বাংলাদেশ ও ইসলাম
১৯৭১ সালে দুনিয়ার মানচিত্রে যে ভূখন্ডটি বাংলাদেশ নামে পরিচিত লাভ করেছে, সে এলাকাটিতে অতি প্রাচীনকাল থেকেই জনবসতি ছিল। এখানে দ্বীন ইসলামের আলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পথেই প্রথমে বিস্তার লাভ করে। এর ফরশ্র“তি স্বরূপ মুসলিমদের হাতে রানৈতিক প্রাধান্য আসে। এ জন্যই এ এলাকায় মুসলিমদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। শুধু রাজনৈতিক শক্তির বলে এদেশে মুসলিম শাসন কায়েম হয়নি।
দিল্লিতে শত শত বছর মুসলিম শাসকদের রাজধানী থাকা সত্ত্বেও চারপাশে বহুদূর পর্যন্ত মুসলমানদের সংখ্যা সবসময়ই কম ছিল। কিন্তু বাংলার মাটিতে মুসলিম শাসন শুরু সংখ্যা সবসময়ই কম ছিল। কিন্তু বাংলার মাটিতে মুসলিম শাসন শুরু হবার পূর্বেই বিপুল সংখ্যক স্থানীয় জনতা মুসলমান হয়। ইসলাম প্রচারক আরব বণিকদের প্রচেষ্টায় চাঁটগা দিয়ে এ এলাকায় ইসলামের আলো পৌঁছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ব্যবসায়ে লেন-দেনের সাথে সাথে তাদের নিকট মানবিক অধিকার ও মর্যাদার সন্ধান পেয়ে মুসলিম হওয়া শুরু করেছিল। এমন উর্বর জমির খোঁজ পেয়ে ইসলামের আলো নিয়ে বহু নিঃস্বার্থে মুবাল্লিগ এদেশে আগমন করেন। এভাবে নদী-খিলজি ১২০১ সালে মাত্র ১৭ জন অগ্রগামী আশ্বারোহী সেনা নিয়ে গৌড়ে আগমন করলে গৌড়ের রাজা লক্ষণ সেন বিনা যুদ্ধে পালায়ন করেন এবং বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। বাংলার সাথে সাথে আসামের দিকেও যখন মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো, তখন বর্তমান সিলেট অঞ্চলের রাজা গৌর গোবিন্দের মুসলিম বিরোধী চক্রান্তকে খতম করার জন্য হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রঃ) ৩৬০ জন মুজাহিদ নিয়ে এদেশে আসেন।
সুতরাং ইতিহাস থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, শাসকের ধর্ম হিসেবে এ এলাকায় মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেনি। বরং ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এবং মানুষের মত ইজ্জত নিয়ে বাঁচার তাকীদেই তারা মুসলমান হয়। এ কারণেই এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এত বেশী ইসলাম পরায়ণ। ধর্মের নামে শাসকদের অধর্মের ফলে বর্তমানে যুব শ্রেণীর একাংশে যে ধর্ম-বিরোধী তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা সাময়িক এবং তার বিপরিত প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। (বাংলাদেশ ও জামায়েত ইসলামী)
বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির মযবুত ভিত্তি
আগেই বলা হয়েছে ইসলাম নিজস্ব গতিতে প্রথম যুগেই আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সমুদ্রপথে এদেশে পৌঁছে। এরপর যুগে যুগে মুবাল্লিগ, ওলী ওদরবেশগণের আদর্শ জীবন এদেশের জনগণকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। রাজ্য বিজয়ীদের চেষ্টায় এদেশে ইসলাম আসেনি বরং ইসলামের প্রসারের ফলেই এখানে মুসলিম শাসনের পত্তন হয়।
একথা সত্য যে, দ্বীন ইসলামের সঠিক ও ব্যাপক জ্ঞানের অভাবে এ দেশের মুসলমানদের মধ্যে তাদের অমুসলিম পূর্ব-পুরুষদের অনেক কুসংস্কার, ভন্ড পরীর ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের চালু করা র্শিক-বিদায়াত, প্রতিবেশী অন্যান্য ধর্মের কতক পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি বিভিন্নরূপে কম-বেশী চালু রয়েছে। কিন্তু এদেশের অশিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যেও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নবীর প্রতি মুহাব্বত এবং মুসলিম হিসেবে জাতীয় চেতনাবোধ এমন প্রবল রয়েছে যে, সকল রাজেনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও কোন কালেই তা হারিয়ে যায়নি। বাংলাদেশ আন্দোলনের রাজনৈতিক তুপানে মুসলিম জাতীয়তাবোধ খতম হয়ে গেছে বলে সাময়িকভাবে ধারণা সৃষ্টি হলেও এদেশের মুসলিম জনতা এর পরপরই ঐ চেতনার বলিষ্ঠ পরিচয় দিয়েছে।
একথা যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে যে, এদেশের জনগণ মনস্তাত্ত্বিক দিকে দিয়ে ভাবপ্রবণ হবার ফলে কখনও কখনও রাজনৈতিক গোলকধাঁধায় সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে বা ভুল করতে পারে। কিন্তু সচেতনভাবে কখনও ইসলামী চেতনাবোধ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের মহাপ্লাবন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সরকারী অপচেষ্টা এদেশের মুসলিম জাতীয়তাবোধের নিকট যেভাবে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছে, তা বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির মযবুত ভিত্তির সুস্পষ্ট সন্ধান দেয়।
বাংলাদেশ এখন আর বাঙালী জাতীয়তাবাদী দেশ নয়। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে গৌরব বোধ করে। বাংলাদেশ ইসলামী সেক্রেটারীয়েটের মতো ‘বিশ্ব মুসলিম রাষ্ট্র সংঘের’ উল্লেখযোগ্য সদস্য হিসেবে প্রত্যেক ইসলামী পররাষ্ট্র সম্মেলনে উৎসাহের সাথে যোগদান করে। বাংলাদেশের মাসনতন্ত্রের কলংক স্বরূপ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের’ উল্লেখ ছিল দেশবাসীর ইসলামী চেতনাবোধ তা বরদাশত করেনি। সুতরাং বাংলাদেশের ইসলামী শক্তির ভিত্তি অত্যন্ত মযবুত। (বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী)