হযরত ওমরের শাহাদাত
রসূলে খোদার (সা) শেষ বিদায়ের পর ইসলাম ও মুসলিম জাতির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ছিল এক পর্বতপ্রমাণ দায়িত্ব। এ সহ্যাতীত বোঝা ইসলামের দুই জন নিষ্ঠাবান সন্তান মিলিতভাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহাদের প্রথম ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) ও দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন হযরত ওমর ফারুক (রা)। হযরত সিদ্দিক (রা) একাধারে রসূলে খোদার (সা) বিচ্ছেদ-ব্যথায় তিলে তিলে নিঃশেষিত হইয়া আসিতেছিলেন, অপরদিকে ইসলাম ও মুসলিম জাতির দায়িত্বের গুরুভার তাঁহার মস্তক বিগলিত করিয়া দিতেছিল। ইহার ফল হইল, রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পর তিনি মাত্র দুই বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। তাহার পর এই দায়িত্বের বোঝা সিম্পূর্ণরূপে হযরত ওমরের কাঁধে আসিয়া পতিত হয়। হযরত ওমর ফারুক (রা) কেমন প্রাণপণ সাধনা করিয়া খেলাফরেত দায়িত্বভার পালন করিয়াছিলেন নিম্নের কয়েকটি ঘটনা হইতে তাহার অনুমান করা যাইবে।
হরমুজান ছিলেন বিখ্যাত সেনাপতি। পারস্য সম্রাট ইয়াজদেগারদ তাঁহাকে আওয়াজ ও ইরান প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া মুসলমানদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধ বাধিলে পর হরমুজান এই শর্তে অস্ত্র ত্যাগ করিতে সম্মত হইলেন, তাহাকে ছহিছালামতে মদীনায় পৌঁছাইয়া দেওয়া হইবে। হযরত ওমর (রা) তাঁহার সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত করিবেন অম্লান বদনে তাহাই মানিয়া লইবেন। যুদ্ধ থামিয়া গেল। হরমুজান বিপুল সমারোহে মদীনায় রওয়ানা হইলেন। ইরানের কতিপয় বড় বড় শোভিত করিলেন, মখমলের বহুমূল্য আবা পরিধান করিলেন। কটিদেশে বহুমূ্যে তরবারি ঝুলাইয়া রাজকীয় শান-শওকতে মদীনায় প্রবেশ করিলেন। মসজিদে নববীর নিকট পৌঁছিয়া লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমীরুল মোমেনীনের সহিত কোথায় দেখা হইবে? ইরানীদের ধারণ ছিল, যে ব্যক্তির দাপটে সমগ্র দুনিয়ায় বিপ্লবের বাতাস বহিয়া চলিয়াছে, তাঁহার দরবার নিশ্চয়ই নিতান্ত জাঁকজমকপূর্ণ হইবে। একজন বেদুইডন হাতের ইশারায় দেখাইয়া বলিলেন, এই তো আমীরুল মোনেনীন। আমীরুল মোমেনীন ওমর (রা) তখন মসজিদের বারান্দায় শুইয়া ছিলেন। ইয়ারমুকের ময়দানে যখন ত্রিশ সহস্র রোমীয় সৈন্য পাঘে বেড়ি লাগাইয়া মুসলিম বাহিনীর সহিত লড়াই করিতেছিল, তখন হযরত ওমরের অবস্থা কিরূপ ছিল? বিশ্বস্ত বর্ণনা, যতদিন যুদ্ধ চলিয়াছিল, ততদিন হযরত ওমর (রা) একরাত্রিও শান্তির সহিত শুইতে পারেন নাই। যুদ্ধ শেষে যখন বিজয়ের খবর আসিল, তখন আল্লাহর উদ্দেশে সেজদায় পড়িয়া অশ্রু প্রবাহিত করিতে থাকেন।
কাদেসিয়ার যুদ্ধে পারস্য সম্রাট রাজ্যের সর্বশক্তি যুদ্ধের ময়দানে নিয়োগ করিয়াছিলেন। একদিন যুদ্ধেই দশ হাজার ইরানী ও দুই হাজার মুসলিম সৈন্য হতাহত হন। যুদ্ধ চলাকালে হযরত ওমরের অবস্থা ছিল, প্রত্যহ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মদীনার বাহিরে কোন বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া কাদেসিয়ার সংবাদবাহী কাসেদের পথ চাহিয়া থাকিতেন। কাসেদ যেদিন বিজয়ের সংবাদ লইয়া আসে, সেইদিনও তিনি মদীনার বাহিরে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। যখন জানিতে পারিলেন, হযরত সাদের কাসেদ যুদ্ধের খবর লইয়া আসিয়াছে, তখন তিনি খবর জিজ্ঞাসা করিতে শুরু করিলেন। কাসেদ উট দৌড়াইয়া যাইতেছিল আর খবর বলিতেছিল। হযরত ওমরও উটের রেকাব ধরিয়া কাসেদের পিছু পিছু দৌড়াইতে ছিলেন। শহরের অভ্যন্তরে পৌঁছার পর কাসেদ যখন শুনিতে পাইল, তাহার উটের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইয়া আসা লোকটিকে মদীনাবসীগণ অতি সম্ভ্রমে আমীরুল মোমেনীন বলিয়া সম্বোধন করিতেছে, কথন কাসেদের বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। ইনিই আল্লাহর রসূলের খলিফা। কাসেদ বিনীতভবে নিবেদন করিল, “আমিরুল মোমেনীন, আপনি পূর্বেই কেন আমাকে পরিচয় দেন নাই? তাহা হইলে তো আমাকে এই ধৃষ্টতা প্রদর্শন করিতে হইত না।” ওমর (লা) বলিলেন, এই কথা বলিও না। আসল কথা বলিয়া যাও। কাসেদ বলিয়া যাইতে লাগিল, আর তিনি পূর্ববৎ উটের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটিয়া বাড়ী পৌঁছিলেন।
খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর সর্বসাধারণ মুসলমানকে মসজিদে নববীতে ডাকিয়া আনিয়া বলিতে লাগিলেন, “মুসলগণ, তোমাদের সম্পদে আমার ঠিক ততটুকু অধিকার রহিয়াছে, যতটুকু কোন এতীমের প্রতিপিালকের জন্য এতীমের সম্পদে থাকে। আমার যদি সামর্থ্য থাকে, তবে তোমাদের নিকট হইতে কোন প্রকার পারিশ্রমিক নিব না। যদি অসমর্থ হইয়া পড়ি, তবে কেবলমাত্র খাওয়া-পরার খরচ গ্রহণ করিব। ইহার পরও তোমরা আমার প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখিও যেন অপব্যয় অথবা সঞ্চয় করিতে না পারি।” রোগে মধুর প্রয়োজন পড়িলে মসজিদে লোক সমবেত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ভাইসব, যদি আপনরা অনুমতি দে, তবে বাইতুল মালের ভাণ্ডার হইতে সামান্য মধু গ্রহণ করিয়া ব্যবহার করি। জনসাধারণ তাঁহার আবেদন মঞ্জুর করিলে পর তিনি তাহা গ্রহণ করেন।
রাত ভরিয়া তিনি নামায পড়িতেন এবং ক্রন্দন করিতে থাকিতেন। অনেক সময় ক্রন্দন করিতে করিতে দগম বন্ধ হইয়া আসিত। অশ্রু বহিতে বহিতে পবিত্র চেহারায় দুটি কাল দাগ পড়িয়া গিয়াছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ (রা) বর্ণনা করেন, একাদ হযরত ওমর (রা) নামায পড়াইতেছিলেন। কেরাত পড়িতে পড়িতে যখন আয়াতে পাক (আরবী*****) পর্যন্ত পৌছিলেন, তখন হঠাৎ এমন জোরে ক্রন্দন করিতে শুরু করিলেন যে, লোকেরা অস্থির হইয়া উঠিল।
ইমাম হাসান (লা) হইতে বর্ণিত আছে, হযরত ওমর (রা) নামায পড়িতেছিলেন, এমতাবস্থায় (আরবী******) এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছিয়া এমনভাবে কাঁদিতে শুরু করিলেন যে, তাঁহার দুই চক্ষু লাল হইয়া গেল! কোন কোন সময় লোকের সন্দেহ হইত, হয়ত দুশ্চিন্তায় তাঁহার অন্তর ফাটিয়া যাইবে। সঙ্গে সঙ্গে হয়ত তিনি মৃত্যুবরণ করিবেন। কোন কোন সময় অবস্থা এত শোচনীয় হইয়া যাইত যে, লোকেরা তাঁহাকে দেখিতে আসিত।
এক সাহাবী ঐ সমস্ত সৎকর্মাবলীর বিবরণ দিতেছিলেন, যাহা তিনি রসূলুল্লাহর (সা) সঙ্গে থাকিয়া করিয়াছিলেন। শুনিতে শুনিতে অধীর হইয়া হযরত ওমর (রা) বলিতে লাগিলেন, যাঁহার হাতে আমার জীবন সেই পবিত্র সত্তা শপথ, আমি মনে করি, যদি পুরস্কার কিছু নাও পাওয়া যায়, তবু অন্ততঃ আজারেব হাত হইতে মুক্তি পাওয়া গেলেন যথেষ্ট হইবে।
একদা রাস্তা দিয়া যাইতেছিলেন। কি মনে করিয়া মাটি হইতে একটি তৃণখণ্ড উঠাইলেন এবং আক্ষেপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, পরিতাপ! আমি যদি এই তৃণ খণ্ডাটির ন্যায় নগণ্য হইতাম! হায়, আমি যদি জন্মই না নিতাম! আমার মাতা যতি আমাকে প্রসবই না করিতেন! অন্য এক সময় বলিতেছিলেন, যদি আকাশবাণী হয় যে, এক ব্যক্তি ব্যতীত দুনিয়ার সকল লোকের গোনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, তবু আমার ভয় দূর হইবে না। আমি মনে করিব, বোধ হয় সেই হতভাগ্য মানুষাটি আমি!
এই সমস্ত চিন্তা তাঁহার জীবিকাগত অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় করিয়া দিয়াছিল। তিন রোম ও ইরান সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করিয়াছিলেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁহার নিঃস্বতা ও উপবাপস দূর হয় নাই। সাধারণ লোক পর্যন্ত উহা উপলব্ধি করিত, কিন্তু তিনি সর্বদা অম্লান বদনে আল্লাহর ইচ্ছাই মানিয়া লইতেন। একদিন তাঁহার কন্যা মুসলিম জননী হযরত হাফসা (রা) সাহসে ভর করিয়া বলিয়া ফেলিলেন, পিতা, আল্লাহ আপনাকে উচ্চ মর্যদা দান করিয়াছেন, আপনার পক্ষে ভাল খাবার এবং ভাল পোশাক হইতে দূরে থাকার প্রয়োজন কি? তিনি জওয়াবে বলিলেন,- বৎস, মনে হয় তুমি রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের দারিদ্র ও নিঃস্বতার কথা ভুলিয়া গিয়াছ। আল্লাহর শপথ, আখেরাতে আনন্দ লাভ করার পূর্ব পর্যন্ত আমি তাঁহার পদাংক অনুসরণ করিয়া চলিব। এই কথা বলিয়া তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের দারিদ্রের কথা বর্ণনা করিতে লাগিলেন। শুনিয়া শেষ পর্যন্ত হাফছা (রা) রোদন করিতে শুরু করেন।
একবার ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রা) তাঁহাকে দাওয়াত করিয়াছিলেন। খাইতে বসিয়া কিছু উৎকৃষ্ট খাদ্য দেখিতে পাইয়া হাত উঠাইয়া বলিতে লাগিলেন, “যাঁহর হাতে আমার জীবন তাঁহার শপথ, তোমরা যদি রসূলুল্লাহর (সা) পথ পরিত্যাগ কর, তবে বিভ্রান্ত হইয়া যাইবে।
হযরত আহওয়াস (রা) হইতে বর্ণিত আছে, একদা হযরত ওমরের সম্মুখে ঘৃতে পাক করা গোশ্ত দেওয়া হইল। তিনি খাইতে অস্বীকার করিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, এখনই তোমরা দুই তরকারি একত্রিত করিয়া ফেলিলে। একটি ঘৃত আর একটি গোশত। একটিতে যখন খাওয়া চলিত তখন দুইটি একত্রিত করিয়া ফেলার কি প্রয়োজন ছিল?
সাহাবীগণ তাঁহার শরীরে কখনও গরম কাপড় দেখেন নাই। তাঁহার জামায় একত্রে বারটি পর্যন্ত তালি লাগাইয়াছিলেন। মাথায় ছেঁড়া জীর্ণ পাগড়ি থাকিত। ছেঁড়া ফাটা জুতা পায়ে দিতেন। এই অবস্তায় পারস্য বা রোম সম্রাটের দূতদের সাক্ষাত দান করার সময় মুসলমানগণ লজ্জিত হইয়া পড়িতেন, কিন্তু তাঁহার মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা যাইত না।
একবার হযরত আয়েশা ও হযরত হাফছা (রা) মিলিতভাবে বলিলেন, আমীরুল মোমেনীন, আল্লাহ আপনাকে মর্যদা দান করিয়াছেন, বড় বড় সম্রাটের দূত আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসেন; এমতাবস্থায় আপনার জীবনযাত্রর একটু পরিবর্তিত হওয়া উচিত। জওয়াবে তিনি বলিলেন, আক্ষেপের বিষয়, তোমরা উভয়ে রসূলে খোদার (সা) সম্মানিতা সহধর্মিনী হওয়া সত্ত্বেও আমাকে দুনিয়ার প্রতি উৎসাহিত করিতেছ! তাঁহর নিকট তো একটি মাত্র কাপড় থাকিত, দিনের বেলায় তিনি তাহা বিছাইতেন, রাত্রে গায়ে দিতেন। হাফ্ছা, তোমরা কি স্মরণ নাই, একদা তুমি রসূলুল্লাহর (সা) বিছানা বদলাইয়া দিয়াছিলে আর সেই বিছানায় শুইয়া তিন ভোর পর্যন্ত নিদ্রিত রহিলেন। নিদ্র হইতে জাগিয়া তোমাকে বলিয়াছিলেন, হাফছা, তুমি এ কি করিলে? আমার বিছানা বদলাইয়া দিলে আর আমি সকাল পর্যন্ত ঘুমাইয়অ রহিলাম। দুনিয়ার আরাম-আয়েশে আমার প্রয়োজন কি? বিছানা নরম করিয়া দিয়া তুমি কেন আমাকে অচেতন রাখিলে?
একবার জামা ছিঁড়িয়া গেলে তিনি তালির উপর তালি লাগাইতেছিলেন। হযরত হাফ্ছা (রা) উহাতে বারণ করিলে বলিতে লাগিলেন,- হাফছা, আমি মুসলমানদের সম্পদ হইতে ইহার অধিক ভোগ করিতে পারি না।
জিনিসের দর-দাম যাচাই করার জন্য কখনও কখানও তিনি বাজারে যাইতেন। তখন পথে পড়িয়া থাকা পরাতন রশি, খেজুরের বীচি ইত্যাদি উঠাইয়া লোকের বাড়ীতে ছুঁড়িয়অ দিতেন; যেন উহা পুনরায়অ ব্যবহার করা চলে।
একদা উৎবা ইবনে ফারদাত তাঁহর নিকট আগমন করিলেন। সিদ্ধ গোশ্ত এবং শুকনা রুটি তাহার সম্মুখে দেওয়া হইয়াছিল; আর তিনি জোর করিয়া তাহা গলাধঃকরণ করিতেছিলেন। উৎবা থাকিতে না পারিয়া বলিতে লাগিলেন, আমীরুল মোমেনীন, আপনি যদি খাওয়া-পরায় আরো কিছু বেশী খরচ করেন, তবে ইহাতে মুসলিম জাতির সম্পদ মোটেই কমিয়া যাইবে না। ওমর (রা) বলিলেন- আফসোস, তোমরা আমাকে আরামপ্রিয়তা প্রতি উৎসাহিত করিতেছ। রবী ইবনে যিয়াদ বলিলেন- আমীরুল মোমেনীন, আল্লাহ আপনাকে যে মর্যাদা দান করিয়াছেন, তাহাতে আরাম-আয়েশ অবশ্যই করিতে পারেন। এই বার তিনি রাগান্বিত হইয়া বলিতে লাগিলেন-“আমি জাতির আমানতদার, আমানতে খেয়ানত জায়েয আছে কি?”
খলিফা তাঁহার বিরাট পরিবারের জন্য বাইতুল মাল হইতে রোজ মাত্র দুই দেরহাম গ্রহণ করিতেন! একবার হজ্বের সফরে সর্বমোট ৮০ দেরহাম খরচ হইল। ইহাতে তিনি অনুতাপ করিতেছিলেন, আমার দ্বারা অপব্যয় হইয়া গেল। বাইতুল মালের উপর যাহাতে চাপ না আসে এই জন্য তিনি ছেঁড়া জীর্ণ কাপড়ে পর্যন্ত তালি দিতেন।
একদিন খলিফা জুমার খুৎবা দেওয়ার জন্য মিম্ব দাঁড়াইলেন। হযরত হাসান (রা) শুনিয়া দেখিলেন, তাঁহর জামায় মোট ১২টি তালি দেওয়া রহিয়াছে। আবুল উসমান বলেন, আমি খলিফার পাজামা দেখিয়াছি, উহাতে চামড়ার তালি দেওয়া ছিল।
একবার বাহরাইন হইতে গনীমতের মাল আসিল। উহাতে মেশ্ক ও আম্বর ছিল। খলিফা এমন একজন দক্ষ ওজনবিশারদ খোঁজ করিতেছিলেন, যিনি অত্যন্ত নিপণতার সহিত এই সব বণ্টন করিতে পারেন। বিবি আসিয়া নিবেদন করিলেন, আমি এই কাজ করিতে পারিব। খলিফা বলিলেন, আকেলা, আমি তোমার দ্বারা এই কাজ করাইতে পারিব না। মেশ্ক্ আম্বর বণ্টন করার সময় তোমার হাতে যাহা লাগিয়া থাকিবে তাহা যদি শরীরে ঘষিয়া ফেল. তবে আমাকেই উহার জবাবদিহি করিতে হইবে।
একদা দ্বিপ্রহরের রৌদ্রে মাথার উপর চাদর ফেলিয়া খলিফা মদীনার বাহিরে কোথাও গিয়াছিলেন। ফিরিয়া আসার সময় এক ক্রীতদাসকে গাধার উপর আরোহণ করিয়া আসিতে দেখিলেন। পরিশ্রান্ত খলিফা আরোহণের ইচ্ছা প্রকাশ করিলে ক্রীতদাস গাধা হইতে নামিয়া বাহন গাধাটি তাঁহাকে দিয়া দিল। খলিফা বলিলেন, তুমি বসিয়া থাক, আমি তোমার পশ্চাতে আরোহণ করিয়া যাইতেছি। শেষ পর্যন্ত এইভাবেই তাঁহারা মদীনার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। মদীনাবাসীগণ আশ্চার্যন্বিত হইয়া দেখিলেন, আমীরুল মোমেনীন এক ক্রীতদাসের পশ্চাতে গাধায় আরোহণ করিয়া আসিতেছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কয়েক বারই তাঁহকে সরকারীভাবে সফর করিতে হইয়াছে, কিন্তু কোন সময়ই তিনি তাঁবু পর্যন্ত সঙ্গে নেন নাই। বরাবরই গাছের নীচে বসিয়া বিশ্রাম করিতেন এবং মাটিতে বিছানা বিছাইয়া শয়ন করিতেন। দ্বিপ্রহরে বিশ্রামের প্রয়োজন হইলে বৃক্ষ শাখায় কম্বল টানাইয়া ছায়া করিয়া লইতেন।
হিজরী ১৮ সনে আরবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই সময় হযরত ওমরের অস্থিরতা ছিল বেদনাদায়ক। গোশ্ত ঘৃত প্রভৃতি সর্বপ্রকার ভাল ভাল খাদ্য তিনি পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। একদিন তাঁহার পুত্রের হাতে তরমুজ দেখিতে পাইয়া ভীষণ রাগান্বিত হইলেন। বলিতে লাগিলৈন- মুসলিম জনসাধারণ আনাহারে মরিতেছে আর তুমি ফল খাইতেছ! ঘৃত ত্যাগ করিয়া জয়তুন তৈল ব্যবহরের ফলে একদিন পেটে পীড়া দেখা দিল। তিন পেটে আঙ্গুল রাখিয়া বলিতে লাগিলেন, যে, পর্যন্ত দেশে দুর্ভিক্ষ বিদ্যমান থাকে, তোমাকে ইহাই গ্রহণ করিতে হইবে।
ইকরেমা ইবনে খালেদ বলেন, একদা মুসলমানদের এক প্রতিনিধিদল যাইয়া খলিফাকে বলিলেন, যদি আপনি একটু ভাল খাদ্য গ্রহণ করেন তবে আল্লাহর কাজে আরও শক্তি পাইবেন। তিন জিজ্ঞাসা করিলেন, ইহা কী তোমাদের ব্যক্তগত ধারণা, না মুসলিম সাধারণের সম্মিলিত অভিমত? বলা হইল, ইহা মুসলিম সাধারণেরই অভিমত। তখন বলিলেন, আমি তোমাদের সমবেদানার জন্য কৃতজ্ঞ। তবে আমি আমর অগ্রগামীদ্বয়ের রাজপথ পরিত্যাগ করিতে পরি না। তাঁহাদের সান্নিধ্য আমর জন্য এখানকার আরামের চাএত বেশী লোভনীয়!
যে সমস্ত লোক যুদ্ধের ময়দানে চলিয়অ যাইতনে, খলিফা তাহাদের বাড়ী বাড়ী যাইয়া খোঁজন নিতেন, প্রয়োজনীয় বাজার সওদা পর্যন্ত নিজ হাতে আনিয়া দিতেন। সৈন্যদের কোন চিঠি আসিলে স্বয়ং বাড়ী বাড়ী যাইয়া বিলাইয়া দিতেন। বাড়ীর লোকেরা যে খবর দিত তাহা নিজ হাতে লিখিয়া চিঠির জওয়াব দিতেন।
হযরত তাল্হা (রা) এর বর্ণনা, একদিন প্রত্যূষে আমার ধারণ হইল, সম্মুখের কুটিরে হযরত ওমর (রা) তশরীফ আনিয়াছেন। আবার মনে হইল, আমীরুল মোমেনীন এখানে কি করিতে আসিবেন? খবর লইয়া জানা গেল, এখানে একজন অন্ধ বৃদ্ধা বাস করেন, হযরত ওমর (রা) প্রত্যেহ খবর লওয়ার জন্য আগমন করিয়া থাকেন।
এই ছিল হযরত ওমরের নিত্যকার কর্ম তালিকা। আল্লাহর প্রতি সীমাহীন ভয়’ মুসলমানদের অসীম সেবা এবং দিনরাত্রে অন্তহীন ব্যস্ততা লাগিয়াই থাকিত। তদুপরি এক রাত্রিও আরাম করিয়া শুইতেন না বা এক বেলাও তৃপ্তির সহিত আহার করিতেন না। ফল এই দাঁড়াইল, তাঁহার সুঠাম দেহ দিন দিন দুর্বল হইয়া চলিল, শক্তি হ্রাসপ্রাপ্ত হইল। শরীর ধীরে ধীরে কৃশ হইয়া গেল। বার্ধক্যের বহু পূর্বেই বৃদ্ধের ন্যায় সামর্থ্যহীন হইয়া পড়িলেন। এমতাবস্থায় অধিকাংশ সময় বলিতেন, যদি কোন ব্যক্তি খেলাফতের এই গুরুদায়িত্ব বহন করিতেন, তবে খলিফা হওয়ার চাইতে বরং দেহ হইতে আমার মস্তক পৃথক করিয়া দেওয়াকেই আমি আনন্দের সহিত গ্রহণ করিতাম।
হিজরী ২৩ সনে কেরমান, সজেস্তান, মাকরান, ইস্পাহান প্রভৃতি স্থান বিজিত হয়। তখন ইসলামী রাষ্ট্রের আয়তন মিসর হইতে বেলুচিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া গিয়াছিল। এই বৎসরই তিনি শেষবারের মত হজ্ব করিলেন। হজ্ব হিইতে প্রত্যাবর্তনের পথে একস্থানে প্রচুর পরিমাণ কঙ্কর একত্রিত করতঃ উহার চাদর বিছাইয়া শুইয়া পড়িলেন এবং উপর দিকে দুই হাত তুলিয়া বলিতে লাগিলেনঃ
“খোদাওয়অন্দ, এখন আমর বয়স বাড়িয়া গিয়াছে। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজারা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছে। এখন তুমি আমাকে এমনভাবে উঠাইয়া লও যেন আমার আমল বরবাদ না হয় এবং আমর বয়সের সীমা স্বাভাবিকতা গণ্ডি অতিক্রম না করে।”
শাহাদাতে পটভূমি
একদা কা‘ব আল-আহ্বার খলিফাকে বলিলেন, আমি তাওরাতে দেখিয়াছি, আপনি শহীদ হইবেন। খলিফা বলিলেন, এ কি করিয়া সম্ভব, আরব থাকিয়াই আমি শহীদ হইব?
সঙ্গে সঙ্গে দোয়া করিলেন, “হে আল্লাহ, আমাকে তোমার পথে শহীদ কর এবং তোমার প্রিয় রসূলের (রা) মদীনায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সুযোগ দাও।”
একদিন জুমার খুৎবায় বলিতে লাগিলেন- আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি, একটি পাখী আসিয়া আমার মাথার উপর ঠোকর মারিয়াছে। এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা হইতেছে আমার মৃত্যু নিকটবর্তী। আমার জাতি দাবী করিতেছে, আমি যেন আমার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচিত করিয়া যাই। স্মরণ রাখিও, আমি মৃত্যু বা খেলাফত কোনটিরই মালিক নই। আল্লাহ স্বয়ং তাঁহার দ্বীন ও খেলাফরেত রক্ষক। তিনি উহা কখনও বিনষ্ট করিবেন না।
যুহরী বলেন, হযরত ওমর (রা) নির্দেশ দিয়াছিলেন, কোন প্রাপ্তবয়স্ক মোশরেক মদীনায় প্রবেশ করিতে পারিবে না। এই ব্যাপারে কুফার শাসনকর্তা হযরত মুগীরা ইবন শো‘বা (রা) তাঁহাকে লিখিয়া জানাইলেন, এখানে ফিরোজহ নামক এক বিচক্ষণ যুবক রহিয়াছে। সে সূত্রধর ও লৌহ শিল্পের খুব ভাল কাজ জানে। আপনি যদি তাজাকে মদীনায় প্রবেশের অনুমতি দেন, তবে সে মুসলমানদের অনেক কাজে লাগিতে পারে। হযরত ওমর (রা) তাহাকে মদীনায় প্রবেশের অনুমতি দিলেন। ফিরোজ মদীনায় প্রবেশ করিয়াই খলিফার নিকট অভিযোগ করিল, হযরত মুগীরা (রা) আমার উপর অযথা কর ধার্য করিয়া রাখিয়অছেন, আপনি তাহা হ্রাস করিয়া দিন।
হযরত ওমর (রা) জিজ্ঞাসা করিলেন, কত কর ধার্য করা হইয়অছে?
ফিরোজ জবাব দিল- দৈনিক দুই দেরহাম
হযরত ওমর (রা) বলিলেন,-তোমার পেশা কি?
ফিরোজ বলিল, -কাষ্ঠ চিত্র ও লৌহ শিল্প।
ওমর (রা) বলিলেন,- পেশার তুলনায় এই পরিমাণ কর মোটেই অধিক নহে।
ফিরোজের পক্ষে এই উত্তর সহ্যাতীত ছিল। সে ক্রোধে অধীর হইয়া বাহিল হইয়া গেল এবং বলিতে লাগিল- আমীরুল মোমেনীন আমি ব্যতীত আর সকলের প্রতি ন্যায় বিচার করেন। কিছুদিন পর হযরত ওমর (রা) ফিরোজকে পুনরায় ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- আমি শুনিতে পাইলাম, তুমি এমন এক প্রকার চক্র তৈয়ার করিতে পার যাহা বায়ুর সাহায্যে চলিতে পারে। ফিরোজ একটু ব্যঙ্গ করিয়া জওয়াব দিল- আমি আপনার জন্য এমন চক্র তৈয়ার করিব যাহা এখানকার লোক কখনও ভুলিবে না। ফিরোজ চলিয়া গেলে পর ওমর (রা) বলিলেন- এই যুবক আমাকে হত্যার হুমকি দিয়া গেল।
দ্বিতীয় দিন ফিরোজ একটি দুইধারী খঞ্জর আস্তিনে লুকাইয়া প্রত্যুষে মসজিদে উপস্থিত হইল। মসজিদের কিছু লোক নামাযের কাতার ঠিক করিতে নিযুক্ত ছিলেন। নামাযের কাতার যখন ঠিক হইয়া যাইত তখনই সাধারণতঃ হযরত ওমর (রা) তশরীফ আনিতেন এবং ইমামত করিতেন। এই দিনও তদ্রূপ হইল। কাতার ঠিক হইয়া যাওয়ার পরই ওমর (রা) ইমামতের জন্য অগ্রসর হইলেন। নামায শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ফিরোজ আসিয়া উপর্যুপরি খড়গ দ্বারা ছয়টি আঘাত করি।, তন্মধ্যে একটি আঘাত নাভির নীচদেশে মারাত্মকরূপে বিঁধিয়া গেল।
দুনিয়া এই মারাত্মক মুহূর্তেও খোদাভীতির এক নূতন দৃশ্য দেখিল। আহত হযরত ওমর (লা) যখন ঢলিয়া পড়িতেছিলেন, তখন তিনি হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফকে হাতে ধরিয়া ইমামের স্থানে দাঁড় করাইয়া দিলেন এবং স্বয়ং সেই স্থানে পড়িয়াই কাতরাইতে লাগিলেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ এই অবস্থায়ই নামায পড়াইলেন। আমীরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (রা) সম্মুখে পড়িয়া কাতরাইতে ছিলেন। ফিরোজ আরো কয়েকজনকে আহত করিয়া শেষ পর্যন্ত ধরা পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গেই আত্মহত্যা করিয়া ফেলিল।
আহত হযরত ওমর ফারুককে উঠাইয়া গৃহে আন হইল। সর্বপ্রথম তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহার আততায়ী কে? লোকেরা বলিল, ফিরোজ! এই কথা শুনিয়া পবিত্র চেহারা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তুপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া মুখে বলিতে লাগিলেন, আল্লাহর শোকর আমি কোন মুসলমানের হাতে নিহত হইতেছি না।
লোকেরা ধারণা ছিল, আঘাত তত মারাত্মক নহে, হত সহজেই আরোগ্য হইয়া যাইবেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন চিকিৎসকও ডাকা হইল। চিকিৎসক খেজুরের রস এবং দুধ পান করাইলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উহা আঘাতের স্থান দিয়া বাহির হইয়া আসিল। ইহাতে মুসলমানদের মধ্যে নৈরাশ্য দেখা দিল। সকলেই বুঝিলেন, হযরত ওমর (রা) আর দুনিয়ায় থাকিবেন না।
এমন মনে হইতেছিল, হযরত ওমর (রা) যেন একা আহত হন নাই, সমগ্র মদীনাবাসীই আহত হইয়াছেন, মুসলিম খেলাফত আহত হইয়া গিয়াছে। সর্বোপরি পবিত্র ইসলাম যেন আহত হইয়া পড়িয়াছে। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে লোকে তাঁহাকে দেখিতে আসিত এবং পঞ্চমুখে তাঁহার প্রশংসাকীর্তন করিত। তিনি তখন বলিতেছিলেন, আমার নিকট যদি আজ সমগ্র দুনিয়ার স্বর্ণও মওজুদ থাকিত, তবে তাহাও কেয়ামতে ভীতি হইতে মুক্তি পাইবার জন্য বিলাইয়া দিতা।
খলিফা নির্বাচন সমস্যা
হযরত ফারুকে আজম (রা) যে পর্যন্ত মুসলমানদের চোখের সম্মুখে ছিলেন, সেই পর্যন্ত তাঁহাদের অন্তরে নূতন খলিফা নির্বাচনের কোন খেয়ালই উদয় হয় নাই। তাঁহার মনে করিতেন, ইসলামের এই আদর্শ সেবকই বোধ হয় দীর্ঘকাল ধরিয়া রসূলের উম্মতের রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া যাইবেন। হযরত ফারুক (রা) যখন শয্যা গ্রহণ করিলেন তখনই তাহাদের অন্তরে অসহায় ভাব এবং নিদারুণ নিঃসঙ্গতা অনুভূত হইতে শুরু করিল। এই মুহূর্তে সকল মুসলমানেরই ভাবনা ছিল, অতঃপর কে মুসলিম জাতির অভিভাবক হইবেন? যত লোক খলিফাকে দেখিতে আসিতেন, সকলেই একই অনুরোধ করিতেছিলেন, “আমীরুল মোমেনীন, আপনার স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করিয়া যান।” খলিফা মুসলমানদের এই তাকিদ শুনিতেছিলেন এবং নিরুত্তর হইয়া ভাবিতেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বলিলেন, তোমরা কি চাও, মৃত্যুর পরও এই সমস্যা হইতে এমনভাবে দূরে থাকি, যেন আমর পাপগুলির সহিত অর্জিত পুণ্য সমতা রক্ষা করিতে পারে।
হযরত ফারুকে আজম (রা) অবশ্য দীর্ঘকাল হিইতেই খেলাফত-সমস্যার উপর চিন্তা করিতেছিলেন। লোকে রা অনেক সময় তাঁহাতে একান্তে বসিয়া ভাবিতে দেখিয়াছে। প্রশ্ন করিলে বলিতেন, আমি খেলাফতের সমস্যা নিয়া ভাবিতেছি। বার বার ভাবনার পরও তাঁহার বিচক্ষণ দৃষ্টি কোন বিশেষ ব্যক্তির উপর নিবদ্ধ হইতেছিল না। অনেক সময়ই তাঁহার মুখ হইতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বাহির হইয়া আসিত। বলিতেন, আফসোস! এই গুরুদায়িত্ব বহন করার মত কোন লোক যে আমি খুঁজিয়া পাইতেছি না।
এক ব্যক্তি নিবেদন করিলেন, আপনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে কেন খলিফা নিযুক্ত করিতেছেন না? জবাবে তিনি বলিলেন, আল্লাহ তোমরা সর্বনাশ করুন। আল্লাহর শপথ, আমি কখনও তাহার নিকট এইরূপ কামনা করি নাই। আমি কি এমন এক ব্যক্তিকে খলিফা নিযুক্ত করিব, যাহার মধ্যে স্বীয় স্ত্রীকে ঠিকমত তালাক দেওয়ার যোগ্যতাও বিদ্যমান নাই।
এই প্রসঙ্গে আরো বলিলেন : আমিআমার সাথীগণকে খলিফা হওয়ার লোভে নিমগ্ন দেখিতেছি। যদি আবু হোযাইফার মুক্তি দেওয়া ক্রীতদাস সালেম অথবা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ জীবিত থাকিতেন, তবে আমি তাহাদের সম্পর্কে কিছু বলিয়া যাইতে পারিতাম। এই উক্তি হইতে মনে হয়, খেলাফতের সমস্যা হইতে দূরে থাকিয়াই তিন দুনিয়া পরিত্যাগ করিতে চাহিতেন, কিন্তু মুসলমানদের তাকিদ দিনিই বর্ধিত হইতেছিল। শেষে তিনি বলিলেন, “আমার মৃত্যুর পর ওসমান, আলী, তালহা, যুবাইর, আবদুর রহমান ইবনে আউফ এবং সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস তিন দিনের মধ্যে যাঁহাকে নির্বাচিত করিবেন, তাঁহাকেই যেন খলিফা নিযুক্ত করা হয়।”
আখেরাতের প্রস্তুতি
শেষ মুহূর্তে তিনি পুত্র আবদুল্লাহকে ডাকিয়া বলিলেন, আবদুল্লাহ, হিসাব করিয়া দেখ আমার উপর কি পরিমাণ ঋণ রহিয়াছে। হিসাব করিয়া বলা হইল, ৮৬ হাজার দেরহাম। বলিলেন, এই ঋণ আমার পরিবারের সম্পত্তি দ্বারা গ্রহণ করিও। যদি তাহাতেও না হয় তবে কোরায়শ গোত্র হইতে সাহায্য চাহিও।
হযরত ওমরের জনৈক ক্রীতদাস নাফে (রা) হইতে বর্ণিত আছে, তাঁহার উপর ঋণ কেন থাকিবে? মৃত্যুর পর তাঁহার এক এক উত্তরাধিকারী এক লক্ষ টাকার সম্পত্তি পাইয়াছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে, হযরত ওমরের একটি গৃহ হযরত আমির মোয়াবিয়ার নিকট বিক্রয় করিয়া তাঁহার সমুদয় ঋণ পরিশোধ করা হইয়াছিল। ঋণ পরিশোধের পর বলিলেন, তুমি এখনই মুসলিম জননী হযরত আয়েশার নিকট যাও এবং তাঁহর নিকট আবেদন জানাও, ওমর তাঁহর পূর্ববর্তী দুই বন্ধুর নিকট সমাহিত হইতে চাহে। তাঁহাকে অনুমতি দেওয়া হউক। আবদুল্লাহ৯ ইবনে ওমর (রা) খলিফার এই আবেদন হযরত আয়েশার নিকট পৌঁছাইলেন। আয়েশা (রা) সমবেদনায় বিগলিত হইয়া বলিলেন, এই স্থান আমি নিজের জন্য রক্ষিত রাখিয়াছিলাম, কিন্তু আজ আমি ওমরকে নিজের উপর প্রাধান্য দিতেছি। পুত্র যখন তাঁহাকে হযরত আয়েশার মঞ্জুরীর খবর শুনাইলেন, তখন নিতান্ত খুশী এই শেষ আরজুয পূর্ণ হওয়ার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন।
তখন হইতে মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হইল। এই অবস্থায়ই লোকদিগতে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন- যে ব্যক্তি অতঃপর খলিফা নির্বাচিত হইবেন, তাঁহাকে পাঁচটি দলের অধিকার সম্পর্কে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। ইহারা হইতেছেনঃ মোহাজের, আনসার, বেদুঈন, যে সমস্ত আরব অন্যান্য স্থানে যাইয়া বসবাস শুরু করিয়াছেন, এবং যিম্মী প্রজা। তৎপর প্রত্যেক দলের অধিকারের বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। যিম্মী বা সংখ্যালঘু প্রজাদের সম্পর্কে বলিলেন, “আমি পর্বর্তী খলিফাকে অসিয়ত করিয়া যাইতেছি, তিনি যেন আল্লাহর রসূলের যিম্মাদার মর্যাদা রক্ষা করেন। যিম্মীদের সঙ্গে কৃত সমস্ত অঙ্গীকার যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। তাহাদের শত্রুদের যেন দমন করা হয় এবং তাহাদের সাধ্যাতীত কোন কষ্ট নে না দেওয়া হয়।”
মৃত্যুর সামান্য পূর্বে স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহকে বলিলেন, আমার কাফনে যেন কোন প্রকার আড়ম্বর করা না হঃয়। আমি যদি আল্লাহর নিকট ভাল বলিয়া বিবেচিত হই তবে ভাল পোশাক এমনিতেই পাইব্ আর যদি মন্দ বিবেচিত হই তবে ভাল কাঠন কোন কাজে আসিবে না।
পুনরায় বলিলেন , “আমার জন্য যেন দীর্ঘ ও প্রশস্ত কবর খনন না করা হয়। কারণ, আল্লাহর নিকট যদি আমি অনুগ্রহপ্রাপ্তির যোগ্য হই, তাহা হইলে স্বাভাবিকভাবেই আমার কবর বিস্তৃত হইয়া যাইবে। আর যদি অনুগ্রহপ্রাপ্তির যোগ্য না হই, তবে কবরের বিস্তৃতি আমাকে শাস্তির সংকীর্ণতা হইতে কিছুতেই মুক্তি দিতে সক্ষম হইবে না। আমার জানাযার সহিত যেন কোন নারী গমন না করে, কোন প্রকার অতিরঞ্জিত গুণাবলী দ্বারাও যেন আমারকে স্মরণ করা না হয়। জানা প্রস্তুত হইয়া যাওয়ার পর যথসম্ভব শীঘ্র যেন আমাকে কবরে রাখিয়া দেওয়া হয়। আমি যদি রহমত পাওয়ার যোগ্য হই, তবে আমাকে আল্লাহর রহমতের মদ্যে সথা সম্ভব তাড়াতাড়ি প্রেরণ করাই উচিত হইবে। আর যদি আযাবের যোগ্য হই, তবুও একটি মন্দ লোকের বোঝা যতশীঘ্র নিক্ষেপ করা যায় ততই মঙ্গল।” এই বেদনাময় অসিয়তের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহর শেষ মুহূর্ত ঘনাইয়া আসিল। অত্যন্ত স্বাভাবি অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এটা ২৩ হিজরীর যিলহাজ্জ মাসের একেবারের শেষ দিকের ঘটনা। তখন তাঁহর বয়স হইয়াছিল ৬৩ বৎসর। হযরত সোয়াওয়াব জানাযার নামায পড়ান। হযরত আবদুর রহমান. ওসমান, হযরত তালহা, হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) মুসলিম জাহানের এ উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পার্শ্বে চিরনিদ্রায় শোয়াইয়া দেন। ইন্না ল্লিাহি ওয়া ইন্ন ইলাইহে রাজেউন হযরত ওমর ফারুকের শাহাদাত মুসলমানদের হৃদয়ে যে বেদনার সৃষ্টি করিয়াছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। প্রত্যেক মুসলমান প্রাণ ভরিয়া তাঁহাদের এই মহান নেতার জন্য অশ্রু বিসর্জন করিয়াছিলেন। হযরত উম্মে আয়মান (রা) বলেন,- “যেই দিন হযরত মওর (রা) শহীদ হইলেন, সেই দিন হইতেই ইসলাম দুর্বল হইয়া গিয়াছে।”
হযরত আবু উমামা (রা) বলেন,- “হযরত আবু বকর সিদ্দিক ও হযরত ওমর (রা) যেন ইসলামের পিতামাতা ছিলেন,- তাঁহাদের বিদায় হইয়া যাওয়ার পর ইসলাম যেন এতীম হইয়া গেল। আল্লাহ বলেন, -তাঁহার মরিয়া যান নাই, বরং জীবিত আছেন এবং সর্বদা জীবিত থাকিবেন।”