হযরত মোয়াবিয়ার জীবন-সন্ধ্যা
আমির মোয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের ব্যক্তিত্ব বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। আরব চরিত্রের দৃঢ়তা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার পূর্ণ সমবেশ ঘটিয়াছিল তাঁহার মস্তিষ্কে। আরবের ইতিহস তাঁহার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রশংসা কীর্তনে মুখর হইয়া রহিয়াছে। প্রায় সমগ্র জীবনই তাঁহার নেতৃত্ব রাজত্বের ভিতর দিয়া অতিবাহিত হইয়াছে। আর সর্বদাই তাঁহার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সাফল্য লাভ করিতে দেখা গিয়াছে। সমসাময়িক যুগে তিনি একজন কামিয়াব রাজনৈতিক নেতার আসন লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
একটি আশ্চার্য প্রচেষ্টা
আমির মোয়াবিয়া যখন মারাত্মকভাবে অসুস্থ হইয়া পড়িলেন, চারিদিক যখন ব্যাপকভাবে তাঁহার জীবন সম্পর্কে নৈরাশ্যের কথা প্রচারিত হইয়া গেল, তখন তিনি রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করিতে লাগিলেন। পুত্র ইয়াযিদকে তিনি তরবারির বলে মসনদের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ইয়াযিদ তখন রাজধানী হইতে দূরে অবস্থান করিতেছিলেন। এমতবস্থায় চারিদিকে বিদ্রোহ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা ছিল।
এই পরিস্থিতিতে আমির মোয়াবিয়া (রা) পরিচর্যাকরীগণকে নির্দেশ দিলেন : “আমার চোখে ভালভাবে সুরমা লাগাও, মাথায় উত্তমরূপে তেল দাও।” তত্ক্ষণাৎ নির্দেশ পালন করা হইল। সুরমা তেল ব্যবহারের দরুন চেহারার ঔজ্জ্বল্য দেখা দিল। তত্পর নির্দেশ দিলেন, “আমার বিছানা নিচু করিয়া পৃষ্ঠদেশে তাকিয়া লাগাও এবং আমাকে তুলিয়া বসাইয়া দাও। তত্পর লোকদিগকে আসার অনুমতি দাও। সকলেই যেন দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সালাম করিয়া চলিয়া যায়, কেহ যেন এখানে না বসে।”
নির্দেশমত শহরবাসীগণ দলে দলে তাঁহাকে দেখিতে আসিল। সকলেই সালাম করিয়া ফিরিয়া যাইতে লাগিল; যাওয়ার পথে পরস্পরে বলাবলি করিতে লাগিল, কে বলে আমির মোয়াবিয়া মৃত্যুমুখে চলিয়াছেন? তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ বলিয়াই তো মনে হইল। সব লোক চলিয়া গেলে পর আমির মোয়াবিয়া নিম্নের অর্থ সম্বলিত কবিতা আবৃত্তি করিলেন :
“তিরস্কারকারী শত্রুভাবাপন্নদের সম্মুখে আমার দুর্বলতা প্রকাশ করিতে পারি না। আমি সব সময় তাহাদেরকে দেখাইতে চাই যে, বিপদ আমাকে কাবু করিতে পারে না।” (তাবারী)
নশ্বর দুনিয়া সম্পর্কে
রোগশয্যায় কোরায়শদের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁহাকে দেখিতে আসিলেন। আমীর মোয়াবিয়া তাঁহাদের সম্মুখে এইভাবে দুনিয়ার নশ্বরত্ব ব্যাখ্যা করিলেন, “দুনিয়া, আহ দুনিয়া! ইহা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি উহাকে ভালভাবেই দেখিয়াছি, গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়াছি। আল্লাহর শপথ, যৌবনে আমি দুনিয়ার মউজের দিকে ধাবিত হই এবং তাহার সকল স্বাদই নিঃশেষে গ্রহণ করি, কিন্তু আমি দেখিলাম, দুনিয়া অল্পদিনের মধ্যেই ডিগবাজি খাইয়া তাহার রূপ পরিবর্তন করিয়া ফেলিয়াছে। এক এক করিয়া সকল বাধাই শিথিল করিয়া দিয়াছে। তত্পর কি হইল? দুনিয়া আমার সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে, আমার যৌবন ছিনাইয়া নিয়াছে, আমাকে বৃদ্ধে পরিণত করিয়াছে। হায়! এই দুনিয়া কত জঘন্য স্থান।”-(এহইয়াউল উলুম)
রোগশয্যায় শায়িত হওয়ার পর আমীর মোয়াবিয়া (রা) সর্বশেষ খুতবা প্রদান করেন : “লোকসকল, আমি এই দুনিয়ার ক্ষেত্রের শস্যবিশেষ। আমার পর যত শাসনকর্তা আগমন করিবেন, সকলেই আমার চাইতে খারাপ হইবেন, যেইরূপ আমার পূর্ববর্তীগণ সকলেই আমার চাইতে উত্তম ছিলেন।” –(এহইয়াউর উলুম)
আক্ষেপ
সময় যখন শেষ হইয়া আসিল, তখন বলিতে লাগিলেন, আমাকে বসাইয়া দাও। তাঁহাকে বসাইয়া দেওয়া হইল। তত্পর দীর্ঘক্ষণ যাবৎ যিকরে নিমগ্ন রহিলেন। সর্বশেষ ক্রন্দন করিতে করিতে বলিলেন, মোয়াবিয়া, এতদিন খোদাকে স্মরণ করিতেছ, যখন বার্ধক্য তোমাকে কোন কর্মেরই আর যোগ্য রাখে নাই, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল স্থবির হইয়া আসিয়াছে। ঐ সময় কেন স্মরণ কর নাই, যখন যৌবনের ডাল তাজা ও সবুজ ছিল।
তত্পর চিত্কার করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন এবং দোয়া করিলেন, “হে প্রভু, কঠিন-হৃদয়, পাপী এই বৃদ্ধের উপর দয়া কর। ইলাহী, উহার স্খলনসমূহে ক্ষমা করিয়া দাও। উহার গোনাহ মাফ কর। তোমার সীমাহীন ধৈর্য ও ক্ষমার আশ্রয়ে উহাকে স্থান দাও। যে তোমাকে ব্যতীত আর কাহারও নিকট কিছু প্রত্যাশা করে নাই, তোমাকে ছাড়া আর কাহারও কোন ভরসা রাখে না।” –(এহইয়াউল উলুম)
রোগশয্যায় স্বীয় দুই কন্যা তাঁহার পরিচর্যা করিতেছিলেন। একদিন ইহাদের সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “তোমরা একটি পাপীকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাইতেছ। সে দুনিয়ায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ দুই হাতে একত্রিত করিয়াছিল, কিন্তু আক্ষেপ, শেষ পর্যন্ত উহা দোযখে নিক্ষিপ্ত না হয়। তত্পর এই কবিতাটি আবৃত্তি করিতে লাগিলেন : “আমি তোমাদের জন্য কঠোর পরিশ্রম করিয়াছি এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের দ্বারে লাঞ্ছিত হওয়ার মত অবস্থা হইতে চিরতরে বাঁচাইয়া দিয়াছি।”-(তাবারী)
স্বীয় মহত্ত্বের উল্লেখ
মৃত্যুর পূর্বক্ষণে তিনি আসহাব ইবনে রাবীলার বিখ্যাত কবিতাটি আবৃত্তি করেন। যাহার মর্ম হইল- “তোমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মহত্ত্ব এবং দানশীলতাও মরিয়া যাইবে। দানপ্রার্থীদের হাত ফিরাইয়া দেওয়া হইবে এবং দ্বীন-দুনিয়ার নৈরাশ্য বরাদ্দ হইবে।”
এই কবিতা শুনিয়া তাঁহার কন্যাগণ চিত্কার করিয়া উঠিলেন। বলিতে লাগিলেন, কখনই নয়, আমীরুল মোমেনীন! খোদা আপনার মঙ্গল করুন, কখনও এইরূপ হইবে না। আমীর মোয়াবিয়া কোন উত্তর দিলেন না, কেবল একটি কবিতা আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। তাহার আবৃত্তিকৃত কবিতার অর্থ হইল- “মৃত্যু যখন নখ বিঁধাইয়া দেয়, তখন কোন প্রকার তাবিজই আর কাজে আসে না।”
অন্তিম উপদেশ
এই ঘটনার পর আমীর মোয়াবিয়া সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণ পর একটু হুশ হইলে স্বীয় পরিবার-পরিজনের লোকদিগকে দেখিয়া বলিতে লাগিলেনম, “আল্লাহকে সর্বদা ভয় করিও। কেননা যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন। ঐ ব্যক্তির জন্য কোন প্রকার আশ্রয় নাই, যে আল্লাহর প্রতি ভীতি পোষণ করে না।”- (তাবারী)
অবস্থা শোচনীয় আকার ধারণ করিলে কাসেদ প্রেরণ করত ইয়াযিদকে ডাকিয়া পাঠানো হইল। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি যাত্রা করিলেন, কিন্তু আসিয়া পৌছিতে পৌছিতে আমীরের অবস্থা আরও শোচনীয় হইয়া গেল। ইয়াযিদ আসিয়াই পিতাকে ডাকিলেন, কিন্তু তিনি আর কথা বলিতে পারিতেছিলেন না। এই অবস্থা দেখিয়া ইয়াযিদ ক্রন্দন করিতে শুরু করিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে কবিতা আবৃত্তি করিতে লাগিলেন, “যদি দুনিয়ার কোন মানুষ সর্বদা জীবিত থাকিত, তবে নিঃসন্দেহে তাহাদের আমীর জীবিত থাকিতেন। কেননা, তিনি কোন অবস্থায়ই শক্তিহীন ও তুচ্ছ ছিলেন না।”
“তিনি ছিলেন বিশেষ বিজ্ঞ ও তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী, কিন্তু মৃত্যুর সময় কোন বুদ্ধি আর কাজে আসিল না।”
এই কথা শুনিয়া আমীর মোয়াবিয়া চক্ষু খুলিলেন এবং ইয়াযিদকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিলেন : “বত্স! যে বিষয় আমি খোদার দরবারে বিশেষ ভয় পোষণ করিতেছি, তাহা হইতেছে, তোমার জন্য আমার ব্যবস্থা। প্রিয় বত্স, একদা আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সহিত কোন ভ্রমণে বাহির হইয়াছিলাম। অজু করার সময় আমি তাহাকে পানি ঢালিয়া দিয়াছিলাম। আমার পরিধানের জামা ছিঁড়া ছিল। বলিলেন, মোয়াবিয়া, তোমার কি একটা ভাল জামা দিব? আমি নিবেদন করিলাম, নিশ্চয়: দিন হুজুর। তিনি আমাকে নিজের একটি জামা দান করিলেন, কিন্তু আমি উহা একদিনের বেশী পরিধান করি নাই। সযত্নে রাখিয়া দিয়াছিলাম। এখনও উহা আমার নিকট রক্ষিত আছে। আর একদিন আল্লাহর রাসূল ক্ষৌর করাইলেন। আমি তাঁহার কিছু পবিত্র চুল ও নখ আনিয়া সযত্নে রাখিয়া দিয়াছিলাম। আজ পর্যন্তও তাহা একটি শিশির মধ্যে আমার নিকট রক্ষিত আছে। দেখ, মৃত্যুর পর গোসল ও কাফন দেওয়া সমাপ্ত হইলে ঐ চুল ও নখ আমার চোখের উপর এবং মুখমণ্ডলে ছড়াইয়া দিও। তত্পর আল্লাহর রাসূলের সেই জামাটি বিছাইয়া উহার উপর আমাকে কাফন দিও। আমার বিশ্বাস, কোন বস্তু যদি আমাকে সামান্য উপকার করে, তবে এই জিনিসগুলিই করিবে।” –(ইস্তিয়াব, ইকদুল ফরীদ)
মৃত্যু যন্ত্রণা
মৃত্যু যন্ত্রনা শুরু হওয়ার পরও এই কবিতাটি আবৃত্তি করিতেছিলেন, “আমি যদি মরিয়া যাই, তবে কি কেহ চিরকাল জীবিত থাকিবে? মৃত্যু কি কোন পাপ?“-(ইস্তিয়াব)
ঠিক মৃত্যুর সময় তিনি এই কবিতা আবৃত্তি করিতেছিলেন : “আফসোস! যদি আমি রাজ্যপতি না হইতাম। আক্ষেপ! যদি আমি দুনিয়ার স্বাদ গ্রহণ করিতে যাইয়া অন্ধ না হইতাম।
আক্ষেপ! আমি যদি সেই ভিখারীর ন্যায় হইতাম, যে সামান্যতে জীবন যাপন করে।” –(ইকদুল ফরীদ)
এই কথা বলিতে বলিতে মুসলিম জাহানের এই প্রতিভাবান ব্যক্তি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ইয়াযিদের মর্সিয়া
আমীর মোয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াযিদ এই মর্সিয়া রচনা করিয়াছিলেন : “কাসেদ যখন পত্র লইয়া ছুটিয়া আসিল, তখন আমার অন্তর কাপিয়া উঠিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, তোর সর্বনাশ হউক। পত্রে কি লিখা রহিয়াছে? কাসেদ বলিল, খলিফা ভীষণ অসুস্থ। ভীষণ কষ্ট পাইতেছেন।’ তখন ভূমি যেন আমাকে লইয়া ধসিয়া যাইতে শুরু করিল, যেন উহার কোন স্তম্ভ ভঙ্গিয়া পড়িয়াছে। হেন্দা তনয় (মোয়াবিয়া) মারা গিয়াছেন? সঙ্গে সঙ্গে মর্যাদাও মরিয়া গিয়াছে। উভয়ে সর্বদা একত্রে থাকিতেন। এখন উভয়েই যাইতেছেন। যে পতনের দিকে চলিয়াছে, হাজার চেষ্টা করিলেও তাহাকে উঠানো যাইবে না। আর যে উঠিতেছে, তাহাকে সহস্র চেষ্টার পরও পতিত করা চলিবে না। সৌভাগ্য ও মর্যাদা যাহা দ্বারা রহমতের ধারা ভিক্ষা করিত, যদি মানুষের বুদ্ধির পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়, তবে তিনিই সকলের উপর থাকিতেন।”-(ইস্তিয়াব, তাবারী)
ইয়াযিদের খুতবা
আমীর মোয়াবিয়া ইন্তেকালের পর দীর্ঘ তিন দিন ইয়াযিদ গৃহ হইতে বাহির হইলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি আসিয়া নিম্নোক্ত খুতবা দিলেন :
সর্বময় প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য, যিনি স্বীয় ইচ্ছায় কর্ম করেন। যাহাকে ইচ্ছা দেন যাহাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করেন। কাহাকেও সম্মান দান করেন, কাহাকেও দেন লাঞ্ছনা।
“লোকসকল, মোয়াবিয়া আল্লাহর রজ্জুসমূহের অন্যতম ছিলেন। আল্লাহর যে পর্যন্ত ইচ্ছা ছিল উহা বিস্তৃত করিয়াছিলেন, যখন ইচ্ছা হইয়াছে কাটিয়া ফেলিয়াছেন। মোয়াবিয়া স্বীয় অগ্রবর্তীদের তুলনায় অধম এবং পরবর্তীদের তুলনায় উত্তম ছিলেন। আমি এখন আর তাঁহাকে নির্দোষ ও পবিত্রতম বলিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিব না। তিনি তাঁহার প্রভুর নিকট পৌছিয়া গিয়াছেন। যদি তাঁহাকে তিনি ক্ষমা করেন, তবে তাঁহার অনুগ্রহ বলিতে হইবে। আর যদি মোয়াবিয়াকে তিনি শাস্তি দেন তবে উহা তাহারই পাপের শাস্তি হইবে। আমি তাহার পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছ। আমি অবাধ্য বা দুর্বল নই। তোমার কোন বিষয় অধীর হইও না। খোদা যদি কোন বিষয় পছন্দ না করেন, তবে তাহা শীঘ্রই পরিবর্তন করিয়া দেন। যদি পছন্দ করেন তবে তাহা সহজ করিয়া দেন।”