বাংলাদেশ ও বাংলাভাষা
আমার দেশ বাংলাদেশ
প্রত্যক মানুষই তার একখানা নিজস্ব বাড়ী কামনা করে। ছোট একটি কুঁড়ে ঘরও গৃহহীনের নিকট কামনার বস্তুু। আপন দেশও মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজন। পৃথিবীর কোন একটি ভূখন্ডকে আমার দেশ হিসেবে গণ্য করার সৌভাগ্য যাদের হয়নি তারাই এর অভাব সত্যিকারভাবে অনুভব করতে পারে। তাই তারা জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত তাদের বংশধররা পর্যন্ত অন্য দেশে পয়দা হলেও পিতামাতার জন্মভূমিকে আপন দেশ মনে করে। ফিলিস্তিনে যেসব মুসলিম অধিবাসী কয়েক দশক পূর্বে জন্মভুমি ত্যাগ ক তে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে, তাদের, তাদের সন্তানেরা অন্যান্য দেশে পয়দা হয়ে সেখানেই লেখা-পড়া বা কাজ-কর্ম শিখে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোন রকম প্রতিষ্ঠাই তাদের আপন দেশের অভাব দূর করতে পরছে না। তাই ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সের যুবকদের যারা কোনদিন ফিলিস্তিন দেখেওনি, তারা পযন্ত ফিলিস্তিনের জন্য অকা তরে জীবন দিচ্ছে। আমার দেশ এমনই এক আকষর্ণীয় বিষয়।
ঘটনাচক্রে ১৯৭১ সালে ২২ শে নভেম্বর ১৯৭৮ সালের ১০ই জুলাই পযর্ন্ত যায় সাত বছর বাধ্য হয়ে বিদেশে ছিলাম। যেখানেই রয়েছি সম্মানের সাথেই ছিলাম। কিন্তু আমার দেশের মায়া কোন দিন বিদেশে মনকে সুস্থির থাকতে দেয়নি। সাড়ে চার বছর পর পরিবার পরিজন দেশ থেকে যেয়ে আমার সাথে মিলিত হবার পর দেশের জন্য অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল।
আমি লন্ডনে ছিলাম দুর সম্পর্কের এক ভাতিজার বাসায়। তার স্ত্রী আমাকে পিতার মতো সেবা যতœ করেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা আমাকেই আপন দাদা মনে করত। আমার পরিবার ওখানে যাবার পর ওরা দাদী পেয়ে আরও খুশী। কিন্তু আমার ছেলেদের লেখা-পড়া নিয়ে মহাচিন্তায় পড়লাম। বাংলাদেশী আমার পরনো বন্ধুদের যাঁরা ওখানে বাড়ী কিনে স্থায়ী বাসিন্দা, এমন কি বৃটিশ নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন তাঁরা আমার অস্থিরতা দেখে বিস্মিত হলেন। তাঁরা ছেলেদের লেখা-পড়া সে দেশেই শেষ করার পরামর্শ দিলেন। সে দেশের লেখা-পড়ার এত সুবিধা থাকা সত্বেও আমার অস্থিরতা কমল না। বিলাতের বড় বড় শহরগুলোতে বালাদেশীদের সংখ্যা এত বেশী যে, বিয়ে-শাদী ও সামাজিকতার সব কাজকর্মেই নিজ দেশের পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব। তবুও ছেলেদের সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হলাম। কারন সে দেশে দীর্ঘকাল থাকলেই ওরা ইংরেজ হতে পারবে না। অথচ বাংলাদেশী হয়েও গড়ে উঠবে না। যে ছেলে নবম শ্রেনীর ছাত্র সে এক বছরেই ইংরেজীতে সেখানে অনেক উন্নতি করা সত্বেও অন্ততঃ প্রবেশিকা পর্যন্ত দেশে না পড়লে মাতৃভাষ শেখা হবে না বলে আশংকা ছিল। তাকে দেশে ফেরত পাফিয়ৈ নিশ্চিত হলাম। সবার ছোট ছেলেটির মাত্র সোয়া দু’বছর বিদেশে পড়ার পর দেশে এসে বাংলার মাধ্যমে পড়তে গিয়ে ভাষা সমস্যা দেখা দিল। বিশেষ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দু,বছর পর্যন্ত ইংরেজীতে অনুবাদ করে বহু বাংলা শব্দ বুঝাতে হয়েছে।
বিলাতে বাংলাদেশীদের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে কথ বলতে গিয়ে ভাষা সমস্যা প্রথমেই প্রকট হয়। বয়স্ক যারা তারা বাংলা ভাষায় না বললে সবাই বুঝতে পারে না। কিন্তু বাংলা বললে যুবক ও কিশোরদের পক্ষ থেকে ইংরেজীতে বলার জোর দাবী উঠে। কারন ঘরে আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলতে পারলেও কোন আলোচনা বাংলায় হলে ওদের বুঝতে খুব কষ্ট হয়। ৬ বছর বিলাত থাকাকালে যখনই বাংলাদেশী কিশোর ও যুবকদের ৬ বছর বিলাত থাকাকালে যখনই বাংলাদেশী কিশোর ও যুবকদের সাথে মিশবার সুযেগ হয়েছে তখনই তাদেরকে কয়েকটি পরামর্শ দেয়া কর্তব্য মনে করেছি।
১। তোমরা বাংলাভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে শিখবার চেষ্টা করবে। নইলে দেশে যেয়ে গনগগণের সাথে আপন হতে পারবে না। এবং তাদের ভালবাসাও পাবে না। দেশের সেবা ও জনগণের খিদমত করার সুযোগ এবং তৃপ্তি পেতে হরে দেশবাসীর ভাষা ভালবাবে আয়ত্ত করতে হবে।
২। বিদেশে যত সুযোগ-সুবিধাই পাও, সে দেশকে আপন দেশ হিসেবে পাবে না। বৃটিশ পাসপোর্ট পেরেই ইংরেজরা তোমাদেরকে আপন দেশী মনে করবে না। সে দেশের আইনগত নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও মনের দিক থেকে নিজেকে বিদেশীই বাবতে হবে।
৩। যত ভল বেতনেই বিদেশে চাকুরী কর, কোন দিন নিজের দেশকে সেবা করার মত মানসিক তৃপ্তি পবে না। নিজের দেশে যতটুকু কাজই কর, মনে গবীর তৃপ্তি বোধ হবে যে দেশের জন্য সমান্য সেবা হলেও করতে পারছি। ভাড়া বাড়ী উন্নয়নের জন্য কোন ভাড়াটেই টাকা ব্যয় করে না এবং সে বাড়ীতে যত সুবিধাই থাকুক আপন বাড়ী বলে মনে হয় না। নিজের কুঁড়ে ঘরে থাকলেও তার চাইতে বেশী সুখ অনুভূত হয় এবং সেটাকে উন্নত বাড়ীতে পরিণত করে সন্তানদের জন্য রেখে যাবার আকাঙ্খা স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয়।
আমার ছেলেরা যাতে বাংলাভাষার চর্চা করে তার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিলাম। কখনও তাদের কাছে ইংরেজীতে চিঠি লিখি না। তাদের কে বাংলায় টিঠি দিতে বাধ্য করি।
জন্মভুমি স্রষ্টার দানঃ মাতৃভাষা ও জন্মভূমি মানুষ নিজের চেষ্টায় অর্জন করে না। মহান স্রষ্টার সিন্ধান্ত অনুযায়ী এ দু’টো বিষয় অর্জিত হয়। তাই এ দু’টো আকর্ষণ জন্মগত ও মজ্জাগত। আমি নিজের নিজের ইচ্ছায় বাংলাদেশে জন্মলাভ করিনি। আমার খালিক ও মালিক আল্লাহ পাক নিজে পছন্দ করে যে দেশে আমাকে পয়দা করেছেন সে দেশই ”আমার দেশ” হবার যোগ্য এবং যে মায়ের গর্ভে আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর ভাষাই আমার প্রিয়তম ভাষা। বাল্যকাল থেকে যে ভাষায় মানুষ চিন্তা করে স্বপ্ন দেখে ও ভাব প্রকাশ করে সে ভাষা এবং জীবনের প্রথম পনর বছর যে ভৌগলিক পরিবেশে কাটে সে এলাবার মায়া কোন মানুষ সহজে ত্যাগ করতে পারে না।
আমার বাধ্যতামূলক নির্বাসন জীবনে বারবার মনকে প্রবোধ দেবার জন্য চিন্তা করেছি যে, জন্মের পর যেটুকু জমিতে আমাকে শোয়ান হয়েছে সেটুকু জায়গায়ই শুধু আমার জন্মভুমি হয়। যখন হামাগুড়ি দিতে শিখেছি তখন আমার জন্মভুমির আয়তন বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হল। দাঁড়াবার বয়সে আরও প্রশস্ত হল। কর্ম জীবনে আমার জন্মন্থান যে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত তার সমগ্র এলাকাই জন্মভুমিতে পরিণত হল। এটাকে আরও প্রশস্ত মনে করে গোটা এশিয়া কেন, পৃথিবীর সবটাকেই তো আমার দেশ মনে করা যায়। ক্ষুদ্র এলাকা নিয়ে যে বাংলাদেশ সেখানে যাবার এত আকুল আগ্রহ কেন- সেখানের মায়া ভুলতে পারা যায় না কেন? যে দেশে অশান্তি, বিশৃংখলা নিরাপত্তার অভাব, অস্বভাবিক দ্রব্যমূল্য, রোজগারের অভাব ইত্যাদির দরুন সেখানকার মানুষ বিদেশে পাড়ি পমাবার জন্য পাগল সে দেশের হাতছানি আমাকে উল্টো পাগল করল কেন? এসব প্রবোধবাক্য ও দার্শনিক প্রশ্নের যুক্তিভিত্তিক কোন জওয়াবের প্রযোজন নেই। এর সরল জওয়াব আমার মন থেকে যা পেয়েছি তার সামনে অন্য যুক্তি অচল। মায়ের নিকট সন্তান এবঙ সন্তানের নিকট মায়ের মূল্য তাদের চেহারার সৌন্দর্য, গায়ের রং বা অন্যান্য গুণের দ্বারা বিচার্য নয়। কদর্য সন্তানও স্নেহময়ী মায়ের নিকট আদরের দুলালই, আর কদর্য মাও মাতৃভক্ত সন্তানের নিকট স্নেহময়ী মা বলেই পরিচিত।
এরপরও প্রশ্ন থেকে যায় যে, কতটুকু ভৌগলিক এলাকা জন্মভুমি বলে গন্য হবে? ১৯২২ সালে যথস আমি ঢাকা শহরে পয়দা হই তখন বৃটিশ-ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তর্গত ছিলাম। ১৯৭১ সালে সালে বাংলাদেশ একটি পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনত হবার পর স্বভাবিক ভাবেই আমার জন্মভুমি আকারে ক্ষুদ্র হয়েছে এবং প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানের যে এলাকাটি এখন বাংলাদেশ নামে বিশের মানচিত্রে স্থান লাভ করেছে সেটুকুই এখন আমার প্রিয় দেশ বা ”আমার দেশ”।
জন্মভূমিকে ভালবাসাঃ জন্মভুমির ভালবাসা মানুষের সহজাত। যারা কখনও বিদেশে দীর্ঘদিন কাটায়নি তারা এ ভালবাসার গভীরতা সহজে অনুভব করতে পারেনা। চাকুরী, উচ্চশিক্ষা বা ব্যবসা উপলক্ষে ইচ্ছকৃতভাবে যাঁরা বিদেশে বসবাস করেন তাঁদের সব্ াআমার সাথে একমত হবেন যে, বিদেশে যাবার আগে জন্মভূমি এ প্রিয় বলে মনে হয়নি। কিন্তু যারা বাধ্য হয়ে বিদেশে অবস্থান করে এবঙ কোন কারনে দেশে আসতে অক্ষম হয় তাদের এ অনুভুতি আরও গভীর হয়। তারা দৈহিক দিক দিয়ে বিদেশে পড়ে থাকলেও তাদের মনটা দেশেই পড়ে থাকে। দেশের মানুষ দেশের গাছ-পালা, দেশের আবহাওয়া, দেশের ফলমূল, দেশের পশু-পাখী, দেশের মাটি যেমন আপন মনে হয় বিদেশের এসব জিনিস তেমন মনে হতে পারে না। যথই মনোমুগ্ধকর মনে হোক সামগীকবাবে জন্মভুমিই যে প্রিয়তম একথাথার সাক্ষী আমি নিজে।
বিদেশের যাবার আঘে জীবনে ৪৯টি বছর যে আবহাওয়ায় কেটেছে, যে ধরনের খাদ্য খেয়ে দেহ গঠিত হয়েছে, যে রকমের শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় দেহ-মন আবর্তিত হয়েছে কোন দেশেই সামাগ্রীকভাবে তা পাইনি। লন্ডনের গ্রীষ্মকাল কোন কোন বছর এ দেশের বসন্তকালের মতো মিষ্টি মনে হলেও যেখানকার শীতকালটা মহাবিপদই মনে হয়েছে। ক্রমাগত ৫/৭ দনি প্রচন্ড শীতের মধ্যে যখন সূর্যের সাথে একটু সাক্ষাৎ হয় না, তখন ঢাকার প্রিয়তম সূর্যের কথা মনে না হয়ে পারেনি। গরমের দিনে রিয়াদ বা কুয়েতে যখন ১২৫ ডিগ্রি গরমে এয়াকন্ডিশনড কামরা থেকে বের হওয়া দুষ্কর মনে হয়েছে, তখন বাংলাদেশের গরমের মিষ্টতা মনে আসাই স্বভাবিক। শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত বাংলাদেশের যে আবহাওয়ায় আমি অভ্যস্ত হয়েছি তার ঘর্মাাক্ত গ্রীষ্ম বিরামহীন বর্ষা ও কুয়াশাচ্ছন্ন শীত সাময়িকবাবে যতই বিরক্তিকর মনে হোক না কেন সামগ্রীকবাবে জন্মভূমির আবহাওয়াই সর্বোত্তম।
খাদ্যের ব্যাপারটা আরও বেশী অনুভূতপ্রবণ। মানুষ যে ধরনের খাবারে অভ্যস্ত হয় সে খাবার ব্যতিত একটানা অন্য ধরনের খাবারে তৃপ্তি পায় না। জন্শভূমির মাছ-ভাত ও শাকসবজিকে কিছুতেই ভূলতে পারা গেল না। যত উন্নতমানের খাবারই বিভিন্ন দেশে খেলাম বাংলাদেশের চিংডি মাছ ও প্ুঁইশাক, কইমাছ ও পালং শাকের চচ্চরি জাতীয় খাবারের স্মৃতি বার বার মনে এসেছে। অনভ্যস্ত খাবারে শরীরের প্রয়োজন পূরন অবশ্যই হয়েছে। খাওয়ার দায়িত্বও পালন হয়েছে কিন্তু সত্যিকার তৃপ্তিলাভের জন্য বিলাতেও বাংলাদেশের পাবদা, ইলিশ ও অন্যান্য মাছ এবং শুটকি যোগাড় করে খেয়েছি। বহু বাংলাদেশী সে দেশে থাকার বাংলাদেশীদের দোকানে দেশী তরিতরকারী পর্যন্ত পাওয়া যায়।
জন্মভুমির মানষের ভালবাসাও বিদেশে বেশী অনুভুত হয়। বিলাতে পথে – ঘাটে, বাসে-ট্রেনে বা টিউবে (আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেন) দেশী অপরিচিত লোকের সাক্ষাৎ পেলেও অত্যন্ত আপন মনে করে আলাপ-পরিচয় করতে আগ্রহ বোধ হয়েছে। দেশের মানুষ সম্পর্কে কোন সুখরব শুনলে মনে গভীর তৃপ্তিবোধ হয়েছে। আবার কোন দুঃসংবাদ পেলে প্রানে তীব্র বেদনা অনুভুত হয়েছে।
এভাবেই “আমার দেশের” সাথে নাড়ীর গভীর সম্পর্ক বিদেশে না থাকলে এমনভাবে অনুভব করতে পারতাম না। যারা কোন কারনে বিদেশে থাকে তারা সেখানে আপন দেশে থাকার মানসিক তৃপ্তি কিছুতেই পেতে পারে না। আপন বাড়ী ও আপন দেশ সত্যিই প্রিয়তম। তাই বাংলাদেশই আমার দেশ, এর উন্নতিই আমার উন্নতি, এর দুর্নামই আমার দুর্নাম। আমার দেশের কল্যাণের প্রচেষ্টা চালান তাই আমার ঈমানী কর্তব্য।
জন্মভূমির প্রতি মহব্বত এতটা গভীর যে, নবীদের জীবনেও এর স্বাভাবিকতা লক্ষ্যনীয়। দুনিয়ার প্রতি নবীদের সামান্যতম আর্কণও নেই। আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশ পালন করার প্রয়োজনে নিজের সন্তানকে আপন হাতে যবেহ করা বা শিশু পুত্রসহ প্রিয়তমা স্ত্রীকে নির্জন মরুভুমিতে ফেলে আসা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব নয়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) দুনিয়াতে মুসাফিরের মতো জীবন যাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। দুনিয়ার মহব্বতকে সমস্ত পাপের মূল বলে তিনি ঘোষণা করেছেন। দুনিয়াতে আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করা ছাড়া তিনি দুনিয়ার জীবনের প্রতি কোন মায়া পোষণ করতেন না। অতচ মক্কা থেকে হিযরত করে মদীনা যাবার সময় মক্কা শহর থেকে বের হবার পর পেছন ফিরে মক্কাকে সম্বোধন করে বললেন ‘হে মক্কা! দুনিয়ার শহরগুলোর মধ্যে তুমিই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশী প্রিয় এবং আল্লাহর সবগুলো শহরের মধ্যে তোমাকেই আমি সবচাইতে বেশী মহব্বত করি। ইসলামের দুশমনরা যদি তোমাকে ত্যাগ করে যেতাম না। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত যদিও নবী ছিলেন তবুও তিনি মানুষ ছিলেন। তাই মানুষ হিসেবে বিবি-বাচ্চার প্রতি মহব্বত যেমন তাঁর মধ্যে সাবভাবিক ছিল, জন্মভুমির প্রতি ভালবাসাও তেমনি সহজাত ছিল। এ ঘটনা জানার পর জন্মভূমির প্রতি ভালবাসরা মধ্যেও ধর্মীয় প্রেরণা অনুভব করছি।
জন্মভূমির প্রতি এ ভালবাসা সত্ত্বেও তিনি ইসলামের স্বার্থে হিযরত করে মদীনায় চলে গেলেন। এ থেকে মানবজাতি এ শিক্ষাই পেল যে, দ্বীন-ইসলামকে জন্মভূমি থিকেও বেশী ভালবাসতে হবে। নিজের জন্মভূমিতে ইসলামকে বিজয়ী করার যদি অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে যেখানে সম্ভব মনে হয় সেখানে হিযরত করে চলে হলেও দ্বীনকে কায়েম করতে চেষ্টা করা মুসলিম জীবনের প্রধান দায়িত্ব। [আমার দেশ বাংলাদেশ]
আমার ভাষা বাংলা ভাষা
মানুষের জন্মভুমির মতো মাতৃভাষও আল্লাহর দান। নিজের ইচ্ছায় যেমন কেউ কোন এলাকায় জন্মলাভ করতে পারে না, তেমনি মাতৃভাষাও কেউ বাছাই করে নিতে পারে না। যে মাযের কোলে আমার মহান স্্রষ্টা আমাকে তুরে দিয়েছেন সে মায়ের ভাষাই আমাকে শিখতে হয়েছে। এ ব্যাপারটা মোটেই ঐচ্ছিক নয। জন্মভুমির আবহাওয়ার মত মাতৃভাষা প্রত্যেকের মজ্জাগত। দুনিয়ার যত ভাষা খুশি শিখুন। সেসব ভাষয় যোগ্যতা আর্জন করুন কিন্তু আপনার শৈশব ও কৈশোর যদি জন্মভূমিতে কাটিয়ে থাকেন, বিশেষ করে ছাত্র জীবন যদি নিজের দেশেই যাপন কের থাকেন তাহেল সব ভাষা ছাপিয়ে মাতৃভাষাই আপনার মনমগজকে চিরদিন দখল করে থাকবে। বিদেশেও স্বপ্ন দেখবেন মাতৃভাষায়ই, চিন্তা প্রধানতঃ মাতৃভাষায়ই আসবে এবং মনে মাতৃভাষায়ই ভাব সৃষ্টি হবে।
কোন ভাষায় কথা বলতে মনে তৃপ্তি পাওয়া যায়? বাংলাদেশী হয়েও যাঁরা ইংরেজী ভাষায় কথা বলতে বেশী পছন্দ করেন তাদের কৈফিয়ত নিশ্চয়ই আছে। হয়তো মাতৃভাষায় নিজ এলাকার কথ্য রূপ ছাড়া বাংলা বলতে অক্ষম বলে ইংরেজী বলা সুবিধাজনক মনে করেন। কিন্তু আমি বিলাতেও বহু উচ্ছ শিক্ষিত লোককে দেখেছি যে, তাঁরা ইংরেজী ভাষায় যতই যোগ্য হোন নিজ দেশের লোকদের সাথে মাতৃভাষায় কথা না বললে মোটেই তৃপ্তি বোধ করেন না। বিশেষ করে নিজ নিজ জেলার বা এলাকার লোক পেরে স্থায়ীয় কথ্য ভাষায় কথা বলার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারেন না। এটাই স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রম যা তা অবশ্যই কৃত্রিম।
দুনিয়ার বহু দেশ দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। বিদেশী একাধিক ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাভাষী লোকের সাথে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে মোটেই পছন্দ করিনি। বাংলাদেশের বহু লোক বিলাতে সপরিবারে বাস করে এবং বাড়ীতে তারা মাতৃভাষায়ই কথা বলে। কিন্তু তাদের যেসব ছেলেমেয়ে সে দেশে পয়দা হয়েছে বা শৈশবকালেই সেখানে গিয়েছে তারা সেখানকার স্কুলে পড়া-লেখা করার ফরে ইংরেজীতে এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, বাড়ীতেও বাপ-মা ছাড়া আর সবার সাথেই ইংরেজীতে কথা বলে। বঞু পরিবারে দেখেছি যে, ছেলেমেয়েরা পরাস্পর শুধু ইংরেজীতে বলে। অবশ্য বাপ-মা যদি ইংরেজী বলতে না পারে বা না চায় তাহলে বাপ-মায়ের কথ্য ভাষায়ই কথা বলতে বাধ্য হয়। আমার সবচেয়ে ছোট ভাই-এর ছেলের বয়স যখন ৬ বছর তখন বিলাতে ওর সাথে পয়রা দেখা হলো। সে সেখানেই পয়দা হয়েছে। নার্সরীতে তখন পড়ছে।
ওর বাপ-মায়ের কাছে ওর বড় চাচার কথা বহু শুনেছে। তাই আমাকে সেও পিতা মাতার সাথে সাদরেই অভ্যার্থনা জানাল। ওকে কোলে টেনে নিয়ে আদর করে কথা বলতে গিয়ে সমস্যায় পড়লাম। আমি বাংলায় জিজ্ঞেস করি, আর সে ইংরেজীতে জওয়াব দেয়। কতক্ষণ পর্যন্ত চেষ্টা করেও যখন একটি বাক্যও বাংলা বলাতে পারলাম না তখন চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বললাম, “আমি কোন ইংরেজের চাচা নই। আমার সাথে বাংলায় কথা না বললে চাচা হতে রাজী নই”। ফল আরও খারাপ হলো। সে আমার কাছে আর আসতে চায় নাÑকথা বলাও বন্ধ করল। বাধ্য হয়ে আমাকেই আতœসর্মপন করতে হলো এবং ইংরেজীতে কথা বলে ওর টহপষব (চাচা নয়) এর মর্যাদা পেলাম। সে যদিও বাপ মায়ের সাথ ছোট থেকেই বাংলা বলায় অভ্যস্ত, তবুও পারিবারিক বাঁধাধরা কতক কথাই বাংলায় শিখেছে। মনের ভাব প্রকাশের জন্য যত শব্দ ও বচন সে স্কুলে ৩ বছর বয়স থেকেই শিখছে সে ভাষাই তার মাতৃভাষায় পরিণত হয়েছে।
দেশ বিদেশে ঘুরে আমার উপর মাতৃভাষার প্রভাব যেন আরও বেশী অনুভব করলাম। কোন সময় এমনও হয়েছে যে, সাপ্তাহ খানিক বাংলা বলার লোক না পেয়ে যেন হাঁপিয়ে উঠেছি। একটানা অনভ্যস্ত খাবার খেয়ে মাছ-ভাতের জন্য মন যেমন অন্থির হতো, বাংলায় কথা বলার লোক না পেলেও কেমন যেনো অস্বস্তি বোধ হতো। কোন সময় আরব দেশের আরবী খানা খেতে খেতে বাংলায়ই দেশী খাবারের কথা ভেবেছি। অতচ ইংরেজীর মাধ্যমেই আজীবন লেখাপাড়া করেছি। ১৯৪০ সালে যখন ঢাকায় সপ্তম শ্রেনীতে উঠলাম তখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ স্কুলে বাংলা মাধ্যম চালু হলেও ঢাকা বোর্ডে ইংরেজী মাধ্যমই চালু ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গোটা শিক্ষাই ইংরেজীর মাধ্যমে হলেও বাংলা ভাষার প্রভাব আমার উপর এত বেশী ছিল যে, বি.এ-তে বাধ্যতামূলক এক পেপার বাংলা পড়ে যেন আমার পেট ভরতো না। স্পেশাল বিষয় হিসেবে বাংলা নিয়ে আরও তিন পেপার বাংলা পড়া যেতো। আমার সে বিষয় নেবার সুযোগ না থাকলেও বাংলা বিভাগের শিক্ষকগন আমার উৎসাহ দেখে নিয়মিত তাঁদের ক্লাশে যেতে অনুমতি দিতেন এবং আমি তাঁদের কয়েকজনের ক্লাশে রীতিমত যোগদান করতাম। ক্লাশে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অধ্যাপকগণের মনোযোগও আমার প্রতি যথেষ্ট পেয়েছি। এমনকি বি.এ. পরীক্ষার বাধ্যতামূলক এক পেপারের পরীক্ষায় ভাল নম্বর দেখে বিশ্ববিদ্যালযের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্ব রঞ্জন ভাদুরী আমাকে বাংলায় এম,এ, পড়ার জন্য অতি স্নেহ ভরে তাকিদ দিলেন। বাংলা ভাষায় ডিগ্রি নেবার আমার আগ্রহ ছিল না। বাংলাভাষায় চর্চা এবং লেখাপড়ার উৎসাহ অবশ্যই ছিল ও আছে এবং স্বভাবিকভাবেই থাকবে বলে আশা করি।
রাসূল (সা) বলেছেন যে, তিন কারনে তোমরা আরবী ভাষাকে ভালবাসবে। এর পয়লা কারন তিনি এভাবে উল্লেখ করেছেনঃ আমি আরবীভাষী। এ থেকে বুঝা যায় মাতৃভাষার প্রতি মানুষের ভালবাসা এমন স্বাভাবিক যে, রাসুলের জীবনেও তা প্রমানিত হয়। এ হাদীস জানার পর থেকে আমার মাতৃভাষাকে ভালবাসার মধ্যে একটি পবিত্র অনুভূতি যোগ হলো।
রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. ক্লাসের ছাত্র থাকাকারে যখন প্রথম এ আন্দোলনের সূচনা হয় তখন এর মধ্যে কোন রাজনৈতিক গন্ধ আমি অনুভব করিনি। তখনকার শাসকগনের পক্ষ থেকে এটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বলে প্রচার করলেও আমি আমি এটাকে অপপ্রচার মনে করেছি। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহনরারীদের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কারো থাকুক বা নাই থাকুক এ আন্দেলনের আবেদন ঠিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ও মানবিক। ফজলুল হক মুসলিম হল সংসদের প্রক্তন জেনারেল সেক্রেটারী (১৯৪৬-৪৭) এবং ডাসুর তদানীন্তন জি,এস, সাথে আলোচনায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে আমি যা বলতাম তা নিম্নরূপঃ
ইংরেজ থেকে আযাদী হাসিল করার পর যোগ্যতার সাথে এর সুফল ভোগ করতে হলে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতেই হবে। ইংরেজরা এদশে দখল করার পর যখন ইংরেজী ভাষায় রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করল তখন মানুষ পরাধীনতার বিস্বাদ তীব্রভাবে অনুভব করল। মাতৃভাষায় মহাজ্ঞানী ব্যক্তও তখন রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপে নিরক্ষরে পরিনত হলো। ইংরেজের ভাষা না জানায় সরকারের নিকট আর কোন যোগ্যতাই গল্য রইল না। ফরে ইংরেজী না জানা সব শিক্ষত লোক রাতারতি মূর্খের সমপর্যায়ে আবনমিত হলো।
“এ সুস্পষ্ট যুক্তির নিত্তিতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাভা একমাত্র উর্দু ভাষা শিখে যোগ্য হবার মত চেষ্টা করলেও বাংলাভাষী পাকিন্তানীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হতে বধ্য হবে। তাঝাা বাংলাভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না পেলে শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ে বাংলাআভার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবে”
“স্বাধীন জাতীয় মর্যাদা নিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের প্রয়োজনে তাই উর্দুর সাথে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষ হিসেবে স্বীকার করতেই হবে। পূর্ব পাকিস্তানী জনসংখ্যা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দবী আমরা করছি না। আমারা উর্দু ও বাংলা দু‘টো ভাষকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার দাবী জানাচ্ছি। এ দাবীর যৌক্তিকতা অস্বীকার করার সাধ্য কারো নেই।”
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে আমরা শ্লোগান দিতাম তা আজও স্পষ্ট মনে আছে। “বাংলা উর্দু ভাই ভাই-রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। “উর্দু বাংলা বাই ভাই-উর্দুর সাথে বাংলা চাই”।
আমার বাংলাভাষার রূপঃ একই ইংরেজী ভাষা বৃটেন ও আমেরিকায় প্রচলিত থাকলেও উভয় দেশের ভাষায় এত পার্থক্য কেন সৃষ্টি হলো? উভয় দেশ একই খৃষ্ট ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্বেও ক্রমে ভাষার পাথর্ক্য বাড়ছে। ধর্মকে ব্যক্ত জীবনে সীমাবদ্ধ রাখার যত চেষ্টাই হোক আধুনিক যুগেও ভাষা ও সংস্কৃতিতে ধর্মীয় প্রভাব অবচেতনভাবে হলেও থেকেই যায়। আমাদের দেশে হিন্দু ও মুসলিম দু‘টো প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছ্ ে এদেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ভাষা ও সংক্সৃতি হিন্দু প্রধান। হিন্দুদের ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মুসলিমদের ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য এতটা স্পষ্ট যে, ভাষা ও সাহিত্যে এ স্বাভাবিক প্রতিফলন হয়েছ্ েমুসলমানদের ভাষায় কুরআন হাদীসের পরিভাষা ও শব্দ এবং এর প্রভাবে ফরাসী ও উর্দু শব্দ ব্যাপক হারে চালু রয়েছে। মুসলিম সাহিত্যিক ও কবিদের ভাষা এবং হিন্দু কবি ও সাহিত্যিকদের ভাষায় স্বাধাবিকভাবেই যেটুটু পার্থক্য রয়েছে তা জোর করে দুর করার চেষ্টকে অপচেষ্টাই বলতে হবে। হিন্দু ভাইরা “নেমন্তন্ন” খাবেন তাতে মুসলমানদের আপত্তি থাকা যেমন অন্যায় মুসলমানরা “দাওয়াত” খেলে কারো নারাজ হওয়া সুস্থ মনের পরিচায়ক নয়। পাকিস্তান হবার আগেও হোষ্টেলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, যেমন ফজলুল হক মুসলিম হলে আমরা “গোশত” খেতাম। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে ঢাকা হলে (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) আমার হিন্দু সহপাঠীরা “মাংস” খেতো।
কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের ভাষা ও কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এত পার্থক্য কেন? এ পার্থক্যকে কৃত্রিম মনে করা ভূল। নজরুল কাব্যে আরবী ফারসী ও উর্দু প্রাচুয়ের ফলে মুসরিম সমাজে তার জনপ্রিয়তা স্বাভাবিক ছিল। তাই বাংলাভাষী মুসলমানদের নিকট নজরুলই জাতীয় কবি হিসেবে সমাদৃত। রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষার মহান কবি হিসেবে আমাদের অন্তরে উচ্চ আসলে অধিষ্ঠিত হলেও মুসরিম জাতীয় কবির মর্যাদা তিনি পাননি। অথচ উভয় কবিই পশ্চিম বংগে জন্ম নিয়েছেন।
জনাব আবুল মনসুর “পূর্ব বাংলার” জনগনের ভাষাকে বাংলাদেশের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্টিত করার উদ্দেশ্যে পশ্চিম বংগের জনগনের ভাষা থেকে আলাদা করে দেখছেন। কিন্তু পশ্চিম বংগ ও বাংলাদেশের জনগনের ভাষার যে পার্থক্য রযেছে তার চেযেও বড় পার্থক্য উত্তর বংগ ও সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা, মোমেনশাহী ও নোয়াখালীর ভাষায় সুস্পষ্ট। তাই জিলায় বা এলাকায় কথ্য ভাষার যে পার্থক্য তা সাহিত্যের ভাষা কোন একটি আঞ্চলিক ভাষা হতে পারে না।
পশ্চিম বাংলার সাহিত্য হিন্দু সংস্কৃতি প্রধান এবং বাংলাদেশের সাহিত্য মুসলিম প্রধান হওয়াই স্বাভাবিক। এর ফলে দু‘দেশের ভাষায় কিছু পার্থক্য এমন থাকাই সঙ্গত যা সংস্কৃতিগতভাবে আপন পরিচয় বহন করবে। এ স্বাতন্ত্রটুকুই একটি দেশের নিজস্ব পরিচিতি। বিশ্বের জাতিপুঞ্জের মধ্যে এ ধরনের বৈশিষ্ট্য দ্বারাই জাতির অস্তিত্ব প্রামাণিত হয়। কোন একটি দেশকে অন্য জাতি অস্ত্রের বলে জয় করার সত্বেও আপন সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকলে বেঁচে থাকলেও একদিন সে দেশ রাজনৈতিক আযাদীও হাসিল করতে পারে। কিন্তু যুদ বিজয়ী জাতির সংস্কৃতির নিকট সে দেশের জনগন পরাজিত হয় তাহলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
”আমার দেশ বাংলাদেশ” আমার ভাষা বাংগালী ভাষা নয় – ”বাংলাদেশী ভাষা।” কারণ মুসলিম সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এদেশের শতকরা ৯০ জনের ধর্ম, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষার দিক দিয়ে আমার আদর্শগতভবে মুসলিম জাতি এবং ভৌগলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশী জাতি। এদেশের সব ধর্মের নাগরিক মিলে আমরা রাজনৈতিক পরিভাষায় বাংলাদেশী নেশান বা জাতি। কিন্তু আদর্শিক মানে আমরা মুসলিম মিল্লাতের আন্তর্ভূক্ত। আমি তাঁদের সাহিত্য কর্মের মান অনুযায়ী যথারীতি শ্রদ্ধা পোষণ করি। ইংরেজী সহিত্য থেকেও আমি সাহিত্যের সুস্বাদু খোরাক পাই। কিন্তু তাদের সাহিত্য ও ভাষা আমার জাতীয় সাহিত্য বা জাতীয় ভাষা নয়। বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সহজবেধ্য যে ভাষা তাই আমার ভাষা।
এর নাম যদিও বাংলাভাষাই – তবু পশ্চিম বংগের ভাষা থেকে এর পরিচয় ভিন্ন। এ ভাষা “বাংলাদেশের বাংলাভাষা” যেমন আমেরিকান ইংরেজী ভাষা ইংরেজী হলেও ইংল্যান্ডের ইংরেজী ভাষা থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। [আমার দেশ বাংলাদেশ]
আমার হল ফজলুল হক মুসলিম হল
মানুষের জীবনে কোন এক সময়ে সাধারণ একটা ঘটনাও বিরাট প্রভাব বিস্তার করে এবং মনে দীর্ঘ স্থায়ী অনুভুতির সৃষ্টি করে। ১৯৮০ সালের ২৬ মে জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সালের ২৬ শে জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ”মুসলিম” হল ফজলুল হক হলে চমৎকার অনুষ্টানে যোগদান করার সুযোগ হয়। “পূর্নমিলনী উৎসব ১৯৮০” নামে এ অনুষ্টানটিতে এ হলের প্রাক্তন ছাহ্রদের সাথে বর্তমানে অবস্থানরত ১৪০০ তরুণ ছাত্রের পরষ্পর মিলিত হবার এক প্রশংসনীয় ব্যবস্থা হয়। হলের বয়স ৪০ বছর। সুতরাং এ হলের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে কমপক্ষে ৬০বছর বয়সের বৃদ্ধের সংখ্যাও নগন্য ছিল না। চাকুরী জীবন থেকে অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের সাথে পরিচয়ও হলো।
প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের যাঁরা এ মহান উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা সত্যিই আন্তরিক মোবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য। তাঁরা এমন এক দুর্লভ মুহূর্তের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন যা আমার মতো অনেককেই নিঃসন্দেহে পরম মানসিক তৃপ্তি দান করেছে। এর প্রভাব আমার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে প্রাক্তন ছাত্রদের একটি সমিতি গঠনের প্রস্তাব আমাকে অত্যন্ত উৎসাহিত করেছে। প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা এতে নেতৃত্বের ভুমিকা পালন করেছেন তাঁদের কয়েকজন আমার সমসাময়িক – কেউ সহপাঠি, কেউ সিনিয়র, আবার কেউ জুনিয়ার।
এ অনুষ্টানের সভাপতি হলের প্রভোষ্ট, প্রধান অতিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি, হলের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাক্তন কয়েকজন ছাত্রের বক্তৃতা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। ১৯৪৪ থেকে ৪৮ সাল পর্যন্ত এ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে হলের যাবতীয় ক্রিয়াকান্ডে আমার ভুমিকা অত্যান্ত সক্রিয় ছিল। হল-সংসদের বর্তমান পায়িত্বশীলদের কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে আমার পুরাতন মধূর দিনগুলোকে ফিরে পেলাম বলে মহে হচ্ছিল।
ছাত্র জীবনটা সত্যি জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়। পরবর্তী জীবন যতই অনিশ্চিত হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকারে উজ্জলতম জীবনের স্বপ্ন আনন্দেরই সুস্পষ্ট ইংগিত দেয়। আমি ”প্রাক্তন ছাত্র” হিসেবে ঐ অনুষ্টানে বসে সত্যিই যেন ছাত্র জীবনের অনন্দ বোধ করছিলাম। প্রাক্তন হলেও ছাত্র হিসেবেই স্বীকৃতি তো পেলাম। তরুন ছাত্রদের সাথে এক সামিয়ানার নিচে বসে ৫৭ বছর বয়সেও সত্যি তারুণ্য অনভব করলাম।
হলের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছিল। আমি যেন তাদের মধ্যে নিজের অতীতকে ফিরে পেলাম। ১৯৪৬-৪৭ সালের এ হলেরই জি, এস, এবং ৪৭-৪৮ সালে ডাকসুর জি,এস এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের জি,এস হিসেবে হল মিলনায়তন ও কার্জন হলে যেসব অনুষ্ঠান পরিচলনার সুযোগ আমার হয়েছিল সেদিন যেন সে পুরাতন ছবিই নতুন করে দেখলাম। সত্যি সেদিন আমি এতটা ভাবপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম যে, গোটা অনুষ্ঠানটি আমাকে অভিভুত করে রেখেছিল।
এমন কিছু পুরনো বন্ধুর সাথে সেখানে দেখা হলো যাদের সাথে এ সুযোগ ছাড়া জীবনে আর দেখা হতো কিনা জানিনা। বেশ কিছু পরিচিত বিশিষ্ঠ লোক এমনও পেলাম যারা এ হলের ছাত্র বলে যানা ছিল না। তাদের সাথে নতুন করে পরিচয় হলো। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত বহু প্রাক্তন ছাত্রের আমন এক সমাবেশ সেদিন দেখলাম যার স্মৃতি স্থায়ীভাবেই মনে জগরুক থাকবে। প্রাক্তন ছাত্রদের সমিতি গছিত হলে এ ধরনের সমাবেশের আরও সুযোগ হবে। সমিতির প্রস্তাবটি প্রধানত দু‘টো কারনে আমার মনে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। প্রথমত হলের উন্নয়নে এবং ছাত্রদের কল্যাণমূলক কার্যাবলীকে প্রাক্তন ছাত্রদের যথাসাধ্য অংশগ্রহনের মহাসুযোগ হবে। দ্বিতীয়তঃ ভিন্ন মত, পথ, আদর্শ ও চিন্তার লোকেরা অন্তত একটি মহৎ উদ্দেশ্যে একত্র হয়ে ভাবের বিনিময় করার সুযোগ পাবে। যাদের পরষ্পর দেখা সাক্ষতেরও কোন সুযোগ হয় না তাঁরা হলকে কেন্দ্র করে এক সাথে কাজ করারও সুযোগ পাবে, এটা সত্যিই বড় আনন্দের বিষয়। এমন কি রাজনৈতিক কারনেও যারা একে অপর থেকে অনেক দূরে তারাও হলের কল্যানে একযোগে কাজ করার মাধ্যমে নৈকট্য বোধ করবে।
অনুষ্ঠানে কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের বক্তৃতায় এ হলের অতীত গৌরবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার মহান আন্দোলনের গৌরব। ১৯৪৮ সাথে এ আন্দোলন ফজলুল হক মুসলিম হল থেকেই শুরু হয়। অনুষ্ঠানে এ বিষয় বক্তৃতা শুনবার সময় আমার চোখের সামনে ঐ সময়কার ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত কর্মতৎপরতার পূর্ন চিত্র ফুটে উঠলো। শ্লোগান দেবার জন্য টিনের তৈরী চুংগা একজনের হাতে তুলে দিয়ে ১০-১২ জনের এক একটি দলকে বিভিন্ন এলাকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করে একটি দল নিয়ে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। ভাষা আন্দোলনে এ হলের অগ্রনী ভুমিকা কেউ অস্বীকার করবে না।
ফজলুল হক মুসরিম হরের একটি বড় অবদানের কথঅ কেউ উল্লেখ করেননি। সেটা হল-সংসদের নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলীম হল। ফজলুল হক মুসলিম হল এর ১৮ বছর পর শুরু হয়। এ দু‘টো হল সংক্ষেপে এস, এম, হল ও এফ, এইচ, হল নামেই ছাত্রদের নিকট পরিচিত। হলের সংসদ নির্বাচনে এস,এম হলে এমন এক ঐতিহ্য চালু হয়ে যায় যা শিক্ষিত রুচিশীলদের নিকট গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। জিলাবাদই (ডিষ্ট্রিক্টিজম) সেখানে নির্বাচনী আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। কুমিল্লা ও নোয়াখালী জিলার ছাত্র এত বেশী ছিল যে, এ দু‘জিজলার ছাত্র নির্বচনী ঐক্য গঠন করলে তদানীন্তন পর্ববংগের সব জিলার ছাত্র মিলেও সংখ্যা লঘুতে পরিণত হতো। যদিও প্রতিভা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষয় কৃতিত্বের ভিত্তিতেই নির্বচনের প্রার্থী মনোনীত হতো। তবু জলাবাদের দরুন ঐ মানদন্ড জিলার সংকীর্ণ সীমায় আবদ্ধ হয়ে যেত।
১৯৪০ সালে ফজলুল হক মুসলিম হলের জন্ম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৪ সালে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হই এ হলের মাধ্যমে। নোয়াখালী জিলার জনাব নাজমুল করিম (মরহুম ডঃ নাজমুল করিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রফেসার) এ হলের অন্যতম সিনিয়র ছাত্র। ৪৪-৪৫ শিক্ষবর্ষের হল সংসদের নির্বাচনের শরুতেই জনাব নাজমূল করিমের নেতৃত্বে জিলাবাদের পরিবর্তে প্রতিভা ও কর্মসুচীর ভিত্তিতে নির্বাচন পরিচালনার আন্দোলনে কুমিল্লা জিলার পক্ষ থেকে আমি উৎসাহের সাথে শরীক হলাম। সে বছরই প্রথম সাফল্যের সাথে জিলাবাদকে উৎখাত করা হয়। জনাব নাজমুল করিম হলের স্পীকার নির্বাচিত হন এবং বরিশালের জনাব মেসবাহ উদ্দিন (অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সরকারের সচিব) ভি,পি নির্বাচিত হন। অবশ্য নির্বাচনী যুদ্ধে এ দু‘জন প্রতিদ্বন্দ্বী দলে ছিলেন। এরপর আরও ৩টি নির্বচনে আমি অত্যন্ত সক্রিয় ছিলাম। প্রত্যেক নির্বচনের সময় বিভিন্ন আকর্ষনীয় নামে নির্বাচনী দল গঠিত হতো। এসব দল হল ভিত্তিক ছিল। নির্বচনের পর ঐসব নামের কোন ব্যবহার হতো না। জিলাবাদের পরিবর্তে এভাবেই নির্বচন চলতে থাকে। অবশ্য পরবর্তীকালে দেশভিত্তিক ছাত্র সংগঠন গঠিত হওয়ায় ঐসব সংগঠনের নামেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার রীতি চালু হয়। এখন সব হলেই দলভিত্তিক নির্বাচন যুদ্ধ চলে। জিলাবাদ খতম করে নীতি ও কর্মসূচী ভিত্তিতে হলের সংসদ নির্বাচন পরিচালনার মহান ঐতিহ্য এফ, এইচ, হলেরই বিশেষ অবদান।
এফ, এইচ, হলের সাথে মনের যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে তা এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অত্যন্ত সজীব হওয়ায় পরম তৃপ্তিবোধ করেছি এবং আমার হল জীবনকে আবার ফিরে পাওয়ার সুস্বাদ উপভোগ করেছি। এ “হল” এত আপন যে সেখানকার সব কিছুই “আমার দেশের” মতোই প্রিয়। তাই এ হলকে “আমার হল” বলতে গৌরব বোধ করি। এর গৌরব বৃদ্ধি করার জন্য কিছু করতে পারলে সৌভাগ্য মনে করব। প্রাক্তন ছাত্রদের সমিতি সুসুংগঠিত হলে এ সুযোগ আমার মতো অনেকেই নিতে পারতেন। কিন্তু সমিতির উদ্যোক্তাগন বিভিন্ন করনে নিরাশ হয়ে এ প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করেন। [আমার দেশ-বাংলাদেশ]