অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
স্বর্ণযুগে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীন ছিল। শাসকবৃন্দ শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে যেরূপ ধারণা পোষণ করতেন এবং শাসক ও শাসিতের অধিকার সম্পর্কে যে ধরণের চিন্তা করতেন, তাদের অর্থনীতিও সেই ধরণের ছিল। হযরত মুহাম্মাদ সা., হযরত আবু বকর রা., হযরত ওমর রা. এবং হযরত আলী রা. এর যুগে ইসলামী আদর্শ সক্রিয় ছিল অর্থাৎ এই নীতি প্রচলিত ছিল যে, সরকারী অর্থ-সম্পদ সবই জাতির এবং জনতার সম্পদ। শাসক তা থেকে কেবলমাত্র নিজের অথবা নিজের আত্মীয়-স্বজনের অধিকার প্রমাণ করেই কিছু গ্রহণ করতে পারে। এমনিভাবে শাসক প্রত্যেক ব্যক্তিকে কেবলমাত্র তার সত্যিকার প্রাপ্য যতটুকু ততটুকুই দিতে বাধ্য। কেননা এ ব্যাপারে শাসক ও অন্যান্যরা সমান। হযরত ওসমান রা.-এর যুগে এ নীতিতে সামান্য বিকৃতি দেখা দিয়েছিল, তখনও জনগণ নিজেদের পূর্ণ অধিকার অর্জন করতো। তবে সম্ভবতঃ সম্পদের প্রাচুর্যের দরুণ লোকদের নির্ধারিত বৃত্তি ইত্যাদি দেয়ার পরেও বিপুল অর্থ বেঁচে থাকতো। খলিফার ধারণা ছিল এই যে, নিজ আত্মীয়-স্বজন ও তার ইচ্ছানুযায়ী অন্যান্য লোকদের দান করার তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এরপর যখন শাসন ক্ষমতা চলে গেল স্বৈরাচারী শাসকদের হাতে, তখন সমস্ত বিধি-নিষেধ অপসারিত হলো এবং শাসকরা জনগণকে দান কিংবা বঞ্চনার হিড়িক চলতে থাকলো। মুসলমানদের সম্পদে শাসকদের, তাদের সন্তান-সন্ততির, তাদের তল্পিবাহী ও চাটুকারদের জন্য অবাধ ভোগের দ্বার উন্মুক্ত হলো। তারা এ ব্যাপারে ইসলামের সমস্ত সীমরেখা অতিক্রম করে চলতে থাকলো।
এ হলো পরিস্থিতির একটা মোটামুটি বিবরণ। এবারে আমরা কয়েকটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তের মাধ্যমে এর বিস্তারিত বিবরণ পেশ করবো।
রাসূলুল্লাহ সা. এর যুগ থেকে বাইতুল মালের আয়ের যে সব পন্থা চলে আসছিল তা হচ্ছেঃ
প্রথমতঃ যাকাত– এটা মুসলমানদের বিভিন্ন রকমের সম্পদের ওপর ধার্য করা হয়। যেমনঃ স্বর্ণ, রৌপ্য, কৃষি উৎপাদন, ফলমূল, গবাদিপশু, বাণিজ্য পণ্য, খনিজ ও প্রোথিত ধন প্রভৃতি। সাধারণভাবে যাকাতের গড় হার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ। এটা ৮টি প্রসিদ্ধ খাতে ব্যয় করা হয়।
দ্বিতীয়তঃ জিজিয়া– এটা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিমদের বসবাসের জন্য রাষ্ট্রকে প্রদত্ত কর বিশেষ। এটা মুসলমানদের যাকাত এবং কায়িক ত্যাগ কুরবানীর সমপর্যায়ভুক্ত।
তৃতীয়তঃ ‘ফায়’- এটা হচ্ছে সেই অর্থ-সম্পদ যা মোশরেকদের নিকট থেকে যুদ্ধ ছাড়াই আদৌ পরিশ্রম না করেই পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট বিধান অনুসারে এই অর্থ সম্পদের সমগ্রটাই আল্লাহ, তাঁর রাসূল, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন ও প্রবাসীদের প্রাপ্য।
চতুর্থতঃ গণিমতের মাল বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ– এর চার পঞ্চমাংশ যোদ্ধাদের আর বাকীটুকু ‘ফায়’-এর অনুরূপ এবং ঐ সব খাতেই ব্যয়িত হবে।
অথবা, গণিমতের স্থলে ‘খারাজ’- মোশরেকদের যে সব জমি যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের হস্তগত হয়; যেমন হযরত ওমর রা. পারস্যের জমির ব্যাপারে করেছিলেন- সেই সব জমির ওপর ধার্যকৃত কর বিশেষ।
রাসূলুল্লাহ সা. এর যুগে বাইতুল মালের আয় পর্যাপ্ত ছিল না। মুহাজেররা নিজেদের ঘরবাড়ী ত্যাগ করে মদিনায় এসেছিলেন এবং আনসারগণ তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে নিজেদের ধন সম্পত্তিতে অংশীদার করে ভাই বানিয়ে নিয়েছিলেন। এ সময়ে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল সীমাবদ্ধ। যুদ্ধের আগে মুসলমানদের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল ইচ্ছাকৃত দান।
যখন যুদ্ধাভিযানের ধারাবাহিকতা শুরু হলো এবং হিজরতের দ্বিতীয় বছর যাকাত ফরজ হলো তখন আসল আয়ের উৎস অর্থাৎ যাকাতের সাথে আরেকটা উৎস গণিমতের মাল যুক্ত হলো। এর এক পঞ্চমাংশ দেয়া হতো যোদ্ধাদেরকে। রাসূলুল্লাহ সা. পদাতিককে একাংশ এবং অশ্বারোহীকে দুই অংশ অন্য এক রেওয়ায়েত তিন অংশ দিতেন। এভাবে তিনি এই নীতি নির্ধারিত করে দিলেন যে, ‘‘প্রত্যেকের অংশ তার ত্যাগ ও কুরবানী অনুপাতে।’’ তিনি অবিবাহিতকে একাংশ এবং বিবাহিতকে দুই অংশ দিতেন। এমনিভাবে তিনি দ্বিতীয় নীতি এই নির্ধারণ করেন যে, ‘‘প্রত্যেকের অংশ তার প্রয়োজন অনুপাতে।’’ গণিমতের অবশিষ্ট এক পঞ্চমাংশ ব্যায়ের খাত ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
অতঃপর একটা নতুন ব্যাপার ঘটলো। বনু নজীর অভিযানে প্রথম বারের মত ‘ফায়’ অর্জিত হলো। এটিকে রাসূলুল্লাহ সা. মুহাজেরদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেন। আনসারদের মধ্য থেকে মাত্র দু’জন দরিদ্র ব্যক্তিকে এ থেকে অংশ দেয়া হয়। এরপর কোরআনের এক আয়াতে এই মূলনীতি ঘোষণা করা হয় যে,
‘তোমাদের ধনিকদের মধ্যে যেন সম্পদের আবর্তন সীমিত হয়ে না থাকে।’
অপ্রতিহত গতিতে দেশ জয় ও ইসলামী সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের সাথে সাথে বাইতুল মালের আয় বর্ধিত হতে থাকে। সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যে মুসলমানগণ ক্রমশঃ আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে থাকে। কারণ ইসলামের নির্ধারিত অংশ অনুসারে তারা সকলেই বাইতুল মালের অর্থের সমান অংশীদার।
যখন রাসূলুল্লাহ সা. ইন্তেকাল করেন এবং কিছু লোক ইসলাম-ত্যাগী হয়ে যাকাত দিতে অস্বীকার করে, তখন আবু বকর রা. যে ভূমিকা গ্রহণ করেন তা ইতিহাসের অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তিনি বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা করেনঃ
‘‘খোদার শপথ! (যাকাতের) উট ও অন্যান্য গবাদি পশু বাঁধার এক গাছি রশিও যদি তারা দিতে অস্বীকার করে তবে আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো।’’ এ ব্যাপারে তিনি হযরত ওমর ইবনে খাত্তাবের অভিমতের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পরে হযরত ওমরও হযরত আবু বকরের অভিমত সমর্থন করেন ও নিশ্চিন্ত মনে গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রথমদিকে তার মত ছিল এই যে, তারা ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ (আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই) স্বীকার করে বলে তাদের সাথে যুদ্ধ করা ঠিক নয়। তার মতভেদ এতটা তীব্র ছিল যে, তিনি খানিকটা চড়া স্বরে বলে ওঠেন, ‘‘আমরা তাদের বিরুদ্ধে কি করে অস্ত্র ধারণ করি’’ যখন রাসূলুল্লাহ সা. বলে গেছেনঃ
‘‘মানুষ যতক্ষণ না বলবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ‘ইলাহ’ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহ রাসূল, ততক্ষণ আমাকে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি এটা বলবে, তার ধন ও প্রাণ আমার থেকে নিরাপদ থাকবে। অবশ্য ইসলামী বিধান অনুসারে তাতে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন হলে সে কথা স্বতন্ত্র। সে ক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর আয়ত্তাধীন।’’ এতে হযরত আবু বকর রা. পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে জবাব দিলেন যে, ‘‘খোদার শপথ! যে ব্যক্তি নামায ও যাকাতে প্রভেদ করবে আমি তার সাথে যদ্ধ করবো। কেননা যাকাত হলো ধন-সম্পদের ওপর ধার্য অধিকার বিশেষ।’’ সংগে সংগে হযরত ওমর রা. বলে উঠলেন, ‘‘খোদার শপথ! আমি অনুভব করতে পেরেছি যে, আল্লাহ আবু বকরের বক্ষকে যুদ্ধের জন্য উন্মোচিত করে দিয়েছেন। এখন আমিও বুঝতে পেরেছি যে, এটাই সঠিক পন্থা।
এই মহান যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তিনি ইতিহাসে ইসলামের একটি মূলনীতিকে কার্যকরী করে দেখিয়ে দিলেন। তিনি সপ্রমাণ করলেন যে, আল্লাহ ধন-সম্পদে সমাজের জন্য যে হারে ও যে নিয়মে অধিকার নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তা আদায় করার জন্য যুদ্ধ করাও ন্যায়সংগত।
হযরত আবু বকর রা. যাকাত, গণিমত ও ‘ফায়’ প্রভৃতির তহবিল নির্ধারিত খাতে ব্যায় করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা. এর পদানুসরণ করতে থাকেন। তিনি নিজেদের জন্য মুসলমান জনসাধারণের নির্ধারিত মামুলী বৃত্তি গ্রহণ করতেন আর সেটা ছিল দৈনিক মাত্র দুই দিরহাম। এর পর তিনি জনগণকে নির্ধারিত বৃত্তি প্রদান করতেন। অতঃপর অবশিষ্ট অর্থ তিনি সামরিক খাতে ব্যয় করতেন।
হযরত আবু বকরের যুগে অপর একটি ব্যাপারেও হযরত ওমরের সাথে তাঁর মতভেদ ঘটে। হযরত আবু বকরের অভিমত ছিল, ধন বণ্টনের ব্যাপারে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী এবং পরবর্তী যুগে ইসলাম গ্রহণকারী, স্বাধীন ও গোলাম, নারী ও পুরুষ সকলকে সমান অংশ দেওয়া উচিত। কিন্তু হযরত ওমর রা. ও সাহাবাদের একটি দল ইসলামের প্রতি প্রথম অগ্রসর ব্যক্তিদের পর্যায়ক্রমে অগ্রগণ্য বলে স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। হযরত আবু বকর রা. তাদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘‘তোমরা যে শ্রেষ্ঠত্ব ও অগ্রাধিকারের কথা বলছ, সে সম্পর্কে আমি উত্তম রূপে ওয়াকিবহাল। কিন্তু আসলে ওটা এমন একটা ব্যাপার, যার সওয়াব আল্লাহ তায়ালা আখেরাতে প্রদান করবেন। পক্ষান্তরে এটা হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যাপার। এখানে অগ্রাধিকারের চাইতে সমাধিকারের নীতিই উত্তম।’’
বস্তুতঃ এই সমাধিকারের নীতি অনুসরণই অব্যাহত থাকে এবং আয়ের পরিমাণ ক্রমশঃ যতই বাড়তে থাকে ততই সমান হারে মুসলমানদেরকে স্বচ্ছলতা ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে থাকে। অবশেষে ওমর ইবনে খাত্তাবের রা. যুগ এলো। তিনি তখনো একই অভিমত পোষণ করতেন। তিনি বলতেন, ‘‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর সা. বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাকে আমি রাসূলুল্লাহর সা. পক্ষে যুদ্ধকারীর সম-মর্যাদা দিতে পারি না।’’
একদিন বাহরাইনের শাসনকর্তা আবু হোরাইরা রা. বহু অর্থ-সম্পদ নিয়ে খলিফার দরবারে উপনীত হন। তাঁর ভাষায়, ‘‘পাঁচ লাখ দিরহাম নিয়ে আমি সন্ধ্যা বেলায় ওমরের সাথে সাক্ষাত করি। আমি বললাম, ‘আমিরুল মু’মিনীন! এই নিন টাকা।’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কত টাকা?’ আমি বললাম, ‘পাঁচ লাখ দিরহাম।’ তিনি বললেন, ‘জান, পাঁচ লাখে কত হয়।’ আমি বললাম, ‘জি হাঁ, পাঁচশো হাজার।’ কিন্ত তিনি বিশ্বাস করতে চাইলেন না। বললেন, ‘মনে হচ্ছে তোমার মস্তিষ্ক সুস্থ নয়। যাও রাত্রে আরাম কর গিয়ে। সকালে এস।’ আমি সারারাত বিশ্রাম করে ভোরে আবার এসে বললাম, ‘আমিরুল মু’মিনীন! টাকা নিন।’ তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ টাকা ন্যায়সঙ্গত পন্থায় অর্জিত হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘যতদূর আমার জানা আছে, ন্যায়সঙ্গত পন্থায়ই অর্জিত হয়েছে।’ তখন হজরত ওমর রা. উপস্থিত লোকদেরকে সম্বোধন করে বললেন, ‘ভাই সব! আমাদের কাছে বহু অর্থ এসেছে। তোমরা মেপে-গুণে অথবা ওজন করে যেভাবে ইচ্ছা বন্টন করে নিতে পার।’ এক ব্যক্তি উঠে বললোঃ ‘আমিরুল মু’মিনীন। আপনি যথারীতি হিসাবের খাতা তৈরী করে নিন এবং সেই হিসাবের বিবরণ অনুসারে লোকদের মধ্যে বণ্টন করুন। হযরত ওমর রা. এ প্রস্তাব পছন্দ করেন। তিনি মুহাজেরদের জন্য মাথা প্রতি ৫ হাজার, আনসারদের জন্য মাথা প্রতি ৩ হাজার এবং নবীর সা. মহিষীদের জন্য মাথা প্রতি ১২ হাজার দিরহাম ধার্য করেন।
এখানে আমরা এ রেওয়ায়েত এই জন্য উদ্ধৃত করেছি যাতে অগ্রাধিকার দান সম্পর্কে হযরত ওমরের রা. নীতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তা ছাড়া এ দ্বারা সেই সময়কার প্রাচুর্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। অর্ধ মিলিয়ন দিরহাম তখন এমন একটা স্বপ্ন বলে মনে হতো যেন এ কথা কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বলতে পারে না। অবশ্য পরবর্তী যুগে বড় বড় বিজয়ের ফলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়।
ইমাম আবু ইউসুফ (রহ) তার কিতাবুল খারাজে লিখেন, ‘‘হযরত ওমর রা. বলেছেন, ‘খোদার শপথ! এই ধন-সম্পদে (বাইতুল মালের ধনসম্পদে) প্রত্যেক নাগরিকেরই অধিকার রয়েছে। এতে কারো অধিকার অপরের চেয়ে বেশী নয়। এ ধরণের ব্যাপারে আমিও তোমাদেরই মত একজন। তবে আমাদের মর্যাদার তারতম্য আল্লাহর কিতাবের আলোকে এবং রাসূলুল্লাহর সা. সাহচার্য অনুপাতে নির্ধারিত হবে। ইসলামের জন্য কে কি পরিমাণ দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং কে কত আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে তা বিবেচনা করতে হবে, মুসলমান অবস্থায় স্বচ্ছলতা অথবা দারিদ্রের প্রতিও দৃষ্টি দেয়া হবে। খোদার শপথ! আমি যদি বেঁচে থাকি তবে সানার পাহাড়ে মেষচারণকারী রাখালও বিনা পরিশ্রমে নিজের জায়গায় বসেই ধন-সম্পদ থেকে তার প্রাপ্য অংশ লাভ করতে পারবে।’’
‘‘তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেকের জন্য বার্ষিক ৫ হাজার দিরহাম, ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং হাবশায় হিজরতকারীদের প্রত্যেকের জন্য বার্ষিক ৪ হাজার দিরহাম এবং বদর-যোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততিদের মাথা প্রতি ২ হাজার দিরহাম বৃত্তি নির্ধারণ করেন। হযরত হাসান রা. ও হযরত হোসেনের রা. জন্য বার্ষিক ৫ হাজার দিরহাম বৃত্তি নির্ধারিত করেন। মক্কা বিজয়ের পূর্বে হিজরতকারীদের প্রত্যেকের জন্য তিনি বার্ষিক ৩ হাজার দিরহাম এবং মক্কা বিজয়ের পর ঈমান আনয়নকারীদের জন্য মাথা প্রতি ২ হাজার দিরহাম এবং আনসার ও মোহাজেরদের তরুণ পুত্রদের জন্যও অনুরূপ বৃত্তি নির্ধারণ করেন। সাধারণ মুসলমানদের জন্য বৃত্তি নির্ধারণে তিনি তাদের সামাজিক মর্যাদা, কোরআনের জ্ঞান এবং ইসলামের পথে জেহাদকে মাপকাঠি হিসাবে গ্রহণ করেন। অবশিষ্ট সবাইকে তিনি এক সারিতে রাখেন। যে কোন মুসলমান মদিনায় এসে অবস্থান করলে তার জন্য ২৫ দিনার বৃত্তি ধার্য করা হতো। সিরিয়া ও ইরাকের মতই ইয়ামেনবাসীদের জন্যেও দুই হাজার, এক হাজার, নয়শো, পাচশো’ এবং তিনশ’ দিরহাম করে বৃত্তি নির্ধারিত ছিল। তিনশ’র চেয়ে কম কারো ছিল না। তিনি বলতেন যে, সম্পদ যদি আরো বর্ধিত হয় তাহলে আমি প্রত্যেকের জন্য চার হাজার দিরহাম ধার্য করবো- এক হাজার তার সফরের জন্য, এক হাজার অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য, এক হাজার পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের উদ্দেশ্যে রেখে যাওয়ার জন্য এবং এক হাজার তার ঘোড়া ও খচ্চরের জন্য।’’ (আল-ফারুক ওমর, দ্বিতীয় খণ্ড; ডক্টর মোহাম্মদ হোসেন হাইকেল)
বৃত্তি ধার্য করার ব্যাপারে হযরত ওমর রা. যে নীতি নির্ধারণ করেন কোন কোন ব্যক্তির ব্যাপারে তা অনুসরণ করা তিনি প্রয়োজন মনে করেননি। এই সব ব্যক্তিকে তিনি তারই সমপর্যায়ের অন্যান্য লোকের চাইতে অধিক বৃত্তি দেন।
ওমর ইবনে আবি ছালমার জন্য তিনি ৪ হাজার দিরহাম ধার্য করেন। ইনি হলেন উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালমার পুত্র। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাস এতে আপত্তি জ্ঞাপন করে আমিরুল মুমিনীনকে বলেন, ‘‘আপনি ওমরকে কিসের ভিত্তিতে আমাদের ওপর প্রাধান্য দিচ্ছেন? তার পিতার মত আমাদের পিতারাওতো হিযরত এবং বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।’’ আমিরুল মুমিনীন তাকে জবাব দেন, ‘‘আমি তাকে, রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট তার মর্যাদা ছিল ভিত্তিতে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে আমার নিকট আপত্তি করছে সে উম্মে সালমার মত মা নিয়ে আসুক, আমি তার কথা মেনে নেব।’’ তিনি উসামা ইবনে জায়েদের জন্য চার হাজার দিরহাম ধার্য করেন। এতে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বলেন, ‘‘আপনি আমার জন্য তিন হাজার ধার্য করলেন। আর উসামার জন্য চার হাজার ধার্য করলেন। অথচ আমি এমন বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি যাতে উসামা অংশগ্রহণ করেননি।?’’ হযরত ওমর রা. তাকে জবাব দিলেনঃ ‘‘আমি তাকে এ জন্য বেশি দিয়েছি যে, সে রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট তোমার চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল। তার পিতাও রাসূলুল্লাহর সা. নিকট তোমার পিতার চেয়ে অধিক প্রিয় ছিলেন।’’ তিনি হযরত আবু বকরের রা. স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইসের জন্য এক হাজার দিরহাম, উম্মে কুলসুম বিনতে উকবার জন্য এক হাজার দিরহাম এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের মায়ের জন্য এক হাজার দিরহাম নির্ধারণ করেন। এই সব মহিলাকে তিনি তাদেরই সমপর্যায়ের অন্যান্য মহিলার চেয়ে বেশি দেন, কেননা তারা যে সব পুরুষের স্ত্রী কিংবা মা ছিলেন, তাদের অন্যান্য পুরুষের ওপর অগ্রাধিকার ছিল।’’ (আল-ফারুক ওমর, দ্বিতীয় খণ্ড, হাইকেল)
এখানে ধন বণ্টনের ক্ষেত্রে আবু বকর ও ওমরের দুটো পৃথক অভিমত দেখা যাচ্ছে। ওমরের অভিমতের ভিত্তি ছিল, ‘‘যারা রাসূলুল্লাহর সা. বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, তাদেরকে আমি তাঁর পক্ষে যোদ্ধাদের সমপর্যায়ে গণ্য করতে পারবো না।’’ এছাড়া ইসলামের পথে দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষা বরদাশত করাকে মাপকাঠি হিসাবে গ্রহণ করার জন্যও ইসলামে ভিত্তি রয়েছে। সেই ভিত্তি হচ্ছে শ্রম ও শ্রমের মজুরীর মধ্যে সমতার নীতি। এমনিভাবে আবু বকরের রা. অভিমতেরও ভিত্তি রয়েছে, ‘‘লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং তার প্রতিদানও তার হাতে নিবদ্ধ। তিনি কেয়ামতের দিন এর পূর্ণ প্রতিদান দেবেন। দুনিয়ায় কারো মৌলিক প্রয়োজন পূরণের চেয়ে বেশী অধিকার নেই।’’
কিন্তু আমরা কোন প্রকার দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই হযরত আবু বকরের মতকে অগ্রাধিকার দেব। কারণ এটা মুসলমানদের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠায় সর্বাপেক্ষা অধিক সহায়ক। আর জানা কথা এই যে, সাম্য হচ্ছে ইসলামের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। এ নীতি সেই ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষা পাবার ব্যাপারেও অধিক সহায়ক- যা এই বৈষম্য নীতি গ্রহণ করার ফলে দেখা দিয়েছিল। এক শ্রেণীর লোকের সম্পদ বর্ধিত হয়ে গিয়েছিল এবং বছরের পর বছর মুনাফার দ্বারা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছিল। ধন-বিজ্ঞানের দিক থেকে এটা একটি সর্বজনবিদিত সত্য যে, মুনাফার মাধ্যমে সম্পদ যত বাড়ে, তা মূলধনের বৃদ্ধি অনুপাতে অনেক বেশী। স্বীয় অনুসৃত নীতির এই ভয়াবহ পরিণতি দেখে হযরত ওমর রা. তার জীবনের শেষ ভাগে প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি পরবর্তী বছর পর্যন্ত জীবিত থাকলে সকলের বৃত্তি সমান করে দেবেন। এই সময়ে তার এ উক্তি অত্যন্ত প্রসিদ্ধি লাভ করেঃ
‘‘যে সব সিদ্ধান্ত আমি ইতিপূর্বে গ্রহণ করেছি তা পুনরায় করার সুযোগ পেলে ধনিকদের প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ নিয়ে দরিদ্র লোকদের মধ্যে বিতরণ করে দিতাম।’’
কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সময় অতিবাহিত হয়ে যায় এবং পরিস্থিতি তাঁর আয়ত্বের বাইরে চলে যায়। বৈষম্যমূলক বণ্টন নীতির যে সব কুফল দেখা দেয় তা গোটা ইসলামী সমাজের ভারসাম্য ব্যাহত করে। এরপর যখন মারওয়ানের স্বেচ্ছাচারমূলক কার্যকলাপ শুরু হয় এবং হযরত ওসমান রা. তা বরদাশত করতে থাকেন তখন সমাজ মারাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পতিত হয়।
মর্যাদার পার্থক্য অনুসারে ধন-বণ্টনের কুফল দেখে হযরত ওমর রা. নিজের মত পরিত্যাগ এবং হযরত আবু বকরের রা. মত গ্রহণ করেন। হযরত আলীর রা. মতও ছিল প্রথম খলিফার ন্যায়।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমরা হযরত আলীর খেলাফতকে প্রথম দুই খলিফার খেলাফতেরই স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা বলে মনে করি। আর হযরত ওসমানের যুগকে মনে করি একটি শূণ্যতা, যা আলী ও পূর্ববর্তী খলিফাদ্বয়ের মাঝে বিভেদের দেয়াল টেনে দিয়েছিল। কারণ এ সময়ে মারওয়ানই ছিল আসল শাসন পরিচালক। এ জন্য এখন আমরা হযরত আলী রা. সম্পর্কে আলোচনা করবো, এর পর আলোচনা করবো হযরত ওসমানের রা. যুগ সম্পর্কে।
হযরত আলী বৃত্তি বণ্টনের ব্যাপারে সাম্যের নীতি গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম ভাষণেই স্পষ্ট করে বলেনঃ
‘‘শোনো! রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের মধ্যে আনসার কিংবা মোহাজের-যেই মনে করে যে, রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্যের কারণে অন্যান্যদের ওপর তার প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার রয়েছে, তার জানা উচিত যে, এই অগ্রাধিকার সে কেয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট লাভ করবে এবং তার প্রতিদানও সেখানে পাবে। ভালো করে বুঝে নাও! যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের আহ্বানে সাড়া দেয়, আমাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি দেয়, আমাদের জীবন-বিধান গ্রহণ করে এবং আমাদের কেবলা অভিমুখী হয়- ইসলামের যাবতীয় অধিকার ও কর্তব্য তার ওপর অর্পিত হয়। তোমরা সকলে আল্লাহর বান্দা, আর এ সমস্ত সম্পদ আল্লাহর। এটা সকলের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হবে। এ ব্যাপারে কেউ অপর কারো ওপর অগ্রাধিকার পাবে না। অবশ্য খোদাভীরু লোকদের জন্য আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম প্রতিদান।’’
এটাই প্রকৃত ইসলামী বিধান, ইসলামের সাম্যের আদর্শের সাথে এর পরিপূর্ণ মিল রয়েছে। এটা ইসলামী সমাজে ভারসাম্য রক্ষার নিশ্চয়তা দেয় এবং এতে কেবল কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টা সাধনা দ্বারাই সম্পদ বাড়ানো যায়। এই নীতি কাউকে লাভজনক কাজের জন্য অপরের চেয়ে বেশী অর্থ সরবরাহ করে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা দেয়ার অবকাশ রাখে না।
হযরত ওমর রা. জীবনের শেষ ভাগে এই নীতি অনুযায়ী কাজ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সময় পাননি। আকস্মিক শাহাদাতের ফলে তিনি তাঁর দু’টো ইচ্ছা সফল করতে পারেননি। একটা হলো তিনি চেয়েছিলেন যে, ধনিকদের নিকট থেকে অতিরিক্ত সম্পদ নিয়ে তা গরীবদের মধ্যে বিতরণ করবেন। কেননা এই অতিরিক্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছিল শুধুমাত্র সরকারী অর্থের অসম বণ্টনের ফলে। দ্বিতীয় ইচ্ছা ছিল তিনি ধনবন্টনের ব্যাপারে সম-অধিকার নীতি প্রবর্তন করবেন।
হযরত ওসমান রা. যখন খলিফা হলেন তখন তিনি এই দু’টো সিদ্ধান্তের একটিও কার্যকরী করার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তিনি বাড়তি অর্থ তার মালিকের হাতেই ছেড়ে দেন এবং বৃত্তি বন্টনেও বৈষম্য বহাল রাখেন। অধিকন্তু তিনি তাদেরকে মুক্ত হাতে আরো উপঢৌকনাদি দিতে থাকেন। এর ফল দাঁড়াল এই যে, ধনীরা আরো বেশি ধনী এবং গরীবরা আরো গরীব হয়ে পড়ে। অবশ্য গরীবরাও কখনো কখনো স্বচ্ছলতা বোধ করতো। যাদের ধন-দৌলতের কোন অভাব ছিল না তিনি তাদেরকেও বড় বড় অংকের অর্থ সাহায্য করেন। কোরেশদেরকে তিনি সারা দুনিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার অবাধ সুযোগ দেন। তিনি বড় বড় ধনীদেরকে সাওয়াদ অঞ্চলে অথবা বিদেশে দালান কোঠা ও জায়গা-জমি খরিদ করারও সুযোগ দেন। এর পরিণতি স্বরূপ তাঁর খেলাফতের শেষের দিকে সমগ্র মুসলিম সমাজে ধন-বণ্টনে বিরাট বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তাঁর ওপর অনুগ্রহ করুন।
হযরত আবু বকর রা. ও তার পর হযরত ওমর রা. এই নীতি অত্যন্ত কঠোরভাবে কার্যকরী করতেন যে, কোরাইশ প্রধানদের একটি উল্লেখযোগ্য দলকে মদিনায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতেন। তাই আবু বকর রা. ও ওমর রা. তাদেরকে বিজিত দেশে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অনুমতি দিতেন না। কারণ রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা, ইসলামের জন্য তাদের ত্যাগ ও কুরবানী এবং জেহাদে তাদের অগ্রসরতার দরুণ জনগণ বিশেষভাবে তাদের ভক্ত ও অনুরক্ত হতে পারে এবং তখন এই ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ধন-সম্পদ, দক্ষতা ও পদের লিপ্সা জন্মাতে পারে। এটাকে অবশ্য ইসলামের ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পর্কিত নীতির বিরুদ্ধাচরণ বলা যেতে পারে না। কেননা ইসলামে ব্যক্তি স্বাধীনতা সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের শর্তের সাথে জড়িত। যখন হযরত ওসমানের যুগ এলো, কখন তিনি তাদেরকে সর্বত্র অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা দান করলেন। অধিকন্তু তিনি তাদেরকে বিজিত দেশ সমূহে ঘর-বাড়ী ও জায়গা-জমি ক্রয় করার জন্যও উদ্বুদ্ধ করলেন। আর এটা করলেন তখনি- যখন তিনি তাদেরকে লাখ লাখ দিরহাম দিয়ে ফেলেছেন।
নিঃসন্দেহে মুসলমানদের এবং বিশেষতঃ মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে উদার ও সদয় ব্যবহার হিসেবেই এ সব করা হয়েছিল। কিন্তু এই নীতির অত্যন্ত মারাত্মক কুফল দেখা দেয়। সে কুফল আবু বকর রা. ও ওমরের রা. দৃষ্টি থেকে গোপন ছিল না। এর ফলে মুসলমানদের সমাজে বিপুল আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। এর ফলে সমাজে একটি অলস ও নিষ্ক্রীয় শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। চরম নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও তাদের ধন সম্পদের অন্ত ছিল না। বিনা চেষ্টায় বসে বসে তারা পরম তৃপ্তিকর জীবন যাপন করতো।
এভাবে বিলাসিতা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। অথচ এই বিলাসিতার বিরুদ্ধে ইসলাম তার আইন-কানুন ও নীতিমালা উভয়ের মাধ্যমেই অবিরাম যুদ্ধ ঘোষণা করে আসছিল। হযরত ওসমানের পূর্ববর্তী খলিফাদ্বয়ও এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন এবং এটা যাতে কোনক্রমেই মাথা তুলতে না পারে তার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি যখন এই পর্যায়ে উপনীত হয় তখন কতিপয় লোকের মধ্যে ইসলামী প্রাণশক্তির বিষ্ফোরণ ঘটে। তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন হযরত আবু জর। তিনি ছিলেন সবচেয়ে স্পষ্টবাদী ও বিপ্লবী।
দুঃখের বিষয়, হযরত আবু জরের নীতিকে ভ্রান্ত আখ্যা দিয়ে মিশরের দারুল ইফতা সম্প্রতি এক ফতোয়া দিয়ে আবু জরের চেয়ে বেশি ইসলাম বুঝার দাবী ফলাতে চেষ্টা করেছেন। খোদার দ্বীন তাদের নিকট যেন ব্যবসা-পণ্যে পরিণত হয়েছে।
আবু জর রা. মুসলিম সমাজের উঁচু তলার লোকদের বিলাসিতাকে পূর্ণোদ্যমে চ্যালেঞ্জ করেন। কেননা ওটা ছিল ইসলামের একেবারেই পরিপন্থী। এই বিলাসিতার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তিনি বনু উমাইয়া ও হযরত মুয়াবিয়ার সমালোচনা করেন। কেননা তার এ নীতির দরুন ধনিকদের ধন এবং বিলাসীদের বিলাসিতাই কেবল বেড়ে চলছিল।
আবু জর রা. জানতে পারলেন যে, হযরত ওসমান রা. মারওয়ানকে আফ্রিকার রাজস্বের এক-পঞ্চমাংশ, হারেসকে দুই লাখ দিরহাম এবং জায়েদ ইবনে ছাবেতকে এক লাখ দিরহাম দান করেছেন। এটা তার বিবেকের পক্ষে অসহনীয় ছিল। তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করে এক জনসভায় নিম্নরূপ বক্তৃতা দেনঃ
‘‘আজকাল এমন সব কাজ করা হচ্ছে যা আমার বুদ্ধির অগম্য। খোদার শপথ! এ সব কাজের পেছনে আল্লাহর কোরআনে কিংবা রসূলের হাদীসে কোথাও কোনো ভিত্তি নেই। খোদার শপথ! আমি সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সত্য পদদলিত হচ্ছে, বাতিলকে পুনরায় জীবন্ত করে তোলা হচ্ছে, সত্যবাদী লোকদেরকে মিথ্যাবাদী প্রমাণিত করা হচ্ছে এবং ‘তাকওয়া’ ও খোদাভীতি ছাড়াই লোকদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। হে ধনিক সমাজ! তোমরা গরীবদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার কর। যারা টাকা-পয়সা জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে জানিয়ে দাও যে তাদের কপালে, পিঠে ও পার্শ্বে আগুন দিয়ে দাগানো হবে। হে পুঁজিপতিরা! জেনে রাখ, ধন-সম্পদে তিনজন অংশীদার রয়েছেঃ প্রথমতঃ অদৃষ্ট। এটা যে কোনো মুহূর্তে ধ্বংস অথবা মৃত্যুর মাধ্যমে তোমাদের বিনা-অনুমতিতে তোমাদের নিকট থেকে ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নিতে পারে। দ্বিতীয়তঃ উত্তরাধিকারী। সে সব সময় অপেক্ষা করছে, কখন তোমার চোখ মুদিত হবে এবং সে তোমার ধন-সম্পদ কুক্খিগত করবে। তৃতীয়তঃ তোমার অধিকার। যদি তুমি এই তিনজনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুর্বল অংশীদার না হতে চাও তবে সে জন্য অবশ্যই চেষ্টা কর। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
‘‘তোমরা যতক্ষণ নিজেদের প্রিয়তম সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় না করবে ততক্ষণ প্রকৃত কল্যাণ লাভে সক্ষম হবে না।’’ বন্ধুগণ! তোমরা এখন রেশমী পর্দা এবং মখমলের বালিশ ব্যবহার করা শুরু করেছে। আজকাল আজার বাইজানের গদিতে শয়ন করা তোমাদের পক্ষে কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছে। অথচ রাসূলুল্লাহ সা. শুধু চাটাই-এর ওপর শয়ন করতেন। তোমরা আজ রকমারী খাদ্য খাও অথচ রাসূলুল্লাহ সা. পেট ভরে জবের রুটিও পেতেন না।’’
মালেক ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ বর্ণনা করেন যে, একবার আবু জর রা. হযরত ওসমানের সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি তাকে সাক্ষাতের জন্য ডাকলে আবু জর রা. একখানা লাঠি হাতে করে দরবারে উপস্থিত হন। এই সময়ে হযরত ওসমান রা. কা’ব নামক সাহাবীকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘‘কা’ব, আবদুর রহমান ইন্তেকাল করেছেন। তিনি বহু টাকা রেখে গেছেন। সে সম্পর্কে তোমার অভিমত কি?’’ কা’ব বললেন, ‘‘তিনি যদি তা থেকে আল্লাহর হক আদায় করে থাকেন তাহলে আর তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করা যায় না।’’ এ কথা শোনামাত্র আবু জর রা. তার লাঠি উত্তোলন করলেন এবং কা’বকে এক ঘা বসিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি যেঃ
‘‘যদি আমার কাছে এই পর্বতের সমান সোনা থাকতো এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করতাম ও তা আল্লাহ গ্রহণ করতে থাকতেন তবে আমি তা থেকে ছয় উকিয়া পরিমাণ স্বর্ণও রেখে যাওয়া পছন্দ করতাম না।’’ এই হাদীস বর্ণনা করে তিনি হযরত ওসমানকে তিনবার খোদার শপথ দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি কি এ হাদীস শুনেছেন?’’ তিনি বললেন, ‘‘হাঁ!’’ (৪৫৩ নম্বর হাদীস- মুসনাদে আহমদ)
এ ধরণের আহ্বান বরদাশত করা মারওয়ান ও মুয়াবিয়া রা. এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তারা অবিরাম হযরত ওসমানকে তার বিরুদ্ধে উস্কানী দিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আবু জরকে উপযুক্ত শরিয়ত সম্মত অপরাধ ছাড়াই দেশান্তরিত হয়ে ‘রবজা’য় চলে যেতে হয়।
দেশে সম্পদের সীমাহীন প্রাচুর্য্য সত্ত্বেও অর্থলিপ্সা যাকে পর্যদস্ত করতে পারেনি সেই জাগ্রত বিবেকের পক্ষ থেকেই এই উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছিল। তখন সম্পদের কেন্দ্রায়ণ এমন প্রকট হয় যে, ইসলামী সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত এবং ইসলামের প্রধান প্রধান মূলনীতিগুলো অবলুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছিল। আমরা এই সময়কার আর্থিক প্রাচুর্য সম্পর্কে মাসউদী বর্ণিত কতিপয় নমুনা পেশ করছি। তিনি বর্ণনা করেনঃ
‘‘ওসমানের রা. আমলে সাহাবারা বিপুল ধন-সম্পদ উপার্জন করেন। যেদিন ওসমান রা. শাহাদাত বরণ করেন, সেদিন তার কোষাধ্যক্ষের নিকট তার দেড় লাখ দিনার ও দশ লাখ দিরহাম নগদ জমা ছিল। ওয়াদিল কুরা ও হোনাইন প্রভৃতি স্থানে তাঁর যে ভূ-সম্পত্তি ছিল তার দাম ছিল এক লাখ দিনার। এ ছাড়াও তিনি বহু সংখ্যক ঘোড়া ও উট রেখে যান। জোবায়ের রা. এর ইন্তেকালের পর তাঁর পরিত্যক্ত একটি ভূ-সম্পত্তির মূল্যই ছিল ৫০ হাজার দিনার। তা ছাড়া তিনি এক হাজার ঘোড়া ও এক হাজার বাঁদী রেখে যান। তালহার রা. ইরাক থেকে দৈনিক এক হাজার দিনার এবং সারাত থেকে এর চেয়েও বেশী আয় হতো। আবদুর রহমান ইবনে আওফের আস্তাবলে এক হাজার ঘোড়া ছিল, তার এক হাজার উট এবং দশ হাজার ছাগল-ভেড়াও ছিল। তাঁর ইন্তেকালের পর তার সম্পত্তির এক চতুর্থাংশের মূল্য দাঁড়ায় ৮৪ হাজার দিরহাম। জায়েদ ইবনে ছাবেত এত বেশী সোনা রূপা রেখে যান যে, তা কুড়াল দিয়ে কাটতো হতো। যে সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি তিনি রেখে যান তা এ থেকে পৃথক। জোবায়ের বসরায়, মিশরে, কুফায় ও আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি করে প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এমনভিাবে তালহা রা. কুফায় একটি বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেন। মদিনায়ও তিনি সেগুনের কাঠ ও চুন-সুরকী দিয়ে একটি বিরাট কোঠা নির্মাণ করেন। সা’দ ইবনে আবি আক্কাস আকিকে একটি প্রশস্ত প্রাঙ্গন গম্বুজসহ সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করেন। মিকদাদ মদিনার ভিতরে ও বাইরে কারুকার্যখচিত এক মনোরম প্রাসাদ তৈরী করেন। ইয়ালা ইবনে মুম্বা ৫০ হাজার দিনার নগদ এবং তিন লাখ দিরহাম মূল্যের ভূ-সম্পত্তি রেখে যান।’’ (ওসমান- উস্তাদ ছাদেক উরজুন)
ওমরের রা. আমলে ধন বণ্টনে মর্যাদার তারতম্য করার অনিবার্য ফল হিসাবে সম্পদের এই ভারসাম্যহীন প্রাচুর্যের উৎপত্তি হয়। হযরত ওমর রা. এ নীতি ও এর ফলাফলের অবসান ঘটাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি এটার অবসান করেই ছাড়তেন যদি তার বুকে খঞ্জর বিদ্ধ না হতো। তার শাহাদাতের পর এ প্রাচুর্য ক্রমশঃ বেড়েই যেতে থাকে। হযরত ওসমান রা. সে নীতি অব্যাহত রাখেন এবং তার ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে। হযরত ওসমান রা. অসম বণ্টন ছাড়াও যে সব উপহার-উপঢৌকনাদি এবং জায়গীর ইত্যাদি প্রদান করেন সেগুলোও মুসলিম সমাজে ধনবাদী প্রবণতা বাড়িয়ে তোলার ব্যাপারে সহায়তা করে। এরপর এমন কতগুলো কার্যকারণ আত্মপ্রকাশ করে যার দরুণ ধন-সম্পদের ভারসাম্যহীন প্রাচুর্য অস্বাভাবিকভাবে প্রসার লাভ করে। বিশেষতঃ ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির একত্রিকরণ এবং লাভজনক কারবারের উপায়-উপকরণ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কুক্ষিগত হওয়ার ফলে মুসলিম সমাজে পুঁজিবাদী প্রবণতার ব্যাপক প্রসার ঘটে। আবু জরের মন থেকে যে গভীর ও আন্তরিকতা পূর্ণ আবেদন বহির্গত হয়েছিল তার বিরোধিতা ও উপেক্ষার কারণেও পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে যায়। যদি তার আবেদন সফলকাম হতো এবং রাষ্ট্র প্রধানকে তিনি স্ব-মতে দীক্ষিত করতে পারতেন তাহলে তার মধ্যে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার যোগ্যতা ছিল। এতে করে ধনিকদের নিকট থেকে অতিরিক্ত ধন-সম্পদ নিয়ে গরীবদের মধ্যে বণ্টন করা সম্পর্কিত হযরত ওমরের শেষ সংকল্প পূর্ণ হতো। জাতিকে পুজিবাদী অভিশাপ থেকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্র প্রধানের এরূপ করা সম্পূর্ণ বৈধই শুধু ছিল না বরং বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের খাতিরে অবশ্য কর্তব্যও ছিল।
একদিকে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। মুষ্টিমেয় অভিজাত পরিবারের সদস্যদের জীবনে প্রাচুর্যের বান ডেকেছিল। অপরদিকে ঠিক তেমনি তীব্রতা ও প্রাবল্য নিয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র ও হাহাকার আঘাত হানছিল সাধারণ মানুষের জীবনে। এতে স্বভাবতই বিদ্বেষ ও ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। এই সমস্ত কার্যকারণ অব্যাহত গতিতে পুঞ্জিভূত হতে থাকে এবং তা শেষ পর্যন্ত এক বিভীষিকাময় সহিংস অভ্যুত্থানের সূচনা করে ছাড়ে। এই অভ্যুত্থানে ইসলামের শত্রুদেরই উপকার সাধিত হয় এবং তা হযরত ওসমানের প্রাণ সংহার করে। সেই সাথে মুসলিম উম্মতের শান্তি ও নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয় এবং তাকে বিশৃংখলা ও উত্তেজনার গভীরতম আবর্তে নিক্ষেপ করে। যতক্ষণ স্বয়ং ইসলামের প্রাণশক্তি এই বিশৃংখলার আগুনে ধূমায়িত না হয় এবং উম্মত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের হিংস্র থাবায় আক্রান্ত না হয় ততক্ষণ এ বিশৃংখলার আগুন নির্বাপিত হয়নি।
ওসমানের রা. পর আলী রা. সাম্য ও ন্যায় বিচারের যে নীতি গ্রহণ করেন, তাতে পুঁজিবাদী মহল এবং যারা সম্পদের অসম-বণ্টন দ্বারা ব্যাপক উপকৃত হয়েছিল তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে; এটা আদৌ অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ছিল না। তারা হযরত আলীকে এ নীতি পরিহার করার পরামর্শ দেয় এবং আশংকা প্রকাশ করে যে, এতে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। তাঁর জাগ্রত বিবেকে ইসলামের যে দীপশিক্ষা প্রজ্জ্বলিত ছিল তদনুসারে তার এই জবাব দেয়াই স্বাভাবিক ছিল যে, ‘‘তোমরা কি আমাকে আমার দেশবাসীর ওপর জুলুম করে অন্য কারো সাহায্যে গ্রহণের পরামর্শ দিতে চাচ্ছ? এ ধন-সম্পদ যদি আমার হতো তথাপি আমি এর বণ্টনে সাম্য অবলম্বন করতাম। আর এটা যখন আল্লাহর সম্পদ, তখন আমি কি করে বে-ইনসাফী করতে পারি? জেনে রাখ, সম্পদ অন্যায়ভাবে কাউকে দেয়া অপব্যায়ের আওতায় পড়ে। সন্দেহ নেই যে, এতে করে দানকারী দুনিয়ায় খানিকটা মর্যাদাশীল হতে পারে, কিন্তু আখেরাতে এরূপ নীতি তাকে অবশ্যই লাঞ্ছিত করে ছাড়বে।’’
বনু উমাইয়া অর্থ ব্যবস্থার ব্যাপারে ভিন্ন নীতি অনুসরণ করে। অবশেষে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের যুগ এলে তিনি অন্যায়ভাবে অর্জিত ধন-সম্পদ প্রত্যর্পণ এবং অপব্যয় রোধ করার কঠোর নীতি অবলম্বন করেন। এ সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বেই বলেছি। এই সময়ে বনু উমাইয়ার লোকেরা বাইতুল মালের অর্থ সম্পদের ব্যাপারে অন্যান্য প্রজাদের সমানাধিকার পায়। তখন আর চাটুকার, স্তুতিবাদী কবি ও গায়কদের কোনো অংশ তাতে ছিল না। তিনি কবিদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং বাইতুল মাল থেকে তাদের পুরস্কার দেয়ার নীতি রহিত করেন।
একবার কবি জারির তার প্রশংসা করে এক কবিতা পাঠ করেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তাকে বলেন, ‘‘জারির! তুমি কি মোহাজেরদের সন্তান, যে তাদেরকে যা দিয়ে থাকি তা তোমাকেও দেব? তুমি কি আনসারদের সন্তান, যে তাদেরকে যা দিয়ে থাকি তা তোমাকেও দেব? না তুমি কোন গরীব লোক, যে তোমাকে তোমার জাতির ছদকা ও জাকাতের তহবিল থেকে কিছু দেয়ার নির্দেশ দেব?’’
সে জবাব দিল, ‘‘আমিরুল মু’মিনীন! আমি এর কোনোটি নই। বরং আমি সর্বাপেক্ষা স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। আমাকে সাবেক শাসকরা এর পুরস্কার হিসাবে চার হাজার দিরহাম ও তার সাথে মূল্যবান কাপড়-চোপড় ও সওয়ারীর জন্তু দিতেন। ওগুলো গ্রহণ করার আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তাই আপনার কাছে আমি সেই পুরস্কার চাই।’’
ওমর জবাব দিলেন, ‘‘প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজের প্রতিফল আল্লাহর কাছে পাবে। তবে আমার যতদূর জানা আছে, আল্লাহর সম্পদে (রাষ্ট্রীয় কোষাগারে) তোমার কোন প্রাপ্য নেই। তবে আমার ব্যক্তিগত ভাতা লাভ করা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আমি হিসাব করে দেখবো যে, আমার পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের জন্য সারা বছরে কত লাগে। যত লাগে ততটা আমি রেখে কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা তোমাকে দিয়ে দেব।’’ জারির বললো, ‘‘না আমার দরকার নেই। আল্লাহ আমিরুল মু’মিনীনকে আরো বেশী দান করুক এবং তার আরো বেশী প্রশংসা করা হোক এই কামনা করি। আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট মনে বিদায় হচ্ছি।’’ তিনি বললেন, ‘‘এটাই আমার নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় পন্থা।’’ জারির সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হলে ওমর ভাবলেন, ও আবার নিন্দাবাদও করতে পারে। এর একটা প্রতি-বিধান করা উচিত। এই ভেবে তিনি তাকে পুনরায় ডেকে আনতে নির্দেশ দিলেন। জারির এলে তিনি বললেন, ‘‘আমার কাছে চল্লিশটি দিনার ও দুই জোড়া কাপড় আছে। এর এক জোড়া ধুয়ে অপর জোড়া পরি। আমি এই জিনিসগুলোর অর্ধেক তোমাকে দিতে পারি। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা সাক্ষী আছেন যে, তোমার চাইতে ওমরের এই জিনিসগুলোর বেশী প্রয়োজন।’’ জারির বললো, ‘‘আমিরুল মুমিনীন! আল্লাহ আপনাকে আরো বেশী দিন। খোদার শপথ! আমি সন্তুষ্টচিত্তেই যাচ্ছি। এগুলোর আমার কোনো দরকার নেই।’’ তিনি বেললেন, ‘‘বেশ! তাহলে তুমি যখন শপথ করে বললে, তখন আমি তোমাকে বলতে চাই যে, তুমি এই প্রার্থনা ও পুরস্কার গ্রহণ না করে আমাদেরকে যে অনটন থেকে অব্যাহতি দান করলে সেটা আমাকে তোমার কবিতা ও স্তুতিবাদের চেয়ে বেশী মুগ্ধ করেছে। এখন তুমি আমার বন্ধু হয়ে যাও।’’
মুসলমানদের সম্পদকে যখন এভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং তাকে তার আসল পাওনাদারদের নিকট পৌঁছানো হয়েছে তখন আর বর্ণনাকারীদের এ বর্ণনায় বিস্ময়ের কিছু থাকে না যে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের যুগে লোকেরা এত স্বচ্ছল হয়ে উঠেছিল যে, যাকাত নেয়ার লোক পাওয়া যেত না, কেননা তারা তাদের অন্যায্য ন্যায্য পাওনা পেয়ে যাকাতের দিক থেকে অভাব শূণ্য হয়ে গিয়েছিল।
ইয়াহিয়া ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন, ‘‘আমাকে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ যাকাত ও ছদ্কা সংগ্রহের জন্য আফ্রিকায় পাঠান। আমি সেখানকার যাকাত ও ছদ্কা সংগ্রহ করে তা বিতরণ করার জন্য গরীব লোকদের সন্ধান করি। কিন্তু কোনো গরীব লোক আমি সেখানে পাইনি। কোনো ব্যক্তিই সেখানে অর্থ গ্রহণ করতে সম্মত হয়নি। কারণ ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তাদের সকলকে ধনী বানিয়ে দিয়েছিলেন। অবশেষে আমি সেই অর্থ দ্বারা গোলাম ক্রয় করে স্বাধীন করে দেই।’’
আসল ব্যাপার হলো, দারিদ্র ও অভাব শুধুমাত্র সম্পদের কেন্দ্রীকরণেরই সৃষ্টি। প্রত্যেক যুগে গরীব লোকেরা বৃহৎ পুঁজিপতিদের জুলুম-উৎপীড়ন ও শোষণের শিকার হয়ে থাকে, আর এই বৃহৎ পুঁজিপতিরা আত্মপ্রকাশ করে বড় বড় দান, উপঢৌকন, পুরস্কার, জায়গীর, শোষণ, জুলুম ও মুনাফাখুরীর বলে।
উমাইয়া ও তার পরবর্তী আব্বাসীয় শাসনামলে সরকারী কোষাগার বাদশাহদের জন্য নিজের সম্পদের মতই ‘‘হালাল’’ হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ে দু’টো পৃথক পৃথক কোষাগার স্থাপন করা হয়। একটি সাধারণ কোষাগার- অপরটি বিশেষ কোষাগার। শোষোক্তটি সম্পর্কে এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে, ওটার আয় ও ব্যয় বাদশাহর জন্য নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু এরূপ বহু দেখা যেত যে, কোনো সাধারণ খাতের অর্থ বিশেষ কোষাগারে দাখিল করা হয় আবার কোনো বিশেষ ব্যয় সাধারণ কোষাগার থেকে সম্পন্ন করা হয়।
অধ্যাপক আদম মেজ (Adam Mez) স্বীয় পুস্তক ‘ইসলামী সভ্যতা চতুর্থ শতাব্দী’-তে বলেনঃ
ভাতা ও রাজধানী সংশ্লিষ্ট ব্যয় বরাদ্দের জন্য সাধারণ কোষাগার থেকে অর্থ গ্রহণ করা হতো। আমাদের কাছে চতুর্থ শতকের প্রথম দিকের একটি ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে যাতে বিশেষ কোষাগারের উপার্জন খাত সমূহ বিস্তারিত ভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
১. সন্তান-সন্ততির জন্য পিতা কর্তৃক পরিত্যক্ত সম্পদঃ কথিত আছে যে, সবচেয়ে বেশী সম্পদ রেখে যান হারুনুর রশীদ অর্থাৎ ৪ কোটি ৮ লাখ দিনার। মুতাজিদ (হিঃ ২৭৯-২৮৯) নিজ শাসনামলে প্রতি বছর সকল ব্যয়-বরাদ্দের পর বিশেষ উপার্জন খাত থেকে দশ লাখ দিনার সঞ্চয় করতেন। এভাবে তার কাছে ৯০ লাখ দিনার সঞ্চিত হয়। তিনি আশা পোষণ করতেন যে এক কোটি দিনার হলে তা গলিয়ে বড় একটা পিন্ড তৈরী করবেন এবং তাঁর কাছে এক কোটি দিরহাম আছে তাই তার আর কোনো অর্থের লোভ নেই এ ধারণা সৃষ্টি করার জন্য তিনি সেই পিন্ড প্রকাশ্য দরবারে ঝুলিয়ে রাখবেন বলেও স্থির করেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, এক কোটি দিরহাম সঞ্চিত হলে তিনি এক বছরের জন্য জনগণের এক-তৃতীয়াংশ খাজনা মওকুফ করে দেবেন। কিন্তু এ বাসনা পূর্ণ হবার আগেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।
মুতাজিদের পর মুকতাফির (২৮৯-২৯৫) যুগ আসে। তিনি কোষাগারের উপার্জন এক কোটি চল্লিশ লাখে উন্নীত করেন।
২. পারস্য ও কিরমান থেকে বার্ষিক গড়ে (ব্যয়ের খাত কেটে রাখার পর) হিঃ ২৯৯-৩২০ পর্যন্ত ২ কোটি ৩০ লাখ দিনার কর ও সরকারী সম্পত্তি লব্ধ অর্থ। এ থেকে চল্লিশ লাখ সাধারণ কোষাগারে ও অবশিষ্ট এক কোটি ৯০ লাখ বিশেষ কোষাগারে দাখিল করা হতো। অবশ্য এ থেকে সেই সব দেশের জরুরী প্রয়োজনের খাত সমূহে ব্যয়িত অর্থ বাদ দেয়া আবশ্যক মনে করা হতো। যেমন হিঃ ৩০৩ সালে (৯১৫ খৃঃ) এই দেশগুলো জয় করতে তিনি ৭০ লাখের চেয়ে বেশী অর্থ ব্যয় করেন।
৩. মিসর ও সিরিয়া থেকে অর্জিত অর্থঃ যেমন অমুসলিমদের ‘জিজিয়া’ সংগ্রহ করে জনসাধারণের কোষাগারে দাখিল করার পরিবর্তে খলিফার কোষাগারে জমা করা হতো। কেননা আমিরুল মুমিনীন হবার কারণে নীতিগত ভাবে ওটা তার ন্যায্য অধিকার ছিল।
৪. পদচ্যুত উজীর, সচিব ও সরকারী কর্মচারীদের উপার্জিত অর্থ, তাদের বাজেয়াফ্ত করা সম্পত্তিঃ তাছাড়া খলিফা নিজের নিঃসন্তান ভৃত্যদের এবং রাজ পরিবারের নিঃসন্তান গোলামদের উপার্জিত অর্থের মালিক হতেন। যেহেতু তারা সাধারণতঃ উচ্চ পদস্থ ও উচ্চ বেতনভোগী কর্মচারী ছিল, তাই এ উপায়ে খলিফার কোষাগারে বিপুল অর্থের সমাগম হতো।
৫. সাওয়াদ, আওয়াজ এবং অন্যান্য পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে আগত ও সরকারী সম্পত্তি লব্ধ অর্থঃ এটাও বিশেষ কোষাগারে দাখিল করা হতো।
৬. খলিফারা যে অর্থ সঞ্চয় করতেনঃ যেমন হিঃ তৃতীয় শতকের দু’জন শেষ খলিফা মুতাজিদ ও মুকাতাফী বার্ষিক ১০ লাখ দিনার সঞ্চয় করতেন। মুকতাদিরও অনুরূপ সঞ্চয় করতেন। এভাবে পনেরো বছরে সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়াতো এক কোটি পঞ্চাশ লাখ অর্থাৎ প্রায় খলিফা হারুনুর রশীদের অর্থের অর্ধেক।
এই বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ‘খলিফা’ নামধারী এই বাদশাহরা মুসলিম জনগণের ধন-সম্পদের ওপর কিভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল এবং অর্থ-ব্যবস্থার কাঠামো ইসলামী মূলনীতি থেকে কতখানি ভিন্ন ধরণের হয়ে পড়েছিল।
একদিকে ধনের প্রাচুর্য, আরামপ্রিয়তা ও বিলাসিতা চরমে উঠেছিল অপরদিকে তারই পাশাপাশি বঞ্চনা, ক্ষুধা ও দারিদ্রের দৃশ্য ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। ইসলামী সমাজ ইসলামী রীতি-নীতি থেকে দূরীভূত ও ইসলামী মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার ফলে অবনতির সর্বনিম্নস্তর উপনীত হয়েছিল।
কতিপয় মূলনীতি
কিন্তু এ সব সত্ত্বেও ইসলামের বাস্তব কর্মধারা অর্থ ব্যবস্থার ব্যাপারে অনেকগুলো মূলনীতি নির্ধারিত করে দিয়েছে। মানবতার একান্ত দুর্ভাগ্য এই যে, উমাইয়া শাসকদের কারণে ইসলামকে তার প্রথম যুগেই বিকৃতি ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু তথাপি ইসলামী ইতিহাস ইসলামের অনেকগুলো মতাদর্শকে বাস্তব রূপদান করে দেখিয়ে দিয়েছে।
বাস্তব ইতিহাস এ কথা চূড়ান্তরূপে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে যেঃ
১. ইসলামে অগ্রসর ব্যক্তিদের চেয়ে দরিদ্র লোকেরা বাইতুল মালের অর্থের অধিক হকদার। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘আদি ইবনে হাতেম বর্ণনা করেছেন, আমি স্বীয় গোত্রের কতিপয় লোকের সাথে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাবের নিকট গমন করি। তিনি তাই গোত্রের কয়েক ব্যক্তির জন্য দু’হাজার করে ভাতা নির্ধারণ করছিলেন। আদি বলেন, আমি পুনরায় তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। তথাপি তিনি আমার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। আমি পুনরায় তার সামনে এসে দাঁড়ালাম এখনো তিনি আমাকে উপেক্ষা করলেন। আমি বললাম, ‘‘আমিরুল মুমিনীন! আপনি কি আমাকে চিনেন?’’ হযরত ওমর রা. খিল খিল করে হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, খোদার শপথ! আমি তোমাকে ভাল করেই চিনি। সকলে যখন কুফরির ওপর অবিচল ছিল তুমি তখন ঈমান এনেছিলে। অন্যের যখন পশ্চাদপসরণ করছিল তুমি তখন সম্মুখে অগ্রসর হয়েছিলে। অনেকেই যখন প্রতারণা করছিল তুমি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলে। আমার ভালভাবেই মনে পড়ে যাকাতের যে প্রথম অর্থ দেখে রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবা রা. দের মুখমণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, সেটা ছিল তাই গোত্রের যাকাতের টাকা। আমিই সে টাকা রাসূলুল্লাহ সা. এর দরবারে আনয়ন করেছিলাম।’’ অতপর হযরত ওমর রা. এই বলে ওজর পেশ করতে আরম্ভ করেন যে, আমি এই অর্থ থেকে শুধুমাত্র সেই সব লোকের ভাতা নির্ধারণ করেছি যারা নিজ নিজ পোষ্যদের খাদ্য না দিতে পেরে অনাহারে কষ্ট ভোগ করছে। কেননা তারা হচ্ছে গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।’’
যে ওমর রা. ইসলামের ব্যাপারে অগ্রসর লোকদের অগ্রাধিকার দানের পক্ষপাতি ছিলেন, সেই ওমরের রা. পক্ষ থেকে এ উক্তি অত্যন্ত অর্থবহ এবং এ থেকে অনেক কিছু প্রমাণিত হয়। আসলে ইসলামী সমাজে ‘প্রয়োজন’ হচ্ছে অধিকারের সর্বপ্রথম ভিত্তি। এই মূলনীতি থেকেই বুঝা যায় যে ইসলাম দারিদ্র ও অভাবের কত বড় দুশমন এবং এগুলো মোচনের চেষ্টাকে সে অন্য সকল চেষ্টার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়।
২. সমাজের এক শ্রেণী সীমাহীন প্রাচুর্যের উদ্দাম স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবে আর অপর শ্রেণী থাকবে বঞ্চিত-নিঃস্ব-সর্বহারা, ইসলাম কিছুতেই এটা বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। এ ধরণের অবস্থায় সংশোধনের উদ্দেশ্যে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইসলাম সরকারকে পূর্ণ ক্ষমতা দান করে। এটা এমন একটা মূলনীতি যা ঐতিহাসিক ভাবে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে প্রমাণিত। তিনি বনু নজীর থেকে সংগ্রহীত ‘ফায়’ এর সমগ্র অর্থই শুধুমাত্র দরিদ্র মোহাজেরদের মধ্যে বিতরণ করেন- যাতে প্রথম সুযোগেই ইসলামী সমাজে খানিকটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কেবলমাত্র দু’জন দরিদ্র আনসারকে তিনি তাদের সাথে শামিল করেন। অতঃপর কোরআন এই ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তকে সমর্থন করার জন্য এগিয়ে আসেঃ
‘‘যাতে করে ধন-সম্পদ শুধুমাত্র তোমাদের ধার্মিক সম্প্রদায়ের মধ্যে আবর্তনশীল না থাকে।’’
এ দৃষ্টান্তটি অত্যন্ত অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ। এর আলোকে আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী শাসনকারী মুসলমান শাসন মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাইতুল মাল থেকে অভাবী ও দরিদ্র লোকদেরকে উপযুক্ত পরিমাণে সাহায্য করার সর্বদাই ক্ষমতা রাখে। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের মধ্যে যাতে সাধারণ ভারসাম্য ব্যাহতকারী বৈষম্য বিরাজিত না থাকে এ জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের অবশ্য কর্তব্য।
৩. ক্ষমতা ও অক্ষমতা অনুপাতে করের হারে তারতম্য করা অপরিহার্য। অমুসলিমদের ওপর জিজিয়া ধার্য করার সময়ে তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের ওপর নিম্নলিখিত হারে কর ধার্য করা হয়ঃ
ক. বিত্তশালী শ্রেণী- মাথা প্রতি বার্ষিক ৪৮ দিরহাম।
খ. মধ্যম শ্রেণী- মাথা প্রতি বার্ষিক ২৪ দিরহাম।
গ. দরিদ্র শ্রমজীবি- মাথা প্রতি বার্ষিক ১২ দিরহাম।
সম্পূর্ণ নিঃস্ব, দেউলে, শ্রমে অক্ষয় এবং শারীরিক অথবা মানসিক দিক থেকে পঙ্গু ব্যক্তিদের জিজিয়া মওকুফ। কেবলমাত্র স্বাধীন সুস্থমনা পুরুষদের জিজিয়া দিতে হতো। মহিলা কিংবা শিশুদের জিজিয়া দিতে হতো না।
দুর্ভিক্ষের বছর হযরত ওমর রা. জাকাত সংগ্রহ করার জন্য কর্মচারী পাঠাননি- বরং দুর্ভিক্ষ দূর হওয়া পর্যন্ত জাকাত আদায় স্থগিত রেখেছিলেন। দুর্ভিক্ষ শেষে তিনি আদায়কারী পাঠান এবং সক্ষম লোকদের নিকট দ্বিগুণ জাকাত দাবি করেন। একটি দুর্ভিক্ষের বছরের দ্বিতীয়টি চলতি বছরের। অক্ষম লোকদের তিনি ক্ষমা করেন। অতঃপর তিনি নির্দেশ দেন যে আদায়কারী যেন তার সংগৃহীত দ্বিগুণ অর্থের এক ভাগ উক্ত অক্ষম লোকদেরকে দিয়ে আসে এবং অবশিষ্ট এক ভাগ রাজধানীতে নিয়ে আসে।
৪. বল প্রয়োগ করা অথবা জীবনের প্রয়োজনীয় অর্থ থেকে কাউকে বঞ্চিত করে কর আদায় করা নিষিদ্ধ ছিল। হযরত আলী রা. তার জনৈক কর্মচারীকে নির্দেশ দেন ‘‘তুমি যখন তাদের নিকট যাবে তখন কর আদায় করার জন্যে তাদের গ্রীষ্ম কিংবা শীতের বস্ত্র-খাদ্য-দ্রব্য ও সওয়ারীর জন্তু বিক্রি করবে না, কাউকে একটা বেত্রাঘাতও করবে না, কাউকে এক পায়েও দাঁড় করাবে না যতই খাজনা বা কর বাকী থাকুক না কেন। কেননা আমাদেরকে শুধু জন-সাধারণের প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৫. ‘‘প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার ত্যাগের অনুপাতে’’ এই নীতির পাশাপাশি ‘‘প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার প্রয়োজন অনুপাতে’’ নীতিও কার্যকরী করা অপরিহার্য। নবী করীম সা. গণিমত লব্ধ অর্থ থেকে অবিবাহিতদের জন্য এক অংশ এবং বিবাহিতদের জন্য দুই অংশ নির্ধারিত করেন। এ থেকে এ কথাই প্রামণিত হয় যে ভাতা নির্ধারণে পরিশ্রমের সাথে সাথে প্রয়োজনের প্রতিও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। নইলে এটা জানা কথা যে, জেহাদে বিবাহিত এবং অবিবাহিতকে সমান পরিশ্রম করতে হয়। কেবল বিবাহিতের প্রয়োজন দ্বিগুণ বলে তাকে দ্বিগুণ ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ থেকে এ কথাও প্রমাণিত হচ্ছে যে শুধুমাত্র ‘প্রয়োজন’ ও ইসলামে মালিকানা অর্জনের একটা পৃথক মাধ্যম হতে পারে। ‘সামাজিক নিরাপত্তা’র ব্যাপারে এ মূলনীতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৬. প্রত্যেক অক্ষম ও অভাবী ব্যক্তির জন্য সামাজিক নিরাপত্তার বিধান। হযরত ওমর রা. প্রত্যেক নবজাতকদের জন্য একশো দিরহাম বৃত্তি নির্ধারণ করে দিলেন। শিশু একটু বড় হলে দু’শো দিরহাম এবং সাবালক হবার পর তাকে আরো বেশী দেয়া হতো। কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর জন্য একশো দিরহাম এবং তাকে লালন-পালনকারীর জন্য অতিরিক্ত ভাতা দেয়া হতো, শিশুর দুধ পান করানো ও অন্যান্য ব্যয়ভার ‘বাইতুল মাল’ থেকে বহন করা হতো, আর সে বড় হলে অন্যান্য বালকদের সমান ভাতা পেত।
হযরত ওমরের এই উদারতা আসলে ইসলামের উদারতারই প্রত্যক্ষ ফল স্বরূপ, কেননা পথে পড়া শিশু নিজের দিক থেকে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। সে তার অপরাধী মা-বাপের পাপের জন্য বিন্দুমাত্রও দায়ী নয়। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, হযরত ওমর রা. অন্ধ ইহুদী ও খৃষ্টান কুষ্ঠ রোগীদের জন্য ‘বাইতুল মাল’ থেকে সাহায্য বরাদ্দ করেছিলেন। ওমরের রা. প্রকৃতিতেও উদারতা সকল মানুষের জন্য ছিল, শুধু মাসলমানদের জন্য নয়। এটা হচ্ছে অভাব, অক্ষমতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা।
৭. ‘‘সম্পদ কোত্থেকে অর্জিত হয়েছে?’’ এ মৌলিক প্রশ্নের সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শাসকের নিকট যে সম্পদ রয়েছে তা আসলে জাতির সম্পদ না তার নিজস্ব এ সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার মুসলিম সমাজের রয়েছে, এ ব্যাপারে জনগণের হিসাব গ্রহণের হাত থেকে তার অব্যাহতি লাভের কোনো উপায় নেই। এ হিসাব গ্রহণের নীতি নির্ধারিত হওয়ার ফলে জাতীয় কোষাগার প্রশাসকদের হস্তক্ষেপ থেকে অনেকটা নিরাপদ হয়েছে। এ ধরণের কোনো কিছু করার পূর্বে শাসককে একাধিকবার চিন্তা করতে হয়। হযরত ওমর রা. তার সকল শাসনকর্তাদের সাথে এরূপ করেছেন। হযরত আলীও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরূপ নীতি অবলম্বন করেছেন।
৮. যাকাত ব্যবস্থা ইতিহাসের সেই সর্বাপেক্ষা অন্ধকার যুগেও স্থগিত হয়নিঃ যদিও সে যুগ ইসলামের প্রাণশক্তি থেকে বহু দুরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। হযরত আবু বকর রা. এর যুগের প্রারম্ভে ধর্মত্যাগীদের সাথে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এ যাবত কোনো এক ব্যক্তিও মৌখিক অথবা কার্যতঃ যাকাত অস্বীকার করেনি। কেবল আমাদের যুগে এসে যখন পাশ্চাত্য সভ্যতা বিজয়ীর আসনের অধিষ্ঠিত হলো। তখন তারই পরিণামে ইসলামী মূলনীতি সমূহের সর্বশেষটি যাকাতও মুসলমান সমাজের বাস্তব জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
৯. সাধারণ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাঃ এই ব্যবস্থা অনুসারে প্রত্যেক জনপদের লোকদেরকে সেখানে অনাহারে মৃত্যুবরণকারী যে কোনো ব্যক্তির জন্যে দায়ী করা হয়। ফৌজদারী বিধি অনুসারে তাদের ওপর এই দায়িত্ব বর্তায়। এই ভাবে মৃত্যুবরণকারী লোকের জন্য সংশ্লিষ্ট জনপদের সবাইকে পাইকারীভাবে জরিমানা তথা ‘দিয়াত’ দিতে হয়। কারণ সমাজের সকলে সেই ব্যক্তির হত্যাকারী সাব্যস্ত হয় যে তাদেরই মধ্যে থেকে অনাহারে ধুকে ধুকে মরেছে।
এই বিধান শরিয়াতের অপর একটি বিধান দ্বারাও সমর্থিত হয়। সেটা হচ্ছে এই যে, কোন ক্ষুধা-পিপাসা জর্জরিত ব্যক্তি ক্ষুধা-পিপাসায় মৃত্যু বরণ করার আশংকা বোধ করলে তাকে খাদ্য অথবা পানীয়ধারী ব্যক্তির সাথে সবশেষ পন্থা হিসাবে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং এরূপ ব্যক্তিকে সে হত্যা করলে তার দুনিয়ায়ও কোনো শাস্তি জরিমানা হবে না এবং আখেরাতেও আযাব ভোগ করতে হবে না।
১০. সুদ বিলোপ এবং দারিদ্রাবস্থায় ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির নীতিঃ আধুনিক সভ্যতা সুদকে হালাল ঘোষণা করার পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম সমাজে সুদ যথারীতি নিষিদ্ধই ছিল। ফরাসী আইন এই অভিশাপ আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় এবং একে আমাদের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক জীবনের একটা অন্যতম স্তম্ভে পরিণত করে। অথচ এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এটা শুধু এই জন্যে প্রচলিত হয় যে আমাদের বাস্তব জীবন থেকে নৈতিক মূল্যবোধের প্রভাব মুছে গিয়েছিল এবং মানুষের মন থেকে সততা ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অথচ ইসলাম এই মনোভাবকে সমাজে ও পারস্পরিক লেন-দেনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে।
এ বিষয়গুলি ছাড়াও পারস্পরিক সহানুভূতি ও সামাজিক নিরাপত্তা জনিত বহুনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে যা আইনের শক্তি দ্বারা কার্যকরী করার বস্তু নয়। স্বয়ং আমাদের নিকট অতীত ও মুসলিম সমাজের ওপর ইসলামী মূল্যবোধের প্রভাবের অস্তিত্ব সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়। এ যুগ আমাদের দাদারা নয় বরং পিতারাই স্বচক্ষে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চলে অবলোকন করেছেন। মুসলিম জাহানের ওপর পাশ্চাত্যে বস্তুবাদী সভ্যতার সর্বাত্মক প্রতিপত্তি সত্ত্বেও আজও এই প্রভাব অনেকটা অম্লান রয়েছে। সেখানে এই মূল্যবোধ কার্যকরী করার ব্যাপারে আইন ও বল প্রয়োগের আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। আজ কালকার সরকার সমূহের মধ্যে যে সব ওয়াক্ফ বিভাগ পরিদৃষ্ট হয়- যাকে আজ তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের বিপক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং যাকে বিভিন্ন শোষক শ্রেণী নানা নামে ও নানা দলে কুক্ষিগত করে রেখেছে এ সব প্রকৃতপক্ষে দূর ও নিকট অতীতের মুসলমানদের হৃদয়ে অবস্থিত দয়া, সহানুভূতি, সৎকর্মশীলতা, সামাজিক নিরাপত্তা ও পারস্পরিক সহযোগিতার পবিত্র মনোভাবেরই সাক্ষ্য বহন করছে। পাশ্চাত্যের নৃশংসতা, মৃত চেতনা ও স্থবির জড়বাদী সভ্যতা তাদের অন্তরাত্মাকে বিকৃত করতে সক্ষম হয়নি।
আমাদের স্বর্ণযুগে দুর্বলের প্রতি সামাজিক নিরাপত্তা দানের মনোভাব এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, শুধু মানুষই নয় জন্তু-জানোয়ারও তা থেকে উপকৃত হয়েছে, বহু স্থানে দুর্বল পশুদের আশ্রয় স্থল তৈরী করার জন্য কোনো কোনো স্থান ওয়াক্ফ করা হয়েছে যাতে তারা সেখানে এসে ক্ষুধা ও দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে।
প্রাথমিক স্তরে শাসন পদ্ধতি ও অর্থনৈতিক কার্যধারায় কিছুটা বিকৃতি দেখা দেয়ায় সে সুদূর প্রসারী ক্ষতি হয়েছে তা সত্ত্বেও এটাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম।
ইতিহাসের বাস্তব মঞ্চে এই হচ্ছে ইসলামের ভূমিকা যা বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর সাধারণ মূলনীতিগুলো সম্পর্কে এ কথা বলা চলে যে, নবতর পরিস্থিতির দাবি পূরণ এবং নতুন সমস্যাবলীর সমাধান করার পরিপূর্ণ যোগ্যতা তার রয়েছে, ছিল এবং অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবে। আগামী দিনে যে সমাজ ইসলামের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং যেখানে ইসলামী শরিয়তকে রাষ্ট্রীয় আইনের মর্যাদা দান করা হবে সেখানে ইসলাম, সেই সমাজের যাবতীয় দাবী ও প্রয়োজন অত্যন্ত ব্যাপকতা ও ভারসাম্য সহকারে পূরণ করতে সক্ষম হবে। আজকের মানব সমাজ যেভাবে মতবাদ সমূহ ও মানবীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ঘাত-প্রতিঘাতে নিরন্তর এক চরম সীমা থেকে অপর চরম সীমায় গিয়ে আঘাত খাচ্ছে, আর এই ঘাত-প্রতিঘাতে মানব জাতি যেরূপ তার বহু মূল্যবান সম্পদ বিসর্জন দিচ্ছে- ইসলাম তাকে এই অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতি থেকে চিরতরে নিরাপদ ও সুরক্ষিত করবে। [গ্রন্থকারের ‘‘আল ইসলাম ওয়া মুসকিলাতুল হাজারা’’ (ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতার সংকট) গ্রন্থের ‘‘উজতেরাব ওয়া ইনতেমার’’ (উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি) অধ্যায় দ্রষ্টব্য]
…….. সমাপ্ত ……..