প্রথম পর্যায়: ১৯৩৩ – ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ
নীরব সংস্কার
কায়রোর প্রাথমিক বছরগুলোতে এ দাওয়াত পূর্বের মতোই নীরব ও প্রচ্ছন্নতার সাথে অব্যাহত ছিল। মসজিদে মসজিদে বক্তৃতা ও আলোচনা চলতো, সমর্থক ও সহযোগীদের সংগঠিত করা হতো, বিভিন্ন শাখা প্রতিষ্ঠা এবং শহর ও গ্রামে সফর করা হতো। এক বছর পর (১৯৩৪) ইং ইমাম হাসানুল বান্না এক নিবন্ধে বার্ষিক কার্যক্রমের রিপোর্ট দিতে গিয়ে বলেনঃ ইখওয়ানের দাওয়াত ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য মিসরের পঞ্চাশের অধিক শহর ও গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রত্যেক জায়গায় কোন না কোন কল্যাণমূলক স্কিম কার্যকর করা হয়েছে। যেমন ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ান একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে, একটি ক্লাব গঠন করেছে। বালকদের প্রশিক্ষণের জন্য হেরা নামে এবং বালিকাদের জন্যে উম্মাতুল মুমিনীন নামে বিদ্যালয় খোলা হয়েছে। শিবরাখিয়াতে মসজিদ ও ক্লাব, শিশুদের স্কুল এবং একটি কারিগরি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে ছেলেরা লেখাপড়া শেষ করেনা তারা এতে ভর্তি হবে। এভাবে মাহমুদিয়ায় বস্ত্র ও কার্পেট তৈরির কারখানা খোলা হয়েছে। এর পাশাপাশি পবিত্র কুরআন হিফয ও পঠন শিক্ষার পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কাহলিয়াতেও হিফয ও নাযেরার মাদ্রাসা চালু হয়েছে। মোট কথা, আউফু তেকে ইস্কান্দারিয়া পর্যন্ত প্রত্যেক শাখাই কোন না কোন কল্যাণমূলক স্কিম চালু করেছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান এবং সরকারের কাছে সংস্কার দাবী
স্বয়ং দাওয়াতের মেজাজ এবং এর ওপর দেশের নতুন নতুন সমস্যা আন্দোলনের বৃত্তকে সম্প্রসারিত করে। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াবলীও এর উদ্দেশ্যের মাঝে সংমিশ্রিত হয়। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইখওয়ান যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক স্কিম চালু করে জনগণের মধ্যেই শুধু এর গ্রহণযোগ্যতা অর্জিত হয়নি বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারও এর প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মাহমুদ পাশা ইখওয়ানকে সে অঞ্চলগুলোতেও বিদ্যালয় খোলার পরামর্শ দেন যেখানে সরকারের বিদ্যালয় ছিলনা। হাসানুল বান্না এক দীর্ঘ চিঠিতে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ঃ
মিসরীয় সমাজে নৈতিকতা ধ্বংসের মুখোমুখি। নৈতিক মহত্ব ও সৌন্দর্য মহিমা দুঃখজনক ভাবে চুরমার হয়ে গেছে। চতুর্দিক থেকে এর ভিত্তি দুর্বল করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। তরুণ ও যুবসমাজ, ব্যক্তি পরবার বলতে গেলে প্রত্যেকে ধ্বংসের নিশানায় পরিণত হয়েছে এবং তড়িৎ সংস্কারের উপযোগী হয়ে পড়েছে। সংস্কারের জন্যও বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা জরুরী। মৌলিক ও বুনিয়াদি পন্থা হলো, শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংশোধন করা, রাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা, যুবকদের অবসর সময় কাজে লাগানোর উত্তম সুযোগ ও ক্ষেত্রে সৃষ্টি করা এবং কঠোর হস্তে অন্যায় দমন করা।
মাহমুদ পাশা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্ন পর্যন্ত যে কজন মন্ত্রীর মন্ত্রীসভা দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়, ইমাম হাসানুল বান্না তাঁদের সকলকে দলের পক্ষ থেকে পত্র লিখেন। এ পত্রগুলোতে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রস্তাব পেশ করা হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেশের অবস্থা শোধরানোর পরামর্শ দেয়া হয়। এ ছাড়া ইসলামী শরীয়ত চালু করার দাবী জানানো হয়। মাহমুদ পাশাকে তিনি যে পত্র লেখেন, এতে বিস্তারিতভাবে মিসরীয় জাতির অবস্থা বর্ণনা করা হয় এবং মিসর যে অজ্ঞতা, দরিদ্রতা, রুগ্নতা, নৈতিক অধঃপতন এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে অনগ্রসর ছিল তাও উল্লেখ করা হয়। তাঁর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে দৃষ্টি আকর্ষণমূলক পত্র পাঠানো হয় সেখানে তিনি লিখেনঃ
এসবের প্রতিকার ও সমাধান কিতাবুল্লাহর শিক্ষায় রয়েছে। যদি এ অজুহাত পেশ করা হয় যে, দেশে ইংরেজ ক্ষমতাসীন, তবে তা হবে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অজুহাত। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ইংরেজদের কোন সম্পর্ক নেই। আর যদি এ দলীল দেয়া হয় যে, এখানে লক্ষ লক্ষ বিদেশী বাস করে তবে এও গুরুত্বহীন প্রমাণিত হবে। আমরা আলোচনার মাধ্যমে ওদেরকে বোঝাতে পারি। ওরা নিজেরাই দেখে নেবে যে, ইসলামের বিধান ও শিক্ষা কিভাবে ওদের অধিকার সংরক্ষণ করে এবং ওদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দেয়। একথা আমরা অমুসলিমদেরও বলবো। আমাদের ইতিহাস অধ্যয়ন করা তাদের উচিত যে, আমরা কিভাবে ওদের সাথে ন্যায় ইনসাফ বজায় রাখি। মূল সমস্যা স্বয়ং মিসরীয় নেতৃত্ব। তারা ইসলামের দাওয়াত ও মেজাজ সম্পর্কে অনবহিত। প্রয়োজন হলো তাদের নিজেদেরই ইসলামের আকিদা বিশ্বাস এবং শরীয়তের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। মিসরে নাস্তিকতার ব্যাধি এসেছে তুরস্ক থেকে। এ কারণে আমরা মুহাম্মদ মাহমুদ পাশার সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি যে, এর মুকাবিলায় ইসলামের কালেমা বুলন্দ করুন এবং একে নিজেদের রীতি নীতিতে পরিণত করুন।
মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের প্রতি দাওয়াত
ইখওয়ানুল মুসলেমূনের সে পত্রটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, যা তাঁরা ১৯৩৬ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট ফারুক, প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা নাহাস পাশা এবং আরব ও মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের কাছে লিখেন। এ পত্রের শিরনাম ছিল আলোর ডাক। পত্রটি আজো আমাদের সামনে বিদ্যমান রয়েছে পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠার একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকাকারে। একত্রে তাঁরা অত্যন্ত তাঁরা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ ভাষার চমৎকারিত্বে প্রথমে ইসলামের মৌলিক ও প্রাথমিক ধারণা এবং ইসলামী তাহযীব তমুদ্দনের ওপর আলোকপাত করেন। এছাড়া সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, এ ধরনের শ্রেষ্ঠ জীবন দর্শনের উপস্থিতি স্বত্বেও পাশ্চাত্য জীবনধারা এবং সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা ভীষণ অনিষ্টকর। এ প্রাথমিক আলোচনার পর ইসলামী জীবন দর্শন ও পাশ্চাত্য জীবন দর্শনের তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। দুটি পদ্ধতিরই বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়। অতএব এ ফলাফল গ্রহণ করা হয় যে, ইসলাম প্রতিটি ক্ষেত্রে চাই তা সামরিক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য,অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার অথবা রাষ্ট্রীয় আইন কানুন যাই হোক না কেন মুসলিম উম্মাহর উন্নয়ন এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করে। পরিশেষে পঞ্চাশটি বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা হয়। এগুলোর মধ্যে দশটি রাজনৈতিক, বিচার বিষয়ক এবং রাষ্ট্রীয় নীতি পদ্ধতি সম্পর্কিত। ত্রিশটি সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক এবং দশটি অর্থনৈতিক বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রকৃতপক্ষে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেই এ প্রস্তাবগুলো তৈরি করা হয়। এগুলোর প্রতি এক নযর তাকালেই বুঝা যায় এর সম্পাদনকারীরা শুধুমাত্র পুঁথিগত জ্ঞানের অধিকারীই নয় বরং তাঁরা দেশের সমস্যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বাস্তব অভিজ্ঞতার অধিকারী। প্রস্তাবগুলো যদিও আজ থেকে ত্রিশ বছর পেরিয়ে যাবার পরও আজো তা সমভাবে উপযোগী ও তাজা মনে হবে। পত্রটির সমাপ্তি কথাগুলো ছিল নিম্নরূপঃ
আমরা আমাদের সকল শ্রম, যোগ্যতা ও উপকরণ প্রত্যেক সেই সরকারের জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত আছি যারা উম্মতে মুসলিমার উন্নতি ও কল্যাণের জন্য নিবেদিত প্রাণ হতে বদ্ধ পরিকর হবে। আমরা তাদের প্রতিটি ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেবো এবং সকল ত্যাগ ও কুরবানি করতে প্রস্তুত থাকবো।
১৯৩৮ সালে মিসরের প্রেসিডেন্টকে এক পত্র লেখা হয়। এতে রাজনৈতিক দলগুলো দেশে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছিল সে অভিযোগ উল্লেখ করা হয়। আমীর উমর তূসন ও আমীর মোহাম্মদ আলী তওফীককেও একই বিষয়ে পত্র লেখা হয়।
ইখওয়ানের এ ধারণা ছিল যে, সে সময় যতগুলো রাজনৈতিক দল ছিল তা স্বগঠিত। জনপ্রতিনিধিত্বশীল নয়। আর এটাই সুবর্ণ সময় যে, সকল দেশ প্রেমিক ব্যক্তি সঠিক ইসলামী উদ্দেশ্যের ওপর ঐক্যবদ্ধ হবে এবং একে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ও আন্তরিক প্রচেষ্টার দ্বারা কার্যকরী করে তুলবে। ১৯৩৮ সালে আইনমন্ত্রী আহমদ খাসাবা পাশাকেও একটি দীর্ঘ স্মারকলিপি প্রদান করা হয় যেখানে আইন মন্ত্রীর কাছে এ দাবী পেশ করা হয় যে, পঞ্চাশ বচর ধরে অনৈসলামিক আইন কানুন পরীক্ষা করা হয়েছে কিন্তু তা চরম ব্যর্থই প্রমাণিত হয়েছে। এবার ইসলামী শরীয়তের পরীক্ষা করা হোক। এ পত্রে ইসলামী আইনের উপযোগিতা ও শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে স্বয়ং পাশ্চাত্যবাসীর সাক্ষ্য স্বীকৃতও পেশ করা হয়।
১৯৩৮ সালে মুস্তফা নাহাস পাশা যখন প্রধান মন্ত্রিত্বের পদে সমাসীন হন তখন ইখওয়ান তাঁকেও একটি স্মারকলিপি প্রদান করে। তাঁর কাছে দাবী করা হয় যে, মিসরের বৈদেশিক নীতি ইসলামী দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বের মৌলনীতির ওপর সুসংহত হওয়া উচিত এবং এর লক্ষ্য হবে ইসলামী ঐক্য প্রতিষ্ঠা। ১৯৩৯ সালে নাহাস পাশাকে আরো একটি পত্র লেখা হয় এবং পরামর্শ দেয়া হয় যে, নাহাস পাশার নেতৃত্বাধীন ওয়াফদ পার্টির সদস্যর জীবন ইসলামের প্রকৃত আদর্শে উজ্জীবিত হওয়া উচিত। এছাড়া ওয়াফদ পার্টি তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ইসলামী মূলনীতির আলোকে গঠন করুক। এই ঘোষণাপত্রে আইন প্রণেতাদের নীতিতে সংস্কার এবং প্রচলিত ও শরীয় আদালতের পার্থক্য বিমোচন এবং সকল আদালতে ইসলামী শরীয়ত চালু করার প্রস্তাব ছিল। এছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কারের রূপরেখাও পেশ করা হয়। প্রত্যেক স্বাস্থ্যবান নাগরিককে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া, অন্যায়ের প্রতিরোধ, অর্থনৈতিক পলিসির পরিবর্তন, ইউরোপীয় অনুকরণের প্রবণতা রোধ, সরকারি রীতি নীতির বিপর্যয় সংশোধনের প্রস্তাব অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ সকল পত্রের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল মিসরে ইসলামী সমাজ ও ইসলামী হুকুমত কায়েম করা। আরব দেশগুলোতে এই পত্রগুলো ইসলামী মান ব্যক্তিদের অনুভূতিকে জাগ্রত করতে অত্যন্ত সহায়ক ছিল।
ইখওয়ান শুধুমাত্র পত্র লেখাতেই থেমে থাকেনি। বরং মিসরীয় শাসক গোষ্ঠীকে নসিহত ও বোঝানোর যত সর্বোত্তম পন্থা ও মাধ্যম ছিল সবই ব্যবহার করে। ১৯৬৩ সালে হাসানুল বান্না নাহাস পাশার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সে সময় নাসিম পাশা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইখওয়ান নাসিম পাশার সরকারের কাছে মিসরীয় শিক্ষকদের মাঝে দীনি শিক্ষা চালুর দাবী করেছিল। হাসানুল বান্না নাহাস পাশাকেও এ দাবীর ব্যাপারে বিস্তারিত অবহিত করেন এবং দেশের প্রখ্যাত রাজনীতিক হওয়ার কারণে এ দাবীর জন্য তাঁর সহযোগিতাও লাভ করেন। নাহাস পাশা, হাসানুল বান্নার প্রতি এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে, স্বয়ং হাসানুল বান্নারই বক্তব্য তিনি তাঁকে অর্থাৎ হাসানুল বান্নাকে ওয়াফদ পার্টির একজন রাহনুমা উপদেষ্টা মনে করতেন।
অমুসলিম রাষ্ট্রের ব্যাপারে ইখওয়ানের নীতিগত অবস্থান
রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য ইখওয়ান যে প্রচেষ্টা চালায় সে ধারানুযায়ী এ কথা জেনে রাখা আবশ্যক যে, ইতোমধ্যে মিসরে একের পর এক যতো সরকারই এসেছে, চাই তা দাসতুর পার্টির হোক অথবা ওয়াফদ পার্টির অথবা আজাদ, ইখওয়ান তাদের কারোরই পৃষ্ঠপোষকতা করেনি বরং সর্বদা তাদের কাছ থেকে দূরে অবস্থান করেছে। ইখওয়ানের এ নীতিতে যে উদ্দেশ্য ছিল তা হলো:
“যে সরকার সরাসরি অনৈসলামিক মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার দ্বার কখনোই কোন কল্যাণের আশা করা যায় না। তারা কোন প্রকার সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভের যোগ্য নয়।”
যদিও শাসক গোষ্ঠী মুসলমান এবং তারা ইসলামের প্রকাশ্য অস্বীকারকারী নয়। এ কারণে ইখওয়ান প্রত্যেক সরকারের কাছে সংস্কার সংশোধনের দাবী জানায় এবং দেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিধান চালু করার আপিল করতে থাকে। এর পাশা পাশি তারা নিজেরাও এর অনুসারী হয়। তারা কখনও সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়োগের পথ অবলম্বন করেনি। বরং দেখা যায় যদি কখনো সরকার তাদের দাবী দাওয়া আন্তরিকতার সাথে মেনে নেয়ার স্বীকৃতি দেয়, তখন তারাও তাদের সমর্থন প্রদানে কৃপণতা করে না।
সামষ্টিক দাওয়াত
এ পর্যায়ে সর্বশেষ ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এ ছিল যে, ইখওয়ানের মিশন এক সুদূরপ্রসারী ব্যাপক ও পরিপূর্ণ দাওয়াত রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩৮ সালে কায়রোতে পঞ্চম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় – যেখানে ইমাম হাসানুল বান্না এক দীর্ঘ বক্তৃতা পেশ করেন এতে পূর্ণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ বিস্তারিতভাবে তিনি ইখওয়ানের উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচী তুলে ধরেন। স্বীয় দাওয়াতের ব্যাপকতার প্রতি ইঙ্গিত জানিয়ে তিনি বলেনঃ
ইখওয়ানুল মুসলেমূন একটি প্রাচীন দাওয়াত। এ কারণে যে, ইখওয়ান ইসলামের গোঁড়ার দিকে প্রত্যাবর্তনের দাওয়াত দেয় এবং কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের মূল উৎসের প্রতি ডাক দেয়। এটি একটি তরীকায়ে সুন্নীয়াত। কারণ ইখওয়ান সকল আচার আচরণ ও ইবাদত অনুষ্ঠানে পবিত্র সুন্নতের অনুসরণ করার চেষ্টা করে। এটি একটি তাসাওফ। কেননা ইখওয়ানের চিন্তাধারায় নেকীর ভিত্তি হলো আত্মশুদ্ধি, করবের বিশুদ্ধতা, অবিরাম আমল, সৃষ্টির প্রতি মুখাপেক্ষীহীনতা, আল্লাহ প্রেম এবং কল্যাণের পথে সহযোগিতা। এটি একটি রাজনৈতিক দল কারণ ইখওয়ান একদিকে সরকারের কাছে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ে সংস্কারের দাবী জানায় এবং অপরদিকে জাতিকে স্বকীয়তা ও আত্নমর্যাদাবোধের প্রশিক্ষণ দেয়। এটি একটি সামরিক সংগঠন। কারণ ইখওয়ান শারীরিক প্রশিক্ষণের উপর বেশী গুরুত্বারোপ করে এবং স্পোর্টস দল গঠন করে। এটি একটি সাংস্কৃতিক সংঘ। কেননা ইখওয়ানের ক্লাব বাস্তবে এক তালীম ও তাহযূবের শিক্ষালয় এবং বিবেক বুদ্ধি ও রুহকে আলোকিত করার প্রতিষ্ঠান। এটি একটি অর্থনৈতিক কোম্পানি। কারণ ইসলাম বিশেষ দৃষ্টিকোণের অধীনে সম্পদ উপার্জনের নির্দেশনা দেয় এবং ইখওয়ান ইসলামের শিক্ষানুযায়ী জাতীয় অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। এটি একটি সামাজিক দর্শন। কারণ ইখওয়ান সমাজের সকল ব্যাধির প্রতি মনোনিবেশ করে। এগুলোর উপশমের চিন্তা করে। জাতিকে এ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য তৎপর হয়। (সংক্ষিপ্ত )
ইসলাম প্রসঙ্গে ইখওয়ানের চিন্তাধারা
এ বক্তৃতায় হাসানুল বান্না নিজ দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য, নীতিমালা ও কর্মসূচী এবং জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে দলের দৃষ্টিভঙ্গি ও অপর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে দলের পলিসির ওপর বিশদ আলোকপাত করেন। এ বক্তৃতা পরবর্তীতে দলের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এজন্য বক্তৃতার কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দিক বর্ণনা করা প্রয়োজন মনে করছি।
“কিছু কিছু লোক ইসলামকে শুধু মাত্র বাহ্যিক ইবাদত অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করে। যদি তারা নিজেরা তা পালন করে অথবা অপর কেউ তা সম্পন্ন করে তবে এতেই তারা নিশ্চিত হয়ে যায়। কেউ কেউ ইসলামকে উন্নত আচার এবং পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক ছাড়া আর কিছু মনে করে না। এদের কাছে বৈষয়িক জীবনের সমগ্র কদর্যতা থেকে পূর্ণরূপে দূরে থাকার নামই ইসলাম। কতিপয় লোক ইসলামের বাস্তব এবং সংগামী দিকের মুখরোচক বুলি ছাড়া সামনে অগ্রসর হয় না। কিছু লোক ইসলামকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এবং অনুকরণীয় জিনিস মনে করে। যাদের জীবন সংগ্রামে না কোন ত্যাগ আছে না ফায়দা। এ কারণে তারা ইসলামের ব্যাপারে এবং সে সব বিষয়ে ভুলেও নাক গলাতে যায়না যার সাথে ইসলামের সম্পর্ক রয়েছে এ ধরনের কথাবার্তা আপনারা তাদের কাছে শুনতে পারেন, যারা ফিরিঙ্গী সভ্যতা সংস্কৃতির রঙয়ে রঙ্গিন। এদের একই প্রকৃতির আরো কয়েকটি দল রয়েছে, ইসলামের ব্যাপারে যারা নিজস্ব একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। আমাদের বিশ্বাস হলো, ইসলামের শিক্ষা এবং এর বিধান জাগতিক ও পার্থিব উভয় জীবনের সাথে সম্পর্কিত। যারা এটা মনে করে যে, ইসলামের শিক্ষা জীবনের আধাত্নিক দিক অথবা ব্যক্তিগত ইবাদতের গণ্ডি সীমাবদ্ধ, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই, তারা কঠিন ভ্রান্তির মাঝে নিমজ্জিত। ইসলাম যেমন আকিদা বিশ্বাসের নাম তেমন ইবাদতের নাম। দেশ, জাতি, দীন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, আধ্যাত্মিকতা ও বাস্তব কর্মের নাম। ইসলাম একদিকে কুরআন অপরদিকে তরবারীরও নাম। কুরআন এ সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এবং এগুলোকে ইসলামের মূল বিষয় বস্তু হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।” (সংক্ষিপ্ত )
ইখওয়ানের দাওয়াতের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে হাসানুল বান্না উল্লেখ করেন – এ দাওয়াতের বৈশিষ্ট্যসমূহ এর সমসাময়িক দলগুলোর মধ্যে পাওয়া যাবে না তার কতিপয় হলোঃ
১. ফিকহী মতবিরোধ মুক্ত
২. প্রভাবশালী মহলের মুখাপেক্ষীহীনতা
৩. রাজনৈতিক দলসমূহ থেকে দূরে অবস্থানকারী
৪. কর্ম পদ্ধতিতে ক্রমবিন্যাস নীতির অনুসরণ
৫. প্রচারবিমুখ ফলদায়ক বাস্তব কাজ
৬. শহর ও গ্রামে দাওয়াতের দ্রুত বিস্তার লাভ
উদ্দেশ্যে ও কর্মনীতি
উদ্দেশ্য ও কর্মনীতিকে সংক্ষিপ্ত আকারে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ইখওয়ানের চেষ্টা সংগ্রামের উদ্দেশ্য ও দাবী শুধু এটাই যে, মুসলমানদের নব প্রজন্মকে ইসলামের প্রকৃত ও সঠিক শিক্ষার সাথে এতোটা পরিচিত করে তোলা, যেনো তারা জীবনের সকল ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গরুপে ইসলামের অনুসরণ করে। এ উদ্দেশ্য পূরণে তারা যে কর্মনীতি গ্রহণ করেছে, সংক্ষিপ্তভাবে তা হলোঃ
জনমতকে পরিবর্তন করা এবং দাওয়াতের পতাকাবাহী ও পৃষ্ঠপোষকদের ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়া, যেনো তারা ইসলামের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকতে পারে এবং ইসলামের আনুগত্য অনুসরণে অন্যের জন্য আদর্শ হয়ে উঠে।
সংগঠনের কর্মীদের সামনে আদর্শ দায়ীর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য পেশ করতে গিয়ে হাসানুল বান্না বলেনঃ
তোমাদের মধ্যে যখন এমন তিনশত লোক তৈরি হবে, যাদের প্রত্যেকে রুহানীয়াতের দিক থেকে ঈমান ও আকিদার শক্তিতে বলিয়ান হয়, চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে জ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতির অলংকারে সজ্জিত হয় এবং দৈহিক দিক থেকে সুস্থ শরীর ও সামরিক প্রশিক্ষণে পরিপূর্ণতা লাভ করে, তখন তোমরা আমার কাছে দাবী করতে পারো যে, তোমাদের নিয়ে সমুদ্রের বিশাল প্রশস্ততা পাড়ি দেবো। আকাশের শূন্যতায় ভেসে বেড়াবো এবং সকল বাতিল শক্তির সাথে লড়াই করবো। তখন একাজ করতে ইনশাআল্লাহ আমি মোটেও সংশয়িত হবোনা।
সন্ত্রাস ও ক্ষমতা লিপ্সার অভিযোগ এবং তা জবাব
বিরোধীদের কতিপয় আপত্তি এবং সন্দেহ সংশয়ের জবাব দিতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন: একটি গোষ্ঠি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করে, ইখওয়ানুল মুসলেমূনের কার্যক্রমে রাষ্ট্র ও ক্ষমতাও কি অন্তর্ভুক্ত? যেমন আপনারা মনে করেন- ইখওয়ানুল মুসলেমূন তার সকল পদক্ষেপ ও পরিকল্পনায় ইসলামী সীমারেখার পরিপূর্ণ অনুসারী। এটি যে ইসলামের ওপর ঈমান পোষন করে, তা রাষ্ট্রকেও ততোটাই জরুরী স্বীকৃতি দেয় যতোটা তাবলীগ ও নসীহতকে। ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রাঃ) বলেনঃ
**************আরবী***************
“আল্লাহ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ক্ষমতা দ্বারা সেই সমস্ত বিষয়ের প্রতিরোধ করেন, যার প্রতিরোধ একাকী কুরআন দ্বারা হয়না।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষমতাকে ইসলামের একটি কড়া হিসেবে গণ্য করেছেন এবং ফিকাহর গ্রন্থ সমূহেও ক্ষমতাকে আকায়েদ ও উসুলের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে, শাখা প্রশাখার মধ্যে নয়।
অধিকাংশ লোক জিজ্ঞেস করে যে, ইখওয়ানুল মুসলেমূন কি তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য শক্তি ব্যবহার করে? অথচ সন্ত্রাসবাদী বিপ্লব বলতে যা বোঝায়, ইখওয়ান সে সম্পর্কে চিন্তাও করতে চায়না। তারা কোন অবস্থাতেই এ পদ্ধতির ওপর ভরসা করেনা, আর না এর সুবিধা গ্রহণ ও লাভবান হওয়া তার আকাঙ্ক্ষা। এভাবেই তারা মিসরের প্রত্যেক সরকারকে সুস্পষ্টভাবে বলে যে, অবস্থা যদি এরকমই থাকে এবং বিশেষজ্ঞ মহল এর প্রতিকারের কোন পদ্ধতির কথা চিন্তা না করে, তবে এর অনিবার্য পরিণতি চরমপন্থি বিপ্লবের রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, এ প্রকৃতির বিপ্লব ইখওয়ান সংঘটিত করবে অথবা তার দাওয়াত এধরনের পরিণাম সৃষ্টি করবে। বরং এটা অবস্থার চাপ, ঘটনার দাবী ও সংস্কার থেকে পশ্চাদপসরণের পরিণতি হিসেবেই সংঘটিত হবে। (সংক্ষিপ্ত )
এ পর্যায়ে ইখওয়ান কয়েকটি সাপ্তাহিক এবং মাসিক পত্রিকাও বের করে। সাপ্তাহিক আত তাআরুফ ও আশশিআ এবং মাসিক আল মানার এ সময়েই প্রকাশিত হয় এবং কিছুদিনের ব্যবধানে মিসরের মাটি ইসলামী সাংবাদিকতার পাশাপাশি বহির্দেশেও দাওয়াতী টীম পাঠানোর রীতি চালু হয় এবং অন্যান্য আরবদেশসমূহের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অতঃপর সেসব দেশে সুযোগ সুবিধা ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ইখওয়ানের মাকা প্রতিষ্ঠা করা হয় – যা স্থায়ী কেন্দ্রের মর্যাদা লাভ করে।