রাজনৈতিক ব্যবস্থা
ইতিহাস সাক্ষী যে, একটি সু-সংহত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিক দিয়ে ইসলামের একটি দুর্লভ ও আদর্শ যুগ অতিবাহিত হয়েছে। নিদারুন পরিতাপের বিষয় এই যে, ইসলামের এ যুগ বেশী দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। আগামীতে আমরা এর প্রকৃত কারণ অনুধাবনের চেষ্টা করবো। কোন কোন ব্যক্তির ধারণা এই যে, এই কারণ স্বয়ং ইসলামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল প্রকৃতিতেই নিহিত রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই কারণ তার অভ্যন্তরেই নিহিত না বাইরে- তা আমরা পরে আলোচনা করবো। প্রথমে আমরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করবো। কেননা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সবসময় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীন এবং তার প্রকৃতির অনুসারী হয়ে থাকে।
নবী করিম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের সময় ঘনিয়ে এলে একদিন হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে নামাজের ইমামতী করার নির্দেশ দিলেন। এতে হযরত আয়েশা (রাঃ) এই যুক্তি দেখিয়ে আপত্তি জ্ঞাপন করেন যে, আবু বকর (রাঃ) এর হৃদয় অত্যন্ত কোমল। তাই নামাজের ইমামতি করলে লোকেরা তার আওয়াজ শুনতে পাবে না, তাঁকে তার নির্দেশ পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেন। এতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রেগে যান এবং আবু বকর (রাঃ)-কে ইমামতী করার জন্য ডেকে আনার ওপর জোর দেন।
প্রশ্ন এই যে, এর অর্থ কি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে খলিফা নিযুক্ত করে গেছেন? মুসলমানরা কি এ দ্বারা স্পষ্টতঃ তাই বুঝেছিলেন?
আমাদের মতে এ দু’টোই নিতান্ত অযৌক্তিক কথা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যদি খলিফা নিযুক্ত করে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত করতেন এবং ইসলামে যদি খলিফা মনোনীত করার বিধানই থাকতো তাহলে তিনি যেমন ইসলামের অন্যান্য বিধি ও নীতি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, এটাও সেরূপ করতেন। আর মুসলমানরাও যদি স্পষ্ট বুঝে থাকতেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবু বকরকে খলিফা নিযুক্ত করে গেছেন- তাহলে সাকিফা নামক স্থানে মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে খলিফা নিয়ে যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় তার প্রশ্নই উঠতো না। কারন আনাসাররা কখনো রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সিদ্ধান্তে আপত্তি করার মত লোক ছিলেন না।
প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের গোটা ব্যাপারটাকেই মুসলামানদের পারস্পরিক পরামর্শের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়ছে। লোকেরা পূর্ণ স্বাধীনতা ও সম্মতির সাথে খেলাফতের যোগ্যতম ব্যক্তি নির্বাচন করবে- এটাই ছিল উদ্দেশ্য। সাকিফায় অনুষ্ঠিত আলোচনার পর যদি এই সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে যে, খলিফা মুহাজেরদের মধ্যে থেকে হবে- তাহলে সেটা ইসলামের কোন নির্দিষ্ট বিধান ছিল না বরং মুসলমানদের পারস্পরিক আলাপ আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত একটা সিদ্ধান্ত। আনসাররা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে তাতে কেউ আপত্তি করতে পারতো না। কিন্তু বাস্তবে যা হয়েছিল তাহলো এই যে, আনসাররা হযরত আবু বকরের খেলাফতে সম্মত হয়ে যান। কেননা তিনি অন্য সকলের চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। অবশ্য মদিনায় আওস ও খাযরাজ গোত্র আঞ্চলিকতা ভিত্তিক বিদ্বেষ উস্কিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা ঘোলাটে করতে চেয়েছিল কিন্তু আনসাররা সে চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন।
এ ক্ষেত্রে খলিফা মোহাজেরদের মধ্য থেকে হবে, এ সিদ্ধান্তের অর্থ এই নয় যে খলিফা কোরেশ বংশের মধ্য থেকেই হতে হবে, যদি তাই হতো তাহলে হযরত ওমর রাঃ পরামর্শ পরিষদ নিযুক্ত করার সময় বলতেন না যে, “হোজায়ফার গোলাম সালেম জীবিত থাকলে আমি তাকে খলিফা নিযুক্ত করতাম।” জানা কথা যে, সালেম (রাঃ) কোরেশ বংশোদ্ভূত ছিলেন না। তাছাড়া ইসলামের মূলনীতি অনুসারেও কোন কোরেশীকে শুধু ‘কোরেশী’ এবং রসূলুল্লাহর (সাঃ) বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে অন্যান্য মুসলমানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করা যায় না। স্বয়ং হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ-
——-এরাবিক টেক্সট——
“যার কার্যকালাপ তাঁকে পিছিয়ে দেয় তার বংশ-মর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারবে না।”
হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত ওমর (রাঃ) কে খলিফা নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি মুসলমানদেরকে বাধ্য করে গিয়েছিলেন। তার এই নিয়োগকে রদ করার পূর্ণ অধিকার তাদের ছিল। হযরত ওমর (রাঃ) আবুবকরের নিয়োগের ফলে নয় বরং লোকদের নির্বাচনের ফলেই খলিফা হয়েছিলেন। এমনিভাবে হযরত ওমর (রাঃ) ছয় সদস্য বিশিষ্ট পরামর্শ পরিষদ গঠন করেন। এই পরিষদকে নিজেদের মধ্য হতে একজনকে খলিফা নির্বাচনের জন্য তিনি নির্দেশ দিয়ে যান। কিন্তু মুসলমানদের ওপর সেই ছয়জনের একজনকে খলিফা মেনে নেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। তার সম্পূর্ণ স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মধ্য থেকেই একজনকে নির্বাচিত করেন। কারন প্রকৃতপক্ষে তখনকার মুসলিম উম্মতের মধ্যে ঐ ছয় জনই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যাক্তি ছিলেন।
হযরত আলীর রাঃ নির্বাচনের সময় মতভেদ দেখা দেয়। এই মতভেদের দরুন প্রথম বারের মত মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এর পরিণামেই একে একে এমন সব হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয় যে, ইসলামের প্রাণশক্তি, তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মূলনীতি এবং জীবনের অন্যান্য বিভাগে তার প্রবর্তিত চিন্তাধারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে ইসলামের আসল মতাদর্শ আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। সেটা হচ্ছে এই যে,কেবলমাত্র মুসলমানদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ভিত্তিতেই কোন ব্যাক্তি শাসকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। হযরত আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচাত ভাই, তার জামাতা, তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। এসব জেনে বুঝেও মুসলমানরা তাঁকে অনেক বিলম্বে খেলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। হয়তো বা হযরত আলীকে এরূপ বিলম্বিত করা বিশেষতঃ হযরত ওমরের পর-তার অধিকার ক্ষুণ্ণ করারই নামান্তর। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই বিলম্ব দ্বারাই ইসলামের শাসন পদ্ধতির সর্বাপেক্ষা নিখুঁত মূল্যায়ণ সম্ভব হয়েছে। এতে করে এই বৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হয়েছে যে উত্তারাধিকারের ধারণা খেলাফতের আসনের ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। কারণ এ ধারণা ইসলামের প্রাণসত্তা ও তার মূলনীতিসমূহ থেকে সবচেয়ে দূরত্বে অবস্থিত। হযরত আলীর প্রতি ব্যক্তিগত ভাবে একটু অবিচার হলেও এই আদর্শের বাস্তব রূপায়ন যে তার চেয়েও গুরুতর, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এরপরে এল বনু উমাইয়ার যুগ। তারা ইসলামী খেলাফতকে বনু উমাইয়ার বংশের মধ্যে সীমিতই শুধু করলো না বরং এক স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় রূপান্তরিত করলো। এটা ইসলামের শিক্ষার ফল ছিল না বরং এটা ছিল “জাহেলিয়াতের” প্রভাব। জাহেলিয়াতের এই প্রভাব ইসলামের প্রাণশক্তিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
এখানে ইয়াজিদের নিয়োগ ও বাইয়াত কিভাবে সম্পন্ন হয়েছিল সে সম্পর্কে কতিপয় রেওয়ায়েত পেশ করলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সিরিয়ায় ইয়াজিদের পক্ষে ‘বাইয়াত’ (প্রস্তাবিত অথবা মনোনীত খলিফার প্রতি জনগণের আনুগত্য বা সমর্থন ও সম্মতিকে বাইয়াত বলা হয়) গ্রহণের পর মুয়াবিয়া সাইদ ইবনুল আসকে যে প্রকারেই হোক হেজাজবাসীদের সমর্থন আদায় করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। কিন্তু সাইদ ব্যর্থ হন। অতঃপর মুয়াবিয়া স্বয়ং বিপুল সৈন্য-সামন্ত সমভিব্যাহারে মক্কায় যান এবং শীর্ষস্থানীয় মুসলমানদেরকে সমবেত করে তাদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ
“দেখ, তোমাদের সাথে আমি যেরূপ ব্যবহার করেছি এবং তোমাদের আত্নীয়তা ও সম্পর্ক-সম্বন্ধের যেরূপ মর্যাদা রক্ষা করেছি তা তোমরা ভালভাবেই অবগত আছো। ইয়াজিদ তোমাদেরই ভাই-তোমাদের চাচার ছেলে। আমার ইচ্ছা এই যে, তোমরা ইয়াজিদকে নামে মাত্র খলিফা মেনে নাও। যাবতীয় নিয়োগ-বদলি, রাজস্ব আদায় ও বণ্টন প্রভৃতি কাজ তোমরাই করবে।”
আব্দুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রাঃ) জবাব দিলেন, আপনার জন্য দু’টো পন্থার একটা অনুসরণ করা উচিত, হয় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যেমন নিজের বংশ বহির্ভূত এক ব্যাক্তির পক্ষে অছিয়ত করেছিলেন তাই করুন, নচেৎ হযরত ওমর (রাঃ) যেমন কোন নিকট আত্নীয় নয় এমন ছয় ব্যাক্তির সমন্বয়ে যে পরিষদ গঠন করেন সেরূপ একটি নিরপেক্ষ পরিষদ গঠন করুন।”
মুয়াবিয়া (রাঃ) ক্রোধে যেন জ্বলে উঠলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কাছে তৃতীয় কোন পন্থা নেই?” ইবনে জোবায়ের বললেন, “না।” মুয়াবিয়া অন্যান্য লোকদের দিকে ফিরে বললেন, “তোমাদের মতামত কি?” সকলে একযোগে বললেন, “ইবনে জোবায়ের যা বলেছেন আমাদের বক্তব্যও তাই।” তখন মুয়াবিয়া (রাঃ) তাদেরকে হুমকি দিয়ে বললেন, “কোন চরম পন্থা অবলম্বন করার আগে হুশিয়ারী সংকেত দিলে পরে আর আপত্তির অবকাশ থাকে না। আমি তোমাদের সামনে ভাষণ দিলাম সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের একজন দাঁড়িয়ে সকলের সামনে আমার কথার প্রতিবাদ করলো। আমি এটা বরদাশ্ত করলাম এবং ক্ষমা করে দিলাম।
কিন্তু এখন আমি একটি চূড়ান্ত কথা বলার জন্য দাঁড়িয়েছি। আমি হুশিয়ার করে দিচ্ছি তোমাদের কেউ যদি এর জবাবে একটি কোথাও বলে, তবে দ্বিতীয় কোন কথা কর্ণগোচর হবার আগেই তরবারী তার দেহ থেকে মাথা ছিন্ন করে ফেলবে। এখন প্রত্যেকের নিজ নিজ প্রাণ রক্ষা করার চিন্তা করা উচিত।
এরপর মোয়াবিয়ার দেহরক্ষী বাহিনীর অধিনায়ক ইয়াজিদের মননোয়নের বিরোধী হেজাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগনের মস্তকোপরি উলঙ্গ তরবারীধারী দুজন করে লোক নিযুক্ত করে মুয়াবিয়া অধিনায়ককে নির্দেশ দেন যে ওদের কেউ যদি আমার ঘোষণার সমর্থনে অথবা প্রতিবাদে একটি বাক্যও উচ্চারণ করে তবে উভয় যেন একযোগে তরবারি দিয়ে আঘাত করে।
এই ব্যবস্থা করার পর মুয়াবিয়া মিম্বারে আরোহণপূর্বক বললেন, “এই ব্যক্তিগণ হচ্ছেন মুসলমানদের নেতা এবং তাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি, এদের মতামত ছাড়া কোন কিছু করা উচিত নয়। এরা ইয়াজিদের খেলাফতে সম্মত হয়ে ‘বাইয়াত’ করেছেন তোমরাও আল্লাহর নাম নিয়ে বাইয়াত কর। সংগে সংগে লোকেরা ‘বাইয়াত’ করলো। [ইবনুল আমীর, হাওয়াদেস হিঃ ৫৬। আমরা এই বর্ণনাতে সত্য বলে গ্রহণ করার ব্যাপারে বেশী জোর দেয়া পছন্দ করি না। কিন্তু ইসলামের মূলনীতিকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এটুকু নিশ্চয়ই বলবো যে, এই রেওয়ায়েত যদি সত্য হয়ে থাকে তবে এ ধরণের কাজ ইসলামের মূল প্রকৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিল। কোন যুক্তি কিংবা ওজর আপত্তি এ কাজকে সঠিক বলে প্রমাণ করতে পারে না। – গ্রন্থকার]
এই হচ্ছে ইয়াজিদ সরকারের ভিত্তি। এই ভিত্তিকে ইসলাম কখনো মেনে নিতে পারে না। আর স্বয়ং ইয়াজিদ কি ধরনের লোক ছিল? তার সম্পর্কে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হানজালার (রাঃ) বিবরণ লক্ষ্যণীয়।
“খোদার শপথ! আমরা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে তখন আন্দোলন শুরু করি যখন আমাদের আশংকা হয় যে আমাদের ওপর আকাশ থেকে প্রস্তর বৃষ্টি হবে। এই ব্যক্তি মা ও কন্যা এবং একাধিক বোনকে এক সাথে বিয়ে করে, মদ পান করে, নামাজ পরিত্যাগ করে। খোদার শপথ! অন্য কোন লোক আমার সাথী না হলেও আমি একাই আল্লাহর পথে কোরবানী দিতাম।”
হয়তো বা এটা ইয়াজিদের একজন দুশমনের অতিরঞ্জিত কথা। কিন্তু পরে ইয়াজিদ যে সব জঘন্য কাজ করেছিল যথাঃ হযরত হোসাইন (রাঃ) কে এমন নিকৃষ্ট পন্থায় হত্যা করা, কাবা শরীফ ঘেরাও এবং তার ওপর প্রস্তর নিক্ষেপ প্রভৃতি সাক্ষ্য দেয় যে ইয়াজিদের দুশমনেরা আদৌ অতিরঞ্জিত বর্ণনা দেয়নি। প্রকৃত অবস্থা যাই থাক না কেন মুসলমানদের মধ্যে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ও তাবেইনদের উপস্থিতি সত্ত্বেও ইয়াজিদই খেলাফতের যোগ্যতম ব্যক্তি ছিল- এ কথা দাবি করার ধৃষ্ঠতা কেউ দেখাতে পারে না। মূলতঃ এ সবের লক্ষ্য ছিল সরকারকে শুধু উমাইয়া বংশের মধ্যে সীমিত করা এবং তাকে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করা। এ প্রবণতা ইসলাম ও ইসলামী বিধানের বুকে ছুরিকাঘাতের সমতুল্য ছিল।
এ তথ্যগুলো আমাদের পরিবেশন করার প্রকৃত উদ্দেশ্য কোন ব্যক্তির নিন্দা করা নয়, বরং ইসলামে যে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোন শরিয়ত সম্মত সনদ ছাড়াই শুরু করা হয়, তার সাথে ইসলামের প্রাণশক্তি ও মূলনীতির যে কোনই সম্পর্ক নেই, তা স্পষ্ট করে দেখানো। ইসলামকে ও ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কলুষমুক্ত ও আসল স্বরূপ প্রকাশ করার জন্য আমাদের এ আলোচনার অবতারণা।
শাসন পদ্ধতির কতিপয় নমুনা
এই সত্যের সঠিক উপলব্ধির ব্যাপারে সহায়তা করার জন্য আমরা খেলাফতে রাশেদার বিভিন্ন যুগ যথাঃ হযরত আবু বকর ও ওমরের যুগ, হযরত ওসমান ও মারওয়ানের যুগ, অতঃপর হযরত আলীর যুগ এবং এমনিভাবে আব্বাসী ও উমাইয়া যুগ থেকে শাসন পদ্ধতির কতপয় বাস্তব নমুনা পেশ করার চেষ্টা করবো।
যখন মুসলমানগণ হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে খেলাফতের আসনে অভিষিক্ত করেন, তখন তাঁর দৃষ্টিতে মুসলমানদের ওপর আল্লাহর দ্বীন ও শরিয়তকে বাস্তবায়িত করা ছাড়া অন্য কোন কাজ ছিল না। এ ধরনের কোন চিন্তা তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি যে, ইতিপূর্বে সাধারণ নাগরিক হিসেবে তার ওপর যে সব কাজ হারাম ছিল এখন তা এ পদের জন্য হালাল হয়ে যাবে। অথবা আগে যে সব অধিকার ছিল না, তেমন কোন নতুন অধিকার তিনি পাচ্ছেন কিংবা তার ওপর যে সব দায়েত্ব ও কর্তব্য এতদিন ছিল, এখন তা থেকে তিনি মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন।
সাকিফায় যখন তার অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় তখন তিনি নিম্নরূপ ভঅষণ দেন, “আমি যদি আমার দায়িত্বসমূহ সুচারুরূপে পালন করি তাহলে তোমরা আমার সাহায্য ও সহযোগিতা করবে। আর যদি আমি বাঁকা পথে চলতে আরম্ভ করি তাহলে তোমরা আমাকে সোজা করে দেবে। সত্যবাদিতা হচ্ছে বিশ্বস্ততা আর মিথ্যাবাদিতা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে দুর্বল, সে আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে সবল– যাবত আমি তাকে তার অধিকার না দিয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি সবচেয়ে শক্তিশালী, সে আমার নিকট সবচেয়ে দুর্বল– যাবত আমি তার নিকট থেকে রাষ্ট্রের অধিকার আদায় করি। মনে রেখো, কোন জাতি যখনি জেহাদ থেকে পিছপা হয়, তখনই আল্লাহ তাকে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করেন। যখনি কোন জাতি অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখনই আল্লাহ তায়ালা সকলের ওপর পাইকারীভাবে আজাব নাজিল করেন। যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করতে থাকবো, ততক্ষণ তোমরা আমার আদেশ মান্য করবে। আর যদি আমি আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য থেকে বিচ্যুত হই, তখন তোমাদের ওপর আমার আদেশ পালনের দায়িত্ব থাকবে না।”
হযরত আবু বকরের বাড়ী মদিনার পার্শ্ববর্তী “সানহে” অবস্থিত ছিল। একটা ক্ষুদ্র মামুলী ধরণের বাড়ী। খলিফা হবার পরও তিনি সে বাড়ী মেরামতও করাননি। সেই বাড়ী থেকে মদিনা পর্যন্ত তিনি প্রতিদিন সকালে ও বিকালে পদব্রজে আসা-যাওয়া করতেন। কখনো কখনো একটা ঘোড়া ব্যবহার করতেন কিন্তু সেটা বাইতুল মালের ছিল না, ছিল ব্যক্তিগত। পরে কাজের চাপ বেড়ে গেলে তিনি মদিনায় চলে আসেন।
তিনি ব্যবসায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। খলিফা নির্বাচিত হবার পরের দিন যখন ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে রওনা করেছেন, তখন মুসলমানরা তাকে থামিয়ে বললেন, “খেলাফতের দায়িত্ব ব্যাবসা-বানিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে পালন করা যাবে না।” তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি যখন জীবিকা নির্বাহের অন্য কোন পন্থা জানি না তখন আমার চলবে কি করে?” সবাই তার বিষয় বিবেচনা করলেন এবং তার ব্যবসায় করতে না পারা ও খেলাফতের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে ‘বাইতুল মাল’ থেকে তার পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমান বেতন নির্ধারণ করেন।
এ সত্ত্বেও তিনি মৃত্যুকালে অছিয়ত করেন যে তিনি ‘বাইতুল মাল’ থেকে যা কিছু গ্রহণ করেছেন তা যেন হিসাব করে তার জমি-জমা ও অন্যান্য সম্পত্তি থেকে গ্রহণ করে বাইতুল মালে জমা দেয়া হয়।
ইসলাম শাসক ও শাসিতের বিবেক ও মন-মগজে যে চেতনা ও দায়িত্বানুভূতি জাগিয়ে তোলে তারই প্রভাবাধীনে উজ্জীবিত হয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) প্রতিটি প্রজার অভাব অভিযোগ দূর করার জন্য নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী মনে করতেন। তিনি সানহে অবস্থানকালে তার পার্শ্ববর্তী দুর্বল ও অসহায় প্রতিবেশীদের ছাগলের দুধ প্রতিদিন দুইয়ে দিতেন। যখন তিনি খলিফার পদে অধিষ্ঠিত হন তখন তাঁর প্রতিবেশীর একটি শিশু মেয়ে তাকে বলে, “এখনতো আপনি আর আমাদের ছাগল দুইয়ে দেবেন না, তাই না?” আবু বকর (রাঃ) বলেন, “কেন দেব না? নিশ্চয় দুইয়ে দেব।” তিনি যথার্থই তাদের দুধ দুইয়ে দেয়া অব্যহত রাখলেন। কখনো কখনো ছাগলের মালিক বালিকাকে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, ‘খালি দুধ দুইয়ে দেব, না মাখনও বের করবো?” কখনো সে বলতো, “মাখন বের করে দাও।” আবার কখনো বলতো, “খালি দুধ রেখে দাও।” মোট কথা সে যা বলতো, তিনি তাই করতেন।
হযরত আবু বকরের খেলাফতকালে হযরত ওমর (রাঃ) মদিনায় একটি অন্ধ মহিলার তত্বাবধান করতেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখেন, তিনি যাওয়ার আগেই কে এসে মহিলাটির কাজ করে দিয়ে যায়। এরূপ প্রতিদিন হতে লাগলো। একদিন গোপনে লুকিয়ে বসে থাকেন। দেখেন যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) এসে মহিলাটির সব কাজ করে দিয়ে যান। খেলাফত এবং তার গুরুদায়িত্ব তাকে এ কাজ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি। তাকে দেখামাত্র হযরত ওমর (রাঃ) চিৎকার করে বলে উঠলেনঃ “নিশ্চয়ই আপনি। খোদার শপথ আপনিই (প্রতিদিন এই কাজ করে থাকেন)।”
এটা হল হযরত আবু বকরের শাসন নীতির কয়েকটা সাধারণ নমুনা! তার স্থলে যখন হযরত ওমর এলেন তখনও এই নীতি অক্ষুন্ন ছিল। ওমর (রাঃ) কখনো খেলাফতকে নিজের একটা বাড়তি অধিকার হিসেবে গ্রহণ করেননি। তবে বাড়তি দায়িত্ব অবশ্যই মনে করেছেন। বলা বাহুল্য সে দায়িত্ব আল্লাহর আইন জারী করা ছাড়া আর কিছু নয়।
‘বাইয়াত’ অনুষ্ঠানে তিনি যে ভাষণ দেন তাতে বলেন, “ভাই সব! আমি তোমাদেরই একজন। তার চেয়ে বেশী কিছু নই। যদি খলিফাতুর রসূলের (হযরত আবু বকর) অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা সংগত হতো তাহলে আমি কিছুতেই তোমাদের এ দায়িত্ব গ্রহণ করতাম না।”
অপর এক ভাষণে তিনি বলেন, “আমার ওপর তোমাদের সম্পর্কে কতিপয় দায়িত্ব অর্পিত আছে সেগুলো আমি উল্লেখ করছি। ওগুলো সম্পর্কে তোমরা সব সময় আমার কাছে হিসাব চাইবে। তোমাদের খাজনা ও কর আদায় করা আমার দায়িত্ব। আমি তোমাদের মধ্যে সততার সাথে ধন বন্টন করবো, তোমাদেরকে বিপদের মুখে নিক্ষেপ করবো না, বেশীদিন সীমন্ত রাখবো না এবং যুদ্ধের জন্যে বিদেশে থাকাকালে তোমাদের পরিবারবর্গের তত্ত্বাবধান করবো।”
তিনি বলতেন, “আমি আল্লাহর মালকে নিজের পক্ষে ইয়াতিমের মালের সমতুল্য মনে করি। প্রয়োজন না হলে স্পর্শ করবো না আর প্রয়োজন হলে সততার সাথে গ্রহণ করবো।”
একবার তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, “আল্লাহর মাল থেকে আপনি কতটুকু গ্রহণ করা নিজের পক্ষে বৈধ মনে করেন?” তিনি উত্তরে বলেন, “শীত ও গ্রীষ্মের জন্য দু’খানা কাপড়, হজ্জ-ওমরার জন্যে সওয়ারীর জন্তু এবং কোরেশের কোন মাঝারী পরিবারের সমমানের খাদ্য আমার পরিবারবর্গের জন্য। এর পরে আমি সাধারণ মুসলমানের মতই একজন মুসলমান। তারা যা পাবে আমিও তাই পাব।”
সাধারণত তিনি এভাবেই জীবন যাপন করতেন। কিন্তু কখনো কখনো তিনি নিজের জন্য যা বৈধ বলে ঘোষণা করেছেন তার ব্যাপারেও অসাধারণ কঠোরতা প্রয়োগ করতেন। একদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার জন্য মধু ব্যবহার করতে বলা হল।
বাইতুল মালে প্রচুর মধু ছিল। তিনি মিম্বরে আরোহন করে বললেন : “তোমরা অনুমতি দিলে মধু ব্যবহার করতে পারি নইলে এটা আমার জন্য হারাম।” তৎক্ষণাৎ উপস্থিত সবাই অনুমতি দিয়ে দিল।
মুসলমানরা হযরত ওমরের এই কঠোরতা দেখে তাঁর কন্যা উম্মুল মোমিনীন হযরত হাফসা (রাঃ) এর নিকট গিয়ে বললেন, “ওমর (রাঃ) নিজের ব্যাপারে কৃচ্ছতার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। বর্তমান সময়ে আল্লাহ তাআলা স্বচ্ছলতা দান করেছেন। যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ থেকে তাঁর ইচ্ছামত ও প্রয়োজনমত গ্রহণ করা উচিত। মুসলমানদের পক্ষ থেকে তাদের এরূপ করার পূর্ণ অনুমতি রয়েছে।” হযরত হাফসা (রাঃ) যখন হযরত ওমর (রাঃ) কে এ কথা বললেন তখন তিনি জবাব দিলেন, “হাফসা, তুমি তোমার জাতির পক্ষপাতিত্ব করেছ আর নিজের পিতার সাথে অহিতাকাঙ্খী সুলভ আচরণ করেছ। আমার পরিবারভুক্ত লোকদের আমার জান ও মালে অধিকার রয়েছে, কিন্তু আমার ধর্ম ও আমানতদারীতে কোন অধিকার নেই।”
তিনি নিজের ও নিজের প্রজাদের মধ্যে সাম্যের ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব দিতেন। যখন বিখ্যাত আমুর রামাদা’র দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তখন তখন হযরত ওমর (রাঃ) শপথ করেন যে যতদিন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসবে ততদিন তিনি ঘি ও গোশত স্পর্শ করবেন না। তিনি এই প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। ফলে তেল খেতে খেতে তার শরীরের চামড়া শুকিয়ে কালো হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর বাজার দুটো পাত্রে দুধ ও ঘি বিক্রি হতে দেখা গেল। হযরত ওমরের জনৈক ভৃত্য চল্লিশ দিরহাম দ্বারা তা কিনে নিয়ে এল। সে এসে তাকে বললো, এখন আল্লাহ আপনার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করে দিয়েছেন। বাজারে দুধ ও ঘি বিক্রির জন্য এসেছে, আমি তা কিনে নিয়ে এসেছি। কিন্তু যখন তিনি তার দাম জানতে পারলেন তখন বললেন, “খুব চড়া দামে কিনেছ দু’টোই সদকা করে দাও। আমি অপব্যয় করে খাওয়া পছন্দ করি না।” মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। অতপঃর বললেন, “জনগণের যে দুরবস্থা হয় তা যদি আমারও না হয় তাহলে তাদের সমস্যার গুরুত্ব আমি কি করে বুঝবো।”
ওমর (রাঃ) এর মত ছিল যে জিনিস থেকে প্রজারা বঞ্চিত তা থেকে তার নিজেরও বঞ্চিত হওয়া উচিত। যেমন তিনি নিজেই বলেছিলেন, তার মনের কোন কোণেও এরূপ ধারণা বিদ্যমান ছিল না যে, খেলাফতের পদে অভিষিক্ত হয়ে তিনি কোনরূপ বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয়েছেন। তিনি মনে করতেন যে এ ব্যাপারে তিনি যদি সাম্য ও সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হন তাহলে জনগণের আনুগত্য লাভের কোন অধিকারই তার থাকবে না। এ থেকে ইসলামের রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি জানা যায়। তা হচ্ছে এই যে, কোন শাসক আল্লাহর আইন কার্যকর করা এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা সত্ত্বেও নিজের বিচার ফায়সালায় ইনসাফ ও ন্যায়-নীতি রক্ষা না করলে আনুগত্য লাভের যোগ্য হতে পারে না। হযরত ওমর (রাঃ) এর মনে ইসলামের এই মূলনীতি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল ছিল এবং এ সম্পর্কে অনুভুতি সবসময় জাগরূক থাকত।
একবার তিনি এক ব্যক্তির সাথে একটি ঘোড়ার দরদস্তুর করেন। এরপরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্যে সেটায় সওয়ার হয়ে দৌড়াদৌড়ি করেন। ইত্যবসরে ঘোড়া ঠোকর খেয়ে পড়ে যায় এবং আহত হয়। তিনি ঘোড়া ফিরিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু মালিক ঘোড়া ফেরত নিতে অসম্মতি প্রকাশ করলো। শেষ পর্যন্ত উভয়ে মোকদ্দমা নিয়ে বিচারপতি শোরাইহের আদালতে গিয়ে হাজির হলেন। শোরাইহ উভয় পক্ষের বিবৃতি শ্রবণের পর বললেন, “আমিরুল মোমিনীন! আপনি যে জিনিস কিনেছেন তা নিয়ে নিন। নচেৎ ওটা যে অবস্থায় নিয়েছিলেন সে অবস্থায় ফেরত দিন।” ওমর বে-ইখতিয়ার বলে ওঠলেন, “একেই বলে ন্যায় বিচার।” অতঃপর তিনি শোরাইহকে তার ন্যায় বিচারে সন্তুষ্ট হয়ে কুফার বিচারপতি নিযুক্ত করেন।
যখন হযরত ওমরের নীতি নিজের ব্যাপারে এতটাই কঠিন ছিল তখন খলিফার আত্মীয় স্বজন ও অন্যান্য নাগরিকের বেলায় কোন বৈষম্যমূলক আচরণের তো প্রশ্নই ওঠে না। উদাহরণ স্বরূপ, যখন তার পুত্র আব্দুর রহমান মদ পান করেন তখন তার ওপর ইসলামী দন্ড কার্যকর করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ সম্পর্কে তার ঘটনা সর্বজন বিদিত। এমনিভাবে আমর ইবনুল আসের পুত্র জনৈক মিশরীয় বালকের ওপর অত্যাচার করলে তাকে শরীয়তের দন্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হয়।
কর্মচারীদের ব্যাপারে তার নীতি ছিল, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের নিকট যে অতিরিক্ত সম্পদ পাওয়া যেত, সে সম্পর্কে তাদের জবাবদিহী করতে হতো। মুসলমানদের ক্ষতি করে কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঐ সম্পদ সঞ্চিত হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে পুংখানুপুংখরূপে তদন্ত করা হতো। “সম্পদ কিভাবে অর্জিত হলো?” – এটা ছিল একটি মৌলিক প্রশ্ন এবং এ অনুসারে তিনি যখনই কোন কর্মচারীর মধ্যে দুর্নীতির সন্দেহ বোধ করেছেন তখনই কৈফিয়ত তলব করেছেন। মিশরের শাসনকর্তা আমর ইবনুল আসের অর্ধেক সম্পত্তি এই অনুসারেই বাজেয়াপ্ত করে বাইতুল মালে জমা করা হয়। কুফাস্থ প্রতিনিধি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের সাথেও তিনি এ নীতি অবলম্বন করেন। এমনিভাবে বাহরাইনের শাসনকর্তা হযরত আবু হোরাইরার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন।
হযরত ওমরের রাজনীতির সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে এই যে, প্রজার ইসলামের চতুর্সীমার মধ্যে থেকে সরকারের আনুগত্য ও হিত কামনা করবে, আর সরকার করবে ন্যায় বিচার ও সর্বাঙ্গীন জনকল্যাণ। এ জন্যই তিনি তার একজন সাধারণ প্রজার এ উক্তি স্বীকার করেন যে, “যদি তোমার মধ্যে আমরা গোমরাহী দেখি তবে আমরা তরবারী দ্বারা সোজা করে দেব।” অর্থাৎ তিনি মেনে নিলেন যে প্রজাদের শাসকের সমালোচনা ও সংশোধনের অধিকার রয়েছে। একদিন তিনি বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, “তোমাদের জান-মাল ও মান-ইজ্জতের ওপর অযথা হস্তক্ষেপের জন্যে আমি কর্মচারীদেরকে নিয়োগ করিনি। তাদেরকে নিয়োগ করেছি তোমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর বাস্তব শিক্ষাদানের জন্য। যদি কোন কর্মচারী কারও ওপর জুলুম অত্যাচার করে তবে আমি তা কিছুতেই বরদাশ্ত করবো না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তার সম্পর্কে আমার নিকট অভিযোগ আনা উচিত।” এ ভাবে তিনি কর্মচারীদের জন্য তাদের ক্ষমতার সীমারেখা নির্দেশ করেন এবং তা লংঘন করতে নিষেধ করে দেন।
শাসকের এহেন গুরুদায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি খাত্তাবের বংশধরদের মধ্য থেকে দ্বিতীয় কোন খলিফা নির্বাচিত হওয়া পছন্দ করেননি। তিনি সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করে যান যে আব্দুল্লাহকে যেন খলিফা নির্বাচিত করা না হয়। অবশ্য তিনি তাকে পরামর্শ পরিষদে শামিল করেন। এ সময় তিনি যে উক্তি করেন, তা খেলাফত সম্পর্কে তার ধারণার সঠিক প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি বলেন,
“আমরা তোমাদের ওপর কর্তৃত্ব করার আদৌ কোন অভিলাষ পোষণ করি না। আমি নিজেও এটা করে সুখী হইনি। তাই আমার বংশধরের মধ্যে আর কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুক তাও আমি চাই না। এটা যদি সত্যই ভালভাবে সম্পাদিত হয়ে থাকে তাহলে আমরা সকলে তার নায্য অংশ পেয়েছি। অন্যথায় সমগ্র বংশের মধ্যে একলা ওমরের জবাবদিহী করাই যথেষ্ট।”