৫.
রসূলের প্রতি ঈমান
নবুওয়াতের তাৎপর্য
তাওহীদের পর ইসলামের দ্বিতীয় মৌল বিশ্বাস হচ্ছে ‘নবুওয়াত’ (রিসালাত)। যেরুপ প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে তাওহীদ হচ্ছে প্রকৃত দ্বীন, তেমনি আনুগত্যের ক্ষেত্রে নবুওয়াত হচ্ছে প্রকৃত দ্বীন। নবুওয়াত (রিসালাত)-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পয়গম্বরি বা বার্তাবাহক। যে ব্যক্তি একজনের বাণী অন্যজনের কাছে নিয়ে পৌছায়, তাকে বলা হয় নবী (রসূল) বা বাণী বাহক। কিন্তু ইসলামী পরিভাষায় নবী বলা হয় তাঁকে, যিনি আল্লাহর বাণী তাঁর বান্দাদের কাছে নিয়ে পৌছান এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তাদেরকে সৎপথে চালিত করেন। এ কারণেই কুরআনে নবী বা রসূলের জন্যে ‘পথপ্রদর্শক’(আরবী******) শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি শুধু বাণীই পৌছান না, লোকদেরকে সহজ-সরল পথেও চালিত করেন।
আল্লাহর একজন দিশারী তো মানুষের মনের ভেতরই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সে খোদায়ী ইলহামের আলোকে ভালো ও মন্দ চিন্তাধারা এবং ভ্রান্ত ও সঠিক কর্মধারার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে মানুষকে চিন্তা ও কর্মের সরল পথ দেখিয়ে থাকে। যেমন বলা হয়েছেঃ
(আরবী************)
“মানব প্রকৃতির এবং সেই সত্তার শপথ যিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন। পরে তার পাপ ও তার পরহেযগারী তার প্রতি ইলহাম করেছেন। নিসন্দেহে কল্যাণ পেল সে, যে নিজের নফসের পবিত্রতা বিধান করল এবং ব্যর্থ হলো সে, যে তাকে দমন করলো।” –(সূরা আশ শামস : ৭-১০)
কিন্তু এ দিশারীর নির্দেশ যেহেতু সুস্পষ্ট নয়, বরং মানুষকে মন্দ কাজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্যে তার সাথে আরো বহু মানসিক ও বাহ্যিক শক্তিনিচয় জড়িত হয়ে আছে এবং সেহেতু দুনিয়ার অসংখ্য বাঁকা পথের মধ্য থেকে সত্যের সোজা পথ বের করার এবং সে পথে নির্ভয়ে চলার ব্যাপারে ঐ স্বাভাবিক দিশারীর একক নির্দেশ মানুষের পক্ষে যথেষ্ট হতে পারে না। এ কারণেই আল্লাহর তায়ালা বাহির থেকে এ অভাব পূরণ করে দিয়েছেন। এবং মানুষের কাছে তাঁর পয়গম্বর পাঠিয়েছেন, যাতে করে তাঁরা খোদায়ী জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে এ অন্তর্নিহিত দিশারীর সাহায্য করতে পারেন। এবং অস্পষ্ট স্বাভাবিক ইলহামের প্রভা অজ্ঞানতা ও বিভ্রান্তিকর শক্তির চাপে নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তাকে উজ্জ্বল নিদর্শনাবলীর সাহায্যে সুস্পষ্ট করে তোলেন।
এটাই হচ্ছে নবুওয়াতের মর্যাদার আসল ভিত্তি। যাঁরা এ মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন, তাঁদেরকে আল্লাহর তায়ালা এক অসাধারণ জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি দান করেছেন। তার সাহায্যে তাঁরা কোন আন্দাজ-অনুমান ও কল্পনার ভিত্তিতে নয়, বরং নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে এমন সব বিষয়ের তাৎপর্য পরিজ্ঞাত হয়েছেন, যে ব্যাপারে সাধারণ লোকেরা মতানৈক পোষণ করে থাকে। পরন্তু এ অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে তারা দুনিয়ার বাঁকা পথগুলোর মধ্য থেকে সত্যের সোজা ও স্বচ্ছ পথটিও নির্ভুলভাবে চিনে নিয়েছেন।
নবী এবং সাধারণ নেতাদের মধ্যে পার্থক্য
বাহ্যিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সকল যুগেই মানুষ স্বীকার করে নিয়েছে। এ দাবি কেউ কখনো করেনি যে, মানুষের জন্যে শুধু তার অন্তর্নিহিত দিশারীর নির্দেশই যথেষ্ট। বাপ-দাদা, বংশ-গোত্র ও জাতির সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ, শিক্ষক পন্ডিত, ধর্মগুরু, রাজনৈতিক নেতা, সমাজ সংস্কারক এবং এ ধরনের অন্য যেসব লোকের বুদ্ধিমত্তা নির্ভরযোগ্য মনে হতো, তারা হামেশাই দিশারীর মর্যাদার লাভ করতেন এবং তাঁদের অনুসরণও করা হতো। কিন্তু যে জিনিসটি এক নবীকে অন্যান্য নেতাদের ওপর বিশিষ্টতা দান করে, তা হচ্ছে ‘খোদায়ী জ্ঞান’। অন্যান্য নেতাদের কাছে খোদায়ী জ্ঞান নেই। তারা শুধু আন্দাজ-অনুমান ও কল্পনার ভিত্তিতেই মত পোষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাদের এ মতামত ও সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রবৃত্তির লালসাও শামিল হয়ে পড়ে। এ কারণেই তারা যে প্রত্যয় ও কানুন তৈরি করেন, তার মধ্যে সত্য ও মিথ্যা উভয়েরই ভেজাল থাকে। তাদের নির্ধারিত পন্থায় কখনো পুরোপুরি সত্য থাকে না। এ নিগূঢ় সত্যের দিকেই কুরআন বরাবর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেঃ
(আরবী**********) “তারা যে বস্তুটির অনুসরণ করে, তা নিছক অনুমান এবং প্রবৃত্তির লালসা বৈ কিছুই নয়।” –(সূরা আন নাজম : ২৩)
“তাদের কাছে কোন সত্যিকার জ্ঞান নেই, তারা শুধু আন্দাজ-অনুমানের পায়রুবি করে চলে। আর অনুমানের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তা সত্যের প্রয়োজনকে কিছুমাত্র পূরণ করে না।” –(সূরা আন নজমঃ২৮)
(আরবী**************)
“কিন্তু যালেমরা কোনরুপ জ্ঞান ছাড়াই তাদের প্রবৃত্তির লালসার অনুসরণ করলো।” –(সূরা আর রুমঃ ২৯)
(আরবী**************)
“লোকদের মধ্যে কেউ এমন আছে যে, অহংকারের সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আল্লাহর সম্পর্কে কোনরুপ জ্ঞান, হেদায়াত ও উজ্জ্বর কিতাব ছাড়াই তর্ক করে, যাতে করে (লোকদেরকে) আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে।” –(সূরা আল হাজ্জ : ৮-৯)
(আরবী************)
“তাঁর চেয়ে বড়ো পথভ্রষ্ট আর কে আছে, যে আল্লাহর কাছ থেকে আগত হেদায়াতের পরিবর্তে আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো।”
পক্ষান্তরে নবী বা রসূলকে আল্লাহর তরফ থেকে ‘জ্ঞান’ দান করা হয়। তাঁর নেতৃত্ব অনুমান ও প্রবৃত্তির লালসার দ্বারা চালিত হয় না, বরং তিনি আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের আলোকে যে সোজা পথটি স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট দেখতে পান সেদিকে মানুষকে চালিত করেন। তাই কুরআনে যেখানেই নবীগণকে ‘পয়গম্বরির’ (রিসালাত) মর্যাদায় অভিষিক্ত করার কথা উল্লেখিত হয়েছে, সেখানে একথাও বলা হয়েছে যে, তাদেরকে ‘জ্ঞান’ দান করা হয়েছে। উদাহরণত হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর দ্বারা নবুওয়াতের ঘোষণা করানো হয়েছে নিম্নরুপঃ
(আরবী*************)
“হে প্রিয় পিতা! বিশ্বাস করো, আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে, যা তোমার কাছে আসেনি। সুতরাং তুমি আমার অনুসরণ করো, আমি তোমায় সোজা পথে চালিত করবো।” –(সূরা মরিয়ম : ৪৩)
হযরত লূত (আ)-কে নবুওয়াত দানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এভাবেঃ
(আরবী**************)
“লূতকে আমরা বিচার শক্তি ও জ্ঞান দান করেছি।” –(সূরা আম্বিয়াঃ ৭৪)
হযরত মূসা (আ) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছেঃ
(আরবী**************)
“তিনি যখন পূর্ণ যৌবনে উপনীত হন এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠেন, তখন আমরা তাকে বিচার শক্তি ও জ্ঞান দান করলাম।” –(সূরা কাসাসঃ ২)
হযরত দাউদ (আ) ও সোলাইমান (আ)-এর নবুওয়াতি প্রাপ্তির কথাও এভাবেই উল্লেখিত হয়েছেঃ
(আরবী**************)
“তাদের প্রত্যেকেই আমরা হেকমত ও জ্ঞান দান করেছি।”
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**************)
“তুমি যদি জ্ঞান লাভের পরও তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহর কাছ থেকে তোমাকে রক্ষাকারী আর কোন সমর্থক ও সাহায্যকারী থাকবে না।” –(সূরা আল বাকারাঃ ১২০)
পয়গম্বরির মর্যাদাঃ এবং সাধারণ নেতাদের মুকাবিলায় পয়গম্বরের শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাতের পর এবার পয়গম্বরি সম্পর্কে কুরআনের পেশকৃত নীতিগত বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত।
আল্লাহর প্রতি ঈমান ও নবীর প্রতি ঈমানের সম্পর্ক
সর্বপ্রথম কথা হলো এই যে, নবীর কাছে যখন এক অসাধারণ জ্ঞানের মাধ্যম রয়েছে এবং আল্লাহর তরফ থেকে তাঁকে অসামান্য অন্তর্দৃষ্টি দান করা হয়েছে, তখন আল্লাহর সম্পর্কে একমাত্র তাঁর পেশকৃত বিশ্বাসই নির্ভুল হতে পারে। কোন ব্যক্তি যদি নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা কিংবা অন্যান্য বিজ্ঞানী দার্শনিকদের ভিত্তিতে কোন বিশ্বাস নির্ধারণ করে, তবে আল্লাহর সম্পর্কে তার প্রত্যয় শুধু যে নির্ভুল হবে না তাই নয়, বরং দ্বীনের মৌল বিষয় সংক্রান্ত এবং সাধারণ মানবীয় বিচার-বুদ্ধির সীমা বহির্ভূত অতি প্রাকৃতিক বিষয় সম্পর্কেও কোন যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে না। ফলকথা ঈমান ও প্রত্যয়ের সুষ্ঠুতা নির্ভর করে সম্পূর্ণরুপে নবীর প্রতি ঈমানের ওপর। এ সম্পর্ক সূত্র ছিন্ন করে চিন্তার পাত্রকে নির্ভুল জ্ঞানের দ্বারা পূর্ণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এ কারণেই কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় নবীর প্রতি ঈমানের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী**************)
“কতো জনপদ তাদের প্রভু এবং তাঁর নবীদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করাতে আমরা তাদের কাছ থেকে কঠিন হিসেব গ্রহণ করেছি। এবং তাদেরকে বড়ো বড়ো শাস্তি দান করেছি, এর দ্বারা তারা নিজেদের কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করেছে। আর শেষ পর্যন্ত তাদের পরিণাম হয়েছে অমঙ্গলজনক।” –(সূরা আত ত্বালাক : ৮-৯)
(আরবী**************)
“যে ব্যক্তি আল্লাহর এবং রসূলের সাথে কুফরী করে এবং আল্লাহর ও তাঁর রসূলের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির করতে চায় এবং বলে যে, আমরা কাউকে মানবো আর কাউকে অস্বীকার করবো আর তার মধ্য থেকে কোন পথ বের করে নিতে ইচ্ছুক, সে নিশ্চিতভাবে কাফের। আর কাফেরদের জন্যে আমরা এক অপমানকর আযাবের ব্যবস্থা করে রেখেছি। যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর রসূলের প্রতি এবং তাদের কারো মধ্যে তারা পার্থক্য সৃষ্টি করেনি, তাদেরকে শীঘ্রই আল্লাহর তায়ালা তাদের প্রতিফল দান করবেন। আল্লাহর বড়োই ক্ষমাশীল ও দায়াময়।” –(সূরা আন নিসা : ১৫০-১৫২)
(আরবী*************)
“যে ব্যক্তি হেদায়াত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠার পরও রসূলের সাথে তর্ক করে এবং ঈমানদার লোকদের পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে, তাকে আমরা সেই পথেই ফিরিয়ে দেবো, যে পথে সে নিজে ফিরে গিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেবো; আর এটা অত্যন্ত খারাপ জায়গা।” – (সুরা আন নিসা: ১১৫)
এ ধরনের অসংখ্য আয়াতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও রসূলের প্রতি ঈমানের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। যে ব্যক্তি আল্লাহর নবীদের অস্বীকার করে এবং তাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে চায়না, সে আল্লাহ কে মানুক বা না মানুক উভয় অবস্থায়ই তার গোমরাহী সমান। কারণ প্রকৃত জ্ঞান ছাড়া আল্লাহ সম্পর্কে যে বিশ্বাস গঠন করা হবে, তা তাওহীদি বিশ্বাস হলেও কদাচিৎ নির্ভুল ও নির্ভেজাল হতে পারেনা।
কালেমার ঐক্য
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, কেবল নবীর প্রতি ঈমানই গোটা মানবজাতিকে একটি বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। মতানৈক্যের ভিত্তি হচ্ছে আসলে অজ্ঞানতা। লোকেরা কোন জিনিসের তাত্পর্য অবহিত না হলে, নিছক অনুমানের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং তার ফলে স্বভাবতই তাদের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হবে। কারণ অনুমান ও কল্পনার সাহায্যে সিধান্ত গ্রহণ করাটা হচ্ছে অন্ধকারে হাতড়ানোর মতো। কোথাও আলো না থাকলে পঞ্চাশ ব্যক্তি একটি জিনিসকে হাতড়িয়ে দেখে পঞ্চাশ রূপ বিভিন্ন মত প্রকাশ করবে। কিন্তু আলো আসার পর আর কোন মতানৈক্য বাকি থাকবে না, বরং সকল চক্ষুস্মান ব্যক্তি একই বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছবে। সুতরাং নবীগণকে যখন অলৌকিক জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা অলংকৃত করা হয়েছে তখন তাদের ধারণা, শিক্ষা ও কর্মপন্থায় মতানৈক্যের সৃষ্টি হওয়া মোটেই সম্ভবপর নয়। এ কারণেই কুরআন বলেছে যে, সমস্ত নবীই একই দলভুক্ত; সবার শিক্ষা ও দ্বীন মূলত একই। একই ছিরাতুল মুস্তাকিমের দিকে সবাই আহ্বান জানিয়েছেন। আর মু’মিনের জন্যে সবার প্রতি ঈমান আনাই আবশ্যক। যে ব্যক্তি নবীদের মধ্য থেকে কোন একজন নবীকেও অস্বীকার করবে, সে সকল নবীর প্রতি অস্বীকৃতির অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে। এবং তার অন্তরে ঈমানের চিহ্নমাত্র বাকি থাকবেনা। কারণ যে শিক্ষাকে সে অস্বীকার করছে তা শুধু একজন নবীরই শিক্ষা নয়, বরং তা সমস্ত নবীরই শিক্ষা।
****************
“(আল্লাহ নবীদের বললেন;) হে নবীগণ! পবিত্র জিনিস থেকে খাও এবং সৎকাজ করো, তোমরা মূলত একই দলভুক্ত আর আমি তোমাদের প্রভু। সুতরাং তোমরা আমায় ভয় করে চলো। কিন্তু পরবর্তীকালে লোকেরা পরস্পরে মতানৈক্য করে নিজেদের ধর্মকে আলাদা-আলাদা করে নিয়েছে। আর এখন অবস্থা এই যে, যাদের কাছে যা রয়েছে তা নিয়েই তারা আনন্দিত।” -(সুরা আল মু’মিনুন: ৫১-৫৩)
*************
“হে মুহাম্মদ! আমরা সেভাবে তোমার প্রতি অহী নাযিল করেছি, যেভাবে নূহ এবং পরবর্তী নবীদের প্রতি নাযিল করেছিলাম। আর সেভাবে আমরা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব, ইয়াকুব খান্দান, ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন এবং সোলায়মানের প্রতি অহী প্রেরণ করেছি এবং দাউদকে জবুর দান করেছি। আর আমরাই সে সব নবীকে প্রেরণ করেছি, যাদের কথা ইতিপূর্বে তোমাদের বলেছি এবং সে সব নবীকেও, যাদের কথা তোমাদের বলিনি। আর তোমাদের পূর্বে আল্লাহ তায়ালা মূসার সাথেও কথা বলেছেন।” -(সুরা আন নিসা: ১৬৩-১৬৪)
এ ধরনের বহু আয়াত থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত নবী একই সত্য দ্বীনের দিকে লোকদের আহ্বান জানাতে এসেছিলেন এবং প্রত্যেক কওমের কাছেই তারা প্রেরিত হয়েছেন।
************
এদের মধ্যে যেসব নবীর কথা কুরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি স্পষ্টভাবে ঈমান থাকা আবশ্যক। আর যেসব নবীদের নাম আমাদের বলা হয়নি তাঁদের সম্পর্কে সঠিক প্রত্যয় হচ্ছে এই যে, তাঁরা সবাই ইসলামেরই আহ্বায়ক ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন জাতি তাদের শিক্ষাকে বদলে নিয়েছে এবং পরস্পরে মতানৈক্য করে নিজেদের জন্যে পৃথক পৃথক ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। আমরা বৌদ্ধ, কৃষ্ণ, জরদশত, কনফুসস প্রমুখকে এজন্যই নবী বলতে পারিনা যে, তাঁদের সম্পর্কে কুরআনে স্পষ্টত কিছু উল্লেখ নেই। কিন্তু আমাদের প্রত্যয় হচ্ছে এই যে, ভারত, চীন, জাপান, ইরান, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং অন্যান্য সমস্ত দেশেই আল্লাহর নবীরা এসেছেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর ন্যায় একই ইসলামের দিকে সবাই আহ্বান জানিয়েছেন। সুতরাং আমরা কোন জাতির ধর্মগুরুকে মিথ্যা সাব্যস্ত করতে চাইনা, বরং ইসলামের ছিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত ভ্রান্ত মত ও পথ আজ দুনিয়ায় প্রচলিত, আমরা কেবল সেগুলোকেই অস্বীকার করি।
নবীর আনুগত্য ও অনুসরণ
নবুওয়াত বিশ্বাসের অনিবার্য ফল হচ্ছে এই যে, শুধু ঈমান ও ইবাদাতের ব্যাপারেই নয়, জীবনের সকল বাস্তব ক্ষেত্রেই আল্লাহর রসূলের অনুসৃত পন্থার অনুসরণ করতে হবে। কারণ আল্লাহ যে ‘জ্ঞান’ ও ‘অন্তর্দৃষ্টি’ দ্বারা তাঁদেরকে সম্মানিত করেছিলেন তা দ্বারা ভ্রান্ত ও যথার্থ পন্থাগুলোর পার্থক্য তাঁরা সুনিশ্চিত ভাবেই জানতে পারতেন। এ কারনেই তাঁরা যা কিছু বর্জন বা গ্রহণ করতেন এবং যা কিছু নির্দেশ দিতেন, তা সবই করতেন আল্লাহর ইঙ্গিতে। সাধারন মানুষ বছরের পর বছর, এমন কি যুগের পর যুগ অভিজ্ঞতা লাভ করেও ভ্রান্তি ও যথার্থের পার্থক্য সৃষ্টিতে পুরোপুরি সফলকাম হতে পারতো না, আর কিছুটা সাফল্য অর্জিত হলেও, তা অকাট্য বিশ্বাসের দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতো না, বরং তা নিছক অনুমান ও অনুসন্ধানের ওপর নির্ভরশীল হতো এবং তাতে বিভ্রান্তির আশংকা অবশ্যই থেকে যেতো। পক্ষান্তরে আল্লাহর নবীগণ জীবনের ক্রিয়াকান্ডে যে পন্থা অবলম্বন করেছেন এবং যে পথে চলার শিক্ষা দিয়েছেন, তা করেছিলেন জ্ঞানের ভিত্তিতে। এজন্যেই তাতে ভ্রান্তির কোন সম্ভাবনা নেই। আর এ কারনেই কুরআন মজীদ বার বার নবীদের আনুগত্য এবং তাঁদের অনুসরণ করার নির্দেশ দিচ্ছে। তাদের অনুসৃত পন্থাকে শরীয়ত, সোজাপথ ও ছিরাতে মুস্তাকীম বলে অভিহিত করছে। এবং অন্যান্য মানুষের আনুগত্য বর্জন করে কেবল নবীদেরই আনুগত্য করার এবং তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণের তাকিদ করছে। কারণ তাঁদের আনুগত্য হচ্ছে ঠিক আল্লাহরই আনুগত্য এবং তাদের অনুসরণ হচ্ছে খোদায়ী ইচ্ছার অনুসরণ।
****************
“আমরা যে নবী পাঠিয়েছি, কেবল আল্লাহর নির্দেশে তাঁর আনুগত্য করার জন্যই পাঠিয়েছি।”-(সুরা আন নিসা: ৬৪)
***************
“যে ব্যক্তি নবীর আনুগত্য করলো, সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো।” -(সূরা আন নিসাঃ ৮০)
**************
“হে মুহাম্মদ! বলে দাও: তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসতে চাও তাহলে আমার আনুগত্য করো। (তাহলে) আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী। (লোকদের) বলো, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করো, এরপরও যদি তারা পাশকাটিয়ে যায়, তবে নিশ্চিত জেনো- আল্লাহ কাফেরদের পছন্দ করেন না”। -(সুরা আল ইমরান: ৩১-৩২)
****************
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের আনুগত্য করো, আর তোমরা যখন তাঁর নির্দেশ শুনছ তখন তাঁর থেকে পাশ কাটিয়ে যেয়োনা। তোমরা এমন লোকদের মতো হয়োনা, যারা বলে যে, ‘আমরা শুনেছি’ অথচ তারা কিছুই শুনেনা। আল্লাহর কাছে তারাই হচ্ছে নিকৃষ্টতম পশু, যারা কিছুই বোঝেনা।” -(সুরা আল আনফাল: ২০-২২)
****************
“কোন বিষয়ে যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল ফয়সালা করে দেন, তখন নিজেদের ব্যাপারে কোন ফয়সালার অধিকার বাকী রাখা কোন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীর জন্যে জায়েজ নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্যতা করলো, সে স্পষ্ট গোমরাহির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হলো।” -(সুরা আল আহযাব: ৩৬)
************
“অতপর তারা যদি তোমার কথা না মানে, তবে জেনে রেখো, তারা শুধু প্রবৃত্তির লালসারই অনুসরণ করে চলছে। আর এমন ব্যক্তির চেয়ে অধিক গোমরাহ আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর নির্দেশ বর্জন করে আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে?” (সুরা আল কাসাস: ৫০)
এরূপ আরো অনেক আয়াতে নবীর আনুগত্য ও অনুসরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পরন্তু সুরায়ে আহযাবে এ বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পস্ট করে বলা হয়েছে যে, যারা আখেরাতের সাফল্য এবং আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার আশা করে, আল্লাহর রসুলের জীবন হচ্ছে তাদের জন্যে এক অনুকরন যোগ্য আদর্শ।
***************
“প্রকৃত পক্ষে তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের জীবনে এক সর্বোত্তম নমুনা বর্তমান ছিল এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি আশাবাদী এবং খুব বেশী করে আল্লাহর স্মরণ করে।” – (সুরা আল আহযাব: ২১)
নবুওয়াত বিশ্বাসের গুরুত্ব
আনুগত্য ও অনুসরণ সংক্রান্ত নির্দেশাবলীর সাথে নবুওয়াত সম্পর্কিত প্রত্যয় হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির প্রাণ, তার জীবনী শক্তি, তার প্রতিষ্ঠা শক্তি এবং তার বিশিষ্ট প্রকৃতির মূল ভিত্তি।
প্রত্যেক সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থায় তিনটি জিনিস মূলভিত্তির কাজ করে। প্রথমত, চিন্তাপদ্ধতি; দ্বিতীয়ত, নৈতিক বিধান এবং তৃতীয়ত, সমাজ বিধান। দুনিয়ার সকল সংস্কৃতিতে এ তিনটি জিনিস তিনটি ভিন্ন উপায়ে সংগৃহীত হয়। চিন্তা পদ্ধতি আহরিত হয় এমন সব চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানীদের শিক্ষা থেকে, যারা কোন না কোন কারনে বড়ো বড়ো মানব গোষ্ঠীর মানসিকতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে বসেছেন। নৈতিক বিধান গ্রহণ করা হয় এমন সব রাষ্ট্রনায়ক, সংস্কারক ও ধর্মনেতার কাছ থেকে, যাঁরা বিভিন্ন যুগে বিশেষ বিশেষ জাতির ওপর কর্তৃত্ব লাভ করেছেন। আর সমাজবিধান প্রনয়ণ করে থাকেন এমন লোকেরা, জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে যাদের দক্ষতা ও নৈপুণ্যের উপর নির্ভর করা হয়।এভাবে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তাতে অনিবার্যরূপে তিনটি মৌলিক ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়:
এক: এ তিনটি ভিন্ন উপায় থেকে যে উপকরণ সংগৃহীত হয়, তা দ্বারা এমন এক বিচিত্রধর্মী মিকচার তৈরী হয় যার মেজাজ প্রতিষ্ঠায় হয়তো বা শতাব্দীকাল চলে যায়। তথাপি তার ভেতরে বহু অসংলগ্নতা, অসমতা ও অসামঞ্জস্যতা বাকি থেকে যায়। দুনিয়ায় বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক অসংখ্য। সবারই চিন্তা পদ্ধতি পৃথক পৃথক এবং পরস্পর থেকে মূলতই ভিন্ন। সাধারণত মানব জীবনের বাস্তব সমস্যাবলীর সাথে এদের কোনরূপ নিবিড় সম্পর্ক থাকে না, বরং এদের অধিকাংশই মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণতার কারণে প্রসিদ্ধ। এহেন উৎস থেকে দুনিয়ার মানুষ তাদের চিন্তা পদ্ধতি আহরণ করে। দ্বিতীয় উপকরণ যে দলটির কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়, তাদের মধ্যেও ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণা, চিন্তাধারা ও মানসিকতার দিক থেকে প্রচুর মতানৈক্য লক্ষ্য করা যায়। এ দলটির মধ্যে যদি কোন বিষয়ে ঐক্য থাকে, তবে তা হচ্ছে এই যে, এর প্রতিটি ব্যক্তিই কল্পনার জগতের অধিবাসী এবং অতিরিক্ত আবেগ ও উচ্ছ্বাস প্রবণতার অনুসারী। নিরেট বাস্তব সমস্যাবলীর সাথে এদের সম্পর্ক খুবই কম। আর তৃতীয় উপাদানটির উৎসও পরস্পর বিভিন্ন, অবশ্য তাদের মধ্যে একটি বিষয়ে ঐক্য রয়েছে, তাহলো এই যে, তাদের ভেতর কোমল অনুভূতি খুবই কম। অতিরিক্ত বাস্তববাদিতা তাদেরকে নিঠুর ও নিরস বানিয়ে দিয়েছে। স্পষ্টত এরূপ বিচিত্র ও পরস্পর বিরোধী উপকরণাদির সঠিক ও সুসম মিশ্রণ খুবই কঠিন ব্যাপার, এবং তাদের অনৈক্য ও বৈপরিত্য নিজস্ব বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল না করে কিছুতেই পারে না।
দুইঃ এ উপায়গুলো থেকে যে তিনটি উপাদান অর্জিত হয়, তাতে যেমন স্থায়িত্বের শক্তি নেই, তেমনি নেই ব্যপকতার যোগ্যতা। বিভিন্ন জাতির ওপর বিভিন্ন চিন্তানায়ক, রাষ্ট্রনেতা ও আইন বেত্তা প্রভাব বিস্তার করে থাকেন এবং তার ফলে তাদের চিন্তা পদ্ধতি, নৈতিক বিধান ও সমাজ বিধানে নীতিগত পার্থক্য সূচিত হয়। পরন্তু একটি জাতির ওপরও প্রথম যুগে যেসব বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনায়ক ও আইন বেত্তা প্রভাব বিস্তার করেন, পরবর্তী যুগগুলোতে তাঁদের প্রভাব বজায় থাকে না, বরং যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব প্রভাব বিস্তারকারী এবং তাঁদের প্রভাবও বদলে যেতে থাকে। এভাবে সংস্কৃতিগুলো এক দিকে জাতীয় রূপ ধারণ করে এবং সেগুলোর বিরোধের ফলে জাতিসমূহের মধ্যে এমন বিরোধের আগুন প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে, যা প্রকৃতপক্ষে শান্তির তৃণরাশিতে অগ্নি সংযোগকারী বিদ্যুৎ শলাকা তুল্য। অন্যদিকে প্রত্যেক জাতির স্বতন্ত্র তাহজিব ও তমদ্দুন স্থায়ীভাবে এক টলটলায়মান অবস্থার মধ্যে থাকে এবং একটি সুনির্দিষ্ট পথে বিকাশ লাভ করার পরিবর্তে কখনো বিবর্তনের দিকে, কখনো বিপ্লবের দিকে গতিশীল হয়।
তিনঃ উপাদানত্রয়ের উল্লেখিত উৎসগুলোর মধ্যে কোন একটিতেও পবিত্রতার চিহ্নমাত্র থাকে না। জাতি তার চিন্তানায়কদের কাছ থেকে যে চিন্তাপদ্ধতি, দিশারীদের কাছ থেকে যে নৈতিক বিধান এবং আইন বেত্তাদের কাছ থেকে যে সমাজ বিধান লাভ করে, তা সবই হচ্ছে মানবীয় প্রচেষ্টার ফল আর এ মানবীয় প্রচেষ্টার ফল হওয়া সম্পর্কে এর অনুসারীরাও পুরোপুরি সচেতন থাকে। এর অনিবার্য ফল হচ্ছে এই যে, অনুসরণ কখনো পূর্ণত্ব লাভ করে না। অনুসারীরা তাদের অনুসরণের চরম অবস্থায়ও ঈমানী ভাবধারায় পরিপ্লুত হতে পারে না। তারা নিজেরাই উপলব্ধি করে যে, তাদের সংস্কৃতির মৌল উপাদানে ভ্রান্তির সম্ভাবনা এবং সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পরন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তার ভ্রান্তিগুলো স্বপ্রমান করতে থাকে। তার ফলে স্বভাবতই সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এভাবে কোন চিন্তাপদ্ধতি বা আইনশাস্ত্র কখনো জাতির ওপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে এবং সমাজ ও সভ্যতাকে স্থিতিশীল করে তোলার অবকাশ পায় না।
পক্ষান্তরে নবীর প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে যে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তা উল্লেখিত তিনটি বিচ্যুতি ও বিকৃতি থেকে মুক্ত থাকে।
প্রথমত, তাতে সংস্কৃতির তিনটি উপকরণ একই উৎস থেকে আহৃত হয়। একই ব্যক্তি চিন্তাপদ্ধতি নির্ধারণ করেন, নৈতিক বিধান নিরূপণ করেন এবং সমাজ বিধানের নীতিও প্রণয়ন করেন। তিনি যুগপৎ চিন্তার জগত, নৈতিক জগত ও কর্ম জগতের দিশারী। তিন জগতের সমস্যাবলীর ওপরই তাঁর দৃষ্টি সমান প্রসারিত। তাঁর মধ্যে সহনশীলতা, কোমল অনুভূতি এবং কর্মনৈপুণ্য এ তিনটি উপাদানের এক সুষম সমন্বয় ঘটে এবং প্রতিটি উপাদানের সঙ্গত পরিমাণ নিয়ে তিনি সংস্কৃতির বটিকায় এমনভাবে শামিল করে দেন যে, কোন অংশেই কম-বেশী হয় না। অংশগুলোর মধ্যে কোন অসংলগ্নতা ও অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয় না। এ বস্তুটি প্রকৃতপক্ষে মানবীয় শক্তি সামর্থের ঊর্ধে। কিন্তু প্রভুর হেদায়াত ছাড়া এটি সম্পাদন করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়।
দ্বিতীয়ত, এর কোন উপাদানই জাতিগত বা কালগত হয় না। আল্লাহ্র নবী যে চিন্তাপদ্ধতি, নৈতিক বিধি ও সমাজ বিধান নির্ধারণ করে দেন, তা জাতিগত প্রবণতা বা কালগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নয়, বরং তা সত্য ও সততার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। আর সত্য ও সততা হচ্ছে এমন জিনিস, যা প্রাচ্য পাশ্চাত্য, কালো-সাদা, অনার্য-আর্য ও প্রাচীন-আধুনিকের সকল সীমারেখা থেকে উর্ধে। যে জিনিসটি সত্য এবং সত্যাশ্রয়ী তা দুনিয়ার প্রত্যেক কোণ, প্রত্যেক জাতি এবং সময় ও কালের প্রত্যেক আবর্তনেই একইরূপ সত্য ও সত্যাশ্রয়ী। সূর্য জাপানেও যেমন সূর্য, জিব্রালটারেও তেমনই সূর্য। হাজার বছর পূর্বে সূর্য যেমন ছিল হাজার বছর পরেও ঠিক তেমনই থাকবে। সুতরাং কোন সংস্কৃতি বিশ্বজনীন, মানবিক এবং স্থায়ী সংস্কৃতি হতে পারলে তা একমাত্র আল্লাহর রসূলের প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতিই হতে পারে। কারণ আপন মূলনীতি ও মৌল ভিত্তি অপরিবর্তিত রেখে প্রত্যেক দেশ, জাতি ও যুগের উপযোগী হবার মতো যোগ্যতা কেবল এর মধ্যেই বর্তমান রয়েছে।
তৃতীয়ত, এ সংস্কৃতি পূর্ণ পবিত্রতার মর্যাদা অধিকার করে আছে। এর অনুসারীগণ এ প্রত্যয় এবং ঈমান পোষণ করে যে, এ সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন আল্লাহ্র নবী তাঁর কাছে রয়েছে আল্লাহ্র দেয়া জ্ঞান। তাঁর জ্ঞানের মধ্যে সংশয় বা দ্বিধার লেশ মাত্রও নেই। (*******) তাঁর কথাবার্তায় না আন্দাজ-অনুমানের স্থান আছে, আর না আছে প্রবৃত্তির তাড়না। তিনি যা কিছুই পেশ করেন, আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই করেন। তাঁর পদস্খলন ঘটার কিংবা ভ্রান্ত পথে চালিত হবার কোনই সম্ভাবনা নেই। (***************) “তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হয়েছে না বিভ্রান্ত। সে নিজের ইচ্ছায় বলে না। এটাতো একটা অহী যা তার প্রতি নাযিল করা হয়। তাকে মহাশক্তিধর শিক্ষা দিয়েছেন”।-(সূরা আন নাজমঃ ২-৫) এরুপ ঈমান ও প্রত্যয় যখন নবীর অনুগামীদের শিরা-উপশিরায় প্রবিষ্ট হয়, তখন তারা পূর্ণ মানসিক নিশ্চিন্ততার সাথে নবীর অনুবর্তন করতে থাকে। তাঁর অন্তরে কোন সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের স্থান থাকে না। তাঁর অন্তরে কখনো এরূপ আশংকা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে না যে, এ পন্থাটি হয়ত নির্ভুল নয় বরং অপর কোন পন্থা সত্যাশ্রয়ী কিংবা অন্তত এর চেয়ে উত্তম। স্পষ্টত এরূপ সংস্কৃতিই হবে ইপ্সিত মানের মযবুত এর অনুসরণ হবে নিতান্তই মযবুত এর মধ্যে দুনিয়ার অন্যান্য সংস্কৃতির চেয়ে বেশী শৃঙ্খলাবোধ (Discipline) পরিলক্ষিত হবে। এর চিন্তা পদ্ধতি, নৈতিক বিধি ও সমাজ বিধানে বেশী সংহতি, ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা কায়েম হবে।
বস্তুত আল্লাহ্র নবীগণ ছিলেন এ সংস্কৃতিরই নির্মাতা। শত শত বছর ধরে এঁরা দুনিয়ার প্রত্যেক অংশে এর জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। ক্ষেত্র যখন পুরোপুরি তৈরী হলো, তখন শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এসে এর জন্যে পূর্ণাঙ্গ ইমারত গড়ে তুললেন।
নবুওয়াতে মুহাম্মদীর বিশিষ্ট প্রকৃতি
এ পর্যন্ত যা কিছু বিবৃত হয়েছে তা ছিলো নবুওয়াত সংক্রান্ত সাধারণ বিধি ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু তা ছাড়াও কয়েকটি বিষয় রয়েছে, যা বিশেষভাবে নবুওয়াতে মুহাম্মদঈ (সাঃ)-এর সাথে সম্পৃক্ত। একথা নিসন্দেহ যে, নবুওয়াতের মর্যাদার দিক থেকে মুহাম্মাদ (সা) এবং অন্যান্য নবীদের মধ্যে মূলত কোন পার্থক্য নেই। কারণ, কুরআন মজীদের স্পষ্ট ঘোষণা এই যে, (***************) নবীদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য বৈধ নয়। সুতরাং নীতিগতভাবে সমস্ত নবীর বেলায়ই একথা প্রযোজ্য যে, তাঁরা সবাই আল্লাহ্র তরফ থেকে প্রেরিত। সবাইকে ‘প্রজ্ঞা’ এবং ‘জ্ঞান’ দান করা হয়েছে। সবাই একই ছিরাতুল মুস্তাকীমের দিকে আহ্বানকারী। সবাই মানব জাতির জন্যে দিশারী ও পথপ্রদর্শক। সবারই আনুগত্য ফরজ এবং সবার জীবন চরিতই মানবজাতির জন্য অনুকরণযোগ্য আদর্শ। কিন্তু কার্যত আল্লাহ্ তায়ালা কয়েকটি ব্যাপারে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে অন্যান্য নবীদের মুকাবিলায় একটি বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দান করেছেন। এ স্বাতন্ত্র নিছক কোন মামুলী ও হালকা ব্যাপার নয় যে, এর প্রতি লক্ষ্য রাখা বা না রাখার কারণে কোন ফলোদয় হবে না বরং প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সমগ্র ব্যবস্থায় এর একটি মৌল গুরুত্ব রয়েছে। আর কার্যত ইসলামের সকল প্রত্যয় ও কানুনের ভিত্তি নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর এ বিশিষ্ট মর্যাদার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ কারণেই নবুওয়াত সম্পর্কে কারো ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত পরিশুদ্ধ হতে পারে না, যতক্ষণ না সে এ বিশিষ্ট ও স্বাতন্ত্র মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি ঈমান আনবে।
পূর্ববর্তী নবুওয়াত ও নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর পার্থক্য
এ জিনিসটি অনুধাবন করার জন্য কয়েকটি বিষয় স্মরণ রাখা দরকার।
একঃ কুরআনী ইঙ্গিত, প্রাচীন ইতিহাস এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অনুমান থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নবীদের সংখ্যা কয়েক সহস্রাধিক হওয়াই উচিত। কুরআন বলেছেঃ (***************) “এমন কোন জাতি ছিল না, যার কাছে কোন সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি।” আর একথা সুস্পষ্ট যে, দুনিয়ার এতো বিপুল সংখ্যক মানব গোষ্ঠী অতিক্রান্ত হয়েছে যে, আমাদের ইতিহাস তার না হদিস দিতে পেরেছে আর না দিতে পারে। সুতরাং প্রত্যেক জাতির জন্যে যদি একজন নবীও এসে থাকেন, তবু নবীদের সংখ্যা সহস্রের সীমা অতিক্রম করে যাওয়াই উচিত। কোন কোন হাদীস থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে নবীদের সংখ্যা এক লাখ চব্বিশ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিপুল সংখ্যার মধ্যে কুরআন মজীদ যে সকল নবীর নাম উল্লেখিত হয়েছে, তাঁদের সংখ্যা আঙ্গুলি দ্বারাই গণনা করা চলে। এঁদের সাথে যদি আমরা সেসব ধর্মগুরুর নামও শামিল করে নেই, যাদের নবুওয়াত সম্পর্কে কুরআন মজীদে কোন ইংগিত নেই, তবুও এ সংখ্যা দশকের সীমা অতিক্রম করে না। এভাবে অসংখ্য নবীর নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে যাওয়া এবং তাঁদের শিক্ষার নিদর্শনাদি বিলুপ্ত হওয়ায় একথাই প্রমাণিত হয় যে, তাঁদের আগমন ঘটেছিল বিশেষ বিশেষ যুগ এবং বিশেষ জাতির জন্যে। তাঁদের কাছে এমন কোন জিনিস ছিলো না, যা স্থিতি ও স্থায়িত্ব দান করতে এবং বিশ্বজনীন ব্যাপ্তি দান করতে পারে।
দুইঃ পরন্তু যে সকল নবী ও ধর্মগুরুর নাম আমরা জানি, তাঁদের জীবনী ও শিক্ষা ধারার ওপর কল্প-কাহিনী ও বিকৃতির এতো আবরণ পড়ে আছে যে, তাঁদের সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার কোন তুলনা নেই। তাঁদের যেসব নিদর্শন বর্তমান দুনিয়ায় বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলোর প্রতি কাল্পনিক বিশ্বাস পরিহার করে নিছক ঐতিহাসিক মানদণ্ডে যাচাই করে দেখলেই আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে, তার কোন একটি জিনিসের ওপরও নির্ভর কার চলে না। আমরা তাঁদের প্রকৃত জীবন-কাল পর্যন্ত নির্দেশ করতে পারি না। তাঁদের প্রকৃত নাম পর্যন্ত আমরা অবহিত নই। তাঁরা বাস্তবিকই দুনিয়ায় বর্তমান ছিলেন কিনা, এটাও আমরা চূড়ান্তভাবে বলতে পারি না। বুদ্ধ, জারদশত এবং ঈশার ন্যায় মশহুর ব্যক্তিরা ঐতিহাসিক পুরুষ ছিলেন না, নিছক কল্পনার মানুষ ছিলেন, ঐতিহাসিকরা সে সম্পর্কেও সন্দেহ করেছেন। পরন্তু তাঁদের জীবন চরিত সম্পর্কে আমাদের যা কিছু জানা আছে, তা এতোই সংক্ষিপ্ত এবং অস্পষ্ট যে, তাকে জীবনের কোন একটি বিভাগেও তাদেরকে অনুকরণযোগ্য আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা চলে না, তাঁদের প্রচারিত শিক্ষা-দীক্ষার অবস্থাও প্রায় এরূপ। যে সকল গ্রন্থ ও শিক্ষা-দীক্ষা তাঁদের নামে প্রচলিত, তার কোন একটির প্রামাণিকতাও তাঁদের পর্যন্ত পৌঁছে না। বরং আভ্যন্তরিক ও বাহ্যিক এ উভয় দিক দিয়েই এমন বলিষ্ঠ প্রমাণাদি বর্তমান রয়েছে, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ সকল গ্রন্থ ও শিক্ষা-দীক্ষার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ও রদবদল হয়েছে। এর থেকে সত্যই প্রতিভাত হয় যে, মুহাম্মদ (সা)-এর পূর্বে যত নবী ও ধর্মগুরু অতিক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের নবুওয়াত ও ধর্মীয় নেতৃত্ব খতম হয়ে গিয়েছে।
তিনঃ প্রায় সকল নবী ও ধর্মগুরু সম্পর্কেই একথা স্বপ্রমাণিত যে, তাঁরা যে বিশেষ বিশেষ জাতির মধ্যে আগমন করেছিলেন, তাঁদের শিক্ষা ছিলো ঠিক সেইসব জাতির জন্যেই নির্দিষ্ট। তাদের কেউ কেউ নিজেরাই একথা প্রকাশ করেছেন আর কারো কারো সম্পর্কে ঘটনাপ্রবাহই এটা প্রমাণ করে দিয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ), হযরত মূসা (আ), কনফিউশাস, জারদশত, এবং কৃষ্ণের শিক্ষা কখনো তাদের স্বজাতির সীমা অতিক্রম করেনি। সেমেটিক এবং আর্যজাতিগুলোর অন্যান্য নবী ও ধর্মগুরুর অবস্থাও একই রূপ। অবশ্য বুদ্ধ এবং ঈসার অনুসারীগণ তাঁদের শিক্ষাকে অন্যান্য জাতির কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। কিন্তু তাঁরা নিজেরা কখনো না এর জন্যে চেষ্টা করেছেন, আর না কখনো এ দাবী করেছেন যে, তাঁদের বাণী সমগ্র বিশ্বের জন্যে। বরং ঈসা (আ) থেকে খোদ ইঞ্জিলেই একথা উদ্ধৃত হয়েছে যে, তিনি শুধু বনী ইসরাঈলদের হেদায়াতের জন্যেই দুনিয়ায় এসেছিলেন।
চারঃ সমস্ত নবী ও ধর্মগুরুদের মধ্যে একমাত্র মুহাম্মাদ (সা) ই এমন পুরুষ, যার জীবন চরিত্র ও শিক্ষা দীক্ষা সম্পর্কে আমাদের কাছে নির্ভুল প্রামাণ্য এবং সুনিশ্চিত তথ্যাবলী বর্তমান রয়েছে এবং সে সবের সত্যতার সন্দেহের কোন অবকাশ মাত্র নেই। তাই কোন রুপ প্রতিবাদের ভয় না করেই বলা হয় যে, দুনিয়ার কোন ঐতিহাসিক পুরুষ সম্পর্কেই আজ এতো নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ভাণ্ডার বর্তমান নেই। এমন কি কোন সন্দিগ্ধ ব্যক্তি যদি তার সততায় সন্দেহ পোষণ করে, তবে তাকে সমস্ত দুনিয়ার ইতিহাস ভাণ্ডারকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে হবে। কারন এতো বড় প্রামান্য ভাণ্ডারের সততায় সন্দেহ পোষণের পর এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে ইতিহাসের সমস্ত জ্ঞানই মিথ্যার একটি স্তুপ মাত্র এবং তার একটি বর্ণের ওপর নির্ভর করা চলে না।
পাঁচঃ এভাবে সমস্ত নবী ও ধর্মগুরুর মধ্যে কেবল মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনধারা ও জীবনবৃত্তান্তই আমাদের সামনে সবিস্তারে বর্তমান রয়েছে। কেবল জাতিসমূহের ধরমগুরুদের মধ্যেই নয়, বরং দুনিয়ার সমস্ত ঐতিহাসিক পুরুষের মধ্যে মুহামাদ্দ (সা) ছাড়া এমন কোন পুরুষ নেই যার জীবন চরিতের এতো খুঁটিনাটি বিষয় ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সুরক্ষিত রয়েছে। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর জামানা ও বর্তমান যুগের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকলে তা হচ্ছে এই যে, সে যুগে হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর দৈহিক সত্তা বর্তমান ছিল আর আজ তা নেই। কিন্তু জীবনের সাথে যদি দৈহিক অস্তিতের শর্ত আরোপ করা না হয়, তবে আমরা বলতে পারি যে হযরত (সা) আজো বেঁচে আছেন এবং যতদিন দুনিয়ায় তার জীবন চরিত থাকবে ততদিন তিনি বেঁচে থাকবেন। হাদীস ও জীবনী গ্রন্থাবলীতে দুনিয়ার মানুষ আজো হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনকে ততটা নিকট থেকেই দেখতে পারে যতটা নিকট থেকে তার সমকালীন লোকেরা দেখতে পারতো। কাজেই এটা সম্পূর্ণ সঙ্গত ভাবেই বলা যেতে পারে যে, নবীগণ ও অন্যান্য ধর্মগুরুদের মধ্যে একমাত্র মুহাম্মাদ (সা)-এরই যথার্থ এবং পূর্নাঙ্গ অনুসরণ করা সম্ভব।
ছয়ঃ হযরত (সা) এর শিক্ষা সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। পূর্বেই বলা হয়েছে যে নবীগণ এবং ধর্মগুরুদের এমন কেউ নেই যার আনীত ধর্মগ্রন্থ ও প্রচারিত শিক্ষা আজো নির্ভুল আকারে বর্তমান রয়েছে এবং বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্য পন্থায় নিজস্ব বাহক ও তার প্রচারকের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা যেতে পারে। এ সৌভাগ্যের অধিকারী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মাদ (সা)। তাঁর আনীত গ্রন্থ কুরআন অবিকল সেই ভাষায় বর্তমান রয়েছে যে ভাষায় হযরত (সা) তাকে পেশ করেছিলেন। আর কুরআন ছাড়াও তিনি নিজস্ব ভাষায় যেসব হেদায়াত দিয়েছিলেন, তাও প্রায় নির্ভুল আকারেই সুরক্ষিত রয়েছে। এবং ইনশাআল্লাহ চিরকাল সুরক্ষিত থাকবে। কাজেই নবী ও ধর্মগুরুদের মধ্যে একমাত্র মুহাম্মাদ (সা) এর শিক্ষার অনুসরণ নিশ্চিন্ত ও সংশয়াতীতভাবে করা যেতে পারে।
সাতঃ অতীতকালে নবী ও ধর্মগুরুদের শিক্ষা ও জীবনী সম্পর্কে যে তথ্য ভাণ্ডার বর্তমান দুনিয়ায় বিদ্যমান, সে সবের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। সেখানে সত্য ও সততা, কল্যাণ ও মঙ্গল, সচ্চরিত্র এবং সদাচরনণর যত পবিত্র দৃষ্টান্তই আপনি পাবেন, তার প্রতিটি জিনিসই আপনি মুহাম্মাদ (সা) এর শিক্ষা ও জীবনীতে পাবেন। এরুপে তাঁর পরে মানব সমাজ যত নেতার আবির্ভাব হয়েছে, তাদের শিক্ষা এবং জীবনীতেও আপনি এমন কোন সত্য, সততা এবং পুণ্য ও মঙ্গল খুঁজে পাবেন না, যা মুহাম্মাদ (সা) এর শিক্ষা ও জীবন চরিত্রে বর্তমান নেই। পরন্তু হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর শিক্ষা ও জীবনীতে সত্য জ্ঞান, সৎ-কর্মশীলতা এবং সুনীতির এমন আর একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা দুনিয়ার কোন অতীত ও বর্তমান ধর্মগুরুর শিক্ষা ও জীবনীতে পাওয়া যাবেনা। সবচেয়ে বড় কথা হল এই যে, খোদায়ী জ্ঞান, নৈতিক চরিত্র এবং পার্থিব আচরন সম্পর্কে ইসলামের বাইরে থেকে কোন নির্ভুল কথা মানুষ চিন্তায় করতে পারে না। কাজেই এ সত্য অনস্বীকার্য যে, মুহাম্মাদ (সা) এর শিক্ষা ও চরিত্র হচ্ছে সমস্ত মঙ্গলের সমষ্টি। সত্য বলে যা কিছু ছিলো, তা মুহাম্মাদ (সা) প্রকাশ করে দিয়েছেন, সোজা পথ যাকে বলা হতো, তা তিনি উজ্জ্বল করে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দিক থেকে মানুষের নৈতিক চরিত্র ও আচার ব্যবহারকে সুস্থ রাখার জন্য এবং দুনিয়ায় সঠিকভাবে জীবন যাপন করার জন্য যত সুনীতি ও সুনিয়ম হতে পারতো, তা তিনি সবই স্পষ্টভাবে পেশ করে দিয়েছেন। এখন আর তাতে সংযোজন ও পরিবর্ধনের কোনই অবকাশ নেই।
আটঃ নবী ও ধর্মগুরুদের গোটা দলের মধ্যে একমাত্র মুহাম্মাদ (সা)-ই দাবী করেছেন যে, তাঁর দাওয়াত সমগ্র মানব জাতির জন্য আর কার্যতও তিনি নিজের জীবদ্দশায়ই বিভিন্ন দেশের রাজরাজড়া দের কাছে আমন্ত্রণ লিপি পাঠিয়েছেন এবং তাঁর দাওয়াত পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তে এবং মানব জাতির প্রত্যেক গোষ্ঠীর কাছে পৌছেছে। এ বিশেষত্ব একমাত্র হযরত (সা) ছাড়া আর কেউ অর্জন করতে পারেনি। কেউ কেউ তো বিশ্বজনীনতার দাবীও করেনি আর তাঁরা বিশ্বজনীন মর্যাদা ও লাভ করেনি। আর কারো কারো ধর্ম বিশ্বজনীন মর্যাদা লাভ করেছে বটে; কিন্তু তাঁরা নিজেরা কখনো সেরূপ দাবিও করেনি আর তাঁর জন্য চেষ্টাও করেনি। বস্তুত হযরত মুহাম্মাদ (সা) হচ্ছেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি বিশ্বজনীনতার দাবীও করেছেন, তাঁর জন্যে চেষ্টাও করেছেন এবং কার্যত বিশ্বজনীনতা লাভও করেছেন।
নয়ঃ দুনিয়ার নবীদের আগমনের তিনটি মাত্র কারনেই থাকতে পারে। প্রথমত, কোন জাতির হেদায়াতের জন্যে পূর্বে কোন নবী আসেনি এবং ********** অনুযায়ী তাঁর জন্যে এক বা একাধিক নবীর প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, পূর্বে কোন নবী এসেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর নবুওয়াতের লক্ষনাদি বিলীন হয়ে গেছে; তাঁর শিক্ষা এবং তাঁর আনীত কিতাব বিকৃত হয়ে গেছে; তার জীবন সংকান্ত্র নিদর্শনাদি মুছে গেছে এবং লোকদের পক্ষে তাঁর উত্তম আদর্শের অনুসরন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে তৃতীয়ত, পূর্ববর্তী নবী বা নবীদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ বিধায় তাতে অধিকতর সংযোজন ও পরিবর্ধনের আবশ্যক। এ তিনটি কারন ছাড়া নবীদের আগমনের আর কোন চতুর্থ কারন নেই, আর বিচার-বুদ্ধির দৃষ্টিতে থাকতেও পারে না।১ কোন জাতির জন্যে নবীও এসেছেন, তাঁর শিক্ষা এবং জীবনী নির্ভুল আকারে সুরক্ষিতও রয়েছে, তাতে কোন সংযোজন-পরিবর্ধনের ও প্রয়োজন নেই, আর তা সত্ত্বেও তারপর কোন দ্বিতীয় নবী পাঠিয়ে দেয়া হবে এটা কিছুতেই সম্ভব নয় নবুওয়াতের পদটি নিছক কোন মর্যাদার ব্যাপার নয় যে, তা কোন সৎকাজের বিনিময়ে পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে। বরং এ হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের খেদমত, যা এক সুনির্দিষ্ট কাজের জন্যে প্রয়োজন মতো কারো উপর ন্যস্ত করা হয়। উপরন্তু এ পদটি এতো ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ ধরনেরও নয় যে, কোন বিগত শিক্ষার প্রতি নিছক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যেই কাউকে এটি অর্পণ করা হয়। এ কাজের জন্যে তো সত্যাশ্রয়ী আলেম এবং মুজাদ্দিদগণই যথেষ্ট। কাজেই বিচার বুদ্ধি চূড়ান্তভাবে এ দাবীই করছে যে, উল্লেখিত কারণত্রয়ের মধ্যে কোন একটি কারণ না ঘটা পর্যন্ত কোন নবী আসতে পারে না। আর আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (সা) এর সাথে এ তিনটি কারণই বিদূরিত হয়ে গেছে। তাঁর দাওয়াত সমগ্র মানব জাতির জন্যে, সুতরাং এখন বিভিন্ন জাতির জন্যে পৃথক নবী আসার কোন প্রয়োজন নেই। তাঁর আনীত কিতাব এবং তাঁর নবুওয়াতের নিদর্শন সম্পূর্ণ নির্ভুল আকারেই সুরক্ষিত রয়েছে; কোন নতুন কিতাব বা হেদায়াত আসারও প্রয়োজন নেই। তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াত পূর্ণাঙ্গ এবং সম্পূর্ণ। এ ক্ষেত্রে না সত্য জ্ঞানের মধ্য থেকে কিছু গোপন রয়ে গেছে, আর না সৎকাজের জন্যে হেদায়াত ও অনুকরণযোগ্য পেশ করার
১.একটি কারন অবশ্য এ হতে পারে যে, একজন নবীর সাহায্যের জন্যে তাঁর সাথে অপর একজন নবী প্রেরণের প্রয়োজন হয়েছে। এ রকম কয়েকটি দৃষ্টান্ত কুরআনেও পাওয়া যায়।কিন্তু এটি আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। কারন মদদ গার নবীর নবুওয়াত সেই নবুওয়াতের ই পরিশিষ্ট মাত্র, যার সাহায্যাথে তাঁকে উজির হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
ব্যাপারে কোন ত্রুটি হয়েছে। কাজেই এতে পরিবর্ধনকারীরও কোন প্রয়োজন নেই। যখন এ তিনটি কারণ বর্তমান নেই,-অথচ নবীর আগমনের কারন এ তিনটি বিষয়ের ওপরেই নির্ভরশীল_তখন স্বভাবতই স্বীকার করতে হবে যে, নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (সা) এর পর নবুওয়াতের দরজা চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। যদি আজ এ দরজা খোলা থাকে তবে তার অর্থ এই যে, আল্লাহ অনর্থক কাজও করেন, অথচ আল্লাহ এর থেকে মুক্ত শুদ্ধ ও পবিত্র। তাঁর দ্বারা কখনো কোন অনর্থক কাজ সম্পাদ্দিত হয় না।১
নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (সা) এর তিনটি বিশেষাত্নক মর্যাদাকে কুরআন অত্যন্ত বিস্তৃত ও সুস্পষ্টভাবে পেশ করেছে।
সাধারন দাওয়াত
কুরআন বলছে
“( হে মুহাম্মাদ!) বলে দাও, লোক সকল! আমি তোমাদের সবার প্রতি সেই আল্লাহর প্রেরিত নবী, যিনি আসমান-জমিনের সাম্রাজ্যের মালিক, যিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং যিনি জীবন দাতা ও মৃত্যুদাতা। কাজেই ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর উম্মী নবী ও রাসূলের প্রতি, যিনি আল্লাহ এবং তাঁর বানীর প্রতি ঈমান পোষণ করেন। তাঁর অনুসরন করো, যাতে করে তোমরা সোজা পথে চলতে পারো। -(সুরা আল আরাফঃ ১৫৮)
“(হে মুহাম্মাদ!) আমরা তোমায় সমগ্র মানব জাতির জন্যেই সুসংবাদ দাতা ও সতর্ক কারী বানিয়ে পাঠিয়েছি কিন্তু বেশির ভাগ লোকই সে সম্পর্কে অনবহিত”। -(সূরা সাবাঃ ২৮)
১। ব্যাপারটা শুধু এটুকুই নয় যে, নিষ্প্রয়োজনে একজন নবী প্রেরন করা একটি অনর্থক কাজ, বরং তা বিচার বুদ্ধিরও পরিপন্থী। নবুওয়াতের কাজ সম্পূর্ণ হবার পর তো এর দরজা বন্ধ হয়েই যাওয়া উচিত, যাতে করে এক নবীর অনুসরণে সারা দুনিয়ার মানুষ একত্রিত হতে পারে। নচেত এ দরজাটি খোলা থাকলে প্রত্যেক নতুন নবীর আগমনেই লোকদের মধ্যে নতুন করে কুফর ও ঈমানে পার্থক্য সূচিত হবে এবং একত্রিত লোকেরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করবে।
“হে লোক সকল! তোমাদের প্রভুর তরফ থেকে এ নবী তোমাদের কাছে সত্য সহকারে এসেছেন, কাজেই তোমরা ঈমান পোষণ করো; এটা তোমাদের পক্ষে কল্যাণকর। আর যদি কুফরি করতে থাকো, তবে জেনে রাখো, আল্লাহই আসমান ও জমিনের অধিপতি”। -(সূরা নিসাঃ ১৭০)
“( হে মুহাম্মাদ!) আমরা তোমায় বিশ্ববাসীরজন্যে রহমত বানিয়ে পাঠিয়েছি”।-(সূরা আল আম্মিয়াঃ ১০৭)
“তিনি পবিত্র যিনি তাঁর বান্দার ওপর হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী কিতাব পাঠিয়েছেন, যাতে করে তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যে সতর্ককারী হন”। -( সূরা আল ফুরকানঃ ১)
এর থেকে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেঃ
প্রথমত, মুহাম্মাদ (সা) এর দাওয়াত কোন যুগ, কোন জাতি বা দেশের জন্যে নির্দিষ্ট নয়, বরং তিনি চিরকালের জন্যে সমগ্র মানব জাতির দিশারি ও পথপ্রদর্শক।
দ্বিতীয়ত, তাঁর প্রতি ঈমান পোষণ এবং তাঁর অনুসরণ করার জন্যে সমগ্র মানব জাতিই আদিষ্ট।
তৃতীয়ত, তাঁর প্রতি ঈমান পোষণ এবং তাঁর অনুসরণ ছাড়া সৎপথ পাওয়া যেতে পারে না।
এ তিনটি বিষয়ই প্রত্যয়বাদের অন্তর্ভুক্ত কারন যে বিশ্বজনীন সংস্কৃতির নাম ইসলাম তার বিশ্বজনীনতা ও অসীমতা এ প্রত্যয়ের ওপরই নির্ভরশীল। বস্তুত নবী করীম (সা) এর প্রচারিত দ্বীনের বাইরেও সুপথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে এটা যদি স্বীকার করা হয় তবে ইসলামী দাওয়াতের সার্বজনীনতাই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ইসলামী আদর্শের বিশ্বজনীনতাও অর্থহীন হয়ে পড়ে।
দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণতা
************
তিনিই আপন রাসুল কে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহ পাটিয়েছেন, যাতে করে তিনি সমগ্র দ্বীনের ওপর তাকে বিজয়ী করে তুলতে পারেন”। -( সূরা আত তাওবাঃ ৩৩)
***********
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ সম্পদকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্যে ইসলামকেই দ্বীন রূপে মনোনীত করলাম”।এর থেকে জানা গেল যে, যে জিনিসটা হেদায়াত বলা হয় এবং সত্য দ্বীন বলতে যে জিনিসটা বুঝায়, তা সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণরূপে আরবী নবী (সা) এর মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সর্ববিধ দ্বীনের ওপর তাঁর নবুওয়াত পরিব্যপ্ত হয়েছে। তাঁরই মাধ্যমে দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এবং পূর্বেকার নবীদের মাধ্যমে হেদায়াতের যে অমীয়ধারা অল্প অল্প করে নেমে আসছিলো, এবার তা পূর্ণত্বের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এরপর হেদায়াত, দ্বীন এবং সত্য জ্ঞানের মধ্যে এমন কোন জিনিস বাকী নেই, যা প্রকাশ করার জন্যে অপর কোন নবী বা রাসূল আসার প্রয়োজন হতে পারে। এরুপ স্পষ্টতর ভাষায় দ্বীনের পরিপূর্ণতা এবং নেয়ামতের সম্পূর্ণতার কথা ঘোষণা করার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে পূর্ববর্তী নবুওয়াতগুলোর সাথে আনুগত্য ও অনুসরণের সম্পর্ক ছিন্ন হতে এবং ভবিষ্যতের জন্যে নবুওয়াতের দরজা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। এ দু’টি জিনিস, অর্থাৎ পূর্ববর্তী দ্বীনসমূহের রহিতকরণ এবং নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি হচ্ছে রিসালতে মুহাম্মাদী (সা) এর পার্থক্য সূচক বৈশিষ্ট্য কুরআন মজীদে এ দুটি জিনিসকেই স্পষ্টভাষায় বিবৃত করা হয়েছে।
***********
পূর্ববর্তী দ্বীন সমূহের রহিতকরণ
***********
পূর্ববর্তী দ্বীন সমূহের রহিতকরণ কথাটির তাৎপর্য এই যে, পূর্বেকার নবীগণ যা কিছু পেশ করেছিলেন, এখন তা সবই রহিত হয়ে গিয়েছে। তাঁদের নবুওয়াত ও সত্যবাদিতার প্রতি মোটামুটি বিশ্বাস রাখা আবশ্যক বটে, কারণ তারা সবাই ইসলামী দাওয়াতের আহব্বায়ক ছিলেন। তাঁদেরকে বিশ্বাস করা ইসলামকে বিশ্বাস করারই নামান্তর। কিন্তু কার্যত এখন আনুগত্য ও অনুসরণের সম্পর্ক তাঁদের থেকে ছিন্ন হয়ে শুধু মুহাম্মাদ (সা) এর শিক্ষা ও জীবনাদর্শের সাথেই যুক্ত হয়ে গেছে। এ জন্যে যে, নীতিগতভাবে পূর্ণত্বের পর অপূর্ণতার কোনই প্রয়োজন ছিলনা। দ্বিতীয়ত, পূর্বতন নবীদের শিক্ষাদীক্ষা ও জীবন চরিত বিকৃত ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে; যার ফলে কার্যত তাদের নির্ভুল অনুসরন আর সম্ভব ছিলোনা এ কারনে কুরআন মাজীদের যেখানেই রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেখানে **** কিংবা **** শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা বিশেষভাবে মুহাম্মাদ(সা) কেই বুঝানো হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ
“ তাঁদের বল, আল্লাহ এবং রাসুলের আনুগত্য কবুল কর। অতপর তারা যদি তোমাদের দাওয়াত কবুল না করে, তবে আল্লাহ সেইসব লোকদেরকে (যারা তাঁর ও রাসুলের আনুগত্য করতে অস্বীকার করে) কিছুতেই ভালবাসতে পারে না”।-(সূরা আলে ইমরানঃ ৩২)
আল্লাহর আনুগত্য কর। আনুগত্য কর রসূলের এবং সেই সব লোকেরও যারা তোমাদের মধ্যে সামগ্রিক দায়িত্ব সম্পন্ন। (সূরা আন নিসাঃ ৫৯)
“যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করে সে প্রকৃতপক্ষে আল্লহরই আনুগত্য করে”। (
আর এ কারনেই যেসব জাতি পূর্বতন নবীদের কারো প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে, তাদেরকেও মুহাম্মাদ (সা) এর প্রতি ঈমান পোষণ এবং তাঁর অনুসরন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই বলা হয়েছেঃ
*************
“হে কিতাব ধারীগণ! তোমাদের কাছে আমার রসূল এসেছেন, যিনি তোমাদের কাছে এমন বহু কথা বিবৃত করবেন, যা তোমরা কিতাব থেকে গোপন করে ফেলেছিলে। পরন্তু যিনি বহু কথা থেকে তোমাদের ক্ষমাও করে দিবেন। তোমাদের কাছে আল্লহর তরফ থেকে নূর এবং খোলাখুলি বর্ণনাকারী কিতাব এসেছে এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর সন্তুষ্টির অনুসারী লোকদের শান্তির পথ প্রদর্শন করবেন, তাঁদেরকে অন্ধকার থেকে আলোকের মধ্যে নিয়ে আসবেন। আর তাঁদেরকে সহজ সরল পথে পরিচালিত করবেন”।(সূরা আল মায়েদাঃ ১৫-১৬)
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
“কিতাবধারীদের মধ্যে ঈমান দার লোক হচ্ছে তারা, যারা এ উম্মী নবী-রসূলের অনুসরণ করে চলে, যার কথা তারা নিজস্ব তাওরাত ও ইঞ্জিলেই লিপিবদ্ধ দেখতে পায়। তিনি তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ দেন এবং দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখেন। তাদের জন্যে প্রবিত্র দ্রব্যাদি হালাল করে দেন, অপ্রবিত্র দ্রব্যাদি হারাম ঘোষণা করেন এবং তাদের ওপর থেকে সমস্ত বোঝা ও বেড়ি অপসারিত করে দেন। কাজেই যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে, তাঁর সাহায্য ও সহায়তা করেছে এবং তাঁর সাথে অবতীর্ণ নূরের অনুসরন করেছে, তারাই হচ্ছে কল্যাণপ্রাপ্ত হে মুহাম্মাদ! বলে দাওঃ লোক সকল! আমি তোমাদের প্রতি সেই আল্লাহর প্রেরিত রসূল, যিনি আসমান ও জমিনের গোটা সাম্রাজ্যের অধিপতি। তিনি ছাড়া আর কোন মাবূদ নেই। তিনি জীবন ও মৃত্যু দানকারী কাজেই ঈমান আনো আল্লাহ ও তাঁর উম্মী রসূল ও নবীর প্রতি যিনি আল্লাহ ও তার বাণীর প্রতি ঈমান এনেছে। আর তোমরা তার অনুসরণ করো, যাতে করে তোমরা সোজা পথে চলতে পারো”।(সূরা আল আরাফঃ ১৫৭-১৫৮)
এ সুস্পষ্ট আয়াত কয়টিতে পূর্বতন ধরমসমূহের রহিতকরনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার অর্থ এবং তাৎপর্য বাতলে দেয়া হয়েছে। তার কারণও বিবৃত করা হয়েছে, তার স্বাভাবিক পরিণাম ফলও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এও বলে দেয়া হয়েছে যে, এখন থেকে হেদায়াত ও কল্যাণ প্রাপ্তি নবী উম্মী (সা) এর অনুসরনের সাথে ওতপ্রোত জড়িত। পরুন্তু এও বুঝিয়ে বলা হয়েছে যে, তাওরাত ও ইঞ্জিলের প্রতি বিশ্বাসী এবং অন্যান্য জাতির কাছে যে দ্বীন পাঠানো হয়েছিলো, নবী উম্মী (সা) এর প্রচারিত দ্বীন হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তারই সংস্কার ও পরিপূর্ণতা মাত্র।
খতমে নবুওয়াত
এভাবে দ্বীনের পরিপূর্ণতার অপর পরিণাম ফল খতমে নবুওয়াতকেও কুরআন মজীদে স্পটতর ভাষায় বিবৃত করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
“মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নয়, বরং সে আল্লাহর রসূল এবং খাতামুন নাবীয়্যিন। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে অবহিত”। -(সূরা আল আহযাবঃ ৪০)
নবুওয়াতের দরজা বন্ধ করা সম্পর্কে এ ঘোষণাটি এতোই সুস্পষ্ট যে, কারো অন্তরে যদি বক্রতা ও কুটিলতা না থাকে, তবে এর পরে সে ইসলামের ভিতর নবুওয়াতের দরজা খোলার কোন অবকাশই বের করতে পারে না। আয়াতে উল্লেখিত **** শব্ধে ** অক্ষরে ‘জবর’ দিয়ে পড়া হোক আর ‘জের’ দিয়ে উভয় অবস্থাতে একই ফল দাঁড়াবে; আর তা হলো এই যে, যে আল্লাহর জ্ঞানের বিপরীত কোন কিছুই ঘটতে পারে না, তাঁর জ্ঞান অনুসারেই নবুওয়াতের দরজা চিরদিনের তরে বন্ধ হয়ে গেছে।
নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর প্রতি বিশ্বাসের আবশ্যিক উপাদান
দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণতা, পূর্ববর্তী দ্বীন সমূহের রহিতকরণ এবং খতমে নবুওয়াতের এ তিনটি বিশ্বাস প্রকৃত পক্ষে ইসলামের প্রত্যয়বাদের অন্তর্ভুক্ত এবং নবুওয়াতের ভিত্তি হচ্ছে এ বিশ্বাসের আবশ্যিক অঙ্গ। ইসলামের সার্বজনীন দাওয়াতের ভিত্তি হচ্ছে এই যে, মানব জাতির জন্যে দাওয়াতে মুহাম্মাদী রূপে এমন একটি পূর্ণাঙ্গধর্ম প্রবর্তন করা হয়েছে, যার মধ্যে পূর্বেকার সমস্ত দাওয়াতের অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এবং ভবিষ্যতের জন্যে এমন কোন অসম্পূর্ণতা বাকী রাখা হয়নি, যা পুরো করার কখনো প্রয়োজন হতে পারে। এ পূর্ণাঙ্গ দ্বীন চিরকালের জন্যে ইসলাম ও কুফর, হক ও বাতিলের মধ্যে এক সুনির্দিষ্ট ও চিরস্থায়ী পার্থক্য কায়েম করে দিয়েছে। এরপর কেয়ামত পর্যন্ত এতে আর কোনরূপ হ্রাস-বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না। বস্তুত যা কিছু ইসলাম এবং হক তা মুহাম্মাদ (সা) স্পষ্টত বাতলে দিয়ে গেছেন। এরপর এ জাতীয় আর কোন নতুন জিনিস আসার সম্ভাবনা নেই যে, তাঁর স্বীকৃতির ওপর মুসলিম ও হক প্রাপ্ত হওয়া নির্ভর করবে। পক্ষান্তরে যে জিনিসকে মুহাম্মাদ (সা) কুফর ও বাতিল বলে আখ্যা দিয়েছেন, তা চিরকালের জন্যেই কুফর ও বাতিল। তাঁর কোন জিনিস যেমন আজ হক ও ইসলাম হতে পারে না, তেমনি তা ছাড়া অপর কোন জিনিসের ভিত্তিতে কুফর ও ইসলামের নতুন পার্থক্যও সৃষ্টি করা যেতে পারে না। এহেন সুদৃঢ় এবং অপরিবর্তনীয় ভিতির ওপরই বিশ্বব্যাপী স্থায়ী মিল্লাত ও ইসলামী সংস্কৃতির গগনচুম্বী ইমারত তৈরি করা হয়েছে। এরূপ ভিত্তির ওপর তার নির্মাণ এ জন্যেই করা হয়েছে, যাতে করে দুনিয়ার মানুষ চিরদিনের জন্যে একই মিল্লাত, একই দ্বীন এবং একই সংস্কৃতির অনুসরনণের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। সে মিল্লাত হবে এমন, যার পূর্ণত্ব ও স্থায়িত্ব সম্পর্কে তাদের ভয় থাকবে না। আস্থা ও নির্ভরতার ওপরই ইসলামের সার্বজনীন দাওয়াতের ভিত্তি স্থাপিত, আর এর ওপরই ইসলামের স্থিতি ও স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। যে ব্যাক্তি বলে যে, ইসলামের অবতরণের পরও পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর অনুসরণ বৈধ, সে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের কাছ থেকে সার্বজনীন দাওয়াতের অধিকারই ছিনিয়ে নিতে চায়। কারণ ইসলাম ছাড়া অন্যান্য পন্থায় যখন হেদায়াত প্রাপ্তি সম্ভব হবে, তখন সমগ্র মানব জাতিকে ইসলামের দিকে আহবান জানানো অনর্থক হয়ে দাঁড়াবে। আর যে ব্যক্তি বলে যে, মুহাম্মাদ (সা) এর শিক্ষা ধারায় প্রত্যেক যুগের প্রয়োজন ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যেতে পারে, সে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের কাছ থেকে স্থায়িত্বের অধিকার হরণ করে নিতে চায়। কারন যে দ্বীন অসম্পূর্ণ এবং পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাপেক্ষে, তার চিরকালের জন্যে হেদায়াত প্রাপ্তির মাধ্যমে হবার দাবী করলে তার সে দাবী অসত্য। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বলে যে, ইসলামে মুহাম্মাদ (সা) এর পরও নবী আসার অবকাশ রয়েছে, সে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের স্থিতিশীলতার ওপরই আঘাত হানতে চায়। কারণ নবুওয়াতের দরজা উন্মুক্ত রাখার মানেই হচ্ছে এই যে, ইসলামের একতা ও সংঘবদ্ধতার মধ্যে হামেশাই বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার আশংকা বর্তমান থাকবে। পরন্তু নতুন নবী আসার ফলে কুফর ও ইসলামের এক নতুন নিভেদের উন্মেষ হবে এবং এমন প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহ, মুহাম্মাদ (সা) এবং কুরআনের প্রতি ঈমান পোষণকারী লোকেরা দলে দলে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। কাজেই নবুওয়াতের দরজা উন্মোচন হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে ফিতনা ও বিভ্রান্তির দরজা উন্মোচনের শামিল। ইসলামের মূলোৎপাটনের যতগুলো সম্ভাব্য কারণ রয়েছে, তার মধ্যে নতুন নবুওয়াতের দাবীই হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক ও বিপজ্জনক কারণ। মুসলিম জাতির সংগঠন পদ্ধতি এ ভিত্তির উপরই কায়েম করা হয়েছে যে, যারা মুহাম্মদ (সা:) এবং কুরআনের প্রতি ঈমান আনবে, তারা সবাই মুসলমান এবং ঈমানদার। তারা এক মিল্লাত, এক জাতি। পরস্পরে তারা ভাই ভাই। সুখ-দুঃখে, আনন্দ-বিষাদে তারা একে অপরের অংশীদার। এখন যদি কেউ কেউ এসে বলে যে মুহাম্মদ (সা) এবং কুরআনের প্রতি ঈমান পোষণই যথেষ্ট নয়, তার সাথে আমার প্রতিও ঈমান আনা আবশ্যক, আর যে ব্যক্তি আমার প্রতি ঈমান আনবেনা সে মুহাম্মদ (সাঃ) এবং কুরআনের প্রতি ঈমান রাখা সত্ত্বেও কাফের, পরন্তু এর ভিত্তিতেই সে মুসলমানদের মধ্যে কুফর ও ইসলামের বিভেদ সৃষ্টি করে এবং মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক গঠিত একজাতিকে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলে, কুরআন যাদেরকে ******Arabic***** বলে ভাই ভাই বানিয়ে দিয়েছে, তাদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সে ছিন্ন করে দেয়, তাদের নামাজ ইত্যাদি পৃথক করে দেয়, তাদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলে, এমন কি তাদের মধ্যে রোগ পরিচর্যা, শোক-সহানুভূতি, জানাযায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি সম্পর্কও বাকি না রাখে-তবে তার চেয়ে ইসলামের, ইসলামী জাতীয়তার, ইসলামী সংস্কৃতির এবং ইসলামী সমাজ পদ্ধতির দুশমন আর কে হতে পারে?
এ আলোচনা থেকে অনায়াসেই বুঝা যেতে পারে যে, নবুওয়াতে মুহাম্মদীর সাথে দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণতা, পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর রহিতকরণ এবং খতমে নবুওয়াতের বিশ্বাস কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং ইসলামের স্থিতি ও স্থায়িত্ব এবং তার প্রবর্তনের জন্য তার ঈমানের অন্তর্ভুক্তি কেন আবশ্যক।