গোসল
ওয়াজিব গোসল
*************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ স্বামী-স্ত্রী যখন চার শাখা মিলাইয়া বসে ও এক (পরুষের) লিঙ্গ অপর (স্ত্রীর) লিঙ্গের সহিত মিলিত হয়, তখনই গোসল ওয়াজিব হইয়া যায়। – মুসলিম, তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা যৌন-সঙ্গমে উভয়ের গোসল ওয়াজিব হইয়া যায়। ইহা যেমন কুরআন মজীদের স্পষ্ট ঘোষণা হইতে প্রমাণিত, হাদীস হইতেও ইহা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। কিন্তু প্রশ্ন উঠিয়াছে, যৌন সঙ্গম সম্পূর্ণতা লাভের পর গোসল ওয়াজিব হইবে, না শুরু হওয়া মাত্র ওয়াজিব হইয়া পড়িবে? আলোচ্য হাদীস এবং এই পর্যায়ের অপরাপর বহু সংখ্যক হাদীস হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, দুই লিঙ্গ মিলিত হইলেই গোসল ওয়াজিব হইবে। হযরত আলী ও মু’আয জাবাল (রা) উভয়ই বলিয়াছেনঃ
********************
দুই লিঙ্গ যখনি পরস্পরের সহিত মিলিত হইবে, তখনি গোসল ওয়াজিব হইবে।
অর্থাৎ যৌন-সঙ্গম সম্পূর্ণতা লাভ না করিলেও লিঙ্গদ্বয় শুধুমাত্র পরস্পরের সাথে মিলিত হইলেই গোসল ওয়াজিব হইবে। তবে একটি অঙ্গ অপর অঙ্গের উপর শুধু রাখা হইলেই গোসল ওয়াজিব হইবে না। গোসল ওয়াজিব হওয়ার জন্য আরো কিছু অগ্রসর হওয়া আবশ্যক। মাহমুদ ইবনে লুবাইদ আনসারী যায়দ ইবনে সাবিত (রা)-কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেনঃ এক ব্যক্তি যদি তাহার স্ত্রীর সহিত যৌন কার্য করে; কিন্তু উহার পরিণতি পর্যন্ত না পৌছায় অর্থাৎ শুক্র নির্গত না হয়, তাহা হইলে সে কি গোসল করিবে? উত্তরে যায়দ বলিয়াছেনঃ হ্যাঁ, সে অবশ্যই গোসল করিবে- তাহাকে গোসল করিতে হইবে। মাহমুদ বলিলেনঃ কিন্তু হযরত উবাই ইবনে কা’য়ার ভিন্নমত পোষণ করিতেন। এইরূপ অবস্থায় গোসল করাকে তিনি ওয়াজিব মনে করিতেন না। তখন হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা) বলিলেনঃ উবাই ইবনে কা’য়াব শুরুতে এইরূপ মত প্রকাশ করিয়াছিলেনঃ কিন্তু পরে মৃত্যুর পূর্বে তিনি এই মত প্রত্যাহার করেন। আর কেবল তিনিই নহেন, অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ী এই মতের বাতিল হইয়া যাওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ এক মত। খোদ নবী করীম (স) হইতেও ইহাই বর্ণিত।
ওয়াজিব গোসলের নিয়ম
*************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) যখন জানাবাতের (ওয়াজিব) গোসল করিতেন, তখন শুরু করিয়াই তিনি প্রথমে স্বীয় দুইখানি হাত ধৌত করিতেন। পরে ডান হাতে বাম দিকে পানি ফেলিয়া স্বীয় লজ্জাস্থানসমূহ ধুইতেন। ইহার পর অযূ করিতেন ঠিক সেই রকমের অযূ, যেমন নামায পড়ার জন্য করা হয়। পরে পানি লইয়া মাথার চুলের গোড়ায় পৌছাইতেন। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি মনে করিতেন যে, তিনি সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ভালোভাবে পানি পৌছায়াছেন, তখন দুই হাতে ভরিয়া-ভরিয়া মাথার উপর পানি ফেলিতেন। পরে সমস্ত শরীরে পানি প্রবাহিত করিতেন। সর্বশেষে দুই পা ধুইতেন।- বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত এই হাদীস হইতে রাসূলে করীম (স)-এর ওয়াজিব গোসলের বিস্তারিত নিয়মাদি জানা যাইতেছে। মূলত ইহা আল্লাহর নির্দেশঃ
*********************************
তোমরা যদি অপবিত্র অবস্থায় থাক, তাহা হইতে তোমরা পূর্ণমাত্রায় পবিত্রতা অর্জন কর।
এরই পূর্ণ অনুসরণ ও প্রতিপালন নবী করীম (স) নিজে পুরাপুরিভাবে পালন করিতেন। তাঁহার ওয়াজিব গোসলের এই পদ্ধতি সমগ্র মুসলমানের জন্যই অনুসরণীয়। ব্স্তুত অপবিত্র দেহ পরিবত্রকরণের ইহাপেক্ষা উত্তম পদ্ধতি আর কিছুই হইতে পারে না।
******************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) তাঁহার খালা উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মূনা (রা) হইতে বর্ণিত করিয়াছেন, তিনি (মায়মূনা) বলিয়াছেনঃ আমি নবী করীম (স)-এর জন্য গোসলের পানি রাখিয়া দিয়াছিলাম। তিনি উহা দ্বারা স্ত্রী সহবাস জনিত অপবিত্রতা হইতে পাক হওয়ার জন্য গোসল করিলেন। প্রথমে তিনি তাঁহার বাম হাত দ্বারা পানির পাত্রটি তাঁহার ডান হাতের উপর কাত করিলেন এবং তাঁহার হস্তদ্বয় ধুইয়া ফেলিলেন। অতঃপর তিনি তাঁহার হাতখানি পাত্রের মধ্যে ঢুকাইয়া দিলেন এবং স্বীয় লজ্জাস্থানের উপর পানি ঢালিয়া দিলেন। তাহার পর তিনি তাহার হাত প্রাচীরগাত্রের কিংবা (বলিয়াছেন) মাটির উপর ঘষিলেন। ইহার পর তিনি কুল্লি করিলেন, নাকের ভিতর দিকে পানি দিয়া ধুইলেন এবং তাঁহার মুখমন্ডল ও দুইটি বাহু ধুইলেন। অতঃপর তাঁহার মাথার উপর তিনবার এবং তাহারও পর তাঁহার সমস্ত দেহের উপর পানি ছাড়িয়া দিলেন। পরে একপাশে সরিয়া গিয়া তাঁহার পা দুইখানি ধুইলেন। – তিরমিযী
ব্যাখ্যা হাদীসটির প্রতিপাদ্য হইল, স্বামী-স্ত্রীর যৌন সঙ্গম করিবার পর সমস্ত শরীর নাপাক হইয়া যায় বলিয়া নিয়ম মত গোসল করিয়া লইতে হয়। কেননা নাপাক শরীরে আল্লাহর ইবাদত করা চলে না- সম্পূর্ণ হারাম। ইসলামের প্রধান ইবাদত- নামায পড়ার জন্য সর্বপ্রথম গোসল করিয়া নাপাক শরীর পাক করিয়া লওয়া ফরয। এ কারণে উহার পর গোসল করিতে হইবে বিধায় হযরত মায়মূনা (রা) নবী করীম (স)-এর জন্য পূর্বাহ্নেই পানির ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়ছিলেন। কেননা আরব মরুভূমিতে তখনকার সময় পানি খুবই দুষ্প্রাপ্য ছিল। পূর্বাহ্নেই উহার ব্যবস্থা করিয়া না রাখিলে পরে প্রয়োজনের সময় বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া স্বাভাবিক ছিলঃ
হাদীসের প্রথম বাক্য হইলঃ ************ ‘আমি নবী করীম (স)-এর জন্য ‘গুসল’ (মানে গোসলের পানি) রাখিয়াছিলমা’। বুখারী শরীফে উদ্ধৃত এই হাদীসটিতে এখানকার শব্দ হইল ********* ‘গোসলের জন্য পানি’। যৌন সঙ্গমের পর শরীর নাপাক হওয়ার দরুন নবী করীম (স) এই পানি দিয়া গোসল করিয়াছিলেন। অতঃপর হাদীসে এই গোসল করার ব্যাপারে নবী করীম (স) কি পদ্ধতি অনুসরণ করিতেন তাহা সবিস্থারে বর্ণিত ও বিবৃত হইয়াছ্ হযরত মায়মূনা (রা) নিজ চক্ষে দেখা সেই পদ্ধতির বর্ণনা দিয়াছেন। বলিয়াছেন, নবী করীম (স) প্রথমে পাত্রটি কাত করিয়া নিজে দুইখানি হাত ধুইয়া লইলেন। হাত ধোয়া পানি পাত্রের বাহিরে পড়িল। তাহার পর ছোট পাত্রের অভাবে হাত দ্বারাই পানি তুলিয়া স্বীয় শরীরের ময়লা পরিস্কার করিলেন। হাতে কোনরূপ ময়লা লাগিয়া থাকিতে পারে বলিয়া তিনি উহা দেওয়াল কিংবা মাটিতে ঘষিয়া সাফ করিরেন। তাহার পর প্রথমে মাথা ও পরে সমস্ত শরীরের উপর তিনবার পানি প্রবাহিত করিয়া দিয়া গোসল সমাপ্ত করিলেন এবং শেষে একপাশে সরিয়া গিয়া তাঁহার পা দুইখানি ধুইলেন।
বস্তুত ইহাই হইল জানাবাত-যৌন সঙ্গমজনিত নাপাকি- হইতে শরীর পাক করার উদ্দেশ্যে করা গোসলেরন নিয়ম। এ নিয়ম স্বয়ং নবী করীম (স) পালন করিয়াছেন ও সমস্ত মুসলমানদের জন্য এই পদ্ধতিই রাখিয়া ও শিখাইয়া গিয়াছেন। এই ধরনের গোসলের প্রথম অযূর সময় পা ধুইতে হয় না, পার ধুইতে হয় সর্বশেষ এবং একপাশে সরিয়া গিয়া- যেন সকল প্রকার মলিনতা হইতে নিজেকে রক্ষা করা যায়। বিশেষত কাঁচা মাটির উপর গোসল করিলে এইরূপ করা অবশ্যই জরুরী। কিন্তু গোসলের স্থান পাকা-পোক্ত হইলেও গোসলের পানি প্রবাহিত হইয়া সরিয়া গেলে সেখানে দাঁড়াইয়া পা ধোয়া যাইতে পারে। অন্যত্র সরিয়া যাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
জুম’আর দিনে গোসল
***********************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ তোমাদের নিকট যখন জুম’আর দিন উপস্থিত হইবে, তখন তোমরা অবশ্যই গোসল করিবে। – বুখারী, মুসলিম।
ব্যাখ্যা এই হাদীসে জুম’আর দিন গোসল করিতে বলা হইয়াছে। জুম’আর দিনের এই গোসল ওয়াজিব নহে। যে কারণে গোসল করা ওয়াজিব হয়, তাহার কথা ইতিপূর্বে বলা হইয়াছে। সেই গোসলের হুকুম মূলত আল্লাহই দিয়াছেন। এতদ্ব্যতীতও কোন কোন ক্ষেত্রে রাসূলে করীম (স) গোসলের নির্দেশ দিয়াছেন। এসবই নির্দেশ ফরয বা ওয়াজিবের নির্দেশ নহে। সেই নির্দেশ হইতে শুধু সুন্নাত কিংবা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। জুম’আর দিনে গোসল করা সম্পর্কে রাসূলে করীমের এই নির্দেশ এই পর্যায়ে গণ্য। যদিও হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত একটি হাদীসে জুমআর দিনের গোসলকেও ‘ওয়াজিব’ বলা হইয়াছে। কিন্তু প্রায় সব ইমাম ও শরীতবিদদের মতে পরিভাষায় যাহাকে ওয়াজিব বলা হয়, জুম’আর গোসল সেরূপ নয়। বরং শুধু তাকীদ করাই উহার লক্ষ্য। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত আর এক হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
**************************************
নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরী হইল এক সাপ্তাহের সাতদিনের মধ্যে একদিন জুম’আর দিন গোসল করা। এই গোসলে সে যেন তাহার মাথা ও শরীর খুব ভালো করিয়া ধৌত করে।
বস্তুত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাধারণভাবেও গোসল করা একান্তই বাঞ্চনীয়। গোসল না করিলে দেহে ময়লা জমিয়া যায়, শরীরে হইতে এক প্রকার দুর্গন্ধ বাহির হয়। আর ইসলামের দৃষ্টিতে তাহা খুবই ঘৃণ্য। এই কারণে সপ্তাতে অন্তত একবার খুব ভালোভাবে গোসল করা আবশ্যক। নবী করীম (স) অপর এক হাদীসে বলিয়াছেনঃ
******************************
হে লোকেরা, এই জুম’আর দিনটিতে তোমরা অবশ্যই গোসল করিবে এবং ভালো সুঘন্ধি ও তেল- যাহাই পাইবে, তাহা অবশ্যই ব্যবহার করিবে।
ঈদের দিনে গোসল
**************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স) দুই ঈদের দিনে-রোযার ঈদ ও কুরবানীর ঈদে গোসল করিতেন। – ইবনে মাজাহ্
ব্যাখ্যা ঈদের দিনে বিশেষভাবে গোসল করা, যতখানি সম্ভব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করা এবং সুগন্ধি ব্যবহার করা মুসলিম জাতির এক সামষ্টিক ও জাতীয় রীতি। এই রীতি নিঃসন্দেহে মুসলমানদের প্রাথমিক কালহইতেই চলিয়া আসিয়াছে এবং ইহা প্রথম চালু হইয়াছে নবী করীমের হিদায়ত অনুযায়ী কিংবা তাঁহার আমল অনুসরণ করার ফলে, ইহাতে সন্দেহ নাই। কাজেই ইহা যে খুবই ভালো কাজ সেই বিষয়ে কাহারো দ্বিমত থাকিতে পারে না।
কিন্তু ঈদের দিনে গোসল করা সম্পর্কিত হাদীস সমূহের সনদ হাদীস তত্ত্ববিদদের বিচারে খুবই দুর্বল। অবশ্য এই পর্যায়ে সাহাবাদের নিজস্ব কথা খুবই উত্তম।
কিন্তু তবুও এইসব হাদীস হইতে এইকথা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, দুই ঈদের দিনে গোসলকরা সুন্নাত। গোসল না করিলে সুন্নাত তরক হইয়া যাইবে।