হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরের শাহাদাত
হযরত আবদুল্লাহর পিতা ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম, মাতা হযরত আস্মা, মাতামহ হযরত আবু বরক সিদ্দিক, খালা উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা এবং দাদী ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ফুফী হযরত সাফিয়া।
তিনি মদীনায় জন্ম গ্রহণ করেন। মাত্র সাত আট বৎসর বয়সেই তিনি রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের হাতে বায়আত করার সৌবাগ্য অর্জন করিয়াছিলেন। একুশ বৎসর বয়সে তিনি ইয়ামুকের যুদ্ধে শরীক হইয়াছিলেন। মুসলমানদের সাইপ্রাস বিজয় তাঁহারই দূরদর্শিতা ফল। জঙ্গে জামালে তিনি হযরত আয়েশা সিদ্দিকার পক্ষে প্রাণ খুলিয়া যুদ্ধ করেন। জঙ্গে সিফ্ফিনের সময় নিরপেক্ষ ছিলেন। হযরত ইমাম হাসান (রা) যখন হযরত মোয়াবিয়া অনুকূলে খেলাফরেত দাবী পরিত্যাগ করেন, তখন তিনিও বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে হযরত মোয়াবিয়ার আনুগত্য স্বীকার করিয়া নেন, কিন্তু আমীর মোয়াবিয়া (রা) যখন ইয়াযিদকে খেলাফরেত উত্তরাধিকারী বলিয়া ঘোষণা করেন, তখন তিনি ঘোর বিরোধিতা শুরু করেন। ফলে আমীর মোয়াবিয়া (রা) স্বয়ং মদীনায় আগমন করতঃ হযরত ইমাম হোসাইন, আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর, আবুদল্লাহ ইবনে ওমর (রা) প্রমুখকে ডাকাইয়া আলোচনার ব্যবস্থা করেন। আলোচনা সভায় সকলে মিলিয়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে প্রদান মুখপাত্র নির্বাচিত করেন। এই সভায় উভয় পক্ষে যে আলোচনা হইয়াছিল তাহার সারমর্ম নিম্নরূপঃ
আমীর মোয়াবিয়া (রা) বলিলেনঃ আপনারা আমার আন্তরিকতা, সমবেদনা ও ক্ষমাগুণ সম্পর্কে ভালভাবেই ওয়াকেফহাল আছেন। ইয়াযিদ আপনাদেরই ভই ও পিতৃব্য পুত্র। আপনার তাহাকে নামেমাত্র খলিফা মানিয়া নিন এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ, যথা রাজস্ব, বিচার বিভাগ প্রভৃতি পরিচালনা নিজ হস্তে গ্রহণ করুন। ইয়াযিদ কখনও আপনাদের কোন কাজে বাধার সৃষ্টি করিবে না। এই কথা শুনিয়া উপস্থি সকলেই চুপ করিয়া রহিলেন, কেহ কোন জবাব দিলেন না।
আমীর মোয়াবিয়অ (রা) বলিলেন, “ইবনে যুবাইর, আপনি সকলের মুখপাত্র, আপনি উত্তর দিন।”
হযরত ইবনে যুবাইর (রা) জবাব দিলেন, আপনি রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অথবা আবু বকর ও হযরত ওমরের পথ অবলম্বন করুন; আমরা সকলে মিলিয়া তৎক্ষনাৎ আনুগত্যে মাথা নত করিয়া দিব।
আমীর মোয়াবিয়া (রা) জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহাদের নীতি কি ছিল?
ইবনে যুবাইর (রা) বলিলেন, আল্লাহর রসূল কাহাকেও স্বীয় খলিফঅ নিযুক্ত করেন নাই। মুসলিম সাধারণ তাঁহার পর হযরত আবু বকরকে খলিফা নির্বাচিত করিয়াছিলেন।
আমীর মোয়াবিয়া (রা) উত্তর দিলেন, “আজ আমাদের মধ্যে হযত আবু বকরের ন্যায় ব্যক্তিত্ব কোথায়? আমি যদি তাঁহাদের পথ অবলম্বন করিতে যাই তবে মতবিরোধ আরও বর্ধিত হইয়া যাইবে।”
ইবনে যুবাইর (রা) বলিলেন, তবে অন্ততঃ হযরত আবু বকর অথবা হযরত ওমরের নীতি অনুসরণ করুন।
আমীর মোয়াবিয়া (রা) বলিলেন, তাঁহাদের নীতি বলিতে আপনি কি বুঝাইতে চান?
ইবনে যুবাইর (রা) বলিলেন, হযরত আবু বকর (রা) তাঁহার কোন আত্মীয়কে খলিফা নির্বাচিত করেন নাই। তৎপর হযরত ওমর ফারুক (রা) এমন ছয় ব্যক্তিকে খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করেন যাঁহারা তাঁহার কোন আত্মীয় হইতেন না। আমীর মোয়াবিয়া বলিলেন, ইহা ছাড়া আপনারা অন্য কোন প্রস্তাব মঞ্জুর করিতে প্রস্তুত আছেন কি?
হযরত ইবনে যুবাইর (রা) বলিলেন, ‘কখনই নয়।’
এরপর আমীর মোয়াবিয়া (রা) কঠোরতর নীতি অবলম্বন করিলেন। তিনি তাঁহাদের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করিয়া বলপূর্বক মদীনাবাসীদের নিকট হইতে ইয়াযিদের পক্ষে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি ইয়যিদকে অন্তিম উপদেশ দিয়া যান, “যে ব্যক্তি শৃগাল-সুলভ বুদ্ধিমত্তা লইয়া ব্যাঘ্রের ন্যায় আক্রমণ করিতে উদ্যত ইবেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর। যদি তিনি আপোসে মানিয়া নেন, তবে ভাল। অন্যথায় কাবু পাওয়ার পরই তাঁহাকে খতম করিয়া ফেলিও।”
আমীরে মোয়াবিয়ার ইন্তেকালের পর হযরত ইমাম হোসাইন যখন শহীদ হইয়া গেলেন, তখন হযরত ইবনে যুবাইর (রা) তেহামা, হেজায ও মদীনার লোকদের নিকট হইতে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতঃ পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করিলেন এবং ইয়াযিদের কর্মচারীদিগকে এই সমস্ত এলাকা হইতে বাহির করিয়া দিলেন। ইয়াযিদ মুসলিম ইবনে ওকবাকে বিরাট সৈন্যবাহিনী সহ তাঁহার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। মুসলিম সর্বপ্রথম মদীনা জয় করিয়া লণ্ঠন করে। তৎপর আবু কুবাইস পর্বতে শিবির স্থাপন করতঃ কাবাব মসজিদে প্রস্তর ও অগ্নি বর্ষণ শুরু করে। বিরাট শত্রুবাহিনী চারিদিক হইতে মক্কা শহর ঘিরিয়া ফেলে। ঠিক সেই সময় ইয়াযিদের ইন্তেকাল হইয়া যায় এবং তৎপুত্র মোয়াবিয়া স্বয়ং রাজত্বের দাবী পরিত্যাগ করেন। ফলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা) স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র মুসলিম জাহানের খলিফা হইয়া গেলেন।
আমীর মোয়াবিয়া (রা) যেদিন ইয়াযিদকে বলপূর্বক মুসলিম দুনিয়ার খলিফা নিযুক্ত করেন, সেই দিন হইতেই ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়াছিল। এই ঘটনার পর স্বাভাবিকভাবে আবার ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হইল। আমীর মোয়াবিয়ার ইজতেহাদী ভুলের জন্য ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা পুনঃপবর্তনের এই উজ্জ্বল সম্ভাবনার সূচনা মুহূর্তে হযরত ইবনে যুবাইরের দ্বারা এমন কয়েকটি ভুল সংঘটিত হইল যে, দেখিতে দেখিতে এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা আবার চিরতরে বিনষ্ট হইয়া যায়। এই ভুলগুলি সমালোচকদের দৃষ্টি সাধারণতঃ নিম্নরূপঃ
১. সিরিয়া দেশীয় সেনাপতি হোসাইন ইবনে নোমায়র তাঁহার নিকট প্রস্তাব করিয়াছিলেন, আমি এক সম্মিলিত বাহিনীসহ সিরিয়ায় গমন করি, সেইখানকার জনসাধারণ আপনার প্রতি খেলাফরেত আনুগত্য প্রদর্শন করার খুবই সম্ভাবনা রহিয়াছে। এই ব্যাপারে আমি যথাসধ্য চেষ্টা করিয়া দেখিব, কিন্তু হযরত ইবনে যুবাইর (রা) তাঁহাকে বলিলেন, “ইয়া তখনই হইতে পারে যখন আমি এক একজন হেজাযবাসীর রক্তের প্রতিশোধস্বরূপ অন্ততঃ দশ জনি সিরীয়কে হত্যা করিয়া লইব।” এই কথা শুনিয়া হোসাইন ইবনে নোমায়র নিরাশ হইয়া স্বীয় সৈন্যবাহিনীসহ সিরিয়ায় ফিরিয়া গেলেন।
২. মারওয়ান এবং অন্যান্য উমাইয়া বংশীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ মদীনায় ইবনে যুবাইরের হাতে আনুগত্যেল শপথ গ্রহণ করিতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু ইবনে যুবাইর (রা) মদীনায় পদার্পণ করিয়া ই তাহাদিগকে বাহির করিয়া দিলেন। এইভাবে তাহাদের পক্ষে সিরিয়ায় পৌঁছিয়া বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ মিলিল। শেষ পর্যন্ত এই সমস্ত লোক সিরিয়ায় চলিয়া গেলেন এবং তথায় মারওয়ানকে খলিফা নিযুক্ত করিয়া ইবনে যুবাইরের এলাকায় আক্রমণ করিতে শুরু করিলেন। তাহারা দামেশক, মিসর, ফিলিস্তিন, হেমস্ প্রভৃতি স্থান হইতে ইবনে যুবাইরের আঞ্চলিক শাসকর্তাগণকে বিতারিড় করিয়া দিলেন।
৩. বনী সাকীফের মোখতার সাকাফী নামক এক ক্ষমতালোভী ব্যক্তি হযরত হোসাইন হ্যার আওয়াজ উত্থাপন করিল। ইবনে যুবাইর (রা) সহজেই এই দলকে বনী উমাইয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি তাহা না করিয়া বরং মোহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া, ইবনে আব্বাস (রা) প্রমুখ কতিপয় আহ্লে বায়তের প্রভাবশালী ব্যক্তিকে কারারুদ্ধ অথবা দেশান্তরিত করিয়া দেন। ফলে মোখতার সাকাফীর পক্ষে শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ হইল। তিনি কুফা হইতে ইবনে যুবাইরের নিযুক্ত শাসনকর্তাকে বিতাড়িত করিয়া কুফা ও সমগ্র ইরাকে ক্ষমতা বিস্তার করিয়া ফেলিলেন। শেষ পর্যন্ত এই ফেৎনা বহু রক্তপাত ও দীর্ঘ সময়ের প্রচেষ্টার পর বিদূরিত হয়, কিন্তু এই সুযোগেই মারওয়ানের স্থলাভিষিক্ত আবদুল মালেক সিরিয়া প্রদেশ ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় বিশেষ শক্তি সঞ্চয় করিতে সমর্থ হন। ইবনে যুবাইর (রা) কর্তৃক সিরিয়া আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই ইহারা কুফা আক্রমণ করিয়া সমগ্র ইরাক প্রদেশ দখল করিয়া ফেলেন। এতদিনে আবদুল মালেক ইবনে যুবাইরের সহিত শেষ বোঝাপড়া করার মত শক্তি সঞ্চয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন। এই উদ্দেশে তিনি একদা এক বিরাট জনসভা আহ্বান করতঃ উত্তেজনাময় এক বক্তৃতা দান করিলেন এবং উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, তোমাদের মধ্যে কে ইবনে যুবাইরকে হত্যার দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারে?
জনতার মধ্য হইতে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ উঠিয়া বলিলেন, এই জন্য আমি প্রস্তুত আছি।
আবদুল মালেক পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, এমন কোন বীরপুরুষ আছে কি যে ইবনে যুবাইরকে খতম করার দায়িত্ব নিতে পারে?
হাজ্জাজ পুনরায় বলিলেন, আমি এই দায়িত্ব বহন করিতে প্রস্তুত আছি। আবদুল মালেক পুনরায় বলিলেন, এমন কে আছে, যে ইবনে যুবাইরের মস্তক কাটিয়া আনিবে? এইবারও হাজ্জাজ দাঁড়াইয়া বলিলেন, “এই দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করুন।”
শেষ পর্যন্ত এই দায়িত্ব হাজ্জাজের উপরই অর্পণ করা হইল। হিজরী ৭২ সনে তিনি বিরাট এক সৈন্যবাহিনীসহ মক্কা আক্রমণ করিলেন। হযরত ইবনে যুবাইর (রা) পবিত্র কাবার প্রাঙ্গণে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। হাজ্জাজ চারিদিক হইতে কাবা অবরোধ করিয়অ প্রবল বেগে প্রস্তর ও গোলাগুলি বর্ষণ করিতে শুরু করিলেন। উদ্ধত সিরীয় সৈন্যগণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত প্রস্তররাশি পবিত্র কাবার দেওয়ালে লাগিয়া দেওয়াল ফাটিয়া পড়িতে লাগিল; ইবনে যুবাইর নিতান্ত প্রশান্ত মনেই এই প্রস্তর ও অগ্নি বৃষ্টি প্রতিরোধ করিতে লাগিলেন। এইভাবে দেখিতে দেখিতে কয়েক মাস অতিবাহিত হইয়া গেল। হযরত ইবনে যুবাইর (রা) প্রতি নামাযের সময় শান্ত মনে নামাযে দাঁড়াইয়া যাইতেন, চারিদিকে নিক্ষিপ্ত প্রস্তররাশি বর্ষণ ও অগ্নি প্রজ্বালন তিনি ধুলা-বালির চাইতে অধিক গুরুত্ব দিতেন না, কিন্তু এইভাবে অবরুদ্ধ থাকিয়া শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের অশ্বসমীহ জবেহ করিয়া কাইতে শুরু করিলেন। নগরের অভন্তরে এমন নিদারুণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল যে, প্রায় প্রতি ঘর হইতেই ক্ষুধাতুর জনতার ক্রন্দনের রোল উঠিল। হযরত ইবনে যুবাইরের সৈন্যগণ অনশন কাতর হইয়া ধীরে ধীরে পলায়ন করতঃ হাজ্জাজের সৈন্যবাহিনীতে যাইয়া শরীক হইতে শুরু করিল।
অল্পদিনের মধ্যেই প্রায় এক হাজার সৈন্য যাইয়া শত্রু সৈন্যের সহিত মিলিত হইল। স্বয়ং ইবনে যুবাইরের দুই পুত্র হামযা ও হাবীব পর্যন্ত হাজ্জাজের সৈন্যবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করিল। তৃতীয় পুত্র বীরত্বের সহিত লড়াই করিয়া শাহাদাত বরণ করিলেন।
ইবনে যুবাইর (রা) তখন স্বীয় জননী হযরত আসমার বয়স হইয়াছিল একশত বৎসরেরও অধিক। তাঁহার শরীরের কুঞ্চিত চামড়ায় যে পরিমাণ ভাঁজ পড়িয়াছিল, অন্তরেও বোধহয় সমপরিমাণেই আঘাত সঞ্চিত হইয়া রহিয়াছিল। ইবনে যুবাইর (রা) মাতাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আম্মা, আমার সঙ্গী-সাথী এমনকিট নিজ সন্তানগণও দল ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। এখন পর্যন্ত মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন নিষ্ঠাবান ব্যক্তি আমার সঙ্গে টিকিয়া আছেন। অন্যদিকে শত্রুরা আামার কোন দাবীই মানিতেছে না। এই অবস্থায় আপনার পরামর্শ কি?”
হযরত আসমা (লা) বলিলেন, বৎস, তুমি যদি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া থাক তবে সত্য প্রতিষ্ঠা করিতে যাইয়া তোমার অন্যান্য সঙ্গী-সাথীগণ যেভাবে প্রাণ দিয়াছেন সেইভাবে প্রাণ দিয়া দাও। আর যদি তুমি সত্যের উর প্রতিষ্ঠিত না থাকিয়া থাক, তবে তোমার ভাবা উচিত ছিল, নিজের এবং অন্যান্য সঙ্গী-সাথীদের জীবনপাত করার জন্য তুমি দায়ী হইতেছ।
ইবনে যুবাইর (রা) বলিলেন, এখন আমার সকল সঙ্গীই আমাকে শেষ জবাব দিয়া চলিয়া গিয়াছেন।
হযরত আসমা (রা) বলিলেন, সঙ্গী-সাথীদের অসহযোগিতা ধর্মভীরু ভদ্র মানুষের নিকট গুরুত্ব রাখে না। ভাবিয়া দেখ, দুনিয়ায় তুমি কতদিন থাকিতে পারিবে? সত্যের জন্য জীবন দিয়া দেওয়া সত্য উপেক্ষা করিয়া জীবিত থাকার চাইতে বহু গুণে শ্রেয়।
ইবনে যুবাইর (রা) জবাব দিলেন, আমার ভয় হয়, বনী উমাইয়ার নিষ্ঠুর লোকগুলি হত্যা করার পর আমার মৃতগেহ শূলে বিদ্ধ অথবা অন্যান্য উপায়ে লাঞ্ছিত করিতে পারে।
হযরত আসমা (রা) বলিলেন, “বৎস, ছাগল জবেহ করার পর তাহার চামড়া উঠাইবার সময় আর তাহার কোন প্রকার কষ্ট হয় না। যুদ্ধের ময়দানে গমন কর এবং খোদার সাহায্য চাহিয়া স্বীয় কর্তব্য করিতে থাক।”
হযরত ইবনে যুবাইর (রা) আনন্দাতিশয্যে মাতার মস্তক চুম্বন করিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, “মা! আল্লাহর পথে কখনও দুর্বল প্রতিপন্ন হইব না! আমার উদ্দেশ্য কেবল আপনাকে এতটুকু নিশ্চয়তা দেওয়া, আপনার পুত্র কোন অসৎ পথে জীবন দান করে নাই।”
হযরত আসমা (রা) বলিতে লাগিলেন, বৎস, সর্বাবস্থায়ই আমি ধৈর্য ও খোদার শুকরিয়া আদায় করিতে থাকিব। যদি জয়ী হইয়া ফিরিতে পার, তবে আমি তোমার বিজয় দেখিয়া খুশী হইব। আর যদি আমার নিকট হইতে চির বিদায় গ্রহণ কর, তথাপি আমি ধৈর্য ধারণ করিব। যাও, আত্মোৎসর্গ কর! ফল খোদার হাতে।
ইবনে যুবাইর (লা) বলিলেন, মা, আমার জন্য দোয়া করুন।
হযরত আসমা (রা) হাত উঠাইয়া দোয়া করিলেন, “হে খোদা, আমি আমার পুত্রকে তোমার হাতে সমর্পণ করিতেছি। তাহাকে তুমি দৃঢ়তা এবং ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দান কর।”
দোয়া করার পর বৃদ্ধা মাতা তাঁহার কম্পিত দুই বাহু প্রসারিত করিয়া বলিতে লাগিলেন, বৎস! একবার আমার কোলে আস, শেষবারের মত আমি তোমাকে ধারণ করি।
ইবনে যুবাইর (রা) বলিতে লাগিলেন, আজকের সাক্ষাতই আমাদের শেষ সাক্ষাত। অদ্যই আমার জীবন সমাপ্ত হইতেছে। অতঃপর তিনি অবনত মস্তকে মায়ের বুকে আশ্রয় নিলেন। স্নেহময়ী মাতা এই সাহসী বীর পুত্রকে কোলে তুলিয়া লিইলেন এবং চুম্বন করিয়া বলিতৈ লাগিলেন, বৎস, নিজের কর্তব্য পালন কর। এই সময় ইবনে যুবাইর (রা) বর্ম পরিধান করিয়া রাখিয়াছিলেন। বৃদ্ধা মাতা সর্বশরীরে লোহার পোশাক দেখিতে পাইয়া একটু বিমর্ষভাবে বলিলেন, বৎস, আল্লাহর পথে প্রাণ উৎসর্গকারীদের এইরূপ লোহার পোশাক লওয়া উচিত নহে।
এই কথা শুনিয়া হযরত ইবনে যুবাইর (রা) লোহ-বর্ম শরীর হইতে খুলিয়া ফেলিলেন এবং স্বাভাবিক বেশে বীরত্ব গাঁথা গাহিতে গাহিতে সিরীয় সৈন্যদের দিকে চলিয়া গেলেন। শত্রু বাহিনীকে তিনি এমন ভীষণ বিক্রমে আক্রমণ করিলেন যে, ক্ষণিকের জন্য ময়দান কম্পিত হইয়া উঠিল, কিন্তু সিরীয় সৈন্য ছিল গণনাতীত, ইহার সম্মুখে তাঁহার মুষ্টিমেয় বাহিনী বেশীক্ষণ টিকিতে পারিল না। বাধ্য হইয়অ পিছু হটিয়া আসিতে হইল। এই সময় এক ব্যক্তি চিৎকার করিয়া বলিতে লাগিলেন, ইবনে যুবাইর (রা) পিছু হটিয়অ রক্ষিত স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করুন, কিন্তু তিনি আহ্বানকারীর প্রতি উপেক্ষার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতঃ এই বলিয়া সামনে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, ইবনে যুবাইর এত ভীরু কাপুরুষ নয় যে, বীর সঙ্গীদের মৃত্যু দেখিয়া ভয় পাইবে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন সঙ্গী লইয়া তিনি সিংহবিক্রমে ময়দানে ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিলেন এবং সিরীয় সৈন্যবাহিনীর উপর আক্রমণ চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। যেদিকে তিনি অগ্রসর হইতেছিলেন, শত্রুব্যূহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া যাইতেছিল, কিন্তু তাঁহার শরীল ছিল উন্মুক্ত ও অরক্ষিত। এই জন্য উল্কার বেগে তিনি যখন শত্রুর সৈন্যকে ধাওয়া করিতেছিলেন, তখন শত্রুপক্ষের আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত দেহ হইতে রক্ত ছিটিয়া পড়িতেছিল। এইসময় হাজ্জাজ গোটা সৈন্যবাহিনী একত্রে পরিচালিত করিলেন। তাহার বিশিষ্ট বাহাদুরদিগকে একত্রিত করতঃ তীব্র আক্রমণ চালাইয়া কাবা মসজিদের দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছিয়া গেলেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত ময়দানের প্রাধান্য হযরত ইবনে যুবাইরের বাহিনীরই আয়ত্তে ছিল। এই মুষ্টিমেয় বাহাদুর বাহিনী নারায়ে তকবীর উচ্চারণ করতঃ তরবারিরর বিজলী খেলিতে খেলিতে যেদিকে অগ্রসর হইতেন, সিরীয় সৈন্যদের কাতারের পর কাতার বিধ্বস্ত হইয়া যাইত।
এই অবস্থা দেখিয়া হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ঘোড়া হইতে লাফাইয়া পড়িলেন এবং স্বীয় পতাকাবাহীকে অগ্রসর করাইয়া সঙ্গীদিগকে উৎসাহ দিতে লাগিলেন। হযরত ইবনে বাজপক্ষীর ন্যায় ঝাঁপাইয়া পড়িয়া শত্রু বাহিনীর ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি রুদ্ধ করিয়া দিলেন। ঠিক এই সময় কাবর মিনার হইতে আজানের আওয়াজ আসিল। আল্লাহু আকবর ধ্বনি কর্ণে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহর এই বান্দা তরবারি কোষবদ্ধ করিয়া মসজিতে চলিয়া গেলেন। শত্রু বাহিনীর সম্মুখে তাঁহার সামান্য কয়েকজন সৈন্য আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
নামায হইতে ফিরিয়া দেখিতে পাইলেন, তাঁহার মুষ্টিমেয় বাহিনী সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হইয়া গিয়াছে। তাঁহার পতাকা ভূলুণ্ঠিত এবং পতাকাবাহী নিহত হইয়া গিয়াছেন। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখিয়াও তাঁহার অন্তর কাঁপিল না। একাকীই তিনি অগণিত শত্রু সৈন্যদের মধ্যে প্রবেশ করতঃ বিদ্যুৎগতিতে তরবারি চালনা শুরু করিলেন। এমন সময় সম্মুখ দিক হইতে একটি তীর আসিয়অ তাঁহার মস্তক ভেদ করিয়া গেল। শিরস্ত্রাণ, মুখমণ্ডল ও দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হইয়া উঠিল। এই সময় তিনি এই কবিতা আবৃত্তি করিতেছিলেন-
“আমরা এমন নই যে, পৃষ্ঠ প্রদর্শন করার পর আমাদের পাতদেশে রক্ত ঝরিবে। আমরা বক্ষ প্রশস্ত করিয়া দণ্ডায়মন হই, আর আমাদের বাহুতে রক্তের ফোয়ার ছুটে।”
ইবনে যুবাইর (রা) এই বরত্বগাঁথা গাহিতে তরবারি চালাইয়া যাইতেছিলেন। দীর্ঘক্ষণ তরবারি চালাইয়া এই অবস্থায়ই তিনি মাটিতে লুটাইয়া পড়িলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার পবিত্র রূড দুনিয়ার বাধন ছাড়িয়া চিরদিনের মত বিদায় হইয়া গেল।
হাজ্জাজ প্রতিশ্রুতি মত তাঁহার মস্তক কর্তন করিয়া আবদুল মালেকের নিকট পাঠাইয়া দিলেন এবং দেহ শহরের বাহিরে উচ্চস্থানে ঝুলাইয়া দিলেন।
এই হৃদয়বিদারক খবর হযরত আসমার কানে গেল! তিনি হাজ্জাজকে বলিয়া পাঠাইলেন যেন ইবনে যুবাইরের পবিত্র দেহ শূলি হইতে সরাইয়া দেওয়া হয়। হাজ্জাজ উত্তর দিলেন, কিছুতেই নয়; আমি এই দৃশ্য স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিতে চাই। হযরত আসামা (রা) পুনরায় পবিত্র লাশের দাফন-কাফনের অনুমতি চাহিলেন, কিন্তু হাজ্জাজ এই আবেদনেও কর্ণপাত করিলেন না।
কোরায়শগণ এই পথে চলিতেন এবং তাঁহাদের এই বীর সন্তানের শূলবিদ্ধ লাশ দেখিয়া নীরবে ফিরিয়া যাইতেন। একদিন ঘটনাক্রমে হযরত আসমা (রা) এই পথে যাইতে যাইতে পুত্রের লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় পাইলেন। স্নেহমীয় মাতা দীর্ঘক্ষণ লাশের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিতে লাগিলেন, “এখনও কি এই বীর যোদ্ধার অশ্ব হইতে অবতরণ করার সময় আসে নাই?”
আল্লামা শিবলী নোমানী হযরত আসামার এই বীরত্বব্যঞ্জক উক্তি নিম্নলিখিতভাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছেনঃ লাশ শূলির উপর দীর্ঘ কয়েকদিন ঝুলিয়া রহিল। তাঁহার মাতা এতে কোন দুঃখ করিলেন না। ঘটনাক্রমে একদিন ঐদিক দিয়া যাইতেছিলেন, লাশ ঝুলন্ত দেখিয়া বলিলেন. “দীর্ঘক্ষণ যাবতই জাতির এই খতিব মিম্বরে আরোহণ করিয়াছেন, নামেন নাই। এই বীর এখনও যোদ্ধাবেশ ত্যাগ করেন না।”