রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও দেশপ্রেম
জন্মভুমিরূপ আল্লাহর মহাদানের শুকরিয়াই হলো দেশপ্রেম
জন্মভূমি সত্যিই প্রিয়। মায়ের সাথে এর তুলনা চলে। তাই জন্মভুমিকে মাতৃভূমিও বলা হয়।
কিন্তু দুই কারনে আমি মাতৃভূমি বলি না। এক কারন হলো—এ উপমহাদেশে মাতৃভূমিকে দেবী মনে করে পূজা করা হয়। দ্বিতীয় কারন— জন্মভূমি কেবলমাত্র মাতৃভূমিই নয়, পিতৃভূমিও বটে। তাই জন্মভূমি বলাই বেশী সঠিক। তা ছাড়া কারো মায়ের জন্ম অন্য কোন দেশে হলে তাঁর নিজের জন্মের দেশটাকে মায়ের দেশ বলা সঠিক হয় না। মাতৃভাষা কথাটি অবশ্যই সঠিক। কারন শিশু পহেলা মায়ের কাছ থেকেই কথা শেখে এবং মায়ের সাথে বেশী সময় থাকার ফলে মায়ের মুখের ভাষা ও উচ্চারণই শেখে। এ ব্যাপারে পিতার অবদান কম বলেই পিতৃভাষা কখনো বলা হয়না। জন্মভুমিকে মায়ের সাথে তুলনা করার কারন কয়েকটিঃ
১। মায়ের প্রতি ভালোবাসা যেমন সহজাত তেমনি জন্মভুমির প্রতি ভালোবাসাও মানুষের প্রকৃতিগত। শৈশব থেকেই শিশু যেমন মাকেই সবচেয়ে বেশী কাছে পায় এবং মায়ের স্নেহ- মমতায় বড় হতে থাকে, তেমনি জন্মভুমির আলো –বাতাস, গাছ-পালা, পশু- পাখী, খাল-বিল-পুকুর, মাছ-তরকারী, মাঠের ফসল ইত্যাদির সাথে যে ঘনিষ্ঠ পরিচয়, তাতে জন্মভূমির সাথে দেহ মনের এক স্বাভাবিক ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিদেশে যারা যায়নি তারা এটা অনুভব করে না। মা মারা গেলে যেমনি তাঁর অভাবটা বুঝে আসে, তেমনি কিছুদিন বিদেশে থাকলে দেশের প্রতি ভালোবাসার সুতোর টান পড়ে।
বিলাতে ৭৩ সাল থেকে ৬ বছর থাকাকালে মনে হতো, সে দেশের আকাশ- বাতাস, চন্দ্র- সূর্য, গাছ- পালা সবই অপরিচিত। শীতকালে গরম ঘরে বসে কাঁচের জানালা দিয়ে বরফ পড়া দেখতে এতো চমৎকার লাগতো যে, অনেক্ষন চেয়ে থাকতে বাধ্য হতাম। সে দেশে শীতের মওসুমেই বৃষ্টি বেশী হয়। টিপটিপ বৃষ্টি না হয় বরফ পড়া চলতেই থাকে। আমার জন্মভূমির সকালের সুন্দর সূর্য সে দেশে কোথাও নেই। আমার দেশে শীতকালেও চিরসবুজ গাছ-পালার অভাব হয়না। সে দেশে গাছ ভর্তি পার্কে শীতকালে প্রথম যেয়ে আমার মনে হল যে গাছগুলো শুধু মরাই নয়, পুড়ে কালো হয়ে গেছে। এসব গাছে আবার পাতা গজাতে পারে বিশ্বাস করাই কঠিন।
২। ছোট বয়স থেকে যে ধরনের খাবার খেয়ে অভ্যাস হয়, সে খাবারের আকর্ষণ যে এতো তীব্র তা দীর্ঘ দিন বিদেশে না থাকলে টের পাওয়া যায়না। মাতৃভাষার মতই মায়ের হাতের খাবার মানুষের সত্তার অংশে পরিনত হয়। মাঝে মাঝে যারা অল্প দিনের জন্য বিদেশে যায়, তাঁদের নিকট ভিন্নধরনের খাবার বৈচিত্র্যের স্বাদ দান করে— একথা ঠিক। কিন্তু দীর্ঘদিন জন্মভূমির অভ্যস্ত খাবার না পেলে যে কেমন খারাপ লাগে এর কোন অভিজ্ঞতা যাদের হয়নি তারা এ সমস্যাটি বুঝবে না। পুষ্টিকর, মজাদার এবং দামী খাবার পেলে আবার দেশের খাবারের কথা মনে পড়বে কেন – এমন প্রশ্ন অনভিজ্ঞ লোকই করতে পারে।
আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা হল, বহু রকমের মজাদার খাবারের টেবিলে খাওয়ার সময় চিংড়ী এবং পুই শাকের চচ্চড়ি, কেসকী মাছের ভুনা, কৈ মাছ- পালং শাকের চচ্চড়ি, টাকি মাছ এবং কচি লাউয়ের সালুন, ভাজা পুঁটি মাছ ইত্যাদির কথা মনে উঠলে ওসব ভালো খাবারও মজা করে খেতে পারতাম না। খাবার পর মনে হতো যে খাবার কর্তব্য পালন করলাম বটে, তৃপ্তি পেলাম না।
৩। মাতৃভাষায় কথা বলার স্বাদটাও যে কতো তৃপ্তিদায়ক সে অভিজ্ঞতাও দেশে থাকাকালে টের পাইনি। বিলাতে বাংলায় কথা বলা লোকের অভাব ছিল না। আমেরিকায় এক ইসলামী সম্মেলন উপলক্ষে ৭৩ সালের আগস্টে যেতে হল। “মুসলিম স্টুডেন্ট এ্যাসোসিয়েশন ( M.S.A ) নর্থ আমেরিকা”- এর উদ্যোগে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দিনের সম্মেলনের পর নিউইয়র্ক থেকে লস এঞ্জেলস পর্যন্ত এম, এস, এ— এর যতো শাখা আছে সেখানে আমাকে এক সপ্তাহ সফর করাল। কোন দিন দুই জায়গায় কোন দিন তিন যায়গায় বক্তৃতা করতে হল। এ ৭ দিনের মধ্যে বাংলায় কথা বলার কোন সুযোগ পেলাম না। লন্ডন ফিরে এসে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে চাপলাম। কামরার এক কোনায় বসলাম। দূরে আরেক কোনায় এক লোককে এদেশী মনে হল। কাছে যেয়ে বসলাম। ভদ্রলোক বই পড়ছিলেন। লক্ষ্য করে দেখলাম বাংলা বই। নিশ্চিত হলাম যে বাংলায় কথা বলা যাবে। বার বার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলাম—যাতে কথা বলার সুযোগ পাই। দশ দিনের ভুখা। আমি যে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি তা টের পেয়ে মুখ তুলে চাইলেন আমার দিকে। আলাপ শুরু করলাম। তিনি কোন স্টেশনে নামবেন, আমি কোথা থেকে এলাম, কার বাড়ি কোথায়, লন্ডনে কে কোন যায়গায় থাকি ইত্যাদি আলাপ চললো। মনে হল ফাঁপা পেট যেন হালকা হচ্ছে। ভদ্রলোকের বাড়ি কোলকাতা এবং তিনি হিন্দু। খুব আন্তরিকতার সাথে বাংলাদেশ নিয়েও কিছু কোথা হল।
বাংলাদেশের আবহাওয়া, খাবার জিনিস এবং মাতৃভাষা নিয়ে এসব ঘটনা একথার প্রমান হিসেবেই পেশ করলাম যে, জন্মভূমির ভালোবাসা সত্যিই সহজাত। এ ভালোবাসা রচনার জন্য কোন কৃত্রিম কর্মসূচী রচনার দরকার হয় না। অবচেতনভাবেই এ ভালোবাসা জন্মে।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, রাজনৈতিক ভাষায় যাকে “দেশপ্রেম” বলে তাও কি সহজাত ব্যাপার ? আমার হিসেবে দেশপ্রেমও নিঃসন্দেহে সহজাত। আমার জন্মভুমিতেই রাজনীতি চর্চা করা আমার জন্য স্বাভাবিক। অন্য দেশে আমার রাজনীতি করার সুযোগ কোথায় ? বিলাতে বাংলাদেশীরা যেটুকু রাজনীতি করে তা তাঁদের জন্মভূমিকে কেন্দ্র করেই। তাই এদেশের প্রধান সব কয়টি দলের শাখাই সেখানে রয়েছে।
মানুষ প্রধানত নৈতিক জীব। কিন্তু মানুষ রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবও। আমার রাজনীতি চর্চা নিয়ে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে লন্ডনে আমার আলোচনা হয়। আমার রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনাকালে তিনি সেখানে ইংরেজীর অধ্যাপক ছিলেন। ডক্টরেট করতে এসে এখানে সেটেল্ড করে গেছেন। নিজের বাড়িতেই থাকেন। এটা ১৯৭৬ সালের কথা। সাড়ে চার বছর পরিবার থেকে বিছিন্ন জীবন যাপন করার পর ৭৬ –এর মে মাসে আমার স্ত্রী, ছোট ছেলে দুটোকে নিয়ে লন্ডনে পৌঁছেছে। বড় চার ছেলে আমার ছোট ভাইয়ের কাছে ম্যানচেস্টারে আশ্রয় নিয়েছে।
ঐ বন্ধুটি আমাকে পরামর্শ দিলেন যে, স্ত্রী- পুত্র সবাই যখন চলে আসতে পেরেছে, তখন এখানে স্থায়ীভাবে বাস করার পরিকল্পনাই করুন। ওরা আপনার নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। আপনি সহজেই ‘এসাইলাম’ পেয়ে যাবেন। আমি বলাম, আমি তো আমার জন্মভুমি থেকে হিজরত করে আসিনি। দেশে পৌঁছুতে পারলাম না বলে সুযোগের অপেক্ষায় বাধ্য হয়ে বিদেশে পড়ে আছি। তিনি বললেন, যারা বাংলাদেশ বানালো তাঁদের মধ্যে আমার জানা বেশ কিছু লোক দেশের অরাজকতা, আশান্তি এবং নিরাপত্তাহীনতার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। আপনি উল্টা চিন্তা কেন করছেন, বুঝলাম না।
আমি বললাম, এরই নাম দেশপ্রেম। আমার আল্লাহ আমাকে যে দেশে পয়দা করলেন আমি সে দেশের মায়া ত্যাগ করতে পারি না। আমাকে ঐ দেশে পয়দা করে আল্লাহ ভুল করেছেন বলে আমি মনে করি না। আমি আর কোন দেশকে জন্মভূমির চেয়ে বেশে ভালবাসবো কিভাবে ?
তিনি বললেন, আমি দেশপ্রেমের কথা বলছি না। আপনার এবং আপনার পরবারের কল্যাণের চিন্তা করেই এ পরামর্শ আমি আপনাকে দিয়েছি। আমি বললাম, আমি তো কল্যাণ মনে করতে পারছি না। আমার ছেলেরা ব্রিটিশ পাসপোর্ট পেয়ে গেলেও এদেশকে জন্মভূমি বানাতে পারবে না। আমি তাঁদেরকে জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই না। আমার পক্ষে যদি দেশে যাবার সুযোগ না হয়, তবু ছেলেদেরকে তাঁদের জন্মভূমিতেই পাঠাতে চাই।
বিলাতেও স্থানীয় এবং অস্থানীয় বিতর্কে কিছু কিছু সংঘর্ষও হচ্ছে। ইংরেজ জাতীওতাবাদীরা এদেশের লোক বলে আমার ছেলেদেরকে স্বীকার করবে না। শুধু পাসপোর্ট সে মর্যাদা দিতে সক্ষম নয়। জন্মভূমি আল্লাহর দান। এ মহাদানের শুকরিয়াই হল দেশপ্রেম।
৭ বছর বাধ্য হয়ে বিদেশে থাকার পর ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসের ১১ তারিখ আমার প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরে আসার পর যে কেমন আনন্দ লেগেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। গ্রহহীন লোক বাড়ি পেলে যেমন খুশী হয়, তাঁর চাইতেও বেশী আনন্দিত হয়েছি। হারানো মহামূল্যবান সম্পদ ফিরে পাবার আনন্দ যে কেমন, তা শুধু তাঁর পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব— যার জীবনে বাস্তবে এমনটা ঘটে। মনে হয়েছে যে, আমি যেন আমার প্রকৃতিকে ফিরে পেলাম। মাছ শুকনায় পড়ে আবার পানিতে ফিরে গেলে সম্ভবত এমনি প্রশান্তি বোধ করে।
বিদেশে আটকা পড়ে থাকা কালে প্রতি বছরই হজ্জের মৌসুমে মক্কা শরীফে যাওয়ার সৌভাগ্য হতো। বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলগণের সাথে ঘনিস্ট যোগাযোগ এবং বাংলাদেশী জনগনের সাথে ভাবের আদান- প্রদানের জন্য এটাই একমাত্র পথ ছিল।
দোয়া কবুল হওয়ার স্থানসমূহে বিশেষ করে আরাফাতের ময়দানে দয়াময়ের দরবারে কাতরভাবে দোয়া করার সময়ে আমি ধরনা দিয়ে বলতাম “হে আমার খালিক এবং মালিক তুমি আমার জন্য যে দেশটিকে জন্মভূমি হিসেবে বাছাই করেছো, সে দেশে পৌঁছার পথে যতো বাঁধা আছে টা মেহেরবানী করে দূর করে দাও।” আমার এ দোয়া যে কবুল হয়েছে তা দেশে ফিরে আসার পড়ে বুঝতে পারলাম।
বিদেশে থাকা কালে বহু ইসলামী বিশ্ব সম্মেলনে মেহমান হবার সুযোগ হওয়ায় বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাথে ঘনিস্ট যোগাযোগের বিরল সৌভাগ্য হল। আমার দেশে চলে আসার পর গত এক বছরে বহু ইসলামী সম্মেলনে দাওয়াত পেয়েও বাংলাদেশী পাসপোর্টের অভাবে যেতে অক্ষম বলে জানাতে বাধ্য হয়েছি। আমার নাগরিকত্ব নিয়ে যে অহেতুক সমস্যা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে, সে কথা জানার পর কয়েকটি সম্মেলনে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আমার কাছে দাবী জানিয়েছে। এ সযোগে ইসলামী আন্দোলনের কয়েকজন নেতা ঐ সব সম্মেলনে মেহমান হিসেবে গিয়েছেন।
বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে কোন কারনে আসলে আমার সাথে দেখা করে পহেলাই প্রশ্ন করেন যে, আপনাকে আমাদের দেশে আর দেখতে পাইনা কেন ? জবাবে বলি, “বিদেশে থাকাকালে গিয়েছি। কিন্তু এখন সুযোগ পাচ্ছি না। ৭ বছর আমাকে দেশে আসতে দেয়নি। এখন আর যেতে দেয় না।” নাগরিকত্বের সমস্যার কথা জেনে এবং আমার ঐ জবাব শুনে তারা খুব হাসেন। আমি তাঁদেরকে বলি যে, দোয়া করুন, যাতে বাইরে যাবার বাঁধা দূর হয়ে যায়। তারা জানতে চান যে, আমার বিদেশে যাবার আগ্রহ আছে কি- না ? আমি হেসে বলি, “আল্লাহ পাক আমার জন্মভূমিতে তাঁর দ্বীনের কাজ করার যে সযোগ দিয়েছেন, এতেই আমি তুষ্ট। বিদেশে যাবার সুযোগ পাচ্ছি না বলে আমার সামান্যতমও আফসোস নেই। তাছাড়া বিদেশে থাকা কালে দেশে আসবার ব্যবস্থা করবার জন্যই দোয়া করেছি। মাঝে মাঝে আবার বিদেশে যাবার সুযোগ দেবার জন্য দোয়া করতে ভুলে গিয়েছিলাম।” এসব কথা শুনে সবাই বেশ কৌতুক বোধ করেন।
( দৈনিক সংগ্রাম, মার্চ- ১৯৯৩ )
যারা বাংলাদেশ আন্দোলনে শরীক হয়নি তারা কি স্বাধীনতা বিরোধী ছিল ?
১৯৭০- এর নির্বাচনের দীর্ঘ অভিযানে শেখ মুজিব প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় জনগণকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, “আমরা ইসলাম বিরোধী নই।” এবং “আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাইনা।” জনগন তাকে ভোট দিয়েছিলেন তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কোন ম্যান্ডেট তিনি নেননি। নির্বাচনের পরও এ জাতীয় সুস্পষ্ট কোন ঘোষণা তিনি দেননি।
তাই ১৯৭১- এ বাংলাদেশ আন্দোলনে যারা শরীক হয়নি, তারা দেশের স্বাধীনতা বিরোধী ছিল না। ভারতের অধীন হবার ভয় এবং ধরমনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের খপ্পরে পড়ার আশংকাই তাঁদেরকে ঐ আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করেছিলো। তারা তখনো অখন্ড পাকিস্তানের নাগরিকই ছিল। তারা রাষ্ট্র বিরোধী কোন কাজে লিপ্ত ছিল না বা কোণ বিদেশী রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করেনি। নিজ দেশের কল্যাণ চিন্তাই তাঁদেরকে এ ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিল। ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই কাজ করেছে। তাই আইনগতভাবে তাঁদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
নৈতিক বিচারে ব্যক্তিগতভাবে যারা নরহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ এবং অন্যান্য অন্যায় করেছে, তারা অবশ্যই নরপশু। যাদের চরিত্র এ জাতের, তারা আজও ঐসব করে বেড়াচ্ছে। পাক সেনাবাহিনীর যারা এ জাতীয় কুকর্মে লিপ্ত হয়েছিলো তাঁরাও ঐ নরপশুদেরই অন্তর্ভুক্ত। যাদের কোন ধর্মবোধ, নৈতিক চেতনা এবং চরিত্র বলে নেই, তারা এক পৃথক শ্রেনী। পাঞ্জাবী হোক আর বাঙ্গালী হোক, এ জাতীয় লোকের আচরন একই হয়।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
রাজনৈতিক মতপার্থক্য আর স্বাধীনতা বিরোধী হওয়া এক কথা নয়
অবিভক্ত ভারত থেকে ইংরেজ বিতাড়নের আন্দোলনে কংগ্রেসের সাথে মুসলিম লীগের মতবিরোধকে কতক নেতা স্বাধীনতার বিরোধী বলে প্রচার করতো। কংগ্রেস হিন্দু- মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবী করতো এবং গোটা ভারতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু মুসলিম লীগ জানতো যে, কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলে ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তি পেলেও মুসলমানদেরকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধীনেই থাকতে হবে। তাই ঐ স্বাধীনতা দ্বারা মুসলমানদের মুক্তি আসবে না। তাই মুসলিম লীগ পৃথকভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন চালানো এবং ভারত বিভাগ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পাকিস্তান দাবী করলো। ফলে মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলন একই সংগে ইংরেজ এবং কংগ্রেসের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলো।
কংগ্রেস নেতারা তারস্বরে মুসলিম লীগ নেতাদেরকেই ইংরেজের দালাল ও দেশের স্বাধীনতার দুশমন বলে গালি দিতে লাগলো। কংগ্রেসের পরিকল্পিত স্বাধীনতাকে স্বীকার না করায় মুসলিম লীগকে স্বাধীনতার বিরোধী বলাটা রাজনৈতিক গালী হতে পারে, কিন্তু বাস্তব সত্য হতে পারে না।
ঠিক তেমনি যে পরিস্থিতিতে ভারতের আশ্রয়ে বাংলাদেশ আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিলো, সে পরিবেশে যারা ঐ আন্দোলনকে সত্যিকার স্বাধীনতা আন্দোলন বলে বিশ্বাস করতে পারেনি। তাঁদেরকে স্বাধীনতার দুশমন বলে গালি দেয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যতই প্রয়োজনীয় মনে করা হোক, বাস্তব সত্যের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
বিশেষ করে স্বাধীনতার নামে প্রদত্ত শ্লোগানগুলোর ধরন দেখে ইসলামপন্থীরা ধারনা করতে বাধ্য হয় যে, যারা স্বাধীন বাংলাদেশ বানাতে চায়, তারা এদেশে ইসলামকে টিকতে দেবে না, এমনকি মুসলিম জাতীয়তাবোধ নিয়েও বাঁচতে দেবে না। সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ( মুসলিম জাতীয়তার বিকল্প ) এমন তুফান প্রবাহিত হল যে, মুসলিম চেতনাবোধসম্মন্ন সবাই আতংকিত হতে বাধ্য হল। এমতাবস্থায় যারা ঐ স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারলো না, তাঁদেরকে দেশের দুশমন মনে করা একমাত্র রাজনৈতিক হিংসারই পরিচায়ক। ঐ স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলে ভারতের অধীন হবার আশংকা যারা করেছিলো, তাঁদেরকে দেশপ্রেমিক মনে না করা অত্যন্ত অযৌক্তিক।
এ বিষয়ে প্রখ্যাত সাহিত্তিক, চিন্তাবিদ এবং সাংবাদিক মরহুম আবুল মানসুর আহমাদ দৈনিক ইত্তেফাক ও অন্যান্য পত্র- পত্রিকায় বলিষ্ঠ যুক্তিপূর্ণ এতো কিছু লিখে গেছেন যে, যা অন্য কেউ লিখলে হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহী বলে শাস্তি পেতে হতো। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারনে পরাজিত পক্ষকে বিজয়ী পক্ষ দেশদ্রোহী হিসেবে চিত্রিত করার চিরাচরিত প্রথা সাময়িকভাবে গুরুত্ব পেলেও স্থায়ীভাবে এধরনের অপবাদ টিকে থাকতে পারে না।
আজ একথা কে অস্বীকার করতে পারে যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবীদার কিছু নেতা এবং দলকে দেশের জনগন বর্তমানে ভারতের দালাল বলে সন্দেহ করলেও বাংলাদেশ আন্দোলনে যারা অংশগ্রহন করেনি, সে সব দল এবং নেতাদের সম্পর্কে বর্তমানে এমন সন্দেহ কেউ প্রকাশ করে না যে, এরা অন্য কোন দেশের সহায়তায় এদেশের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দিতে চায়।
তারা গোটা পাকিস্তানকে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে রক্ষা করা উচিৎ বলে মনে করেছিলো। তাঁদের সে ইচ্ছা পূরণ হয় নি। বাংলাদেশ পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনত হয়ে যাবার পর তারা নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চলে যায় নি। যদি বর্তমান পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে ভৌগলিক দিক দিয়ে ঘনিষ্ঠ হতো, তাহলেও না হয় সন্দেহ করার সম্ভাবনা ছিল যে, তারা হয়তো আবার বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার ষড়যন্ত্র করতে পারে। তাহলে তাঁদের ব্যাপারে আর কোন প্রকার সন্দেহের কারন থাকতে পারে ? বাংলাদেশকে স্বাধীন রাখা এবং এ দেশকে রক্ষা করার লড়াই করার গরজ তাঁদেরই বেশী থাকার কথা। বাংলাদেশের নিরাপত্তার আশংকা একমাত্র ভারতের পক্ষ থেকেই হতে পারে। তাই যারা ভারতকে অকৃত্রিম বন্ধু মনে করে, তারাই হয়তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। কিন্তু যারা ভারতের প্রতি অবিশ্বাসের দরুন ৭১ সালে বাংলাদেশকে ভারতের সহায়তায় পৃথক রাষ্ট্র বানাবার পক্ষে ছিল না, তারাই ভারতের বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন দেবে। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী হওয়ার মানসিক, আদর্শিক এবং ঈমানী প্রেরনা তাঁদেরই, যারা এদেশকে একটি মুসলিম প্রধান দেশ এবং ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়।
পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীদের সাথে ভাষার ভিত্তিতে যারা বাঙ্গালী জাতিত্বের ঐক্যে বিশ্বাসী, তাঁদের দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা টিকে থাকার আশা কতোটুকু করা যায় জানি না। কিন্তু একমাত্র মুসলিম জাতীয়তাবোধই যে বাংলাদেশের পৃথক সত্ত্বাকে রক্ষা করতে পারে এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং মুসলিম জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিতদের হাতেই বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্ত্বা সবচেয়ে বেশী নিরাপদ।
শেরে বাংলার উদাহরণ
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবই পাকিস্তান আন্দোলনে মূল ভিত্তি ছিল। শেরে বাংলা এ, কে ফযলুল হক সে ঐতিহাসিক দলিলের প্রস্তাবক ছিলেন। অথচ মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সাথে এক ব্যাপারে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ বিরোধী শিবিরের সাথে হাত মেলান এবং পাকিস্তান ইস্যুতে ১৯৪৬ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করেন। পাকিস্তান হয়ে যাবার পর তিনি কোলকাতায় নিজের বাড়িতে সসম্মানে থাকতে পারতেন। তিনি ইচ্ছা করলে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের মতো ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হতে পারতেন। কিন্তু যখন পাকিস্তান হয়েই গেলো, তখন তাঁর মতো নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক কিছুতেই নিজের জন্মভূমিতে না এসে পারেননি। পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত থাকা সত্ত্বেও এদেশের জনগন শেরে বাংলাকে পাকিস্তানের বিরোধী মনে করেনি। তাই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তাঁরই নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের উপরে এতো বড় বিরাট বিজয় অর্জন করে। অবশ্য রাজনৈতিক প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকার তাকে “রাষ্ট্রদ্রোহী” বলে গালি দিয়ে তাঁর প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে দেয়। আবার কেন্দ্রীয় সরকারই তাকে গোটা পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বানায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরও নিযুক্ত করে। এভাবেই তাঁর মতো দেশপ্রেমিককেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রদ্রোহী বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।
শহীদ সহ্রাওয়ারদীর উদাহরণ
জনাব সহ্রাওয়ারদী পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে যখন পূর্ব বঙ্গ এবং পশ্চিম বঙ্গ বিভক্ত হয়, তখন গোটা বঙ্গদেশ এবং আসামকে মিলিয়ে “গ্রেটার বেঙ্গল” গঠন করার উদ্দেশ্যে তিনি শরত বসুর সাথে মিলিত চেষ্টা করেন। তাঁর প্রচেষ্টা সফল হলে পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতো না। তিনি পশ্চিম বঙ্গের লোক। পশ্চিম বঙ্গের বিপুল সংখ্যক মুসলমানের স্বার্থ রক্ষা এবং কোলকাতা মহানগরীকে এককভাবে হিন্দুদের হাতে তুলে না দিয়ে বাংলা ও আসামের মুসলমানদের প্রাধান্য রক্ষাই হয়তো তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু পড়ে যখন তিনি পূর্ব বঙ্গে আসেন, তখন তাকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে পাকিস্তানের দুশমন বলে ঘোষণা করা হয় এবং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোলকাতা ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। অবশ্য তিনিই পরে পাকিস্তানের উযিরে আযম হবারও সুযোগ লাভ করেন। বলিষ্ঠ ও যোগ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করার প্রয়োজনে দুর্বল নেতারা এ ধরনের রাজনৈতিক গালির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের গালি দ্বারা কোন দেশপ্রেমিক জননেতার জনপ্রিয়তা খতম করা সম্ভব হয় নি।
তাই ৭১ এর ভুমিকাকে কেন্দ্র করে যেসব নেতা এবং দলকে “স্বাধীনতার দুশমন” ও “বাংলাদেশের শত্রু” বলে গালি দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যতই বিষোদ্গার করা হোক, তাঁদের দেশপ্রেম, আন্তরিকতা এবং জনপ্রিয়তা ম্লান করা সম্ভব হবে না।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )