তায়াম্মুম
**************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি হযরত আসমার নিকট হইতে একখানি গলার হার ধার হিসাবে লইয়াছিলেন এবং পরে তাহা তিনি হারাইয়া ফেলেন। তখন রাসূলে করীম (স) এক ব্যক্তিকে (উহার সন্ধানে) পাঠাইয়া দিলেন। সেই ব্যক্তি (গিয়া) তাহা পাইল। তখন তাঁহাদের সম্মুখে নামাযের সময় আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু তাঁহাদের নিকট (অযূ করার) পানি ছিল না। তখন তাঁহারা নামায পড়িলেন। পরে এই বিষয়ে তাঁহারা রাসূলের নিকট অভিযোগ করিলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল করেন। অতঃপর হযরত উসাইদ ইবনে হুযাইর (রা) হযরত আয়েশা (রা)-এক বলিলেনঃ “আল্লাহ আপনাকে বিপুল কল্যাণ দান করুন। আল্লাহর শপথ, আপনার সঙ্গে এমন একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহা আপনি অপছন্দ করেন, কিন্তু আল্লাহ উহাকে আপনার ও মুসলমানদের জন্য বিপুল কল্যাণ পূর্ণ করিয়া দিয়াছেন।- বুখারী
ব্যাখ্যা তায়াম্মুম সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ার উপলক্ষ এবং তৎসংক্রান্ত বিরাট ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই হাদীসে উল্লেখিত হইয়াছে। ইহা পঞ্চম হিজরীর ঘটনা। নবী করীম (স) বনুল মুসতা’লিক যুদ্ধে গমন করিয়াছিলেন, সঙ্গে হযরত আয়েশা (রা) ও হযরত আসমা (রা)ও গমন করিয়াছিলেন। যুদ্ধ হইতে ফিরিবার পথে মদীনার নিকটবর্তী একস্থানে হযরত আয়েশার গলায় রক্ষিত হার হারাইয়া যায়। তিনি উহার স্ন্ধানে ব্যস্তহ হইয়া পড়েন। পরে নবী করীম (স) হযরত উসাইদ ইবনে হুযাইর (রা)-কে তাঁহার স্ন্ধানে পাঠাইয়া দেন এবং তাঁহারা সন্ধানের পর হারানোর অলংকার লাব করেন। ইতিমধ্যে নামাযের সময় উপস্থিত হয়; কিন্তু নামাযের অযু করিবার জন্য প্রয়োজনীয় পানি কোথাও পাওয়া গেল না। এখন তাঁহারা কি করিবেন; অযূ না করিয়া কিভাবে নামায পড়েন। মদীনায় ফিরিয়া আসিয়া তাঁহারা রাসূলের নিকট সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিলেন। অত:পর তায়াম্মুম অনুমতি সঙক্রান্ত আয়াত নাযিল হয়। আয়াতটি এইঃ
*****************************************************তোমরা যদি অসুস্থ হও; কিংবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেহ পায়খানা-প্রসাব করিয়া আসে বা স্ত্রী সহবাস করিয়া থাক; কিন্তু অত:পর পানি না পাও, তাহা হইরে পবিত্র মাটির উপর লক্ষ্য নিবন্ধ কর। আর তোমাদের মুখমন্ডল ও তোমাদের দুই হাত মসেহ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা দোস স্খলনকারী ও গুনাহ মাফকারী।
আলোচ্য হাদীস হইতে একথা স্পস্টভাবে জানা যায় না যে, সহাবিগণ পানি না পাইয়া কিভাবে নামায পড়িলেন, তায়াম্মুম করিয়া, কি অযূ তায়াম্মুম ব্যতিরেকেই নামায পড়িলেন। তবে মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে **** শব্দের পরে ****** কথাটি স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।
হাদীস শরীফ
অর্থাৎ তাঁহারা বিনা অযূতেই নামায পড়িলেন। কিন্তু তাহাভী শরীফে উদ্ধৃত এক হাদীসে উল্লেখ রহিয়াছেঃ
*************************************************
তাঁহারা যখন পানি পাইলেন না, তখন তাঁহাদের মধ্যে কেহ পাঞ্জা পর্যন্ত মাটি মুছিলেন, কেহ কাঁধ পর্যন্ত মাটি দ্বারা মসেহ করিলেন, আবার কেহ সমস্ত শরীরে মাটি মুছিয়া দিলেন।
অর্থাৎ পানি না পাওয়ার কারণে যখন তাঁহারা অযূ করিতে পারিলেন না তখন তাঁহারা নামাযের জন্য জরুরী পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে মাটির দিকে লক্ষ্য করিলেন এবং বিভিন্ন লোক বিভিন্নবাবে মাটির দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু তাঁহাদের এই কাজ যেহেতু অজ্ঞতাপ্রসূত ছিন ও আল্লাহর নিকট হইতে অনুমতি না পাইয়া ও জানিয়া নিজস্বভাবেই মাটি মাখিয়া নিয়াছিলেন, এই জন্য মনে করা যাই ত পারে যে, তাঁহারা তায়াম্মুম করেন নাই। ‘তারবানী’ বর্ণিত হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ রহিয়াছেঃ
********** তাঁহারা কোন প্রকার পবিত্রতা অর্জন না করিয়াই নামাজ পড়িলেন। তবে যদি তাঁহারা শরীরে মাটি মাখিয়া থাকেন, তবুও তাহার দ্বারা পবিত্রতা অর্জিত হইয়াছেবলিয়া ধরা যাইতে পারে না। কেননা এই কাজ তাঁহারা করিয়াছিলেন নিজস্ব চিন্তা ও ইজতিহাদের সাহায্যে। উহার পশ্চাতে তখনো শরীয়তের কোন দলীল বর্তমান ছিল না। কিন্তু রাসূলের জীবদ্দশায় এই ধরনের ব্যাপারে এইরূপ ইজতিহাদ করা জায়েয হইয়াছে কিনা তাহা অবশ্য এক স্বতন্ত্র ব্যাপার। কাহারো মতে মোটামুটিভাবে জায়েয আর ইহাই অধিকাংশের মত। কাহারো মতে ইহা ঠিক কাজ হয় নাই, আবার কাহারো মতে রাসূলের নিকট হইতে দূরবর্তীদের জন্য ইহা সঙ্গত, নিকটবর্তীদের জন্য নহে।
এই হাদীস হইতে মোটামুটি জানা যায় যে, কোন মুসলিম যদি এমন কোন অবস্থায় পড়ে, তখন নামাযের পবিত্রতা অর্জনের জন্য যদি জরুরী পরিমাণ পানি পাওয়া না যায়, তবে তখন সে কুরআনের অতিক্রমনে ‘তায়াম্মুম’ করিবে কিন্তু যদি পানির মত তায়াম্মুম করিবার জন্য মাটিও পাওয়া না যায়, তখন কি করা হইবে? এই সম্পর্কে চারিটি মতের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম এই যে, এইরূপ অবস্থায় কোন প্রকার পবিত্রতা অর্জন ব্যতীত নামায পড়িবে, কিন্তু পরে অযূ বা তায়াম্মুমের সুযোগ পাইলেই উক্ত নামায পুনরায় আদায় করিবে। দ্বিতীয় মত এই যে, এইরূপ অবস্থায় নামায পড়াই ফরয নয়, বরং মুস্তাহাব মাত্র অর্থাৎ পড়া ভাল, না পড়িলে গুনাহ্ নাই। তবে পরে অবশ্যই উহা কাযা করিতে হইবে। তৃতীয় এই যে, এইরূপ অবস্থায় নামায পড়া হারাম। কেননা সে জরুরী পবিত্র হইতে বঞ্চিত। উহা কাযা করিতে হইবে। ইমাম আবূ হানীফার অভিমত ইহাই। আর চতুর্থ মত এই যে, এইরূপ অবস্থায়ও নামায আদায় করা ওয়াজিব এবং পুনরায় তাহা পড়া ওয়াজিব নহে। আলোচ্য হাদীস এই মতের দলীল। কেননা, নবী করীম (স) এই ঘটনার সহিত জড়িত সাহাবিগণকে পুনরায় নামায পড়িবে বলিয়াছেন বলিয়া কোন উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। ইমাম মালিকের মতে এইরূপ অবস্থা নামায পড়িবে না, আর পরেও উহা পড়িতে হইবে না। বরং এইরূপ অবস্থাকে ’হায়য্’ অবস্থা মনে করিতে হইবে।
মোট কথা, ইহাই হইতেছে তায়াম্মুমের গোড়ার কথা *******************
*******************************
হাদীস শরীফ
হযরত ইমরান হুসাইন (রা) বর্ণিত, তিনি বলিয়াছেনঃ আমরা এক সফরে রাসূলে করীম (স)- এর সঙ্গে ছিলাম্ তিনি লোকদের লইয়া নামায পড়িলেন। এই সময় দেখা গেল এক ব্যক্তি আলাদা হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। নবী করীম (স) সেই ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন্ জিনিস তোমাকে নামায পড়িতে নিষেধ করিল? সেই ব্যক্তি বলিলঃ আমার শরীর নাপাক হউয়াছে, আর পানি নাই বলিয়া শরীর পাক করিতে পারি নাই, তোমার কর্তব্য ছিল পবিত্র মাটি স্পর্শ করা। ইহাই তোমার জন্য যথেষ্ট ছিল। -বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা শরীর নাপাক হইলে গোসল করিয়া পাক করিতে হয় আর পানি না পাওয়া গেলে শরীর পাক করিবার আর কোন উপায় নাই, হাদীসে উল্লেখিত ব্যক্তির ইহাই ছিল ধারণা। এই কারণে সামনে জামা’আতের সহিত নামায হইতে দেখিয়াও তিনি উহাতে শরীক হন নাই। কেননা তাঁহার শরীর নাপাক, আর নাপাক শরীর লইয়া নামায পড়া যায় না, ইহা তো জানা কথা। তখন নবী করীম (স) লোকটিকে বলিলেনঃ তোমার কর্তব্য ছিল পবিত্র মাটি স্পর্শ করা অর্থাৎ তায়াম্মুম করা এবং ইহাই তোমার জন্য যথেষ্ট। পানি না পাওয়া গেলে শুধু তায়াম্মুম দ্বারাও যে শরীরকে পাক করা যায় এবং এই শরীর লইয়া নামাযও পড়া যায়, উক্ত ব্যক্তি এইবারই সর্বপ্রথম জানিতে পারিলেন। সেই সঙ্গে এই হাদীসের সাহায্যে দুনিয়ার সর্বসাধারণ মুসলমানরাও এই তত্ত্ব জানিতে পারিলেন। ইহা সর্বসম্মত মত। তবে পরে পানি পাওয়া গেলে গোসল করিতে হইবে কিন্তু নামায পুনরায় পড়িতে হইবে না।
****************************************************
হযরত আবূ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম(স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ পবিত্র মাটি মুসলমানের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে- দশ বৎসর পর্যন্ত পানি পাওয়া না গেলেও। পরে যদি কখনো পানি পাওয়া যায় তখন যেন সেই পারি দ্বারা স্বীয় শরীর ধুইয়া লয়- ইহাই উত্তম। -মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ
ব্যাখ্যা এই হাদীস হইতে জানা গের যে, বৎসরের পর বৎসর ধরিয়াও যদি কেহ পানি না পায় এবং তদ্দরুন এতদিন পর্যন্তঅযূ কিংবা গোসল করিতে না পারে তাহা হইলে তায়াম্মুম করিয়াই সে অযূ ও গোসলের কাজ সারিবে। উভয় অবস্থায় তায়াম্মুম পবিত্রতা অর্জনের জন্য যথেষ্ট হইবে। হাদীসে এই কথাও স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে যে, উত্তরকালে কোন এক সময় পানি পাইলে তখন অযূ ও গোসল করা তাহার কর্তব্য।
***************************************************
হযরত আম্মার (রা) হইতে বর্ণিত, তিনি বলিয়াছেনঃ এক ব্যক্তি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের নিকট আসিয়া বলিলঃ আমি অপবিত্র হইয়াছি- গোসল করা প্রয়োজন, কিন্তু পানি পাইতেছি না বলিয়া গোসল করিতে পারি না। এরূপ অবস্থায় আমার কি করা প্রয়োজন? (আম্মার বলেন) লোকটির এই প্রশ্ন শুনিয়া আমি হযরত উমর (রা)-কে সম্বোধন করিয়া বলিলামঃ আপনার হয়ত স্মরণ আছে, অতীতে কোন এক সময় আমরা এক সফরে ছিলাম, তখন আমাদের গোসলের প্রয়োজন হইয়াছিল। কিন্তু পানি না পাওয়ার কারণে আপনি নামায পড়িলেন না। আর আমি পানি না পাইয়া বালু দ্বারাই সমস্ত শরীর মাখিয়া বালু গোসল করিলাম। পরে নবী করীম (স০- কে এই কতা বণায় তিনি ইরশাদ করিলেনঃ তোমার শুধু এইরূপ করায় যথেষ্ট ছিল- এই বরিয়া তিনি তাঁহার দুইখানি হাত মাটির উপর ফেলিলেন এবং উহাতে ফুৎকার দিয়া মাটি- কণা ঝাড়িয়া ফেলিলেন। অত:পর সেই হাত দ্বারা স্বীয় মুখমন্ডল ও বাহু দুইকানিমারিয়া দিলেন। – বুখারী মুসলিম
ব্যাখ্যা পানি না পাওয়া গেলে শরীর পাক করণ এবং অযূর জন্য শুধু তায়াম্মুম করাই পবিত্রতার্জনের জন্য যথেষ্ট। আর সে তায়াম্মুমের জন্যও সমস্ত শরীর মাটি মাখার প্রয়োজন করে না। দুইখানি হাত মাটিতে লাগাইয়া উহা হইতে মাটি কণা ঝাড়িয়া ফেলিয়া মুখমন্ডল এবং কনুই সহ হাত দুইখানি মলিয়া দিলেই যথেষ্ট হইবে। তবে শর্ত এই যে, মাটিকে অবশ্যই পাক ও পবিত্র হইতে হইবে।
তায়াম্মুম করিয়া একবার নামায পড়িয়া লওয়ার পর পানি পাওয়া গেলে পুনরায সেই নামায পড়িতে হইবে কিনা, ইহা একটা প্রশ্ন এবং এই প্রশ্ন অনেতকর মনেই জাগিতে পারে। ইহার জওয়াব পাওযা যায আবূ দাউদ ও সুনানে দারমী বর্ণিত একটি হাদীসে। তাহাতে বলা হইয়াছে, দুইজন লোক সফরে পানি না পাওয়ার কারনে তায়াম্মুম করিয়া নামায পড়িয়াছিলেন। পরে পানি পাইয়া একজন সেই নামায আবার পড়িলেন, অপরজন পড়িলেন না। নবী করীম (স) এই কাহিনী শুনিয়া যে লোক পুনরায় নামায পড়েন নাই, তাঁহাকে বলিলেনঃ
************************
তুমি ঠিক সুন্নাত মুতাবিকই কাজ করিয়াছ। তোমার প্রথম নামাযই তোমার জন্য যথেষ্ট।
আর যে ব্যক্তি নামায পুনরায় পড়িয়াছিলেন, তাঁহাকে বলিলেনঃ
**************** দুইবার নামায পড়ার সওয়াব তুমি অবশ্যই পাইবে। শরীরে যদি এমন কোন আঘাত বা রোগ থাকে যাহার দরুন পানি ব্যবহার করা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হইতে পারে, তাহার যে তায়াম্মুম করাই যথেষ্ট, তাহা যেমন কুরআনের আয়াত হইতে স্পষ্ট ও অকাট্যভাবে জানা যায় তেমন আবূ দাউদ ও দারে কুতনী বর্ণিত একহি হাদীস হইতেও জানিতে পারা যায়। নবী করীমের জীবদ্দশায় একজন লোকের শরীরে আঘাত ছিল। তাহার শরীর নাপাক হওয়ার কারণে নিরুপায় মনে করিয়া গোসল করে। ইহার পর তাহার মৃত্যু ঘটে। নবী করীম (স) এই কথা শুনিয়া বলিলেনঃ
*************************
লোকগুলি ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করিয়াছে, আল্লাহও উহাদের হত্যা করুন। তাহারা যখন করণীয় জানিত না, তখন তাহারা সংশ্লিষ্ট লোকদের নিকট জিজ্ঞাসা করিল না কেন? জিজ্ঞাসাই হইল সব বিভ্রান্তির প্রতিবিধান। এই ব্যক্তির গোসল করার পরিবর্তে কেবল তায়াম্মুম করা ও জখমের উপর পানি ছিটাইয়া দেওয়াই যথেষ্ট ছিল। অথবা জখমের উপর পট্টি লাগাইয়া উহার উপর ভিজা হাত মলিয়া দেওয়া এবং দেহের অন্যান্য সব অংশ ধুইয়া ফেলাই যথেষ্ট ছিল।