ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা
মানবিক সাম্যের এই সু-উচ্চ মর্যাদার পূর্ণ বিবরণ দেয়া সম্ভব হবে না যতক্ষন আমরা উচ্চ পদস্থ লোকদের ব্যাপারে ইসলামী সমাজের নীতি সম্পর্কে সঠিকভাবে ওয়াকিফহাল না হবো। বড়রা যখন ছোটদের সাথে এক সারিতে দাঁড়াবে এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের একমাত্র ভিত্তি হবে- বংশ-মর্যাদা, পদ-মর্যাদা ও ধন-সম্পদ নয় বরং চরিত্র- কেবলমাত্র তখনি প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। কেবলমাত্র ছোটদের সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না।
ইমাম আবু ইউসুফ (রাঃ) তদীয় ‘কিতাবুল খারাজে’ লিখেছেনঃ ‘একবার হযরত ওমর (রাঃ) তার কর্মচারীদের হজ্জের সময় তার সাথে সাক্ষাত করার নির্দেশ পাঠান। যথাসময়ে তারা উপস্থিত হলে হযরত ওমর (রাঃ) তাদের ও সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেনঃ
“ভাইসব! সততার সাথে তোমাদের তত্ত্বাবধান ও সেবার জন্যই আমি এসব কর্মচারী নিয়োগ করেছি। তোমাদের জান-মাল ও মান-সম্মানের উপর হস্তক্ষেপ করার জন্য আমি এদেরকে নিযুক্ত করিনি। সুতরাং কোন কর্মচারীর বিরুদ্ধে তোমাদের কারো কোন অভিযোগ থাকলে তার দাঁড়িয়ে সে কথা বলা উচিত। সেদিন মাত্র এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো, “আমিরুল মুমেনীন! আপনার অমুক কর্মচারী আমাকে অন্যায়ভাবে একশো কোড়া মেরেছে”।
হযরত ওমর (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমিও কি তাকে প্রহার করতে চাও? এস, প্রতিশোধ গ্রহণ কর”। তখন আমর ইবনুল আস দাঁড়িয়ে বললেন, “আমিরুল মুমেনীন! আপনি কর্মচারীদের সাথে এরূপ ব্যবহার করা শুরু করলে তা তাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হয়ে দাড়াবে। এটা একটা স্থায়ী রীতি হয়ে দাঁড়াবে এবং আপনার পরবর্তী লোকেরাও তদনুসারে কাজ করবে”।
হযরত ওমর (রাঃ) বললেনঃ “তাই বলে কি আমি এই ব্যক্তিকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে দেব না? অথচ আমি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে নিজের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে দেখেছি। (লোকটিকে লক্ষ্য করে) এস, প্রতিশোধ গ্রহণ কর”। আমর ইবনুল আস বললেন, “আমাদেরকে লোকটিকে সন্তুষ্ট করার সুযোগ দিন”।
হযরত ওমর (রাঃ) অনুমতি দিলেন। তখন তারা লোকটিকে দু’শো দিনার দিয়ে সন্তুষ্ট করলেন। প্রতিটি কোড়ার বিনিময়ে দুই দিনার দিতে হলো। আমর ইবনুল আস অন্য কর্মচারীর ওপর থেকে বিপদ অপসারণ করলেন সত্য, কিন্তু স্বয়ং তাঁর পুত্রের বিরুদ্ধে যখন জনৈক মিশরীয় ছেলেকে প্রহার করার অভিযোগ এল তখন ওমর (রাঃ) তাকে প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়ে ছাড়েন এবং আমরকে কোন উচ্চ-বাচ্চ করতে দেননি। প্রতিশোধ গ্রহণ করানোর সময়ে হযরত ওমর (রাঃ) বলেছিলেন, “এই বড়লোকের ছেলেকে প্রহার কর”। আমর ইবনুল আসেরও শাস্তি ভোগ করা অবধারিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মিশরীয় লোকটি ক্ষমা করে দেয় এবং প্রহার থেকে বিরত থাকে।
আর একদিন হযরত ওমর (রাঃ) বসে মুসলমানদের মধ্যে কিছু অর্থ বন্টন করছিলেন। সমবেত লোকদের ভীড় প্রবল হয়ে ওঠে। সা’দ ইবনে আবি আক্কাস সম্মুখে অগ্রসর হলেন এবং অন্যান্য লোককে ঠেলে হযরত ওমরের নিকট পৌঁছে যান। এই সাহাবী বিশিষ্ট অভিজাত পরিবারের সন্তান। হযরত ওমর (রাঃ) এই বলে তাঁকে এক দোররা কষে দিলেন, “তুমি পৃথিবীর ওপরে আল্লাহর হুকুমতের প্রতাপ মান না কিন্তু আল্লাহর হুকুমাতের দৃষ্টিতে যে তোমার প্রভাব প্রতিপত্তির কানা-কড়িও মূল্য নেই তা তোমাকে দেখিয়ে দেয়া আমি প্রয়োজন বোধ করলাম”।
কেউ বলতে পারে যে, তিনিতো ছিলেন খলিফা। তার সাথে কার তুলনা? এই জন্য আমরা এবার দেখবো যে খলিফা ও বাদশাহদের সামনে তাদের প্রজারা মত প্রকাশ ও সমালোচনার ব্যাপারে কতখানি স্বাধীনচেতা ও নির্ভীকতার পরিচয় দিয়েছেন। মতামত প্রকাশে এই স্বাধীনচেতা ও নির্ভীকতার আসল উৎস হচ্ছে ইসলাম প্রদত্ত বিবেক ও প্রজ্ঞার স্বাধীনতা এবং কথায় ও কাজে বাস্তবায়িত পূর্ণ সাম্য।
খলিফা হিসাবে ভাষণ দিতে গিয়ে হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, “যদি তোমরা আমার মধ্যে কোন বক্রতা দেখ তবে আমাকে সোজা করে দিও”। সমবেত মুসলমানদের মধ্য থেকে একজন বলে ওঠেন, “তোমার মধ্যে কোন বক্রতা দেখলে আমরা তোমাকে তীক্ষ্ণধার তরবারী দিয়ে সোজা করে দেব”। একথা শুনে ওমর (রাঃ) বললেন, “আল্লাহর হাজার শোকর যে, তিনি ওমরের খেলাফতের মধ্যে এমন ব্যক্তিও সৃষ্টি করেছেন যে তাকে তীক্ষ্ণধার তরবারী দিয়ে সোজা করতে পারে”। একবার মুসলমানরা গণিমতে কতগুলো ইয়ামেনী চাদর লাভ করেন। সকল মুসলমানের মত হযরত ওমরও একটা চাদর পান এবং তার পুত্র আব্দুল্লাহকেও একটা চাদর দেন। যেহেতু খলিফার জামার দরকার ছিল তাই আব্দুল্লাহ নিজের অংশের চাদরটা খলিফাকে দিয়ে দেন যাতে দু’টো মিলে একটা জামা হতে পারে। এ জামা গায়ে দিয়ে হযরত ওমর (রাঃ) বক্তৃতা দিতে ওঠেন এবং বলেন, “তোমরা আমার কথা শোন এবং মেনে চল”।তৎক্ষনাৎ সালমান উঠে বললেন, “আপনার কথা আর শুনবোও না মানবোও না”। ওমর (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন?” সালমান বললেন, “আগে আপনি জবাব দিন, এ জামা কি করে তৈরী করলেন? নিশ্চয়ই আপনিও একটা চাদরই পেয়েছেন, আর আপনি খুবই লম্বা মানুষ”। তিনি বললেন, “তাড়াহুড়া করে ফায়সালা করে ফেল না”। অতঃপর তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরকে ডেকে বললেন, “আমি তোমাকে খোদার শপথ দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি বল, যে চাদর দিয়ে আমি জামা বানিয়েছি তা তোমার চাদর কি-না? তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। তখন সালমান বললেন, “এবার বলুন আপনি, কি হুকুম। আমরা শুনবো এবং মানবোও”।
কেউ বলতে পারে যে, এটা তো ওমরের (রাঃ) ব্যাপার। তার সাথে কার তুলনা?
আবু জাফর মনসুরের উদাহরণ নিন। তিনি যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন তার আইনের ভিত্তি শরিয়তের ওপর নয় বরং আমাদের পরিভাষা অনুসারে সামাজিক রসম-রেওয়াজ ও রীতি-প্রথার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সুফিয়ান সওরী তার নিকট গিয়ে বলেন, “আমিরুল মুমেনীন! আপনি আল্লাহ ও মুসলমানদের ধন-সম্পদ তাদের ইচ্ছা ও সম্মতি ছাড়াই ব্যয় করছেন। বলুন এর কি জবাব আছে আপনার কাছে?” হযরত ওমর (রাঃ) একবার সরকারী খরচে হজ্জ করেছিলেন, তাতে তার এবং তার সংগী-সাথীদের ওপর সর্বমোট ষোল দিনার ব্যয়িত হয়েছিল। তথাপি ওমর (রাঃ) বলেছিলেন, আমার মনে হয় আমরা বাইতুল মালের ওপর বিরাট বোঝা চাপিয়েছি। আপনি নিশ্চই জানেন, মনসুর ইবনে আম্মার আমাদেরকে কি হাদীস শুনিয়েছিলেন। কারণ সেই মজলিসে আপনিও ছিলেন এবং সর্বপ্রথম আপনিই হাদীসটা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের সম্পদে নিজের খেয়াল খুশী মত হস্তক্ষেপ করবে তার জন্য দোজখের আগুন অবধারিত রয়েছে”। এতে বাদশাহর ঝানু চাটুকার আবু ওবায়দা নামক কেরানী বলে উঠলো, “কি! আমিরুল মুমেনীনের সাথে এ ধরনের আলাপ!” সুফিয়ান তাকে ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ হতভাগা! হামান ও ফেরাউন এই ভাবেই চাটুকারীতা করে পরস্পরকে ধ্বংশ করেছিল।” এই বলেই দরকার থেকে নিস্ক্রান্ত হন।
স্বৈরাচারী শাসকদের স্বৈরাচার যতই প্রবল হোক, যার হৃদয় জোর্তিময় ছিল এবং যে বস্তুগত প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর বিধানের নিকট পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পন করেছে- তেমন ব্যক্তির ওপর হস্তক্ষেপ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ওয়াসেকও ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক। তার কাছে একবার জনৈক মুসলিম দার্শনিক আগমন করেন। তিনি ওয়াসেককে সালাম করেন কিন্তু তার জবাবে ওয়াসেক বলেন- “লা সাল্লামাল্লাহ আলায়কা” (অর্থাৎ আল্লাহ যেন তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত না করেন)”। এ কথা শোনা মাত্রই তিনি ওয়াসেককে ধমক দিয়ে বলেন, “তোমার শিক্ষকরা তোমাকে অত্যন্ত অভদ্র আচরণ শিখিয়েছে”। আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
“যখন তোমাদেরকে সালাম করা হয় তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম কর অথবা সেটার মতই জবাব দাও”। অথচ তুমি আমাকে উত্তম সালাম করা দূরে থাক সমান সমান জবাবও দাওনি। (আবু হানিফা-জুন্দী)।
বিচারপতি আবু ইউসুফ আদালতের অধিবেশনে বসেছেন। এক ব্যক্তি তার নিকট মোকদ্দমা নিয়ে এলো। আব্বাসী বাদশাহ হাদীর সাথে একটি বাগানের ব্যাপারে তার কোন্দল। আবু ইউসুফ মত পোষণ করেন যে, বাগান ওই লোকটিরই প্রাপ্য। কিন্তু অসুবিধা এই যে, বাদশাহের সাক্ষী ছিল। তিনি বললেন, “বাদী দাবি করছেন যে, বাদশাহর সাক্ষীরা সত্যবাদী এ মর্মে বাদশাহকে শপথ করতে হবে”। হাদী শপথ করাকে নিজের অবমাননা মনে করায় তা অস্বীকার করেন এবং বাগান তার মালিককে ফেরত দেন। অপর একটি মামলায় তিনি হারুনুর রশীদকে শপথমূলক বিবৃতি দিতে বাধ্য করেন। ফজল ইবনুর রবী হারুনুর রশীদের পক্ষে সাক্ষী হয়ে এলে তিনি তার সাক্ষ্য নাকচ করে দেন। খলিফা বিক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “ফজলের সাক্ষ্য নাকচ হবার কারণ কি?” জবাবে আবু ইউসুফ বলেন, “আমি তাকে বলতে শুনেছি যে, আমি আপনার গোলাম”। যদি তার কথা সত্য হয়ে থাকে তাহলে গোলামের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় আর যদি সে মিথ্যুক হয়ে থাকে তাহলে মিথ্যুকের সাক্ষ্য গ্রাহ্য হতে পারে না”।(আবু হানিফা-জুন্দী)
ইসলাম যে ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রদীপ মানুষের বিবেক-মনে প্রজ্জ্বলিত করেছিল, তা ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারময় যুগেও অনির্বাণ ছিল। ইতিহাসের প্রতিটি যুগে বিবেকের এহেন গৌরবদীপ্ত স্বাধীনতার প্রচুর উদাহরণ পরিদৃষ্ট হয়।
মিসরে আহমদ ইবনে তুলুন, বাক্কার ইবনে কাতিবা নামক হানাফী কাজীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। আহমদ তাকে আব্বাসী যুবরাজ মুয়াফ্ফাকের ওপর অভিসম্পাত করার অনুরোধ জানালে তিনি ক্ষণিক থেকে বললেনঃ
—-এরাবিক টেকস্ট—-
“সাবধান! অত্যাচারীদের ওপর অভিসম্পাত”। এতে এক ব্যক্তি আহমদ ইবনে তুলুনকে বলেন যে, বাক্কার আপনাকে (আহমদকে) লক্ষ্য করেই অভিসম্পাত করেছে। এর ফলে ইবনে তুলুন তাকে প্রদত্ত যাবতীয় উপঢৌকন ফেরত চান। এ জিনিসগুলো তিনি যেরূপ সিলমোহর করা অবস্থায় দিয়েছিলেন সে অবস্থায়ই ফেরত পান। অতঃপর ইবনে তুলুন বাক্কারকে একটি ভাড়াটিয়া ঘরে অন্তরীণ করেন। বহুলোক তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ইবনে তুলুনের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আসতো। বাক্কার তাদের সাথে জানালার মধ্য দিয়ে আলাপ করতেন, এরপর ইবনে তুলুন এমন কঠিন রোগে আক্রান্ত হন যে, তার জীবনের কোন আশাই থাকলো না। তখন তিনি বাক্কারের মুক্তির নির্দেশ দেন। যে দূত মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিল তাকে তিনি বলেছেন, “ইবনে তুলুনকে বল, আমি অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে গেছি আর উনি রোগাক্রান্ত। এখন শীগগীরই আমাদের সাক্ষাৎ হবে। আমাদের মাঝে শুধু আল্লাহ ব্যবধান সৃষ্টি করে রেখেছেন”। ইবনে তুলুন মারা গেলে বাক্কার বলতেন, “আহা! বেচারা মারা গেছে!” (আবু হানিফা-জুন্দী)
এই “বেচারা মারা গেছে!” উক্তিটির মধ্য দিয়ে তার এ অনুভূতি মূর্ত হয়ে উঠেছে যে, ইবনে তুলুন ক্ষমতাসীন ছিল সত্য, কিন্তু সে ছিল তার চেয়ে নীচ এবং অসহায়।
আইয়ুবী শাসনামলে মিশরের বাদশাহ ইসমাইল ক্রুসেড-যুদ্ধে ইংরেজদের সহযোগিতা করেন। ইংরেজরা তাকে সুলতান নাজমুদ্দিন আইয়ুবের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে-এই মর্মে আশ্বাস পেয়ে সায়দাসহ কতিপয় এলাকা তিনি ইংরেজদের নিকট হস্তান্তর করেন।কিন্তু আজ্জুদ্দীন ইবনে আব্দুল সালাম এর কঠোর প্রতিবাদ জানালে বাদশাহ রুষ্ট হয়ে তাকে গ্রেফতার করেন। অতঃপর তিনি দূত পাঠিয়ে আজ্জুদ্দীনকে ভীতি ও লোভে প্রদর্শন করেন। দূত তাকে বলে, “আপনি বাদশাহর কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ না করলে আপনাকে সাবেক পদে বহাল করা হবে এবং আপনার আরো পদোন্নতি হবে”। আজ্জুদ্দীন জবাব দেন, “খোদার শপথ! বাদশাহ এসে আমার হাত চুম্বন করুক-তাও আমি বরদাশত করবো না। আসলে তোমরা এক জগতের লোক আর আমি অন্য জগতের লোক”। (আবু হানিফা-আব্দুল হালিম জুন্দী)
জাহির বেবরিসের শাসনামলে শেষ মহিউদ্দিন নবভী দামেস্ক অবস্থান করতেন। তিনি জাহিরকে প্রায়ই সদুপদেশ দিতেন। তিনি কখনো চিঠি দ্বারা কখনো মৌখিক উপদেশ দিতেন। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী তার প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘হুনসুল মহাজারা’তে বাদশাহর নিকট লিখিত তার বহু চিঠি উদ্বৃত করেছেন।এর অধিকাংশ চিঠিতে জনগনের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে কর মওকুফ করার দাবি জানানো হয়েছে। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “এ বছর যথোপযুক্ত বৃষ্টি হয়নি। দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য দ্রব্যের তীব্র অভাব, গবাদি পশুর মড়ক প্রভৃতি কারণে সিরিয়াবাসীরা শোচনীয় অবস্থায় পতিত। এমতাবস্থায় দরিদ্র জনগনের ওপর আপনার অনুগ্রহ প্রদর্শণ করা উচিত। আপনার এবং জনগনের কল্যাণের জন্যই এ কথা বলা। কেননা কল্যাণ কামনাই হচ্ছে ইসলামের মূল কথা”।
বাদশাহ এ উপদেশ শুধু প্রত্যাখ্যানই করলেন না, অধিকন্তু তার প্রতি আলেম সমাজের অসহযোগীতায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “তাতারীরা যখন দেশের ওপর হামলা করে লুটতরাজ চালাচ্ছিল-তখন এই হুজুররা কোথায় ছিলেন?” শেখ মহিউদ্দীন তার এ টিটকারীর কঠোর জবাব দিয়েছিলেন। তিনি নিজের মতামত এবং পূর্বোক্ত উপদেশের পূনরাবৃত্তি করে বলেন, “অমুসলিম হানাদারদের ব্যাপার আর দেশের মুসলিম শাসকদের ব্যাপার সমান হতে পারে না। সেই বিদ্রোহী কাফেররা যখন আমাদের দ্বীনের ওপর বিন্দুমাত্র ঈমান রাখতো না- তখন তাদেরকে আমরা কি উপদেশ দিতে পারতাম এবং তাতে কি লাভ হতো? আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই যে, আমাকে সত্য কথা বলা এবং সদুপদেশ দেয়া থেকে কেউ বিরত রাখতে পারবে না। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, এটা আমার এবং আমার মত অন্যান্যদের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। আর কর্তব্য পালন করতে গিয়ে যে বিপদেরই সম্মুখীন হতে হোক না কেন, সেটা আল্লাহর নিকট মহাকল্যাণের কারণ এবং মর্যাদা বৃদ্ধির সহায়ক হবে। আমি পুরোপুরিভাবে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করছি। আল্লাহ তার বান্দাদের অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিফহাল। আল্লাহর রাসূল আমাদেরকে সত্য কথা বলা সর্বাবস্থায় অব্যাহত রাখতে এবং এ ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দাবাদ গ্রাহ্য না করতে উপদেশ দিয়েছেন। আমরা বাদশাহকে সর্বাবস্থায় ভালবাসি এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তার কল্যাণ কামনা করি”।
শেখ সাহেব এমনি হীত কামনার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চিঠি লিখতে থাকেন। কিন্তু জাহির তার উপদেশ কর্ণপাত না করে আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতির অজুহাতে কর আদায় করা অব্যাহত রাখেন। বাদশাহ নিজের মতামতের পক্ষে আলেমদের ফতোয়া জমা করে রেখেছিলেন। এই সব আলেম তার নির্দেশ অনুসারে ফতোয়া দিয়েছিল। তিনি শেখকে ডেকে অন্যান্য আলেমদের ফতোয়ায় স্বাক্ষর দিতে বলেন। শেখ এতে অত্যন্ত কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, “আমি জানি, তুমি কয়েদী ক্রীতদাস ছিলে। তুমি ছিলে দেউলে। এরপর আল্লাহ তোমার ওপর অনুগ্রহ করেন এবং তোমাকে বাদশাহর মর্যাদায় উন্নীত করেন। আমি জানি, তোমার কাছে জরিদার কাপড় পরিহিত এক হাজার ক্রীতদাস এবং আপদমস্তক স্বর্ণালংকারে মন্ডিত একশো দাসী আছে। এখন তুমি যদি ক্রীতদাসের এই জরিদার কাপড়গুলো এবং দাসীদের অলংকারগুলো খরচ করে দাও তাহলে আমি ফতোয়া দেব যে, তোমার জন্য প্রজাদের নিকট থেকে কর আদায় করা বৈধ”।
জাহির একথা শুনে প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং তাকে তৎক্ষনাৎ দামেস্ক থেকে বহিস্কার করেন। শেখ সিরিয়ার নাভা নামক স্থানে বসবাস করতে থাকেন। পরে সমস্ত আলেমগণ ও ফকীহগণ বাদশাহকে বলেন যে, “ইনি আমাদের সর্বজনমান্য ও সবার সেরা আলেম। তাকে দামেস্কে ফিরিয়ে আনুন”। এতে বাদশাহ তাকে দামেস্কে ফিরে আসার অনুমতি দেন, কিন্তু শেখ তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “যতদিন জাহির ওখানে থাকবে ততদিন আমি আসবো না”। এর একমাস পর জাহির মৃত্যুমুখে পতিত হন। (অধ্যাপক আবু জুহরা কৃত ‘ইবনে তাইমিয়া’ থেকে)।
সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসেও এ ধরনের মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। আমি শুধু দু’টো ঘটনার উল্লেখ করবো।
ইসমাইলের শাসনামলে একবার সুলতান আব্দুল আজীজ মিসরে আগমন করেন। ইসমাইল তার আগমনের প্রতীক্ষার দিন গুনছিলেন, কারণ তার খদেভ উপাধি লাভের ব্যাপারে তার আগমন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। তা ছাড়া সুলতানের সফরের ফলে মিসরের বহু রাজনৈতিক সুবিধাদি পাওয়ার বহু সম্ভাবনা ছিল। এই সময়ে সুলতান কর্তৃক আলেমদের সাক্ষাত দানে এক কর্মসূচী তৈরী
করা হয়। এই সাক্ষাত দানের অনুষ্ঠানে বহু ইসলাম বিরোধী রসম-রেওয়াজ পালিত হয়। তন্মধ্যে একটি ছিল এই যে, আগমনকারীর নতজানু হয়ে ভূমির সাথে মাথা ঠুকে তুর্কী কায়দায় কুর্ণিশ করতে হতো। রাজ প্রাসাদের ব্যবস্থাপকদের ওপর আগত আলেমদেরকে এ সব রসম-রেওয়াজের অনুশীলন দানের দায়িত্ব ছিল, পাছে তারা সুলতানের সামনে ভুল না করে বসেন।
অতঃপর সাক্ষাত অনুষ্ঠান সময় ঘনিয়ে এল, আলেমগণ একে একে ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলেন এবং নিছক পার্থিব স্বার্থের লোভে নিজেরই মত সৃষ্ট জীবের সামনে কুর্ণিশ করে যেতে লাগলেন। তারপর শিখানো পদ্ধতিতে সুলতানের দিকে মুখ করে পেছনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বেরিয়ে এলেন। এই ঘৃণ্য কাজ থেকে মাত্র একজন আলেম রক্ষা পেলেন। তিনি হচ্ছেন শেখ হাসানুল আদাদী। তিনি তুচ্ছ পার্থিব স্বার্থকে ঘৃণাভরে উপেক্ষা করেন এবং আল্লাহর হাতে সমস্ত শক্তি নিহিত এই অনুভূতি জাগ্রত রাখেন। তিনি স্বাধীন মানুষের মত মাথা উচু করে ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সুলতানের সামনে এসে ইসলামী রীতি অনুসারে “আসসালামু আলাইকুম” বলে সালাম করেন। অতঃপর (শাসকের সাথে সাক্ষাত করার সময় কোন আলেমের যেমন করা উচিত) তিনি তাকে আল্লাহকে ভয় করা এবং মানুষের সাথে সুবিচার ও সদয় ব্যবহার করার উপদেশ দেন। তারপর কথা শেষ করে আবার সালাম করেন এবং নির্ভীক স্বাধীন মানুষের মত আবার মাথা উচু করে বাইরে চলে যান।
এসব দেখে দরবারের ব্যবস্থাপক এবং স্বয়ং খদেভের চেতনা বিলোপের উপক্রম হলো। তারা ভাবলেন পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে এবং সুলতানের বোধহয় ক্রোধের কোন সীমা থাকবেনা। তাদের সযত্ন অনুশীলন ব্যর্থ হওয়ায় তারা হতাশায় ভেংগে পড়লো।
কিন্তু সত্য কথার প্রভাব কখনো ব্যর্থ হতে পারে না। ওটা যে শক্তি ও প্রতাপ নিয়ে মন থেকে বেরিয়ে আসে সেই শক্তি ও প্রতাপ নিয়ে অন্যান্যদের মনে উপ্ত হয়। এখানেও তাই হলো। সুলতান বে-ইখতিয়ার বলে ফেললেন যে, তোমাদের এখানে শুধু এই একজনই আলেম রয়েছে। সুলতান শুধু তাকে পুরস্কৃত করলেন এবং অন্য সবাইকে বঞ্চিত রাখলেন।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে খদেভ তওফিক পাশা ও শেখ হাসানুওভীলের মাঝে ‘দারুল উলুমে’।
শেখ হাসানুওভীল ছিলেন দারুল উলুমের অধ্যাপক। তিনি সস্তা মূল্যের মামলী ধরণের জামা (জালবাব) পরিধান করতেন। একদিন দারুল উলুমের অধ্যক্ষ জানতে পারলেন যে, খাদেভ শীগ্গিরই মাদ্রাসা পরিদর্শন করতে আসবেন। তিনি তৎক্ষনাৎ মাদ্রসা পরিস্কার করা ও সাজ শয্যা শুরু করে দিলেন। শেখ হাসানুওভীলকে পোষাক পরিবর্তন করে কাফতান ও জুব্বা (অপেক্ষাকৃত অভিজাত পোষাক) পরিধান করে আসতে বলা হলো। শেখ ইঙ্গিতে এ অনুরোধ মেনে নিলেন।
নির্ধারিত দিনে শেখ তার পুরনো পোষাক পরিধান করেই এলেন। তবে তার হাতে একটা রুমালে একটা কিছু পুটুলির মত বাধা ছিল। তাকে পুরনো পোষাকে দেখে অধ্যক্ষের মুখ-মন্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল। খানিকটা ক্রোধমাখা স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “শেখ! জুব্বা ও কাফতান কোথায়? তিনি রুমালের দিকে ইংগিত করে দেখিয়ে দিলেন যে এখানে আছে। অধ্যক্ষ ভাবলেন যে মেহমানের আগমন আসন্ন হলেই হয়তো উনি পোষাক পরিবর্তন করে নেবে।
কিছুক্ষণ পর প্রতিক্ষিত মেহমান এলেন। সমগ্র মাদ্রাসায় একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। এর পরক্ষণেই এক অপূর্ব ঘটনা সংঘটিত হলো। শেখ হাসানুওভীল হাতের পুটুলীটি নিয়ে খদেভের সামনে হাজির হলেন এবং সম্পূর্ণ নির্বিকার চিত্তে বলেলেন, “ আমাকে লোকেরা বলেছে যে আমাকে অবশ্যই জুব্বা ও কাফতান পরে আসতে হবে। যদি আপনার জুব্বা-কাফতানই চাই তাহলে এই রইলো জুব্বা-কাফতান, আর যদি আপনার হাসানুওভীলকে চাই তাহলে এই যে, হাসানুওভীল উপস্থিত”।
স্বাভাবিকভাবেই খদেভ জবাব দিলেন যে, তার হাসানুওভীলকে চাই।
এ হচ্ছে মুমিনদের প্রকৃত অবস্থা। তাদের ইসলামের সম্মান ছাড়া অন্য কোন সম্মানের আকাংখা থাকে না। তাদের মন-মানস ও বিবেক তুচ্ছ ও অসার মূল্যবোধ এবং ক্ষণস্থায়ী স্বার্থের কোন গুরুত্ব দেয় না। তারা ইসলামের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করে এবং তাকে পুরোপুরিভাবে জীবনে কার্যকরী করে। তারা ইসলামের দুর্জয় প্রাণশক্তি অর্জন করার পর কোন মানুষকে সন্তুষ্ট করা প্রয়োজন বোধ করে না। বস্তুতঃ এটাই হলো প্রকৃত ইসলাম।
বিজিত দেশসমূহের সাথে ব্যবহার
বিজিত দেশসমূহের অধিবাসী এবং মুসলিম দেশসমূহের অমুসলিম জাতি সমূহের সাথে যে ব্যবহার করা হয়েছে, এবার আমরা সে সম্পর্কে পর্যালোচনা করবো। কারণ সাম্য, সুবিচার ও বিবেকের স্বাধীনতার সাথে এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম প্রবর্তিত এই সাম্য ও সুবিচার ব্যক্তি, গোষ্ঠি ও ইসলামের পরিধি ছাড়িয়ে সমগ্র মানবতার সাথে যুক্ত হয়েছে।
বিজিত দেশসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে দেশ জয়ের ব্যাপারে ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও কার্যকারণের প্রসঙ্গ স্বভাবতঃই এসে পড়ে। এটা একটা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। আমরা এ সম্পর্কে শুধু যতটুকু অপরিহার্য এবং ইসলামের বিশ্বজনীন সামাজিক ন্যায়-নীতির সাথে সম্পৃক্ত ততটুকুই আলোচনা করবো।
ইসলামী দাওয়াত মানুষের বিবেক ও মন-মগজকে আবেদন জানায়। এতে বল প্রয়োগ ও বাধ্যবাধকতার অবকাশ নেই। এমনকি পূর্ববর্তী ধর্মগুলোতে অলৌকিক ঘটনাবলীর আকারে যে মনস্তাত্মিক বল প্রয়োগ প্রচলিত ছিল ইসলাম তাকেও প্রশ্রয় দেয়নি। ইসলামই একমাত্র বিধান, যা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও চেতনা-অনুভূতির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে, তাকে অলৌকিক ঘটনা বা মোজেজার মাধ্যমে সম্মোহিত করা এবং মনস্তাত্মিক উপায়ে প্রলুব্ধ করার পরিবর্তে তাকে সাদাসিদে ভাষায় সম্বোধন করে ক্ষান্ত হয়েছে। তরবারীর শক্তি দ্বারা মানতে বাধ্য করার পন্থা সে কখনো অবলম্বন করেনি।
————এরাবিক টেক্সট——
“জীবন বিধানের ব্যাপারে বল প্রয়োগের অবকাশ নেই”।
————এরাবিক টেক্সট——
“সদুপদেশ ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে তোমার প্রভুর পথে আহবান জানাও আর উত্তম পন্থায় বিতর্ক কর”।
কিন্তু কোরাইশরা প্রথম দিন থেকেই বস্তুগত শক্তি দ্বারা এই নতুন জীবন বিধানের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। আল্লাহতায়ালা যাকেই ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন, তার ওপর তার অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে। কিছু সংখ্যক মুসলমানকে তারা তাদের ঘর-বাড়ী, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। তাদেরকে পর্বতের গুহায় আটক রেখে সামাজিক ‘বয়কট’ করে অনাহারে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে। মোট কথা, মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে রাখার জন্য বস্তুগত শক্তি ব্যবহারের কোনো পন্থাই তারা বাদ রাখেনি।
এমতাবস্তায় ইসলামের অনুসারীদেরকে জুলুম থেকে রক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না-
————এরাবিক টেক্সট——
“যাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাদেরকে অস্ত্র ধারনের অনুমতি দেয়া গেল। কেননা তার মজলুম। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম”।
————এরাবিক টেক্সট——
“যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর। অবশ্য বাড়াবাড়ি করো না। কারণ সেটা আল্লাহ পছন্দ করেন না”।
এরপর এক সময়ে সমগ্র আরব উপদ্বীপ ইসলামের ছায়াতলে এসে যায়। দেশ জয়ের ধারাবাহিকতা আরবের বাইরে পদার্পণ করে। প্রশ্ন জাগে যে, এই দেশ জয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি ছিল?
আগেই বলেছি, ইসলাম আপনাকে একটা আন্তর্জাতিক মতাদর্শ ও বিশ্বজনীন জীবন বিধান পেশ করেছে। সে নিজেকে কোন বিশেষ উদ্দীপনার চতুর্সীমায় আবদ্ধ করতে পারে না। নিজের কল্যাণ ধারাকে সে বিশ্বের প্রতিটি কোণে এবং সমগ্র মানব জাতির নিকট পৌঁছিয়ে দিতে চায়। কিন্তু পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় রোম ও পারস্যের দুই বিশাল সাম্রাজ্য। তারা তাকে ধ্বংস করার জন্য ওৎ পেতে বসে থাকে। এই শক্তি ইসলামী আন্দোলনের নিশানবাহীদেরকে পৃথিবীতে ঘুরে ফিরে লোকদের নিকট ইসলামের মর্মবাণী পৌঁছে দেয়ার সুযোগ দিতে প্রস্তুত ছিল না। এমতাবস্থায় খোদায়ী বিধান ও সাধারণ মানুষের মাঝে যে রাষ্ট্রীয় শক্তি অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা অপসারণ করা ছাড়া ইসলামের গত্যন্তর ছিল না। এই বাধা অপসারনের পর সে মানুষকে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করা এবং মানুষের আনুগত্য ও গোলামী থেকে মুক্ত হবার সুযোগ দেয়। বাতিল ব্যবস্থার স্থলে ইসলামী ব্যবস্থা কায়েম হবার এ হচ্ছে মর্মার্থ। এতে মানুষ অবাধ বাক-স্বাধীনতা লাভ করে। রাষ্ট্রীয় শক্তির বাধা অপসারিত হওয়া এবং আল্লাহর বিধানের বিজয়ের পর আনুগত্য শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং মানুষ মানুষের গোলামী থেকে মুক্তি লাভ করে। এরপর যার ইচ্ছা হবে স্বেচ্ছায়-সানন্দে ও পূর্ণ অধিকার নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে, যার ইচ্ছা হবে না- গ্রহণ করবে না। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব নীতি নিজেরই নির্ধারণ করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কোরআনের নিম্নোক্ত ঘোষনায় দ্বীন বা আনুগত্য কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হওয়ার এটাই মর্মার্থ-
————এরাবিক টেক্সট——
“এই কাফেরদের সাথে সংগ্রাম কর যতক্ষণ পর্যন্ত আনুগত্য পুরোপুরিভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে না যায়”। এখানে দ্বীন শব্দের অর্থ হচ্ছে আনুগত্য। উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ মানুষের কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের অধীন হবে। অতঃপর কোন বাধা বিপত্তি ও জোর-জবরদস্তি ছাড়াই নিজেদের আকিদা-বিশ্বাস নিজেরাই নির্বাচন করে নেবে।
এই ব্যাখ্যার আলোকে এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, ইসলামের দেশ জয়মূলক ঘটনাবলী শক্তিমদমত্ত জাতি সমূহের শোষণ-নিষ্পেষণের উদ্দেশ্য বিজাতির বিরুদ্ধে পরিচালিত সম্প্রসারণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সমূহ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের। এ যুদ্ধসমূহের তাৎপর্য শুধু এই যে, এগুলো ছিল ইসলামের আনীত নতুন আকিদা-বিশ্বাস ও মতাদর্শের মধ্যে ও অন্য জাতিগুলোর মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রীয় শক্তি অপসারনের সংগ্রাম। এটা জাতিগুলোর জন্য ছিল নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংগ্রাম, আর তাদের ওপর বস্তুগত শক্তির সাহায্যে খোদা হয়ে সওয়ার থাকা রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে বন্তুগত ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
ইসলাম নিজেকে গোটা মানব জাতির বিধান মনে করে এবং নিজের প্রচার ও প্রসারের ব্যাপারে বস্তুগত শক্তি প্রয়োগ করে না। নিজের এই মূলনীতি অনুসারে সে বিশ্বের সমস্ত জাতির সামনে তিনটে পথ রেখেছে। প্রত্যেক জাতিকে তার একটা না একটা গ্রহণ করতে হবে- ইসলাম গ্রহণ, জিজিয়া দেয়ার মাধ্যমে সহযোগিতা ও আনুগত্য প্রকাশ অথবা যুদ্ধ।
বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্য তার “ইসলাম গ্রহণের” আহ্বান নিঃসন্দেহে ন্যায় সংগত। কারণ এটাই হল একমাত্র হেদায়েতের পথ। এটা খোদা, মানুষ, জীবন ও জগত সম্পর্কে সর্বাধুনিক ও পরিপূর্ণতম মতবাদ। এটা সেই সিংহদ্বার- যেখান দিয়ে প্রবেশ করার পর একজন অমুসলিম সমস্ত মুসলিমানের ভাই হয়ে যায়, মুসলমানদের মতই তার অধিকার এবং মুসলমানদের মতই তার কর্তব্য স্থির হয়। বর্ণে, বংশে, ধনে, মানে- কোন দিক দিয়ে অন্য কোন মুসলমান এই নতুন মুসলমানের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করতে পারে না।
জিজিয়ার আহ্বানও অনুরূপ। দেশ রক্ষার জন্য মুসলমানদের জান পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়। সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তারা যাকাতও দেয়। একজন অমুসলিমও ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে। আভ্যন্তরীণ, বৈদেশিক এবং অন্য যাবতীয় সুযোগ সুবিধা উপভোগ করার ব্যাপারে সে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্য সকলের সাথে সমান অংশীদার। বার্ধক্যে কিংবা অক্ষমতায় সে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুবিধাও উপভোগ করতে পারে। এমতাবস্থায় ইনসাফ ও ন্যায়-নীতির দাবী এই যে, এ সব কাজে তারও নিজ অর্থ দ্বারা শরীক হওয়া উচিত। যাকাতে যেহেতু আর্থিক করের চেয়ে ইবাদতের বৈশিষ্ট্যই অধিকতর বিরাজমান, তাই ইসলাম তাদেরকে এই ইবাদাত পালনে বাধ্য করে না। কেননা ইসলামকে যারা গ্রহণ করেনি তাদের আবেগ অনুভূতিকেও ইসলাম শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে। এ জন্য সে তাদের নিকট থেকে যাকাতের পরিবর্তে জিজিয়ার আকারে কর আদায় করে। জিজিয়া ধার্য করার সময় এ কথা লক্ষ্য রাখা হয়েছে যে, দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার প্রয়োজন হলে সেটা শুধু মুসলমানরাই করে থাকে। এছাড়া জিজিয়া আনুগত্য ও আত্মসমর্পনেরও নিদর্শন। এ থেকে বোঝা যায় যে, জিজিয়া দানকারীরা শক্তির মাধ্যমে ইসলামের পথে বাধার সৃষ্টি করবে না এবং জনগণের কাছে ইসলাম পৌঁছে দেয়ার পথে কেউ অন্তরায় হবে না। এটাই ছিল ইসলামের উদ্দেশ্য।
সর্বশেষ পন্থা হচ্ছে যুদ্ধ। ইসলাম এবং জিজিয়া- এ দুটোই প্রত্যাখ্যান করার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, সে (অর্থাৎ অমুসলিম) ইসলাম ও সাধারণ মানুষের মাঝে অন্তরায় হয়ে থাকতে বদ্ধপরিকর। এমতাবস্থায় শক্তির বলে বলিয়ান হয়ে প্রদর্শিত এ স্পর্ধাকে মুক্তি দিয়েই খতম করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। কেননা এ ছাড়া এর আর কোন ওষুধ নেই।
ইসলাম বিজিত দেশগুলোতে নিজের মানবিক ও আন্তর্জাতিক কর্মসূচীকে যথাযথরূপে বাস্তবায়িত করেছে। ইসলাম গ্রহণ করলে সে সেই অধিবাসীদেরকে সকল ব্যাপারে মুসলমানদের সমান অধিকার দিয়েছে। জিজিয়া দিলেও তাদেরকে সব উচ্চতর মানবাধিকারে সমৃদ্ধ করেছে। এমনকি যুদ্ধের পরিস্থিতিতেও সে তাদের সাথে ব্যবহারে ইনসাফ ও মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
কোন বিজিত দেশের শাসনকর্তা ইসলাম গ্রহণ করার পর ইসলাম যথারীতি তাদেরকে সেখানকার শাসনকর্তা হিসাবে বহাল রেখেছে। পারস্য বংশোদ্ভূত ‘বাজান’ কে হযরত আবু বকর (রাঃ) ইয়ামানের শাসনকর্তা হিসেবে বহাল রাখেন। এমনিভাবে সানার শাসনকর্তা পারসিক ফিরোজকে তার পদে নিয়োজিত রাখেন। আরব বংশোদ্ভূত কায়েস ইবনে আবদে ইয়াগুস যখন ফিরোজকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে তখন আবু বকর (রাঃ) আরবী মুসলমানের বিরুদ্ধে পারসিক মুসলমানের সাহায্য করেন এবং তাকে পুনরায় সেখানে এনে পূর্বপদে বহাল করেন। এমনিভাবে মুসলমানরা অধীনস্থ কর্মচারীদেরকে এবং আমীরের নিম্নপদস্থ অমুসলিম কর্মকর্তাদেরকে স্বপদে বহাল রাখেন।
যারা ইসলামও গ্রহণ করে না- এবং জিজিয়াও দিতে স্বীকৃত হয় না বরং যুদ্ধের পথ বেছে নেয়- সেই সব বিদ্রোহীর যাবতীয় ধনসম্পদ বিজেতা কর্তৃক করায়ত্ব করা ইসলামী আইন অনুসারে সম্পূর্ণ বৈধ। এ সত্ত্বেও হযরত ওমরের (রাঃ) যুগে যখন পারস্য বিজিত হয়, তখন তিনি ইসলামের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের দাবিতে অন্য এক নীতি প্রবর্তন করেন। তিনি ভূমির ওপর যথারীতি ভূমি মালিকদের স্বত্বাধিকার স্বীকার করেন, তবে তার ওপর খাজনা ধার্য করেন। তিনি একাধারে দুটো স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রাখেন। একটি হলো স্বয়ং বিজিত দেশগুলোর স্বার্থ, যদিও তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল; তথাপি তিনি তাদের জীবিকার উপায় হরণ করতে চাননি। দ্বিতীয় স্বার্থ ছিল মুসলমানদের পরবর্তী বংশধরদের। সমস্ত ভূমি বর্তমান বিজেতাদেরকে দিয়ে দিলে ভবিষ্যৎ বংশধররা তার ফল থেকে বঞ্চিত হতো।তাই তিনি মনে করলেন ভুমি থেকে খাজনা গ্রহণ করার পন্থাই উত্তম। এতে করে লব্ধ অর্থ সব সময় জনকল্যাণে ব্যয় করা যাবে এবং ভবিষ্যতের বংশধররাও তা থেকে যুক্তিসঙ্গত অংশ পেতে থাকবে।
এটা একটা সর্ববাদী সম্মত সত্য কথা যে, বিজিত দেশগুলোর সাথে ইসলাম সর্বদা অতি উন্নতমানের মানবিক আচরণ করেছে। মানুষকে সে তার সৌন্দর্য, বৈশিষ্ট্য ও কল্যাণকর গুণাবলী দ্বারা উপকৃত হওয়ার অবাধ ও শর্তহীন সুযোগ দিয়েছে। অধিকন্তু এগুলোর দ্বারা উপকৃত হওয়ার জন্য সে বর্ণ, বংশ, ভাষা ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে আহ্বানও জানিয়েছে। প্রত্যেককে সমাজ কল্যাণের জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করার সুযোগ দিয়েছে। ইসলামের একটা বিশেষ বিভাগে অর্থাৎ আইন ও ফেকাহ শাস্ত্রে বিজিত দেশের অধিবাসীরা ও দাস শ্রেণীর লোকেরা বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিল। গণজীবনের কোন একটি উল্লেখযোগ্য বিভাগেও আরবদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল না। এমনকি আমীর ও শাসনকর্তার পদেও এমন সব লোক নিযুক্ত করা হতো, যারা সংশ্লিষ্ট দেশের অতিরিক্ত রাজস্ব প্রথমে সে দেশের কল্যাণ খাতে ব্যয় করতো এবং এর শুধু অবশিষ্টাংশই কেন্দ্রীয় বায়তুলমালে জমা করতো। বিজিত দেশগুলো উপনিবেশের পর্যায়ভুক্ত ছিল না এবং বিজেতাদের জন্য দেশবাসীর জানমাল নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য ব্যাবহার করার অবকাশও ছিল না। ঠিক অনুরূপ ভাবে ইসলাম বিজিত দেশগুলোর অধিবাসীদেরকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের অতুলনীয় স্বাধীনতা দিয়েছে। তাদের ইবাদতখানা, খানকা, গির্জা এবং আলেমদের ও ধর্মযাজকদের সংরক্ষণের দায়িত্ব ইসলাম স্ব-হস্তে গ্রহণ করেছে। সে তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ও প্রতিশ্রুতিগুলো এমন সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে যার কোন নজির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধের ইতিহাসে মেলা দুষ্কর। আজও এ ব্যাপারে ইসলামের প্রবর্তিত রীতিই বহাল রয়েছে।
আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা হতভাগ্য উপনিবেশগুলোর সাথে যে ব্যাবহার করে, তার সাথে যখন আমরা ইসলামের তুলনা করি, তখন ইসলামকে তার ইতিহাসের প্রত্যেক যুগে সবচেয়ে উদার, সবচেয়ে মহৎ ও সবচেয়ে পবিত্র আদর্শ হিসেবে উজ্জ্বল ও ভাস্বর দেখতে পাই। আজ আমরা দেখতে পাই যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন ও অর্থনৈতিক উন্নতি-অগ্রগতির ব্যাপারে পাশ্চাত্য সভ্যতার গুণ বৈশিষ্ট্য থেকে ঔপনিবেশিক দেশগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যাতে যত দীর্ঘদিন সম্ভব তাদেরকে দুধের গাভীর মত দোহন করা যেতে পারে। তা ছাড়া ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পর্যায়ে মানবীয় মান-সম্মান ও ভদ্র রীতি-নীতিকে জলাঞ্জলি দেয়া, ইচ্ছাকৃত ভাবে নৈতিক নৈরাজ্য বিস্তার করা, গোষ্ঠীগত ও দলগত বিদ্বেষ সৃষ্টি করা ও তা সম্প্রসারিত করা এবং অর্থনৈতিক শোষণ-নিপীড়ন চালানো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
পাশ্চাত্যবাসীরা আজ ধর্মীয় স্বাধীনতার বড় বড় বুলি আওড়ান বটে কিন্তু তাদের পূর্বতন ইতিহাস স্পেনের তথাকথিত আদালতগুলোর পাশবিক শাস্তি এবং প্রাচ্যে ক্রুসেড যুদ্ধের নৃশংসতা দ্বারা কলংকিত। আজও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিছক একটি প্রদর্শনী মাত্র। উদাহরণ স্বরূপ দক্ষিণ সুদানে খ্রিস্টান মিশনারীদের সকল সুযোগ সুবিধা থাকলেও মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। গত মহাযুদ্ধে জনৈক ইংরেজ সেনাপতি এ্যালেন বী (Allen by) বায়তুল মুক্ককাদাসে প্রবেশ করার সময়ে ইউরোপের প্রতিটি মানুষের মানসিকতার রূপ এই বলে তুলে ধরেন যে “প্রকৃতপক্ষে ‘ক্রুসেড যুদ্ধ’ আজ শেষ হল।” ফরাসি জেনারেল কাট্টো ১৯৪০ শালে দামেস্কে বিপ্লব অনুষ্ঠানের পর সেখানে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমরা ক্রুসেড যোদ্ধাদের বংশধর। আমাদের সরকার যাদের পছন্দ না হয়, তারা এখান থেকে চলে যেতে পারে।” ঠিক এই ধরনেরই কথা তার এক সম-মতাবলম্বী ১৯৪৫ সালে আলজিরিয়াতে বলেছিলেন।
সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অবস্থা আরও সাংঘাতিক। সেখানে মুসলমানদেরকে ক্রমশঃ নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চলছে। মাত্র সিকি শতাব্দীতে রাশিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা চার কোটি দু’লাখ থেকে কমে দু’কোটি ছ’লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। যে রেশন কার্ড ছাড়া সেখানে জীবনযাপনের উপায় উপকরণ মেলা সম্ভব নয় তা থেকেও আজকাল মুসলমানদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাদের বলা হয়, “তোমাদের যখন খুশি নামাজ পড়ার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু সরকার তোমাদেরকে খাদ্য দিতে পারবে না। তোমরা তোমাদের খোদার কাছে খাদ্য চাও।” এমনি ব্যবহার তাদের সাথে যুগোস্লাভিয়া এবং অন্যান্য দেশেও করা হয়।
ইসলাম চিরদিনই সর্বাত্মক ও সার্বজনীন সামাজিক সুবিচারের এমন উন্নত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে- যার ধারে কাছেও ইউরোপীয় সভ্যতা যেতে পারেনি। আর কোনদিন পারবেও না, কেননা ওটা হচ্ছে নিছক জড়বাদী ও বস্তুবাদী সভ্যতা। নরহত্যা, লুটতারাজ, রক্তপাত, হিংস্রতা ও নৃশংসতার ওপরই ওর ভিত্তি প্রথিষ্ঠিত। [এ সম্বন্ধে বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য গ্রন্থকারের “আসসালামুল আলমী আল-ইসলাম (বিশ্বশান্তি ও ইসলাম) এবং “দিরাসাতুন ইসলামিয়া’র ‘ইসলামের দেশ জয়ের প্রকৃতি ও তাৎপর্য’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]
পারষ্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সবল ও দুর্বল, ধনী ও নির্ধন, ব্যক্তি ও সমাজ, শাসক ও শাসিত এবং এমনিভাবে সকল মানব মণ্ডলীর মধ্যে দয়া, সহানুভূতি, হীতকামনা ও পারষ্পরিক সহযোগিতার যে গুণাবলী ইসলামের কাম্য সে সম্পর্কে ইতিহাস থেকে কতিপয় বাস্তব উদাহরন পেশ করবো। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের উদাহরণ মালায় পরিপূর্ণ।
ইসলাম গ্রহণের সময় আবু বকর (রাঃ) এর নিকট ব্যবসায়ের মুনাফালব্ধ চল্লিশ হাজার দিরহাম ছিল। ইসলাম গ্রহণের পরও তিনি ব্যাবসা করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু যেদিন তার মহান বন্ধু হযরত মুহাম্মাদ সাঃ এর সাথে মদিনায় হিজরত করেন সেদিন তার এত পুঁজির মাত্র পাঁচ হাজার দিরহাম অবশিষ্ট ছিল। নিজের অবশিষ্ট সমস্ত পুঁজি তিনি নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলিম গোলামদের স্বাধীন করার জন্য ব্যয় করেন, এ সম্পদ থেকে তিনি দরিদ্র সর্বহারাদেরকে সাহায্য করতেন।
হযরত ওমর (রাঃ) ছিলেন নিতান্ত দরিদ্র। খয়বরে তিনি এক টুকরো ভূমি লাভ করেন। তিনি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট এসে বলেন, “আমি খয়বরে খানিকটা জমি পেয়েছি। এত মূল্যবান সম্পত্তি আমি কোন দিন পাইনি। এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে বললেন “যদি তোমার মনে চায় তবে আসল জমি নিজের অধিকারে রেখে তার লভ্যাংশ দান করে দিও।”
হযরত ওমর (রাঃ) সেটা গরিব-দুঃখী, অভাবী আত্নীয়-স্বজনের জন্য, গোলামদেরকে স্বাধীন করার জন্য এবং দুর্বল-অক্ষম লোকদের সাহায্যে ও জনকল্যাণমূলক কার্যাবলীর জন্য ওয়াক্ফ করে দেন। এভাবে তিনি নিজের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ আল্লাহ্র পথে দান করে কোরআনের এই উক্তির সার্থকতা প্রমাণ করেনঃ
————এরাবিক টেক্সট——
“তোমরা যতক্ষণ নিজেদের প্রিয় সম্পদকে আল্লাহর পথে ব্যয় না করবে ততক্ষণ প্রকৃত কল্যাণ অর্জনে সক্ষম হবে না।”
খেলাফতের পূর্বে হযরত ওসমানের নিকট সিরিয়া থেকে একটি বাণিজ্য বহর আসে। এই বহরে গম,জয়তুনের তেল ও মোনাক্কাবাহী এক হাজার উট ছিল। এই সময়ে দুর্ভিক্ষের দরুন মুসলমানগণ শোচনীয় দুর্দশায় পতিত ছিলেন। বহু ব্যবসায়ী তার কাছে এসে বলে, “দেশে খাদ্য দ্রব্যের চাহিদা কত তীব্র তাতো আপনি ভাল করেই জানেন। এই দ্রব্য সম্ভার আমাদের নিকট বিক্রি করে দিন।” হযরত ওসমান (রাঃ) বলেন, “স্বাচ্ছন্দে বিক্রি করতে পারি কিন্তু আমাকে কত মুনাফা দেবে তাই বল।” ব্যাবসায়ীরা বললো, “দ্বিগুণ মূল্য দেব।” হযরত ওসমান (রাঃ) বলেন, “আমাকে তো এর চেয়ে অনেক বেশী মুনাফা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।” তারা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনার বাণিজ্য বহর এইমাত্র এলো, আর ওটা পৌঁছানো মাত্রই আমরা মদিনার সমস্ত ব্যাবসায়ী হাজির হয়েছি। অন্য কেউ তো আপনার সাথে আমাদের পূর্বে সাক্ষাত করেনি। তা হলে কোন ব্যক্তি আপনাকে এত মুনাফা দিতে চেয়েছে?” হযরত ওসমান (রাঃ) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা আমাকে দশগুণ মুনাফা দেয়ার ওয়াদা করেছেন। তোমরা কি আমাকে এর চেয়ে বেশী দিতে পার?” তারা বললো, “না”। তখন হযরত ওসমান (রাঃ) আল্লাহকে সাক্ষী করে ঘোষণা করলেন যে, “এই বাণিজ্যে বহরের সমস্ত সম্পদ আল্লাহর উদ্দেশ্য দরিদ্র ও মিসকিনদের জন্য সদ্কা করে দিলাম।”
হযরত আলীর (রাঃ) পরিবারে একদিন মাত্র তিনটে জবের রুটি ছিল। এই রুটি কয়টি তিনি একজন ইয়াতিম, একজন মিসকিন, ও একজন কয়েদীকে দান করে দিলেন। তিনি তাদেরকে তৃপ্তির সাথে খাইয়ে নিজে সপরিবারে অভুক্ত অবস্থায় নিদ্রা গেলেন।
হরত হোসাইনের ওপর ঋণের ছাপ বেড়ে গেছে। আবি নাইজারের নির্ঝরিণী তার মালিকাধিন, ইচ্ছা করলে সেটা বিক্রি করে তিনি ঋণ পরিশোধ করতে পারেন। কিন্তু গরীব মুসলমানরা তা থেকে সেচ কার্য সম্পন্ন করে, সে জন্য তিনি তা বিক্রী করলেন না। অথচ বনু হাশেমের শ্রেষ্ঠ পরিবারের সন্তান হয়ে ঋণের বোঝা বয়ে বেরাতে লাগলেন।
মদিনায় আনসাররা মুহাজেরদেরকে নিজ নিজ সম্পত্তি, ঘরবাড়ী সকল জিনিসেরই অংশীদার করেন। তাদেরকে নিজেদের ভাই বলে গ্রহণ করেন। তাদের পক্ষ থেকে দিয়াত(অনিচ্ছাকৃত হত্যা বা জখমের আর্থিক ক্ষতিপূরণ) দিয়ে দেন, তাদের কয়েদিদেরকে ফিদিয়া দিয়ে মুক্ত করেন। এক কথায় তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে আপন করে নেন। কোরআনের ভাষায়ঃ
————এরাবিক টেক্সট——
“তারা যা কিছু মুহাজেরদেরকে দেয় সে সম্পর্কে মনে কোন কুণ্ঠা বা সংকোচ বোধ করে না। তারা নিজ স্বার্থের ওপর অপরের স্বার্থকে অগ্রগণ্য মনে করে, এমনকি যদি তাদেরকে অভুক্তও থাকতে হয়।”
বস্তুতঃ যতদিন মুসলিম দেশগুলো পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবমুক্ত থাকে ততদিন তাদের সমাজ জীবনে এই প্রাণশক্তি সক্রিয় থাকে। জনাব আবদুর রহমান আযযাম তার গ্রন্থ “আর রিসালাতুল খালিদা”য় লিখেছেনঃ
“আমি উত্তর আফ্রিকার তাওয়ারেক গোত্রকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তার ভিত্তিতে জীবন যাপন করতে দেখেছি। তাদের গোত্রে কোন ব্যক্তিই শুধু নিজের জন্য নয় বরং গোটা সমাজের জন্য জীবন ধারণ করে। তারা যে কাজ সমাজের জন্য করে তাতেই তারা সবচেয়ে বেশী গর্ব অনুভব করে। একটা অপূর্ব ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। জনৈক শহরবাসী ফরাসিদের এলাকা থেকে হিজরত করে তাওয়ারেকদের নিকট ‘ফাজানে’ বসবাস এবং তাদের কৃপাদৃষ্টির ওপর জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। অতঃপর সে জীবিকার সন্ধানে বের হয়। সে তাদের দানের প্রতিদান দিতেও সংকল্পবদ্ধ ছিল। সে তার পরিবার পরিজনকে ঐ মুসলিম গোত্রের তত্তাবাধানে রেখে আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সে কোন চাকরির সন্ধান পেলো না। সে আমাদের নিকট ‘মিসরাতা’ নামক স্থানে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এলো। আমরা তাকে, যাতে সে পরিবারবর্গের নিকট ফিরে যেতে পারে সেই পরিমাণ সাহায্য করলাম। কিন্তু সে প্রায় এক বছর পর আবার আমাদের নিকট ফিরে এলো। আমরা মনে করলাম যে, সে তার পরিবারবর্গের নিকট থেকে ফিরে আসছে। কিন্তু সে আমাদের ধারণা খণ্ডন করে বলে যে, সে এখন নিজ পরিবারবর্গের নিকট যাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, “কিভাবে?” সে বললো, “গত সাক্ষাতের সময় আমি যে টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়ে ব্যাবসা করেছি। এখন আমার নিকট যে টাকা সঞ্চিত হয়েছে তা নিয়ে আমি তাওয়ারেকদের নিকট যেতে পারবো।” আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি নিজের পরিবারের নিকট যাবে- না তাওয়ারাকদের নিকট?” সে বললো, “আমি প্রথমে তাওয়ারাকেদের নিকট যাব, কেননা তারা আমার অনুপস্থিতিতে আমার পরিবারবর্গের তত্ত্বাবধান করেছে। এখন আমি গিয়ে তাদের মধ্যে যারা নিজ পরিবার থেকে অনুপস্থিত রয়েছে তাদের পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণ চালাবো এবং নিজের উপার্জিত অর্থ নিজের এবং প্রতিবেশীদের সন্তান-সন্ততির মধ্যে বণ্টন করে দেব।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমাদের সমাজে কি প্রতিবেশীদের পারস্পরিক সম্পর্ক কি এরূপই?” সে বলল, “হাঁ, আমারা সকলে সুখে-দুঃখে পরস্পরের অংশীদার হই। আমারা বিদেশ থেকে খালি হাতে বাড়ি যেতে অত্যন্ত লজ্জাবোধ করি। কারণ আমাদের প্রতিবেশীরাও ঠিক আমাদের পরিবারবর্গের মতই আমাদের পথ চেয়ে থাকে।
এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার পর গ্রন্থকার এ সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে গিয়ে ঘটনার অত্যন্ত নির্ভুল ব্যাখ্যা দেনঃ
“সমাজ জীবনের এ বিচিত্র পদ্ধতি শুধু তাওয়ারেক গোত্র কিংবা বেদুঈন যাযাবরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা তাদের গোত্রবাদেরও ফল নয়। এটাই হচ্ছে আসল ইসলামী পদ্ধতি। আধুনিক জড়বাদী ও বস্তুবাদী সভ্যতা থেকে যারা বহু দূরে অবস্থিত- সে সমস্ত গোত্রের মধ্যেই এ সমাজ ব্যবস্থার অত্যন্ত ব্যাপক প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। আমি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বহু শহর বন্দরকে ইসলামী ভাবাপন্ন দেখেছি এবং শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ ও আরব-অনারব নির্বিশেষে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে এরূপ সমাজ পদ্ধতির প্রচলন দেখেছি। আমি বহু জায়গায় আজও মুসলমানদেরকে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে অত্যন্ত সুখী জীবন-যাপন করতে দেখেছি। তারা নিঃসন্দেহে পাশ্চাত্য জড়বাদীর সভ্যতার পূজারী কোটি কোটি মানুষের তুলনায় অধিক সুখী ও সমৃদ্ধশালী। তারা আজও হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কায়েম করা সমাজ ব্যবস্থার খুবই নিকটবর্তী। পাশ্চাত্য পূজারী মানুষ সমাজের বিরাট ক্ষতি ও বিপর্যয়ের বিনিময়েও নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের অগ্রাধিকারে বিশ্বাসী। নিজের ব্যক্তিগত খেয়াল খুশি ও প্রবৃত্তির কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য প্রয়োজন হলে তারা নিজ পরিবারেরও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করতে দ্বিধাবোধ করে না, প্রতিবেশীর স্বার্থে সদ্বব্যবহারের তো প্রশ্নই ওঠে না।”
প্রকৃত ব্যাপার হলো, এই পারস্পারিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ইসলামের প্রাণশক্তিরই সৃষ্টি। কিন্তু এটাকে শুধু ব্যক্তির ও সমাজের বিবেকের বা দয়া-মায়ার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। সরকারও এটা কার্যকরী করার ব্যবস্থা করতো। হযরত ওমর (রাঃ) কর্তৃক ‘বাইতুল মাল’ থেকে মাতৃদুগ্ধত্যাগী শিশু, বৃদ্ধ ও রুগ্ন লোকদের জন্য মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করা এর প্রকৃষ্ট উদাহরন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই ব্যয়ের খাতগুলো যাকাতের সুপরিচিত ব্যয়ের খাত থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। স্বীয় প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ খাতকে ‘সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ (Social security) বলে অভিহিত করা যেতে পারে। তিনি দুর্ভিক্ষের সময় চুরির শাস্তি রহিত করেছিলেন। কেননা হয়তোবা তীব্র ক্ষুধা কাউকে চুরি করতে উদ্বুদ্ধ করে থাকবে। ইসলামে সন্দেহের ভিত্তিতে দণ্ডবিধি মওকুফ করা হয়ে থাকে। নিম্নোক্ত ঘটনা সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাস্তবায়নের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পেশ করে এবং এ থেকে ব্যক্তি মালিকানার প্রকৃত সরূপ ও সীমারেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বর্ণিত আছে যে, আব্দুর রহমান ইবনে হাতেব বালতায়ার কতিপয় গোলাম মোজাইনা গোত্রের একটি উট চুরি করে। তাদেরকে ধরে হযরত ওমরের (রাঃ) দরবারে নেয়া হলে তারা চুরির কথা স্বীকার করে। হযরত ওমর (রাঃ) কাছির ইবনুচ্চালতকে নির্দেশ দেন তাদের হাত কেটে দিতে। সে যখন হুকুম তামিল করতে এগিয়ে গেল, ওমর (রাঃ) তাকে থামলেন এবং বললেন, “শোন আমি জানতে পেরেছি যে, তোমরা ঐ গোলামদের থেকে প্রচুর পরিশ্রম নিয়ে থাক অথচ তাদেরকে অভুক্ত রাখ? এমনকি তাদের ক্ষুধা এতো তীব্র হয় যে তারা হারাম জিনিস খেলেও তা বৈধ হয়। আমি খোদার শপথ করে বলছি যে, এটা জানতে না পারলে আমি ওদের হাত কেটে দিতাম।” অতঃপর তিনি আব্দুর রহমান ইবনে আবি হাতেব ইবনে আবি বালতায়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন “আমি ওদের হাত কাটলাম না সত্য, তবে আমি তোমার ওপর এমন জরিমানা ধার্য করবো যে তুমি মজা টের পাবে।” তিনি মোজাইনা গোত্রীয় লোকটির নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার উটের দাম কত?” সে বললো, “চারশো দিরহাম”। ওমর (রাঃ) ইবনে হাতেবকে বললেন, “যাও ওকে আটশো দিরহাম দিয়ে যাও।” তিনি গোলামদের চুরির শাস্তি ক্ষমা করে দিলেন। কেননা তাদের মনিব তাদেরকে অভুক্ত রেখে চুরি করতে বাধ্য করেছিল।
ইসলামের ইতিহাসে সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মর্যাদা অন্য এক দিক দিয়েও বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। সে দিকটি হচ্ছে তার সার্বজনীনতা। কেননা ইসলামের গণ্ডি পেরিয়েও এ ব্যবস্থা অক্ষুন্ন থাকে।
একবার হযরত ওমর (রাঃ) এক অন্ধ বৃদ্ধকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে দেখেন। জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারেন যে, সে ইহুদি। তিনি তার নিকট জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি ভিক্ষা করছ কেন?” সে বলল, “জিজিয়া, অভাব ও বার্ধক্য- এই তিনে মিলে আমাকে ভিক্ষা করতে বাধ্য করেছে।” হযরত ওমর (রাঃ) তাকে হাত ধরে গৃহে নিয়ে গেলেন এবং তার সাময়িক প্রয়োজন পূরণের উপযোগী অর্থ দিলেন। অতঃপর বায়তুল মালের তত্তাবাধায়ককে বলে পাঠালেন, এই ব্যক্তি এবং এর মত অন্যান্য লোকদের খোঁজ নাও। খোদার শপথ, এটা আদৌ ইনসাফের কথা নয় যে, যৌবনে আমরা তার পরিশ্রমের ফল ভোগ করবো আর বার্ধক্যে তাকে অবজ্ঞাভরে তাড়িয়ে দেব। যাকাত দরিদ্র ও সর্বহারাদের প্রাপ্য। আর এ লোকটি আহলে কিতাবের একজন সর্বহারা। তিনি তার এবং তার মত অন্যান্য লোকদের জিজিয়া মওকুফ করে দেন।
দামেষ্ক সফরের সময়ে তিনি একটি গ্রামের কাছ দিয়ে পথ অতিক্রম করেন। তিনি জানতে পারেন যে, সেখানে কতিপয় খ্রিষ্টান কুষ্ঠরোগী বাস করে। তিনি তাদেরকে যাকাতের তহবিল থেকে সাহায্য দান এবং তাদের জন্য রেশনে খাদ্য সরবারাহ করার নির্দেশ দেন।
তেরশো বছরেরও বেশী অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ইসলামের প্রাণশক্তি ওমরকে মানবতার সেই সুমহান স্তরে অধিষ্ঠিত করেছিল, যেখান থেকে তিনি সামাজিক নিরাপত্তাকে একটি সার্বজনীন মানবাধিকারের মর্যাদা দান করেন। এই অধিকার অর্জনের জন্য কোন বিশেষ ধর্ম অথবা সম্প্রদায়ের শর্ত ছিল না- কোন শরিয়ত এবং কি আকিদার অনুসারী তাও দেখার প্রয়োজন ছিলা না।
এটা হচ্ছে সেই সু-উচ্চ স্তর যেখানে পোঁছাতে মানবতার পদদ্বয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এবং সে এখনো তা থেকে বহু দূরে রয়েছে।