বিবেকের সচেতনতার দৃষ্টান্ত
দৃষ্টান্তগুলো পেশ করার আগে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থাৎ ইসলামের ইস্পিত বিবেকের ওপর আলোকপাতকারী কয়েকটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি। কেননা এই বিবেকের ওপরই ইসলামের গোটা ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। আগেই বলেছি যে, ইসলাম ব্যক্তির বিবেককে সদা জাগ্রত থাকার এবং তার চেতনা ও অনুভূতিকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও তীব্র করার শিক্ষা দেয়। ইসলামের ইতিহাস এই বিবেকের সচেতনতা ও অনুভূতি তীব্রতার এত অধিক দৃষ্টান্ত সংরক্ষণ করেছে যে তা আমাদের এ সীমাবদ্ধ গ্রন্থে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এখানে অনেকগুলো নমুনার স্থলে বিবিধ রকমের মাত্র কয়েকটি নমুনা পেশ করা যাচ্ছে।
হযরত বারিদা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে,
“মাগের ইবনে মালেক (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সাঃ) দরবারে হাজির হয়ে বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে পবিত্র করুন।” রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বললেন, “তোমার সুমতি হোক, যাও, আল্লাহর নিকট তওবা কর গিয়ে”। মাগের কিছুদুর পর্যন্ত চলে যায়- অতঃপর আবার রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে ফিরে এসে বলে, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে পবিত্র করুন”। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আগের মতই জবাব দেন, তিনবার এরূপ হলো। চতুর্থবার রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বললেন, “আমি তোমাকে কিসের থেকে পবিত্র করবো?” মাগের বললো, “ব্যভিচার থেকে”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) লোকদের নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, এই ব্যক্তি মাতাল নয় তো?” সকলে জানালো যে সে মাতাল না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, “ও কি মদ খেয়েছে”। এক ব্যক্তি গিয়ে মাগেরের মুখ শুঁকলো। দেখা গেল সে মদ খায়নি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি সত্যই ব্যভিচার করেছ?” মাগের বলেলো, “হ্যাঁ”। এরপর তিঁনি শাস্তির হুকুম দিলেন এবং তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করে শাস্তি কার্যকরী করা হলো”।
এ ঘটনার দুই তিন দিন পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “তোমরা মাগেরের জন্য মাগফেরাতের দোয়া কর। সে এরূপ তওবা করেছে তা একটি গোটা জাতির মধ্যে বন্টন করে দিলে তাদের জন্য যথেষ্ট হবে”।
এরপর তাঁর নিকট আজ্দ গোত্রের এক মহিলা এল। সে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে পবিত্র করুন”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তোমার সুমতি হোক, যাও, আল্লাহর নিকট তওবা কর গিয়ে।? সে বললো,
“আপনি কি আমাকে মাগেরের মত ফিরিয়ে দিতে চান? আমি যে ব্যভিচার দ্বারা গর্ভবতী হয়েছি”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তুমি কি সত্যই ব্যভিচার দ্বারা গর্ভবতী?” সে বললো, “হ্যাঁ”। তিঁনি তাকে বললেন, “সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত অপেক্ষা কর”। অতঃপর তিনি উক্ত মহিলাকে সন্তান প্রসব পর্যন্ত জনৈক আনসারীর তত্ত্বাবধানে প্রেরণ করেন। কিছুদিন পর উক্ত আনসারী এসে রাসূলুল্লাহকে জানালেন যে, মহিলাটি সন্তান প্রসব করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বললেন, “ আমি তাকে মৃত্যুদন্ড দেব আর শিশুকে দুধ পান করানোর কেউ থাকবে না- এমন কাজ আমি করবো না”। এতে এক আনসারী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! শিশুর দুধ পান করানোর দায়িত্ব আমি গ্রহণ করছি”। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার ওপর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করলেন।
অন্য রেওয়ায়েতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মহিলাকে বললেন, “তুমি যাও, সন্তান প্রসব করার পর এসো”। সন্তান প্রসবের পর সে এলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “যাও দুধ পান করাও গিয়ে। দুধ ছাড়লে তখন এসো”।এরপর শিশু দুধ ছেড়ে দিলে সে শিশুকে কোলে নিয়ে রাসূলুল্লাহর কাছে এলো। শিশুর হাতে এক টুকরো রুটি ছিলো। সে বললো, “রাসূলে খোদা! আমি শিশুর দুধ ছাড়িয়ে দিয়েছি। এখন সে রুটি ইত্যাদি খেতে শিখেছে”। তখন তিনি শিশুকে একজন মুসলমানের হাতে সোপর্দ করলেন এবং মহিলার মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দিলেন। তার বুক পর্যন্ত গভীর গর্ত খোড়া হলো, অতঃপর রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নির্দেশে লোকেরা তাকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেললো। খালেদ ইবনে ওলীদ (রাঃ) একটু সামনে অগ্রসর হয়ে একটা পাথর তার মাথার নিক্ষেপ করলেন। এর দরুন খানিকটা রক্ত ছিটে এসে খালেদের মুখমন্ডলে লাগলো। এতে খালেদ মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে কটুক্তি করলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তা শুনতে পেয়ে বললেন, “খালেদ! মুখ সামলে কথা বলো। খোদার শপথ করে বলছি, এই মহিলা এমন তওবা করেছে যে, অন্যায়ভাবে আদায়কারীও যদি সেরূপ তওবা করতো তবে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হতো”। অতঃপর তাঁর নির্দেশে মহিলার জানাজার নামাজ পড়া হলো এবং তাকে যথারীতি দাফন করা হলো। (মুসলিম, নাসায়ী)।
মাগের ইবনে মালেক ও উক্ত মহিলার চরিত্র আমাদের সামনে সুস্পষ্ট। এদের কারো ব্যভিচারের কঠিন শাস্তির কথা অজানা ছিলনা। তাদেরকে কেউ পাপ কাজ করতে দেখেনি এবং তা প্রমাণ করার উপায়ও ছিল না। তা সত্ত্বেও তারা উভয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে পিড়াপিড়ি করলো্ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হৃদয়ের কোমলতা ও ইসলামের ন্যায়-নীতিমূলক প্রকৃতির তাগিদে সন্দেহের ভিত্তিতে তাদের শাস্তি ক্ষমা করতে চাইলেন। কিন্তু তা এত বেশি পিড়াপিড়ি করলো যে তাদের মুক্তির সমস্ত দ্বার রুদ্ধ হয়ে গেল। মহিলাটি তো খানিকটা শক্ত কথাই বলে ফেললো যে, তিনি কি তাকে মাগেরের মত ফিরিয়ে দিতে চান? যেন সে ইসলামের বিধানের অকাট্য বিধানের ব্যাপারে শৈথিল্য ও উদারতা প্রদর্শনের অভিযোগ রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ওপর আরোপ করতে চাচ্ছে।
এসব কেন?………তাদের এরূপ কথা বলা যে, “হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে পবিত্র করে দিন” তাদের মধ্যে এমন এক জীবন্ত ও উদগ্র প্রেরণার অস্তিস্ত নির্দেশ করে যা স্বয়ং বেঁচে থাকার আকাংখার চেয়েও প্রবল ও প্রাণবন্ত। এই প্রেরণা বিবেকের সচেতনতা ও অনুশোচনার তীব্রতা ছাড়া আর কিছু নয়। যে পাপের কথা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না তা থেকে পবিত্র হবার সুতীব্র বাসনা এবং অপবিত্র অবস্থায় আল্লাহর কাছে উপস্থিত হতে হবে এই অনুভূতি থেকে সৃষ্ট প্রচন্ড লজ্জা তাদেরকে অস্থির করে তুলেছিল।
এই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম। অপরাধীর মনে সুতীব্র অনুশোচনা আর নবীর মনে প্রথমে দয়া ও সহানুভূতি এবং পরে অপরাধ প্রমানিত হওয়ার পর অপরাধীর তওবা ও স্বীকারোক্তির মাহাত্মের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে দন্ড কার্যকরী করার মত দৃঢ়তা ও বুদ্ধিমত্তা এই ইসলামেরই বহিঃপ্রকাশ। কেননা ইসলাম তার সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকুক ও তার গৌরব অম্লান থাকুক- এটাই ছিল অপরাধী ও শাসক উভয়ের নিকট সবচেয়ে কাম্য বস্তু।
দন্ড বিধির ক্ষেত্রে যখন মুসলিম বিবেকের এই অবস্থা তখন যে সব সামাজিক কাজে প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে হয় তাতে তার ভূমিকা কিরূপ হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এ প্রসঙ্গে সিরিয়ার সেনাবাহীনির নেতৃত্ব থেকে খালেদ ইবনে ওলীদকে অপসারিত করে আবু ওবায়দাকে সেনাপতি নিযুক্ত করার ঘটনা প্রণিধানযোগ্য। খালিদ হলেন সেই গৌরবদীপ্ত সেনাপতি, যিনি তখন পর্যন্ত কোন যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেননি। সৈনিকসুলভ স্বভাব ও দক্ষতা তার মেরু মজ্জায় মিশে গিয়েছিল। জাহেলিয়াতের যুগে এবং ইসলাম গ্রহণের পরেও তিনি ছিলেন একমাত্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা। এহেন খালেদকে সেনাপতিত্ব থেকে অপসারিত করা হয় অথচ তিনি অসহযোগিতাও করেননি, বিদ্বেষও পোষণ করেননি। লজ্জা কিংবা সম্ভ্রমবোধ তাকে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাতে উদ্বুদ্ধ করেনি। বিদ্রোহ করার কোন চিন্তার তো প্রশ্নই ওঠেনা। তিনি একাই যুদ্ধের ময়দানে সমান আবেগ উদ্দীপনা নিয়ে ইসলামের বিজয়ের প্রেরণায় ও শাহাদাতের কামনায় উজ্জীবিত হয়ে পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যান। এ সময়ে তিনি তার মনে কোনো প্রকার কু-চিন্তা ও কু-প্ররোচনার প্রশ্রয় দেননি। কেননা সচেতন মুসলিম বিবেক এ ধরনের চিন্তার বহু উর্দ্ধে। এসব চিন্তার কোনই গুরুত্ব নেই তার কাছে।
ঘটনার অপর দিকটিও অর্থপূর্ণ। হযরত ওমরের খালেদকে অপসারিত করাও একই চেতনা ও প্রেরণা থেকে উদ্ভুত ছিল। তিনি হযরত আবু বকরের খেলাফতকালে খালেদ ইবনে ওলিদের মধ্যে এমন কয়েকটি ত্রুটি লক্ষ্য করেন যা ওমরের বিবেককে প্রকম্পিত করে তোলে। একটি ছিল এই যে, খালেদ মালেক ইবনে নোয়াইরাকে হত্যা করার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেন এবং অব্যবহিত পরে তার স্ত্রীকে বিয়ে করেন। এর পর তিনি আবার অনুরূপ একটা ত্রুটি লক্ষ্য করেন। সেটা হচ্ছে এই যে, মুসাইলেমায়ে কাজ্জাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেদিন বারশত শীর্ষস্থানীয় সাহাবী শহীদ হন, তার অব্যবহিত পরের দিন প্রত্যুষে খলেদ মাজ্জায়ার মেয়ে বিয়ে করেন।
এসব কার্যকলাপের সামনে যা আমার ধারণা ত্রুটিপূর্ণ কার্যকলাপ ছিল খলিফা খালেদের বীরত্বের এবং যুদ্ধ জয়ের কোনোই গুরুত্ব দেননি। নিঃসন্দেহে খালেদ সবচেয়ে বড় সেনাপতি ছিলেন। তিনি সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক যুদ্ধ জয় করেছিলেন। তদুপরি মুসলিম জাতি সিরিয়া ও ইরাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সিদ্ধান্তকারী যুদ্ধের মুখোমুখি ছিল। সেখানে খালেদের মত অপরাজেয় সেনাপতির সমর দক্ষতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু খালেদের মারাত্মক ত্রুটিসমূহ ওমর (রাঃ) এর বিবেকে যে চাঞ্চল্য ও অস্থিরতার সৃস্টি করেছিল, খালেদের এই সব গুণাগুণের কোনোটাই তা দমন করতে সক্ষম হয়নি। এর কোনটাই খালেদকে সেনাপতিত্ব থেকে এবং পরে খোদ সেনাবাহিনী থেকেও অপসারিত করার স্বপক্ষে তাঁর অভিমতকে পরিবর্তিত করতে পারেনি। আরো একটি কারণ ছিল এই যে, খালেদ অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারমূলকভাবে দায়িত্ব পালন করতেন আর এটা ছিল হযরত ওমরের মেজাজের পরিপন্থি। তাঁর দায়িত্ববোধ তাঁকে খুটিনাটি ব্যাপারেও নজর রাখতে হস্তক্ষেপ করতে উদ্বুদ্ধ করতো।(সাদেক উরজুন কৃত গ্রন্থ ‘খালেদ ইবনে ওলিদ’ থেকে)।
কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, খালেদ যদি এত বড় ভুল করে থাকেন, তাহলে হযরত আবু বকর (রাঃ) তাকে ছেড়ে দিলেন কেন? আসল ব্যাপার এই যে, খালেদ বিন ওলিদ সম্পর্কে হযরত আবু বকরের মতামত ওমরের মত গুরুতর ছিলনা। তিনি মনে করতেন যে, খালেদের বুদ্ধির ভুল হয়েছে এবং তিনি পরিকল্পিতভাবে কোন ত্রুটি বা গুনাহর কাজ করেননি। এ কারনে তিনি তার ওপর রুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তাকে ক্ষমা করেছেন। অবশ্য দ্বিতীয় ঘটনাটিকে হযরত আবু বকর (রাঃ)ও ঘোর আপত্তির দৃষ্টিতে দেখেন এবং তিনি এক ক্রোধাপ্তি চিঠি লিখে পাঠান। কিন্তু এসব সত্ত্বেও খালেদের ভুল-ভ্রান্তিকে তিনি ক্ষমার যোগ্য মনে করতেন এবং তা শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করেও দেন।
এই যুগে মুসলিম গণ-বিবেক যে সু-উন্নত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল, তার সাথে ঘটনার উপরোক্ত ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। কিন্তু ডাঃ হাইকেলের মত ব্যক্তি খালেদের ব্যাপারে হযরত আবু বকর ও ওমরের নীতির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আমাকে রীতিমত বিস্মিত করেছে। হাইকেলের এই ব্যাখ্যা ইসলামের প্রাণশক্তির সাথে কোনোই সম্পর্ক নেই। অবশ্য এটা এ যুগের নোংরা রাজনীতির সাথে যথার্থভাবে সংগতিশীল। ‘আস-সিদ্দিকু আবু বকর’ নামক গ্রন্থের ১৫০ থেকে ১৫২ পৃষ্ঠায় ডাঃ হাইকেল লিখেছেনঃ
“মালেক ইবনে নোয়াইরার ব্যাপারে আবু বকর ও ওমরের মধ্যে মতভেদ কত দুর গিয়ে পৌছেছিল তা পাঠক নিষ্চয় উপলব্ধি করতে পেরেছেন্ তার দু’জনেই যে ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণকামী ছিলেন, সেটা সন্দেহাতীত ব্যাপার। এখানে প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, খালেদের ভুল কি একজনের নিকট অতীব বিরাট এবং অপর জনের নিকট অতীব ক্ষুদ্র ছিল, না ব্যাপক বিদ্রোহ ও ধর্ম ত্যাগের সমস্যা জর্জরিত আরব উপদ্বীপের মুসলিম জীবনের নাজুক পরিস্থিতিতে সঠিক নীতি নির্ধারণ নিয়েই আসল মতভেদের উদ্ভব হয়েছিল?”
আমার মতে আসল মতভেদ ছিল নীতি নির্ধারণ নিয়ে। উভয় খলিফার প্রকৃতিতে যে পার্থক্য ছিল সে অনুসারে এই মতভেদ অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। ওমর (রাঃ) ছিলেন আপোষহীন ন্যায় বিচারের প্রতীক। তার দৃষ্টিতে খালেদ জনৈক মুসলমানের ওপর অবিচার করেছিলেন। তাই তিনি যাতে ভবিষ্যতে আর এরূপ ন্যাক্কারজনক ও ভাবমূর্তি ক্ষুন্নকারী কাজ করার সুযোগ না পান সে জন্য তাকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারণ করা প্রয়োজন ছিল। মালেকের ব্যাপারে খালেদের বুদ্ধি ও বিবেচনাই ভুল হয়েছে একথা মেনে নিয়ে তাকে ক্ষমা করা গেলেও- যদিও হযরত ওমর (রাঃ) তা মানতে পারতেন না- মালেকের স্ত্রী লায়লার সাথে অশালীন আচরণের শাস্তি না দেয়া কিছুতেই শোভন হতো না। [যদি সত্যিই হযরত ওমরের অভিমত এত কঠিন ও চরম ভাবাপন্ন হতো তাহলে নিজের খেলাফতকালে তাকে অবশ্যিই ব্যাভিচারের শাস্তি দিতেন-গ্রন্থকার।] ‘তিনি একজন অজেয় সেনাপতি’ ‘তিনি খোদার তলোয়ার’ এ সব কথা তাকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য যথেষ্ট হতো না। কেননা তার মানে দাঁড়াতো খালেদের মত লোকদের জন্য হারামকে হালাল করে দেয়া। আর এরূপ করা হলে মুসলমানদের সামনে আল্লাহর বিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নিকৃষ্টতর নজীর স্থাপন করা হতো। নিজের এই মতামতের কারণে ওমর (রাঃ) বার বার আবু বকর (রাঃ) এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শেষ পর্যন্ত আবু বকর (রাঃ) খালেদকে (রাঃ) ডেকে তার কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কড়া সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।
অপরদিকে আবু বকরের (রাঃ) দৃষ্টিতে পরিস্থিতি এত বেশি নাজুক ছিল যে, এ ধরনের ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দেয়া সম্ভব ছিল না। সে সময়ে গোটা দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল এবং আরবের চারিদিকে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। এমনি পরিস্থিতিতে ভুলবশতঃ কিংবা ইচ্ছাবশতঃ এক ব্যক্তি অথবা কয়েক ব্যক্তিকে হত্যা করার কি গুরুত্ব থাকতে পারে? যে সেনাপতিকে ত্রুটিপূর্ণ কার্যকলাপের দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছিল তিনি সেই ভয়াবহ বিপদ থেকে দেশকে রক্ষা করার সবচাইতে শক্তিশালী মাধ্যম ছিলেন। কোন স্ত্রীকে ইদ্দতের পূর্বে বিয়ে করা আরবদের প্রচলিত আদত-অভ্যাসের পরিপন্থি ছিল না, বিশেষতঃ কোনো বিজয়ী সেনাপতির পক্ষে। কারণ যুদ্ধের কারণেই সে যুদ্ধবন্দী মেয়েদের মালিকানা অধিকার লাভ করে থাকে। [ইসলামী শরিয়তের ক খ-ও জানে না – এমন লোকের পক্ষে এ ধরনের উক্তি করা সম্ভব। যদি সত্যি সত্যিই খালেদ কোন মুসলমানের স্ত্রীর ওপর বলৎকার করে থাকেন তাহলে তার ওপর ব্যাভিচারের দন্ড কার্যকরী করা অপরিহার্য ছিল। তাছাড়া মালেক যখন মুসলমান তখন তার স্ত্রীকে বাঁদী বানানোর প্রশ্নই ওঠেনা।] খালেদের মত অসাধারণ মানুষের ব্যাপারে আইনের কড়াকড়ি আরোপ করা অপরিহার্য ছিলনা। বিশেষতঃ এমন পরিস্থিতিতে যখন এমন কাজ রাস্ট্রের স্বার্থের বিরোধী ছিল এবং তার অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারতো। এ সময়ে মুসলমানদের জন্য খালেদের তরবারী অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। যেদিন আবু বকর (রাঃ) তাকে ডেকে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন সেদিনই মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল খালেদের। খালেদের (রাঃ) অবস্থানস্থল আল-বাত্তাহের সন্নিকত এমামাতে মোসায়লেমা বনু হানিফার চল্লিশ হাজার নওজোয়ানকে নিয়ে যুদ্ধের সাজে সেজে ছিল। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ ছিল সবচাইতে সাংঘাতিক বিদ্রোহ। মুসলমানদের সেনাপতিদের মধ্যে থেকে ইকরামা (রাঃ) কে সে আটক করে ফেলেছিল এবং তখন বিজয়ের সমস্ত আশা-আকাংখা খালেদের তরবারীর ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিল। এমতাবস্থায় মালেক ইবনে নোয়াইরাকে হত্যা করার কারণে অথবা খালেদকে বিমুগ্ধকারিণী অপরূপ সুন্দরী লায়লার কারণে খালেদ (রাঃ)কে অপসারণ করা এবং মুসলিম বিহিনীকে মুসাইলেমার হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবার অবকাশ সৃষ্টি করা কি করে উচিত হতো? এভাবে আল্লাহর দ্বীনকে পৃথিবীতে সবচেয়ে মারাত্মক বিপদে ফেলে দেয়া হতো নয় কি? খালেদ খোদার পতাকা ছিলেন-খোদার তরবারী ছিলেন- তাই আবু বকর (রাঃ) তাকে ডেকে নিয়ে শুধু তিরস্কার করে ক্ষান্ত হওয়া এবং তৎক্ষনাৎ এমামাতে গিয়ে মোসালেমার মোকাবেলা করতে নির্দেশ দেয়াই সবচেয়ে সংগত কর্মপন্থা বলে বিবেচনা করেছিলেন।
এই হচ্ছে আমার দৃষ্টিতে খালেদ ইবনে ওলিদের ব্যাপারে আবু বকর ও ওমরের নীতির পার্থক্যের আসল চিত্র। বনি হানিফার মিথ্যা নবুয়তের দাবিদার যখন ইকরামা (রাঃ) কে গ্রেফতার করে তখন আবু বকর (রাঃ) খালেদকে তার মোকাবিলার জন্য প্রেরণ করেন। সম্ভবতঃ তার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, মদিনাবাসী এবং ওমরের মতের সমর্থকরা এতে করে বুঝতে পারবে যে- খালেদ ইসলামের দুর্যোগ মূহূর্তের সবচেয়ে বড় বন্ধু। এ নির্দেশ দিয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) তাকে এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে নিক্ষেপ করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, খালেদ হয় যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হবে- তখন সেটা হবে মালেক ও তার স্ত্রীর প্রতি অবিচারের চেয়ে উত্তম শাস্তি আর না হয় তিনি বিজয়ী হবেন এবং সে বিজয় তাকে গুনাহ থেকে পবিত্র করবে। শেষ পর্যন্ত তিনি বিজয়ী হলেন এবং বিপুল গণিমতের সম্পদ নিয়ে রাজধানীতে ফিরে এলেন। এভাবে তিনি মুসলমানদেরকে এত বড় বিপদ থেকে মুক্ত করলেন। সে বিপদের সামনে আল বাত্তাহে অবস্থানকালে তার পক্ষ থেকে যে ত্রুটি বিচ্যুতি হয় – সেটার কোন গুরুত্বই ছিলনা।
এই হচ্ছে ডাঃ হাইকেলের দৃষ্টিতে পরিস্থিতির রূপ। আমার দেখে বিস্ময় জাগে যে, এক ব্যক্তি কিভাবে তার কল্পনার ডানা মেলে ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগে প্রবেশ করে এবং সেই জাগ্রত ও সচেতন বিবেক সমূহের ছায়তলে বসে লেখনি পরিচালনা করে। অথচ তার নিজের বিবেক ও মন ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা দানের ব্যাপারে আধুনিক জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গীর উর্দ্ধে ওঠা তো দূরের কথা তার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবান্বিত। তার দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে ইসলামের মূল প্রাণশক্তি এবং সেই বিশেষ যুগের বাস্তব ইতিহাসের কোনই সম্পর্ক নেই। এটা তো বর্তমান যুগের রাজনীতি। এই রাজনীতির দৃষ্টিতে উৎকৃষ্ট লক্ষ্যের জন্য নিকৃষ্ট কর্মপন্থা ও উপায় উপকরনের আশ্রয় গ্রহণ সম্পূর্ণ বৈধ। এ রাজনীতি মানবীয় বিবেক-বুদ্ধিকে পরিস্থিতি ও প্রয়োজনে গোলাম বানিয়ে দেয় আর একে উচ্চতর ‘ডিপ্লোমেসী’ এবং উচ্চাঙ্গের কর্মদক্ষতা ও কর্মকুশলতার নামে অভিহিত করে।
যে চিত্র ডাঃ হাইকেল তুলে ধরেছেন এবং যাকে তিনি একমাত্র বিশুদ্ধ চিত্র বলে দাবী করেছেন- তাতে হযরত আবু বকরের (রাঃ) ব্যক্তিত্বকে কত নীচ ও হীন করে দেখানো হয়েছে তা যে কোন চক্ষুষ্মান ব্যাক্তি দেখতে পারে।
সৌভাগ্য যে, আজকের নিকৃষ্ট ও অধঃপতিত সমাজের মানুষ যে দূরবীক্ষণ দ্বারা দেখতে অভ্যস্ত আবু বকরের ব্যক্তিত্ত তার অনেক উর্দ্ধে। এ দূরবীক্ষণ দ্বারা মানবতার সেই সু-উন্নত স্তরকে পর্যবেক্ষণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। বিশেষতঃ পর্যবেক্ষক যদি ইসলামী শরিয়তের সম্পর্কেও অজ্ঞ থাকে তাহলে ব্যাপার আরো ঘোলাটে হয়ে যায়।
স্বীয় পুস্তক ‘আল-ফারুক-উমর’-এ ডাঃ হাইকেল পুনরায় এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি খালেদকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে হযরত ওমরের মানসিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে চেষ্টা করেছেন। সেখানেও পুনরায় তাকে আধুনিক অধঃপতিত সভ্যতা প্রভাবিত করেছে। যে দল-নেতার সামনে আপাতঃ কল্যাণ ও আঞ্চলিক প্রয়োজন ছাড়া অন্য কিছুর গুরুত্ব থাকে না-ইসলামের প্রাণশক্তি যার পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়- সেই নেতার চরিত্রই লেখকের মন মানসে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। ৯৯ ও ১০০ পৃঃ তিনি লিখেছেনঃ
“বুঝে আসে না যে, হযরত ওমর (রাঃ) খালেদের (রাঃ) অপসারণের মত বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত কেন নিলেন। অথচ সিরিয়ায় মুসলমানদের সমগ্র সামরিক শক্তি খালেদের অধীন ছিল। মুসলিম বাহিনীর পক্ষে সেটা ছিল অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্ত। তারা রোমক সৈন্যদের মুখোমুখী দাঁড়িয়েছিল। প্রকাশ্য যুদ্ধও হচিছল না- আবার দু’পক্ষের কেউ কাউকে হার মানাতে পারছিল না। ইরাক থেকে খালেদের আগমনের পূর্বে যে পরিস্থিতি ছিল তার আগমনের পরও সে পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে। উভয় পক্ষ আক্রমন চালাবার উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষা করছিল। খলিফার এটা উপলব্ধি করা প্রয়োজন ছিল যে, খালেদকে পদচুত করলে মুসলমানদের উৎসাহ উদ্দীপনায় ভাটা পড়বে এবং পরিস্থিতি আরো অধিক বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। বস্তুতঃ খালেদ যতক্ষনে না মুসলমানদের উক্ত বিপজ্জনক মুহূর্ত অতিক্রম করিয়ে না নেন ততক্ষণ খলিফার অপেক্ষা করাই উচিত ছিল এবং এরপর যা খুশী নির্দেশ তিনি জারী করতে পারতেন”।
“যুদ্ধের উত্থান-পতনে এ ব্যাপারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর প্রতি দৃষ্টি দেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। আবু ওবাইদা (রাঃ) খলিফার অসন্তোষ ও অমতকে অগ্রাহ্য করে এ সব ব্যাপারের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রেখেছেন। কিন্তু ওমর ব্যাপারটা দেখেছেন অন্য দিক থেকে। তিনি যদি খালেদকে পদচ্যুত করার ব্যাপারে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত মূলতবী রাখতেন তাহলে তার নীতি ক্ষুন্ন হতো এবং ব্যাপারটা জটিল হয়ে পড়তো। জানা কথা যে, যুদ্ধে মুসলমানদের হয় জয় হতো না হয় পরাজয় হতো। যদি পরাজয় হতো তাহলে খালেদকে পদচ্যুত করেও লাভ হতো না। কিন্তু যদি খালেদের নেতৃত্বে মুসলমানরা জয় লাভ করতো তাহলে হযরত ওমরের পক্ষে তাকে বিজয় ও সাফল্যের গৌরব থেকে নীচে নামিয়ে পদচ্যুত করা সম্ভব হতো না। এরূপ করা অত্যন্ত ভুল কাজ হতো।
“ওমর (রাঃ) মোটের ওপর চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে, সিরিয়ায় অথবা অন্য কোথাও খালেদকে সেনাপতি পদে বহাল রাখবেন না। এ কারণেই তিনি পদচ্যুতির হুকুম জারী করার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেন। এ সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে তার যুক্তি এ ছিল যে খালেদ (রাঃ) হযরত আবু বকররের (রাঃ) নির্দেশাবলী যথাযতরূপে পালন করেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেহেতু মুসলমানরা জয়লাভ করেছিল, তাই কেউ ওমরের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করতে পারতো না। তিনি যা ভাল বুঝেছেন তা-ই করেছেন। খালেদও এমন পর্যায়ে ছিলেন যে, তাকে পদচ্যুতকারীরর ওপর কোনো অবিচারের অভিযোগ আরোপ করা যেতো না”।
এ হলো বিংশ শতাব্দীর হাইকেল ‘পাশা’র চিন্তাধারা- যা তিনি হিজরী প্রথম শতাব্দীর ওমর ফারুকের ওপর চাপাতে চাচ্ছেন। ইতিপূর্বে তিনি হযরত আবু বকরের ব্যাপারেও এরূপ করেছেন। যার আত্মা আবু বকর (রাঃ) ও ওমরের আত্মাকে স্পর্শও করতে পারেনি, যে ইসলামের পরিবেশে কিছুদিন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করা সত্ত্বেও এক মুহুর্তের জন্যও বিংশ শতাব্দির মলিনতা ও কদর্যতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি- সেরূপ লোকের পক্ষেই এরূপ ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি করা সম্ভব। আধুনিক সভ্যতার নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং বিবেক, সত্যবাদিতা ও ধর্ম- সব কিছুকে উপেক্ষাকারী সুবিধাবাদ যে লেখকের পিছু ছাড়েনি- তা অত্যন্ত স্পষ্ট। অধিকন্তু এ যুগের মিথ্যাচার ও প্রতারণা দর্শন তার চিন্তা ও দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
জিজ্ঞাস্য এই যে, হাইকেল সাহেব ওমর ফারুক (রাঃ) কে কি ভেবেছেন? যদি পরিস্থিতি অন্যরকম হতো এবং এরূপ সুযোগ না থাকতো তাহলে কি ওমর (রাঃ) খালেদ (রাঃ)কে ছেড়ে দিতেন? অথচ স্বয়ং হাইকেল পাশার বর্ণনা অনুসারে হযরত ওমরের বিবেক এ ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চিত ছিল যে, মালেক ইবনে নোয়াইরার ব্যাপারে এবং আল্লাহ ও তার দ্বীনের ব্যাপারে খালেদের কার্যকলাপ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও অন্যায় ছিল।
যে ওমর (রাঃ) পাহাড়কে স্থানচ্যুত করতে পারতেন কিন্তু নিজে নীতিচ্যুত হতেন না, যে ওমরের ঈমান ঝড়ের গতিবেগ ঘুরিয়ে দিত, কিন্তু নিজে বিচলিত হতেন না- সেই ওমর (রাঃ) কি করে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারতেন?
এ ধরনের কাজ করতো উমাইয়া ও আব্বাসীয় বাদশাহরা। মানুষ তাদের এসব কাজকে ‘ডিপ্লোমেসী’ ও ‘চতুরতা’ বলে আখ্যায়িত করতো। কিন্তু ওমর (রাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) ছিলেন এসব থেকে বহু উর্ধ্বে। এখন কেউ যদি তাঁদের সম্পর্কেও এই রূপ চিন্তা করা শুরু করে থাকেন তাহলে সেটা হচ্ছে বর্তমান যুগের নিকৃষ্ট মনোবৃত্তি ও নিম্ন মানের মূল্যবোধের প্রভাব।
আমি এই চিন্তাধারার উপস্থাপনা এবং তার ভ্রান্তি স্পষ্ট করার ব্যাপারে খানিকটা বিস্তারিত বিবরণের সাহায্য নিয়েছি। কারণ এ ছাড়া আধুনিক যুগের ধ্বংসাত্মক বিভ্রান্তি থেকে আক্রান্ত মন-মানসকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। ইসলামের প্রাণশক্তির চরমোৎকর্ষের যুগে যে চিন্তা-পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, কেউ কেউ সেই চিন্তা পদ্ধতির ব্যাখ্যা বর্তমান জড়বাদী চিন্তা-পদ্ধতির আলোকে দিতে চান। অথচ আজকের এ চিন্তা-পদ্ধতি প্রচলিত তখনকার আত্মিক চেতনা ও জাগরণ থেকে বহুদূরে অবস্থিত। আমি এই বিভ্রান্তিকর অপব্যাখ্যার অপনোদন করতে চাই। কারণ মানবীয় বিবেক এবং তার অন্তর্নিহিত শক্তি সমূহের এ দ্বারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
অবশ্য আমি প্রথম শতকের লোকদের কোনো কৃত্রিম পোষাকে আবৃত করে পেশ করতে চাই না অথবা তাদেরকে যাবতীয় মানব-সুলভ দুর্বলতা থেকে মুক্ত দেখাতেও ইচ্ছুক নই। আমি শুধু চাই মানুষ পুনরায় বিবেকের ওপর নির্ভর করতে শিখুক। এই উদ্দেশ্যে আমি মুসলমানদের জীবনের সঠিক পরিচয় পেশ করতে চাই। এতে করে যেসব বিবেকের মধ্যে উক্ত উন্নত স্তরের দিকে অগ্রসর হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে তারা সেই পরিচয় উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
এখন আমি জীবনের বিভিন্ন বিভাগে প্রথম শতকের মুসলমানরা যেরূপ বিবেক সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন, তার দৃষ্টান্ত পুনরায় পেশ করবো।
একদিন দেখা গেল, আমিরু মুমেনীন ওমর ইবনুল খাত্তার (রাঃ) পানির মশক ঘাড়ে করে নিয়ে আসছেন। তার পুত্র বিক্ষুব্ধভাবে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি এরূপ করছেন কেন?” তিনি জবাব দেন, “আমার মন অহংকার ও আত্মগরিমায় লিপ্ত হয়েছিল, তাই ওকে আমি অপদস্থ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি”। চেতনার তীব্রতা দেখুন! এই ব্যক্তির মনের কোনো এক কোনে ক্ষণিকের জন্য খেলাফত, রাজ্য জয় এবং অনাগত কালের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে সামান্যতম আত্মম্ভরিতা মাথা তুলেছিল। তিনি এটা বরদাশত করলেন না এবং তৎক্ষণাৎ সকলের সামনে প্রবৃত্তিকে জব্দ করা শুরু করে দিলেন। তিনি বিন্দুমাত্র ভেবে দেখলেন না যে, তিনি কত বড় বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বাধিনায়ক, যার মধ্যে আরব উপদ্বীপ ছাড়াও রোম এবং পারস্য সাম্রাজ্যের অধিকাংশ দেশ অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
আর একদিন দেখা গেল, আলী ইবনে তালেব প্রচন্ড শীতে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছেন। তার গায়ে শীত নিবারনের উপযুক্ত পোষাক নেই। ‘বায়তুল মাল’ তার মুঠোর মধ্যে রয়েছে। কিন্তু তাঁর বিবেক সচেতনতা তাঁকে একটি কপর্দকও স্পর্শ করতে দিচ্ছে না।
আবু ওবায়দা (রাঃ) ‘আমওয়াসে’ নিজ বাহিনী নিয়ে শিবির স্থাপন করেছেন। ‘আমওয়াসে’ ভয়াবহ মহামারী দেখা দিল। হযরত ওমর (রাঃ) শংকিত হলেন পাছে ‘আমিনুল উম্মতের’(আবু ওবায়দা) কোনো অনিষ্ট না হয়। তিনি তাঁকে মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য চিঠি লিখে নিজের কাছে ডাকেন। চিঠিতে তিনি লিখেনঃ
“সালাম বাদ, একটা জরুরী কাজে তোমার আমার সামনা-সামনি কথা বলা প্রয়োজন। আমি খুব জোর দিয়ে বলছি, এই চিঠি পড়ার পর চিঠি রাখার আগেই আমার কাছে রওয়ানা হও”। আবু ওবায়দা (রাঃ) চিঠি পড়া মাত্রই আসল উদ্দেশ্য আঁচ করে ফেলেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই খলিফা একটা পথ খুঁজে বের করেছেন। সংগে সংগে বলে ওঠেনঃ “আল্লাহ! আমিরুল মুমেনীনকে ক্ষমা করুন”। তিনি হযরত ওমরকে চিঠির নিম্নরূপ জবাব লিখে পাঠানঃ
“আমি বুঝতে পেরেছি আমাকে দিয়ে আপনার প্রয়োজনটা কি, এ সময়ে মুসলমানদের গোটা বাহিনী আমার সাথে রয়েছে। আমি মুসলিম জোয়ানদের নিকট থেকে পৃথক হতে চাই না। আল্লাহ যতক্ষণ আমার ও তাদের ভাগ্যের লিখন পূর্ণ না করেন ততক্ষণ আমি তাদেরকে ছেড়ে যেতে পারি না। আমিরুল মুমেনীন, এই সব কারণে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি আমাকে এই নির্দেশ পালনে বাধ্য করবেন না। আমাকে আমার জোয়ানদের সাথে থাকতে দিন”।
হযরত ওমর (রাঃ) চিঠিটা পড়ে কাঁদতে লাগলেন। উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করেন, “আবু ওবায়দা কি ইন্তেকাল করেছেন?” তিনি বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে জবাব দেন, “না”।
বস্তুতঃ তাকদীরের ওপর অটল বিশ্বাস এবং আল্লাহর পথের প্রতিটি সৈনিকের নিজের সমান মর্যাদা দান- এ দুটো কার্যকারণই আবু ওবায়দা (রাঃ) কে মৃত্যুর মুখে অবিচল থাকতে বাধ্য করেছিল।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মুয়াজ্জিন হজরত বেলাল বিন রাবাহের ইসলামী ভাই আবু রুয়াইহা খাশ্য়ামী তার বিয়ের জন্য ইয়ামনের কতিপয় লোকের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়ার জন্য বেলালের কাছে আবদার ধরেন। হজরত বেলাল সেই লোকদেরকে বলেন, “আমি বেলাল বিন রাবাহ। আর এ হচ্ছে আমার ভাই আবু রুয়াইহা। এর ধর্ম ও চরিত্র দুটোই খারাপ। তোমাদের ইচ্ছা হয় তার সাথে আত্মীয়তা কর, না হয় করো না”।
একদম পরিস্কার কথা বলে দেন। নিজের ভাই এর দোষ গোপন করে তাদেরকে প্রতারিত করেননি।
তিনি একটা বিয়ের কথা-বার্তার মাধ্যম হচ্ছেন- এ অনুভূতি তাঁকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহির অনুভূতি থেকে বিস্মৃত করে দেয়নি। ইয়ামনবাসীরা তাঁর সত্যবাদীতায় মুগ্ধ হয়ে সম্বন্ধ স্থাপনে রাজী হন। এত বড় সত্যবাদী তাদের মেয়ের জন্য বিয়ের পয়গাম এনেছে এটুকুই তাদের জন্য যথেষ্ট গৌরবের ব্যাপার ছিল।
ইমাম আবু হানিফার চরিত্র লক্ষ্যনীয়ঃ তিনি নিজের শরীক ব্যবসায়ী হাফ্স ইবনে আবদুর রহমানের কাছে কিছু কাপড় বিক্রীর জন্য পাঠান। তিনি তাঁকে বলে দেন যে, একখানা কাপড়ে কিছু খুঁত আছে তা ক্রেতাকে জানিয়ে দিতে হবে। হাফ্স সেই কাপড় বিক্রী করে দেন কিন্তু খুঁতের কথা বলতে ভুলে যান। খুঁতপূর্ণ কাপড়ের বিনিময়ে তিনি পুরো দাম আদায় করেন। এই চালানের দাম ছিল ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার দিরহাম। আবু হানিফা (রঃ) তাঁর শরীককে ক্রেতার সন্ধান নিতে বলেন কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও ক্রেতার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এরপর তিনি তাঁর শরীক থেকে পৃথক হন এবং গোটা চালানের দাম আল্লাহর পথে দান করে দেন। নিজের পবিত্র সম্পত্তি সাথে তিনি সেটা মিশাতেও চাননি। [আবদুল হালিম আল-জুনদীর গ্রন্থ- ‘আবু হানিফা বাতলুল হুররিয়াতি অত্-তাছামুহি ফিল ইসলাম’ থেকে গৃহীত।]
বর্ণিত আছে যে, প্রখ্যাত ইমাম ইউনুছ বিন ওবায়েদের নিকট বিভিন্ন মূল্যের কাপড় বিক্রীর জন্য রক্ষিত ছিল। এক রকমের কাপড়ের প্রতি জোড়ার দাম ছিল চারশো দিরহাম। অপর এক ধরনের কাপড়ের প্রতি জোড়ার দাম ছিল দু’শো দিরহাম। তিনি নিজের ভ্রাতুস্পুত্রকে দোকানে রেখে নামাজ পড়তে যান। এ সময় একজন লোক আসে এবং চারশো দিরহাম মূল্যের জোড়া চায়। ছেলেটি তাকে দু’শো দিরহাম মূল্যের জোড়া দেখায়। সেটা তার পছন্দ হয় এবং সন্তুষ্ট চিত্তে খরিদ করে নিয়ে যায়। সে উক্ত কাপড় নিয়ে বাড়ী যাওয়ার সময় পথে ইউনুছের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। ইউনুছ তার কাপড় চিনতে পেরে জিজ্ঞাসা করেন যে, সে ওটা কত দামে খরিদ করেছে? সে জবাব দেয় যে, চারশো দিরহাম। তিনি বলেন, এটা তো দু’শো দিরহাম মূল্যের কাপড়। যাও ওটা ফেরত দিয়ে এস। সে জবাব দিল, এ কাপড় আমাদের দেশে পাঁচশো দিরহাম মূল্যে পাওয়া যায়। তাই আমি ওটা সন্তুষ্ট চিত্তেই খরিদ করেছি।ইউনুস বললেন, তোমাকে ফেরত নিতেই হবে। কারণ ইসলামের ব্যাপারে হীত কামনার চেয়ে উত্তম কাজ আর কিছু হতে পারে না। এই বলে তিনি তাকে দোকানে নিয়ে যান এবং দু’শো দিরহাম ফিরিয়ে দেন। অতঃপর তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে এই বলে তিরস্কার করেনঃ “তোর লজ্জা করলো না? তোর মনে খোদার ভয়ের সৃষ্টি হলো না? শতকরা একশো ভাগ লাভ করিস্ আর মুসলমানদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখিস না?” ছেলেটি শপথ করে বললো যে, ক্রেতা খুশী হয়েই কাপড় কিনেছিল। এতে তিনি বললেন, “তুই নিজের জন্য যা পছন্দ করিস- তা অপরের জন্যও পছন্দ করতে হয়, একথা ভুলে গেলি কেন?”
মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদ থেকে বর্ণিত আছে যে, তার অনুপস্থিতিতে তার ভৃত্য এক ব্যাক্তির নিকট পাঁচ দিরহাম দামের কাপড় দশ দিরহামে বিক্রী করে। তিনি জানতে পেরে সারাদিন উক্ত ক্রেতার সন্ধান করেন। শেষে তাকে পেয়ে বললেন, ভৃত্য ভুল করে তোমার কাছে পাচঁ দিরহামের কাপড় দশ দিরহামে বিক্রী করেছে। সে আশ্চর্য হয়ে বললো, “আমিতো খুশী হয়েই এ দাম দিয়েছি”। তিনি জবাব দিলেন, “তুমি হাজার খুশী হও। আমি নিজের জন্য যা পছন্দ করি তা তোমার জন্যও পছন্দ করবো”। এই বলে তিনি তাকে পাঁচ দিরহাম ফিরিয়ে দেন। (আর রিসালাতুল খালেদাঃ আবদুর রহমান আজ্জাম)
এ তিনটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনের সবচেয়ে শক্তিশালী চাবিকাঠি হচ্ছে ইউনুস ইবনে ওবায়েদের এই উক্তি যেঃ “তোর লজ্জা করলো না?” নিঃসন্দেহে নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত হওয়া ও আল্লাহর ভয়ে ভীত হওয়াই হচেছ এই সমস্ত ঘটনার পেছনে সক্রিয় একমাত্র শক্তি। মানুষের বিবেক, প্রকৃতি ও মন-মানস যখন ইসলামের প্রাণশক্তিকে গ্রহণ করে এবং সেই প্রাণশক্তি তার মেরু-মজ্জায় মিশে যায় তখন ইসলাম পূর্ণ শক্তি সহকারে তার মধ্যে এরূপ চরিত্রের সৃষ্টি করে।
এই কয়টি দৃষ্টান্ত ছাড়া আরো বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। কিন্তু মানুষের বিবেকের পরিশুদ্ধির জন্য ইসলাম যে সর্ব্বোচ্চ লক্ষ্য সামনে রেখে, তার দিকে পথ-নির্দেশের জন্য এই দৃষ্টান্ত কয়টিই আমাদের জন্য যথেষ্ট। ইসলাম মানুষের বিবেককে যাবতীয় বস্তুগত প্রয়োজন, সম্পর্ক-সম্বন্ধ এবং জানমাল ও পদ-মর্যাদার আকর্ষণ থেকে উর্ধ্বে তুলতে চায়। সে মানুষকে সদা সচেতন, বিবেকবান ও তীব্র অনুভূতি সহকারে জীবনের সকল দায়িত্ব যথাযথ রূপে পালন করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে চায়।
সাম্যের উদাহরণ
ইসলাম মানব জাতির জন্য পরিপূর্ণ সাম্যের বাণী নিয়ে এসেছিল। যত মূল্যবোধ সাম্যের পথে অন্তরায় সৃ্ষ্টি করেছে তার শৃংখল থেকে সে মানুষকে মুক্ত করতে এসেছিল। এবার আমরা দেখতে চাই এই মতবাদকে বাস্তব জীবনে কিভাবে রূপায়িত করা হয়েছে।
সে সময়ে সারা দুনিয়ার দাস-শ্রেণী স্বাধীন মানব জাতি থেকে পৃথক একটা স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসাবে বিদ্যমান ছিল। আরব উপদ্বীপেরও ছিল একই অবস্থা। এ ব্যাপারে আমরা যখন হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কার্যাবলী বিবেচনা করি তখন দেখতে পাই যে তিনি নিজের ফুফাতো বোন এবং কোরাইশ বংশীয় হাশেমী গোত্রের মেয়ে জয়নবকে নিজের আজাদ করা গোলাম জায়েদের সাথে বিয়ে দেন। বিয়ে একটা অত্যন্ত নাজুক ব্যাপার, এতে উভয় পক্ষের সমতা অন্য সকল প্রশ্নের চাইতে গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়।
মহানবী (সাঃ) ছাড়া আর কোনো ব্যক্তি এবং ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো শক্তির পক্ষে এত বড় অসাধারণ কাজ করা সম্ভব ছিল না- এমন কি আজও মুসলিম জাহান ব্যতীত অন্য কোথাও সম্ভব নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাসবৃত্তি বে-আইনী বটে কিন্তু কোনো নিগ্রোর পক্ষে কোন শ্বেতাংগিনীকে-তা সে যতই নিকৃষ্ট হোক- বিয়ে করা আইনানুগভাবে নিষিদ্ধ। শুধু তাই নয়, বরং কোনো নিগ্রোর পক্ষে বাসে বা অন্য কোন যানে-রেস্তোঁরায় থিয়েটারে অথবা অন্য কোন স্থানে কোন শ্বেতাঙ্গের পাশাপাশি উপবেশন করাও আজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ।
হিজরতের প্রথম যুগে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আনসার ও মোহাজেরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন তখন তার স্বাধীনকৃত গোলাম জায়েদ এবং তার চাচা হামজা ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন, হজরত আবু বকর (রাঃ) এবং খারেজা ইবনে জায়েদ ভাই ভাই বন্ধনে আবদ্ধ হন। খালেদ ইবনে রুয়াইছা খাশ্য়ানী এবং বিলাল ইবনে আবি রাবাহের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়। এই ভ্রাতৃত্ব শুধু কথার মধ্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি- বরং রক্ত সম্পর্কের মত মজবুত ও পাকাপোক্ত সম্পর্কের রূপ ধারণ করে। জান-মাল ও জীবনের সকল ব্যাপারে তাদের মধ্যে আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরপরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জায়েদকে মুতা যুদ্ধে সেনাপতি বানিয়ে পাঠান। অতঃপর তার ছেলে উসামা (রাঃ)-কে রোমের যুদ্ধে এমন এক বাহিনীর সেনাপতি করেন-যার মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন মুহাজের ও আনসার। এই সেনাবাহিনীতে হজরত আবু বকর (রাঃ) এবং ওমন (রাঃ)ও ছিলেন- যারা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকটতম সাথী ও উজীর এবং পরে পূর্ণ ঐক্যমত সহকারে খলিফা নির্বাচিত হন। উসামার নেতৃত্বে পরিচালিত এই সেনাবাহিনীতে রাসূলুল্লার (সাঃ) ঘনিষ্ট আত্মীয় সা’দ ইবনে আবি আক্কাসও ছিলেন। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) মাতুল গোষ্ঠি-বনু জোহরা গোত্রের লোক। তাছাড়া কোরাইশদের যে সব ব্যক্তি নবুয়তের প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন- তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। আল্লাহতায়ালা তাকে মাত্র সতের বছরে ইসলাম গ্রহণের তওফিক দেন। তিনি বিরাট বিত্তশালী ও মর্যাদা সম্পন্ন লোকি ছিলেন। তিনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ সমর-কুশলীও ছিলেন এবং সেই সাথে জেহাদী প্রেরণায়ও উদ্বুদ্ধ ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর হজরত আবু বকর (রাঃ) যখন উসামার বাহিনীকে পুনরায় যুদ্ধে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিযুক্ত সেনাপতিকেও বহাল রাখেন। তিনি যখন সেনাপতিকে বিদায় দেয়ার জন্য মদিনার বাইরে আসেন- তখন উসামা সওয়ারীতে চড়ে যাচ্ছিলেন, আর খলিফাতুল মুসলেমীন চলছিলেন পায়ে হেঁটে। উসামা এতে অত্যন্ত কুন্ঠা বোধ করেন। নিজে সওয়ার হয়ে সওয়ারীতে চড়বেন, আর বৃদ্ধ খলিফা পায়ে হেঁটে চলবেন- এটা তিনি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছিলেন না। তাই উসামা বললেন, “খলিফাতুর রাসূল! আপনিও সওয়ারীতে আরোহন করুন-নইলে আমি নেমে আসবো”। খলিফা শপথ করে বলেন, “খোদার কছম! তুমি নীচে নেমনা। খোদার কছম! নীচে নেমনা। খোদার কছম! আমি সওয়ারীতে আরোহন করবো না। আমি কিছুক্ষণ আল্লাহর রাহে হেঁটে চললে আমার কোনোই ক্ষতি হবে না”। এরপর হজরত আবু বকরের (রাঃ) হঠাৎ মনে পড়ে যে, হজরত ওমরের তাঁর প্রয়োজন পড়তে পারে। অসুবিধা ছিল এই যে, ওমর (রাঃ) উসামার বাহিনীর একজন সৈনিক ছিলেন। যেহেতু সে বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন উসামা, তাই ওমর (রাঃ) কে রাখতে হলে উসামার অনুমতি প্রয়োজন।খলিফা বলেন, “যদি আপনি ভাল মনে করেন তবে অনুগ্রহ পূর্বক ওমরকে আমার সাহায্যের জন্য রেখে যান”।
এখানে এসে বিস্ময়ে ইতিহাসের গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। “যদি আপনি ভাল মনে করেন তবে অনুগ্রহ পূর্বক ওমরকে (রাঃ) আমার সাহায্যের জন্য রেখে যান”। একথা কত উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে খলিফা তার মামুলী সেনাপতিকে বলতে পারেন তা বুঝিয়ে বলার উপযুক্ত ভাষা আমাদের নেই।
ইতিহাস আরো সম্মুখে অগ্রসর হয়। আমরা দেখতে পাই, ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) আম্মার ইবনে ইয়াসার (রাঃ)কে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। অথচ তিনিও দাস শ্রেণী-উদ্ভুত ছিলেন। আমাদের কল্পনার চোখ আরো বিস্তারিত হয় যখনি আমরা দেখি যে, আমর ইবনে হিশামের পুত্র সোহায়েল, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এবং অন্যান্য কোরাইশ সর্দার দাঁড়ানো থাকতে হজরত ওমর দু’জন প্রাক্তন গোলাম সোহায়েব (রাঃ) ও বিলাল (রাঃ)কে আগে ডেকে নেন। কেননা তারা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাহাবী ও বদর যুদ্ধের সিপাহী। এ অগ্রাধিকারে আবু সুফিয়ান অস্ফুট ক্রুদ্ধ স্বরে জাহেলিয়াতের উক্তি করে ফেলেনঃ “এমন কান্ড কখনো দেখিনি। আমাদেরকে দরজায় দাঁড় করিয়ে গোলামগুলোকে ভেতরে ডেকে নেয়া হলো”।
হজরত ওমর (রাঃ) একদিন মক্কা শরীফের কোথাও যাচ্ছিলেন। দেখেন যে চাকর-নফররা মুনিবদের সাথে খেতে বসেনি বরং একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি রাগান্বিত হয়ে মুনিবদের উদ্দেশ্যে বলেন, “ব্যাপার কি! নিজেদের ভৃত্যদের সাথে এরূপ বৈষম্যমূলক ব্যবহার করা হচ্ছে কেন?” অতঃপর তিনি ওই ভৃত্যদেরকে ডেকে জোর পূর্বক মনিবদের সাথে ভোজনে বসিয়ে দেন।
হযরত ওমর (রাঃ) নাফে ইবনুল হারেসকে মক্কার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তার সাথে উসফানে খলিফার সাক্ষাত হলে জিজ্ঞাসা করেন, “কি সংবাদ, কাকে স্থলাভিষিক্ত করে এসেছ?” নাফে জবাব দেন, “ইবনে আবজাকে স্থালাভিষিক্ত করে এসেছি। তিনি আমাদের আজাদকৃত গোলামদের অন্যতম”। ওমর (রাঃ) বললেন, “সে কি! একজন আজাদকৃত গোলামকে মক্কাবাসীদের ওপর নিজের স্থলাভিষিক্ত করে এলে?” জবাব এলো, “তিনি কোরআনে অভিজ্ঞ, শরিয়তে সুপন্ডিত এবং সুবিচারক”। হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, “হবেই তো! আমাদের নবী (সাঃ) বলে গেছেন যে, আল্লাহতায়ালা এই কিতাব দ্বারা অনেককে ওপরে তুলবেন, অনেককে নীচে নামাবেন”।
————এরাবিক টেক্সট——-
বলা বাহুল্য, হযরত ওমর (রাঃ) আপত্তি জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে নয়- বরং ইবনে আবজার পরিচয় জানবার জন্য প্রশ্ন করেছিলেন। নইলে এই ওমরই নিজের পরবর্তী খলিফা নির্বাচনকারী ছয় সদস্য বিশিষ্ট পরিষদকে অছিয়ত করার সময় বলতেন না যে, “হোজাইফার গোলাম সালেম জীবিত থাকলে আমি তাঁকে খলিফা নিয়োগ করে যেতাম”। এ থেকে বুঝা যায়, তিনি তাকে পরিষদের ছয়জন সদস্যের প্রত্যেকের চেয়ে উত্তম মনে করতেন। এই ছয়জন ছিলেন, ওসমান, আলী, তালহা, জোবায়ের, আবদুর রহমান ইবনে আওফ, সা’দ ইবনে আবি আক্কাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)।
একবার জনৈক আজাদকৃত গোলাম অন্য একজন কোরাইশ বংশীয় ব্যক্তির নিকট তার বোনের পাণি গ্রহণের অভিলাষ প্রকাশ করে এবং তার বোনকে প্রচুর অর্থ দিতে চায়। কিন্তু সে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ওমর (রাঃ) যখন একথা জানতে পারলেন, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কোন কারণে তার সাথে তোমার বোন বিয়ে দিতে চাওনি? সে অত্যন্ত ভালো মানুষ এবং সে তোমার বোনকে অনেক অর্থ সম্পদও দিতে চেয়েছে”। লোকটা বললো, “আমরা উচ্চ সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক। কিন্তু সে আমার বোনের সম-পর্যায়ভুক্ত নয়”। ওমর (রাঃ) বললেন, “এই ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় দিক থেকে সম্ভ্রান্ত, দুনিয়ায় সম্ভ্রান্ত এই জন্যে যে, সে প্রচুর বিত্তবান আখেরাতে সম্ভ্রান্ত এই জন্য যে, সে খোদাভীরু ও সৎকর্মশীল। যদি মেয়ে রাজী থাকে তবে তাকে এই ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিয়ে দাও”। লোকটি তার বোনের মতামত গ্রহণ করে দেখে যে সে সম্মত। অতঃপর তার সাথে তার বোনকে বিয়ে দিয়ে দেয়।
গোলামদের যে ক্ষেত্রে ইচ্ছা, উচ্চ থেকে উচ্চতর পদমর্যাদায় উন্নীত হবার অবাধ সুযোগ ছিল। তাই আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের সাথে তার গোলাম ইকরাম, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের সাথে তার গোলাম নাফে, আনাস ইবনে মালিকের সাথে তার গোলাম ইবনে শিরীন এবং আবু হোরাইরার সাথে তার গোলাম ইবনে হরমুজ ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য ও অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। বসরায় হাসান বসরী এবং মক্কায় মুজাহেদ ইবনে জুবায়ের, আতা ইবনে আবি রাবাহ এবং তাউস ইবনে কাইসান খ্যাতনামা ফকীহ ছিলেন এবং তাঁরা সকলেই ছিলেন দাস বংশোদ্ভুত। অনুরূপভাবে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের সময়কার মিশরের মুফতি ইয়াজিদ ইবনে আবু যিব দিনকালার আসওয়াদ নামক ব্যক্তির গোলাম ছিলেন। (আবু হানিফাঃ আবদুল হালিম জুন্দী)।
শ্রমজীবীদের ব্যাপারেও মুসলমানদের নীতি অনুরূপ ছিল। গায়ে খেটে জীবিকা উপার্জনকারীরা মুসলমানদের সমাজ জীবনে অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী ছিল। স্বয়ং শ্রমের মর্যাদা ছিল অত্যন্ত উচ্চ। তাই শ্রমিক মাত্রই- তা সে যে পেশার সাথেই সংশ্লিষ্ট হোক- সমান শ্রদ্ধা লাভ করতো। কোনো শ্রমজীবীর পেশা তাকে জ্ঞানার্জনে বাধা দিতে পারতো না- এমনকি বড় বিদ্বান ও ওস্তাদে পরিনত হবার পথেও কোনো বাধা ছিল না।
ইমাম আবু হানিফা কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন, আর তার পরবর্তী বহু বিখ্যাত মনীষি ব্যবসায়ী অথবা কারিগর ছিলেন। ইমাম আহমদ ইবনে আমর ছিলেন জুতা প্রস্তুতকারী। তার পিতা ছিলেন ইমাম আবু হানিফার সহচর মুহাম্মদ ও হাসানের শিষ্য। ইনি একদিকে জুতা তৈরী করে জীবিকা উপার্জন করতেন, আবার অপরদিকে খলিফা মুহতাদী বিল্লাহর জন্য ‘কিতাবুল খারাজ’ বা ‘ইসলামের রাজস্ব-নীতি’ প্রণয়ন করেছিলেন। এই সময়ে তিনি ফেকাহ শাস্ত্রের ওপর নিজের মূল্যবান গ্রন্থাবলী প্রণয়ন করতেন। কাফ্ফালের হাতে তালা বানানোর দাগ পরিদৃষ্ট হতো, ইবনে কাত্তান্দুবাগা দর্জ্জীগিরী করতেন, খ্যাতনামা ইমাম জাসসাস ছিলেন কাঁচপাত্র র্নিমাতা। এমনিভাবে ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দিতে আমাদের সামনে আসেন পিতলের পাত্র বিক্রেতা (সাফ্ফার), আতর বিক্রেতা (সায়দালানী), হালুয়া বিক্রেতার পুত্র (হালওয়ারী), আটা বিক্রেতা (দাক্কাক), সাবান বিক্রেতা (সাজুনী), জুতা প্রস্তুতকারী (নায়ালী), তরকারী বিক্রেতা (বাক্কালী) এবং হাড়ী বিক্রেতা (কুদূরী) প্রমুখ।
ইসলামী সভ্যতার প্রাতঃকালেই অর্থাৎ প্রথম শতাব্দীতে মুসলমানরা যা করে দেখান, বহু শতাব্দীব্যাপী চেষ্টা করেও পাশ্চাত্য জগত তা করতে পারেনি- অর্থাৎ কিনা কোন পেশাই মূলতঃ নীচ কিংবা সম্ভ্রান্ত নয়, আসলে মানুষই উচ্চতর গুণাবলীর অধিকারী হয় অথবা তা থেকে বঞ্চিত হয়। (আবু হানিফাঃ জুন্দী)