হযরত ওসমানের শাসন পদ্ধতি
সন্দেহ নেই, শাসন পদ্ধতি সম্পর্কিত এ ধারণা হযরত ওসমানের (রাঃ) আমলে খানিকটা পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। অবশ্য এ পরিবর্তন সত্ত্বেও সেটা সামগ্রিকভাবে ইসলামের আওতাভূক্ত থাকে।
হযরত ওসমান (রাঃ) যখন অশীতিপর বৃদ্ধ তখন তার ওপর খেলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হয়। মারওয়ান তার বার্ধক্যের সুযোগ গ্রহণ করে বহু বিষয়ে ইসলামের পরিপন্থী নীতি অবলম্বন করে। ওদিকে হযরত ওসমানের কোমলচিত্ততা আত্মীয়-স্বজনের প্রতি তার অস্বাভাবিক প্রীতি ও স্নেহ এই দু’টোর কারণে এমন কতিপয় পদক্ষেপ গৃহীত হয় যা সাহাবাদের নিকট বিশেষ আপত্তিজনক বলে মনে হয়। এই পদক্ষেপগুলোর অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর ফলে যে ভয়াবহ গোলযোগ ও বিশৃংখলা দেখা দেয় তা ইসলামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
হযরত ওসমান (রাঃ) এর স্বীয় জামাতা হারেস ইবনে হাকামকে তার বিয়ের দিন বাইতুল মাল থেকে দু’লাখ দিরহাম দান করেন। পরদিন প্রাতে বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষ জায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) বিষন্ন বদনে অশ্রুসজল নয়নে খলিফার নিকট এসে তাকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিতে অনুরোধ করেন। তিনি তার নিকট কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে মুসলমানদের ধনাগার থেকে তার জামাতাকে দান করার কারণেই তিনি ইস্তফা দিতে চান। হযরত ওসমান (রাঃ) বিস্ময়ের সাথে বললেন, “ইবনে আরকাম। আমি আত্মীয় স্বজনের প্রতি সহৃদয় ব্যবহার করেছি এজন্য তুমি কাঁদছো? ইসলামের প্রাণশক্তি সম্পর্কে সুতীব্র অনুভূতির অধিকারী সেই ব্যক্তি এ প্রশ্নের উত্তরে যে জবাব দিলেন তা হলো, “না, আমীরুল মুমিনীন! কথা সেটা নয়, আমি এ চিন্তা করে কাঁদছি যে, আপনি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জীবদ্দশায় মুসলমানদের জন্য যে বিপুল অর্থ দান করতেন তারই প্রতিদান হিসেবে এ অর্থ গ্রহণ করলেন না তো? খোদার শপথ করে বলছি, আপনি তাকে একশো দিরহাম দিলেও তা বেশী হতো। খলিফার আত্মীয়-স্বজনের জন্য একশো দিরহাম ব্যয় করাকেও যার বিবেক সংগত মনে করতো না- সেই ব্যক্তির ওপর হযরত ওসমান ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং বলেন, “ইবনে আরকাম! তুমি চাবি রেখে যাও। আমি অন্য লোক অবশ্যই পাব।”
এই ধরনের দৃষ্টান্ত হযরত ওসমানের মধ্যে বহু দেখা যায়। একবার তিনি জুবায়েরকে ছ’লাখ, তালহাকে দু’লাখ এবং মারওয়ান ইবনে হাকামকে আফ্রিকার এক পঞ্চমাংশ প্রদান করেন। এতে হযরত আলীর নেতৃত্বাধীন সাহাবাদের একটি দল প্রবল আপত্তি তুললে খলিফা জবাব দেন, “আমার অনেক আত্মীয় স্বজন রয়েছে এবং তাদের সাথে আমার সহৃদয় ব্যবহার করা উচিত।” লোকেরা এই জবাবকে আরো আপত্তিকর আখ্যায়িত করে প্রশ্ন করলেন “হযরত আবু বকর ও ওমরের কি আত্মীয়-স্বজন ছিল না?” হযরত ওসমান (রাঃ) জবাব দিলেন, “আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ) আত্মীয়-স্বজনকে বঞ্চিত করে আল্লাহর নিকট উত্তম প্রতিদানের প্রত্যাশা করতেন আর আমি তাদেরকে দান করে পূণ্য অর্জন করতে চাই।” এতে তারা রাগান্বিত হয়ে উঠে চলে এলেন এবং বললেন, “খোদার শপথ! যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সেই দু’জনের নীতিই আমাদের নিকট আপনার নীতির চেয়ে অধিক প্রিয়।”
ধন-সম্পদ ছাড়া পদ ও চাকুরীর অবস্থা ছিল এই যে, ওসমানের (রাঃ) আত্মীয়-স্বজনের ওপর তা বৃষ্টির মত বর্ষিত হয়েছিল। এদেরই অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন হযরত মুয়াবিয়া। ওসমান (রাঃ) মুয়াবিয়ার রাজ্যের সীমা বাড়িয়ে ফিলিস্তিন ও হেমসকেও তার অন্তর্ভুক্ত করে দেন। তাকে সমগ্র সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি বানিয়ে দেন এবং তিনি যাতে সমগ্র আর্থিক ও সামরিক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে হযরত আলীর মোকাবিলায় খেলাফতের দাবীদার হয়ে দাঁড়াতে পারেন সেজন্য তার পথ খোলাসা করে দেন। চাকুরীর সুবিধা লাভকারী এই সব আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রত্যাখ্যাত হাকাম ইবনে আস, তার পুত্র মারওয়ান ইবনুল হাকাম এবং তার দুধভাই আবদুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে আবিচ্ছারাহ অন্যতম ছিলেন। মারওয়ানকে তিনি নিজের প্রধান উজীরের পদে অধিষ্ঠিত করেন।
সাহাবারা এই সব কার্যকলাপের অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ পরিনতির কথা চিন্তা করে বারবার মদিনায় ছুটে আসতেন এবং ইসলামী রীতি-নীতিকে বিকৃতির হাত থেকে এবং খলিফাতুল মুসলেমীনকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা চালাতেন। কিন্তু খলিফার অবস্থা এই যে, বার্ধক্য ও দুর্বলতার দরুন মারওয়ানের ওপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এ কথা ঠিক যে হযরত ওসমান (রাঃ) এর মধ্যে ইসলামী ভাবধারার অবস্থিতি সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ অথবা কোন অভিযোগ আরোপ করার অবকাশ নেই। কিন্তু সংগে সংগে তাঁকে সম্পূর্ণ নির্ভুল বলাও কঠিন। ভুল-ভ্রান্তির কারণ আমাদের মতে মারওয়ানের ওজারত এবং হযরত ওসমানের বার্ধক্যজনিত মানসিক অস্বাভাবিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
একবার জনগণ সমবেত হয়ে হযরত আলীকে হযরত ওসমানের সাথে আলাপ-আলোচনার জন্য প্রেরণ করেন। তিনি গিয়ে বলেনঃ
“আমি জনগণের প্রতিনিধি হয়ে এসেছি। তারা আমার নিকট আপনার সম্পর্কে নানা কথা বলেছে। কিন্তু আমি আপনাকে কি বলব তা বুঝতেই পারছি না। আমি যা জানি তা আপনার অজানা নয়। আপনাকে কোন কথা বুঝানোরও সাধ্য আমার নেই। কেননা আপনি নিজেই সব কিছু বুঝতে পারেন। আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞান আমাদের কারও নেই। ইসলাম সম্পর্কে আপনার আগে আমরা কোন জ্ঞান অর্জন করিনি। এমন কোন তথ্য নেই যা শুধু আমরা জানি এবং আপনার নিকট তা এখন পৌঁছানোর প্রয়োজন হতে পারে। কোন কথাই আপনার কাছ থেকে গোপন করে আমাদেরকে শিখানো হয়নি। আপনি রাসূল (সাঃ) কে দেখেছেন, তাঁর কথা শুনেছেন, তার সাহচর্যে অবস্থান করেছেন এবং তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ) আপনার চাইতে বেশী কল্যাণের নিকটবর্তীয় ছিল না। রক্ত সম্পর্কের দিক দিয়েও যেমন, আবার শ্বশুর জামাতা সম্পর্কেও তেমন- আপনি তাদের উভয়ের চাইতে রাসূলুল্লাহর ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তি। তাদের কেউ এ ব্যাপারে আপনার চাইতে অগ্রগামী ছিল না। সুতরাং নিজের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন। আপনাকে অন্ধকার থেকে আলোকে আনা কিংবা অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের দিকে আনার কোনই প্রয়োজন নেই। সঠিক পথ সম্পূর্ণ উজ্জল ও স্পষ্ট। ইসলামের নিদর্শন সমূহ এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে। ওসমান! জেনে রাখুন! যে ন্যায়পরায়ণ শাসক নিজেও সুপথে থাকে, অপরকেও পরিচালিত করে, সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠিত এবং বেদা’তকে বিলুপ্ত করে- সেই হলো আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম ব্যক্তি। খোদার শপথ! সব কিছুই স্পষ্ট। আল্লাহর নীতি এখনো প্রতিষ্ঠিত এবং তার পতাকা এখনো উড্ডীন। আল্লাহর নিকট সবচাইতে অধম ব্যক্তি হচ্ছে সেই, যে সুন্নাতকে বিলুপ্ত এবং বেদা’তকে প্রচলিত করে। আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, কেয়ামতের দিন জালেম শাসককে অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় হাজির করা হবে। তার ওজর-আপত্তি শ্রবণ করা হবে না এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (তাবারী)
হযরত ওসমান (রাঃ) জবাব দিলেন, “আমি জানি, তুমি যা বলেছ লোকেরাও তাই বলে থাকে। শোন! খোদার শপথ করে বলছি, যদি তোমার স্থলে আমি হতাম তাহলে আমি তোমার নিন্দা বা সমালোচনা করতাম না এবং তোমাকে সমালোচনার মুখে অসহায় ছেড়ে দিতাম না। আমি এ আপত্তি তুলতাম না যে, তুমি আত্নীয়-স্বজনের প্রতি কৃপা প্রদর্শন করলে কেন? গরীব-দুঃখীর সাহায্য করলে কেন? ওমর (রাঃ) যাদেরকে শাসনকর্তা পদে নিয়োগ করতেন- তাদেরকে নিয়োগ করলে কেন? আলী! আমি খোদার শপথ দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কি জান না- মুগিরা ইবনে শো’বা সেই পদে নিযুক্ত আছে।”
তিনি বললেনঃ “হ্যাঁ জানি।”
ওসমানঃ “জান, তাঁকে হযরত ওমর (রাঃ) শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন?”
আলিঃ “হ্যাঁ।”
ওসমানঃ তাহলে আমি যদি আত্মীয়তার জন্য ইবনে আমেরকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করে থাকি তাহলে তোমরা সে জন্য আমাকে সমালোচনা কর কেন?
আলীঃ “আমি আপনাকে আসল ব্যপার বলছি। ওমর (রাঃ) যাকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন, ওমরের জুতা তার মস্তকোপরি থাকতো। তার বিরুদ্ধে টু শব্দটি শুনলেও তৎক্ষণাৎ তাকে হাজির হতে বলতেন এবং তার শেষ মীমাংসা করে তবে ক্ষান্ত হতেন। এই কাজটাই আপনি করেন না। আপনি নিজে দুর্বল হয়ে পরেছেন এবং আত্নীয়-স্বজনের সাথে নম্র ব্যবহার শুরু করেছেন।
ওসমানঃ “আর তোমার আত্মীয়দের সাথেও তো করি।”
আলীঃ “সন্দেহ নেই, তাঁদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ আত্নীয়তা রয়েছে কিন্তু অন্য লোক তাঁদের চেয়ে উত্তম।”
ওসমানঃ “তুমি নিশ্চয় জান, ওমর (রাঃ) তার খেলাফতের গোটা যুগ ধরেই মুয়াবিয়াকে শাসনকর্তা পদে বহাল রাখেন। আমিও তো তাকে শাসনকর্তা হিসাবে বহাল রেখেছি।”
আলীঃ “আমি আপনাকে খোদার শপথ দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, আপনি কি জানেন না যে, ওমরকে গোলাম ‘ইয়ারফা’ যত ভয় করতো, মুয়াবিয়া তার চাইতেও বেশি ভয় করতেন?”
ওসমানঃ “হ্যাঁ”
আলীঃ “কিন্তু এখন অবস্থা এই যে, মুয়াবিয়া আপনার মতামত না নিয়েই সিদ্ধান্ত করতে থাকেন অথচ আপনি তার খবরও রাখেন না। তিনি নিজের হুকুম কে লোকদের মধ্যে ওসমানের হুকুম বলে চালিয়ে দেন। এ সব ব্যাপার আপনার নিকট পৌঁছায়, কিন্তু আপনি মুয়াবিয়ার উক্তির প্রতিবাদ করেন না”।
শেষ পর্যন্ত হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে এক ভায়াবহ অভ্যুত্থান শুরু হলো- এর মধ্যে সত্য ও অসত্য, ভাল ও মন্দ উভয় প্রকারের কার্যকারণ মিশ্রিত ছিল। তবে সামগ্রিকভাবে ব্যাপারটাকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একথা স্বীকার না করে উপায় থাকে না যে, এই অভ্যুত্থান মোটামুটিভাবে ইসলামী ভাবধারার একটি গণবিস্ফোরণ ছিল। অবশ্য এই মত প্রকাশ করার সময় আমরা এ সত্য অগ্রাহ্য করছি না যে, এই বিস্ফোরণের পিছনে অভিশপ্ত ইহুদী সন্ত্রাসবাদী নেতা ইবনে সাবারও গোপন হাত সক্রিয় ছিল।
হযরত ওসমানের ওজর হিসেবে আমরা এ কথা পেশ করতে চাই যে, খেলাফতের দায়িত্ব তার ওপর তার শেষ বয়সে এসে অর্পিত হয়। তিনি ছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধ আর উমাইয়া গোত্রের লোকেরা তাঁকে ঘিরে রেখেছেল। তাঁর অবস্থা সম্পর্কে আলী রা. সবচেয়ে নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি যদি ঘরে বসে থাকি তবে তিনি (ওসমান) বলবেন যে, তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছ- আমার অধিকার ও সম্পর্ক অগ্রাহ্য করেছো। আর যদি তার সাথে আলাপ-আলোচনা করি, তাহলেও তিনি নিজের খেয়াল-খুশি অনুসারেই কাজ করেন। মারওয়ান তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করায়। রাসূলুল্লাহ সা. এর সাহচর্য গ্রহণ করা সত্ত্বেও বার্ধক্যের কারণে তিনি পুরোপুরিভাবে তাদের খপ্পরে পড়ে গেছেন। তারা তাকে যেদিকে ইচ্ছা করে- সেদিকে চালিত করে।’’
বস্তুতঃ তৃতীয় খলিফার বার্ধক্যের সময় এই গতিশীল জীবন ব্যবস্থাটি উমাইয়া চক্রের মুষ্ঠির মধ্যে চলে যাওয়ায় তার অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। কেননা এর বাস্তব রীতি-পদ্ধতিকে এর আদর্শিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখার সময় আর দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হয়নি।
তাঁর দীর্ঘ খেলাফত যুগে উমাইয়া চক্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও শক্তি অত্যন্ত প্রবল ও মজবুত হয়। তারা সিরিয়া ও অন্যান্য দেশে ক্ষমতা সু-সংহত করার সুযোগ লাভ করে। তা ছাড়া হযরত ওসমানের অনুসৃত নীতির স্বাভাবিক ফল হিসেবে সম্পদের কেন্দ্রায়ন অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। ফলে তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান মুসলিম উম্মাতের ভিত্তিকে ইসলামের প্রাথমিক যুগেই দুর্বল করে দেয়।
এ যুগের ইতিহাস একদিকে সত্য দ্বীনের কতিপয় দুর্লভ গুণাগুণের স্বাক্ষর বহন করে। অপরদিকে তার পাশাপাশি সমাজ, রাষ্ট্র এবং শাসক ও শাসিতের অধিকার সম্পর্কে এক প্রবল চিন্তাগত বিপ্লবেরও নিদর্শন বহন করে। অবশ্য যে গোলযোগের সৃষ্টি হয় তার বিপজ্জনক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবও কম গুরুতর নয়।
হজরত ওসমানের পর
হজরত ওসমারন রা. যখন ইন্তেকাল করেন তখন কার্যতঃ উমাইয়া রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। খলিফা নিজেই তাদেরকে এ সুযোগ সরবরাহ করেন। সারাদেশে বিশেষতঃ সিরিয়ায় তারা নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ এবং অন্যান্য যাবতীয় সম্পদকে তারা নিজেদের কুক্ষিগত করে। তারা সৌভ্রাতৃত্ব, অপরের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দান, সামাজিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান প্রভৃতি কাজকে উপেক্ষা করতে থাকে। আর এ সবই হজরত ওসমানের খেলাফতের ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত হতে থাকে। এর কারণে মুসলিম জাতির মধ্যে ইসলামের প্রণশক্তি ও ভাবধারা অত্যন্ত দুর্বল ও ম্লান হয়ে পড়ে।
খলিফার কতিপয় পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ জনগণের মনে কখনো স্বাভাবিকভাবে আর কখনো অযৌক্তিকভাবে এক তীব্র ও তিক্ত ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। মুসলমানরা অভিযোগ মুখর হয়ে ওঠে যে, খলিফা নিজের আত্মীয়-স্বজনের সংগে বৈষম্যমূলক আচরণ করেন এবং তাদের লাখ লাখ দিরহাম উপঢৌকন দেন। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দুশমনদেরকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করার জন্য তাঁর প্রিয় সাহাবীদেরকে অপসারিত করেন এবং আবু জরের রা. মত উন্নত চরিত্রের সাহাবীর ওপর শুধু এ জন্য নির্যাতন চালান যে, তিনি সম্পদের কেন্দ্রায়ন ও উঁচু তলার লোকদের বিলাসিতা ও আমোদ-প্রমোদের বাড়াবাড়ির বিরোধিতা করেছিলেন। আবু জর রা. দানশীলতা ও সৎপথে ব্যয়ের প্রচলন এবং শালীনতা ও পবিত্রতার পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এ সব কার্যকলাপ মুসলমানদেরকে মর্মাহত ও বিচলিত করে তোলে। এ ধরণের প্রবণতা যখন ব্যাপকভঅবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন কিছু লোকের মধ্যে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে আবার কিছু লোকের মধ্যে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়। যাদের মনে ইসলামী আদর্শ বদ্ধমূল ছিল তাঁরা এ সব কার্যকলাপ দেখে নীরবতা অবলম্বন করাকে পাপ মনে করতে থাকেন। তাঁদের মনে সৃষ্ট এ ভাবধারা তাঁদেরকে বিদ্রোহ প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। আর যারা ইসলামকে শুধু লেবেল হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের পার্থিব লোভ লালসা তাদের আত্মকেন্দ্রিক করে রাখে, যারা সব সময় বাতাসের দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের লক্ষ্য পরিবর্তন করেন, তাদের চরিত্র উচ্ছৃংখল এবং দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে। এহেন পরিস্থিতিই হজরত ওসমানের খেলাফতের অবসান ঘটায়।
হজরত আলী রা. যখন খেলাফতের মসনদে আসীন হলেন, তখন পরিস্থিতি আয়ত্বে আনা সহজসাধ্য ছিল না। ওসমানের রা. যুগে যারা অবৈধ মুনাফাখোরীতের লিপ্ত ছিল বিশেষতঃ বনু উমাইয়া ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে হজরত আলী রা. তাদের ব্যাপারে নীরব থাকবেন না। এ সব চিন্তা করে তারা নিজ নিজ কল্যাণের খাতিরে মুয়াবিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
হজরত আলী রা. এই লক্ষ্য নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন যে তিনি জনগণ ও সরকারকে পুনরায় ইসলামের আসল রাজনৈতিক আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত করবেন। তাঁর অবস্থা ছিল এই যে, তাঁর স্ত্রী স্ব-হস্তে গম পিষতেন এবং তা-ই তিনি আহার করতেন। একবার তিনি নিজের এক বস্তা গমের ওপর বায়তুল মালে জমা দেয়ার উদ্দেশ্যে সরকারী সিল মোহর অংকিত করছিলেন। বললেন, ‘‘আমি নিজের পেটে শুধু তাই প্রবেশ করাতে চাই যার হালাল হওয়া সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।’’ কখনো কখনো এমন অবস্থা হয়েছে যে, তাঁকে খাদ্য বস্ত্র খরিদ করার জন্য নিজের তরবারী পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। কুফায় তিনি শ্বেত–প্রসাদে অবস্থান করতেন, তিনি কি ধরণের জীবন যাপন করতেন সে সম্পর্কে নজরে ইবনে মানসুরের বর্ণনা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেনঃ
‘‘আমি হজরত আলীর নিকট গিয়ে দেখি, তাঁর সামনে দুর্গন্ধযুক্ত টক দুধ এবং শুকনো রুটি রয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমিরুল মু’মিনীন! আপনি কি এসব জিনিস খান?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. এর চেয়ে শুকনো রুটি এবং মোটা কাপড় পরিধান করতেন। আমি যদি তাঁর নীতি অনুসরণ করে না চলি তাহলে আমার আশংকা হয় যে, হয়তো রাসূলুল্লাহর সা. সংগী হতে পারবো না।’’
এমনিভাবে হারুন ইবনে আনতারা বর্ণনা করেছেন যে, আমি খাওরানাক নামক স্থানে হজরত আলীর সাথে সাক্ষাত করতে যাই। তখন ছিল শীতকাল। হজরত আলীর রা. গায়ে একটা ছিন্ন পুরনো চাদর ছিল এবং তিনি থরথর করে কাঁপছিলেন। আমি বললাম, ‘‘আমিরুল মি’মিনীন! আপনার ও আপনার পরিবার পরিজনের জন্য এই সম্পদে আল্লাহ কিছু অধিকার নির্ধারিত করেছের। তা সত্ত্বেও আপনি নিজের প্রতি এরূপ কঠোর আচরণ করছেন।’’ আলী রা. বললেন, ‘‘খোদার শপথ! আমি তোমাদের হক নষ্ট করব না। এটা আমার সেই চাদর যা আমি মদিনা থেকে এনেছিলাম।’’
অবশ্য হজরত আলী রা. নিজের ও নিজের পরিবার বর্গের ব্যাপারে এরূপ নীতি অবলম্বন করার সময় এ কথা নিশ্চয়ই জানতেন যে, ইসলাম তাকে এর চেয়ে অনেক বেশী গ্রহণের অনুমতি দেয়। ইসলাম কাউকে সর্ব রকমের আরাম-আয়েশ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে নিতান্ত সংসার বিরাগীর মত জীবন যাপন করতে বাধ্য করে না। তিনি জানতেন যে, তখনো একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বাইতুল মালের ধন-সম্পদে তার যা প্রাপ্য ছিল তার চাইতে তিনি অনেক কম গ্রহণ করছিলেন। তা ছাড়া জনগণের কাজে সর্বক্ষণ নিয়োজিত শাসক হিসেবে তার প্রাপ্য আরো বেশী ছিল। তিনি ইচ্ছা করলে অন্ততঃ হজরত ওমর রা. বিভিন্ন দেশের শাসন কর্তাদের যেরূপ বেতন নির্ধারণ করতেন সেই পরিমাণ বেতন গ্রহণ করতে পারতেন। হজরত ওমর রা. কুফার শাসনকর্তা আম্মার ইবনে ইয়াসার এবং তার সহকারীদের জন্য মাসিক ছ’শ দিরহাম বেতন নির্ধারণ করেছিলেন। আর সাধারণ লোকদের মত যে সব দানের অংশ পেতেন সেটা এ থেকে স্বতন্ত্র। তাছাড়া তিনি দৈনিক একটি ছাগলের অর্ধাংশ ও আধা বস্তা আটা পেতেন। এমনিভাবে কুফার জনগণকে ইসলামের শিক্ষাদানের এবং বাইতুল মালের দেখাশুনার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কে নিয়োগ করেন এবং তাঁর জন্য মাসিক একশো দিরহাম এবং দৈনিক একটি ছাগলের এক চতুর্থাংশ নির্ধারণ করেন। ওসমান ইবনে হানিফের জন্য বাৎসরিক পাঁচ হাজার দিরহাম বৃত্তি, দৈনিক একটি ছাগলের এক চতুর্থাংশ ও মাসিক দেড়শো দিরহাম বেতন নির্ধারণ করেন।
হজরত আলী রা. নিজের জন্য যে কঠিন পথ অবলম্বন করেন, তা এ সব ব্যাপার না জেনে করেননি। তিনি যে দৃষ্টিভংগী অনুসারে এ নীতি অবলম্বন করেন তা হচ্ছে এই যে, শাসক সব সময়ই জনসাধারণের জন্য আদর্শ স্থানীয় হয়ে থাকে এবং তার ওপর সন্দেহের প্রচুর অবকাশ থাকে। যেহেতু সরকারী কোষাগার তার অধীন থাকে, তাই আত্মসাতের সন্দেহও সৃষ্টি হতে পারে। সেটা জনসাধারণ ও নিজের অধীনস্থ রাজ-কর্মচারীদের জন্য সততা ও সংযমের আদর্শ হয়ে থাকে। এ কারণে তিনি নিজেকে হজরত আবু বকর ও ওমরের রা. সংযমের নীতির অনুসারী করে তোলেন। যে সব ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তাদের জন্য এই উন্নত মাপকাঠিই সর্বাপেক্ষা সংগত ছিল।
হজরত আলী রা. গোটা রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে নবী সা. ও তার পরবর্তী খলিফাদ্বয়ের আদর্শের অনুসারী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
একবার তিনি স্বীয় বর্ম জনৈক খৃস্টানের নিকটে পেয়ে তাকে ধরে নিয়ে বিচারপতি শোরাইহের নিকট গিয়ে উপস্থিত হন এবং একজন সাধারণ নাগরিকের মত তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তিনি দাবী করেন যে, ওই বর্ম তার। শোরাইহ খৃস্টানকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমিরুল মু’মিনীনের দাবী সম্পর্কে তার বক্তব্য কী? খৃস্টান বললো, ‘বর্ম নিশ্চয়ই আমার, তবে আমিরুল মু’মিনীনকেও আমি মিথ্যুক বলতে চাই না।’’ শোরাইহ বললেন, ‘‘আমিরুল মু’মিনীন! আপনার নিকট কোন প্রমাণ আছে কী?’’ হজরত আলী রা. হেসে বললেন, ‘‘আমার কাছে প্রমাণ নেই।’’ শোরাইহ রায় দিলেন যে, বর্ম খ্রীস্টানকে দিতে হবে। সে বর্ম নিয়ে রওয়ানা দিল আর আমিরুল মু’মিনীন অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকলেন। কয়েক পা গিয়ে সে ফিরে এল এবং বলতে লাগলো ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, যে ধর্মের খলিফা স্বয়ং আমাকে বিচারকের নিকট পেশ করে এবং বিচারক তার বিরুদ্ধে রায় দেন; নিঃসন্দেহে তা সত্য ধর্ম।’’ এ বলেই সে কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করলো। অতঃপর সে বললো, ‘‘আমিরুল মু’মিনীন! খোদার শপথ করে বলছি, এ বর্ম আপনার। আপনি যখন সিফ্ফিন অভিমুখে যাত্রা করেন তখন আমি সেনাবাহিনীর পেছনে পেছনে চলছিলাম। এ বর্ম আপনার বাদামী রং-এর উটের ওপর থেকে পড়ে গেছে।’’ হজরত আলী রা. বললেন, ‘‘তুমি যখন ঈমান এনেছ তখন এটা তোমাকেই উপহার দিলাম।’’ (আবকারিয়া ইমাম– উস্তাদ আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ)
তিনি যে শাসন পদ্ধতি অনুসরণ করেন তার রূপরেখা তিনি তার অভিষেক অনুষ্ঠানের ভাষণেই নির্দেশ করেনঃ
‘‘ভাইসব! আমি তোমাদেরই মত একজন মানুষ। তোমাদের যা অধিকার আমারও তাই। তোমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয় তা আমার ওপরও অর্পিত হয়। আমি তোমাদের নবীর নীতি অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করবো এবং তারই আইন চালু করবে। শোনো! ওসমান রা. যাকে যত জায়গা-জমি এবং আল্লাহর ধন থেকে যাকে যা কিছু দিয়েছেন তা বাইতুল মালে ফেরত নেয়া হবে। কেননা, বাস্তবকে কোন জিনিস পরিবর্তিত করতে পারে না। এমনকি যদি আমি দেখি যে, এই রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিয়ে কিংবা বাঁদী খরিদ করার কাজে ব্যয়িত হয়েছে অথবা তা বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তবুও আমি তা ফেরত আনবো। কারণ, ন্যায়-নীতি যার পক্ষে দুঃসহ হবে, জুলুম ও অত্যাচার তার পক্ষে আরো বেশী দুঃসহ হবে।’’
‘‘ভাইসব! হুশিয়ার হয়ে যাও! কিছুদিন আগে যাদের ওপর দুনিয়ার স্বার্থ প্রবল হয়ে পড়েছিল এবং তারা বড় বড় দালান-কোঠা, উট-ঘোড়া, দাস-দাসী ও চাকর-নফরের মালিক হয়েছিল- তাদেরকে যখন আমি এই সব কিছু থেকে বঞ্চিত করবো এবং তাদের আসল অধিকারের আওতায় ফিরিয়ে আনবো- তখন যেন তারা বলতে আরম্ভ না করে থাকে যে, আবু তালেবের বেটা আমাদেরকে আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। জেনে রাখ! রাসূলুল্লাহর সাহাবী, মুহাজের ও আনসারদের মধ্য থেকে কেউ যদি এরূপ মনে করে যে, রাসূলুল্লাহ সা. এর নৈকট্য ও সাহচর্য লাভের দরুণ অন্যান্যদের ওপর তার অগ্রাধিকার ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে তাহলে তার জানা উচিত যে, এই শ্রেষ্ঠত্ব ও অগ্রাধিকারের স্বীকৃতি শুধু আল্লাহর নিকট পাওয়া যাবে এবং সেখানেই এর উপযুক্ত প্রতিদান পাওয়া যাবে। জেনে রাখ! যে ব্যক্তি খোদা ও রাসূলের দাওয়াতে সাড়া দেবে, আমাদের জাতীয়তাকে গ্রহণ করবে, আমাদের সত্য দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করবে এবং আমাদের কেবলামুখী হবে, সে ইসলামের দেয়া যাবতীয় অধিকার লাভ করবে এবং তার নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধ্য হবে। তোমরা সকলে আল্লাহর দাস এবং এ সম্পদ আল্লাহর সম্পদ। এটা তোমাদের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করা হবে। এ ব্যাপারে কাউকে কারো ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হবে না। খোদাভীরু লোকদের জন্য আল্লাহর নিকট উত্তম প্রতিদান রয়েছে।’’
মুনাফাখোর, বৈষম্যপ্রিয়, স্বার্থান্বেষী ও সুবিধাবাদী মহল হযরত আলীর সমবণ্টন নীতিতে খুশী হতে পারেনি এবং তা না হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। তাই এই মেহল শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী উমাইয়া শিবিরে গিয়ে মিলিত হয়। এই শিবিরে গিয়ে তারা ইনসাফ ও ন্যায়-নীতি জলাঞ্জলী দিয়ে নিজেদের তুচ্ছ স্বার্থের শেষ রক্ষা করতে তৎপর হয়ে উঠে।
যাদের দৃষ্টিতে মুয়াবিয়ার মধ্যে হযরত আলীর চাইতে বেশী চাতুর্য, বিচক্ষণতা, সতর্কতা ও দ্ক্ষতা ধরা পড়ে এবং যারা এই কারণে শেষ পর্যন্ত মুয়াবিয়া বিজয়ী হয়েছেন বলে মনে করেন, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ভুল করেন এবং হযরত আলীর প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ ও তার আসল কর্তব্য পালন সম্পর্কে সঠিক মতামত স্থাপনে ব্যর্থ হন। হযরত আলীর সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ কর্তব্য ছিল ইসলামী ঐতিহ্যকে তার প্রকৃত শক্তিতে পুনর্বহাল করা এবং সত্য দ্বীনের নির্জীব-প্রায় দেহে পুনরায় জীবনীশক্তির সঞ্চার করা। হযরত ওসমানের রা. দুর্বলতা ও বার্ধক্যের সুযোগে উমাইয়া বংশীয় কু-চক্রীদের যে মলীনতা ও কদর্যতা ইসলামের প্রাণশক্তিকে কলুষিত করে তোলে তা থেকে তাকে মুক্ত করাই ছিল হযরত আলীর অন্যতম মিশন।
এই মিশন সফল করার সংগ্রামে তিনি যদি মুয়াবিয়ার রা. মত কর্মপন্থা গ্রহণ করতেন তাহলে তাঁর মিশনই ব্যর্থ হয়ে যেত। এর অর্থ এই দাঁড়াতো যে, তিনি খেলাফত অর্জনের সংগ্রাম শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য করেছেন। এরূপ হলে তাঁর সংগ্রামের কোন মূল্যই থাকতো না। আলী ‘আলী’ হয়েই থাকতে হবে, নচেৎ ‘খেলাফত এবং সেই সাথে তার প্রাণও যদি তার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় তাহলে তার আপত্তি নেই’- এই ছিল হযরত আলী রা. এর সংকল্প। এ সংকল্প তার মন থেকে এক মুহূর্তের জন্য স্থলিত হতো না। এক বর্ণনা অনুসারে (অবশ্য যদি এটা সত্য হয়) হযরত আলী রা. বলতেন, ‘‘খোদার শপথ, মুয়াবিয়া আমার চাইতে ধূর্ত নয়, কিন্তু সে ধোকাবাজ। সে প্রকাশ্যে নাফরমানি করে। আমি যদি ধোঁকা ও প্রতারণা পছন্দ করতাম তাহলে আমি সবচাইতে ধূর্ত হতাম।’’
হযরত আলীর ইন্তেকালের পর বনু উমাইয়ার যুগ আসে। উমাইয়াদের সামনে হযরত ওসমানের রা. ঈমান, তার খোদাভীরুতা এবং তার হৃদয়ের কোমলতা একটা প্রতিবন্ধক স্বরূপ ছিল। কিন্ত সেটা তো আগেই অপসারিত হয়েছিল। এবার হযরত আলীর ইন্তিকালে সর্বশেষ বাধাও দূর হয়ে গেল এবং উচ্ছৃংখলতার পথ উন্মুক্ত হলো।
এরপরও ইসলাম পৃথিবীতে সম্প্রসারিত হতে থাকে। কিন্তু ইসলামের প্রাণশক্তি যে মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল সে ব্যাপারে কো দ্বি-মতের অবকাশ নেই। যদি স্বয়ং ইসলামের প্রকৃতিতে একটি প্রবল শক্তি লুকানো না থাকতো এবং তার আধ্যাত্মিক শক্তিতে গতিশীলতার যোগ্যতা না থাকতো তাহলে উমাইয়া যুগই তাকে তার আসল পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তার প্রাণশক্তি অবিরাম সংগ্রাম করতে এবং শক্তি অর্জন করতে থাকে। আজও তার মধ্যে সংগ্রামের ও বিজয়ের গোপন শক্তি নিহিত রয়েছে।
উমাইয়া যুগ থেকে মুসলমানদের কোষাগার অতিমাত্রায় উদার হয়ে পড়ে এবং তা বদাশাহ, তাদের চাটুকার ও তল্পিবাহীদের লুটের মালে পরিণত হয়। ইসলামী সুবিচার-ন্যায়নীতির ভিত্তি ধ্বসে পড়ে। শাসকরা বিশেষ সুবিধাভোগী আর তাদের চাটুকাররা উপঢৌকন-ভোগীতে পরিণত হয়। মোটকথা খেলাফত রূপান্তরিত হয় রাজতন্ত্রে, আর তাও নিকৃষ্টতম স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে। এই স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কেই রাসূলুল্লাহ সা. ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন। এর পরিণতি দাঁড়ালো এই যে, আমাদের গায়ক কবি ও চাটুকারদেরকে পুরস্কার দেয়ার বহু কাহিনী শ্রবণ করতে হলো। মাবাদ নামক কবিকে জনৈক উমাইয়া বাদশাহ ১২ হাজার দিনার পুরস্কার দেন এবং আব্বাসী বাদশাহ হারুনুর রশীদ ইসমাইল ইবনে জামে নামক গায়ককে শুধুমাত্র একটি গানের জন্য চার হাজার দিনার দান করেন, সেই সাথে একটা সুন্দর কারুকার্য খচিত মনোরম বাড়ীও দেন। কালের স্রোতধারা এভাবেই চলতে থাকে। কখনো অল্প সময়ের জন্যে এতে বিরতি দেখা দেয়, অতঃপর আবার পূর্ণ গতিবেগে ছুটে চলে।