চতুর্থ পর্যায়: ১৯৪৯ –১৯৫৪ ইং
নতুন মুরশিদ নতুন উদ্যম
অবস্থা আবারো পাল্টে যায়। সাত মাস পর ২৫ জুলাই ১৯৪৯ সালে ইবরাহীম আবদুল হাদী পাশা গদি-চ্যুত হতে বাধ্য হন। হোসাইন সিররী পাশা কোয়ালিশন মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করাই ছিল এর দায়িত্ব। এতে ইখওয়ান কিছুটা স্বস্তি লাভ করে। নির্বাচন ওয়াফদ পার্টি বিজয়ী হয়। এ সফলতায় ইখওয়ানের সহায়তাও জড়িত ছিল। ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ সালে নাহাস পাশা ক্ষমতার বাগডোর হাতে নেন। এ সময়ে ইখওয়ান আংশিক স্বাধীনতা লাভ করে। যাদের ব্যাপারে ধারণা করা হয়েছিল যে, এদের কাহিনীর যবনিকা ঘটেছে। আঁচল ঝেড়ে তারা আবার মাথা উঁচু করে দাড়ায়। তাদের কলমগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠে এবংয় তাদের সংবাদপত্রগুলো নতুনভাবে প্রকাশিত হয়। হাসান বিন ইসমাঈল আল হোযাইবী তাদের নয়া মুরশিদে আম নির্বাচিত হন। এর পূর্বে তিনি সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এডভাইজার ছিলেন। ইখওয়ানুল মুসলিমূন তাদের নতুন মুরশিদে আমের নেতৃত্বে নিজেদের বিভিন্ন শাখায় নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও মজবুতিকরণের কাজে নিয়োজিত হয়। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে সরকার ইখওয়ানের কতিপয় মালিকানা পূর্ণবহাল করে। এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় কাউন্সিল অব ষ্টেটের এক নির্দেশের ভিত্তিতে। যেখানে কাউন্সিল অব স্টেট উল্লেখ করে ইখওয়ানুল মুসলিমূনকে অবৈধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভুল ছিল। এ সিদ্ধান্ত মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটের অধীন ছিল না। এরপর ইখওয়ান নিমিষেই নিজেদের অবস্থা ঠিক করে নেয় এবং পুনরায় ইতিহাসের মঞ্চে এসে উপবিষ্ট হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়।
প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সূচনা
১৯৫১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মুস্তফা নাহাস পাশার সরকার টিকে থাকে। এরপর নাহাস পাশার পদচ্যুতির পর কাসরে আবেদীন এবং ইংরেজদের পারস্পরিক পরামর্শ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের জন্ম দেয় এবং নয় মাসের মধ্যে চার বার মন্ত্রিত্বের পরিবর্তন ঘটে। জনগণ ইংরেজদের সাথে নিঃশর্ত সম্পর্ক ছিন্নটা দাবী করছিল। এ দাবী দিনে দিনে জোরদার আকার ধারণ করছিল কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনী নিঃশর্ত তো দূরে থাক, শর্তসাপেক্ষেও যেতে প্রস্তুত ছিল না। জনগণ, প্রাসাদ ও ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে কেটি প্রাচীর নির্মিত ছিল। যে মন্ত্রী পরিষদই গঠিত হতো তা জনগণের দাবীর মুখে নত হলেই প্রাসাদ তাকে ব্রিটিশ ট্যাংকের শক্তিমত্তায় উল্টে দিত। আর যদি প্রসাদের খাহেশ পূরণ করা হতো। তবে জনগণের প্রতিবাদ বিক্ষোভ তার জন্য পতনের বার্তায় পরিণত হতো, এভাবে ২৩ -২৬ মে ৫২ সালে দেশে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে এবং দেশের ইতিহাসের ধারা পাল্টে যায়। এর বর্ণনা পূর্বে এসেছে।
ব্রিটিশ চুক্তি ভঙ্গের ঘোষণা
১৯৫১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মুসতফা নাহাস পাশার সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। নাহাস পাশার এ সময়কালীন মন্ত্রিত্বের সোনালী কর্মসূচী ছিল যে, তিনি জনদাবীর প্রেক্ষিতে পার্লামেন্টের মাধ্যমে সেই চুকিত রদের ঘোষণা দেন যা ১৯৩৬ সালে মিসর ও ব্রিটেনের মাঝে সংঘটিত হয়েছিল। যার ভিত্তিতে মিসর ব্রিটিশের সেনা ছাউনি নির্মাণ করেছিলো এবং সুয়েজের ওপর ব্রিটিশ ও ফ্রান্স যৌথ ইজাদারী প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল। নাহাস পাশা পার্লামেন্টে ঘোষণা দেন ১৯৩৬ সালে স্বয়ং মিসর ব্রিটিশের সাথে এ চুক্তি করেছিল এবং আজ মিসরই তা বাতিল ঘোষণা করেছে। এ ঘোষণায় জনগণের মুত প্রাণে চাঞ্চল্য দেখা দেয় কিন্তু প্রাসাদ এবংয় ব্রিটিশ বাহিনীর মাঝে অস্থিরতা নেমে আসে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ইখওয়ানের অংশগ্রহণ
নাহাস পাশা ব্রিটিশ নেতৃত্বের সাথে বাদানুবাদ করতে চেয়েছিলেন, যেনো সৈন্য প্রত্যাহারের ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ নেতৃত্ব তা এড়িয়ে চলে। জনগণ বাধ্য হয় এবংয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। নাহাস সরকারও জনগণের সাথে যোগ দেয়। প্রিয় স্বদেশের স্বাধীনতার জন্যে মুজাহিদরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুয়েজ এলাকা পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। ইখওয়ানুল মুসলিমূনের স্বেচ্ছাসেবক রা এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বীরত্ব ও আত্ন্যত্যাগের বিস্ময়কর কৃতিত্ব দেখায়। ইখওয়ান কলেজগুলোতে সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির প্রতিষ্ঠা করে এবংয় সকল দলের ছাত্ররা নির্বিঘ্নে ইখওয়ানের তত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে শুরু করে। এতে ইংরেজ বাহিনী বেহুশ হয়ে পড়ে। এমনকি ইংরেজ বাহিনী র হাই কমান্ড রেডিও ষ্টেশন থেকে অবিরাম এ ঘোষণা প্রচার করে যে, যে ব্যক্তি শায়খ মুহাম্মদ ফারগালির মাথা কেটে আনবে তাকে পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার দেয়া হবে। শায়খ ফারগালী ইখওয়ানের মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন। এ যুদ্ধে তিনি গেরিলা বাহিনীর সাহায্যে ইংরেজ বাহিনীকে নাস্তানুবাদ করে দেন (জামাল আবদুন নাসের ১৯৫৪সালের শেষের দিকে, যেসব ইখওয়ান নেতাকে ফাঁসীর সাজা দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শায়খ মুহাম্মদ ফারগালীও একজন ) ওয়াফদ সরকার ইখওয়ান মুজাহিদদের সাহসিকতা, কৌশল, আত্মত্যাগ এবং জিহাদি জজবায় এতেটা প্রভাবিত হয় যে, তারা ইখওয়ান নেতাদের ডেকে এ ব্যাপারে মতবিনিময় করেন যে, যুদ্ধের কমান্ড সম্পূর্ণরূপে ইখওয়ান স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর অর্পণ করা হোক। কিন্তু এ প্রস্তাবের আগের দিন প্রাসাদ ওয়াফদ সরকারকে পদচ্যুত করে। ওয়াফদ সরকারের সাথে ইখওয়ানের এ চুক্তি হয়েছিল যে, সরকার ইখওয়ানের রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করবেনা। যদিও ইতোপূর্বে এ সরকারই চেষ্টা করেছিল ইখওয়ান যেন রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফুয়াদ সিরাজউদ্দীন ( যিনি ওয়াফদের সেক্রেটারি জেনারেলও ছিলেন ) পার্লামেন্টেও ১৯৫০ সালে আইন পাশ করেছিলেন। কিন্তু ইখওয়ান এ আইন মেনে নিতে অস্বীকার করে। অবশেষে স্বয়ং ওয়াফদ সরকারকে নত হতে হয়।
ওয়াফদ সরকারকে নির্মূল করার উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়া। অতঃপর আলী মাহেরকে মন্ত্রীসভা গঠনের আহবান জানানো হয়। কিন্তু এ মন্ত্রীপরিষদও কয়েকদিনের মেহমান ছিল মাত্র। আলী মাহেরের পর নাজিব হেলালীকে আনা হয়। তিনিও বেশীদিন টিকতে পারেননি। এ দুজন সাবেক শাসকদের বিপরীত নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এরা ইখওয়ানুল মুসলেমূন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত ও পরামর্শ গ্রহণ করতেন। নাজিব হেলালীর মন্ত্রিত্ব কালে ইখওয়ান অস্বাভাবিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেয়। নাজিব হেলালীর পর হোসাইন সিররী এবং দ্বিতীয়বারের মতো নাজিব হেলালি প্রধানমন্ত্রীত্বের আসনে সমাসীন হন। এ সকল মন্ত্রীপরিষদের মর্যাদা কাঠের পুতুলের চেয়ে বেশিকিছু ছিলনা। উত্তেজিত জনতাকে শিশুর মত বুঝ দেয়ার চমকে নিমজ্জিত করাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।
১৯৫২ সালের সেনা অভ্যুত্থান
জুলাই ১৯৫২ সালে মিসরের ভূখণ্ড আরেকটি অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করে। মিসরের বাদশা ফারুকের কাছ থেকে আল্লাহ প্রতিশোধ গ্রহণ করেন এবং চোখের পলকে তার ফেরাউনী জাঁকজমক ও মাহাত্ম্য প্রাচীন উপাখ্যানে পরিণত হয়। এ অভ্যুত্থান কিভাবে সংঘটিত হয় এবংয় এর সফলতার কারণ কি ছিল এবং প্রয়োজনই বা অনুভূত হয়েছিল কেন? এসব প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান না করে পরবর্তী অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। এ কারণে সংক্ষিপ্তভাবে এ প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ব্রিটিশ উপনিবেশ মিসরে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে এবং দেখতে দেখতে তারা মিসর রাজকে নিজ থলের ভেতর পুরে ফেলে। আহমদ আরাবী পাশা এবং মোস্তফা কামালের মতো দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব এ অনুপ্রবেশ রুখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এ ঝড় দিনের পর দিন প্রচণ্ড আকার ধারণ কর। স্বাধীনতাকামীরা একের পর এক বেশ কটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে কিন্তু কোনটিই টিকে থাকেনি। ১৮ ডিসেম্বর ১৯১৪ সালে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে মিসরের ওপর ব্রিটিশ উপনিবেশের ঘোষণা দেয়া হলে মিসরবাসী এ উপনিবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে ব্রিটেন স্বীয় উপনিবেশ তুলে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি তত্বাবধানের নামে এমন শিকল মিসরের পায়ে আটকে দেয়া হয় যে, যদিও ব্রিটেনের উপনিবেশ খতম হয়ে গেছে তবু মিসরের প্রতিরক্ষা বিদেশীদের নিরাপত্তা এবং এ ধরনের বিন্ন ভিন্ন শিরনামের অন্তরালে এ দানব সম স্বৈরশাসক বরাবরই তৎপর ছিল। ১৯ এপ্রিল ১৯২৩ সালে মিসরে প্রথমবারের মতো শাসনতন্ত্র চালু করা হয় এবং মিসরকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। ইসলামকে ঘোষণা দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে। কিন্তু যেদেশে আধিপত্যবাদরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে মিসরের এ নতি সেখানে কিভাবে পছন্দনীয় হতে পারে? সুতরাং ২৬ আগস্ট ১৯৩৬ সালে মিসর ও ব্রিটেনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার নাম ছিল বন্ধুত্ব চুক্তি। এ চুক্তি মোতাবেক মিসর ব্রিটেনকে এ ছাড় দেয় যে, তারা সুয়েজের পাড় ইংরেজ বাহিনীর ছাউনি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যা সুয়েজের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করবে। এভাবেই ইংরেজরা সুকৌশলে যুদ্ধের প্রস্তুতি সহ মিসরে অবতরণ করে এবং মিসরের দুভার্গ্য দিবসের উদয় ঘটে। এরপর মিসরে শাসনতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে এবং ইংরেজ ও মিসরের বাদশা এবং তাদের পুতুল মন্ত্রী পরিষদ দেশে ক্ষমতাসীন হয়। সুয়েজের নিরাপত্তা কে হস্তগত করে ইংরেজ বাহিনী মিসরের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রকেই হাতিয়ে নেয় এবং যতই ইংরেজদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিল ততই মিসরের পরাধীনতা বেড়ে চলছিল। মিসরের গোটা প্রশাসন ব্যবস্থায় ইংরেজরা প্রাধান্য বিস্তার করছিল। ঘটনা এতদূর পর্যন্ত গড়ায় যে, মিসরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির শিরায় শিরায় ইংরেজীয় কূটনীতির রক্ত প্রবাহিত হয়ে পড়ে। স্কুল ও কলেজগুলোর অধিকাংশই খ্রিষ্টানদের অধীনে চলে যায়। শিক্ষক শিক্ষিকারা চিল খ্রিষ্টান। ব্যবসায় বাণিজ্যের ওপর ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মিসরীয় জাতি তাদের জুলুমের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। প্রথম ফুয়াদের যুগে মিসরীয় জনগণের অন্তত কিছু না কিছু বলার স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু ফারুকের যুগ মিসরীয় জনগণের জন্য দ্বিগুন গোলামীর যুগ। এর একটি হলো, ইংরেজদের একচ্ছত্র আধিপত্য এবং অপরটি ফারুকের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন।
হাসানুল বান্না ইখওয়ানুল মুসলিমূন প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন তা হলো, মিসরের নিষ্প্রাণ ও হতাশ জাতির মাঝে জিহাদের জজবা সৃষ্টি। জিহাদ সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত পুস্তিকা ছিল ইখওয়ানের প্রাথমিক যুগের শক্তিশালী আওয়াজ। এ পুস্তিকায় ইমাম বান্না ভাষার অলংকার মিশিয়ে মিসরীয় জনগণকে এর প্রতি আকৃষ্ট করেন যা ছিল মুসলমান জাতির পশ্চাৎপদতা এবং পতনের হাত থেকে মুক্তির আসল প্রতিষেধক। ইমাম বান্না এ পুস্তিকায় প্রথমে কুরআনের সে সমস্ত আয়াত উল্লেখ করেন যেখানে জিহাদের সুস্পষ্ট ফরযিয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর হাদিস দ্বারা বিস্তারিতভাবে এর সাক্ষ্য পেশ করেন। তাঁর পুস্তকটির গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো, জিহাদ সম্পর্ক উম্মতে মুসলিমার সকল ইসলামী আইন বিশারদদের মতামত উল্লেখ। এ প্রসঙ্গে তিনি ইবনে কুদামার মতামত বর্ণনা করেন যে, যখন কোন শহরে কাফির বাহিনী চড়াও হবে তখন এর অধিবাসীদের ওপর তাদের সাথে যুদ্ধ করে শহর থেকে হটিয়ে দেয়া ফরযে আইন হয়ে দাঁড়ায়। আজহারের উলামাদের তেজস্বী বক্তব্য হলো,বোখারী শরীফের ব্যাখাতা ইমাম বদরুদ্দীন আইনীর থেকে বড় আলেম আর কে আছে। তাঁর অভ্যাস ছিল, এক বছর শিক্ষা ও পাঠদানে নিয়োজিত থাকতেন এবং এক বছর অতিবাহিত করতেন হজ্জের মধ্যে। পরিশেষে সেই লোকদেরও সমালোচনা করেন – যারা যুদ্ধকে জিহাদে আসগর এবং জিহাদে নফসকে জিহাদে আকবর সাব্যস্ত করে আত্মশুদ্ধির দোহাই দিয়ে রোকদেরকে উদ্যমহীন করে তাকে। এ সম্পর্কে তিনি লিখেনঃ
“কিছু লোক এ প্রচেষ্টা চালায় যে, সর্বসাধারণকে যুদ্ধের গুরুত্ব এবং জিহাদের প্রস্তুতি থেকে বিরত রাখবে। তারা এ দরীর পেশ করে যে, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে জিহাদে আকবর হলো, মানুষ স্বীয় নফসের সাথে জিহাদ করবে। কিন্তু এ দলীল ভিত্তিহীন। হাফজ৭ ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর গ্রন্থ তাসদিদুল কাউসে লিখেছেন, একথা লোক মুখে প্রচারিত কথার মধ্যে শামিল। এবং তা রসূলের (সা:) কথা নয়। বরং ইবরাহীম বিন আবলারদীর কথা।”
সুতরাং ইখওয়ানুল মুসলেমূন তাদের মৌলিক উদ্দেশ্য হিসেবে এ ঘোষণা দেয় যে,
***************আরবী****************
অর্থাৎ আল্লাহর পথে শাহাদাত আমাদের মহান আকাংখা। এটা কেবল তাদের মৌখিক শ্লোগানই ছিল না বরং কার্যত তারা স্বীয় সদস্যদের জিহাদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন।। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবকরা অনর্থক কাজে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতো এবং জিহাদের প্রাণ সঞ্চার করতো জাতির মাঝে। এ জিহাদি জজবার যথার্থ প্রকাশ ঘটেছিল তখন, ১৯৪৮ সালে ইহুদীদের বিরুদ্ধে আরব জনতা যখন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আনওয়ার সাদাত (যিনি জামাল আবদুন নাসেরের দক্ষিণ হস্ত এবং পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট) তাঁর ডায়েরী সাফহাতে মাজহুলার ১৭৭ পৃষ্ঠায় লিখেন:
“সেই দিনগুলোতে (অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ফিলিস্তিন যুদ্ধে) যুদ্ধ জিহাদে অন্যান্য দলগুলোর চেয়ে সবচে বেশি যে দলটি বিস্ময়ের প্রকাশ ঘটাচ্ছিল, সেটি ইখওয়ানুল মুসলেমূন। যে রাতে ফিলিস্তিনে রওয়ানা হবার কথা ছিল, সেদিন হাসানুল বান্না এবং শাইখ ফরগালী এসে মুজাহিদ দলের উদ্দেশ্যে এক জ্বালাময়ী ভাষণ পেশ করেন এবং তাদের মাঝে প্রবল আবেগ উত্তেজনার সৃষ্টি করেন।”
জিহাদের প্রেরণা উজ্জীবিত করার পর ইখওয়ানুল মুসলিমূন দ্বিতীয় বড় যে কাজটি করে তাহলো, দেশে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন। ১৯৩৮ সালে হাসানুল বান্না আইন মন্ত্রী আহমদ খুশবু পাশাকে এক দীর্ঘ চিঠি লিখেন, যেখানে দাবী করা হয় – পঞ্চাশ বছর ধরে অনৈসলামিকতাই পরীক্ষা করা হয়েছে আর তা কঠিনাভাবেই ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। এবার ইসলামী আইনের পরীক্ষা হওয়া উচিত। এ চিঠিতে ইমাম হাসানুল বান্না প্রথমে কুরআনের দৃষ্টিতে ইসলামী আইনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। এরপর উল্লেখ করেন, যদি এ দেশের শাসনতন্ত্র আইনের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন তবে আপনি অনুভব করতে সক্ষম হবেন যে, এর উৎসস্থল কুরআন সুন্নাহ নয় বরং বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইটালী ইত্যাদি ইউরোপীয় দেশসমূহের শাসনতন্ত্র ও আইনের অনুরূপ।
আমাদের সংবিধান পূর্নাঙ্গ ও আংশিক উভয় দিক থেকেই ইসলামের সাথে প্রকাশ্যভাবে সাংঘর্ষিক। এবার ভেবে দেখুন, যদি একজন মুসলমানের সামনে এমন কোন বিষয় উপস্থিত হয় যার ফায়সালা ইসলামের দৃষ্টিতে একরকম এবং প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতে অন্যরকম হয়, তবে এক্ষেত্রে সেই মুসলমান লোকটি কোন পন্থা অবলম্বন করবে। এছাড়া চিন্তা করে দেখুন, এদেশের ম্যাজিস্ট্রেট, জজ, প্রধান বিচারপতি এবং আইন মন্ত্রীর পক্ষে আহকামুল হাকিমীন আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করা কিভাবে বৈধ হতে পারে?
এই কঠোর সমালোচনার পর ইমাম হাসানুল বান্না তাদের অভিযোগের জবাব দেন যারা আধুনিক যুগে ইসলামী আইন প্রণয়ন অসম্ভব মনে করে থাকে এবং পরিশেষে এ দাবী রেখে চিঠি সমাপ্ত করেন যে-
“ইখওয়ানুল মুসলিমূনের দাবী হলো, আমাদের সরকার ইসলামী শরীয়তের দিকে ফিরে আসুক এবং মিসরীয় আইন ব্যবস্থাকে অতিসত্বর শরীয়তের ভিত্তির ওপর ঢেলে সাজাক। আমরা এক মুসলিম জাতি, আমরা অঙ্গিকার করছি যে, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহর আইন এবং কুরআন ও সুন্নাহর শাসন ও বিধিনিষেধ মেনে নেবো, যদিও এজন্য আমাদেরকে অনেক বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হয় এবং বৃহৎ থেকে বৃহত্তর কুরবানি পেশ করতে হয়। একটি স্বাধীন ও মুসলমান জাতি হিসেবে এটা আমাদের স্বাভাবিক অধিকার। রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা এবং ধৈর্যের অপর কোন চিত্র এর বিকল্প হতে পারেনা। আপনিও এ অধিকার অর্জনে আমাদের সহযোগিতা করবেন। এ অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন এবং জাতিকে এমন কোন পথে নামতে বাধ্য করবেন না যেখানে হতাশা এবং অসহায় অবস্থায় অধিকাংশ জাতিই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ’’
একদিকে ইখওয়ানের এ দাবী, অপরদিকে মিসরে ক্ষমতার মালিকানা নিয়ে বাক বিতন্ডা শুরু হয়। খাদীভ তাওফীক পাশা আরাবী পাশাকে বলে – এ দেশ আমি আমার পৈত্রিক সূত্রে লাভ করেছি। এ ধরনের চিন্তাধারা তাওফীক পাশার স্থলাভিষিক্তদের মাথায়ও বাসা বেধে ছিল। তবু প্রথম ফুয়াদের (১৯৩৬) যুগ ছিল বেশি সমৃদ্ধ। কিন্তু ফারুকের যুগ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং ইংরেজদের চোগলখুরীর কারণে অন্ধকারাচ্ছন্ন। এ যুগে হাসানুল বান্নাই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি শাহী দরবার থেকে দুরে অবস্থান করেন। তাছাড়া এটা সেই হাম্মামখানা ছিল যেখানে নাহাস পাশার মতো স্বাধীন ব্যাক্তি তাহা হুসাইনের মতো মুক্ত চিন্তার মানুষ, আহমদ হাসান যাইয়াতের মতো প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং মুহাম্মদ ফাকীর মতো সুন্নতের পতাকাবাহী ব্যক্তিদেরকেও উলঙ্গ অবস্থায় দেখা গেছে। স্বয়ং ফারুকও হাসানুল বান্নাকে ঘৃনা করতেন। প্রথম প্রথম তো তিনি ইখওয়ানুলের আন্দোলনকে পাত্তাই দিতেন না। কিন্তু ক্রমান্বয়ে যখন ইসলামী শরীয়ত প্রণয়নের দাবী জোরদার হয়ে উঠে তখন তার চোখ খুলতে শুরু করে। আনোয়ার সাদাত তাঁর লিখিত গ্রন্থে বর্ণনা করেন, ১৯৪৪ সালে তিনি ( অর্থাৎ আনোয়ার সাদাত) হাসানুল বান্নার সাথে সাক্ষাত করেন। সে সময় হাসানুল বান্না বাদশা ফারুকের চিন্তনীয় কিছু বিষয় কতিপয় পর্যবেক্ষকের বরাত দিয়ে বলেনঃ
“বাদশা, ইখওয়ানের দাওয়াতে কঠিন বিপদ অনুভব করেছেন। তাঁর কানে একথা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে যে, ইখওয়ানের দাওয়াতের ভিত্তিতে। ইসলামে পৈত্রিক সূত্রে বাদশাহী লাভ করার কোন সুযোগ নেই …. সুতরাং বাদশা ভাবছে কিভাবে ইখওয়ানের গায়ে হাত দেয়া যায়। (সাফহাতে মাজহূলাঃ পৃষ্ঠা – ১৯)
ইখওয়ান ও ফারুকের দন্দ্ব এত দূর গড়ায় যে, শেষ পর্যন্ত ফারুক এবং আবদুল হাদী পাশা মিলে হাসানুল বান্নাকে শহীদ করলো। পরবর্তীতে আদালতের তদন্ত দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, খুনিদের মধ্যে ফারুকের বিশেষ পরিচারকও জড়িত ছিল। এ সত্বেও ইখওয়ানের আন্দোলন মিসরীয় জনগণের অন্তরে এ চিরন্তন সত্যটি ভালোভাবেই ফুটিয়ে তোলে যে, যতক্ষণ না দেশ থেকে বাদশাহী প্রথার ভিত পাল্টে দেয়া যায় ততক্ষণ এখানে কোন সংস্কার কর্মসূচী কার্যকর হতে পারেনা। আবার বাদশাহী প্রথার অবসানই মূল কথা নয় বরং ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠাই হলো মুখ্য বিষয়। ফারুকের দমননীতি, তার নৈতিক অরাজকতা, ইংরেজদের সাথে সম্প্রীতি এবং কৃষকদের ওপর তার কর্মচারীদের নির্বিচার যুলুম পীড়ন ইখওয়ানের দাওয়াতে যাদুর প্রভাব সৃষ্টি করে এবং এমন একটি সময় আসে যে, মিসরের অবুঝ শিশুরাও ফারুকের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে।
ফারুকের শাসনামলে যে মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হতো তা দুটি অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতো অথবা ফারুকের মর্জি মতো প্রতিষ্ঠিত হতো এবং এর মর্যাদা কাঠের পুতুলের চেয়ে বেশি কিছু হতো না। আর পিঠের ওপর দাড়িয়ে থাকতো ইংরেজ ফৌজ। এভাবেই ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ সালে ওয়াফদ পার্টির সরকার ব্রিটেনের ট্যাংকের বদৌলতে কায়েম হয়েছিল।
সুতরাং ইখওয়ান এ সকল সরকারের সাথে তাদের অসন্তুষ্টি এবং অসহযোগিতার ঘোষণা প্রদান করে।
এ কাহিনীর চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো মিসরীয় ফৌজ। মিসরীয় ফৌজকে নিঃসন্দেহে তৎকালে আরব দেশসমূহের মধ্যে সবচে বেশি মজবুত এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ফৌজ মনে করা হতো। কিন্তু ইংরেজ বাহিনীর অবস্থিতি একে পরাভূত করে রেখেছিল। মিসরীয় ফেজের অফিসারদের অধিকাংশই বাদশা পুজার রোগে আক্রান্ত ছিল। কেবল মাত্র সীমিত সংখ্যক কিছু ব্যক্তি এমন ছিল যারা সংগিন অবস্থা এবং বিপর্যয় দেখে রক্তের অশ্রু বইয়ে দিত। কিন্তু সংস্কার কাজের জন্য যাদের হাতে দেশের প্রকৃত শক্তি ক্ষমতা রয়েছে তাদের চিন্তা চেতনার জগতে পরিবর্তন সাধিত হওয়া প্রয়োজন ছিল। মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত (তৎকালে) সেই সেনা অফিসারদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা হাসানুল বান্নার দাওয়াত সম্পর্কে সর্ব প্রথম অবহিত হন। তাই আনোয়ার সাদাত তার রচিত গ্রন্থে লিখেছেন –
“হাসানুল বান্নার সাথে অনেক সেনা অফিসার সাক্ষাত করতেন। হাসানুল বান্নার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র এটাই ছিল যে, কোনভাবে মিসরীয় সেনা অফিসারদের মধ্যে দীনদারী সৃষ্টি হোক।” (সাফহাতে মাজহূলা – পৃষ্ঠা: ৩৪৯)
হাসানুল বান্নার নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর স্বর্গীয় দাওয়াতের এমন বিস্ময়কর প্রভাব ছিল যে, তা সেনাবাহিনীর মাঝে সীমাহীন গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। আনোয়ার সাদাত লিখেছেন : “ দেশ বাসী ইংরেজ আধিপত্য থেকে যে কোন মূল্যে মুক্ত হতে চেয়েছিল। এ অনুপ্রেরণার ভিত্তিতেই মিসরীয় সেনাবাহিনীর স্বাধীনতাকামী অফিসারদের একটি গ্রুপ এবং হাসানুল বান্নার মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
“এ সম্পর্কে এতোটা গভীর হয়েছিল যে, মিসরীয় সেনাবাহিনীর একটা গ্রুপ ইখওয়ানকে মিসরের মুক্তির একমাত্র ভরসা মনে করত।”
এভাবেই ইখওয়ান প্রতিটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে ইংরেজদের জবরদখল এবং সালতানাতের যুলুম পীড়ন থেকে মিসরীয় জাতিকে মুক্তি দেয়ার জন্য ময়দান প্রস্তুত করছিল। অবশেষে জুলাই ১৯৫২ সালে বিপ্লব সংঘটিত হয়। তারপর থেকে মিসরে বাদশাহী প্রথার সমাপ্তি ঘটে। এ বিপ্লবের সফলতায় শুধুমাত্র সেনাবাহিনীরই কৃতিত্ব ছিল না। কেননা মিশরীয় ফৌজের মাঝে এতোটা হিম্মত ছিল যে, তারা এমন কোন দুঃসাহস প্রদর্শন করবে – যেখানে তাদের তিন ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে মুকাবিলায় অবতীর্ণ হওয়া অনিবার্য ছিল। এর একটি হলো ইংরেজ বাহিনী, দ্বিতীয়টা ফারুক এবং তৃতীয়টি মিসরের ভাগ্যান্বেষী রাজনীতিবিদদের সরকার। বিপ্লবের প্রথম গোলটি নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীই নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু ইংরেজ প্রভাব এবং ফারুকের বিরুদ্ধে ইখওয়ান মিসরীয় জনগণের মাঝে অসন্তোষের বীজ এতোটাই বপন করেছিল যে, বিপ্লবের গোলার আওয়াজ শোনা মাত্রই গোটা জাতি তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে ফুল ছিটাতে থাকে। জেনারেল নাজিবের ভাষায় – “বিপ্লবের পর দীর্ঘকাল পর্যন্ত ইখওয়ান এবং বিপ্লবী কর্তৃপক্ষের মধ্যে সহযোগিতামূলক গভীর সম্পর্ক বজায় থাকে।” হাসানুল বান্নার হত্যাকারীকে গ্রেফতার করা হয়। ইখওয়ানের রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। ইখওয়ানও বিপ্লবীদের পৃষ্ঠপোষকতায় কম ছিলনা। বরং একটি গোষ্ঠী তাদের সহায়তায় এতো অগ্রসর ছিল যে, ইখওয়ানের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে এ আচরণ খটকার সৃষ্টি করে। আর একারণেই হাসানুল হোযায়বী এবং দলের আবেগ প্রবণ যুবকদের মাঝে এ প্রসঙ্গে কিছুটা মত পার্থক্য ও সৃষ্টি হয়।
ইখওয়ান এবং বিপ্লবী পরিষদের মধ্যে মতবিরোধ
অবশেষে ইখওয়ান এবং বিপ্লবী সরকারের মাঝে মতবিরোধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। যা হ্রাস পাবার পরিবর্তে ক্রমশ: বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অবস্থা এক বড় রকমের ট্রাজেডি পর্যন্ত গড়ায়। এসব মত বিরোধের সংক্ষিপ্ত সার হলো :
এক : মতবিরোধের সূত্রপাত ঘটে বিপ্লবী মন্ত্রীপরিষদ গঠন নিয়ে। ৯ ডিসেম্বর ১৯৫২ সালে বিপ্লবী পরিষদ আলী মাহেরকে (যাকে বিপ্লবের পর প্রধান মন্ত্রী বানানো হয়েছিল )। পদচ্যুত করে এবং মুহাম্মদ নাজিব মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। বিপ্লবী পরিষদ ইখওয়ানকে মন্ত্রীপরিষদে তিনটি পদ প্রদানের প্রস্তাব পেশ করে কিন্তু মাকতাবুল ইরশাদ ( ইখওয়ানের মজলিসে শুরা ) তা গ্রহণ করেনি। হাসানুল হুযাইবী দলকে এ ধরণের সরকারের সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না – যেখানে প্রকৃত স্বাধীনতা সরকারের থাকবেনা বরং বিপ্লবী নেতৃত্বই তা অর্জন করবে। হাসানুল হুযাইবী বলেন আমরা সরকারের নির্ভেজাল শুভাকাঙ্ক্ষী, নেতৃত্বের কর্ণধাররা ভাল কাজ করলে আমাদের সহযোগিতা লাভ করবে। আর যদি তাদের দ্বারা কোন ত্রুটি সংঘটিত হয় তবে আমরা এ ব্যাপারে সমালোচনা করবো। মজলিশে শুরার একজন সদস্য আহম হাসান বকুরী দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন এবং তাকে দল থেকে পদত্যাগ করতে হয়।
দুই : ইখওয়ান ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের দাবী পুনরায় উত্থাপন করতে শুরু করে। আল মুসলিমূন পত্রিকা ( আগস্ট ১৯৫১) বিপ্লবের ওপর আলোকপাত করে লিখে যে – “জাতিকে উপনিবেশ ও গোলামীর হাত থেকে মুক্ত করার কাজটি বিপ্লবের দ্বারা পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত কাজ এমন এক জাতিকে আঞ্জাম দিতে হবে যারা চিন্তা ও জ্ঞানের দিক থেকে, অনুভূতি ও প্রেরণার দিক থেকে এবং আমল ও আখলাকের দিক থেকে পূর্ণরূপে মুসলমান। যাদের ওপর ইসলামী বিধান বাস্তবায়নের ভরসা করা যায়। এ কাজ কেবল তারাই করতে পারে যারা ইসলামের সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখে এবং হক বাতিলের যুদ্ধে পা কোন অবস্থাতেই টলবেনা।” ইখওয়ান বিপ্লবী পরিষদের কাছে দাবী জানায় যে, দেশে মদ পান এবং জুয়া-বাজী নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু পরিষদ কেবল গুটি কয়েক মৌলিক বিধিনিষেধ স্থির করে, যাতে ইখওয়ান সন্তুষ্ট হয়নি।
তিন : ১০ ডিসেম্বর মিসরের সংবিধান বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এবং নতুন সংবিধান রচনার জন্য একশ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। হাসানুল হুযায়বী সদস্যদের অনুরাগ লক্ষ্য করে দাবী করেন যে, এই বিষয়টি রেফারেনডামের মাধ্যমে ঠিক করা হোক যে, মিসরের জন্য ইসলামী শরীয়ত নির্ধারিত হবেনা পাশ্চাত্য ব্যবস্থা। কিন্তু এ দাবী বিপ্লবী পরিষদের কাছে বিষাদময় হয়ে উঠে।
চার : ১৬ জানুয়ারি ৫৩ সালে বিপ্লবী পরিষদ এক আইনের বলে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সে সময় হাসানুল হুযায়বীর অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা বেশ কাজে আসে। উরজুস ইখওয়ান ফৌজের সাথে নিজেদের ভাগ্য জড়িত করতে চাচ্ছিল। কিন্তু হাসানুল হুযাইবী স্বীয় পার্থক্য বজায় রাখা জরুরী মনে করেন। যদিও এর ফলে ছোট খাট রাজনৈতিক চিত্তাকর্ষতা থেকে দূরে থাকতে হয়। সুতরাং তিনি বিপ্লবী পরিষদের কাছে একটি স্মারক লিপি পাঠান। যাতে ইখওয়ানকে প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাতারে গণ্য করায় আপত্তি জানিয়ে বলা হয় – ইখওয়ান একটি সার্বজনীন দীনী জামায়াত, রাজনীতি এ কর্মসূচীর একটি অংশ মাত্র। ইখওয়ান ক্ষমতার প্রত্যাশী নয় এবং না তারা পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে।” এভাবেই মুরশিদ দলকে এক কঠিন বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন।
পাঁচ : ২৩ জানুয়ারি ১৯৫৩ সালে সরকারী দল কর্তৃক ‘সাতহুত তাহরীর’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। ইখওয়ান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যদের এতে যোগদানেরও দাওয়াত দেয়া হয়। ইখওয়ান তা প্রত্যাখ্যান করে। হাসানুল হুযাইবী জামাল আবদুন নাসেরের সাথে দেখা করে তাকে বলেন ‘বিপ্লব’গোটা জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। সুতরাং জাতিকে কোন বিশেষ দলের সাথে জড়িত করা উচিত নয়। এর পরিণতি যা হবে তা হলো, সুযোগ সন্ধানীরা এতে প্রবেশ করে ব্যক্তিগত স্বার্থে সংগঠনকে ব্যবহার করবে এবং সরকার ও বিপ্লবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে।
ছয় : ২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৩ সালে ব্রিটেনের সাথে দ্বিতীয় বারের মতো আলোচনার ধারা শুরু হয়। ইখওয়ান আলোচনাকে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে কেবল সময় ক্ষেপণ বলে মনে করতো। এছাড়া এমন কোন শর্ত মেনে নিতেও প্রস্তুত ছিলনা – যা ইংরেজদের কোনভাবে পুনরায় মিসরের মাটিতে পা রাখার সুযোগ করে দেয়।
সাত : চুক্তির শর্তের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছিল যে, ইংরেজ দূতাবাসের কর্মকর্তা মিঃ ইভেনজ মুরশিদের আমের ( হাসানুল হুযাইবী) সাথে সাক্ষাত করবেন যেন চুক্তির শর্তের ব্যাপারে তিনি ইখওয়ানের অভিমত জানতে পারেন। মিস্টার ইভেনজ এবং ইখওয়ান উভয়ের মাঝে এতে সম্মতি ছিল। মুরশিদ এ সাক্ষাতকারে সরকারের অবস্থানের পূর্ণ সমর্থন করেন এবং অনতিবিলম্বে মেজর সালাহ সালেমকে ( ন্যাশনাল গাইডেন্স মন্ত্রী) ডেকে আলাপ আলোচনার বিষদ বিবরণ শোনান। কিন্তু এ স্বত্বেও বিপ্লবী পরিষদের পক্ষ থেকে ইখওয়ানের প্রতি ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আরোপ করা হয়।
ইখওয়ান ও বিপ্লবী পরিষদের মধ্যে মতভেদের এ ছিল মূল কারণ। কিন্তু ১২ জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে এমন এক ঘটনা সংগঠিত হয় যাকে কেন্দ্র করে ইখওয়ানকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এদিন ইখওয়ানের ছাত্ররা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে শহীদ দিবস পালন করছিল। হঠাৎ হাইতাতুত তাহরীরের একটি জীপে করে ক’জন অস্ত্রধারী এসে ‘আল্লাহু আকবার’ এবং এবং ‘মিসর জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিতে দিতে প্রবেশ করলো। কিন্তু তাদেরকে বাধা প্রদান করা মাত্র তারা রিভলভার থেকে গুলি বর্ষণ শুরু করে। ইখওয়ান ছাত্ররাও সাথে সাথে পাল্টা জবাব দেয়। এ ঘটনাকে ছুতা বানিয়ে বিপ্লবী সরকার ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং গ্রেফতার করে অসংখ্য নেতাকে। অপরদিকে জেনারেল নাজিবকেও বিপ্লবী পরিষদ পদচ্যুত করে। এ নিয়ে দেশে এক বড় রকমের বিশৃংখলা দেখা দেয়। সেনাবাহিনীর মাঝে প্রবল চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বিপরীত নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত নাজিবকে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হয়। এমনকি ইখওয়ান ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণাও দেয়। এ ঘোষণার তিন দিন পর হাইতুত তাহরীর প্রচন্ড হাংগামা শুরু করে এবং দেশের পরিবেশ এতোটা বিরূপ আকার ধারণ করে যে নাজিবকে পদত্যাগ করতে হয়। ইখওয়ান ছাড়া সকল রাজনৈতিক দলকে ভেঙ্গে দেয়া হয়। এবং জামাল আবদুন নাসের স্বয়ং প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পয়লা সেপ্টেম্বর ৫৩ সালে ব্রিটেনের সাথে সৈন্য প্রত্যাহার চুক্তির ওপর স্বাক্ষর সম্পাদিত হয়। ইখওয়ান এ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে এবং ইখওয়ান ও বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের মাঝে উত্তপ্ত বিতর্ক শুরু হয়। ২৬ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে জামাল আবদুন নাসেরের ওপর প্রাণনাশমূলক হামলা হয় যার অভিযোগ আরোপ করা হয় ইখওয়ানের ওপর। এমনকি ইখওয়ানের ছয়জন নেতার মৃত্যুদন্ড দেয়ার মাধ্যমে এই দীর্ঘ কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে। হাজার হাজার লোককে জেলে পুরা হয় এবং তাদের প্রতি যুলুম নির্যাতনের এমন চরম ষ্টীম রোলার চালানো হয় যা দেখে মানব ইতিহাসের কালো অধ্যায়ও কেঁপে উঠে। একদিকে বিপ্লবী সরকার ফেরাউন, নমরুদ, চেঙ্গিস ও হালাকু খানের স্মৃতি সজীব করে তুলছিল, অপরদিকে ইখওয়ান বন্দীরা বেলাল, খোবাইব এবং সাঈদ বিন জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মতো ইসলামের মহান ব্যাক্তিদের আদর্শ উজ্জীবিত করছিল।