ইসলামের স্বর্ণ যুগে সামাজিক ন্যায়-নীতি
মূল-সাইয়েদ কুতুব
অনুবাদ-আকরাম ফারুক
প্রকাশকের কথা
ইসলাম মানব জাতির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র জীবন বিধান। সর্বশেষ নবী সৃষ্টির মহা পুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর তিরোধানের পর চার খলিফা ও পঞ্চম খলিফা হিসেবে খ্যাত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রাঃ) এর যুগকে ইসলামের স্বর্ণযুগ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। সে যুগের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই গ্রন্থে এবং সে সময়কার সামগ্রিক কর্মকান্ড যথাঃ খলিফাতুল মুসলিমিনের খোদাভীতি, উন্নত নৈতিক মান, জনসেবা, সরকারী কোষাগার থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক কপর্দকও গ্রহণ না করা, সামাজিক শান্তি, শৃংখলা, সুবিচার, একে অন্যের প্রতি মমত্ববোধ, সহানুভূতি ইত্যাদি সর্বকালের সর্বযুগের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
বর্তমান এই নব্য জাহেলিয়াতের যুগে মুসলিম মিল্লাতের আমূল পরিবর্তন এবং ব্যক্তি জীবনে প্রতিটি মুসলমান ইসলামের মূল আবেদন সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভে এ গ্রন্থ সহায়ক ভূমিকা রাখবে, ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তায়ালা এই গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে পাঠক সমাজকে বিশেষভাবে উপকৃত হবার তৌফিক দান করুন। আমিন।
ইসলামের মূল প্রাণশক্তি
ইসলামের স্বর্ণোজ্জল ইতিহাসের দিকে দৃকপাত করলে আমরা সেখানে তার মূল প্রাণশক্তিকে সদা সক্রিয় দেখতে পাই।
সত্য দ্বীনকে যে ব্যক্তি জানবার চেষ্টা করবে এবং তার মেজাজ-প্রকৃতি ও ইতিহাসকে অধ্যয়ন করবে সে তার প্রাণশক্তিকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। এই প্রাণশক্তিকে সে ইসলামের আইন-কানুন ও নীতিমালার মধ্যে পূর্ণোদ্যমে কার্যকর দেখতে পাবে। এটা এত প্রভাবশালী যে, যে কোনো মানুষই এর দ্বারা প্রভাবান্বিত না হয়ে পারে না। কিন্তু কোনো গভীর অনুভূতি ও মৌলিক চিন্তাধারা যেমন সীমাবদ্ধ ভাষায় বর্ণণা করা যায় না তেমনি এই প্রাণশক্তিরও বর্ণনা দেয়া অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ প্রাণশক্তি আবেগ ও উদ্দীপনায়, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে এবং রসম-রেওয়াজের মধ্যে সক্রিয় থাকে বটে কিন্তু তাকে ভাষার সীমিত পোষাকে আবৃত করা অত্যন্ত কঠিন।
এই প্রাণশক্তিই সেই সমুন্নত প্রোজ্জ্বল দিক চক্রবালের রূপরেখা নির্দেশ করে, যার অভিমুখে যাত্রা করার জন্য ইসলাম তার অনুসারীদেরকে প্রেরণা ও উৎসাহ যোগায়। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য উদ্বুদ্ধ করে এবং সে জন্য শুধু অপরিহার্য্য্ কর্তব্য ও গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতা পালনে ক্ষান্ত না হয়ে, স্বেচ্ছায় সানন্দে আরো বেশি চেষ্টা সাধনা করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছারপথ অত্যন্ত কঠিন ও দুর্গম আর সেখানে পৌঁছার পর তার ওপর অবিচল থাকা আরো বেশি দুঃসাধ্য। জৈবিক প্রেরণা ও চাহিদা এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের প্রবল চাপ অধিকাংশ মানুষের পায়ে জিঞ্জির হয়ে জীবনের মহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছারপথে অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। আর যদিও-বা আবেগ উদ্দীপনার তীব্রতায় এর সংকল্পের প্রাবল্যে কখনো সেখানে পৌঁছেই যায় তাহলেও তার সেখানকার বাধা-বিঘ্ন ও বিপদ-আপদ অতিক্রম করে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ এ মহোন্নত স্তরের সাথে জড়িত রয়েছে জান-মাল এবং চিন্তা ও কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তন্মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তির ওপর নিজ সত্তা, নিজ সমাজ ও মানব জাতি সম্পর্কে এবং সর্বোপরি তার স্রষ্টার ব্যাপারে যে দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে তা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুতর। তার স্রষ্টা যে তার প্রতিটি ছোট বড় কাজ সর্বদা স্বচক্ষে অবলোকন করছেন, তার মনের গভীরে লুকানো গোপন কথা ও তার নিঃ শব্দ কার্যক্রম সম্পর্কেও কার্যক্রম সম্পর্কেও ওয়াকিফহাল রয়েছেন- এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট অনুভূতি জাগরুক রাখাই হচ্ছে স্রষ্টার সম্পর্কে তার গুরু দায়িত্ব। এই গুরু দায়িত্ব উপলব্ধি করার জন্য ইসলাম তার বিবেককে করেছে সদা জাগ্রত এবং হুশিয়ার। আর তার চেতনা ও প্রজ্ঞাকে করেছে সুতীক্ষ্ণ ও সুতীব্র।
উচ্চতম লক্ষ্যের অভিমুখে যাত্রার এই জটিলতা এবং লক্ষ্যে উপনীত হবার পর তথায় স্থায়িত্বের এই দুঃসাধ্যতার অর্থ এ নয় যে, ইসলাম একটা কবিসুলভ কল্পণা অথবা এমন একটা অতি মানবিক ধারণা যাকে জয় করার অভিযোগ পোষণ করা যায় কিন্তু যাকে স্পর্শ করা যায় না। আসল ব্যাপার তা নয়। যে সুমহান ও সুউচ্চ স্তরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে উপনীত হওয়া সকল যুগের সকল মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এটা হচ্ছে একটা লক্ষ্যসীমা মাত্র। মানুষ সর্বদা ওটা অর্জন করার জন্য সচেষ্ট থাকবে সে জন্যে তার রূপরেখা নির্দেশ করে দেয়া হয়েছে। এ চেষ্টা অতীতে যেমন করা হয়েছে, আজ এবং আগামীতেও তা অব্যাহত থাকা উচিত। অতীতের মানব সমাজ এ লক্ষ্যে উপনীত হবার চেষ্টা চালিয়েছে- কখনো লক্ষ্যে উপনীত হয়েছে আবার কখনো বা দূরে সরে গেছে। এটা এমন একটা আদর্শ যাকে শুধু মানুষের বিবেক ও তার অন্তর্নিহিত শক্তি সমূহের ওপর গভীর আস্থা দ্বারাই জয় করা সম্ভব। এতে করে প্রমাণিত হচ্ছে যে, অনাগত ভবিষ্যতে মানুষ সম্পর্কে হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। এই সর্ব্বোচ্চ লক্ষ্যের পূর্বেই একটি সুবিশাল প্রান্তর রয়েছে। চেষ্টা সাধনা ও সাফল্যের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হওয়া অধিকাংশ মানুষের পক্ষে সম্ভব সে মাপকাঠির জন্য এ বিশাল প্রন্তর যথেষ্ট। আল্লাহর একটি স্থায়ী নীতি এই যে, তিনি কোনো ব্যাক্তিকে তার ক্ষমতার চেয়ে বেশি চেষ্টার জন্য বাধ্য করেন না।
“আল্লাহ্ কোনো মানুষকে তার ক্ষমতার চাইতে বেশি কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেন না।” (সূরা বাকারা-শেষ আয়াত) ইসলামের মেজাজ-প্রকৃতি এতো ইনসাফ প্রিয় ও মধ্যমপন্থি যে, সে সাধারণ মানুষের নিকট থেকে শুধুমাত্র অবশ্য করণীয় কার্যসমূহ গ্রহণ করেই সন্তুষ্ট হয়। কারণঃ
“প্রত্যেকের কাজের বিভিন্ন স্তর রয়েছে।” বস্তুত অবশ্য করণীয় হিসেবে যে সব দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে জীবনের সাফল্যের জন্য সেটাই যথেষ্ট। এরপরে সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হবার জন্য পথ সর্বদা উম্মুক্ত রয়েছে এবং সেদিকে অগ্রসর হবার জন্য উদাত্ত আহবানে ইসলাম সদা সোচ্চার রয়েছে।
যে প্রাণশক্তির কথা আমরা ওপরে উল্লেখ করেছি, তা ইসলামের সমাজ ও সভ্যতাকে বাস্তব রূপদানে পরিপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যে ইসলাম শুধু একটা বিশ্বাসের নাম ছিল, তা ব্যাক্তিসমূহ ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এখন আর ইসলাম শুধু মতবাদ ও মতাদর্শের নাম নয় – ওটা নিছক ওয়াজ-নছিহত ও হেদায়েত কিংবা অলীক কল্পনা সমূহের সমষ্টিও মাত্র নয়। ওটা এখন জীবন্ত ও জাগ্রত মানব চরিত্রের রূপ ধারণ করেছে, বাস্তব জীবনের ঘটনাবলীতে আত্নপ্রকাশ করেছে – সর্বোপরি তা এমন সব সমাজ সংস্থা ও সংস্কারমূলক কীর্তি স্থাপন করেছে- তা কেউ স্বচক্ষে দেখতে ও স্বকর্ণে শ্রবণ করতে পারে। এসব সমাজ সংস্থা ও সংস্কার কীর্তি গোটা মানক জীবন ও ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বস্তুতঃ এ সব ইসলামের সেই মহিমান্বিত ‘প্রাণশক্তির’ই অবদান। এই প্রাণশক্তিই মৃতপ্রায় ব্যাক্তিসমূহের জীবনে বিপ্লব এনে দিয়েছিল। তাতে এক নব চেতনা ও নতুন জীবনী শক্তির সঞ্চার করেছিল।
বস্তুতঃ ইসলামের ইতিহাসের সূচনা যুগে এবং তার পরবর্তী যুগে বিস্ময়কর ব্যাক্তি সমূহের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং যাদের জীবনের আলোড়ল সৃষ্টিকারী গৌরবগাথা ইসলামের ইতিহাসে সুরক্ষিত রয়েছে তাদের সম্পর্কে এটাই হচ্ছে সঠিক ব্যাখ্যা। যে অবিশ্বাস্য ধরনের ঘটনাবলী শুধু উচ্চতর চিন্তার সৃষ্ট রূপকথার মত মনে হয়, তারও রহস্য এই।
আত্মার পবিত্রতা, বিবেকের নির্ভীকতা, অভাবনীয় ত্যাগ-তিতীক্ষা ও কোরবানী, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের মরণপণ সংকল্প, চিন্তা ও আত্মার অসাধারণ ও অচিন্তনীয় উচ্চতা এবং জীবনের বিভিন্ন বিভাগের অসামান্য কৃতিত্ব যা পুরোপুরি ভাবে বর্ণনা করা ইতিহাসেরও ক্ষমতা বহির্ভূত-এ সব কিছু ইসলামের এই বিপ্লবী প্রাণশক্তিরই অবদান।
ইতিহাসের পাতায় যে সব অসাধারণ কীর্তি ও ঘটনাবলী ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তার সাথে ইসলামের বিপ্লবী প্রাণশক্তির একটা সুগভীর সম্পর্ক আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। মূলতঃ ইসলামের ইতিহাসে যে শক্তির প্রকাশ দেখা যায় এই অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তিই তার মূল উৎস।
এ কীর্তি সমূহকে যদি আমরা উক্ত প্রাণশক্তি থেকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখতে যাই তাহলে আমাদের অধ্যয়ন অসম্পূর্ণ থাকবে। এই ভ্রান্ত অধ্যয়নের ফলে জীবন ও জগতের ওপর সক্রিয় ভাবে প্রভাবশীল শক্তিসমূহ সম্পর্কে আমরা অত্যন্ত মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে লিপ্ত হতে বাধ্য হব। এর ফল দাড়াবে এই যে, প্রত্যেক গৌরবোজ্জ্বল ব্যক্তিদের গৌরব ও সম্মানের উৎস নির্ণয় করতে গিয়ে আমরা তার ব্যক্তিগত মাহাত্মকেই প্রাধান্য দেব এবং এ সবের সর্বপ্রথম উদ্দীপক ও সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী কার্যকরণ উক্ত ‘প্রাণশক্তি’কে অগ্রাহ্য করবো। অথচ এই প্রাণশক্তিই সেই মহান ব্যক্তিদের বিবেক ও মনকে প্রভাবান্বিত করেছিল, আর এরই বলে বলিয়ান হয়ে তারা ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল এবং ঘটনা স্রোতকে নিজেদের ইস্পিত স্রোতে প্রবাহিত করেছিল। এর পর তারা ইতিহাসকে জীবনের এক উদ্দাম, উচ্ছল ও গতিবান স্রোতধারার নিকট সোপর্দ করেছিল। আর সেই স্রোতধারার ওপর ভর করেই আত্মপ্রকাশ করেছিল সেই সব অবিস্মরণীয় বিপ্লবাত্মক কীর্তি।
আমরা যদি গৌরবদীপ্ত মহৎ ব্যক্তিগণের আবির্ভাব এবং তাদের কীর্তি সমুহের প্রকাশকে সম্পূর্ণরূপে এই বিপ্লবী প্রাণশক্তির অবদান বলে অবিহিত করি তা’হলে সেটা অত্যুক্তি হবে না। আসলে এই প্রাণশক্তি একটা অতীন্দ্রিয় প্রেরণা ছাড়া আর কিছু নয়। এটা যে সব কীর্তি ও ব্যক্তিত্বের সাথে এসে মিলিত হয়েছে তা বাহ্যতঃ ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন শক্তি হলেও মূলতঃ তা-সবই অতীন্দ্রিয় শক্তি। এদের মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তিত্ব উক্ত অতীন্দ্রিয় প্রেরণাকে গ্রহণ করার ব্যাপারে কতদুর যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে সেটাই হচ্ছে তার মহত্বের মাপকাঠি। এখন যদি আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুয়তকে উক্ত যোগ্যতার সর্বোচ্চ স্তর বলে মনে করা হয় তা হলে সেটা বিচিত্র কি? আসলে তাঁর সত্তাই অতীন্দ্রিয় প্রেরণাকে পরিপূর্ণ রূপে গ্রহণ করেছিল এবং সারা জীবন ব্যাপী সেই সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল।
নবুয়তের স্তরের পর উচ্চ মর্যাদার বহু স্তর রয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাহাবীরা এবং তাদের পরবর্তী অনুসারীরা এই সব স্তরে অধিষ্ঠিত হন। এই মহান দ্বীনের প্রাণশক্তিকে যে ব্যক্তি যতদূর গ্রহণ করতে পেরেছে, সে সেই অনুযায়ী উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে। বস্তুতঃ অত্যন্ত ব্যাপক অধ্যয়নের পরই আমরা অনুধাবন করতে পারবো যে, এই প্রেরণা মানবাত্মাগুলোকে কতদূর প্রভাবান্বিত করতে পেরেছে- কিভাবে তাদের ঘুমন্ত প্রাণকে জাগিয়ে তুলেছে- কর্মচঞ্চল ও কর্মক্ষম করে তুলেছে- অপূর্ব ও আশ্চর্যজনক দৃষ্টান্তসমূহ স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং সর্বশেষ গোটা মানবেতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে।
এই প্রেরণা ও প্রাণশক্তির প্রভাব আমরা ইতিহাসের বড় বড় ঘটনা এবং দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট ঘটনা- উভয়ের মধ্যেই দেখতে পাই। জানা কথা যে, আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যের পরিমাণ ইঞ্চি-গজে নির্ণয় করা সম্ভব নয় বরং তার সম্পর্ক হলো গুনাগুণের সাথে। এর পরিমাণ নির্ণয় করা যায় শুধু বিভিন্ন পরিস্থিতি ও পরিবেশে অনুষ্ঠিত ঘটনাপুঞ্জের মাধ্যমে।
আরব উপদ্বীপের মুষ্টিমেয় কতগুলো লোক অতি অল্প সময়ের মধ্যে রোম ও পারস্যের মত দুটো বিশাল সাম্রাজ্যকে পদানত করে ফেলেছিল। গোটা মানবজাতির ইতিহাসে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় বিজয়ের অন্য কোনো নজীর পেশ করতে পারবে না। কিন্তু এই গৌরবদীপ্ত ঘটনার গৌরব ও মাহাত্ম্য কিছুমাত্র ম্লান হবে না যদি আমরা বলি যে কোরাইশদের জুলুম-নির্যাতনের জবাবে বেলাল (রাঃ) নামক হাবসী ক্রীতদাস একাই যে ধৈর্য্যর পরিচয় দিয়েছিল তাতেও এই একই মাহাত্ম্য প্রকাশ পেয়েছে। কোরাইশরা হযরত বেলাল হাবশী (রাঃ)কে ইসলাম পরিত্যাগ করতে বাধ্য করার জন্য যে যাতনা দিয়েছিল তা মানুষ মাত্রেরই ধৈর্য ক্ষমতার বহির্ভূত। নীচ থেকে তাকে উত্তপ্ত বালি দগ্ধ করছিল, পেট ও বুকের ওপর পাথরের বোঝা চাপানো ছিল, প্রবল ক্ষুধা ও পিপাসায় তার বুক ফেটে যাচ্ছিল, তদপুরি তাকে প্রচন্ড জোরে প্রহার করা হচ্ছিল। কিন্তু এই অসহনীয় নির্যাতনের মধ্যে তার মুখ দিয়ে যে কথা নিঃসৃত হয় তা ছিল ‘আহাদ’ ‘আহাদ’।
এ প্রেরণাই যখন কোনো পথচারী সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে তখন স্বৈরাচারী সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়েও সে কড়া কড়া স্পষ্ট কথা বলে এবং আল্লাহর রাহে কারো নিন্দা-সমালোচনাকে ভয় পায় না। বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি খলিফায়ে রাশেদ যখন বিনয়, অল্পে তুষ্ট ও আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শণ করেন তখন তার মধ্যেও একই প্রাণশক্তি কার্যকর দেখা যায়। উভয় ব্যক্তি একই উৎস থেকে শক্তি লাভ করেছেন আর সে উৎস হচ্ছে ইসলামের দুর্জয় ও বিপ্লবী প্রাণশক্তি।
রোম ও পারস্য বিজয় প্রসঙ্গে এ কথা বলা প্রয়োজন মনে হচ্ছে যে, এখানে ইসলামের বিজয় মূলতঃ একটা আধ্যাত্মিক মতাদর্শের বিজয় ছিল। এই মতাদর্শ মানুষের অন্তরাত্মাকে জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। এ ঘটনা ইতিহাসের আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণকে সমর্থন করে কেননা এখানে বস্তুগত বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। বস্তুগত বিশ্লেষণ দ্বারা এই অসাধারণ বিজয়ের হেতু নির্দেশ করা অসম্ভব। নিছক বস্তুগত শক্তি দ্বারা আরবরা অত বড় দু’টো সাম্রাজ্যকে পদানত করতে পারতো না।
সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইসলাম আরবদের চিন্তা ও কর্মে, উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে মনস্তাত্মিক বিপ্লব সংঘটিত করেছে তার গুরুত্ব ঐসব দেশের বিজয়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং বেশী। এটা ইসলামের প্রাণশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে দেশ জয়ের ঘটনাবলীর চাইতে স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয়। এ কথা সকলেরই জানা যে, মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুয়ত ও ইন্তোকালের মাঝামাঝি সময়ে আরব উপদ্বীপে খোদ তাঁর আনীত নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া স্বতন্ত্র কোন অর্থনৈতিক বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়নি- তাই সেখানখার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন কোন মৌলিক পরিবর্তনও সাধিত হয়নি যা আরবদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গী, কার্যকলাপ ও সমাজ ব্যবস্থায় এত বড় বিপ্লব আনতে পারে। বস্তুতঃ এ সমস্ত কীর্তিকলাপ আসলে এই আধ্যাত্মিক মতাদর্শেরই সৃষ্টি।
এখানে আমাদের পক্ষ্যে এই বিপ্লবের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। আমরা এর একটি মাত্র দৃষ্টান্ত পেশ করবো। এ দৃষ্টান্ত সে যুগের আরবদের একটি বিবৃতির মধ্যে পাওয়া যায়। এ বিবৃতিটি তারা ইসলামের শত্রুদের সামনে দিয়েছিলেন অথচ তারা এর একটি কথারও প্রতিবাদ করতে পারেননি। এ হচ্ছে আন্দোলনের প্রাথমিক যুগের ঘটনা। কোরাইশদের জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের দ্বীন ও ঈমান রক্ষা করার জন্য মুসলমানরা হিজরত করে হাব্শায় চলে যান। হাব্শায় গিয়ে পাছে তারা শক্তি অর্জন করে ফেলে এই আশংকায় কোরাইশরা রাজা নাজ্জাশীর নিকট দু’জন প্রতিনিধি প্রেরণ করে। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম মোহাজেরদেরকে সেখান থেকে বহিস্কার করানো ব্যবস্থা করা। এই প্রতিনিধিদ্বয় চিল আমর ইবনুল আস ও আবদুল্লাহ ইবনে আবি রাবিয়া। তারা গিয়ে বললো,
‘জাহাপনা! আমাদের দেশের কতিপয় অবুঝ তরুণ আপনার দেশে এসে বসবাস করছে। তারা নিজ জাতির ধর্ম ত্যাগ করেছে এবং আপনার ধর্মও গ্রহণ করেনি। তারা নিজেদের পক্ষ থেকে এক মনগড়া ধর্ম এনেছে- যা আমাদের জন্যও নতুন- আপনার জন্যও নতুন।ওদের বাপ-চাচা, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং আমাদের জাতির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আমাদেরকে আপনার কাছে এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যে আপনি অনুগ্রহ পূর্বক ওদেরকে দেশে ফেরত পাঠাবেন। সে সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এই তরুণদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তরুণরা যে সব জিনিষের ওপর আপত্তি তোলে এবং যেগুলোকে মন্দ বলে, তা আমাদের নেতারাই ভাল বোঝেন।‘
এই কথা শুনে নাজ্জাশী মুসলিম তরুণদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যার জন্য তোমরা নিজ জাতিকে পরিত্যাগ করে এসেছ এবং আমার ধর্ম বা অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করনি সে ধর্মটা কি?”
উত্তরে আবু তালেবের পুত্র জাফর (রাঃ) বললেন,
“হে বাদশাহ! আমরা চরম মুর্খতা ও অজ্ঞতার মধ্যে লিপ্ত ছিলাম, প্রতিমা পূজা করতাম, মৃত দেহ আহার করতাম ও ব্যভিচার করতাম। আত্মীয়তার বন্ধনের অবমাননা করা ও প্রতিবেশীর অধিকার হরণ করা আমাদের নিত্যকার অভ্যাস ছিল। আমাদের মধ্যে যারা সবল ছিল তারা দুর্বলের ওপর অত্যাচার ও শোষণ চালাতো। এমনি অবস্থায় আমাদেরই একজনকে আল্লাহ নবী বানিয়ে আমাদের নিকট প্রেরণ করলেন। আমরা তার বংশ-মর্যাদা, তার সততা-সত্যবাদীতা, তার বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতা সম্পের্কে ওয়াকিফহাল। তিনি আমাদেরকে আল্লাহর প্রতি আহবান করেন, আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা ও কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত-উপাসনা ও আনুগত্য করার শিক্ষা দেন। আমরা এবং আমাদের পিতৃপুরুষরা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য যে সব প্রতিমা ও প্রস্তর মূর্তির পূজা করতাম, তিনি সেগুলোর পূজা ছেড়ে দিতে বলেন। তিনি সততা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে ও প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি অশ্লীল ও অশালীন কার্যকলাপ, মিথ্যাবাদিতা, ইয়াতিমের ধন আত্মসাৎ ও সতী নারীদের বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদেরকে এক আল্লাহর এবাদত করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার সাথে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদেরকে নামাজ কায়েম করতে, যাকাত দিতে ও রোজা রাখতেও নির্দেশ দিয়েছেন…..।”
কোরাইশদের দু’জন প্রতিনিধিই দরবারে উপস্থিত ছিলেন। তার মধ্যে একজন ছিল আমর ইবনুল আস- বাকপটুতা ও কুটনৈতিক দক্ষতায় যার জুড়ি ছিলনা। কিন্তু জাফর (রাঃ) প্রাগৈসলামিক আরবের পরিস্থিতির যে ছবি এঁকেছেন এবং রাসুলুল্লাহ’র আনীত জীবন-বিধানের যে পরিচয় পেশ করেছেন দু’জনের কেউ তার প্রতিবাদ করেনি। এটা প্রমাণ করেছে যে আরবের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে এ বর্ণনা সম্পূর্ণ সঠিক ছিল।
এ হচ্ছে শুধু আরব উপদ্বীপ সম্পর্কে ইতিহাসের একটি সাক্ষ্য। আধুনিক যুগের একজন অমুসলিম সে সময়কার সমগ্র পৃথিবী সম্পর্কে এ ধরনেরই একটি সাক্ষ্য দিয়েছেন। জে. এইচ. ডেনিসন (J.H. Denison) তার পুস্তকে সভ্যতার ভিত্তি হিসাবে ভাবাবেগ-এ (Emotion as the basis of civilization)লিখেছেন,
“পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে সভ্য জগত নৈরাজ্যের এক সাংঘাতিক বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছেল। এরূপ মনে হচ্ছিল যে, চার হাজার বছরের অবিশ্রান্ত চেষ্টা সাধনার ফলে গড়ে ওঠা বিরাট সভ্যতা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে চাচ্ছে এবং মানবতা অসভ্যতা ও বর্বরতার আদিম যুগে ফিরে যেতে উৎসুক হয়ে উঠেছে। গোত্রে গোত্রে ভয়াবহ দাংগা ও কোন্দল লেগে ছিল। কোন আইন-শৃংখলার পরিবর্তে বিভেদ ও বিশৃংখলার জন্ম দিচ্ছিল। যেন একটি বিরাট বৃক্ষের বিস্তীর্ণ ডালপালা সমগ্র পৃথিবীকে নিজের ছায়াতলে আবৃত করতে চায়। কিন্তু ভেতর থেকে তার কান্ডকে মূল পর্যন্ত এমনভাবে ঘুনে খেয়ে দিয়েছে যে, যে কোন মুহূর্তে বৃক্ষটি ভুমিস্মাৎ হতে পারে। তখনকার সভ্যতা ঠিক এমনি অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল। এহেন সর্বাত্মক ধ্বংসের চিহ্ন যখন পরিস্ফুট ঠিক তখনি সেই ব্যক্তি জন্মলাভ করলেন যিনি সমগ্র বিশ্বকে ঐক্যবব্ধ করলেন।” [মওলানা মুহাম্মদ আলী প্রণীত ও ওস্তাদ আহমদ জাওয়াদুছাছানুহার কর্তৃক আরবীতে অনুদিত Islam and New World order থেকে গৃহীত। ] যাহোক আমরা এখন এই ইসলামের সামাজিক ন্যায়-নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট কতিপয় ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত পেশ করবো।