[চার]
ইসলামে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের লক্ষ্যঃ
কুরআন সুন্নাহ্র শিক্ষা, আইন-কানুন বাস্তবায়ন
যোগ্যতর ব্যক্তির পরিচয়, শাসন-কর্তৃত্বের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিচিত, কর্তৃত্বের লক্ষ্য দীনের লক্ষ্য দীনের প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় সংস্কার, জুমুআ ও জামায়াতের সুষ্ঠু প্রতিষ্ঠা, জনগণের দীনী সংশোধন-এই পরিচ্ছেদের আলোচ্য বিষয়।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলতেন, আমি এজন্য তোমাদের নিকট কোনো শাসক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রেরণ করি, তারা যেন তোমাদেরকে মহাপ্রভু আল্লাহ্র কিতাব এবং নবীর আদর্শ শিক্ষা দেয় আর দীন তথা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সক্রিয় ও স্থায়ী রাখে।
সর্বাধিক যোগ্যতর ব্যক্তির পরিচয় তখন জানা যাবে, যখন শাসন কর্তৃত্বের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যে পৌঁছার পদ্ধতি জানা যাবে। তোমার কাছে যখন লক্ষ্য স্পষ্ট হবে এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছার পদ্ধতি জানা হয়ে যাবে, তখন মনে করবে যে, তোমার করণীয় বিষয়টি তুমি পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পেরেছো।
রাজা-বাদশাহ তথা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে যদি বৈষয়িক স্বার্থ প্রাধান্য পায় আর তারা ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ ত্যাগ করে বসে, তখন শাসক কর্তৃপক্ষ শাসন যন্ত্রে এমন সব লোককেই পদোন্নতি দেন, যাদের দ্বারা তাদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য-লক্ষ্যই অধিক হাসিল হয়। সে শাসক নিজ ব্যক্তি স্বার্থের জন্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রত্যাশী, সে নিয়োগ-বদলিতে ঐ ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দেবে, যে তার রাষ্ট্র, কর্তৃত্ব পদ বহাল রাখতে সহায়ক। মহানবী (সা)-এর রাজনৈতিক আদর্শে আমরা দেখতে পাই, শাসন ক্ষমতা ও যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও সেনাপতিগণ যারা রাষ্ট্র প্রধানের প্রতিনিধি এবং ফৌজী সিপাহ্সালার, তারা মুসলমানদের জুমআর নামায এবং জামাআতের ইমামত করতেন। জনগণের সামনে মূল্যবান বক্তৃতা দান করতেন। এ জন্যেই রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর তিরোধানের প্রাক্কালে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-কে নামাযের ইমামতের দায়িত্বে পদোন্নতি দিয়েছিলেন। মুসলিম মিল্লাতে সমর নেতৃত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও তাঁকেই অগ্রগামী রাখতেন।
মহানবী (সা) যখন কাউকে সেনাপতি নিয়োগ করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করতেন, সর্বপ্রথম তাঁকে প্রদত্ত সরকারী অর্ডারে নামায কায়েমের হুকুম করতেন। এমনিভাবে যখন কাউকে কোনো শহর জনপদের শাসনকর্তা করে পাঠাতেন, প্রথমে তাকে জামাআতের সাথে নামায পড়বার নির্দেশ দিতেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সা) আত্তাব ইবনে উসায়দ (রা)-কে মক্কার শাসনকর্তা করে পাঠিয়েছিলেন। তেমনি উসমান ইবনে আবিল আস (র)-কে পাঠিয়েছিলেন তায়েফের শাসনকর্তা করে। হযরত আলী (রা) হযরত মুয়ায (রা) এবং হযরত আবু মূসা (রা)-কে ইয়ামেনের শাসনকর্তারূপে পাঠিয়েছিলেন। আমর ইবনে হাযম (রা)-কে পাঠিয়েছিলেন নাজরানের শাসনকর্তা করে। তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নায়েব বা প্রতিনিধি হিসাবে জামাআতের নামাযে ইমামত করতেন এবং শরী’য়াতী শাসন তথা হুদূদ ইত্যাদি কায়েম করতেন। যুদ্ধের সেনাপতিও ঠিক একই কাজ করতো। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইনতিকালের পর ইসলামী রাষ্ট্রে তাঁর স্থলাভিষিক্ত খলীফাগণও একই নিয়মে এসব রাষ্ট্রীয়-ধর্মীয় দায়িত্ব সম্পাদন করতেন। বনী উমাইয়া-র বাদশাহগণ এবং দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আব্বাসী শাসকগণও তাই করেছেন। এটা এজন্যে করা হতো যেহেতু দীন ইসলাম সবচাইতে গুরুত্তপূর্ণ বিষয় হলো নামায এবং জিহাদ।
এ কারণেই বহু হাদীসে নামায এবং জিহাদকে একই সাথে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিনি কোনো রুগীর শুশ্রুসায় গেলে বলতেন-
********আরবী
“ হে আল্লাহ্ তোমার এ বান্দাকে আরোগ্য দান করো, যেন সে নামাযে হাজির হতে পারে এবং তোমার দুশমনদের মোকাবেলা করতে পারে”।
*******আরবী
“হে মুআয! আমার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামায”।
আঞ্চলিক শাসক ও কর্মচারীদের কাছে হযরত উমরের নির্দেশনামাঃ
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় নিয়োজিত কর্মচারী ও গভর্নরের উদ্দেশ্যে যে সরকারী ফরমান লিখে পাঠাতেন। ঐগুলোতে লিখা থাকতো-
*******আরবী
“আমার কাছে তোমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নামায। যে ব্যক্তি নামাযের হেফাজত করলো, সে দীনের হেফাজত করলো। যে নামায নষ্ট করলো সে অন্যান্য কাজও বেশী নষ্ট করবে”।
হযরত উমরের এ কথার তাৎপর্য হলো, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
****আরবী
“নামায হচ্ছে দীনের স্তম্ভ”। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যখন এই স্তম্ভটির হেফাজত করবে, তখন নামায তাকে অশ্লীলতা এবং সকল গর্হিত কাজ ও দুর্নীতি থেকে রক্ষা করবে এবং অন্যান্য ইবাদতের কাজে নামায তার সাহায্যকারী হবে। (“কারণ ********আরবী নামায গর্হিত-অবাঞ্ছিত কাজ থেকে বিরত রাখে”।)
আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
******আরবী
“(দীনের উপর) অটল-অবস্থান এবং নামাযের দ্বারা (আল্লাহ্র) সাহায্য কামনা কর আর (মনে রেখো) নামায অত্যন্ত ভারি জিনিস। তবে যারা আল্লাহ্কে ভয় করে তাদের জন্যে এটি ভারি নয়”। (সূরা বাকারাঃ ৪৫)
********আরবী
“হে মুসলমানগণ, (সকল সময় তোমরা দীনের উপর অটল অবস্থান নিয়ে) ধৈর্য ও নামাযের দ্বারা (আল্লাহ্র) সাহায্য কামনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ধৈর্যধারণকারীদের সাথে থাকেন”। (সূরা বাকারাঃ ১৫৩)
আল্লাহ্ তায়ালা রাসূল (সা)-কে সম্বোধন করে বলেছেনঃ
*******আরবী
“(হে নবী!) নিজের পরিবারস্থ লোকদের নামাযের তাগিদ করো। নিজেও পাবন্দির সাথে নামাযে রত থাকবে। আমি তা তোমাদের নিকট কোন রিযিক চাই না বরং আমি নিজেই তোমাদের রিযিক দেই। উত্তম পরিণতি তো তাকওয়া তথা আল্লাহ্ভীতি পূর্ণ সাবধানী জীবন অবলম্বনেই রয়েছে”। (সূরা ত্ব-হাঃ১৩২)
*******আরবী
“জিন এবং ইনসানকে আমি একমাত্র আমার ইবাদত তথা নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও দাসত্ব করার জন্যেই সৃষ্টি করেছি। তাদের থেকে আমি কোন রিযিকের প্রত্যাশী নই। আর তাদের কাছে এটাও চাইনা যে তারা আমাকে খাবার দিক। আল্লাহ্ নিজেই তো অধিক রিযিকদাতা, প্রচন্ড শক্তিধর এক মহাসত্তা”। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬-৫৮)
অতএব এটা বুঝা গেল যে, কর্তৃত্ব নেতৃত্বের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের সেবা করা এবং তাদের সংশোধন করা। মানুষ যদি দীনকে পরিত্যাগ করে তাহলে তারা কঠিন দুর্গতির সম্মুখীন হয়ে পড়বে, আর তাদেরকে যেসব পার্থিব নেয়ামত সুযোগ-সুবিধা ও উপভোগ্য জিনিস দান করা হয়েছে, সেগুলো তাদের জন্যে কখনও কল্যাণকর হবে না। বৈষয়িক সেই কাজের দ্বারা তাদের যেই দীনী কল্যাণ সাধিত হতো, তা হবে না।
বৈষয়িক যেই জিনিসের দ্বারা মানুষ দীনী কল্যাণ লাভ করতে পারে, তা দু’প্রকার। এক, সম্পদকে তার হকদারের কাছে পৌঁছানো। দুই, বাড়াবাড়ি এবং অন্যায়ভাবে সম্পদ হস্তগতকারীকে শাস্তি প্রদান। সুতরাং যে ব্যক্তি সীমা অতিক্রম ও বাড়াবাড়ি করে না, জেনে রেখো, সে তার দীনের কাজে অভ্যস্ত হয়েছে। এজন্যে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা) বলতেনঃ
*****আরবী
“ হে জনগণ, আমি আমার কর্মচারী ও গভর্ণদেরকে এজন্যে তোমাদের কাছে পাঠাই, যেন তারা তোমাদেরকে তোমাদের প্রভুর কিতাব এবং নবীর আদর্শ শিক্ষা দেয় আর তোমাদের মধ্যে দীন কায়েম রাখে”।
বর্তমানে যেহেতু শাসক-শাসিত উভয়ের মধ্যে বিকৃতি ঘটেছে, যদ্দরুন সকল ক্ষেত্রের কার্যকলাপেই বিকৃতি দেখা দিয়েছে, এজন্যে সংশোধনও একটি কষ্ট সাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়িঁয়েছে বৈ কি। তাই যেসব সম্ভাব্য সকল উপায়ে জনগণের দীন-দুনিয়া উভয়টির কল্যাণার্থেই কাজ করবে, সেসব ব্যক্তি যুগশ্রেষ্ঠ এবং উত্তম মুজাহিদ হিসাবে গণ্য হবে। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
******আরবী
“ন্যায়পরায়ণ ইমাম বা নেতার একটি দিন ৬০ বছরের ইবাদতের চাইতে উত্তম”।
মুসনাদের ইমাম আহমদ গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, তিনি ইরশাদ করেছেন-
******আরবী
“মানুষের মধ্যে আল্লাহ্র অতি প্রিয় ব্যক্তি হচ্ছে ন্যায়পরায়ণ নেতা। আর আল্লাহ্র রোষে অধিক নিপতিত ব্যক্তি হচ্ছে জালিম নেতা”।
বুখারী ও মুসলিম শরীফের হযরত আবু হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
***********আরবী
“ আল্লাহ্র ছায়া ছাড়া যেদিন আর কোন ছায়া থাকবে না, তখন সাত শ্রেণীর লোককে আল্লাহ্ তায়ালা নিজের রহমতের ছায়াতলে স্থান দেবেন। (১) ন্যায়পরায়ণ নেতা, (২) ইবাদতগুযার যুবক, (৩) ঐ ব্যক্তি যিনি নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হবার পরও পুনরায় কখন মসজিদে যাবেন তার অন্তর সে ভাবনায় মগ্ন থাকে, (৪) সেই দুই ব্যক্তি যাদের বন্ধুত্ব একমাত্র আল্লাহ্র জন্যে-ঐ বন্ধুত্বের ভিত্তিতেই তারা মিলিত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হলেও ঐ কারণেই বিচ্ছিন্ন হয়, (৫) যে ব্যক্তি একান্তে মানুষের অগোচরে আল্লাহ্র যিকির করে এবং চোখের পানি ছেড়ে দেয়, (৬) যে ব্যক্তিকে কোনো অভিজাত সুন্দরী রমণী কামাচারের আহ্বানে জানালে সে এই বলে জবাব দেয় যে, বিশ্ব জগতের প্রতিপালক আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনকে আমি ভয় করি, (৭) যে ব্যক্তি এমন গোপনে দান খয়রাত করে যে, ডান হাতে খরচ করলে তার বাম হাত জানে না”। (বুখারী ও মুসলিম)
সহীহ মুসলিম শরীফে হৈয়াদ ইবনে হাম্মাদ (রহ) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“ তিন প্রকারের লোক বেহেশতী। (১) ন্যায়পরায়ণ শাসক, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান (২) দয়ালু ব্যক্তি, নিকটাত্মীয় এবং মুসলমানদের সহমর্মিতায় যার হৃদয় বিগলিত, (৩) সেই ধনী ব্যক্তি, যিনি চরিত্রবান এবং দানশীল”।
সুনানে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একটি হাদীস উল্লেখিত আছে যে-
********আরবী
“ দান খয়রাতের কাজে নিষ্ঠাবান সচেষ্ট ব্যক্তি হচ্ছে আল্লাহ্র রাস্তার মুজাহিদের মতো। তবে দান হতে হবে লোক দেখাবার জন্যে নয়”।
আল্লাহ্ তায়ালা জুলুম-অন্যায়ের ধ্বজাধারী সন্ত্রাসী, আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন- ********আরবী
“ যতদিন (সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষের বিরুদ্ধে) ফিৎনা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার অবসান না ঘটবে এবং (সমাজে) একমাত্র আল্লাহ্র দ্বীনেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত না হবে, তোমরা (মানবতার বিরোধী ঐ প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সম্ভাব্য সকল উপায়ে) লড়ে যেতে থাকো”। (সূরা বাকারাঃ ১৯৩)
একবার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খেদমতে আরয করা হলো যে, ইয়া রাসূলুল্লাহ! মানুষ কোন সময় আপন বীরত্ব দেখাবার জন্যে লড়াই করে, কখনও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রেরণা তাদের লড়াইর পেছনে অনুপ্রেরণা যোগায়, আবার কখনো লড়াইর পেছনে দেখানো ভাবও সক্রিয় থাকে। এহেন অবস্থার কোনটিকে “ আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ” বলা যাবে? হযরত রাসূল (সা) ইরশাদ করলেন-
********আরবী
আল্লাহ্র বাণীকে সমুন্নত রাখার জন্যে যে ব্যক্তি লড়াই করবে, সেটিই হবে “জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহ্র পথে জিহাদ”। (হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত।)
অতএব বুঝা গেল, জিহাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সর্বত্র আল্লাহ্র শ্রেণী বৈষম্যমুক্ত ন্যায় বিধান তাঁর দীনেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা এবং তাঁর বাণীকে সমুন্নত করা। *****আরবী তথা “আল্লাহ্র বাণী” কথাটি ব্যাপক অর্থবোধক। এর দ্বারা আল্লাহ্র বিধান গ্রন্থ কালামুল্লাহ্কেও বুঝানো হয়ে থাকে।
এভাবে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“ আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট দলীল দিয়ে প্রেরণ করেছি। তাদের মাধ্যমে প্রেরণ করেছি ‘কিতাব’ ও ‘মীযান’ (ন্যায়দন্ড), যেন তাঁরা (ইসলামের) ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে”। (সূরা হাদীদঃ২৫)
বিভিন্ন পয়গম্বর এবং কিতাব প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন আল্লাহ্র হক এবং বান্দার হকসমূহ ইনসাফ ও ন্যায়নীতি সহকারে প্রতিষ্ঠিত করে।
অতঃপর আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন-
********আরবী
“ আমি লোহা সৃষ্টি করেছি। তাতে রয়েছে বিরাট ভীতিপূর্ণ উপাদান। মানুষের কল্যাণও তাতে নিহিত আছে। আর তাতে অন্য এক উদ্দেশ্য এটাও নিহিত যে, আল্লাহ্ তায়ালা প্রত্যক্ষভাবে জানতে চান যে, এর মাধ্যমে কারা তাঁকে ও তাঁর রাসূলদের সাহায্যে এগিয়ে আসে”। (সূরা হাদীদঃ২৫)
অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ্র কিতাবের বিধানসমূহ ও এর নীতি-আদর্শ বাদ দিয়ে ভিন্ন মতাদর্শ ও নীতির অনুসরণ করে চলে, আল্লাহ্র অভিপ্রায় হলো, সে প্রতিরোধ এগিয়ে এলে তাকে লোহা উপকরণ দ্বারা গঠিত হাতিয়ার দ্বারা হলেও অন্যায় পথ থেকে ফেরানো উচিত। কারণ, দীনের প্রতিষ্ঠা, দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব আল্লাহ্র কিতাব এবং (শক্তির প্রতীক) তরবারীর উপরও ক্ষেত্র বিশেষে নির্ভরশীল। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সা) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন ******আরবী অর্থাৎ “আমরা যেন সেই অগ্রগামী ব্যক্তির প্রতি তরবারী তথা উপযুক্ত অস্ত্রের আঘাত হানি যে ব্যক্তি কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে এর অনুসারীদের নিশ্চিহ্ন করতে এগিয়ে আসে।
সুতরাং উদ্দেশ্য যখন এই, তখন ‘আকরাব ফাল আকরাব’ (নিকটতর অতঃপর নিকটস্থ) এ পন্থায় লক্ষ্য হাসিল করা বাঞ্ছনীয়। কর্তৃত্ব-নেতৃত্বের প্রশ্নে এমন দুই ব্যক্তিকে বেছে নেবে এবং লক্ষ্য করবে যে, উভয়ের মধ্যে কে লক্ষ্যের অতি নিকটতর? উভয়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের যোগ্যতার দিক থেকে যে শ্রেষ্ঠ, তাকেই কর্মকর্তা বা শাসনকর্তা নিযুক্ত করবে।
নেতৃত্বের প্রশ্নে কাকে অগ্রাধিকার দেয়া বাঞ্ছনীয়? এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন- ********আরবী
“ (ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজে) জাতির ইমামত বা নেতৃত্ব সে ব্যক্তিই করবে, যে আল্লাহ্র আইনের কিতাব অধিক পাঠ ও মর্মার্থ অনুধাবনকারী। তাতে যদি একাধিক ব্যক্তির যোগ্যতা সমপর্যায়ের হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে হযরতের সুন্নাত-নীতি আদর্শ সম্পর্কে যে ব্যক্তি বিশেষভাবে অবগত, তাকেই প্রাধান্য দেবে। তাতেও সকলে সমপর্যায়ের হলে ঐ ব্যক্তিই নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন, যিনি হিজরত গমনে অগ্রবর্তী ছিলেন। যদি হিজরত গমনের যোগ্যতাও সকলের সমান সমান হয়, তাহলে যে বয়সে অপেক্ষাকৃত বড়, তাকে নেতা নির্ধারণ করবে। তাঁর প্রভাব বলয়ের মধ্যে অপর কোন ব্যক্তি নেতৃত্ব করবে না এবং তাঁর মর্যাদার আসনে অনুমতি ছাড়া বসবে না”। (মুসলিম)
একাধিক ব্যক্তির মধ্যে যদি সমযোগ্যতা থাকে এবং তাদের মধ্যে কে যে অধিক যোগ্য তা জানা না যায়, তখন ‘কোরা’ বা লটারির মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করবে। যেমন সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা) কাদেসিয়ার যুদ্ধে করেছিলেন। কে আযান দেবে, তা নিয়ে সেনাবাহিনীতে বিরাট বাক-বিতন্ডার সূত্রপাত ঘটে। এমনকি পরস্পর সংঘর্ষের উপক্রম দেখা দেয়। সকলেই বলছে ‘আমি আযান দেবো’। অনেকেই অগ্রাধিকার প্রাপ্তির যৌক্তিকতা তুলে ধরে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিম্নোক্ত নির্দেশের অনুসরণ করা হয়।
*******আরবী
“মানুষ আযান এবং নামাযের সামনের সারির সওয়াবের গুরুত্ব বুঝার ফলে যদি লটারীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে তাই করবে”।
[পাঁচ]
মাল-সম্পদ, ঋণ, যৌথ ব্যবস্থা, মুজারাবাত
আল্লাহ্র নির্দেশিত পন্থায় মোকদ্দমার ফয়সালা ইত্যাদি
সরকারী আমানতের অপর ধরন হলো মাল-সম্পদ এবং বিশেষ ও সাধারণ ঋণ, আমানতদারী, যৌথ ব্যবস্থা, তাওয়াক্কুল, মুজারাবাত, এতীমের সম্পদ, ওয়াকফ ইত্যাদি। ফকীর-মিসকীন সর্বস্বহীনকে দান-খয়রাত প্রদান, উসুলকারী, কর্মচারী, ‘মোয়াল্লাফাতুল কুলূব’, দাস মুক্তি, ঋণগ্রস্তকে অর্থ সাহায্য দান এবং আল্লাহ্র পথে দান-সাদকা প্রদান প্রভৃতি এ পরিচ্ছেদের আলোচ্য বিষয়।
আমানতের দ্বিতীয় প্রকারটি মাল-সম্পদের সাথে সংশ্লিষ্ট। কর্জ বা ঋণ সম্পর্কে আল্লাহ্ ইরশাদ করেন-
******আরবী
“তোমাদের মধ্যে যদি একে অপরকে আমানতদার বানায়, তার উচিত উক্ত দাতাকে তার আমানত আদায় করে দেয়া এবং নিজ প্রভু আল্লাহ্কে ভয় করা”। (সূরা বাকারাঃ ২৮৩)
এ প্রকার আমানতের মধ্যে যেসব বিষয় শামিল তা হলো মূলধন, বিশেষ ও সাধারণ ঋণ, যেমন গচ্ছিত সম্পদ। যৌথ শরীকদার, মুয়াক্কিল, মুজারিব ও এতীমের মাল, ওয়াকফ সম্পত্তি, খরিদকৃত সম্পদের মূল্য আদায় করা, ঋণ, নারীদের মোহর, লভ্যাংশের মজুরী ইত্যাদি।
এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“জন্মগতভাবে মানুষ অসহিষ্ণু। যখন তাকে ক্ষতি স্পর্শ করে, সে বিচলিত হয়ে ওঠে আর যখন তাকে প্রাচুর্য স্পর্শ করে, সে কৃপণ হয়ে যায়। তবে নামাযী ব্যক্তিরা নয়, যারা নিজেদের নামাযে সদা নিষ্ঠাবান, যাদের সম্পদে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিত উভয় শ্রেণীর মানুষের হক নির্ধারিত রয়েছে।…… আর যারা আমানত ও নিজেদের কৃত চুক্তি ওয়াদা রক্কা করে”। (মায়ারিজঃ ১৯-৩২)
তিনি আরও ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“ হে নবী! আমি তোমার কাছে সঠিকরূপে কিতাব নাযিল করেছি। তোমাকে আল্লাহ্ তায়ালা যেরুপ বাৎলিয়ে দিয়েছেন, তুমি ঠিক সেভাবে মানুষের পারস্পরিক বিরোধ, মামলা-মোকাদ্দমার ফয়সালা করবে। খেয়ানতকারী প্রতারকদের পক্ষাবলম্বন করবে না”। (সূরা নিসাঃ ১০৫)
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
*******আরবী
“ তোমার কাছে যে ব্যক্তি আমানত রেখেছে, তুমি তাকে তা হুবহু বুঝিয়ে দাও। তোমার কাছে খেয়ানত-প্রবঞ্চনা ও বিশ্বাসঘাতকতা করলে, তুমি তার সাথে প্রবঞ্চনা করো না”।
মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“মুসলমানরা যাকে জানমালের নিরাপত্তার প্রশ্নে বিশ্বস্ত মনে সে-ই ‘মুমিন’। আর ঐ ব্যক্তি হচ্ছে খাঁটি ‘মুসলিম’, যার হাত ও রসনা থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে। আর প্রকৃত ‘মুহাজির’ হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে আল্লাহ্র নিষিদ্ধ কাজ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তেমনি সেই হচ্ছে খাঁটি মুজাহিদ, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র জন্যে আপন সত্তার বিরুদ্ধে লড়াই করে”।
এটি একটি সহীহ হাদীস। এর অংশ বিশেষ বুখারী এবং মুসলিমে উল্লেখিত আছে। কিছু অংশ তিরমিযী শরীফেও উল্লেখ আছে।
রাসূলুল্লাহ (সা) আরও ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“ফেরত দেয়ার অভিপ্রায় যে মানুষের সম্পদ গ্রহণ করে, আল্লাহ্ তা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন। আর কেউ সম্পূর্ণ আত্মসাতের নিয়তে কারও কাছ থেকে কোনো অর্থ-সম্পদ নিলে, আল্লাহ্ তায়ালা তা ধ্বংস করে দেন”। (বুখারী)
সকল আমানত পরিশোধকে আল্লাহ্ ফরজ করেছেন। আমানতে খেয়ানত, লুট, ছিনতাই, চুরি, প্রতারণা যাই হোক, তা আদায়ের জন্য সতর্ক করা হয়েছে। এমনিভাবে হাওলাত বা ধার হিসাবে গৃহীত অর্থ সম্পদ ও জিনিসপত্র ফেরত দেয়া ফরজ।
রাসূলুল্লাহ (সা) এ সম্পর্কে বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন-
*********আরবী
“ধারে গৃহীত জিনিস ফেরত দিতে হবে, উটের শাবক যার জন্যে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাকেই দিয়ে দেবে। ঋণ অবশ্য পরিশোধ্য। নেতার উপর যে কর্তব্য নির্ধারিত তাকে তা আদায় করতেই হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা প্রত্যেক হকদারকে তার হক (অধিকার) প্রদান করে দিয়েছেন। সুতরাং উত্তরাধিকারীর জন্যে অসিয়ত নেই”।
দেশের প্রধান শাসক, আঞ্চলিক শাসকবর্গ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ এবং জনগণের সকলেই এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। শাসক ও শাসিত উভয় শ্রেণীর উপরই এটা ফরজ বা কর্তব্য যে, তারা পরস্পরের উপর বর্তিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। রাষ্ট্র নায়ক এবং তার স্থলাভিষিক্ত কিংবা নিয়োজিত ব্যক্তি ও জনগণের ন্যায্য অধিকার দানে অবহেলা করা চলবে না। হকদারকে তার হক আদায় করে দিতেই হবে। তাদের ন্যায্য অধিকার আংশিকভাবে নয় পুরোপুরিই আদায় করে দেয়া তাদের উপর ফরজ করা হয়েছে। এমনিভাবে জনগণ ও রাষ্ট্রের যেসব হক তাদের কাছে দেয়া হয়েছে, তা পরিশোধ করে দেয়া ফরজ। রাষ্ট্রের অনধিকার ও অন্যায়ভাবে কিছু দাবী করাও বৈধ নয়। কেউ কোনো অন্যায় দাবী তুলে রাষ্ট্রীয় শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুললে নিম্নলিখিত আয়াতের মর্মবাণী তাদের উপর প্রযোজ্য হবে। যেমন-
***********আরবী
“ হে নবী! তাদের মধ্যে এমন কিছু লোকও রয়েছে, সাদকা-খয়রাতের প্রশ্নে তারা তোমার ব্যাপারে অভিযোগের সুরে কথা বলে। অতঃপর যখন এ থেকে তাদের কিছু দেয়া হয় তারা খুশি হয় আর যদি না দেয়া হয় তাহলে-সাথে সাথে বিগড়ে বসে। আল্লাহ্ তায়ালা এবং তাঁর রাসূল তাদের যা প্রদান করেছিলেন, তারা যদি এটা আনন্দে গ্রহণ করতো এবং বলতো যে, আল্লাহ্ই আমাদের জন্য যথেষ্ট, এখন দেননি তো কি হয়েছে, ভবিষ্যতে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল আমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ প্রদান করবেন, আমরা তো আল্লাহ্র সাথেই যোগসূত্র স্থাপন করে আছি, (তাহলে এটাই তাদের উপযুক্ত উক্তি হতো।) দান-খয়রাত তো শুধু ফকীর-মিসকীনদের হক আর ঐ সকল ব্যক্তির হক, যারা (রাষ্ট্রের)কর্মচারী হিসাবে দান-সাদকার অর্থ উসুল করার জন্যে নিযুক্ত। তেমনি যাদের অন্তরকে (দীনের সাথে) সংযোগ করা কাম্য, এগুলো তাদেরও হক। দাসমুক্তির ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করণে, আল্লাহ্র পথে এবং দুস্থ প্রবাসী মুসাফিরের পাথেয় হিসাবে দান-সাদকার অর্থ ব্যয়িত হবে। সাদকা বিলি-বন্টনে এসব হচ্ছে আল্লাহ্র নির্ধারিত খাত। আল্লাহ্ই সবজান্তা এবং অতি প্রজ্ঞাময়”। (সূরা তওবাঃ৫৮-৬০)
জনগণের উপর রাষ্ট্রের যেসব অধিকার রয়েছে, সেগুলো দানে বিরত থাকার অধিকার তাদের নেই। এমনকি শাসক অত্যাচারী হলেও রাষ্ট্রের স্বার্থে যেসব বিষয় তাদের দেয়, তা দিতেই হবে। এ মর্মে মহানবী (সা) ঠিক তখনই নিম্নোক্ত ইরশাদ করেছিলেন, যখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসকের বিরুদ্ধে জুলুম নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। যথা-
********আরবী
“তোমাদের উপর তাদের এই হক বা অধিকার রয়েছে, তা আদায় করে দাও, কারণ, আল্লাহ্ তায়ালা তাদেরকে জনগণের অধিকারের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবেন”।
হযরত আবু হুরায়রা (রা) কর্তৃক মহানবী (সা) –এর হাদীস বর্ণিত আছে যে-
*********আরবী
“বনী ইসরাঈলকে নবীগণ শাসন করতেন। তাদের কোন একজন পয়গম্বরের ইন্তেকাল হলে তারা অপর এক পয়গম্বরকে তাঁর খলীফা তথা স্থলাভিষিক্ত করতেন। তবে আমার পর এভাবে আর কোনো নবী-রাসূল নেই এবং আসবেও না। তবে বহু খলীফা হবে। সাহাবীগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঐ সময়ের জন্যে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আপনার কি নির্দেশ’। রাসূল (সা) বললেন, তোমরা পূর্ণ বিশ্বস্ততা সহকারে তাদের আনুগত্য করে যাবে। প্রথ যিনি নির্বাচিত হবেন, তার প্রতি তোমাদের আনুগত্যের দায়িত্ব কর্তব্য যথাযথ পালন করবে। তারপর যিনি তার প্রতি। অতঃপর তোমাদের উপর যেসব হক পালনীয় হয়ে আছে, তা দিয়ে দেবে। জনগণের যেসব অধিকার রয়েছে, আল্লাহ্ সে ব্যাপারে শাসকদের নিকট কৈফিয়ত তলব করবেন। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
হযরত ইবনে মাসউদ (রা) কর্তৃক সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“আমার পরে তোমরা বহু ধন-ঐশ্বর্য দেখতে পাবে, আর এমন বিষয়ও দেখবে এবং এমন কথাও শুনবে, যেগুলো তোমরা পছন্দ করবে না। সাহাবা-এ কেরাম আরয করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল, এরূপ মুহূর্তে আমাদের করণীয় সম্পর্কে বলুন”। রাসূল (সা) ইরশাদ করেন-
**********আরবী
“তোমাদের কাছে (সরকারী-বেসরকারী) যাদের হক বা অধিকার থাকে, তোমরা তা পরিশোধ করে দেবে আর নিজেদের অধিকারের জন্যে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা জানাবে”।
জনসাধারণের তহবিলের দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকবে, (ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা) অর্থ বন্টনে স্বেচ্ছাচারিতা চালাবার কোনো অধিকার তাদের নেই। রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদকে ব্যক্তিগত অর্থ-সম্পদ মনে করবে না। যেভাবে খুশি সেভাবে সরকারী অর্থ ব্যয় করবে না। কারণ সরকারী অর্থ তহবিলের দায়িত্বে যিনি নিয়োজিত থাকবেন, তিনি এক মালিক নন, বরং আমানতদার মাত্র; (ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা তা নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চলবে না)। মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“ আল্লাহ্র কসম, না আমি কাউকে (অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ) প্রদান করি, না কারুর সম্পদ (অন্যায়ভাবে) গ্রহণ করি বা আটক রাখি। আমি যেভাবে আদিষ্ট ঠিক সেভাবেই জনগণের মাঝে সম্পদ বণ্টন করে থাকি”। (বুখারী)
লক্ষ্য করার বিষয় যে, মহানবী (সা) রাব্বুল আলামীন বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের রাসূল (বার্তাবাহক)। তিনি বলেছেন, কাউকে দেয়া না দেয়ার প্রশ্নে তাঁর ইচ্ছারও কোনোজ মূল্য নেই। বিলি-বণ্টনে মালিকদের মতো নিজ ইচ্ছামাফিক সরকারী মাল সম্পদ ব্যয়ে তাঁর কোনো ইখতিয়ার নেই। দুনিয়াদার শাসক ও উচ্চ কর্মকর্তারা সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে স্বজনপ্রীতি অবলম্বন করে এবং তাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয় করে। অনেক হকদার লোককেও তারা শুধু এজন্যে বঞ্চিত করে যে, যেহেতু ঐ সকল লোক তাদের প্রিয়জনদের তালিকাভুক্ত নয়। রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা। আল্লাহ্ যেখানে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি সেখানেই তা ব্যয় করতেন।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবও (রা) (রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপারে) একই নীতির অনুসরণ করেছেন। একদা অনেক ব্যক্তি এসে তাঁকে বললঃ আপনার আরও কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা প্রয়োজন। আপনি বায়তুল মাল থেকে আরও কিছু বেশী অর্থ গ্রহণ করলে ভাল হবে। হযরত উমর (রা) বললেনঃ আমার এবং জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক তোমাদের জানা নেই। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে এরূপ যেমন, কিছু লোক সফর করছে। সকলে নিজ নিজ মাল-সামান ও অর্থ-সম্পদ তাদের একজনের কাছে গচ্ছিত রেখে বললোঃ আপনি আমাদের এই অর্থ ও মালামাল আমাদের প্রয়োজনে ব্যয় করবে। এমতাবস্থায় আমানতদারের জন্যে সেই অর্থ-সম্পদ থেকে কিছু ব্যয় করা এবং যেমন খুশি তেমনি খরচ করা বৈধ্য হবে কি?
একবার হযরত উমর (রা)-এর নিকট ‘খুমুসের’ (গণীমতের পঞ্চাংশ) অনেক মাল এসেছিল। ঐগুলো দেখে তিনি বললেনঃ জনগণ তাদের আমানত দিয়ে দিয়ে বেশ কাজ করেছে। উপস্থিত দু’একজন বললেন, আপনি আমানতের মালসমূহ আল্লাহ্র হুকুমে যথাযথ ব্যয় করে থাকেন। এজন্যে জনগণও আমানতসমূহ (যাকাত, ওশর, কর ইত্যাদি সরকারী পাওনা) নিয়মিতভাবে এনে আপনার হাতে জমা দিয়ে দেয়। আপনি যদি এতে হেরফের করতেন তারাও করতো।
“উলিল আমর” বা নেতা বলতে কি বুঝায়, জনগণের তা জানা উচিত। তাঁর অধিকার এবং মর্যাদা কি, সে সম্পর্কেও অবহিত থাকা আবশ্যক। নেতার তুলনা অনেকটা বাজারের মতো। বাজারে তোমরা যে পরিমাণ মূল্য দাও, সে পরিমাণ পণ্য পাও, তাই হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ) বলতেনঃ তুমি যদি সত্যবাদী এবং ন্যায়পরায়ণ হও এবং বিশ্বস্ততার পরিচয় দাও, তাহলে এর বিনিময়ে তুমিও একই প্রতিদান পাবে। পক্ষান্তরে যদি মিথ্যাচার, অন্যায়, অবিচার ও বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দাও তাহলে তুমিও প্রতিদানে একই আচরণ পাবে।
অতএব দেশের প্রধান শাসক ও তাঁর অধীনস্থ অন্যান্য কর্মকর্তার উপর ফরজ হলো, ন্যায়নীতির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থ সংগ্রহ করা এবং সেগুলো যেখানে ব্যয় করা সঙ্গত ওখানে সেভাবে ব্যয় করা। হকদারকে বঞ্চিত না করা।
হযরত আলী (রা)-এর নিকট একবার অভিযোগ আসলো যে, তাঁর কোনো কোন ‘নায়েব’ (প্রতিনিধি) জনগণের উপর জুলুম করে। তিনি তখন আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে উঠলেন-
********আরবী
“ হে আল্লাহ্! আমি তাদের জুলুম-অত্যাচার এবং আপনার হক ত্যাগ করার নির্দেশ দেইনি”।
[ছয়]
রাষ্ট্রীয় সম্পদ তিন প্রকার
এই পরিচ্ছেদের বিষয় বস্তুসমূহঃ (১) গণীমতের মাল (তথা রণাঙ্গনে শত্রু পরিত্যক্ত সম্পদ), (২) সাদকা-খয়রাত, (৩) মাল-ঈ-ফাঈ। সকল পয়গম্বরের তুলনায় মহানবী (সা)-কে ৫টি অতিরিক্ত জিনিস দেয়া হয়েছে।
শ্রমজীবী দুর্বলদের কারণেই তোমরা যারা সবল তাদের খাদ্য জুটে এবং অন্যান্য সহায়তা মিলে। ‘গানেম’দের (গনিমত লাভকারী) মধ্যেই মালে গণীমত বণ্টন করবে। বনী উমাইয়া, বনী আব্বাসও তাই করেছে।
কুরআন ও হাদীছে উল্লেখিত রাষ্ট্রীয় সম্পদ তিন প্রকার। (১) গণীমতের মাল, (২) সাদকা-যাকাত, (৩) মাল-এ-ফাঈ। কাফেরদের সাথে লড়াইয়ের পর যেই সম্পদ হস্তগত হয়, তাকে মালে গণীমত বলা হয়। কুরআন মজীদের সূরা আনফালে মালে গণীমতের কথা আল্লাহ্ তায়ালা উল্লেখ করেছেন। বদর যুদ্ধের সময় এ সূরা নাযিল হয়েছিল। ‘আনফাল’ শব্দটি ‘নফল’ শব্দের বহুবচন। নফল অর্থ অতিরিক্ত, সূরার নাম ‘আনফাল’ রাখার কারণ ছিল, মুসলমানদের সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যেমনঃ আল্লাহ্ ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“ হে নবী! মুসলমান সৈনিকরা তোমার নিকট গণীমতের মাল (বণ্টনের) নিয়ম-বিধি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। তুমি তাদের বলে দাও যে, মালে গণীমত তো আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের জন্য। (সূরা আনফালঃ ১)
********আরবী
আর জেনে রেখো, যে সম্পদ তোমাদের হস্তগত হয়, তার এক পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহ্র এবং তাঁর রাসূলের জন্য, রাসূলের নিকটাত্মীয় এবং ইয়াতীমদের জন্যে আর পরমুখাপেক্ষী ভিক্ষুক ও দুস্থ প্রবাসী মুসাফিরের জন্য”। (সূরা আনফালঃ৪১)
তিনি আরও ইরশাদ করেন-
*******আরবী
“গণীমতের যেসব মাল তোমাদের হস্তগত হয়, সেগুলোদ হালাল এবং পবিত্র জ্ঞানে ভক্ষণ করোদ আর আল্লাহ্কে ভয় করো। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। (সূরা আনফালঃ৬৯)
সহীহ বুখারী এবং মুসলিম শরীফে হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে, মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন যে,
******আরবী
“এমন পাঁচটি জিনিস আমাকে দেয়া হয়েছে, যা ইতিপূর্বে আর কোন নবীকে দেয়া হয়নি। (১) এক মাসের দূরত্বে (অবস্থান রত শত্রুর মনে) আমার ব্যক্তিত্বের ভীতি সৃষ্টির (মাধ্যমে) আমাকে বিজয় প্রদান করা হয়েছে। (২) গোটা ভূপৃষ্ঠকে আমার জন্যে মসজিদ এবং এর মাটিকে পবিত্রতা দানকারী বানানো হয়েছে। সুতরাং আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তির জীবদ্দশায় নামাযের সময় উপস্থিত হবে, সে যেন নামায আদায় করে নেয়। (৩) আমার জন্যে মালে গণীমত তথা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিত্যক্ত সম্পদ হালাল করা হয়েছে। আমার পূর্বে কারোর জন্য তা হালাল ছিল না। (৪) আমাকে সুপারিশ অধিকার দেয়া হয়েছে। (৫) আমার পূর্বে নবী রাসূলদেরকে নিজ নিজ কওমের জন্যে প্রেরণ করা হতো আর আমি প্রেরিত হয়েছি গোটা বিশ্বমানবের জন্যে”।
মহানবী (সা) আরও ইরশাদ করেছেন যে,
**********আরবী
‘কিয়ামতকে সামনে রেখে আমি তরবারিসহ প্রেরিত হয়েছি, যেন মানুষ এক আল্লাহ্র ইবাদত করে যার কোনো শরীক নেই। আমার রিযিক আমার বল্লমের ছায়াতলে রাখা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধাচরণকারীর জন্যে রয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনা। যে অপর জাতির (ধর্মীয়) সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত রূপে গণ্য হবে। (মুসনাদে আহমদ)
অতএব, মালে গণীমতের বেলায় এক পঞ্চমাংশ হচ্ছে ফরয। তার থেকে এ অংশ আলাদা করে আল্লাহ্র নির্দেশ মাফিক তা খরচ করবে। অবশিষ্ট মাল গণীমত আহরণকারীদের মধ্যে বিতরণ করবে। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর উক্তি হলো, “তারাই মালে গণীমতের অধিকারী যারা জিহাদে অংশ গ্রহণ করে। চাই যুদ্ধ করুক বা না করুক। মালে গণীমত বন্টনকালে কারোর পদমর্যাদা, কর্তৃত্ব-নেতৃত্বের পরোয়া করবে না। বংশ মর্যাদা বা আভিজাত্যের সামনেও ভীরুতা দেখাবে না। সম্পূর্ণ ন্যায় নীতি ও ইনসাফের সাথে এ মাল বণ্টন করবে। মহানবী (সা) ও তাঁর খলীফাগণ কি করতেন? সহীহ বুখারী শরীফে আছে যে, হযরত সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস (রা) অন্যদের তুলনায় নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। যেমন, আল্লাহ্র রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন,
************আরবী
“ তোমাদের বিজয় এবং রিযিক প্রদান করা হয় তোমাদের দুর্বলদের অসিলায়”।
মুসনাদে আহমদ হাদীস গ্রন্থে সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) সমীপে এ মর্মে আরয করলাম যে, হে আল্লাহ্র রাসূল! জনৈক ব্যক্তি আপন কওমের মর্যাদা ও নেতৃত্ব বজায় রাখার লড়াই করছে। তাঁর অংশ কি অন্যদের মতোই সমান হওয়া উচিত? হুযূর (সা) বললেন-
*********আরবী
“ হে ইবনে উম্মে সা’দ ! তোমার মরে যাওয়াই শ্রেয়। তোমাদেরকে কি তোমাদের দুর্বলদের অসিলায় রিযিক ও বিজয় প্রদান করা হয় না?”
বনী উমাইয়া এবং বনী আব্বাসের শাসনামলে গণীমতের মাল আহরণকারীদের মধ্যেই বিলি-বন্টন করা হতো। তখন মুসলমানরা রোম, তুরস্ক এবং বারবারদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত থাকত। জিহাদে কেউ যদি দুঃসাহসিক কোনো কাজ করে, গুরুত্বপূর্ণ কোন অভিযান চালায় যেমন দুর্গ দখল করা, যদ্দরুন যুদ্ধ জয়ের পথ উন্মুক্ত হয় কিংবা শত্রুবাহিনীর নেতার উপর হামলা চালিয়ে দুশমনকে পরাস্ত করে অথবা অনুরূপ অন্য কোন কাজ করে, তাহলে এহেন ব্যক্তিকে ‘নুফল’ বা অতিরিক্ত দেয়া যাবে। কেননা খোদ রাসূলুল্লাহ (সা) এবং তাঁর খলীফাগণ ‘নুফল’ দিতেন। যেমন, ‘বেদায়া’ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) ‘খুমুস’ (এক পঞ্চমাংশ) ছাড়াও এক চতুর্থাংশ আরও দিয়েছিলেন। তেমনি গাযওয়া-এ-রাজফায় ‘খুমুস’ এর অতিরিক্ত এক তৃতীয়াংশ দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে উলামা-এ-কিরামের মতভেদ আছে, কারও মতে ‘নুফল’ ও অতিরিক্ত দান ‘খুমুস’ তহবিল হতে দেয়া হবে। কারও মতে ‘খুমুস-এর এক পঞ্চমাংশ থেকে দেয়া হবে, যেন যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী কারও উপর কারোর প্রাধান্য প্রকাশ না পায়।
সঠিক কথা হলো এই যে, খুমুস-এর এক চতুর্থাংশ থেকে নুফল ও অতিরিক্ত মালে গণীমত প্রদান করবে, তাতে কারোর উপর কারোর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলেও হতে পারে। তবে এই ‘নুফল’ প্রদান কোনো দ্বীনী স্বার্থেই হতে হবে- ব্যক্তির খেয়াল-খুশি বা স্বার্থপরতার তাতে কোনো স্থান নেই। মহাবনী (সা) একই লক্ষ্যে কয়েকবার ‘নুফল’ প্রদান করেছেন। সিরীয় ফকীহগণ এবং ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আহমদ প্রমুখের মত হচ্ছে এটিই। এ মতের ভিত্তিতেই বলা হয়েছে যে, এক চতুর্থাংশ এবং এক তৃতীয়াংশ শর্তহীনভাবেই দিয়ে দেবে। এর অধিক পরিমাণ দিতে হলে তাতে শর্ত আরোপ করতে হবে। যেমন, নেতা কিংবা সেনাবাহিনীর সিপাহ্সালার বলবেন, “ যে ব্যক্তি অমুক কিল্লাটি ধ্বংশ করবে” অথবা “ শত্রু দলের অমুককে হত্যা করবে, তাকে এটা দেয়া হবে। কারও কারও অভিমত হলো, নুফল এক তৃতীয়াংশের অধিক না দেয়া। তবে হাঁ শর্ত আরোপ করে দেয়া যাবে। এ দুটি অভিমত হচ্ছে ইমাম আহমদ ও অন্যদের।
সঠিক বর্ণনা মতে, নেতার জন্যে এটা বলা জায়েয আছে যে, “ যে ব্যক্তি যে জিনিস নিয়েছে সেটি তারই”। বদর যুদ্ধে মহানবী (সা) এরূপ বলেছিলেন। তবে এটা তখনই বলা যায়, যদি কল্যাণের মাত্রা অধিক হয় এবং অসন্তোষের মাত্রা কম হয়।
ইমাম বা নেতা কারও পক্ষে কোনো প্রকার জুলুম, প্রতারণা, বাড়াবাড়ি কিংবা মালের ক্ষতি করার অধিকার নেই। কেউ এরূপ করলে কিয়ামতের দিন এজন্যে তাকে আল্লাহ্র কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। কারণ, এ ধরনের কাজও খিয়ানত। মাল-এ-গণীমতের মধ্যে লুটতরাজ করাও নাজায়েয। যার যার খেয়াল খুশি মত লুটপাট করে গণীমত মাল নিয়ে যাওয়া থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলিমগণকে বিরত রেখেছেন।
গণীমতের মাল বণ্টন হবার পূর্বে যদি নেতা এই সাধারণ অনুমতি প্রদান করেন যে, “যে যেইটা হস্তগত করে নিয়েছো সেটা তারই” এটা তখনই জায়েয এবং হালাল হবে যদিতা ‘খুমুস আদায় করার পর হয়ে থাকে। অনুমতির জন্যে বিশেষ কোনো শব্দ বা বাক্য নেই। যেভাবেই হোক নেতা বা ইমামের পক্ষ থেকে অনুমতি হলেই হবে। তবে যে ক্ষেত্রে সাধারণ অনুমতি দেয়া না হয়, তখন যদি কেউ কোনো জিনিস নেয়, ঐ অবস্থায় এতদূর ন্যায়নীতিবোধ নিয়ে কাজ করবে যে, অনুমতি পেলে তার ভাগে যে পরিমাণ মাল আসতো, ঠিক ঐ পরিমাণই সে গ্রহণ করতে পারে।
ইমাম যদি গণীমতের মাল সংগ্রহ করা বন্ধ করে দেন এবং অবস্থা কিছুটা এরূপই হয় যে, তিনি যেটা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত নিবেন, তাহলে পরস্পর বিরোধী দুটি মত দেখা দিলে উভয়টিই বাদ দিবে এবং মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে। কারণ আল্লাহ্র দ্বীনের পথ হচ্ছে মধ্যপন্থা। মাল বণ্টনকালে ন্যায়-নীতি হচ্ছে এই যে, এক অংশ পাবে ‘পেয়াদা’ অর্থাৎ পদাতিক আর তিন অংশ পাবে ঘোড় সওয়ার বাহিনী যারা আরবী ঘোড়া রাখে। এক অংশ তার আর দুই অংশ ঘোড়ার। খায়বর যুদ্ধে মহানবী (সা) এরূপই করেছিলেন।
কোনো কোনো ফকীহ-এর মতে সওয়ার (আরোহী) পাবে দুই অংশ। এক অংশ থাকবে তার আর এক অংশ তার ঘোড়ার। তবে প্রথমোক্ত মতটিই সঠিক। সহীহ হাদীসও এ ব্যাপারে পোষকতা করে। কারণ ঘোড়ার সাথে তার সহিস ইত্যাদিও থাকে। তাই ঘোড়া অধিক সাহায্যের মুখাপেক্ষী। ‘পেয়াদা’র তুলনায় সহিস বা সওয়ারের দ্বারাই অধিক কল্যাণ সাধিত হয়।
কোনো কোনো ফকীহর অভিমত হলো, আরবী ঘোড়া এবং ‘হাজীন’ ঘোড়াকে সমান অংশ দিতে হবে। কারও মতে আরবী ঘোড়াকে দুই অংশ এবং হাজীন ঘোড়াকে এক অংশ দেবে।এ রাসূলুল্লাহ (সা) এবং সাহাবা-এ-কিরাম থেকে এরূপ বর্ণিত আছে, ‘হাজীন’ ঐ ঘোড়াকে বলা হয় যার মা হচ্ছে ‘নাবতিয়া’- (১) তাকে ‘বিরযাওন’ এবং ‘বাস্তরী’ও বলা হয়। ছিন্নমুস্ক ও অছিন্নমুস্ক উভয় ঘোড়ার একই হুকুম। যেই পুরুষ ঘোড়া মাদী ঘোড়ার উপর প্রজননে ব্যবহৃত হয়নি, অতীত যুগের লোকেরা তাকে অপেক্ষাকৃত অধিক গুরুত্ব দিত। কারণ এরূপ ঘোড়া অধিক শক্তিশালী এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়ে থাকে।
গণীমতের মালের মধ্যে যদিদ মুসলমানের মাল থাকে- চাই সেটা জমিন হোক কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি-যা বণ্টনের পূর্বে অন্য মানুষও জানতো, তাহলে সে মাল তাকে ফেরত দিয়ে দেবে। এটা মুসলিম উম্মাহ্র সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।
গণীমতের মাল এবং এর বণ্টন সম্পর্কিত অনেক বিধি বিধান রয়েছে। এ ব্যাপারে পূর্বসূরীদের পক্ষ থেকে রয়েছে অনেক বক্তব্য ও দৃষ্টান্ত। কোনটি সর্বসম্মত এবং কোনটিতে মত পার্থক্য রয়েছে, যেগুলোর আলোচনার অবকাশ এখানে কম। এখানে মোটামুটি মৌলিক ক’টি কথাই শুধু পেশ করা হয়েছে।