“তিন”
মৌলিক আকীদা ও চিন্তাধারা
১. ঈমানের তাৎপর্য ও গুরুত্ব
জীবন দর্শন ও জীবন লক্ষ্যের পর এবার আমাদের সামনে তৃতীয় প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়। তা হচ্ছে ঐ যে, ইসলাম কোন ভিত্তির ওপর মানব চরিত্রের পুনগঠন করে?
চরিত্র ও তাঁর মানসিক ভিত্তি
মানুষের সকল কাজ-কর্ম ও ক্রিয়া-কাণ্ডের উৎস হচ্ছে তাঁর মন।কর্ম-কাণ্ডের উৎস হিসেবে মনের দ্যুতি অবস্হা রয়েছে।আকি অবস্থা হচ্ছে ঐ যে,তাতে কোন বিশেষ ধরনের চিন্তাধারা বদ্ধমূল হবে না, নানারূপ বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারা প্রবিষ্ট হতে থাকবে এবং তাঁর মধ্যে যে চিন্তাটি বেশি শন্তিশালী, সেটিই কাজের প্রেরনাদানকারী।আর দ্বিতীয় অবস্থাটি হচ্ছে ঐ যে, তা বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারার বিচরণক্ষেত্র থাকবে না, বরং তাঁর ভেতরে কতিপয় বিশিষ্ট চিন্তাধারা এমনভাবে দৃঢ়মূল হবে যে, তাঁর গোটা বাস্তব জীবন স্থায়ীভাবে তারই প্রভাবাধীন হবে এবং তাঁর দ্ধারা বিক্ষিপ্ত ক্রিয়া-কাণ্ড অনুষ্ঠিত হবার পরিবর্তে সুবিন্যস্ত ও সুসংহত কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হতে থাকবে।প্রথম অবস্থাটিকে একটি রাজপথের সাথে তুলনা করা যেতে পারে; প্রত্যেক যাতায়াতকারীর জন্যই সে পথটি অবাধ,উন্মুক্ত।তাতে কারো বৈশিষ্ট্যতা নেই। দ্বিতীয় অবস্থাটি হচ্ছে একটি ছাঁচের মত; এর ভেতর থেকে হামেশাই একটি নির্দিষ্ট রূপ ও আকৃতির জিনিষ ঢালাই হয়ে বেরোয়। মানুষের মন যখন প্রথম অবস্থায় থাকে, তখন আমরা বলি যে, তাঁর কোন চরিত্র নেই। সে শয়তানও হতে পারে,এবার ফেরেশতাও হতে পারে। তাঁর প্রকৃতিতে রয়েছে বহুরূপী স্বভাব।তাঁর দ্বারা কখন কি ধরনের কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়, কোন নিশ্চয়তা নেই। পক্ষান্তরে সে যদি দ্বিতীয় অবস্থায় আসে তো আমরা বলে থাকি যে, তাঁর একটি নিজস্ব চরিত্র আছে। তাঁর তাঁর বাস্তব জীবনে একটি নিয়ম-শৃঙ্খলা, একটি ধারাবাহিকতা আছে। পরন্তু সে কোন অবস্থায় কি কাজ করবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে।
কর্ম-শৃঙ্খলার প্রথম শর্ত:
এর থেকে জানা গেল যে, মানুষের বাস্তব জীবনে একটি নির্ভরযোগ্য নিয়ম-শৃঙ্খলা অবলম্বন নির্ভর করে তাঁর এক নির্দিষ্ট চরিত্র গঠনের ওপর। আর এরূপ চরিত্র গঠন করতে হলে তাঁর মন-মানসকে চিন্তার বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে হবে,তার ভেতরে কতিপয় বিশিষ্ট চিন্তাধারা বদ্ধমূল হতে হবে এবং অন্য কোন চিন্তাধারা প্রবিষ্ট এবং তাঁর মনোজগতে যাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে না পারে, উক্ত চিন্তাধারায় এতটা স্থিতি, দৃঢ়তা ও অনমনীইয়তার সঞ্চার করতে হবে।এ চিন্তা ধারা যতটা গভীরে প্রোথিত হবে,চরিত্র ততটাই বেশী মজবুত হবে, আর মানুষের বাস্তব জীবন ততটাই সুবিন্যস্ত,সুসংহত ও নির্ভরযোগ্য হবে। অপর দিকে এতে যতটা দুর্বলতা থাকবে, প্রতিকূল চিন্তা-ধারাকে পথ করে দেবার যতখানি অবকাশ থাকবে, চরিত্র ততটাই দুর্বল হবে আর বাস্তব জীবনও সেই পরিমাণে বিশৃঙ্খল ও অনির্ভরযোগ্য হয়ে যাবে।
ঈমানের অর্থ :
কুরআনের ভাষায় চরিত্রের ঐ মানসিক ভিত্তিকেই বলা হয় ‘ঈমান’। ঈমান শব্দটি ‘আমন’(*******) ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। ‘আমন’- এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি ও নির্ভীকতা লাভ। এর থেকেই গঠিত হয়েছে ‘আমানত’ এটি খেয়ানতের বিপরীত শব্দ। অর্থাৎ যাতে খেয়ানতের ভয় নেই,তাই হচ্ছে আমানত। আমীনকে এ জন্যই আমীন বলা হয় যে,তাঁর সদাচরণ সম্পর্কে অন্তর নিঃশংক হয়, সে অসদাচরণ করবে না বলে ভরসা হয়। এভাবে যে উট নিরীহ ও অনুগত হয়, তাকে আমুন (***) বলা হয়। কারন তাঁর দ্বারা অবাধ্যতা ও অনিষ্টকারীতার কোন ভয় থাকে না। এ মূল বর্ণ থেকেই আরেকটি ধাতু রূপ হচ্ছে ‘ঈমান’ (****)। এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, মনের ভেতর কোন কথা গভীর প্রত্যয় ও সত্যতার সাথে এমনভাবে দৃঢ়মূল করে নিতে হবে যে,তাঁর প্রতিকূল কোন জিনিসের পথ খুঁজে পাওয়া ও প্রবিষ্ট হবার শঙ্কাই বাকী থাকবে না, ঈমানের দুর্বলতার অর্থ হচ্ছে এই যে, মন-মানস ঐ কথায় পুরোপুরি নিশ্চিত হয় নি, অন্তঃকরণ পুরোপুরি প্রশান্তি লাভ করে নি, বরং তাঁর প্রতিকূল কথারও মনের মধ্যে প্রবিষ্ট হবার সুযোগ রয়েছ। এরই ফলে চরিত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং এটিই বাস্তব জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। ঈমানের শক্তি ও দৃঢ়টা লাভ হচ্ছে এর বিপরীত জিনিস। সুদৃঢ় ঈমানের অর্থ হচ্ছে এই যে, চরিত্র ঠিক মজবুত ও নিশ্চিত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।এবার নির্ভর করা চলে যে,মনের ভেতর যে চিন্তা ও ভাবধারা বদ্ধমূল হয়েছে এবং যা দ্বারা চরিত্রের ছাঁচ তৈরি হয়েছে,বাস্তব ক্রিয়া-কাণ্ড ঠিক তদনুসারেই সম্পাদিত হবে।
সংস্কৃতির ভিত রচনায় ঈমানের স্থান:
যদি বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের আকিদা ও চিন্তাধারার প্রতি ঈমান রাখে এবং তাদের চরিত্র বিভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে কোন সামাজিক ও সামগ্রিক সংস্থাই গঠিত হতে পারে না। তাদের দৃষ্টান্ত হল,যেমন কোন ময়দানে অনেকগুলো পাথর বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে; প্রতিটি পাথরের নিজস্ব দৃঢ়তা আছে বটে, কিন্তু তাদের ভেতরে কোন সম্পর্ক সূত্র নেই। পক্ষান্তরে যদি একটি অখণ্ড ভাবধারা বহু সংখ্যক লোকের মনে ঈমান হিসেবে বদ্ধমূল হয় তো ঈমানের ঐ ঐক্য সুত্রই তাদেরকে একটি জাতিতে পরিনত করবে- যেমন করে ঐ বিক্ষিপ্ত পাথরগুলোকেই চুন-সুরকি-সিমেন্ট দ্বারা গেঁথে দেয়া হলে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর দাঁড়িয়ে যাবে। এবার তাদের মধ্যে যথারীতি সহায়তা ও সহযোগিতা শুরু হয়ে যাবে, এর ফলে তাদের উন্নতির গতি দ্রুত থকে দ্রুততর হতে থাকবে। এই ধরনের ঈমান তাদের চরিত্রে সামঞ্জস্য এবং বাস্তব ক্রিয়া-কাণ্ডে সাদৃশ্য সৃষ্টি করবে। এর ফলে একটি বিশেষ তমদ্দুন জয়লাভ করবে,এক বিশিষ্ট সংস্কৃতি আত্মপ্রকাশ করবে।এক নতুন জাতির অভ্যুদয় ঘটবে এবং সংস্কৃতির ভবনকে এক নতুন পদ্ধতিতে নির্মিত করবে।
এ আলোচনা থেকে বোঝা গেল যে, যে মৌলিক চিন্তাধারা একটি সংস্কৃতির অনুগামীদের মধ্যে ঈমানরূপে বদ্ধমূল হয়ে যায়, সে সংস্কৃতিতে তাঁর গুরুত্ত অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।
ঈমান দু’ প্রকার :
এবার ঈমানের দিক দিয়ে দুনিয়ার বিভিন্ন সংস্কৃতির অবস্থা কিরূপ,তাই আমাদের দেখা দরকার। ঈমান শব্দটি আসলে একটি একটি ধর্মীয় পরিভাষা। কিন্তু এখানে যেহেতু আমরা তাকে মৌলিক ভাবধারা অর্থে ব্যাবহার করছি, সেহেতু এ অর্থে তাকে দু’ শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। একটি হচ্ছে ধর্মীয় ধরনের, অপরটি পার্থিব ধরনের। ধর্মীয় ধরনের ঈমান কেবল ধর্ম ভিত্তিক সংস্কৃতিরই মূলভিত্তি হতে পারে; কারন এ অবস্থায় একই ঈমান দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রেই কতৃত্বশীল হয়ে থাকে। কিন্তু যে সংস্কৃতি ধর্ম ভিত্তিক নয়, তাতে পার্থিব ঈমান ধর্মীয় ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে ধর্মীয় ঈমানের কোন প্রভাবই থাকে না।
ধর্মীয় ঈমান:
ধর্মীয় ঈমান সাধারনত এমন সব বিষয় নিয়ে গঠিত হয়, যা মানবীয় চরিত্রকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ভিত্তির গড়ে তোলে। যেমন, বিশিষ্ট গুণাবলীতে ভূষিত এক বা একাধিক উপাস্য, ঐশী বলে স্বীকৃত কিতাবাদি এবং ধর্মগুরুদের শিক্ষা ও নিয়ম-নীতি,যার ওপর প্রত্যয় ও কর্মের ভিত্তি স্থাপিত।দ্বীনী দৃষ্টিভঙ্গী বাদ দিলে নিছক পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের ঈমানের সাফল্য দু’টি জিনিসের ওপর নির্ভরশীল। প্রথম এই যে, ধর্ম যে বিষয়গুলোকে সত্য বলে মানায় এবং যেগুলোর প্রতি প্রত্যয় পোষণের দাবী জানিয়েছে, যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধির দিক দিয়ে সেগুলোর সত্যোপযোগী হতে হবে।দ্বিতীয় এই যে, সে বিষয়গুলো এমন ধরতে হবে, যাতে করে সেগুলোর ভিত্তিতে সুষ্ঠুভাবে মানবীয় চরিত্রের পুনর্গঠন হতে পারে। অর্থাৎ তাঁর আধ্যাত্মিকতা যাতে এক উন্নতমানের নৈতিক ব্যবস্হাপনার ভিত্তিস্থাপনকারী হয় এবং তাঁর নৈতিক চরিত্র নিজস্ব পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সাথে সাথে পার্থিব জীবনেও মানুষকে সাফল্য সার্থকতা লাভের উপযোগী করে তোলে,চরিত্রকে তাঁর এমনভাবে গঠন করতে হবে।
প্রথম শর্তটি এ জন্যে জরুরী যে, ঈমান যদি নিছক কতোগুলো সংস্কারের সমষ্টি হয় কিংবা তাতে সংস্কার বেশি ও যুক্তির পরিমাণ কম হয়,তবে মানুষের মনে তার প্রাধান্য সম্পূর্ণত অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার প্রভাবাধীন থাকবে। যে মাত্র মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ক্রমবিকাশের উন্নত স্তরের দিকে যাত্রা শুরু করবে, তখনি ভ্রান্ত সংস্কারে মোহ ভঙ্গ শুরু হয়ে যাবে, ঈমানের ভিত্তি টলমলিয়ে ওঠবে এবং সে সাথে যে যে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার ওপর ব্যক্তি ও জাতীয় চরিত্রের বুনিয়াদ রচনা করা হয়েছিল, তাঁর গোটা ব্যবস্থাপনাই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা বিভিন্ন শিরক ভিত্তিক ধর্ম দেব-দেবী, উপাস্য, আল্লাহ ও ধর্মগুরুদের সম্পর্কে যেসব ধারণা বিশ্বাস পেশ করে, তাঁর কথা উল্লেখ করতে পারি। তাদেরকে যেসব গুণাবলী দ্বারা ভূষিত করা হয়েছে, যেসব ক্রিয়া-কাণ্ড তাদের প্রতি আরোপ করা হয়েছে, যেসব কাহিনী তাদের সম্পর্কে রচনা করা হয়েছে,নিরপেক্ষ বিবেক-বুদ্ধি সে সবকে সত্য বলে মানতে এবং সেগুলোর প্রতি ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানায়। আর প্রায়শই দেখা যায় যে, ঐগুলোর প্রতি বিশ্বাস পোষণকারী জাতি দুনিয়ায় উন্নতি ও অগ্রগতি লাভের উপযুক্তই হয় না।ভ্রান্ত সংস্কার তাদের মনের ওপর এমন মন্দ প্রভাব বিস্তার করে যে, উৎকৃষ্টতম কর্ম-শক্তিগুলোই একেবারে নিস্তেজ হয়ে যায়। তাদের প্রেরনায় না মহত্ত্বের সৃষ্টি হয়, না সংকল্পে হয় দৃঢ়তা। তাদের দৃষ্টিতে না ব্যপ্তির সৃষ্টি হয়, না মগজে হয় আলো আর না হৃদয়ে হয় সৎ সাহস। অবশেষে এ জিনিসটাই ঐ জাতির জন্য স্থায়ী দারিদ্র,লাঞ্ছনা,অপদার্থতা ও গোলামীর কারন হয়ে দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে যে সকল জাতির মধ্যে যে কারনে উন্নতির পথ খুলে যায়, তারা জ্ঞান-বুদ্ধির দিক থেকে যতো উন্নতি করতে থাকে, আপন রব,উপাস্য ও ধর্মগুরুদের ওপর থেকে ততোই তাদের বিশ্বাস চলে যেতে থাকে। প্রথম দিকে অবশ্য নিছক সমাজ ব্যবস্থার নিরাপত্তার খাতিরে ঐ ভ্রান্ত ঈমানকে নিতান্ত অসুবিধা সত্ত্বেও বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে ঐগুলোর বিরুদ্ধে মন-মগজ এত তীব্রভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠে যে, শেষ পর্যন্ত জাতীর মনে ঐগুলোর জন্যে কোন বাধনই অবশিষ্ট থাকেনা। নিছক ক্ষুদ্র একটি আধ্যাত্মিক দলকে ঐগুলোর প্রতি যথার্থ কিংবা পেশাদারী ঈমানের জন্যে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকী গোটা জাতির হৃদয় ও মনেই এক ভিন্ন ধরনের ঈমান-আমরা যাকে পার্থিব ঈমান বলে অভিহিত করেছি-আধিপত্য বিস্তার করে বসে।
দ্বিতীয় শর্তটির আবশ্যকতা একেবারে সুস্পষ্ট। যে ঈমান মানুষকে পার্থিব জীবনের সাফল্য অর্জনের জন্যে তৈরী করতে পারেনা, তার প্রভাব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনেই সীমিত থাকে, বৈষয়িক জীবন পর্যন্ত পৌছতে পারে না। পরিণতির দিক থেকে এরও দু‘টি অবস্থা রয়েছে। হয় ঐগুলোর প্রতি বিশ্বাসী জাতি কোন উন্নতিই করবে না; অথবা উন্নতি করলেও ঐগুলোর বাঁধন থেকে খুব শিগগিরই মুক্তি লাভ করবে, ধর্মীয় ঈমান সাংস্কৃতিক ঈমানের জন্যে জায়গা ছেড়ে দিবে; আর বৈষয়িক জীবনের কর্মপ্রচেষ্টায় জাতির তৎপরতা যখন বেড়ে যাবে, তখন নৈতিকতা ও আধ্মাত্যিকতা ও ধর্মীয় ঈমানের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ধর্মের ছিদ্রান্বেষ করতে চাই না। এ জন্যে বিভিন্ন ধর্মের প্রত্যয়াদি সম্পর্কে এখানে কোন বিস্তৃত আলোচনা করবো না। আপনারা দুনিয়ার ধর্মগুলো অভিনিবেশ সহকারে পর্যালোচনা করলে বিভিন্ন ধর্মের ঈমান কিভাবে তাদের অনুসারীদেরকে পার্থিব জীবনে উন্নতি লাভ করতে বাধা দিয়েছে এবং কিভাবে জ্ঞান ও বুদ্ধির উন্নতির সাথে সাথে বিভিন্ন ধর্মের সহযোগিতা করতে পারেনি, তা অবশ্যই জানতে পারবেন। পরন্তু আপনারা এ-ও দেখতে পাবেন যে, অন্যান্য জাতিগুলো পতনকালে নিজেদের ধর্মীয় বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান রেখেছে এবং উত্থানকালে সেগুলো পরিহার করেছে। পক্ষান্তরে মুসলমান তার ঈমানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী মযবুত ছিলো তখন, যখন সে দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী উন্নত ও অগ্রসর ছিলো। আর যখন সে বুদ্ধি-জ্ঞানে ও পার্থিব উন্নতিতে পিছনে পড়ে রইলো এবং অন্যান্য জাতি তাদের ওপর বিজয় লাভ করলো, তার ঈমানের ভিতর দুর্বলতা আসে ঠিক তখনই। আজ মুসলমানদের চরম পতন অবস্থা। সে সাথে ঈমানী দৌর্বল্যের ব্যধিতেও তারা তীব্রভাবে আক্রান্ত। কিন্তু আজ থেকে হাজার বারো শো বছর পূর্বে তারা ছিলো উন্নতির উচ্চতম শিখরে অবস্থিত; আর সে সাথে নিজেদের ঈমানের ক্ষেত্রেও ছিলো চূড়ান্ত রকমের মজবুত। পক্ষান্তরে ইউরোপের খ্রিষ্টান ও জাপানের বৌদ্ধগণ প্রকৃত খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ছিলো তখন তারা ছিলো চূড়ান্ত পর্যায়ের অধপতিত। আর যখন তারা উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করলো তখন খৃষ্টবাদ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাদের আর ঈমান রইলো না। বস্তুত ইসলামের ঈমান ও অন্যান্য ধর্মের ঈমানের মধ্যে এ এমন এক উজ্জ্বল পার্থক্য যে, যে কোন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষন ব্যক্তি অনায়াসেই এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম।
পার্থিব ঈমান
এবার যে বিষয়গুলোকে আমরা পার্থিব ঈমান বলে অভিহিত করেছি, সেগুলোর প্রতি দৃকপাত করা যাক। এ ঈমানের ভেতর কোন ধর্মীয় উপাদানের অস্তিত্ব নেই। এখানে না কোন খোদা আছে, না আছে কোন ধর্মগুরু; না কোন ঐশী কিতাব আছে, না আছে মানব চরিত্রকে নৈতিক ও আধ্যত্মিক ভিত্তির ওপর গঠন করার উপযোগী কোন শিক্ষাদীক্ষা। এ হচ্ছে খালেছ পার্থিব বিষয়।
এর ভেতর সবচেয়ে বড়ো জিনিস হচ্ছে ‘কওম’ বা জাতি। এটিকে এক ভৌগলিক সীমার মধ্যে বসবাসকারী লোকেরা মা’বুদ (উপাস্য) বানিয়ে পূর্ণ নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে পূজা করে থাকে। এদিক থেকে সমস্ত ‘জাতি পূজক’ এ মর্মে ঈমান পোষণ করে যে, জাতি হচ্ছে তাদের ধন ও প্রাণের মালিক, তার খেদমত করা অবশ্য কর্তব্য, তার উদ্দেশ্যে দেহ-মন ও ধন-প্রাণ উৎসর্গ করা পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। কেবল এইটুকুই নয় বরং তারা এ বিশ্বাসও পোষণ করে যে একমাত্র তাদের জাতিই সত্যাশ্রয়ী, তারাই ভূমির উত্তরাধিকারী ও পাওনাদার, দুনিয়ার সকল ভূমি হচ্ছে তাদের জন্যে যুদ্ধলব্ধ মাল এবং সমুদয় জাতি যুদ্ধবন্দী তুল্য। তাই সারা দুনিয়ায় আপন জাতির ঝান্ডা উড়ানো প্রত্যেক ব্যক্তিরই কর্তব্য।
দ্বিতীয় মা’বুদ হচ্ছে দেশের ‘আইন-কানুন’। এটি তারা নিজেরাই তৈরী করে, আবার নিজেরাই এর উপাসনা করে। এ উপাসনাই হচ্ছে তাদের সামাজিক ও সামগ্রিক নিয়ম-শৃংখলার নিশ্চয়তা দানকারী।
তৃতীয় মা’বুদ হচ্ছে তাদের নিজস্ব ‘নফস’ বা প্রবৃত্তি। এর প্রতিপালন, এর ইচ্ছা ও প্রয়োজন পূরণ এবং এর দাবী ও আকাংখার চরিতার্থতার প্রতি তারা সর্বদা লক্ষ্য রাখে।
চতুর্থ মা’বুদ হচ্ছে ‘জ্ঞান’ ও ‘বিচক্ষনতা’ (ইলম ও হেকমত)।এর প্রতি ঈমান পোষণ করে, এর আলোকে ও পথ-নির্দেশে তারা উন্নতি ও প্রগতির পথে এগিয়ে চলে।
এ ঈমান নিশ্চিতরুপে পার্থিব জীবনের জন্যে কিছু পরিমাণ কল্যাণকর।কিন্তু সত্য ও সততার দিক দিয়ে এর মর্যাদা কতটুকু, এ প্রশ্ন ছেড়ে দিলেও নিছক পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকেও বলা চলে যে, এর কল্যাণকারিতা না যথার্থ, আর না চিরস্থায়ী।এর সবচেয়ে বড় ত্রুটি এই যে, এতে কোন আত্মিক বা নৈতিক উপাদানের অস্তিত্ব থাকেনা, তাই ধর্মের বাঁধন শিথিল হতেই নৈতিক বিকৃতির দরজা খুলে যায়। আবার লোকদের অন্তরে নৈতিক চেতনার সৃষ্টি করা এবং প্রকৃতপক্ষে নৈতিকতার কোন মান সৃষ্টি করা আইনের কাজ নয়। এমন কি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নৈতিকতার সংরক্ষণ করতে পারে, এমন কোন শক্তি ও তার ভেতরে বর্তমান নেই। তার প্রভাব ও কর্মক্ষেত্র অতি সীমিত। বিশেষত যে আইন-কানুন লোকদের নিজেদের তৈরী, এ ব্যাপারে তার অসহায়তা আরো প্রকট। এ জন্যেই এরূপ আইনের বাঁধনকে শিথিল ও সংকুচিত করা সম্পুর্ণ লোকদের ইচ্ছাধীন ব্যাপার; লোকদের ভেতর যতোই কর্ম স্বাধীনতার আকাংখা বৃদ্ধি পায়, পুরানো নৈতিক বাঁধনকে ততোই সংকুচিত ও অসহনীয় মনে হয়।আর নৈতিক বাঁধন সম্পর্কে এ অনুভূতি যখন ব্যপকতর হয়ে পড়ে, তখন জনমতের চাপে নিজের বাঁধনকে শিথিল করতে আইন স্বতঃই বাধ্য হয়। এভাবে ক্রমে ক্রমে নৈতিকতার সমস্ত বাঁধনই খুলে যায় এবং এক ব্যাপক নৈতিক অধ:পতন শুরু হয়ে যায়। আর নৈতিক অধপতন এমন একটি বস্তু যে, তার ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে সম্পদের প্রাচুর্য, রাষ্টশক্তি, বৈষয়িক উপাদান, জ্ঞান বুদ্ধি এর কোনটিই প্রতিরোধ করতে পারে না। এ ঘুণ ভেতর থেকেই ধরতে শুরু করে এবং দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর ইমারতকেও তার সাজসজ্জা সমেত ধ্বসিয়ে দেয়।
এছাড়া জাতিপূজা ও আত্মপূজার অন্যান্য অনিষ্টকারিতাও এমন প্রকট যে, তার বিস্তৃত ও পুংখানুপুংখ বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।এখন তো ঐগুলো বুঝার জন্যে কোন আলাপ-আলোচনা ও চিন্তা-ভাবনারই প্রয়োজন হয় না। কারণ ঐগুলো মতবাদের পর্যায় অতিক্রম করে উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষনের স্তরে এসে পড়েছে। আমরা আজ স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি যে, ঐগুলোর কারণেই এক বিরাট সংস্কৃতি ধ্বংস ও উৎসন্নতার প্রান্তদেশে এসে পৌছেছে। আজ যেসব বস্তুর নিশ্চিত আত্মপ্রকাশের সঙ্কা গোটা দুনিয়াকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলেছে, এ হচ্ছে সে সবেরেই অনিবার্য পরিণতি।
কতিপয় সাধারণ মূলনীতি
এ গোটা আলোচনা থেকে কতিপয় সাধারণ মূলনীতি স্থিরীকৃত হয়। এগুলোকে পরবর্তী আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার পূর্বে এক সঠিক পরস্পরার সাথে হৃদয়ে বদ্ধমূল করা দরকার।
একঃ মানুষের সকল ক্রিয়া-কান্ডের শৃংখলা ও সুসংহতি নির্ভর করে তার এক সুস্থির ও সুনির্দিষ্ট চরিত্র গঠনের ওপর। কোন সুস্থির চরিত্র ছাড়া মানুষের বাস্তব জীবন বিশৃংখল, পরিবর্তনশীল ও অনির্ভরযোগ্যই থেকে যায়।
দুইঃ যেসব ভাবধারা পূর্ণ শক্তি সহকারে মানুষের মনের ভেতর বদ্ধমূল হয়ে যায় এবং তার সমুদয় কর্মশক্তি নিজস্ব প্রভাবাধীন নিয়ে কাজ করানোর মত প্রাধান্য লাভ করে, তাদের ওপরই চরিত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়।ইসলামী পরিভাষায় এ বদ্ধমূল হওয়াকেই বলা হয় ‘ঈমান’ আর এরূপ বদ্ধমূল যাবতীয় ভাবধারাকেই আমরা ‘ঈমানিয়াত’ বলে অভিহিত করে থাকি।
তিনঃ চরিত্রের ভালো-মন্দ, শুদ্ধ-অশুদ্ধ এবং দৃঢ় ও দুর্বল হওয়া সম্পূর্ণত ঐ ‘ঈমানিয়াত’ তথা ঈমানের বিষয়গুলোর সুষ্ঠতা ও দৃঢ়তার ওপর নির্ভরশীল। ওগুলো নির্ভুল হলে চরিত্রও নির্ভুল হবে, মযবুত হলে চরিত্রও মযবুত হবে। নতুবা ব্যাপার ঠিক বিপরীত হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং মানুষের জীবনে এক নির্ভুল ও উন্নতমানের নিয়ম-শৃংখলা স্থাপন করতে হলে তার চরিত্রকে এক অভ্রান্ত ও সুদৃঢ় ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা অপরিহার্য
চারঃ ব্যক্তির একক জীবনের ক্রিয়া-কান্ডকে বিক্ষিপ্ততার কবল থেকে মুক্ত করে সংহত ও শৃংখলাবদ্ধ করার জন্যে যেমন ঈমানের প্রয়োজন, তেমনি বহু ব্যক্তিকে অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ধার করে একটি সুশৃংখল ও সুসংবদ্ধ সমাজ গঠন করতে হলে তাদের সবার হৃদয়েই এ অখন্ড ঈমান দৃঢ়মূল করে দেয়া আবশ্যক। সমাজ ও তমুদ্দুন এটাই দাবী করে।
পাঁচঃ এক অখন্ড ঈমানের প্রভাবাধীনে বহু ব্যক্তির মধ্যে যখন্ এক অখন্ড জাতীয় চরিত্র গড়ে ওঠে এবং সেই চরিত্রের প্রভাবে তাদের জীবনের কর্মকান্ডে এক প্রকারের সাদৃশ্যের সৃষ্টি হয়, তখনই এক বিশেষ ধরন ও প্রকৃতির সংস্কৃতি জন্ম লাভ করে। এ দৃষ্টিতে প্রত্যেক সংস্কৃতিরই সংগঠন ও গোড়াপত্তন জাতীয় চরিত্র নিরুপণ ও দৃঢ়তা বিধানকারী ঈমানের বিষয়গুলো অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে থাকে।
ছয়ঃ যে জাতির ঈমান আধ্যাত্মিক বিষয় সমন্বিত, তার ধর্ম ও সংস্কৃতি হচ্ছে এক ও অভিন্ন।আর যে জাতির ঈমান দুনিয়াবী বিষয় সমন্বিত, সংস্কৃতি তার ধর্ম থেকে পৃথক হয়ে থাকে।এ শেষোক্ত অবস্থায় ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে ধর্মের কো্ন বিশেষ প্রভাব বাকী থাকে না।
সাতঃ ধর্ম থেকে সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতা শেষ পর্যন্ত নৈতিক অধপতন ও ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আটঃ সংস্কৃতিকে ধর্মের প্রভাবাধীনে থাকতে হলে ধর্মের ‘ঈমানিয়াতকে’ এমন আধ্যাত্মিক বিষয় সমন্বিত হতে হবে, যেন মামুলি পর্যায় থেকে নিয়ে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত তা মানুষের বুদ্ধি-বিকাশের সহায়তা করতে পারে। সে সঙ্গে মানুষ যাতে যুগপৎ উচ্চমানের দ্বীনদার ও দুনিয়াদার উভয়ই হতে পারে, সে বিষয়গুলোর দ্বারা তার চরিত্রকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে। বরং তার দুনিয়াদারী ঠিক দ্বীনদারী এবং দ্বীনদারী ঠিক দুনিয়াদারীতে পরিণত হবে।
নয়ঃ যে জাতির ধর্ম ও সংস্কৃতি এক ও অভিন্ন, তার ঈমান শুধু ধর্মীয় ঈমানই নয়, বরং তা যুগপৎ পার্থিব ঈমানও হয়ে থাকে। সুতরাং তার ঈমান টলমলিয়ে ওঠা তার ধর্ম ও সংস্কৃতি উভয়ের জন্যেই মারাত্মক, তার দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের পক্ষেই ধ্বংসাত্মক।
এ সাধারণ মূলনীতিগুলোর প্রেক্ষিতেই আমাদেরকে ঈমান সম্পর্কে ইসলামের ভূমিকার প্রতি সমালোচনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে।
ঈমানের তাৎপর্য, ব্যক্তি চরিত্রে তার বুনিয়াদী গুরুত্ব এবং সামাজিক ও সামগ্রিক সংস্কৃতিতে তার মৌলিক ভূমিকার পর এবার দেখা যাক ইসলাম কি কি জিনিসের প্রতি ঈমান পোষনের আহ্বান জানিয়েছে? তার ঈমানিয়াত যুক্তিবাদী সমালোচনার মানদন্ডে কতখানি উত্তীর্ণ হয়? তার জীবন পদ্ধতিতে ঈমানের ভূমিকা কি? এবং মানুষের ব্যাক্তি চরিত্র ও সামগ্রিক চরিত্রে তা কতখানি প্রভাবশীল হয়?