সরল-সোজা পথ। কাজেই তোমরা এর অনুসরণ কর, অন্যায় পথসমূহের অনুসরণ করবে না। অন্যথায় (এ অনুসরণ) তাঁর রাস্তা থেকে তোমাদের ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে। এ হলো সে কথা আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে যার নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা মুত্তাকী হয়ে যাও।” (সূরা আনৎআম: ১৫১-১৫৩)
মহান আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন-
(আরবী**********)
“কোন মুসলমান অপর কোন মুসলমানকে হত্যা করা যায়েজ নয়, কিন্তু তবে ভুলবশতঃ হলে সেটা স্বতন্ত্র।….. আর যে ব্যক্তি জ্ঞাতসারে কোন মুসলমানকে হত্যা করবে, তার প্রতিফল হল জাহান্নাম। যেখানে সে অনাদি-অনন্তকাল বাস করবে, আল্লাহ তা’আলার গযব এবং অভিশাপ তার উপর পতিত হবে। তদুপরি আল্লাহ তা’আলা তার জন্য বড় কঠিন আযাব তৈরী করে রেখেছেন।” (সূরা নিসা: ৯২-৯৩)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন: (আরবী**********)
“এ কারণেই বনী ইসরাইীলকে আমি এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছি, যে ব্যক্তি খুনের বদলে কিংবা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির শাস্তিস্বরূপ নয়, বরং অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, সে যেন গোটা মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করলো। পক্ষান্তরে যেব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করলো, বস্তুতঃ সে যেন গেটা মানব জাতির জীবন বাঁচিয়ে দিল।” (সূরা মায়েদা: ৩২)
সহীহ বুখারী ও মুসরিমে বর্ণিত আছে, মহানবী (স) ইরশাদ করেছেন-
(আরবী**********)
“কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম অন্যায়ভাবে হত্যার বিচার হবে।” প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য হত্যা তিন প্রকার-
(১) কতলে আমাদ (ইচ্ছাকৃত হত্যা): যাতে ভুল-ভ্রান্তি কিংবা ভুল সাদৃশ্য হওয়ার সম্ভাবনার কোন অবকাশ নেই। যার ব্যাখ্যা হলো, অন্যায়বাবে কাউকে হত্যা করা, সাধারণতঃ যেভাবে হত্যা করা হয়ে থাকে যেমন তরবারী, খঞ্জর, ছুটি, হাতুড়ি, বেলচা, কোদাল, কুড়াল, ঢাল ইত্যাদির আঘোতি কিংবা গুলী ছুড়ে কাউকে হত্যা করা, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কিংবা পানিতে ডুবিয়ে মারা অথবা কোনও উঁচু স্থান হতে নীচে ফেলে হত্যা করা, গলাটিপে, অণ্ডকোষে তীব্র চাপ সৃষ্টি করে অথবা মুখ চেপে হত্যা করা কিংবা বিষপ্রয়োগে কারো প্রাণ হরণ করা। সুতরাং এ জাতীয় খুনের বদলে হদ জারী করতে হবে অর্থাৎ, হত্যাকারীর প্রাণসংহার করতে হবে। কিন্তু নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ এ ক্ষেত্রে তিনটির যে কোন এক পন্থা অবলম্বনের পূর্ণ অধিকার পাবে- (১) চাই তাকে হত্যা করুক কিংবা(২) ক্ষমা করে দিক, অথবা (৩) দিয়্যাত তথা রক্তমূল্য গ্রহণ করতঃ ছেড়ে দিক। কিন্তু নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণের পক্ষে হত্যাকারী ব্যতিরেকে অপর কাউকে হত্যা করা যাজেয় নয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী-
(আরবী**********)
“আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন বৈধ কারণ ব্যতীত তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করো না। আর যে ব্যক্তি মজলুম ও অন্যায় পথে নিহত হয, আমি তার ওয়ারিশকে অধিকার দিয়েছি। কাজেই (প্রতিশোধমূলক) হত্যার বেলায় সে যেন অন্যায় বাড়াবাড়ি না করে। কেননা (প্রাপ্য প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে) তারই জিত, সে-ই সাহায্য প্রাপ্ত।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩৩)
অত্র আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, কেবল মাত্র হত্যাকারী। ভিন্ন ধরনের কোন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দান বৈধ নয়। হযরত আবূ শুরায়হ আল খূযাঈ (রা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“যদি কোন ব্যক্তি খুন হয় অথবা আশংকাজনক অবস্থায় তাকে পাওয়া যায় এবং পর সে মারা যায়, এমতাবস্থায় উপায় মাত্র তিনটি, (১) হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ড দান, (২) তাকে ক্ষমা করে দেয়া, (৩) রক্তমূল্য গ্রহণ করতঃ তাকে ছেড়ে দেয়া। এ তিন পন্থা ছাড়া কেউ যদি চতুর্থ কোন পথ অবলম্বন করে, তবে তার এহেন কাজ অত্যাচারের শামিল, তাই তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম, যেখানে সে চিরকাল বাস করবে।” (আহলে সুনান তিরমিযী)
ক্মা করা অথবা রক্তমূল্য গ্রহণ করার পর হত্যাকারীকে হত্যা দণ্ড দান অতি কঠিন গুনাহ। এমনকি প্রথম কতল করার চাইতেও জঘন্যতম অপরাধ। এ পর্যায়ে কোন কোন আলিম এও বলেছেন যে, ‘হদে’র বিধান অনুসারে তাকে হত্যা করে ফেলতে হবে। কেননা নিহিত ব্যক্তির ওয়ারিশগণের কোন অধিকার নাই রক্তমূল্য গ্রহণকরার পর তাকে হত্যা করার।”
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লহার বাণী হচ্ছে-
(আরবী**********)
“তোমাদের মধ্য হতে নিহত ব্যক্তির প্রাণের বদলে এমন বিধান দেয়া হয়েছে যে, আযাদ ব্যক্তির পরিবর্তে আযাদ, গোলামের বদলে গোলাম আর নারীর বদলে নারীর। অতঃপরদ নিহতের ভাইয়ের পক্ষ থেকে সে ব্যক্তির কেসাসের কোন অংশ ক্ষমা করে দেয়া হলে, শরীয়তের বিধান মোতাবেক তার নিকট ভদ্রভাবে তাগাদা করা চাই। অপরপক্ষে হত্যাকারী কর্তৃক নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশদের সাথে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে তা সঠিকভাবে আদায় করে দেয়া উচিত। এটা তোমাদরে পালনকর্তার পক্ষ হতে তোমাদরে জন্য অতি সহজ পন্থা এবং বিশেষ দয়াস্বরূপ, এরপরও যদি কেউ সীমা অতিক্রম করে, তার জন্য রয়েছে ভিষণ কষ্টদায়ক আযাবের ব্যবস্থা। আর হে জ্ঞানীজন! কেসাসের মধ্যে রয়েছে “তোমাদের জীবনের নিরাপত্তাঃ, যেন তোমর (হত্যাকাণ্ড) থেকে বেঁচে থাক।” (সূরা বাকারাহ: ১৭৮-১৭৯)
এর বিশ্লেষণে আলিমগণ বলেন, নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশদের অন্তর থাকে ক্রোধ ও প্রতিশোধ স্পৃহায় পরিপূর্ণ। সম্ভব হলে তারা হত্যাকারী ও তার ওয়ারিশদের পর্যন্ত নিধন করতে উদ্যত-উন্মাত্ত হয়ে যায়। কাজেই কোন কোন সময় অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, তারা কেবল হত্যাকারীকে খুন করেই নিবৃত্ত থাকে না, বরং ঘাতকের সাথে সাথে তার আত্মীয়-স্বজন এমনকি গোত্রপতি সর্দারদের পর্যন্ত হত্যা করে বসে। এটা অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থা। কেননা হত্যাকারী প্রথম জুলুম করেছিল বটে কিন্তু নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ খুনের বদলা নিতে গিয়ে এমন সব মাত্রাবিহীন জুলুম অত্যাচার করে বসে, যা প্রকৃত হত্যাকারীও করে নাই। অধিকন্তু তারা এমন সব কর্মকাণ্ড করে বসে, যা কিনা শরীয়ত বহির্ভূত এবং জাহেলী যুগে পল্লীবাসী কি নগরবাসী সকলেই সমবেতভাবে সে কার্জে শরীক হয়ে পড়তো, আর বংশানুক্রমে তা চলতে থাকতো। নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ হত্যাকারীর ওয়ারিশদিগকে হত্যা করার চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতো। এদেরকে আবার বিপক্ষে দল হত্যা করে চলতো। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ নিজ নিজ মিত্র সংগ্রহ করত দলবদ্ধ হয়ে মারামারি কাটাকাটি ও হানাহানির এক প্রাণান্তকর পরিবেশে স্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতো ও দীর্ঘকাল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ জিইয়ে রাখত।
এমনিভাবে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার আবরণে গোত্রে গোত্রে হিংসা-প্রতিহিংসার অনিবর্বাণ শিখা আর শত্রুতার অনলপ্রবাহ অব্যাহত গতিতে বয়ে চলতো। এর মূল কারণ এটাই ছিল যে, তারা ন্যায়-ইনসাফের পথ পরিহার করে “কেসাস” তথা “খুনের বদলে খুন” এ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল না এবং এটাকে তারা যথেষ্ট মনে করতো না। ফলে হত্যার আইনগত প্রতিশোধে শরীয়তসম্মত পথে না গিয়ে, তারা ঘটনাকে ব্যাপক গণহত্যার রূপ দিয়ে বসত। অথচ মহান আল্লাহ আমাদের ওপর কেসাস ফরয করে দিয়েছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল অন্যায় হত্যার ইনসাফভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং সমাজ থেকে অন্যায় অত্যাচার নির্মূল করা।
প্রসঙ্গতঃ এটাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, “কেসাসের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জীবন।” কেননা কেসাসের ফলে হত্যাকারীর ওয়ারিশ অভিভাবকদের রক্তপাত বন্ধ হয়, প্রাণে বেঁচে যায়, ফিৎনা ফাসাদ দূরীভূত হয়। [কেসাসের ফলে হত্যাকারী অধিক হ ত্যাকাণ্ড করার সুযোগ পায় না] অধিকন্তু কোন ব্যক্তি যদি কাউকে হত্যা করার গোপন ইচ্ছা পোষণ করেও থাকে কিন্তু সে যখন জানতে পারে যে, পরবর্তীকালে তার সাধের প্রাণটাও রক্ষা পাবার নয় এবং কেসাসস্বরূপ নিজেরও মৃত্যু ঘটবে তখন এহেন মারাত্মক ও প্রাণের ঝুঁকি নিতে অবশ্যই সে বিরত থাকবে।
আলী ইবনে আবু তালিব (রা) এবং আমর ইবনে শুয়াইব (র) থেকে বর্ণিত আছে, মহানবী (স) বলেছেন-
(আরবী**********)
“সকল মুসলমানের রক্ত সমান, এ ব্যাপারে সবাই একমত, যিম্মীদের সাথে সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের সকলেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। সাবধান! স্বীয় অঙ্গীকারে স্থির থাকা পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ কোন ব্যক্তিকে এবং কাফিরের মুকাবিলায় কোন মুসলমানকে যেন হত্যা করা না হয়।” (আহমদ, আবু দাউদ)
এ সম্পর্কে মহানবী (স) ঘোষণা করেছেন: ছোট বড় আশরাফ আতরাফ নির্বিশেষে সকল মুসলমানের রক্ত সমপর্যায়ের। আরবীকে অনারব আজমীর উপর, কুরায়শী হাশিমীকে গায়র কুরাশী হাশিমীর উপর, আযাদ ব্যক্তিকে আযাদকৃত গোলামের ওপর, আলিমকে মূর্খের উপর এবং রাজাকে প্রচার উপর তিনি কোন প্রাধান্য দান করেন নাই। এটা সকল মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ রায় এবং সর্ববাদীসম্মত সিদ্ধান্তু। কিন্তু জাহেলী ধ্যান ধারণার বাহক এবং ইহুদী শাসকগোষ্ঠী এর বিপরীত পন্থা ও ভ্রান্ত নীতির ছত্রছায়ায় স্বার্থবাদী হুকুম জারি করার ফলে সারা আরব জাহান পরস্পর হানাহানি মারামারিত মেতে উঠে।
মদীনার পার্শ্ববর্তী জনপদে ‘বনু নাযীর’ ও ‘বনু কুরাইযা’ ইহুদীদের দুইদিট গোত্রের আবাস ছিল। বনু কুরাইযার মুকাবিলায় বনু নাযীর গোত্রের অধিক পরিমাণে খুন হয়েছিল, যে কারণে তারা নবী করীম (স) কে বিচারক সাব্যস্ত করেছিল। হদ্দে যিনার হুকুমের মধ্যে ইহুদীরা এ পর্যন্ত পরিবর্তন এনেছিল যে, রজমের পরিবর্তে তারা অপরাধীর গায়ে লোহার দাগ দিত। এরপর ইহুদীরা মুসলমানদের নিকট এসে বলতে থাকে, তোমাদের নবী যদি এ হুকুম প্রদান করেন, তবে এটা আমাদের জন্য দলীলস্বরূপ। অন্যথায় একথাই প্রমাণিত হবে যে, তোমরা তাওরাতের হুকুম বর্জন করেছ। এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহগ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন-
(আরবী**********)
“হে রাসূল! লোকদের কুফরী তৎপরতা যেন আপনাকে চিন্তিত ও মনঃক্ষুণ্ণ না করে, যারা শুধু মুখে বলে আমরা ঈমান এনেছি, অথচ তাদের অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করেনি….।
কাজেই হে পয়গম্বর! মীমাংসার জন্য যদি তারা আপনার নিকট উপস্থিত হয়, তবে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেয়া না দেয়া আপনার ইচ্ছাধীন, কিন্তু যদি তাদের ব্যাপারে মুখ ফিরিয়ে নেন বা বিরত থাকেন, তবে তারা আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি আপনাকে ফয়সালা করতেই হয়, তবে ন্যায়ের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিন, কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ন্যায় ও ইনসাফকারীকে পছন্দ করেন।…
তোমরা মানুষকে ভয় করবে না, ভয় করবে তো আমাকে করবে, আর আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না। যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব (এর বিধান মোতাবেক) হুকুম ফয়সালা করবেনা এরাই হলো কাফির। আর তাওরাতে আমি ইহুদীগণকে লিখিত হুকুম দিয়েছিলাম যে, জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে তাঁদ এবং জখমের বদলে একই পরিমাণ জখমের বিধান করতে হবে।” (সূরা মায়িদা: ৪১-৪৫)
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করেছেন যে, সকল প্রাণ একই পর্যায়ভুক্ত, একের উপর অপরের প্রাধান্যের অবকাশ নেই। অথচ ইহুদীরা লেনদেন, আচার-আচরণে এ ধরনের ভেদ নীতির প্রকাশ ঘটিয়ে চলতো।
(আরবী**********)
“হে নবী! আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব নাযল করেছি যা এর পূর্বে নাযিলকৃত কিতাবসমূহের স্বীকৃতি দান করে এবং সেগুলোর হিফাযতকারীও। কাজেই মহান আল্লাহ তোমার উপর যা কিছু নাযিল করেছেন এর ভিত্তিতেই তাদেরকে তুমি হুকুম দান কর, কিন্তু তোমার প্রতি নাযিলকৃত সত্য অর্জন করতঃ তাদের কুপ্রবৃত্তি ও খাহেশের আনুগত্য করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি বিশেষ পন্থা ও শরীয়ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছি….
এখনও কি তারা জাহেলী যুগের হুকুম কামনা করে? (আল্লাহর উপর) বিশ্বাস স্থাপনকারীগণেল জন্যে আল্লাহর চাইতে উত্তম হুকুমদাতা কে হতে পারে?” (সূরা আল মায়েদা: ৪৮-৫০)
আলোচ্য আয়অতে মহান আল্লাহ ফয়সালা করে দিয়েছেন যে, উঁচু-নীচু নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জান-প্রাণ, রক্ত একই মানের সমান পর্যায়ের অথচ জাহেলী যুগের অধিকাংশ হত্যা-খুন-জখম ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো প্রবৃত্তির চাহিদা ও খেয়াল খুশির মতো। ফলে নগর-বন্দর, নিভৃত পল্লীসহ সকল জনপদ এর বিশক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যেত। আপাত দৃষ্টিতে এর কারণ যাই থাকুক কিন্তু মূলত অন্তরের আল্লাহদ্রোহী প্রবণতা এবং বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি, আদল-ইনসাফের কার্যকর ভূমিকা না থাকাই ছিল এর জন্য এককভাবে দায়ী। গোত্রে গোত্রে একে অপরে উপর প্রাধান্য শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রভুত্ব কায়েমের প্রতিযোগিতা চলতো অব্যাহত গতিতে- চাই সেটা হত্যা ও খুনের ব্যাপারে হোক কি ধন-সম্পদের বেলায়- একে অপরের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করাকে সম্মান ও গৌরবের বিষয় মনে করা হতো। ন্যায় নীতির কার্যকারতা জলাঞ্জলি দিয়ে দু’দলের কেউ ধৈর্য, উদারতা ও মহানুভবতার ধার ধারতো না। পক্ষ প্রতিপক্ষ সকলেই একে অন্যের প্রতি অন্যায়-উৎপীড়ন ও জুলুম-নির্যাতন করতো। এক পক্ষ যা করতো প্রতিপক্ষও তার চাইতে কোন অংশে কম করতো না। এই ছিল তৎকালীন সামাজিক ন্যায় বিচারের বাস্তব চিত্র। সুতরাং এমনি এক অস্বস্তিকর ও অরাজক পরিবেশে পবিত্র কুরআন আদল ইনসাফ ও ন্যায়নীতি বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে এবং সমকালীন সমাজে প্রচলিত সকল প্রকার জাহেলী আইন-কানুন, হুকুম-আহকাম বাতিল ঘোষণা করেছে। কোন মুজাদ্দিদ কোন সংস্কারক সমাজ সংস্কারের ভূমিকা ও বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে ময়দানে আসলে সূচনাতে আদল-ইনসাফ ও ন্যায়নীতি অবলম্বন করেই তাঁকে এগিয়ে যেতে হবে। এমনি ধারা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের ফয়সালা হলো-
(আরবী**********)
“আর মুসলমানদের দু’টি দল যদি পরস্পরে যুদ্ধ-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দাও। অতঃপর েএকদল যদি অপর দলের উপর জুলুম অত্রাচার চালায়, তবে অত্রাচারীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করো যতক্ষণ না তারা আল্লাহর হুকুমের পতি ফিরে আসে। অতঃপর যখন তারা প্রত্যাবর্তন করে, তখনসাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে উভয়পক্ষে সন্ধি করিয়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ও ইনসাফকারীকে পছন্দ করে থাকেন। মুসলমানগণতো পরস্পর ভাই ভাই, কাজেই ভাইদের মধ্যে তোমরা আপোষের মিলমিশ এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্য স্থাপন করে দিও।”(সূরা হুজরাত: ৯-১০)
খুনের বদলার ব্যাপারে সব চাইতে উত্তম পন্থা হলো প্রথমতঃ নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। কেননা কুরআনে বরাণনা করা হয়েছে:
(আরবী**********)
“জখমের প্রতিশোধ অনুরূপ জখমই। অতঃপর যে মজলূম ব্যক্তি নিজের উপর কৃত জুলুমের প্রতিশোধ ক্ষমা করে দেয়, তাহলে এটা তার স্বীয় গুনাহর কাফ্ফারা হয়ে যাবে।” (সূরা মায়িদা: ৪৫)
হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন: (আরবী**********)
“কেসাসযোগ্য কোন ঘটনা বা মুকাদ্দমা নবী করীম (স) এর খিদমতে পেশ করা হলে, তিনি ক্ষমার নির্দেশ দান করতেন।” (আবু দাউদ)
সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা (রা) এর রেওয়ায়েত সূত্রে বর্ণিত আছে, মহানবী (স) ইরশাদ করেছেন:
(আরবী**********)
“সাদকার দ্বারা সম্পদের মধ্যে স্বল্পতা আসে না, আর যে ব্যক্তি অপরকে ক্ষমা করে দেয় আল্লাহ অবশ্যেই তার মান-সম্মান বাড়িয়ে দেন এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নম্রতা প্রকাশ করে, আল্লাহ তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন।” (মুসলিম)
ইসলামের সাম্যবাদী নীতি সম্পর্কেই আলোচনা হয়েছে, আলোচনায় পরিষ্কার হয়েছে যে, মুসলমান সকলে একই শ্রেণীভুক্ত এবং সাম্যেল অধিকারী কিন্তু সমপর্যায়ের ক্ষেত্রে যিম্মী কাফির ও মুসলমান একই স্তরের হতে পারে না, বরং এখানে বিশ্বাসগত পার্থক্য বিদ্যমান। সকল আলিম এ ব্যাপারে একমত। তদ্রুপ কোন যিম্মী কাফির ভ্রমণ কিংবা ব্যবসার উদ্দেশ্যে মুসলিম অধ্যুষিত শহরে আগমন করলে, সকলের ঐকমত্যে সেও মুসলমানের সমপর্যায়ের হবে না, আর সে মুসলমান সম-অধিকারের যোগ্য পাত্রও বিবেচিত হবে না।
অবশ্য কোন কোন আলিম মন্তব্য করেছেন যে, যিম্মীর বেলায়ও ‘কুফু’ তথা ইসলামী সাম্য প্রযোজ্য হবে এবং সে একজন মুসলিম নাগরিকের ন্যায় যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগের অধিকার লাভ করবে।
দ্বিতীয় প্রকার, খুন হল “কতলে খাতা” (খুলক্রমে হত্যা করা), যা (******) তথা “ইচ্ছাকৃত হত্যার’ প্রায় অনুরূপ। এ সম্পর্কে মহানবী (স)-এর ইরশাদ হলো:
(আরবী**********)
“তোমরা সাবধান! কোড়া কিংবা লাঠির আঘাতে ইচ্ছাকৃত হত্যা অনুরূপ “কতলে খাতার” দণ্ডস্বরূপ একশো উট দিতে হবে। যার মধ্যে চল্লিশটি উটনী হবে (গর্ভধারী) গাভীন।”
বস্তুতঃ একে “শিব্হে আমাদ” বলা হয়েছে যে, কোড়া কিংবা লাঠি দ্বারা প্রহারকারী জুলুম অবশ্যই করেছে। কেননা আধাতের বেলায় সে মাত্রায় এবং সীমার ভেতর সংগত থাকতে পারেনি। কিন্তু এটাও সত্যও কথা যে, এ ধরনের প্রহারের সব সময় যে মৃত্যু ঘটবে তা নয়, বরং প্রায়শ এর ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হয়।
তৃতীয় প্রকারের খুন হলো- “কাতলে খাতা” তথা ভুলক্রমে হত্যা। যেমন কোন ব্যক্তি শিকারে গুলি বা তীর ছুড়লো কিন্তু তা লেগে গেল এবং মানুষের গায়ে। অথচ এর পিছনে তার আদৌ কোন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল না। যার ফলে এহেন কল্পনাতীত ঘটনাটি ঘটে গেল। তাই এর বিনিময়ে ‘হদ’ তথা প্রাণদণ্ডের হুকুম জারী হবে না; বরং এরূপ ক্ষেত্রে কাফ্ফারা দিয়াত এবং রক্তমূল্য দেয়াই শরীয়তের বিধান। এ সম্পর্কিত বহু মাসআলা মনীষীগণের সংকলিত বা রচিত গ্রন্থরাজীতে লিখিত রয়েছে।