ওমর ইবনে আবদুল আজিজ
এবারে ওমর ইবনে আবদুল আজিজের যুগের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এ যুগটা ছিল খেলাফতে রাশেদারই পরিশিষ্ট। এটা ছিল একটা তীব্র আলোকচ্ছটা যা গোটা পথকে আলোকিত করে তুলেছিল। অবৈধভাবে আত্মসাৎকৃত শাসন ক্ষমতাকে তার আসল মালিক মুসলিম জাতির নিকট ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তিনি তার খেলাফত যুগের উদ্বোধন করেন। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে সরকার গঠনের একমাত্র বৈধ পন্থা হচ্ছে এই যে, মুসলিম জাতি নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় শাসক নির্বাচিত করবে, সামরিক শক্তি দ্বারা কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে নয়। তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেনঃ
‘‘ভাই সব! আমাকে আমার নিজের এবং জাতির মতামত ছাড়াই এ কঠিন দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। আমার আনুগত্যের যে বোঝা তোমাদের ওপর চেপে রয়েছে তা আমি নিজেই দূরে নিক্ষেপ করছি। তোমরা নিজেরাই কাউকে নির্বাচন কর।’’
জনতা চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘‘আমিরুল মু’মিনীন! আমরা আপনাকেই নির্বাচন করছি। আপনার নেতৃত্বের ওপর আমরা পূর্ণ আস্থাশীল।’’
এভাবে তিনি শাসক নির্বাচনের আসল পদ্ধতিকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। কেননা জাতির সম্মতি ও পরামর্শ ব্যতিত কেউ শাসক নিযুক্ত হতে পারে না।
অতঃপর তিনি জনতাকে লক্ষ্য করে বলেন,
‘‘বন্ধুগণ! আমার আগে কিছু সংখ্যক শাসক অতিবাহিত হয়ে গেছে। তারা ছিল জালেম। তোমরা কেবল তাদের জুলুম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদেরকে সহযোগিতা দিয়েছ। মনে রেখ! স্রষ্টার না-ফরমানী করে সৃষ্টির আনুগত্য করা যায় না। যে ব্যক্তি নিজে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে তার আনুগত্য স্বীকার করা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু যে আল্লাহ্র না-ফরমানী করে তার আনুগত্য স্বীকার করা উচিত নয়। যতক্ষণ আমি তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করবো ততক্ষণ তোমরাও আমার নির্দেশ মেনে চলবে। কিন্তু আমি যদি আল্লাহর না-ফরমানী করি তাহলে আমার নির্দেশ পালন করা তোমাদের জন্য জরুরী নয়।’’
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সর্বপ্রথম তিনি অবৈধভাবে আত্মসাৎকৃত ও বাজেয়াপ্তকৃত সম্পদ প্রত্যর্পণ করা শুরু করেন। এ কাজ তিনি নিজের সম্পদ থেকেই শুরু করেন। তিনি নিজের যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তির উপার্জন সূত্র অনুসন্ধান করে দেখতে পান যে, তার সবই অবৈধভাবে অর্জিত। তৎক্ষণাৎ তিনি সেই সব সস্পদ ফিরিয়ে দেন। এমনকি তার হাতে একটা অংগুরী ছিল। সেটার দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এটা আমাকে পশ্চিমাঞ্চল থেকে আদায়কৃত অর্থ সম্ভার থেকে ওলিদ অন্যায়ভাবে দিয়েছিল।’’ তিনি সেটা তৎক্ষণাৎ বায়তুল মালে জমা দেন। তার নিকট যত জায়গীর ছিল তা তিনি ফিরিয়ে দেন। এমামার কতিপয় জায়গীর, ইয়ামনে মুকাইদিস, জাবালুল অরস ও ফিদিক তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল- এর সব ক’টি তিনি পরিত্যাগ করেন এবং মুসলমানদের হাতে প্রত্যর্পণ করেন, শুধুমাত্র সুয়াইদা নামক স্থানে একটি নির্ঝরিনী তিনি নিজের অধিকারে রাখেন। এটি তিনি নিজের অর্থে খোদাই করেছিলেন। এর মুনাফা প্রতি বছর তার হাতে আসতো এবং তা প্রায় দেড়শো দিনার হতো।
যখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যা কিছু তার অধিকারভুক্ত রয়েছে, তার সবই তিনি মুসলমানদের হাতে প্রত্যর্পণ করবেন তখন অন্যায়ভাবে অধিকারভুক্ত মুসলমানদের সকল অধিকার প্রত্যর্পণ করতে হবে এই বলে জনগণকে আহ্বান জানাবার নির্দেশ দিলেন। সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি মিম্বারের ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেনঃ
‘‘নাগরিকবৃন্দ আমাদেরকে বহু জিনিস দিয়েছিলেন, সেগুলো আমাদের গ্রহণ করাও উচিত ছিল না, কাউকে দান করাও উচিত ছিল না। এর সব সম্পদ আমার হস্তগত হয়েছিল। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ আমার নিকট হিসাব চাইতে পারতো না। তোমরা শুনে নাও, আমি এ ধরণের সমস্ত ধন-সম্পদ প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্ত করেছি। তবে এ কাজ আমি আমার ব্যক্তিগত ধন-সম্পদ থেকেই শুরু করছি।
মুহাজেম! তুমি পড়তে আরম্ভ কর।’’
এর আগে একটি থলিতে করে সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র আনা হয়েছিল। মুহাজেম এক একটি করে দলিল পড়তে আরম্ভ করলেন। এক একটি পড়া শেষ হলে ওমর সেটি নিয়ে নিতেন, তার হাতে ছিল এক কাঁচি, তা দিয়ে তিনি দলিলগুলো কেটে রাখতেন। শেষ পর্যন্ত কোন একটি দলিল তার কাট-ছাটের হাত থেকে রক্ষা পেলো না। এর পর তিনি স্বীয়-মহিষী ফাতেমা বিনতে আব্দুল মালেকের মামলা হাতে নিলেন। তিনি তাকে বললেন, ‘‘তুমি তোমার গহনা বাইতুল মালে দাখিল করে দাও নতুবা আমাকে তোমার থেকে পৃথক হবার অনুমতি দাও। দু’টোর একটা গ্রহণ কর। আমার পক্ষে ওগুলোর সাথে ঘরে বসবাস করা সম্ভব নয়।’’ ফাতিমা বললেন, ‘‘আমিরুল মু’মিনীন! আমি আপনাকেই গ্রহণ করবো। একটি হীরকের কিইবা মূল্য। ওর চাইতে হাজার গুণ মূল্যবান জিনিস হলেও আমি তার মোকাবেলায় আপনাকে অগ্রাধিকার দিতাম।’’ এরপর তার নির্দেশে ওটা বাইতুলমালে জমা করা হলো। যখন ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ইন্তেকাল করেন এবং ইয়াজিদ ইবনে আবদুল মালেক সিংহাসনে আরোহন করেন তখন তিনি তাঁর বোন ফাতিমাকে বলেন যে, তুমি যদি চাও তবে তোমার হীরক তোমাকে ফেরত দেয়া যেতে পারে।’’ তিনি জবাবে বলেন, ‘‘আমি ওটা ওমরের জীবদ্দশায় অত্যন্ত আনন্দের সাথে দিয়েছিলাম, আজ তার ইন্তেকালের পর আমি তা কিছুতেই গ্রহণ করবো না।’’
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ শুধু অবৈধ সম্পদ ফেরত দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে তিনি নিজের জন্য ‘বাইতুল মাল’ থেকেও কোন কিছু গ্রহণ করতেন না। তিনি যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ থেকে নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে একটি পয়সাও ব্যয় করতেন না। অথচ হজরত ওমর ফারুক রা. ‘ফায়’ লব্ধ সম্পদ থেকে নিজের জন্য দৈনিক দুই দিরহাম নির্ধারণ করেছিলেন। হযরত ওমর ইবনে আব্দূল আজীজকে হযরত ওমর ফারুকের সমান গ্রহণ করতে অনুরোধ করলে তিনি তার জবাবে বলেন, ‘‘ওমর ইবনে খাত্তাবের নিকট ব্যক্তিগত সম্পত্তি মোটেই ছিল না- এদিকে আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি যা আছে তাদের আমার বেশ চলে যায়।’’
তিনি মারওয়ান বংশধরকে অর্ধেক সম্পত্তি আসল মালিকদের নিকট প্রত্যর্পণে উদ্বুদ্ধ করেন। বর্ণিত আছে যে, হেমসের একজন অমুসলিম এসে বলেছিল, ‘‘আমিরুল মুমিনীন! আমার অনুরোধ আল্লাহর বিধান অনুসারে নিষ্পত্তি করে দিন।’’ তিনি বললেন, ‘‘কি ব্যাপারে?’’ সে বললো, ‘‘আব্বাস ইবনে ওলিদ ইবনে আব্দুল মালেক আমার ভূমি কেড়ে নিয়েছে।’’ আব্বাস সেখানেই বসা ছিল। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আব্বাস, কি বলতে চাও?’’ আব্বাস বললো, ‘‘ওটা আমাকে (পিতা) ওলিদ ইবনে আবদুল মালেক দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি আমাকে লিখিত দলিলও দিয়েছেন।’’ তিনি আগন্তুককে বললেন, ‘‘এখন তোমার বক্তব্য কি?’’ সে বললো, ‘‘আমিরুল মু’মিনীন! আপনি আমাকে আল্লাহর কিতাব অনুসারে ফায়সালা করে দিন।’’ ওমর বললেন, ‘‘হ্যা, ওলিদ ইবনে আব্দুল মালেকের দলিলের চাইতে আল্লাহর ফরমানই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ তুমি এর জমি ফিরিয়ে দাও।’’ তৎক্ষণাৎ সে তার জমি ফিরিয়ে দিল।
রওহ নামে ওলিদের এক ছেলে ছিল। সে আশৈশব গ্রামে লালিত পালিত হওয়ার দরুন দেখতে সম্পূর্ণ গ্রাম্য বলে মনে হতো। কতিপয় ব্যক্তি ওমরের নিকট হেমসে অবস্থিত কয়েকটি দোকান সম্পর্কে মোকদ্দমা রুজু করে। আসলে এই দোকানগুলো ছিল অভিযোগকারীদের, কিন্তু ওলিদ তা রওহের নামে লিখিয়ে দেন। ওমর রওহকে ডেকে তাদের দোকান প্রত্যর্পণের নির্দেশ দেন। রওহ জবাব দেয় যে, দোকান ওলিদের লিখিত দলিল অনুসারে তার মালিকানাভুক্ত। তিনি জবাব দেন, ওলিদের দলিল দিয়ে তোমার কোন কাজ হবে না। দোকান ওদের এ সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তুমি ফিরিয়ে দাও।’’ তখন রওহ এবং হেমসের এক ব্যক্তি উঠে দরবার থেকে ফিরে আসতে লাগলো। পথে রওহ হেমসবাসীকে হুমকি দিল। হেমসবাসী ফিরে গিয়ে ওমরের কাছে উপস্থিত হয়ে রওহের হুমকির কথা জানালো। ওমর তার দেহরক্ষী বাহিনীর সেনাপতি কাব ইবনে হামেদকে নির্দেশ দিলেন, ‘‘রওহের নিকট গিয়ে বল যে, সে যেন দোকান তার মালিকদের ফিরিয়ে দেয়। যদি ফিরিয়ে দেয় উত্তম, নচেৎ তার মস্তক ছেদন করে আমার কাছে হাজির কর।’’ একথা শুনে রওহের এক শুভাকাংখী দরবার থেকে বেরিয়ে এল এবং আমিরুল মু’মিনীনের নির্দেশের কথা ব্যক্ত করলো। শুনে রওহের চৈতন্য বিলুপ্ত হবার উপক্রম হলো। কাব তার নিকট অর্ধোন্মুক্ত তরবারী হাতে নিয়ে উপনীত হলো। কাব বলা মাত্রই সে গিয়ে দোকান খালি করে দিল।
জনগণ অবিশ্রান্তভাবে জুলুম, বল প্রয়োগ ও হয়রানির নালিশ নিয়ে তার দরবারে হাজির হতে থাকে। অবৈধভাবে ছিনিয়ে নেয়া সব সম্পত্তির মামলাই তার নিকট পেশ করা হয় এবং তিনি তার সব গুলোই প্রকৃত মালিকের নিকট হস্তান্তর করেন, তা তার অধিকারভুক্ত থাকুক বা অন্য কারো। তিনি বনু মারওয়ানের নিকট থেকেও বল প্রয়োগে ছিনিয়ে নেয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করেন এবং তার আসল মালিকের নিকট প্রত্যর্পণ করেন। তিনি অকাট্য সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াও এ ধরণের জুলুমের প্রতিকার করতেন, এ ব্যাপারে তিনি সামান্য প্রমাণকেও যথেষ্ট মনে করতেন, যখনই তার নিকট কোন সম্পত্তির ব্যাপারে জুলুম করা হয়েছে বলে অনুমিত হতো অমনি তিনি সে সম্পত্তির মালিকানা প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্ত করতেন। কারণ তিনি জানতেন যে, পূর্বতন শাসকরা জনগণের সাথে অবিচার করতো। বর্ণিত আছে যে, জুলুমের মাধ্যমে গৃহীত ধন-দৌলত ফেরত দিতে দিতে তিনি ইরাকের ‘বাইতুল মাল’ শূণ্য করে দেন। ফলে সিরিয়া থেকে সেখানে সম্পদ স্থানান্তরিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালেক উমাইয়া বংশোদ্ভূত আম্বাসা ইবনে সাইদ ইবনুল আসকে ২০ হাজার দিনার উপহার দেন। বিভিন্ন সরকারী দপ্তর ঘুরে নির্দেশনাটি মোহরের দপ্তরে এসে উপনীত হয় এবং কেবল টাকা গ্রহণ করা বাকী থাকতেই সুলাইমানের মৃত্যু হয়। আম্বাসা ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের বন্ধু ছিলেন। ভোর হতেই তিনি ওমরের নিকট উক্ত উপহারটির ব্যাপারে আলাপ করার জন্য রওনা হন। এসে দেখেন, তার দুয়ারে বনু উমাইয়ার লোকেরা দাঁড়িয়ে। তারাও নিজ নিজ ব্যাপারে কথা বলার জন্য সাক্ষাতপ্রার্থী। আম্বাসাকে দেখে তারা ভাবলেন যে, আমরা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করার পূর্বে এর সাথে কিরূপ ব্যবহার করা হয় তা-ই দেখে নেয়া যাক। আম্বাসা তার নিকট গিয়ে বললেন, ‘আামিরুল ম’মিনীন! সুলাইমান আমাকে ২০ হাজার দিনার দেয়ার নির্দেশ জারী করেছিলেন। এই নির্দেশ মোহরের দপ্তরে পৌঁছে গিয়েছিলো এবং কেবল ওটা গ্রহণ করা বাকী ছিল। এমন সময় তার ইন্তেকাল হয়ে যায়। আমার বিশ্বাস আপনি এই মহানুভবতার কাজটি সম্পূর্ণ করে দেবেন। কেননা সুলাইমানের চেয়ওে আপনার সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর।’’ ওমর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কত টাকা?’’ তিনি বললেন, ‘’২০ হাজার দিনার।’’ ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ বললেন, ‘’২০ হাজার দিনার তো মুসলমানদের চার হাজার পরিবারের জন্য যথেষ্ট। এতটা অর্থ আমি কি করে এক ব্যক্তিকে দিয়ে দিতে পারি? আমি তা কিছুতেই পারবো না।’’ আম্বাসা বলেন, এ কথা শুনে আমি সেই দলিলটি দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেই- যাতে অর্থের কথা লিখিত ছিল। ওমর বললেন, ‘‘দলিল তুমি নিজের কাছেও রাখতে পার। কারণ আমার পরে এমন লোকও ক্ষমতাসীন হতে পারে, যে এই সরকারী অর্থের ব্যাপারে আমার চাইতে বেশী দুঃসাহসী হবে এবং এই দলিলে লিখিত টাকা তোমাকে হয়তো দিয়ে দেবে।’’ এ কথা শুনে আমি দলিলটি তুলে নিলাম এবং বাইরে এসে বনু উমাইয়ার লোকদেরকে আমার সাথে খলিফার আচরণের কথা খুলে বললাম। তারা বলে উঠলো, ‘‘এর পরে আর আমাদের কোনো আশা নেই। তুমি গিয়ে খলিফার নিকট আবেদন কর যেন আমাদেরকে অন্য কোন অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করার অনুমতি দেন।’’ আমি তার নিকট পুনরায় গিয়ে বললাম, ‘‘আমিরুল মু’মিনীন! আপনার বংশের লোকেরা আপনার দরজায় দাঁড়িয়ে আগে তাদেরকে যে সব বৃত্তি দেয়া হতো তা এখনও জারী রাখার আবেদন জানাচ্ছে।’’ ওমর জবাব দিলেন, ‘‘খোদার শপথ! এ অর্থ আমার নয় আর আমি এ ধরণের দান করার অবকাশও দেখি না।’’ আমি বললাম, ‘‘আমিরুল মু’মিনীন! তাহলে তারা অন্য অঞ্চলে গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করার অনুমতি চাচ্ছে।’’ তিনি বললেন, ‘‘তারা যা করতে চায়, আমার পক্ষ থেকে অনুমতি রয়েছে।’’ আমিও বললাম, ‘‘আমিও যেতে চাই।’’ তিনি বললেন, ‘‘হা, তোমাকেও অনুমতি দিচ্ছি। তবে আমার মতে তোমার এখানে থাকাই উত্তম। তোমার কাছে যথেষ্ট পুঁজি রয়েছে। এদিকে আমি সুলাইমানের পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিক্রি করবো। দেখা যেতে পারে, তুমি সেখান থেকে এমন কিছু কিনতে পার কিনা-যার লভ্যাংশ দ্বারা তোমার এই ক্ষতিপূরণ হতে পারে। আম্বাসা বলেন, ‘‘আমি সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম এবং সুলাইমানের ত্যাজ্য সম্পত্তি থেকে এক লাখ দিনারের জিনিসপত্র কিনে তা ইরাকে নিয়ে দু’লাখ দিনারে বিক্রি করলাম। আমি সেই দলিলও সংরক্ষণ করেছিলাম। ওমরের ইন্তেকালের পর ইয়াজীদ ইবনে আব্দুল মালিকের নিকট উক্ত দলিল নিয়ে উপনীত হই এবং তিনি সেই ২০ হাজার দিনার আমাকে দিয়ে দেন।’’
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ মারওয়ানের বংশধরকে ডেকে বলেন যে, ‘‘তোমাদেরকে আল্লাহ বিপুযল ধন-ঐশ্বর্য দান করেছেন। আমার ধারণা মতে উম্মতের সামগ্রিক সম্পদের অর্ধেক অথবা দুই-তৃতীয়াংশ তোমাদের কুক্ষিগত রয়েছে। সুতরাং জনসাধারণের যা কিছু প্রাপ্য তোমাদের নিকট রয়েছে তা তাদের নিকট প্রত্যর্পণ কর। আমাকে বল প্রয়োগে বাধ্য করো না।’’ কিন্তু কেউ এ কথার জবাব দিল না। তিনি বললেন যে, ‘তোমরা আমার কথার জবাব দাও।’’ তাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি বলে উঠলো, ‘‘আমরা আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি পরিত্যাগ করতে পারবো না। আমরা এভাবে নিজেদের সন্তান-সন্ততিদেরকে নিঃস্ব বানিয়ে দিতে এবং পিতৃপুরুষদের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করতে পারবো না, তা আমাদের মস্তক ছেদন করাই হোক না কেন।’’ ওমর বললেন, ‘‘খোদার শপথ! যদি আমি আশংকা না করতাম যে, যে জনগণের অধিকারের জন্য আমি এই চেষ্টা-সাধনায় লিপ্ত রয়েছি, তাদেরকেই তোমরা দলে ভিড়িয়ে ফেলবে- তাহলে আমি অল্প সময়ের মধ্যেই তোমাদেরকে জব্দ করে ছাড়তাম। কিন্তু আমার গোলযোগের আশংকা রয়েছে। যাদি আল্লাহ আমাকে আরো কিছু দিন জীবিত রাখেন, তাহলে আমি প্রত্যেক নাগরিককে তার ন্যায্য অীধকার দিয়ে তবে ক্ষান্ত হব।’’ (ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ, আহম্মদ, জাকি, সফওয়াত)।
কিন্তু তিনি নিজ বাসনা অনুসারে এতটা আয়ু লাভ করতে পারেননি যাতে সকলের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া যায়। তার পরবর্তী শাসকরা তার প্রদর্শিত পথের পরিবর্তে উমাইয়াদের পথে চলতে থাকে। এরপর আব্বাসীয়রাও এল বাদশাহ হয়ে। তারা যখন এল, তখন দেশে বিপর্যয় ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, দেশবাসী ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল। কেননা উমাইয়া শাসকরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদেরকে ইসলামী জীবনপদ্ধতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। বস্তুতঃ আব্বাসীয় শাসন উমাইয়া শাসনের চাইতে উত্তম ছিল না। সেটাও ছিল একই ধরণের স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসন।
রাজতন্ত্র
আমরা যেহেতু এখানে ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসন পদ্ধতি নয়- বরং শাসন ব্যবস্থার ব্যাপারে ইসলামী প্রাণশক্তির ইতিহাস আলোচনা করতে চাচ্ছি- তাই আমরা সেই প্রাণশক্তির বিকৃতি করণ ও তাতে মলিনতার স্পর্শের বিভিন্ন স্তর বিশ্লেষণ করার জন্য রাজততান্ত্রিক শাসনামলের তিনটি ভাষণ পেশ করেই ক্ষান্ত হব। খেলাফতে রাশেদার যুগে যে তিনটি ভাষণ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তার সাথে এ তিনটির তুলনা করলে উভয়ের মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে তা সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সন্ধির পর মুয়াবিয়া কুফায় জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘‘কুফাবাসীগণ! তোমরা কি মনে করেছ যে আমি নামাজ, জাকা, ও হজ্জ্বের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছি? আমিতো ভাল করেই জানি যে, তোমরা নামাজ, জাকাত ও হজ্জ্ব যথারীতি পালন করে থাক। আসলে আমি যুদ্ধ করেছি তোমাদের গর্দানের ওপর আমার শাসন চালাবার জন্য। তোমাদের অসম্মতি সত্ত্বেও আল্লাহ আমার অভিলাষ পূর্ণ করেছেন। জেনে রেখ, এই হাংগামায় যত জান-মালেরই ক্ষতি হয়ে থাক না কেন তার কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না। আর আমি যত প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকে না কেন তা সব এই যে আমার পায়ের তলে পিষ্ট করে দিলাম।’’ এমনিভাবে তিনি মদিনাবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেনঃ
‘‘খোদার শপথ! আমার যতদূর জানা আছে, আমি তোমাদের প্রীতি-ভালবাসার পরিণতিতে ক্ষমতা লাভ করিনি। তোমরা এতে খুশী হওনি- তাও আমি জানি। আমি এই তরবারীর সাহায্যে সংগ্রাম করেছি। তোমাদের ব্যাপারে আমি আবু বকর ও ওমরের কর্মপন্থা অনুসরণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনকে সম্মত করতে পারলাম না। সুতরাং আমি নিজেকে এমন এক পথে চালিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে আমার ও তোমাদের- উভয় পক্ষেরই কল্যাণ সাধিত হবে। সকলকে সুচারুরূপে মিলেমিশে পানাহার করতে হবে। তোমরা যদি আমাকে শাসক হিসেবে সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে মনে না কর, তথাপি আমি তোমাদের জন্য উত্তম শাসক।’’
মনসুর আব্বাসী উমাইয়া শাসন ধারাকে চরম বিকৃতির পথে এগিয়ে নিয়ে যান এবং রাজত্ব ও বাদশাহীকে একটি ঐশী ও খোদার পক্ষ থেকে সঠিক ও সত্য ব্যাপার বলে গণ-মানসে ধারণার সৃষ্টি করে দেন। অথচ ইসলামের নিকট এ ধারণা সম্পূর্ণ অপরিচিত। এরূপ অপকীর্তি সাধনের পর মনসুর নিম্নরূপ ভাষণ দেনঃ
‘‘দেশবাসী! আমি আল্লাহর জমীনে তার স্থলাভিষিক্ত। তারই সাহায্য সহায়তায় তোমাদের ওপর শাসন চালাবো। আমি তার ধন-সম্পদের ওপর তার পক্ষ থেকে নিয়োজিত প্রহরী। তার ইচ্ছা ও অনুমতি অনুসারে আমি তা ব্যয় করি অথবা কাউকে দান করি। আল্লাহ আমাকে জাতীয় কোষাগারের তালা স্বরূপ বানিয়েছেন। তিনি যদি আমাকে খুলতে চান তাহলে তোমাদের মধ্যে খাদ্য বণ্টন অথবা দান করার জন্য খোলেন আর যদি বন্ধ করতে চান তাহলে বন্ধ করে দেন।’’
এরপর শাসন ব্যবস্থা ইসলাম ও তার মূলনীতির আওতা থেকে একেবারেই বাইরে নিক্ষিপ্ত হলো।