এক
পার্থিব জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারণা:
মানুষ নিজের সম্পর্কে গোড়া থেকেই একটা প্রকাণ্ড রকমের ভুলধারণা পোষণ করে আসছে এবং আজ পর্যন্তও তার সে ভুল ধারণা বর্তমান রয়েছে। কক্ষনো তাকে বাড়াবাড়ির পথ অবলম্বন করে এবং নিজেকে সে দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত সত্তা বলে মনে করে নেয়। তার মন-মস্তিস্কে স্পর্ধা, অহংকার ও বিদ্রোহের ভাবধারা পূর্ণ হয়ে যায়। কোন শক্তিকে তার শক্তির ওপরেতো দূরের কথা, নিজের সমকক্ষ ভাবতেও সে প্রস্তুত হয়না। বরং *********** (আমার চেয়েও শক্তিশালী আর কে?) এবং ************ (আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভু) এর ধ্বনি সে উচ্চারন এবং নিজেকে সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন ভেবে জোর-জুলুমের দেবতা এবং অন্যায়-অবিচার ও ধ্বংস-বিপর্যয়ের সাক্ষাৎ মূর্তিরুপে দেখা দেয়। এবার কখনও সে কড়াকড়ির রোগে আক্রান্ত হয় এবং নিজেকে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে নীচসত্তা বলে ধারণা করে বসে। গাছ, পাথর, দরিয়া, পাহাড়, জানোয়ার, হওয়া, আগুন, মেঘ, বিজলী, চন্দ্র, সূর্য, তারকা, মোট কথা এমন প্রতিটি জিনিসের সামনেই সে মাথা নত করে দেয়, যার ভেতর কোন প্রকার শক্তি কিংবা উপকার-অপকার দেখতে পায়। এমনকি,তার নিজেরই মতো মানুষের মধ্যেও যদি সেকোন শক্তি দেখতে পায়, তাকেও সে দেবতা এবং মাবুদ বলে মানতে এতটুকুও দ্বিধা করেনা।
মানুষের মূল পরিচয়ঃ
ইসলাম এ দু’চরম ধারনাকে বাতিল করে দিয়ে মানুষের সামনে তার প্রকৃত পরিচয় পেশ করেছে। সে বলেঃ *************
“আপন তত্ত্বের প্রতি মানুষের লক্ষ্য করা উচিত যে, সে কোন জিনিস থেকে পয়দা হয়েছে,? সে পয়দা হয়েছে সবেগে নির্গত এক পানি থেকে যা পিঠ ও বক্ষ অস্থির মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে”।– ( সুরা আততারিকঃ৫-৭ )
*****************************
“মানুষ কি লক্ষ্য করেনা যে, আমরা তাকে এক বিন্দু পানি থেকে সৃষ্টি করেছি? এখন সে খোলাখুলি দুশমনে পরিণত হয় এবং আমাদের জন্যে দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকে আর নিজের আসলকে ভুলে গেছে।”
( **************************************)
“মানুষের সৃষ্টির সূচনা করেছেন মাটি থেকে; অতপর মাটির নির্যাস থেকে যা এক অপবিত্র পানি তার বংশধারা চালিয়েছেন। তৎপরতার গঠনকার্য ঠিক করেছেন এবং তার ভেতরে আপন রুহ ফুঁকে দিয়েছেন”। [সূরাআসসাজদাঃ৭-৯]
( ****************)
“আমরা তোমাদেরকে মাটি থেকে, তারপর পানি বিন্দু থেকে, অতপর জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে, তৎপর পূর্ণ বা অপূর্ণ মাংসপিন্ড থেকে পয়দা করেছি, যেন তোমাদেরকে আপন কুদরত দেখাতে পারি এবং আমরা যে শুক্র-বিন্দুকে ইচ্ছা করি এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাতৃ গর্ভে রেখে দেই, অনন্তর তোমাদেরকে বাচ্চা বানিয়ে বের করি; অতপর তোমাদেরকে বাড়িয়ে যৌবন পর্যন্ত পৌছিয়ে দেই; তোমাদের ভেতর থেকে কেউ মৃত্যুবরণ করে, আর কেউ এমন নিকৃষ্টতম বয়স পর্যন্ত গিয়ে পৌছে যে, বোধ শক্তি লাভ করার পর আবার অবুঝ হয়ে যায়।” [সূরা আলহাজ্জঃ৫]
(****************)
“হে মানুষ! তোমার সেই দয়ালু রব সম্পর্কে কি জিনিস তোমাকে প্রতারিত করেছে? যিনি তোমাকে পয়দা করেছেন তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-গুলো ঠিক করেছেন, তোমার শক্তি ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করেছেন এবং যে আকৃতিতে ইচ্ছা করেছেন তোমার উপাদানসমূহ সংযোজিত করেছেন। [সূরা ইনফিতারঃ৬-৮]
(**************) “ এবং আল্লাহ্ই তোমাদেরকে তোমাদের মায়েদের পেট থেকে বের করেছন; যখন তোমরা বের হলে, তখন এমন অবস্থায় ছিলে যে, তোমরা কিছুই জানতেনা। তিনি তোমাদেরকে কান দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, অন্তঃকরণ দিয়েছেন, যেন তোমরা শোকর করো।’’
( *************)
“তোমরাকি শুক্রবিন্দু সম্পর্কে চিন্তা করেছ যা তোমরা মেয়েদের গর্ভে নিক্ষেপ করে থাকো? তা থেকে (বাচ্চা) তোমরা পয়দা করো, না আমরাই করে দিয়েছি। এবং আমরা তোমাদের দৈহিক আকৃতি বদলে দিতে এবং অন্য এক চেহারায় তোমাদের তৈরি করতে-যা তোমরা জানো না-অপারগ। আর তোমরা নিজেদের প্রথম পয়দায়েশের কথাতো জানোই; তাহলে কেন তোমরা তা থেকে সবক হাসিল করোনা? অনন্তর তোমরা কি লক্ষ্য করেছো যে, তোমরা যে ফসলাদির চাষাবাদ করো, তাকি তোমরা উৎপাদন করো, না আমরা উৎপাদনকারী? আমরা যদি ইচ্ছা করি তো তাকে খড় কুটায় পরিণত করতে পারি এবং তোমরা শুধু কথা বানাতে থাকবে যে, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি বরং সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছি। অতঃপর তোমরা কি সেই পানির প্রতি লক্ষ্য করেছো, যা তোমরা পান করে থাকো? তা কি তোমরা মেঘ থেকে বর্ষণ করিয়েছো, না বর্ষণকারী আমরা? আমরা যদি ইচ্ছা করি তো তাকে তিক্ত বানিয়ে দিতে পারি। সুতরাং কেন শোকর আদায় করোনা? তৎপর সেই আগুনের প্রতি কি তোমরা লক্ষ্য করেছো, যা তোমরা প্রজ্জলিত করো? যে কাঠ দিয়ে জ্বালানো হয়, তা কি তোমরা পয়দা করেছো, না আমরা জন্মদানকারী? আমরা তাকে এক স্মারকবস্তু এবং পথিকদের জন্যে জীবনের পাথেয় স্বরূপ সৃষ্টি করেছি। সুতরাং হে মানুষ, তোমার মহিমান্বিত রবের পবিত্রতা ঘোষণা করো।” – ( সূরা আল ওয়াকিয়াঃ৫৮-৭৪ )
(***************)
“যখন সমুদ্রের ভেতর তোমাদের ওপর ঝড়ের বিপদ নেমে এলো তখন তোমরা নিজেদের সমস্ত বাতিল মাবুদকে ভুলে গেলে এবং তখন আল্লাহর কথাই শুধু মনে এলো। তারপর তিনি যখন তোমাদেরকে উদ্ধার করে স্থলভাগে পৌছিয়ে দিলেন, তখন তোমরা আবার বিদ্রোহের ভুমিকায় অবতরণ করলে; মানুষ বাস্তবিকই বড় অকৃতজ্ঞ। তোমরা কি এসম্পর্কে নিঃশঙ্ক হয়ে গেলে যে, আল্লাহ্ তোমাদেরকে মাটির মধ্যে প্রোথিত করতে পারেন কিংবা তোমাদের ওপর বায়ুর ঝড় এমনি প্রবাহিত করতে পারেন এবং তোমরা নিজেদের কোন সাহায্যকারী পাবেনা? তোমরা কি এব্যাপারে নিঃশঙ্ক হয়ে গেলে যে, আল্লাহ তোমাদেরকে পূণর্বার সমুদ্রে নিয়ে যেতে পারেন এবং তোমাদের ওপর বায়ুর এমন প্রচণ্ড ঝটিকা প্রবাহিত করতে পারেন, যা তোমাদের নাফরমানীর ফলে তোমাদেরকে নিমজ্জিত করে দিতে পারে, অনন্তর তোমরা আমাদের পশ্চাদপবন করার কোনই সাহায্যকারী পাবেনা”-( সূরা বনি ইসরাঈলঃ৬৭-৬৯)
এ আয়াত সমূহে মানুষের গর্ব ও অহংকারকে একেবারে চূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এতে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে যে, তোমার প্রকৃত তত্বের প্রতি একটু লক্ষ্য করে দেখ। এক বিন্দু নাপাক ও তুচ্ছ পানি মাতৃগর্ভে গিয়ে বিভিন্ন রুপ নাপাকীর দ্বারা বর্ধিত হয়ে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। আল্লাহ ইচ্ছা করলে সেই মাংসপিণ্ডে প্রাণই না দিতে পারেন এবং তা এমন অসম্পূর্ণ অবস্থায়ই বেরিয়ে যেতে পারে। আল্লাহ তাঁর আপন ক্ষমতা বলে সেই মাংস-পিণ্ডে প্রাণসঞ্চার করেন, তার ভেতর অনুভূতি ও চেতনার সৃষ্টি করেন এবং মানুষের পক্ষে দুনিয়ার জীবনে প্রয়োজনীয় শক্তি ও হাতিয়ার দ্বারা সজ্জিত করেন। এভাবে তুমি দুনিয়ায় আগমন করো। কিন্তু তোমার প্রাথমিক অবস্থা হচ্ছে এইযে, তুমি একটি অসহায় শিশুতে পরিণত হয়ে আসো, তোমার ভেতর নিজের কোন প্রয়োজনই পূরণ করার ক্ষমতা থাকেনা। আল্লাহই তাঁর নিজস্ব কুদরত বলে এমন ব্যবস্থা করে দেন যে, তোমার লালন-পালন হতে থাকে, তুমি বড়ো হতে থাকো; যৌবনে পদার্পণ করো; শক্তিমান ও ক্ষমতাশালী হও; পুনরায় তোমার শক্তি-সামর্থ্যের অবনতি শুরু হয়, তুমি যৌবন থেকে বার্ধক্যে পদার্পণ করো; এমনকি একসময় তোমার ওপর শৈশবকালের মতোই অসহায় অবস্থা চেপে বসে। তোমার চেতনা শক্তি তোমায় ত্যাগ করে যায়; তোমার শক্তি-সামর্থ্য দুর্বল হয়ে যায়, তোমার জ্ঞান-বুদ্বি লুপ্ত হয়ে যায়; অবশেষে তোমার জীবন প্রদীপ চিরকালের মতো নিভে যায়। ধন-দৌলত, সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সব কিছু ছেড়ে তোমাকে কবর গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। এই সংক্ষিপ্ত জীবনকালে তুমি নিজেকে নিজে এক মুহূর্তের জন্যেও জিন্দা রাখতে সমর্থ নও। বরং তোমার চেয়ে উচ্চতর একশক্তি তোমাকে জীবিত রাখেন এবং যখন ইচ্ছা করেন তোমাকে দুনিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। পরন্তু যতদিন তুমি জিন্দা থাকো, প্রাকৃতিক বিধানকেই তোমার আকড়ে থাকতে হয়। এই হাওয়া, এইপানি, এইআলো, এইউত্তাপ, এইজমিরফসল, এই প্রাকৃতিক সাজ-সরঞ্জাম-যার ওপর তোমার জীবন নির্ভরশীল এর কোনটিই তোমার আওতাধীন নয়। না তুমি এগুলোকে পায়দা করো, আর না এরা তোমার হুকুমের অনুসারী। এই বস্তুগুলোই যখন তোমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তখন তুমি এদের মোকাবিলায় অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়ো। এক বায়ুর ঝঞ্ঝা তোমাদের জনপদ সমুহকে মিসমার করে দেয়। এক বন্যা-তুফান তোমাদেরকে ডুবিয়ে ফেলে। এক ভূমিকম্প তোমাদেরকে ধুলিস্মাৎ করে দেয়। তুমি যতোই অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হও, আপন জ্ঞান-বুদ্ধি (যা তোমার নিজের সৃষ্ট নয়) দ্বারা যতোই উপায় উদ্ভাবন করো, নিজের বিবেকের (যা তোমার অর্জিত নয়) দ্বারা যতোই সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করো না কেন, প্রাকৃতিক শক্তির সামনে এসবই অকেজো হয়ে যায়। অথচ এহেন শক্তি নিয়ে তুমি বড়াই করো, আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে ওঠো, কাউকে পরোয়া পর্যন্ত করো না, ফেরাউনী ও নমরুদীপনার পরাকাষ্ঠা দেখাও, নির্মম অত্যাচারী, সীমাহীন জালেম কিংবা চরম অহংকারী হও, আল্লাহর সামনে বিদ্রোহ প্রদর্শন করো, আল্লাহর বান্দাদের উপাস্য (মাবুদ) হয়ে বসো এবং আল্লাহর দুনিয়ায় অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করো।
বিশ্ব-প্রকৃতিতে মানুষের মর্যাদা:
এতো গেলো অহংকার নিরসন করার ব্যাপার। অন্যদিকে ইসলাম মানুষকে বলে দিয়েছে যে, সে নিজেকে নিজে যতোটা তুচ্ছ মনে করে নিয়েছে, ততোটা তুচ্ছ সে নয়। সেবলেঃ ( **************)
“আমরা বনী আদমকে ইজ্জত দান করেছি এবং স্থল ও জল পথে যানবাহনের ব্যবস্থা করেছি এবং বহু জিনিসের ওপর যা আমরা পয়দা করেছি তাকে এরূপ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” – ( সূরাবনীইসরাঈলঃ৭০ )
(****************)
“(হেমানুষ!) তুমি কি লক্ষ্য করোনা যে, দুনিয়ায় যা কিছু রয়েছে, আল্লাহ তার সবই তোমাদের জন্যে অধীন করে দিয়েছেন?” –(সূরাআলহাজ্জঃ৬৫)
( ****************)
(***********)
“এবং জানোয়ার পয়দা করেছেন, যার ভেতর তোমাদের জন্যে শীত থেকে বাঁচার সামান এবং লাভজনক বস্তু নিহিত রয়েছে এবং তার ভেতর থেকে কোন কোনটি তোমরা আহার করে থাকো। ঐগুলোর ভেতর তোমাদের জন্যে নিহিত রয়েছে একপ্রকার সৌন্দর্য, যখন প্রত্যুষে তোমরা ঐগুলো নিয়ে যাও এবং সন্ধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে আসো তারা তোমাদের বোঝা বহন করে এমন স্থানে নিয়ে যায়, যেখানে তোমরা প্রাণান্তকর কষ্ট ছাড়া পৌছতে পারোনা তোমাদের রব বড় মেহেরবান ও দয়া প্রদর্শনকারী তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধা তোমাদের সওয়ারির জন্য এবং জীবনের সৌন্দর্য সামগ্রী আল্লাহ আরো অনেক জিনিস পয়দা করে থাকেন যা তোমাদের জানা পর্যন্ত নেই তিনিই আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন তার কিছু তোমাদের পান করার জন্যে, আর কিছু গাছ-গাছড়ার প্রতিপালনের কাজে লাগে, যা দ্বারা তোমরা আপন জানোয়াররে আহার্য লাভ করে থাকো সি পানি থেকে আল্লাহ তোমাদের জন্যে ফস্ল, জয়তুন, খেজুর, আঙ্গুর এবং সকল ফল উৎপাদন করেন এ জিনিসগুলোতে তাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে যারা ভেবে-চিন্তে কাজ করে। তিনিই তোমাদের জন্যে রাত দিন এবং চন্দ্র-সূর্যকে অধীন করে দিয়েছেন। এবং নক্ষত্ররাজিও সেই আল্লাহর হুকুমের ফলে অধীন হয়ে রয়েছে। এর ভেতরে তাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে, যারা বিবেক-বুদ্বির সাহায্য কাজ করে। আরো বহু রঙ্গের জিনিস তিনি তোমাদের জন্যে দুনিয়ায় পয়দা করেছেন, তাতে শিক্ষাগ্রহণকারীদের জন্যে বড়ো নিদর্শন রয়েছে। এবং সেই আল্লাহই সমুদ্রকে অধীন করে দিয়েছন, যেনো তা থেকে তাজা গোশত (মাছ) বের করে খেতে পারো এবং সৌন্দর্যের উপকরণ ( মুক্তা ইত্যাদি ) বের করতে পারো, যা তোমরা পরিধান করো। আর তোমরা দেখে থাকো যে, নৌকা ও জাহাজসমূহ পানি ভেদ করে সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে ভেসে চলে যায়। তাই সমুদ্রকে এ জন্যে অধীন করা হয়েছে যেনো আল্লাহর ফযল তালাশ করতে পারো (অর্থাৎ ব্যবসায় করতে পারো) সম্ভবত তোমরা শোকর আদায় করবে তিনিই দুনিয়ায় পাহাড় লাগিয়ে দিয়েছেন, যেনো পৃথিবী তোমাদের নিয়ে ঝুঁকে না পরে এবং দরিয়া ও রাস্তা বানিয়ে দিয়েছেন, যাতে তোমরা গন্তব্য পথের সন্ধান পেতে পারো; এরূপ আরো বহুবিধ আলামত বানিয়ে দিয়েছেন; এমনকি, তার তারকারাজি দ্বারা লোকেরা রাস্তা চিনে থাকেআর যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামত হিসেব করো, তাহলে তা বেশুমার দেখতে পাবে”
-( সূরা আন নাহলঃ ৫-১৮ )
উপরোক্ত আয়াতসমূহে মানুষকে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ায় যতো জিনিস রয়েছে, তার সবই তোমাদের খেদমত ও ফায়দার জন্যে অধীন করে দেয়া হয়েছে এবং আসমানের জিনিস সম্পর্কেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য এই গাছ-পালা, এই দরিয়া, এই সমুদ্র, এই পাহাড়, এই জীব-জন্তু, এই রাত-দিন, এই আলো-অন্ধকার, এই চন্দ্র-সূর্য, এই তারকারাজি মোটকথা যা কিছু তুমি দেখতে পাচ্ছো এর সবই তোমার খাদেম, তোমার ফায়দার জন্যে নিয়োজিত এবং তোমার জন্যে কার্যোপযোগী করে বানানো হয়েছে তুমি এগুলোর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছো; তোমাকে এদের চেয়ে বেশী ইজ্জত দান করা হয়েছে, তোমাকে এদের সেবার যোগ্য রুপে তৈরি করা হয়েছে তাহলে কেন তুমি তোমার ঐ খাদেমদের সামনে মাথা নত করো? কেন ওদেরকে তোমার প্রয়োজন পূরণকারী মনে করো? কেন ওদের সামনে যাঞ্চার হাত প্রসারিত করো? কেন ওদের কাছে সাহায্য কামনা করো? কেন ওদেরকে ভয় করো ও শঙ্কিত হও? কেন ওদের শ্রেস্টত্ব ও মহিমা কীর্তন করো? এভাবে তো তুমি নিজেই নিজেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করছো নিজের মর্যাদা নিজেই ক্ষুণ্ণ করছো; নিজেকেই নিজের খাদেমের খাদেম ও গোলামের গোলামে পরিণত করছো!
মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি
এ থেকে জানা গেল যে, মানুষ না এতোটা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন যতোটা সে অহমিকা বশত নিজেকে নিজে মনে করে, আর না এতোটা তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট যতটা সে নিজেকে বানিয়ে নিয়েছে এখন প্রশ্ন ওঠে: তাহলে দুনিয়ায় মানুষের সঠিক মর্যাদা কি? এর জবাবে ইসলাম বলে: (******************)
“ আর যখন তোমার পরোয়ারদিগার ফেরেশতাদেরকে বললেন যে, আমি দুনিয়ায় এক খলীফা ( প্রতিনিধি ) পাঠাতে চাই, তখন তারা আরজ করলো: তুমি কি দুনিয়ায় এমন প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাও যে সেখানে গিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি এবং খুন-খারাবী করবে? অথচ আমরা তোমার মহত্ত্ব ঘোষণা করি এবং তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করি আল্লাহ বললেন: আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না আর তিনি আদমকে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দিলেন অতপর তাকে ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন এবং বললেনঃ তোমরা যদি সত্যবাদী হও তো ঐ জিনিসগুলোর নাম বলে দাও তারা বললঃ পবিত্র তোমার সত্তা! তুমি যা কিছু আমাদেরকে শিখিয়েছো তা ছাড়া আর কিছুই জানি না তুমিই বিজ্ঞ এবং সর্বজ্ঞ আল্লাহ বললেনঃ হে আদম, তুমি ফেরেশতাদেরকে ঐ জিনিসগুলোর নাম বলে দাও সুতরাং আদম যখন তাদেরকে ঐ বস্তুগুলোর নাম বলে দিলেন, তখন আল্লাহ বললেন: আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আসমান ও জমিনের সমস্ত গোপন কথাই আমি জানি এবং যা কিছু তোমরা প্রকাশ করো আর লুকিয়ে রাখো তার সবকিছুরই আমি খবর রাখি আর যখন আমি ফেরেশতাদেরকে আদেশ করলাম, আদমকে সেজদা করো, তখন তারা সবাই সেজদা করল একমাত্র ইবলিস ছাড়া, সে অস্বীকার করলো, অহংকার প্রকাশ করলো এবং নাফরমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। আর আমরা আদমকে বললামঃ হে আদম, তুমি এবং তোমার স্ত্রী উভয়ে জান্নাতে থাকো এবং এখানে যা পাও তৃপ্তি সহকারে খাও কিন্তু ঐ গাছটির কাছেও যেও না, তাহলে তুমি জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু শয়তান তাদেরকে জান্নাত থেকে পদস্থলিত করলো এবং যে সুখ-সম্পদের মধ্যে ছিল,তা থেকে বের করে দিলো”। (সূরা আল বাকারাঃ ৩০-৩৬)
“…………………আরবী লেখা……………”
“আর যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেনঃ আমি বিবর্ণ শুষ্ক কর্দম থেকে এক মানুষ বানাতে চাই, অতপর আমি যখন তার সুষ্ঠ অবয়ব দান করবো এবং তার ভেতর আপন রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দেবো, তখন তোমরা তার জন্য সেজদায় লুটিয়ে পড়। বস্তুত তামাম ফেরেশতাই সেজদা করলো, শুধু ইবলিশ ছাড়া; সে সেজদাকারিদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানালো। আল্লাহ বললেনঃ হে ইবলিশ! তোর কি হল যে, তুই সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করলি? ইবলিশ বললঃ আমি এমন নই যে, সে মানুষকে সেজদা করবো,যাকে তুমি কালো বিবর্ণ শুষ্ক কর্দম থেকে সৃষ্টি করেছ। আল্লাহ বললেনঃ তুই এখান থেকে বেরিয়ে যা, তুই বিতাড়িত। প্রতিফল দিবস পর্যন্ত তোর উপর অভিসম্পাত”। (সূরা আল হিজরঃ ২৮-৩৫)
এ বিষয়টিকে কোরআন মজিদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে। এর সংক্ষিপ্ত সার হল এইঃ আল্লাহ মানুষকে দুনিয়ায় তাঁর প্রতিনিধি (নায়েব) হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, তাকে ফেরেশতাদের চেয়ে বেশি জ্ঞান দিয়েছেন, তার জ্ঞানকে ফেরেশতাদের তাসবীহ পাঠ ও পবিত্রতা বর্ণনার উপরে স্থান দিয়েছেন, ফেরেশতাদের তাঁর সেই প্রতিনিধিকে কে সেজদা করার আদেশ করেছেন, ফেরশতাগণ তাকে সেজদা করলো এবং এভাবে সমস্ত ফেরেশতা তাঁর সামনে নতমস্তক হোল; কিন্তু ইবলিশ এতে অস্বীকৃতি জানালো এবং এভাবে শয়তানী শক্তি তাঁর সামনে মাথা নত করলো না। অবশ্য তখনও সে ছিল মাটির তুচ্ছ এক পুতুল মাত্র; কিন্তু আল্লাহ তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়ে এবং জ্ঞান দান করে তাকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের যোগ্য করে দিলেন। ফেরেশতারা তার এই শ্রেষ্ঠত্ব কে স্বীকার করে নিল এবং তার সামনে নতমস্তক হোল। কিন্তু শয়তান তাকে স্বীকার করলো না। এই অপরাধে শয়তানের উপর লা’নত বর্ষিত হোল। কিন্তু সে মানুষকে কুমন্ত্রনা দেয়ার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত সুযোগ চেয়ে নিলো। তাই মানুষকে সে কুমন্ত্রনা দিলো, জান্নাত থেকে বহিষ্কার করালো আর তখন থেকে মানুষ ও শয়তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হোল। আল্লাহ মানুষকে বললেনঃ আমি তোমাকে যে হেদায়েত পাঠাবো তা মেনে চললে তুমি জান্নাতে যেতে পারবে, আর তোমার আদি দুশমন শয়তানের হুকুম তামিল করলে তোমার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।
প্রতিনিধি পদের গুরুত্বঃ
এই আলোচনা থেকে নিম্নরূপ বিষয় গুলি জানা গেলঃ
এই দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা হচ্ছে এই যে, সে আল্লাহর খলীফা। খলীফা বলা হয় নায়েব অথবা প্রতিনিধিকে। প্রতিনিধির কাজ হলোঃ যার সে প্রতিনিধি, তাঁর ই আনুগত্য করে চলবে। সে আর না কারো আনুগত্য করতে পারে, আর না আপন মনিবের প্রজা এবং তার চাকর, খাদেম ও গোলামকে নিজেরই প্রজা,নিজেরই চাকর, খাদেম ও গোলামে পরিণত করতে পারে। বরং এরূপ করলে সে বিদ্রোহী বলে অভিযুক্ত হবে এবং উভয় ক্ষেত্রেই শাস্তি লাভ করবে। সে যেখানে প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়েছে,সে সেখানে আপন মনিবের মাল-মাত্তা ব্যবহার করতে পারে, তাঁর প্রজাদের উপর শাষন চালাতে পারে, তাদের কাছ থেকে খেদমত নিতে পারে, তাদের তত্ত্বাবধান করতে পারে; কিন্তু এ হিসেবে নয় যে, সে নিজেই মনিব অথবা এ হিসেবেও নয় যে, উক্ত মনিব ছাড়া সে অন্য কারো অধিনস্থ বরং এই হিসেবে যে, সে আপন মনিবের প্রতিনিধি এবং যত জিনিস তার কর্তৃত্বাধীন সেগুলোর উপর সে মনিবের তরফ থেকে নিযুক্ত আমানতদার। এ কারনে সে সাচ্চা, মনঃপুত এবং পুরষ্কার লাভের যোগ্য প্রতিনিধি ঠিক তখনই হতে পারে, যখন সে আপন মনিবের আমানতের খেয়ানত না করবে,তাঁর দেয়া হেদায়েত অনুসরন করে চলবে এবং তাঁর বিধান লংঘন না করবে- তাঁর ধন সম্পদ, তাঁর প্রজা, তাঁর চাকর, তাঁর খাদেম এবং তাঁর গোলামদের উপর শাসন চালাতে তাদের কাছ থেকে খেদমত নিতে, এবং তাদের সাথে ব্যবহার ও তাদের তত্ত্বাবধান করতে তাঁরই রচিত আইন কানুন মেনে চলবে। সে যদি এরূপ না করে তবে সে প্রতিনিধি নয় –বিদ্রোহী হবে,মনঃপুত নয়-মরদুদ হবে, পুরষ্কার লাভের যোগ্য নয়-শাস্তির উপযোগী হবে। আল্লাহ বলেনঃ
“…………………আরবী লেখা……………”
“যারা আমার দেয়া হেদায়েত অনুসরন করবে,তাদের জন্য কোনরূপ শাস্তির ভয় বা কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আর যারা নাফরমানী করবে এবং আমার বাণী ও নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চাইবে,তাদের জন্য রয়েছে দোযখের অগ্নি;সেখানে তারা চিরকাল থাকবে”।(সূরা আল বাকারাঃ ৩৮-৩৯)
প্রতিনিধি বা আমানতদার কখনো এরূপ স্বাধীন হয়না যে,সে নিজের মর্জী মোতাবেক যা খুশী তাই করতে পারে; আপন মনিবের ধন-দৌলত ও তাঁর প্রজাদের ব্যাপারে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে এবং এসব ব্যাপারে তাকে কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করার থাকবে না। বরং তাকে আপন মনিবের সামনে জবাবদিহি করতে হয়,প্রতিটি কড়া –ক্রান্তির হিসেব তাকে দিতে হয়,তার মনিব তার প্রতিটি কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, এবং তাঁর আমানত, তাঁর মাল-মাত্তা এবং তাঁর প্রজাদের সে যা কিছু করেছে তার জিম্মাদারি তার উপর ন্যস্ত করে তাকে শাস্তি কিংবা পুরস্কার দান করতে পারে।
প্রতিনিধির সর্বপ্রথম কর্তব্য হলঃ সে যার প্রতিনিধি তাঁর আজ্ঞানুবর্তিতা, তাঁর শাসন ও তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে মেনে নেয়া। সে যদি এরূপ করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে না সে নিজের প্রতিনিধি পদের গুরুত্ব কে বুঝতে পারবে, আর না তার আমানতদারির পদে অভিষিক্ত হওয়া সম্পর্কে তার মনে কোন সুষ্ঠু ধারনা জন্মাবে; না তার জিম্মাদারি ও জবাবদিহি সম্পর্কে কোন অনুভূতি জাগবে; আর না তার উপর ন্যস্ত আমানত সম্পর্কে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করার মতন যোগ্যতা লাভ করবে। প্রথমত এই আমানত ও প্রতিনিধিত্বের ধারনা নিয়ে মানুষ যে কর্মনীতি অবলম্বন করবে, এছাড়া অন্য কোন ধারনা নিয়েও ঠিক তাই অনুসরন করবে, এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর যদি ধরেও নেয়া যায় যে অসম্ভবটিই তার পক্ষে সম্ভব তবুও তার কোন দাম নেই। কারন মনিবের আজ্ঞানুবর্তিতা অস্বীকার করে পূর্বেই সে বিদ্রোহী হয়েছে। এখন যদি সে নিজের ইচ্ছে-প্রবৃত্তি কিংবা অন্য কারো আনুগত্য করতে গিয়ে সৎকাজ করেও তবে যার আনুগত্য করেছে, তার কছেই তার পুরস্কার চাওয়া উচিৎ। তার মনিবের কাছে সেই সৎকাজ সম্পুর্ন অর্থহীন।
মানুষ তার মুল সত্তার দিক দিয়ে তুচ্ছ সৃষ্টি মাত্র। কিন্তু সে যা কিছু ইজ্জত লাভ করেছে, তা শুধু তার ভেতরে ফুঁকে দেওয়া রূহ ও দুনিয়ায় তাকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব দান করার কারণেই। এখন শয়তানের আনুগত্য করে তার রূহ কে কলুষিত না করা এবং নিজেকে প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করে বিদ্রোহের পর্যায়ে অবনমিত না করার ওপরই তার এই ইজ্জতের হেফাজত নির্ভরশীল। এ দ্বায়িত্বে অবহেলা করলে তাকে সেই তুচ্ছ সৃষ্টিই থেকে যেতে হবে।
মালাকূতি শক্তি (অদৃশ্য জগতের শক্তি) মানুষের আল্লাহর প্রতিনিধিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবেই তাঁর সামনে মাথা নত করেছে, কিন্তু শয়তানি শক্তি তাঁর প্রতিনিধিত্বকে স্বীকার করে না, বরং তাকে নিজের অনুগত বানাতে চায়। মানুষ যদি এই দুনিয়ায় প্রতিনিধিত্বের কর্তব্য পালন করে এবং আল্লাহরই প্রদর্শিত পথে চলে তাহলে মালাকূতি শক্তি তার সহায়তা করবে। তার জন্য ফেরেশতাদের সেনাবাহিনী অবতরন করবে। মালাকূত জগত কখনো তার প্রতি বিমুখ হবে না। এই সকল শক্তির সাহায্যে সে শয়তান ও তার অনুচরদের পরাজিত করে ফেলবে। কিন্তু সে যদি প্রতিনিধিত্বের হক আদায় করতে কুণ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথে না চলে, তাহলে মালাকূতি শক্তি তার সংশ্রব ত্যাগ করবে; কেননা এর ফলে সে নিজেই নিজের প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হবে। আর যখন তার সহায়তা করার মতন আর কোন শক্তি বর্তমান থাকবেনা এবং সে নিছক মাটির একটি পুতুলে পরিনত হবে, তখন শয়তানি শক্তি তার উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। অতপর শয়তান এবং তার অনুচরগণই হবে তার একমাত্র সহায়ক ও সাহায্যকারী, তাদের বিধি –বিধানেরই করবে সে আনুগত্য এবং তাদের মতোই তার পরিণাম।
আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার কারনে মানুষের মর্যাদা হচ্ছে দুনিয়ার সকল জিনিসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত। দুনিয়ার প্রতিটি জিনিসই তার অধীন, তার ব্যবহারের জন্য নিয়োজিত এবং আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় তা থেকে সে খেদমত গ্রহনের অধিকারী। এই সকল অধীনস্থ জিনিসের সামনে নত হওয়া তার পক্ষে নিতান্তই অপমানকর। এদের সামনে নত হলে সে নিজেই নিজের ওপর যুলুম করে এবং আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হবে। কিন্তু এমন এক সত্ত্বাও রয়েছে যার সামনে নত হওয়া, যার আনুগত্য করা তার অপরিহার্য কর্তব্য (ফরয) এবং যাকে সেজদা করার ভিতর নিহিত রয়েছে তার জন্য ইজ্জত-সন্মান। সেই সত্ত্বাটি কে?- আল্লাহ তার মনিব, যিনি তাঁর জন্য মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি মনোনীত করেছেন।
মানব জাতির কোন বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণী আল্লাহর প্রতিনিধি নয় বরং গোটা মানবজাতিই প্রতিনিধিত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত আর প্রতিনিধি বা খলীফা হিসেবে প্রতিটি মানুষই অন্য মানুষের সমান। এ জন্যই না কোন মানুষের অপর কোন মানুষের সামনে নত হওয়া উচিত। আর না কেউ নিজের সামনে অন্য কোন মানুষকে অবনত করানোর অধিকারী। একজন মানুষ শুধু অন্য একজন মানুষের কাছে মনিবের হুকুম ও তাঁর হেদায়েতের আনুগত্য করারই দাবী জানাতে পারে। এ দিক দিয়ে অনুগত ব্যক্তি হবে ‘আমের’(আদেশকারী) আর অননুগত ব্যক্তি হবে ‘মামুর’(আদিষ্ট)। কেননা যে ব্যক্তি প্রতিনিধিত্বের হক আদায় করলো সে হক না আদায়কারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের মানে এই নয় যে সে নিজেই তার মনিব।
আমানত ও প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে লাভ করেছে। এই জন্য প্রতিটি ব্যক্তি নিজ নিজ স্থানে এই পদ মর্যাদার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। না একজনের উপর অন্যান্যদের কৃতকর্মের জবাবদিহি ন্যস্ত হবে, আর না একজন অন্যজনের কৃত কর্ম থেকে ফায়দা হাসিল করতে পারবে। অনুরুপভাবে না কেউ এই জিম্মাদারী থেকে কাউকে নিষ্কৃতি দিতে পারবে, আর না কারোর দুষ্কৃতির বোঝা অন্যের ঘাড়ে চাপানো হবে।
মানুষ যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ায় থাকে আর যতদিন বাকি থাকে মাটির পুতুল(মানব দেহ) এবং আল্লাহর ফুঁকে দেয়া রূহের সম্পর্ক ততদিনই সে থাকে প্রতিনিধি। এই সম্পর্ক ছিন্ন হবার সাথে সাথেই সে দুনিয়ার খেলাফতের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। তার এই প্রতিনিধিত্বকালের কীর্তিকলাপের যাচাই – পর্যালোচনা হওয়া উচিত, তার উপর ন্যস্ত আমানতের হিসেব – নিকেশ হওয়া উচিত, প্রতিনিধি হিসেবে তার উপর অর্পিত দ্বায়িত্ব সে কিভাবে পালন করেছে, তার তদন্ত হওয়া উচিত। সে যদি খেয়ানত, বিশ্বাস ভঙ্গ, অবাধ্যতা, বিদ্রোহ এবং দ্বায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে থাকে তবে তার সাজা পাওয়া উচিত। পক্ষান্তরে সে যদি ঈমানদারি,বিশ্বস্ততা, দ্বায়িত্বজ্ঞান ও আনুগত্য পরায়ণতার সাথে কর্তব্য পালন করে থাকে তাহলে তার পুরস্কারও তার পাওয়া দরকার।
জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারনা
উপরোক্ত ‘খেলাফত’ ও ‘প্রতিনিধিত্ব’ শব্দ দুটো থেকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রতিনিধির প্রকৃত কর্তব্য এই যে,আপন প্রভুর মাল-মাত্তায় তার প্রতিনিধিত্বের ‘হক’ পুরোপুরি আদায় করার চেষ্টা করবে এবং প্রকৃত মালিক যেভাবে তার ভোগ-ব্যবহার করে থাকে,যতদূর সম্ভব সে-ও সেভাবে ভোগ-ব্যবহার করবে। বাদশাহ যদি তার প্রজাদের উপর কাউকে প্রতিনিধি(নায়েব) নিযুক্ত করেন, তবে তার পক্ষে সেই প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা ব্যবহারের প্রকৃষ্ট পন্থা হবে এই যে, প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণ, স্নেহ-মমতা, দয়াশীলতা, নিরাপত্তা, সুবিচার ও ক্ষেত্র বিশেষে কড়াকড়ি করার ব্যাপারে খোদ বাদশাহ যেরূপ ভুমিকা গ্রহণ করে থাকেন, সে-ও ঠিক সেরূপ ভূমিকাই গ্রহণ করবে এবং বাদশাহের মাল-মাত্তা ও ধন-সম্পদ তারই মতো বুদ্ধিমত্তা (হিকমত), প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও সতর্কতার সাথে ভোগ-ব্যবহার করবে।
কাজেই মানুষকে আল্লাহর খলিফা-প্রতিনিধি আখ্যা দেয়ার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, আল্লাহর সৃষ্টির সাথে আচরণের বেলায় মানুষের অনুসৃত নীতি যদি স্বয়ং আল্লাহর মতই হয়, কেবল তখনই সে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব ও খেলাফতের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারবে। অর্থাৎ যেরূপ প্রতিপালনসুলভ মহত্বের সঙ্গে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির রক্ষনাবেক্ষণ ও প্রতিপালন করে থাকেন, সেরূপ মহত্ব নিয়েই মানুষ তার সীমাবদ্ধ কর্মক্ষেত্রে, আল্লাহ কর্তৃক তার আয়ত্ত্বাধীন করে দেয়া বস্তুসমূয়ের সংরক্ষণ ও লালন-পালন করবে। অনুরূপভাবে যে ধরনের রহমানী মহত্বের সঙ্গে আল্লাহ তার ধন-সম্পদ ব্যবহার করেন, যেরূপ সুবিচার ও নিরপেক্ষতার সাথে তিনি তার সৃষ্টির ভেতর শৃঙ্খলা বজায় রাখেন এবং যে ধরনের দয়া ও অনুকম্পার সঙ্গে তিনি তার ‘জবর’ ও ‘কাহর’ (অর্থাৎ দয়াশুন্যতা সূচক) এর গুনাবলী প্রকাশ করেন, আল্লাহর যে সৃষ্টির ওপর মানুষকে কর্তৃত্ব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং যাকে করা হয়েছে তার অধীনস্থতার সাথে এইমানুষ অপেক্ষাকৃত কম মাত্রায় হলেও ঠিক তেমনি ধরনেরই ব্যবহার করবে।
****** এর প্রজ্ঞাময় বাক্যটিতে এ তাৎপর্যই বিধৃত হয়েছে। কিন্তু মানুষ যখন এ সত্যটি ভালোমত উপলব্ধি করতে পারবে যে, এ দুনিয়ায় সে কোন স্বাধীন শাসক নয়, বরং প্রকৃত শাসকের সে প্রতিনিধি মাত্র, কেবল তখনই সে এ উন্নত নৈতিক মর্যাদা লাভ করতে পারে। এ হচ্ছে প্রতিনিধি পদের প্রকৃত দায়িত্ব। এটাই দুনিয়ার প্রতিটি বস্তু, এমনকি তার দেহ এবং দৈহিক ও মানসিক শক্তির সঙ্গে তার সম্পর্কের স্বরূপ ও পরিধি সুনির্দিষ্ট করে দেয়।
প্রতিনিধিত্বের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে এপর্যন্ত যা বলা হলো কুরআন মজিদে তার প্রতিটি কথারই বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। এ থেকে দুনিয়া এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিটি দিকই উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মানুষ প্রতিনিধি, মালিক নয়
কুরআনে বলা হয়েছে:
***********
“সেই আল্লাহই তোমাদেরকে দুনিয়ায় প্রতিনিধি বানিয়েছেন এবং তোমাদের ভেতর কাউকে কারুর চেয়ে উঁচু মর্যাদা দিয়েছেন, যেন তোমাদেরকে তিনি যা কিছু দান করেছেন, তার ভেতর তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন।” – (সুরাআলআন’আম: ১৬৫)
قَالُوا أُوذِينَا مِن قَبْلِ أَن تَأْتِيَنَا وَمِن بَعْدِ مَا جِئْتَنَا ۚ قَالَ عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يُهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ
“(মুসা বনী ইসরাঈলকে) বললেন: খুব শিগগীরই আল্লাহ তোমাদের দুশমনকে ধ্বংস এবং দুনিয়ায় তোমাদেরকে খলিফা বানবেন, যাতে করে তোমরা কিরূপ কাজ করো তা তিনি দেখতে পারেন।” – (সুরাআলআরাফ: ১২৯)
***********
“হে দাউদ: আমরা তোমাকে দুনিয়ায় প্রতিনিধি বানিয়েছি, সুতরাং তুমি লোকদের ভেতর সত্য সহকারে শাসন করো এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করোনা; কারন এ তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে।যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্যে এই কারণে কঠোর শাস্তি রয়েছে যে, তারা হিসেবের দিনকে ভুলে গিয়েছে।” – (সুরা সাদ: ২৬)
*******
“আল্লাহ কি সকল শাসকদের শাসক নন?” – (সুরাআততীন: ৮)
********
“হুকুমত আল্লাহ ছাড়া আর কারুর নয়.” – (সুরাআলআন’আম: ৫৭)
*********
“বলো, হে আল্লাহ! সমস্ত রাজ্যের মালিক! তুমি চাও রাজ্য দান করো, আর যার কাছ থেকে ইচ্ছে করো রাজ্য ছিনিয়ে নাও. যাকে চাও সম্মান দান করো, আবার যাকে চাও অপমানিত করো.”
**********
“তোমাদের প্রতি তোমাদের আল্লাহর তরফ থেকে যা কিছু নাযিল হয়েছে শুধু তারই আনুগত্য করো এবং তিনি ছাড়া অপর কোন পৃষ্ঠপোষকদের আনুগত্য করোনা.” – (সুরাআল-আরাফ: ৩)
**********
“বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদাত, আমার জীবনও আমার মৃত্যু সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্যে।” – (সুরা আল আন’আম: ১৬২)
এই আয়াত সমূহ থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে যে, দুনিয়ায় যতো জিনিসই মানুষের ভোগ-ব্যবহারও কর্তৃত্বাধীন রয়েছে, তার কোনটারই-এমনকি তার নিজ স্বত্তার ও মালিকানা তার নয়। এগুলোর প্রকৃত মালিক, শাসক ও নিয়ামক হচ্ছেন আল্লাহ। এই জিনিসগুলোকে প্রকৃত মালিকের ন্যায় আপন খেয়াল-খুশীমত ভোগ ব্যবহার করার কোন অধিকার মানুষের নেই। দুনিয়ায় তার মর্যাদা হচ্ছে নিছক প্রতিনিধির এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথেচলা এবং তাঁর প্রদর্শিত পন্থায় ঐ জিনিসগুলোর ভোগ-ব্যবহার করা পর্যন্তই তার ইখতিয়ার সীমাবদ্ধ। এ নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে আপন প্রবৃত্তির আনুগত্য করা কিংবা প্রকৃত শাসক ছাড়া অন্যকোন শাসকের নির্দেশ মেনে চলা বিদ্রোহ এবং ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
দুনিয়ার জীবনে সাফল্যের প্রাথমিক শর্ত:
কুরআনে বলা হয়েছে:
*************
“যারা বাতিলের প্রতি ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে, প্রকৃতপক্ষে তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” – (সুরা আল আনকাবুত: ৫২)
********
“তোমাদের ভেতর থেকে যে কেউ নিজের দ্বীন (অর্থাৎআল্লাহরআনুগত্য) থেকে ফিরে যায় এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, দুনিয়া ও আখেরাতে এমন লোকদের আমল বরবাদ হয়ে যায়.”
*****
“যে কেউ ঈমান আনতে অস্বীকার করে তার যাবতীয় আমল নষ্ট হয়ে যায় এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে.” – (সুরা মায়েদা: ৫)
এ আয়াত সমূহ থেকে জানা গেল যে, আপন মনিবের শাসন কর্তৃত্ব স্বীকার করা এবং নিজেকে তার প্রতিনিধি ও আমানতদার মনে করে সকল কাজ সম্পাদন করার ওপরই দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের সাফল্য নির্ভর করে।এ স্বীকৃতি ছাড়া আল্লাহর ধন-সম্পদ ও দ্রব্য-সামগ্রী সে যতটুকু ভোগ-ব্যবহার করবে, তা শুধু বিদ্রোহাত্মক ভোগ-ব্যাবহারই হবে। আর এটা সাধারণ জ্ঞানের কথা যে, বিদ্রোহী যদি কোন দেশ দখল করে দেশ সেবার উত্তম নজীর ও পেশ করে, তবু দেশের আসল বাদশাহ তার এই ‘সত্কাজের’ আদৌ স্বীকৃতি দেবেনা। বাদশাহর কাছে বিদ্রোহী বিদ্রোহীই। তা ব্যক্তি চরিত্র ভালো হোক আর মন্দ, বিদ্রোহ করে সে দেশকে সুষ্ঠুভাবে চালিত করুক আর নাই করুক তাতে কিছু আসে যায়না।
দুনিয়া ভোগ-ব্যবহারের জন্যই
কুরআনে বলা হয়েছে:
“হেমানুষ! দুনিয়ায় যেসব হালাল ও পবিত্র দ্রব্যাদি রয়েছে, তা থেকে খাও এবং কোন ব্যাপারে শয়তানের আনুগত্য করোনা; কারন সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। সে তোমাদেরকে পাপাচার, নির্লজ্জতা এবং আল্লাহর সম্পর্কে যাহা তোমরা জাননা এমন কথা বলার নির্দেশ দেয়” – (সুরাআলাবাকারা: ১৬৮-১৬৯)
****
“হে ঈমানদার গণ! যেসব পবিত্র জিনিস আল্লাহ তোমাদের জন্যে হালাল করেছেন, তাকে নিজেদের জন্যে হারাম করোনা এবং সীমালংঘন করো না না; কারন, আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেননা। আর আল্লাহ তোমাদেরকে যেসব হালাল ও পবিত্র রিযিকদান করেছেন, তা থেকে খাও এবং যে আল্লাহর প্রতি তোমরা ঈমান রাখো, তাঁর নাফরমানী হতে দূরে থাক.” – (সুরা আলমায়েদা: ৮৭-৮৮)
********
“(হে নবী! বলো, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্যে যেসব সৌন্দর্য সামগ্রী (জিনাত) বের করেছেন, তাকে কে
***********
“(আমাদের পয়গাম্বর) তাদেরকে নেক কাজের আদেশ দেন এবং অন্যায় ও পাপাচার থেকে বিরত রাখেন, তাদের জন্যে পবিত্র জিনিস হালাল ও অপবিত্র জিনিস হারাম আর তাদের ওপরকার বোঝা ও বন্ধন সমূহ দূর করে দেন।”
– (সুরা আরাফ: ১৫৭)
*******
“তোমরা আপন প্রভুর ফযল (অর্থাৎ ব্যবসায়ের দ্বারা জীবিকা) তালাশ করবে, এর ভেতরে তোমাদের জন্যে কোনই অনিষ্ট নেই.”
**********
“মসীহর অনুগামীগন নিজেরাই বৈরাগ্যবাদ উদ্ভাবন করে নিয়েছিল শুধু আল্লাহর সন্তোষ লাভের আশায়, এটা তাদের জন্যে আমরা বিধিবদ্ধ করিনি।”
– (সুরা আল হাদিদ: ২৭)
**********
“আমরা জাহান্নামের জন্যে বহু জ্বিন ও মানুষ পয়দা করেছি। তাদের কাছে দিল রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা চিন্তা-ভাবনা করেনা, তাদের কাছে চক্ষু রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা দেখেনা; তাদের কাছে কান রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা শোনে না, তারা জানোয়ারের মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতর। এরাই রয়েছে গাফলতে নিমজ্জিত।”-(সুরা আল আরাফঃ১৭৯)
এই আয়াতগুলোতে একথা সুস্পষ্ট যে, দুনিয়া ত্যাগ করাটা মানুষের কাজ নয়। দুনিয়া এমন কোন জিনিস নয় যে, তাকে বর্জন করতে হবে, তা থেকে দূরে থাকতে হবে এবং তার কায়-কারবার, বিষয়াদি, ভোগোপকরণ ও সৌন্দর্য সুষমাকে নিজের প্রতি হারাম করে নিতে হবে। এ দুনিয়া মানুষের জন্যেই তৈরী করা হয়েছে; সুতরাং তার কাজ হচ্ছে, একে ভোগ-ব্যবহার করবে, বিপুলভাবে ভোগ-ব্যবহার করবে। তবে ভাল-মন্দ, পাক-নাপাক ও সমীচীন-অসমীচীনের পার্থক্যের প্রতি লক্ষ রেখে ভোগ করবে। আল্লাহ তাকে দেখার জন্য চক্ষু দিয়েছেন। যদি মানুষ তার দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ইন্দ্রিয় নিচয় ও মানসিক শক্তিকে ব্যবহার না করে অথবা ভুল পথে ব্যবহার করে তো তার ও পশুর মধ্যে কোনই প্রভেদ থাকে না।
দুনিয়াবী জীবনের রহস্য:
**************
“(আখেরাত সম্পর্কে) আল্লাহর ওয়াদা নিশ্চিতরুপে সত্য; সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলে না দেয় এবং প্রতারক (শয়তান) তোমাদেরকে আল্লাহর সম্পর্কে নিশ্চিত করে না রাখে।”-(সূরা ফাতের:৫)
********************
“যারা নিজেদের প্রতি নিজেরা যুলুম করেছে, পার্থিব আনন্দ-উপভোগের-যা তাদেরকে দেয়া হয়েছিল-পেছনে পড়ে রয়েছে; এরাই ছিলো অপরাধী।”-(সূরা হুদঃ১১৬)
*********
“তাদের সামনে পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত পেশ করো। তাহলো এই, যেন আসমান থেকে আমরা পানি বর্ষণ করলাম এবং তার ফলে দুনিয়া শস্য-শ্যামল হয়ে গেলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই শস্যাদি ভূষিতে পরিণত হয়ে গেল, যা দমকা হাওয়ায় ইতঃস্তত উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ প্রতিটা জিনিসের ওপর ক্ষমতাবান। ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি হচ্ছে নিছক পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যোপকরণ মাত্র; কিন্তু তোমার প্রভুর দৃষ্টিতে ‘সওয়াব’ এবং ভবিষ্যত প্রত্যাশার দিক থেকে স্থায়ী নেকীই হচ্ছে অধিকতর উত্তম।”
-(সূরা আল কাহাফঃ৪৫-৪৬)
********
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ধন-দৌলত ও তোমাদের সন্তানাদি যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে তোমাদের গাফেল করে না দেয়। যারা এরূপ করবে, প্রকৃতপক্ষে তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ।”-(সূরা মুনাফেকুনঃ৯)
**********
“তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমদের সন্তানাদি এমন জিনিস নয় যা তোমাদেরকে আমাদের নিকটবর্তী করতে পারে। আমাদের নিকটবর্তী কেবল তারাই যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে।”
“জেনে রাখ, দুনিঢার জীবন হচ্ছে একটি খেল, একটি তামাশা, এক বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের একের ওপর অপরের গর্ব করা এবং ধন-সম্পদ ও সন্তানাদিতে একের চেয়ে অন্যের প্রাচুর্য লাভের চেষ্টা করা। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই যে, বৃষ্টি হলো এবং তার থেকে উৎপন্ন ফসল দেখে কৃষক খুব খুশী হলো। তারপর সে ফসল পাকলো এবং তুমি দেখতে পেলে যে তা বিবর্ণ হয়ে গেলো। অবশেষে তা ভূষিতে পরিণত হলো।”
-(সূরা আল হাদীদঃ২০)
********
“তোমরা কি প্রতিটি উঁচু জায়গায় নিষ্ফল স্মৃতি স্তম্ভ এবং বড় বড় ইমারত তৈরী করছো? সম্ভবত এই ধারণায় যে, তোমরা এখানে চিরকাল থাকবে।”
-(সূরা আশ শুয়ারাঃ১২৮-১২৯)
“তোমাদের কি নিশ্চিতভাবে ছেড়ে দেয়া হবে এখানকার এই জিনিস-গুলোর মধ্যে এই বাগ-বাগিচা, এই ঝর্ণাধারা, এই শস্য ক্ষেত এবং মনোহর আবরণযুক্ত খেজুরের বাগান? আর তোমরা পাহাড় কেটে বাড়ি তৈরী করছো এবং খুশীতে রয়েছো।”
-(সূরা আশ শুয়ারাঃ১৪৬-১৪৯)
“তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদের আসবেই-চাই তোমরা খুব সুদৃঢ় কেল্লার মধ্যেই থাকো না কেন।”
-(সূরা আন নিসাঃ ৭৮)
“প্রত্যেককেই মৃত্যুবরণ করতে হবে; তারপর তোমদের সবাইকে আমাদের দিকে নিয়ে আসা হবে।”-(সূরা আনকাবুতঃ৫৭)
“তোমরা কি ধারণা করে নিয়েছো যে, আমরা তোমাদেরকে নিষ্ফল পয়দা করেছি এবং তোমাদেরকে আমাদের দিকে ফিরিয়ে আনা হবে না?”
পূর্বে বলা হয়েছিল যে, দুনিয়া তোমদের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে; তোমরা একে খুব উত্তমরূপে ভোগ-ব্যবহার করো। এবার বিষয়টির অপর দিক পেশ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, দুনিয়া তেমাদের জন্যে হলেও তোমরা দুনিয়ার জন্যে নও। অথবা দুনিয়া তোমাদের ভোগ-ব্যবহার করবে আর তোমরা তার মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে, এ জন্যেও তাকে সৃষ্টি করা হয়নি। দুনিয়ার জীবনে প্রতারিত হয়ে তোমরা কখনো এ ধারণা পোষণ করো না যে, তোমাদের এখানে চিরকাল থাকতে হবে। খুব ভালোমতো জেনে রাখো এই মাল-মাত্তা, ধন-দৌলত, শান-শওকত, সামানপত্র সবকিছুই অস্থায়ী জিনিস। সবকিছুই হচ্ছে কালের ধোঁকা মাত্র। এর সবারই পরিণাম হচ্ছে ধ্বংস। তোমাদের ন্যায় এর প্রতিটি বস্তুই মাটিতে মিশে যাবে। এ অস্থায়ী জগতের মধ্যে একমাত্র বাকী থাকার মতো জিনিস হচ্ছে মানুষের নেকী; তার দিল ও আত্মার নেকী; তার আমল ও আচরণের নেকী।
কৃতকর্মের দায়িত্ব ও জবাবদিহি
এরপর বলা হয়েছেঃ
“বিচারের সময় যাকে আমরা গোপন রাখার ইচ্ছে পোষণ করি-অবশ্যই সমুপস্থিত হবে, যাতে করে প্রত্যেকেই তার চেষ্টানুযায়ী ফল পেতে পারে।”-(সূরা ত্বাহা-১৫)
“তোমাদের কি তোমাদের আমল ছাড়া অন্য কোন জিনিসের দৃষ্টিতে প্রতিফল দেয়া হবে?”-(সূরা আন নমলঃ৯০)
“আর মানুষ ততটুকুই ফল লাভ করবে যতটুকু চেষ্টা সে করেছে; তার প্রচেষ্টা শীগগীরই দেখে নেয়া হবে।অতপর সে পুরোপুরি ফল লাভ করবে। আর পরিশেষে সবাইকে তোমাদের পরোয়ারদেগারের কাছেই পৌঁছতে হবে।”
-(সূরা আন নাজমঃ ৩৯-৪২)
“যে ব্যক্তি এ দুনিয়ায় অন্ধ থাকে সে আখেরাতেও অন্ধ থাকবে। আর সে সঠিক পথ থেকে দূরে সরে আছে।”-(সূরা বনী ইসরাঈলঃ৭২)
“তোমরা নিজেদের জন্যে এ দুনিয়া থেকে যেসব নেকী পাঠাবে, আল্লাহর কাছে গিয়ে ঠিক তা-ই পাবে। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ সবই দেখেন।”
-(সূরা আল বাকারাঃ১১০)
“সে দিনকে ভয় করো যে দিন তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। অতপর প্রত্যেকে তার কৃতকর্মের বদলা পাবে এবং তাদের প্রতি কখনোই যুলুম করা হবে না।” -(সূরা আল বাকারাঃ২৮১)
“সে দিন প্রত্যেকেই তার কৃত নেকী এবং তার কৃত বদী কে উপস্থিত পাবে।” -(সূরা আলে ইমরানঃ৩০)
“সেদিন যাবতীয় কৃতকর্মের (আমলের) পরিমাপ এক ধ্রুব সত্য। যাদের আমলের পাল্লা ভারী হবে, কেবল তারাই কল্যাণ লাভ করবে আর যাদের আমলের পাল্লা হালকা হবে, তারাই হবে নিজেদের ক্ষতিসাধনকারী।কেননা তারা আমাদের আয়াতের প্রতি যুলুম করছিলো।”
“যে ব্যক্তি অণু পরিমাণও নেক কাজ করবে তার প্রতিফল সে দেখতে পাবে, আর যে অণু পরিমাণও পাপ করবে, তার প্রতিফলও সে দেখতে পাবে।”-(সূরা আয যিলযাল ৭-৮)
“আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেছেন এবং বলেছেন, আমি তোমদের কোন আমলকারীর আমলকেই নষ্ট হতে দেবো না-সে পুরুষই হোক কিংবা নারী।”-(সূরা আলে ইমরানঃ১৯৫)
“আমরা তোমাদেরকে যা কিছু দান করেছি, তা থেকে খরচ করো, তোমাদের ভেতরকার কারো মৃত্যু আসার পূর্বে। যখন সে বলবেঃ হে আমার প্রভূ! তুমি যদি আমাকে আর কিছুটা সময় দান করতে তাহলে তোমার পথে আমি খরচ করতাম এবং নেককারদের অন্তর্ভূক্ত হতাম। কিন্তু কারোর নির্ধারিত সময় আসার পর আল্লাহ তাকে কখোনই সময় দান করেন না। ”-(সূরা মুনাফিকুনঃ১০-১১)
(আরবী************)
“হায়”! সেই সময়টা যদি তুমি দেখতে যখন অপরাধী তার প্রভূর সামনে অবনত মস্তকে দাঁড়াবে এবং বলবেঃ হে আমাদের পরোয়ারদেগার! এবার আমরা দেখে নিয়েছি এবং শুনতেও পেয়েছি; এক্ষণে তুমি আমাদেরকে ফিরিয়ে দাও, আমরা ভালো কাজ করবো, এবার আমরা প্রত্যয় লাভ করেছি। কিন্তু বলা হবেঃ এবার তোমরা সেই গাফিলতের স্বাদ গ্রহণ করো, যে কারণে তোমরা এই দিন আমাদের সামনে হাযির হওয়ার ব্যাপারকে ভুলে গিয়েছিলে। আজকে আমরাও তোমাদের কে ভুলে গেছি। সুতরাং তোমরা যে ‘আমল’ করতে, তার বিনিময়ে আজ চিরস্থায়ী আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো।” -(সূরা আস-সাজদাঃ ১২-১৪
এখানে বলা হয়েছে যে, দুনিয়া হচ্ছে কাজের ক্ষেত্র; চেষ্টা ও সাধনার স্থান। আর পরকালীন জীবন হচ্ছে প্রতিফল লাভের ক্ষেত্র; নেকী ও বদীর ফল এবং কৃতকর্মের প্রতিদান পাবার স্থান। মানুষ তার মৃত্যু সময় পর্যান্ত দুনিয়ায় কাজ করার সুয়োগ পেয়েছে। এরপর সে কখনো আর কাজের সুযোগ পাবে না। সুতরাং এই জীবনে তাকে একথা স্মরণ রেখে কাজ করতে হবে যে, আমার প্রতিটি কাজ প্রতিটি আচরণ এবং ভালোমন্দ প্রতিটি আমলেরই একটি নিজস্ব প্রভাব ও গুরুত্ব রয়েছে এবং সেই প্রভাব ও গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতেই আমি পরকালীন জীবনে ভালো বা মন্দ ফল লাভ করব। আমি যা কিছু পাবো তা তার এই জীবনের প্রয়াস প্রচেষ্টা এবং এখনকার কাজেরই প্রতিফল হিসেবে পাবো; আমার কোন নেকী না বিনষ্ট হবে আর না কোন পাপকে ছেড়ে দেয়া হবে।
ব্যক্তিগত দায়ীত্ব
এই দায়িত্বানুভূতিকে অধিকতর জোরদার করে তোলার জন্যে এ-ও বলে দেয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার নিজস্ব কাজের জন্যে দায়িত্বশীল। তার এই দায়িত্বের ব্যাপারে না অন্য কেউ অংশীদার রয়েছে, আর না কেউ কাউকে তার কাজের ফল হতে বাঁচাতে পারে।
(আরবী**********)”তোমাদের ওপর তোমাদের আপন সত্তার দায়িত্ব রয়েছে। তোমরা যদি হেদায়াত পাও তাহলে অপর কোন বিভ্রান্ত ব্যক্তি তোমাদের কোন ক্ষতিসাধান করতে পারে না।” -(সূরা আল-মায়েদাঃ ১০৫)
(আরবী***********)
“প্রত্যেক ব্যক্তি যা কিছু অর্জন করে, তার বোঝা তারই ওপর ন্যস্ত; কেউ কারো বোঝা বহন করে না।” -(সূরা আল-আন’আমঃ ১৬৪)
(আরবী**********)
“কেয়ামতের দিন তোমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং তোমাদের সন্তানাদি কোনই কাজে আসবে না। সেদিন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করবেন, আর তাঁর দৃষ্টি রয়েছে তোমাদের আমলের প্রতি।” -(সূরা মুমতাহিনাঃ ৩)
(আরবী*************)
“তোমারা নেক কাজ করলে নিজেদের জন্যেই করবে আর দুষ্কর্ম করলে তাও নিজেদের জন্যে।” – (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৭)
(আরবী***************)
“কোন ব্যক্তি অন্য কারোর গোনাহের বোঝা মাথায় নিবে না; যদি কারোর ওপর গোনাহের বড়ো বোঝা চেপে থাকে এবং সে সাহায্যের হাত প্রসারিত করার জন্যে কাউকে ডাকে, তবে সে তার বোঝার কোন অংশই নিজের মাথায় তুলে নিবে না- সে আত্বীয়-স্বজনই হোক না কেন।” -(সূরা আল-ফাতিরঃ ১৮)
(আরবী***************)
“হে মানব জাতি! আপন প্রভুকে ভয় করো আর সেই দিনকে ভয় করো, যেদিন না কোন পিতা তার পুত্রের কাজে আসবে আর না পুত্র তার পিতার কিছুমাত্র কাজে আসবে।” -(সূরা লোকমানঃ ৩৩)
(আরবী*************)
“যে ব্যক্তি কুফরী করেছে তার কুফরির বোঝা তারই উপর ন্যস্ত, আর যে ব্যক্তি নেক কাজ করলো সে ধরনের লোকেরাই নিজেদের কল্যাণের জন্যে রাস্তা পরিষ্কার করছে।” -(সুরা আর-রুমঃ ৪৪)
এখানে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি মানুষের ওপরই তার ভালো ও মন্দ কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে। এর ভেতরে না এ আশা পোষণের কোন সুযোগ রাখা হয়েছে যে, আমাদের দোষ-ত্রুটি বা গাফিলতির কেউ কাফফারা আদায় করবে, আর না এ প্রত্যাশার কোন অবকাশ রয়েছে যে, কারো কোন আত্মীয়তা বা সম্পর্কের কারণে আমরা আমাদের অপরাধের দায় থেকে অব্যাহতি পাবো এবং এ আশংকারও কোন সুযোগ রাখা হয়নি যে, কারো দুষ্কৃতি আমাদের নেক কাজকে প্রভাবিত করবে, কিংবা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টি আমাদের আমলের স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির ওপর প্রভাবশীল হতে পারে। কেউ আগুনে হাত প্রদান করলে তার স্বাভবিক দাহ থেকে কোন জিনিস তাকে রক্ষা করতে পারে না। আবার কেউ মধু পান করলে তার মিষ্ট স্বাদ উপলব্ধি থেকেও কোন জিনিস তাকে বাধা দিতে পারে না। না দহনের জ্বালা ভেগের ব্যাপারে কেউ কারো শরীকদার হতে পারে, আর না মিষ্টি স্বাদ গ্রহণে কেউ কাউকে বঞ্চিত করতে পারে। ঠিক তেমনি পাপের কুফল এবং সৎকাজের সুফলের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিঃসঙ্গ ও অন্য নিরপেক্ষ। সুতরাং দুনিয়াকে ভোগ-ব্যবহার করার ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তিরই পূর্ণ দায়িত্ববোধ থাকা অপরিহার্য। দুনিয়া ও তার অন্তর্গত বস্তুনিচয় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে এ ভেবে তার জীবন যাপন করা উচিত যে, তার প্রতিটি কাজের জন্যে সে নিজেই দায়িত্বশীল; পাপের বোঝাও তার একার উপরই ন্যস্ত, আর সৎকাজের ফায়দাও সে একাকীই ভোগ করবে।
ওপরে পার্থিব জীবন সম্পর্কিত ইসলামী ধারণার যে ব্যাখ্যা দান করা হলো তাতে তার বিভিন্ন অংশ ও উপাদানগুলো প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। এখন তার গঠন ও বিন্যাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক এবং বিক্ষিপ্ত অংশগুলোর সমন্বয়ের ফলে যে পূর্ণাঙ্গ ধারণাটি গড়ে উঠে তা কতখানি প্রকৃতি ও বাস্তবের সাথে সংগতিপূর্ণ, পার্থিব জীবন সম্পর্কে অন্যান্য সংস্কৃতিগুলোর ধারণার তুলনায় এর কি মর্যাদা হতে পারে এবং এই জীবন দর্শনের ওপর যে সংস্কৃতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় তা মানুষের চিন্তা ও কর্মকে কোন বিশেষ ছাঁচে ঢালাই করে, তা-ও দেখা যাক।
জীবনের স্বাভাবিক ধারণা
জীবনের স্বাভাবিক ধারণা দুনিয়া এবং দুনিয়াবী জীবন সম্পর্কে অন্যান্য ধর্মগুলো যে ধারণা পেশ করেছে কিছুক্ষণের জন্যে তা আপনার মন থেকে দূর করে দিন। অতপর একজন সূক্ষ্মদর্শী হিসেবে আপনি চারপাশের দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এই গোটা পরিবেশে আপনার মর্যাদা কি, তা অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করুন। এই পর্যবেক্ষনের ফলে কয়েকটি জিনিস অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আপনার চোখে পড়বে।
আপনি দেখতে পাবেন যে, যতগুলো শক্তি আপনি লাভ করেছেন তার পরিধি অত্যন্ত সীমিত। যে ইন্দ্রিয় শক্তির ওপর আপনার জ্ঞান নির্ভরশীল, আপনার নিকটতম পরিবেশের সীমা অতিক্রম করতে পারে না। যে অংগ-প্রত্যঙ্গের ওপর আপনার গোটা কর্মকান্ড নির্ভরশীল তা মাত্র কতিপয় দ্রব্যকেই তা আয়ত্তাধীন রাখতে পারে। আপনার চারদিকের বেশুমার জিনিস আপনার দেহ এবং শক্তির তুলনায় অনেক বড়ো এবং এসবের মুকাবেলায় আপনার ব্যক্তি সত্তাকে অত্যান্ত তুচ্ছ ও কমজোর বলে মনে হয়। দুনিয়ার এই বিরাট কারখানায় যে প্রচন্ড শক্তিগুলো ক্রিয়াশীল রয়েছে, তার কোনটাই আপনার আয়ত্তাধীন নয়, বরং ঐ শক্তিগুলোর মুকাবেলায় নিজকে অত্যন্ত অসহায় মনে করেন। দৈহিক দিক থেকে আপনি একটি মধ্যম শ্রেণীর প্রানী। নিজের চেয়ে ছোট জিনিসের ওপর আপনি বিজয়ী, কিন্তু নিজের চেয়ে বড়ো জিনিসের নিকট আপনি পরাজিত।
কিন্তু আপনার ভেতরকার আর এক শক্তি আপনাকে ঐ সমস্ত জিনিসের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। সেই শক্তির বদৌলতেই আপনি সম জাতীয় সমস্ত প্রাণীর ওপর আধিপত্য বিস্তর করেন এবং আপনার চেয়ে তাদের দৈহিক শক্তি অনেক বেশী হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে কর্তৃত্বাধীন করে নেন। সেই শক্তির দরুনই আপনি আপনার চারপাশের বস্তুগুলোকে ভোগ-ব্যবহার করে থাকেন এবং ঐগুলো থেকে আপন মর্জী মাফিক সেবা গ্রহণ করেন। সেই শক্তির বদৌলতেই আপনি শক্তির নব নব উৎসের সন্ধান পান এবং সেগুলোকে বের করে নিয়ে নতুন নতুন পদ্ধতিতে ব্যবহার করেন। সেই শক্তির দরুনই আপনি জ্ঞান অর্জনের উপায়-উপাদান সমূহ বৃদ্ধি করেন এবং যে সকল বস্তু আপনার স্বাভাবিক শক্তির আওতা বহির্ভূত সেগুলো পর্যন্ত উপনীত হন। মোটকথা, ঐ বিশেষ শক্তিটির বদৌলতে দুনিয়ার সকল বস্তুই আপনার খাদেমে পরিণত হয় এবং আপনি তাদের খেদমত গ্রহণকারীর সৌভাগ্য অর্জন করেন।
আবার বিশ্ব কারখানার যে সকল উচ্চতর শক্তি আপনার আয়ত্তাধীন নয়, সেগুলোও এমনি ধারায় কাজ করে চলছে যে, সাধারণভাবে সেগুলোকে আপনার শত্রু বা বিরোধী বলা চলে না, বরং তারা আপনার মদদগার এবং আপনার কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধার অনুকূল। হাওয়া, পানি, আলো, উত্তাপ এবং এই ধরনের আর যেসব শক্তির ওপর আপনার জীবন নির্ভরশীল তার সবগুলোই এমন একটি বিশেষ নিয়মের অধীন কাজ করে যাচ্ছে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনার সাহায্য করা। এই হিসেবে আপনি বলতে পারেন যে, উল্লেখিত বস্তু-গুলো আপনার অনুগত।
এই গোটা পরিবেশের ওপর আপনি যখন গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করেন তখন এক মহাশক্তিশালী বিধানকে আনি ক্রিয়াশীল দেখতে পান। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু থেকে শুরু করে বৃহৎ হতে বৃহত্তর সকল বস্তুই এই শক্তিধর বিধানের অক্টোপাশে সমানভাবে আবদ্ধ। এরপরও তার শৃংখলা ও নিয়ন্ত্রণের ওপর সমগ্র আলমের স্থিতি একান্তভাবেই নির্ভরশীল। আপনি নিজেও সেই বিধানের অধীন। কিন্তু আপনি এবং দুনিয়ার অন্যান্য দ্রব্যের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য বস্তুগুলো ঐ বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করার অণু পরিমাণও ক্ষমতা নেই। কিন্তু তার বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষমতা আপনার রয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং আপনি যখন তার বিরুদ্ধাচরণ করতে চান, তখন এ কাজে সে আপনার সাহায্যও করে থাকে। অবশ্য এমন প্রতিটি সঙ্গে সঙ্গে কিচুটা প্রতিক্রিয়া রেখে যায় এবং সে বিরুদ্ধাচরণের পর তার মন্দ পরিণতি থেকে আপনিও বাঁচতে পারেন না।
এই বিশ্বব্যাপী ও অপরিবর্তনীয় বিধানের অধীনে সৃষ্টি ও ধ্বংসের বিভিন্ন দৃশ্য আপনারা দেখতে পান। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ভাঙা ও গড়ার এক অসমাপ্য ধারা অব্যাহত রয়েছে। যে বিধান অনুযায়ী একটি জিনিস পয়দা ও প্রতিপালন করা হয়, সেই বিধান অনুসারেই তাকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্নও করে দেয়া হয়। দুনিয়ার কোন বস্তুই সেই বিধানের বাঁধন থেকে মুক্ত নয়। দৃশ্যত যে বস্তুগুলোকে এ থেকে মুক্ত বলে মনে হয় এবং যেগুলোকে অচল-অনড় বলে সন্দেহ হয়, সেগুলোকেও গভীরভাবে নিরীক্ষা করলে বোঝা যায় যে, তাদের মধ্যেও আবর্তন ও পরিবর্তনের ক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে এবং সৃষ্টি ও ধ্বংসের কবল থেকে তাদেরও নিস্তার নেই। যেহেতু বিশ্বপ্রকৃতির অন্যান্য বস্তু চেতনা ও বোধশক্তি সম্পন্ন নয় অথবা নূ্ন্যকল্পে এ সম্পর্কে আমাদের কোন জ্ঞান নেই, এ জন্যেই আমরা তাদের ভেতরে এই সৃষ্টি ও ধ্বংসের ফলে কোন আনন্দ বা বিষাদের লক্ষণ অনুভব করি না। কিন্তু মানুষ এক চেতনা ও বোধশক্তি সম্পন্ন প্রাণী বিধায় তার চারপাশের এই পরিবর্তনগুলো দেখে সে আনন্দ ও বিষাদের এক তীব্র প্রতিক্রিয়া অনুভব করে। কখনো অনুকূল বিষয়ের প্রকাশ দেখে এতো তীব্র আনন্দানুভব করে যে, এ দুনিয়ায় যে ধ্বংসেরও সম্ভাবনা রয়েছে, একথাটাই সে ভুলে যায়। আবার কখনো প্রতিকূল বিষয় দেখে তার বিষাদ এতোটা তীব্র হয়ে ওঠে যে, এ দুনিয়ায় শুধু ধ্বংস আর ধ্বংসই সে দেখতে পায় এবং এখনো যে সৃষ্টির সম্ভবনা রয়েছে সে সত্যটা সে ভুলে যায়।
কিন্তু আপনার ভেতর আনন্দ ও বিষাদের যতো পরস্পর বিপরীত অনুভূতিই থাকুক না কোন এবং তার প্রভাবে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে আপনি যতোই কড়াকড়ি বা বাড়াবাড়ির দৃষ্টিভংগি গ্রহণ করুন না কেন, এই দুনিয়াকে কার্যত ভোগ-ব্যবহার করতে এবং আপনার ভেতরকার শক্তিনিচয়কে কাজে লাগাতে আপনি নিজস্ব প্রকৃতির কারণেই বাধ্য। আপনার প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার আকাংখা রয়েছে এবং এ আকাংখাকে চরিতার্থ করার জন্যে আপনার ভেতর ক্ষুদা নামক এক প্রচন্ড শক্তি দেয়া হয়েছে য আপনাকে হামেশা কাজের জন্যে উদ্ধুদ্ধ করছে। প্রকৃতি আপনাকে আপনার বংশধারা বাঁচিয়ে রাখার কাজে নিয়োজিত করতে ইচ্চুক; এই জন্যে সে যৌনচেতনা নামক এক অদম্য শক্তি আপনার ভেতর সঞ্চার করেছে, যা আপনার দ্বারা তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে অনুপ্রণিত করে। এমনিভাবে আপনার স্বভাব-প্রকৃতিতে অন্যান্য উদ্দেশ্য আরো কতিপয় শক্তির সমাবেশ করা হয়েছে এবং তার প্রতিটি শক্তিই আপনার দ্বারা নিজ নিজ অভীষ্ট পূর্ণ করে নেয়ার চেষ্টা করে। প্রকৃতির এই বিভিন্নমুখী উদ্দেশ্য আপনি উৎকৃষ্টভাবে আঞ্জাম দেবেন কি নিকৃষ্টভাবে, সানন্দচিত্তে নিষ্পন্ন করবেন কি জোর-জবরদস্তির চাপে তা সম্পূর্ণত আপনার জ্ঞান-বুদ্ধির ওপরই নির্ভর করে। শুধু তাই নয় খোদ প্রকৃতি আপনার ভেতর ঐ উদ্দেশ্যগুলো পূর্ণ করার কাজ আঞ্জাম দেয়া বা না দেয়ার এক বিশেষ ক্ষমতা পর্যন্ত প্রদান করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রকৃতি এই বিধানও করে দিয়েছে যে, সানন্দচিত্তে ও ভালোভাবে তার উদ্দেশ্য পূরণ করা আপনার জন্যেই কল্যানকর এবং তা পূরণ করতে পরান্মুখ হওয়া কিংবা পূর্ণ করলেও নিকৃষ্টভাবে করা খোদ আপনার পক্ষেই ক্ষতিকর।
বিভিন্নধর্ম ও মতাদর্শের ধারণা:
একজন সুষ্ঠ প্রকৃতি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এবং এই দুনিয়ার
প্রেক্ষিতে নিজের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে ওপরে বর্ণিত প্রতিটি বিষয়ই তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। কিন্তু মানব জাতির বিভিন্ন দল এই গোটা দৃশ্যটিকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখেছেন এবং প্রায়শ এমনি ব্যাপার ঘটেছে যে, যাদের চোখে যে দিকটি উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতেই তার পার্থিব জীবন সম্পর্কে একটি মতবাদ গড়ে নিয়েছেন এবং অন্যান্য দিকগুলো প্রতি দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা পর্যন্ত করেননি।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, একটি দল মানুষের দুর্বলতা ও অসহায়তা এবং তার মুকাবেলায় প্রকৃতির বড়ো শক্তিগুলো প্রভাব ও পরাক্রম দেখে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, দুনিয়ায় মানুষ নিতান্তই একটি তুচ্ছ জিনিস আর দুনিয়ার এই মংগলকারী ও ক্ষতিকারক শক্তিগুলো কোন বিশ্বব্যাপী বিধানের অধীন নয় বরং এরা স্বাধীন কিংবা আধা স্বাধীন। এই চিন্তাধারা তাদের মনের ওপর এতখানি প্রাধান্য বিস্তার করেছে, তাদের দৃষ্টিপাত থেকেই তা অপসৃত হয়ে গেছে। তারা আপন অস্তিত্বের উজ্জ্ব দিকটি ভুলে গেলেন এবং নিজেদের কমজোরী ও অক্ষমতার আতিশষ্যপ্রসূত স্বীকৃতির দ্বারা তাদের সম্মান ও সম্ভ্রমের অনুভূতিকে বিসর্জন দিলেন। মূর্তি পূজা, বৃক্ষ পূজা, নক্ষত্র পূজা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা এই মতবাদেরই প্রত্যক্ষ ফল।
আর একটি দল দেখতে পেলেন যে, দুনিয়ায় শুধু বিপর্যয়েরই লীলাভূমি। সমস্ত বিশ্ব সংসার চালিত হচ্ছে শুধু মানুষের দুঃখ-কষ্ট আর নিগ্রহ ভোগের জন্যে। দুনিয়ার যাবতীয় সম্পর্ক সম্বন্ধই হচ্ছে মানুষকে অশান্তি আর বিপদের জালে জড়িত করার ফাঁদ বিশেষ। কেবল মানুষের কথাই বলি কেন, গোটা বিশ্বজাহানই এই বিষাদ ও ধ্বংসের কবলে আবদ্ধ। এখানে যা কিছু সৃষ্টি হয়, ধ্বংসের জন্যেই হয়। বসন্ত আসে এই জন্যে যে, শীত এসে তার শ্যামলিমা হরণ করে নিয়ে যাবে। জীবনের বৃক্ষ পল্লবে সুশোভিত হয় এই জন্যে যে, মৃত্যুরূপ শয়তান এস তার মজা লুণ্ঠন করবে। স্থিতির সৌন্দর্য এতো পরিপাট্য নিয়ে আসে এই জন্যে যে, ধ্বংসের দেবতা তার সঙ্গে খেলা করার বেশ সুযোগ পাবে। এই মতবাদ ঐ লোকগুলোর জন্যে দুনিয়া এবং তার জীবনে কোন আকর্ষণই অবশিষ্ঠ রাখেনি। তারা সংসার ত্যাগ, আত্মপীড়ন ও কৃচ্ছ্রসাধনা করে নিজেদের ভেতরকার সমস্ত অনুভূতিকে বিলুপ্ত করা এবং প্রকৃতির বিধান শুধু নিজের কারখানা চালিত করার জন্যে মানুষকে উপকরণে পরিণত করেছে সে বিধানটিকে ছিন্ন করার মধ্যেই তারা মুক্তির পথ দেখতে পেয়েছে।
অন্য একটি দল দেখলো, দুনিয়ায় মানুষের জন্যে আনন্দ ও বিলাসের প্রচুর উপকরণ রয়েছে এবং মানুষ এক স্বল্প সময়ের জন্যে এর রসাস্বাদনের সুযোগ পেয়েছে। দুঃখ ও বিষাদের অনুভূতি এই রস্বাসাদনকে বিস্বাদ করে দেয় সুতরাং মানুষ ঐ অনুভূতিটাকে বিলুপ্ত করে দিলে এবং কোন জিনিসকেই নিজের জন্যে দুঃখ ও বিষাদের কারণ হতে না দিলে এখানে শুধু আনন্দ আর ফুর্তিই দেখা যাবে। মানুষের জন্যে যা কিছু রয়েছে এই দুনিয়াতেই রয়েছে; তার যা কিচু মজা লটার এই পার্থিব জীবনেই লুটতে হবে। মৃত্যুর পর না মানুষ থাকবে আর না থাকবে দুনিয়া বা তার আনন্দ-ফূর্তি, সবকিছুই যাবে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে।
এর বিপরীত আরেকটি দল এমন রয়েছে, যারা দুনিয়ার আনন্দ-স্ফূর্তি এমন কি গোটা দুনিয়াবী জিন্দেগীকেই সম্পূর্ণ গুনাহ বলে মনে করে। তাদের মতে মfনবীয় আত্মার জন্যে দুনিয়ার বস্তুগত উপকরণগুলো হচ্ছে এক প্রকার নাপাকী-অশুচিতার শামিল। এই দুনিয়াকে ভোগ-ব্যবহার করা, এর কায়-কারবারে অংশগ্রহণ করা এবং এর আনন্দ স্ফূর্তির রসাস্বাদন করার ভেতরে মানুষের জন্যে কোন পবিত্রতা বা কল্যাণ নেই। যে ব্যক্তি আসমানী রাজত্বের দ্বারা সৌভাগ্যবান হতে চায়, দুনিয়া থেকে তার দূরে থাকাই উচিত। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার দৌলত ও হুকুমাত এবং পার্থিব জীবনের রসাস্বাদন করতে চায়, তার নিশ্চিত জেনে রাখা উচিত যে, আসমানী রাজত্বে তার জন্যে কোন স্থান নেই। এ দলটি এ-ও অনুভব করেছে যে, মানুষ তার নিজস্ব স্বভাব-প্রকৃতির তাগিদেই দুনিয়াকে ভোগ-ব্যবহার করতে এবং তার কায়-কারবারে লিপ্ত হতে বাধ্য; আসমানী রাজত্বে প্রবেশ করার কল্পনা যতোই চিত্তাকর্ষক হোক না কেন, তা এতখানি শক্তিশালী কিছুতেই হতে পারে না যে, তার ওপর নির্ভর করে মানুষ তার প্রকৃতির মুকাবেলা করতে পারে। তাই আসমানী রাজত্ব অবধি পৌঁছার জন্যে তারা একটি সংক্ষিপ্ত পথ আবিষ্কার করে নিয়েছে, আর তাহলো এই যে, এক বিশেষ সত্তার প্রতি যারা ঈমান আনবে, তাঁর প্রায়শ্চিত্তই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেবে।
অপর একটি দল প্রাকৃতিক আইনের ব্যাপকতা দেখে মানুষকে নিছক এক অক্ষম ও দুর্বল সত্তা বলে মনে করে নিয়েছে। তারা দেখেছে যে, মানুষ যে আদৌ কোন স্বাধীন ও অনন্যপর সত্তা নয়, মনস্তত্ত্ব, শরীরতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব এবং উত্তরাধিকার আইনের সাক্ষ্য এই সত্যকেই প্রতিপন্ন করেছে। প্রকৃতিক আইন তাকে আষ্টপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এ আইনের বিরুদ্ধে সে না কিছু ভাবতে পারে, না পারে কোন জিনিসের ইচ্ছা পোষণ করতে, আর না সে কোন কাজ করার ক্ষমতা। সুতরাং তার ওপর তার কোন কাজের দায়িত্ব আরোপিত হয় না।
এর সম্পূর্ণ বিপরীত আর একটি দলের মতে মানুষ শুধু এক ইচ্ছা শক্তিসম্পন্ন সত্তাই নয়, বরং সে কোন উচ্চতর ইচ্ছাশক্তির অধীন বা অনুগতও নয়, আর না সে আপন কৃতকর্মের জন্যে নিজের বিবেক বা মানবীয় রাজ্যের আইন-কানুন ছাড়া অন্য কারোর সামনে জবাবদিহি করতে বাধ্য। সে হচ্ছে এই দুনিয়ার মালিক। দুনিয়ায় সমস্ত জিনিস তারই অধীন। তার ইখতিয়ার রয়েছে এগুলোকে স্বাধীনভাবে ভোগ-ব্যবহার করার। নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার এবং নিজের আমল ও আচরণে এক সুষ্ঠ নিয়ম-শৃংখলা বজায় রাখার জন্যে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে সে নিজেই বিধি-নিষেধ আরোপ করে নিয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক দিক দিয়ে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং এ ব্যাপারে কোন উচ্চতর সত্তার সামনে জাবাবদিহি করার ধারণাও সম্পূর্ণ অবান্তর।
এই হচ্ছে পার্থিব জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের বিভিন্ন রূপ ধারণা। এর বেশীর ভাগ ধারণার ভিত্তিতেই বিভিন্ন রূপ সংস্কৃতির ইমারত গড়ে উঠেছে। বস্তুর বিভিন্ন সংস্কৃতির ইমারতে যে বিভিন্ন ধরন ও প্রকৃতি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তাদের এক বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্ররূপ গ্রহণের প্রকৃত কারণ এই যে, তাদের মূলে রয়েছে পার্থিব জীবন সম্পর্কে এক বিশেষ ধারণা। এই ধারণাই এই বিশিষ্ট রূপ গ্রহণের দাবী জানিয়ে থাকে। আমরা যদি এর প্রত্যেকটি বিস্তৃতভাবে পর্যালোচনা করে কিভাবে এটা এক বিশেষ ধরনের সংস্কৃতির জন্ম দিল তা অনুসন্ধান করি, তবে তা হবে নিসন্দেহে এক মনোজ্ঞ আলোচনা। কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে এরূপ আলোচনার কোন সম্পর্ক নেই। কারণ আমরা চাই শুধু ইসলামী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টরূপে তুলে ধরা।আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, জীবন সম্পর্কে যতগুলো ধারণা ইতিপূর্বে বিবৃত হয়েছে, তার সবই দুনিয়াকে এক একটি বিশেষ দিক থেকে দেখার ফলমাত্র। এর কোন এটি মতবাদ ও সামগ্রিকভাবে সমস্ত বিশ্বজাহানের ওপর পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে এবং এই দুনিয়ায় সবকিছুর মধ্যে সঠিক মর্যাদা নিরূপণ করার পর গড়ে উঠেনি। এ কারণেই আমরা যখন কোন বিশেষ দৃষ্টিকোণ বর্জন করে অন্য কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দুনিয়াকে নিরীক্ষন করি, তখণ প্রথমোক্ত দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মতবাদটি বাতিল ও ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়। আর দুনিয়ার প্রতি সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করলে তো সকল মতবাদের ভ্রান্তিই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ইসলামী ধারণার বৈশিষ্ট্য:
এখন অতি সুন্দরভাবে উপলদ্ধি করা যেতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মতবাদের মধ্যে ইসলামী মতবাদই হচ্ছে প্রকৃতি ও বাস্তব সত্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল। একমাত্র এই মতবাদেই দুনিয়া এবং মানুষের মধ্যে এক নির্ভুল সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। এর ভেতরেই আমরা দেখতে পাইঃ দুনিয়া কোন ঘৃণ্য বা বর্জনীয় জিনিস নয়, অথবা মানুষ এর প্রতি আসক্ত হবে এবং এর আনন্দ উপকরণের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে, এ এমন কোন জিনিসও নয়। এখানে না পুরোপুরি গঠন ক্রিয়া চলছে, আর না চলছে এক তরফা বিপর্যয়। একে পরিহার করা যেমন সংগত নয়, তেমনি এর ভেতরে পুরোপুরি ডুবে থাকাও সমীচীন নয়। না সে পুরোপুরি পংকিল ও অপবিত্র, আর না তার সবটাই পবিত্র ও পংকিলতা মুক্ত। এই দুনিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ক আপন রাজত্বের সাথে কোন বাদশাহর সম্পর্কের মতোও নয়। কিংবা জেলখানার সাথে কয়েদীর যে সম্পর্ক সেরূপ সম্পর্ক সেরূপ সম্পর্কও নয়। মানুষ এতটা তুচ্ছ নয় যে, দুনিয়ার যে কোন শক্তিই তার সেজদার উপযোগী হবে অথবা সে এতখানি শক্তিধর ও ক্ষমতাবানও নয় যে দুনিয়ার প্রতিটি জিনিসের কাছ থেকেই সে সেজদা লাভ করবে। না সে এতটা অক্ষম ও অসহায় যে, তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা- অভিপ্রায়ের কোন মূল্যই নেই, আর না সে এতখানি শক্তিমান যে, তার ইচ্ছা প্রবৃত্তিই সবকিছুর উর্ধে। সে যেমন বিশ্বপ্রকৃতির একচ্ছত্র সম্রাট নয়, তেমনি কোটি কোটি মনিবের অসহায় গোলামও নয়। এই চরম প্রান্তগুলোরই মধ্যবর্তী এক অবস্থায় তার প্রকৃত স্থান।
এ পর্যন্ত তো প্রকৃতি ও সুষ্ঠ বিবেক আমাদের পথনির্দেশ করে। কিন্তু ইসলাম আরো সামনে এগিয়ে মানুষের যথার্থ মর্যাদা কি তা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করে দেয়। সে বলে দেয়ঃ মানুষ এবং দুনিয়ার মধ্যে কি ধরনের সম্পর্ক বিদ্যমান? মানুষ দুনিয়াকে ভোগ ব্যবহার করবে কি ভেবে? সে এই বলে মানুষের চোখ খুলে দেয় যে, তুমি অন্যান্য সৃষ্টির মত নও। বরং তুমি দুনিয়ায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি (Viceroy)। দুনিয়া ও তার শক্তিগুলোকে তোমারই অধীন করে দেয়া হয়েছে। তুমি সবার শাসক, কিন্তু একজনের শাসিত; সকলের প্রতি আজ্ঞাকারী, শুধু একজনের আজ্ঞানুবর্তী। সমগ্র সৃষ্টির ওপরে তোমার সম্মান, কিন্তু যিনি তোমায় প্রতিনিধিত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে দুনিয়ায় এ সম্মান দান করেছেন, তুমি যখন তার অধীন ও আজ্ঞানুবর্তী হবে এবং তাঁর দেয়া বিধি-বিধানের আনুগত্য করে চলবে কেবল তখনি তুমি এ সম্মানের অধিকারী হতে পারো। দুনিয়ায় তোমায় পাঠানো হয়েছে এই জন্যে যে, তুমি তাকে ভোগ-ব্যবহার করবে। তারপর এই দুনিয়ার জীবনে তুমি ভালো-মন্দ বা শুদ্ধ-অশুদ্ধ যা কিছুই কাজ করো না কেন, তার ভিত্তিতেই তুমি পরকালীন জীবনে ভাল বা মন্দ দেখতে পাবে। সুতরাং দুনিয়ায় এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে তোমার ভেতরে হামেশা ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত থাকা উচিত এবং যে বস্তুগুলোকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে তোমার কাছে আমানত রেখেছেন, তার প্রতিটি জিনিস সম্পর্কেই পুংখানুপুংখ হিসেব গ্রহণ করা হবে- একথাটি মুহূর্তের তরেও বিস্মৃত না হওয়া উচিত।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই ধারণাটি বিস্তৃত ও পুংখানুপংখরূপে প্রত্যেক মুসলমানের মনে জাগরুক নেই। এমন কি, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ অংশ ছাড়া আর কেউ এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণাও পোষণ করে না। কিন্তু এই ধারণাটি যেহেতু ইসলামী সংস্কৃতির মর্মমূলে নিহিত রয়েছে, এ জন্যেই মুসলমানের চরিত্র তার প্রকৃত মর্যাদা ও যথার্থ বৈশিষ্ঠ্য থেকে অনেক দূরে সরে গেলেও আজো তারা তার প্রভাব থেকে একেবারে মুক্ত হয়নি। যে মুসলমান ইসলামী সংস্কৃতির আওতায় প্রতিপালিত হয়েছে, তার আচরণ ও কাজ-কর্ম বাইরের প্রভাবে যত নিকৃষ্ট হয়ে থাক না কেন, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান বোধ, আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নত না করা, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় না করা, আল্লাহ ভিন্ন আর কাউকে মালিক ও মনিব না ভাবা, দুনিয়ায় নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্বশীল মনে করা, দুনিয়াকে কাজের ক্ষেত্র এবং পরকালকে প্রতিফলের ক্ষেত্র বলে বিশ্বাস করা, নিছক ব্যক্তিগত আমলের উৎকর্ষ-অপকর্ষের ওপর পরকালীন সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভরশীল বলে ধারণা পোষণ করা, দুনিয়া এবং তার দউলত ও ভোগ উপকরণকে অস্থায়ী ও শুধু ব্যক্তিগত আমল ও তার ফলাফলকে চিরস্থায়ী মনে করা-এই জিনিসগুলো তার প্রতিটি ধমনীতে অনুপ্রবিষ্ট হবেই। আর একজন সূক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি তার কথাবার্তা ও কর্মতৎপরতার ভেতর তার আত্মা ও হৃদয়ের গভীরে বদ্ধমূল ঐ আকিদা ও বিশ্বাসের প্রভাব (তা যতোই ক্ষীণ হোক না কেন) অনুভব করবেই।
ইসলামী সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে কোন ব্যক্তি এ সত্যটি স্পষ্টত উপলব্ধি করতে পারবে যে, এর ভেতরে যতদিন পূর্ণাঙ্গ অর্থে সত্যিকার ইসলাম বর্তমান ছিলো, ততদিন এ একটি নির্ভেজাল বাস্তব সংস্কৃতি ছিলো। এর অনুবর্তীদের কাছে দুনিয়া ছিল আখেরাতেরই ক্ষেত্রস্বরূপ। তারা দুনিয়াবী জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকে এই ক্ষেত্রটির চাষাবাদ, বীজ বপন ইত্যাদি কাজে ব্যয় করারই চেষ্টা করতো, যাতে করে পরকালীন জীবনে বেশী পরিমাণে ফসল পাওয়া যেতে পারে। তারা বৈরাগ্যবাদ ও ভোগবাদের মধ্যবর্তী এমন এক সুষম ভারসান্যপূর্ণ অবস্থায় দুনিয়াকে ভোগ-ব্যবহার করতো, অন্য কোন সংস্কৃতিতে যার নাম-নিশানা পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। আল্লাহর খেলাফতের ধারণা তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে পুরোপুরি লিপ্ত হতে এবং তার কায়-কারবারকে পূর্ণ তৎপরতার সাথে আঞ্জাম দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করতো এবং সেই সঙ্গে দায়িত্ববোধ এবং জবাবদিহির অনুভূতি তাদেরকে কখনো সীমা অতিক্রম করতে দিত না। তাঁরা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে খুবই আত্ম-মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ছিলেন। আবার এই ধারণাই তাদেরকে দাম্ভিক ও অহংকারী হতে বিরত রাখতো। তাঁরা সুষ্ঠুভাবে খেলাফতের দায়িত্ব সম্পাদনের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রতিটি পার্থিব জিনিসের প্রতিই অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে যে সকল জিনিস দুনিয়ার ভোগাড়ম্বরে আচ্ছন্ন করে মানুষকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে ভুলিয়ে রাখে তার প্রতি তাদের কোনই আসক্তি ছিল না। মোটকথা, দুনিয়ার কায়-কারবার তাঁরা এভাবে সম্পাদন করতো, যেন এখানে তাঁরা চিরদিন থাকবেন না, আবার এর ভোগাড়ম্বরে মশগুল হওয়া থেকে এই ভেবে বিরত থাকতেন, যেন এ দুনিয়া তাদের জন্য এক পান্থশালা, সাময়িক কিছুদিনের জন্যেই তাঁরা এখানে বসতিস্থাপন করেছেন মাত্র।
পরবর্তীকালে ইসলামের প্রভাব হ্রাস এবং অন্যান্য সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় মুসলমানদের চরিত্রে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বৈশিষ্ট্য আর বাকী থাকল না। এর ফলে তারা পার্থিব জীবন সম্পর্কে ইসলামী ধারণার যা কিছু বিপরীত তার সব কাজই করলো। তারা বিলাশ-ব্যসনে লিপ্ত হলো। বিশাল ইমারত নির্মাণ করলো। সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং চারুকলার প্রতি আকৃষ্ট হলো। সামাজিকতা ও আচার-পদ্ধতিতে ইসলামী রুচির সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যয়-বাহুল্য ও আড়ম্বরে তারা অভ্যস্ত হলো। রাষ্ট্র শাসন ও রাজনীতি এবং অন্যান্য বৈষয়িক ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ অনৈসলামী পন্থা অনুসরণ করলো। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও তাদের হৃদয়ে দুনিয়াবী জীবন সম্পর্কে যে ইসলামী ধারণা বদ্ধমূল হয়ে ছিলো, কোথাও না কোথাও তার স্পষ্ট প্রভাব প্রতিভাত হতো। আর এ প্রভাবই অন্যান্যদের মোকাবিলায় তাদের এক বিশেষ মর্যাদা দান করতো। জনৈক মুসলমান বাদশাহ যমুনার তীরে এক বিশাল ইমারত নির্মাণ করেন এবং তার ভেতর আমোদ প্রমোদ ও জাক-জমকের এমন সব আয়োজনই করেন, যা তখনকার দিনে ছিলো অচিন্তনীয়। কিন্তু সেই ইমারতের সবচেয়ে আনন্দদায়ক প্রমোদ কেন্দ্রটির পিছন দিকে (অর্থাৎ কেবলার দিকে) এই কবিতাটি খোদাই করা হয়ঃ
“তোমার পায়ে বন্ধন, তোমার দিল তালাবদ্ধ,
চক্ষুযুগল অগ্নিদগ্ধ আর পদযুগল কণ্টকে ক্ষতবিক্ষত;
ইচ্ছা তোমার পাশ্চিমে সফর করার
অথচ চলেছ পূর্বমুখী হয়ে,
পশ্চাতে মঞ্জিল রেখে কে তুমি চলেছো
এখনো সতর্ক হও।”
সে প্রাসাদটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে অতুলনীয় ছিল না। তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রাসাদ দুনিয়ার অন্যান্য জাতির মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু দুনিয়ার বুকে বেহেশত নির্মাণকারীদেরকে ‘পশ্চাতে মঞ্জিল রেখে কে তুমি চলেছো অনিশ্চিতের দিকে সতর্ক হও’ বলে সতর্ক করে দেয়, এমনি চিন্তাধারার নজির দুনিয়ার আর কোন জাতির মধ্যে পাওয়া যাবে না।১
১. এ হচ্ছে দিল্লীর লাল কেল্লার কথা।
কাইসার ও কিসরার ধরনের বাদশাহী পরিচালনাকারীগণও কোন শত্রুকে পরাজিত করে শক্তির অহমিকা প্রকাশ করার পরিবর্তে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে সেজদায় ভূলুণ্ঠিত হয়েছেন, ইসলামী ইতিহাসে এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। বড়ো বড়ো অত্যাচারী ও উদ্ধত শাসকরা ইসলামী শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ করতে চাইলে কোন আল্লাহর বান্দাই তাদেরকে মুখের উপর শাসিয়ে দেন এবং তার ফলে তারা আল্লাহর ভয়ে কেঁপে ওঠেন। নিতান্ত দুষ্কৃতিকারী ও কদাচারী ব্যক্তিগণও কোন একটি মামুলি কথায় সচেতন হয়ে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনের রঙ বদলে যায়। পার্থিব ধন দৌলতের প্রতি মোহগ্রস্ত ব্যক্তিদের মনে দুনিয়ার অস্থায়িত্ব এবং আখেরাতের জিজ্ঞাসাবাদের চিন্তা জাগলো আর অমনি তারা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে সবকিছু বিলিবণ্টন করে দিয়ে এক মধ্যমপন্থী আদর্শ জীবন অবলম্বন করেছেন। মোটকথা, মুসলমানদের জীবনে যতো অনৈসলামী প্রভাবই বিস্তার লাভ করুক না কেন, তাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি দিকেই ইসলামী মতবাদের দীপ্তি কোন না কোন কোনরূপে আপনার দৃষ্টিগোচর হবেই। আর এটা দেখে আপনার মনে হবে, যেন অন্ধকারের মধ্যে সহসা আলোর প্রকাশ ঘটেছে।