৭০ এর নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি
নির্বাচনের পর
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইন সভায় আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিনত হওয়ায় শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বলে মন্তব্য করা সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকলেন। ওদিকে ভুট্ট “এধার হাম, ওধার তুম” বলে এক দেশে দুটো মেজরিটি পার্টির অদ্ভুত শ্লোগান তুললেন। বুঝা গেলো যে, ভুট্ট পশ্চিম পাকিস্তানের বাদশাহ হতে চান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আলাদা না হলে সে সুযোগ তাঁর হয়না। তাই ইয়াহিয়া খানের সাথে যোগসাজশ করে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাঁধা সৃষ্টি করতে লাগলেন।
সেসময় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বার বার জোর দাবী জানানো হল যে, “ব্যালটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংখাগুরু দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া হোক।” কারন জামায়াতে ইসলামী আশংকা করেছিলো যে, ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব হলে রাজনৈতিক সংকটের সাথে সাথে দেশে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সে সময়কার দৈনিক পত্রিকাগুলো জামায়াতের এই দাবীর ঐতিহাসিক সাক্ষী।
নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের জানুয়ারীতে লাহোরে মাওলানা মওদুদীর সভাপতিত্বে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মাজলিশে শূরায় সিদ্ধান্ত হয় যে, যদি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে, তাহলে জামায়াত এর বিরোধিতা করবে না। এ বিষয়ে এখানকার প্রাদেশিক জামায়াতকে যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য পূর্ণ ইখতিয়ার দেয়া হল। এরপর এ সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতই নিতে থাকে।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি
জেনারেল ইয়াহিয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হিসাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন বলে দাবী করা সত্ত্বেও নির্বাচনের পর তিনি মোটেই আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেন নি। নির্বাচন সঠিকভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে গৌরবের সাথে ঘোষণা করা সত্ত্বেও নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে দেশকে তিনি চলতে দিলেন না। অযৌক্তিক কারনে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানে বিলম্ব করতে থাকলেন।
৬ দফার দোহাই দিয়ে শেখ সাহেব নির্বাচনে জয়লাভ করেন। একথা জানা থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্ট সাহেব ৬- দফার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালালেন। ইয়াহিয়া খানের সাথে ভুট্ট সাহেবের বার বার সাক্ষাৎ ও ভুট্ট সাহেবের ক্ষমতায় অংশগ্রহনের দাবী থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হল যে, শেখ সাহেবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার উদ্দেশ্যেই ইয়াহিয়া- ভুট্টোর মধ্যে ষড়যন্ত্র চলছে।
সমস্ত রাজনৈতিক দলের দাবীতে অবশেষে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় ৩রা মার্চ ১৯৭১- এ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলেন। একমাত্র ভুট্টো সাহেবই এই অধিবেশন মুলতবি করার দাবী জানালেন এবং মুলতবী না হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোন সদস্যকে যেতে না দেবার হুমকী দিলেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টো সাহেবের দাবী মেনে নিয়ে শেখ সাহেবের মতামত ছাড়াই যখন অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতবী করলেন তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগন বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। ক্ষমতা হস্তান্তর না করার সন্দেহ তাঁদের মনে আরও ঘনীভূত হল। এ সুযোগে শেখ মুজিব বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। জনগনের বিক্ষোভকে দমনে অক্ষম হয়ে অবশেষে ইয়াহিয়া খান শেখ সাহেবের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্দেশ্যে ঢাকায় এলেন। ৫ দিন পর্যন্ত আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে দু’পক্ষ দেশবাসীকে বার বার আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও হঠাৎ শেষ মুহূর্তে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় ইয়াহিয়া খান সামরিক শক্তি দিয়ে বিদ্রোহ দমনের ব্যবস্থা করলেন। কায়েদে আযম শক্তি প্রয়োগ করে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্রিত করেননি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বার বার শক্তি প্রয়োগ করে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। জনগণ বিশেষ করে বাঙ্গালী মুসলমানরা ইচ্ছা করে বিচ্ছিন্ন হয়নি।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
টিক্কা খানের অভিযান
২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ঢাকা শহরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং ব্যাপক হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে চরম সন্ত্রাস সৃষ্টি করে অসহযোগ আন্দোলনকে দমন করার প্রচেষ্টা করলো। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হল। কয়েক রাতের সামরিক অপারেশনে ঢাকা শহর স্তব্ধ হয়ে গেলো এবং রাজধানী তাঁদের পুনর্দখলে এলো।
ঢাকার বাইরের সব জেলায়ই এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ জেলা এবং মহকুমা শহরে অসহযোগ আন্দোলন জারী রাখলেন। ঢাকার বাইরে সেনাবাহিনী ও পুলিশেও বিদ্রোহ দেখা দিলো। যেসব শহরে অবাঙ্গালী ( বিহারী নামে ) উল্লেখযোগ্য সংখায় ছিল সেখানে বিহারীদেরকে হত্যা করে ঢাকার প্রতিশোধ নেয়া হল। এর প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনী ঐ সব এলাকায় গিয়ে বাঙ্গালী হত্যা করলো এবং সরকারী ক্ষমতা বহাল করলো।
এভাবে দু’দিকের আক্রমনে নিরপরাধ সাধারন মানুষ নিহত ও অত্যাচারিত হতে থাকলো। এক মাসের মধ্যে মোটামুটি দেশে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত হল বটে কিন্তু দেশটিকে নিশ্চিতভাবে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়া হল।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
আত্মঘাতী লড়াইয়ের পরিণাম
অদৃষ্টের কি কঠোর পরিহাস। কতক লোকের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের ফলে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই হয়ে গেলো ও চির দুশমন ভারত এক ভাইয়ের বন্ধু সেজে উভয়েরই সর্বনাশ করার সুযোগ পেলো। দু’ভাইয়ের সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়ার সুযোগে উভয়ের দুশমন এক পক্ষের বন্ধু সেজে গোটা সম্পত্তিই আত্মসাৎ করার নজীর বিরল নয়। পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারত ঠিক সে ভূমিকাই গ্রহন করার মহাসুযোগ পেয়েছে। দুশমন তাঁর কাজ ঠিকই করেছে। পাকিস্তানকে ধ্বংস করার এ মহা সুযোগ ভারত কেন ছেড়ে দেবে ? দোষ দুশমনের নয়। দুশমনকে সে সুযোগ দেয়াটাই প্রকৃত অন্যায়। আমাদের নির্বাচিত সব নেতাই এজন্যে কম বেশী দায়ী। এ আত্মঘাতী লড়াই চলাকালে সত্যিকারের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের প্রান কেঁদেছে। কি মারাত্মক পরিস্থিতি তখন। সেনাবাহিনী দেশের অখন্ডতা রক্ষার জন্য আপন দেশবাসীকেই মারলো। আর বাঙ্গালী মুসলমানদের দুর্দশার অন্ত থাকলো না। এক দল মুসলমান ভারতের গোলামীর ভয়ে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করলো। আর এক দল পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য ভারতের মতো দুশমনের সাহায্য গ্রহন করতে নিজেদেরকে বাধ্য মনে করলো। হিন্দুদের তো এতে কোন মানসিক অসুবিধা ছিল না। কিন্তু দুপক্ষেই বাঙ্গালী মুসলমান দেশ প্রেমের তাগিদে যেসব কাজ করলো তাঁর পরিণাম কতো করুন।
একদল ভারতের দেয়া বোমা দিয়ে নিজেদের দেশেরই পুল উড়ায়, আর এক দল পুল রক্ষার জন্য প্রান হারায়। দুপক্ষেই দেশপ্রেম। কুশাসন এবং রাজনৈতিক বিভ্রান্তি এভাবেই দেশের জন্য আত্মত্যাগীদেরকে এমন আত্মঘাতী লড়াইয়ে লিপ্ত করে থাকে। একদলকে ভারতের দালাল, আর অন্য দলকে পাকিস্তানের দালাল বলে গালি দিলেই কি এদের দেশপ্রেম মিথ্যা হয়ে যাবে ?
এর পরিনামে কতো দেশপ্রেমিক উভয় পক্ষে খতম হয়ে গেলো। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গত ২৫ বছরে যা কিছু অর্জিত হয়েছিলো তা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হল। অরাজকতার সুযোগে সমাজবিরোধী ও উচ্ছৃঙ্খলদের হাতে কতো নিরপরাধ মানুষ জান মাল হারাল। যে শোষণ থেকে বাঁচার জন্য এতকিছু করা হল তাঁর চেয়ে কতো বেশী শোষণ তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্র জঘন্য ও ব্যাপকভাবে চালাচ্ছে। সমস্ত সামরিক জিনিস পত্র তারা নিয়ে গেলো। দেশে আজ খাবার নেই, কাপড় নেই, ঔষধ নেই, নিরাপত্তা নেই— আছে শুধু হাহাকার। জনগন কি এই অবস্থার আশায় গত নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলো। বিজয়ী দলকি দেশকে এ অবস্থায় দেখতে চেয়েছিলেন ? নিশ্চয়ই নয়। কেউই ধ্বংসের নিয়তে কাজ করেনি। কিন্তু যে নিয়তেই করা হউক ভুলের ভুলের পরিণাম ভোগ করতেই হয়। ভুলের ক্ষতি অনিবার্য। ব্যক্তিগত ভুলের ফল এতো বড় ব্যাপক হয়না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শাসকরা এবং রাজনৈতিক নেতারা করে থাকেন তাঁর পরিনাম যে কতো বেদনাদায়ক ও মারাত্মক হয় বাংলার মুসলমান তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণের ফলে বাংলাদেশ আপাতত জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে এসেছে বটে – কিন্তু এ কলংক কি বাঙ্গালী মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনে কালিমা লাগায়নি ? ইতিহাস তো একথা বলবে না যে, এক লাখ মুসলিম সশস্ত্র বাহিনী হিন্দুস্তানের সেনাপতির নিকট আত্মসমর্পণ করেছে। এ কালিমা সারা দুনিয়ার মুসলমানদের আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন করেছে। ১৯৬৫ সালে পাক- ভারত যুদ্ধে যে গৌরব অর্জন করা হয়েছিলো তা যেমন বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্যও সম্মানজনক ছিল তেমনি এ অপমানও তাঁদেরকে স্পর্শ করেছে।
এমনিভাবে এ আত্মঘাতী লড়াই সাধারনভাবে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের জন্য যে কতো মারাত্মক পরিনতি বয়ে এনেছে তা কদ্দিন ভোগ করতে হবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারে।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )