শিক্ষাংগনে
শিক্ষা ক্ষেত্রে ইখওয়ান যে অবদান রাখে, তা তাদের সকল তৎপরতার মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। ইখওয়ান বিভিন্ন সময়ে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। তারা শিক্ষার চারটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন :
১. সত্যানিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।
২. উন্নত নৈতিক চরিত্রের বিকাশ।
৩. অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো।
৪. জ্ঞান বিজ্ঞানের মৌলিক ভিত্তির ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ লোক তৈরি।
ইখওয়ানের শিক্ষা পরিকল্পনার বিস্তারিত রূপ হলো নিম্নরূপ :
প্রথমত : চিরন্তন ও সুদৃঢ় এক পলিসি গ্রহণ করা যা শিক্ষার মান উন্নত করবে এবং সে সকল শ্রেণীর মাঝে একত্ব সৃষ্টি করবে যা উদ্দেশ্য ও লক্ষের দিক থেকে সমকক্ষ। জাতির বিভিন্ন সংস্কৃতিকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসা এসব শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়কে নৈতিক প্রশিক্ষণ ও দেশপ্রেমিক মন সৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট করা।
দ্বিতীয়ত : ইসলামের ইতিহাস এবং ইসলামী তাহযীব তামাদ্দুনের ইতিহাসের ওপর বিশেষ দৃষ্টি দেয়া।
তৃতীয়ত : দীনী শিক্ষাকে সকল শিক্ষামূলক পর্যায়ে মৌলিক বিষয় হিসেবে পড়ানো।
চতুর্থত : বালিকাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সিলেবাস পুনর্বিবেচনা করা এবং প্রতিটি শাখায় বালক বালিকাদের সিলেবাসে পার্থক্য সৃষ্টি।
পঞ্চমত : এমন ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে রাখা যারা ক্ষতিকর আকীদা বিশ্বাস এবং অনৈতিকতার মাঝে নিমজ্জিত।
ষষ্ঠত : বিজ্ঞানের প্রতি পুরোপুরি দৃষ্টি দেয়া এবং পাশ্চাত্য দর্শন ও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের পার্থক্য নিরূপণ করা।
প্রথম দিকে ইখওয়ান তাদের শিক্ষা স্কিমসমূহ সরকার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই ক্ষান্ত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা তাদের সাধ্যমত এগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালায়। এ উদ্দেশ্যে তারা একটি বোর্ড গঠন করে এবং বালক বালিকাদের পৃথক পৃথক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কারিগরি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নিরক্ষরতা দূর করা এবং জনগণের মাঝে দীনী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, কুরআন হিফযখানা এবংয় কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় চালু করা হয়। পরীক্ষায় কৃতকার্য ছাত্রদের জন্য কয়েকটি শিক্ষা কেন্দ্র খোলা হয় যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা ছিল। যে সমস্ত বয়সের শিশুরা শ্রমের কারণে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত রয়ে যায় তাদের শিক্ষার জন্য শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ছেলেদের শিক্ষার জন্য প্রাইভেট স্কুল চালু করা হয়। উম্মাহাতুল মুমিনীন বিদ্যালয় নামে মেয়েদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। মোটকথা, ইখওয়ান ব্যাপক পরিকল্পনার ভিত্তিতে শিক্ষা অভিযানকে বাস্তবায়ন করে। দেশব্যাপী যেখানে যেখানে ইখওয়ানের শাখা ছিল, তার কোন একটিও এমন ছিলনা যার অধীনে কো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলনা। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের যে অনুরাগ ছিল, তার প্রমাণ হলো বয়স্ক শিক্ষার একটি কেন্দ্র যেখানে একসাথে ১৭৩ জন শ্রমিক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণ হিসেব দেয় বেশ কঠিন। শুধুমাত্র কায়রো শহরেই ৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল যার মধ্যে ১১টিই কলেজ।
জনকল্যাণ
ইখওয়ান বিভিন্নমুখী কর্মসূচীর মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে। এ কর্মসূচী নির্বাহের জন্য তারা জনকল্যাণ নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। ইখওয়ান এ কাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়েই শুরু করেছিল। নাকরাশী পাশার যুগে ইখওয়ানকে যখন অবৈধ ঘোষণা করা হয়, তখন মিসরে ইখওয়ান প্রতিষ্ঠিত জনকল্যাণমূলক কেন্দ্র ছিল পাঁচশটি। ১৯৪৫ সালে আইন অনুযায়ী সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ কেন্দ্রগুলোর তত্বাবধান গ্রহণ করে। এ কেন্দ্রগুলো উপযুক্ত লোকদের জিনিসপত্র ও টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতো। যাকাত, সদকা এবং কুরবানির চামড়া থেকে সংগৃহীত অর্থ দ্বারা অভাবীদের প্রয়োজন পূরণ করতো। বেকারদের জন্য উপার্জনের ব্যবস্থা করতো এবং কখনো কখনো পর্যাপ্ত পুঁজি দ্বারা তাদেরকে কারবারে নিয়োজিত করতো। রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হতো। গরীবদের জন্য সস্তা মূল্যে খাদ্য সরবরাহ করা হতো। শ্রমিক মহলে শিক্ষার ব্যবস্থা করতো। গ্রাম্য অধিবাসীদের সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য ইখওয়ান একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। গ্রাম এলাকায় গরীব ও দরিদ্রদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করা হতো এবং গ্রাম পঞ্চায়তের মাধ্যমে স্থানীয় ঝগড়া বিবাদ মীমাংসা করানো হতো।
নাহাস পাশার আমলে ইখওয়ানকে পূর্ণবহাল করা হলে তারা বিভিন্ন কর্মসূচীর সংযোগে জনকল্যাণমূলক ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর সূচনা ঘটে কায়রোতে একটি মসজিদ, একটি চিকিৎসা কেন্দ্র, একটি লাইব্রেরী এবং একটি মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এ পরিকল্পনার অধীনে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা মসজিদসমূহের দেখাশোনার ব্যবস্থা করা হয়। কেবলমাত্র কায়রোতেই পঁচিশটি মসজিদ ইখওয়ানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো এগুলোর মধ্যে কতগুলোর সমস্ত ব্যয়ভার ইখওয়ান নিজেই বহন করতো। এবং কতগুলোতে তারা শুধুমাত্র ইমামতী ও খতীবের দায়িত্ব পালন করতো সম্পূর্ণ অবৈতনিক ভাবে।
কৃষক ও শ্রমিকদের কল্যাণে ইখওয়ানের কেন্দ্রে স্বতন্ত্র বিবাগ ছিল যা তাদের নিানবিধ সমস্যার সমাধান করতো। একটি শ্রমিক সেন্টার খোলা হয় যেখানে শ্রমিকদেরকে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এবং লেবার আইন সংক্রান্ত শিক্ষা দেয়া হতো। এ বিভাগে শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের একটি টিম কাজ করতো। একই ভাবে কৃষি ক্ষেত্রেও ইখওয়ানের বড় অবদান চির। তাদের কৃষি বিভাগ কৃষকদেরকে কৃষির নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করতো এবং ফসলকে আকাশ ও যমীনের যাবতীয় বিপদ থেকে রক্ষা করার পদ্ধতি শিক্ষা দিত। ইখওয়ানকে এ সকল কাজ এ জন্যেই করতে হতো যে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে মোটেও দৃষ্টি দেয়া হতো না। এবং দীনী দাওয়াতের সাথে এ দীনী আন্দোলনের সেই গভীর ও ব্যাপক প্রভাব গ্রহণ করছিল যা শুধু শুধুই বক্তৃতা বিবৃতির দ্বারা তারা গ্রহণ করতো না।
সামাজিক কল্যাণেও একটি স্বতন্ত্র বোর্ড কাজ করতো। আর এ বিভাগটি ছিল সামাজিক বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং প্রফেসারদের সমন্বয়ে গঠিত। তারা সামাজিক উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও তত্বাবধান করতো। ইখওয়ান তাদের শেষ দিনগুলোতে কায়রোর সে অঞ্চলে যাকে প্রাচীন মিসর বলা হতো, একটি আদর্শ শহর নির্মাণের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপদানের কাজ করেছিল। এ উদ্দেশ্য তার জমি ক্রয় করে এবং এখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত লোকদের এক পরিছন্ন বসতি স্থাপন করতে চেয়েছিল।
অর্থনৈতিক অঙ্গনে
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইখওয়ানের অবদান ছিল সর্বব্যাপী। জাতীয় অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য তারা বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। যার মুনাফা মুদারাবাতের ভিত্তিতে বন্টিত হতো এবং এ মুনাফায় শ্রমিকদেরও অংশীদারিত্ব ছিল।
১.ইসলামী কোম্পানি : চার হাজার পাউন্ড পুঁজি সমন্বয়ে ১৯৩৯ সালে এর পদচারণা শুরু হয়। ইখওয়ানের বারে লোকেরাও এতে অত্যন্ত আগ্রহান্বিত হয় এবংয় চার হাজার পাউন্ড থেকে উন্নীত হয়ে এর মূলধন বিশ হাজার পাউন্ডে পৌঁছে। এ কোম্পানি কয়েকটি সাধারণ বাস চালু করে। জ্বালানী তেলের চুলা তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। যার চাহিদা শুধু মিসরেই নয় মিসরের বাইরেও সৃষ্টি হয়। এ কোম্পানি একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরিও প্রতিষ্ঠা করে।
২. আরব কোম্পানি : ১৯৪৭ সালে ষট হাজার পাউন্ড পুঁজি নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এ কোম্পানিটি হাজার হাজার পাউন্ড মূল্যের পাথর কাটার আধুনিক যন্ত্র আমদানি করতো। কিন্তু সংগঠনকে যখন অবৈধ ঘোষণা করা হয় তখন এর সঞ্চয় লা ওয়ারিশ অবস্থায় পড়ে থাকে এবং কোম্পানির হাজার হাজার পাউন্ড লোকসান হয়।
৩. বস্ত্র কোম্পানি : ১৯৪৮ সালে আট হাজার পাউন্ড দ্বারা এ কোম্পানি কাপড় তৈরির কারখানা চালু করে। এ কারখানায় ষাট জন কারিগর কাজ করতো। কারখানাটি উৎকৃষ্টতর পপলিন, রেশমি, গাবরুন এবং অন্যান্য উৎকৃষ্ট কাপড় তৈরি করতো যা ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হতো।
৪. ইসলামী পাবলিকেশন্স কোম্পানি : সত্তর হাজার পাউন্ড বিনিয়োগে এর সূচনা ঘটে।
৫. দৈনিক পত্রিকা কোম্পানি : এর প্রাথমিক পুঁজি ছিল পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। ৫ মে ১৯৪৬ সালে এ কোম্পানির পক্ষ থেকে দৈনিক পত্রিকা চালু হয় যা স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতির প্রচলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
৬. বাণিজ্য ও প্রকৌশল কোম্পানি : চৌদ্দ হাজার পাউন্ড পুঁজি নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গৃহনির্মাণ কাজে এ কোম্পানি অত্যন্ত সুনাম অর্জন করে।
৭. বাণিজ্যিক কোম্পানি : এর কেন্দ্র ছিল কায়রোতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানেও শাখা ছিল এ কোম্পানি পারস্পরিক সহযোগিতার মৌলনীতির ভিত্তিতে কাজ করতো। নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সস্তা মূল্যে সরবরাহ করতো।
এছাড়া চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইখওয়ানের অবদান হলো, শুধু মাত্র কায়রোতেই সতেরটি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং একটি হাসপাতাল ছিল। এ হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি করা হতো। এসব চিকিৎসালয় থেকে লাখ লাখ মানুষ বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা ভোগ করতো। বিভিন্ন রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ এতে বিনা পারিশ্রমিকে অথবা স্বল্পভাতায় চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করতেন।
এ হলো ইসলামী বিশ্বের মহান দীনী আন্দোলনের অবদানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। যে আন্দোলনকে নির্মল করার জন্য মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের বার বাছর যাবত তার সকল প্রকার শক্তিসামর্থ্য ব্যয় করেছিল। এছাড়া প্রাশ্চাত্য এবং পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ এবং ইসরাইল যাদের সামনে এক বড় প্রতিবন্ধক ছিল।
মিসর ও ইখওয়ান
[এ নিবন্ধটি ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাইয়েদ কুতুবের (রঃ) শাহাদাত উপলক্ষে রচিত। এতে মিসরের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা সে সময়ের সাথে সম্পর্কিত।]
১৯৪৫ সাল থেকে চলে আসা নাসের ও ইখওয়ানের দ্বন্দ্ব বর্তমানে আবারো চরম দুঃখজনক পর্যায়ে এসে পরিণত হয়েছে। ৫৪ সালে ইখওয়ানের ছয়জন বিশিষ্ট নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। আর এখন পুনরায় তিনজনকে ফাঁসী দেয়া হলো যাদের মধ্যে প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব সাইয়েদ কুতুবও রয়েছেন। এঁদের ওপর অভিযোগের দীর্ঘ ফিরিস্তি আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং ভয়ঙ্কর অভিযোগ হলো, এঁরা প্রেসিডেন্ট নাসেরকে হত্যা করতে চেয়েছিল। এছাড়া অস্ত্র বলে দেশে রক্তাক্ত বিপ্লব সংঘটিত করার পরিকল্পনা তৈরি করছিল। এসব অভিযোগের রহস্য কি এবং ইখওয়ানের পক্ষ থেকে অভিযোগগুলোর কি জবাব দেয়া হয় এ দুটি দিকের ওপর আলোকপাত করার পূর্বে সেসব কারণ অনুসন্ধান করে দেখা দরকার যা প্রকৃত পক্ষ এ দ্বন্দ্বের গভীরে কাজ করেছে।
বিগত কয়েক বছরে মিসরীয় সরকার তাদের বৈদেশিক নীতি যে প্রকৃতিতে পরিচালিত করছিল মিসরের চিন্তাশীল এবং দেশ প্রেমিক মহল এতে সন্তুষ্ট ছিল না এবং এ অসন্তোষ চরম ক্রোধ, বিরক্তি এবং উত্তেজনাকর অবস্থায় রূপান্তরিত হতে থাকে। মিসরীয় জাতি মূলত ইসলাম প্রেমিক, ইসলামী ইতিহাসের সাথে তাদের রয়েছে সুগভীর সম্পর্ক। শতাব্দীকাল ধরে সেখানে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হয়ে আসছে। ইসলামী বিশ্বের সাথে সর্বদা তাদের সংযোগ ছিল। নিকট অতীতে তাদের মাঝে অনেক সংস্কারক, জ্ঞানীগুণী এবং দাওয়াতের শক্তিশালী জামায়াত অতিক্রান্ত হয়েছে। শহরবাসীর বিশেষ মহল বাদে সাধারণ বাসিন্দারা যাদের অধিকাংশ ই ছিল গ্রাম্য কৃষক ইসলামের সাথে তারা ছিল গভীর ভাবে আবদ্ধ এবং তাদের সামাজিক জীবনে ইসলামী জীবন ইসলামী আচরণের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হতো। এ মুসলমান জাতিকে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকার হতে হয় তা নিম্নরূপ :
ইসলামী বিশ্বের সমস্যা ও সংকটকে মিসরের বৈদেশিক নীতি ইসলামী বা মুসলমানদের সমস্যা হিসেবে দেখতনা। বরং সেসব গোষ্ঠীর দূরদর্শী চশমা দিয়ে বিচার করতো যাদের লেজুড়বৃত্তি এর মর্যাদার কারণ হতো। অথবা এটি মিসরীয় শাসকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও উপযোগিতার অনুগত। এ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিই মিসরের বৈদেশিক নীতিকে ভিত্তিহীন এবং সুযোগ সন্ধানী বানিয়ে রেখেছে। একদিকে মিসর সরকার ইসরাইলের সাথে শত্রুতাকে তাদের সর্বপ্রধান সর্বশেষ উদ্দেশ্য হিসেবে গণ্য করতো, কিন্তু অপরদিকে ওই দেশগুলোর সাথে তাদের গভীর সংযোগ ছিল যা না কেবল ইসরাইলকেই সমর্থন করতো বরং এর উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য নিবেদিত ছিল। যুগোস্লাভিয়ার সাথে এর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আবিসিনিয়ার হ্যাল সেলাসীর সাথে চরম ঘনিষ্ঠতা ছিল। অথচ এ ব্যক্তি মুসলমানদের হত্যাকারী ছিল এবং ইসরাইলের জন্য আফ্রিকার ভুখন্ডকে কন্টকমুক্ত করছিল। ইরিত্রিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সে কয়েকটি ইসরাইলী কোম্পানিকে ব্যবসায় বাণিজ্যের অনুমতি প্রদান করে। একবার আমেরিকা কংগ্রেসে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সে বলে :
আমি আগামী বিশ বছরে এ সকল হাবশী মুসলমানদের খ্রিষ্টান বানিয়ে ছাড়বো যারা আমার সাম্রাজ্যে বসবাস করে।
ম্যাকারিউস মিসরীয় সরকারের দৃষ্টিতে এতোটা প্রিয় ছিল যে, তুরস্কের বিরুদ্ধে তাকে সমরাস্ত্র পর্যন্ত সাহায্য দেয়া হয়। আবার ইদানীং নিকোসিয়া তেকে ঘোষণা করা হয় যে, যদি তুরস্ক সাইপ্রাসের ওপর হামলা করে তবে এর জবাবে মিসরের রকেট সেখানে সাহায্য পৌছবে। ম্যাকারিউস কোন অজানা অজ্ঞান ব্যক্তিত্ব ছিলনা। সে সাইপ্রাসীয় তুর্কীদের নির্দয়ভাবে হত্যা করে যা প্রকৃত অর্থে অর্থোডক্স গির্জার আড়ালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সেবাই করছিল। ম্যাকারিউস যখন মিসর সফর করে তখন সে প্রেসিডেন্ট নাসেরের প্রশংসা করতে গিয়ে বলে-
তিনি আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, এমনকি আলোচনার মাঝে তিনি ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ পর্যন্ত উল্লেখ করেননি।
মিসর সরকার এবং মিসরীয় শাসকদের অযাচিত বলপ্রয়োগ সিরিয়াকে চিরকালের জন্য অন্ধকার ভবিষ্যতের গহ্বরে নিক্ষেপ করে। সিরিয়া মিসরের সাথে যে আবেগপূর্ণ বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিল তার দাবী এই ছিল যে, সিরীয়দের এ মহা ঐতিহাসিক ত্যাগের মর্যাদা দেয়া হবে এবং যে অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে তারা মিসরের আঁচলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল তা সমাধানের লক্ষে মিসর মদদ দেবে। এ কথা প্রত্যেকের জানা ছিল যে, সিরিয়া কমিউনিস্টদের চোগলখুরী দ্বারা ভীত হয়ে নিজেকে মিসরের সাথে সম্পৃক্ত করে। কিন্তু মিসর কর্তৃপক্ষ সিরিয়ায় লুটতরাজের যে বাজার গরম করে সে কারণে সিরিয়ার জন্য মিসর থেকে আলাদা হবার প্রয়োজন দেখা দেয় এবং বর্তমানে অবস্থা এ দাড়ায় যে, তারা আকাশ থেকে ছিটকে পড়ে খেজুর গাছে আটকে পড়েছে। এর পূর্বে মিসর সুদানকে অকেজো করে দেয়। নীল উপত্যকার ঐক্যের ফাঁদ তৈরি হতে না হতেই তা ছিড়ে যায়। নাজিবের সাথে মিসর সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ সুদানী জনগণকে মিসরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির কারণে পরিণত করে। আর এখন মিসর সরকার তাদের পূর্বের ভুলসংশোধনের পরিবর্তে আরো অধিক ভুল করার অপরাধ করে যাচ্ছে। যেহেতু সুদানের বর্তমান সরকার মিসরের সাথে ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে নয় সেহেতু মিসরীয় শাসকরা সুদান সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন ও বিপাকে ফেলবার জন্য দক্ষিণ সুদানের কমিউনিস্টদের সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে। সুদান সরকার সেসব মিসরীয় অস্ত্রশস্ত্রের উৎসও খুঁজে বের করে যা মিসর থেকে দক্ষিণ সুদানে প্রবেশ করেছিল।
এবার ইয়েমেনের সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক। প্রকৃত অবস্থা হলো ইয়েমেন সমস্যা মিসর সরকারের বেআইনি নীতির কারণে শুধু মিসরের জন্য বদনামের কারণেই পরিণত হয়নি। বরং ইসরাইলী রেডিওর ভাষায় গোটা ইসলামী বিশ্বের ললাটে কলঙ্ক লেপন করেছে। তিন বছর যাবত মিসরীয় সৈন্য ইয়েমেনে অবস্থান করেছে। এ তিন বছরে ইয়েমেনী গোত্রগুলোর ওপর তারা যে যুলুম নির্যাতন চালায় তার বিস্তারিত বর্ণনা আলাদাভাবে দেয়ারই দাবী রাখে। এ তিন বছরে মিসর তার সৈন্যদের জন্য একশ কোটি পাউন্ড ব্যয় করেছে এবং এ পর্যন্ত পাঁচ লাখ পাউন্ড দৈনিক ব্যয় হচ্ছে। এক লাখের কাছাকাছি লোক যুদ্ধে প্রাণ হারায় যার মধ্যে দশ হাজার মিসরীয় সৈন্য এবং অবশিষ্টরা ইয়েমেনের অধিবাসী। একদিকে আরব জাতীয়তাবাদীদের দাবী, অপরদিকে আরব ভাইদের এ গণহত্যা প্রত্যেক দেশপ্রেমী নাগরিকের জন্য দুশ্চিন্তার কারণে পরিণত হয়। মিসরের সেসব লোকেরা বিশেষভাবে এ যুদ্ধের প্রতি কঠিন অসন্তোষ প্রকাশ করে যাদের সন্তানরা সানআ এবং তাজের পাহাড়ে মৃত্যুর শিকার হয়। মিসর সরকার এ প্রচার চালায় যে, ইয়েমেনের যুদ্ধে নিহতরা স্বাধীনতার জন্যে শহীদ। কিন্তু একজন মুসলমানের বিবেক একথা কিভাবে মেনে নিতে পারে যে, মুসলমান মুসলমানের গলাও কাটবে, অথচ শাহাদাতের মর্যাদাও লাভ করবে। এ অবস্থায় গোটা আরব বিশ্ব, ইয়েমেনী জনগণ এবং মিসরীয় জাতি হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। স্বয়ং মিসরীয় সেনাবাহিনীও এতে বিরক্তি বোধ করে এমনকি প্রেসিডেন্ট নাসেরের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুল লতিফ বাগদাদী এবং কামাল উদ্দিন হোসাইন যারা তার দক্ষিণ হস্ত হিসেবে বিবেচিত হতো এ যুদ্ধের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। আর এরই প্রতিদান হিসেবে তারা তিরস্কারের শিকার হন।
ফিলিস্তিন সমস্যার সাথে মিসরের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এ সমস্যা এ পর্যন্ত যে পর্যায়ে অতিক্রম করে তার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তা সকল সম্ভাব্য সমাধান থেকে দুরে চলে যেতে থাকে এবং এখন আরব জনগণ এটা ভাবতে বাধ্য হয় যে, মিসর সরকার এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানোর ইচ্ছা পোষণ করেন যখন ইসরাইলের প্রভাব দিনে দিনে বেড়ে চলছে। প্রথমত: মিসর সরকার সে দেশগুলোর সাতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে যা কেবল ইসরাইলকে সমর্থন করে না। বরং ইসরাইলকে দমন করার জন্য সহযোগিতা করতে পারে তাদের সাথে মিসর সরকার অমানবিক নীতি গ্রহণ করেছে।বরং প্রকাশ্য বিবাদের পর্যায়ে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ফিলিস্তিন সমস্যার ব্যাপারে মিসরের নীতির সুস্পষ্ট ত্রুটি সমূহ এ ছিল যে, তারা গাজায় জাতিসংঘের জরুরী বাহিনীর অনধিকার প্রবেশকে সমর্থন করে সে অঞ্চলকে কার্যত ইসরাইলের অবাধ বিচরণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। আর এটাই সে এলাকা যেখান থেকে আরব স্বেচ্ছাসেবকরা ইসরাইলে গোপনে প্রবেশ করে গেরিলা অভিযান চালাতো। জাতিসংঘ পুলিশ এখন আরব স্বেচ্ছাসেবকদের এ অঞ্চলে প্রবেশ কবতে দিচ্ছেনা এবং ইসরাইল নিশ্চিন্তে এখানে তার অর্থনৈতিক অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করছে। তেমনিভাবে পশ্চিম তীরেও জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করে মিসর সরকার একে কার্যত ইহুদীদের হাতে অর্পণ করে। জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইহুদীদের এ অঞ্চলে ঘোষণার কোন সাহসই হতনা অথচ এখন তারা ইলাত এলাকায় বিরাট বন্দর গড়ে তুলেছে এবং তাদের জাহাজগুলো সগর্বে আফ্রিকীয় দেশগুলোতে যাতায়াত করছে। এ উপসাগর উন্মুক্ত হওয়ার সকল সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটে যে কারণে ইসরাইল কঠিন পেরেশান ছিল এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম মন্দা অবস্থার শিকার হয়েছিল। এখন তারা নির্বিঘ্নে আফ্রিকার দেশগুলোতে নিজেদের বাণিজ্যিক বাজার প্রতিষ্ঠা করছে এবং এ দেশগুলোর অধিকাংশই তাদের প্রতারণার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে।
মিসর সরকারের চোখের সামনে তাদের নিদেরেই ভুলের কারণে এসব পরিবর্তন ঘটে। যা দেখে আরব জনগণর বুকে আগুন জ্বলে উঠে। কিন্তু মিসর সরকার এর ক্ষতিপূরণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে উলটা এ ঘোষণা করছে যে, ফিলিস্তিনি সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো আরব দেশসমূহের সমাজতান্ত্রিক এবং বিপ্লবী সরকারগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া। অর্থাৎ বিশ্বের মুসলমানরা এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হবে যারা সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী। ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার এক অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট নাসের বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন :
আমি সুস্পষ্টভাবে বলছি যে, আত্মরক্ষার জন্যেও আমাদের কোন শক্তি নেই। যদিও আমরা আক্রমণ করার পজিশনে রয়েছি। জর্দান নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়ার সমস্যাকে এ মুহূর্তে মুলতবী করা উচিত।
আবদুল হাকিম আমের ফ্রান্স সফরকালে প্যারিসে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে বলেন : সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র ইসরাইলের সাথে যুদ্ধের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা কোনটাই পোষণ করেনা।
এ সফরেই মিসর সরকার ফ্রান্সের কাছ থেকে হাজার হাজার ডলার গ্রহণ করে। জনৈক মিসরি সেনা অফিসার ব্রিগেডিয়ার মুহাম্মদ ফৌজ তার ইহুদীবাদ ও ইসরাইল নামক গ্রন্থের ১৩১পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন।
কেউ কেউ ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে যুদ্ধকে স্বীকৃতি দেয়। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ব্যাপার। এ সমাধান জাতিসংঘের সেই চুক্তির পরিপন্থী যাতে আরবদেশগুলো স্বাক্ষর প্রদান করেছে। এমনকি এ সমাধান স্থায়ী শান্তি-নীতিরও খেলাফ যার পতাকাবাহী হলো মিসর।
এ গ্রন্থটি কায়রোতে মিলিটারি ট্রেনিং কলেজের সিলেবাসভুক্ত ছিল। আর এটা কি কোন জটিল বিষয়, যাকে মিসরের মুসলিম জনগণ বুঝতে পারবেনা যে, মিসর সরকার ইয়েমেনে একশ কোটি পাউন্ড ব্যয় করতে পারে, ষাট হাজার সৈন্য ব্যবহার করতে পারে অথচ ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের কাছে কোন উপায় উপকরণ নেই?
আরব বিশ্ব তথা ইসলামী বিশ্বে বর্তমানে যে বিষয়টি সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হা হলো ইসলামী ঐক্য। আরব নেতৃবৃন্দের কনফারেন্স তাদের বিগত বৈঠকে এ প্রস্তাব পাশ করে যে, ফিলিস্তিন সমস্যাকে কেবলমাত্র আরবদের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে একে সকল মুসলমানের সমস্যা হিসেবে সাব্যস্ত করা উচিত এবং এজন্যে মুসলমান সরকারগুলোর সাহায্য সহযোগিতা লাভ করা প্রয়োজন। সোনালী ল্যান্ডের নেতা এ প্রস্তাব পেশ করেন যে, মুসলিম দেশগুলোর কিছু কিছু সমস্যার ব্যাপার ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। এ উদ্দেশ্যে মুসলিম নেতৃবৃন্দের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। সৌদি আরবের বাদশা ফয়সল এ প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং কার্যত এ দাওয়াত নিয়ে তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন। এখন বিবেকের দাবী এটাই ছিল যে, মিসর সরকার এ দাওয়াতকে সহায়তা দানে এগিয়ে আসবে, শুধু তাই নয়, বরং এর অগ্রবর্তী বাহিনীতে যোগ দেবে। কিন্তু পক্ষান্তরে সর্বপ্রথম মিসর সরকারই এ দাওয়াতের বিরোধীতা করে বসলো। না তারা নিজে এ পরিকল্পনায় জড়িত হতে প্রস্তুত হলো, আর না অন্য প্রভাবাধীন দেশসমূহকে এতে শামিল হবার অনুমতি প্রদান করলো। বরং এ পরিকল্পনার জবাব সেই দলীল দ্বারা দেবার পরিবর্তে গালিগালাজের পথে নেমে এলো। প্রশ্ন হলো, যদি আরব দেশগুলোর সমাজতান্ত্রিক এবং বিপ্লবী সরকারগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ চিন্তাধারাকে ঐক্যের ভিত্তি সাব্যস্ত করতে পারে তবে ইসলামের মৌলিক ভিত্তির ওপর ঐক্যবদ্ধ হওয়া হারাম কেন হবে? এছাড়াও মিসর সরকার তাদের বিরোধী পক্ষের সমালোচনায় (যদি আরব নেতৃবৃন্দকে বিরোধীপক্ষের কাতারে রাখা হয়) যে ভাষা ও কৌশল অবলম্বন করে তা না ইসলামী চরিত্র অনুযায়ী ছিল না আরব নীতি অনুযায়ী। বরং দানবিয় নীতি নৈতিকতাও একে সহ্য করতে পারেনা। যেমন অমুকে সাইয়েদ বংশের নয় বরং শয়তান বংশের, অমুক ব্যক্তি ইহুদীর বাচ্চা, ইত্যাদি। এসব কি কোন ভদ্র ও মার্জিত সরকারের অপপ্রচারের ভাষা হতে পারে? আর মিসরের জনগণ এতোটা নাদান নয় যে, তারা নিজের দেশের মুখপাত্রের ভাষার প্রয়োগ এভাবে হতে দেখে পেরেশান হবে না।
মিসরের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও এখানে উল্লেখযোগ্য। যেমন আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছি, মিসরীয় জনগণের অধিকাংশই নিরীহ ও সাদাসিধা প্রকৃতির কৃষক। ইসলামের সাথে কৃষকদের সম্পর্ক এতোটা সুদৃঢ়, যতোটা কোন বৃদ্ধার ইমান মজবুত হতে পারে। অন্য দেশের মুসলমানদের মতো তাদের ইচ্ছা আকঙ্খাও একটাই যে, মিসরে ইসলামের প্রসার ঘটুক, ইসলামী শিক্ষার উন্নতি হোক, ইসলামী আইন মর্যাদা লাভ করুক, তাদের নেতবৃন্দ ইসলামী শরীয়তের অনুসারী হোক এবং পূর্ববর্তীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলুক। কিন্তু পরিস্থিতি জনগণের আকাঙ্ক্ষাকেই শুধু অপূর্ণ করছে না বরং একে পদদলিত করছে।
সাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা প্রাপ্ত মিসর অঙ্গিকার সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করা হবে। প্রেসিডেন্ট নাসের এ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চিন্তাগত সমাজতন্ত্রের পরিভাষায় ব্যাখ্যা করেন এবং মিসরি সংবাদ পত্র এর ব্যাখ্যা করে মার্কসবাদ হিসেবে। ফারুকের শাসনামল পর্যন্ত সংবিধানে কমপক্ষে এ বাক্যটি সংযুক্ত চিল ডে, রাষ্ট্রীয় ধর্ম হবে ইসলাম। কিন্তু মিসর অঙ্গিকার এ রক্ষণশীলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু মুখেই নয় বরং বাস্তবে। তা মিসরে চালু করা হয়। মিসরের একক দল আরব সোশ্যালিস্ট পার্টি, এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেয়। মিসরের সোশ্যাল পার্টি নিজ অস্তিত্ব বিলীন করে আরব সোশ্যালিস্ট পার্টিতে একীভূত হবার ঘোষণা দেয়। সমাজতন্ত্রের অনুপ্রবেশের পর মিসর সরকার ঢালাওভাবে ব্যক্তি-সম্পদ এবং কোম্পানিগুলোর ওপর যেভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, তা জনগণের মাঝে ভয়ভীতি ও প্রতিশোধ স্পৃহাকে প্রজ্জ্বলিত করে তোলে। মিসরের অর্থনৈতিক অবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হয়। স্বয়ং আল আহরামের বর্ণনা মতে কায়রো পরিণত হয় ভিক্ষুকের শহরে। এ সমাজতন্ত্রের দ্বারা প্রকৃত পক্ষে কৃষক শ্রমিক নয় বরং আরব সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতারাই লাভবান হয় যাদের প্রতারণা ও লুটপাট থেকে কোন সম্মানিত ব্যক্ত পর্যন্ত ছাড়া পায়নি। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, মিসরের বড় বড় শহর কায়রো এবং ইস্কান্দারিয়া অশ্লীলতা ও পাপাচারের আড্ডাখানায় রূপান্তরিত হয়। পত্র পত্রিকার জগতে কমিউনিস্ট ও নাস্তিকদের সমাগম ঘটে। এরা ইচ্ছেমত ভোগবাদ ও নৈতিক বিপর্যয়ের উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে চলছিল। যারা যথারীতি নামায পড়ে, কফি খান, থিয়েটার এবং সিনেমা থেকে বিরত থাকে, তাদের দৃষ্টিতে এরা রক্ষণশীল, সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট ও মৃত্যুদন্ডযোগ্য।
সবচেয়ে বড় যে বিপদ মিসরের মাথায় ভেঙ্গে পড়ে, তা হলো ফেরাউনী সভ্যতার পুনরুজ্জীবন। মিসর অঙ্গীকারের বক্তব্য হলো আমরা আমাদের উন্নয়নের খসড়া ফেরউনীয় যুগের সভ্যতা থেকে গ্রহণ করবো। রামসিসের (মিসরের ফেরাউন ) প্রকৃতি স্থাপত্য এলাকা প্রতিকৃতি স্থাপত্য এলাকা থেকে স্থানান্তর করে কায়রোর মধ্যস্থলে স্থাপন করা হয় এবং এ স্থাপন কার্যে ব্যয় হয় পাঁচ লাখ পাউন্ড। প্রেসিডেন্ট নাসের তার এক বক্তৃতায় জনগণকে উদ্দেশ্যে করে বলেন ওহে, তাহতামূত ও রামসিসের বংশধর! তদ্রূপ আর এক জায়গায় বক্তৃতার সময় বলেন দুই হাজার বছর পর আজ প্রথমবারের মতো মিসরে স্বয়ং মিসরবাসীর রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ এলো। অর্থাৎ হযরত ওমর (রা:) এর যুগ থেকে নিয়ে এ পর্যন্তকার সকল অমিসরীয় মুসলমান শাসকের যুগ তার দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদের যুগ ছিল। এবং ফেরাউনী যুগের পর এই প্রথমবার মিসর সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভ করলো। আর এ দুঃসাহস এতদূর পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় যে, আবু সম্বলের মন্দির এবং প্রতিকৃতির ভিত্তিমূলে মিসর অঙ্গিকার, ইঞ্জিল ও কুরআন মজীদের দু দুটি কপি সমাধিস্থ করায়। একজন অশিক্ষিত মুসলমানের কাছেও কি আমরা এটা আশা করতে পারি যে, সে ফেরাউনী মূর্তির নীচে কুরআন রাখার ব্যাপারে নীরব থাকবে এবং তার ঈমানী মর্যাদাবোধ একে মেনে নেবে?
এসব কিছু এমন পরিস্থিতিতে ঘটছিল যখন নাগরিক স্বাধীনতা হরণ করা হয়, সংবাদপত্র ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। মিসরের নামকরা পত্রিকা আল মিসরীয় সম্পাদক আবুল ফাহাত নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। অপর একটি বিখ্যাত পত্রিকার সম্পাদক মোস্তাফা আমিন মিসর সরকারের প্রশংসায় যিনি পঞ্চমুখ ছিলেন, জেলখানায় নজরবন্দী ছিলেন এবংয় তারপর আমেরিকার পক্ষে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ আরোপ করা হয়। কমিউনিস্ট পত্র পত্রিকা বাজারে পানির মতো প্রবাহিত হচ্ছিল। আল আরাম পত্রিকার সম্পাদক মুহাম্মদ হাসনাইন হায়কাল এবং রেডিও কায়রোর ঘোষক আসাদ আহমদ নিয়মিত সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা জনগণকে শোনাতেন। একটি গোষ্ঠী আযহারের আলেমদেরকেও হাত করে ফেলে যারা ইসলামকে সমাজতান্ত্রিক প্রমাণিত করেছে। সমাজতন্ত্রের প্রশংসা ও গুণকীর্তনের প্রতিধ্বনিতে মিসরের পরিবেশ কেঁপে উঠতো, আকাশ ফেটে যেত। মিসরীয় সংবাদপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী প্রত্যহ প্রেসিডেন্ট নাসেরকে হত্যার যড়যন্ত্র করা হতো। যার পেছনে কোন না কোন রক্ষণশীল গ্রুপের হাত সক্রিয় ছিল বলে বিবেচিত হতো। এবং বাস্তবে অবস্থা এ ছিল যে, যখন মিসরে বিভিন্ন কারখানা ও অফিস আদালতে জাতীয়করণ করা হয় বরং সোজা কথায় সোশ্যালিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে দেয়া হয়, এ প্রতিষ্ঠান গুলোর উৎপাদন আয় শূন্যের কোঠায় এসে নামে এবং পূর্বের তুলনায় ব্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।
এটা হলো সার্বিক চিত্রের এক দিক। এবার এর অপর দিক উল্লেখ করা হলো – আরব সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং মিসরীয় শাসক গোষ্ঠী জনগণের কণ্ঠনালীতে যে তিক্ত ঢোক গেলাতে চেয়েছিল, তা তাদের দ্বারা গেলানো সম্ভব হয়নি। অঙ্গীকারের প্রশংসা এবং গুণাবলী মিসরীয় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য লক্ষ লক্ষ পাউন্ড ব্যয় হয়েছে। কিন্তু জনগণ তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। তারা এটাকে একটা প্রতারণা ছাড়াও কমিউনিস্ট সংবিধানের সূক্ষ্ম আবরণ মনে করতো। ফেরাউনী সভ্যতার পুনরুজ্জীবনের জন্য গোটা রাষ্ট্র যন্ত্র সক্রিয় ভূমিকা পালনে ওয়াকফ ছিল। মিসরীয় পাউন্ডে ফেরাউনের ছবি ছাপা হয়। ডাকটিকেটেও ফেরাউনের প্রতিকৃতি মুদ্রিত হয়। মিসরীয় কারেন্সিতেও ফেরাউনী যুগের চিহ্ন ঈগল অংকিত হয়। সড়কগুলোর নাম রামাসিস রোড, পার্কগুলোর নাম রামাসিস উদ্যান, সিনেমার নাম রামাসিস সিনেমা রাখা হয়। মিসরে নির্মিত মোটর গাড়ীর নাম রাখা হয় রামাসিস। কিন্তু মিসরের মুসলিম জনতা এ সভ্যতার প্রতি হাজার বার লানত বর্ষণ করছে এবং ফেরাউনকে তারা সে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে, যেভাবে হযরত মূসা (আঃ) ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসলামের অনুসারীদের দেখা উচিত। একই ভাবে ইয়েমেনে সরকারের অব্যাহত ভুল ত্রুটি গোপন করার সীমাহীন প্রচেষ্টা চালানো হয়। ইয়েমেনে মৃত্যুবরণকারী সৈন্যদের অধীনতার জন্যে শহীদ খেতাব দেয়া হয়। তাদের আত্মীয় স্বজনদের বিভিন্ন উপায়ে সন্তুষ্ট করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এস্বত্ত্বেও মিসরীয় সেনাবাহিনীর একটি অংশ এবং মিসরীয় জনগণ এ তোষামোদির প্রতি কঠিন বেজার হয়।
পক্ষান্তরে ইসলামপন্থী যে কোন ব্যক্তি, সে ইখওয়ানের সমর্থক হোক অথবা বিরোধী পক্ষ তারা যে সমস্ত কথা বলে, তা জনগণের মাঝেও দিক দিগন্তে শোনা যেতো। ইখওয়ানুল মুসলেমূনের নেতা ও কর্মীরা ১৯৫৪ সালের শেষ ভাগ থেকে জেলখানায় বন্দী জীবন যাপন করেন। রাজনৈতিক তৎপরতার কোন চিন্তা কল্পনা করাও তাদের অসম্ভব ছিল। তবু তাদের জ্ঞানী ব্যক্তিরা জেলখানায় অথবা জেলের বাইরে জ্ঞানগত ও চিন্তাধারার দিক থেকে দেশের অভ্যন্তরে ইসলামকে রক্ষার যতটুকু খিদমত করা সম্ভব ছিল তা তাঁরা করেছন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা রচনা করেছেন।মিসরে তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, ইসলামী ইতিহাস এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ওপর বিপুল সাহিত্য বিগত দশ বছরে রচিত হয় এবং তা বিভিন্ন বিষয়ে এত বেশী ছিল যে, লোকেরা লেখকদেরকে সাহস উদ্যম প্রদান এবং প্রকাশকদেরকে প্রশংসা না জানিয়ে পারেনি। আজ আমরা ইসলামের ফৌজদারি আইন সংক্রান্ত শহীদ আবদুল কাদের আওদাহর বিখ্যাত গ্রন্থের দুখণ্ড ছাড়াও বিখ্যাত মিসরীয় গবেষক দার্শনিক ফাতহী ভাসঢীর এ বিষয় সম্বলিত ছয়টি বৃহৎ গ্রন্থ দেখতে পাই। ইসলামের আন্তর্জাতিক আইনের ওপর লিনতার কোর্ট অব আপিলের জজের এক বিরল সংকলন পাওয়া যায়। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দার্শনিক আলোচনার ওপর মুহাম্মদ কুতুব, আব্দুল্লাহ আসসাম্মান, মুহাম্মদ হুসাইনের রচনা সমগ্র পাওয়া যায়। বিখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব নামক ইসলামী ইতিহাসের ফকীহ মুফসসীর,মুহাদ্দিস নেতা, ভাষাবিদ এবং ঐতিহাসিকদের জীবন সংক্রান্ত দীর্ঘ ধারা আমাদের কাছে বিদ্যমান রয়েছে, যা মিসরের প্রকাশকরা প্রকাশ করে। মোট কথা, এভাবে হাজা হাজার গ্রন্থ এ যুগে জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ রচনা করেন এবং চৈন্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত করার চেষ্টা সংগ্রাম চালানো হয়। এ রক্ষণশীল সাহিত্য সামগ্রী মিসরের জনগণের মাঝে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। মিসরের লাইব্রেরীগুলো এসকল সাহিত্য দ্বারা ভরপুর ছিল এবং অধিকাংশ ক্রেতার বগলে এ সাহিত্যগুলোই দেখা যেতো।
মিসরের কমিউনিস্ট পার্টির (বর্তমানে আরব সোশ্যালিস্ট পার্টির নামে চিহ্নিত) জন্য এ অবস্থা হয়েছিল হৃদয় পিষে ফেলার মতো। মিসরের সমাজতান্ত্রিক (সোজা কথায় কমিউনিস্ট ) সমাজে পরিবর্তন সাধানের জন্য এ রক্ষণশীল প্রকৃতির চিন্তাধারা এবং রক্ষণশীল লেখকদের সমূলে বিনাশ করা অত্যন্ত জরুরী ছিল। আমাদের জনা মতে কমিউনিস্ট নেতারা একটি দীর্ঘ রিপোর্ট তৈরি করে মস্কো পাঠায় যাতে সুস্পষ্টভাবে একথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত মিসরে রক্ষণশীল গ্রুপের একজন ব্যক্তিরও অস্তিত্ব থাকবে ততোক্ষণ পর্যন্ত মিসর আমাদের জন্য এটি লোকমাতেও পরিণত হবে না।
রাজনৈতিক দিক থেকেও মিসরের অবস্থা যা ছিল তা এ থেকে অনুমান করা যায় যে, মিসরীয় শাসকবর্গের অসংগত ব্যয়ের ফলে সিরিয়াবাসী মাত্র তিন বছরের মধ্যে প্রতিবাদী হয়ে উঠে এবং তারা সিরিয়াকে স্বাধীন করেই ছাড়ে। কিন্তু যেখানে বার বছর যাবত এ অসংগত কারবার চালু ছিল, সেখানে তিক্ততা ও অসন্তোষের সীমা কতোটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে তা সহজেই অনুমেয় মিসরীয় জনগণের মিসরের শাসকবর্গের সাথে অসন্তোষের উন্মুক্ত প্রকাশ তখন ঘটে যখন ১৯৬৪ সালে মুস্তফা নাহাস পাশার মৃত্যু হয় এবং লাখ লাখ মানুষ তার জানাজায় শরীক হয় এবং এ জানাজায় পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ অসন্তোষ প্রতিরোধে ১১ অক্টোবর ১৯৬৫ সালে এক আইন পাশ করা হয়। যাতে প্রেসিডেন্টকে এ ক্ষমতা দেয়া হয় যে, তিনি যে কাউকে রাজনৈতিক কারণে মামলা দায়ের করা ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবেন এবং তার বিরুদ্ধে কোথাও আপিল করা যাবে না।
অপরদিকে ইয়েমেন সমস্যাও এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, মিসরের জনগণ আবেগে উন্মুক্ত হয়ে মাথা ছিড়ে ফেললেও যথেষ্ট হবেনা। তিনবছর যাবত মিসরীয় সেনাবাহিনী ইয়েমেনের বারো বাজিয়ে ছাড়ে। এক কোটি পাউন্ড ব্যয় করা হয়। দশ হাজার ( অপর বর্ণনানুযায়ী পঁচিশ হাজার ) মিসরীয় যুবকদের এ যুদ্ধে উৎসর্গ করা হয়। মিসরের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়ে। ইসরাইলের মুকাবিলার জন্য সর্বশেষ যে শক্তি বর্তমান ছিল তাও বিনষ্ট করা হয় এবং ইয়েমেনের বিভিন্ন ব্যক্তি যাদের মধ্যে সাল্লালের সমর্থক এবং বদরর সহযোগীও থাকবে, সবাই একই সাথে বসে এ সমস্যার সমাধান করবে। চাই তা আজ নয় কাল, সরাসরি ও প্রত্যক্ষভাবে অথবা অন্যের মধ্যস্থতায় হোক। শেষ পর্যন্ত এ মহাত্রুটির পরিণাম কি দাঁড়ায় এ মানসিক অস্থিরতা ও মিসরীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে কঠিন অশান্তি সৃষ্টির কারণে পরিণত হয়। এ অশান্তির সমাধান এটাও ঠিক করা হয় যে, দেশে ভয় ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করা হবে। আর যদি কোথাও সমালোচনা অথবা কড়া অভিমত পরিলক্ষিত হয় তবে যথাসময়ের পূর্বেই তা বন্ধ করে দেয়া হবে।
সুদানে কমিউনিস্টদের যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় তা ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর। মিসরীয় কমিউনিস্টরা সুদানী কমিউনিস্টদের আশ্রয় দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে। দক্ষিণ সুদানের বিদ্রোহীদের উসকে দেয়া হয় যাতে সুদানের অভ্যন্তরে একটা বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় এবং কমিউনিস্টদের ওপর থেকে মুসলমানদের দৃষ্টি সরিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু সুদানের ইখওয়ানুল মুসলেমূনের সকল ইসলাম পন্থী লোকের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সুদানে কমিউনিস্টদের দমিয়ে রাখে। মিসরীয় কমিউনিস্ট এবং রুশ কমিউনিস্ট পার্টি মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমূনের ওপর এর প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাদের কাছে ইখওয়ানরা মিসরীয়, সুদানী, জর্দানী, সিরিয়, ইরাকী অথবা সৌদি যে, দেশেরই হোকনা কেন তারা একই। তাদের দাওয়াত এবংয় সংগঠনও এক।
এসব কারণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট নাসের যখন মস্কো সফরে যান তখন সেখানে তিনি এক সম্মেলনে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেন ইখওয়ান আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। অতীতে আমি তাদেরকে ক্ষমা করেছি কিন্তু এখন আর ক্ষমা করবোনা।
একদিকে তিনি মস্কোতে এ হত্যা পরিকল্পনার কথা ফাঁস করেন, অপরদিকে মিসরে গণহারে ধরপাকড় শুরু হয়। ইখওয়ানের গায়ে হাত দিয়ে প্রেসিডেন্ট নাসের কয়কটি মহলের সন্তুষ্টি কুড়িয়েছেন এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন যেমন রুশদের খুশী করেছে, মিসরের কমিউনিস্ট পাটিকে (রাশিয়া পন্থী) খুশী করেছেন। রুশদের খুশী করার মাধ্যমে বৈদেশিক সাহায্য বৃদ্ধি পায় এবং মিসরের কমিউনিস্ট পার্টিরও সে দুর্নাম ঘুচে যায় তাদের সম্পর্কে দেশে রক্ষণশীল চিন্তাধারার ব্যাপক প্রকাশনার মাধ্যমে যা বদ্ধমূল ছিল। অনুরূপ আমেরিকাকেও খুশী করা হয়েছে। কারণ আমেরিকার দৃষ্টিতে কমিউনিস্টদের দমন করার চেয়ে ইসলাম পন্থীদের দমন করা হাজার গুণ উত্তম ও অধিক কল্যাণ জনক। এতে ইহুদীদেরও সন্তুষ্টি হাসিল হয়েছে। কারণ ইখওয়ান ইরিত্রিয়া বিদ্রোহী মুসলমানদের সহায়তা করতো এবং তাদের সুদৃষ্টি হীল সেলামী শাসকদের জন্য সমস্যার কারণে পরিণত হয়। মিসরে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টির জন্য এক শক্তিশালী হাতর উদ্ভব ঘটে। তা এ কারণে যে, যদি অন্য আর কারো মাথায় শয়তান চেপে বসে তবে সে ইখওয়ানের পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং সমাজতন্ত্র ও ইয়েমেন সমস্যাকে সমালোচনার বস্তু বানাবেনা।
তথাকথিত ষড়যন্ত্র প্রকাশের পর মিসরীয় গোয়েন্দা পুলিশ যেভাবে নির্দয়ভাবে ইখওয়ান কর্মীদের গ্রেফতার করে এবং ইখওয়ানদের বাড়ী বাড়ী তল্লাশির নামে তাদের মহিলাদের সাথে যে পাশবিক আচরণ করে তা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। কিছু কিছু দৃষ্টান্ত এমনও রয়েছে যে, স্বামী ও স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মাসুম বাচ্চা একাকী ঘরে পড়ে রয়েছে। বাবা মা তাদের দুধের বাচ্চাটিকেও গ্রেফতারের জন্য জিদ করে যাতে সে ঘরের ভেতর ক্ষুধা তৃঞ্চায় না মরে জেল খানায় দিন যাপন করতে পারে। কিন্তু মিসরীয় পুলিশ তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে অপর কেউ তার দেখাশুনা করতেও প্রস্তুত হয় না, কারণ তাকে দেখাশুনার ইচ্ছে প্রকাশ করা হলে স্বয়ং নিজেকেই সন্দেহজনক দৃষ্টিতে পড়তে হবে। এ ধড় পাকড়ে মিসরের সর্বত্রই একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যেহেতু কৃষকদের মধ্যে ইখওয়ানের প্রভাব বেশী ছিল সুতরাং এ দরিদ্র জনগোষ্ঠী মিসরীয় পুলিশের প্রতিশোধের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। এমন দুটি ঘটনা ঘটে যা পরিস্থিতিকে চরম নাজুক করে তোলে, এর একটি হলো কারদাসার ঘটনা এবং অপরটি মিয়াতের।
কারদাসা সমুদ্র তীরবর্তী একটি গ্রাম। এ গ্রামে গোয়েন্দা পুলিশের কজন সদস্য ইখওয়ান কর্মীদের সন্ধানে যায় এবং এ অনুসন্ধান অভিযানে তারা এক বাড়ীতে হানা দেয়। তারা যখন জানতে পারে যে, এখানে ইখওয়ানের কেউ নেই তখন সে বাড়ীর এক মহিলাকে তারা গ্রেফতার করে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যায়। গ্রামের কৃষকরা এ খবর জানার পর কাজ কর্ম ফেলে গ্রামে ছুটে যায় এবং পুলিশ ফাড়িতে হামলা চালায়। উভয় পক্ষে লাঠি ও পাথর বিনিময় হয়। এ ঘটনায় পুলিশের একজন সদস্য নিহত হয়। এবং অবশিষ্টরা পালিয়ে যায়। কৃষকদের বিজয়ী দলটি মুর্দাবাদ শ্লোগান দিতে দিতে গ্রামে ফিরে আসে। পরে যখন জানতে পারে যে, পুলিশ সেনা সাহায্য তলব করেছে এবং কামান দ্বারা গোটা গ্রাম ঘিরে ফেলা হচ্ছে। তখন কৃষকরাও নিজেদের আশ পাশে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু সেনাবাহিনীর গোলা বারুদ নিক্ষেপে গোটা গ্রাম বিধ্বস্ত হয়ে যায়। অসংখ্য মানুষ মারা যায় এবং যারা বেঁচে ছিল তাদেরকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের বাড়িঘর লুণ্ঠিত হয়। সুইজারল্যান্ডের সংবাদপত্র এলিবারটেট ১০ ডিসেম্বর ১৯৬৫ সংখ্যায় এ সংবাদ পরিবেশন করে বর্ণনা করে যে, কারদাসা গ্রামবাসী অস্ত্রী দ্বারা আবদুন নাসেরের সেনাদের মুকাবিলা করে যারা ইখওয়ানুল মুসলেমূনের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের জন্য গ্রামের ওপর চড়াও হয়েছিল।
অপর ঘটনাটি সংঘটিত হয় মিয়াতে। যা রোম সাগরের উপকূলে কায়রো থেকে একশ ত্রিশ মাইল পূর্বে অবস্থিত। ইখওয়ানের খোঁজে পুলিশের একটি দল এ গ্রামে প্রবেশ করে। পুলিশ এখানে একজন মৎস্যজীবীর নৌকার তল্লাশী নিতে চায়।কিন্তু সে এ ভয়ে টালবাহানা করতে থাকে যে, পুলিশ তার শিকার করা সব মাছ নিয়ে নেবে। এ জেলের এ ধরনের দুঃসাহস পুলিশের ক্ষমতা ও মর্যাদার পরিপন্থী ছিল। সুতরাং পুলিশ তাকে নির্দ্বিধায় গুলি করে হত্যা করে। তার মৎসশিকারী বন্ধুরা নির্যাতনের এ নির্মম দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠে এবং আশপাশের লোকজন জেলেদের সাহায্যার্থে ছুটে আসে। মুহূর্তে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়। দরিদ্র জেলেদের অসহায়ত্বে প্রভাবিত হয়ে তারা মিয়াতের পুলিশও সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে এবং মিসর শাসকের নাম মুর্দাবাদের শ্লোগান দেয়। দোকানগুলোতে ঝুলানো সিরিয় নেতার ছবি উত্তেজিত হয়ে পদদলিতকরে। স্থানীয় প্রশাসন ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে বিক্ষোভ দমন করার জন্য সেনা সাহায্য তলব করে। অতঃপর মিসরীয় বাহিনী এসে মিয়াত ঘিরে ফেলে। এরপর যা ঘটে কল্পনাও সম্ভব নয়। কায়রোর সংবাদপত্রগুলোতে ৪ ডিসেম্বর ৬৫ সংখ্যায় একজন স্মাগলার ও পুলিরে সংঘর্ষ হিসেবে এ ঘটনার সংবাদ পরিবেশন করা হয়। কিন্তু জয়েন্ট প্রেস নিউজ অব আমেরিকার সংবাদ অনুযায়ী এ ঘটনায় গ্রামের অন্তত ষোল ব্যক্তি নিহত হয় এবং মার্শাল আবদুল হাকীম আমের অতি স্বাভাবিক ভাবে তা উপভোগ করে। ইউনাইটেড প্রেস অফ আমেরিকা বলে মৃতদের গোসল ও কাফন ছাড়াই দাফন করা হয়। এছাড়া সেনারা হাজা হাজার লোককে বন্দী কর নিয়ে যায়। রয়েটার ও এজেন্সি ফ্রান্স এ ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে।
সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী ডিসেম্বর (১৯৬৫) শেষ পর্যন্ত ইখওয়ানের চল্লিশ হাজারেরও অধিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফ ১১ অক্টোবর ৬৫ তারিখে লিখেছিলেন যে, এ পর্যন্ত বিশ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এখনো সারাদেশে ধরপাকড় অব্যাহত রয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিল আটাশর কাছাকাছি মহিলা। এছাড়াও গ্রেফতারকৃতদের পরিবারবর্গকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাসন দেয়া হয়। সুতরাং লন্ডনের একটি ইহুদী সংবাদপত্র জিউস অবজারভার আনন্দ চিত্তে ২৮ নভেম্বর ৬৫ তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায় এ সুসংবাদ শোনায় যে এ সপ্তাহের খবরে এ ব্যাপারে সত্যতা পাওয়া যায় যে, গ্রেফতারকৃত ইখওয়ানদের চার হাজার পাঁচশ পরিবারকে বহু দূরের নির্জন এলাকায় নির্বাসিত করা হয়েছে।
মিসরের সরকারী মহলের ধারনা অনুযায়ী গ্রেফতারকৃতরা দুটি দলে বিভক্ত। কিছু সংখ্যক হলো এমন যাদের ওপর মিসর রকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আরোপ করা হয় এদের সংখ্যা চারশোর কম এবং অধিকাংশরা হলো তারা যাদের ওপর কোন অভিযোগ নেই।