৯
পারলৌকিক জীবন
মৃত্যুর পরে কি কোন জীবন আছে? থাকলে তা কি রকমের জীবন? এ প্রশ্নটি মূলত আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধির সীমা বহির্ভূত। কারণ মৃত্যু সীমার ওপারে কি আছে, আর কি নেই তা উঁকি মেরে দেখার মতো চোখ আমাদের নেই। ওপারের কোন আওয়াজ শোনার মতো কান আমাদের নেই। এমন কি, ওপারে আদৌ কিছু আছে কিনা, তা নিশ্চিতরূপে জানার মতো কোন যন্ত্রও আমাদের আয়ত্বাধীন নয়। কাজেই বিজ্ঞনের দিক থেকে বলতে গেলে এ প্রশ্ন তার সম্পূর্ণ সীমা বহির্ভূত যে ব্যক্তি বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে অস্বীকার করে, সে নিসন্দেহে একটি অবৈজ্ঞানিক কথা বলে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সেখানে কোন জীবন আছে, একথা যেমন বলা যায় না, তেমনি কোন জীবন নেই, একথাও বলা চলে না। কাজেই ঐ সম্পর্কে অন্তত কোন নিশ্চিত জ্ঞান-সূত্র না পাওয়া পর্যন্ত যথার্থ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এ হতে পারে যে, আমরা পারলৌকিক জীবনকে স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করবো না।
কিন্তু বাস্তব জীবনে কি এ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা চলে? আদৌ নয়। কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিতে কোন একটা জিনিসকে জানার উপায় উপকরণ সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন না হওয়া পর্যন্ত সে সম্পর্কে নেতিবাচক বা ইতিবাচক কোনরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা সম্ভবপর হতে পারে। কিন্তু সেই বস্তুটির সাথে যখন আমাদের বাস্তব জীবন সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে, তখন আর স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির ওপর কর্মনীতির নির্ধারণ না করে উপায় থাকে না। উদাহরণত বলা যায়, একটি লোক সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না। তার সাথে যদি আপনাকে কোন কারবার করতে হয়, তাহলে হয় তাকে ঈমানদার নচেত বেঈমান ভেবে আপনি কাজ করতে বাধ্য। আপনি মনে মনে অবশ্যই ধারণা করতে পারেন যে, লোকটি ঈমানদার কি বেঈমান প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমি সন্দিগ্ধচিত্তে কাজ করবো; কিন্তু তার ঈমানদারিকে সন্দেহজনক ভেবে আপনি যে কাজ করবেন, কার্যত তার ধরন তাকে বেঈমান মনে করার মতোই হবে। কাজেই বাস্তব ক্ষেত্রে স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতির মধ্যে সন্দিগ্ধ অবস্থাটা শুধু মনের মধ্যেই থাকতে পারে; বাস্তব কর্মনীতি কখনো সন্দিগ্ধ অবস্থার ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারেনা। তার জন্য স্বীকৃতি কিংবা অস্বীকৃতি একান্তই অপরিহার্য।
একটু সামান্য তলিয়ে চিন্তা করলেই এটা বোঝা যেতে পারে যে, পারলৌকিক জীবনের প্রশ্নটি নিছক একটি দার্শনিক প্রশ্নই নয়, বরং আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে তার গভীরতর সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের গোটা নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই এ প্রশ্নের উপর নির্ভরশীল। আমার যদি ধারণা হয় যে, জীবনের সবকিছু এ পার্থিব জীবনেই শেষ এবং এরপর আর কোন জীবন নেই, তাহলে আমার নৈতিক আচরণ এক ধরনের হবে।আর যদি আমি এ ধারণা রাখি যে, এরপরে আরো একটি জীবন আছে, যেখানে আমার বর্তমান জীবনের যাবতীয় ক্রিয়াকর্মের হিসাব দিতে হবে এবং আমার এ জীবনের কৃতকর্মের ভিত্তিতেই সেখানে ভাল বা মন্দ পরিণাম ভোগ করতে হবে, তাহলে নিশ্চয়ই আমার নৈতিক আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের হবে। এর একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। মনে করুন, এক ব্যক্তি এ ধারণা নিয়ে ভ্রমণ করছে যে, তাকে এখান থেকে শুধু করাচী যেতে হবে। করাচী পৌঁছার পর তার ভ্রমণ শুধু চিরতরে সমাপ্তিই লাভ করবেনা, বরং সেখানে সে পুলিশ, আদালত এবং জিজ্ঞাসাবাদকারী সকল শক্তির একেবারে নাগালের বাইরে চলে যাবে।
পক্ষান্তরে অপর এক ব্যক্তি মনে করে যে, এখান থেকে করাচী পর্যন্ত তার ভ্রমণ একটি মনজিল মাত্র। এরপর তাকে সমুদ্র পারের আর একটি দেশে যেতে হবে, যেখানকার বাদশাহ এ দেশেরও বাদশাহ। সে বাদশহর দফতরে তার পাকিস্তানে থাকাকালীন যাবতীয় ক্রিয়াকর্মের গোপন রেকর্ড বর্তমান রয়েছে। সেখানে সে স্বীয় কর্মের দৃষ্টিতে কিরূপ মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য, তা তার সেই রেকর্ড বিচার-বিশ্লেষণ করে স্থির করা হবে। এখন এ দু’ ব্যক্তির কর্মনীতি কতোখানি পরস্পর বিরোধী হবে, আপনারা তা সহজেই আন্দাজ করতে পারেন। প্রথম ব্যক্তি এখান থেকে শুধু করাচী পর্যন্ত ভ্রমণের প্রস্তুতি করবে, আর দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রস্তুতি চালাবে পরবর্তী দীর্ঘ মঞ্জিলগুলোর জন্যেও। প্রথম ব্যক্তি মনে করবে, লাভ-ক্ষতি যা কিছু করাচী পৌঁছা পর্যন্তই তার পরে আর কিছুই নেই। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি ধারনা করবে, আসল লাভ ক্ষতি ভ্রমণের প্রথম পর্যায়ে নয়, বরং তা রয়েছে শেষ পর্যায়ে। প্রথম ব্যক্তি তার ক্রিয়াকলাপের কেবল সে সব ফলাফলের প্রতি লক্ষ্য রাখবে; যা করাচী পর্যন্ত ভ্রমণে প্রকাশ পেতে পারে। আর দ্বিতীয় ব্যক্তির দৃষ্টি থাকবে সেসব ফলাফলের প্রতি, যা সমুদ্রপারের সেই দেশটিতে গিয়ে প্রকাশ পাবে। স্পষ্টত এই দু’ ব্যক্তির কর্মনীতির পার্থক্য তাদের ভ্রমণ সংক্রান্ত ধারণারই পত্যক্ষ ফল। ঠিক এরূপে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কিত ধারণা বিশ্বাস আমাদের নৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং তার ধারাকে চূড়ান্ত রূপে নির্ণয় করে দেয়। বাস্তব কর্ম ক্ষেত্রে কোন পদক্ষপ গ্রহণ করতে হলে আমরা এ জীবনকে প্রথম ও সর্বশেষ জীবন ভেবে কাজ করছি, না পরবর্তী কোন জীবন ও তার ফলাফলের প্রতি লক্ষ্য রাখছি-এ প্রশ্নের ওপরই সে পদক্ষেপের দিক নির্ণয় নির্ভর করে। প্রথম অবস্থায় আমাদের পদক্ষেপ হবে এক ধরনের, আর দ্বিতীয় অবস্থায় তা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।
এর থেকে জানা গেলো যে, পারলৌকিক জীবনের প্রশ্নটি নিছক একটি দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্ন নয়, বরং এটি বাস্তব জীবনের প্রশ্ন। এমতাবস্থায় এ সম্পর্কে সন্দেহ ও দোদুল্যমান অবস্থায় থাকার কোনই অবকাশ নেই। সন্দিগ্ধ অবস্থায় অথবা জীবনে যে দৃষ্টিভঙ্গিই গ্রহণ করবো, শেষ পর্যন্ত তা অবিশ্বাসীরই দৃষ্টিভঙ্গি হবে। কাজেই যে কোন দিক দিয়েই বিচার করা যাক না কেন, মৃত্যুর পরে কোন জীবন আছে কিনা এ প্রশ্নের চূড়ান্ত মিমাংসা করতে আমরা বাধ্য। এ ব্যাপারে বিজ্ঞান আমাদের সাহায্য না করলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি-প্রমাণের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে।
এখন বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি-প্রমাণের জন্যে আমাদের কাছে কি কি উপকরণ আছে, তা-ই একটু বিচার করে দেখা যাক। আমাদের সামনে প্রথম উপকরণ হচ্ছে মানুষ আর দ্বিতীয় উপকরণ এ বিশ্বব্যবস্থা। আমরা মানুষকে এ বিশ্বব্যবস্থার পটভূমিতে রেখে যাচাই করে দেখবো, মানুষ হিসেবে তার সমস্ত চাহিদা ও দাবি-দাওয়া কি এ ব্যবস্থাপনায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, না কোন জিনিস অপূরণীয় থাকার ফলে তার জন্যে ভিন্নরূপ কোন ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন? মানুষের দেহটির প্রতিই লক্ষ্য করে দেখুন- এটি বহু খনিজ দ্রব্য, লবণ, পানি এবং গ্যাসের সমষ্টি। এর পাশাপাশি বিশ্বজগতেও মাটি, পাথর, ধাতু, লবণ, গ্যাস, নদী এবং এ ধরনের অন্যান্য জিনিস বর্তমান। এ জিনিসগুলোর নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য বিধানের প্রয়োজন। বিশ্ব জগতের সর্বত্র তা ক্রিয়াশীল রয়েছে। সেই বিধান বাইরের পরিবেশে যেমন পাহাড়, নদী ও বাতাসকে নিজ নিজ কাজ সম্পাদনের সুযোগ দিচ্ছে, তেমনি মানব দেহও তার অধীনে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, মানুষের দেহ তার চারপাশের বস্তুনিচয় থেকে খাদ্য গ্রহণ করে বিকাশ বৃদ্ধি লাভ করছে। এ ধরণের নিয়ম বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, ঘাস ইত্যাদি সৃষ্টি জগতেও বর্তমান এবং এখানেও বর্ধনশীল দেহধারীদের জন্যে প্রয়োজনীয় বিধানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
তৃতীয়ত, মানুষের দেহ একটি জীবন্ত স্বত্তা, যা নিজ ইচ্ছায়ই নড়াচড়া করে, নিজের খাদ্য নিজেই সংগ্রহ করে, নিজের হেফাজতের দায়িত্ব নিজেই পালন করে এবং নিজের বংশ রক্ষার ব্যবস্থা নিজেই করে থাকে। সৃষ্টি জগতে এ ধরনের আরো বহুবিধ জীবনের অস্তিত্ব বর্তমান- জল স্থল ও বায়ুমণ্ডলে এরূপ অসংখ্য জীব-জন্তু লক্ষ্য করা যায়, যাদের গোটা জীবনের ওপর পরিব্যপ্তি থাকার উপযোগী আইন-বিধানও এখানে পুরোপুরি ক্রিয়াশীল।
এ সবের ওপর মানুষের আর একটি স্বত্তা রয়েছে, যাকে আমরা নৈতিক স্বত্তা বলে অভিহিত করি। তার মধ্যে সৎকাজ ও দুষ্কৃতি করার অনুভূতি আছে। সৎকাজ ও দুষ্কৃতির পার্থক্য বোধ আছে। সৎকাজ ও দুষ্কৃতি করার শক্তি আছে। তার প্রকৃতি সৎকাজের ভালো ফল এবং দুষ্কৃতির মন্দ ফল প্রত্যাশা করে। যুলুম, ইনসাফ, সত্যবাদিতা, মিথ্যাচার, হক-নাহক, দয়াশীলতা, নিষ্ঠুরতা, কৃতজ্ঞতা, বদান্যতা, কৃপণতা, আমানতে খেয়ানত এবং এ ধরনের বিভিন্ন নৈতিক গুণের মধ্যে সে স্বভাবতই পার্থক্য করে থাকে। এ গুণসমূহ কার্যত তার জীবনে লক্ষ্য করা যায়। এগুলো কোন কাল্পনিকজিনিস নয়, বরং বাস্তবক্ষেত্রের মানবীয় সমাজ ও সভ্যতার ওপর এগুলো প্রভাবশীল হয়ে থাকে। কাজেই মানুষ স্বভাবগতভাবেই তার ক্রিয়াকান্ডের প্রাকৃতিক ফলাফলের মতোই নৈতিক ফলাফল তীব্রভাবে প্রত্যাশা করে।
কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার প্রতি গভীরভাবে তাকিয়ে দেখুন এ ব্যবস্থাপনায় মানবীয় ক্রিয়াকর্মের নৈতিক ফলাফল কি পুরোপুরি প্রকাশ পেতে পারে? আমি সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এখানে তার কোনই সম্ভাবনা নেই। কারন অন্তত আমার জানামতে এখানে নৈতিক স্বত্তার অধিকারী অপর কোন জীবের অস্তিত্ব নেই। পরন্তু গোটা বিশ্বজগত প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে পালিত হচ্ছে। এর কোথাও নৈতিক বিধানকে ক্রিয়াশীল দেখা যায় না। এখানে রূপার ওজন ও মূল্য দু-ই আছে, কিন্তু সত্যের ওজন বা মূল্য কোনটিই নেই। এখানে আমের বীজ হতে হামেশা আম গাছই জন্মে; কিন্তু সত্যের বীজ বপনকারীদের প্রতি কখনো পুষ্পবৃষ্টি আর কখনো (বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে) জুতা নিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। এখানে বস্তুগত উপাদানগুলোর জন্যে সুনির্দিষ্ট বিধান আছে, সেই বিধান অনুসারে হামেশা সুনির্দিষ্ট ফলাফল প্রকাশ পায়। কিন্তু নৈতিক উপাদানগুলোর জন্য কোন সুনির্দিষ্ট বিধান নেই, সেগুলোর ক্রিয়াশীলতার ফলে হামেশা নির্দিষ্ট ফলাফলও প্রকাশ পায়না। প্রাকৃতিক বিধানের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্যের ফলে এখানে কখনো নৈতিক ফলাফল প্রকাশই পেতে পারে না; কখনো প্রকাশ পেলেও প্রাকৃতিক বিধান যতোটুকু অনুমতি দেয়, কেবল ততোটুকুই প্রকাশ পায়। বরং অনেক ক্ষেত্রে এরূপও দেখা যায় যে, নৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে কোন কাজের একটি বিশেষ ফল লাভের সম্ভাবনা থাকলেও প্রাকৃতিক বিধানের হস্তক্ষেপে ফলাফল সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ নিজেও তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি বাঁধাধরা নিয়মে তার ক্রিয়াকর্মের নৈতিক ফলাফল লাভের কিঞ্চিৎ প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু তার এ প্রচেষ্টা খুবই সীমিত এবং অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ প্রমানিত হয়েছে। একদিকে প্রাকৃতিক বিধান তাকে সীমিত ও ত্রুটিপূর্ণ করে রেখেছে, অপরদিকে মানুষের নিজস্ব দূর্বলতা এ ত্রুটিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমি কয়েকটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে আমার বক্তব্যকে সুস্পষ্ট করতে চাই; ধরুন এক ব্যক্তি যদি অন্য এক ব্যক্তির শত্রু হয় এবং তার ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় তবে ঘরটি পুড়ে যাবে। এটা তার কাজের স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ফল। এর নৈতিক ফল স্বরূপই সেই ব্যক্তির ততোখানি শাস্তি হওয়া উচিত, যতোখানি সে একটি পরিবারের ক্ষতি করেছে। কিন্তু এ ফল প্রকাশ পাওয়া কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে-যেমন অগ্নি সংযোগকারীর সন্ধান পাওয়া, তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা, তার অপরাধ সাব্যস্ত হওয়া, আদালত কর্তৃক অগ্নিদগ্ধ পরিবার ও তার ভবিষ্যত বংশধরদের সঠিক ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা এবং ন্যায়পরতার সাথে অপরাধীকে ঠিক সেই পরিমাণ শাস্তিদান করা। এ শর্তগুলোর কোন একটি যদি পূর্ণ না হয়, তাহলে নৈতিক ফল আদৌ প্রকাশ পাবে না, কিংবা তার খুব সামান্য অংশই প্রকাশিত হবে। আবার এমনো হতে পারে যে, নিজের শত্রুকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে সেই ব্যক্তি দুনিয়ায় পরম সুখে কালানিপাত করতে থাকবে।
এর চেয়েও বড়ো রকমের একটি উদাহরণ দেয়া যাক। কতিপয় ব্যক্তি নিজ জাতির ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে বসে এবং গোটা জাতি তাদের অঙ্গুলি সংকেতে চলতে থাকে। এ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে তারা লোকদের মধ্যে জাতিপূজার উৎকট মনোভাব এবং সাম্রাজ্যবাদী উন্মাদনার সঞ্চার করে। এভাবে তারা আশপাশের জাতিগুলোর সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসে, লক্ষ লক্ষ নিরীহ লোক হত্যা করে, দেশের পর দেশ ধ্বংস করে ফেলে কোটি
কোটি মানুষকে অপমান ও লাঞ্ছনার জীবন যাপনে বাধ্য করে। তাদের এ কীর্তিকালাপ স্বভাবতই মানবেতিহাসে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে এবং সে প্রতিক্রিয়া পুরুষানুক্রমে- যুগের পর যুগ ধরে চলতে থাকবে। আপনি কি মনে করেন, এ কতিপয় ব্যক্তি যে মহাপরাধ করেছে, তার যথোচিত ন্যায়সঙ্গতশাস্তি কখনো এ পার্থিব জীবনে পেতে পারে? স্পষ্টতই বলা যায় তাদের দেহ থেকে যদি সমস্ত গোশত কেটে ফেলা হয়, কিংবা তাদেরকে জীবন্ত অবস্থায় জ্বালিয়ে দেয়া হয় অথবা মানুষের আয়ত্তাধীনে অপর কোন কঠিন শাস্তিও দেয়া হয়, তবু তারা কোটি কোটি মানুষ এবং তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের যে পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছে, সে পরিমাণ শাস্তি তারা কখনোও পেতে পারে না। কারণ বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা যে প্রাকৃতিক বিধানের দ্বারা চালিত, তদনুসারে অপরাধ তুল্য শাস্তি পাওয়া কিছুতেই সম্ভবপর নয়।
অনুরূপভাবে দুনিয়ার আদর্শ মহাপুরুষদের কথা বলা যেতে পারে। তাঁরা মানব জাতিকে সততা ও ন্যায়পরতা শিক্ষা দিয়েছেন এবং জীবন যাপনের জন্যে আলোকজ্জ্বল পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন। তাঁদের অকৃপণ দানের ফলে অসংখ্য মানুষ পুরুষানুক্রমে–যুগের পর যুগ ধরে কল্যাণ লাভ করে আসছে এবং ভবিষ্যতে আরো কতকাল লাভ করবে, তার ইয়ত্তা নেই। এসব মহাপুরুষ কি এ দুনিয়ায় তাঁদের কৃতকর্মের পূর্ণ প্রতিফল লাভ করতে পারবে? আপনি কি ধারণা করতে পারেন যে, বর্তমান প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে এক ব্যক্তি তার এমন কাজেরও প্রতিফল লাভ করতে পারে, যার প্রতিক্রিয়া মৃত্যুর পরও হাজার হাজার বছর ধরে অসংখ্য মানুষ পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে?
আমি ওপরেই বলেছি যে, প্রথমত বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা যে বিধানের দ্বারা চালিত, তাতে মানবীয় ক্রিয়াকর্মের পূর্ণ নৈতিক ফল লাভ করার কোনই অবকাশ নেই। দ্বিতীয়ত এখানকার ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষ যেসব কাজ করে থাকে, তার প্রতিক্রিয়া এতো সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘস্থায়ী যে, তার পূর্ণ ফলাফল ভোগ করার জন্য হাজার হাজার বরং লক্ষ লক্ষ বছর দীর্ঘ জীবনের প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে মানুষের পক্ষে এতো দীর্ঘ জীবন লাভ করা সম্ভবপর নয়। এর থেকে জানা গেলো যে, মানব সত্তায় মৃত্তিক, আঙ্গিক ও জৈবিক উপাদানগুলোর জন্যে বর্তমান প্রাকৃতিক জগত (Physical World) এবং তার প্রাকৃতিক বিধানগুলোই যথেষ্ঠ। কিন্তু তার নৈতিক উপাদানের জন্যে এ দুনিয়া একেবারেই অপর্যাপ্ত। তার জন্যে অন্য একটি বিশ্বব্যবস্থার প্রয়োজন, যেখানে নৈতিক বিধান হবে কর্তৃত্বশীল আইন (Governing Law) আর প্রাকৃতিক বিধান তার অধীনে থেকে শুধু সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। সেখানে জীবন সীমিত না হয়ে অসীম হবে এবং এখানে অপ্রকাশিত বা ভিন্ন রূপে প্রকাশিত সকল নৈতিক ফলাফলই সেখানে সঠিক ও পূর্ণরূপে প্রকাশিত হবে। সেখানে সোনা ও রূপার পরিবর্তে সৎকাজ ও সত্যতার ওজন ও মূল্য হবে। সেখানে আগুন কেবল তাকেই জ্বালাবে যে নৈতিক কারনে দগ্ধ হওয়ার উপযুক্ত। সেখানে সৎলোকেরা সুখ-শান্তি পাবে আর দুষ্কৃতিকারীরা দুঃখ-ভোগ করবে। বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রকৃতি ও স্বভাবতই এমনি একটি জগতব্যবস্থা দাবী করে।
এ ব্যাপারে বুদ্ধিবৃত্তি আমাদেরকে শুধু ‘হওয়া উচিত’ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েই তার কাজ শেষ করে। এখন প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কোন জগত আছে কিনা, এ সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের বুদ্ধি ও জ্ঞান উভয়ই অসমর্থ। এ ব্যাপারে একমাত্র কুরআনই আমাদেরকে সাহায্য করে। তার ঘোষণা এই যে, তোমাদের বুদ্ধি ও প্রকৃতি যে জিনিসটি দাবী করে, মূলত হবেও ঠিক তা-ই। বর্তমান প্রাকৃতিক বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যবস্থা একদিন চূর্ণ করে ফেলা হবে এবং তারপর এক নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। সেখানে আসমান, জমীন এবং তার মধ্যকর বস্তুনিচয় এক ভিন্ন রূপ ধারণ করবে। অতপর সৃষ্টির আদিকাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ায় যারা এসেছে,তাদের সবাইকে আল্লাহ তায়ালা পুনর্জীবিত করবেন এবং এক সাথে সবাই তাঁর সামনে উপস্থিত হবে সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রত্যেক জাতি এবং গোটা মানব গোষ্ঠীর কর্মের রেকর্ড নির্ভূল ও নিখুঁত অবস্থায় সুরক্ষিত থাকবে। এ দুনিয়ায় প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতিটি কাজের যতখানি প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তার পূর্ণ বিবরণ সেখানে মওজুদ থাকবে। এ প্রতিক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মানব গোষ্ঠীই সাক্ষীর কাঠগড়ায় উপস্থিত থাকবে। যেসব অণু-পরমাণুর ওপর মানুষের কথা ও কাজের ছাপ পড়েছে, তারাও নিজ নিজ কাহিনী পেশ করবে। খোদ মানুষের হাত-পা, চোখ-কান, জিহ্বা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদেরকে কি কি কাজে ব্যবহার করা হয়েছিলো তা সাক্ষ্যদান করবে। অতপর সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক এসব কার্যবিবরণীর ভিত্তিতে কে কতোটা পুরস্কার আর কতোটা শাস্তির উপযুক্ত পূর্ণ ন্যায়পরতার সাথে তা ঘোষণা করবেন। এ পুরস্কার বা শাস্তির পরিধি এতো ব্যাপকতর হবে যে, বর্তমান জগতের সীমিত মাপকাঠির ভিত্তিতে তা অনুধাবন করাও অসম্ভব। সেখানে সময় ও স্থানের মাপকাঠি ভিন্নরূপ এবং প্রাকৃতিক বিধানও অন্যরকম হবে। মানুষের যেসব সৎকাজের প্রতিক্রিয়া দুনিয়ায় হাজার হাজার বছর ধরে চলছে, সেখানে তার পুরোপুরি প্রতিফল লাভ করা যাবে। মৃত্যু, ব্যাধি, বার্ধক্য তার সুখ-শান্তিতে কিছুমাত্র ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারবে না। অনুরূপভাবে তার যে দুষ্কৃতির প্রতিক্রিয়া দুনিয়ায় হাজার হাজার বছর ধরে অসংখ্য মানুষ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, তার পূর্ণ শাস্তিও ভোগ করতে হবে। মৃত্যু বা অজ্ঞানতা এসে সে শাস্তি থেকে তাকে বাঁচাতে পারবে না।
এমন একটি জীবন ও জগতকে যারা অসম্ভব মনে করে, তাদের মানসিক সংকীর্ণতার জন্যে আমার অনুকম্পা হয়। আমাদের বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা যদি বর্তমান প্রাকৃতিক বিধান সহ বিদ্যমান থাকতে পারে, তাহলে অন্য একটি বিশ্বব্যবস্থা অপর কোন প্রাকৃতিক বিধান সহ কেন বর্তমান থাকতে পারবে না। অবশ্য এরূপ জগতের সম্ভাবনা কোন বাস্তব সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা নির্ণয় করা চলে না। এর জন্যে ঈমান বিল গায়েব বা অদৃশ্যে বিশ্বাসের একান্তই প্রয়োজন।
— সমাপ্ত —