বাংলাদেশের জাতীয়তা
বাংলাদেশের জাতীয়ত
বাংলাদেশের কোন সচেতন দেশপ্রেমিকই জাতীয় আযাদী ও নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। দুনিয়ার মানচিত্রে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যা প্রায় চারপাশ থেকেই একটি মাত্র দেশ দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। একমাত্র দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের অপর পারে বার্মা রয়েছে। এছাড়া গোটা বাংলাদেশ ভারত দ্বারাই বেষ্টিত। এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জও ভারতের অংশ। সুন্দরবনের দক্ষিণে নতুন গজিয়ে উছা দ্বীপটি ভারত বিনা বাধায় দখল করার পর ঐ বেষ্টনী আরও মজবুত হলো।
একথা সত্য যে অগণিত উস্কানী সত্ত্বেও বাংলাদেশ বাংলাদেশ ভারতের সাথে ভাল সম্পর্ক রক্ষা করে চলার চেষ্টা করছে। প্রতিবেশীর সাথে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে রাখা কোন দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। বাংলাদেশী জনগণ একমাত্র আযাদীর উদ্দেশ্যেই ঐ সংগ্রাম করেছিল। তাই কোন অবস্থাতেই তারা আযাদী বিপন্ন হতে দিতে পারে না। ভঅরতের কুক্ষিগত হবার উদ্দেশ্যে তারা আন্দোলন করেনি।
জাতীয় নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক রয়েছে। ভৌগলিক নিরাপত্তাই প্রধানতঃ সবার নিকট প্রাথমিক গুরুত্ব পায়। কারণ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে কোন রাষ্ট্র যদি ভৌগলিক দিক থেকৈই অন্য রাষ্ট্রের দখলে চলে যায় তাহেল সার্ব গ্রাসী দাসত্বের পথই সুগম হয়। কিন্তু ইতিহস থেকে সারা দুনিয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক দাসত্বের পনিণামেই ভৌগলিক দাসত্ব আসে। কোন জাতি আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আযাদরি হিফযতে সক্ষম হরে ভৌগলিক ও রাজনৈতিক দাসত্ব সহজে আসতে পারে না। আবার অর্থনৈতিক আযাদী ছাড়া রাজনৈতিক আযাদী ভোগ করাও সম্ভব নয়। কোন সময় রাজনৈতিক ভুলের কারণে বা শক্তিমান কোন বিদেশী বাহিনীর আক্রমণে একটি দেশ তার ভৌগরিক ও রানৈতিক আযাদী হারালেও আদর্শিক চেতনা এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীন সত্তার হেফাযতের ফলে ঐ আযাদী ফিরে পাওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু যুদ কোন স্বাধীন দেশ অন্য কোন দেশের আদর্শ ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয় তাহলে এর পরিণামে ভৌগলিক ও রাজনৈতিক আযাদী থেকে চিরতরে বঞ্চিত হতে সে বাধ্য। তাই মজবুত সশস্ত্র বাহিনীই দেশের একমাত্র রক্ষাকবচ নয়। [আমার দেশ বাংলাদেশ]
বাংগালী মুসলমান বনাম বাংগালী জাতি
বাংলাভাষী মানুষ অবাঙ্গালীদের নিকট বাঙ্গালী নামেই পরিচিত। পশ্চিম বঙ্গের কোন লোক স্থায়ীভাবে দিল্লীতে অবস্থান করলেও তার ভাষাগত পরিচয়ের কারণেই তাকে বাঙ্গালী বলা হয়। যদিও সে ব্যক্তি দিল্লীর উর্দু বা হিন্দীভাষীর মতোই জাতিতে ভারতীয়। লন্ডনে বাংলাদেশী ও পশ্চমবঙ্গের লোকেরা বাংলাভাষীর মতোই জাতিতে ভারতীয়। লন্ডনে বাংলাদেশী ও পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা বাংলাভাষী হিসেবে ভরতীয় ও পাকিস্তানীদের নিকট বাঙ্গালী বরেই লোকেরা বংলাভাষী হিসেবে ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের নিকট বাঙ্গালী বলেই পরিচিত। বুঝা গেল যে, সব বাংলাভাষীই এক জাতিতে পরিণত হয়নি।
পাঞ্জাবী ভাষাভাষী ভরতীয় শিখ ও পাকিন্তানী পাঞ্জাবী মুসলমানের ভাষা এক হওয়া সত্ত্বেও শিখ ও মুসলমান এক জাতীয়তায় বিশ্বাসী নয়। কারন শুধু ভাষার কারণে কোন জাতি গড়ে উঠে না। জাতিত্বের আসল ভিত্তি যাদের যাদের মধ্যে উপন্থিত রয়েছে তাদের ভাষও যদি এক হয় তাহলে জাতীয়তাবোধ অধিকতর মুজবুত হতে পারে। কিন্তু ধর্ম, কৃষ্টি ও ইতিহাসের ঐক্যই প্রকৃত জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করে। এসব দিক দিয়ে যদি কোন এক জনগোষ্ঠী অপর জনগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন হয় তাহলে শুধু ভাষার ঐক্য তাদেরকে কখনো এক জাতিতে পরিণত করতে পারে না। এ কারণেই পাঞ্জাবী মুসলমান ও বাঙ্গালী হিন্দু এক জাতিতে পরিনত হতে পারেনি। তাদের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। এ পার্থক্যের কারনেই তাদের কৃষ্টি ও জীবন ধারণ এত অমিল দেখা যায়। ইতিহাসও তাদের এক নয়। বখতিয়ার খলজির বিজয় ও রাজা লক্ষণ সেনের পরাজয় বাঙ্গলী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমানের মধ্যে একই ধরনের আবেগ সৃষ্টি করে না। শাহ জালালের সাতে রাজা গৌর গোভিন্দের সংঘষং উভয়ের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরিত ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একই ভৌগলিক অঞ্চলে বাসবাস করা সত্বেও বাঙ্গালী মুসলমান ও বা্গংালী হিন্দু কেন এক জাতি নয় এবং বাঙ্গালী হওয়ার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে কেন জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়নি সে কথঅ ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি দ্বারা বিচার বিবেচনা করা প্রয়োজন।
মুসলমানের পরিচয়ঃ দুনিয়ার প্রতিটি সৃষ্টির যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য যে মহান স্রষ্টা প্রত্যেক সৃষ্টির উপযোগী বিধানের ব্যবস্থা করেছেন, তিনি অবশ্যই তার শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্যও জীবন বিধান দিয়েছেন। সৃষ্টির জন্য স্রষ্টর রচিত বিধি-বিধানের নামই ইসলাম এবং ইসলামী জীবন বিধান পালনকারীকেই মুসলিম বলে। মুসলিম শব্দটি আররী। ফরাসী ভাষায় বলা হয় মুসলমান। মুসলমান ঐ ব্যক্তির নাম যে সচেতনভাবে আল্লাহ পাককে জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র মনিব হিসেবে এবং রাসূল (সাঃ) কে একমাত্র আদর্শ নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। যে কালেমা তাইয়েবা কবুল করে মুসলমান হতে হয় এ কালেমার মাধ্যমে আসল আল্লাহর প্রভুত্ব ও রাসূলের নেতৃত্ব নিরষ্কুশভাবে মেনে নেয়া হয। এটাই কালেমার মর্মকথা।
একজন অমুসরিম যেমন ঐ কালেমার মাধ্যমে ইসলামী জীবন পদ্ধতি কবূল করে মসলমান হয় তেমনি কোন মুসলমান যদি ঐ কালেমা পরিত্যাগ করে তাহরে সে আর মুসলমান বলে গণ্য হতে পারে না। কাফেরের সন্তান ইসলাম গ্রহন করলে যদি মুসলমান হয় তাহলে মুসলমানের সন্তান ইসলাম ত্যাগ করলে কেন কাফের হবে না? সুতারাং মুসলমানিত্ব গ্রহন ও বর্জনযোগ্য একটা গুন। কলেজের প্রিন্সিপালের ছেলে বলেই কোন অশিক্ষত ব্যক্তি যেমন গদিনশীল প্রিন্সিপাল হতে পারেনা। তেমন ইসলামী আদর্শ ত্যাগ করে মুসলিম পিতামাতার সন্তানও গদিনশীল মুসলমান বলে গণ্য হতে পারে না।
মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিঃ যারা ইসলামী জীবন বিধানকে কবূর করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস, সব বিষয়ে তাদের চিন্তাধারাম তাদের জীবন ও কর্মধারা এক বিশেষ ধরনের ছাঁচে গড়ে উঠে। যারা ইসলামকে জীবন বিধান হিসেবে গ্রহন করে না বা ইসলামী জীবনধারা পালন করতে রাজী নয় তাদের বাস্তব জীবন স্বাভাবিক কারণেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ছাঁচে গড়ে উঠে।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাতৃভাষা ছিল আরবী। যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনল না তারা একই ভাষাভাষী, এমন কি একই বংশের লোক হওয়া সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের জীবন যাপনেই অভ্যস্ত হয়ে রইল। আর যারা ইসলাম গ্রহন করলো তারা তাদের বংশ ও আতœীয়-স্বজনের জীবনধারা থেকে আলাদা হয়ে গেলো। একই এলাকায় একই ভাষাভাষী এসন কি একই গোত্রের লোকদের মধ্যে আদর্শ, নীতি ও জীবন বিধানের পার্থর্ক্যের দরুন আরবী ভাষী মুসলমান ও আরবী ভাষী অমসুলমান পৃথক পৃথক জাতিতে পরিণত হলো। আবার অন্য ভাষার লোকও জাতি হয়ে গেল। সুতারাং মুসলমানদের জাতীয়তার ভিত্তি হলো একমাত্র ইসলাম। ভাষা, বংশ বর্ণ ও দেশ মুসলমানদের জাতীয়তার ভিত্তি নয়।
১৯৬৮ সাথে একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান ২১ শে ফেব্র“য়ারী উপলক্ষে তাদের নিমন্ত্রণ পত্রে উল্লেখ করেছিল যে, “প্রয়োজন হলে আমরা মুসলমানিত্ব ত্যাগ করতে পারি কিন্তু বাঙ্গালীত্ব পরিত্যাগ করা সম্ভব নয।” এ কথাটা যে মনোভাব নিয়ে বলা হয়েছে তাতে বুঝা যায় যে বেচারাদের ইসলাম সম্বদ্ধে সঠিক ধরণা নেই। কিèতু যে উদ্দেশ্যেই কথাটা বলা হোক কথাটা বাস্তবে সত্য। অর্থাৎ যারা জন্মগতভাবে বাঙ্গালী তারা বাঙ্গালীতু পরিত্যাগ করতে বাস্তবেই অক্ষম। বাঙ্গালী মায়ের সন্তান যদি এদেশ ছেড়ে বিলাতে চলে যায় এবং বাংলাভাষায় কথাই না বলে তবুও তার বাংগালিত্ব মুছে যাবে না এবং মাতৃভাষা বদলে যাবে না। সবসময় ইংরেজী বলার অভ্যাস করলেও ইংরেজী তার মাতৃভাষা বলে গন্য হবে না। অবশ্য মুসলমানিত্ব এমন এক গুণ বা পরিচয় যা ইচ্ছে হলে গ্রহন করা যায় এবং ইচ্ছে হলে ত্যাগ করা যায়। তাই তাদের ঐ বক্তব্য ঠিকই। কিন্তু এ দ্বারা যে অর্থ তারা বুঝতে চায় তা সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের। তারা বলতে চায় যে, বঙ্গালীত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে দরকার হলে মুসলমানিত্ব ত্যাগ করবো। এ জাতীয় মন-মগজ যেসব মুসলিম যুবকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তাদেরকে আমি মোটেই দোষী সাব্যস্ত করি না। তারা অজ্ঞতার শিকার। তাদের চিন্তাধারা মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলবার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা নেই বেল তারা অজ্ঞ রয়ে গেছে।
মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সাথে ভারতকে বিভক্ত করে যারা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তারা যদি ইসলামের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে মুসলিম যুবকদের মধ্যে এ জাতীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিই হতো না।
মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতকে বিভব্ত করে যারা পাকিন্তান নামক রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিনে তারা যদি ইসলামের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে মুসলিম যুবকদের মধ্যে এ জাতীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিই হতো না।
মুসলমানরা যদি ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তায় বিশ্বাস করতো তাহলে হিন্দুরা ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশকে বিভক্ত করতো না। মুসলমানরা যদি দেশ ভিত্তিক জাতীয়তায় বিশ্বাসী হতো তাহলে গান্ধি ও নেহেরুর অখন্ড ভারতীয় জাতীয়তাক্ েসিমর্থন করতো। তাহলে পাকিস্তানের জন্মই হতো না এবং বাংলাদেশ নামে কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টিই হতে পারতো না।
যারা বাঙ্গালী জাতীয়তার কথা বলে তারা একথাটা কি চিন্তা করে দেখেছেন? মুসলমানরা যদি আলাদা জাতি হিসেবে সংগঠিত না হতো তাহলে “বংগদেশ” বিভক্ত হতো না। বর্তমানে বাংলাদেশ তখন অখন্ড ভারত রাষ্ট্রের অধীনে পশ্চিম বংগের সাথে মিলে একটি অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশে পরিণত হতো। এ অবস্থা হলে বাংগালী জাতীয়তার প্রবক্তাদের কী দশা হতো? স্বাধীন বাংগালী জাতির দাবী করার কি কোন পথ তখন তালাশ করা সম্ভব হতো?
বাংলাদেশ যে মুসলিম জাতীয়তারই সৃষ্টি একথা ঐতিহাসিক সত্য। মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত না হলে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে কোন রাষ্ট্র কোন প্রকারেই অস্তিত্ব লাভ করতে পারতো না। তাই মুসরিম জাতীয়তাবোধ খতম হয়ে গেলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আর মুসলিম জাতীয়তাকে স্বীকার করে নেবার পর আবার বাংগালী জাতীয়তা কী করে বহাল থাকতে পারে? সুতরাং বাংগালী মুসলমান জাতি হিসেবে মুসলিম জাতি, যদিও বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে তারা বাংগালী কিন্তু মুসলমানরা বাংগালী জাতি নয়। [আমার দেশ বাংলাদেশ]
বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক
বাংলাদেশে বর্তমানে (১৯৮৮) প্রায় ১১ কোটি মানুষ আছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ কোটি মুসলমান এবং অন্ততঃ এক কোটি অমুসলমান। সংখ্যায় মুসলমানদের তুলনায় কম বরেই তাদেরকে সংখ্যালঘু বলা হয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী হলো হিন্দু। তাদের সংখ্যা ৭৫-৮০ লাখ হতে পারে। বাকী ২০ লাখের মদ্যে খৃস্টান, বৌদ্ধও বিভিন্ন উপজাতি রয়েছে।
এখানকার মুসলমানদের সাথে খৃষ্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয় সম্প্রদায় সমূহের সম্পর্ক কোন সময়ই খারাপ ছিল না। অনুন্নত হিন্দুদের সাথেও সম্পর্ক ভালই ছিল। ১৯৪০ খেবে ১৯৪৯ সাল পযর্ন্ত সে সম্পর্কে যে ভাটা পড়েছিল তা রাজনৈতিক পরিস্থিতিরই পরিণাম। গান্ধি ও নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস অখন্ড ভারতের পতাকাবাহী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই পাকিন্তান আন্দোলন ও ভারত বিভাগের দাবীর ঘোর বিরোধী ছিল। সে সময় ভারত বিভাগের ইস্যুতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে রাজনৈতিক লড়াই চলছিল তার কারণে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক অবশ্যই ফাটল ধরেছিল। ঐ অবস্থায়ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের তুলনায় উচ্চ বর্নের হিন্দুদের সাথেই সম্পর্ক বেশী খারাপ ছিল। কারণ কংগ্রেসের নেতৃত্বে সর্বস্তরেই উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাই অধিষ্ঠিত ছিল।
১৯৪৬ সালে কোলকাতা ও বিহারে ব্যাপক মুসলিম হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ১৯৪৯ সাল পযর্ন্ত বিচ্ছিন্নভাবে মাঝে মাঝে চলতে থাকে। কিন্তু ভারতে অদ্যাবধি মুসলিম হত্যা অবিরাম চলতে থাকা সস্তে¡ও ১৯৫০ সাল থেকে এদেশের মুসলমানরা হিন্দুদের উপর কোন আক্রমণ করেনি।
বর্তমানে এদেশের বসবাসরত ৮০ লাখ হিন্দু নিশ্চয়ই অনভব করেন যে, তাদের সাথে মুসলমানদের এমন কোন বিরোধ নেই যার কারণে তারা এদেশ ছেড়ে চলে যাবার চিন্তা করতে পারেন। যাদের যাবার দরকার তারা আগেই চলে গেছেন। এখনও যারা আছেন তারা পুরুষানুক্রমে এ দেশেরই অধিবাসী। মুসলমান জনগণ কোথও তাদের অপর মনে করছে না। উভয় সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে মেলামেশা স্বাভাবিক অবস্থায়ই চলছে। কোন কালে রাজনৈতিক কারণে যে বিরোধ ছিল তা বহু আগেই বিলীন হয়ে গেছে।
এদেশের খৃস্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয়দের সাথে কোন কালেই মুসলমানদের সম্পর্ক খারাপ ছিল না। সংখ্যায় তারা অনেক কম বরে তাদের সাথে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টির কোন কারণও ঘটেনি। সংখ্যালঘুদের মধ্যে হিন্দুরাই প্রধানতঃ উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ভুমিকা পালন করায় তাদের সাথে যেটুকু বিরোধ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ছিল তা হিন্দু সম্প্রদায় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এ বিরোধটুকুও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে সৃষ্টিই হয়নি।
একথা জোর দিয়েই বলা চলে যে, বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এমন কোন বিরোধ নেই যার ফলে কোন রকম সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সৃষ্টি হতে পারে। এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার কোন আশংকাও দেখা যায় না। যার ফলে তারা এদেশ থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার চিন্তা করতে পারে। বাংলাদেশের পাশেই আসামে গত কয়েক বছর থেকে ব্যাপক মুসলিম গণহত্যা চলা সত্বেও এবং ভারতের বহু প্রদেশে ১৯৪৭ সাল থেকে মুসলমানদের জান-মালও ইজ্জতের উপর এত ঘন ঘন হামলা হওয়া সত্ত্বেও এদেশের মুসলামানরা এখানকার হিন্দুদের উপর এর প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা না করায় একথা প্রমানিত হয়েছে যে, এদেশের মুসলমান জাতি অন্তত এ ব্যাপারে ইসলামের নীতিমালা মেনে চলতে সক্ষম হয়েছে।
সুতারাং বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সমস্যা বলে কোন সমস্যার বলে কোন অস্তিত্ব নাই। এখানে হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান বৌদ্ধ ও উপজাতীয়দের সবাই পরাস্পরের দেশীয় ভাই। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের একদল সন্ত্রাসবাদী লোক বিদেশী অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা পেয়ে ওখানকার অধিবাসীদের মধ্যে শান্তির নামে যে অশান্তি জিইয়ে রেখেছে তা নিতান্তই ঐ এলাকার একাংশেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েক হলে অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যায়। [আমার দেশ বাংলাদেশ]
এপার বাংলা ওপার বাংলা
এক সময়ে এক শ্রেনীর সার্থান্বেষী মহল ”এপার বাংলা ওপার বাংলা” শ্লোগানটিকে জনপ্রিয় করে তুলবার আপ্রাণ চেষ্টা রেছেন।
তখন বাংলাদেশের পাসপোর্টেও নাগরিকত্বের পরিচয় ছিল বাংগালী। ১৯৭৫ এর পর এ ব্যাপারে নতুন করে চেতনা জাগ্রত হয়। এবং এর ফলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশী নাগরিকত্বই এদেশীয়দের পাসপোর্ট স্থান লাভ করে।
একথা ঠিক যে, পশ্চিম বংগের জনগনের ভাষাও বাংলা। কিনউত একমাত্র ভাষাই যদি জাতীয়তার ভিত্তি হতো তাহলে অবিভক্ত বাংলা বিভক্ত হতো না। আমেরিকা, কানাডা, ও অষ্ট্রেলিয়ার ভাষা ইংরেজী হওয়া সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের সাথে মিলে এক জাতি হয়ে যায়নি। তাদের মধ্যে ধর্মের মিল থাকা সত্ত্বেও ভাষার ভিত্তিতে একজাতি বলে তারা পরিচয় দেয় না।
পশ্চিম বঙ্গের জনগোষ্ঠীর সাথে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম-সংস্কৃতি, পোশাক, ইতিহাস-ঐতিহ্য, এমন কি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্তের এত পার্থক্য রয়েছে যে, শুধু ভাষার ঐক্য ঐ পার্থক্য সামান্য কমাতে সক্ষম নয়। সুতারাং ওপার বাংলার সাতে এপার বাংলার জাতিগত মিল তালাশ করে পাওয়ার উপায় নেই।
পশ্চিম বংগের নাম পরিবর্তন করে ”বাংলা” নাম দেবার চেষ্টা নাকি চলছে। এটা তাদের ইচ্ছা। এতে আপত্তি করার কোন অধিকার বা প্রয়োজন আমাদের নেই। যদি এ নামা রাখার চেষ্টা সফল হয় তাহরে ওপার বাংলা আর এপার বাংলাদেশ থাকবে। উভয় পারে “বাংলা” আর কখনও হবে না।
পূর্ব বংগ নামে যখন কোন এলাকা নেই, তখন পশ্চিম বংগ নামটা অর্থহীনই বটে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পূর্ব বংগ ও পশ্চিম বংগ নামে সেকালের ‘বংগদেশ’কে বিভক্ত করা হয়। ১৯৫৬ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে পর্ব বংগের নামা পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পরই পশ্চিম বংগ নামটি অবন্তর হয়ে যায়। তবুও এ নাম তারা এখনও বদলাননি। এ বিষয়ে অবশ্য আমাদের কিছু বলার নেই।
পশ্চিম বংগের সাথে অবশ্যই আমাদের প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক রয়েছে। এপার ও ওপারের বহু মানুষের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় উভয় এলাকায় ছড়িযে থাকা বিপুল সংখ্যক লোক রোজই আসা যাওয়া করে। এ যাতায়াত যতটা সহজ করা হয় মানবিক দিক দিয়ে ততই মঙ্গল। উভয় অঞ্চলের মধ্যে সহিত্যের মাধ্যমে সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। সার্তক সাহিত্য রাষ্ট্রীয় সীমায় আবদ্ধ থাকে না। যদি ইংরেজী ও উর্দু সাহিত্য এদেশের সাহিত্যামোদীদের পিপাসা মিটাতে পারে তাহলে এ উভয় এলাকার সফল বাংলা সাহিত্য-কর্ম উভয় দেশের পাঠক পাঠিকাদের নিকট আকর্ষনীয় ও গ্রহনযোগ্য না হওয়ার কোন কারণ নেই। কোলকাতার যেসব অপ-সাহিত্য এখানে ছড়াচ্ছে এর জন্য এখানকার কুরুচি বিশিষ্ট পাঠকরাই দায়ী। এর জন্য সাহিত্য দায়ী হতে পারে না। দুগর্ন্ধময় বস্তু একশ্রেনীর জীবনকে অবশ্যই আকৃষ্ট করে থাকে। সে সব সাহিত্য পদবাচ্য নয়। সত্যিকার সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ বই পুস্তকের আদান – প্রদান উভয়কেই সমৃদ্ধ ও উপকৃত করতে পারে।
উভয় অঞ্চলের মধ্যে ব্যবস্যা-বাণিজ্যের সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ হতে পারে। উভয় দেশের সীমান্তে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারী কর্মচারীদের সহায়তায় যে বেআইনি ব্যবসা চলছে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্বক। উভয় দেশের পণ্য নিজ নিজ দেশের চাহিদা মোতাবেক আনদানী ও রফতানীর জন্য সরকারী ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন। পণ্য পাচারের জঘন্য ব্যবসার পরিবর্তে বৈধ ব্যবসা উভয়ের অর্থনীতিকে সাহয্য করবে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সত্তা। প্রতিবেশী হিসেবে পশ্চিম বংগের সাতে সব রকম বৈধ সম্পর্কই থাকা উচত। কিন্তু এপার বাংলা ওপার বাংলা শ্লোগান যে কুমতলবে দেয়া হয়েছিল তা এখন একেবারেই অর্থহীন। [আমার দেশ বাংলাদেশ]
বাংলাদেশের পটভূমিও মুসলিম জাতীয়তাবোধ
পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের কুশাসন, ইসলামের নামে অনৈসলামী কার্যকলাপ, গণবিরোধী নীতি ও আজনৈতিক সমস্যার সাময়িক সমাধানের অপচেষ্টার ফলে এদেশের জনগণের মধ্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়অ সৃষ্টি হয়, সে সুযোগে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও ইসলাম বিরোধী মতাদর্মের বাহকগন বাংলাদেশ আন্দোলনকে এমন খাতে পরিচালনার ব্যবস্থা করে যার ফলে এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশে দ¦ীন-ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের মতই নিছক পুজাপাঠ তাজীয় এবং ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ ধর্মে পরিণত করার অপচেষ্টা চলে। “ইসলাম” ও “মুসলিম” শব্দ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উৎখাত করা হয়। পত্র – পত্রিকার দাউদ হায়দার জাতীয় ধর্মদ্রোহীদের লেখা ও কবিতায় মুসলমানদের প্রাণাধিক প্রিয় নবী (সঃ) সম্পর্কে চরম আপত্তিকর কথা পর্যন্ত প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈমান তখন এক বিরাট পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। তারা এ কঠিক পরীক্ষয় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এভাবেই মুসলিম চেতনাবোধ অনৈসলামী শক্তির বিরুদ্ধে দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৭৫ এর আগষ্ট বিপ্লব এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফর্ত ইসলামী জগরণ বাংলাদেশের আদর্শিক পটভুমিকে সম্পূর্নরূপে বদলে দেয়। এরই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ক্রমে ক্রমে চরম ধর্মবিরোধী শাসনতন্ত্রের ধর্মমুখী সংশোধন চলতে থাকে। বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভুমি যে ভাবেই রচনা করার চেষ্টা হোক না কেন, বর্তমানে ইসলামের নৈতিক শক্তি এতটা মজবুত যে, মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের মুসলিম জনতা এখন আর অবহেলা পাত্র নয়। ইসলামের ভবিষ্যত অন্য কোন মুসলিম দেশ থেকে এখানে যে কম উজ্জল নয একথা ক্রমে ক্রমে সুস্পষ্ট হচ্ছে। সরকারী পর্যাযে ইসলাম যে অবস্থাতেই থাকুক, এদেশের কোটি কোটি মুসলিমের সামগিক চেতনায় ইসলামের প্রভাব ক্রমেই যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা স্বীকার না করে উপায় নেই
১৯৭০ সালের জনগণ যাদের কে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিলেন, তাদেরকে গন-অধিকার আদায়ের দায়িত্বও ক্ষমতা দেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম জাতীয়তার উপর হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার তাদেরকে দেয়া হয়নি। সুতরাং যখন জনগণ দেখল যে, তাদের অধিকার আগের চেয়েও খর্ব করা হয়েছে এবং জনসাধারণকে সরকারের গোলমে পরিণত করা হচ্ছে, এমন কি মুসরিম জাতীয়তাবোধকে পর্যন্ত ধ্বংস করা হচ্ছে তখন সবাই চরম নৈরাশ্য ও ভীষণ অস্থিরতা বোধ করলো। এরই ফলে ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট দেশের প্রেসিডেন্ট হত্যার মতো ঘটনার দিনটিকে জনগণ এত উৎসাহের সাথে মুক্তির দিন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। [বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী]