মৃত্যুর দুয়ারে হযরত আমর ইবনুল আস
হযরত আমর ইবনুল আসের বীরত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিজয় কাহিনীতে ইতিহাসের পাতা সমৃদ্ধ হইয়া আছে। মুসলমানদের মিসর বিজয় তাঁহারই দূরদর্শিতা ও অপূর্ব বিচক্ষনতার ফল। উমাইয়া বংশের খোলাফত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁহার ভূমিকাই ছিল প্রধান। সমকালীন রাজনীতিতে তিনি সর্বদা অগ্রনী ছিলেন। ঐতিহাসিকগণের সর্বসম্মত অভিমত, আরবের তদানীন্তন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তিন ব্যক্তির মস্তিষ্কে আসিয়া সমবেত হইয়াছিল। আমর ইবনুল আস, মোয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান ও যিয়াদ ইবনে আবিহে। ঘটনাক্রমে এই তিন মনীষীই একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাইয়াছিলেন। তাঁহারা মিলিয়া রাজনৈতিক সূক্ষ্ম বুদ্ধি দ্বারা ইসলামী ইতিহাসের ধারা সম্পুর্ণ ভিন্ন পথে প্রবাহিত করিয়া দেন। হযরত আলী (রা) এবং খেলাফতে রাশেদার শক্তিকে কেবলমাত্র আমীর মোয়াবিয়াই পরাজিত করেন নাই, উহাতে আমর ইবনুল আসের মস্তিষ্ক ছিল সবচাইতে বেশী কার্যকর। এহেন একজন রাজনৈতিক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কোন অবস্থায় মৃত্যুকে স্বাগত জানাইয়া ছিলেন, নিম্নে আমরা সংক্ষেপে তাহাই বর্ণনা করিব।
একটি আশ্চর্য প্রশ্ন
আরবের এই বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ মৃত্যুশয্যায় শায়িত হইয়া অনুভব করিলেন, জীবনের কোন আশাই আর নাই। তখন তিনি স্বীয় দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান ও কতিপয় বিশিষ্ঠ সৈনিককে আহ্বান করিলেন। শুইয়া শুইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন : “আমি তোমাদের কেমন সঙ্গী ছিলাম?“ সকলে এক বাক্যে উত্তর দিলেন : সুবহানাল্লাহ, আপনি অত্যন্ত দয়াবান নেতা ছিলেন, প্রাণ খুলিয়া আমাদিগকে দান করিতেন, সর্বদা খুশি রাখিতেন। এই কথা শুনিয়া ইবনে আস গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলেন, “এই সব কেবল আমি এই জন্য করিতাম যেন তোমরা আমাকে মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করিতে পার। তোমরা আমার সৈনিক ছিলে, আমি তোমাদের নেতা ছিলাম। শত্রুদের আক্রমণ হইতে আমাকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব তোমাদের উপর ন্যস্ত থাকিত, কিন্তু মৃত্যুদূত এখনই আমার জীবন শেষ করার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে। অগ্রসর হও এবং তাহাকে বিতাড়িত কর।” এই কথা শুনিয়া সকলে একে অপরের মুখ দেখিতে থাকিল। কাহারও মুখে কোন উত্তর আসিতেছিল না। কিছুক্ষণ পর তাহারা বলিল, “জনাব, আমরা আপনার মুখ হইতে এই রকম অবান্তর কথা শোনার জন্য কখনও প্রস্তুত ছিলাম না। আপনি ভালভাবেই জানেন, মৃত্যুর সম্মুখে আমরা আপনার কোন কাজেই আসিতে পারিনা।”
ইবনে আস দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, “আল্লাহর শপথ, এই সত্য আমি ভালভাবেই জানিতাম। তোমরা আমাকে মৃত্যুর হাত হইতে কখনও বাঁচাইতে পারিবে না, কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, পূর্বে হইতেই যদি আমি এ কথা ভাবিতে পারিতাম। পরিতাপ, তোমাদের কাহাকেও যদি আমার ব্যক্তিগত রক্ষিবাহিনীতে না রাখিতাম। হযরত আলীর মঙ্গল হউক, তিনি কি চমত্কার বলিতেন, “মানবের শ্রেষ্ঠ রক্ষক তাহার মৃত্যু।”- ( তাবাকাতে ইবনে সাদ)
প্রাচীরের দিকে মুখ করিয়া ক্রন্দন
এক বর্ণনাকারী বলেন, আমি আমর ইবনুল আসকে দেখিতে গিয়াছিলাম, তিনি মৃত্যুযন্ত্রনায় আক্রান্ত ছিলেন। হঠাত তিনি প্রাচীরের দিকে মুখ ফিরাইয়া অঝোরে কাঁদিতে লাগিলেন। তাঁহার পুত্র আবদুল্লাহ জিজ্ঞাস করিলেন; আপনি ক্রন্দন করিতেছের কেন? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কি আপনাকে এই সমস্ত সুসংবাদ দেন নাই? অতপর তিনি সুসংবাদগুলি শুনাইতে লাগিলেন, কিন্তু ইবনে আস মাথায় ইশারা করিয়া আমার দিকে ফিরিয়া বলিতে লাগিলেন, আমার নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হইতেছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ কালেমার সাক্ষ্য।
জীবনে আমি তিনটি স্তর অতিক্রম করিয়াছি। একসময় এমন ছিল, যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর চাইতে বেশী আন্তরিক শত্রুতা আর কাহারও সহিত পোষণ করিতাম না। আমার সর্বশ্রেষ্ঠ আকাঙ্খা ছিল, যে কোন উপায়ে যদি রাসূলুল্লহ (সা) কে হত্যা করিতে পারিতাম। এই অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হইত, তবে নিঃসন্দেহে জাহান্নামে যাইতে হইত।
তত্পর এমন এক সময় আসিল, যখন আল্লাহ আমার অন্তরে ইসলামের আলো দিলেন, আমি রাসূলুল্লা (সা) এর খেদমতে হাযির হইয়া নিবেদন করিলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! হাত বাড়ান আমি আনুগত্যের শপথ করিতেছি। তিনি পবিত্র হাত বাড়াইলেন, কিন্তু আমি হাত টানিয়া নিলাম। আল্লাহর রাসূল (সা) বলিলেন, আমর, তোমার কি হইল। আমি নিবেদন করিলাম, একটি শর্ত আরোপ করিতে চাই! রাসূলে খোদা (সা) বলিলেন, তোমার শর্ত কি? নিবেদন করিলাম, আমাকে পূর্ণভাবে আন্তরিক সান্ত্বনার কথা দিন। তিনি বলিলেন, হে আমর, তুমি কি জান না, ইসলাম তত্পূর্ববর্তী সকল গোনাহের অবসান ঘোষণা করে। অনুরূপ হিজরত এবং হজ্বও পূর্ববর্তী গোনাহ দূর করিয়া দেয় ( ইবনে আসের এই বিখ্যাত উক্তি বোখারী ও মুসলিম উভয়েই বর্ণনা করিয়াছেন)
এই সময় আমি লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, আমার নজরে রাসূলুল্লাহ (সা) এর চাইতে অধিক প্রিয় ব্যক্তি আর কেহ রহিল না। তাঁহার চাইতে অধিক সম্মানিত ব্যক্তি বলিয়া আর কাহাকেও মনে হইল না।
আমি সত্য বলিতেছি, কেহ যদি আমেকে আল্লাহর রাসূলের (সা) শরীরের গঠন সম্পর্কে জিজ্ঞাস করে, তবে আমি ঠিকমত বলিতে পারিব না। কারণ, অত্যাধিক মর্যাদাবোধের দরুন আমি কখনও তাঁহার দিকে ঠিকমত চোখ তুলিয়া পর্যন্ত চাহিতে পারিতাম না। এই অবস্থায় যদি মৃত্যুবরণ করিতাম, তবে নিশ্চিতভাবে জান্নাতের অধিকারী হইতে পরিতাম। তত্পর এমন এক সময় আসিল যখন এদিন সেদিক অনেক কিছুই করিয়াছি। এখন নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারি না, আমার পরিণতি কি হইবে।
ধীরে ধীরে মাটি দিও
আমার মৃত্যুর পর শবযাত্রার সহিত যেন কোন ক্রন্দনকারিণী স্ত্রীলোক না যায়। আগুনও যেন বহন করা না হয়। সমাধিস্থ করার সময় আমার উপর ধীরে ধীরে মাটি ফেলিও। সমাধিস্থ করার পর একটি জন্তুর গোশত বন্টন করিতে যতটুকু সময় অতিবাহিত হয় ততক্ষণ আমার নিকট অবস্থান করিও। কেননা তোমাদের বর্তমানে আমি কিছুটা আশ্বস্ত হইতে পারিব। ইতিমধ্যে আমি বুঝিতে পারিব, আমি খোদার দরবারে কি জবাব দিব। – (তাবাকাতে ইবনে সাদ)
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁহার হুশ বজায় ছিল। মোয়াবিয়া ইবনে খাদিজ কুশল জিজ্ঞারা করিতে গেলেন, জিজ্ঞাস করিলেন, কেমন আছেন?
উত্তর দিলেন, চলিয়া যাইতেছি। অস্বস্তি বেশী হইতেছে, ভাল থাকিতেছি কম, এই অবস্থায় আমার ন্যায় বৃদ্ধের বাঁচিয়া থাকা কি সম্ভবপর? (ইকদুল ফরীদ, তাবাকাতে ইবনে সাদ)
হযরত ইবনে আব্বাসের সহিত কথোপকথন
একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) তাঁহাকে দেখিতে আসিলেন সালাম করিয়া স্বাস্থ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিতে লাগিলেন, আমি দুনিয়ার লাভ অল্প গহণ করিয়াছি, কিন্তু দ্বীন বরবাদ করিয়াছি অধিক। যদি আমি যাহা লাভ করিয়াছি তাহা ছাড়িয়া, যাহা ত্যাগ করিয়াছি তাহা গহণ করিতাম, তবে নিশ্চিতভাবে জিতিয়া যাইতাম। যদি সুযোগ পাই, তবে অবশ্যই এইরূপ করিব। যদি কোথাও পালাইয়াও যাইতে হয়, তবে তাহাই করিব। এইক্ষণ তো আমি নিক্ষেপণ যন্ত্রের ন্যায় আকাশ ও মাটির মধ্যস্থলে ঝুলিতেছি। হাতের জোরে উপরেও উঠিতে পারিতেছি না, পায়ের বলে নীচেও অবতরণ করিতে পারিতেছি না। ভ্রাতুষ্পুত্র, আমাকে এমন কোন উপদেশ দাও, যাদ্দ্বারা কোন উপকার পাই।
ইবনে আব্বাস (রা) জবাব দিলেন, আল্লাহর বান্দা, এখন সেই অবসর আর কোথায়? আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র স্বয়ং বৃদ্ধ হইয়া ভ্রাতৃস্থানে আসিয়া পৌছিয়াছে; যদি ক্রন্দন করিতে বলেন, প্রস্তুত আছি। ঘরে বসা লোক ভ্রমণের কথা কি করিয়া অনুভব করিবে?
আমর ইবনুল আস এই উত্তর শুনিয়া দুঃখিত হইলেন। বলিতে লাগিলেন, কী ভীষণ সময়। আশি বত্সরেরও বেশী বয়স হইয়াছে। ইবনে আব্বাস, তুমিও আমাকে পরওয়ার দেগারের অনুগ্রহ হইতে নিরাশ করিতেছ। হে খোদা, আমাকে তুমি খুব কষ্ট দাও। যেন তোমার ক্রোধ দূর হইয়া শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্টি ফিরিয়া আসে।
ইবনে আব্বাস (রা) বলিলেন, আপনি যাহা কিছু গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা নুতন ছিল, আর এখন যাহা দিতেছেন তাহা পুরাতন। সুতরাং যাহা বলিতেছেন তাহা কি করিয়া সম্ভব?
এই কথা শুনিয়া তিনি একটু অধীর হইয়া উঠিলেন, বলিতে লাগিলেন : ইবনে আব্বাস, আমাকে কেন নিরাশ করিতেছ? যাহা কিছু বলি তাহাই কাটিয়া দিতেছ।
মৃত্যু অবস্থা
আমর ইবনে আস অনেক সময় বলিতেন, এই সমস্ত লোকদের দেখিয়া আমি আশ্চার্যান্বিত হই, মৃত্যুর সময় যাহাদের হুশ অবশিষ্ট থাকা সত্ত্বেও কেন তাহারা মৃত্যু-যন্ত্রনার কথা বলিতে পারেন না। অনেকেরই এই কথা স্মরণ ছিল। তিনি স্বয়ং যখন এই অবস্থায় উপনীত হইলেন, তখন হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এই কথা উত্থাপন করিলেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে, স্বয়ং তাঁহার পুত্র এই কথা জিজ্ঞাস করিয়াছিলেন।
এই কথা শুনিয়া আমর ইবনে আস দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “মৃত্যুর স্বরূপ বর্ণনা করা সম্ভবপর নয়। মৃত্যু বর্ণনাতীত! আমি কেবলমাত্র এতটুকু আভাস দিতে পারি, আমার মনে হইতেছে যেন আকাশ মাটির উপর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে এবং আমি তাহার নীচে পড়িয়া ছটফট করিতেছি।”- (আল কামেল, ১ম খণ্ড)
মনে হইতেছে আমার মাথায় যেন পর্বত ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। আমার পেটে যেন অসংখ্য খেজুরের কাঁটা পুরিয়া দেওয়া হইয়াছে। সুচেঁর ছিদ্রদিয়া যেন আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বাহির হইতেছে।–( তাবাকাতে ইবনে সাদ)
এই অবস্থায় তিনি একটি সিন্দুকের দিকে ইশারা করিয়া স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহকে বলিতে লাগিলেন, “ইহা নিয়া যাও।”
তাঁহার পুত্র আবদুল্লাহ বিখ্যাত আবেদ ছিলেন। তিনি বলিলেন, ইহাতে আমার কোন প্রয়োজন নাই। তিনি বলিলেন, ইহাতে ধন-দৌলত রহিয়াছে। আবদুল্লাহ পুনরায় উহা গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলেন। তত্পর আমর ইবনুল আস হাত কচলাইতে কচলাইতে বলিলেন, ইহাতে স্বর্ণের পরিবর্তে যদি ছাগলের বিষ্ঠা থাকিত।” – ( আল কামেল)
দোয়া
শেষ সময় যখন ঘনাইয়া আসিল তখন উপরের দিকে হাত তুলিলেন। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করিয়া প্রার্থনার সুরে বলিতে লাগিলেন, ইলাহী, তুমি নির্দেশ দিয়াছ, আর আমি তাহা পালন করি নাই। ইলাহী, তুমি নিষেধ করিয়াছ; আর আমি নাফরমানী করিয়াছি। ইলাহী, আমি নির্দোষ নই যে, তোমার নিকট ওজরখাহী করিব। শক্তিশালী নই যে, জয়ী হইব। তোমার রহমত যদি না আসে, তবে নিশ্চিতরূপে ধ্বংস হইয়া যাইব।–( তাবাকাতে ইবনে সাদ)
অতপর তিন বার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলিতে বলিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন।