বাংলাদেশের আসল সমস্যা
বাংলাদেশের মৌলিক সমস্যা
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বেরই অন্যতম একটি রাষ্ট্র। তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের যাবতীয় সমস্যাই এখানে অত্যন্ত সজীবভাবেই বর্তমান ঃ
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ঃ শাসনতান্ত্রিক স্থায়ী কাঠামো ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবই তৃতীয় বিশ্বের প্রধান সমস্যা। এ সমস্যার কারণ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হলেও সমস্যার প্রকৃত রূপ একই। শাসনতন্ত্র সেখানে একনায়কের খামখেয়ালীর খেলনা, আর সরকারী দল তার অনুগত দাস। ফলে সেখানে শাসনতন্ত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে না এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব হয় এবং পরিণামে সামরিক শাসন এসে নতুন সমস্যার জন্ম দেয়। কারণ সামরিক শাসন কখনও রাজনৈতিক সমাধান নয়।
একথা দেবাসীর মন-মগজে কায়েম হতে হবে যে, ব্যক্তি যত যোগ্য বা নিঃস্বার্থই হোক তাকে দেশের ভাগ্যবিধাতা হিসেবে মেনে নেয়া মরাত্মক ভুল। ব্যক্তি চিরজীবী নয় এবং ব্যক্তি ভুলের ঊর্ধেও নয়। এ ধরনের দায়িত্বের অধিকারী ব্যক্তির একার বুলে একটি দেশে বিপর্যয় হয় এবং গোটা জাতির স্বার্থ বিপন্ন হয়। অতীত ও বর্তমান ইতিহাস এর জ্বলন্ত সাক্ষী। তাছাড়া সর্বক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির হঠাৎ মৃত্যু হলে গোটা দেশ চরম শাসনতান্ত্রিক সংকটের সম্মুখীন হয়।
তাই কোন দেশের স্থায়ী কল্যাণের জন্য একটি স্থায়ী শাসনতান্ত্রিক কাঠামো থাকা অপরিহার্য। দেশের সকলের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যত বংশধরদের উন্নতি এবং দেশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এরই উপর প্রধানত নির্ভরশীল। ব্যক্তিত্বের প্রভাব ও যোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সব দেশে সব কালেই স্বীকৃত। কিন্তু জাতির ভাগ্য কোন এক ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া আত্মহত্যার শামিল। শাসক আজ আসবে, কাল স্বাভাবিক মানবিক কারণেই চলে যাবে। কিন্তু দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে স্থায়ী বিধি-ব্যবস্থা না থাকলে যিনিই ক্ষমতায় আসবেন তিনি তার মরযী মতে শাসনতন্ত্রকে যেমন খুশী রদ-বদল করবেন। কোন স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য এর চেয়ে অপমানকর কোন কথা আর হতে পারে না। এ অবস্থায় জাতীয় মর্যাদাবোধই বিনষ্ট হয়।
সুতরাং যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জাতীয় সংসদে আসন পান তাদের নেতৃস্থানীয়দের এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। তাদেরকে সর্বসম্মতভাবে শাসনতন্ত্রের মূল রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। যদি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত সম্ভব না হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে গণভোটের মাধ্যমে জাতীয় সিন্ধান্তে পৌঁছতে হবে।
২. নৈতিক অবক্ষয় ঃ দ্বিতীয় প্রধান সমস্যা হলো নৈতিক অবক্ষয়। মানুষ নৈতিক জীব। বিবেকসম্পন্ন জীব হিসেবে ভাল-মন্দের ধারণা থেকে কোন মানুষ মুক্ত থাকতে পারে না। যে জাতির অধিকাংশ লোক মন্দ জেনেও ইচ্ছা করে তাতে লিপ্ত হয়, সে জাতির জীবনে কোন ক্ষেত্রেই শৃঙ্খলা থাকতে পারে না। এমন জাতির মধ্যে কোন আইনই সঠিকভাবে জারি হতে পারে না। নৈতিকতাশূন্য সরকারী কর্মচারী জাতির ডাকাক স্বরূপ। প্রতিটি আইন তাদেরকে যোগ্যতার সাথে ডাকাতি করার ক্ষমতা যোগায়।
আমাদের দেশে আইন-আদালত, কোর্ট-কাচারী, থানা-পুলিশ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, উযীর-নাযীর, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, ইত্যাদিকে আধুনিক যুগোপযোগী করার জন্য জাতীয় শক্তি-সামর্থের অনেক বেশী অর্থ-দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কাংখিত শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ সাধিত হচ্ছে না। মানুষ প্রকৃতপক্ষেই বিবেকবান নৈতিক সৃষ্টি। নৈতিকতা বোধই মনুষ্যত্বে। আর চরিত্রই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। তাই নৈতিক চেতনাই মানুষের আসল সত্তা। মানুষের দেহ-যন্ত্রের পরিচালনাশক্তি যদি ও সত্তার হাতে তুলে দেয়া না হয়, তাহলে সে পশুর চেয়েও অধম হতে পারে।
প্রত্যেক জাতিই তার বংশধরকে শৈশবকাল থেকেই নীতিবোধের ভিত্তিতে সুশৃঙ্খল বানাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সব জাতির নীতিবোধের ভিত্তি এক নয়। প্রত্যেক জাতি কতক মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতেই জাতীয় নীতিবোধের ধারণা লাভ করে। বাংলাদেশের শতকরা ৮৭ জনের মৌলিক বিশ্বাস হলো তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। সুতরাং এদেশের জাতীয় নীতিবোধ যদি এর ভিত্তিতে রচিত হয়, তাহলে জাতীয় চরিত্র গঠনের কাজ ত্বরান্বিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি অন্য কোন ভিত্তি তালাশ করা হয়, তাহলে প্রচলিত মৌলিক বিশ্বাসকে ধ্বংসে করতে কয়েক পুরুষ পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। এরপর নতুন ভিত্তি রচনা করে জাতির নৈতিক মান রচনা করার কাজে হাত দিতে হবে। এমন আত্মঘাতী পথে জেনে-শুনে কোন বুদ্ধিমান জাতি যেতে পারে না।
একটি কথা আমাদের শিক্ষিত সমাজকে গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের সমাজে হাজারো দোষ-ক্রটি থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আল্লাহ, রাসূল ও আখিরাত সম্বন্ধে কোন না কোন মানের বিশ্বাস মুসলিমদের মধ্যে অবশ্যই আছে। হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, উচিত অনুচিত সম্পর্কে জনগণের ধারণা মোটামুটি আছে। প্রবৃত্তির তাড়নায়, আপাত মধুর প্রলোভনে বা কুসংসর্গে মানুষ বিবেকের নৈতিক অনুভূতির বিরুদ্ধে কাজ করলেও সে নীতিবোধ থেকে বঞ্চিত নয়। বিবেকের দংশনই প্রমাণ করে যে, মানুষ নৈতিক জীব। দেহের অসংগত দাবীকে অগ্রায্য করে বিবেকের নির্দেশ পালনের জন্য যে নৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন সে শিক্ষা ব্যতীত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা যোগ্য দানব সৃষ্টি করতে পারে বটে, সুশৃঙ্খল সৎমানব গঠন করতে পারে না।
জাতির নৈতিক উন্নয়ন ব্যতীত অন্যান্য দিকের উন্নতি সম্পূর্ণ অসম্ভব। অন্যায় পথে ধন-সম্পদ অর্জনের মনোবৃত্তি দমন করতে না পারলে সমাজ থেকে শোষণ উৎখাত হব্ েকি করে ? সরকারী আয়ের প্রতিটি উৎস পথে ঘুষখোর ও দুর্নীতিপরায়ণ লোক থাকলে দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা কি করে সম্ভব ? সর্বস্তরে দেশে যে দুর্নীতি ব্যাপক আকারে বিরাজ করছে তা দূর করার ব্যবস্থা না হলে জনগণ কোন সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় খেদমত পেতে পারে না। দুর্নীতির ফলে করদাতা জনগণ মনিব হয়েও সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা শোষিত, নির্যাতিত ও অপমানিত।
৩. অর্থনৈতিক নিরারপত্তার অভাব ঃ তৃতীয় প্রধান সমস্যা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব। দেশে এমন ধরনের এক অর্থব্যবস্থা চালু রয়েছে যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চেয়েও নিকৃষ্ট। সমাজতন্ত্রের নামে কিছু শিল্প-কারখানাকে সরকারী পরিচালনাধীন করেই সুফল পাওয়া যেতে পারে না। বাংলাদেশে বর্তমান অর্থব্যবস্থা কোন পরিকল্পিত ব্যবস্থা নয়। ‘অরাজকাতাই’ই এর একমাত্র পরিচয়।
কোন দেশের সুপরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার প্রথম ভিত্তিই হলো জনগণের মৌলিক মানবীয় প্রয়োজন পূনণের লক্ষ্যবিন্দুকে অর্জনের দৃঢ়সংকল্প। খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা যদি পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য না হয়, তাহলে দেশের উন্নয়নের নামে যাই করা হোক, তা শোষণের হাতিয়ারেই পরিণত হয়্ প্রতিটি মানুষের এসব্ মৌলিক প্রয়োজন পূরণই প্রকৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঠিক উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য ব্যতীত রাষ্ট্র ও সরকার মানব জীবনের জন্য অর্থহীন।
দুনিয়ার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এ উদ্দেশ্য হাসিল করার দু’প্রকার বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। (১) পশ্চিম ইউরোপীয় কল্যাণমূলক কয়েকটি রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক দলীয় একনায়কত্ব ছাড়াই ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধি ও ন্যায়ভিত্তিক বন্টনের মাধ্যমে এ সমস্যার মোটামুটি সমাধান করেছে। অবশ্য পুঁজিবাদী সমাজের তুলনায় সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা অধিকতর সন্তোষজনক হলেও শুধু রাজনৈতিক নিরাপত্তাই মানুষকে প্রয়োজনীয় সুখ ও শান্তি দিতে পারে না। তাই ঐ সব দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা এত বেশী। মানুষ পেটসর্বস্ব জীব নয় যে, পেটে ভাত থাকলেই তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। মানুষ বিবেক প্রধান জীব, তাই তার রুহকে অশান্ত রেখে বস্তুগত দৈহিক প্রয়োজন পূরণ হলেও সে সুখী হয়ে যায় না। তবু ঐ কয়টি রাষ্ট্র যেটুকু করেছে তা অন্যসব দেশের তুলনায় নিঃসন্দেহে মন্দের ভাল।
(২) অপর দিকে সমাজতান্ত্রিক দেশে মানুষের সকল প্রকার আযাদী হরণ করে যে অর্থব্যবস্থা চালু করেছে, তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য সেটা বিবেচ্য। পুঁজিবাদী অর্থনীতি রাজনৈতিক স্বাধীনাতার দোহাই দিয়ে অর্থনেতিক গোলামী কায়েম করে, আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নামে চরম ও স্থায়ী রাজনৈতিক দাসত্বের প্রচলন করে।
আমাদের দেশে কোন ধরনের অর্থব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত, সে বিষয়ে ধীর মস্তিস্কে চিন্তা-ভাবনা করে আমরা যদি রাজনৈতিক আযাদী ও অর্থনৈতিক মুক্তি এক সাথে পেতে চাই, তাহলে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা গভীর অধ্যয়ন ও তুলনামূলক জ্ঞানের ভিত্তিতে অত্যন্ত বলিষ্ঠ মনোভাব নিয়ে দাবী করছি যে, আল্লাহর কুরআনে ও রসূলের বাস্তব শিক্ষায় আধুনিক যুগের জন্যও একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের যে মজবুত বুনিয়াদ রয়েছে তাই এদেশের অর্থনৈতিক সমস্যার একমাত্র ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান দিতে পারে। ডেনমার্ক ও নরওয়ের মত কয়েকটি দেশের অর্থব্যবস্থা এবং জাপানের কর্মকুশলতা থেকেও আমরা অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা পেতে পারি যা ইসলামী বুনিয়াদের উপর এদেশের উপযোগী কাঠামোতে বাস্তবায়িত করা সম্ভব।
শুধু থিওরী বা মতবাদ দ্বারা বাস্তব সমাধান হয় না। সত্যিকারের সমাধানের জন্য দরদী মনের প্রয়োজন। যাদের অন্তর দেশেরগরীবদের অবস্থা দেখে অস্থির হয় না, বিধবা ও বিবস্ত্র নারীকে কংকালসার ছেলেমেয়েসহ শহরে-বন্দরে ভিক্ষায় ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে যাদের প্রাণ কাঁদে না, স্কুলে পড়ার বয়সের ছেলে-মেয়েদেরকে ইট ভাংগতে ও রাস্তায় কাগজ কুড়াতে দেখে যাদের মনে পিতৃøেহ জাগে না, তারা রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে দেশের দুর্গত মানুষের জন্য যে পর্যন্ত গভীর মমত্ববোধ না জাগবে এবং ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে যে পর্যন্ত তারা যথাসাধ্য জনসেবার অভ্যাস না করবে, সে পর্যন্ত জাতির ভাগ্য উন্নয়নের পরিবেশই সৃষ্টি হবে না।
৪. উদ্দেশ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা ঃ চতুর্থ বড় সমস্য হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা। গতানুগতিক ধারায় শিক্ষার স্রোত চলছে লক্ষ্যহীনভাবে। শিক্ষার প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে বিবেকবান মানুষ গড়া। এরপর লক্ষ্য হওয়া উচিত জাতির প্রয়োজন পূরণের জন্য সুপরিকল্পিত শিক্ষা। আমরা দীর্ঘ কোর্সের ব্যয়বহুল এম, বি, বি, এস ডাক্তার দিয়ে ৯ কোটি মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন ১৫০ বছরেও পূরণ করতে পারবো না। এর জন্য গ্রামে থাকতে রাযী স্বল্প-মেয়াদী কোর্সের বিরাট চিকিৎসক বাহিনী সৃষ্টি করতে হবে। হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্যে অল্প খরচে এ প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। জাতীয় সম্পদের বিরাট অংশ ব্যয় করে আমরা দামী ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করছি। অথচ তাদেরকে কাজ দিতে পারি না বলে তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
কিশোর ও যুবকদের হাতকে উৎপাদনের যোগ্য বানাবার জন্য সংক্ষিপ্ত টেকনিক্যাল শিক্ষা ব্যাপক না করায় শিক্ষা দ্বারা বেকারের মিছিলকে বৃদ্ধিই করা হচ্ছে। কি করে দেশের সব হাতে কাজ তুলে দেয়া যায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে দেশের সব নারী-পুরুষকে বিভিন্ন কুটির শিল্পের শিক্ষা দিয়ে উৎপাদনী জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। আমাদের গরীব দেশের সম্পদ কি করে বাড়ান যায়, সে শিক্ষার জন্য কলেজের মতো দালান, এমনকি হাই স্কুলের মতো ঘর না হলেও চলতে পারে। পশু পালন, হাস-মুরগী বৃদ্ধি, মাছের সস্তা চাষ, ফল-মূল, শাক-সবজি উৎপাদনের জ্ঞান নিরক্ষর লোকদের মধ্যেও বিতরণ করা সম্ভব। শিক্ষা বলতে শুধু স্কুল-কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাই বুঝায় না। একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার জন্য সব নাগরিককে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ব্যাপক গণশিক্ষা প্রয়োজন। গণশিক্ষার জন্য মসজিদ মক্তব ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোই ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫ অবহেলিত মহিলা সমাজ ঃ দেশের অন্যতম প্রধান সমস্য মহিলাদের পশ্চাতে পড়ে থাকা। তাদের পিছনে ফেলে রাখা হয়েছে বলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। জনশক্তির অর্ধেক মহিলা-কিন্তু জাতীয় প্রাণশক্তির বিচারে মহিলার সমাজের বৃহত্তর সম্পদ। তাদেরকে হয় পুরুষের সেবক, না হয় ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা ইসলামের অনুসারী তারাও নারীকে ঐ মর্যাদা ও অধিকার দিচ্ছে না যা কুরআন-হাদীসে তাদের প্রাপ্য বলে ঘোষনা রয়েছে। ইসলামের নামে শুধু কর্তব্যটুকুই তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। মোহরের অধিকার, উত্তরাধিকারের অধিকার, খোলা তালাকের অধিকার, স্বামীর অবহেলা-অবিচারের ইত্যাদি ভোগ করার সুযোগ তাদের কোথায় ? নারীর উপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় মহিলা সমাজ জাতির অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে আছ। অথচ তারা জাতীয় উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখতে পারে।
অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, নারীর মর্যাদা ও অধিকারের নামে তাদেরকে পুরুষের সাথে একই কর্মক্ষেত্রে নিক্ষেপ করে সমাজের নৈতিক কাঠামো ও পারিবারিক পবিত্রতা ধ্বংস করা হচ্ছে। অথচ অবহেলিত গ্রাম্য মহিলাদেরকেও নারীদের উপযোগী প্রাথমিক চিকিৎসা, ধাত্রী-বিদ্যা, কুটির শিল্প, পশু পালন, ফল-মূল তরি-তরকারি উৎপাদন ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে জাতির উন্নতির সহায়ক বানান যায়। দেশের শিশু শিক্ষার দায়িত্ব মায়েদের হাতে তুলে দেবার জন্য তাদের উপযোগী বিশেষ শিক্ষা না নিয়ে পুরুষের সাথে বসিয়ে একই ধরনের বিদ্যা শেখাবার অপচেষ্টা চলছে। সমাজের বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে নারীকে তার দৈহিক যোগ্যতা ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের উপযোগী কাজে লাগিয়ে সমাজের গাড়ী সচল করা অপরিহার্য। নারী ও পুরুষ এ গাড়ীর দু‘টো চাকা। এদের অবস্থান একত্র নয়, নিজ নিজ স্থানে তাদের কাজে লাগাতে হবে। তবেই সমাজের গাড়ী সন্তোষজনকভাবে চলতে পারে।
নারীর সর্বাপেক্ষা পবিত্র ও গুরুত্বপুর্ণ কাজ হলো মায়ের দায়িত্ব পালন। মানব শিশুর মধ্যে মানবিক মহৎ গুণাবলী প্রধানত মায়ের কাছ থেকেই অর্জন করা সম্ভব। এর জন্য মাতৃজাতিকে শিক্ষ দেবার কোন ব্যবস্থা কি দেশে আছে ? পরিবার পরিচালনা ও সংরক্ষণের দায়িত্বও নারীরই উপর ন্যস্ত। অথচ এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে গড়ে তুলবার ব্যবস্থাও নেই। স্বামী রোযগার করে পরিবার চালাবার জন্য উপযুক্ত স্ত্রীর হাতে টাকা তুলে দিলেই পারিবারিক ব্যবস্থা সুন্দরভাবে চলতে পারে। মা ও স্ত্রীর এ দু’টো দায়িত্বকে অবহেলা করে নারী জাতির উন্নতির নামে পুরুষের করণীয় কাজে তাদেরকে নিয়োগ করা নারীত্বের চরম অবমানা। ঐ দু’টো দায়িত্বের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেবার পরও সমাজ গঠন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনে নারীর উপযোগী বহু কাজ রয়েছে যা নারীদের পক্ষেই অধিকতর যোগ্যতার সাথে করা সহজ। প্রাথমিক শিক্ষা, নারী চিকিৎসা, হস্তশিল্প এবং যেসব শিল্পে দৈহিক শক্তির প্রয়োজন হয় না, সে সব ক্ষেত্রে নারীসমাজ যতটা খেদমত করতে পারে তার পূর্ণ সুযোগ অবশ্যই তাদেরকে দিতে হবে যাতে জাতি দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
পাঁচটি বড় বড় সমস্যা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে চিন্তার বিশেষ একটি ধারা সৃষ্টি এখানে উদ্দেশ্য। এ সমস্যাগলোর সমাধান একটি কথা দ্বারাই হয়ে যাবে না। আর সমস্যাগুলো একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্নও নয়। একই দেহে অনেক রোগের বিভিন্ন উপসর্গ দেখে প্রত্যেক রোগের পৃথক পৃথক চিকিৎসা যেমন অবাস্তব, তেমটি দেশের এসব সমস্যাকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা না করে সত্যিকারভাবে সমাধান করা অসম্ভব। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নৈতিক উন্নয়ন, ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থ, উপযুক্ত শিক্ষাব্যবসস্থা, মহিলাদেরকে জাতির উপযুক্ত খেদমতের যোগ্য বানান ইত্যাদি একই মহাপরিকল্পানা বিভিন্ন অংশ হবে। কোন একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তি ব্যতীত এ ধরনের সঠিক পরিকল্পনা অসম্ভব। আমরা এ উদ্দেশ্যেই ইসলামকে আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছি।
(বাংলাদেশ ও জামায়েত ইসলামী)
বাংলাদেশ কি সত্যি দরিদ্র ?
হিমালয়ান উপমহাদেশের সব কয়টি দেশই এক সময় ইংরেজ শাসনের অধীন ছিল। বর্তমানে সেখানে ছোট বড় অনেক কয়টি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম আছে। বাংলাদেশ, বার্মা, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ নামে যে এলাকাটি এখন পরিচিত তাকে এককালে অখন্ড বৃটিশ ভারতের আমলে ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলিত রাখা হয়েছিল। ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত কোলকাতা মহানগরীকে কেন্দ্র করে শিল্প কারখানা ও ব্যবসা বাণিজ্য চাল করে সেকালের পূর্ব বংগকে এর বাজারে পরিণত করা হয়। আর পূর্ব বংগের কৃষিজাত উৎপন্ন দ্রব্য এবং চাল, মাছ, দুধ, ডিম ও মুরগী দ্বারাই ঐ এলাকার পুষ্টি সাধিত হতো।
ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের ফলে পূর্ব বংগের উন্নয়নের প্রয়োজনেই ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বংগ ও আসামকে নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ গঠন করা হয়। কিন্তু কোলকাতা ভিত্তিক কায়েমী স্বার্থ অখন্ড বাংগালী জাতীয়তার শ্লোগান তুলে ১৯১১ সালে নতুন প্রদেশটি বাতিল করাতে সক্ষম হয়। ফলে কোলকাতার শোষণ আবার বহাল হয় এবং পূর্ব বংগের উন্নয়ন মুলতবী হয়ে যায়।
১৯৪৭ সালে ঢাকায় পূর্ব বংগের রাজধানী স্থাপিত হবার পর এ এলাকার উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের সাথে পূর্ব বংগ একটি প্রদেশ হিসেবে এক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এ এলাকার উন্নয়ন মোটামুটি এগিয়ে চলছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পূর্ব বংগের নেতৃত্ব দুর্বল থাকায় এ এলাকার উন্নয়ন আশানুরূপ গতিতে অগ্রসর হতে পারেনি। কেন্দ্রীয় রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায়, সশস্ত্র বাহিনীতে পূর্ব বংগের কোন উল্লেখযোগ্য স্থান না থাকায় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের উপর সামরিক শক্তির প্রাধান্য সৃষ্টি হওয়ায় পূর্ব বংগের নেতৃত্ব প্রভাবহীন হয়ে পড়ে। এত কিছু সত্ত্বেও ২৫ বছরের মধ্যে পূর্ব বংগ শিল্প বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে পরিমাণ উন্নতি করেছিল তাতে উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় খুব বেশী পেছনে পড়ে থাকেনি। বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে চালু হবার পর কতক অনিবার্য কারণে সাময়িকভাবে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয় তার দরুন বাংলাদেশকে দুনিয়ার দরিদ্রতম দেশসমূহের মধ্যে গণ্য করার কোন সংগত যুক্তি নেই।
বাংলাদেশ একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম হবার পর সরকারী ক্ষমতার অধিকারীরা যদি একটু সততার পরিচয় দিতে পারতেন এবং সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী বিভিন্ন শক্তি যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করত তাহলে এদেশ এতটা দুরবস্থায় পতিত হতো না। স্বাধীনতা আন্দোলনে শরীফ হবার অজুহাতে অনেকেই অন্যায় সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অপচেষ্টা করায় দুর্দমা আরও বেড়ে যায়। বহু রকমের দেশী ও বিদেশী স্বার্থের বাহকরা এমন সব তৎপরতা চালায় যার ফলে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থাও কায়েম হতে পারেনি।
এত কিছু সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মোটামুটি ধারণা যদি কারো থাকে তাহলে কেউ এদেশকে গরীব বলে মন্তব্য করতে পারবে না। দেশের খনিজ, কৃষিজ ও বনজ সম্পদ এবং পানি ও মৎস্য সম্পদ সম্পর্কে এদেশেরই অনেকের কোন ধারণা নেই। এখানে এর বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। কিন্তু যতটুকু জানার সুযোগ পেয়েছি তাতে বাংলাদেশের যত গরীব মনে করা হয় প্রকৃতপ্েক্ষ যে তত গরীব নয় তা জোর দিয়েই বলতে পারি। (আমার দেশ বাংলাদেশ)
বাংলাদেশের আসল অভাব*
দুনিয়ার বহুদেশ দেখার সুযোগ পাওয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা জন্মেছে। এর ফলে বাংলাদেশীদের।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কালাম আযাদের লেখা ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ বইটি থেকে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
সাথে অন্যদের তুলনা করে মতামত প্রকাশ করা সম্ভব। দোষে গুণেই মানুষ। আমার দেশের মানুষের স্বভাবগত গুণগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে বেশ উৎসাহ বোধ করি। যেমন বুদ্ধিবৃত্তি, বোধশক্তি, বাচনশক্তি, স্মরণশক্তি ইত্যাদির বিচারে এদেশের লোক কোন দেশের পেছনে মনে হয় না। উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ পেলে এদেশের লোক সব কাজেই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে সক্ষম।
এদেশের আয়তন ছোট হলেও বিরাট জনসংখ্যার এদেশকে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েছে। মুসলিম জনসংখ্যার দিক দিয়ে এদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। বর্তমানে এদেশের লোক মধ্যপ্রাচ্য ও ইংল্যান্ডে কর্মরত রয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশেও এদেশের লোক জীবিকার সন্ধানে পৌঁছে গেছে। কর্মদক্ষতার দিক দিয়ে তারা কোথাও অযোগ্য প্রমাণিত হচ্ছে না। এদেশের জনশক্তিকে প্রয়োজনীয় কারিগরী শিক্ষা দিলে দেশের জন্য বিরাট সম্পদ ও গৌরভ অর্জন করে আনতে সক্ষম হবে।
এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যে পরিমাণ আছে তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এক-চতুর্থাংশ জনশক্তির কর্মসংস্থান হতে পারে। আধুনিক কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করে বর্তমান চাষযোগ্য জমিতেই দ্বিগুণ ফসল ফলান সম্ভব।
এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশকে দুনিয়ার সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর তালিকায় গণনা করা মোটেই ঠিক নয়। তাহলে ‘তলাহীন ঝুড়ি’ হিসেবে যে বাংলাদেশের দুর্ণাম সারা দুনিয়ার ছড়িয়ে গেল তার আসল কারণ কী ? অভাব আমাদের অবশ্যই আছে। দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্যের অভাব, চিকিৎসার অভাব ইত্যাদি অসত্য নয়। কিন্তু এসব অভাবের আসল কারণ একটা মৌলিক জিনিসের অভাব। সে জিনিসটিই মানব সমাজের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান। এর নাম হলো ‘চরিত্র’। চরিত্র এমন এক ব্যাপক অর্থবোধক মানবিক গুণ যা প্রত্যেক মানব সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। চরিত্রের মর্মকথা হলো মানব সুলভ আচরণ। ভাল ও মন্দের সার্বজনীন একটা ধারণা মানাব সমাজে চিরকাল বিরাজ করছে। ঐ ধারণা অনুযায়ী যদি কেউ মানুষের সাথে ব্যবহার করে তাহলে সবাই তাকে চরিত্রবান বলে স্বীকার করে।
টাকা পয়সার লেনদেনের ব্যাপারে ওয়াদা রক্ষা করার যে একটি চারিত্রিক গুণ তা সবাই মানবে বাধ্য। যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে অন্যের সাথে ওয়াদা ভংগ না করে। এতেই প্রমাণিত হয় যে, চরিত্র ঐ সব আচরণেরই সামষ্টিক নাম যেসব আচরণ প্রত্যেক মানুষ অন্যের কাছ থেকে পেলে খুশী হয় এবং না পেলে ব্যথিত হয়।
একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টা আরো সহজে বুঝা যাবে। আজকাল একথা সবারই মুখে শুনা যায় যে, এদেশে ঘুষ না দিলে কোথাও কোন ন্যায্য অধিকারও পাওয়া যায় না। টাকা দিলে যে কোন অন্যায় দাবীও আদায় করা যায়। যে ঘুষ খায় সে যখন নিজের কাজের জন্য কোথাও ঘুষ দিতে বাধ্য হয় তখন তার মনেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাহলে বুঝা গেল যে, ঘুষ নেয়ার কাজটাকে সে-ও ভাল কাজ বলে বিশ্বাস করতে পারছে না। সুতরাং যে ঘুষ খায় সে অবশ্যই চরিত্রহীন।
আরও একটা উদাহরণ দিচ্ছি। গাড়ির লাইসেন্স ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ী চালাবার উপায় নেই। যে সরকারী অফিস থেকে লাইসেন্স নিতে হয় সেখানে দিনের পর দিন ঘুরাফিরা করেও লাইসেন্স না পাওয়া গেলে মনের অবস্থাটা কিরূপ হতে পারে ? আপনি ঘুষ দিচ্ছেন না বলেই এরকম ঘুরতে হচ্ছে। লাইসেন্স ইস্যু করার দায়িত্বশীলরা কর্তব্যে অবহেলা করার ফলে আপনার কত মূল্যবান সময় নষ্ট হলো ? এ দায়িত্বশীল ব্যক্তিই নিজের কোন কাজে অন্য কোন অপিসে এ রকম ভোগান্তির শিকার হলে তিনি কি খুশী হবেন ?
এসব উদাহরণ থেকেই দেশের অবস্থাটা আঁচ করা যায়। বাংলাদেশে এখন সবাই সবাইকে ঠকাবার চেষ্টায় কর্মতৎপর। তাই আমরা সবাই কেবল ঠকেই চলেছি। সবার বহু মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘুষ খেয়ে যে টাকা নিচ্ছে তা অন্যদেরকে ঘুষ দিতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে সবাই বিবেকের নিকট দোষী হ্ওয়া ছাড়া এবং অশান্তি কামাই করা ছাড়া আর কী পেলাম ?
কর্তব্যে অবহেলা, ইচ্ছাকৃত কাজ না করা সেবার পরিবর্তে শোষণ করা, মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিতকরা। অন্যায় স্বার্থ হাসিল না হলে দায়িত্ব পালন না করা ইত্যাদি অগণিত উপায়ে আমার চরিত্রহীনতার পরিচয় দিচ্ছি। ফলে আমাদের প্রতিভা,মেধা, বুদ্ধি ্ও যোগ্যতার নিজ হাতে বিনষ্ট করে দেশকে অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
তাই বস্তুগত সম্পদের অভাব,নৈতিকতার অভাব, মনুষ্যত্বের অভাব। এঅভাব দূর না হলে দুনিয়ার যত সম্পদই ভিক্ষা ্ও ঋণ হিসেবে আমরা পাচ্ছি তা দ্বারা আমাদের দারিদ্র কখনও দূর হবে না। যে পাত্রের তলা নেই দুনিয়ার সম্পদ দিয়েও তা পূর্ণ করা সম্ভব নয়। আমরা তাই তলাহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছি। চরিত্রের অভাব দূর করতে না পারলে আমাদের দশা আরও খারাপ হতে বাধ্য।
জাতিকে চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে হলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব চরিত্রবান লোকদের হাতে তুলে দিতে হবে। চরিত্রবাল লোক আকাশ থেকে নাযিল হবে না। বিদেশ থেকেও তা আমদানী করার জিনিস নয়। সাংগঠনিক পদ্ধতিতে চরিত্র গঠনের আন্দোলনের মাধ্যমে চরিত্রবান একদল লোক জনগণের নিকট তাদের কর্মতৎপরতার দ্বারা পরিচিত হলে জনগণ তাদের নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন করবে। গণ সমর্থন নিয়ে এমন একদল চরিত্রবান লোক দেশের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করতে পারলেই এদেশের উজ্জল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা পাওয়া যেতে পারে।
চরিত্রের কোন বিকল্প নেই। দুনিয়ার অন্য কোন দেশের অবস্থা চরিত্রের দিক দিয়ে এতটা দুর্বল কিনা আমার জানা নেই। চরিত্রের নিুতম মান ছাড়া কোন জাতিই উন্নতি করতে পারে না।
বাংলাদেশের অবস্থা এ দিক দিয়ে এত করুণ যে, এদেশের চরিত্রবান লোকের অতি সত্ত্বর সুসংগঠিত না হলে কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যে কি আছে আল্লাহই জানেন। (আমার দেশ বাংলাদেশ)