ইসলামের পুনর্জাগরণে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ভূমিকা
মূল: খলিল আহমদ হামেদী
অনুবাদকের কথা
তখন মিসরে চলছিল ফেরাউনী সভ্যতা পুনর্জীবনের জঘন্য অপপ্রয়াস। ইসলামের চিহ্ন মুছে ফেলার আয়োজন চলছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে। এমন এক সংকটময় মুহূর্তে ইখওয়ানুল মুসলেমূনের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯২৮ সালে। আন্দোলনের পতাকা হাতে ছুটে আসেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আহবায়ক ইমাম হাসানুল বান্না।
আধুনিক যুগে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার যে কর্মসূচী ও কর্মকৌশল নিয়ে ইখওয়ানুল মুসলেমূন যাত্রা শুরু করেছিল, দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের সে ইতিহাস জানা অত্যন্ত গুরুত্বের দাবী রাখে। ইখওয়ানুল মুসলেমূনের ওপর জুলুম নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চালানো হয়েছে, আধুনিক যুগের অন্য আর যে কোন ইসলামী আন্দোলনে সে দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবেনা। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা নেতৃবৃন্দের প্রতিও চলেছে ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতন ও বর্বরতা। বিনা অপরাধে হাজার হাজার মানুষকে চরম শাস্তি দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র ইখওয়ান কর্মীর আত্মীয় স্বজন হবার কারণে। তবুও ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় তাঁরা উতরে গেছেন। ইখওয়ানের জুলুম নির্যাতনের এ ইতিহাস আমাদের ঈমানকেও তাজা ও মজবুত করার প্রেরণা যোগাবে।
সর্বোপরি যে কারণে এ পুস্তিকাটি অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি তা হলো-দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ইখওয়ানের তৎপরতা ও ভূমিকার সাথে আমাদের আন্দোলনের একটা তুলনামূলক পর্যালোচনা খুঁজে পাওয়া। সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে ইখওয়ান যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে দেখায় তা সত্যি আমাদের বিস্মিত করবে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে ইখওয়ানের আন্দোলনের যে গতিধারা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল, আমরা তার চেয়ে কতোটা অগ্রসর নাকি অনেক পিছিয়ে রয়েছি, তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। এছাড়া আধুনিক যুগে ইসলামী আন্দোলন কি ধরনের বাধা প্রতিবন্ধকতা ও জুলুম নির্যাতনের মুখোমুখি হতে পারে এবং তা মোকাবিলায় কি ধরনের উপকরণ, কতোটা মজবুত ঈমান ও অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন সে সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত হওয়া দরকার।
মরহুম খলিল আহমদ হামেদী অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইখওয়ানের আন্দোলনের একটা সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছেন। পুস্তিকাটির মূল নামের খানিকটা পরিবর্তন করতে হয়েছে সংগত কারণেই। পাঠকরা এ থেকে সামান্য উপকৃত হলে আমাদের শ্রম সার্থক হবে। দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়িত প্রত্যেকের জন্য এটি হোক প্রেরণার উৎস। আমীন।
–অনুবাদক
বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আন্দোলন পূর্ব অবস্থা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর পরই মিসর কঠিন রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়। দেশের অভ্যন্তরে নান ধরনের জাতীয় ও গোত্রীয় সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তুরস্ক জাতীয়তাবাদের পতাকাবাহী তুর্কীরা যখন খেলাফত ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে, সে সময় তাদের এই সংস্কার কাজে আরবদের মাঝে জাতীয়তাবাদ এবং স্বাদেশিকতাবাদের অনুরাগ প্রবল হয়ে। স্বীয় ইতিহাস, রাজনৈতিক মর্যাদা এবং আজহারের জাতীয় অবস্থান এছাড়াও অপরাপর নানান কারণে মিসর আরব বিশ্বের নেতৃত্ব লাভ করেছিল। এ কারণে মিসরে জাতীয়তাবাদ ও স্বাদেশিকতাবাদের শ্লোগান যখন উত্থিত হয় তখন সাথে সাথে সমগ্র আরব দেশগুলোতে এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়। বিভিন্ন স্বদেশী আন্দোলন ডানা মেলতে শুরু করে। সা’আদ জগলুলের (১৯২৭ মৃঃ) শ্লোগান-
(**********************আরবি**********************)
(দীন আল্লাহর এবং দেশ আমাদের সকলের) সমুন্নত হয়। মোস্তফা নাহাশ পাশার (১৯৬৪ মৃঃ) নেতৃত্বে ওয়াফদ পার্টির যাত্রা শুরু হয়। স্বদেশী আন্দোলন স্বদেশ পূজার অন্তরালে এবং তুর্কীদের খেলাফতের বিলোপ সাধনকে বাহানা বানিয়ে নাস্তিকতা, যরোয়েষ্ট্রীয়, অশ্লীল চিন্তা এবং পাশ্চাত্যপূজা) দীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে আদর্শিক দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। সংস্কারবাদীদের অবস্থান ছিল বেশ মজবুত। কারণ ক্ষমতা এবং সংবাদ ও প্রচার মাধ্যমগুলো ছিল তাদের দখলে। এসবের মুকাবিলায় ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহীরা শুধু কমজোরই ছিল না বরং যতোটুকু ছিল তাও আত্মনির্ভরশীলতা থেকে বঞ্চিত। অধিকন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষও দেশের পরিবেশকে কলুষিত করে তোলে। ওয়াফদ পার্টি ক্ষমতাসীন হলে দস্তুর পার্টির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার প্রচেষ্টায় লেগে যায়। পক্ষান্তরে দস্তুর পার্টি ক্ষমতায় এলে দেশকে ওয়াফদ পার্টির হাত থেকে পবিত্র করার ইস্যু তৈরি করে।
সেসময় আলী আব্দুর রাজ্জাকের যুগের অপমানজনক গ্রন্থ আল ইসলাম ওয়াল উসুলুল হুকুম (ইসলাম ও শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি) প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এবং খেলাফত ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক অধিকার প্রদানের কোনো অবকাশও ইসলামে নেই। ত্বাহা হোসাইনের গ্রন্থ ফীশ শি বিল জাহিলী ও এ দ্বন্দ্ব সংকুল যুগের উৎপাদিত। যেখানে স্বয়ং কুরআন সম্পর্কে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করা হয়। কাসিম আমীনের তাহরীরুল মারতা তে এমন নারী স্বাধীনতা দাবি করা হয় যা পাশ্চাত্যের নারীরা অবাধে ভোগ করে। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইসলাম তথা অন্যান্য সকল ধর্মের প্রতি হামলা চালানো হয়। সাপ্তাহিক আসসিয়াত সংস্কারপন্থীদের মুখপত্র ছিল। এটি পক্ষপাতহীনভাবে সংস্কার, ফেরাউনী সভ্যতার পুনরুজ্জীবন এবং পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার দাওয়াত প্রচার করতো। দস্তুর পার্টির প্রভাবশালী নেতা আদলী ইয়েকেন, আবদুল খালেক সবুওয়ত, ইসমাঈল সিদকী, মুহাম্মদ মাহমুদ এবং লুতলী সাইয়েদ ছিল এবং পৃষ্ঠপোষক এবং তারা ইসলামের প্রতি এটির আক্রমণের উদ্যম বাড়িয়ে তুলতো। কিন্তু তার শক্তিমান সম্পাদকের মৃত্যুর (১৯২৬) পর এটিও চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সংবাদপত্রের জগতে শুধুমাত্র মুহেবুদ্দীন আলখতীব এর সাপ্তাহিক আলফাতাহ টিকে থাকে। কিন্তু এর অবস্থা এমন ছিল যে, বাদ্য শালার ভেতর গানের পাখীর আওয়াজ কেইবা শুনতে পারে।
যেমন আমি উল্লেখ করেছি দীনের অবস্থান দুর্বল এবং নেতিবাচক। এমতাবস্থায় সাইয়েদ জামালউদ্দিন আফগানীর (১৮৯৭) পর মুহাম্মদ আবদুহূ তাঁর মিশন সুসংহত করেছিলেন। কিন্তু শেখ মুহম্মদ আবদুহূ রাজনৈতিক ময়দানে ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তেমনি আবার তিনি তাঁর শিক্ষক জামালুদ্দীন আফগানীর বিপরীত ইউরোপের ব্যাপারে ভীত ছিলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্য থেকে সাইয়েদ রশীদ রেজা (১৯৩৩) ছাড়া আর কোনো মুজাহিদ পুরুষ বেরিয়ে আসেনি। রশীদ রেজার কর্মক্ষেত্র যদিও সীমাবদ্ধ ছিল এবং তিনি তুর্কী ও আরবদের দ্বন্দ্বে আরব জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তার পরে প্রয়োজনীয় আওয়াজও নিস্তব্ধ হয়ে যায় এবং মোস্তফা সাদেক রাফেয়ী ছাড়া ভোগবাদ ও ভ্রষ্টামীর এ ঝড়ের মুকাবিলায় আত্মনির্ভরশীলতার সাথে এগিয়ে আসার মতো আর কেউ ছিল না।
অবস্থা এতোটাই শোচনীয় আকার ধারণ করে যে, শুধু মিসরেই নয় বরং অধিকাংশ আরব দেশগুলোতে ফেরাউনী ও নমরূদীয় কালেমা পড়ানো শুরু হয়। নবী বংশের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ফয়সল বিন হোসাইন বলেন:
(*******************আরবী**********************)
অর্থাৎ আরব হয়েছিল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মূসা (আঃ)-এর পূর্বের আরবে পরিণত।
দামেস্ক ইউনিভার্সিটিতে প্রকাশ্যে খোদার জানাজা বের করা হয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বিঘ্নে ইসলাম ও মুহাম্মদ (সা:)-এর প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ চলতে থাকে। রাজনৈতিক বৈঠকগুলোতে ইসলামের নাম উচ্চারণ করা অপমানিত হওয়ার শামিলে পরিণত হয়। পার্ক ও উদ্যানগুলোতে নিষ্ঠাবান মুসলমানরা নামায পড়তেও লজ্জা বোধ করে। এ পর্যন্ত অবস্থা গড়ানোর পর একসময় সত্যের মর্যাদাবোধ স্ব-মহিমায় দুলে উঠে এবং মাহমুদীয়ার এক নবযুবকের দ্বারা আল্লাহ সেই কাজ করান যা বড় বড় উলামা মাশায়েখ দ্বারাও সম্ভব হতো না। আর তিনি হলেন ইখওয়ানুল মুসলেমূনের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হাসানুল বান্না।