৭.
শেষ দিবসের প্রতি ঈমান
শেষ দিবস বলতে বুঝায় মৃত্যুর পরবর্তী জীবন। এ জন্য একে পরকালের জীবন এবং পরলোকও বলা হয়। কুরআন মজীদে সম্ভবত এমন কোন পৃষ্ঠাই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাতে এই পরকালের কোন উল্লেখ নেই। নানাভাবে ও ভঙ্গিতে এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে এবং একে মানুষের হৃদয়ে বদ্ধমূল করা হয়েছে। এর সত্যতা সম্পর্কে যুক্তি-প্রমাণ দেয়া হয়েছে। এর বিস্তৃত বিবরণ দেয়া হয়েছে। এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর প্রতি ঈমান আনার আহবান জানানো হয়েছে। স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছেঃ যে ব্যক্তি এই শেষ জীবনের প্রতি ঈমান পোষণ করে না, তার সমস্ত কৃতকর্ম বিনষ্ট হয়ে যায়ঃ
“বস্তুত আমাদের নিদর্শনসমূহকে যে কেউ মিথ্যা মনে করবে এবং পরকালে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোকে অস্বীকার করবে তার সকল আমল নষ্ট হয়ে গেল।” –(সূরা আল আ’রাফঃ ১৪৭)
“ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেসব লোক যারা আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাত হওয়ার সংবাদকে মিথ্যা মনে করেছে।”-(সূরা আল আন’আমঃ ৩১)
বস্তুত যে পরকাল বিশ্বাসকে এতোটা গুরুত্ব সহকারে পেশ করা হয়েছে, তাকে মানব মনে স্বাভাবিকভাবেই উদ্ভুত কতিপয় প্রশ্নের জবাব বলা যেতে পারে।
কতিপয় স্বাভাবিক প্রশ্ন
মানুষ সুখের চেয়ে বেশী দুঃখ এবং আরামের চেয়ে বেশী কষ্ট-ক্লেশ অনুভব করে। আর এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার যে, যে জিনিস মানুষের অনুভূতিকে বেশী আঘাত করে, তা ততোবেশী তার চিন্তাশক্তিকে ক্রিয়াশীল করে তোলে। আমরা যখন কোন জিনিস লাভ করি, তখন তার খুশীতে এটা চিন্তা করেই দেখি না যে, এটা কোত্থেকে এলো কিভাবে এলো এবং কদ্দিন থাকবে? কিন্তু কোন জিনিস যখন আমাদের হারিয়ে যায়, তখন তার শোকাঘাত আমাদের চিন্তাশক্তির ওপর প্রচন্ড চাবুক লাগিয়ে দেয় এবং আমরা তখন ভাবতে থাকি: এটা কি করে হারানো গেলো? কোথায় গেলো? কোথায় রয়েছে? এটা কি আর কখনো পাওয়া যাবে? এ কারণেই জীবন এবং তার উন্মেষের প্রশ্ন আমাদের কাছে ততোবেশী গুরুত্ব রাখেনা, যতোটা গুরুত্ব রাখে মৃত্যু এবং তার পরিণতি সংক্রান্ত প্রশ্ন। যদিও দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চ এবং এতে নিজের অস্তিত্ব দেখে আমাদের মনে অবশ্যই এ প্রশ্ন জাগে যে, এটা কি রকমের হট্টগোল? এটা কিভাবে সৃষ্টি হলো? কে সৃষ্টি করলো? কিন্তু এ সবকিছু হচ্ছে আসল মুহূর্তের চিন্তা। বিশিষ্ট ও প্রগাঢ় চিন্তাশীল লোকেরা ছাড়া সাধারণ লোকেরা এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। পক্ষান্তরে মৃত্যু ও তার তিক্ততার সম্মুখীন হতে হয় প্রতিটি মানুষকেই। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনেই এমন বহু সময় আসে, যখন সে নিজ চোখের সামনে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে। অসহায় ও দূর্বল লোকেরাও মৃত্যুবরণ করে, শক্তিমান ও শক্তিশালী ব্যক্তিরাও মৃত্যুবরণ করে। দুঃখজনক মৃত্যুও সংঘঠিত হয়, শিক্ষামূলক মৃত্যুও ঘটতে দেখা যায়। এভাবে সবাইকে চলতে দেখে প্রত্যেক ব্যক্তির মনে নিজেরও এ যাত্রা পথে চলার দৃঢ়প্রতীতি জন্মে। এসব দৃশ্য দেখে মৃত্যুর প্রশ্ন মনে তোলপাড় সৃষ্টি করেনা-মৃত্যু জিনিসটা কি, মানুষ এ দরজা অতিক্রম করে কোথায় যায়, দরজার পিছনে কী রয়েছে, বরং সত্যই কিছু আছে কিনা-এসব প্রশ্ন আলোড়িত করে তোলে না, এমন মানুষ হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবেনা।
এটা তো সাধারণ ও অসাধারণ সবারই ভেবে দেখা একটি সাধারণ প্রশ্ন। একজন মামুলি কৃষক থেকে শুরু করে এক বিরাট দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক পর্যন্ত সবাই এ ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে থাকে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আরো কতিপয় প্রশ্ন রয়েছে, যা প্রায় প্রত্যেক চিন্তাশীল ব্যক্তির মনে খোঁচাতে থাকে এবং জীবনে বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা এ খোঁচানীকে আরো বাড়িয়ে দেয়। দুনিয়ায় আমাদের এ কয়েক বছরের জীবন, এর প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি দণ্ড কোন না কোন কাজে, কোন না কোন চেষ্টায় ব্যয়িত হয়। যাকে আমরা স্থিতি মনে করি, তাও একরূপ গতি। যাকে আমরা বেকার মনে করি, তাও এক প্রকার কাজ। এর প্রতিটি কাজে ভালো কাজের ফল ভালো এবং মন্দ কাজের ফল মন্দ হওয়া একান্তই আবশ্যক। সৎ প্রচেষ্টার সুফল এবং অসৎ প্রচেষ্টার কুফল অবশ্যই প্রকাশ পাওয়া উচিত। কিন্তু দুনিয়ার এ জীবনে আমাদের সকল প্রচেষ্টার পরিণতি, যাবতীয় প্রয়াসের ফলাফল, সমস্ত ক্রিয়া-কর্মের প্রতিদান কি আমরা পেয়ে থাকি? একজন দুষ্কৃতিকারী সমগ্র জীবন দুষ্কর্মের মধ্যে অতিবাহিত করেছে। কোন কোন দুষ্কর্মের ফল সে নিসন্দেহে দুনিয়ায় লাভ করেছে। কোন দুষ্কর্মের ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। কোন দুষ্কর্মে সে দুঃখ-কষ্ট, মুসীবত ও অশান্তিতে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই সাথে বহু দুষ্কর্মের পুরোপুরি ফল সে এ দুনিয়ায় ভোগ করেনি। বহু দুষ্কর্ম লোক চক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে, যার ফলে তার দুর্নাম এবং অপমান পর্যন্ত হয়নি। আর দুর্নাম হয়ে থাকলেও যে বেচারার উপর সে যুলুম করেছিলো, তার ক্ষয়-ক্ষতির কি প্রতিকার হলো? তাহলে এ দুষ্কৃতিকারীর এহেন যুলুম-পীড়ন এবং অসহায় মযলুম লোকদের ধৈর্য-স্থৈর্য কি বিফলে যাবে? এ সবের কোন ফলাফল কি কখনো প্রকাশ পাবেনা?
সৎকর্মের অবস্থাও হচ্ছে অনুরূপ। বহু সৎলোক জীবন ভর সৎকাজ করে গেছে এবং তার পুরোপুরি সুফল তারা দুনিয়ায় পায়নি। বরং কোন কোন সৎকাজের ফলে তাদের উল্টো দূর্নাম ও অপমান সইতে হয়েছে। কোন সৎকাজের জন্যে তাদের নিপীড়ন করা হয়েছে। কঠোর দণ্ড দেয়া হয়েছে। আর কোন কোন সৎকর্ম তো দুনিয়ার সামনেই প্রকাশই পায়নি। তাহলে এ বেচারাদের সমস্ত সৎকাজ কি বিফলে গেছে? এতো কঠিন শ্রম ও প্রচেষ্টার পর তারা চিত্তের প্রশান্তি লাভ করেছেন-কেবল এটুকু ফলাফলই কি যথেষ্ট?
এ প্রশ্নটি তো শুধু ব্যক্তি ও ব্যষ্টির সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু এরপর জাতি, শ্রেণী, বস্তু এবং এ গোটা দুনিয়ার পরিণামের সাথে সম্পৃক্ত আরো একটি প্রশ্ন রয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষ মরে যাচ্ছে এবং তার স্থলে অন্য মানুষ জন্মগ্রহণ করছে। গাছ-পালা পশু-পাখীর বিলুপ্তি ঘটছে, আবার তাদের স্থলে অন্য গাছ-পালা ও পশু-পাখী উৎপন্ন হচ্ছে। কিন্তু জন্ম ও মৃত্যুর ধাপ কি এমনই অব্যাহত থাকবে? এ কি কোথাও গিয়ে শেষ হবেনা? এই যে হাওয়া, পানি, মাটি, আলো, উত্তাপ তথা প্রাকৃতিক শক্তিনিচয়ের সাহায্যে গোটা বিশ্ব কারখানা এক বিশেষ ধারায় পরিচালিত হচ্ছে, সবই কি অবিনশ্বর? এ সবের জন্য কি কোন আয়ুষ্কাল নির্ধারিত নেই? এদের নিয়ম-শৃংখলা ও বিন্যাস ব্যবস্থায় কি কোন পরিবর্তন সূচিত হবেনা?
ইসলাম এ সকল প্রশ্নেরই সুষ্ঠু সমাধান করে দিয়েছে। বস্তুত পরকালীন জীবনের বিশ্বাস হচ্ছে এ প্রশ্নাবলীরই স্বাভাবিক জবাব। কিন্তু এ সমাধান, এর সত্যতা এবং এর নৈতিক ও তামাদ্দুনিক ফলাফল সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে খোদ মানুষ এসব প্রশ্নের সমাধান প্রচেষ্টায় কতখানি সফলকাম হয়েছে, তা যাচাই করে দেখা দরকার।
পরকালীন জীবনের অস্বীকৃতি
একদল বলেন যে, জীবন বলতে যা কিছু বুঝায়, তা এই দুনিয়ার জীবনেই শেষ। মৃত্যুর মানে হচ্ছে সম্পূর্ণ ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া, এরপর জীবন চেতনা, অনুভূতি ও কর্মফল বলতে কিছু নেই।
“এই লোকেরা বলে আমাদের প্রথম মৃত্যু ছাড়া আরতো কিছুই নেই। তারপর আমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে না।”-(সূরা দোখানঃ ৩৪-৩৫)
“এই লোকেরা বলেঃ জীবন তো শুধু আমাদের এই দুনিয়ারই জীবন। জীবন ও মৃত্যু সবতো এখানেই। আর কালের আবর্তন ছাড়া আমাদেরকে আর কেউ ধ্বংস করে না।”-(সূরা আল জাসিয়াঃ ২৪)
পক্ষান্তরে এ বিশ্বকারখানা যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। এর নিয়ম-শৃংখলা এমন যে, এ কখনো বিপর্যস্ত হবার নয়।
যারা এ ধরনের কথা বলে, তারা কোন জ্ঞান সূত্রের সাহায্যে এ প্রমাণ্য তথ্য জানতে পেরেছেন যে, মৃত্যুর পর বাস্তবিকই কিছু নেই এবং এ বিশ্ব কারখানা সত্য সত্যই অবিনশ্বর- এ ভিত্তিতেই তারা একথা বলেন না। বরং তারা শুধু নিজেদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির ওপর নির্ভর করে একথা বলছেন। তাদের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ হলো এই যে, মৃত্যুর পরবর্তী কোন অবস্থা তারা অনুভব করেননি। আর বিশ্ব ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবার কোন লক্ষণও তারা দেখতে পাননি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন জিনসকে অনুভব না করাই কি তার অস্বীকৃতির জন্য যথেষ্ট প্রমান? তাহলে আমাদের অনুভূতিই কি বস্তুর অস্তিত্ব এবং অনুভূতিহীনতাই কি তার অনস্তিত্ব নির্দেশ করে? তাই যদি হয় তো আমি বলবোঃ যে জিনিসটি আমি অনুভব করি, আসলে তখনি তা জন্মলাভ করে আর যখন তা আমার অনুভূতির বাইরে চলে যায়, তখন তার স্বাভাবিক বিলুপ্তিও ঘটে। আমি যে দরিয়াকে বইতে দেখেছিলাম, তার সৃষ্টি হয়েছে তখনি, যখন আমি তাকে বইতে দেখেছি, আর যখন তা আমার দৃষ্টি পথ থেকে অপসৃত হয়েছে, তখন তার অস্তিত্বও নিশ্চিন্হ হয়ে গেছে। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি আমার এহেন উক্তিকে নির্ভুল বলে মেনে নিবে? তা যদি না হয় তাহলে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ উক্তিকে কিভাবে সত্য বলে মানতে পারে যে, মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা যেহেতু আমাদের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার কাছে ধরা পরেনি, এ কারনেই মৃত্যুর পর আর কোন অবস্থাই নেই।
পরন্তু মৃত্যু ও ধ্বংস সম্পর্কে নিছক ইন্দ্রিয়ানুভুতির ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেমন ভুল, তেমনি জীবন ও অস্তিত্ব সম্পর্কেও নিছক ইন্দ্রিয়ানুভুতির সাহায্যে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সে সবের কোন ভিত্তি নেই। আমরা এ বিশ্ব ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত হতে দেখেনি বলেই যদি এর চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর হবার সিদ্ধান্ত নির্ভুল হয়, তাহলে আমিও এক মযবুত ইমারত দেখে বলতে পারি যে, এটি চিরকাল কায়েম থাকবে; কারন আমি একে ধ্বসে পড়তেও দেখিনি কিংবা ভবিষ্যতে ধ্বসে পড়ার ইঙ্গিতবহ কোন ফাটল তো আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। আমার এ যুক্তিধারা কি বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?
চরিত্রের উপর পরকাল-অবিশ্বাসের প্রভাবঃ
দার্শনিক ও বিজ্ঞানীগণ আস এ ব্যাপারে প্রায় একমত যে, এ বিশ্ব ব্যবস্থা একদিন না একদিন অবশ্যই বিপর্যস্ত হবে। বিশ্বের চিরন্তনতা সংক্রান্ত প্রাচীন মতবাদের প্রবক্তা সম্ভবত আজ আর পন্ডিত মহলে কেউ নেই। কিন্তু তবু মৃত্যুকেই চুড়ান্ত ধ্বংস আখ্যা দান করার মতো লোক এখনো অনেক রয়েছে এবং উপরিউক্তি অযৌক্তিক ধারণাই হচ্ছে তাদের এ মতবাদের ভিত্তি। কিন্তু এর অযৌক্তিকতার কথা বাদ দিলেও এ একটি অনস্বীকার্য সত্য যে, এ মতবাদ দ্বারা মানুষ কখনো চিত্তের প্রশান্তি লাভ করতে পারে না। বরং জীবনের ঘটনাবলী দেখে মানব মনে যেসব প্রশ্নের উদ্ভব হয়, এ মতবাদে তার বেশির ভাগ প্রশ্নেরই সমাধান বাকী থেকে যায়। সর্বপরি মানুষের জীবন ও চরিত্র গঠনের ভিত্তি এ মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে তা অবশ্যই দুটি অবস্থার সম্মুখীন হবে। প্রথমত, অবস্থা প্রতিকূল হলে এ মতবাদের ফলে এক প্রচন্ড রকমের নৈরাশ্য, হতাশা ও উৎসাহহীনতা মানুষের ওপর চেপে বসবে। কারন মানুষ সখন তার সৎকাজের কোন পরিণাম ফল দুনিয়ায় দেখতে পাবে না, তখন তার কর্মশক্তি শিথিল ও স্তিমিত হয়ে যাবে। সখন সে অন্যায় যুলুমের কোন প্রতিকারের উপায় দেখবে না, তখন তার মনোবল ভেঙ্গে পড়বে। যখন সে দুনিয়ায় দুষ্কৃতি কদাচার ও যুলুমের বিকাশ-বৃদ্ধি দেখবে, তখন স্বতই ভাববে যে, সৃষ্ঠি জগতে সাফল্য ও সমৃদ্ধি শুধু দুষ্কৃতিরই আর কল্যাণ ও সৎকাজের জন্যে রয়েছে শুধু অবনতি। পক্ষান্তরে অবস্থা অনুকূলে হলে মানুষ এ মতবাদের প্রভাবে এক আত্নপুজারী পশুতে পরিনত হবে। সে ভাববে যেদিনটি বিলাস-ব্যসনে ও সুখ-সম্ভগে অতিবাহিত হবে, কেবল তাই হবে সার্থক। দুনিয়ার কোন রসাস্বাদ ও সুখ-সম্ভোগ থেকে যদি সে বঞ্চিত হয়, তাহলে তা পরন করার মত কোন জীবন আর ফিরে পাবে না। কাজেই সে নির্বিচারে যুলুম-পীড়ন চালাবে। লোকদের অধিকার হরণ করবে। নিজের কল্যাণ লাভ এবং প্রবৃত্তির বাসনা পূরণের জন্যে নিকৃষ্টতম কাজ করতেও সে পরোয়া করবে না। এহেন ব্যাক্টির ধারণায় বড়োজোর সে সব সৎকাজ, ভদ্রতা ও শালীনতাই স্থান পাবে, যা দ্বারা তার সুনাম, সুখ্যাতি, সম্মান কিংবা অন্য কোনরূপ পার্থিব কল্যাণ অর্জিত হবে। অনুরূপভাবে যেসব অপরাধ ও পাপাচারের পরিণাম ফল কোন পার্থিব শাস্তি, দৈহিক পীড়ন কিংবা বৈষয়িক ক্ষতিপূরন আত্নপ্রকাশ করতে পারে, কেবল সেগুলোকেই সে অপরাধ ও পাপাচার বলে গণ্য হবে। আর যেসব সৎকাজের কোন সুফল এ দুনিয়ায় প্রকাশ পাবার নয়, তার দৃষ্টিতে সেগুলো করা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু হবে না। আর যেসব দুষ্কৃতির কোন ক্ষতি এ দুনিয়ায় বরন করার নয়, তার দৃষ্টিতে সেগুলো ঠিক পুণ্যের কা বলে বিবেচিত হবে।
যদি কোথাও গোটা সমাজের নৈতিক ব্যবস্থা এমন মতবাদ ও মানসিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তার সম্পুর্ণ নৈতিক ধ্যান-ধারনাই বদলে যাবে। তার গোটা নৈতিক ব্যবস্থা স্বার্থপরতা ও আত্নপূজার বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। সেখানে সৎকাজ হবে পার্থিব কল্যাণের সমার্থক আর দুষ্কৃতি হবে বৈষয়িক ক্ষতির নামান্তর। সেখানে মিথ্যা যদি পার্থিব ক্ষতির কারণ হয় তবেই তা হবে গোনাহ বলে বিবেচিত আর কল্যাণের মাধ্যম হলে তা হবে ঠিক পূণ্যের কাজ বলে সাব্যস্ত। সততা যদি দুনিয়ায় কল্যাণ লাভের মাধ্যম হয় তো তা হবে সুকৃতি, আর ক্ষতিকর হলে তার চেয়ে বড়ো দুষ্কৃতি আর কিছুই হবেনা। বিলাস-ব্যাসন ও সুখ-সম্ভোগের জন্যে ব্যাভিচার হবে আশীর্বাদ স্বরূপ আর যদি তা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়, তবেই তা হবে আপত্তিকর জিনিস। ফলকথা, এ পার্থিব জীবনের পর কোন ভালো কিংবা মন্দ পরিণাম দেখা দেয়ার ভয় কিংবা আশা যেখানে না থাকে, সেখানে মানুষ শুধু এ দুনিয়ায় প্রকাশ পাবার মত কর্মফলের প্রতিই লক্ষ্য রাখবে এবং এতে করে তার ক্রিয়া-কর্মের নৈতিক মুল্যবোধে এমন পরিবর্তন সূচিত হবে, যা আদৌ কোন সভ্য সমাজের উপযোগী হতে পারে না। বরং একথা বলাই অধিকতর সমীচিন হবে যে, এহেন নৈতিক মুল্যমান নিয়ে কোন মানব গোষ্ঠীর পক্ষে পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর পর্যায়ে না নেমে উপাই নেই।
কেউ বলবেন যে, শাস্তি ও পুরস্কারের জন্যে দুনিয়ায় শুধু বৈষয়িক ও দৈহিক লাভালাভই নয়, বরং মানুষের মধ্যে বিবেক নামক একটি শক্তিরও অস্তিত্ব রয়েছে। তার পীড়ন, তার আর্তনাদও এ দুনিয়ায় দুষ্কৃতির জন্যেও যথেষ্ট শাস্তি। আর তার প্রশান্তি মানুষের সৎকাজের জন্যে যথেষ্ট পুরস্কার। কিন্তু আমি বলবো দুনিয়ায় এমন বহু দুষ্কৃতি রয়েছে, যেগুলোর বৈষয়িক ফায়দা দেখেই মানুষ বিবেকের দংশন সহ্য করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়, আবার বহুত সৎকাজের জন্যে মানুষকে এত কুরবানী করতে হয় যে, শুধু বিবেকের প্রশান্তিই তার যথেষ্ট পুরস্কার হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, বিবেকের প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, কোন নৈতিক মতাদর্শ সৃষ্টি করা তার কাজ নয়, বরং এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা ও ট্রেনিং-এর ফলে যে নৈতিক আদর্শ মানব মনে প্রবিষ্ট হয়, তার বিবেক তারই সমর্থন করতে শুরু করে। এ কারণেই একজন হিন্দুর বিবেক যেসব বিষয়ে পীড়িত বোধ করে, একজন মুসলমানের বিবেক সেসব বিষয়ে কোন পীড়া অনুভব করেনা। কাজেই কোন সমাজে নৈতিক মতাদর্শ যদি বদলে যায় এবং কল্যান ও অকল্যাণের মানদণ্ডও পরিবর্তিত হয়, তবে তার সাথে সাথে বিবেকের গতি মুখও ঘুরে যাবে। এ সমাজ যেসব ক্রিয়া-কান্ডকে অন্যায়ভাবে ছেড়ে দিবে, সে সবের জন্যে এর বিবেক কোনরূপ পীড়াবোধ করবে না আর যেসব ক্রিয়া-কান্ড সৎকাজ বলে স্বীকৃতি পাবে না, সে সবের জন্যে কোন প্রশান্তিও অনুভব করবে না।
জন্মান্তরবাদ
দ্বিতীয় দল জন্মান্তরবাদ পেশ করছে। এর সারকথা হলোঃ মৃত্যু অর্থ চুড়ান্ত ধ্বংস নয়, বরং দেহান্তর প্রাপ্তি মাত্র। আত্না এ দেহ ত্যাগ করার পর অপর কোন দেহ অবলম্বন করে। আর মানুষ তার প্রথম জীবনে নিজস্ব কৃতকর্ম ঝোকপ্রবণতার বলে যে যোগ্যতা অর্জন করে, এ দ্বিতীয় দেহ কিংবা অধিকতর বিশুদ্ধ কথায় দ্বিতীয় খাঁচাটি তারই উপযোগী হয়ে থাকে। তার কৃতকর্ম যদি মন্দ হয় এবং তার প্রভাবে তার ভেতর নিকৃষ্ট যোগ্যতার সৃষ্টি হয়, তাহলে তার আত্না নিম্নমানের জৈবিক কিংবা উদ্ভিদ স্তরে নেমে যাবে। আর যদি ভাল কৃতকর্মের বলে সে ভালো যোগ্যতার সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে তার আত্না উচ্চস্তরের দিকে উন্নতি হবে। ফলকথা, এ মতবাদ অনুশারে শাস্তি ও পুরস্কার সবকিছুই এ দুনিয়া এবং এ দেহজগতেই সীমাবদ্ধ। আত্নাগুলো শুধু পূর্ববর্তী কৃতকর্মের ফল ভোগ করার জন্যে বরাবর এ দুনিয়ার খাঁচা বদল করে আসে।
এক কালে এ মতবাদটি খুবই জনপ্রিয় ছিলো। হযরত ঈসা (আ)-এর কয়েক শতক আগে গ্রীস দেশে পিথাগোরাস, আন্বেজুকলাশ প্রমুখ দার্শনিক এর প্রবক্তা ছিলেন। মিসরের প্রাচীন ইতিহাসেও এর কিছুটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ইহুদীদের মধ্যেও বহিপ্রভাবের ফলে জন্মান্তরবাদ ঢুকে পড়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে এ মতবাদটি ভারতোদ্ভুত ধর্মগুলোতে (যথা ব্রাহ্মণ্যবাদ, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম ইত্যাদি) পাওয়া যায় কিংবা পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিন আফ্রিকা, মধ্য অষ্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকার অসভ্য বা আধা সভ্য জাতিগুলোর মধ্যে দেখা যায়। বাকী সমস্ত সভ্য জাতিগুলো একে বর্জন করেছে। কারন মানুষ এ পর্যন্ত জ্ঞান-বুদ্ধির উন্নতির ফলে দুনিয়া এবং এর জীবন ধারা সম্পর্কে যতোটা অবগতি লাভ করেছে, তা জন্মান্তরবাদের সকল ভিত্তিকেই অস্বীকার করে। খোদ ভারতোদ্ভুত ধর্মগুলোতে আমরা এ মতবাদের ইতিহাসের প্রতি দৃকপাত করলে দেখতে পাই যে, প্রাচীন বৈদিক ভারতে যে, মৃত্যুর পর মানুষ অপর এক জীবন লাভ করে, যা সৎকর্মশীলদের জন্যে সম্পূর্ন আরামদায়ক আর দুষ্কৃতিকারীদের জন্যে সম্পূর্ন কষ্টদায়ক। তারপর হঠাৎ করে এ মতবাদে পরিবর্তন সূচিত হয় এবং পরবর্তী যুগের ভারতীয় সাহিত্যে জন্মান্তরবাদ এক দার্শনিক বিশ্বাস রূপে পাওয়া যায়। এ পরিবর্তনের কারণটা এখনো অনুসন্ধান করা হয়নি। কোন কোন গবেষকের ধারনা হচ্ছে এই যে, আর্যদের মধ্যে এ চিন্তাধারা এসেছে দ্রাবিড়দের কাছ থেকে। আর কেউ কেউ বলেন, এটা খোদ আর্যদের নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে বর্তমান ছিলো। পরবর্তি কালের অনুমানের এক বিরাট ইমারত গলে তুলেছেন। অনুরূপভাবে বৌদ্ধ সাহিত্যে জন্মান্তর সংক্রান্ত বিস্তৃত পরিকল্পনা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু গোড়ার দিকে এ ধর্মের তার কোন অস্তিত্ব ছিলো না। প্রাচীন সাহিত্য থেকে জানা যায়, গোড়ার দিকে বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বাস ছিলোঃ জীব হচ্ছে একটি নদী বিশেষ, যা ক্রমাগত আবর্তন ও পরিবর্তনের সাথে বয়ে চলেছে। এ ধারনাটিই সামনে এগিয়ে এ রূপ গ্রহণ করলো যে, সমগ্র জগতে একই আত্না এবং একই জীবন বর্তমান, যা আকৃতির পর আকৃতি এবং খাঁচার পর খাঁচা বদল করে যাচ্ছে। এর থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উটে যে, গোড়ার দিকে অহী ও ইলহাম থেকে ভারতীয় জাতিগুলো যে জ্ঞান লাভ করেছিলো, তাকে বদলে ফেলে তারা এক দার্শনিক হেয়ালীপূর্ন ধর্মমত আবিষ্কার করে নিয়েছে। আর এ মতবাদটি ছিলো সম্পুর্নরুপে তাদের নিজস্ব মনগড়া।
বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনা
এখানে জন্মান্তরবাদ সম্পর্কে কোন বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই। তবে জন্মান্তরবাদের বুনিয়াদটা যে সম্পূর্ণ বিচার-বুদ্ধির বিপরীত এবং জীবন ও জগত সম্পর্কে লব্ধ যাবতীয় মানবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিপন্থী তা নির্দেশ করার জন্যে অন্তত এতটুকু আলোকপাত করা প্রয়োজন। জন্মান্তরবাদীদের ধারনা হলোঃ প্রত্যেক ব্যাক্তি এ দুনিয়ায়ই তার কৃতকর্মের প্রতিফল লাভ করে -সে ভালো কাজের ফলে জীবনের উচ্চস্তরে আরোহণ করে আর মন্দ কাজের ফলে নিম্নস্তরে আবতরণ করে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ মানুষ যদি এ জীবনে মন্দ কাজ করে তো জৈবিক ও উদ্ভিদ স্তরে অবতরণ করবে। আর যদি জীবজন্তু তার জীবনে ভাল কাজ করে তো মানবীয় স্তরে আরোহণ করবে। এর অন্য অর্থ দাঁড়ায়, জৈবিক ও উদ্ভিদ জীবন হচ্ছে মানবীয় জীবনের মন্দ কাজের পরিণাম ফল আর মানবীয় জীবন হচ্ছে উদ্ভিদ ও জৈবিক জীবনের সৎকাজের ফল। অন্য কথায়, বর্তমানের যারা মানুষ, তাদের মানুষ হবার কারন এই যে, পূর্বে তারা উদ্ভিদ ও জৈবিক জীবনে সৎকাজ করেছিল। আর বর্তমানে যারা উদ্ভিদ ও জীবজন্তু তাদের এ দশা প্রাপ্তির কারন এই যে, তারা মানবীয় জিবনে মন্দ কাজ করেছিল। এ মতবাদটি মানতে হলে আরো কয়েকটি বিষয় জানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে আর তা সবই জ্ঞান-বুদ্ধির বিপরীত। যেমনঃ
একঃ জন্মান্তরের এ আবর্তন ধারার কোন আদি নির্ণয় করা যায় না। কারন মানুষ হতে হলে তার আগে উদ্ভিদ ও জীবজন্তু হওয়া প্রয়োজন। আবার উদ্ভিদ ও জীবজন্তু হতে হলে তার আগে মানুষ হওয়া আবশ্যক। এরুপ অনাদি আবর্তন ধারাকে বিচার-বুদ্ধি অবাস্তব বলে ঘোষনা করে।
দুইঃ জন্মান্তরের আবর্তন ধারা যদি অনন্ত হয়, তাহলে একথা মানতে হবে যে, বারংবার পরিবর্তনকারী আত্নাগুলোকেই শুধু নয়, বরং আত্নার জন্যে খাঁচা সরবরাহকারী বস্তুগুলোও অনন্ত হবে। আর এ পৃথিবী, এ সৌরমন্ডল এবং এর ভেতরের ক্রিয়াশীল শক্তিনিচয় -এ সবই অনন্ত হবে। কিন্তু বিচার-বুদ্ধি দাবি করে আর বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এর সাক্ষ্য বহন করে যে, এ সৌরমন্ডল অনাদিও নয়, অনন্তও নয়।
তিনঃ একথা মানতে হবে যে, উদ্ভিদ, জীবজন্তু ও মানব জাতির যা কিছু বৈশিষ্ট্য তাহলো তাদের দৈহিক সৌন্দর্যের দিক থেকে, জীবনের দিক থেকে নয়। কারন যে জীবন মানুষের খাঁচার মধ্যে গিয়ে বিচার-বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি লাভ করেছে, পশুর খাঁচার মধ্যে গিয়ে তা-ই বুদ্ধিহীন হয়ে পড়েছে। আর উদ্ভিদের খাঁচার মধ্যে গিয়ে তো বেচারা ইচ্ছা ও কর্মশক্তিই হারিয়ে ফেলেছে।
চারঃ যেসব কাজ ভেবে-চিন্তে ও সজ্ঞানে করা হয়,কেবল সেইসব কাজকেই ভাল-মন্দ ও সদসৎ আখ্যা দেয়া চলে।এ দৃষ্টিতে মানুষের কাজ-কর্ম সদসৎ হতে পারে এবং তার জন্যে শাস্তি ও পুরস্কারও দেয়া যেতে পারে; কিন্তু উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর কাজকর্মকে যেমন সদসৎ আখ্যা দেয়া সঙ্গত নয়, তেমনি তার জন্য শাস্তি বা পুরস্কার দেয়ারও কোন যুক্তিসঙ্গত কারন নেই। এরূপ সিদ্ধান্ত করতে হলে একথাও মানতে হবে যে, উদ্ভিদ এবং জীবজন্তুর মধ্যেও ভেবে-চিন্তে ও সজ্ঞানে কাজ করার শক্তি রয়েছে।
পাঁচঃ যদি পরবর্তি জীবন আমাদের বর্তমান জীবনের কৃতকর্মের ফল হয়, তাহলে স্বভাবতই মন্দ কাজের ফল মন্দ হওয়া উচিত। আর যদি দ্বিতীয় জীবনে যদি সেই মন্দ ফলই আমরা পাই, তাহলে সে মন্দ ফল থেকে আর ভালো কাজ সম্পাদিত হবে -এটা কি করে সম্ভবপর? স্বভাবতই এর দ্বারা মন্দ কাজই সম্পাদিত হবে এবং তার ফল তৃতীয় জীবনে আরো মন্দ হবে। এভাবে দুস্কৃতিকারী মানুষের আত্না জন্মান্তরের আবর্তন ধারায় ক্রমাগত নীচের স্তরের দিকে নামতে থাকবে। এর পক্ষে আর কখনো ওপরে উঠে আসার প্রত্যাশা করা যেতে পারে না। এবং অন্য অর্থ দাঁড়ায় এই যে, মানুষ থেকে জীবজন্তু হতে পারে বটে, কিন্তু জীবজন্তু থেকে মানুষ হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, বর্তমানে মানুষ তারা কোন সৎকাজের ফলে মানুষ হয়েছে এবং কোত্থেকে এসেছে।১ [জন্মান্তরবাদ সম্পর্কে অধিকতর সমালোচনার জন্যে ‘তাফহীমুল কুরআন’ সূরা আ’রাফ ৩০ টীকা দেখুন]
সমাজ ও তমদ্দুনের ওপর জন্মান্তরবাদের প্রভাব
এছাড়া আরও বহু কারনে সুস্থ বিচার-বুদ্ধি জন্মান্তরবাদকে গ্রহণ করতে পারে না। এ কারণেই মানুষ বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে পরিমাণ উন্নতি করে যাচ্ছে, জন্মান্তরবাদ সে পরিমাণে পরিত্যাক্ত হতে চলেছে। এমন কি, বর্তমানে, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নতিতে যেসব জাতি বেশি পশ্চাদপদ প্রধানত সেসব জাতির মধ্যেই এ মতবাদ প্রচলিত। সেই সাথে এ সত্যও স্বীকার্য যে, জন্মান্তরবাদ মানুষের সৎসাহস ও মনোবল দমিয়ে দেয় এবং উন্নতির প্রাণ চেতনাকেও নিস্তেজ করে ফেলে। এ মতবাদ থেকেই মানুষের ব্যাক্তিগত ও জাতীয় জীবনের পক্ষে চরম ধ্বংসাত্নক অহিংসা’ নীতির উদ্ভব ঘটেছে। যে জাতি এহেন নীতিতে বিশ্বাসী, তার যোদ্ধ ভাবধারা (Spirit) স্বভাবতই লুপ্ত হয়ে যায়। তাদের দৈহিক শক্তি নিস্তেজ হয়ে যায়। বরং দৈহিক শক্তিকে বিকাশদানকারী উত্তম প্রেরণাগুলো থেকেই তারা বঞ্চিত হয়ে যায়। সে জাতির জনগন শুধু দৈহিক দিক থেকেই নয়, মানসিক দিক থেকেও দুর্বল হয়ে পড়ে। এ দ্বিমুখী দূর্বলতার ফলেই তারা পরাভূত ও পদানত হয়ে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত হয় দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কিংবা অন্যান্য শক্তিমান জাতিগুলোর মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।
জন্মান্তরবাদের দ্বিতীয় ক্ষতি এই যে, তা সভ্যতা ও কৃষ্টির চির শত্রু। তা মানুষকে বৈরাগ্যবাদ ও সংসার ত্যাগের দিকে টেনে নিয়ে যায়। জন্মান্তরবাদীদের বিশ্বাস এই যে, কামনাই আত্নাকে পাপ পঙ্কিল করে তোলে। এর কারণেই আত্না বারংবার দৈহিক খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে নিজ কৃতকর্মের পরিণাম ফল ভোগ করে থাকে। কাজেই মানুষ যদি কামনাকে দমন করে এবং নিজেকে দুনিয়া ও তার গোলক ধাঁধাঁয় জড়িয়ে না ফেলে, তাহলে আত্না জন্মান্তরের আবর্তন থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। আর এটাই হচ্ছে মুক্তিলাভের একমাত্র পথ। কারণ পার্থিব বিষয়াদিতে জড়িত হবার পর কামনা ও তার চাহিদা থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এর অনিবার্য ফলাফল এ দাঁড়ালো যে, যারা মুক্তির পিয়াসী, তাদের সন্নাসী হয়ে বন-জঙ্গল কিংবা পাহাড়-পর্বতে চলে যেতে হবে; আর যারা এরূপ করতে সম্মত না হবে, তাদের মুক্তি সম্পর্কে নিরাশ হয়ে জীবজন্তু ও উদ্ভিদের স্তরে আবর্তন করতে প্রস্তুত হতে হবে। এহেন ধারণা বিশ্বাস কি সভ্যতা ও কৃষ্টির উন্নতির ব্যাপারে কিছুমাত্র সহায়ক হতে পারে? আর কোন জাতি কি এহেন বিশ্বাস পোষণ করে দুনিয়ায় উন্নতি লাভ করতে পারে?
এতে সন্দেহ নেই যে, বিভিন্ন দিক থেকে জন্মান্তরবাদ অন্তত মৃত্যুকে চূড়ান্ত ধ্বংস বা চির প্রস্থান মনে করার চেয়ে উত্তম। কারণ মানুষের মধ্যে চিরস্থায়ী হবার একটা স্বাভাবিক আকাংখা রয়েছে, জন্মান্তরবাদে সে আকাংখা কতকটা নিবৃত্ত হতে পারে। সেই সাথে এ মতবাদে শাস্তি ও পুরষ্কার এবং ভালো ও মন্দ কর্মফলের ধারণা রয়েছে তার ভিত্তিতে এ একটি উত্তম ও সুদৃঢ় নৈতিক বিধানের সহায়ক হতে পারে। কিন্তু এ অনস্বীকার্য সত্যের দিকেও আমরা বারবার ইঙ্গিত করেছি যে, যে মতবাদ জ্ঞান-বুদ্ধির বিপরীত এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক স্বরূপ, মানুষের মন ও মগজের ওপর তার বন্ধন সুদৃঢ় হতে পারে না -বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রমবিকাশের প্রত্যেক স্তরে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমোন্নতির প্রত্যেক পর্যায়ে সমান
শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। আর তার বন্ধনই যখন কায়েম থাকতে পারে না, তখন শুধু বইয়ের পাতায় একটি দার্শনিক মতবাদ হিসেবে তার বর্তমান থাকাটা নৈতিক ব্যবস্থার স্থিতি ও সুদৃঢ়তার পক্ষে কিছুমাত্র উপকারী হতে পারে না। কারন তা যখন বইয়ের পরিবর্তে অন্তরের পাতায় প্রতিষ্ঠিত হবে এবং লোকেরা পুরোপুরি তার প্রতি বিশ্বাস পোষন করবে, কেবল তখনি তা উপকারী বলে সাব্যস্ত হবে।
দ্বিতীয়ত, এ মতবাদ তার সর্বশেষ পরিনতির দিক থেকে নিজস্ব নৈতিক মুল্যও হারিয়ে ফেলেছে। কারন এর ফলে একজন মানুষের বিশ্বাস জন্মে যে, জন্মান্তরের আবর্তন ধারা ঠিক একটি মেশিনের মত এতে প্রত্যেক কাজের যে পরিণাম ফল নির্দিষ্ট রয়েছে তা আত্নপ্রকাশ করবেই – কোন অনুতাপ, মার্জনা কিংবা প্রায়শ্চিত্তের দ্বারাই তার প্রভাব ও ফলাফলকে বদলানো যেতে পারে না। এমতবস্থায় একবার গোনাহ করে ফেললে এমন ব্যক্তি চিরদিনের জন্য গোনাহর আবর্তে জড়িয়ে পড়বে; তখন সে ভাববেঃ আমায় যখন জানোয়ার বা উদ্ভিদ হতেই হবে, তখন এ মানবীয় জীবনের সমস্ত আরাম-আয়েশ ও সম্ভোগ কেন প্রান ভরে উপভোগ করবো না?
পরলৌকিক জীবনের বিশ্বাস
দুনিয়া ও মানুষের পরিণাম সম্পর্কে দু’ শ্রেনীর সিদ্ধান্ত ওপরে পেশ করা হলো। এর থেকে এও জানা গেল যে, এ দু’ টি মত যেমন বিচার-বুদ্ধির দৃষ্টিতে নির্ভুল নয়, তেমনি দুনিয়ায় পতন ও ধ্বংসের নিদর্শানাদি দেখে মানব মনে স্বভাবত যেসব প্র্রশ্নের উদয় হয়, তার পুরোপুরি এবং সন্তোষজনক জবাবও প্রদান করে না। পরন্তু এক নির্ভুল ও সুদৃঢ় নৈতিক ব্যবস্থার সহায়তা করার মতো প্রয়োজনীয় যোগ্যতাও এর মধ্যে বর্তমান নেই। এবার তৃতীয় মতটির কথা শোনা যাক। তাহলোঃ
একঃ দুনিয়ার প্রতিটি জিনিসের যেমন পৃথক পৃথক একটি আয়ুষ্কাল রয়েছে, যা উর্ত্তীর্ণ হবার পর তার মধ্যে স্বভাবতই বিপর্যয় ও বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়, তেমনি এ বিশ্বজগতেরও একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল রয়েছে, যা উর্ত্তীর্ণ হবার পর এ গোটা বিশ্বকারখানাই চুরমার হয়ে যাবে এবং অন্য এক জগত এর স্থলাভিষিক্ত হবে, যার প্রাকৃতিক বিধান এর প্রাকৃতিক বিধান থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন হবে।
দুইঃ এ বিশ্বজগত চুর্ণবিচূর্ণ হবার পর আল্লাহ্ তায়ালা একটি বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করবেন, সেখানে প্রত্যেক জিনিসেরই হিসেব গ্রহন করা হবে। মানুষ সেদিন এক নতুন দৈহিক জীবন লাভ করবে। সে আপন রবের সামনে হাযির
হবে। তার পূর্বেকার জীবনে কৃত সমস্ত ক্রিয়াকর্ম সঠিকভাবেই যাচাই ও ওজন করা হবে। সত্য ও ইনসাফের সাথে তার মামলার বিচার করা হবে। সে ভালো কাজের জন্যে পুরষ্কার এবং মন্দ কাজের জন্যে শাস্তিলাভ করবে।
তিনঃ মানুষের পার্থিব জীবন মূলত তার পারলৌকিক জীবনের ভুমিকা মাত্র। এ জীবন ক্ষনস্থাহী, সে জীবন চিরস্থাহী। এটি অসম্পুর্ন আর সেটি পূর্ণাঙ্গ। এ ক্ষনস্থায়ী জীবনে সমস্থ কাজের পুরোপুরি ফল প্রকাশিত হয়না। প্রতিটি অঙ্কুরই তার স্বাভাবিক বিকাশের সাথে এ অসম্পূর্ণ দুনিয়ায় ফলদান করতে পারেনা। এ অসম্পুর্ণতা সেই দ্বিতীয় জীবনে পূর্ণতা লাভ করবে। পরস্তু যা কিছু এখানে নিস্ফল ও অনর্থক রয়ে গেছে, তার প্রকৃত ফলাফল ও সার্থকতা সেখানে আত্নপ্রকাশ করবে। সুতরাং এ দুনিয়ার জীবনে আপন ক্রিয়াকর্মের যেসব অসম্পূর্ণ এবং কখনো কখনো প্রতারণাপুর্ণ ফলাফল প্রকাশিত হয়, মানুষের কেবল সে সবের প্রতিই লক্ষ্য রাখা উচিত নয়। বরং ফলাফলের এ পরিপুর্ণ ধারার প্রতি লক্ষ রেখেই তার ক্রিয়াকর্মের মূল্যমান নির্ধারণ করা উচিত।
বস্তুত এহেন মত-ই আল্লাহ্র নবীগন পেশ করে গেছেন। আর কুরআন মজীদ এর দিকেই মানব জাতিকে জোরালো ভাষায় আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এ মতের নৈতিক ফলাফল এবং ইসলামী সংস্কৃতিতে এর মর্যাদা ও গুরুত্ব আলোচনার পূর্বে এর পিছনে কী যুক্তি-প্রমান রয়েছে এবং বিচার-বুদ্ধিই বা তা কতোখানি গ্রহন করে সেইটে আমরা বিচার করে দেখতে চাই।
বুদ্ধিবৃত্তিক তত্ত্ব অনুসন্ধানের নির্ভুল পন্থা
প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুর পরে কোন জীবন আছে কিনা, এ প্রশ্নটি আমাদের ইন্দ্রিয় ও অনুভূতিলব্ধ অভিজ্ঞতার সীমা বহির্ভূত বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। আমরা বড়োজোর এটুকু অনুভব করি যে, যে ব্যাক্তি কয়েক মুহুর্ত পূর্ব পর্যন্ত শ্বাস গ্রহন এবং নিজের ইচ্ছানুসারে কাজ করেছিল, এখন সে জীবনের সমস্ত নিদর্শন থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে। তার দেহ থেকে এমন কোন জিনিস অদৃশ্য হয়ে গেছে, যা এ নিথর, নিশ্চল ও নিস্ক্রিয় পদার্থটিকে বিকাশ, বুদ্ধি ও গতিশীলতার উপযোগী শক্তি সঞ্চার করেছিলো। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সে জিনিসটি কোথায় গেল? দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কি তা বর্তমান রয়েছে, না অদৃশ্য হয়ে গেছে? এবং এরপর আর কখনও কি এ দেহ কিংবা এরূপ আর কোন দেহের সাথে তার সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হবে? আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞানের সাহায্যে এ প্রশ্নের কোন নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচক জবাব আমরা দিতে পারিনা। কারন সে জিনিসটিকেই কার্যত আমরা কথনো অনুভব করিনি আর এখনো করিনা। এ হিসেবে পুর্বাহ্নেই একথা বুঝে নেয়া দরকার যে, এ প্রশ্নের সাথে বিজ্ঞান অর্থাৎ বাস্তব হেকমত বা অভিজ্ঞতা-জাত জ্ঞানের কোনই সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান যখন এ ব্যাপারে ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত করতে পারে না, তখন নেতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত করারও তার অধিকার নেই। বিজ্ঞান শুধু এটুকুই বলতে পারে যে, মৃত্যুর পর কি হয়, আমি জানি না। কিন্তু সে যদি ন্যায়-নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে এ দাবী করে বসে যে, যেহেতু মৃত্যুর পর কি হয় আমি জানি না, সেহেতু আমি জানি যে, মৃত্যুর পর কিছুই হয় না- তবে সে নিশ্চিতরূপে যুক্তিবাদের সীমা অতিক্রম করে যাবে।
ইন্দ্রিয়ানুভুতির পর আমাদের কাছে জ্ঞানের দ্বিতীয় সুত্র হচ্ছে মননশীলত(আরবী*****)। মানুষ সর্বদাই নিজেকে ইন্দ্রিয়লব্ধ বস্তুর সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। এবং তার মানসিক প্রকৃতি চিন্তা-শক্তিকে প্রয়োগ করে ইন্দ্রিয়গোচর বিষয়ের বাইরে অবস্থিত প্রচ্ছন্ন সত্যগুলোকে জানার জন্যে দাবী জানিয়ে এসেছে। এ বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানকেই বলা হয় মননশীলতা। এর দুটি পদ্ধতি রয়েছেঃ
প্রথম পদ্ধতি হলোঃ দুনিয়া এবং খোদ মানুবীয় অস্তিত্বের নিদর্শনাদির প্রতি চোখ বন্ধ করে কিংবা অনেকখানি বেপরোয়া হয়ে নিরেট বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ের দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহন করা এবং শেষ পর্যন্ত বুদ্ধির ঘোড়দৌড়কে অব্যাহত রাখা। এ হচ্ছে কেবল অনুমান নির্ভর দর্শনের ক্ষেত্র এবং এ অন্ধকার মঞ্জিলই হচ্ছে সমস্ত বিভ্রান্তির উৎসস্থল। যেসব দার্শনিক মতবাদে লিপ্ত হয়ে মানুষ কল্পনার জগতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়, এখান থেকেই সেসব মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। এখান থেকেই আল্লাহ্, ফেরেস্তা, বিশ্বব্যবস্থা ও পরকালীন জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন ও পরস্পর বিভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী মতবাদের উন্মেষ ঘটেছে যা শুধু অন্ধকারে হাতড়ে চলা এবং আন্দাজ-অনুমান ও কল্পনার সাহায্যে চলার ফল ছাড়া আর কিছুই নয়।
দ্বিতীয় পদ্ধতি হলোঃ বিশ্বপ্রকৃতি ও নিজের অস্তিত্বের প্রতি চোখ মেলে তাকিয়ে সত্য পথের মশাল বরাদাররুপী নিদর্শনাদি পর্যবেক্ষণ করা এবং এ সকল প্রদীপ নিয়ে সুস্থ বিচার-বুদ্ধি ও নির্ভুল চিন্তা শক্তির সাহায্যে ঐ নিদর্শনাবলীর আড়ালে প্রচ্ছন্ন মৌলিক সত্য পর্যন্ত উপনীত হওয়া। এ পদ্ধতিতে বিজ্ঞান ও দর্শন উভয়েই মিলিতভাবেই অগ্রসর হয়। অবশ্য প্রকৃত সত্য পর্যন্ত পৌঁছার সুনিশ্চিত পথ এটাও নয়; কিন্তু আসমানী হেদায়াতের কথা বাদ দিলে মানুষের কাছে এটাই হচ্ছে সত্য সন্ধানের একমাত্র সুত্র। এবং এ সুত্রের সাহায্যে প্রকৃত সত্য কিংবা তার কাছাকাছি পর্যন্ত পৌছানো সম্ভবপর। অবশ্য তার জন্যে শর্ত এই যে, মানুষের পর্যবেক্ষণ শক্তি প্রখর হতে হবে, আর অনুভবশক্তি নির্মল ও তীক্ষ্ণ হতে হবে এবং তার মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার মত প্রচুর যোগ্যতা ও প্রতিভা থাকতে হবে। দার্শনিক মত অনুসারে মানুষের উন্নতি ও প্রগতি এ পর্যবেক্ষন ও মননশীলতার সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করে। আজকে যেসব মতবাদের ওপর দর্শনের ভিত্তি স্থাপিত এবং যেসব মুলনীতির প্রতি বিশ্বাস পোষন না করে বিজ্ঞানের কোন ছাত্র এক পা-ও সামনে এগোতে পারেনা, তার কোন একটি জিনিসও নিছক অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষনের উপর নির্ভরশীল নয়। বাস্তব যে বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার জন্যে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তার ওপরই প্রতিটি মতবাদ ও মূলনীতির ভিত্তি স্থাপিত। প্রাকৃতিক বিধান, আকর্ষন ও বিকর্ষন নীতি, কার্যকারন ধারা, আপেক্ষিকতার নীতি, বিবর্তনবাদ, যোগ্যতমের স্থায়ী হওয়ার নীতি ইত্যাকার যেসব মূলনীতি ও আইন-কানুনের ওপর বড়ো বড়ো দার্শনিকেরা বিশ্বাস পোষন করেন, তা সবই হচ্ছে বহিদৃশ্য ও প্রাকৃতিক নিদর্শনাদি সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা ও বুদ্ধি-বৃত্তিক অনুমান প্রয়োগের ফল। নচেত আজ পর্যন্ত কেউ এসব বিধান ও মূলনীতির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পর্যবেক্ষন করেনি।
তাছাড়া কোন বস্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পর্যবেক্ষন থেকে একজন সাধারন লোকের যতোটা বিশ্বাস জন্মে নিজস্ব পর্যবেক্ষন ও অনুমান থেকে সিদ্ধান্তের প্রতি একজন দার্শনিকেরও ঠিক ততোটাই প্রত্যেয় জন্মে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোন বড়ো রকমের দার্শনিকও কোন অবিশ্বাসীকে ঐ সিদ্ধান্ত মানার জন্যে বাধ্য করতে পারে না। কারন এক ব্যাক্তি যতক্ষন পর্যন্ত দার্শনিকের মতোই বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে বহির্দৃশ্য ও বাহ্য নিদর্শনাদি পর্যবেক্ষন না করবে এবং দার্শনিকদের মতোই চিন্তা ও গবেষণা শক্তিকে প্রয়োগ না করবে, ততক্ষন লোকের পক্ষে দর্শনের পথে পদক্ষেপ করা এবং তাতে উন্নতি ও প্রগতি লাভ করার একমাত্র উপায় এ হতে পারে যে, দার্শনিকের বুদ্ধিমত্তা এ বিচক্ষণতার ওপর তার আস্থা হবে, নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও চিন্তা-ভাবনা থেকে লব্ধ সিদ্ধান্ত ছেড়ে তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতিই সে অদৃশ্য বিশ্বাস পোষণ করবে।
এ পূর্বাভাসটি হৃদয়ে বদ্ধমূল করে নেয়া দরকার। কারণ অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াদি সম্পর্কে কুরআন মজীদের বর্ণনা ও যুক্তিধারাকে বুঝতে হলে এ পূর্বাভাসটি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। এটি না বোঝার ফলেই বহু প্রকার ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এবার আমরা পরকালীন জীবন সম্পর্কে কুরআন মজীদের বক্তব্যের প্রতি মনোনিবেশ করবো।
পরকালীন জীবন সম্পর্কে অবিশ্বাসীদের প্রশ্ন
কুরআন মাজীদ যখন পরকালীন জীবন সংক্রান্ত মতবাদ পেশ করে, তখন তার বিরুদ্ধে অবিশ্বাসীরা একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। তাদের সে প্রশ্নটি ছিলো ঠিক আজকের অবিশ্বাসীদেরই প্রশ্নের অনুরূপ। আর প্রকৃতপক্ষে এ সম্পর্কে একটি প্রশ্নই উত্থাপন করা সম্ভবপর। তাহলো এই যে, মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করা সম্পুর্নরূপে বুদ্ধি ও ধারণার বহির্ভূত কথা নয় কি? যে মৃত ব্যক্তি পঁচে গলে মাটিতে মিশে গেছে, যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাটি, বাতাস ও পানিতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, সে আবার জীবন লাভ করবে- এটা আমরা কি করে মেনে নিতে পারি?
আরবী*************
“তারা বললোঃ আমরা যখন মাটিতে বিলীন হয়ে যাবো, তারপর কি আমরা আবার নতুনভাবে জন্মলাভ করবো? ”-(সূরা সাজদাহঃ ১০ )
আরবী************
“তারা বললোঃ যখন মাংস গলে গিয়ে আমাদের শুধু হাড়-গোড় থেকে যাবে এবং আমরা গুড়ো গুড়ো হয়ে যাবো, তারপর কি আমাদের নতুনভাবে সৃষ্টি করে উঠানো হবে?
”-(সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৪৯)
আরবী**************
“আমরা মরে মাটিতে মিশে যাবার পর কি আবার উঠবো? এরূপ প্রত্যাবর্তন তো বুদ্ধি ও ধারণার বহির্ভূত।”-(সূরা আল ক্বাফঃ ৩)
আরবী***************
“হাড় গোড় পঁচে-গলে যাবার পর কে আবার তাঁকে জীবিত করবে? ”-(সূরা ইয়াসীনঃ ৭৮)
কুরআন মাজীদের যুক্তিধারা
এ সন্দেহের মোকাবিলায় কুরআন মাজীদ একটি অনুপম যুক্তিধারা অবলম্বন করেছে। তাহলো এই যে, কুরআন সর্বপ্রথম আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাদি পর্যবেক্ষণ করার এবং সে সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করার দিকে লোকদের আহ্বান জানিয়েছে।
সে বলছেঃ আরবী****************
“আমরা বিশ্বপ্রকৃতিতে এবং খোদ তাদের অস্তিত্বের মধ্যে আপন নিদর্শনাদি প্রত্যক্ষ করাবো, যাতে করে তাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এটিই হচ্ছে সত্য।”। -(সূরা হা-মীম আস সেজদাঃ ৫৩)
আরবী**************
“তারা কি আসমান ও জমিনের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না?
”-(সূরা আল আরাফঃ ১৮৫)
আরবী*************
“আসমান ও জমিনে বহু নিদর্শন রয়েছে যেগুলো তারা অতিক্রম করে যায়, কিন্তু সে সম্পর্কে তারা চিন্তা-ভাবনা করে না”-(সূরা ইউসুফঃ ১০৫)
এ ইঙ্গিতের দ্বারা বলা হয়েছে যে, যেসব জিনিস মানুষের ইন্দ্রিয়নিচয় থেকে প্রচ্ছন্ন রয়েছে, সেগুলো চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করা কিংবা অভিজ্ঞতার সাহায্যে সেগুলোর স্বরূপ নির্ণয় করার মতো শক্তি তাকে দেয়া হয়নি। অবশ্য দিন রাত তার সামনে পেশকৃত নিদর্শনাদি খোলা চোখে প্রত্যক্ষ করলে, আসমান ও জমিনের ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষন করলে, খোদ নিজের পয়দায়েশের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এবং এসব ইন্দ্রিয়গোচর ও পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যাবলীর সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে প্রকৃত সত্য পর্যন্ত পৌছার চেষ্টা করলে- সে অনায়াসেই বুঝতে পারবে যে, যা কিছু বলা হয়েছে তা নির্ভুল, যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত।
পরকালীন জীবনের সম্ভাবনা
তারপর এ বহির্দৃশ্য ও বাহ্য নিদর্শনাদির মধ্যে যে জিনিসগুলো সম্পুর্ণ রূপেই সুস্পষ্ট, কুরআন সেগুলোকে লোকদের সামনে পেশ করে এবং তা দ্বারা এ যুক্তি প্রদর্শন করে যে, যে বিষয়টিকে তোমরা বুদ্ধিবৃত্তি ও ধারণার বহির্ভূত মনে করছো, তা তোমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও ধারণায় যতোই অসম্ভব বিবেচিত হোক- প্রকৃতপক্ষে তা মোটেই অসম্ভব ব্যাপার নয়।
আরবী************
“সেই আল্লাহ, তোমাদের নিকট দৃশ্যমান স্তম্ভ ছাড়াই আসমানকে সমুন্নত করে রেখেছেন, তারপর তিনি আরশের অপর দীপ্তিমান হয়েছেন। তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে আজ্ঞাবর্তী করেছেন। তাদের প্রত্যেকেই এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে গতিমান রয়েছে। তিনিই গোটা বিশ্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেন। তিনি আপন নিদর্শনাদি স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে করে তোমরা আপন প্রভুর সাথে
সাক্ষাতকার সম্পর্কে প্রত্যয়শীল হও।”-(সূরা আর রাদঃ ২)
আরবী***********
“তোমাদের সৃষ্টি করা কি বেশী কঠিন, না আসমান সৃষ্টি? আল্লাহ তো (এত বড় জিনিস) তৈরী করেছেন।”-(সূরা আন নাজিয়াতঃ ২৭)
এসব আসমানী কদর নিদর্শনের দ্বারা এ সত্য প্রতিপন্ন করা হচ্ছে যে, একমাত্র আল্লাহ-ই এতোবড়ো বিশ্বপ্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন। বড়ো বড়ো গ্রহ নক্ষত্রকে তিনি নিজস্ব আইনের বন্ধনে বেঁধে রেখেছেন। তাঁর কুদরতই এ বিরাট জগতকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সাহায্যে চালিত করেছে। ফলে কোনো গ্রহই তার কক্ষপথকে চুল পরিমাণ অতিক্রম করতে পারে না; নিজেদের নির্ধারিত আয়ুষ্কাল থেকে মূহুর্তের জন্যেও বিচ্যুত হতে পারে না। তাঁর অসীম শক্তিই বিশ্বপ্রকৃতির স্তরগুলোকে অদৃশ্য, অননুভূত এবং মানুষের আয়ত্ব বহির্ভূত অবলম্বনের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। এহেন শক্তিমান ও ক্ষমতাবান আল্লাহ মানুষের মতো তুচ্ছ সৃষ্টিকে একবার ধ্বংস করে পুনর্বার জীবিত করতে সক্ষম নয়-তাঁর সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা কত বড় খামখেয়ালী ও নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হতে পারে?
আরবী************
“তারা কি দেখে না যে, যে আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের মতো মানুষ সৃষ্টি করতেও সক্ষম।”-(সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৯৯)
আসমানের পর কুরআন আমাদের নিকটতম পরিবেশ, অর্থাৎ পৃথিবীর নিদর্শনাবলীর প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেঃ
আরবী************
“পৃথিবীর বুকে ভ্রমন করো এবং আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেছেন তা দেখো।
আর সেই আল্লাহ-ই বস্তুনিচয়কে পুনর্বার জীবন দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব জিনিসের উপর ক্ষমতাবান।”-(সূরা আনকাবুতঃ ২০)
আরবী****************
“তাদের জন্যে মৃত ভূমিই হচ্ছে একটি নিদর্শন; আমরা তাকে জীবন দান করেছি এবং তার থেকে ফসল উৎপাদন করেছি, যা তারা আহার করে থাকে।”-(সূরা ইয়াসীনঃ ৩৩)
আরবী****************
“আল্লাহর রহমতের নিদর্শন দেখো, জমিন মৃত হবার পর কিভাবে তিনি জীবনদান করেন। নিশ্চয়ই তিনি মৃত মানুষকেও অবশ্য জীবন দান করবেন। তিনি সকল জিনিসের উপর ক্ষমতাবান।”-(সূরা রূমঃ ৫০)
আরবী************
“তার নিদর্শনাদির মধ্যে একটি হলোঃ তোমরা জমিনকে শুকনো পড়ে থাকতে দেখছো। কিন্তু যখনি আমরা পানি বর্ষণ করি; অমনি তা অঙ্কুরিত ও ফলফুলে সুশোভিত হয়ে উঠে। কাজেই যিনি জমিনকে জীবিত করেছেন, তিনি মৃত মানুষকেও জীবন দান করবেন।
নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল জিনিসের উপর ক্ষমতাবান।”-(সূরা হা-মীম আস সেজদাঃ ৩৯)
আরবী**********
“আল্লাহই বাতাসকে পরিচালিত করেন। তারপর তা মেঘরাশিকে উপড়ে নিয়ে যায়।
অতঃপর আমরা সেই মেঘরাশিকে পানি-তৃণ-লতাহীন জনপদের দিকে চালিত করি। তারপর সেই মৃত-পতিত জমিনকে তিনি বৃষ্টির সাহায্যে জীবিত করে তোলেন। সুতরাং (কিয়ামতের দিনও) এভাবেই জীবিত হয়ে উঠতে হবে”-(সূরা ফাতিরঃ ৯)
এরপর কুরআন বলছে যে, সকল দিক থেকে চোখ বন্ধ করে খোদ নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা তলিয়ে চিন্তা করো। তাহলে দেখতে পাবে, মৃতকে জীবন দান সম্পর্কে আল্লাহর ক্ষমতার প্রমাণ তোমার নিজের ভেতরেই বর্তমান রয়েছে।
আরবী****************
“নিঃসন্দেহে মানুষের উপর দিয়ে মহাকালের এমন একটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, যখন সে কোনো উল্লেখযোগ্য জিনিসই ছিল না।”-(সূরা আদ দাহরঃ ১)
আরবী***************
“তোমরা মৃত ছিলে,আল্লাহ তোমাদের জীবিত করেছেন। তিনি আবার তোমাদের মৃত করবেন, আবার জীবিত করবেন। পুনরায় তাঁর দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।”-(সূরা আল বাকারাঃ ২৮)
আরবী***************
“মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত হবার ব্যাপারে যদি তোমাদের সন্দেহ থাকে তবে জেনে রাখো যে, আমরা মাটির ন্যায় নিষ্প্রাণ বস্তু থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি”-(সূরা আল হাজ্জঃ ৫)
আরবী**************
“সে বললোঃ হাড়-গোড় গলে যাবার পর কে আবার তাকে জীবিত করবে? বলে দাওঃ এসব তিনিই জীবিত করবেন যিনি প্রথমবার জীবনদান করেছিলেন।”-(সূরা ইয়াসীনঃ ৭৮-৭৯)
আরবী***************
“এদেরকে বলে দাওঃ তোমরা পাথর, লোহা, কিংবা তোমাদের মতে জীবিত হওয়া জ্ঞান-বুদ্ধি বহির্ভূত এমন কোন জিনিসেই পরিণত হও। অতঃপর তারা জিজ্ঞেস করেঃ আমাদেরকে কে পুনর্বার জীবিত করবে? বলে দাওঃ তিনিই (জীবিত করবেন)
যিনি প্রথমবার তোমাদের সৃষ্টি করেছিলেন”-(সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৫০-৫১)
*****************
“আমরা মানুষকে মাটির ঢেলা থেকে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর আমরা সেই ঢেলাকে শুক্রবিন্দুতে পরিনত করে একটা সুরক্ষিত জায়গায় রেখে দিয়েছি। তারপর শুক্রকে রক্ত পিন্ডে পরিণত করেছি। পুনরায় রক্ত পিন্ডকে মাংস পিন্ডে রুপ দিয়েছি। অতঃপর মাংস পিন্ডের জন্য অস্থিপিঞ্জর বানিয়েছি। অতঃপর অস্থি পঞ্জরের উপর মাংস সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাকে একটি ভিন্ন জিনিশ বানিয়ে দাঁড় করিয়েছি। কাজেই আল্লাহ অত্যন্ত বরকতপূর্ণ, তিনিই উত্তম স্রষ্টা। এরপর তোমরা অবশ্যই মৃত্যু বরণ করবে। তারপর কেয়েমতের দিন তোমাদের নিশ্চিতরূপে উথিত করা হবে। -(সূরা মুমেনূনঃ ১২-১৬)
*****************
“মানুষ কি শুধু একবিন্দু শুক্র ছিলনা বা মাতৃগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়েছিল? অতঃপর সে একটি রক্ত পিন্ডে পরিনত হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ মানবীয় রূপ দান করেছেন। এবং গঠন প্রকৃতিতে সুবিন্যস্ত করে দিয়েছেন। অতঃপর তাকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে দিয়েছেন। এবং পুরুষ ও নারীর জোড়া বানিয়েছেন এহেন আল্লাহ-ই কি মৃতকে জীবিত করাতে সমর্থ নন?”-(সূরা আল কিয়ামাহঃ৩৭-৪০)
এ পরিষ্কার সুস্পষ্ট ও আমাদের পর্যবেক্ষণ ও ইন্দ্রিয়ানুভুতির কাছাকাছি সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের পর কোরআন মজীদ ঠিক সাধারন (Commonsense)জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত একটি দলিল পেশ করেছে। সে বলেছে যে, কোন জিনিস বিক্ষিপ্ত ও বিশিষ্ট হয়ে যাবার পর পুনরবার তাকে সাবেক রূপে সৃষ্টি করার চেয়ে সম্পূর্ণ শূন্য অবস্থা থেকে তাকে সৃষ্টি করাতাই হচ্ছে কঠিন কাজ। কাজেই এ কঠিনতর কাজটি সম্পাদন করতে যে শক্তি অসামর্থ্য হয়নি, সে সহজতর কাজটি সম্পূর্ণ করতে কেন অসামর্থ্য হবে? এক ব্যাক্তি যদি মোটর আবিষ্কার এবং তা তৈরি করতে সক্ষমই হয় তবে তার খুচরা অংশগুলো পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করার পর পুনর্বার সেগুলো জুরে দিতে সে সামর্থ্য হবে না, এটা কি বোধগম্য হতে পারে? এ দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায় যে, যে বিশ্বকারিগর তোমাদেরকে শূন্য অবস্থা থেকে সৃষ্টি করেছেন, মৃত্যুর পর তিনি তোমাদেরকে পুনর্বার সৃষ্টি করতে মোটেই অক্ষম হতে পারেনা।
************
“তারা কি দেখে না যে, আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন? অতপর এভাবেই তিনি তার পুনরাবৃত্তি করবেন। আর এ কাজ আল্লাহর পক্ষে নিশ্চয়ই সহজতর।”- (সূরা আল আনকাবুতঃ১৯)
*************
“তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেন। তারপর তিনি তার পুনারাবৃত্তি করেন এ পুনরাবৃত্তি তার পক্ষে খুবি সহজতর”-(সূরা আর রূমঃ ২৭)
************
“আমরা কি প্রথমবার সৃষ্টি করতে অসমর্থ ছিলাম? (না, প্রথমবারের সৃষ্টিকে তারা অস্বীকার করে না) কিন্তু নতুন সৃষ্টিতে তাদের সন্দেহ রয়েছে”-(সূরা ক্কাফঃ ১৫)
একবার যেসব মৃতের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তারা আবার কিভাবে সাবেক দেহে পরিণত হবে- এ সন্দেহটুকু বাকী থেকে যায়। কারণ কেউ পানিতে দুবে মারা গেছে এবং তার হাড় –মাংস মৎস ও জলজ প্রাণীর খাদ্যে পরিণত হয়েছে। কেউ আগুনে পুড়ে মারা গেছে কিংবা মরার পর পুড়ে ফেলা হয়েছে এবং গোটা দেহ ভস্ম ও ধুম্রে রূপান্তরিত হয়েছে। কেউ ভূমিতে সমাহিত হয়েছে এবং তার দেহ মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন তার সাবেক দেহ ফিরেয়ে আনা এবং তাতে সেই সাবেক রূহ ফুঁকে দেয়ে কিভাবে সম্ভবপর? লোকেরা এ সন্দেহ আপনাদের চেষ্টা করেছে এ বলে যে, আত্মাকে দৈহিক জীবন দাণ করার জন্ন্যে তার সাবেক দেহ ফিরেয়ে দেয়া অপরিহার্য নয়। বরং এমন হতে পারে যে, আত্মা সেটিই থাকবে এবং তার সাবেক দেহের অনুরূপ কোন ভিন্ন দেহ দান করা হবে। কিন্তু কোরআন বলেছে যে, আল্লাহ সাবেক দেহ দান করতেই সক্ষম। মানুষের দৈহিক অঙ্গ-প্রত্তঙ্গই শূন্যে বিলীন হয়ে যায়নি, বরং বিক্ষিপ্ত অবস্থায় তার প্রতিটি অংশ কোথাও না কোথাও বর্তমান রয়েছে। বাতাসে, পানিতে, মাটিতে উদ্ভিদ বা পশুর দেহে, খনিজ পদার্থে নানাভাবে তার অংশগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। আল্লাহর জ্ঞান এমন সর্বোব্যাপক যে, তাঁর প্রতিটি অংশের অবস্থান সম্পর্কে তিনি অবহিত। তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা এমন অপরিসীম যে, ঐ বিক্ষিপ্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে একত্র করে তিনি সাবেক রূপ দান করতে সক্ষম।
************
“জমীন তাদের মধ্যে থেকে কি জিনিস ক্ষয় করে আমরা জানি আমাদের কাছে এমন কিতাব আছে যাতে প্রত্যেকটি জিনিসের রেকর্ড সুরক্ষিত আছে।”-(সূরা ক্কাফঃ ৪)
************
“তাঁর কাছে অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে, যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। স্থলে ও জলে জা কিছু আছে, সবই তিনি জানেন। এমনকি গাছের একটি পাতা পরলেও তিনি জানেন। দুনিয়ার অন্ধকার পর্দার ভিতর এমন কোন দানা নেই, আর এমন কোন শুষ্ক ও সিক্ত জিনিস ও নেই, যা সুস্পষ্টরূপে প্রদর্শনকারী এক কিতাবে বর্তমান নেই।”-(আনআমঃ ৫৯)
উপরে যা কিছু বলা হলো, পরকাল অবিশ্বাসের ভিত্তিমুলে অবস্থিত সন্দেহগুলো দূর করাই হচ্ছে তাঁর উদ্দেশ্য। অবশ্য অবিশ্বাসের মুল কারণ এ নয় যে, অবিশ্বাসীরা কোন অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ বা অন্য কোন নিশ্চিত জ্ঞান সূত্রের মাধ্যমে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের অসম্ভাবনাকে চূড়ান্ত ও সুস্পষ্টরূপে জেনে নিয়েছে অবিশ্বাসের একমাত্র ভিত্তি হল, মৃত্যুর পর আবার জীবিত হওয়াটা তাদের বোধগম্য নয়। তারা এরূপ দৃশ্য কখনও দেখেনি বরং তারা দেখে আসছে যে, একবার যে মরছে সে আর ফিরে আসেনি। কাজেই যে মরেছে সে আবার ফিরে আসবে একথা যখন বলা হয়, তখন এ স্বভাব বিরোধী কথাটাকে তারা অবাস্তব, অসম্ভব এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও ধ্যান-ধারনার বহির্ভূত মনে করে। কিন্তু চিন্তা গবেষণার পথে আ একটি ধাপ অগ্রসর হলেই এসব শোবা-সন্দেহ দূর হয়ে যায় এবং পূর্বের অসম্ভব বিষয়টাকে ঠিক সম্ভবপর মনে হয় যে বিষয়-গুলোকে লোকেরা সম্ভবপর বরং বাস্তব ও যথার্থ মনে করে, সেগুলোর অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করতে তারা অভ্যস্ত বলেই এরূপ মনে করে থাকে। একটি বীজ মাটির মধ্যে গিয়ে অঙ্কুরিত হয় এবং এক প্রকাণ্ড ধাল-পালা বিশিষ্ট বৃক্ষরূপে আত্নপ্রকাশ করে। এক ফোটা শুক্র মাতৃগর্ভে গিয়ে পৌঁছে এবং সেখান থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপে বেরিয়ে আসে। দুটি বাতাসের সমন্বয়ে পানির সৃষ্টি হয়। এবং একটি নির্দিষ্ট নিয়মে বারবার পানি থেকে বাষ্প এবং বাষ্প থেকে পানির সৃষ্টি হয়। শূন্য লোকের বিশাল অঙ্গনে কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র বলের মতো ছুটে চলছে এবং কোন বস্তুগত যোগসূত্র ছাড়াই তারা পরস্পরে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এসব গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি, পরিক্রম ও আবর্তন ব্যবস্থার কোথাও বিন্দুমাত্র গরমিলের সৃষ্টি হচ্ছে না। এ সকল বিষয় দেখতে লোকেরা খুবই অভ্যস্থ, এ জন্য এগুলোকে তারা সাধারণ বিষয় মনে করে। কিন্তু এ জিনিসগুলোই যদি তাদের সামনে প্রকাশ না পেত এবং এর পরিবর্তে অপর কোন ব্যবস্থাপনায় তারা অভ্যস্থ হতো, তবে এগুলোকেই তারা বুদ্ধিবৃত্তি ও ধারণার বহির্ভূত মনে করতো এবং দৃঢ়তার সাথে এদের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতো। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, মঙ্গল গ্রহে কোন গাছ-পালা জন্মায় না। সেখানকার অধিবাসীদের যদি বলা হয় যে, একটি মাষা পরিমাণ বীজ মাটিতে পুঁতলেই বিরাট বৃক্ষে পরিণত হয় এবং তাঁর সাবেক আকৃতি থেকে কয়েক হাজার, বরং কয়েক লক্ষ গুন বড় হয়ে যায়, তবে একথা মঙ্গল গ্রহবাসীদের ততোটাই বিস্ময়কর মনে হবে দুনিয়াবসীর কাছে মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভের ব্যাপারটা যতখানি বিস্ময়কর মনে হয়। তারাও ঠিক এটাকে একইভাবে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু একথে সুস্পষ্ট যে, অসম্ভাবনার এ ফতোয়াটা জ্ঞান ও তথ্য নির্ভর নয় এবং তা হবে অজ্ঞতা ও মূর্খতা প্রসূত বিচার-বুদ্ধির অধিগম্যতার ফল নয়, বরং তা হবে অনধিগম্যতার ফল। পরকাল সম্পর্কে অবিশ্বাসের ব্যাপারটাও ঠিক এরূপ। লোকেরা যদি বিস্ময় ও অবিশ্বাসের স্বরূপটি বুঝে নেয় তবে স্বভাবতই তারা জানতে পারবে যে, কোন জিনিস তাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও ধারণার বহির্ভূত হওয়াটাই অসম্ভাবনার ও অবাস্তবতার পক্ষে কোন প্রমান নয়। মানুষ আজকে যেসব জিনিষ আবিস্কার করছে, একশ বছর পূর্বে সেগুলোই মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও ধারণার বহির্ভূত ছিলো। কিন্তু আজ বাস্তব ঘটনাবলী থেকে প্রমাণিত হয়েছে, আদতে এগুলো অসম্ভব ছিলো না। অনুরূপভাবে যে জিনিসগুলোকে আজ মানুষ অসম্ভব মনে করছে, একশো বছর পর তা মানুষের হাতেই সম্ভবপর হবে এবং বাস্তব ঘটনাবলী প্রমান করবে যে তাঁর মধ্যে অসম্ভব কিছু নেই। কাজেই মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি এবং তাঁর বহির্ভূত ও অন্তর্ভুক্ত রহস্যটি যখন এই, তখন এ সীমিত বুদ্ধির অধিগম্য নয় বলেই কোন জিনিসকে অসম্ভব বলা যেতে পারে না।
কোন প্রচ্ছন্ন ও ইন্দ্রিয় শক্তি বহির্ভূত জিনিসকে সাব্যস্ত করতে হলে সর্বপ্রথম তাঁর সম্ভাবনা সাব্যস্ত করা দরকার। তাই কুরান মজীদ অকাট্য যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে পরকালীন জীবন সংক্রান্ত সকল শোবা-সন্দেহ দূর করে তাঁর সম্ভাবনাকে সাব্যস্ত করছে। এতে করে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে তাঁর প্রয়োজনীয়তা সাব্যস্ত করা উচিত। এতে করে এমন একটা জিনিস যে অবশ্যই হওয়া দরকার, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি এটা সহজেই মেনে নিবে
বিশ্বব্যবস্থা একটা বিচক্ষণ ব্যবস্থা
এ বিশ্ব প্রকৃতি কি কোন বিচক্ষণ সত্তার সৃষ্টি, না কোন বিচক্ষণতা ছাড়া আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে? প্রকৃত পক্ষে এ প্রশ্নটির মীমাংসার ওপরই পরকালীন জীবনের প্রয়োজনীয়তা নির্ভরশীল। বর্তমান যুগের বিজ্ঞান ভক্ত মানুষ বলে যে, কোন বিচক্ষণ কারিগর এ বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টি করেননি। এ আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত সমগ্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ( যার মাধ্যমে মানুষ ও শামিল রয়েছে) নিয়ে এগিয়ে চলেছে। যেদিন বস্তু ও শক্তির (Energy) পারস্পরিক সংযোগ খতম হয়ে যাবে, সেদিন এ ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। একথা সুস্পষ্ট যে, কোন জ্ঞান, বুদ্ধি, চেতনা, ইচ্ছাশক্তি ও বিচক্ষণতা ছাড়াই এক অন্ধপ্রকৃতি (Nature) যে ব্যবস্থাপনা চালিত করেছে তাঁর মধ্যে কোন রূপ উদ্দেশ্য ও বিচক্ষণতার সন্ধান করা একেবারেই পণ্ডশ্রম। এ কারণেই আজকের জড় বিজ্ঞান প্রাকৃতিক নির্দেশনাদির উদ্দেশ্যমূলক কার্যকারণকে (Teleological Causation) শুধু নিজের সীমা বহির্ভূত করে দেয়নি, বরং এরূপ চিন্তাপদ্ধতিকে সম্পূর্ণ অবান্তর ও অর্থহীন ঘোষণা করেছে। সে চূড়ান্তরূপে দাবী করেছে যে, এ বিশ্বপ্রকৃতি এবং এর কোন জিনিস ও ক্রিয়া কাণ্ডের পেছনে কোনই উদ্দেশ্য নেই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, চক্ষু দেখার জন্যে নয়, বরং চক্ষুর ভেতরে বস্তুর যে বিশেষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে, তাঁর ফলশ্রুতিই হচ্ছে দেখা। অনুরূপভাবে মস্তিস্ক চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি ও চেতনার কেন্দ্রস্থল নয়, বরং যকৃত থেকে পিত্তরস নিঃসৃত হবার মতই মস্তিস্ক থেকে চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনা নির্গত হয়। বস্তুত দ্রব্যনিচয়ের প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ক্রিয়া-কাণ্ডকে তাদের উদ্দেশ্য বলে আখ্যায়িত করা এবং তাদের সৃষ্টির মধ্যে কোন বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা অনুসন্ধান করা নিছক ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ মতবাদটি স্বীকার করে নিলে পার্থিব জীবনের পর অপর কোন জীবনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে স্বীকার করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণই থাকে না। কারণ যে বিশ্বজগতের ব্যবস্থাপনা কোন অজ্ঞ, নির্বোধ ও অচেতন প্রকৃতির দ্বারা কোনরূপ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছাড়াই চালিত হচ্ছে, তাঁর মর্যাদা একটি একটি খেলনার বেশী কিছু হতে পারে না। যে বিশ্ব এবং তার প্রতিটি জিনিসই হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন এবং এ উদ্দেশ্যহীনতা পূর্ণতা লাভ করলেই সে ধ্বংস হয়ে যাবে। এহেন অন্ধ প্রকৃতির পক্ষে ন্যায়পরায়ণতার গুণে বিভূষিত হওয়া এবং তার কাছ থেকে কোন হিসাব-কিতাব ও ইনসাফের প্রত্যাশা করা সুদূর পরাহত। এতদসত্ত্বেও যদি তাকে ন্যায়পরায়ণতার গুণে বিভূষিত বলে ধরে নেয়াও যায়, তবুও মানুষ যেহেতু তার হাতে একটি অসহায় পুতুলের মতো খেলছে এবং নিজের ক্ষমতাবলে কিছু কয়া তো দুরের কথা, আদতে কোন ক্ষমতা ইচ্ছা-শক্তিরই সে অধিকারি নয়, কাজেই তার উপর কোন ভাল বা মন্দ কাজের দায়িত্ব আরোপিত হওয়া উচিত নয় – যেমন মোটরের উপর সোজা কি বাঁকা পথ গমনের কোন দায়িত্ব অর্পিত হয় না। আর দায়িত্বের প্রশ্ন পরিত্যক্ত হবার পর দুনিয়াই বিচার ইনসাফ ও শান্তি- পুরস্কারের প্রশ্ন খতম হয়ে যায়- তার জন্যে স্বতন্ত্র জীবনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা তো দূরের কথা।
কিন্তু এ মতবাদটি সম্পূর্ণরূপেই বিচার-বুদ্ধির পরিপন্থী। একে প্রতিপন্ন করার জন্যে কোনরূপ বুুদ্ধিবৃত্তির প্রমাণ কিংবা বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যই পেশ করা হয়নি। এর সমর্থনে এ যাবত মোটামুটি বলা হয়েছে ঃ বিশ্বপ্রকৃতির কোন স্রষ্টা ও পরিচালক আমরা দেখতে পাই না এর সৃষ্টির কোন উদ্দেশ্য আমাদের বোধগম্য নয়। কোনরূপ ¯্রষ্টা ছাড়াই আমরা একে চলমান ও গতিশীল দেখতে পাই। আর এ গতিশীলতার উদ্দেশ্য জানা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়, তা জানার কোন প্রয়োজনীয়তাও আমরা দেখি না। কিন্তু কোন জিনিসের কার্যকারণ ও নিমিত্ত কারণ না জানাটাই তার কার্যকারণ ও নিমিত্ত কারণ না থাকাকে প্রমাণ করে না। মনে করুন ঃ একটি শিশু কোন মুদ্রণ যন্ত্রকে চলমান অবস্থায় দেখতে পেলো। এ যন্ত্রটি কি উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে, তা সে বুঝতে পারলো না। এ কারণে সে মনে করলো, এ শুধু একটি খেলনা মাত্র-কোন বিশেষ লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছাড়াই এটি চালিত হচ্ছে। সে দেখলো ঃ এ যন্ত্রটির যেরূপ আওয়াজ সৃষ্টি হচ্ছে, অংশগুলো নড়াচড়া করছে,,মাটি কেপেঁ কেঁপে উঠছে-তেমনি কাগজ ও ছেপে ছেপে বেরোচ্ছে। এ কারণে সে সিদ্ধান্ত করলোঃ ওই ক্রিয়াগুলো যেমন যন্ত্রটি চালিত হবারই পরিণতি,তেমনি কাগজগুলো ছেপে ছেপে বেরোনও তার গতিশীলতার এক স্বাভাবিক ফল। সে এটা বুঝতেই পারলো না যে, যন্ত্রটির এ গোটা ক্রিয়াকান্ডের মধ্যে শুধু একটি কাজ,অর্থাৎ কাগজ গুলো ছেপে বেরোনই হচ্ছে সমগ্র যন্ত্রটির জন্ম উদ্দেশ্য।আর বাকী সমস্ত ক্রিয়াকান্ড যন্ত্রটির গতিশীলতার স্বাভাবিক পরিণতি। তার শিশু সুলভ সন্ধানী দৃষ্টি এ যন্ত্রের অংশগুলোর বিন্যাস,সংস্থাপন ও নিয়ম-শৃংখলা উপলদ্ধি করার মতো শক্তিই অর্জন করেনি। এর প্রতিটি অংশ যেরূপ তৈরী করা হয়েছে এবং যেখানে সংযুক্ত করা হয়েছে, তার জন্যে সেইরূপ ও সেই জায়গাটিই যে উপযোগী এবং যন্ত্রের ভেতর নিজ ভাগের কাজ সম্পাদনের জন্যে অংশটির সেইরূপ ও সেই স্থানে থাকাই বাঞ্ছনীয় এটাও সে বুঝতে পারেনি। এ কারণেই সেই অপরিণত বুদ্ধি শিশু মনে করে নিয়েছে যে কতকগুলো লোহার টুকরার সংযুক্তির ফলে এ যন্ত্রটি আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে। এর পেছনে যে অবশ্যই কোন বিচক্ষণ সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন, যিনি উত্তম পদ্ধতি ও চমৎকার পরিকল্পনা অনুসারে এটি তৈরী করেছেন এবং এর কোন অংশই নিষ্ক্রিয়,অনুপযোগী,অসংবদ্ধ ও অপ্রয়োজনীয় রাখেননি, পরন্তু এমন বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সাথে পেশকৃত কোন জিনিস যে অকারণ,উদ্দেশ্যহীন ও নিরর্থক হতে পারে না-যন্ত্রটির ক্রিয়াকান্ড ও বিন্যাস বৈচিত্র দেখে তা ধারণা করার মতো উন্নত বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি তার নেই এখন মুদ্রণ যন্ত্রেও এ অসম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ এবং এ সম্পর্কে অপরিণত চিন্তা –ভাবনার দ¦ারা ওই নির্বোধ শিশু যদি এ মতবাদ গড়ে নেয় যে,যন্ত্রটির কোন কার্যকারণ ও নিমিত্ত কারণ নেই,এর সৃষ্টির ব্যাপারে কোন বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা ব্যয়িত হয়নি, এ রূপায়ণের সামনে কোন মহৎ লক্ষ্য বর্তমান নেই-তাহলে যন্ত্রটি সম্পর্কে শিশুর এ মতবাদকে নির্ভুল ও যথার্থ বলে কি কোন বুদ্ধিমান ও পরিণত বয়স্ক ব্যক্তি স্বীকার করবে?
একটি মুদ্রণ যন্ত্রের ব্যাপারে যদি একথা যথার্থ না হয় তাহলে যে বিশ্বব্যবস্থার প্রতিটি অণু-পরমাণু তার ¯্রষ্টার জ্ঞান-বুদ্ধি,ইচ্ছাশক্তি,বিচক্ষণতা ও দূর দৃষ্টির পক্ষে সাক্ষ্যদান করছে,তার সম্পর্কে কিভাবে যথার্থ হতে পারে? অপরিণত বুদ্ধি ও সংকীর্ণ দৃষ্টি শিশু যা ইচ্ছে তাই বলতে পারে। কিন্তু যে বুদ্ধিমান ব্যক্তি চোখ মেলে তাকিয়ে এ বিশ্বজগতের নিদর্শনাবলী পর্যবেক্ষণ কবে দেখেছে, সে এমন একটি বিচক্ষণ, সুবিন্যস্ত, সুশৃংখল ও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার সৃষ্টি,উদ্দেশ্য ও পরিচালনা সম্পর্কে যা খুশী তাই বলতে পারে না বস্তুত যে ব্যবস্থাপনার কোন একটি জিনিসও অকারণ ও নিরর্থক নয়,কোন জিনিস প্রয়োজনের কম বা অতিরিক্ত নয়,যার প্রতিটি অংশ নিজের স্থান ও প্রয়োজনের দৃষ্টিতে পুরোপুরি উপযোগী এবং যার নিয়ম শৃংখলার কোথাও কোন বিচ্যুতি লক্ষ্যগোচর নয় -তেমন একটি ব্যবস্থাপনার কোন জ্ঞান-বুদ্ধি,বিচক্ষণতা,ইচ্ছাশক্তি ছাড়াই সৃষ্টি ও পরিচালিত হতে পারে বলে এক মুহূর্তের জন্যে ও সে সন্দেহ পোষণ করতে পারে না
বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা লক্ষ্যহীন ও নিরর্থক হতে পারে না
পরকালীন জীবন সম্পর্কে কুরআন মজীদে যেসব যুক্তি প্রদর্শন করেছে, তা এ বুনিয়াদী মতবাদের ওপর নির্ভরশীল। এর সারকথা হলো ঃ এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা একজন বিচক্ষণ সত্তা।তাঁর কোন কাজই দূরদৃষ্টি থেকে মুক্ত নয় এবং দূরদৃষ্টি বিরোধী কোন কথাই তাঁর প্রতি আরোপ করা যায় না এ ভিত্তিটি রচনা করার পর কুরআন বলছে
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ {১১৫} فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ {১১৬}
“তোমরা কি এ ধারণা করেছো যে, আমরা তোমাদের নিরর্থক সৃষ্টি করেছি? এবং তোমাদেরকে আমার দিকে ডেকে পাঠানো হবে না? মহান সত্যশয়ী বাদশাহ আল্লাহ এর ঊর্ধে (অর্থাৎ তাঁর দ্বারা নিরর্থক কোন কাজ হয় না )।”-(সূরা আল মুমেনুন ঃ ১১৫-১১৬)
أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَن يُتْرَكَ سُدًى {৩৬}
“মানুষ কি এটা মনে করে বসেছে যে, তাকে এমনই অকারণ ছেড়ে দেয়া হবে?”-(সূরা আল কিয়ামাহ ঃ ৩৬)
} وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِينَ {৩৮} مَا خَلَقْنَاهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ {৩৯} إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ مِيقَاتُهُمْ أَجْمَعِينَ {৪০}
“আমরা আসমান, জমীন এবং তার মধ্যকার বস্তুনিচয়কে খেলার সামগ্রিরূপে সৃষ্টি করিনি। আমরা তো এগুলো বিচক্ষণতার দাবী অনুসারে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না। অবশ্য তাদের জন্যে বিচারের দিন পর্যন্ত সময় নির্দিষ্ট।”-(সূরা আদ দোখান ঃ৩৮-৪০)
أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوا فِي أَنفُسِهِمْ مَا خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُّسَمًّى وَإِنَّ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ بِلِقَاء رَبِّهِمْ لَكَافِرُونَ {৮}
“তারা কি নিজেদের অন্তরে চিন্তা করে দেখেনি যে, আসমান, জমীন ও তার মধ্যকার বস্তুনিচয়কে আল্লাহ বিচক্ষণতার সাথে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের জন্যে একটি সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন? কিন্তু বহু লোকই আপন প্রভুর সাথে সাক্ষাতকারকে অবিশ্বাস করে।”-(সূরা আর রূম ঃ৮)
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে এ মর্মে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আসমান ও জমীনের এ বিশাল কারখানাটি যদি মাত্র কিছুকাল পর্যন্ত চলতে থাকে এবং তারপর কোন ফলাফল ও পরিণতি ছাড়াই ধ্বংস ও বিলীন হয়ে যায়, তবে তা হবে একটি অকারণ ও অনর্থক কাজ-একটি খেল-কামাশা মাত্র। এটা কখনো কোন বিচক্ষণ ব্যক্তির কাজ হতে পারে না লোকেরা যদি বিশ্বাস করে যে, এ কারখানাটি আল্লাহ তৈরী করেছেন আর আল্লাহ তাদের দৃষ্টিতে বিছক্ষণ সত্তা বলে পরিগণিত হন, তাহলে বিচার বুদ্ধির সাহায্যে তাদের এটাও বোঝা উচিত যে, সৃষ্টিজগতের কোন জিনিসই উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি নয়-কোন জিনিসই নিষ্ফল ও নিরর্থক বিলীন হয়ে যাবার নয়। বিশেষত মানুষ হচ্ছে বিশ্বজগতের সবচেয়ে সেরা সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত। তার সচেতন সত্তাই এ জগতের ক্রমবিকাশ এবং এক সমগ্র গতিপ্রকৃতির চাবিকাঠি। তাকে অপরিসীম বিচক্ষণতার সাথে জ্ঞান-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, দূরদৃষ্টি ও ইচ্ছাশক্তির দ্বারা ভূষিত করা হয়েছে এহেন মানুষ এ দুনিয়ায় মাত্র কয়েক বছর একটি যন্ত্রের মতো বেঁচে থাকবে এবং তারপর সে ধ্বংস ও বিলীন হয়ে যাবে-তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য এতোখানি নিরর্থক হতে পারে না
প্রজ্ঞার দাবীতে বিশ্বব্যবস্থার কি পরিণতি হওয়া উচিত
ওপরের আলোচনা থেকে জানা গেল যে, এ বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও পরিচালনা নিরর্থক খেল-তামাশা নয়, এর কোন জিনিসই অকারণ ও উদ্দেশ্যহীন নয়। এখন দ্বিতীয় কথা হলো এই যে, বিচার-বুদ্ধির দাবী অনুসারে ধ্বংস ও বিলুপ্তি ছাড়া এ বিশাল কারখানাটির আর কী পরিণতি হতে পারে এ প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব কুরআন মজীদে বর্তমান রয়েছে সে জবাব শোনার পর সুস্থ বিচার –বুদ্ধি একবারে নিশ্চিন্ত ও পরিতুষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এ জবাবটি বোঝার পূর্বে কতিপয় বিষয় হৃদয়ে বদ্ধমূল করা একান্ত প্রয়োজন।
এক ঃ সৃষ্টিজগতের সমস্ত নিদর্শন এ সাক্ষ্য বহন করছে যে, এ ব্যবস্থাপনায় গোটা আবর্তন ও পরিবর্তনের গতিমুখ ক্রমবিকাশের দিকে নিবদ্ধ। বস্তুর অপূর্ণতাকে পূর্ণতার দিকে চালিত করা এবং তার অসম্পূর্ণ রূপকে পূর্ণতার করে তোলাই এর সমস্ত বিবর্তনের উদ্দেশ্য।
দুই ঃ এ ক্রমবিকাশ নীতি যেহেতু পরিবর্তনের রূপে কার্যকরী হয়, সেহেতু প্রত্যেক সৃষ্টির জন্যেই একটি লয়ের প্রয়োজন একটি আকৃতির সৃষ্টি স্বভাবতই পূর্বতন আকৃতির ধ্বংস বা লয় দাবী করে। আর অপূর্ণ আকৃতির বিলুপ্তি পূর্ণতার সৃষ্টিরই সূচনা করে থাকে। এ আবর্তন ও পরিবর্তন প্রতিটি মুহূর্তে সংঘটিত হয় বটে, কিন্তু বহু গুপ্ত পরিবর্তনের পরই একটি প্রকান্ড প্রত্যক্ষ পরিবর্তন সূচিত হয়ে থাকে যার মধ্যে একটি প্রকান্ড প্রত্যক্ষ লয় সংঘটিত হয়। এ দ্বিতীয় প্রকার লয়কেই আমরা সাধারণ ভাষায় ‘মৃত্যু’ বা পতন নামে আখ্যায়িত করে থাকি। আর একটি আকৃতির সৃষ্টির পর থেকে তার মৃত্যু বা চুড়ান্ত লয় পর্যন্ত সময়কে আমরা ‘জীবন’ নামে অভিহিত করি।
তিন ঃ প্রত্যেক আকৃতিই অবস্থার উপযোগী এক বিশেষ আশ্রয় বা অবলম্বন দাবী করে কোন আকৃতিই তার অবস্থার উপযোগী নয়, এমন আশ্রয়ে বাস করতি পারে না দৃষ্টান্ত স্বরূপ, উদ্ভিদ রূপের জন্যে প্রাণীর দেহ অনুপযোগী। অনুরূপভাবে মানুষের জন্যে যে বিশিষ্ট দৈহিক কাঠামো তৈরী করা হয়েছে,মানবীয় সত্তা ঠিক তারই দাবীদার কাজেই কোন বস্তুকে উন্নততর রূপদান করতে হলে নিকৃষ্টতর রূপের জন্যে তৈরী বাসস্থান ভেঙ্গে ফেলা এবং নতুন রূপের উপযোগী বাসস্থান নির্মাণ একান্ত অপরিহার্য।
চার ঃ বিশ্বজগতের বিভিন্ন অংশের বেলায় ক্রমবিকাশ নীতির ব্যাপকতাকে যে ব্যক্তি উত্তমরূপে বুঝতে পেরেছে,তার দৃষ্টিতে গোটা বিশ্বব্যবস্থার ওপর এ নীতির পরিব্যপ্তি কিছুতেই প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে না বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সৃষ্টির ধারা শুরু হবার আগে আর কতো ব্যবস্থা অতিক্রান্ত হয়েছে, যার প্রত্যেকটি ব্যবস্থা নিজ নিজ আয়ুষ্কাল পূর্ণ করে অধিকতর উন্নত ব্যবস্থার জন্যে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে এবং ক্রমবিকাশের ক্রমিক স্তরগুলো অতিক্রম করে সৃষ্টির ধারা আমাদের এ ব্যবস্থা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে, তা এ ব্যবস্থাপনা দেখে আমরা বলতে পারি না অনুরূপভাবে এ ব্যবস্থাটিও সর্বশেষ ব্যবস্থা নয়। এটিও যখন সম্ভাব্য পূর্ণত্বে উপনীত হবে এবং পূর্ণতার উচ্চতর স্তরে উন্নীত হবার সামর্থ এতে না থাকবে, তখন একেও চূর্র্ণ করে এর পরিবর্তে আন্য কোন ব্যবস্থা কায়েম করা হবে সে ব্যবস্থার আইন বিধান হবে অন্যরূপ এবং তাতে সৃষ্টির পূর্ণতর পর্যায়ে উন্নীত হবার যোগ্যতাও বর্তমান থাকবে।
পাঁচ ঃ বিশ্বজগতের বর্তমান ব্যবস্থাপনার সম্পর্কে তলিয়ে চিন্তা করলেই স্পষ্টরূপে অনুভব করা যায় যে, এ একটি অসম্পূর্ণ ব্যবস্থা এবং এর অধিকতর পূর্ণতার প্রয়োজন এ ব্যবস্থার দ্রব্যনিচয়ের অন্তর্নিহিত মৌল তত্ত্বগুলো (হাকীকত) বস্তুগত মালিন্যে এতখানি আচ্ছন্ন যে মৌল তত্ত্বগুলো তুচ্ছ কল্পনার এবং তাদের বস্তুগত আবরণটা মৌল তত্ত্বেও মর্যাদা লাভ করেছে। যে জিনিস যতবেশী সূক্ষ্ম এবং বস্তুগত মালিন্য থেকে মুক্ত,তা এ বিশ্বব্যবস্থার ততখানিই প্রচ্ছন্ন, আবৃত এবং বুদ্ধি ও চেতনার নাগাল থেকে দূরে অবস্থিত। এখানে নিরেট বস্তুগত দেহের গুরুত্ব রয়েছে, কিন্তু সূক্ষ্ম ও অমিশ্র তত্ত্বের কোন গুরুত্ব নেই। এখানে গাছ,পাথর ইত্যাদি ওজন করা যেতে পারে, কিন্তু বিচার-বুদ্ধি,চিন্তা-কল্পনা,ধ্যান-ধারণা, ইচ্ছা-আকাংখা,আহবান-অনুভূতি দূরদৃষ্টি মাপা কিংবা ওজন করার মতো উপায় এ বিশ্বব্যবস্থায় নেই।এখানে খাদ্যবস্তু ওজন করা যেতে পারে, কিন্তু প্রেম ও ঘৃনা ওজন করার কোন মানদ- নেই। এখানে কাপড় মাপার ব্যবস্থা আছে,কিন্তু ক্রোধ ও হিংসা পরিমাপ করার কোন মাপকাঠি বর্তমান নেই।এখানে টাকা –পয়সার মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে, কিন্তু বদান্যতা ও কৃপণতার পেছনে ক্রিয়াশীল ভাবধারার মূল্যমান নির্ণয় করা সম্ভবপর নয়।এ হচ্ছে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার ত্রুটি। তাই বিচার বুদ্ধিএর চেয়ে উন্নততর কোন ব্যবস্থাপনার দাবী করে, যেখানে মৌলিক তত্ত্বগুলো বস্তুগত আবরণের মুখাপেক্ষী না হয়ে স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবে-যেখানে স্থুলতার ওপর সূক্ষ্মতা জয়যুক্ত হবে এবং আজকের প্রচ্ছন্ন ও আবৃত জিনিসগুলো উজ্জ্বল ও স্পষ্টতর হয়ে উঠবে। অনুরূপভাবে এ জগতের আর একটি ত্রুটি এই যে,এখানে বস্তুগত আইন-বিধান প্রভাবশালী রয়েছে,এর ফলে বস্তুগত আইন-বিধানের সাথে যা সঙ্গতিপূর্ণ ক্রিয়া-কর্মের শুধু সেই ফলাফলই প্রকাশ পাচ্ছে। আর যা বিচার-বুদ্ধি,দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তেমন ফলাফল আদৌ প্রকাশিত হয় না। এখানে আগুন লাগলে সমস্ত দহনশীল বস্তু পুড়ে যাবে,পানি ঢাললে আদ্রতা ও সিক্ততা গ্রহণকারী জিনিসগুলো ভিজে যাবে; কিন্তু সৎকাজ করলে তার ফল সুকৃতির রূপে – যা তার স্বাভাবিক বুদ্ধিভিত্তিক পরিণতি – প্রকাশ পাবে না। বরং তা বস্তুগত আইন-বিধানের উপযোগীরূপে তা সুকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত দুষ্কৃতিই হোক না কেন-প্রকাশিত হবে। এসব অসম্পূর্ণতা দেখে বিচার-বুদ্ধি স্বভাবতই এ ব্যবস্থার পর কোন উন্নততর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবী করে, যেখানে বস্তুগত আইন-বিধানের পরিবর্তে বুদ্ধি-ভিত্তিক আইন-কানুন প্রবর্তিত হবে এবং বর্তমান ব্যবস্থায় বস্তুগত আইন-বিধান জয়যুক্ত থাকার ফলে ক্রিয়া কর্মের যে স্বাভাবিক ফলাফল প্রকাশ পেতে পারছে না, তা সঠিক রূপে প্রকাশ পাবে।
বিশ্বব্যবস্থার পরিসমাপ্তি
এ প্রথমিক কথাগুলো অনুধাবন করার পর কুরআনে হাকীম কিয়ামত ও পরকালীন পুনর্জীবনের যে চিত্র এঁকেছে, তাতে মূল প্রশ্নটির কি জবাব পাওয়া যায় এক্ষণে তাই আমরা দেখব।
কোরআন বলেছেঃ
مَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُّسَمًّى
“আমরা আসমান, জমীন ও তাদের মধ্যকার বস্তুনিচয়কে বিচক্ষণতার দাবী অনুসারে এবং এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সৃষ্টি করেছি”।
-(সূরা আল আহকাফঃ ৩)
وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لأَجَلٍ مُّسَمًّى
“তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে একটি বিশেষ আইনের অধীন করে দিয়েছেন। এসবই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চলছে”।
-(সূরা আর রা’দঃ ২)
অতঃপর সে কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা করছে নিম্নোক্তরূপেঃ
وَإِذَا الْقُبُورُ بُعْثِرَتْO وَإِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْO وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انتَثَرَOإِذَا السَّمَاء انفَطَرَتْO
যখন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে, নক্ষত্রগুলো ছিটকে পড়বে, সমুদ্র উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে, এবং কবরগুলো উদগীরণ করে দিবে”।
-(আল ইনফিতারঃ ১-৪)
وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ O وَإِذَا النُّجُومُ انكَدَرَتْOإِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ
“যখন সূর্য ঢেকে দেয়া হবে, তারকাগুলো বিপর্যস্ত হয়ে যাবে এবং পাহাড় চালিত করা হবে”। -(সূরা আত তাকবীরঃ ১-৩)
وَإِذَا الْجِبَالُ نُسِفَتْ O وَإِذَا السَّمَاء فُرِجَتْ O فَإِذَا النُّجُومُ طُمِسَتْ
“যখন তারকা স্তিমিত হয়ে যাবে, আসমান বিদীর্ণ করা হবে এবং পাহাড় উড়িয়ে দেয়া হবে”। -(সূরা আল মুরসালাতঃ ৮-১০)
وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ O وَخَسَفَ الْقَمَرُOفَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ
“যখন চক্ষু বিষ্ফোরিত হবে, চন্দ্র নিষ্প্রভ হয়ে যাবে, এবং চন্দ্র ও সূর্য একাকার হয়ে যাবে”। -(সূরা আল কিয়ামাহঃ ৭-৯)
وَحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً
“জমীন ও পাহাড়গুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়া হবে এবং একই আঘাতে তারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে”। -(সূরা আল হাককাহঃ ১৪)
يَوْمَ تُبَدَّلُ الأَرْضُ غَيْرَ الأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ وَبَرَزُواْ للّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ
“যেদিন জমীন পরিবর্তন করে ভিন্নরূপ জমীনে পরিণত করা হবে এবং তদ্রূপ করা হবে আসমানকেও। আর সবাই এক ও জবরদস্ত আল্লাহ্র সামনে এসে উপস্থিত হবে”। -(সূরা ইবরাহীমঃ ৪৮ )
এ আয়াতগুলোতে এ ইঙ্গিতই করা হয়েছে যে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল রয়েছে। এটা কোন চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। এর আয়ুষ্কাল পূর্ণ হয়ে গেলে গোটা ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে। সূর্য, পৃথিবী, চন্দ্র এবং অন্যান্য যে সব গ্রহ-উপগ্রহের আবর্তনের উপর এ ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠিত, তা সবই বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, একটি অপরটির সাথে সংঘর্ষ মুখর হবে এবং এ অস্থায়ী প্রাসাদটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, সৃষ্টিজগত সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে – সৃষ্টির ধারাক্রমও বন্ধ করে দেওয়া হবে। বরং এর তাৎপর্য এই যে, বর্তমান ব্যবস্থাধীনে চালিত সৃষ্টির এ বিশেষ ধারণাটি পরিবর্তিত করা হবে এবং সৃষ্টিজগতের জন্য এক ভিন্ন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করা হবে। […………………] আয়াতে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
পরকালীন জীবনের ব্যবস্থাপনা কি হবে?
এখানে প্রশ্ন জাগতে পারেঃ সে ব্যবস্থাটি কি রকম হবে? এ সম্পর্কে কোরআন মাজিদের বর্ণনা থেকে স্পষ্টত জানা যায় যে, সেটি হবে বর্তমান ব্যবস্থাপনারই অসম্পূর্ণতার পূর্ণতা, এ ব্যবস্থাটির বিকশিত ও বিবর্তিত রূপ এবং অবিকল বিচার-বুদ্ধির চাহিদার অনুরূপ। সে ব্যবস্থায় ওজন, পরিমাপ ও হিসেব গ্রহণ সবকিছুই সম্পাদিত হবে। কিন্তু এগুলো বস্তুগত জিনিসের জন্যে নয়, বরং সূক্ষ্ম, মৌল তত্ত্ব ও হাকিকতসমূহের জন্যে সেখানে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণ, ঈমান ও কুফর, নৈতিকথা ও অনৈতিকতার ওজন করা হবে। লোকদের নিয়ত, মনন, ইচ্ছা ও আকাংখা পরিমাপ করা হবে। মনের গুপ্ত ক্রিয়াকর্ম মাপজোখ ও ওজন করা হবে। সেখানে গরিবকে দেওয়া রুটি বা পয়সা হিসেব করা হবে না, কিন্তু এ বদান্যতার পিছনে ক্রিয়াশীল নিয়তটির হিসেব নেয়া হবে। কারণ এ দুনিয়ার মত সেখানকার আইন-কানুন বস্তুগত হবে না – হবে বুদ্ধিবৃত্তিক।
إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً
“চোখ, কান, মন সবকিছুকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে” -(সূরা বনী ইসরাইলঃ ৩৬)
وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِن كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِ
“কিয়ামতের দিন আমরা নির্ভুল পরিমাপকারী দাঁড়িপাল্লা রাখবো। সুতরাং কোন ব্যাক্তির প্রতি কিছুমাত্র যুলুম করা হবে না। বরং একটি সরিষা পরিমাণ আমল হলে তাও আমরা নিয়ে আসবো। আর হিসেব করার জন্য আমরাই যথেষ্ট”। -(সূরা আল আম্বিয়াঃ ৪৭)
O وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَن ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُوْلَـئِكَ الَّذِينَ خَسِرُواْ أَنفُسَهُم
“সেদিন নিশ্চিতরূপে আমল পরিমাপ করা হবে। অতঃপর যার আমলের ওজন ভারী হবে, সে-ই কল্যাণলাভ করবে। আর যার আমলের ওজন হালকা হবে, তারাই হবে ক্ষতি বরণকারী” -(সূরা আল আরাফঃ ৮-৯)
O فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ Oيَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَاتًا لِّيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ
وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
“সেদিন লোকেরা নিজ নিজ আমল প্রত্যক্ষ করার জন্যে পৃথক পৃথক ভাবে বেরোবে। অতঃপর যে ব্যক্তি অণু পরিমাণও সৎকাজ করবে তাও সে দেখতে পাবে আর যে বিন্দু পরিমাণও মন্দ কাজ করবে, তাও সে দেখতে পাবে। -(সূরা আল যিলযালঃ ৬-৮ )
বর্তমান বস্তুগত ব্যবস্থাপনায় বস্তুগত আইন-কানুনের বন্ধনের ফলে যেসব জিনিস গোপনে লোক চক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে আছে, এ দ্বিতীয় ব্যবস্থাপনায় তা সবই উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। গুপ্ত, প্রচ্ছন্ন ও সূক্ষ্ম সত্যগুলো সেখানে স্পষ্টত সামনে এসে ধরা দেবে। এবং প্রতিটি জিনিসেরই আসল ও প্রকৃত মর্যাদা উজ্জলরূপে প্রকাশ পাবে।
لَقَدْ كُنتَ فِي غَفْلَةٍ مِّنْ هَذَا فَكَشَفْنَا عَنكَ غِطَاءكَ فَبَصَرُكَ الْيَوْمَ حَدِيدٌ
“মানুষকে বলা হবেঃ তুমি এ জিনিস সম্পর্কে গাফেলতিতে লিপ্ত ছিলে; অতঃপর আমি তোমার চোখের আবরণ সরিয়ে দিয়েছি। এখন তোমার দৃষ্টি অতীব প্রখর”। -(সূরা আল ক্কাফঃ ২২)
يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُونَ لَا تَخْفَى مِنكُمْ خَافِيَةٌ
সেদিন তোমাদের হাজির করা হবে। তোমাদের কোন রহস্যই গোপন থাকবে না। -(সূরা আল হাক্কাহঃ ১৮)
সেখানে ক্রিয়াকর্মের প্রকৃত ফলাফল-বুদ্ধিবৃত্তি, বিচক্ষণতা ও বিচার-ইনসাফ মুতাবেক প্রকাশিত হবে। বর্তমান ব্যবস্থার বস্তুগত আইন-কানুন ও বস্তুগত উপায়-উপকরনের প্রভাবে ক্রিয়াকর্মের যথার্থ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ফলাফল প্রকাশ পেতে পারে না। এসব আইন-কানুন ও উপায়-উপকরণ সেখানে কার্যকরী হবে না। এ কারণে যেসব জিনিস এখানে বিচার-ইনসাফের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং নির্ভুল ফলাফল প্রকাশ পেতে পেতে দেয় না, তা সবই সেখানে নিষ্ক্রিয় এবং প্রভাবহীন হয়ে যাবে দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে দন-দৌলত বস্তুগত উপকরণের প্রাচুর্য, বন্ধু-বান্ধবদের শক্তি, এখানে চেষ্টা-তদবির, সুপারিশ, পারিবারিক প্রভাব, নিজস্ব চাতুর্য, সতর্ক বুদ্ধি এবং এ ধরনের অন্যান্য জিনিস মানুষকে তার বহু ক্রিয়াকর্মের ফলাফল থেকে রক্ষা করে। কিন্তু সেখানে এসব জিনিসের প্রভাব একেবারে খতম হয়ে যাবে এবং বিচার-ইনসাফ ও সত্যতা অনুসারেই প্রতিটি জিনিসের যে ফলাফল প্রকাশিত হওয়া উচিত ঠিক তাই প্রকাশিত হবে।
هُنَالِكَ تَبْلُو كُلُّ نَفْسٍ مَّا أَسْلَفَتْ
“সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তিই তার পূর্বে কৃত আমল যাচাই করে নিবে”। -(সূরা ইউনুসঃ ৩০)
وَوُفِّيَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ
“প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কৃত আমলের পুরোপুরি প্রতিফল দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি কিছুমাত্র যুলুম করা হবে না”। -(সূরা আল ইমরানঃ ২৫)
يَوْمَ تَجِدُ كُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ مِنْ خَيْرٍ مُّحْضَرًا وَمَا عَمِلَتْ مِن سُوَءٍ
“সে দিন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের কৃত প্রতিটি সুকৃতি ও দুষ্কৃতি উপস্থিত পাবে”। -(সূরা আল ইমরানঃ ৩০)
وَاتَّقُواْ يَوْماً لاَّ تَجْزِي نَفْسٌ عَن نَّفْسٍ شَيْئاً وَلاَ يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلاَ يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلاَ هُمْ يُنصَرُونَ
“সে দিনটিকে ভয় করো, যেদিন এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির কোন কাজে আসবে না। কারো পক্ষে কোন সুপারিশ গ্রহন করা হবে। কারো কাছ থেকে কোন বিনিময় নেয়া হবে না। আর তাদের কোন সাহায্যও করা যাবে না”। (সূরা আল বাকারাঃ ৪৮)
O فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءلُونَ
O فَمَن ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُوْلَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ
“অতঃপর যেদিন সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, সেদিন তাদের মধ্যে কোন আত্মীয়তার সম্পর্কে থাকবে না। তারা একে অপরকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করবে না। সেদিন যাদের আমলের পাল্লা ভারী হবে, তারাই কল্যাণ লাভ করবে। আর যাদের আমল হালকা হবে তারা হবে ক্ষতি বরণকারী” -(সূরা আল মুমিনুনঃ ১০১-১০৩ )
إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ O يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ
“সেদিন ধনমাল ও সন্তান সন্ততি কারো উপকারে আসবে না (সেদিন) যে ব্যক্তি নির্মল হৃদয় নিয়ে আল্লাহর কাছে হাজির হবে, কেবল সে-ই মুক্তির অধিকারী হবে” -(সূরা আশ শু’আরাঃ ৮৮-৮৯)
***********
“তোমরা আমাদের কাছে একাকী এসেছো, যেমন তোমাদেরকে আমরা প্রথমবার একাকী সৃষ্টি করেছিলাম। আমরা তোমাদেরকে যেসব সাজ-সরঞ্জাম দিয়েছিলাম, তা সবই তোমরা পিছনে ফেলে এসেছো। নিজেদের প্রতিপালন ও রেযেক দানের ব্যাপারে যাদেরকে তোমরা আল্লাহর শরীকদার মনে করতে, সেইসব সুপারিশকারীকে আজ আর আমরা দেখতে পাচ্ছি না তোমাদের মধ্যকার সকল সম্পর্ক ছিন্ন ও নাকচ হয়ে গেছে।”
-( সূরা আল আনআমঃ ৯৪ )
(**********)
“কিয়ামতের দিন তোমাদের আত্মীয়-স্বজন ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্যে কিছুমাত্র উপকারী হবে না। আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবেন। তোমরা যা কিছুই করছো, তিনি তা দেখেছেন।”
-( সূরা মুমতাহিনঃ ৩ )
(********)
“সেদিন মানুষ তার ভাই, মা-বাপ, স্ত্রী ও সন্তানদের থেকে পলায়ন করবে। সেদিন প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থায় লিপ্ত হবে।”
-( সূরা আবাসাঃ ৩৪-৩৭ )
বর্তমান ব্যবস্থাপনার একটা মস্তবড়ো ত্রুটি এই যে, এখানে মানুষের কৃতকর্ম ও তার গুণপনার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ সম্পদের বিলি-বন্টন নির্ভরশীল নয়। বরং তা বহু কার্যকারণের ওপর নির্ভরশীল, যেখানে ব্যক্তিগত কৃতকর্ম ও যোগ্যতা-প্রতিভা একটি আংশিক কারণ মাত্র। সেখানে অন্যান্য শক্তিশালী কারণগুলো ব্যক্তিগত কৃতকর্মের প্রভাবকে দুর্বলতর, এমন কি কখনো কখনো একেবারে খতম করে দেয়। এ কারণেই অনুগ্রহ সম্পদের বিলি-বন্টনে ব্যক্তিগত প্রাপ্যাধিকারের কোন স্থান থাকে না কিংবা থকলেও তা নিতান্তই কম। এখানে এক ব্যক্তি জীবন ভর যুলুম-পীড়ন ও সীমালংঘন করা সত্ত্বেও সমৃদ্ধি, সচ্ছলতা ও দুনিয়াবী ঐশ্বর্যে মণ্ডিত হতে পারে। আবার এক ব্যক্তি জীবন ভর ঈমানদারী ও পরহেজগারীর সাথে অতিবাহন করা সত্ত্বেও দূরবস্থা ও দুঃখ-দৈন্যে জর্জরিত থাকতে পারে। এ অসম্পূর্ণতার পুর্ণত্ব লাভ করা প্রয়োজন। আর বিচার-বুদ্বির দাবী এই যে, বর্তমান ব্যবস্থাপনা উন্নতিসাধন করে এমন এক ব্যবস্থাপনায় রূপান্তরিত হওয়া উচিত, যেখানে ন্যায়পরতার সাথে সুফল ও কুফল নন্টন কড় হবে এবং ব্যক্তিগত গুনাগুনের ভিত্তিতে যে যার উপযোগী, সে ঠিক তাই পাবে। কুরআন বলছে যে, পরকালীন জীবনের ব্যবস্থাপনা হবে ঠিক এরূপ। দৃষ্টান্ত স্বরুপঃ
(******)
“যারা দুনিয়ার বুকে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে, ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকদেরকে কি আরো তাদের মতো বানিয়ে দেবো? আল্লাহভীরু ও আল্লাহদ্রোহী লোকদেরকে কি আমরা সমান করে দেবো?
(*******)
“দুষ্কৃতিকারীরা কি ধারণা করেছে যে, আমরা তাদেরকে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকদের সমান করে দেবো? এবং তাদের জীবন ও মৃত্যু একরূপ হবে? তারা কি মন্দ বিষয়ে সিদ্বান্ত করছে।”
(********)
“ প্রত্যেক ব্যক্তিকে ঠিক আমলের অনুরূপ প্রতিফল দেয়া হবে।”
-( সূরা আল আনআমঃ ১৩২ )
(*********)
“জান্নাতকে পরহেযগার লোকদের কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে আর দোযখকে পথভ্রষ্ট লোকদের সামনে পেশ করা হবে।”
-( সূরা আশ শু’ আরঃ ৯০-৯১)
বস্তুত হযরত মুহাম্মদ (স) এবং অন্যান্য নবীগন বর্তমান জগতের পর যে দ্বিতীয় জগতটির কথা বলেছেন এ হচ্ছে তার সংক্ষিপ্ত নকশা। যারা এ জগত এবং এর গোটা কারখানাকে একটি রঙ-তামাশা, একটি খেলাঘর, একটি নিস্ফল হাঙ্গামা এবং আদ্যপান্ত লক্ষ্যহীন একটি গোলক ধাঁধাঁ মনে করে, তারা এ পরিকল্পনা এবং এর সাক্ষ্য প্রমাণাদির কোন বিশ্বাসযোগ্য জিনিস পাবে না বটে; কিন্তু যারা বিশ্বব্যবস্থাকে আল্লাহর সৃষ্ট বস্তু মনে করে এবং আল্লাহকে বিচক্ষণ ও বিচার-বুদ্বি সম্পন্ন সত্তা বলে বিশ্বাস করে, তারা ঐ সাক্ষ্য প্রমাণাদি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার পর নিশ্চিতরূপে এ ধরনের একটি বিশ্বব্যবস্থার আবশ্যকতা স্বীকার করতে বাধ্য হবে। আর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় জীবনের সম্ভাবনা যখন প্রতিপন্ন হয়েছে, তখন বুদ্বিমান ও বিচক্ষন আল্লাহ যে ধরনের একটি সম্ভাবনামায় জগত অবশ্যই সৃষ্টি করবেন-এটা বিশ্বাস করার জন্যে সম্ভাবনার আবশ্যকতা প্রমান করাই যথেষ্ট।
এ আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, ইসলাম যে পারলৌকিক জীবনের প্রতি ঈমান পোষণের দাবী জানিয়েছে, তা বিচার-বুদ্বির বহির্ভূত তো নয়ই, বরং ঠিক বিচার-বুদ্বি ও বিচক্ষনতার দাবী সম্মত। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও বুদ্বিবৃত্তির কোন উন্নতির ফলেই ঈমান এতটুকু শিথিল হতে পারে না-অবশ্য সে উন্নতি যদি বাহ্যিক ও প্রদর্শনীমূলক না হয়ে প্রকৃত ও যথার্থ উন্নতি হয়। (১)
পরকাল বিশ্বাসের আবশ্যকতা
এ পর্যন্তকার আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, এ পার্থিব জীবনের পর, এক দ্বিতীয় জীবনের অস্তিত্ব প্রবল সম্ভাবনাময় ও বিচার- বুদ্ধির দাবী সম্মত। কুরআনের পেশকৃত এ দ্বিতীয় জীবনের প্রতি ঈমান আনতে সুস্থ বিচার- বুদ্বি ও যথার্থ জ্ঞান- বিজ্ঞান কোন রূপ অন্তরায় সৃষ্টি করে না; বরং তা মানুষের আরো উদ্বুদ্ধ করে তোলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো: পারলৌকিক জীবন সংক্রান্ত এ ধারণার প্রতি ঈমান পোষণের আবশ্যকতা কি? একে যেন ঈমান ও প্রত্যয়ের অঙ্গীভূত করা হয়েছে? এর প্রতি কেন এতখানি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে? মুসলমান হবার জন্য কেন এর প্রতি বিশ্বাসকে অপরিহার্য এবং এ বিশ্বাস ছাড়া মুসলমান হওয়াকে অসম্ভব করা হয়েছে? একে অস্বীকার করলে কেন আল্লাহ, রাসুল ও কিতাবের প্রতি ঈমানেও কোন ফায়দা হবে না? কেন জীবনের যাবতীয় সুকৃতি ও সৎকাজ বিনষ্ট হয়ে যাবে?
কেউ বলতে পারে যে, পারলৌকিক জীবন সংক্রান্ত মতবাদ অন্যান্য অতি প্রাকৃতিক মতবাদের মতোই নিছক একটি অতি প্রাকৃতিক মতবাদ মাত্র। স্বীকার করলাম যে, দলীল-প্রমান দ্বারা এ মতবাদটিকে খুব সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করা হয়েছে এবং একে বিশ্বাস করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ বর্তমান রয়েছে। কিন্তু কোন অতি প্রাকৃতিক মতবাদ দলীল-প্রমান দ্বারা সাব্যস্ত হবার অর্থ এ নয় যে, তার প্রতি অবশ্যই ঈমান আনতে হবে এবং তারই ওপর ঈমান ও কুফর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে পরকালীন জীবনের ন্যায় আরো বহু অতি প্রকৃতিক মতবাদ রয়েছে এবং সেগুলোর সমর্থনে শক্তিশালী যুক্তি- প্রমাণও পাওয়া যায়। তাহলে সেগুলোকেও কেন ঈমানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি?
১- আখেরাত সম্পর্কে আরো বিস্তৃত আলোচনার জন্যে তাফহীমুল কুরআন দ্বিতীয় খণ্ডে “ আখেরাত” শব্দে তাফসীর এবং এ গ্রন্তে পরিশিষ্টাংশে সন্নিবিষ্ট “পারলৌকিক জীবন” শীর্ষক প্রবন্ধ দেখুন।
এর জবাব হলোঃ পরকালীন জীবনের ধারণাটি নিছক একটি অতি প্রাকৃতিক মতবাদ হলে এ প্রশ্নটা নিশ্চয়ই একটি শক্তিশালী প্রশ্ন হতো। এমতাবস্থায় এ মতবাদটিকে ঈমান ও প্রত্যয়ের অন্তর্ভুক্ত করার কোনই যুক্তি-সঙ্গত কারণ থাকতো না। কেননা, কোন মতবাদ নিছক অতি প্রাকৃতিক মতবাদ হলে আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না আমরা সে সম্পর্কে অনবহিত হলে কিংবা তাকে অস্বীকার করলে আমাদের নৈতিক চরিত্র ও ক্রিয়াকর্মের ওপর তার কোন প্রভাব পড়ে না। কিন্তু পরকালীন জীবন সংক্রান্ত মতবাদটি সম্পর্কে একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে, এ নিছক একটি দার্শনিক মতবাদ নয়; মানুষের নৈতিক ও কর্মজীবনের সাথে এর গভীর সম্পর্ক বর্তমান রয়েছে। এর প্রতি বিশ্বাসের ফলে পার্থিব জীবন এবং তার গোটা ক্রিয়াকাণ্ড সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি মূলগতভাবে বদলে যায়। এ মতবাদটি স্বীকার করার অর্থ এই যে, মানুষ নিজেকে নিজে এক জিম্মাদার ও দায়িত্বশীল সত্ত্বা মনে করবে। জীবনের গোটা ক্রিয়াকর্মে সে এ ভেবে সম্পাদন করবে যে, প্রতিটি কাজ ও প্রতিটি ক্রিয়ার জন্যেই সে জিম্মাদার। ভবিষ্যত জীবনে তাকে নিজের যাবতীয় কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে এবং ভবিষ্যত সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য তার কৃত সুকৃতি বা দুষ্কৃতির ওপর নির্ভরশীল।
পক্ষান্তরে এ মতবাদটি স্বীকার না করার অর্থ হচ্ছে এই যে, মানুষ নিজেকে নিজে এক দায়িত্বহীন সত্তা মনে করবে। সে তার পার্থিব জীবনের পরিকল্পনা এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তৈরি করবে যে এ জীবনের কৃতকর্মের জন্যে তাকে অপর কোন জীবনে জবাবদিহি করতে হবে না। এ জীবনের কৃতকর্ম ও ক্রিয়াকর্মের ফলে ভবিষ্যতে কোন ভালো কি মন্দ ফলাফল প্রকাশ পাবে না। এভাবে এ মতবাদটি সম্পর্কে অনবহিত হওয়া কিংবা একে অস্বীকার করার অনিবার্য ফল দাঁড়াবে এই যে, যেসব কৃতকর্মের ফলাফল এ দুনিয়ায় প্রকাশ পায়, মানুষের দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ হবে। আর কোন্ কোন্ কাজ তার পক্ষে উপকারী এবং কোন্ গুলো অপকারী তা এসব ফলাফলের দৃষ্টিতেই সে নির্ণয় করবে। সে বিষ খাওয়া ও আগুনে হাত দেয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকবে। কারণ সে জানে যে, এ দু’টি কাজের মন্দ ফল তাকে এ দুনিয়ায়ই ভুগতে হবে। কিন্তু যুলুম পীড়ন, বেইনসাফী, মিথ্যাচার, পরনিন্দা, বিশ্বাস ভঙ্গ, ব্যভিচার ইত্যাকার কাজগুলোর পূর্ণ ফলাফল এ দুনিয়ায় প্রকাশ পায় না বলে এগুলোর মন্দ পরিণাম ফল এখানে যতটা প্রকাশ পাবার আশংকা হবে এগুলো ততটাই সে পরিহার করে চলবে। পক্ষান্তরে যখনই এগুলোর কোন মন্দ পরিণাম ফল প্রকাশ পাবে না কিংবা এগুলো থেকে কোন ফায়দা হাসিলের প্রত্যাশা জাগবে, তখন এ কাজগুলো করতে সে কিছুমাত্র কুন্ঠাবোধ করবে না।
ফলকথা, এ মতবাদ অনুসারে মানুষের দৃষ্টিতে কোন নৈতিক কাজের কোন নির্দিষ্ট নৈতিক মূল্যবান থাকতে না। বরং এ দুনিয়ায় প্রকাশিত ভালো-মন্দ ফলাফলের ওপরই এর প্রতিটি কাজের ভালো-মন্দ নির্ভরশীল হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যাক্তি পরকালের প্রতি বিশ্বাসী, সে কোন নৈতিক কাজের এ দুনিয়ায় প্রকাশিত ফালফালের প্রতিই শুধু দৃষ্টিপাত করবে না, বরং এর পরবর্তী জীবনে প্রকাশিতব্য ফলাফলের প্রতিও সে লক্ষ্য রাখবে এবং সেই ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতেই সে কাজের উপকারিতা বা অপকারিতা নির্ণয় করবে। সে যেমন বিষের ধ্বংসকারিতা ও আগুনের দাহিকা শক্তিকে বিশ্বাস করবে। তেমনি বিশ্বাস ভঙ্গ ও মিথ্যাচারের ধ্বংসকারিতা ও দাহিকা শক্তিতেও বিশ্বাসী হবে। সে যেমন বিষের ধ্বংসকারিতা ও আগুনের দাহিকা শক্তিকে বিশ্বাস করবে। তেমনি বিশ্বাস ভঙ্গ ও মিথ্যাচারের ধ্বংসকারিতা ও দাহিকা শক্তিতেও বিশ্বাসী হবে। সে যেমন খাদ্য ও পানীয়কে উপকারী মনে করবে, তেমনি ন্যায়প্রায়নতা, বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতাকেও উপকারী জ্ঞান করবে। সে তার প্রতিটি কাজের একটি সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত ফলাফলে সে ফালাফল এ জীবনে আদৌ প্রকাশিত না হতে পারে কিংবা বিপরীত রুপেও প্রকাশ পেতে পারে-বিশ্বাসী হবে। তার কাছে নৈতিক ক্রিয়াকর্মের নির্ধারিত নৈতিক মূল্যমান থাকবে এবং পার্থিব উপকার বা অপকারের ফলে সে মূল্যমানে এতটুকু পরিবর্তন সূচিত হবে না। তার নৈতিক ব্যবস্থায় সততা, ন্যায়পরায়নতা, ওয়াদা পালন অবশ্যই পুণ্য ও সুকৃতিরূপে তার ফলে এ দুনিয়ায় শুধু অপকারই হতে পারে কিংবা আদৌ উপকার না হতে পারে-গণ্য হবে। পক্ষান্তরে মিথ্যাচার, যুলুম-পিরন, ওয়াদা ভঙ্গ অবশ্যই পাপ ও দুষ্কৃতি রূপে-তার ফলে দুনিয়ায় শুধু উপকারই হতে পারে এবং একবিন্দুও অপকার না হতে পারে-স্বীকৃত হবে।
কাজেই পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে উদাসীন হওয়া কিংবা তার প্রতি অবিশ্বাস করার অর্থ কেবল এটুকু নয় যে, মানুষ একটি অতি প্রাকৃতিক মতবাদের প্রতি উদাসীন রয়েছে কিংবা তার প্রতি সে অস্বীকৃতি জানিয়ে দিয়েছে। বরং তার অর্থ এই যে, মানুষ তার দায়িত্বশীল ও জিম্মাদারসুলভ মর্যাদা সম্পর্কেই উদাসীন হয়ে পড়েছে। নিজেকে সে স্বাধীন, স্বেচ্ছাচারী ও দায়িত্বহীন প্রানী মনে করে নিয়েছে। দুনিয়ার বাহ্যিক জীবন এবং তার অসম্পূর্ণ, বরং কখনো প্রতারনাদায়ক ফলাফল দেখে সে সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। জীবনের চুরান্ত লাভ-লোকসানের প্রতি উদাসীন হয়ে প্রাথমিক, সাময়িক ও অনির্ভরযোগ্য লাভ-ক্ষতির ওপর সে ভরসা করে বসেছে। এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে সে নিজের ক্রিয়াকর্মের জন্যে সম্পূর্ণ পরিবর্তনশীল ও প্রতারনাদায়ক নৈতিক মূল্যমান নির্ধারণ করে নিয়েছে। সে এক নির্ভুল, সুদৃঢ় ও নৈতিক বিধান থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে, যা শুদু দায়িত্বানুভুতি ও চূড়ান্ত ফলাফলের প্রতি অবিচল দৃষ্টি ও নির্দিষ্ট নৈতিক মূল্যমানের দ্বারাই অর্জিত হতে পারে। এভাবে সে দুনিয়ার অসম্পূর্ণ ও অপূর্ণাঙ্গ বাহ্যদৃশ্য দ্বারা প্রতারিত হয়ে নিজের গোটা জীবন এমন এক দুর্বল ও ভ্রান্ত নৈতিক বিধানের অধীন যাপন করেছে, যেখানে প্রকৃত ক্ষতি লাভে পরিণত হয়েছে, আর প্রকৃত ক্ষতি লাভে পরিণত হয়েছে, আর প্রকৃত লাভ-ক্ষতি আখ্যা পেয়েছে। সেখানে প্রকৃত সুন্দর অসুন্দর হয়ে গেছে আর প্রকৃত অসুন্দর সুন্দর আখ্যা পেয়েছে অনুরূপভাবে যথার্থ পাপ পুণ্য হয়ে গেছে আর যথার্থ পুণ্য পাপে পরিণত হয়েছে।
বস্তুত পরকালের প্রতি ঈমান না আনার এ ফলাফলগুলোই কুরআন মজীদ অত্যন্ত বিস্তৃতরূপে বর্ণনা করেছে। এ ব্যাপারে কুরআনী আয়াত পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে যে, পরকাল না মানার ফলে মানুষের নৈতিক ও কর্মজীবনে যেসব বিকৃতির উদ্ভব হয়, তা এক করে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
একঃ মানুষ নিজেকে উদ্দেশ্যহীন, স্বেচ্ছাচারী দায়িত্বহীন সত্তা মনে করে নিজের জীবনকে সামগ্রিকভাবে নিষ্ফল ও নিরর্থক জ্ঞান করে। তার কাজের কোন তত্ত্বাবধায়ক ও হিসেব গ্রহণকারী নেই-এ ভেবে সে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করেঃ
(*************)
“তোমরা কি মনে করে নিয়েছে যে, আমরা তোমাদের নিরর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে না?” –( সুরা-মু’মিনুন-১১৫ )
(*************)
“মানুষ কি মনে করেছে যে, তাকে এরূপ নিরর্থক ছেড়ে দেয়া হবে?”
-( সূরা কিয়ামাহঃ ৩৬)
(************)
“মানুষ কি ধারণা করেছে যে, তার ওপর কারো ক্ষমতা চলবে না? সে বলে যে, আমি বিস্তর মাল ব্যয় করেছি। সে কি মনে করে যে, কেউ তাকে দেখেনি?” –( সূরা আল বালাদঃ ৫-৭ )
দুইঃ এহেন লোকের দৃষ্টি কেবল দুনিয়ার বাহ্যদিকের ওপরই নিক্ষিপ্ত হয় প্রাথমিক ও সাময়িক ফলাফলকেই সে চূড়ান্ত ও প্রকৃত ফলাফল মনে করে নেয় এর দ্বারা প্রতারিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত করে বসেঃ
(**************)
“তারা দুনিয়াবী জীবনের শুধু বাহ্যদিক সম্পর্কেই জ্ঞান রাখে আর পরকাল সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন।”- ( সূরা আর রুমঃ ৭ )
(***********)
“যারা আমাদের সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশা রাখে না এবং দুনিয়াবী জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট ও নিশ্চিত হয়ে গেছে।” ) -(সূরা ইউনুসঃ ৭)
(**********)
“কখনো নয়, তোমরা তো শীঘ্র পাওয়ার যোগ্য ফলাফলকেই পসন্দ করো আর পরকালের ফালাফলকে বর্জন করো।”-( সূরা কিয়ামাহঃ ২০-২১ )
(***********)
“তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকো, অথচ পরকাল হচ্ছে উত্তম এবং অধিকতর স্থায়ী”
–( সূরা আ’লাঃ ১৬-১৭ )
“তাদেরকে পার্থিব জীবন ধোঁকায় নিক্ষেপ করেছে।”
তিনঃ এ বাহ্যদৃষ্টির ফল দাঁড়ায় এই যে, মানুষের দৃষ্টি বস্তুনিচ্চইয়ের মূল্যমান একেবারেই উল্টো হয়ে যায়। যেসব জিনিস প্রকৃত প্রস্তাবে চূড়ান্ত ফলাফলের দিক থেকে ক্ষতিকর, আপাত লাভের প্রতি দৃষ্টি রাখার ফলে সেগুলোকেই সে উপকারী মনে করে বসে যেসব কর্মকাণ্ড চূড়ান্ত ফলাফলের দিক থেকে ভ্রান্ত, প্রাথমিক ফলাফল লক্ষ্য করেই সেগুলোকে সে কল্যাণকর ভাবতে শুরু করে। এ কারণেই তার পার্থিব চেষ্টা-সাধনা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা নিষ্ফল হয়ে যায়।
(***********)
“যারা পার্থিব জীবনেরই কল্যাণ কামনা করছিল, তারা বললোঃ হায়! কারুনকে যা দেয়া হয়েছিলো, আমরাও যদি তাই পেতাম! সে বড়োই সৌভাগ্যবান। আর যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিলো, তাঁরা বললোঃ তোমাদের জন্য পরিতাপ! যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তার জন্যে আল্লাহর পুরুস্কারই হচ্ছে উত্তম।”
–( সূরা কাসাসঃ ৭৯-৮০)
(************)
“যারা পরকালের প্রতি ঈমান পোষণ করে না, তাদের জন্যে আমরা তাদের ক্রিয়াকাণ্ডকে খুবই চিত্তাকর্ষক বানিয়ে দেই এবং তারা পথভ্রষ্ট হয়ে থাকে।” –( সূরা আন নামলঃ ৮ )
(***********)
“এরা কি এ ভ্রান্তিতে ডুবে আছে যে, আমরা এদেরকে ধনমাল ও সন্তান-সন্তুতি দিয়ে সাহায্য করছি বলে এদের কল্যাণ বিধানেও তৎপর রয়েছি? কিন্তু এরা প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করে না।”
–(সূরা মু’মিনুনঃ ৫৫-৫৬ )
(**********)
“আমরা কি তোমাদের বলবো যে, আমলের দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোক কারা? এ হচ্ছে তারা, জাদের চেষ্টা-সাধনা দুনিয়ার জীবনে ভ্রষ্টপথে চালিত হয়েছে; কিন্তু তারা মনে করছিলো যে, তারা খুব ভালো কাজ করছে। এসব লোকেরাই আপন প্রভুর নিদর্শনদি এবং তার সাক্ষাতকারকে অস্বীকার করেছে। এ জন্যেই তাদের আমল পণ্ড হয়ে গেছে।” –( সূরা আল কাহাফঃ ১০৪-১০৫ )
চারঃ এ ধরনের লোক কখনো সত্য দ্বীনকে গ্রহন করতে পারে না। তার সামনে কখনো নৈতিক আদর্শ,সৎকার্য ও সদাচরণের নীতি পেশ করা হলে সেগুলোকে সে নাকচ করে দেবে আর এ সবের বিপরীত আকীদা ও আমল পেশ হলে সেগুলোকে সে গ্রহন করবে ৎ। কারণ সত্য দ্বীনের সমস্ত নিয়ম-নীতি পার্থিব জীবনের বহু কল্যাণ ও উপকার এবং বহু স্বাধ আনন্দের কুরবানী দাবী করে। তার মূলনীতি ও শিক্ষা হলোঃ পরকালের উত্তম ও চিরস্থায়ী কল্যাণের জন্যে দুনিয়ার অস্থায়ী ও সাময়িক কল্যাণকে কুরবান করে দিতে হবে কিন্তু পরকাল অবিশ্বাসী ব্যক্তি এ দুনিয়ার কল্যাণকেই চূড়ান্ত কল্যাণ মনে করে। এ কারণেই সে এ ধরনের কোন কুরবানীর জন্যে যেমন প্রস্তুত হতে পারে না, তেমনি দ্বীনদারির যেসব নিয়ম-নীতি এরূপ কুরবানীর দাবী করে, সেগুলোকেও সে গ্রহন করতে পারে না। কাজেই পরকাল অবিশ্বাস আর সত্য দ্বীনের অনুসরণ এ দুটি পরস্পর বিরোধী জিনিস। যে ব্যক্তি পরকালে অবিশ্বাসী, সে কখনো সত্য দ্বীনের অনুসারী হতে পারে না।
(***********)
“যারা দুনিয়ার বুকে না-হকভাবে অহংকার করে, আমি তাদেকে আপন নিদর্শন থেকে বিমুখ করে দেবো। তার কোন নিদর্শন দেখতে পলেও তার প্রতি ঈমান আনবে না, কখনো সরল পথ দেখতে পেলেও টা অবলম্বন করবে না, অবশ্য ভ্রান্ত পথ দেখতে পেলে সেদিকে ধাবিত হবে। এর কারণ এই যে, তারা আমার নিদর্শনাদিকে অবিশ্বাস করেছে এবং সেগুলোর প্রতি উদাসীন হয়ে আছে। যারা আমার নিদর্শন এবং পরকালের সাক্ষাতকারকে অবিশ্বাস করবে, তাদের সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ড নিষ্ফল হয়ে যাবে। তারা যেমন আমল করেছে, তেমনি প্রতিফলই কি পাবেনা?” –( সূরা আল আরাফঃ ১৪৬-১৪৭ )
পাঁচঃ পরকাল অবিশ্বাসের দ্বারা মানুষের গোটা নৈতিক ও কর্মজীবনই প্রভাবান্বিত হয়ে থাকে। সে অহংকারী ও বিদ্রোহী হয়ে যায়ঃ
(*************)
“যারা পরকালের প্রতি ঈমান পোষণ করে না, তাদের মন সত্য কথাকে অস্বীকার করতে থাকে এবং তারা অহংকারী হয়ে যায়।” –( সূরা আন নহলঃ ২২ )
(************)
“ফেরাউন এবং তার লশকরগন দুনিয়ার বুকে না-হকভাবে অহংকার করে এবং মনে করে যে, আমার কাছে তাদের কখনো ফিরে আসতে হবে না। তার আচরণ ও কাজ কারবার বিকৃত হয়ে যায়।”
– ( সূরা কাসাসঃ ৩৯)
(************)
“সেসব অসদাচারী লোকদের জন্যে ধ্বংস অবধারিত, যারা অন্যদের কাছে থেকে নেয়ার সময় তো পুরোপুরি মেপে নেয়, কিন্তু অনদেরকে মেপে দেয়ার সময় কম দিয়ে থাকে। তারা কি মনে রাখে না যে, তারা এক বিরাট দিনে পুনরুত্থিত হবে?” –( সূরা আল মুতাফাফিফিনঃ ১-৫ )
সে কঠিন হৃদয়, সংকীর্ণ দৃষ্টি, প্রদর্শনকারী, স্বার্থপর এবং আল্লাহর বন্দেগীর প্রতি পরান্মুখ হয়ে যায়ঃ
(************)
“তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছো, যে প্রতিফল দিবসকে অবিশ্বাস করে? এরূপ ব্যক্তিই এতীমকে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয় এবং মিসকিনকে খাবার দিতে উৎসাহ প্রদান করে না। অতএব সেই নামাযীদের জন্যে পরিতাপ, যারা নিজেদের নামায সম্পর্কে উদাসীন থাকে। এরা সৎকাজ করে শুধু লোক দেখানোর জন্যেই। এরা লোকদেরকে ছোটখাটো এবং সাধারণ প্রয়োজনীয় জিনিস দিতেও কার্পণ্য করে।”
–( সূরা মাউনঃ ১-৭ )
ফলকথা, সত্যকে উপেক্ষা করে চলা এবং গোনাহর কাজে লিপ্ত হওয়া পরকাল অবিশ্বাসের অনিবার্য পরিণতি
(************)
“সত্যের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছে এবং গোনাহর কাজে লিপ্ত হয়েছে এমন সব লোকরাই প্রতিফল দিবসকে অবিশ্বাস করে থাকে।”
– ( সূরা মুতাফফিফিনঃ ১২ )
বস্তুত পরকাল বিশ্বাসের প্রতি উদাসীন কিংবা অবিশ্বাসী হবার এ পরিণাম ফলগুলোকে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই অস্বীকার করতে পারেনা। বিশেষত, পার্থিব জীবনের বাহ্য চাকচিক্যের দ্বারা সন্মোহিত হয়ে জীবনের শুধু পার্থিব ও বৈষয়িক লক্ষ্যবিন্দুর ওপর যে সভ্যতার ইমারত গড়ে উঠেছে এবং যাতে পরকাল বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ বর্জন করা হয়েছে, তার ফলাফল দেখার সুযোগ আমাদের ঘটেছে। এরপরে পরকাল অবিশ্বাসের সাথে আল্লাহ পরস্তি, দ্বীনদারী ও নৈতিক আদর্শের প্রতিষ্ঠা যে একেবারে অসম্ভব আমাদের পক্ষে এ সত্য অস্বীকার করার কোনই অবকাশ নেই।
অথচ লক্ষনীয় বিষয় হলো : ইসলাম এ জিনিসগুলোকেই পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে মানুষকে উত্তম চরিত্র এবং সৎকর্মরাজির দিকে আহ্বান জানায়। তার জন্যে দুনিয়ার বহুবিধ বৈষয়িক স্বার্থ ও আনন্দকে বিসর্জন দেয়া আবশ্যক। সে মানুষকে আল্লাহর ইবাদাত ও আত্মসংশোধনের উপদেশ দেয়, যার কোন ফায়দা বা কল্যাণ এ দুনিয়ার জীবনে লক্ষ্য করা যায়না, বরং তার বিপরীত বহু প্রকার কষ্টক্লেষে মানুষের দেহ-মনকে জর্জরিত হতে হয়। সে জীবনের সকল বিষয় এবং দুনিয়ার সাজ-সরন্জাম থেকে উপকৃত হবার ব্যাপারে হারাম-হালাল ও পবিত্রতা-অপবিত্রতার পার্থক্য বিচার করে। সে উচ্চতর আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্ত মানুষের কাছে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও প্রেম-ভালবাসা এবং কখনো কখনো জান ও মাল পর্যন্ত কুরবানী করে দেয়ার দাবী জানায়। সে মানুষের জীবনকে এমন একটি নৈতিক বিধানের দ্বারা সুসংবদ্ধ করতে চায়, যাতে পার্থিব লাভ-ক্ষতির প্রতি ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে প্রতিটি জিনিসের একটি বিশেষ মূল্যমান নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বস্তুত এহেন দ্বীন শরীয়তকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে কি মানুষ পরকাল বিশ্বাস ছাড়া কামিয়াব হতে পারতো? এহেন আকীদার প্রতি উদাসীন কিংবা অবিশ্বাসী হয়েও মানুষের পক্ষে এরূপ শিক্ষা গ্রহণ করা কি সম্ভবপর ছিলো? এর জবাব যদি নেতিবাচক হয়- আর অবশ্যই নেতিবাচক হবে- তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে, এ ধরনের দ্বীনী ব্যবস্থা ও নৈতিক বিধানের প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বপ্রথম মানুষের মনে পরকাল বিশ্বাসকে বদ্ধমূল করে দেয়া অপরিহার্য। বস্তুত এ কারনেই ইসলাম এ প্রত্যেকটিকে বুনিয়াদী ঈমানের অন্তর্ভূক্ত করেছে এবং ঈমান বিল্লাহর পর এর প্রতিই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে।
এবার ইসলাম এ প্রত্যয়টিকে কী আকারে পেশ করেছে এবং তা দ্বারা মানুষের চরিত্র ও আচরণের ওপর কী প্রভাব পড়ে তা দেখা যাক।
দুনিয়ার ওপর পরকালের অগ্রাধিকার
কুরআন মজিদ সর্বপ্রথম যে জিনিসটি মানুষের মনে বদ্ধমূল করার চেষ্টা করেছে, তাহলো এই যে, দুনিয়া মানুষের একটি অস্থায়ী বাসস্থান। তার জন্যে কেবল এটিই একমাত্র জীবন নয়, বরং এরপর এর চেয়েও এক উত্তম ও চিরস্থায়ী জীবন রয়েছে। সে জীবনের কল্যাণ এখনকার কল্যানের চেয়ে অনেক বেশী প্রশস্ত এবং সেখানকার অকল্যাণ এখানকার অকল্যাণের চেয়ে অনেক বেশী কঠোর। যে ব্যক্তি এ দুনিয়ার বাহ্য চাকচিক্য দ্বারা প্রতারিত হয়ে এরই সুখ-সম্ভোগ ও স্বার্থ লাভের আশায় জড়িয়ে পড়ে এবং সেগুলো অর্জন করার প্রচেষ্টার ফলে সেই পরজীবনের সুখ-সম্পদ ও স্বার্থ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়, সে অত্যন্ত মন্দ জিনিসই খরিদ করে। বরং প্রকৃতপক্ষে তার এই গোটা কারবারটিই হচ্ছে অতিব ক্ষতিকর কারবার। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি এ দুনিয়ার ক্ষতিকেই চূড়ান্ত ক্ষতি বলে মনে করে এবং এর থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে নিজেকে সেই পরজীবনের ক্ষতির উপযোগী করে তোলে, সে যারপর নেই নির্বুদ্ধিতার কাজ করে এবং তার এ কাজকে কিছুতেই বুদ্ধিমত্তাসূলভ বলা যেতে পারেনা। এ বিষয়টিকেই কোরআন মজীদে এতো বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে, এতদসংক্রান্ত সমস্ত আয়াত এখানে একত্রিত করা সম্ভবপর নয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে কয়েকটি আয়াত এখানে উদ্ধৃত করা যাচ্ছে:
(***********)
“এ দুনিয়া নিছক খেল-তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। জীবনের প্রকৃত আবাস হচ্ছে পরকাল”। -(সূরা আল আনকাবুত: ৬৪)
(***********)
“(হে মুহাম্মাদ,) বলে দাও, দুনিয়ার সুখ-সম্পদ খুবই নগণ্য। যে ব্যক্তি তাক্বওয়ার সাথে জীবন যাপন করে, তার জন্য পরকালই উত্তম”। (সূরা আন নিসা : ৭৭)
(************)
“তোমরা কি পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেছো? দুনিয়ার জীবনের সুখ-সম্পদ তো পরকালের তুলনায় খুবই নগণ্য”। (সূরা আত তাওবা : ৩৮)
(***********)
“তোমরা দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দান করো; অথচ পরকালই অধিক উত্তম এবং স্থায়ী”। Ñ(সূরা আল আলা : ১৬-১৭)
(*************)
“প্রত্যেক ব্যক্তিকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর তোমরা এ জীবনের পুরোপুরি প্রতিফল কিয়ামতের দিন পাবে। অতএব সেদিন যে ব্যক্তি দোযখের শাস্তি থেকে বেঁচে গেলো এবং জান্নাতে প্রবেশ লাভ করলো, আসলে সে-ই সফলকাম হলো। আর দুনিয়ার জীবনটুকু ধোঁকার সরঞ্জাম ছাড়া আর কিছুই নয়”। -(সূরা আলে ইমরান : ১৮৫ )
(************)
“যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে, তারা তাদেরকে প্রদত্ত সুখ-সম্ভোগের পেছনেই পড়ে রয়েছে আর এরাই হচ্ছে অপরাধী”। -(সূরা হূদ : ১১৬)
(************)
“(হে মুহাম্মদ!) বলে দাও: কঠিন ক্ষতিতে লিপ্ত হচ্ছে তারাই, যারা নিজেদেরকে এবং নিজস্ব সন্তান-সন্ততিকে কিয়ামতের দিন ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। ইহাই হচ্ছে প্রকৃত ও সুস্পষ্ট ক্ষতি”। -(সূরা যুমার: ১৫)
(***********)
“অতঃপর যে ব্যক্তি বিদ্রোহ করেছে এবং দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। আর যে ব্যক্তি আপন প্রভুর সামনে উপস্থিত হওয়াকে ভয় করেছে এবং আপন প্রবৃত্তিকে লালসার হাত থেকে রক্ষা করেছে, তার ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত”। -(সূরা আন নাযিআত: ৩৭-৪১)
(***********)
“জেনে রাখো, দুনিয়ার জীবনে রয়েছে খেল-তামাশা, শোভা-সৌন্দর্য, পারস্পরিক অহংকার এবং ধনমাল ও সন্তান সন্ততিতে পরস্পর পরস্পরকে অতিক্রম করা। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে বৃষ্টির মতো : বৃষ্টির দ্বারা ফসল পূর্ণরূপে উৎপাদিত হয় এবং কৃষক তা দেখে আনন্দ প্রকাশ করে। অতঃপর তা থেকে পেকে শুকিয়ে যায়; আর তুমি দেখতে পাচ্ছো তা ধূসর বর্ণ হয়ে হয়ে গেছে এবং মাটিতে মিশে গেছে। এরপর হচ্ছে পরকালের জীবন, যেখানে কারো জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি আর কারো জন্য রয়েছে আল্লাহর প্রদত্ত মাগফেরাত এবং সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবন হচ্ছে নিছক একটি ধোঁকার উপকরণ মাত্র”। -(সূরা আল হাদীদ: ২০)
(**********)
“লোকদের জন্যে নারী, শিশু, সোনা ও রূপার স্তুপ, চিহ্নিত ঘোড়া, পশু ও ফসলের ভালোবাসাকে আকর্ষণীয় করে দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে পার্থিব জীবনের সুখ-সম্পদ ও সরঞ্জাম। কিন্তু আল্লাহর কাছে রয়েছে এর চেয়ে উত্তম ঠিকানা। হে মুহাম্মদ, বলে দাও: আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়ে উত্তম সুখ-সম্পদের কথা বলবো? যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করেছে, তাদের জন্যে প্রভুর কাছে রয়েছে জান্নাত, যার নিম্নদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং পবিত্র জোড়া লাভ করবে আর তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হবে”। -(আলে ইমরান : ১৪-১৫)
দুনিয়ার ওপর পরকালকে অগ্রাধিকার দেয়া, পরকালের স্থায়ী সাফল্যের জন্য অস্থায়ী স্বার্থ লাভকে কোরবানী করা এবং পরকালের স্থায়ী ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ক্ষতিকে বরদাশত করার এ শিক্ষা ইসলামে অত্যন্ত জোরালো এবং আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো : কুরআন ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি ঈমান পোষণকারী ব্যক্তি কোন জোর-জবরদস্তির বলে নয়, বরং মনের ঐকান্তিক আকর্ষণেই এমন প্রতিটি কাজ সম্পাদন করবে, যাকে আল্লাহ ও রসূল(সাঃ) পরকালের সাফল্যের উপায় বলে নির্দেশ করেছেন। অনুরূপভাবে সে এমন প্রতিটি জিনিস পরিহার করে চলবে, যাকে তাঁরা উভয়েই পরকালের ক্ষতির কারণ বলে অভিহিত করেছেনÑ দুনিয়ার জীবনে তা যতোই উপকারী বা ক্ষতিকর বিবেচিত হোক না কেন।
আমলনামা ও আল্লাহর আদালত
কুরআন মজীদ আর যে জিনিসটি মানুষের মনে বদ্ধমূল করার প্রয়াস পেয়েছে তা হলো এই যে, মানুষ এ পার্থিব জীবনে যে কোন কাজই করেÑ তা যতোই লুকিয়ে করুক না কেন, তার সঠিক ও নির্ভূল রেকর্ড সুরক্ষিত থাকে। কিয়ামতের দিন এ রেকর্ডই আদালতে পেশ করা হবে। মানুষের ক্রিয়াকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি অণু-পরমাণু তার কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্যদান করবে। এমনকি, তার নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে কাঠগড়ায় গিয়ে খাড়া হবে। তাছাড়া তার আমলনামা বা কর্মলিপি অত্যন্ত নির্ভূলভাবে ওজন করা হবে। ন্যায়দণ্ডের এক পাল্লায় থাকবে তার সৎকর্মরাজি এবং অন্য পাল্লায় থাকবে মন্দ কাজগুলো। যদি সৎকাজের পাল্লা ভারী হয় তবে পরকালের সাফল্য তাকে স্বাগত জানাবে। এবং তার বাসস্থান হবে বেহেশত। আর দুষ্কৃতির পাল্লা ভারী হলে তার পরিণাম হবে ধ্বংস ও বিনাশ এবং তার জন্য নির্ধারিত হবে দোযখ নামক নিকৃষ্টতম স্থান। আল্লাহর সেই আদালতে প্রত্যেকেই নিজ কর্মলিপি নিয়ে একাকী উপস্থিত হবে। সেখানে মান-সম্মান, বংশ গৌরব, চেষ্টা-তদবীর, ধন-দৌলত, শক্তি-সামর্থ ইত্যাদি দুনিয়ার কোন সরঞ্জামই তার কাজে আসবে না।
এ বিষয়টিকেও কুরআন অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বিবৃত করেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে কতিপয় আয়াত উল্লেখ করা যাচ্ছে :
কর্মলিপির অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে:
(***********)
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি লুকিয়ে কথা বলে আর যে সজোরে বলে, যে ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে, আর যে দিনের আলোয় চলাফিরা করছেÑ উভয়ের অবস্থানই সমান। অবশ্যই প্রত্যেকের সামনে ও পেছনে তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত রয়েছে এবং তারা আল্লাহর নির্দেশে তার প্রতিটি কথা সংরক্ষণ করছে।” -(সূরা আর রাদ : ১০-১১)
وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَٰذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا ۚ وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا ۗ وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا
“কর্মলিপি পেশ করা হলে তাতে যা কিছু লেখা থাকবে, তুমি দেখবে যে অপরাধী তাতে ভয় পেয়ে যাবে। বলবে: হায়! এ কিতাবের কী অবস্থা! কোন ছোট কিংবা বড়ো জিনিসই এতে বর্জন করা হয়নি। সবই এতে বর্তমান রয়েছে। বস্তুত তারা যা কিছু আমল করেছিলো তা সবই তারা উপস্থিত পাবে।’’ – (সূরা আল কাহাফঃ ৪৯)
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাক্ষ্য এবং মানুষের স্বীকৃতিঃ
يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“সেদিন তাদের স্বীয় জিহ্বা এবং তাদের হাত-পা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দান করবে।” -(সূরা আন নূরঃ ২৪)
حَتَّىٰ إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا ۖ قَالُوا أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُونَ أَنْ يَشْهَدَ عَلَيْكُمْ سَمْعُكُمْ وَلَا أَبْصَارُكُمْ وَلَا جُلُودُكُمْ وَلَٰكِنْ ظَنَنْتُمْ أَنَّ اللَّهَ لَا يَعْلَمُ كَثِيرًا مِمَّا تَعْمَلُونَ
“এমন কি যখন সেখানে পৌছবে, তখন তার কান, তার চোখ এবং তার চামড়া তার কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্যদান করবে। সে তার চামড়াকে বলবেঃ তুমি আমার বিরুদ্ধে কেন সাক্ষ্য দিলে? সে জবাব দেবেঃ যে আল্লাহ প্রতিটি জিনিসকে বাকশক্তি দেন, তিনিই আমাকে বাকশক্তি দিয়েছেন। … তোমরা লুকিয়ে কাজ করতে এবং একথা জানতে না যে, তোমাদের স্বীয় কান, চোখ এবং চামড়া তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্যদান করবে। বরং তোমরা ভাবতে যে, তোমাদের বহু ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ পর্যন্ত অনবহিত।” -(সূরা হা-মীম আস সাজদাঃ ২০-২২)
وَشَهِدُوا عَلَىٰ أَنْفُسِهِمْ أَنَّهُمْ كَانُوا كَافِرِيَ
“তারা খোদ নিজেদের বিরুদ্ধে এ মর্মে সাক্ষ্য দিবে যে, তারা অকৃতজ্ঞ বান্দাহ ছিলো।” -(সূরা আল আনআমঃ ১৩০)
এহেন কর্মলিপি এবং এসব সাক্ষী সহ মানুষ আল্লাহর আদালতে উপস্থিত হবে। অতপর এ উপস্থিতির অবস্থা কিরূপ হবে? সে সম্পূর্ণ একাকী ও অসহায়ভাবে আসামীর কাঠগড়ায় গিয়ে খাড়া হবে।
وَلَقَدْ جِئْتُمُونَا فُرَادَىٰ كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَتَرَكْتُمْ مَا خَوَّلْنَاكُمْ وَرَاءَ ظُهُورِكُمْ ۖ وَمَا نَرَىٰ مَعَكُمْ شُفَعَاءَكُمُ الَّذِينَ زَعَمْتُمْ أَنَّهُمْ فِيكُمْ شُرَكَاءُ ۚ لَقَدْ تَقَطَّعَ بَيْنَكُمْ وَضَلَّ عَنْكُمْ مَا كُنْتُمْ تَزْعُمُونَ
“তোমাকে প্রথমবার যেরূপ সৃষ্টি করেছিলাম, ঠিক তেমনি আজ তুমি আমাদের কাছে একাকী এসেছো। তোমাকে যেসব জিনিস দান করেছিলাম, তা সবই তুমি ছেড়ে এসেছো।”- (সূরা আল আনআমঃ ৯৪)
সেখানে প্রত্যেকেই নিজ নিজ হিসেব পেশ করবেঃ
وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ ۖ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا
اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَىٰ بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا
“প্রত্যেকের ভালো ও মন্দ কর্মলিপি আমরা তার গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি। আমরা তার জন্যে কিয়ামতের দিন একটি কিতাব বের করবো, যা সে নিজের সামনে উন্মুক্ত পাবে। তাকে বলা হবেঃ নিজের কর্মলিপি পড়ে দেখ। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসেব করার জন্যে যথেষ্ট।” – (সূরা বনী ঈসরাইলঃ ১৩-১৪)
সেখানে বংশগত প্রভাব প্রতিপত্তি কোন কাজে আসবে নাঃ
لَنْ تَنْفَعَكُمْ أَرْحَامُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ ۚ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَفْصِلُ بَيْنَكُمْ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
“কিয়ামতের দিন তোমাদের গোত্রীয় সম্পর্ক এবং সন্তান-সন্ততি কোনই কাজে আসবে না।” -(সূরা আল মুমতাহিনাঃ ৩)
সেখানে সুপারিশের দ্বারা কোন ফলোদয় হবে নাঃ
مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ
“যালেমদের জন্য না কোন বন্ধু হবে,না কোন সুপারিশকারীর কথা মানা হবে।”-(সূরা মুমেনঃ ১৮)
সেখানে উৎকোচের কারবার চলবে নাঃ
يَوْمَ لَا يَنْفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ
“সেদিন না ধনমাল কোন কাজে আসবে, আর না সন্তান-সন্ততি।”- (সূরা শুয়ারাঃ ৮৮)
মানুষের কৃতকর্ম ওজন করা হবে এবং প্রতিটি অণু-পরমাণু হিসেব করা হবেঃ
وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا ۖ وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا ۗ وَكَفَىٰ بِنَا حَاسِبِينَ
“আমরা কিয়ামতের দিন নির্ভুল পরিমাপকারী তুলাদন্ড রেখে দেব। কারো ওপর বিন্দু পরিমাণও যুলুম করা হবে না। যদি একটি শর্ষে পরিমাণও আমল হয়, তবু আমরা তা উপস্থিত করবো। আর হিসেব গ্রহণের জন্যে আমরাই যথেষ্ট।” -(সূরা আল আম্বিয়াঃ ৪৭)
সেখানে শান্তি ও পুরষ্কার সবকিছুই হবে আমল অনুযায়ীঃ
الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
“তোমরা যেরূপ আমল করছিলে আজ সেরূপই তোমাদের প্রতিফল দেয়া হবে।” -(সূরা আল জাসিয়াঃ ২৮)
وَلِكُلٍّ دَرَجَاتٌ مِمَّا عَمِلُوا
“প্রত্যেকে যেরূপ আমল করেছে তার জন্যে তেমনই মর্যাদা হবে।” -(সূরা আন’আমঃ ১৩২)
বস্তুত এ পুলিশ ও আদালতের ভয়ই মানুষের মনে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছে। এটা দুনিয়ার পুলিশ নয় যে,তার দৃষ্টি থেকে মানুষ আত্মগোপন করতে পারে। তেমনি এটা দুনিয়ার আদালত নয় যে,সাক্ষ্য-প্রমাণ যোগাড় না হওয়া অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য সংগৃহীত হওয়া কিংবা অবৈধ প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার ফলে মানুষ তার পাকড়াও থেকে মুক্তি পেতে পারে। বরং এ পুলিশ সর্বদা ও সর্বাবস্থায় তার তত্ত্বাবধান করে চলেছে। এ আদালতের সাক্ষীদের দৃষ্টি থেকে সে কিছুতেই রক্ষা পেতে পারে না। এর কাছে মানুষের প্রতিটি চিন্তা ও কর্মের রেকর্ড বর্তমান রয়েছে। এর ফয়সালা এমনি সুবিচার মূলক যে,কোন দুষ্কৃতিই শাস্তি থেকে এবং সৎকাজই পুরষ্কার থেকে ছাড়া পেতে পারে না।
পরকাল বিশ্বাসের উপকার
এভাবে ইসলাম পরকাল বিশ্বাসকে তার নৈতিক বিধি ও শরীয়ত ব্যবস্থার জন্যে একটি মস্তবড়ো বুনিয়াদ তৈরী করে দিয়েছে। এতে একদিকে পূণ্য ও কল্যাণকে অবলম্বন করার এবং ধ্বংস ও বিনাশ থেকে আত্মরক্ষা করার বুদ্ধি-বৃত্তিক প্রেরণা বর্তমান রয়েছে,অন্যদিকে সৎকাজের নিশ্চিত পুরষ্কার এবং দুষ্কৃতির নিশ্চিত শাস্তির ভয়ও নিহিত রয়েছে। ইসলামের এ বিধি ও ব্যবস্থা তার দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের জন্যে কোনরূপ বৈষয়িক শক্তি ও প্রশাসনিক ক্ষমতার মুখাপেক্ষী নয়। বরং সে পরকাল বিশ্বাসের সাহায্যে মানব মনে এক প্রচন্ড বিবেক শক্তি জাগিয়ে তোলে। সে শক্তি কোন বাহ্য প্রলোভন ও ভয়-ভীতি ছাড়াই মানুষকে স্বভাবত সেইসব সৎকাজের জন্যে উদ্ধুদ্ধ করে,যেগুলোকে ইসলাম চূড়ান্ত পরিণাম ফলের দিক দিয়ে সৎকাজ বলে আখ্যা দিয়েছে। অনুরূপভাবে সে সেইসব দুষ্কৃতি থেকে আত্মরক্ষা করার প্রেরণা দেয়,যেগুলোকে ইসলাম চূড়ান্ত পরিণাম ফলের দৃষ্টিতে দুষ্কৃতি বলে সাব্যস্ত করেছে।
কুরআন মজীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যাবে তার বিভিন্ন জায়গায় এ প্রত্যয়টিকে নৈতিক আদর্শ শিক্ষা দেয়ার জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে। লোকদেরকে আল্লাহভীতি ও পরহেযগারির নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথেই বলা হয়েছেঃ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ مُلَاقُوهُ “আলাহকে ভয় করো এবং জেনে রাখো,তাঁর কাছে তোমাদেরকে হাযির হতেই হবে’’ -(সুরা বাকারাঃ ২২৩)। আল্লাহর পথে আত্মত্যাগের জন্যে উৎসাহিত করার সাথে সাথে এ নিশ্চয়তাও দেয়া হয়েছে যে, তোমরা মারা গেলে প্রকৃত প্রস্তাবে মারা যাবে না, বরং চিরস্থায়ী জীবন লাভ করবে। وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَٰكِنْ لَا تَشْعُرُونَ -(সূরা বাকারাঃ ১৫৪) দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য অবলম্বনের উপদেশ দান প্রসঙ্গে এ-ও বলে দেওয়া হয়েছে যে, ধৈর্যশীলদের জন্যে আল্লাহর কাছে অফুরন্ত রহমত ও অনুগ্রহ রয়েছেঃ
أُولَٰئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ
নির্ভীকতা ও সাহসিকতার উদ্দীপনা সৃষ্টি করা হয়েছে এভাবেঃ
قَالَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو اللَّهِ كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ
“যারা মনে করতো যে,তাদেরকে আল্লাহর কাছে হাযির হতে হবে,তারা বললোঃ আল্লাহর হুকুমে ক্ষুদ্র দলই বিরাট বাহিনীর ওপর বিজয়ী হয়ে থাকে।” -(সূরা বাকারাঃ ২৪৯)
কঠিনতম বিপদের মুকাবিলায় সুদৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি যোগানো হয়েছে এই বলেঃ
نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّاۚ ‘’জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার উত্তাপের চেয়ে অনেক বেশী তীব্র।” (তাওবাঃ ৮১)
সৎকাজের অর্থ ব্যয় করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এ বলেঃ
وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ
“তোমরা যা কিছু দান করবে,তার পূর্ণ প্রতিফল তোমরা পাবে এবং তোমাদের প্রতি কিছুমাত্র যুলুম করা হবে না।” -(সূরা বাকারাঃ১৭২)
কার্পণ্য থেকে বিরত রাখার জন্যে বলা হয়েছেঃ
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ ۖ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ ۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“আল্লাহ যাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহ বলে ধনশালী করা সত্ত্বেও তাতে কার্পণ্য করে, তারা যেনো মনে করে না যে,এটা তাদের পক্ষে কল্যাণকর;বরং এটা তাদের পক্ষে খুবই অনিষ্টকর। যে ধন সম্পদে তারা কার্পণ্য করে,কিয়ামতের দিন তা-ই বেড়ি বানিয়ে তাদের গলায় পরিয়ে দেয়া হবে।” -(সূরা আলে ইমরানঃ ১৮০)
সূদী কারবার থেকে বিরত করা হয়েছে এই বলেঃ تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ “সেই দিনকে ভয় করো, যেদিন তোমরা আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে’’ -(সূরা বাকারাঃ ২৮১)
দুনিয়ার সাজ-সরঞ্জামের প্রতি বেপরোয়া এবং দুষ্কৃতিকারীদের স্বাচ্ছন্দ দেখে ঈর্ষা না করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে এভাবেঃ
لَا يَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي الْبِلَادِ مَتَاعٌ قَلِيلٌ ثُمَّ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ ۚ وَبِئْسَ الْمِهَادُ لَٰكِنِ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا نُزُلًا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ ۗ وَمَا عِنْدَ اللَّهِ خَيْرٌ لِلْأَبْرَارِ
“হে নবী, দুনিয়ার জনপদসমূহে আল্লাহর নাফরমান লোকদের চলা-ফেরা তোমাকে যেন ধোঁকায় ফেলতে না পারে। এত ক্ষণস্থায়ী জীবনের আনন্দমাত্র। অতপর সকলে এমন জাহান্নামে যাবে যা সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাসস্থল। পক্ষান্তরে যারা আপন পরোয়ারদেগারকে ভয় করে জীবন যাপন করে তাদের জন্যে রয়েছে এমন উদ্যান যার নিন্মদেশ দিয়ে স্রোতস্বিনীসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে। সে উদ্যানসমূহে তারা চিরকাল অবস্থান করবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই তাদের আতিথেয়তার সামগ্রী। আর আল্লাহর কাছে যা কিছু রয়েছে তাই নেক বান্দাদের জন্যে সর্বোৎকৃষ্ট।”-(সূরা আল ইমরানঃ ১৯৬-১৯৮)