।।দুই।।
জীবনের লক্ষ্য
জীবন দর্শনের পর একটি সংস্কৃতির উৎকর্ষ-অপকর্ষ নিরূপণ করার জন্যে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তাহলো এই যে, সে মানুষের সামনে কোন্ লক্ষ্যবস্তুটিকে পেশ করে? এ প্রশ্নটি এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, মানুষ যে বস্তুটিকে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে নির্ধারিত করে নেয় তার যাবতীয় ইচ্ছা-বাসনা ও বাস্তব কর্মপ্রচেষ্টা সেই লক্ষ্যেরই অনুগামী হয়ে থাকে। সেই লক্ষ্যটির বিশুদ্ধতা বা অশুদ্ধতার ওপরই মানসিকতার ভালো-মন্দ এবং তার জীবন যাত্রা প্রণালীর শুদ্ধি-অশুদ্ধি নির্ভর করে। তার উন্নতি ও অবনতির ওপরই চিন্তা ও ভাবধারার উন্নতি-অবনতি, নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষ-অপকর্ষ এবং অর্থনীতি ও সামাজিকতার উন্নতি-অবনতি নির্ভরশীল। এরই সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হওয়ার ওপর মানুষের ইচ্ছা-বাসনা ও চিন্তা-ভাবনার সুসংবদ্ধতা বা বিক্ষিপ্ততা, তার জীবনের যাবতীয় তৎপরতার শৃংখলা বা বিশৃংখলা এবং তার শক্তিক্ষমতা ও যোগ্যতা প্রতিভার এক কেন্দ্রীকরণ বা বিকেন্দ্রীকরণ নির্ভর করে। এক কথায়, এই জীবন লক্ষ্যের বদৌলতেই মানুষ চিন্তা ও কর্মের বিভিন্ন পথের মধ্যে থেকে একটি মাত্র পথ নির্বাচন করে নেয় এবং তার দৈহিক ও মানসিক শক্তি, তার বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উপায়-উপকরণকে সেই পথেই নিয়োজিত করে। কাজেই কোন সংস্কৃতিকে নির্ভুল মানদণ্ডে যাচাই করতে হলে তার মূল লক্ষ্য-বস্তুটি অনুসন্ধান করা আমাদের পক্ষে নিতান্তই আবশ্যক।
নির্ভুল সামগ্রিক লক্ষ্যের অপরিহার্য্য বৈশিষ্ট্য:
কিন্তু আলোচনা ও অনুসন্ধানের পরে পা বাড়াবার আগে সংস্কৃতির লক্ষ্য বলতে বুঝায়, তা আমাদের নির্ধারণ করে নেয়া উচিত। একথা সুস্পষ্ট যে, আমরা যখন ‘সংস্কৃতি’ শব্দটা উচ্চারণ করি, তখন তা দ্বারা আমাদের ব্যক্তিগত সংস্কৃতিকে বুঝি না, বরং আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতিকেই বুঝি। এ কারণেই প্রতিটি লোকের ব্যক্তিগত জীবনের লক্ষ্য সংস্কৃতির লক্ষ্যবস্তু হতে পারে না। কিন্তু এর বিপরীতভাবে একটি সংস্কৃতির যা লক্ষ্যবস্তু হবে, অনুবর্তীদের মধ্যকার প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনের লক্ষ্য হওয়া একান্ত অপরিহার্য্য- সে সম্পর্কে তাদের চেতনা থাকুক বা না থাকুক। এই দৃষ্টিতে সচেতনভাবেই হোক আর অবচেতনভাবেই হোক, লোকদের একটি বিরাট দলের সম্মিলিত সামগ্রিক জীবনের লক্ষ্য যা হবে, তাই হচ্ছে সংস্কৃতির লক্ষ্যবস্তু এবং এই লক্ষ্যবস্তুর লোকদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের ওপর এতোটা প্রাধান্য লাভ করতে হবে যে, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব জীবন লক্ষ্য হিসেবে এই দলীয় জীবন লক্ষ্যকে গ্রহণ করতে হবে।
এ ধরনের সামগ্রিক জীবন লক্ষ্যের জন্যে একটি অপরিহার্য্য শর্ত এই যে, লোকদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের সাথে তার পূর্ণ সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রাখতে হবে এবং তার ভিতরে যুগপৎ ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য হবার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে। এ জন্যে যে, সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য যদি লোকদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের প্রতিকূল হয়, তাহলে তার পক্ষে প্রথমতই সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য হওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ যে চিন্তাধারাকে লোকেরা ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ না করবে, তা কখনো সামগ্রিক চিন্তাধারার মর্যাদা পেতে পারে না। যদি কোন প্রচণ্ড শত্রুর প্রভাবে তা সামগ্রিক জীবন লক্ষ্যর পরিণত হয়ও, তবু ব্যক্তির জীবন লক্ষ্য ও সমাজের জীবন লক্ষ্যের মধ্যে মধ্যে অবচেতনভাবেই একটি সংঘাত চলতে থাকবে। অতপর ঐ বিজয়ী শক্তির প্রভাব হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথেই লোকেরা আপন আপন জীবন লক্ষ্যের দিকে ঝুঁকে পড়বে। আর সেই সঙ্গে সমাজের জীবন লক্ষ্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সমাজ সত্তার আকর্ষণ ও সংযোগ শক্তি বিলীন হয়ে যাবে এবং পরিণামে সংস্কৃতির নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে যাবে। এ জন্যেই মানুষের স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্য যা হবে, প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতির নির্ভুল লক্ষ্যবস্তু ঠিক তাই হতে পারে। আর কোন সংস্কৃতির আসল বৈশিষ্ট এই যে, তাকে এমন একটি সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য পেশ করতে হবে, যা হুবহু ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যও হতে পারে।
এ দৃষ্টিতে আমাদের সামনে দু’টি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং এ দু’টির মীমাংসা ছাড়া আমরা সামনে এগোতে পারি নাঃ
একঃ স্বাভাবিকভাবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্য কি?
দুইঃ দুনিয়ার অন্যান্য সংস্কৃতিগুলো যে লক্ষ্যবস্তু পেশ করেছে, মানুষের এই স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্যের সঙ্গে তা কতখানি সংগতিপূর্ণ?
মানুষের স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্য
মানুষের স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্যের প্রশ্নটি এই যে, মানুষ স্বাভাবিকভাবে দুনিয়ায় কি উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা করে এবং তার প্রকৃতি কোন্ জিনিসটি কামনা করে? এটা জানার জন্যে আপনি যদি প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেন যে, দুনিয়ায় তার উদ্দেশ্য কি, তাহলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বিভিন্নরূপ জবাব পাবেন। এবং নিজেদের লক্ষ্য বাসনা ও আশা আকাংখা সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন, সম্ভবত এমন দু’জন লোকও খুঁজে পাবেন না। কিন্তু সবগুলো জবাবকে বিশ্লেষণ করলে আপনি দেখতে পাবেন যে, লোকেরা যে জিনিসগুলোকে নিজেদের লক্ষ্য বলে অভিহিত করছে, তা আদপেই কোন লক্ষ্যবস্তু নয়, বরং একটি বিশেষ লক্ষ্যে পৌঁছার মাধ্যম মাত্র; আর সে বিশেষ লক্ষ্যটি হচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্য ও মানসিক প্রশান্তি। ব্যক্তি বিশেষ যতো উচুঁ দরের মননশীল ও বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন হোন, যতো উন্নতমানের সংস্কৃতিবানই হোন, আর জীবনের যে কোন দিক ও বিভাগেই কাজ করুন না কেন, তার যাবতীয় চেষ্টা-সাধনার মূলে একটি মাত্র লক্ষ্যই নিহিত থাকে আর তাহলো এই যে, সে যেন শান্তি, নিরাপত্তা, আনন্দ ও নিশ্চিন্ততা লাভ করতে পারে। সুতরাং একে আমরা ব্যক্তি মানুষের স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্য বলে অভিহিত করতে পারি।
দু’টি জনপ্রিয় সামগ্রিক লক্ষ্য এবং তার পর্যালোচনা
দুনিয়ার বিভিন্ন সংস্কৃতি যেসব সামগ্রিক লক্ষ্য পেশ করেছে সেগুলোর পুংখানুপুংখরূপ বিচার করলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে বহু পার্থক্য বর্তমান। এখানে তা নির্নয় করা আমাদের উদ্দেশ্যও নয়, আর তা সম্ভবও নয়। তবে মূলনীতির দিক থেকে সেগুলোকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি ঃ
এক ঃ যে সংস্কৃতিগুলোর বুনিয়াদ কোন ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ভাবধারার ওপর স্থাপিত নয় সেগুলো তাদের অনুবর্তীদের সামনে শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য লাভের লক্ষ্য পেশ করেছে। এই লক্ষ্যটি কতিপয় মৌলিক উপাদান দিয়ে গঠিত। এর বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ন উপাদানগুলো হচ্ছে এই ঃ
* রাজনৈতিক প্রাধান্য ও আধিপত্য লাভের কামনা।
* ধন-সম্পদে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের আকাংখা, তা দেশ জয়ের মাধ্যমে হোক আর শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করেই হোক।
* সামাজিক তরক্কীতে সবার চেয়ে অগ্রাধিকার লাভের বাসনা, তা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে হোক আর কৃষ্টি সভ্যতার ক্ষেত্রে শান-শওকতের দিক দিয়ে হোক।
দৃশ্যত এই সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য ও উপরোল্লিখিত ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের পরিপন্থি নয়। কেননা একথা এতোটুকু চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বলা যেতে পারে যে, সমাজের জন্যে এ লক্ষ্যবস্তু নিরূপিত হয়ে গেলেই ব্যক্তির জীবন লক্ষ্যও সেই সঙ্গে নির্ণীত হয়ে যায়। এই লক্ষ্যটির এই বাহ্যিক ধাঁধাঁর কারণেই একটি জাতির লক্ষ-কোটি মানুষ তাদের ব্যক্তিগত জীবন মানুষ তাদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যকে এর ভেতরে বিলীন করে দেয়। কিন্তু দূরদৃষ্টি ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে এই সামগ্রিক লক্ষ্যবস্তুটি ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্যের একেবারেই পরিপন্থী। একথা সুস্পষ্ট যে, প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভে ইচ্ছুক জাতি দুনিয়ায় কেবল একটিই নয় বরং একই যুগে একাধিক জাতি এই লক্ষ্যটি পোষন করে থাকে এবং তারা সবাই একে অর্জন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। এর অনিবার্য ফলে তাদের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়ে যায়, প্রতিরোধ, প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক প্রচন্ড গোলযোগ দেখা যায় আর এই হট্টগোল ও বিশৃংখলার মধ্যে ব্যক্তির শান্তি, স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আজকে আমাদের চোখের সামনে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ঠিক এই অবস্থাই বিরাজমান। তবু যদি ধরেও নেয়া যায় যে, কোন এক যুগে শুধু একটি মাত্র জাতিই এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সচেষ্ট হবে এবং এ ব্যাপারে অন্য কোন জাতি তার পথে বাধ সাধবে না, তবু এর সাফল্যে লোকদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের উপস্থিতি সম্ভব নয়। কারণ এরূপ সামগ্রিক লক্ষ্যের এটা স্বাভাবিক প্রকৃতি যে, এ শুধু আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতারই সৃষ্টি করে না, একটি জাতির আপন লোকদের ভেতরও পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মনোভাব জাগিয়ে তুলে। এর ফলে অন্য জাতির লোকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার, দৌলত, হুকুমত, শক্তি, শান-শওকত ও বিলাস-ব্যসনে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ, অপরের রেযেকের চাবি নিজের কুক্ষিগত করা, অর্থোপার্জনের সকল সম্ভাব্য উপায়-উপকরণের ওপর নিজের একক মনোপলি প্রতিষ্ঠা, লাভ ও স্বার্থটুকু নিজের অংশে এবং ক্ষতি ও ব্যর্থতা অন্যের ভাগে পড়ার কামনা, নিজেকে হুকুমদাতা এবং অন্যকে অধীন ও আজ্ঞানুবতী বানিয়ে রাখার প্রচেষ্টা জাতির প্রতিটি ব্যক্তির জীবন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত এ ধরনের লোকদের কামনা ও বাসনার কোথাও গিয়ে নিবৃত্তি হয় না, এজন্যে হামেশা অস্থির ও অনিশ্চিত থাকে। দ্বিতীয়ত এই শ্রেনীর প্রতিদ্বন্দি¦তা যখন একটি জাতির লোকদের মধ্যে পয়দা হয়, তখন তার প্রতিটি গৃহ ও প্রতিটি বাজারই একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিনত হয়। ফলে দৌলত, হুকুমত ও বিলাস-ব্যসন যতো বিপুল পরিমাণই সঞ্চিত হোক না কেন, শান্তি ও স্বস্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা, আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য একেবারে দুর্লভ হয়ে দাঁড়ায়।
পরন্তু এটা স্বাভাবিক ব্যাপার যে, খালেছ বৈষয়িক উন্নতি- যাতে আধ্যাত্মিকতার কোন স্থান নেই-মানুষকে কখনো স্বস্তি দান করতে পারে না, কারণ নিছক ইন্দ্রিয়জ আনন্দ লাভ হচ্ছে নিতান্তই এক জৈবিক লক্ষ্য; আর এ কথা যদি সত্য হয় যে, মানুষ সাধারণ জীব মাত্র নয়, তার স্থান তার চেয়ে ঊর্ধ্বে তাহলে এটাও নিশ্চিতভাবে সত্য হতে হবে যে, নিছক জৈবিক আকাংখার পরিতৃপ্তির জন্যে যে জিনিসগুলোর রসাস্বাদন যথেষ্ট, কেবল সেগুলো অর্জন করেই মানুষ নিশ্চিত থাকতে পারে না।
দুই ঃ যে সংস্কৃতিগুলোর ভিত্তি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ভাবধারার ওপর স্থাপিত তারা সাধারণভাবে মুক্তি বা নাজাতকে নিজেদের লক্ষ্য বলে ঘোষনা করেছে। নিঃসন্দেহে যে আধ্যাত্মিক উপাদান মানুষকে স্বস্তি ও মানসিক প্রশান্তি দান করে, এ লক্ষ্যটির ভেতর তা বর্তমান রয়েছে। আর একথা সত্য যে, মুক্তি যেমন একটা জাতির লক্ষ্য হতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, এটাও আদতে কোন নির্ভূল জীবন লক্ষ্য হতে পারে না। এর কতিপয় কারণ রয়েছে।
প্রথমত, মুক্তির লক্ষ্যের ভেতর এক ধরনের আত্ম-সর্বস্বতা প্রচ্ছন্ন রয়েছে। এর প্রকৃতি হলো, সামগ্রিকতাকে দূর্বল করে ব্যক্তিত্বকে সবল করে তোলা। কারন ব্যক্তি মানুষ যখন কতিপয় বিশেষ কাজ সম্পাদন করেই মুক্তি লাভ করতে পারে, তখন তাকে ব্যক্তি সর্বস্বতার পরিবর্তে সামগ্রিকতার মর্যাদা দান করতে এবং তাকে সুবিন্যস্ত করার জন্যে ব্যক্তিকে সমাজের সাথে একই কর্মনীতি অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, এমন কোন বস্তুই আর এ লক্ষ্যটির ভেতর থাকে না। কাজেই সংস্কৃতির যা আসল লক্ষ্য, এই ব্যক্তি সর্বস্বতার ভাবধারা তার সম্পূর্ন পরিপন্থী।
দ্বিতীয়ত, মুক্তির প্রশ্নটি আসলে মুক্তিলাভের পন্থার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাই এ লক্ষ্যটির বিশুদ্ধ বা অশুদ্ধ হওয়া এটি অর্জনের জন্যে উদ্ভাবিত পন্থার বিশুদ্ধতা বা অশুদ্ধতার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যে ধর্মগুলো সংসার ত্যাগ ও বৈরাগ্যবাদকে মুক্তির পন্থা বলে নির্দেশ করেছে, সেগুলোতে মুক্তি না ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্য হতে পারে, না পারে সামগ্রিক লক্ষ্য হতে। এরূপ ধর্মের অনুগামীগণ শেষ পর্যন্ত দ্বীনকে দুনিয়া থেকে আলাদা করতে এবং দুনিয়াদার লোকদের মুক্তির জন্যে মধ্যবর্তী পন্থা (যেমন দ্বীনদার লোকদের সেবা, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি) উদ্ভাবনে বাধ্য হয়েছে। এর ফল এই দাঁড়িয়েছে যে এ লক্ষ্যটি আর মিলিতভাবে ব্যক্তি ও সমাজের এক অভিন্ন লক্ষ্য থাকেনি। দ্বিতীয়ত, দ্বীনদারদের একটি নগণ্য সংখ্যা ছাড়া গোটা সমাজের জন্যে এই লক্ষ্যের ভেতর এমন কোন মহত্ব, গুরুত্ব, আকর্ষন শক্তি রইলো না, যা তাকে অক্ষুন্ন করে রাখতে পারে। এ জন্যে সমগ্র দুনিয়াদার লোকই একে ত্যাগ করে উপরোল্লিখিত বৈষয়িক লক্ষ্যের পানেই ছুটে চলেছে। অন্যদিকে যে ধর্মগুলো মুক্তিকে বিভিন্ন দেবতা ও মাবুদের সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল বলে ঘোষনা করেছে, তাদের মধ্যে অভিন্নতা বজায় থাকে না। বিভিন্ন দল বিভিন্ন মাবুদের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং লক্ষ্যের ভেতরে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং যার সম্পর্ক সূত্র দ্বারা সকল অনুগামীদের গ্রথিত করা সংস্কৃতির আসল কাজ, সেই যথার্থ ঐক্যটিই বাকী থাকে না। তাই এসব ধর্মের অনুসাররীরাও পার্থিব উন্নতির পথে চলতে এবং আপন সমাজকে সুসংবদ্ধ করতে চাইলে ভিন্ন লক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
আর এক ধরনের ধর্ম রয়েছে, যার আহ্বান গোটা মানব জাতির প্রতি নয়, বরং কোন বিশেষ বংশ-গোত্র কিংবা কোন বিশেষ ভৌগলিক এলাকায় বসবাসকারী জাতির প্রতি। এবং এই হিসেবে তার দৃষ্টিতে মুক্তি কেবল ঐ বিশেষ গোত্র ও জাতির জন্যেই নির্দিষ্ট। এ লক্ষ্যটি নিঃসন্দেহে তাহজীব ও তামুদ্দুনের প্রাথমিক পর্যায়ে একটি সার্থক সামগ্রিক লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে। কিন্তু নির্ভূল বিচার-বুদ্ধির মানদন্ডে এটিও পুরোপুরি উত্তীর্ন হয় না। বিশেষত মুক্তিটা কোন বিশেষ গোত্রের জন্যে নির্দিষ্ট, একথা মানতে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি সম্মত নয়। এ জন্যে এরূপ ধর্মের অনুগামীগন বুদ্ধিবাদী উন্নতির পথে কয়েক পা বাড়িয়েই এ লক্ষ্যের বিরুদ্ধে নিজেরাই বিদ্রোহ করে বসে এবং তাকে মন থেকে মুছে ফেলে দিয়ে অন্য কোন লক্ষ্য গ্রহন করে।
তৃতীয়ত, মুক্তির লক্ষ্যটি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোন থেকে যতো পবিত্রই মনে হোক না কেন, পার্থিব দৃষ্টিতে একটি জাতিকে অনুপ্রাণিত করা এবং জাতীয় উন্নতির জন্যে প্রয়োজনীয় চেতনা, উদ্দীপনা, শক্তি ও তৎপরতা সৃষ্টিকারী কোন বস্তুই এর ভেতর পাওয়া যায় না। এ জন্যেই আজ পর্যন্ত কোন উন্নতিকামী জাতি একে নিজের সামগ্রিক লক্ষ্য হিসেবে গ্রহন করেনি, বরং যে সমস্ত জাতির ধর্ম এই একটি মাত্র লক্ষ্য পেশ করেছে, তাদের মধ্যে হামেশাই ব্যক্তিগত লক্ষ্যের মর্যাদা পেয়ে আসছে।
এ সকল কারণেই বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক এই উভয় লক্ষ্যই নির্ভূল মানদন্ডের বিচারে পুরোপুরি উত্তীর্ন হয় না। এবার ইসলামী সংস্কৃতি কোন্ বস্তুটিকে তার লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছে এবং তার কোন্ কোন্ স্বভাব-প্রকৃতি তাকে একটি নির্ভূল লক্ষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তা-ই আমরা দেখবো।
ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য ও তার বৈশিষ্ট্য:
এ আলোচনার সূচনায়ই একথা ভালোমত মনে রাখা দরকার যে, জীবন লক্ষ্যের প্রশ্নটি আসলে জীবন দর্শন সম্পর্কিত প্রশ্নের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। আমরা পার্থিব জীবন সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করি এবং দুনিয়ায় নিজেদের মর্যাদা ও নিজেদের জন্যে দুনিয়ার মর্যাদা সম্পর্কে যে মতবাদটি বিশ্বাস করি, তাই স্বাভাবিকভাবে জীবনের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয় এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে আমাদের তাবৎ শক্তি ক্ষমতাকে নিয়োজিত করে দেই। আমরা যদি দুনিয়াকে একটা চারণক্ষেত্র বলে মনে করি এবং জীবনটাকে শুধু পানাহার আর পার্থিব বিলাস-ব্যসনে পরিতৃপ্তি লাভের একটা অবকাশ বলে ধারণা করি, তাহলে এ জৈবিক ধারণা নিঃসন্দেহে আমাদের ভেতর জীবন সম্পর্কে এক জৈবিক লক্ষ্য জাগিয়ে দেবে এবং জীবনভর আমরা শুধু ইন্দ্রিয়জ ভোগোপকরণ সংগ্রহের জন্যই চেষ্টা করতে থাকবো। পক্ষান্তরে আমরা যদি নিজেদেরকে জন্মগত অপরাধী এবং স্বভাবগত পাপী বলে বিবেচনা করি এবং সেই জন্মগত অপরাধে দুনিয়ার এই কারাগার ও বন্দীশালায় আমাদের মধ্যে এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি লাভের আকাংখা জাগ্রত হবে এবং এ কারণে মুক্তিকে আমরা আমাদের জীবন লক্ষ্য বলে ঘোষণা করবো। কিন্তু দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা যদি চারণভূমি আর বন্দীশালা থেকে উন্নততর হয় এবং মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদেরকে সাধারণ প্রাণী ও অপরাধীর চেয়ে উচ্চ মর্যাদাবান বলে মনে করি তাহলে নিশ্চিতরূপে বৈষয়িক ভোগোপকরণের সন্ধান ও পরিত্রান লাভ – এই উভয় লক্ষ্যের চেয়ে উন্নততর কোন লক্ষ্যেরই আমরা সন্ধান করবো এবং কোন তুচ্ছ বা নগণ্য বস্তুর প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না।
এ নিয়মটিকে সামনে রেখে আপনি যখন দেখবেন যে, ইসলাম মানুষকে আল্লাহর খলীফা এবং দুনিয়ার বুকে তাঁর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেছে, তখন এই জীবন দর্শন থেকে স্বাভাবিকভাবেই যে লক্ষ্যের সৃষ্টি হতে পারে এবং হওয়া উচিত, আপনার বিবেক-বুদ্ধি স্বভাবতই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবে। একজন প্রতিনিধি তার মালিকের সন্তুষ্টি ও রেযামন্দী লাভ করবে এবং তাঁর দৃষ্টিতে একজন উত্তম, অনুগত, বিশ্বস্ত ও কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মচারী বলে বিবেচিত হবে – এ ছাড়া তার আর কি লক্ষ্য হতে পারে? সে যদি সত্যনিষ্ঠ ও সদুদ্দেশ্যপরায়ণ হয়, তাহলে মনিবের আজ্ঞাপালনে তাঁর সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া আর কোন বস্তু কি তার উদ্দেশ্য হতে পারে? সে কি নিজের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি, কোন স্বার্থলাভের আশা, কোন পদোন্নতি বা পুরষ্কার লাভ, অথবা খ্যাতি-যশ ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির প্রলোভনে পড়ে তার কর্তব্য পালন করবে? অবশ্য মনিব যদি খুশী হয়ে তাকে এসব দান করেন, সেটা আলাদা কথা। মনিব তাকে সুষ্ঠু খেদমতের বিনিময়ে এগুলো দান করার আশ্বাসও দিতে পারেন, এমন কি সঠিকভাবে কর্তব্য পালন করলে মনিব তাকে খুশী হয়ে অমুক অমুক পুরষ্কার দান করবেন, একথাও সে জানতে পারে। কিন্তু সে যদি পুরষ্কারকেই নিজের লক্ষ্য বানিয়ে নেয় এবং নিছক স্বার্থলাভের উদ্দেশ্যে কর্তব্য পালন করে তাহলে এমন কর্মচারীকে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই কি কর্তব্য নিষ্ঠ কর্মচারী বলতে পারে? এই দৃষ্টান্ত দ্বারা আল্লাহ এবং তাঁর প্রতিনিধির বিষয়টিও অনুমান করতে পারেন। মানুষ যখন দুনিয়ার বুকে আল্লাহর প্রতিনিধি, তখন আল্লাহর রেযামন্দী ও সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া তার আর কী জীবন লক্ষ্য হতে পারে?
“হাঁ যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে আত্বসমর্পণ করেছে এবং সে সৎকর্মশীল হয়েছে, তার পুরস্কার তার পরোয়ারদেগারের কাছে; এমনি লোকদের জন্য কোন ভয়ের কারন নেই আর এরা কখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হয় না।”-(সূরা আল বাকারা :১১২)
“ জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই আত্বার প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততা লাভ হয়ে থাকে।”-(সূরা আর রাদ :২৮)
দুনিয়ার জীবনে মানুষ দ্বিতীয় যে জিনিসটি লাভ করতে চায়, তা হচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্য, অর্থাৎ দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগমুক্ত জীবন। কুরআন বলে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলে, তাঁর গযব থেকে বেঁচে থাকলে এবং তাঁর জন্যে পরহেযগারী ও সৎকর্মশীলতা অবলম্বন করলে এ বস্তুটিও স্বাভাবিকভাবে হাসিল হয়ে যায়।
“ এ বস্তিগুলোর লোকেরা যদি ঈমান আনতো, পরহেযগারী অবলম্বন করতো তাহলে আমরা তাদের জন্যে আসমান ও জমিন থেকে বরকতের দরজা খুলে দিতাম।”-(সূরা আল আরাফ : ৯৬)
“ যে ব্যক্তি নেক কাজ করলো মু’মিন অবস্হায়- সে পুরুষ হোক আর নারী- আমরা তাকে অবশ্যই স্ব্ছন্দ জীবন যাপন করাবো। এমন লোকদেরকে আমরা নিশ্চিতরূপে তাদের আমলের চেয়ে অনেক বেশী উত্তম প্রতিফল দান রবো।”-(সূরা আন নাহল : ৯৭)
তৃতীয় যে জিনিসটি মানুষের সবচেয়ে বেশী কাম্য ও অভিপ্রেত তা হচ্ছে রাষ্ট্র ও শাসন ক্ষমতা এবং আধিপত্য ও উচ্চ মর্যাদা। কুরআন বলে যে, তোমরা আল্লাহর প্রতি নিবেদিত হও, এ সম্পদটি নিজেই তোমাদের পায়ের ওপর এসে পড়বে।
“ যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং ঈমানদার লোকদের বন্ধু হয়েছে, (সে আল্লাহর দলে যোগদান করেছে), আর আল্লাহর দল অবশ্যই বিজয়ী হবে।” _(সূরা আল মায়েদা : ৫৬)
“আমরা জবুরে উপদেশ ও নসিহতের পর একথা লিখে দিয়েছি যে, আমাদের নেক বান্দাগণই হবে পৃথিবীর উত্তরাধীকারী।”
“তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে খেলাফত দান করবেন, তাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে তিনি যেভাবে খলিফা বানিয়েছিলেন। আর তিনি তাদের জন্য যে দ্বীনকে পসন্দ করেছেন তাকে অবশ্যই তিনি স্হিতি দান করবেন এবং তাদের ভীতিজনক অবস্হার পর শান্তি প্রদান করবেন।”-(সূরা আন নূর : ৫৫)
অনুরূপভাবে পরকালীন জীবনে মুক্তি মানুষের একান্ত কাম্য। এ সম্পর্কেও কুরআন বলে যে, এ শুধু আল্লাহর সন্তোষ লাভেরই ফলমাত্র :
“ হে নিশ্চিন্ত নফস, আপন প্রভূর দিকে প্রত্যাবর্তন করো, এমন অবস্হায় যেন তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট; অতপর (আল্লাহ বলবেন যে) তুমি আমার বান্দাদের মধ্যে শামিল এবং আমার বেহেশতে দাখিল হয়ে যাও।”-(সূরা আল ফজর : ২৭-৩০)
এ থেকে জানা গেলো যে, অন্যান্যরা যতো জিনিকে কাম্য ও অভীষ্ট বলে ঘোষণা করেছে, ইসলাম সে সবের প্রতি দৃস্টিপাত পর্যন্ত করেনি, বরং যে বস্তুটি অর্জনের ফলে এসব জিনিস আপনা-আপনি হাসিল হয় যায়, ইসলাম সেটিকেই তার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নিয়েছে। অন্যান্যরা যেসব জিনিসকে নিজেদের লক্ষ্য বলে অভিহিত করে, সেগুলোর অন্বেষণে মুসলমান তার অন্তকরণকে এক মুহূর্তের জন্যেও লিপ্ত করবে, তার দৃষ্টিতে তা এতটুকু উপযোগীও নয়। তার সামনে তো ঐ সকল লক্ষ্য এবং সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুর চেয়ে উন্নত ও সুউচ্চ এক মহান লক্ষ্য রয়েছে। সে ভালো করেই জানে যে, এ উচ্চতম লক্ষ্যে যখন সে উপনী হবে, তখন এর অধীনস্হ প্রতিটি জিনিস আপনা-আপনিই সে পেয়ে যাবে। ইমারতের সবচেয়ে উপরের তলায় আরোহণ করলে মধ্যবর্তী তলাগুলো যেমন আরোহণকারীর পায়ের নীচে থাকে, মুসলমান তার লক্ষ্যে পৌঁছে ঠিক সেরূপ অবস্হাই দেখতে পায়।
ছয়ঃ তাকওয়া সৎকর্মশীলতার সর্বোত্তম প্রেরণা- এ লক্ষ্যটির আর একটি বৈশিষ্ট্য এ যে, ইসলাম পরহেযগারী ও সৎকর্মশীলতার যে উন্নত মান প্রতিষ্টা করেছে এবং তার জন্য ন্যায় ও অন্যায়ের যে বিধি-নিষেধ পেশ করেছে, মানুষকে তা পালন করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করার নিমত্ত এ লক্ষ্যটিই একমাত্র মার্জিত ও পবিত্র লক্ষ্য হতে পারে।
দুনিয়ার সৎকাজ যে শুধু সৎকাজ বলেই করা উচিত আর দুষ্কৃতিকে কেবল দুষ্কৃতির কারনেই বর্জন করা উচিত- এমন কথা বলার মতো লোকের কোন অভাব নেই। কিন্তু এ ধরনের কথা যারা বলেন, এর প্রকৃত তাৎপর্যটা পর্যন্ত তাদের জানা নেই। নিছক সৎকাজের খাতিরে সৎকাজ করার মানে হচ্ছে এই যে, সৎকাজের সাথে কোন কল্যাণ ও উপকারীতার সম্পর্ক নেই; সৎকাজ সৎকাজই, আর এ কারণেই তা মানুষের অভীষ্টও হতে পারে। অনুরূপভাবে শুধু দুষ্কৃতির জন্যেই দুষ্কৃতি থেকে বিরত থাকার অর্থ হচ্ছে এই যে, সমস্ত ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দুষ্কৃতি তার নিজস্ব চরিত্রেই দুষ্কৃতি, যেনো তার চরিত্রটাই মানুষের পক্ষে বর্জনীয় হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার মানুষের জন্যে এমন নির্ভেজাল সৎকাজের কোন অস্তিত্ব নেই, যা মানুষের ব্যক্তি সত্বার প্রতি আরোপিত হবার উপযোগী ফায়দা ও কল্যাণ থেকে মুক্ত। আর না এমন খালেছ দুষ্কৃতির অস্তিত্ব আছে,যা মানুষের ব্যক্তি সত্তাকে প্রভাবিত করার অনিষ্টকারীতা থেকে শূণ্য।বরং সত্য কথা এ যে, লাভ ও ক্ষতি তথা উপকারীতা ও অনিষ্টরীতার অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মনে সৎকাজ ও দুষ্কৃতির ধরণা পয়দা হয়েছে। যে কাজ দ্বারা মানুষের প্রকৃতই কোন উপকার হয়, দৃশ্যত তার ভিতরে কিছু অপকারীতা থাকলেও, মানুষ তাকেই সৎকাজ বলে অবিহিত করে। আবার যে কাজ দ্বারা তার যথার্থই কোন ক্ষতি সাধিত হয়, বাহ্যদৃষ্টিতে তার ভেতর কিছু অপকারীতা থাকলেও, মানুষ তাকেই দুষ্কৃতি বলে আক্ষায়িত করে। কোন কাজকে যদি লাভ ও ক্ষতির বিশেষণ থেকে মুক্ত করে নেয়া হয় এবং কাজটি শুধু একটি ক্রিয়াই থেকে যায়, তবে আমরা তাকে সৎকজ বা দুষ্কৃতি এর কোনটাই আখ্যা দিতে পারিনা। একথা নিঃসন্দেহ যে, সৎকাজের অভ্যাস দৃঢ়তর হওয়া এবং উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে উপীত হবার পর মানুষের পক্ষে লাভ ও ক্ষতির ধারণা থেকে মুক্ত হয়েও নিছক সৎকাজের খাতিরে সৎকাজ করা এবং দুষ্কৃতির জন্যেই দুষ্কৃতি থেক বিরত থাক সম্ভবপর। কিন্তু প্রথমত এটা শুধু কল্যাণ ও অকল্যাণের উৎস সম্পর্কে বিস্মৃতি মাত্র, উৎসের অপসারণ নয়; দ্বিতীয়ত এটা শুধু দার্শনিকদের কল্পনার স্বর্গারোহণ মাত্র, কার্যত বড়ো বড়ো বিজ্ঞানীরও এ পর্যন্ত পৌঁছার সৌভাগ্য হয়নি। কাজেই সাধারণ লোকেরা নিছক সৎকাজ অবলম্বন ও দুষ্কৃতি পরিহারকে কিভাবে আপন লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে?
এ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, সৎকাজ ও দুষ্কৃতির ধারণাকে লাভ ক্ষতির ধারণা থেকে পৃথক করা যেতে পারেনা। সৎকজের ভেতরে যতক্ষণ না কোন কল্যাণকারীতা নিহিত থাকবে, ততক্ষণ তা মানুষের পক্ষে কল্যাণকর হতে পারেনা। ঠিক তেমনিভাবে দুষ্কৃতির ভেতরে কোন অনিষ্টকারিতা প্রচ্ছন্ন না থাকলে তাকে বর্জনীয় বলে আখ্যা দেয়া যেতে পারে না। এবার যদি আমরা পরহেযগারী ও সৎকর্মশীলতাকে স্বার্থপরতার তুচ্ছ পর্যায় থেকে স্বার্থহীনতা ও ঐকান্তিকতার উচ্চপর্যায়ে উন্নীত করা এবং তাকে এক নির্বিশেষ ও সার্বজনীন নৈতিক বিধানের ভিত্তি বলে অভিহিত করতে চাই, তাহলে তার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে এই যে, লাভ ও ক্ষতির এমন একটি মানদন্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা হবে বস্তুসর্বস্বতা ও স্বার্থপরতার চেয়ে উন্নততর; যার ভিত্তিতে সর্ববিধ বৈষয়িক ও মানবিক ক্ষতি দ্বারা পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও একটি সৎকাজ মানুষের চোখে শুধু কল্যাণময় বলেই প্রতিভাত হবে এবং সবদিক দিয়ে মঙ্গলময় হওয়া সত্ত্বেও একটি পাপ কাজকে শুধু ক্ষতিকারক বলেই মনে হবে। ইসলাম এ পন্হাটিই অবলম্বন করেছে। সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন না অর্জনকে লাভ ও ক্ষতির একমাত্র মানদন্ড বলে ঘোষনা করেছে। এ মানদন্ড বৈষয়িক স্বার্থপরতামূলক পংকিলতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। এ মানদন্ড অনুযায়ী একজন সৎকর্মশীল মানুষ আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্যে নিজের জান, মাল, সন্তানাদি, সুনাম, সুখ্যাতি ইত্যাদি কুরবান করেও এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, সে লাভবান হয়েছে। আবার একজন দুষ্কৃতিপরায়ণ মানুষ আল্লাহর গযব ডেকে আনার পর দুনিয়ার সকল বৈষয়িক ও স্বার্থপরতামূলক ফায়দা হাসিল করেও এ ভয় পোষণ করে যে, সে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। এ জিনিসটাই মানুষকে পার্থিব লাভ ও ক্ষতির প্রতি বেপরোয়া করে নিঃস্বার্থচিত্তে পরহেযগারী ও সৎকর্মশীলতা অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ করে।
এ পর্যন্ত দু’টি বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথম এই যে, ইসলাম কোন জিনিসটাকে জীবনের লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছে? দ্বিতীয় এই যে, কি কি কারনে তা একটি উত্তম লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়েছে? এবার এ প্রশ্নের তৃতীয় দিকের প্রতি আমাদের আলোকপাত করতে হবে। আর তাহলো এই যে, ইসলামী সংস্কৃতিকে একটি বিশিষ্ট সংস্কৃতির রূপদানে এ লক্ষ্যটির ভূমিকা কি এবং এ সংস্কৃতিকে স কোন্ বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছে?
পন্থা নিরূপণে লক্ষ্য নির্ধারণের প্রভাব
ইতিপূর্বে এ সত্যটির প্রতি ইশারা করা হয়েছে যে, জীবনের যাবতীয় কারবারে লক্ষ্য নিরূপণের যেমন একান্ত প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন লক্ষ্য অর্জনের পন্থা নির্ধারণেরও। আর পন্থা কখনো লক্ষ্যের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোন ভিত্তিতে নিরূপতি হতে পারে না। যদি কোন ব্যক্তির সামনে নিছক ঘুরাফিরা ছাড়া কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বর্তমান না থাকে এবং সে শুধু রাস্তা-ঘাট ও অলি-গলির ধূলো সাফ করে বেড়ায়, তাহলে তাকে আমরা পাগল বা ভবঘুরে বলে আখ্যা দিয়ে থাকি। আর সে যদি লক্ষ্য পোষণ করেও, কিন্তু তা অর্জনের বিভিন্ন পন্থার মধ্যে কোন বিশেষ পন্হার অনুসারী না হয়, বরং যে পন্থাটি তার লক্ষ্যাভিমুখী বলে মনে হয়, সেটিই অবলম্বন করার জন্য তৈরী হয়ে যায়, তবে তাকেও আমরা নির্বোধ বলে অভিহিত করি। কারন যে ব্যক্তি একটি বিশেষ স্থানে যাবার জন্যে দশটি বিভিন্ন পথে চেষ্টা করে, বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী সে কখনো লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারেনা। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি যদি কোন বিশেষ জিনিসকে নিজের অভীষ্ট বলে ঘোষণা করে, আর তা অর্জনের জন্যে বিপরীত দিকগামী পন্থা অবলম্বন করে, তবে তাকে আমরা বুদ্ধিমান বলে মনে করিনা। কারন সে হচ্ছে, এমন বেদুঈনের মতো যে কাবার দিকে যাবার জন্যে তুর্কিস্তানের পথ ধরেছে। সুতরাং মানুষের বাস্তব সাফল্যের জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে, পথ চলার জন্যে প্রথমে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা, তারপর সেই লক্ষ্যের দিকে তার যাবতীয় ইচ্ছা-বাসনা ও প্রয়াস-প্রচেষ্টার মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া, আর সেই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার বিভিন্ন পথ থাকলে তার ভেতরকার সর্বোত্তম পন্থাটি অবলম্বন করা এবং বাকী সমস্ত পথ বর্জন করা।
এ গ্রহন ও বর্জন সম্পূর্ণ বিচার-বুদ্ধিসম্মত। লক্ষ্য নির্ধারণের ফল এই যে, যে পন্থাটি এ লক্ষ্যের সাথে বিশেষভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ, সেটি অবলম্বন করতে হবে এবং বাদবাকী সমস্ত পন্থা পরিহার করতে হবে। একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি যখন ভ্রমণে বেরোয়, তখন লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার সবচেয়ে উত্তম পথটিতেই সে এগিয়ে চলে। তার ভ্রমণকালে এছাড়া আর দশ-বিশটি পথের সন্ধান পায়, তার প্রতি ফিরেও তাকায় না। একজন বুদ্ধিমান ছাত্রের লক্ষ্য অর্জনের পথে জ্ঞানের যে শাখাটি সবচেয়ে বেশি সহায়ক,সেই শাখাটিই সে অবলম্বন করে। তার সাথে আর যেসব শাখার সম্পর্ক নেই, তাতে সে নিজের সময় ব্যয় করতে পছন্দ করে না। একজন বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ব্যবসায়ীর কাছে ব্যবসায়ের যে পন্থাটি সাফল্য লাভের সর্বোত্তম উপায় বলে বিবেচিত হয়,নিজের জন্য সেই পন্থাটি সে অবলম্বন করে।যে কোন কাজে পুঁজি খাটানো এবং যে কোন বৃত্তিতে নিজের শ্রম ব্যয় করাকে সে নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করে।এ গ্রহন ও বর্জনের ব্যাপারে অনুসৃত পথটি লক্ষ্যস্থলে পৌছার পক্ষে সর্বোত্তম হয়েছে কিনা, একজন সমালোচক শুধু এটুকু মতামতই পেশ করতে পারে। কিন্তু গ্রহণ ও বর্জন সম্পর্কে কোন আপত্তি তোলা সম্ভপর নয়।
এ সত্যটি জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে যেমন প্রযোজ্য,তেমনি সামগ্রিকভাবে গোটা জীবনের বেলায় ও প্রযোজ্য। মানুষ যদি তার জীবন সম্পর্কে কোন লক্ষ্য পোষণ না করে অথবা শুধু বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকাই তার লক্ষ্য হয়, তবে জীবন যাপনের জন্য সে যে কোন পন্থা ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারে। তার পক্ষে বিভিন্ন পন্থার মধ্যে ভাল-মন্দ, শুদ্ধ-অশুদ্ধ এবং উৎকৃষ্ট- অপকৃষ্টের তারতম্য করা একেবারে অর্থহীননিজের কামনা-বাসনা ও প্রয়োজনাদি সে যেভাবে খুশি পূর্ণ করতে পারে। বাহ্যিক কার্য-কারন তাকে এক বিশেষ পন্থার অনুসরণে কিছুটা বাধ্য করলেও তার গোটা জীবনকে কোন নিয়ম- শৃঙ্খলা ও বিধি-বিধানের অনুবর্তী করার ব্যাপারে তো কার্যকরী হতে পারে না। কারন নিয়ম- শৃঙ্খলার কোন মৌলিক প্রেরণাই তার ভেতরে বর্তমান থাকবে না। পক্ষান্তরে সে যদি জীবন সম্পর্কে কোন লক্ষ্য পোষণ করে কিংবা স্পষ্ট ভাষায় জীবন সম্পর্কে সহজাত জৈবিক লক্ষের উর্দ্ধে কোন যুক্তিসংগত মানবিক লক্ষ্য তার মনে বদ্ধমূল হয়, তবে বিভিন্ন পন্থার মধ্যে সে অবশ্যই তারতম্য করবে। আর প্রকৃতপক্ষে সে যদি একজন বুদ্ধিমান মানুষ হয় তো জীবন-যাপনের বিভিন্ন পন্থার মধ্যে তার লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে অধিকতর উপযোগী একটি পন্থা তাকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে নেয়ার পর পন্থাবলম্বনে লক্ষ্যহীন মানুষের মতোই আযাদী ভোগ করা তার পক্ষে কিছুতেই সংগত হবে না।
এবার এ নীতিটিকে একটু প্রসারিত করুন। ব্যক্তির জায়গায় সমাজকে নিয়ে দেখুন,বহু ব্যক্তির ওপরও ঠিক এ নীতিই সমভাবে প্রযুক্ত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন সমাজ সভ্যতার প্রাথমিক স্তরে থাকে এবং জীবন সম্পর্কে সহজাত জৈবিক লক্ষ্যের উর্দ্ধে কোন উচ্চ ও উচ্চতর লক্ষ্য তাদের সামনে বর্তমান থাকে না, ততক্ষন তারা নিজের রীতিনীতি ও চাল-চলনের একজন লক্ষ্যহীন মানুষের মতোই স্বাধীন থাকে। কিন্তু বুদ্ধির ক্রমবিকাশ ও সভ্যতার অধিকতর উঁচু স্তরে পৌছার পর যখন তাদের ভেতরে একটি সংস্কৃতির জন্ম হয় এবং সে সংস্কৃতি তাদের সামগ্রিক জীবনের জন্য যুক্তিসংগত লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়, তখন সেই লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আকীদা- বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, লেন-দেন, নৈতিক চরিত্র, সামাজিকতা, অর্থনীতি ইত্যাদির জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা সংস্কৃতির অনুগামীদেরকে সে ব্যবস্থার অনুসারী করে তোলা এবং আর আওতাধীনে থেকে কাউকে এর বহিস্থঃ কোন আকীদা বা কর্মনীতি অবলম্বন্বাধীনতা না দেয়া একান্ত অপরিহার্য হয় পড়ে।
আপন বিধি-ব্যবস্থার সংরক্ষণে একবিম্ব কড়াকড়ি খোদ সংস্কৃতির প্রকৃতির সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ব্যাপারে যে সংস্কৃতির বাঁধন শিথিল হবে এবং বিধি- ব্যবস্থার দৌর্বল্য ও শিথিলতা পাওয়া যাবে, তা কখনো বেঁচে থাকতে পারে না। কারন সংস্কৃতির যে আকীদা ও কর্মপদ্ধতির উদ্ভাবন করেছে, তার অনুগামীগণ কর্তৃক তার অনুসরণের ওপরই নির্ভর করে তার অস্তিত্ব। যখন অনুগামীরা তাদের আকীদা ও কর্মপদ্ধতির অনুসরণ করবে না এবং ঐ পদ্ধতির বহির্ভূত ধ্যান-ধারনা, রীতি-নীতি ও আচার- ব্যবহার তাদের বাস্তব জীবনকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে, তখন কার্যত সংস্কৃতির কোন অস্তিত্বই বাকী থাকবে না। কাজেই একটি সংস্কৃতির পক্ষে নিজের অনুগামীদের কাছে নিজেদেরই উদ্ভাবিত পদ্ধতির অনুসরণের দাবী করা এবং অন্যান্য বহিস্থ পদ্ধতির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার ব্যাপারে চাপ প্রদান সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।সমালোচক বড়জোর এর উদ্দেশ্যের যথার্থ বা অযথার্থ সম্পর্কে কথা বলতে পারেন কিংবা এ উদ্দেশ্যের পক্ষে এ বিশেষ পন্থাটি উপযোগী কিনা, এ সম্পর্কে রায় দিতে পারেন অথবা সর্বাবস্থায় এ পদ্ধতিটির অনুসরণ সম্ভপর কিনা, এ সম্মন্ধে মত প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু আলোচ্য সংস্কৃতি তার অনুগামীদের কাছে নিজেরই উদ্ভাবিত পদ্ধতির অনুসরণের দাবী করার অধিকারী নয়, একথা কিছুতেই বলতে পারে না।
পরন্তু এ নীতিও যখন স্বীকৃত হয়েছে যে, মানসিক ও বাস্তব জীবনের জন্য যে বিশেষ পথ ও পন্থা নির্ধারণ করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তা নির্ভর করে লক্ষ্যের ধরনের ওপর, আর লক্ষ্যের বিভিন্নতার ফলে পথ ও পন্থার বিভিন্নতাও আবশ্যক, তখন এ কথাও মানতে হবে যে, যেসব সংস্কৃতি আপন লক্ষ্যের দিয়ে বিভিন্নমুখী হবে, তাদের বাস্তব ও বিশ্বাসগত পদ্ধতিগুলোও অনিবার্যরূপে পরস্পর থেকে ভিন্নরূপ হতে হবে। সে পদ্ধতিগুলোর কোন কোন অংশের মধ্যে সাদৃশ্য থাকতে পারে, একটি পদ্ধতির মধ্যে অন্য পদ্ধতির কোন কোন খুঁটিনাটি বিষয় এসে যেতে পারে, কিন্তু এ ছোটোখাটো সাদৃশ্য থেকে না সামগ্রিক সাদৃশ্যের সিদ্ধান্ত নেয়া চলে, আর না খুঁটিনাটি জিনিস ধার করার ফলে গোটা পদ্ধতিটারই ধারিত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে।
এ মূলনীতি থেকে আরো দুটি সূত্র বেরোয়:
প্রথম ঐ যে, একটি বিশেষ লক্ষ্য পোষণকারী সংস্কৃতির ব্যবহারিক পদ্ধতি যাচাই করার জন্য ভিন্ন লক্ষ্য পোষণকারী কোন সংস্কৃতির পদ্ধতিকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে না। অর্থাৎ ঐ পদ্ধতিটি যদি ঐ পদ্ধতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়, তবেই অভ্রান্ত নচেৎ ভ্রান্ত সমালোচনায় এ পদ্ধতি সংগত নয়।
দ্বিতীয় ঐ যে, একটি সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখে তার বাস্তব ও বিশ্বাসগত পদ্ধতিকে অন্য পদ্ধতির সাথে বদলানো যেতে পারে না। আর একটি পদ্ধতির মৌলিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্য মধ্যে প্রবেশ করানো চলে। এ ধরনের জগাখিচুড়ীকে যে ব্যক্তি সম্ভব না সংগত মনে করে, সে সংস্কৃতির মূলনীতির সম্পর্কেই অনবহিত এবং তার মেজাজ ও প্রকৃতি অনুধাবনেই অযোগ্য।
ইসলামী সংস্কৃতির গঠন বিন্যাসে
তার মূল লক্ষ্যের ভূমিকা
এ প্রাথমিক কথা গুলো মনে রাখার পর ইসলামী সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণত একটি পৃথক ও বিশিষ্ট সংস্কৃতির রূপদানে তার মূল লক্ষ্যের ভূমিকা কি, তা সহজেই বোঝা যেতে পারে।পূর্বেকার আলোচনায় একথা সবিস্তারে বিবৃত করা হয়েছে যে, ইসলাম জীবনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে,তা অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতির লক্ষ্য থেকে মূলগতভাবেই পৃথক। সেই সাথে একথাও প্রতিপন্ন হয়েছে যে,উদ্দশের বিভিন্নতার ফলে বিশ্বাস ও কর্মের পদ্ধতিতেও মৌলিক পদ্ধতি সূচিত হয়। সুতরাং এর যুক্তিসংগত ফল দাঁড়ায় ঐ যে,ইসলামের লক্ষ্য তাকে এমন একটি বিশিষ্ট সংস্কৃতির রুপ দিয়েছে, যা মূলগতভাবেই অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন।এবং জার বিশ্বাস ও বাস্তব পদ্ধতির সাথে অন্যান্য পদ্ধতির মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।এ পদ্ধতির কোন কোন অংশ হয়ত অন্যান্য পদ্ধতিতেও পাওয়া যেতে পারে।কিন্তু অন্যান্য পদ্ধতিতে সে অংশ গুলো যে হিসেবে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, এখানে সে হিসেবে সন্নিবেশিত নয়। কোন পদ্ধতিতে সন্নিবিষ্ট হবার পর অংশ বিশেষ তার নিজস্ব প্রকৃতি হারিয়ে সমগ্রের প্রকৃতি ধারন করে; আর একটি সমগ্রের প্রকৃতি যখন অপর সমগ্র থেকে ভিন্ন হয়, তখন তার প্রত্যেক অংশের প্রকৃতি অপরের অংশের প্রকৃতি থেকে অনিবার্যরূপে ভিন্নতর হবে,-তার কোন কোন অংশের বহিরাকৃতির সাথে অপরের কোন কোন অংশের যতই সাদৃশ্য থাকুক না কেন।
ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, ইসলাম মানুষকে দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেছে এবং যে মহান প্রভুর সে প্রতিনিধি, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনকেই তাঁর জীবনের লক্ষ্য রূপে নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ লক্ষ্যটি যেহেতু তাঁর গোটা জীবনের লক্ষ্য,এ জন্যই তাঁর জীবনের সকল ক্রিয়াকলাপের মোড় লক্ষ্যের দিকেই নিবদ্ধ হয়,তার দেহ ও প্রানের যাবতীয় শক্তি ঐ লক্ষ্যের পথেই নিয়জিত হওয়া এবং তাঁর চিন্তা কল্পনা,ধ্যান-ধারনা ও গতিবিধির ওপর ঐ লক্ষ্যের কর্তৃত্ব স্থাপিত হওয়া প্রয়োজন।তাঁর জীবন-মৃত্যু, শয়ণ-জাগরন, পানাহার, লেন-দেন, সম্পর্ক-সম্বন্ধ, বন্ধুত্ব ও বৈরিতা, অর্থনীতি ও সামাজিকতা, এক কথায়, তাঁর প্রতিটি জিনিস ঐ একমাত্র লক্ষ্যের নিবেদিত হওয়া উচিত। পরন্তু এ লক্ষ্যটিকে তাঁর ভেতর এমন প্রভাবশীল ও ক্রিয়াশীল হওয়া দরকার, যেন এ প্রাণচেতনার কারনেই সে জীবন্ত ও কর্মতৎপর রয়েছে। এবার স্পষ্টতই বোঝা যায় যে,যে ব্যক্তি তাঁর জীবন সম্পর্কে এমন লক্ষ্য পোষণ করে, আর এ লক্ষ্যের জন্যই সে বেঁচে রয়েছে,সে কখনো লক্ষ্যহীন কিংবা ভিন্ন লক্ষ্য পোষণকারী ব্যক্তির মত জীবন যাপন করতে পারে না।এ লক্ষ্য তো তাঁর নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী মানুষকে এক দক্ষ কর্মী ও সক্রিয় কর্মচারীতে পরিবর্তিত করে দেয়, এমন কর্মী ও কর্মচারী, যে শুধু বেঁচে আছে তাঁর জীবনের লক্ষ্য অর্জন করার জন্য।
তাই এ লক্ষ্য নির্ধারণ করার পর ইসলাম জীবন যাপন করার জন্যে বিভিন্ন পন্থার মধ্য থেকে একটি বিশেষ পন্থা নির্বাচন করে এবং ঐ পন্থা ছাড়া অন্য কোন পন্থা অনুসরণ করে তাঁর প্রিও সময় ও মূল্যবান শক্তির অপচয় না করার জন্য বাধ্য করে।সে এ লক্ষ্যের স্বভাব ও প্রকৃতি অনুসারে আকীদা-বিশ্বাস ও ক্রিয়া-কাণ্ডের একটি স্বতন্ত্র পদ্ধতি উদ্ভাবন করে এবং কোন অবস্থায়ই এ বিশেষ পদ্ধতির সীমা অতিক্রম না করার জন্য মানুষের কাছে দাবী জানায়। সে এ বিশেষ পদ্ধতিকে সোজাসুজি আনুগত্য ও আজ্ঞানুবর্তীতা বলে ঘোষণা করে এবং এ জন্য নামকরন করে দ্বীন(*****) অর্থাৎ আনুগত্য ও আজ্ঞানুবর্তীতা। সে বলে “(*********)” ‘আল্লাহর কাছে দ্বীন হচ্ছে শুধু ইসলাম।‘
এ দ্বীনের ভিত্তিতেই ইসলাম তাঁর অনুসারী এবং যারা অনুসারী নয় তাদের মধ্যে পার্থক্য চিহ্ন এঁকে দেয়।যারা এ বিশেষ লক্ষ্য অনুযায়ী এ অনুসরণ পদ্ধতিকে মেনে চলে, তাদেরকে সে ‘মুসলিম’ (আত্মসমর্পণকারী) ও ‘মু’মিন’(প্রত্যয় পোষণকারী) বলে অভিহিত করে। আর যারা ঐ লক্ষ্যের সাথে এক মত নয় এবং এ অনুসরণ পদ্ধতিকেও মেনে চলে না, তাদেরকে সে ‘কাফের’ (অবিশ্বাসী)১ বলে ঘোষণা করে। সে বংশ, গোত্র, জাতি,সম্প্রদায়, ভাষা, দেশ এবং এ শ্রেণীর যাবতীয় ভেদ-বৈষম্যকে
১: কাফের শব্দটি ব্যবহারেও অতি উচ্চাঙ্গের বাকরীতি অনুসৃত হয়েছে। আরবি অভিধানে ‘কুফর’ এর মৌল অর্থ হচ্ছে গপন করা। এ জন্য বস্তুনিচয়কে গপন করে বলে রাতকে বলা হয় কাফের। বীজকে মাটির মধ্যে গোপন করে দেয় বলে কৃষককেও বলা হয় কাফের এবং ফলকে বীজের ভেতর গোপন করে রাখে বলে খোসাকে বলা হয় কাফুর। এভাবে উপমা হিসেবে নেয়ামতকে গোপন করা এবং শোকর আদায় না করা কে ‘কুফর’ বা ‘কুফরান’ বলা হয়েছে। ইসলাম এ কুফর শব্দটিকে ঈমানের বিপরিত বলে ঘোষণা করেছে।এ দ্ধারা এ নিগূর সত্যের দিকে ইশারা করা হয়েছে যে, যারা ইসলাম গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায়, তারা প্রকৃতপক্ষে আপন স্বভাব প্রকৃতির ওপর আবরন টেনে দেয়।
বিলুপ্ত করে আদম সন্তানের মধ্যে এই এক ‘কুফর’ ও ‘ঈমানের’ বৈষম্য কে দার করায়। যে কেউ এ পদ্ধতি মেনে চলবে- সে প্রাচ্যের হোক কি পশ্চাত্যের সে তাঁর আপনজন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এ পদ্ধতি মেনে না চলবে-সে কা’বার প্রাচীরের নিচেই থাকুক, আর তাঁর রক্তমাংস মক্কার খেজুর এবং জমজমের পানি দ্বারাই গঠিত হোক- সে তাঁর আপনজন নয়।
আকিদা বিশ্বাসের এ ক্রিয়া-কাণ্ডের ভিত্তিতে সে যেমন মানুষের মধ্যে ‘কুফর’ ও ‘ঈমানের’ বৈষম্য দাঁড় করিয়েছে, তেমনি জীবন যাপনের পন্থা এবং দুনিয়ার সকল জিনিসের মধ্যেও সে হারাম-হালাল, জায়েজ-নাজায়েজ ও মাকরুহ-মুস্তাহাবের পার্থক্য কায়েম করেছে। যেসব ক্রিয়া-কাণ্ড ও রীতিনীতি ঐ লক্ষ্য অর্জন এবং খেলাফতের দায়িত্ব পালনের পক্ষে সহায়ক, সেগুলো নিজ নিজ অবস্থানুপাতে হালাল,জায়েজ বা মুস্তাহাব। আর যেগুলো এ পথের বাধা ও প্রতিবন্ধক, সেগুলো আপন আপন অবস্থানুপাতে হারাম,নাজায়েজ বা মাকরুহ।যে মু’মিন এ পার্থক্য চিহ্নকে সমীহ করে, সে ‘মুত্তাকী’(পরহেযগার) আর যে এর প্রতি সমীহ করে না, সে ‘ফাসেক’(সীমালঙ্ঘনকারী)। আল্লাহর দলের লোকদের ভেতর ছোট-বড় ও উচ্চ-নীচ পার্থক্য ধন-দৌলত, বংশীয় আভিজাত্য, সামাজিক পদমর্যাদা বা সাদা-কাল, বর্ণের ভিত্তিতে নয়, বরং ‘তাকওয়ার’ ভিত্তিতে সূচিত হয়।
(***********)
“নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মুত্তাকী তারাই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানীয়।“-(সূরা আল হুজুরাতঃ ১৩)
এভাবে ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-কল্পনা, স্বভাব-প্রকৃতি, নৈতিক-চরিত্র, অর্থনীতি, সামাজিকতা, তমদ্দুন, সভ্যতা, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা, এক কথায় মানবীয় জীবনের সমগ্র দিকে ইসলামী সংস্কৃতির পথ অন্যান্য সংস্কৃতির পথ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। কারন জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারণা অন্যান্য সংস্কৃতির ধারণা থেকে একেবারে পৃথক।অন্যান্য সংস্কৃতির জীবনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, ইসলামের লক্ষ্য তাঁর থেকে ভিন্ন ধরনের।সুতরাং ইসলাম তাঁর ধারণা অনুযায়ী দুনিয়া এবং তাঁর ভেতরকার বস্তুনিচয়ের সাথে যে আচরণ ও কর্মনীতি অবলম্বন করে এবং আপন লক্ষ্য অর্জনের জন্য পার্থিব জীবনের যে কর্মপন্থা গ্রজন করে, তাও মূলগতভাবে অন্যান্য সংস্কৃতির গৃহীত আচরণ ও কর্মপন্থার থেকে ভিন্ন ধরনের।মনের অনেয়াক চিন্তা-কল্পনা ও ধ্যান-ধারণা, প্রবৃত্তির অনেক কামনা-বাসনা ও ঝোঁক-প্রবণতা এবং জীবন যাপনের জন্য এমন বহু পন্থা রয়েছে, অন্যান্য সংস্কৃতির দৃষ্টিতে যার অনসরণ শুধু সংগতই নয়; বরং কখনো কখনো সংস্কৃতির পক্ষে একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু ইসলাম যেগুলোকে নাজায়েয,মকরূহ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে হারাম ঘোষণা করতে বাধ্য। কারন,সেগুলো ঐ সংস্কৃতিরগুলোর জীবন দর্শনের সাথে একেবারে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং তাদের জীবন লক্ষ্য অর্জনের পক্ষেও সহায়ক। কিন্তু ইসলামের জীবন দর্শনের সাথে ঐগুলোর কোন সম্পর্কই নেই অথবা তাঁর জীবন লক্ষ্য অর্জনের পথে অন্তরায় স্বরূপ। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, দুনিয়ায় বহু সংস্কৃতির পক্ষে ললিতকলা হচ্ছে প্রান সরূপ এবং এ সকল চারুকলায় নিপুণ ও পারদর্শী ব্যক্তিগণ ‘জাতীয় বীর’-এর মর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু ইসলাম এর কোনটিকে হারাম, কোনটিকে মকরূহ আর কোনটিকে কিছু পরিমাণ জায়েয বলে ঘোষণা করে।তাঁর আইন-কানুন সৌন্দর্য-প্রীতির এবং কৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগের অনুমতি মাত্র এটুকু রয়েছে যে, মানুষ যেন তাঁর সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ রাখতে, তাঁর পরিতুষ্টির জন্য কাজ করতে এবং খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে পারে।কিন্তু যেখানে গিয়ে এ সৌন্দর্য প্রীতি দায়িত্বানুভূতির চেয়ে প্রবলতর হবে, যেখানে আনন্দ ভোগের আতিশয্য মানুষকে আল্লাহর পূজারী হওয়ার বদলে সৌন্দর্য পূজারী করে তোলে, যেখানে ললিতকলার স্বাদ থেকে মানুষকে বিলাস প্রিয়তার নেশায় ধরে যায় এবং বিবেকের আওয়াজের জন্য হৃদয়ের কান বধির হয়ে যায় এবং কর্তব্যের ডাক শোনার মত আনুগত্য ও দায়িত্বজ্ঞান বজায় না থাকে,ঠিক সেখানে পৌছেই ইসলাম অবজ্ঞা, অবৈধতা ও নিষেধাজ্ঞার প্রাচীর দাড় করিয়ে দেয়। এ জন্যই যে, তাঁর উদ্দেশ্য তানসেন, বান্দাদিন, মানী ও বাহজাদ(১) চার্লিচ্যাপলিন এবং মেরী পিকফোর্ড সৃষ্টি করা নয়, বরং সে চায় আবু বকর সিদ্দিক (রা), উমর ফারুক (রা), আলী বিন আবু তালিব (রা), হোসাইন বিন আলী (রা) ও রাবিয়া বছরী (রা) সৃষ্টি করতে।
এ দৃষ্টান্তের সাহায্যে সমাজ, তমদ্দুন এবং অন্যান্য বহু বিষয়ে বিস্তৃত অবস্থা অনুমান করা যেতে পারে। বিশেষত নারী ও পুরুষের সম্পর্ক, ধনী ও নির্ধনের ব্যবহার, মালিক ও প্রজার সম্বন্ধ এবং অন্যান্য মানবীয় শ্রেণীগুলোর পারস্পরিক আচরণ সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশিত পন্থা সমুদয় প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতির উদ্ভাবিত পন্থা থেকে নীতিগতভাবেই ভিন্নতর। এ ব্যাপারে অন্যান্য সংস্কৃতির অনুসৃত পদ্ধতিকে মানদণ্ড বানিয়ে ইসলামের অবলম্বিত পদ্ধতিকে যাচাই করা মূলতই ভ্রান্তির পরিচায়ক।এ ধরনের কাজ যারা করেন, তারা নিতান্তই স্থুলদর্শী এবং প্রকৃত সত্য সম্পর্কে নিদারুণ অজ্ঞ।