জীবন সায়ান্নে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ
দুনিয়ার যে সমস্ত জাতিকে আল্লাহ পাক রাষ্ট্র পরিচালনার সৌভাগ্য দান করিয়াছিলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ যাঁহাদের ভাগ্যে ঘটিয়াছে, তাঁহাদের ইতহিাসে ইসলামের শেষ আদর্শ খলিফা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের জীবন এক স্মরণীয় আদর্শ। জীবনের সাথে সাথে তাঁহার মৃত্যু বিশ্বের সত্যাশ্রয়ী মানবগোষ্ঠীর জীবনে এক উজ্জ্বল আদর্শ তুলিয়া ধরিয়াছে। আমরা নিম্নে এই মহাপুরুষের জীবন-সায়াহ্ন সম্পর্কে আলোচনা করিতেছি।
খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালেক যখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে মদীনার গভর্নর নিযুক্ত করার প্রস্তাব করেন, তখন তিন বলিয়াছিলেন, “আমি এ শর্তে গভর্ণর পদ গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি, যেন আমাকে পূর্ববর্তী শাসনকর্তাদের ন্যায় জনসাধারণের উপর জুলুম করিতে বাধ্য করা না হয়।” জবাবে খলিফা বলিয়াছিলেন, আপনি যাহা ন্যায় ও সত্য মনে করেন তাহাই করিবেন। ইহাতে রাজকোষে এক পয়সাও যদি না আসে, তাহাতেও আমার কোন আপত্তি নাই।
খলিফার জবাব শনিয়া হযরত ওমর ইবনে আবুদল আজীজ (র) শাসনকর্তার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করতঃ মদীনায় আগমন করিলেন। মদীনায় পদার্পণ করিয়াই তিনি ওলামায়ে কেরামের সবাইকে একত্রিত করিয়া ঘোষণা করিলেন, “যদি আপনারা কোথাও অন্যায় বা জুলুম দেখিতে পান, তবে আমাকে অবহিত করিবেন।” বলাবাহুল্য, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) যে পর্যন্ত এই পদে অধিষ্টিত ছিলেন, কেহ তাঁহার চরিত্রে সততা ও ন্যয়বিচার চাড়া অন্য কিছু দেখে নাই।
খলিফা সোলায়মানের যখন অন্তিমকাল ঘনাইয়া আসে তখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) আশংকা করিতেছিলেন, সোলায়মান হয়ত শেষ পর্যন্ত তাঁহার উপরই খেলাফতের উত্তরাধিকার সমর্পণ করিয়া যাইবেন। এই জন্য তিনি বেশ চিন্তিতও হইয়া পড়িয়াছিলেন। একদিন তিনি চিন্তিত মনে খলিফার উজিরে আজম রেজাবিস হায়াতের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, “আমার ভয় হয়, খলিফা শেষ পর্যন্ত আমার উপরই খেলাফরেত দায়িত্বভার চাপাইয়া না যান। এই ব্যাপারে আপনি যদি কিচু জানিয়া থাকেন তবে বলুন, পূর্ব হইতেই আমি উহার প্রতিরোধ-ব্যবস্থা করিয়া নিতে চাই। বিশেষতঃ খলিফার জীবদ্দশাতেই যেন তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তি নিযুক্ত করার সুযোগ পান সেই ব্যবস্থা করাই ভাল।”
উজিরে আজম তখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-কে অন্য কথায় প্রবোধ দিয়া বিদায় করিলেন সত্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সন্দেহই বাস্তব রূপ ধারণ করি। খলিফা সোলায়মানের অসিয়তনামা খোলা হইলে দেখা গেল, তিনি শেষ পর্যন্ত ওমর ইবনে আবদুল আজীজকেই খলিফা পদের জন্য মনোনীত করিয়অ গিয়াছেন।
খলিফা তখন পরপারে চলিয়া গিয়াছেন। সুতরাং মনোয়ন পরিবর্তন করার আর উপায় ছিল না। উপায়ন্তর না দেখিয়া অলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) জনসাধারণকে মসজিদে সমবেত করিয়অ বলিতে লাগিলেন, “লোকসকল, আমার ইচ্ছা এবং তোমাদের সম্মতি ব্যতিরেকেই আমাকে তোমাদের খলিফা নিযুক্ত করা হইয়াছে। আমি ক্ষমতা চাই না, আমি তোমাদিগকে স্বাধীনতা দিতেছি, যাহাকে ইচ্ছা তোমাদের খলিফা নির্বাচিত করিয়া লও!” জনতার মধ্য হইতে সমবেত কণ্ঠে আওয়াহ উঠিল, “আমীরুল মোমেনীন, আমরা আপনাকেই আমাদের খলিফা নির্বাচিত করিতেছি।” হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) তখন বলিতে লাগিলেন, “সেই পর্যন্ত তোমরা আমাকে খলিফা হিসেবে মান্য করিও যে পর্যন্ত আমি আল্লাহর নির্দেশের সীমা অতিক্রম না করি।”
খলিফা নির্বাচন সমাপ্ত হইল। উমাইয়া বংশের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (রা) উত্তরাধিকারী হিসেবে জনগণের শাসনভার প্রাপ্ত হইলেন না; বরং জনগণই তাঁহাকে শাসনক্ষমতা দান করিল।
খলিফা নির্বাচিত হইয়া যাওয়ার পর সরকারী কর্মচারীগণ বিশেষ তৎপর হইয়া উঠিলেন। মসজিদ হইতে মহলে লইয়া যাওয়ার জন্য বিশেষ শাহী সওয়ার হাজির করা হইল। জাঁকজমকপূর্ণ বাহন দেখিয়া খলিফা বলিতে লাগিলেন, “এসবের প্রয়োজন নাই। আমার জন্য আমার পুরাতন খচ্চরই যথেষ্ট।” খচ্চরে আরোহণ করিয়াই নূতন খলিফা দারুল খোলাফল দিকে রওয়ানা হইলেন। পুরাতন রীতি অনুযায়ী কোতওয়াল বর্শা কাঁধে তাঁহার পশ্চাদগমন করিতে লাগিলেন। খলিফা কোতওয়ালকেও নিরস্ত্র করিলেন এবং বলিতে লাগিলেন- আমিও একজন সাধারণ মুসলিম নাগরিক মাত্র; আমার জন্য আড়ম্বরের প্রয়োজন নাই।
পূর্বের রীতি ছিল, আলেমগণ মসজিদের মিম্বরে দাঁড়াইয়া খলিফার জন্য বিশেষ দোয়া করিতেন। নূতন খলিফা ঘোষণা করিলেন, আমার জন্য বিশেষ দোআর প্রয়োজন নাই। সকল মুসলমানের জন্য দো‘আ করিবেন। যদি খাঁটি মুসলমন হই, তবে স্বাভাবিকভাবেই এই দো‘আ আমার উপরও আসিয়া পৌঁছিবে।
নূতন খলিফা জাঁকজমকপূর্ণ শাহী প্রাসাদে পৌঁছিলেন। তথায় মরহুম খলিফার পরিবার-পরিজন তাঁহার জন্য স্থান ছাড়িয়া দেওয়ার অপেক্ষা করিতেছিলেন। খলিফা আসিয়া নির্দেশ দিলেন, আমার জন্য প্রাসাদের বাহিরে একখানি তাঁবুর ব্যবস্থা কর; আমি প্রাসাদে বাস করিতে চাহি না। নির্দেশ প্রতিপালিত হইলে পর খলিফা নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন। তাঁহার চেহারায় তখন দুশ্চিন্তার ছাপ লাগিয়অছিল। পরিচারিকা আসিয়া জিজ্ঞসা করিল, আজ আপনাকে এমন উদ্ভ্রান্তের মত দেখাইতেছে কেন? খলিফা জবাব দিলেন, “আজ হইতে দেশের সকল নাগরিকের ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করার দায়িত্ব আমার স্কন্ধে অর্পণ করা হইয়াছে। এই বিরাট সাম্রাজ্যের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার আজ হইতে আমাকেই রক্ষা করিতে হইবে। প্রত্যেকটি নিরন্ন ও বিধবার জন্য আজ হইতে আমাকেই জবাবদিহি করিতে হইবে। সুতরাং আমার চাইতে বেশী করুণার পাত্র আর কে, বলিতে পার?”
আমীর মোয়াবিয়ার শাসনকাল হইতে শুরু করিয়া খলিফা সোলায়মানের আমল পর্যন্ত মুসলমানগণ সে সমস্ত লাভজনক জায়গীর, উর্বর ভূমি ও চারণ ক্ষেত্র সম্বলিত এলাকা জয় করিয়াছিলেন, তাহার প্রায় প্রত্যেকটিই উমাইয়া বংশের লোকদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। বলাবাহুল্য, সেই সময় হইতেই মুসলমানদের মধ্যে জমিদারী ও জায়গীরদারী প্রথার সূচনা হয়। এইভাবে বলিতে গেলে তখনকার মুসলিম জনসাধারণের প্রাপ্য দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ বনী উমাইয়ার কবলে পুঞ্জীভূত হইয়অ গিয়াছিল।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিীজ (র) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে উমাইয়া খান্দানের লোকদিগকে ডাকিয়া নির্দেশ দিলেন, “তোমাদের অন্যায়বাবে দখলকৃত সকল সম্পদ আসল মালিকদের নিকট প্রত্যার্পণ করিতে হইবে।” নির্দেশ শুনিয়অ খান্দানের লোকেরা আপত্তি করিতে লঅগিল। তাহার খলিফাকে স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিল, “আমাদের স্কন্ধে মস্তক থাকিতে এইরূপ হইতে পারে না।”
উপায়ন্তর না দেখিয়া খলিফা মুসলিম জনসাধারণকে মসজিদে সমবেত করিলেন। স্বয়ং শাহী দলিল-দস্তাবেজসহ মসজিদে উপস্থিত হইলেন। খেলাফরেত মীর-মুন্সীকেও হাযির করা হইল। নূতন খলিফা পূর্ববর্তী খলিফাদের আমলে সম্পাদিত দানপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ একটি একটি করিয়অ পাঠ করিতে লাগিলেন এবং ঘোষণা করিতে লাগিলেন, “আজ হইতে আমি এই সমস্ত জায়গীর-জমিদারী আসল মালিক অথবা তাহাদের উত্তরাধিকারীদের হস্তে সমর্পণ করিতেছি!” ঘোষণা সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট দলিলটি ছিড়িয়া ফেলিতে লাগিলেন। এইভাবে সকাল হইতে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত কাটিয়া গেল। সর্বশেষ তিনি স্বীয় সকল সম্পত্তি বায়তুল মালে দাখিল করিয়া বাড়ী ফিরিলেন।
নবনির্বাচিত খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) এর স্ত্রী ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপ খলিফা আবুদল মালেকের কন্যা ফাতেমা। ঘরে আসিয়াই স্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন, “তোমার পিতা তোমাকে যৌতুকস্বরূপ যে সমস্ত মূল্যবান অলংকার ও মণি-মাণিক্য দান করিয়াছিলেন, সমস্তই বায়তুল মালে দাখিল করিয়া দাও। অন্যথায় আমার সহিত আজ হইতে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া চলিয়া যাও।” পতিপ্রাণা স্ত্রী নির্দেশ শ্রবণমাত্র সমস্ত অলংকারাদি বাইতুল মালে পাঠাইয়া দিলেন।
উমাইয়া খান্দানের স্থাবর সম্পত্তি ও জমিদারী-জায়গীর প্রভৃতি পূর্বেই বন্টন করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। এইবার খলিফা ইয়াযিদ ইবনে মোয়াবিয়ার যুগ হইতে শুরু করিয়া সোলায়মানের যুড় পর্যন্দ যে পুঞ্জীভূত সম্পদ অন্যায়ভাবে আদায় করিয় রাজকোষ বা অন্যান্য তহবিলে জমা করিয়া রাখা হইয়াছিল, সেই সমস্ত মূল মালিকদের নিকট প্রত্যর্পণ করার নির্দেশ জারি করিলেন। এই নির্দেশ মোতাবেক এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ হস্তান্তরিত হইল যে, খেলাফতের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ প্রদেশ ইরাকের রাজকোষ পর্যন্ত শূন্য হইয়া গেল। এমনকি ইরাকের দৈনন্দিন খরচ চালানের জন্য রাজধানী দামেশক হইতে অর্থ প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দিল।
এমতাবস্থায় কোন কোন শুভাকাঙ্ক্ষী খলিফাকে পরামর্শ দান করিলেন, অন্ততঃ সন্তান-সন্ততির জন্য হইলেও কিছু সম্পত্তি অথবা সঞ্চয় রাখিয়া যান। প্রত্যুত্তরে খলিফা বলিয়াছিলেন, “আমি উহাদিগকে আল্লাহর হাতেই সমর্পণ করিয়া যাইতে হাই।”
ইমাইয়া খান্দানের তরফ হইতে লিখিত এক প্রতিবাদ লিপিতে খলিফাকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিলঃ ব্যক্তিগত ব্যাপারে অথবা স্বীয় শাসন আমলে আপনি যেরূপ ইচ্ছা আবশ্যক তদ্রূপই করিতে পারেন, কিন্তু পূর্ববর্তী খলিফাদের কাজকর্মে আপনার পক্ষে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার নাই। এই প্রশ্নের মীমাংসা করার জন্য খলিফা খান্দানের লোকদিগকে একত্রিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন বিতর্কমূলক ব্যাপারে যদি আমীল মোয়াবিয়া ও খলিফা আবদুল মালেকের আমলের পরস্পর বিরোধী দুইটি দলিল পাওয়া যায়, তবে কোন দলিলকে প্রাধান্য দিতে হইবে? উত্তরে সকলে বলিয়া উঠিলেন, এমতাবস্থায় আমীর মোয়াবিয়ার দলিলকে প্রাধান্য দিতে হইবে। তখন খলিফা বলিলেন, “আমি যে সমস্ত কাজ করিতেছি তাহার দলিল আরও প্রাচীন। আমি আল্লঅহর প্রাচীন গ্রন্থ কোরআনের দলিল অনুযায়ীই এইরূপ করিতেছি।”
অন্য এক সময়ে এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইলে খলিফা বলিয়াছিলেন; পিতার মৃত্যুর পর যদি কোন পরিবারের বড় ভাই সমস্ত সম্পত্তি দখল করিয়া বসে, তখন আপনারা উহার কি প্রতিকার করিবেন? সকলে বলিল- আমরা ছোট ভাইদের প্রাপ্য দিয়া দেওয়ার জন্য চেষ্টা করিব। খলিফা বলিলেন, “খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসন আমলের পর উমাইয়া বংশীয় সকল ব্যক্তিগণ সমগ্র দরিদ মুসলিম জাতির সম্পদ অন্যায়ভাবে দখল করিয়া লইয়াছিলেন। এখন আমি সেই সমস্ত বঞ্চিতদের মধ্যে তাহাদের প্রাপ্য বণ্টন করিতেছি মাত্র।”
একবার উমাইয়অ বংশের লোকেরা সমবেত হইয়া খলিফার পুত্রদের মারফত প্রস্তাব করিলেন, পূর্ববর্তী খলিফাগণ যেরূপ সরকারী দান ও উপহার-উপঢৌকন মারফত পরিবার-পরিজন এবং আত্মীয়-স্বজনকে স্মরণ করিতেন, খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজও যেন অনুরূপভাবে তাঁহার আত্মীয়-স্বজনকে স্মরণ করেন। উত্তরে খলিফা বলিলেন, “তোমরা আল্লাহর চাইতে আমার অধিক আপন নও। এখন যদি তোমাদের সামান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য আল্লাহর আমানত নষ্ট করি, তবে তোমরা কি কেয়ামতের দিন আল্লাহর রোষানল হইতে আমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারিবে? জওয়াব শুনিয়অ আত্মীয়-স্বজন সকলেই নিরাশ হইয়া চলিয়া গেলেন।”
খেলঅফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর খলিফার পরিবার-পরিজনের সকল প্রকার অতিরিক্ত বৃত্তি বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। অভাব জর্জরিত পরিজন কিছু বৃত্তির তাকিদ করিতে আসিলে খলিফা বলিলেন, “দেখ, আমার ব্যক্তিগত কোন সম্পত্তি বা পৃথক আয়ের পথ নাই। তাহাছাড়া বায়তুল মালের সম্পদে তোমাদের যে অধিকার, দেশের শেষ প্রান্তে অবস্থিত একজন সাধারণ মুসলমানের অধিকারের চাইতে তাহা মোটেই বেশী নয়। সুতরাং বায়তুল মাল হইতে তোমরা জনসাধারণের চাইতে একবিন্দুও অধিক আশা করিও না। আল্লাহর শপথ, তোমরা দুনিয়ার সকল মানুষ মিলিয়াও যদি আমার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা কর, তবুও আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিতে পারিব না।”
খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াই খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) রাষ্ট্রের সকল দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মচারীদিগকে পদচ্যুত করিয়া জনসাধারণের উপর নির্যাতনের সকল উৎস বন্ধ করিয়া দিলেন। পুলিশ বিভাগ হিইতে বলা হইল, সন্দেহজনক ব্যক্তিগণকে গ্রেফতার করা না হইলে শান্তি রক্ষা সম্ভবপর হইবে না। জওয়াবে খলিফা বলিয়াছিলেন, “কেবলমাত্র শরীয়তের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করিয়া যাও। উহাতে যদি অপরাধমূলক কার্যকলাপ দূর না হয়, তবে তাহা চলিতে দাও।”
খোরাসানের শাসনকর্তার পত্র আসিল- “এই এলাকার জনসাধারণ নেহায়েত অবাধ্য। তরবারি বা বেত্রাদণ্ড ব্যতীত উহাদিগকে বাধ্য রাখা সম্ভবপর হইবে না।” খলিফা জওয়াব দিলেন, “আপনার ধারণা ভুল। সদাচরণ ও ন্যায়বিচার অবশ্যই তাহাদিগকে ঠিক পথে পরিচালিত করিতে সক্ষম। আপনি সেই পথেই কাজ করিয়া যাইতে থাকুন।”
খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) নির্দেশ জারি করিয়াছিলেন, ইসলাম গ্রহণ কারার সঙ্গে সঙ্গে কাহারও নিকট হইতে আর এক পয়সা জিযিয়া বাবদ আদায় করা চলিবে না। এই যুগান্তরকারী ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য অ-মুসলমান প্রজা ইসলামে দীক্ষিত হইয়া গেল।
হাইয়ান ইবনে শোরাইহ নামক জনৈক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী রিপোর্ট দিলেন, খলিফার নির্দেশের পর এমন বিপুল পরিমাণ লোক ইসলাম গ্রহণ করিয়াছে যে, বর্তমানে জিযিয়ার আমদানী প্রায় বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে। এখন আমাকে ঋণ গ্রহণ করতঃ মুসলমান প্রজাদের বৃত্তি পরিশোধ করিতে হইতেছে।” খলিফা জবাব দিলেন, যে কোন অবস্থার মোকাবেলা করিতে হউক না কেন, মুসলমানদের নিকট হইতে জিযিয়া আদায় অবশ্যই বন্ধ করিতে হইবে। স্মরণ রাখিও, আল্লাহর রসূল (সা) মানবতার পথপ্রদর্শকরূপে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, কর আদায়কারীরূপে নয়। আমি অন্তরের সহিত কামনা করি, রাষ্ট্রের সকল ইসলাম গ্রহণ করুক, জিযিয়া আমদানী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়া যাউক এবং আমর-তোমার মর্যাদা কৃষক-মজুরদের স্তরে নামিয়া আসুক; আমরা সকলে মেহনত করিয়া জীবিকা অর্জন করিব।”
পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাগণ নও-মুসলিমদের নিকট হইতেও অ-মুসলমানদের মতো ‘জিযিয়অ’ বা দেশরক্ষা কর গ্রহণ করিতেন।– (অনুবাদক)
পারস্যের গভর্ণর আদী ইবনে আরতাতের কর্মচারীগণ স্থানীয় কৃষকদের ফলবাগান নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করিয়া সমস্ত ফল ভোগ করিত। এই কথা খলিফার কর্ণগোচর হইলে তিনি তিন ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতঃ গভর্নর আদীকে লিখিয়া পাঠাইলেনঃ
এই সমস্ত দুর্নীতি যদি তোমার জ্ঞাতসারে অথবা নির্দেশক্রমে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে ততে তোমাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করিব না। আপতাতঃ আমি তিন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি প্রেরণ করিতেছি, উহারা তদন্ত করিয়া সমস্ত বাগানের ফল আসল মালিতের নিকট প্রত্যর্পণ করিবেন। তুমি উহাদের কাজে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না।
একবার ইয়ামানের বায়তুল মাল হইতে একটি স্বর্ণ-মুদ্রা হারাইয়া যাওয়ার খবর আসিল। ইহাতে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজহ (র) অধীর হইয়া উঠিলেন এবং তৎমুহূর্তেই তথাকার বায়তুল মালের তহবিল রক্ষককে লিখিয়া পাঠাইলেন, “আমি তোমাকে বিশ্বাসঘাতক মনে করিতেছি না, তবুও তোমার ঔদাসীন্যকে এই জন্য দায়ী করিতেছি। সমস্ত মুসলমানদের পক্ষ হইতে আমি উহার বিচারপ্রার্থী। তুমি শরীয়তের নিয়ম মোতাবেক শপথ করিয়অ বল, এই স্বর্ণমুদ্রা অপচয় হওয়ার পশ্চাতে তোমার কোন হাত না।”
সরকারী কর্মচারীগণ দফতরে কাজ করার সময় কাগজ, কলম, লেফাফা, বাতি প্রভৃতি সরকারী সাজসরঞ্জাম বেপরোয়াভবে ব্যবহার করিতেন। খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) এই সূক্ষ্ম বিষয়টির প্রতিও দৃষ্টি দিলেন এবং আবু বকর ইবনে হাযম প্রভৃতি কতিপয় সরকারী কর্মচারীদের উদ্দেশে লিখিলেন,“সেই সময়ের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা অন্ধকার রাতে আলো ছাড়া মসজিদে নববীতে যাতায়াত করিতে। আল্লাহর শপথ, আজ তোমাদের অবস্থা তদপেক্ষা অনেক ভাল। কলম আরও সূক্ষ্ম করিয়া লও। লাইন আর ঘন ঘন বসাও, দফতরের কাজে ব্যবহৃত সরকারী সাজসরঞ্জাম আরও সাবধানতার সহিত ব্যবহার কর। মুসলমানদের ভাণ্ডার হইতে এমন এক পয়সাও ব্যয় করিতে চাহিও না যদ্বারা সামান্যতম প্রত্যক্ষ উপকারও সাধিত হয় না।”
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) শাহী খান্দানের সর্বপ্রকার বিলাস-বৃত্তি, বিলাস-সামগ্রী ও অপব্যয় বন্ধ এবং শাহী খান্দানের ব্যবহারের জন্য রক্ষিত সমস্ত সরকারী ঘোড়া বিক্রয় করিয়অ বিক্রয়লব্ধ অর্থ বায়তুল মালে জমা করিয়া দিলেন। অপরপক্ষে যে সমস্ত লোক উপার্জনক্ষম নহে তাহাদের সকল নাম সরকজারী রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করিয়া বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। খলিফার তরফ হইতে ঘোষণা করিয়া দেওয়া হইল, আমার কোন লোক যেন অনাহারে না থাকে। কোন কোন এলাকায় গভর্নরদের তরফ হইতে অভিযোগ আসিল, বিপন্ন লোকদিগকে ব্যাপকভাবে বৃত্তি দান করিলে সরকারী ভাণ্ডার একেবারে শূন্য হইয়া যাইবে। রক্ষিত আছে সেই পর্যন্ত আল্লাহর বিপন্ন বান্দাদের মধ্যে বিতরণ কর। যখন একেবারে শূন্য হইয়া যাইবে তখন উহা আবর্জনা দিয়া পূর্ণ করিয়া লও।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) স্বীয় শাসনামলে রাষ্ট্রের মুসলিম অ-মুসলিম নাগরিকদের অধিকার সমভাবে রক্ষা করিতেন। হীরা এলাকায় জনৈক মুসলমান একজন অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে। খলিফা হত্যাকরীকে গ্রেফতার করিয়া নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাওয়ালা করিয়া দিলেন, উহারা ঘাতককে হত্যা করিয়া ফেলিল।
রাবিয়া ইবরে শোবা নামক জনৈক সরকারী কর্মচারী সরকারী কার্য উপলক্ষে জনৈক অমুসলিম নাগরিকের অশ্ব বলপূর্বক গ্রহণ করিয়া ব্যবহার করেন। খলিফার নিকট এই অভিযোগ উত্থাপিত হইলে তিনি রবিয়াকে চল্লিষটি বেত্রাঘাতের দণ্ড দেন।
খলিফা ওয়ালিদ স্বীয় পুত্র আব্বাসকে জনৈক যিম্মীর ভূমি জায়গীরস্বরূপ দিয়াছিলেন। উক্ত যিম্মী হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ-এর নিকট আসিয়া বিচার প্রার্থনা করে। খলিফা ওয়ালিদ-পুত্র আব্বাসকে ডাকিয়া এই ব্যাপারে তাঁহার বক্তব্য পেশ কারার নির্দেশ দিলেন। আব্বাস জওয়াবে ওয়ালিদ-প্রদত্ত জায়গীরের দলিল-দস্তাবেজ পেশ করিলেন। দলিল দেখার পর খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) নির্দেশ দিলেন, যিম্মীর ভূমি ফিরাইয়া দাও। ওয়ালিদের দলিল আল্লাহর কিতাবের নির্দেশের চাইতে অধিক কার্যকর হইতে পারে না।
জনৈক খৃস্টান খলিফা আবদুল মালেকের পুত্র হেশামের বিরুদ্ধে আদালত মোকাদ্দমা দায়ের করে। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) বাদী-বিবাদীকে এক কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া বিচার শুরু করেন। হেশাম ইহাতে নিজেকে ভীষণ অপমানিত মনে করিলেন। ক্ষোভে, দুঃখে তাঁহার চেহারা লাল হইয়া গেল। উহা দেখিয়া হযরত ওমর ইবনে আ্তুল আজীজ (র) বলিতে লাগিলেন, সত্য ধর্ম ইসলামের আদালতে ছোট বড়, মুসলিম-পদে অধিষ্টিত ছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই মানুষ মনে করিতেছিলেনঃ আসমান-জমিরনের মধ্যে যেন ইনসাফের খোদায়ী দণ্ড প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। মানুষের খোদা যেন আকাশ হইতে হস্ত প্রসারিত করিয়া সকল শ্রেণীর মানুষ ও তাহার মানবতাকে প্রেম, স্বাধীনতা আর সমৃদ্ধির জয় মুকুট পরাইতে আগাইয়া আসিয়াছেন। সুখী মানুষ খয়রাত হাতে লইয়া পথে বাহির হইত, কিন্তু কোথাও গ্রহণকারী পাওয়া যাইত না। মানুষ বায়তুল মালের কর্মকর্তদের নিকট দান-খয়রাত প্রেরণ করিত, কিন্তু কেহ হাতা গ্রহণ করিতে চাহিত না। ফলে কোন অভাগ্রস্ত লোক তাঁহাদের পক্ষে খুঁজিয়া বাহির করিতে কষ্ট হইত।
পারস্যের গভর্ণর আদী ইবনে আরতাত খলিফাকে লিখিয়া পাঠাইলেন, একানে সুখ-সমৃদ্ধি এত বর্ধিত হইয়াছে যে, সাধারণ মানুষ এখন দাম্ভিক ও বিলাসী হইতেহ শুরু করিয়াছে। খলিফা জওয়াব দিলেন, জনসাধারণকে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করিতে শিক্ষা দাও।
এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই একদিকে যেমন দেশের সকল শ্রেণীর নাগরিক সুখ-সমৃদ্ধির মনমাতানো গুঞ্জনে আত্মহারা হইয়া উঠিয়াছিল, ঠিক অন্যদিকে যে সাধক পুরুষের ত্যাগ-তিতিক্ষায় এই সমৃদ্ধির প্লাবন আসিয়াছিল, তিনি দিন দিন কৃষ রুগ্ন হিইয়া পড়িতেছিলেন। তাঁহার দিবসের বিশ্রাম ও রাত্রের নিদ্রা শেষ হইয়া গিয়াছিল। সর্বপ্রথম যখন তাঁহাকে মদীনার গভর্নর নিযুক্ত করা হয় তখন তাঁহার ব্যক্তিগত ব্যবহারের সাজ-সরঞ্জাম এত ছিল যে, ত্রিশটি উট বোঝাই করিয়া তাহা মদীনায় প্রেরণ করিতে হইয়াছিল। তাঁহার শরীর এমন সবল ছিল যে, কোমরবন্দ মাংসপেশীর মধ্যে অদৃশ্য হইয়া যাইত।
তাঁহার ভোগ-বিলাসের বহরও ছিল কাহিনীর মত। যে কোন মূল্যবান কাপড় তিনি দুইবার পরিধান করিতেন না। তখন দিনে চারিশত টাকা মূল্যের জামাও তাঁহার পছন্দ হইত না। তিনি এত দুর্মূল্য সুগন্ধ দ্রব্য ব্যবহার করিতেন যে, অনেক সময় তাহা খলিফার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যও পাওয়া যাইত না। খলিফা ওয়ালিদের উজিরে আজম রেজা বিন হায়াত বর্ণনা করেন, আমদের দেশে সবচাইতে পরিপাটি ও সুবেশী পুরুষ ছিলেন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ। তিনি যেদিকে গমন করিতেন চারিদিকে সুগন্ধে মোহিত হইয়া উঠিত।
কিন্তু যে দিন তিনি ইসলামের মহান খলিফা নির্বাচিত হইলেন, সেই দিন হইতে তাঁহার জীবনের অদ্ভুত পরিবর্তন শুরু হয়। খেফাতের দায়িত্বভার গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সকল প্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও বিলাসদ্রব্য বিক্রয় করিয়অ বায়তুল মালে দাখিল করিয়া দেন। এর পরের দিন বাসস্থান হইতে শুরু করিয়া পূর্বেকার কোন ব্যবহার্য দ্রব্যই আরত তাঁহার নিকট ছিল না। পরিধানের জন্য মাত্র একজোড়া সাধারণ কাপড় সঙ্গে রাখিয়াছিলেন। যখন উহা অপরিষ্কার হইত, নিজ হাতে ধুইয়া আবর পরিধান করিতেন।
খলিফা যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তাঁহার এক শ্যালক বিবি ফাতিমাকে বলিয়াছিলেন, আমীরুল মোমেনীনের জামা অত্যন্ত অপরিষ্কার হইয়া গিয়াছে, লোকজন তাঁহাকে দেখিতে আসে, উহা বদলাইয়া দেওয়া দরকার।
ফাতেমা এই কথা শুনিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। ভ্রাতা যখন পুনরায় এই কথা উত্থাপন করিলেন, তখন তিনি বলিলেন, আল্লাহর শপথ, আমীরুল মোমেনীনের অন্য কোন কাপড় নাই, দ্বিতীয় জামা আমি কোথা হইতে আনিয়া দিব?
ঐ জামাটিও আবার আস্ত ছিল না। স্থানে স্থানে কয়েকটি তালি লাগানো ছিল।
একবার খলিফার এক কন্যার পরিধানের কাপড় ছিল না। খলিফার দৃষ্টি এই দিকে আকর্ষণ করা হইলে তিনি বলিয়াছিলেন, এখন কাপড় কেনার মত সংস্থান আমার নাই। বিছানার কাপড় ব্যবস্থা করিয়া দিলেন এবং সকলকে সাবধান করিয়া দিলেন, খলিফা যেন এক কথা জানিতে না পারেন।
একদা খলিফার এক পুত্র পিতার নিকট কাপড় চাহিতে আসিলেন। খলিফা তাঁহাকে বলিয়া দিলেন, আমার ব্যবস্থা নাই। খায়ার ইবনে রেবাহের নিকট আমার কাপড় রহিয়াছে, উহা আনিয়া ব্যবহার কর। খলিফা পুত্র আনন্দিত হইয়া খাইয়ারের নিকট গমন করিলেন, তিনি একখানা পুরাতন খদ্দরের জামা বাহির করিয়া দিলেন। খলিফা-পুত্র নিরাশ হইয়া পুনরায় পিতার নিকট আগমন করিলেন। পিতা বলিলেন, বৎস, আমার নিকট ইহার চাইতে ভাল কাপড় নাই। তুমি যদি একান্তই সহ্য করিতে না পার তবে নির্ধারিত বৃত্তি হইতে কিছু অর্থ আগাম নিয়অ যাও। পরে বৃত্তি গ্রহণের সময় অবশ্যই উহা ফেরত দিতে হইবে।
একবার এক পরিচারিকা খলিফার বেগমের নিকট অভিযোগ করিল, প্রত্যহ কেবল ডাল আর শুকনা রুটি আমি খাইতে পারিব না। বেগম জওয়াব দিলেন, আমি কি করিব! খলিফা এই খাদ্যই তো গ্রহণ করিয়া থাকেন। বেগমকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার কাছে কি একটি মুদ্রা হইবে, আঙ্গুর খাইতে বড্ড ইচ্ছা করিতেছিল।” জওয়াবে বেগম বলিলেন, “এই বিশাল মুসলিম দুনিয়ার খলিফা হইয়া আপনার কি একটি পয়সা খরচ করারও ক্ষমতা নাই?”
খলিফা বলিলেন, হাঁ, এর চাইতে দোযখের হাতকড়া পরিধান করা অবশ্য আমার জন্য আরও সহজ।
খেলঅফতের জিম্মাদারী গ্রহণ করার পর হযরত ওমর দুনিয়ার সকল আরাম আয়েশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার-পরিজন হেইতেও দূরে সরিয়া গিয়াছিলেন। সারাদিন রাষ্ট্র পরিচালনার কার্য করিয়া রাতভর মসজিদে বসিয়া আল্লাহার এবাদত করিতেন। মসজিদেই একটু চক্ষু মুদিয়া বিশ্রাম করিতেন। স্ত্রী ফাতেমা স্বামীর এই কৃতষাধনায় অতীব মর্মাহত হইয়া পড়িয়াছিলেন। একদিন খলিফাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করায় তিনি জওয়াব দিয়াছিলেন, “আমি তোমাদের অধিকার সম্পর্কে অনেকবার ভাবিয়া দেখিয়াছি। আরও ভাবিয়া দেখিয়াছি, এই জাতির ছোট-বড়, সবল-দুর্বল সকলের দায়িত্বও আমার স্কন্ধে অর্পিত হইয়াছে। আমার রাজ্যের যত এতীম, বিধাবা, নির্যাতি, বঞ্চিত ও অক্ষম লোক রহিয়াছে, তাহাদের দায়িত্বও আমার উপর ন্যস্ত। আগামীকাল আল্লাহ যখন আমাকে এই দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করিবেন, আল্লাহর রসূল যখন তাঁহার উম্মতের দায়িত্ব সম্পর্কে আমাকে দায়ী করিবেন, তখন আমি আল্লাহ এবং তাঁহর রসূলের সম্মুখে যদি ঠিকমত জবাবদিহি করিতে না পারি, তখন আমার কি উপায় হইবে? যখন এই সব কথা ভাবি, তখন আমার শরীর ভাঙ্গিয়া আসে; সকল শক্তি যেন বিলীন হইয়া যায়। চক্ষু ফাটিয়অ যেন অশ্রু গড়াইয়া আসে।”
ইসলামের এই মহান খলিফা রাতের পর রাত জাগিয়া শেষ বিচারের জওয়াবদিহির কথা ভাবিতেন। কখনও কখনও দারুণ মনোবেদানয় অশ্রু বর্রণষ করিতেন, সংজ্ঞাহীন হইয়া বিছানায় গড়াইয়অ পড়িতেন। স্ত্রী ফাতেমা এই সব দুঃখ-রজনীর সঙ্গিনী হইয়া স্বামীকে সান্ত্বনা দিতেন, কিন্তু কিছুতেই খলিফার অন্তরে শান্তি আসিত না। এই অবস্থাতেই দীর্ঘ আড়াই বৎসর কটিয়া গেল।
১০১ হিজরী, রজব মাস। উমাইয়অ বংশের প্রতিহিংসাপরায়ণ একদল লোক খলিফার এক গোলামকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা উৎকোচ প্রদান করিয়া তাঁহাকে পানীয় জলের সহিত বিষ পান করাইল। দারুণ বিষেমর ক্রিয়া শুরু হওয়ার পূর্বেই খলিফা এই কথা জানিয়া ফেলিলেন। গোলামকে কাছে ডাকিয়া তাহার নিকট হইতে উৎকোচের এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আদায় করতঃ বায়তুল মালে জহমা করিয়া দিলেন এবং বলিলেন, “যাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করিয়া দিতেছি।”
চিকিৎসকগণ খলিফার বিষক্রিয়া বন্ধ করার জন্য যত্ন করিতে চাহিলেন, কিন্তু তিতিন সকলকে নিরস্ত করিয়া বলিলেন, “আমি আরে এক মুহূর্তও দায়িত্বভার আঁকড়াইয়া থাকিতে চাহি না। আমার পার্শ্বেও যদি রোগের ঔষধ থাকিত, তবুও তাহা আমি হাত বাড়াইয়া গ্রহণ করিতাম না।”
খলিফা সোলায়মান শেষ অসিয়তনামায় ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর পর ইয়াযিদ ইবনে আবদুল মালেমকে খলিফা নিযুক্ত করার সুপারিশ করিয়াছিলেন; শেষ যাত্রার সময় তিনি তাঁহার পরবর্তী খলিফা ইয়াযিদের উদ্দেশে অসিয়তনামা লিীখয়াছিলেনঃ
“এখন আমি আখেরাতের পথে যাত্রা করিতেছি। সেখানে আল্লঅহ আমাকে প্রশ্ন করিবেন, হিসাব গ্রহণ করিবেন, তাঁহার নিকট কোন কিছু গোপন করার ক্ষমতা আমার নাই। ইহার পর যদি তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হন তবে আমি কৃতকার্য হইলাম। আর যদি সন্তুষ্ট না হন, তবে ধিক আমার কর্মজীবনের উপর! আমার পর তুমি আল্লাহকে ভয় করিও। প্রজাসাধারণের প্রতি দৃষ্টি রাখিও। আমার পর তুমিও বেশীদিন জীবিত থাকিবে না। এমন যেন না হয় যে, এই অল্প সময়েল মধ্যেই তুমি আত্মচেতনা হারাইয়া নিজের সর্বনাশের পথ প্রশস্ত করিতে থাকিবে। পরে কিন্তু প্রতিকারের সময়ও আর খুঁজিয়া পাইবে না।”
কোন কোন হিতাকাঙ্ক্ষী এইরূপ বলিতে লাগিলেন, এই শেষ মুহূর্তে হইলেও পরিবার-পরিজনের জন্য কোন সুব্যবস্থা করিয়া যান। এই কথা শুনিয়া উত্তেজনায় খলিফা উঠিয়া বসিতে চাহিলেন। তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া বসাইয়া দেওয়া হইল। এই অবস্থাতেই তিনি বলিতে লাগিলেনঃ
“আল্লাহর শপথ, আমি আমার পরিবার-পরিজনের কোন অধিকার বিনষ্ট করি নাই; হ্যাঁ, অন্যের হক মারিয়া তাহাদিগকে দেই নাই। এমতাবস্থায় আমার এবং আমার সন্তানদের অভিবাক একমাত্র আল্লাহ। আমি তাহাদিগকে আল্লাহ তাঁআলার হস্তেই অর্পণ করিয়া যাইতে চাই। আল্লাহকে যদি তাহারা ভয় করে, তবে আল্লঅহও তাহাদে কোন না কোন ব্যবস্থা করিয়া দিবেন। আর যদি আমার পর উহারা পাপে লিপ্ত হয়, তবে আমি ধন-সম্পদ দিয়া উহাদের পাপের হস্ত আরও দৃঢ় করিয়া যাইতে চাই না।”
অতঃপর সন্তানদিগকে নিকটে ডাকিয়া বলিলেন, “প্রিয় বৎসগণ, দুইটি পথই তোমাদের পিতার ক্ষমতার মধ্যে ছিল! একটি হইতেছে, তোমরা সম্পদশালী হইতে এবং তোমার পিতা দোযখের আগুনে জ্বলিতেন। অন্যটি হইতেছে, আজ তোমরা নিঃস্ব রহিয়া গেলে আর তোমাদের পিতা বেহেশ্তে যাওয়ার যোগ্যতার অর্জন করিলেন। আমি শেষের বিষয়টিই অবলম্বন করিয়াছি। এখন তোমাদিগকে কেবলমাত্র আল্লাহরই হস্তে সমর্পণ করিয়া যাইতেছি।”
এক ব্যক্তি নিবেদন করিল, মদীনার রওজা মোবারকের সন্নিকটস্থ খালি জায়গায় আপনাকে দাফন করার ব্যবস্থা করিব কি? খলিফা জওয়াব দিলেন, আল্লাহর শপথ, আমি যে কোন আযাব সহ্য করিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু আমার এই নগণ্য দেহ আল্লাহর রসূলের (সা) পবিত্র দেহের সহিত সমাহিত হোক, এই ধৃষ্টতা আমি কিছুতেই বরদাশত করিতে পারি না।
অতঃপর জনৈক খৃষ্টানকে ডাকাইয়া সমাধির জন্য তাহার এক টুকরা ভূমি ক্রয় কারা প্রস্তাব করিলেন। খৃষ্টান প্রজা নিবেদন করিল, “আপনার পবিত্র দেহ আমার ভূমিতে সমাধিস্থ হইবে, ইহার চাইতে গৌরবের বিষয় আমার আর কি হইতে পারে? আমি এই গৌরবের পরিবর্তে মূল্য গ্রহণ করিতে চাই না।”
সঙ্গে সঙ্গেই খৃস্টানকে ডাকাইয়অ সমাধির জন্য তাহার এক টুকরা ভূমি ক্রয় করার প্রস্তাব করিলেন। খৃস্টানের ভূমির মূল্য পরিশোধ করিয়া দেওয়া হইল। অতঃপর এই মর্মে শেষ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করিলেন, আমার কাফনের সঙ্গে যেন রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র নখ এবং দাড়ি মোবারকের এক টুকরা কেশ দিয়া দেওয়া হয়। ইতিমধ্যেই ডাক আসিলঃ
“ইহা শেষ মুনযিল, যাহারা প্রাধান্য এবং বিপর্যয় চাহেন না, তাহাদের জন্য এই মন্যিল। শুভ পরিণাম একমাত্র খোদাভীরুদের জন্যই।” কোরআনের এই আয়াত পাঠ করিতে করিতে মহান খলিফার যবান চিরতরে বন্ধ হইয়া গেল।
— সমাপ্ত —