ইখওয়ান নেতৃবৃন্দের শাহাদাত
এ পর্যায়ে আমি মিসরের বিখ্যাত দৈনিক আল মিসরীয়র সম্পাদক আহদ আবুল ফাতাহ রচিত গ্রন্থ ‘জামাল আবদুন নাসের’ থেকে একটি উদ্ধৃতি পেশ করছি। এ থেকে সে অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করা যাবে-যেখানে ইখওয়ানের ছয় নেতার ফাঁসীর শাস্তি এবং তাদের হাজার হাজার কর্মীকে জেলে পুরার ঘটনা উল্লেখ রয়েছে। আহমদ আবুল ফাতাহ লিখেন :
“গ্রেফতার কৃত ইখওয়ানদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা পরিচালিত হয় সে আদালতে, জামাল আবদুন নাসরে যার পিপলস কোর্ট (মাহকামাতুশ শা’ব) অভিহিত করে। এ আদালত ছিল তিনজন জজের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ তিনজনই ছিল জামাল নাসেরের সহকর্মী এবং বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। প্রকাশ থাকে যে, এ ধরনের বিচার কার্যক্রম লজ্জাজনক নাটক ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আরোপ করা হয়। কিন্তু তারা যখন আদালত কক্ষে প্রবেশ করে তখন তাদের দেহ ও মুখমন্ডলের ওপর পাশবিক নির্যাতনের চিহ্ন সুস্পষ্ট হয়ে উঠত। অথচ জজরা একবারও আদালতে এ নির্মম শাস্তি নির্যাতনের বিষয় উত্থাপন করেনি। “
এখানে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ইখওয়ানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো এবং সাধারণ লোকদের কারাগারে বন্দী করার জন্যই এ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং কার্যত এ আদালত আবদুন নাসেরের খেয়ালখুশির অধীনে দমন অভিযানই পরিচালনা করে। আদালত সাত ব্যক্তিকে ফাঁসির নির্দেশ দেয়। তাদের মধ্যে একজন হলেন ইখওয়ানুল মুসলেমূনের মুরশিদে আলা হাসানুল হুযাইবী এবং বাকী ছয়জন সংগঠনের প্রথম শ্রেণীর নেতা। যাদের নাম হলো এডভোকেট আবদুল কাদের [আবদুল কাদের আওদাহ ইখওয়ানুল মুসলেমূনের বিশিষ্ট নেতাদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি ফারুকের শাসনামলে মিসরীয় আদালতের জজ ছিলেন। কিন্তু মুসলমান হবার কারণে অনৈসলামিক আইনের অধীনে বিচারের রায় প্রদান তিনি জায়েজ মনে করেন না বলে এ উচ্চপদ থেকে ইস্তফা দেন। এরপর তিনি ইখওয়ানে যোগদান করেন। এবং নায়েবে মুরশিদে আমের পদে উন্নীত হন। তিনি বেশ কটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে বইটি আলোড়ন সৃষ্টি করে তা হলো – ইসলামের ফৌজদারি আইন ( আততাশরীহুজ জিনায়িল ইসলামী ) এটি দুটি বৃহৎ খন্ডে সমাপ্ত। গ্রন্থটি পৃথিবীর আইনজীবী মহলের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হয়। তিনি এ গ্রন্থ ১৯৫১ সালে রচনা করেন। এ গ্রন্থের শ্রেষ্ঠত্ব এবং বিশেষ অবদানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, লেখককে ফয়াদুল আউয়াল পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। কিন্তু শর্ত আরোপ করা হলো গ্রন্থ থেকে দুটি বাক্য বাদ দিতে হবে। একটি হলো ইসলামের উত্তরাধিকার সূত্র রাজতন্ত্রের প্রবক্তা নয়। অপরটি হলো, ইসলামে কোন বিচারকই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অধ্যাপক আবদুল কাদের আওদাহ (রঃ) এ বাক্যগুলো মুছে ফেলতে অস্বীকার করেন। এবং সেই পুরস্কারকেও প্রত্যাখ্যান করেন। যার মূল্যমান ছিল এক হাজার মিসরীয় পাউন্ড। এছাড়াও তাকে বাদশা ফারুকের রোষানলে পড়তে হয়। কেননা এ বাক্যগুলোর চপেটাঘাত প্রত্যক্ষভাবে বাদশা ফারুকের উপরই পড়েছিল। এ গ্রন্থ ছাড়াও আবদুল কাদের আওদাহ (রঃ) এর আরো কিছু গ্রন্থ রয়েছে যেমন ইসলাম ও আমাদের আইন ব্যবস্থা ইসলাম ও আমাদের রাজনীতি এবং শাসনের ইসলামী শিক্ষা ইত্যাদি।], সেক্রেটারী জেনারেল ইখওয়ানুল মুসলেমূন, শায়খ মুহাম্মদ ফারগালী, ইউসুফ আলাআত, ইবরাহীম আততাইয়েব এবং হিন্দাবী দাবীর।
‘আদালতি কার্যক্রম যুলুম নির্যাতন, প্রতিশোধ গ্রহণ, সত্যকে পদদলিত করা এবং ন্যায় ও ইনসাফের নিন্দায় নিন্দিত ছিল। মিসর ও অপরাপর আরব দেশগুলোর জনগণ এ নীতির প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছিল এবং এধরনের প্রকাশ্য যুলুমের বিরুদ্ধে আরব ও ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন কর্ণার থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, জর্দান এবং ইরাকের প্রধান প্রধান শহরে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। যেখানে সামরিক এক নায়কতন্ত্রের পতনের শ্লোগান দেয়া হয়। আরব ও ইসলামী বিশ্বের সকল নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ কামনা করেন এবং জামাল আবদুন নাসেরের কাছে আবেদন জানান যে, যেভাবেই হোক তিনি যেন এ দুঃখজনক অধ্যায়ের অবসান করেন। আরব দেশগুলোর সংবাদপত্রগুলোও এ নির্দেশ এবং আদালতের কর্মকান্ড ও সামরিক সরকারের ওপর অত্যন্ত শাণিত ভাষায় আক্রমণ চালায়। কিন্তু জামাল আবদুন নাসের এসব আবেদনের প্রতি মোটেও কর্ণপাত করেনি। বরং ইখওয়ান নেতাদের মৃত্যুদন্ড প্রদানে অস্বাভাবিক তৎপরতা দেখান। যদিও ইখওয়ানের মুরশিদে আলা হাসানুল হুযায়বীকে এ দন্ড থেকে বাদ রাখা হয়।
বিশ্ব সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিগণ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন এবং অভিযুক্তদের বিষ্ময়কর নির্ভীকতা ও মনোবল নিজ চোখে দেখেন, ফাঁসী কাষ্ঠে দাঁড়িয়েও যার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি। ফ্রান্সের সবচেয়ে নামকরা পত্রিকা দৈনিক ফ্রান্স সাওয়ার এর প্রতিনিধি জন ল্যাকোয়টার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার পত্রিকায় এ ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেন। যার শিরোনাম ছিল ফাঁসী কাষ্ঠর দিকে ধাবমান লোকদের সাহস ও প্রগলভতার দৃশ্য। তিনি লিখেন কায়রো জেলের সদর দরজায় কালো পতাকা উড়ছিল যা ইখওয়ানুল মুসলেমূনের ছয়জন নেতাকে ফাঁসী দেয়ার শোকাবহ ঘটনাই প্রকাশ করছিল। এরা ফাঁসী কার্যকর করার মূহুর্তে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেন যিনি তাঁদেরকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করেন।
এ লোকেরা মৃত্যুর দিকে অস্বাভাবিক সাহসিকতার সাথে ধাবিত হয়। আটাটার সময় আপিল কোর্টের সম্মুখভাগে কালো পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়। যেখানে অভিযুক্তদের পরশু রাতেই স্থানান্তর করা হয়েছিল। রীতি অনুযায়ী জেলখানার বাইরে বইছিল ঠান্ডা বাতাস। জেলের কেন্দ্রীয় বেষ্টনীর মধ্যে দুজন দানব সদৃশ জল্লাদ যথারীতি দণ্ডায়মান হয়। মুখে উসকো খুসকো গোঁফ। কালো পোশাক পরিহিত। একটি আধখোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ওরা অপেক্ষা করছিল। এটা ছিল ফাঁসী কক্ষের দরজা। আটটা বেজে পাঁচ মিনিট পর সর্ব প্রথম নিরাপত্তা পুলিশ যাকে ফাঁসি কাষ্ঠের কাছে নিয়ে যায়, তিনি হলেন আবদুল লতিফ। তাঁর মাথায় লাল রংয়ের টুপি এবং গায়ে কালো জামা ও লাল পাজামা পরিহিত। দুপা খালি। ঠোঁট নেড়ে তিনি দোয়া পড়ছিলেন। তাঁর চেহারায় সেই প্রফুল্লতাই চমকাচ্ছিল যা আমি আদালতে শুনানির দিনই পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। অপরাধ পাঠ করার পর যাতে ইখওয়ানকে এ ব্যাপারে তিরস্কার করা হয় যে, তারা কর্নেল নাসেরের প্রাণ নাশের এবং শক্তি প্রয়োগ করে বিপ্লব সংগঠিত করতে চেয়েছিল। দুজন মৌলভী কুরআনের কোন অংশের তেলাওয়াত করেন এবং তৃতীয় মৌলভী যিনি ছিলেন দৃষ্টিহীন এবং যাকে শেখ সাদী নামে ডাকা হয়েছিল বক্তব্য রাখছিলেন যেখানে তিনি এ বিষয়ে সাক্ষ্য পেশ করছিলেন যে, আবদুল লতিফ কর্নেল নাসেরকে নিশানা বানিয়ে এক ব্যক্তিকেই শুধু নয় বরং দুই কোটি বিশ লাখ মিসরীয়কেই হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আল্লাহ মিসরীয় বাসীর কল্যাণে কর্নেল সাহেবকে রক্ষা করেন। জেলা প্রশাসক অপরাধীকে কালেমা শাহাদাত পড়ার নির্দেশ করছিল। অথচ তিনি বলতে শুরু করেন আমি আল্লাহর শোকর আদায় করছি, যিনি আমাকে শাহাদাতের মর্যাদা দিয়েছেন। শাহাদাত ইখওয়ানুল মুসলেমূনের মূল্যবান কামনা। আবদুল লতিফ কোন জিনিষ গ্রহণ করতেও অস্বীকার করেন। ইতোমধ্যে আমি একটা চিৎকার শুনতে পেলাম। কাষ্ঠ খণ্ড অপরাধীর পায়ের তলা থেকে বের করে আনা হয়েছে। সাড়ে তিন মিনিট পর্যন্ত তার প্রাণস্পন্দন সচল থেকে অতঃপর তিনি চিরদিনের মতো নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
প্রতিটি ফাঁসি কার্যকর করার পর আমাকে আধ ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করতে হয়। কেননা মিসরীয় আইনে শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির দেহ আধ ঘন্টা পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা অপরিহার্য্য ছিল। যাতে তার মৃত্যুর ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ বাকী না থাকে।
এবার ইউসুফ আলআতকে আনা হলো। তিনি সিরিয়ার সাংগঠনিক সেক্রেটারী ছিলেন। আগের জনের মতো তিনিও লাল ও কালো রংয়ের পোশাক পরিহিত। দুজন ইয়া বড় দৈত্যের মতো জল্লাদের মাঝে তাকে বেশ ছোট দেখাচ্ছিল। তাঁর শরীরের রং নীলাভ এবং মুখমন্ডল ফুলে গেছে। আমাদের সম্মুখে দিয়ে হেটে যাবার সময় দুচোখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছিলেন। ফাঁসি কাষ্ঠের নিকটে পৌছার পর তিনি দুরাকাত নামায পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু জল্লাদরা জবাব দিল মনে মনে পড়ে নাও। সুতরাং তিনি উচ্চ কণ্ঠে এ দোয়া পড়লেন –
(*************আরবী*********************)
(আমাকে ক্ষমা করে দাও এবং ঐ সকল লোকদেরকেও যারা আমার ওপর বাড়াবাড়ি করেছে। ) ইউসুফ আলআতের হৃদ স্পন্দন মাত্র দু মিনিটেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
তৃতীয় অপরাধী ইবরাহীম তাইয়র ছিলেন কায়রো জোনের গোপন সংগঠনের নেতা। এখানে তিনি যে সাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন তা কেউ ভুলতে পারবেনা। তাঁর ঠোটে মৃদু ঘৃণা মেশানো মুচকি হাসি লেগে ছিল। এছাড়া তিনি মাঝ খানে হাটার পরিবর্তে একপাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। উপস্থিত লোকদের প্রতি তাকাচ্ছিলেন নির্ভীক দৃষ্টিতে এবং অত্যন্ত পরিছন্ন কণ্ঠে বলছিলেন আল্লাহর শোকর যে, আমাদের শত্রুরাই আমাদের বিচারক সেজেছে। কিন্তু কিয়ামাতের দিন একজন ন্যায় পরায়ণ বিচারকের সামনে যালিম ও মজলুম উভয়েই হাযির হবে এবং সেই বিচারক হক ও ইনসাফের সাথে ফয়সালা করবেন। এক সময় তিনি জল্লাদকে বলছিলেন খুব শক্ত করে বেধোনা শেকল আমার বাহু ছিড়ে ফেলছে। আপন অর্থবহ মুচকি হাসি নিয়ে তিনি শেষ দরজায় প্রবেশ করেন।
চতুর্থ অপরাধী ছিলেন একজন আইনজীবী। তাঁর নাম হান্দাবী দাবীর। খুনিকে অস্ত্র সরবরাহ এবং হত্যার ব্যাপারে তাকে উত্তেজিত করাই ছিল তাঁর প্রতি আরোপিত অভিযোগ। তাঁর কোন শেষ ইচ্ছা আছে কিনা একথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন আমি জামাল আবদুন নাসেরের কাছে দয়া দাবী করছি। জেলার জবাব দেয় আপনার এ ইচ্ছা তাঁর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। অতঃপর তাঁকেও কালো ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর একজন সুদর্শন মহিমান্বিত শায়খের পালা এলো। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ ফারগলী। ইখওয়ানের বিখ্যাত মুবাল্লিগ। সুমিষ্ট হাসি মুখে এগিয়ে এলেন। তাঁর মুখে এ কথাগুলো বাজছিল আল্লাহু আকবার, আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হচ্ছে। জেলের এক মৌলভী সাহেবের কানে কানে তিনি মৃদু স্বরে কি যেন বললেন এবং ফাঁসি কাষ্ঠের দিকে এগিয়ে গেলেন।
ষষ্ঠ ও সর্বশেষ অপরাধী যাকে ফাঁসি মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তিনি হলেন শায়খ আবদুল কাদের আওদাহ। তিনি ছিলেন ইখওয়ানের আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা। নাজীব ও ইখওয়ানের মাঝে তিনিই ছিলেন মধ্যস্থতাকারী। আদালতের ভেতর তিনি আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর অত্যন্ত বিজ্ঞজনোচিত বক্তব্য পেশ করেন এবং তাকে যখন মৃত্যুর পরওয়ানা শোনানো হয়, তখন তিনি মুচকি হেসে কৃতজ্ঞ চিত্তেই তা গ্রহণ করেন। আমাদের সামনে তাঁকে উন্নত মস্তক ও শান্ত পদেই অতিক্রম করতে দেখেছি চোখে ছিল মুচকি হাসির উজ্জ্বলতা। গম্ভীর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন তিনি। সর্বশেষ কতগুলো আরবী কবিতা আবৃত্তি করছিলেন তিনি। যার মর্ম হলো আমি যদি আল্লাহর পথে জীবন দিতে পারি, তবে আমার কোন কিছুর পরওয়া নেই। তিনি তার মস্তক খুব উঁচু করে বলেন – আমার রক্ত বর্তমান সরকারের জন্য অভিশাপে পরিণত হবে। কোন কিছু গ্রহণ করতে তিনি অস্বীকার করেন। ফাঁসি কাষ্ঠের দিকে যাবার সময় তিনি নির্ধারিত জল্লাদদের পেছনে ফেলে নিজেই অগ্রসর হন।
(সূত্রঃ সংবাদ পত্র ফ্রান্স সাওয়ার প্যারিস ৮ ডিসেম্বর ১৯৫৪ )
এ ছয় ব্যক্তি হলেন তাঁরা, যাদেরকে আবদুন নাসের ফাঁসির সাজা দিয়েছিল। এখানে এমন অনেক সংখ্যক লোকও ছিলেন যারা জেলের ভেতর নীরবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এবং কেউ তার মৃত্যুর সংবাদ পর্যন্ত জানতে পারতোনা। এ প্রসঙ্গে তারাহ জেলের ঘটনা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ হয়ে পড়ে।এ ঘটনা পয়লা জুন ১৯৫৭ সালে ঘটেছিল। সেদিন একুশ ব্যক্তিকে জেলখানার ভেতর এক সাথে গুলি করে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়া হয়। কারণ এরা সেই সরকারী নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে হরতাল ডাকে যে কারণে এই বন্দীদের আত্মীয় স্বজনের সাথে সাক্ষাত করা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল।
পঞ্চাশ হাজার মিসরীয়কে আবদুন নাসের জেলে আটক করে রাখে এবং তাদের সাথে সীমাহীন নির্মম আচরণ করা হয়। এমনকি এ বন্দীদের পরিবার পরিজনের সাথেও চরম অমানবিক ও পাশবিক আচরণ করা হয়। এ পঞ্চাশ হাজার কয়েদী ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং সমাপ্তিহীন এক কাহিনী। এখনো হাজার হাজার ইখওয়ান জেলখানায় দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে এবং এদের মধ্যে অধিকাংশই উন্মুক্ত প্রান্তরে ক্যাম্পের ভেতর জীবন ও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
এ দীর্ঘ উদ্ধৃতিটি আমি জামাল নাসেরের বিশিষ্ট বন্ধু এবং আল মিসরীয় সম্পাদক আহমদ আবুল ফাতাহর গ্রন্থ জামাল আবদুন নাসের থেকে সংকলন করেছি। আহমদ ফাতাহ ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত জামাল আবদুন নাসেরের দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও জামাল নাসেরের চক্ষুশূলে পরিণত হন এবং তাকে ছেড়ে পালানোর পথ বেছে নিতে হয়।
আহমদ আবুল ফাতাহর গ্রন্থের বর্ণিত উদ্ধৃতিটির অধিকাংশই প্যারিসের সংবাদ পত্র ফ্রান্স সাওয়ার এর বর্ণনার উপর নির্ভরশীল। এ সংবাদ পত্রের প্রতিনিধি যে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেন তা আমি শুধু মাত্র এ জনেই উল্লেখ করলাম যে, একজন ভিনদেশী সাংবাদিকের ভাষায় ইখওয়ান নেতৃবৃন্দের শাহাদতের এ মহান ঘটনার চিত্র কিভাবে ফুটে উঠেছে। নয়তো ইখওয়ান নেতৃবৃন্দের সাথে জেল খানায় যা কিছু ঘটেছে এবং একটি নাম সর্বস্ব আদালত তাঁদের যে অবমাননা করেছে এবং ফাঁসীর মঞ্চে তাঁরা যে অভূতপূর্ব ব্যক্তিত্বের প্রমাণ পেশ করেন সে ঘটনা অত্যন্ত বিস্তারিত ও দীর্ঘ।
অবদান
ইতোপূর্বে আমি ইখওয়ানুল মুসলেমূনের ইতিহাস এবং দাওয়াত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভাবে আলোকপাত করেছি। পাঠকদের কাছে যেন এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, যে আন্দোলনের সাথে অব্যাহত যুলুম নির্যাতনের আচরণ করা হয়েছে এবং যাকে দমন করার জন্য গুলি ও ফাঁসি ছাড়া অন্য আর কোন পন্থাকে যথেষ্ট মনে করা হয়নি, সেই আন্দোলনের ইতিহাস কতোটা নির্মল ও পবিত্র এবং তারা কিভাবে প্রতিটি কণ্টকময় অধ্যায় ইসলামের সাথে অকপটভাবে সংযুক্ত ছিল এবং দেশ ও জাতির সত্যিকার কল্যাণকামীতার প্রমাণ তারা কিভাবে পেশ করেন। সামনে আমি একথা উল্লেখ করতে চাই যে, ইখওয়ানের আন্দোলন মিসরীয় সমাজে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং মিসরীয় সমাজের সার্বিক সংস্কারের জন্যে তারা কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, ইখওয়ানুল মুসলেমূনের প্রতিষ্ঠা এমন এক সময়ে হয়েছিল যখন একদিকে ওসমানী খিলাফতের সিংহাসন উল্টে যায় এবং তুর্কী জাতীয়তাবাদ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। অপরকিকে আরব জাতীয়তাবাদ এক প্রতিদ্বন্ধি শ্লোগানে পরিণত হয়। লেবাননেরে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এবং মিসরের নাস্তিকেরা আরব জাতীয়তাবাদের আড়ালে মিসরে নাস্তিক্যবাদ ও পাচার এবং পাশ্চাত্য পূজাকে অত্যন্ত সমুজ্ঝল করে তোলে এবং বড় মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা এ স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। দারুল উলুমের ক্লাব যা হিফনী নাসিফ বেকের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যার সাথে বড় বড় বিদ্বান ব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন, খোলাখুলি বলতে গেলে-
মিসরের দরজা প্রতিটি মতাদর্শ এবং প্রত্যেক সভ্যতা সংস্কৃতির জন্য খোলা রাখার নীতির পতাকাবাহী ছিল। সাহিত্যসেবী ও শিক্ষাবিদ বিদ্বান ব্যক্তিদের একটি গোষ্ঠী মিসরকে প্রাচ্যের পরিবর্তে ইউরোপের একটি অংশ মনে করত। এবং লোহিত সাগরের পরিবর্তে ভূমধ্য সাগরের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতো। মুসা সালামের মতো জটিল বিষয়ে অভিজ্ঞ চিন্তাশীল ব্যক্তি পর্যন্ত এ কথা বলেন যে, মিশরীয় বাসীর জন্য আরবী সাহিত্যের পরিবর্তে জার্মান ও চীনা সাহিত্য অধিক নিকটবর্তী। সাংবাদিকতার অঙ্গনের অবস্থা এমন ছিল যে মুহিবুদ্দীন আল খতীব ১৯৩৪ সালে মিশরীয় সাংবাদিকতার অনুসন্ধান চালানোর পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, – আমাদের মুসলিম সংবাদপত্র হলিউডের প্রতিরূপই মনে হচ্ছে। ব্যবসায় বাণিজ্য পুরোপুরি ইউরোপিয়ানদের অধীনেই ছিল না বরং হোটেল ও কফি খানা গুলোও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এ ইউরোপিয়ান বণিকদের মধ্যে প্রায় এক লাখের মতো ছিল ইতালীয়। মিসরীয় চিন্তাশীলগণ এসব ভিনদেশী বনিকদের হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য শুধু মাত্র যে কাজটি করেন তা হলো, মিসর ব্যাংকের ভিত্তি স্থাপন। এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন আলআত হারব পাশা। এছাড়া মিসরীয় চলচ্চিত্র ও থিয়েটারের উন্নয়ন সাধন করে মিসরের অর্থনৈতিক স্বাধিকার আন্দোলন চালানো হয়। শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা ছিল আরো করুণ। এ অঙ্গনে বিদেশীরা পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল।
চৈন্তিক বিপ্লব সাধনের কর্মসূচী
এমতাবস্থায় ইখওয়ান তাদের সামষ্টিক সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করে এবং মিসরীয় সমাজের প্রতিটি কর্ণারে সংস্কারের কাজ শুরু করে। একদিকে তারা শিক্ষিত মহলকে স্বীয় চেষ্টা সংগ্রামের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করে এবং অপরদিকে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর মাঝে নিজেদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে। শিক্ষিত মহল স্বদেশিকতাবাদ, জাতিপুজা, জাতীয়তাবাদ এবং নাস্তিকতার প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল এবং শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণী রাজতন্ত্র ও উপনিবেশিকবাদের যাঁতাকলে নির্মমভাবে নিষ্পিষ্ট হচ্ছিল। এমনকি জীবন ও জীবনের চাহিদা সম্পর্কে তাদের কোন অনুভূতি ছিলনা।
সুতরাং ইখওয়ান ধর্মদ্রোহিতা, নাস্তিকতা, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং পাশ্চাত্যপূজার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তব্য এবং রচনার মাধ্যমে এসব অনিষ্টকর বিষয়ের ওপর সমালোচনা ও এর ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা তুলে ধরেন। ধর্ম ও বৈষয়িক জগতের বিভক্তিকারক শ্লোগানের মূল রহস্য উন্মুক্ত করে দেন এবং ইসলামকে একটি পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে পেশ করেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতির স্রোত প্রতিরোধ করে ইসলামী সভ্যতার সুষমা সৃষ্টি করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা প্রচারের বড় কেন্দ্র ছিল। ইখওয়ান এদিকে পূর্ণ মনোযোগ স্থাপন করে ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে দীনে ইসলামের প্রাণ সঞ্চার করে এবং অকাজে সময় ব্যয় করার পরিবর্তে তাদেরকে জিহাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ফুয়াদুল আউয়াল বিশ্ববিদ্যালয় ( বর্তমানে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়) মিসরের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ হিসেবে বিবেচিত হয়। এক সময় এমন ছিল যখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করা হতো। কিন্তু ইখওয়ানের দাওয়াতের ফলে এখানে এতোটা পরিবর্তন সাধিত হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে ইখওয়ান সমর্থিত ছাত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বরং ফিলিস্তিনী লেখক ডঃ ইসহাক মূসা আল হোসাইনীর ভাষায় বলা যায় ফুয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অস্থান ছিল নিম্নরূপ :
কৃষি কলেজ : এগারটি আসনের সব কটিতেই ইখওয়ান বিজয়ী হয়।
বিজ্ঞান কলেজ : সর্বমোট আসন সংখ্যা এগার। ইখওয়ান সবগুলো লাভ করে।
প্রকৌশল কলেজ : দশটি আসনের সাতটিতে ইখওয়ান বিজয়ী হয়।
আর্ট কলেজ : দশটি আসনের সাতটিতে ইখওয়ান বিজয়ী হয়।
ল কলেজ : দশটির মধ্যে নয়টি।
কমার্স কলেজ : ইখওয়ান তেরটি আসনের মধ্যে নয়টি লাভ করে।
ল কলেজ এক সময় ওয়াফদ পার্টির সমর্থিত ছাত্রদের ঘাটি ছিল। কিন্তু ইখওয়ানের ছাত্ররা সেখানে দশটি আসনের নয়টিই জিতে নেয় ইখওয়ান যখন ফিলিস্তিন জিহাদে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয় তখন এ ছাত্ররাই মুজাহিদদের প্রথম কাতারে শামিল হয় এবং এরাই ইখওয়ানের ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করে। ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলোও এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তি প্রদান করে যে, ছাত্রদের মধ্যে যে সংগঠনটি সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করে, তা হলো ইখওয়ানুল মুসলেমূন।
এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যখন ইসলাম ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থার আওয়াজ উচ্চারিত হয় তখন তা জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে। শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিকগণ এতে প্রভাবিত হয়। আইনজীবী মহলে এর প্রভাব পড়ে এবং বিশ পঁচিশ বছরের মধ্যে মিসরীয় সমাজের চেহারা পাল্টে যায়। যাদের রচনা পাশ্চাত্য চিন্তা দর্শনের জন্য নিবেদিত ছিল এবং যাদের সমালোচনার সুর সর্বদা ইসলামের ওপর এসে আছড়ে পড়তো, সে লোকেরাই বাতাসের গতি প্রত্যক্ষ করে সম্পূর্ণ বদলে যায় এবং তাদের খোদাদ্রোহী কলম ইসলামী ইতিহাস ও সভ্যতা সংস্কৃতি এবং ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার প্রশংসাকারীতে পরিণত হয়। হায়াতে মুহাম্মদ এর লেখক মুহাম্মদ হুসাইন হয়কাল (মরহুম) এ পরিবর্তনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামী সাহিত্যের চাহিদা এতটা বেড়ে যায় যে, পেশাদার লেখকদের জন্যও ইসলামেরই বিষয়বস্তু সময়ের প্রয়োজন হয়ে দেখা দেয়।
যে কণ্ঠগুলো দীন ও রাজনীতির মধ্যে পার্থক্যের শ্লোগান উচ্চারিত করছিল এবং ইসলামকে প্রাচীন ও সেকেলে বলে অপবাদ দিত এবং যাদের লক্ষ্য দেশের প্রভুদের পূজা ছাড়া অন্য কিছু ছিলনা সে কণ্ঠ থেকে এ সুর বেজে উঠতে শুরু করে যে, ইসলাম আকীদা বিশ্বাস এবং ইবাদতের ও নাম, দেশ ও জাতির ও নাম, ইসলাম যেমনি দীনের নাম তেমন রাষ্ট্র ব্যবস্থাও, আধ্যাত্মিকতা এবং আমলেরও নাম, কোরআন এবং তরবারির নাম। এ দাওয়াত জাতির প্রতিটি শ্রেণীর কাছে পৌঁছে যায়। শহর থেকে নিয়ে গ্রামে গঞ্জে এর জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে। জাতির প্রত্যেক ব্যক্তিই কোন না কোনভাবে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। মিসরের নামকরা সাহিত্যিক আহমদ যাইয়াত এ যুগসন্ধিক্ষণ সম্পর্কে লিখেন :
শুধুমাত্র ইখওয়ানুল মুসলিমূনই এ বিপর্যস্ত সমাজের মধ্যে নির্ভেজাল ইসলামী আকীদা এবং ইসলামী ধ্যান ধারনার প্রতিনিধিত্ব করছে। এরা ধর্মকে একটি পৃথক ইবাদত কেন্দ্র মনে করেন না, আর না দুনিয়াটাকে একটা লাগামহীন ও চিরস্থায়ী বাজার কল্পনা করে। তাদের দৃষ্টিতে মসজিদ হলে বাজারের উঁচু স্তম্ভ এবং বাজার মসজিদের একটি অংশ। তাদের রয়েছে বক্তৃতা বিশ্লেষণের ভাষা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের অভিপ্রায়ের বাস্তবতাই প্রতীয়মান হয়। জিহাদের জন্য এরা সামরিক প্রশিক্ষণ অর্জন করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের স্বতন্ত্র দৃষ্টি ভঙ্গি রয়েছে। প্রতিটি শহরে রয়েছে তাদের অনুসারীবৃন্দ। প্রতিটি আরব দেশে তাদের প্রভাব রয়েছে। মিসর, সুদান, ইরাক ও সিরিয়া, ইয়েমেন ও হেজায এবং আলজিরিয়া ও মরক্কোতে আজ যে, জাতীয় জাগরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে এরা অস্বাভাবিক গুরুত্ব লাভ করবে। ( রিসালাহ, ৭ জানুয়ারি ৫২)।
ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত দার্শনিক ডঃ ইসহাক মূসা আল হুসাইনী ইখওয়ানের আন্দোলন প্রসঙ্গে লিখেন : সরকারী আলেমগণ শুধুমাত্র ভাষাগত জমা খরচ করে চলেছিল। সুফি সম্প্রদায় সংকীর্ণ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণের অর্চনায় সীমাবদ্ধ ছিল। কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত প্রতিটি দলাই তার আংশিক করে চিকিৎসা করেছিল। অবশেষে ইখওয়ানুল মুসলেমূনের আবির্ভাব ঘটে এবং এরা সকল শূন্যতা পূর্ণ করে দেয়।
এ চৈন্তিক এবং বাস্তব বিপ্লবের লক্ষে ইখওয়ান কি উপায় উপকরণ বেছে নিয়েছে অন্য কথায় ইখওয়ান মিসরীয় সাম্রাজ্যের জন্য কি খিদমত আঞ্জাম দিয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্ন রূপ :
ইমাম হাসানুল বান্না মুহাম্মদ মাহমুদ পাশাকে যে চিঠি লিখেছিলেন এতে সমাজের সকল বিপর্যয় ও অনৈতিকতা চিহ্নিত করার পর সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয় যে, এসব দূরীকরণে বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এর মধ্যে মৌলিক পদক্ষেপ হবে শিক্ষাব্যবস্থার উৎসমূল সুন্দরভাবে ঢেলে সাজানো, আইন কানুনের সংস্কার, অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং অবসর সময়কে কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা। সুতরাং ইখওয়ান ইমাম হাসানুল বান্নার বিবৃতি উল্লিখিত পরিকল্পনার আলোকে সংস্কারের কাজ শুরু করে দেয়। ইখওয়ানের তৎপরতার সর্বপ্রথম প্রদর্শন বক্তৃতা, আলোচনা এবং চৈন্তিক ও নৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে গড়ে তোলা যায়।
শ্রমিক ও গরীবদের মাঝে এ কাজ বিশেষভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এবং এরা দলে দলে এ দাওয়াতের দিকে ধাবিত হয়। এ দাওয়াতে তারা অত্যন্ত প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি লাভ করে। ইখওয়ানের এ প্রশিক্ষণমূলক বক্তৃতা কতিপয় মূল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যেমন, অশিক্ষিত জনগনকে নামায রোযার প্রশিক্ষণ দেয়া এবং কুরআনের কিছু সূরা মুখস্থ করানো, ইসলামী দাওয়াতের তাৎপর্য বোঝানো যে, ইসলাম শুধুমাত্র ইবাদত বন্দেগীর নামই নয় বরং ইসলামী জীবন ব্যবস্থার একটি পূর্নাঙ্গ রীতিনীতির নাম। জনগণকে সভ্যতা ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে অভ্যস্ত করে তোলা, শরীয়তের নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে তাদেরকে বোঝানো এবং তা মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা। বস্তুপুজার স্রোত প্রতিরোধ করা এবং এটা জানিয়ে দেয়া যে, প্রাচ্যের নব জাগরণের ইসলামকেই জীবনের সকল ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত। জীবনের সকল বিষয়ে মানুষের সাথে বাস্তব সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের সামনে অনুপম জীবনের আদর্শ উপস্থাপন করা। প্রথম দিকে ইখওয়ানের প্রচার কার্য ও পাঠদান মসজিদ কেন্দ্রীক। কিন্তু যখন বিভিন্ন শহরে তাদের শাখা খোলা হয় তখন তারা তাদের প্রত্যক শাখাকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত করে যেখানে জনসাধারণকে ইসলামী জীবনপদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এ প্রশিক্ষণ মূলক পর্যায়ে কয়েক বছর পর্যন্ত চালু থাকে।
ক্ষমতাসীনদের কাছে ইসলামের দাওয়াত
স্বীয় দাওয়াত প্রসারের লক্ষ্যে অপর যে মাধ্যম তারা বেছে নেন তাহলো, দেশের কর্ণধার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে দাওয়াতমূলক চিঠি প্রেরণ। মুহাম্মদ মাহমুদ পাশাকে দীর্ঘ চিঠি লেখা হয় যাতে তাঁকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের দাওয়াত দেয়া হয় এবং কতিপয় সংস্কারমূলক পদক্ষেপের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। যেমন মিশ্রিত সমাবেশ বা পার্টি সরকারী বা বেসরকারি যাই হোক না কেন। মন্ত্রী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরকে জুয়া ও রেসের কল্যাণ এবং চিত্তবিনোদনমুলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও সংবাদপত্রে নিজ স্ত্রীদের ছবি প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখা। নামাযের সময় অফিস আদালতে ছুটি হবে এবং প্রত্যেকে নামায আদায় করবে। পদস্থ কর্মকর্তাদের ঘরে ইসলামী শিক্ষার প্রাধান্য বিস্তার অর্থাৎ এরা ইংরেজি অথবা ফরাসী ভাষার পরিবর্তে কথাবার্তায় আরবী ভাষা ব্যবহার করবে এবং সন্তানদের জন্য বিদেশী পৃষ্ঠপোষকের পরিবর্তে মিসরীয় পৃষ্ঠপোষক রাখবে। অসৎ সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এ চিঠিতে মুহাম্মদ মাহমুদ পাশাকে আইন বিষয়ক সংস্কারের প্রতিও আহবান জানো হয় এবং আইনকে ইসলামী ধাঁচে ঢেলে সাজানোর দাবী জানানো হয় এবং যেমন একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব পেশ করা হয় যা প্রচলিত আইনকে ইসলামী আইনের সাথে সমন্বয় সাধনের জন্য চিন্তাভাবনা করবে। একটি চিঠি মিসরের বাদশা, নাহাস পাশা এবং আরব কর্তৃপক্ষ মুসলিম উম্মাহকে প্রকৃত ইসলামী উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত করবে, আমরা তাদের সকল নির্দেশ পালন করবো এবং যে কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হবো না। উমর তুসান এবং মুহাম্মদ আলী তাওফীককে চিঠি লেখা হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো দেশে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছিল সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানানো হয়। আইনমন্ত্রী আহমদ খাশবা পাশাকে চিঠি লেখা হয় এবং ইসলামী আইন চালু করার জন্য তাঁর কাছে দাবী জানানো হয়। নাহাস পাশাকে লিখিত চিঠিতে মুসলিম দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করার কথা বলা হয়। অপর একটি চিঠিতে নাহাস পাশার কাছে ওয়াফদ পার্টির ঘোষণা পত্রকে ইসলামী মূলনীতির আলোকে প্রস্তুত করার জন্য দাবী জানানো হয়। ইখওয়ানের এ সকল চিঠিপত্রের কেন্দ্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি হলো, দেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং ইসলামী মূলনীতি অনুযায়ী সমাজের সর্বজনীন সংস্কার করা এবং পত্রাদির ব্যাপক প্রচারের লক্ষ্যে ইখওয়ান তাদের কেন্দ্রীয় দফতরে একটি কমিটি গঠন করে যা এ পত্রগুলোর ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করতো।
সাংবাদিকতার অঙ্গনে
সাংবাদিকতার অঙ্গনেও ইখওয়ান উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। মিসরীয় সাংবাদিক মুহিবুদ্দীন আল খতীবের ভাষায় হলিউডীয় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তো এমন কিছু কিছু সংবাদপত্র পাওয়া যায় যা ইসলামের নাম উচ্চারণ করতো। যেমন শেখ আলী ইউসুফের পত্রিকা আলমুয়ায়্যিদ মুস্তফা কামিলের আললিওয়া আষয়াফেয়ীর আল আখবার, এবং শায়খ আবদুল আযিয জাবিশের আল ইলম। কিন্তু এরপরও মিসরীয় সাংবাদিকতার ওপর নির্ভেজাল জাহিলিয়াতের নিয়ন্ত্রণ ছিল। অবশেষে ইখওয়ান এসে মন্দরে তাওহীদের আযান দেয়। প্রথম প্রথম তারা তাদের বিশিষ্ট মাসিকপত্র বের করে। পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে ইখওয়ানুল মুসলেমূন নামে তারা একটি দৈনিক চালু করে। মিসর ও অন্যান্য আরব দেশ গুলোতে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। পত্রিকাটি তার নির্ভীক সম্পাদনা এবং নিরপেক্ষ সমালোচনার মাধ্যমে সরকারী মহলে কম্পনের সৃষ্টি করে। ইংরেজ উপনিবেশ এর জনপ্রিয়তা দেখে রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে। সুতরাং কয়েক দফায় এটি বন্ধও করে দেয়া হয়। এছাড়া ইখওয়ানের পক্ষ থেকে কয়েকটি সাপ্তাহিক আততাআরূফ সাপ্তাহিক আশশিআ সাপ্তাহিক আননাযীর সাপ্তাহিক আশশিহাব প্রদর্শিত হয়। ১৯৪৮ সালের কঠিন পরীক্ষার পর ইখওয়ান আল মাবাহিস আদ দাওয়াত এবং আল মুসলিমূন চালু করে। মোট কথা ইখওয়ান তাদের শক্তিশালী সাংবাদিকতার মাধ্যমে মিসরের সাংবাদিক অঙ্গনে বিপ্লব সংঘটিত করে। জনগণ অশ্লীল কাহিনী এবং সুড়সুড়িমূলক খবরে তুষ্ট হওয়ার পরিবর্তে গঠনমূলক গভীর প্রসংগের মাঝে আত্নতৃপ্তি গ্রহণ করতে শুরু করে।