[সাত]
যাকাতের খাতসমূহ
যাকাত ৮ শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বণ্টন করবে
সাদকা এবং যাকাত ঐ সকল লোকের জন্যে, যাদের আল্লাহ্ তায়ালা কুরআন মজীদের সূরা আত-তাওবার ৬০ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে যাকাত চাইলে তিনি ইরশাদ করেনঃ
*******আরবী
“সাদকা এবং যাকাত বণ্টনে আল্লাহ্ তায়ালা কোনো নবী বা অপর কারো ইচ্ছাতে সম্মত না হলে নিজেই আট শ্রেণীর মানুষের মধ্যে তা বণ্টন করেছেন। তুমি ঐ আট শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হলে তোমাকেও দেবো”।
(১-২) *****আরবী- ফকীর মিসকীনঃ তাদেরকে তাদের প্রয়োজন মতো দেবো। ধনী মালদারের জন্যে সাদকা ও যাকাত জায়েয নেই। সুস্থ সবল ব্যক্তি, যে কাজকর্ম করে খেতে পারে, তার জন্যেও সাদকা ও যাকাত জায়েয নেই। (এটি ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নিজস্ব মত)
(৩) ******আরবী- সাদকা যাকাত উসূলকারীঃ এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণকারী এবং এ সম্পর্কিত বিষয়ের লেখক প্রমুখ সকলে এর মধ্যে শামিল।
(৪) ********আরবীঃ যাদের হৃদয়কে দ্বীনের স্বার্থে আকৃষ্ট করা প্রয়োজন তাদের জন্যে। ফাইলব্ধ সম্পদের আলোচনায় আমি এর উল্লেখ করেছি।
(৫) ****আরবীঃ গোলাম আযাদ, কয়েদী মুক্তির ক্ষেত্রে সাদকা যাকাতের অর্থ ব্যয় করা। এটিই বলিষ্ঠ রায়।
(৬) ******আরবীঃ করযদার ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের “গারেমীন” বলা হয়, যারা ঋণ এনে তা সময় মতো আদায় করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। তাদেরকে এ পরিমাণ দেবে, যদ্দারা তারা ঋণ পরিশোধে সক্ষম হয়। কোনো ব্যক্তি আল্লাহ্র অবাধ্যতা জনিত কারনে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে, যে পর্যন্ত না সে তওবা করে ঐ কাজ থেকে বিরত হবে, তাকে গণীমতের মাল দেবে না।
(৭) *****আরবীঃ আল্লাহ্র রাস্তায় নিবেদিত ব্যক্তি। এতে ঐ সকল লোক অন্তর্ভুক্ত যারা যোদ্ধা, যারা আল্লাহ্র মাল থেকে এ পরিমাণ পায়নি, যা তাদের প্রয়োজনে যথেষ্ট। আর যারা যুদ্ধে যেতে সক্ষম তাদেরকে এ পরিমাণ দেবে, যাতে তারা যুদ্ধে অংশ নিতে পারে কিংবা পুরোপুরি যুদ্ধ-সামগ্রীতে ব্যয় করতে এবং মজুরী আদায় করে দিতে পারে। হজ্জও ফী সাবীলিল্লাহ-এর অন্তর্ভুক্ত। রাসূল (সা)-এর উক্তিও এর প্রতি সমর্থন জানায়।
(৮) *****আরবীঃ ইবনুস সাবীল। দুস্থ প্রবাসী যে সফরে রত।
[আট]
গণীমতের মালের আলোচনা এবং
কর্মকর্তাদের অবৈধ কমিশন প্রসঙ্গ
“মাল-এ-ফাঈ” কাকে বলে? তার ব্যয়ের খাত কি কি? মহানবীর যুগে আনুষ্ঠানিক অর্থ দফতর বা অর্থ বিভাগ ছিল না। তেমনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর যুগেও না। হযরত ওমরের যুগে যখন বিভিন্ন দেশ জয় হয় এবং মালে গণীমত হিসাবে অসংখ্য ধন-সম্পদ আসতে থাকে, তখন তিনি এজন্যে দিওয়ান (দফতর) খোলার নির্দেশ দেন। ঘুষ-রিশওয়াত সম্পূর্ণ হারাম। কর্মকর্তাদের কার্যসিদ্ধির মতলবে হাদিয়ার নামে যা দেয়া হবে, তাও রিশওয়াত বা ঘুষের অন্তর্ভুক্ত।
“ফাঈ” সম্পর্কে সূরা হাশরের নিম্নোক্ত আয়াতগুলো হচ্ছে মূল। বদর যুদ্ধের পর অনুষ্ঠিত বনী নযীরের যুদ্ধের সময় এসব আয়াত নাযিল হয়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন-
*****************আরবী
“আল্লাহ্ তায়ালা তাদের নিকট হতে তাঁর রাসূলকে বিনা যুদ্ধে যা প্রদান করেছেন, তার জন্য তোমরা ঘোড়া বা উটে আরোহণ করে যুদ্ধ করোনি, কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে যাদের উপর ইচ্ছা তাদের ওপর কর্তৃত্ব দান করেছেন। আল্লাহ্ সব কিছুর উপর অত্যাধিক ক্ষমতাশীল। আল্লাহ্ তায়ালা ঐ সকল জনপদবাসী থেকে যেসব সম্পদ তাঁর রাসূলকে দিয়ে দিয়েছেন, তা আল্লাহ্র এবং রাসূলের, রাসূলের নিকটাত্মীয়দের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্ত ও রিক্তহস্ত দুস্থ প্রবাসীদের হক। [এই হুকুম এজন্যেই প্রদান করা হয়েছে,] যেন তোমাদের মধ্যকার সম্পদশালীদের মধ্যে অর্থ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে ঘুরপাক না খায়। ( হে ঈমানদারগণ!) রাসূল তোমাদেরকে যা প্রদান করেন, তা তোমরা নিয়ে নাও আর যা গ্রহণ নিষেধ করেন, তা থেকে তোমরা বিরত থাকো। আল্লাহ্কে ভয় করো। কারণ-আল্লাহ্ শাস্তি দানে কঠোর। [বিনা যুদ্ধে যেসব মাল হস্তগত হয়েছে, তাতে অন্যান্য হকদারের মধ্যে] মুহতাজ মুহাজিরদেরও হক রয়েছে, যারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায় কাফিরদের জুলুম নিপীড়নের কারণে (হিজরত করে), নিজ বাসগৃহ ও সম্পদ-সম্পত্তি থেকে বেদখল হয়েছে, তারা এখন আল্লাহ্ তায়ালা এবং তাঁর রাসূলের সাহায্যে দৃঢ়প্রদে দন্ডায়মান। এরাই সত্যিকারের মুসলমান, আর হাঁ, তারাও বিনাযুদ্ধে হস্তগত সম্পদের হকদার যারা ইতিপূর্বে মদীনায় বসবাস করতো এবং ইসলামে প্রবেশ করেছে। তাদের নিকট যারা হিজরত করে এসেছে, তাদেরকে তারা ভালবাসে। গণীমতের মাল থেকে মুহাজিরদেরকে যা কিছু প্রদান করা হয়, এজন্যে তারা মনে কোনো প্রকার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না। আপন অস্বচ্ছলতা সত্ত্বেও তারা মুহাজিরদেরকে (সুযোগ-সুবিধা প্রদানে) নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়। নিজ প্রকৃতিকে যারা কার্পণ্য থেকে রক্ষা করে, তারাই সফলকাম আর ঐ সকল মানুষেরও এতে অধিকার রয়েছে, যারা প্রথম পর্যায়ের মুহাজিরদের পরে হিজরত করে এসেছে এবং এই বলে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে যে-
“ হে পরোয়াদেগার! আমাদিগকে এবং আমাদের ঐ সকল ভাইকে আপনি মাফ করে দিন, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছেন। যারা পূর্বে ঈমান এনেছেন, আমাদের অন্তরে যাতে ঐ সকল ব্যক্তির ব্যাপারে হিংসাবিদ্বেষ আমরা পোষণ না করি, (আমাদেরকে সেই তওফীক দান করুন।) হে আমাদের প্রভু! আপনি অতি দয়ালু, মেহেরবান”। (সূরা হাশরঃ ৬-১০)
আল্লাহ্ তায়ালা এসব আয়াতে মুহাজির, আনসার এবং ঐ সকল লোকের কথাও উল্লেখ করেছেন, যারা পরে এসব গুণ-বৈশিষ্টের অধিকারী হবে। সুতরাং তৃতীয় প্রকারে এমন বৈশিষ্ঠ্যের অধিকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই এতে শামিল, আর কিয়ামত পর্যন্তই এ হুকুম বিদ্যমান থাকবে।
*********আরবী
“ যেসব লোক পরে ঈমান এনেছে এবং হিজরত করেছে ও তোমাদের সাথে জিহাদেও শরীক হয়েছে, তারা তো তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত”। (সূরা আনফালঃ ৭৫)
আল্লাহ্র এই বক্তব্যেও তাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ হয়েছে-
********আরবী
“ আর যারা নিষ্ঠা সহকারে তাদের অনুসরণ করে। (সূরা তওবাঃ ১০০)
এই আয়াটিতেও অনুরূপভাবেই তাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ হয়েছে-
***********আরবী
“ আর ঐ সকল লোক যারা এখনও তাদের সাথে শামিল হয়নি (তবে শেষ পর্যন্ত তাদের সাথে এসে মিলিত হবে)। আল্লাহ্ প্রবল পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়”। (সূরা জুমুআঃ ৩)
******আরবী অর্থাৎ তোমরা জিহাদের জন্যে উট নিয়ে কোনো ছুটাছুটি ও তৎপরতা চালাওনি-জিহাদের উদ্দেশ্যে তোমাদের এসব পরিচালনা করতে হয়নি। ইসলামী আইনবিদগণ এ অর্থের প্রেক্ষিতেই বলেছেন যে, “কাফিরদের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়া যে সম্পদ হাতে আসে তাকেই ‘মাল-ই-ফাঈ’ বলা হয়। ****আরবী শব্দটি ****আরবী হতে সংগঠিত। ‘ইজাফ’ অর্থ যুদ্ধ সংঘর্ষ। *****আরবী অর্থ হলো, ঘোড়া এবং উটসমূহ অর্থাৎ এগুলো চালনা করে তোমাদের যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়নি।
এ জাতীয় মালকে “ফাঈ” এজন্যে বলা হয় যে, আল্লাহ্ তায়ালা মুসলমানদেরকে কাফিরদের কাছ থেকে বিনা যুদ্ধে এ মাল এনে দিয়েছেন।
মূল কথা হলো, আল্লাহ্ তায়ালা মাল দৌলত এজন্যে দিয়েছেন, যেন এসব ইবাদতের ক্ষেত্রে মানুষের সহায়ক হয়। বলাবাহুল্য, মানব সৃষ্টির মূল লক্ষ্যই হলো, আল্লাহ্র ইবাদত বা পূর্ণ দাসত্ব-আনুগত্য করা। সুতরাং কাফিররা যেহেতু আল্লাহ্র ইবাদত করে না এবং নিজেদের মাল সম্পদও আল্লাহ্র ইবাদতে ব্যয় করে না, এজন্যে (সত্যের পথে বাধা দানকারীদের) এ সম্পদকে মুসলমানদের জন্যে হালাল ও জায়েয করা হয়েছে, যেন এ সম্পদের দ্বারা তাদের শক্তি সঞ্চয় হয় এবং তারা ইবাদত করতে পারে। কারণ মুসলমানরা একমাত্র আল্লাহ্র বন্দেগী করে থাকে।
সুতরাং ‘মাল-ই-ফাঈ’ তাদেরকে দেয়া হয়েছে, যারা এর হকদার ছিল। এটা এরূপ যেমন কারোর মীরাস বা উত্তরাধিকার ছিনিয়ে নেয়া হলে তার হক তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়, যদি সেটা ইতিপূর্বে অপরের করায়ত্তে থাকে। অথবা এটা সেরূপ যেমন ইহুদী ও নাসারাদের নিকট থেকে জিযিয়া নেয়া হয় কিংবা ঐ মালের মতো, যদ্দারা দুশমনের সাথে সন্ধি করা হয় অথবা এটা ঐ সম্পদের ন্যায় যা অমুসলিমদের পক্ষ থেকে উপঢৌকন হিসাবে রাষ্ট্রপ্রধান পেয়ে থাকে। এটাকে সেই সম্পদের সাথেও তুলনা করা যায়, কোনো খৃষ্টান জনপদ বা অপর জনপদের উপর দিয়ে যাবার সময় সওয়ারীর ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্যভাবে যা ব্যয়িত হয়। মোটকথা, মাল-ই-ফাঈ মুসলমানদের জন্য হালাল ও জায়েয করা হয়েছে যেন মুসলমান এই সম্পদের দ্বারা শক্তি অর্জন করতে পারে এবং আল্লাহ্র ইবাদতে সমর্থ হয়।
শত্রু পক্ষের সওদাগত এবং ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে যা কিছু নেয়া হয়, সেটা হচ্ছে তাদের মোট সম্পদের এক দশমাংশ তথা উশর। এ সকল বণিক-সওদাগর যদি যিম্মী হয় এবং নিজ জনপদ থেকে বের হয়ে অপরের জনপদে গিয়ে ব্যবসায় বাণিজ্য করে, তাহলে তাদের নিকট উশরের অর্ধেক তথা বিংশতম অংশ গ্রহণ করবে। দ্বিতীয় খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তাই করতেন।
সন্ধি ভঙ্গকারীদের পক্ষ হতে দণ্ডস্বরূপ যে অর্থ গ্রহণ করা হয়, সেই অর্থও এরি মধ্যে শামিল। খারাজের মালও এরি অন্তর্ভুক্ত হবে, যা কাফিরদের উপর আরোপিত ছিল। যদিও এর মধ্য থেকে কিছু অংশ কোনো মুসলমানের উপরও আরোপিত হবে। ১ (১. এর ধরন হচ্ছে এরূপ যেমন, প্রথম কাফিরের হাতে কোনো যমীন ছিল, এখন সেটা মুসলমানদের হাতে এসে গেছে। এর মূল যেহেতু খারাজী যমীন, মুসলমানের উপরও একই খারাজ আসবে যা মূল যমীনের উপর নির্ধারণ করা হয়েছিল।)
অতঃপর “মাল-এ-ফাঈ”-এর সাথে সকল প্রকার মাল জমা করা হবে। যে পরিমাণ সরকারী মাল থাকে, তার সবই মুসলমানদের বায়তুল মালে জমা করা হবে। যেমন লা-ওয়ারিশ মাল। হয়তো কোনো মুসলমান মারা গেছে এবং তার কোনো ওয়ারিশ নেই অথবা ছিনতাইকৃত মাল কিংবা হাওয়াতী বা আমানতী মাল যেগুলোর মালিকরা নিরুদ্দেশ। এ মাল জমিন হতে পারে কিংবা স্থাবর কোনো সম্পত্তি। এ ধরনের অন্যান্য মালসহ সবগুলোই মুসলমানদের সম্পদ এবং এগুলো রাষ্ট্রীয় অর্থভান্ডার বায়তুল মালেই জমা করা হবে।
কুরআন মজীদে শুধু “মাল-এ-ফী”-এর কথাই উল্লেখিত- অন্য মালের কথা উল্লেখ নেই। কারণ মহানবী (সা)-এর যুগে যেসব লোক মারা গেছে, তাদের উত্তরাধিকারী ছিল। সাহাবা-এ-কিরামের বংশ পরিচয় জানা ছিল।১ (১.এছাড়া ইসলামের প্রভাব বলয় শুধু আরবেই সীমাবদ্ধ ছিল আর আরবদের বংশ পরিচয় সকলের জানা ছিল। এজন্যে এক শ্রেণীর মালের কথাই উল্লেখিত হয়েছে। কুরআন মজীদে শুধু ফাঈ-এর কথা বলা হয়েছে) একবার কোনো এক গোত্রের জনৈক ব্যক্তি মারা গেলে মহানবী (সা) তার পরিত্যক্ত সম্পদ সংশ্লিষ্ট গোত্র প্রধানের হাওলা করেন। সে সরদার বংশ পরিচয়ের দিক থেকে তার দাদার নিকটাত্মীয় ছিল। ইমাম আহমদ প্রমুখ উলামা-এ-কিরামের এক অংশের এটিই অভিমত। ইমাম আহমদ (রহ) এর ব্যাখ্যা করেছেন। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে যদি তার উত্তরাধিকারী না থাকে, তাহলে তার উত্তরাধিকার তার আযাদকৃত গোলামকে দিয়ে দিবে। ইমাম আহমদের শিষ্যদের একটি বড় জামায়াত এ মতেরই অনুসারী।
কোনো ব্যক্তি মারা গেলে যদি তার উত্তরাধিকারী না থাকে, তাহলে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেবে। মহানবী (সা) এবং খুলাফা-এ-রাশেদীনের অনুসৃত নীতি এটিই ছিল যে, মৃত ব্যক্তি এবং তার উত্তরাধিকার দাবিদারদের মধ্যে আত্মীয়তার সামান্যতম সম্পর্কের প্রমাণই যথেষ্ট।
মুসলমানদের নিকট থেকে নিয়মিতভাবে যে মাল সংগ্রহ করা হতো, তা ছিল যাকাত। যাকাত ব্যতীত তাদের নিকট থেকে আর কিছু গ্রহণ করা হতো না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেতেন, মুসলমানকে জানমাল দিয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদে শরীক হতে হবে এবং আল্লাহ্র নির্দেশ পালন করতে হবে।
মহানবী (সা) এবং হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগে অধিকৃত মাল যা বণ্টন করা হতো এজন্যে কোনো পূর্ণাঙ্গ দেওয়ান বা দফতর ছিল না। বরং ন্যায়সঙ্গত পন্থায় মুসলমানদের মধ্যে তা বণ্টন করে দেয়া হতো। হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)- এর যুগে সম্পদ ও শাসন পরিধি উভয়েরই ব্যাপ্তি ঘটে। তখন যোদ্ধা, মুজাহিদীন এবং ভাতা প্রাপ্তদের জন্যে দেওয়ান এবং দফতর খোলা হয়। উমর (রা) খোদ্ এ দেওয়ান ও দফতর তৈরী করেন। তাতে মুজাহিদীন এবং নিয়মিত সেনাবাহিনীর নাম ঠিকানা লেখা থাকতো। এই দেওয়ান এবং দফতরই মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবময় বিষয়। বিভিন্ন শহর এবং জনপদ থেকে যে সকল খারাজ এবং ‘ফাঈ’ পাওয়া যেতো, তার দফতর আলাদা ছিল।
ফারুকী যুগে এবং তার পূর্বে সরকারী পর্যায়ে আগত সম্পদ তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। এক শ্রেণীর মালের উপর ইমাম ও আমীরের অধিকার ছিল। তিনিই এর অধিকারী বলে বিবেচিত হতেন। এর উপর আল্লাহ্র কিতাব, সুন্নাহ্ এবং মুসলিম উম্মাহ্র ইজমা (ঐক্যমত্য) রয়েছে। আর এক প্রকার মাল রয়েছে, যা গ্রহণ করা ইমাম এবং আমীরের জন্যে হারাম। যেমন, অপরাধে জড়িত থাকার কারণে যদি কাউকে হত্যা করা হয়, তাহলে তার সম্পদ অপর কোনো জনপদ থেকে বায়তুল মালের জন্যে উসূল করতে হবে, যদিও তার উত্তরাধিকারী থাকুক কিংবা সে কোনো ‘হদ’ বা শরয়ী দণ্ডপ্রাপ্ত হোক।
আর এক শ্রেণীর মাল আছে, যে ব্যাপারে ইজতিহাদ ( বা প্রয়োগ বুদ্ধির) অবকাশ থাকে। এ ব্যাপারে উলামা-এ-কিরামের মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন, কোনো ব্যক্তি সম্পদ রেখে মারা গেছে। তার নিকটাত্মীয় রয়েছে। কিন্তু তার *******আরবী যুল ফুরুয বা আসাবা অথবা তৎসম পর্যায়ের কোনো ওয়ারিশ নেই। তাতে কি পন্থা অনুসৃত হবে, এ ব্যাপারে উলামা-এ-কিরামের মত ও পথের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
অধিকাংশ জনগণ জুলুম-নিপীড়নে জর্জরিত হয়। শাসনকর্তা ও উচ্চ সরকারী কর্মকর্তারা হালাল হারামের কোনো পরোয়া করে না। জনগণ থেকে কর উসূল করে থাকে। আবার জনগণও কোনো সময় নিজের কর্তব্য পালন থেকে বিরত থাকে। বায়তুল মালে সম্পদ সঞ্চয়ের পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে ফৌজ (সামরিক খাত) এবং কৃষি পেশায় নিয়োজিতদের উপর জুলুম হয়ে থাকে। অথবা জনগণ জিহাদ রূপ ফরয ছেড়ে দেয়। অপরদিকে রাষ্ট্রনায়করা বায়তুল মালে অর্থ জমা করেন। কিন্তু তাতে হালাল হারামের আদৌ লেহাজ করেনা না। সরকারী অর্থ-সম্পদ অনাদায়ে জনগণকে শাস্তি দেন। মুবাহ এবং ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দিয়ে এমন সব কাজে লিপ্ত হন, যা রাষ্ট্র পরিচালকদের জন্যে কিছুতেই হালাল বা জায়েয নয়। মূল কথা হলো, কারোর নিকট যদি এমন মাল থাকে, যা রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা দেয়া তার উপর ফরয, কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে তা আদায় করছে না, এমন ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে হবে। ঐ সকল মালের দৃষ্টান্ত হলো, যেমন, গচ্ছিত মাল, মুজারাবাত বা সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসায় বা কৃষিজাত মাল, ইয়াতীমের মাল কিংবা ওয়াকফকৃত মাল, বায়তুল মালের সম্পদ। ঋণ গ্রহীতা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ আদায় না করলে, তাকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে তার মাল বাজেয়াপ্ত করতে হবে। অথবা মালের জায়গায় সন্ধান দেবে যে, অমুক জায়গায় আছে। অতঃপর যখন এটা নিঃসন্দেহ হওয়া যাবে, তার কাছে মাল আছে, তখন তাকে গ্রেফতার করবে। মালের সন্ধান না দেয়া পর্যন্ত তাকে আটক রাখবে। অবশ্য প্রহার করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মালের সন্ধান দান কিংবা ঋণ পরিশোধের জন্যে তাকে প্রহার করবে, যেন হকদারের হক আদায় করে দেয় কিংবা আদায় করা সম্ভব হয়। ‘নাফকা-এ-ওয়াজিবা’ তথা ‘অবশ্য দেয়’ খোরপোশের ক্ষেত্রেও একই হুকুম, যদি বিবাদী খোরপোশ দিতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তা আদায় না করে। মহানবী (সা) থেকে উরওয়া ইবনে শারীদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বলেছেন-
*******আরবী
“সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি পাওনা দেয় না, তার মাল জব্দ এবং তাকে শাস্তি দান বৈধ”।
সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে আছে- ******আরবী
“প্রাপ্য অনাদায়কারী বিত্তশালী জালেম”।
হকদারের হক আদায় গড়িমসি করাটাও হক না দেয়ার নামান্তর এবং জুলুম। আর জালেম ব্যক্তি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধী। এটা সর্বস্বীকৃত কথা যে, হারামে লিপ্ত এবং ওয়াজিব তরককারী শাস্তিযোগ্য। অতএব শরীয়তে যদি তার শাস্তি নির্ধারিত না থাকে, তাহলে ‘উলুম আমর’ বা নেতা এ ব্যাপারে ইজতিহাদের আশ্রয় নিবেন। হক অনাদায়কারী বিত্তবানকে শাস্তি দেবেন। যে অনাদায় জেদ ধরে তাকে দৈহিক শাস্তি দেবে, যেন তা আদায় বাধ্য হয়। এ ব্যাপারে ফকীহদের স্পষ্ট অভিমত রয়েছে। ইমাম মালিকের শিষ্যবর্গ এবং ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমদ এর পূর্ণ ব্যবস্থা প্রদান করেছেন। এতে কারোর দ্বিমত নেই। এটি সর্বস্বীকৃত বিষয়।
ইমাম বুখারী সহীহ বুখারীতে ইবনে উমরের একটি রিওয়ায়েত উল্লেখ করেন। তাতে ইবনে উমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন খায়বরের ইহুদীদের সেনা, রুপা এবং অস্ত্র-শস্ত্রের বদলে তাদের সাথে সন্ধি করেন, তখন কোনো কোনো ইহুদী রাসূলুল্লাহ (সা)-কে হুই ইবনে আখতাবের ধনভাণ্ডার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, তখন হুযূর (সা) ইরশাদ করেন- **********আরবী
“ঐ সকল সম্পদ খরচ হয়ে গেছে আর যুদ্ধে সব নিয়ে গেছে”।
ইহুদীদ নেতা সাঈদ (হুই ইবনে আখতারের চাচা) রাসূল (সা)- কে বলল, আপনার সাথে তো এখন চুক্তি হলো আর চুক্তির ভিত্তিতে এ মালের পরিমাণ অনেক বেশী। রাসূলুল্লাহ (সা) সাঈদকে হযরত যুবায়েরের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি সাঈদকে শাস্তি দেন। বর্ণনাকারী বলেছেন, আমি হুই ইবনে আখতাবকে বিরান ভূমিতে ঘুরাফেরা করতে দেখেছি। তখন লোকজন সেখানে গিয়ে সবকিছু ভালভাবে দেখালো। তারা ঐ বিরান ভূমি থেকে অনেকগুলো মশক বের করে আনলো। উল্লেখ্য যে, ঐ ব্যক্তি ছিল যিম্মী আর কোনো অপরাধ ব্যতীত যিম্মীকে শাস্তি দেয়া যায় না। শাস্তির এ নির্দেশ হচ্ছে এমন সব ব্যক্তির জন্যে, যারা অত্যাবশ্যকীয় জিনিস গোপন করার অপরাধে অপরাধী। সুতরাং ওয়াজিব তরকের ভিত্তিতে সে শাস্তিযোগ্য।
অর্থ বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অন্যায়ভাবে মুসলিম জনগণের যেই অর্থ-সম্পদ উসূল করে, ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্বের জন্য ফরয হলো, ঐ সকল অফিসার হতে অন্যায়ভাবে আদায়কৃত মালসমূহ বাজেয়াপ্ত করা। হাদিয়া, তোহ্ফা, সালামী, উপঢৌকনের নামে ঐ সকল কর্মকর্তা (অফিসার) নিজ নিজ শাসনামলে ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা জনগণের ঐ অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করেছিল। হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন- ********আরবী
এ ক্ষেত্রে হাদিয়া, উপঢৌকন হচ্ছে, অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক আদায় কৃত জনসম্পদ, যা এক শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তারা করে থাকেন।
ইবরাহীম হারাবী (রহ) তার ******আরবী “কিতাবুল হিদায়া” গ্রন্থে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে রিওয়ায়েত করেন-
********আরবী
“রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন যে, শাসকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত হাদিয়া, তোহফা হচ্ছে আমানতে খেয়ানত এবং জোরপূর্বক জনসম্পদ আদায় করার নাম”।
সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে আবূ হামীদা সাঈদী (রহ) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ‘আযদ’ গোত্রের ইবনুল্লা তবিয়া নামক এক ব্যক্তিকে যাকাত উসূলকারী কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। সে এসে হযরতের সামনে যাকাতের মাল রেখে বললো, এ মাল হচ্ছে আপনার, আর ঐগুলো হচ্ছে আমার, যা হাদিয়াস্বরুপ মানুষ আমাকে দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন-
**********আরবী
“ এ ব্যক্তি কেমন লোক! তাকে আমরা কাজের দায়িত্ব দিয়েছি, যে কাজের দায়িত্ব আল্লাহ আমাদের উপর ন্যস্ত করেছেন। সে এখন বলছে, এটা আপনার মাল আর ওটা আমাকে ‘হাদিয়া’ স্বরূপ প্রদান করা হয়েছে। সে তার পিতা-মাতার বাড়ী গিয়ে বসে থেকে দেখুক না, তার কাছে হাদিয়া-উপঢৌকন পৌঁছে কিনা? সেই মহান সত্তার কসম, যার কুদরতী হাতে আমার জান, ঐ ব্যক্তি যে জিনিসই গ্রহণ করুক না কেন, কিয়ামতের দিন তা আর ঘাড়ে সওয়ার হবে। উট হলে সেটা চিৎকার দিতে থাকবে, মুখে ফেনা বের হবে আর গাভী হলে সেটা হাম্বা করবে এবং বকরী হলে করবে ভ্যাঁ, ভ্যাঁ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) নিজের বাহুযুগল উপরে এতদূর উত্তোলন করেন যে, আমরা তাঁর বগলদ্বয় দেখতে পাই। তিনি তিনবার বললেন, হে আল্লাহ! আমি কি (আপনার বাণী) পৌঁছে দিয়েছি, আমি পৌছে দিয়েছি?” (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসটির উল্লেখিত মর্ম সমাজের বিভিন্ন স্তরের ঐ সকল “উলূল আমর” (আঞ্চলিক শাসক-প্রশাসনিক কর্মকর্তা)-এর বেলায়ও প্রযোজ্য, যারা ঘুষ, হাদিয়া-তোহফা ইত্যাদি নিয়ে কারোর কাজে সাহায্য করে। যেমন, (অফিসে) ব্যবসায়-বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, চাকুরী ও বেতনের প্রশ্নে, মুজারাবাত, মুসাকাত, মুযারায়াত ইত্যাদিতে এ ধরনের কাজে-কারবারে উপকার হলে, এখানেও একই হুকুম প্রযোজ্য হবে। এ কারণেই হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) কোনো কোনো কর্মচারীর বেতন অর্ধেকে হ্রাস করে দিয়েছিলেন। তাদের মাল-সম্পদ থাকলেও তারা ঋণীও ছিল। আবার খেয়ানতকারী হিসাবেও তারা অভিযুক্ত ছিল না। তাঁর কর্মচারীদের সাথে এই আচরণ করার কারণ ছিল এই যে, তারা কর্মকর্তা হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাদিয়া-তোহফা নিয়েছিল। হযরত উমর (রা) তাদেরকে গভর্ণর ও কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। তাই তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ নেতা ও শাসক হিসাবে সম্পদের সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করণার্থে (প্রশাসনে স্বচ্ছতা বিধান এবং আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে) এ ধরনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
শাসক ও জনগণের মধ্যে বিকৃতি দেখা দিলে প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হলো, আপন আপন কর্তব্যসমূহ যথাযথ পালনে সচেষ্ট হওয়া। হারাম বর্জন করা এবং আল্লাহ যে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন, তা হারাম মনে না করা।
সরকারী কর্মকর্তাদের উপঢৌকন না দিলে অনেক সময় জনগণকে বিপদের কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। উপঢৌকন না দেয়া হলে ঐ সকল কর্মকর্তার জুলুম-নিপীড়ন থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় না। তারপরও তারা এভাবে মানুষের উপর জুলুম-অত্যাচার চালিয়েই নিজেদের দায়িত্ব পালন করে। জোর করে তাদের থেকে অধিক (কর) যাকাতের মাল আদায় করে। বৈষয়িক স্বার্থে নিজের আখিরাতকে সর্বনাশ করে। যে ব্যক্তি এভাবে অপরকে বৈষয়িক শান্তি ও আনন্দ দানের জন্যে এরুপ করে, সে তার আখিরাতকে বিনষ্ট করে। তার কর্তব্য ছিল যথাসম্ভব জুলুমের প্রতিরোধ করা। জনগণের সুযোগ সুবিধার প্রতি লক্ষ্য দেওয়া। মানুষের অভাব অভিযোগ দূর করা। রাষ্ট্রপ্রধানকে জনগণের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করা। জনগণের কোনো অংশ অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইলে, তা থেকে সমাজকে রক্ষা করা।
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
************আরবী
“যারা নিজেদের অভাব-অভিযোগের কথা আমার কাছে পৌঁছাতে পারে না, তোমরা তাদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে আমাকে অবহিত করবে। কারণ, যারা জনগণের অভাব-অভিযোগের প্রতি শাসন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, আল্লাহ তা’আলা পুলসিরাতে তাদের পদযুগলকে সুদৃঢ় রাখবেন-বড় বড় ব্যক্তির পাও সেদিন (পরিস্থিতির ভয়াবহতায়) কাঁপতে থাকবে”।
ইমাম আহমদ (রহ) এবং সুনানে আবূ দাঊদের মধ্যে আবূ উমামা বাহেলী কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
**********আরবী
“ কোনো ব্যক্তি যদি অপর কোনো ভাইয়ের জন্যে সুপারিশ করে আর তার বিনিময়ে সে কোনো উপঢৌকন পাঠায় এবং ব্যক্তিটি সেটা গ্রহণ করে, তাহলে সে সুদের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো”।
ইবরাহীম হারবী (রহ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে তার প্রয়োজন পূরণের অনুরোধ জানালো। সে তার প্রয়োজন মিটিয়ে দিলে অপরজন হাদিয়া পাঠালো আর সে তা কবুল করে নিল। তাহলে এটা হারাম হলো।
হযরত মাসরুক কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, তিনি ইবনে যিয়াদের সাথে কোনো একটি জুলুমের ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। অতঃপর ইবনে যিয়াদ সেই জুলুম বন্ধ করেন। তাতে মাসরুক সন্তুষ্ট হয়ে একটি গোলাম হাদিয়াস্বরুপ তাঁর নিকট পাঠান। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-কে বলতে শুনেছি যে, কোনো মুসলমানের উপর থেকে কোনো জুলুম বা অন্যায় দূরীভূত হলে, এর বিনিময়ে যদি সে কম হোক বা বেশি কোনো কিছু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রদান করেন, তাহলে সেটা হারাম হবে। ইবনে যিয়াদ বলেন, আমি বললাম, হে আবদুর রহমান! আমরা তো এখন সুহ্ত (অবৈধ লেন-দেন) ছাড়া কিছুই বুঝি না। তিনি জবাব দিলেন, ঘুষ বা রিসওয়াত তো কুফরী।
অতএব কোনো শাসনকর্তা বা উচ্চ কর্মচারী যদি নিজের জন্যে কর্মচারীদের নিকট থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করে, যা ঐ ব্যক্তির নিজের ও পরিবারের জন্যে নির্দিষ্ট করা ছিল, এমতাবস্থায় দাতা গ্রহীতা উভয়ের কাউকেই সাহায্য করা উচিত নয়। উভয়ই জালেম। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, এক চোর কর্তৃক অপর চোরের মাল চুরি করার মতো। অথবা এমন দু’টি দলের লড়াইর মতো, যারা নিজেদের বংশ গৌরব এবং নেতৃত্ব ও ক্ষমতার জন্যে লড়াই করছে। এমন সময় জুলুমের সহযোগিতাকরণ কিছুতেই জায়েয নহে। কারণ, সহযোগিতা দু’ধরনের হয়ে থাকেঃ
১. সৎ এবং তাকওয়া-পরহেযগারীর কাজে সাহায্য করা, যেমন জিহাদ করা, শরী’আতী দন্ডবিধি সমাজে কায়েম করা। হকুকুল ইবাদ তথা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, হকদারকে হক প্রদানের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এই ধরনের সহযোগিতা করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা কুরাআনে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ পাক এবং তার রাসূল (সা) এ সহযোগিতাকে ফরয করে দিয়েছেন। কোনো প্রকার ভীতি সন্ত্রাসের কারণে কেউ সৎ ও নেকীর কাজ থাকে বিরত হলে এবং জালিমের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লে, তখন অন্ন মুসলমানরা মজলুমের সাহায্যে এগিয়ে না আসলে এটা ফরযে আইন ও ফরযে কেফায়া ছেড়ে দেয়ার অপরাধ হবে। নিজ খোশ-খেয়ালে যদি কেউ এটা মনে করে যে, সে তাকওয়া পরহেযগারীর অধিকারী, এজন্যে ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার দরকার, তাহলে এ পরিস্থিতিতে যদি সে মজলুমকে সাহায্যে না করে, এতে সে ফরয তরকের অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য হবে। ভীরুতা এবং পরহেযগারীর মধ্যে অনেক সময় বিভ্রান্তি ঘটে। ভীরুতা বশতঃ যেমন কেউ (ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়) অপরের সাহায্য থেকে বিরত থাকে, তেমনি নির্লিপ্ত ভূমিকাকেও পরহেযগারী মনে করা হয়।
২. এ শ্রেণীর সহযোগিতা গুনাহ এবং আল্লাহর অবাধ্যতা। যেমন, মাসূম নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা কিংবা তার মাল লুট ও ছিনতাই করা। যে প্রহারের অপরাধ করেনি, তাকে প্রহার করা। এ ধরনের অপরাধমূলক কাজে সাহায্য সহযোগিতা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল হারাম করে দিয়েছেন।
অবশ্য অন্যায়ভাবে যদি কোনো জনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয় বা ছিনিয়ে আনা হয়, যা পরে নানা কারণে এর মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া অসম্ভব হয়, তাহলে সে সম্পদ জনকল্যাণে ব্যয় করাটাও তাকওয়া এবং পুণ্য কর্মের শামিল। এ জাতীয় সরকারী সম্পদ মুসলমানদের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত। যেমন জিহাদ, জিহাদের জন্যে বিভিন্ন মোর্চা তৈরির কাজ কিংবা মুজাহিদীন তথা সামরিক প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় ইত্যাদি তাকওয়া ও পুণ্য কর্মের অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রের ব্যয়ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতারই কাজ। কেননা, শাসক অন্যায়ভাবে যাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে, তারা বা তাদের কোনো উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতিতে এ সম্পদ এখন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা শাসকের উপর ফরয। সাথে সাথে শাসককে আল্লাহর কাছে অনুতাপ অনুশোচনা করে তওবা করতে হবে। এটিই সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামী আইনবিদদের অভিমত। ইমাম মালিক, ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম আহমদ প্রমুখের একই মত। অনেক সাহাবা-এ-কিরাম থেকেও এটা বর্ণিত আছে। শারঈ দলীল প্রমাণাদিও এই অভিমতের সমর্থন করে।
(অবৈধভাবে আদায়কৃত) মাল অপর কেউ যদি নিয়ে নেয়, তাহলে শাসকের উপর ফরয হলো, তা (উদ্ধার করে) যার মাল তাকে বা তার উত্তরাধিকারীদেরকে ফেরত দেয়া কিংবা সেটা তাদের কল্যাণে ব্যয় করা। অথবা তাদের অনুপস্থিতিতে মুসলমানদের কল্যাণমূলক কোনো কাজে লাগানো। সম্পদ বিনষ্ট করার চাইতে মুসলমানদের কল্যাণে ব্যয় করা অতি শ্রেয়। কারণ, আল্লাহর একথার উপরই শরীআত নির্ভরশীল-
*********আরবী
“যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করো”। (তাগাবুনঃ ১৬)
*******আরবী
“ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর ব্যাপারে যতদূর সাবধান হওয়া আবশ্যক, সাবধান হও”।
এর ব্যাখ্যা নির্ভর করছে মহানবী (সা)-এর নিম্নোল্লেখিত হাদীসের উপর-
*******আরবী
“আমি যখন তোমাদের কোনো ব্যাপারে নির্দেশ দেই, তোমরা সেটা সম্পাদনে যথাসাধ্য চেষ্টা করো”।
সামাজিক কল্যাণ প্রচেষ্টার লক্ষ্যমাত্রায় উপনীত হওয়া এবং সমাজ থেকে পুরোপুরি অশান্তি দূরীভূত হওয়া কিংবা হ্রাস পাওয়া, সবকিছু নির্ভরশীল হচ্ছে যথাক্রমে উপরোল্লিখিত আয়াত এবং হাদীসের দাবী বাস্তবায়নের উপর।
সমাজে কল্যাণ এবং অকল্যাণের সংঘাত দেখা দিলে, কল্যাণকর দু’টি বিষয়ের মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত অধিক কল্যাণকর সেটিই গ্রহন করবে। ক্ষতির মধ্যেও যেটি বেশী ক্ষতিকর, সেটিই পরিহার করবে।
যেই ব্যক্তি জালিমকে সাহায্য করে সে গুনাহ এবং আল্লাহর অবাধ্য কাজের সাহায্যকারী। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মজলূজকে সাহায্য করে কিংবা কোনো জুলুম নির্যাতনের পরিমাণ হ্রাস করার ব্যাপারে সহায়তা করে অথবা জুলুম অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণে সচেষ্ট থাকে, তাহলে সে মজলূমের উকিল ও প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করলো- জালিম বা অত্যাচারীর নয়। এটা সেই ব্যক্তিরই অনুরুপ যে ঋণ দিয়েছে কিংবা জালিমের জুলুম থেকে বাঁচানোর জন্যে কারোর সম্পদের প্রতিনিধি হয়েছে। যেমন ইয়াতীমের মাল, ওয়াকফ সম্পত্তির মাল। এসব মালে হয়তো অন্যায়ভাবে কোনো জালিম ভাগ বসাতে চায়, সে অবস্থায় এর মুতাওয়াল্লী অক্ষমতা হেতু কিছু না দিয়ে পারছে না, কিন্তু সে যথাসম্ভব কম দেয়ার চেষ্টা করেছে, এমতাবস্থায় মুতাওয়াল্লী পূর্ণ চেষ্টা চালিয়ে যদি কিছুটাও কম দিতে পারে, সেটা পুণ্যবানের কাজ হবে। (তবে ঐ জালিম সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে সরকারী প্রশাসনের আইনগত ব্যবস্থা ও জন-প্রতিরোধ আবশ্যক।)
এই নির্দেশের অধীন সেই উকিল বা প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত যে মাল আদায় করার ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করে থাকে, তা লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে অংশ গ্রহণ করে। যে ব্যক্তি মাল বাজেয়াপ্তকরণে এবং তা দেয়ার কাজে অংশ নেয় তারও একই হুকুম।
কোনো জনপদ, গ্রাম, অথবা রাস্তাঘাট, বাজার কিংবা শহরে যদি কোনো অন্যায় বা জুলুম হতে থাকে আর কোনো পরোপকারী ব্যক্তি সেই জুলুম প্রতিরোধে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয় এবং সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করে, কোনো ঘুষ গ্রহণ ব্যতিরেকে ইনসাফ ন্যায়-নীতির সাথে হকদারকে হক দিতে চেষ্টা করে আর ভর্তসনাকারীদের ভর্তসনা উপেক্ষা করে নির্ভীকভাবে একাজ করে, তাহলে সেও পরোপরকারী এবং পুণ্যকর্মশীল।
কিন্তু আজকাল যে কেউ এ জাতীয় মহৎ কাজে অন্যায় হস্তক্ষেপ করে, সে ঐ জালিমেরই প্রতিনিধি হয়ে সহায়তা করে। জালিমকে ভয় করে, বিচারপ্রার্থী থেকে ঘুষ গ্রহণ করে, এজন্যে গর্ববোধও করে, যার থেকে যা পায় অর্থ গ্রহণ করে। এরা জালিম- এদের স্থান জাহান্নাম ছাড়া আর কোথায় হতে পারে? তাদের সহযোগীরাও জাহান্নামী। তাদেরকে অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
[৯]
সরকারী আয়ের খাতসমূহ
গুরুত্বানুসারে অর্থের পর্যায়ক্রমিক বণ্টন হওয়া উচিত। জিহাদে লিপ্ত এবং মুজাহিদীনের সহায়তাকারীরা সকলের চাইতে রাষ্ট্রীয় অর্থের (মাল-এ-ফাঈ) অধিক হকদার। ‘মাল-এ-ফাঈ’-র ব্যাপারে উলামা মুজতাহিদদের মধ্যে ইখতিলাফ (মতবিরোধ) রয়েছে যে, মাল-এ-ফাঈ পুরোপুরি কি মুসলিম জনকল্যাণে ব্যয়িত হবে, না শুধু মুজাহিদীনের মধ্যেই এর বণ্টন সীমিত থাকবে? মহানবী (সা) ‘মুয়াল্লাফাতুল কুলূব’-কেও মাল-এ-ফাঈ থেকে প্রদান করতেন।
*******আরবী
“আমানত (অধিকারসমূহ) তার যথার্থ হকদারকে বুঝিয়ে দাও”। বলতে যা বুঝায়-
অর্থ-সম্পদের ব্যয় এবং এর বণ্টন মুসলিম কল্যাণেই হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে গুরুত্ব পর্যায়ক্রমিক নীতির প্রতি লক্ষ্য রাখা ওয়াজিব। যেমন, সাধারণ মুসলমানদেরকে সাধারণ কল্যাণে পৌঁছানো। এদের মধ্যেই জিহাদকারী ও জিহাদে সহায়তাকারীরাও রয়েছে। মাল-এ-ফাঈ এর মধ্যে সকলের চাইতে হকদার হচ্ছে ইসলামের মুজাহিদগণ। কারণ মুজাহিদীন ব্যতীত ‘মাল-এ-ফাঈ’ অর্জন সম্ভব নয়। এই মুজাহিদীনের দ্বারাই এ অর্থ পাওয়া যায়, আর এজন্যেই ফকীহ তথা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞগণ এ মর্মে দ্বিমত ব্যক্ত করেছেন যে, মাল-এ-ফাঈ মুজাহিদীনের মধ্যেই খরচ করা হবে, না জনকল্যাণকর সকল প্রকার কাজে তা ব্যয়িত হবে? মাল-এ-ফাঈ ছাড়া যে পরিমাণ অর্থই হোক তাতে সকল মুসলমান এবং তাদের কল্যাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ব্যাপারে সকল ইমামেরই ঐকমত্য রয়েছে যে, সাদকা, যাকাত এবং গণীমতের মালের খাত নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এর হকদার হচ্ছে নিম্নোক্ত শ্রেণীর লোকজন-যেমন, কর্মচারী, মূল কর্তৃত্বের অধিকারী, ব্যক্তি প্রমুখ। শাসন কর্মকর্তা, বিচারক, উলামা আর ঐ সকল লোক যারা ঐ অর্থ সংগ্রহ করার দায়িত্ব পালন করে, এর রক্ষণাবেক্ষণ যাদের হাতে ন্যস্ত। এমনকি নামাযের ইমাম ও মসজিদের মুয়াজ্জিন প্রমুখও এদের মধ্যে শামিল। এমনিভাবে সেই বেতনও এর অন্তর্ভুক্ত যে কাজের উপকারিতা জনগণের কাছে পৌঁছে। যেমন সীমান্তে ঘাঁটি নির্মাণ, সমরোপকরণ খাতে ব্যয় করা, অত্যাবশ্যকীয় গৃহ নির্মাণ, জনগণের সুবিধার্থে রাস্তা ঘাট নির্মাণ ও উঁচু নীচু জায়গা সমতল করা। প্রয়োজনে ছোট-বড় নির্মাণ করা, পানি নিস্কাশন প্রণালী পরিষ্কার রাখা, খাল কাটা, পুরানো খালের সংস্কার করা- এই প্রত্যেকটি জিনিসই হচ্ছে অর্থ ব্যয়ের খাত। অভাবী লোকজনও এর মধ্যে রয়েছে।
ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণের মধ্যে এ ব্যাপারে মত পার্থক্য রয়েছে যে, যাকাত ছাড়া মাল-এ-ফাঈ ইত্যাদিতে অভাবী লোকদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে কিনা? ইমাম আহমদ প্রমুখের মাযহাএ দুটি বক্তব্য রয়েছে। কেউ কেউ তাদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন আবার কেউ কেউ বলেছেন, এতে প্রত্যক্ষ দ্বীনী কাজের অগ্রাধিকার থাকবে। এ শ্রেণীর সকলকেই সমঅংশিদার ও সমপর্যায়ের হকদার বলে মনে করে। যেমন পরিতাজ্য সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারীদের সমঅংশিদার থাকে। তবে সঠিক কথা হলো, অভাবীকে অগ্রাধিকার দেবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা) অভাবীদেরকে অগ্রাধিকার দিতেন। যেমন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন-
***********আরবী
“ এই মালে সকলের অংশ রয়েছে। এই মাল সে ব্যক্তি পাবে, যে জিহাদে প্রথমে অংশ গ্রহন করেছে। আর ঐ ব্যক্তি এ মাল পাবে, যে এ কাজে কষ্ট সহ্য করেছে। তাতে ঐ ব্যক্তির হক রয়েছে, যে ব্যক্তি জটিল প্রতিকূলতার পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। আর তাতে হকদার রয়েছে অভাবী লোকেরা”।
হযরত উমর (রা) চার শ্রেণীর লোকের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টন করতেন-
১. যাদের যুদ্ধাভিযানে যাওয়ার ফলে মাল হস্তগত হয়েছে।
২. যারা মুসলমানদের স্বার্থে বিশেষ প্রকারের কষ্ট পরিশ্রম করে। যেমন, শাসনকর্তাবৃন্দ এবং ঐ সকল শিক্ষিত-উলামা যারা মানুষকে দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ প্রাপ্তির খোদায়ী পথ দেখান এবং যারা সমাজের ক্ষতি ও অকল্যাণ প্রতিরোধে অবাঞ্ছিত বিপদ আপদ ও দুঃখকষ্ট সহ্য করেন। যেমন, আল্লাহর পথের মুজাহিদীন যারা ইসলামী সেনাবাহিনীরুপে কর্মরত রয়েছেন।
৩. সেসব বিশেষ ব্যক্তি যারা যুদ্ধবিশেষজ্ঞ এবং সৈনিকদের উপদেশ দেন, ইসলামী শিক্ষা সংস্কৃতি-আদর্শ প্রচারে ওয়ায-নছীহত দ্বারা সমাজকে সৎপ্রবণ রাখার কাজে নিয়োজিত।
৪. যারা অভাবগ্রস্ত।
যখন এই চার শ্রেণীর মানুষের পক্ষ থেকে নিশ্চিত হওয়া যাবে, তখন মনে করবে আল্লাহ্ তায়ালা এই মালের দ্বারা জনগণকে স্বচ্ছল করে দিয়েছেন। অতঃপর প্রয়োজন অনুপাতে বা কাজ অনুসারে দেবে।
এতে বুঝা গেল যে, নাগরিকদের কল্যাণ এবং তার প্রয়োজনানুসারে রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ দিতে হবে আর সেই অর্থ-সম্পদ হতে হবে মুসলমানদের কল্যাণার্থে। যাকাতের বেলায়ও একই অবস্থা। যদি এ থেকে অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ হয়, তাতেও সেই পরিমাণই অধিকার থাকবে এ জাতীয় মালে যে পরিমাণ হকদারের হক থাকে। যেমন, মালে গণীমত ও উত্তরাধীকারের অর্থ-সম্পদ। এগুলোর হকদার বা অধিকারীরাও নির্দিষ্ট রয়েছে।
মুসলমানের রাষ্ট্রীয় নেতার পক্ষে যেখানে ব্যক্তি স্বার্থ, পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতিবশতঃ কাউকে কিছু প্রদান আদৌ বৈধ নহে, সেক্ষেত্রে হারাম কাজে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ের অনুমতির তো প্রশ্নই উঠে না। যেমন হিজড়া, ঘাটুর ছোর্কা, গায়িকা, পতিতা, কৌতুকাভিনেতা, (ইসলামী মূল্যবোধ বিরোধী) অভিনেত্রী, গণক, জ্যোতির্বিদ প্রমুখকে অর্থ দান করা। তবে হাঁ ইসলামের স্বার্থে যার অন্তঃকরণ জয় করা প্রয়োজন, এমন ক্ষেত্রে অর্থ দান আবশ্যক।
কুরআন মজীদে ‘মুয়াল্লাফাতুল কুলূব’-এর জন্য যাকাত দানকে ‘মুবাহ’ করা হয়েছে। মহানবী (সা) খোদ ‘মুয়াল্লাফাতুল কুলূব’ খাতে ‘ফাঈ-এর অর্থ প্রদান করতেন এবং ঐ সকল ব্যক্তিকেও এ থেকে প্রদান করতেন, যারা গোত্রের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। যেমন, বনী তামীমের সর্দার আকরা ইবনে হাবিস, বনী ফাযারার সর্দার উয়ায়না ইবনে হাসন এবং বনী নাবহানের সর্দার যায়েদুল খায়ের আত্তায়ী, বনী কিলাবের সর্দার আলকাশ ইবনে আল্লামা। এমনিভাবে তিনি কুরাইশ নেতা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিকেও উক্ত তহবিল থেকে অর্থ-সম্পদ দান করেছেন। যেমন, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, ইকরামা ইবনে আবু জেহ্ল, আবু সুফিয়ান ইবনে হরব, মুহাইল ইবন আমর, হারিস ইবন হিশাম প্রমুখ। এ মর্মে বর্ণিত বুখারী, সহীহ মুসলিমে আবু সাঈদ খুদরী (রা) কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, হযরত আলী (রা) ইয়ামান থেকে একবার মহানবী (সা)-এর নিকট একটি সোনার হার পাঠিয়েছিলেন। মহানবী (সা) সেই সোনার হারটি চার ব্যক্তির মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। তাঁরা হলেনঃ আকরা ইবনে হাবিস আলহানজালী, উয়াইন ইবনে হাসন ফাযারী, আলকামা ইবনে আলামিতা আলামেরী এবং বনী কিলাবের যায়েদুল খায়ের আততায়ী। তিনি বনী নাবহানের সরদার ছিলেন।
আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, মহানবী এই বণ্টন ব্যবস্থায় কুরাইশ এবং আনসারদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় । তারা বলতে শুরু করলেন যে, মুহম্মদ (সা) নজদী নেতাদের মধ্যে অর্থ সম্পদ ব্যয় করলেন আর আমাদেরকে বাদ দিয়েছেন। মহানবী (সা)-এর কানে একথা আসলে তিনি তাঁদের ডেকে বললেনঃ “তালীফ-এ কুলূব” তথা ইসলামের প্রতি তাদের অন্তরের গভীর আকর্ষণ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমি তা করেছি। ঠিক ঐ সময় সেখানে অতি ঘন দাড়িবিশিষ্ট এক আগন্তুকের আগমন ঘটে। তাঁর গন্ডদ্ব্য ছিল উন্নত এবং চোখ-যুগল অতি উজ্জ্বল এবং সে ছিল প্রশস্ত ললাটের অধিকারী আর তার মস্তক ছিল মুণ্ডিত। সে বললো-
**********আরবী
“ (হে মুহাম্মদ!) আল্লাহকে ভয় করো”। নবীজি বলেন, আমিই যদি আল্লাহর নাফরমানী করি, তাহলে কে তাঁর আনুগত্য করবে? ভূপৃষ্ঠের সকলে আমাকে যেখানে বিশ্বস্ত মনে করে, সে ক্ষেত্রে তোমরা কি আমাকে বিশ্বস্ত মনে করবে না?”
হাদীসের বর্ণনাকারী বলেছেন, উক্ত ব্যক্তি একথা বলেই চলে যাচ্ছিল। তখন সমবেতদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললোঃ তাকে হত্যা করো। সাহাবা-এ-কিরাম বলেছেন, দাঁড়িয়ে উক্তিকারী ব্যক্তি হচ্ছে খালিস ইবনে ওয়ালীদ (রা)। ইসলামী আত্মমর্যাদা এবং মহানবী (সা)-এর প্রতি মহব্বতে তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। হযরত খালিদ লোকটিকে হত্যা করার জন্যে মহানবী (সা)-এর অনুমতি চাইলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
**********আরবী
“ তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন একদল হবে, যারা কুরআন পড়বে কিন্তু তাদের খঞ্জর নামবে না। তারা মুসলমানদের সাথে লড়াই করবে এবং পৌত্তলিকদেরকে আমন্ত্রন জানাবে। ইসলাম থেকে তারা এমনভাবে বের হয়ে যাবে, যেমন ধনুক থেকে তীর দ্রুত বের হয়ে যায়। আমার জীবদ্দশায় যদি আমি (ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে) তাদের পাই, তাহলে আ’দ সম্প্রদায়কে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, আমি তাদের অনুরূপভাবে কতল করবো”।
রাফি ইবনে খাদীজ (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আবূ সুফিয়ান ইবনে হরব (রা) এবং সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, উয়াইনা ইবনে হাসন, আকরা ইবনে হাবিসকে শত শত উট প্রদান করেছিলেন। আব্বাস ইবনে মারদাসকে কিছু কম দিয়েছিলেন। তখন আব্বাস ইবনে মারদাস নিম্নোক্ত কবিতাটি পড়েছিলেন।
********আরবী
“ আপনি কি আমার এবং আমার ঘোড়া-‘উবায়েদের সংগৃহীত (সম্পদ) উয়াইনা ও আকরাকে দিয়ে দিচ্ছেন?”
**********আরবী
“ হাসান এবং হাবিস সভা-বৈঠকে মারদাস থেকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারে না”।
*********আরবী
“ এ দু’জন থেকে আমি কি কোনো অংশে কম? যে পাল্লাটি উঠানো যেতো না অর্থাৎ ভারি ছিল, তাঁকে ঝুকিয়ে দিল?”
একথা শুনে রাসূলুল্লাহ তাকেও একশ’ উট দিয়ে দিলেন। মুসলিম শরীফে এ রিওয়ায়েতটি রয়েছে এবং উবায়েদ ছিল মারদাসের ঘোড়ার নাম।
“মুয়াল্লাফাতুল কুলূব” দু’প্রকার-কাফির ও মুসলমান। কাফিরদের হৃদয় জয়ের ব্যাপারটি হবে এমন, তাদের থেকে কল্যাণের প্রত্যাশা রাখবে যে, হয়তো তারা ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা তাদের দ্বারা ইসলামের যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছিল, সেটা হ্রাস পাবে। আর কিছু প্রদান ছাড়া সে ক্ষতি দূরীভূতও হবার নয়।
“মুসলিম ম্যাল্লাফাতুল কুলূব” হচ্ছে সে সব নওমুসলিম ব্যক্তি, যাদের অর্থ সাহায্য দানের সাথে ইসলামের কল্যাণ নিহিত থাকে। যেমন, তাদেরকে অর্থ সম্পদ দান করা হলে (আর্থিক পেরেশানী মুক্ত হয়ে) তাদের ঈমান সুদৃঢ় হবে এবং তারা খাঁটি মুসলমানে পরিণত হবে। অথবা এ ধরনের মুসলমান ইসলামে দৃঢ় ভিত্তির উপর অটল হলে ইসলাম বিরোধী শক্তির মুকাবিলায় সুবিধা হবে। দুশমনদের ভীত সন্ত্রস্ত রাখতে পারবে। কিংবা তার দুস্তি মুসলমানদের রক্ষায় অনুকূল ভূমিকা পালন করতে সহায়ক হবে। বলাবাহুল্য, দুর্বল ঈমানের মুসলমানদের দ্বারা এরূপ করতে হলে অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হয় বৈ কি।
এ শ্রেণীর অর্থ-সম্পদ সাধারণতঃ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও বিত্তশালীদেরকেই দেয়া হতো এবং দুর্বল অক্ষমদেরকে এ থেকে প্রায় দেয়াই হতো না। যেমন সাধারণতঃ রাজা বাদশারা করে থাকেন। কিন্তু এর মধ্যে নিয়তের পার্থক্য থাকে বিরাট। কাজের ফলাফল নির্ভর করে নিয়তের উপর। অর্থ-সম্পদ দানে যদি দ্বীনী কল্যাণ ও মুসলমানদের সেবা উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে এ দান মহানবী (সা) এবং সাহাবা-এ-কিরামের দানেরই মত আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হবে। (তাঁরাতো নিজের জন্যে কিছুই করেননি।) অর্থ-সম্পদ দান করার সময় অহংকার প্রদর্শন এবং অশান্তি সৃষ্টির কোনো দুরভিসন্ধি থাকলে, সেটা ফেরাউন কর্তৃক তার ধামাধরা লোকদের মধ্যে প্রদত্ত দানের অনুরূপই হয়ে যায়।
যারা দ্বীনের মধ্যে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় এবং সকল সময় ইসলামের বিরুদ্ধে দুরভিসন্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়, এরূপ দানকে তারা খারাপ দৃষ্টিতে দেখে। যেমন যুলখুওয়াইসরা, সে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এর দানকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখতো। তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যা বলার দরকার তা তিনি বলে দিয়েছেন। তার প্রতি তাঁর অসন্তুষ্টির বান নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
যুলখুওয়াইসরা-র গোত্র খারিজীরা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। হযরত আলী (রা) আমীরে মুয়াবিয়া (রা)-এর সাথে বিরোধ নিস্পত্তিকল্পে অনুষ্ঠিত মীমাংসা বৈঠকের পর যেই আপোষ করার নীতি অনুসরণ করেছিলেন, খারিজীরা তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে। খারিজীরা মুসলমানদের নারী শিশুদেরকে বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল। তারাই সেসব ব্যক্তি, যাদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) লড়াই করার জন্য নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, তারাই ছিল বাতিল ও অশান্তি সৃষ্টিকারী নীতি-রীতির অনুসারী, যাতে তাদের না দুনিয়া ঠিক ছিল, না আখিরাত।
অনেক সময় বিভ্রান্ত পরহেযগারী, ভীরুতা, কাপুরুষতা ও কৃপণতার মধ্যে সাদৃশ্যজনিত সন্দেহের সৃষ্টি হয়ে থাকে। কারণ উভয়ের মধ্যেই আমল ত্যাগজনিত ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। খোদাভীতির কারণে অশান্তি এড়িয়ে চলা এবং ভীরুতা ও কৃপণতার কারণে আদিষ্ট জিহাদে অর্থ ব্যয় না করার মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
******আরবী
“ মানুষের মধ্যে সর্বাধিক মন্দ বিষয় হচ্ছে কৃপণতা, লোভ”। ******আরবী এবং ভীরুতা ও কাপুরুষতা। (ইমাম তিরমিযী এ হাদীসকে বিশুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন।)
এমনিভাবে সম সময় মানুষ আমল ছেড়ে দেয় আর মনে মনে ধারণা পোষণ করে, এমনকি প্রকাশও করে যে, এটাই তাকওয়া-পরহেযগারী। কিন্তু মূলত এটাই হল অহংকার এবং নিজেকে বড় মনে করার নামান্তর। এ সম্পর্কে মহানবী (সা) এমন এক পরিপূর্ণ ও ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য উচ্চারণ করেছেন, যাকে আমলের ফলপ্রসূ কিংবা নিস্ফল হবার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি বলা যেতে পারে। যেমন মহানবী (সা) বলেছেন- ********আরবী
“নিয়্যাতানুযায়ী কাজের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে থাকে”।
দেহের জন্যে আত্মা যেমন অপরিহার্য, আমলের জন্যে তেমনি নিয়্যাত অত্যাবশ্যক। অন্যাথায় কোন ব্যক্তির আল্লাহর সামনে সিজদা করা আর কারোর সূর্যের কাছে মস্তক অবনত করার তফাৎটি কোথায়? উভয়ই মাটিতে কপাল ঠুকে থাকে। উভয়ের উপাস্যের ভঙ্গি একই প্রকার। দু’জনের আকৃতি প্রকৃতিও অভিন্ন। আল্লাহর সামনে মস্তক অবনতকারী ব্যক্তিতো আল্লাহর প্রিয় ও নৈকট্য লাভকারী বান্দা, পক্ষান্তরে চন্দ্র-সূর্যের পূজারী আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন ও দূরে নিক্ষিপ্ত এক লাঞ্ছিত অপরাধী। একমাত্র নিয়্যাতের কারণেই এ ব্যবধান ও পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। স্রষ্টার নৈকট্য প্রাপ্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-
***********আরবী
“ তারা পরস্পর একে অপরকে দ্বীনের উপর অটল থাকার এবং পরস্পরকে সহানুভূতিশীল হবার উপদেশ দেয়”। (সূরা বালাদঃ ১৭)
*********আরবী
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “ঔদার্য ও সহশীলতা হচ্ছে উত্তম ঈমানের পরিচালক”।
বস্তুতঃ জনগণের শান্তি নিরাপত্তা বিধান, তাদের লালন ও শাসন কার্যের জন্যে যুগপৎভাবে তাদের প্রতি আর্থিক ঔদার্য, সহানুভূতি সম্পন্ন মনোভাব, সাহসিকতা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। বরং বলতে হয়, দ্বীন ও দুনিয়ার সংশোধন ও কল্যাণ সাধনের জন্যে ঐ দু’টি গুণ অপরিহার্য। সুতরাং উক্ত গুণ দুটির অধিকারী নয় এমন ব্যক্তির কাছ থেকে শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে অনুরূপ গুণের অধিকারী ব্যক্তির হতে তা ন্যস্ত করা আবশ্যক। যেমন কুরআন মজীদে ইরশাদ হচ্ছে-
**********আরবী
“হে মুমিনগণ! তোমাদের কি হলো! যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে অভিযানে বের হবার আহ্বান জানানো হয়, তখন তোমরা মাটির সাথে খুঁটি ধরে বসে থাকো। তোমরা কি আখিরাতের বদলে পার্থিব জীবনে নিয়েই সন্তোষ থাকতে চাও? যদি তাই হয় তবে স্মরণ রেখো, আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাস অতি সামান্য। তোমাদের আহ্বান করার পরও যদি তোমরা আল্লাহর পথে রওনা না হও, তাহলে আল্লাহ্ তোমাদেরকে ভীষণ কষ্টদায়ক শাস্তি প্রদান করবেন। আর তোমাদের স্থলে অপর সম্প্রদায়কে এ কাজের দায়িত্ব দেবেন এবং তোমরা তাদের সামান্যতম ক্ষতিও করতে পারবে না। কেননা আল্লাহ সর্বশক্তিমান। (সূরা তওবাঃ ৩৮-৩৯)
মহান আল্লাহ আরো বলেন-
********আরবী
“ লক্ষ্য করো তোমাদেরকে আহ্বান জানানো হচ্ছে, আল্লাহর পথে ধন সম্পদ ব্যয় করো, আর এ ব্যাপারে তোমাদেরকে কিছু লোক কার্পণ্য করে। তারা আসলে নিজের সাথেই নিজে কার্পণ্য করে। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী স্বয়ংসম্পূর্ণ এক সত্তা। তোমারাই বরং তাঁর মুখাপেক্ষী। তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তা হলে তিনি তোমাদের স্থলে অপর কাউকে একাজে নিয়ে আসবেন আর তারা নিশ্চয়ই তোমাদের মত হবে না”। (সূরা মুহাম্মদঃ ৩৮)
একই মর্মে অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
***********আরবী
“তোমাদের মধ্য হতে বিজয়ের পূর্বে যারা আল্লাহর পথে (জানমাল) ব্যয় করেছে এবং জিহাদ করেছে, উচ্চ মর্যাদায় তারা অন্যের সমতুল্য হতে পারে না। যারা বিজয়োত্তর যুগে জান-মাল ব্যয় করেছে এবং জিহাদ করেছে, তাদের চাইতে তারা উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। যদিও আল্লাহ তায়ালা উভয়ের সাথেই সদ্ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন।১(সূরা হাদীসঃ ১০)
(১. মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় এবং জিহাদ করার মর্যাদা ও সওয়াব পরবর্তী যুগের লোকদের তুলনায় অধিক পাওয়ার কারণ হলো, ইসলাম তখন কেবল মদীনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল আর মদীনা তখন মুনাফিক এবং ইসলামের শত্রুদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। হিজরতের পূর্বে মহানবীর (সা) বিরুদ্ধে মক্কার কাফিরদের দুশমনী ও ষড়যন্ত্র কারো অজ্ঞাত নয়। বাধ্য হয়ে সাফল্যের আশায় তিনি তায়েফ গমন করেন। কিন্তু তাদের দুর্ব্যবহারে সেখান থেকে তাঁকে নিরাশ হয়েই ফিরে আসতে হয়। অধিকন্তু সাহাবীগণসহ নবী করীম (সা)কে ‘শাবে আবু তালিবে’ সুদীর্ঘ তিন বছরব্যাপী একটানা সমাজবর্জিত অবস্থায় ব্যয় করতে হয়। বাধ্য হয়ে কতিপয় সাহাবীকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু সেখানেও কাফিরদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা হয়। মক্কার “দারুন্নাদাওয়া” মিলনায়তনে কুরাইশী কাফির নেতার এক সভা হয়। তারা দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে মহানবী (সা)কে হত্যা করার জন্যে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখন অগত্যা তিনি হিজরত করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য বিরাট পুরস্কার ঘোষনা করা হয়। অপরদিকে তৎকালীন পরিস্থিতিতে মহানবী (সা) সাহাবীগণসহ প্রকাশ্য ইবাদত পর্যন্ত করতে সক্ষম ছিলেন না। এমনকি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য বাইরে গেলে সেখানেও তাঁর রেহাই ছিল না, কাফিররা পশ্চাতে লোক পাঠিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় তৎপর হয়ে উঠতো। অবশেষে হিজরত করে মদীনা গমন করলে স্থানীয় ইহুদী-খৃষ্টান ও মুনাফিকরা তাঁর বিরোধিতায় উঠে পড়ে লেগে যায়। দিবা রাত্রি তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে থাকে তার রীতিমত মক্কার কাফিরদের নিকট গোপন তথ্য ও সংবাদ আদান প্রদান করতে থাকে। এক পর্যায়ে কাফিরগণ মক্কার দারুন্নাদওয়ায় মিলিত হয়ে চক্রান্তমূলক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ফলে বদর ও উহুদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়।
মোটকথা, ইসলাম এক নির্দিষ্ট স্থানে গন্ডীভূত ছিল আর সর্বদিক থেকে মুসলমানগণ ছিলেন তখন অসহায় নিঃসম্বল। তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল এই যে, দু’বেলা আহারের সংস্থান করা অতি কঠিন ছিল। পক্ষান্তরে কাফিররা অর্থনৈতিক সামাজিক সব দিক থেকেই ছিল স্বচ্ছল ও বিত্তশালী। গোটা আরব ভূখন্ডে তখন তাদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ও প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। কাজেই, এসব অসহায় মুসলমানকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে তাদের বাধা দেয় কে? তাদের ধারণা, মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুসলমানকে শেষ করতে পারলেই ইসলাম নামক আপদ নির্মূল হয়ে যাবে। কারণ নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে ইসলাম তখনো বিস্তার লাভ করেনি। এখনকার মুসলমানদের উৎখাত করা হলে অপর জায়গায় মুসলমানরা তাদের জন্যে হুমকি হয়ে দেখা দিবে। আজকে যেখানে অবস্থা এই, কোনো একটি অমুসলিম দেশ থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করা হলে তারা লাখে লাখে গিয়ে প্রতিবেশী একাধিক মুসলিম দেশে গিয়ে বসবাস করছে, তখন অর্থাৎ বিজয় পূর্ব যুগের অবস্থা তেমন ছিল না। কাজেজি মুষ্টিমেয় ক’জন মুসলমানকে শেষ করে ইসলামকে নির্মূল করে ফেলাটা কি কঠিন কাজ? কাফিররা এ চিন্তায় তাড়িত হয়ে মুসলিম অস্তিত্ব বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু আল্লাহ ছিলেন মুসলমানদের সহায়ক। আল্লাহর ওয়াদার পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে মহানবী (সা)দ ইসলামকে জয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কাফিররা মুসলমানদের জাতি সত্তাকে বিলীন করাটা যতই সহজ মনে করুক না কেন, মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর সাহায্য যাদের পশ্চাতে রয়েছে তাদের নির্মূল করা ছিল সাধ্যের অতীত। কারণ আল্লাহ ঘোষণা করেছেন-
*******আরবী
“তিনি সেই মহান সত্তা যিনি পথ নির্দেশক বিধি ব্যবস্থা ও সত্য জীবন বিধান দিয়ে তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন যেন তিনি অন্যান্য (মানব রচিত ও বাতিল বিধি) ব্যবস্থার উপর তাকে বিজয়ী করেন। যদিও তাতে মুশফিক কাফিররা অস্বস্তি বোধ করবে”। (সূরা তওবাঃ ৩৩)
সুতরাং এহেন অবস্থায় সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও অসৎ নেতৃত্বের উৎখাতকল্পে জিহাদ করা, দ্বীনের পথে অর্থ সম্পদ ব্যয় করা, ধন প্রাণের বাজি লাগানো যে কত বড় কঠিন কাজ তা সহজেই অনুমেয়। এ কারণেই মক্কা বিজয়ের পূর্বে প্রাণ-সম্পদ ব্যয়কারীগণ সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। আমাদের উপর তাঁদের অবদান অসীম অতুলনীয়। কেননা তাঁদের মহান ত্যাগের মাধ্যমেই ইসলাম আমাদের ভাগ্যে জুটেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাঁদের এ মহান আদর্শের অনুসরণের তাওফীক দান করুন। আমীন! )
কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানবতার কল্যাণে অসৎ অযোগ্য শোষক নেতৃত্বের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে এনে ( শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষদের ন্যায় বিচারের সুফল দানের জন্যে) সৎ নেতৃত্বের হাতে তা তুলে দেয়ার সংগ্রামের কথাই উপরে উল্লেখিত হয়েছে। যারা এজন্যে অকাতরে প্রাণ-সম্পদ ব্যয় করেছে তাদের প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে- *********আরবী
“ তারা (অর্থাৎ সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামী মুমিনরা) নিজেদের জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে”। (সূরা তওবাঃ ২০)
অপরদিকে কৃপণতা ও ভীরুতাকে মহা অপরাধ আখ্যা দিয়ে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
*******আরবী
“আল্লাহর সম্পদ প্রাপ্ত হয়েও যারা কৃপণতা করে, তারা যেন নিজেদের একাজকে নিজের জন্য উত্তম মনে না করে বরং তাদের এ কৃপণতা তাদের জন্য অতীব মন্দ ফলদায়ক। কেননা কৃপণতার দ্বারা সঞ্চিত সম্পদ কিয়ামতের দিন তাদের গলার শৃঙ্খল রশি হয়ে দাঁড়াবে। (সূরা আলে ইমরানঃ ১৮০)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
*********আরবী
“ যারা স্বর্ণ রৌপ্য জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে সেগুলো ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ শুনিয়া দাও”। (সূরা তাওবাঃ ৩৪)
এমনিভাবে আল্লাহর বিধানের প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজে সৎ নেতৃত্ব কায়েমে যারা বাতিল শক্তির সামনে ভীরুতা ও কাপুরুষতার পরিচয় দেয়, তাদের নিন্দায় কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
**********আরবী
“ বাতিল শক্তির সাথে দ্বন্দ্বমূখর সংকটময় পরিস্থিতির দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েছে বলে যারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, বুঝতে হবে, সে আল্লাহর গযবে পতিত হয়ে গেছে। তার ঠিকানা জাহান্নামে। আর সেটি হচ্ছে অতি নিকৃষ্টতম স্থান। তবে যুদ্ধের কৌশলগত কারণে কিংবা আপন দলে শামিল হওয়ার উদ্দেশ্যে যদি কেউ এরূপ আচরণ করে সেটা স্বতন্ত্র কথা”। (সূরা আনফালঃ ১৬)
************আরবী
অর্থাৎ “আর তারা (তথা মুনফিকরা) কসম করে বলে যে, তারাও তোমাদের অন্তর্ভুক্ত, অথচ তারা আদৌ তোমাদের মধ্যে শামিল নয়। বরং ঐ সকল লোক হচ্ছে ভীরু কাপুরুষ- তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন”। (সূরা তওবাঃ৫৬)
কুরআন হাদীসে এ সম্পর্কে অসংখ্য উক্তি রয়েছে, বরং বিশ্বের সকল মানুষই এতে একমত। এমনকি এ ব্যাপারে প্রবাদও আছে যে-
“ তারা বর্শাও চালাতে জানে না আর তারা দয়ালুও নয়”। আরো বলা হয়-
******* আরবী
“তাঁরা যেমন ঘোড়া সওয়ারীতে পটু নয়, তেমনি আরবের কোন সম্ভ্রান্ত লোকও নয়”।
রাজনীতি ও শাসন কর্তৃত্বের তিন শ্রেণীর লোক
রাজনীতি ও শাসন কর্তৃত্বের প্রশ্নে তিন শ্রেণীর লোকের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়-
(১) যাদের ধ্যান ধারণা পার্থিব মোহে আচ্ছন্ন। ভূপৃষ্ঠে আপন শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা, দাম্ভিকতা প্রদর্শন এবং অশান্তি সৃষ্টিই হলো এই শ্রেণীর মানুষের একমাত্র লক্ষ্য। আখিরাতের জবাবদিহিতার ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ উদাসীন। এনাম প্রদান ও অর্থ ব্যয় ছাড়া (গদি রক্ষা করা যায় না) শাসন কার্য চলতে পারে না বলেই তাদের বিশ্বাস। আর যেহেতু এজন্যে বিপুল অর্থ দরকার, যা তাদের নেই, তাই অর্থাগমের অবৈধ পন্থা তারা অবলম্বন করে থাকে। ফলে তারা শাসকরুপী লুটেরা ও ডাকাত পরিণত হয়। তারা বলে, শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী তারাই হতে পারে, যারা খেতে পারে এবং খাওয়াতেও পারে।নির্মল লোকদের একাজ নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে তারা বঞ্চিত থাকারই যোগ্য। এক শ্রেণীর শাসকের এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রাষ্ট্রের (নীতিবান) আমলা-উমারা পর্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে এবং এহেন রাষ্ট্র প্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ শ্রেণীর শাসকরা পার্থিব লাভ ক্ষতির আলোকেই সবকিছু মূল্যায়ন করে থাকে। পরকালীন জীবনের সুখ শান্তির কথা তারা বেমালূম ভুলে যায়। তওবা করে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যদি তাদের ফিরে আসার ভাগ্য না হয়, তাহলে ইহ-পরকাল উভয় জগতে তারা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সুতরাং তারাই হবে-*******আরবী “দুনিয়া আখিরাত সর্বনাশকারী লোকদের অন্তর্ভুক্ত”।
(২) দ্বিতীয় শ্রেণীঃ যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং জনগণের উপর জুলুম অত্যাচার করাকেও অবৈধ মনে করে বটে, এমনকি হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকার অনিবার্যতায়ও বিশ্বাসী। কিন্তু এ সত্ত্বেও (ঈমানী দুর্বলতা হেতু) তারা মনে করে যে, অন্যায় হারাম পন্থায় অর্থ সংগ্রহ ছাড়া রাজনীতি ও শাসন কার্য পরিচালনা সম্ভব নয়, তাই তারা অবৈধ পন্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা অর্থলুটের পথ বেছে নেয় এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপে জনগণের কল্যাণ চিন্তায় নিরাসক্ত হয়ে পড়ে। ফলে নৈতিক দুর্বলতা ও ভীরুতার শিকার হয়ে জনসেবামূলক ক্রিয়াকলাপকে বিরক্তির মনে করে। তারা দ্বীনের এমন মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করায়, যাতে ওয়াজিব পর্যন্ত ছেড়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করে না, যা কোন কোন হারামের চেয়েও অধিক ক্ষতিকর। অথচ ফরয ছেড়ে দেয়া এবং জিহাদ থেকে বিরত থাকা কার্যত জিহাদ পরিত্যাগ করারই নামান্তর। তারা মনগড়া ব্যাখ্যার ছত্র ছায়ায় দ্বীনী ফরয থেকেই নির্লিপ্তে থেকে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ এও বিশ্বাস করে যে, উল্লেখিত কার্যকলাপ অস্বীকার করা ওয়াজিব আর যুদ্দ ব্যতীত এ ওয়াজিবের উপর আমল করা সম্ভব নয়। ফলে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেমন খারিজী সম্প্রদায়ের লোকেরা করেছিল। এদের দ্বারা না পার্থিব কল্যাণ সাধিত হয়, না পারলৌকিক। অবশ্য সময় বিশেষে এদের কার্যকলাপেও দ্বীন-দুনিয়ার বিচ্ছিন্ন দু’একটি কল্যাণ সাধিত হয়ে যায়। এদের এই ইজতেহাদী অপরাধ ক্ষমাযোগ্য ও বিবেচিত হয়ে থাকে। আবার কখনো এরা অধিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হয়। কিন্তু সার্বিক বিচারে এদের কর্ম প্রচেষ্টা ভ্রান্তিপুর্ণই হয়ে থাকে। অথচ তারা মনে করে, আমরা সৎকাজে লিপ্ত আছি। এ নীতিতে বিশ্বাসী লোকেরা নিজের জন্যও কিছু লাভ করতে পারে না অপরকেও কিছু দিতে পারে না। তারা কেবল অসাধু ব্যক্তিদেরই মনোরঞ্জন করে থাকে। আর এটা মনে করে যে, ‘মুআল্লাফাতুল কুলূব’ তথা দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করণার্থে কিছু ব্যয় করা অন্যায় ও হারাম।
(৩) তৃতীয় শ্রেণীটি হলো উম্মতের মধ্যপন্থী লোকদের। এ শ্রেণীটি হলো দ্বীনে মুহাম্মদী এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের অনুসারী। উম্মতে মুসলিমার মধ্যপন্থী বিশেষ ও সাধারণ সকল মানুষের কিয়ামত পর্যন্ত এটাই সঠিক পথ। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, জনকল্যাণমূলক কাজে অর্থ ব্যয় করা, জনগণের প্রয়োজন মিটানো, চাই তা বিত্তশালী হোক কিংবা বিত্তহীন। জনগণের মান মর্যাদা, ইয্যত-সম্ভ্রম এবং পার্থিব প্রয়োজন পূরণ, ইকামতে দ্বীনের কাজ ও সমাজ সংশোধনে অর্থ ব্যয় করা জরুরী। সক্ষম ব্যক্তি ছাড়া কারো কাছ থেকে উন্নয়ন করের অর্থ গ্রহন করা সমীচীন নয়। সর্বক্ষেত্রে খোদাভীতি এবং কল্যাণ বিবেচনাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা শরীয়তী শাসন ব্যবস্থা খোদাভীতিপূর্ণ জবাবদিহিতা ও জনকল্যাণের প্রাধান্য ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না। আল্লাহ ফরমান-
*******আরবী
“মহান আল্লাহ খোদা ভীরু, মুত্তাকী এবং সৎকর্মশীলদের সঙ্গেই থাকেন”। (সূরা নাহলঃ ১২৮)
সর্বোপরি মূল কথা হলো, জনগণের অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করতে হবে এবং তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে, নিজেরা হালাল খেতে হবে। বৈধ উপায়ে অর্থোপার্জনে সচেষ্ট থাকতে হবে। অধিকন্তু বিত্তশালী ও ধনী লোকের মিতব্যয়ী হওয়া অপরিহার্য। কারণ, বিত্তশালীদের নিকটই অভাবী লোকেরা কিছু পাওয়ার ও প্রয়োজন মিটাবার অধিক আশা পোষণ করে থাকে, যা স্বল্প বিত্তশালী সাধুজনদের নিকট থেকে সাধারণত আশা করা হয় না।১ (১. যেমন, বাদশাহ, মন্ত্রীবর্গ, গভর্ণর, বর্তমানের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রধান, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, নেতৃবৃন্দ অর্থাৎ সারাদেশে শাসক গোষ্ঠী এবং সমাজপতিদের প্রভাব থাকে। যদি তারা ন্যায়পরায়ণ চরিত্রবান হন তবে স্বাভাবিকভাবেই জনগণ তথা গোটা জাতি চরিত্রবান হয়। পক্ষান্তরে যদি তাদের চরিত্র কলুষিত ও ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে জাতীয় চরিত্রে এর প্রভাব প্রতিফলিত হওয়া অনিবার্য। বস্তুত জনসেবার দাবী হলো, সর্বক্ষেত্রে গণস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুতরাং এ সম্পর্কে শেখ সাদী বলেন-
********আরবী
অর্থাৎ “পাহারাদারী করা বকরীর কাজ নয়, বরং পাহারাদারই তার খিদমতে নিয়োজিত”। উচ্চ পদস্থ লোকেরাই যদি অবৈধ পন্থায় কালো টাকার পানে হাত বাড়ায় তার অধীনস্তদের থেকে সচ্চরিত্র ও লোভহীনতার আশা করা বৃথা। শেখ সাদী বলেন-
********আরবী
(অর্থাৎ “বাদশাহ যদি অন্যায় পথে পাঁচটি ডিম গ্রহণ করে, তবে তার সৈন্যরা অবৈধ পন্থায় হাজার মোরগ শিকে চড়াবে”।)
জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়াই জনসেবার মূল কথা। তাই শেখ সাদী বলেন-
*******আরবী
অর্থাৎ “দুর্বলজনের প্রতি দয়া কর। তাহলে শক্তিধর দুশমনের কবলে পতিত হবে না”।
চরম সত্য কথা হল, এ বিশ্ব আল্লাহরই সার্বভৌমত্বাধীন রাজত্ব। কাজেই এখানে একমাত্র তাঁরই বিধান চালু হবে আর এ দ্বারাই কেবল ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধিত হতে পারে। এ পর্যায়ে আলিম ও শাসক ও দু’সম্প্রদায়ের উপরই গোটা জাতির মঙ্গলামঙ্গলের দায়দায়িত্ব নিহিত । তারা ভাল তো সবই ঠিক। অন্যাথায় সব বরবাদ। তাই বলা হয়েছে-
********আরবী
অর্থাৎ “একমাত্র শাসক চক্র এবং অসাধু ধর্মীয় নেতারাই দ্বীন ধর্মে বিপর্যয় এনেছে”। )
সাধুজনদের নিকট থেকে মানুষ সাধারণত চারিত্রিক সংশোধই অধিক পরিমাণে প্রত্যাশা করে। বিত্তশালীদের নিকট থেকে এটা তেমন প্রত্যাশা করে না। সাধ্যানুযায়ী এবং সম্ভাব্য উপায়ে চরিত্র সংশোধন করে নেওয়াটাই হলো তাকওয়া ও দ্বীনের আসল মর্যাদা। আবু সুফিয়ান ইবনে হরবের বর্ণনা অনুযায়ী সহীহ বুখারী ও মুসলিমে উল্লেখ আছে যে, সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে প্রশ্ন করেছিলেনঃ “উক্ত নবী তোমাদের কি শিখান?” উত্তরে আবু সুফিয়ান বলেছিলেনঃ “তিনি আমাদেরকে নামায কায়েম, সততা অবলম্বন, চারিত্রিক সংশোধন এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার নির্দেশ দান করেন”। অপর এক হাদীসে আছে, আল্লাহ্ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর নিকট ওহী প্রেরণ করেন- “ হে ইবরাহীম, তোমার কি জানা আছে, কেন তোমাকে আমি আমার “খলীল” (বন্ধু) বানিয়েছি? তা এ জন্যে যে, ‘গ্রহণ কয়ার চেয়ে দান করাটাই তোমার অধিক প্রিয়। তোমার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে জন্যে তুমি আমার খলীল”।
ইতিপূর্বে বদান্যতার উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বদান্যতা সর্ববস্থায় জাতীয় ও জনস্বার্থের নিরিখে হতে হবে। পক্ষান্তরে, ক্রোধ ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রা এড়িয়ে যাওয়াটাই হলো প্রকৃত বীরত্ব- এদিকটার প্রতি সর্বদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। ক্রোধের দিক থেকে মানুষের তিনটি অবস্থার প্রকাশ ঘটে। (১) আল্লাহ ও ব্যক্তি স্বার্থে ক্রোধান্বিত হওয়া। (২) আল্লাহর উদ্দেশ্যে উভয়ের কোনটির জন্যেই ক্রোধান্বিত না হওয়া। (৩) যাদেরকে উম্মতে ওয়াসাত তথা মধ্যপন্থী বলা হয় তাদের ক্রোধ একমাত্র আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। কাজেই তারা স্বার্থ দুষ্ট ক্রোধের সাথে আদৌ পরিচিত নন। এ সম্পর্কে বুখারী ও মুসলিমে হযরত আয়েশা (রা) এর উক্তি বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন-
********আরবী
“মহানবী (সা) স্বহস্তে কোন খাদেমকে, কোন মহিলাকে, কোন পশুকে অথবা অন্য কাউকে কখনো প্রহার কিংবা আঘাত করেননি। অবশ্য যুদ্ধ ক্ষেত্রের কথা স্বতন্ত্র। আর তাকে নিজের জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তবে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ হতে দেখলে এবং তাঁর সীমা লঙ্ঘিত হলে তখন তাঁর ক্রোধ হতো অপ্রতিরুদ্ধ”।
যে শাসক আল্লাহর জন্যে নয় বরং নিজের জন্যে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে, শুধু ব্যক্তিস্বার্থে নিজের পাওনাটুকু উসূল করে এবং অপরের অধিকার প্রদান করে না, তাহলে সে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের নিকৃষ্টতর জীব। এহেন ব্যক্তির দ্বারা দুনিয়া আখিরাত কোনটিরই কল্যাণ সম্ভব নয়।
সৎ কর্মশীলদের রাজনীতি ও শাসনকার্য ছিল সর্বাঙ্গীন সুন্দর। তাদের নীতি ছিল তাঁরা রাষ্ট্রীয় অপরিহার্য দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে পালন করতেন। আল্লাহ্র নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে অতীব সতর্কতার সাথে দূরে সরে থাকতেন। তারা এমন নির্মল চরিত্রের অধিকারী ছিলেন যে, তাঁদের দানে দ্বীনের অশেষ কল্যাণ সাধিত হতো। তারা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ঠিক ঐ পরিমাণই গ্রহণ করতেন, যদ্দুর তাদের জন্যে বৈধ ছিল। তাদের ক্রোধ বা অসন্তুষ্টি ছিল সম্পূর্ণ আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে। আর তাও আল্লাহ্র নিষিদ্ধ কাজ করো দ্বারা সংগঠিত হলেই কেবল তা প্রকাশ পেত। নিজেদের পাওনা তাঁরা প্রায় ক্ষমাই করে দিতেন।
এটা ছিল নবী চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য। তিনি আয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে কামেল ও পরিপূর্ণ ছিলেন। সুতরাং চারিত্রিক ব্যাপারে তাঁদের নিকটবর্তী লোকেরাই হলেন উত্তম ও মর্যাদাশীল। কাজেই মুসলামানদের প্রথম ফরয হল, নবীর নীতি চরিত্র ও আদর্শের নৈকট্য লাভের আপ্রাণ চেষ্টা করা এবং সাধ্যমত চেষ্টার পর নিজের ভুল-ভ্রান্তির জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তদুপরি এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করতে হবে যে, আল্লাহ্ পাক সত্য ও সামগ্রিক জীবনের উত্তম আদর্শরুপেই নবী (সা) কে প্রেরণ করেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে কুরআনের ভাষ্য হলো-
**********আরবী
“আমানত তার হকদারকে প্রত্যার্পণ করতে আল্লাহ্ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন”।১ (১. এটাই হল ইসলামী বা খোদায়ী হুকুমতের সারকথা। সুতরাং ******আরবী অর্থাৎ “আমাদের ধর্মে খিদমত তথা জনসেবাই হল নেতৃত্বের মূল দর্শন” প্রবাদটি এ অর্থেই প্রচলিত। আজকের বিশ্বে বৃহৎ শক্তি, বড় বড় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তালাশ করলে ******আরবী এর নিদর্শন কোথাও কি দেখতে পাওয়া যায়? বর্তমানে মুসলিম দেশসমূহের প্রতি লক্ষ্য করলেও *******আরবী (অর্থাৎ “নিজের জন্য নয় বরং একমাত্র আল্লাহ্র জন্য”)-এর অর্থে কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গোটা বিশ্বে আজ একই রং অভিন্ন চরিত্রের অধিকারী লক্ষ্য করা যায় যেই দৃশ্য ইসলাম পূর্ব যুগে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যে প্রতিভাত হতো।
ইমামুল হিন্দ হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ) তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ” গ্রন্থে “ইরতিফাকাত ওয়া ইসলাহুর রুসূম” অনুচ্ছেদে রোমান এবং অনারবীদের অবস্থা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। এর উপর চিন্তা করে ******আরবী এর মর্ম সামনে রেখে বিবেচনা করা উচিত- আল্লাহ্ আমাদের নিকট কি চান আর আমরা কি চলছি কোন দিকে, আর বিশ্ব কোন ধরনের বিপ্লব ও পরিবর্তন কামনা করে। নিম্নে এর সারসংক্ষেপ পেশ করা হল। শাহ সাহেব লিখেনঃ “রোমানরা এবং অনারবগণ দীর্ঘদিন যাবত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্টিত থাকার ফলে তারা পার্থিব ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে যায়। শয়তান তাদের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল যে, অধিক পরিমাণে ভোগের সামগ্রী, বিলাস দ্রব্য সংগ্রহ করা, প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিলাস সামগ্রীর প্রদর্শনী করা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পরিণত হয়। সূক্ষ্মতর বিলাস দ্রব্য লাভ করার পিছনেই তাদের বিবেক বুদ্ধি ব্যয় করা হতো। অতঃপর এসব দ্বারা আশ্চর্য ধরনের আমোদ প্রমোদ ও চিত্ত বিনোদনের পন্থা উদ্ভাবন করা হতো। তাদের শাসকবর্গ ক্ষমতার জৌলুস ও জাকঁজমক প্রদর্শন করতে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতো, এ দ্বারাই তার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তাদের রঈস, বিত্তশালী গোত্রপতি ও শাসক শ্রেণীর লোকদের জন্য দু’লাখ টাকার কম মূল্যের মুকুট পরিধান করাটা ছিল কলংকের বিষয়। তাদের জন্য ঝর্ণাধারা প্রবাহিত নহর ও মনোরম উদ্যানবিশিষ্ট প্রকান্ড রাজ প্রাসাদ থাকাটা ছিল অনিবার্য। খিদমতের জন্য সারিবদ্ধ গোলাম বাঁদীর দল আর আস্তাবলে ঘোড়ার পাল থাকা ছিল অতীব জরুরী। সুপ্রশস্ত দস্তরখান এবং বাবুর্চি খানায় সর্বদা উচ্চ মূল্যের খানা তৈরী থাকাকে আভিজাত্যের প্রতীক মনে করা হতো।
মোটকথা, এসব জীবনোপকরণের তুলাদন্ডে জীবন যাত্রার মান নির্ণয় করা হতো। আভিজাত্যবোধ তাদের বিশ্বাসের অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হতো, যা স্থায়ী ব্যাধিরুপে তাদের কৃষ্টি-সভ্যতার শিরা উপশিরায় প্রবাহিত ছিল। কৃষক শ্রমিক পর্যন্ত এতে আক্রান্ত ছিল। নিজেদের ভোগ বিলাসের উপকরণ হাসিল করার উদ্দেশ্যে দেশ জাতি অসংখ্য মানব গোষ্ঠীকে বিপর্যস্ত করে ফেলা তাদের জন্য সাধারণ ব্যাপার ছিল। কিন্তু অঢেল অর্থ ব্যয় ছাড়া এগুলো অর্জন করা সম্ভব ছিল না বিধায় কৃষক, ব্যবসায়ী শ্রমিক মজদুর শ্রেণীর উপর করের বোঝা চাপানো হতো। কিন্ত এ অন্যায় ও অতিরিক্ত কর আদায়ে অপরাগ অবস্থায় বেতনভোগী সৈন্য বাহিনী দ্বারা গরীবদের উপর অত্যাচার-নিপীড়নের ঝড় বইয়ে দেয়া হতো। শাসক শ্রেণীর শক্তির দাপটের সামনে আত্ম সমর্পণকারী গরু গাধার খাটানো হতো। ফলে নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দের প্রতি কিঞ্চিৎ নযর দেয়ার অবকাশই ছিল না। অবস্থা এই দাঁড়িয়েছিল যে, লাখো কোটি আদম সন্তানের ধ্যান-ধারণা থেকে দ্বীন-ধর্ম ও চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য অর্জনের গুরুত্ব বিলীন হয়ে যায়। কল্যাণধর্মী ও উন্নয়ন মুখী কোন পরিকল্পনা ও বৃহৎ কাজ, যার উপর জাতির ভবিষ্যত নির্ভরশীল সার্বিকভাবে বাস্তবক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য শিল্প ক্ষেত্রে কিছু হতো না তা নয়, তবে সেটা ছিল নিছক প্রভুদের প্রমোদমূলক কিংবা তাদের ভোগের সহায়ক সামগ্রী। কেননা এছাড়া প্রভুর নিকট শ্রমিক শিল্পীর কোন কদর ছিল না। কেবল স্বাচ্ছন্দই ছিল মনিবের মনতুষ্টির একমাত্র উপায়। অপর দিকে একদল অর্থ লোভী কবি সাহিত্যিক, অনুকরণ-প্রিয়, গায়ক, চাটুকার, তোষামোদী এবং উমিদার সৃষ্টি হয়ে যে, দরবারী হিসাবে পরিচিত কিংবা দরবারের সাথে তারা সংশ্লিষ্ট ছিল। তাদের সাথে তথাকথিত একদল কপট দ্বীনদার শ্রেণীও শরীক ছিল, যারা প্রকৃত পক্ষে দ্বীনদার তো ছিল না বরং ধর্মের ছদ্মাবরণে স্বার্থসিদ্ধি এবং ধর্মের ব্যবসাই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলে সমাজের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সর্বস্তরে ব্যক্তিস্বার্থ ও সুবিধাবাদী নীতি সংক্রামক ব্যাধিরুপে ছড়িয়ে পড়ে। গোটা সমাজদেহ চরিত্রহীনতায় তলিয়ে যায়। এমনিভাবে তথাকথিত সমাজপতি শ্রেণীর কল্যাণে (!) খোদাভীতি এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বীজ অংকুরিত হতে বাধাপ্রাপ্ত ও বিনষ্ট হয়ে যায়”।
তিনি আরো বলেনঃ “রুম ও আযমের উপর সীমাহীন এ বিপদ আপতিত হওয়ার পর খোদাই গযব টুটে পড়ে এবং সংস্কারের চিকিৎসার মাধ্যমে এ ব্যাধি নির্মূল করার ফয়সালা স্বরূপ আরবের বুকে একজন উম্মী নবী (সা) আগমন করেন, যার নির্মল চরিত্রে তাদের মিথ্যা আভিজাত্যের কোন ছোঁয়া লাগেনি এবং তাদের রীতি-নীতি আর দুশ্চরিত্রের ছায়া থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত। আল্লাহ্ তাঁর নবীকে (সা) আদর্শ জীবনের, উন্নত চরিত্রের প্রতীক বানিয়ে পাঠিয়েছেন। তাঁর কন্ঠে রুমী ও পারসিক চরিত্রহীনতা ও খোদাহীন কার্যকলাপের নিন্দা করিয়েছেন এবং পার্থিব ভোগ বিলাসে মত্ত থাকাকে অসার প্রতিপন্ন করেছেন। অনারবীয় আচার-আচরণকে নিষিদ্ধ করেছেন। যেমন সোনা রুপার থালা-বাসন, স্বর্ণ-মণির অলংকার, রেশমী কাপড়, মূর্তি প্রতিমা ইত্যাদি হারাম করা হয়। মোটকথা, মহানবীর নেতৃত্ব পারস্য ও রোমক সাম্রাজ্য সমূলে উৎখাত করা হয়। আর নবীর কণ্ঠে ঘোষিত হয়-
*********আরবী
“কিসরা ও কায়সার বিলীন হয়ে গেছে। অতঃপর তাদের অভ্যুত্থান আর হবার নয়”।
মোটকথা, মহানবীর আবির্ভাবকালে সারা বিশ্ব তৎকালীন বৃহৎ শক্তি রোম ও পারস্যের আধিপত্য বলয়ে ছিল, তা নিস্পিষ্ট হওয়ার ন্যায় আজ সারা জাহান ইঙ্গ-মার্কিনের মতো যেই দুই বৃহৎ শক্তির দাসত্বের পক্ষপুটে আবদ্ধ, তাও মুসলমানরা ইসলামকে খন্ডিতভাবে বিচার না করে খোদায়ী নির্দেশমাফিক যুগোপযোগী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উদ্ভাবনে অন্যদের মতো মনযোগী হলে এবং যথাযথ ইসলামী অনুশাসন মেনে চললে, নৈতিক আর্থিক, সামরিক আধ্যাত্মিক সকল দিক থেকে আজকের এই বৃহৎ শক্তিদ্বয়ের পরিনীতিও অতীব রোম-পারস্যের অনুরূপ হতে বাধ্য । মূলতঃ উল্লেখিত শক্তিদ্বয় ছাড়া অন্য রাষ্ট্রসমূহ দৃশ্যতঃ যদিও স্বাধীন বলে জোর গলায় প্রচার করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এবং বাসতবের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সমাজ নানান দিক থেকে এদের গোলামীর কঠিন শিকলে বাধাঁ। এদেরই স্বার্থবাদী রাজনীতি, পংকিল কৃষ্টি সভ্যতা, সংস্কৃতি নোংরা আচার আচরণ অনুকরণীয় বলে স্বীকার করা হয়। তাদের অপসংস্কৃতি এবং আয়েশী জীবন ধারা অনুকরণে নিজেদের চরিত্র গঠনে যত্ন সহকারে বিশেষ তৎপরতায় অংশ নেয়া হয়। অথচ পাশ্চাত্যের আধুনিক সভ্যতা সংস্কৃতি বিশেষ ক্ষেত্রে বিশ্ব সমাজকে আজ বিপদগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত করে রেখেছে।
সংক্ষেপে কথা হল, বিশ্ব যদি শান্তি চায়, জীবনের নিরাপত্তা কামনা করে এবং পার্থিব এবং পারলৌকিক জীবনে শান্তি কামনায় আগ্রহী হয়, তবে ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআন এবং ইসলামকে বাস্তব জীবনে সামগ্রিকভাবে কার্যকর করণে এগিয়ে আসতে হবেই। কারণ, এ বিধান কোন মানব রচিত বিধান নয় বরং এটা আল্লাহ্ প্রদত্ত এক চিরন্তন জীবন বিধান। অধিকন্তু মহান আল্লাহ্ সৃষ্ট জগতে একমাত্র তাঁরই বিধান জারী হলেই শান্তি আসতে পারে। মহানবী (সা) এবং খুলাফায়ে রাশেদীন এ মূলনীতি বলেই ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে গোটা বিশ্বে পরিবর্তনের হাওয়া চালু করেন। অর্ধ শতাব্দীরও কল সময়ে পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর সর্বত্র ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয় । যার ফলে নিরপত্তা শান্তি ও কল্যাণময় রাষ্ট্রের শীতল ছায়ায় বিশ্ববাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়। উপরন্তু ********আরবী সীমাহীন শক্তি গোটা বিশ্বকে ছেয়ে ফেলে। তাই পরিশেষে পরিতাপের সুরে বলতে হয়, হায়! মুসলিম জাতি যদি পুনরায় জাগ্রত হয়ে মহানবী (সা) এবং সাহাবীগণের আনুগত্য ও পদাংক অনুসরণে এগিয়ে আসতো, তাহলে মানুষের এ দুনিয়া প্রায় বেহেশতের উদ্যানে রুপান্তরিত হতো। সর্বত্র শান্তির ফল্গুধারা বয়ে যেতো।
******আরবী
অর্থাৎ-হয়তো আল্লাহ্ এর পরে অনুরূপ অবস্থা সৃষ্টি করবেন।)