নামায
সুন্নাত নামায
=========================
হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) জুহরের ফরয নামাযের পূর্বে চার রাক্Õআত ও উহার পরে দুই রাক্Õআত সুন্নাত পড়িতেন। ইমাম বুখারী এই পর্যায়ে হযরত আয়েশা (রা) হইতে যে হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন তাহাতে তিনি বলিয়াছেঃ
============================
নবী করীম (স) জুহরের ফরযের পূর্বে চার রাক্Õআত ও ফজরের ফরযের পূর্বে দুই রাক্Õআত নামায কখনো না পড়িয়া ছাড়িতেন না।
হযরত কখনো না পড়িয়া ছাড়িতেন না।
হযরত উস্মে হাবীবা (রা) হইতে বর্ণিত হাদীসে সুন্নাত নামাযের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ
=============================
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, যে লোক দিন ও রাত্রির মধ্যে মোট বারো রাক্Õআত (সুন্নাত) নামায পড়িবে, তাহার জন্য জান্নাতে একখানি ঘর নির্মিত হইবে। তাহা জুহরের পূর্বে চার রাক্Õআত ও পরে দুই রাক্Õআত, মাগরিবের পর দুই রাক্Õআত, এশার পর দুই রাক্আত আর ফজরের পূর্বে ভোরের নামায দুই রাক্Õআত।
ইমাম তিরমিযী ইহাকে একটি উত্তম হাদীস বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। এই সব কয়াটিই সুন্নাতে মুয়াক্কিদা। তবে ফজরের সুন্নাত দুই রাক্Õআত অধিকতর তাকীদপূর্ণ। কেহ কেহ উহাকে ওয়াজিবও বলিয়াছেন। কোন কোন হাদীস হইতে একথাও প্রমাণিত হইয়াছে যে, নবী করীম (স) জুহরের পূর্বে দুই রাক্Õআত সুন্নাত পড়িয়াছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বলিয়াছেনঃ
============================
আমি নবী করীম (স) হইতে দশ রাক্আত সুন্নাত স্মরণ রাখিয়াছি। তাহা হইলঃ জুহরের পূর্বে দুই রাক্Õআত ও পরে দুই রাক্আত, মাগরিবের পরে দুই রাক্Õআত তাঁহার বাড়ীতে, এশার পর দুই রাক্আত আর ফজরের পূর্বে দুই রাক্আত।
এই হাদীসে জুহরের পূর্বে দুই রাক্আত সুন্নাতের কথা বলা হইয়াছে অথচ হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত উপরোদ্ধৃত হাদীসে চার রাক্আত বলা হইয়াছে। ইহার একটি কারণ হইল যিনি যাহা দেখিয়াছেন, তিনি তাহা বলিয়াছেন অথবা ইবনে উমর (রা) ভুল করিয়া চার রাক্আতের স্থলে দুই রাক্আত বলিয়াছেন কিংবা নবী করীম (স)-ই বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন রকম-কখনো চার রাক্আত কখনো দুই রাক্আত পড়িয়াছেন। ইহাসবই সহীহ বর্ণনা।
ইকামত শুরু হওয়ার পর নামায
============================
হযরত মালিক ইবনে বহায়নাতা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) এক ব্যক্তিকে এমন সময় দুই রাক্আত নামায পড়িতে দেখিতে পাইলেন যখন ইতিপূর্বেই ফরয নামাযের ইকামত বলা হইয়াছে। পরে রাসূলে করীম (স) যখন নামায পড়া শেষ করিয়া ফিরিলেন তখন লোকরা তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিল। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ সকাল বেলা নামায কি চার রাক্আত? সকাল বেলায় নামায কি চার রাক্আত?
ব্যাখ্যা হাদীসের শেষ বাক্য-রাসূলে করীম (স)-এর উক্তি হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, ইহা ফজরের নামাযকালীন একটি ঘটনার বিস্তারিত রূপ সম্ভবত এই ছিল যে, ফজরের জামাআতের ইকামত হওয়ার পর নবী করীম (স) যখন মসজিদে নামায পড়িতে-নামাযেরইমামতি করিতে-আসিলেন, তখন তিনি এক ব্যক্তিতে সুন্নাত নামাযের দুই রাক্আত পড়িতে দেখিলেন। ইহা তাঁহার মনঃপূত হইল না। ফলে তিনি এমন কিছু বলিয়াছেন, যাহাতে এই বিষয়ে লোকদের মনে প্রশ্ন জাগিয়াছিল। নামায শেষ হইবার পর লোকেরা নবী করীম (স)-কে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি দুইবার বলিলেনঃ ফজরের নামায কি চার রাক্আত?-ইহা ছাড়া আর কিছুই বলিলেন না।
এই বিবরণ হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, ফরয নামাযের ইকামত হইয়া যাওয়ার পর সুন্নাত নামায পড়িতে দেখিয়া নবী করীম (স) অসন্তুষ্ট হইয়া ছিলেন এবং ফজরের ফরয নামায চার রাক্আত নাকি তাহা রাগতঃ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। আর ইহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, ইকামত শুরু হওয়ার পর সুন্নাত পড়া শুরু করা যাইতে পারে না-জায়েয নয়। এই কারণেই ইমাম বুখারী (রা) এই হাদীসটি যে পরিচ্ছেদের নীচে উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহার শিরোনাম হইলঃ
============================
ফরয নামাযের জামাআতের ইকামত হইয়া গেলে বা শুরু হইয়া গেলে তখন সেই ফরয না মায ছাড়া অন্য কোন নামায পড়া যাইবে না-এরঅধ্যায়।
মুলত এই কথাগুলি একটি হাদীসের অংশ, সেই হাদীসটি সহীহ্, মুসলিম ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থাদিতে উদ্ধৃত হইয়াছে। উহার মূল বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরায়রা (রা)। বুখারীর উপরিউদ্ধৃত হাদীসটি শুধু ফরয নামায সম্পর্কে প্রযোজ্য। কাজেই মূল প্রতিপাদ্য অর্থাৎ ইকামত হইতে লাগিলে কিংবা হইয়া গেলে তখন সেই ফরয ছাড়া অন্য কোন নামাযই পড়া যাইবে না-পড়িতে শুরু করা যাইবে না। বুখারী তাঁহার তারীখ গ্রন্থে এবং বাজ্জার প্রমুখ হযরত আনাস (রা) হইতে অপর মরফু হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাহাতে স্পষ্ষ্ট বলা হইয়াছেঃ
=========================
ফজরের জামাআতের ইকামত বলা শুরু হইলে কিংবা ইকামত বলা শেষ হওয়ার পর উহার দুই রাক্আত সুন্নাত পড়িতে নবী করীম (স) নিষেধ করিয়াছেন।
অপর এক বর্ণনায় সাহাবিগণ স্পষ্ট ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
============================
ইয়া রাসূল। ইকামতের পর ফজরের দুই রাক্আত সুন্নাতও কি পড়া নিষেধ? ইহার জবাবে তিনি বলেনঃ
============================
হ্যাঁ, ফজরের সুন্নাত দুই রাক্আতও পড়া যাইবে না।
মোট কথা, ইকামত শুরু হইলে সুন্নাত বা নফল কোন নামাযই পড়া যাইবে না। এই পর্যায়ে ইমাম কুরতুবী লিখিয়াছেনঃ
যে লোক মসজিদে প্রবেশ করিয়াছে, কিন্তু সে ফজর-পূর্ব দুই রাক্আত সুন্নাত পড়ে নাই, ওদিকে ইকামত শুরু হইয়া গিয়াছে এই সময় তাহার কি করা উচিত, এ বিষয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতবৈষম্য রহিয়াছে। ইমাম মালি (রা) বলিয়াছেন, সেই লোক ইমামের সঙ্গে ফরয নামায পড়িতে শুরু করিবে, তখন সুন্নাত পড়ায় লাগিয়া যাইবে না। কিন্তু যদি মসজিদে প্রবেশ না করিয়া থাকে ও ওদিকে জামাআত শুরু হইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে মসজিদের বাহিরে দাঁড়াইয়া সুন্নাত দুই রাক্আত পড়িয়া লইবে-অবশ্য যদি জামাআতের নামাযের এক রাক্আত হারাইবার ভয় না থাকে,তবে। এই সময় মসজিদের ছেহেনে দাঁড়াইয়া সুন্নাত পড়া শুরু করা জায়েয হইবে না। আর যদি জামাআতের নামাযের এক রাক্আত হারাইবার আশংকা হয়, তাহা হইলে তখনই জামাআতে শামিল হওয়া যাইবে। সুন্নাত পড়র পড়িবে।
ইমাম আবু হানিফা ও তাঁহার সঙ্গিগণ বলিয়াছেনঃ এই সময় যদি জামাআতের দুইরাক্আত নামাযই হারাইয়া ফেলার আশংকা হয়, দ্বিতীয় রাক্আতের রুকুতেও ইমামের সহিত নামাযে শরীক হইতে পারা সম্ভাবনা না থাকে, তবেই তখন সুন্নাত পড়িতে শুরু না করিয়া ইমামের সহিত শামিল হইয়া যাবে। আর যদি জামাআতের পুরা এক রাক্আত নামায পাওয়ারও আশা থাকে, তাহা হইলে মসজিদের বাহিরে দাঁড়াইয়া ফজরের সুন্নাত দুই রাক্আত পড়িয়া লইবে ও পরে ইমামের সহিত শামিল হইবে। ইমাম আওযায়ীও এই মত সমর্থন করিয়াছেন। তবে জামাআতের শেষ রাক্আতও হারাইবার ভয় না হইলে মসজিদের মধ্যে দাঁড়াইয়াই সুন্নাত দুই রাক্আত পড়া তিনি জায়েম মনে করেন।
ইমাম সওরী বলিয়াছেনঃ জামআতের এক রাক্আতেরও হারাইবার ভয় হইলে ইমামের সহিত শরীক হইয়া যাইবে, সুন্নক পড়িতে শুরু করিবে না। অন্যথায় মসজিদে প্রবেশ করিয়া থাকিলেও সেখানেই সুন্নাত দুই রাকআত পড়িয়া লইবে।
ইবনে হারান বলিয়াছেনঃ ইকামত শুরু হইয়া গেলে কোন অ-ফরয নামায পড়িতে শুরু করা যাইবে না। পরে ফজরের সুন্নাত দুই রাক্আতের কথা ইহা হইতে স্বতন্ত্র।
ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেনঃ মসজিদে প্রবেশ করিয়া যদি দেখে যে, ইকামত হইয়া গিয়াছে, তাহা হইলে ইমামের সঙ্গে জামাআতের শামিল হইয়া যাইবে। এই সময় সুন্নাত দুই রাক্আত মাত্রই পড়া যাইবে না। না মসজিদের ভিতরে, না উহার বাহিরে। ইমাম তাবারী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলও এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। এই মতই অধিক যুক্তিসঙ্গ ও সহিত দলীল ভিত্তিক মনে হয়। ইহাদের দলীল রাসূলের পূর্বোদ্ধৃত বাণীঃ ইকামত হইয়া গেলে বা হইতে থাকিলে তখন সেই সময়কার নির্দিষ্ট ফরয ছাড়া অন্য কোন নামাযই পড়া যাইবে না।
ইমাম আবু হানিফা ও অন্যান্যদের দলীল হইল হযরত আবদুল্লা ইবনে উমর সম্পর্কিত একটি।
বর্ণনাঃ তিনি নামাযের জন্য আসিলেন, দেখিলেন ইমাম ফজরের নামায পড়িতেছেন। তখন তিনি জামাআতে শামিল না হইয়া হযরত হাফসার হুজরায় গিয়া সুন্নাত দুই রাক্আত পড়িলেন। তাহার পর ইমামের সহিত শামিল হইয়া ফরয পড়িলেন। ইমাম সওরী ও ইমাম
আওযায়ী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসজিদে প্রবেশ করিয়া দেখেন যে, জামাআত শুরু হইয়া গিয়াছে। তখন তিনি স্তম্ভের পাশে দাঁড়াইয়া সুন্নাত দুই রাক্আত পড়িলেন ওপরে ফরয জামাআতে শরীক হইলেন। তবে যদি কেহ ইকামত শুরু হওয়ার আগেই সুন্নাত বা নফল পড়িতে শুরু করিয়া থাকে, তাহা হইলে সে উহা সম্পূর্ন না করিয়া ছাড়িতে পারিবেন না। কেননা তাহা ছাড়িয়া দিলে সে নামায অসম্পূর্ন থাকিয়া ও বাতিল হইয়া যায় অথচ কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ
============= তোমার তোদের আমল বিনষ্ট করিও না।
=============================
এই পর্যায়ের আরো দুইটি হাদীস এখানে উদ্ধুত না করা হইলে দায়িত্ব পালন হয় না। তন্মধ্যে একটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মারজাস হইতে বণির্ত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ
=========================
এক ব্যক্তি মসাজদে প্রবেশ করিল। তখন নবী করীম (স) ফরয নামায পড়তে ব্যস্ত ছিলেন। লোকটি তখন মসজিদের একপাশে দাঁড়াইয়া দুই রাক্আত সুন্নাত পড়িল। পরে রাসূলে করীম (স)-এর সহিত জামাআতে শরীক হইল। নবী করীম (স ) নামাযের সালাম ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ হে ব্যক্তি, তুমি কোন নামায লইয়া এত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলে, তোমার নিজের একক নামায লইয়া, না আমাদের সঙ্গে তোমার নামায লইয়া?-মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী
এই হাদীসে জানা যায়, নবী করীম (স) ঐ সময় সুন্নাত নামায পড়ার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন মাত্র। পড়িতে একেবারেই নিষেধ করেন নাই এবং যাহা পড়িয়াছিলেন, তাহা আবার পড়িতেও বলেন নাই। ইহা হইতে জামাআত শুরু হওয়ার পরও সুন্নাত পড়া শুরু কার জায়েজ মনে হয়-যদিও মারূহ।
দ্বিতীয় হাদীসটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ
============================
আমি নামায পড়িতেছিলাম। এই সময় মুয়াযযিন ইকামত বলিতে শুরু করিল। তখন নবী করীম (স) আমাকে টান দিয়া বলিলেনঃ তুমি কি ফজরের চার রাক্আত পড়িবে?
এই হাদীসটি বুখারী ও মুসলীম-এর হাদীস গ্রহণের মান অনুযায়ী সহীহ্। তৃতীয় হাদীসটি হযরত আবুমূসা আল-আশআরী হতে বর্ণিত হইয়াছে।
ফজরের না পড়া সুন্নাত
============================
মুহাম্মদ ইবনে ইবরাইম তাঁহার দাদা কায়স (রা) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স) বাহির হইয়া আসিলেন, তখন নামাযের একামত বলা হইল ও আমি তাঁহার সহিত ফজরের ফরয নামায পড়িলাম। পরে নবী করীম (স) (পিছনের দিকে) ফিরিলেন ও আমাকে নামায পড়িতে দেখিতে পাইলেন। তখন তিনি বলিলেন, হে কায়স, থাম। তুমি কি এক সঙ্গে দুই নামায পড়িতেছ? আমি বলিলামঃ ইয়া রাসূল। আমি ফজরের সুন্নাত দুই রাক্আত পড়ি নাই (তাহাই এখন পড়িলাম)। তিনি ইহা শুনিয়া বলিলেনঃ তাহা হইলে আপত্তি নাই।-তিরমিযী
ব্যাখ্যা এই হাদীসের মূল বর্ণনাকারী কায়স ইবনে আমর ইবনে সহল আনসারী মদীনার অধিবাসী একজন সাহাবী। তিনি নিজেরই একটি ঘটনা বর্ণনা করিয়াছেন এই হাদীসে। এই হাদীসটি হইতে জানা যায়, ফজরের ফরয নামায আদায় করার পর একজন সাহাবীকে নামায পড়িতে দেখিয়া নবী করীম (স) আপত্তি জানাইয়াছিলেন এবং লোকটিকে ডাকিয়া থামিতে ও নামায বন্ধ করিতে বলিয়াছিলেন।
ইহার কারণ এই যে, ফজরের নামাযের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত অন্য কোন নামায পড়া পূর্ব হইতে নিষিদ্ধ। বুখারী শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
==========================
ফজরের ফরয নামাযের পর হইতে সূর্যোদায় পর্যন্ত এবং আসরের নামাযের পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত অন্য কোন নামায পড়িতে নবী করীম (স) নিষেধ করিয়াছেন।
কিন্তু আলোচ্য হাদিসের শেষ কথা হইতে প্রমাণিত হয় যে, কোন ফজরের দুই রাক্আত সুন্নাত ফরয দুই রাক্আতের পূর্বে পড়িতে না পারিলে তাহা সেই সময় সূর্যোদয়ের পূর্বে ফরয নামায শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পড়া যায়। হযরত কায়েসকে তাহা পড়িতে দেখিয়া নবী করীম (স) প্রথমত আপত্তি জানাইয়াছিলেন। তিনি কায়েসকে থামিতে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেনঃ
=========== এক সঙ্গে দুই নামায?
এই জিজ্ঞাসা নিষেধাত্মক। অর্থাৎ
========
এক ফরয নামাযের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের দুইটি ফরয নামায পড়িতেছে?
অথচ ফজরের ফরয আদায়ের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত কোন নফল নামায পড়া জায়েম নহে। ইহার জবাবে সাহাবী বলিয়াছেনঃ
================ আমি ফজরের সুন্নাত দুই রাক্আত পূর্বে পড়ি নাই।
আবু দাউদের বর্ণনায় কথাটির হইলঃ
============================
আমি ফজরের ফরয দুই রাক্আতের পূর্বে সুন্নাত দুই রাক্আত পড়ি নাই। কাজেই তাহা আমি এখন পড়িতেছি।
ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ === ইহার অর্থ
========================
যদি ব্যাপার তাহাই হইয়া থাকে তাহা হইলে এই সুন্নাত এখন পড়ায় তোমার পক্ষে কোন দোষ নাই।
আবু দাউদের অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
============= জওয়াব শুনিয়া নবী করীম (স) চুপ থাকিলেন। ইবনে মালিক মুহাদ্দিস বলিয়াছেন, রাসূসলে করীমের এই চুপ থাকা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, ফজরের সুন্নাত ফরযের পূর্বে পড়িতে না পারিলে ফরয পড়ার পরই তাহা পড়া যাইতে পারে। ইমাম শাফেয়ী্ও এই মত পোষণ করেন। ইমাম আবু হানীফা ইহা সমর্থন করেন নাই। মুন্না আলী আল-কারী মিশকাতের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন, এই হাদীসটি সপ্রমাণিত নয়। তাই ইহা ইমাম আবু হানীফার মতের বিরুদ্ধে দলীল হইতে পারে না।
ইহার জবাবে বলা হইয়াছে, আলোচ্য তিরমিযী উদ্ধৃত হাদীসটি সনদের দিক দিয়া যয়ীফ ও অপ্রমাণিত হইলেও তাহাতে কোন ক্ষতি নাই। কেননা এই ঘটনার বিবরণ অন্যান্য কয়েকটি সহীহ সনদ সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে। তাহা ছাড়া মুহাদ্দিস ইরাকী এই হাদীসের সনদকে======== বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। আর একই হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা যে পরষ্পরের পরিপূরক ও পরষ্পরের ব্যাখ্যা দানকারী তাহা সর্বজন সমর্থিত।আবু তাইয়্যিব সনদী হানাফী তিরমিযীর আলোচ্য হাদীসটির ব্যাখ্যায় রাসূলে করীম (স)-এর শেষ কথাটির অর্থ করিয়াছেন এই ভায়ায়ঃ
==============
অর্থাৎ আজকের ফজরের সুন্নাত যদি তুমি এখন পড়িয়া থাক, তাহা হইলে সেইজন তোমার কোন দোষ হইবে না, তোমার কোন গুনাহ হইবে না এবং সেই জন্য তোমাকে তিরস্কার করা যাইবে না।
ফজরের ফরযের পূর্বে দুই রাক্আত সুন্নাত পড়া না হইয়া থাকিলে তাহা পরে তিন সময়ে পড়া যায়। হয় ফরয পড়ার পর সঙ্গে সঙ্গে পড়িবে, না হয় সূর্যোদয়ের পর পড়িবে। নতুবা জুহরের নামাযের পূর্বে পড়িবে। কিন্তু ভুলিয়া যাওয়ার ভয়ে ফরযের পর পরই পড়িয়া লওয়া উত্তম-এই কথা অনেকে মনে করেন। কিন্তু এই পর্যায়ে একটি হাদীস স্পষ্টঃ
========================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোক ফজরের সুন্নাত দুই রাক্আত (ফরযের পূর্বে) পড়ে নাই, সে যেন উহা সূর্যোদয়ের পরে পড়িয়া নেয়।
-তিরমিযী
ব্যাখ্যা হাদীসের মূল কথা সুষ্ট। ফরয পড়িবার পূর্বে ফজরের দুই রাক্আত সুন্নাত যদি কেহ না পড়িয়া বা পড়িতে না পারিয়া থাকে তাহা হইলে সূর্যোদয়ের পর পড়িয়া নেওয়ার নির্দেশ এখানে স্পষ্ট ভাষায় দেওয়া হইয়াছে।
দারে-কুতনী ও হাকিম-এর বর্ণনায় এই কথাটির ভাষা ভিন্ন ধরণেরঃ
====================
যে লোক ফজরের দুই রাক্আত সুন্নাত নামায সূর্যোদয়ের পূর্বে পড়িতে পারে নাই, সে যেন তাহা পড়িয়া লয়।
মুহাদ্দিস হাকিম একটি স্বতন্ত্র বর্ণনায় এই কথা উদ্ধৃত করিয়াছেন নিজের ভাষায়।
=========================
যে লোক ফজরের সুন্নাত দুই রাক্আত পড়িতে ভুলিয়া গিয়াছে, সে যেন তাহা পড়ে তখন, যখন সূর্যোদয় হইয়া গিয়াছে।
ইমাম তিরমিযী প্রথমোক্ত হাদীসটি উদ্ধৃত করিবার পর লিখিয়াছেনঃ
========================
বর্ণিত হইয়াছে যে, হযরত ইবনে উমর এই হাদীস অনুযায়ী কাজ করিয়াছেন অর্থাৎ তিনি ফজরের পূর্বে পড়িতে না পারিলে সূর্যোদয়ের পূর্বে পড়িয়াছেন এবং কোন কোন বিশেষজ্ঞও এইরূপ আমল করিতেন। সুফিয়ান সওরী, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় ও আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক এই পর্যায়ে গণ্য। ===========
ইমাম শাওকানী লিখিয়াছেনঃ ইমাম শাফেয়ী ফজরের পর এই দুই রাক্আত নামায পড়িয়াছেন এবং তাহা কাযা গণ্য হইত না। তিনি ইহাও বলিয়াছেন যে, ফজরের ফরযের পূর্বে সুন্নাত পড়া না হইয়া থাকিলে সূর্যোদয়ের পূর্বে তাহা পড়াই যাইবে না এবং অব্যশই সূর্যোদয়ের পরে পড়িতে হইবে, এই কথা হাদীসে বলা হয় নাই। ইহাতে শুধু সেই দুই ব্যক্তির জন্যই নির্দেশ রহিয়াছে, যে এই দুই রাক্আত ইতিপূর্বে পড়িতে পারে নাই। তাহাকে বলা হইয়াছে. সে যেন তাহা সূর্যোদয়ের পর পড়িয়া লয়, যেন উহা ভুলিয়া না যায়। কেননা যথাসময়ে উহা না পড়িয়া থাকিলে তাহা তো পরে যে-কোন সময় পড়িতেই হইবে। অতঃপর লিখিয়াছেনঃ
========================
সেই দুই রাক্আত সুন্নাত ফরয নামাযের পরই পড়িতে নিষেধ করা হইয়াছে-এমন কথা এই হাদীস হইতে বুঝা যায় না।
বরং দারে কুতনী, হাকেম ও বায়হাকী শরীফে উদ্ধৃত বর্ণনায় এই হাদীসের ব্যাখ্যা হইলঃ
=======================
যে লোক সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজরের সুন্নাত দুই রাক্আত পড়িতে পারে নাই, সে যেন তাহা পড়িয়া লয়। অর্থাৎ ফরযের পড়া দোষের নয়।============
জুহরের চার রাক্আত সুন্নাত
====================
হযরত আয়েশা (রা) হইত বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত নবী করীম (স) জুহরের পূর্বে চার রাক্আত সুন্নাত পড়িতে না পারিলে তিনি তাহা উহার পরে পড়িতেন।-তিরমিযী
ব্যাখ্যা অর্থাৎ জুহরের ফরয-পূর্বের চার রাক্আত সুন্নাত নবী করীম (স) কিছুতেই না পড়িয়া ছাড়িতেন না। পূর্বে-যথাসময়ে পড়িতে না পারিলে তাহা পরে পড়িতেন। কিন্তু পরে কখন?-পড়িতেন ফরয পড়ার পর দুই রাক্আত সুন্নাত আদায় করার পর। ইবনে মাজাহ্ উদ্ধৃত এই হাদীসের ভাষা হইতেই তাহা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। তাহা এইরূপঃ
============================
রাসূলে করীম (স) জুহরের ফরয-পূর্বে চার রাক্আত (সুন্নাত) যখন পূর্বে পড়িতে না পারিতেন, তখন তিনি তাহা জুহরের ফরয-পরবর্তী দুই রাক্আত সুন্নাতের পর পড়িতেন অর্থাৎ ফরয পড়া হইলে প্রথমে দুই রাক্আত সুন্নাত পড়িতেন।
এই হাদীস হইতে ফরয-পূর্ব সুন্নাতের পুরাপুরি সংরক্ষণ এবং ফরযের শেষ সময় পর্যন্ত উহা পড়ার সময়সীমা দীর্ঘ্যায়িত হওয়ার কথা প্রমাণিত হয়। কেননা ফরয পড়া হইলেই পূর্ববতী না-পড়া সুন্নাতের সময়ে যদি নিঃশোষিত হইয়া যাইত, তাহা হইলে পরে পড়া নামায কাযা বলিয়া গণ্য হইত এবং তাহা ফরয-পরবর্তী দুই রাক্আত সুন্নাতের পূর্বেই পড়িতে হইত। কিন্তু হাদীস হইতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে, যে নবী করীম (স) এই চার রাক্আত সুন্নাত নামাযের ফরযের পূর্বে পড়িতে না পারিয়া পড়িয়াছেন পরবর্তী দুই রাক্আতের পরে। অবশ্য কথাটিকে উল্টাইয়া এইভাবেও বলা যায় যে, পূর্বে না পড়িয়া থাকিলেও উহা যদি কাযা না-ই হয়-যদি তাহা যথাসময়ে আদায় গণ্য হয় তাহা হইলে তাহা শেষ দুই রাকআতের পূর্বেই পড়িতে হইতে হইত। কিন্তু তাহা যেহেতু ফরয-পরবর্তী দুই রাক্আতের পূর্বে পড়া হয় না-পরার বিধান দেওয়া হয় নাই, সেইজন্য দুই রাক্আতের পরে তাহা পড়িবার নিদের্শ করা হইয়াছে, এই জন্য বলিতে হইবে যে, এই চার রাক্আত সুন্নাত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঠিকভাবেই আদায় করা হইয়াছে।=========
নামাযের ইমামত
============================
হযরত আবু মাসউদ আনসারী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন, নামাযের জামাআতে ইমামতি করিবে সেই ব্যক্তি, যে উপস্থিত লোকদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অধিক শুদ্ধভাবে পাঠ করিতে সক্ষম। এই দিক দিয়া সব লোক এক ও সমান হইলে ইমামতি করিবে সেই লোক, যে সুন্নাত ও শরীয়ত সম্পর্কে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন ও বিদ্ধান হইবে। এই গুণেও সকলে সমান হলে ইমামতি করিবে সেই লোক, যে আগে হিজরত করিয়াছে। হিজরতের সময়ও যদি তাহাদের বয়স সমান ও একই থাকে তাহা হইলে বয়সের দিক দিয়া অগ্রবতী ব্যক্তি ইমাম হইবে। (সেই সঙ্গে এই কথাও মনে রাখিবে যে) কেহ যেন অপর কাহারো প্রভাব প্রতিপত্তির অধীন এলাকা ও পরিবেশে সেই লোকের উপর ইমাম হইয়া না বসে এবং তাহার ঘরে তাহার বসিবার আসনে তাহার অনুমতি ছাড়া যেন কেহ না বসে।
-মুসলিম. তিরমিযী, নাসায়ী
ব্যাখ্যা দ্বীন-ইসলামের যাবতীয় আমল ও কাজের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রবতী কাজ হইল নামায। দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ বিধানে নামাযের গুরুত্ব ঠিক তাহাই, যাহা মানুষের গোটা দেহ সংস্থায় রহিয়াছে উহার আত্মার বা প্রাণের। কাজেই উহার ইমাম হওয়ার পদমর্যাদা যে অতি বড় দায়িত্বপূর্ণ ও প্রাণ প্রকম্পকারী ব্যাপার, তাহাতে সন্দেহ নাই। এক দিক দিয়া ইহা রাসূলে করীমের নায়েবী বা প্রতিনিধিত্ব করার সমান। এই কারণে মসজিদের মুসল্লী ও মুকতাদীদের মধ্য হইতে এমন ব্যক্তিকেই ইমাম বানাইতে হইবে, এই পদ ও দায়িত্বের জন্য যাহার যোগ্যতা অন্যান্যের তুলনায় অধিক রহিয়াছে। এই দিক দিয়া অপেক্ষাকৃতভাবে যে লোক রাসূলে করীমের অধিক নিকটবতী, তাহার সহিত যাহার সাদৃশ্য ও একাত্মতা রহিয়াছে অধিক মাত্রায়, রাসূলে করীমের দ্বীনী উত্তরাধিকার যে লোক বেশী লাভ করিয়াছে, তাহাকেই ইমাম হইতে হইবে। এই দৃষ্টিতে বিচার-বিবেচনা করিলে বুঝিতে পারা যাইবে যে, যে লোক সত্যিকার লাভের পর কুরআন মজীদের সহিত বিশেষ ও গভীর সম্পর্ক স্থাপন করিয়াছে, উহাকে স্মরণে রাখিয়াছে, উহার অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করিয়াছে, নিজের মন ও মগজে দৃঢ়মূল করিয়া লইয়াছে, তাঁহার দাওয়াত ও আইন বিধান যে লোক ভাল ভাবে বুঝিতে পারিয়াছে, উহাকে নিজের মধ্যে প্রতিমূর্ত ও প্রতিফলিত করিয়া লইয়াছে, রাসূলে করীমের উত্তরাধীকারীদের মধ্যে সে-ই বড় উত্তরাধিকারী। আর যাহারা এই দিক দিয়া পশ্চাতে পড়িয়াছে, যাহারা ভাগ্যাহত, তাহাদের তুলনায় নামাযের ইমামত ও সামাজিক নেতৃত্ব করার অধিকার সর্বাপেক্ষা বেশী পাইবে প্রথমোক্ত ধরনের লোকেরা। সব নামাযী যদি এই দিক দিয়া সমান হয়, তাহা হইলে কুরআনের পর সুন্নাতের স্থান ও মর্যাদা বিধায় অগ্রাধিকার দেওয়া হইবে তাহাকে, যে সুন্নাত, রাসূলের হাদীস ও শরীয়তের ইলমে অন্যদের তুলনায় বেশী পারদর্শী হইবে। এই ক্ষেত্রেও সব লোক সমান হইলে দেখিতে হইবে তাকওয়া পরহেযগারী ও নৈতিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া বিশিষ্ট কে? এবং এই দৃষ্টিতে যাহাকে অগ্রসর পাওয়া যাইবে তাহাকেই ইমাম রাবানাইতে হইবে। আর এই দৃষ্টিতে যদি লোকেরা সমান হয়, তাহা হইলে তুলনামূলকভাবে বেশী বয়সের লোককেই ইমাম বানাইতে হইবে। তিরমিযী উদ্ধৃত হাদীসে এখানে শব্দ হইল=========বয়সের দিক দিয়া বড়। কেননা বয়সের বড়ত্ব সর্বজনস্বীকৃত। অল্প বয়সের ইমামের প্রতি আস্থা ও ভক্তি ততটা গাঢ় না হওয়াই স্বাভাবিক।
নামাযের ইমামতের জন্য এখানে বর্ণিত পরস্পরা খুবই যুক্তিসঙ্গত। বিবেক ও বিজ্ঞানের বিচারেও ইহা নির্ভুল। মনে হয় এই ক্ষেত্রে ইহা ছাড়া অন্য কিছু যেন হইতেই পারে না। হইলে অবাঞ্চণীয় হইয়া যাইবে। বস্তুত রাসুলে করীমের উপস্থাপিত সব ব্যবস্থাই এমনি সুন্দর, নির্ভুল ও অতীব যুক্তিসঙ্গত।
হাদীসের বাক্য ========-এর সোজা তরজমা করা হইয়াছে, যে লোকদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অধিক শুদ্ধ ও নির্ভূলভাবে পাঠ করিতে সক্ষম। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে, ইহা কুরআন শুধু হেফ্জ করাকেই বুঝায় না, বুঝায় না খুব বেশী মাত্রায় শুধু তিলাওয়াত করা। বরং কুরআন হেফয করার সঙ্গে সঙ্গে উহার বিশেষ জ্ঞান ও উহার সহিত বিশেষ সম্পর্ক রক্ষাকারীকেই বুঝানো হইয়াছে। নবী করীম (স)-এর যুগে যাহাদিগকে কুররা বা কারী বলা হইত, ইহাই ছিল তাহাদের বৈশিষ্ট্যের কারণ। এই হিসাবে হাদীসের তাৎপর্য এই হইবে যে, নামাযের ইমামতের জন্য অধিক যোগ্য হইল সেই ব্যক্তি, যে লোক আল্লাহর কিতাব সম্পর্কিত ইলম ও উহার সহিত সম্পর্ক রক্ষার দিক দিয়া অন্যদের তুলনায় অগ্রবতী। ইহার পর সুন্নাত ও শরীয়ত সম্পর্কিত ইলম হইল ফযীলতের দ্বিতীয় মান। বলা বাহুল্য, তদনুযায়ী আমলও উহাতে গণ্য। কেননা আমল ছাড়া ইলমের কোন মূল্যই সেখানে স্বীকৃত ছিল না।
ফযীলতের তুতীয় মান হইল নবী করীম (স)-এর বিশেষ যুগ-পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যে মক্কা শরীফ হইত মদিনা শরীফে হিজরত করার ব্যাপারে অগ্রবর্তিত। আলোচ্য হাদীসে তাই তৃতীয় পর্যায়েই উহার উল্লেখ করা হইয়াছে। অবশ্য রাসুলের পরে এই হিজরত জিনিসটিই অবশিষ্ট থাকে নাই। এই কারণে ফিকাহবিদগণ এই স্থানে অগ্রাধিকার দানের তৃতীয় মান হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন তাকওয়া পরহেজগারীকে। আর ইহা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কেননা তাকওয়া হইল মন-মানসিকতা ও আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে হিজরত। এই দুই প্রকারের হিজরতের মধ্যে সঙ্গতি ও সাযুজ্য সুষ্পষ্ট।
অগ্রাধিকারের চতুর্থ মান হইল বয়সের দিক দিয়া অগ্রবর্তিতা। বলা হইয়াছে, পূর্বোক্ত তিনটি মানের দৃষ্টিতে মুসল্লীরা সমান ও পার্থক্যহীন হইলে বয়সের দিক দিয়া যে লোক অগ্রসর হইবে, তাহাকেই ইমাম বানাইতে হইবে।
হাদীসের শেষাংশে দুইটি জরুরী হিদায়ত হইয়াছে। একটি এই যে, কেহ অপর কাহারো প্রভাবাবিত এলাকায় গেলে সেখানে যেন সে ইমামতি না করে, বরং সেই স্থানীয় প্রভাবশালী লোকের পিছনেই যেন নামায পড়ে। তবে সেই লোক নিজেই যদি কাহাকেও ইমামতের জন্য অগ্রসর করিয়া দেয়, তবে ভিন্ন কথা।
আর দ্বিতীয় হিদায়ত হইল, কেহ যদি কাহারো ঘরে গমন করে তবে সেই ঘরের মালিকের নিজস্ব বিশেষ আসনে বসিবে না। ঘরের মালিক নিজে বসাইলে তখন অবশ্য কোন আপত্তি থাকিবে না।
এই দুইটি হিদায়তের গুরুত্ব ও যৌক্তিকতা সুষ্পষ্ট এবং ইহার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, নামায-ইমামের পিছনে জামাআতের সহিত মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন এবং রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মূর্ত প্রতীক। এ ক্ষেত্রের নেতৃত্বের ব্যাপাটি কোন ক্রমেই উপেক্ষণীয় নয়, বরং উক্ত প্রতীক অনুসারে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা মুসলমানদের দ্বীনী দায়িত্ব ও কর্তব্য। ইমামত সংক্রান্ত হাদীসসমুহও এই বিশাল ও প্রশস্ততর প্রেক্ষিতে অধ্যয়ন করা আবশ্যক। কেননা এসব হাদীসে কেবল নামাযের ইমামতের কথাই বলা হয় নাই, সমাজ ও রাষ্ট্র ও ইহার মধ্যে শামিল।
ইমামের গুণ-বৈশিষ্ট্য
===========================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের মধ্যে যাহারা উত্তম ও অধিক ভালো লোক, তাহাদিগকেই নিজেদের ইমাম বানাইবে। কেননা তোমাদের রব ও মালিক আল্লাহর দরবারে তাহারাই হইবে তোমাদের প্রতিনিধি।
-দারে কুতনী, বায়হাকী
ব্যাখ্যা ইমাম নামাজের জামাআতের আল্লাহর দরবারে সমস্ত লোকের প্রতিনিধিত্ব করে, ইহা সুষ্পষ্ট কথা। এই কারণে জামাআতের লোকদের-মুক্তাদীদেরই কর্তব্য হইল, এই গুরুত্বপূর্ণ ও মহান উদ্দেশ্যের জন্য তাহারা নিজেদের মধ্য হইতে অধিকতর উত্তম ও ভালো লোককে নিযুক্ত করিবে।
রাসূলে করীম (স) যতদিন দুনিয়ায় বাচিঁয়া ছিলেন ততদিন তিনি নিজেই সব নামাযে ইমামতি করিতেন। পরে মৃত্যুরোগে আক্রান্ত হইয়া পড়ায় তিনি যখন অক্ষম হইয় পড়িয়াছিলেন, তখন ইলম ও আমল উভয় দিক দিয়া সেই সমাজের সর্বাধিক উত্তম ও অধিকতর যোগ্য হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-কে ইমামতি করার জন্য নির্দেশ দান করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বর্ণিত পূর্বোদ্ধৃত হাদীসটির লক্ষ্যও তাহাই। এই হাদীসটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত ও দারে কুতনী কর্তৃক উদ্ধৃত হইয়াছে।
বলা বাহুল্য, উত্তরকালে মুসলমান সমাজে রাসূলের এই নির্দেশ পুরাপুরি পালিত হয় নাই। ফলে তাহাদের সামাজিক বিপর্যয় অপরিহার্য হইয়া পড়ে। মনে রাখা আবশ্যক যে, হাদীসটির লক্ষ্য কেবল নামাযের ইমামতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ইহার লক্ষ্য ব্যাপক-সমগ্র সামাজিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে ও ইহা প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়। রাসূলে করীম (স) এবং তাঁহার পর খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে এই নির্দেশ কাজ হইয়াছে। পরে ইহার গুরুত্ব অনেকটা বিষ্মৃত হইয়া গিয়াছে। আর এই অবাঞ্চিত ঘটনার কারণেই মুসলিম সমাজের বিপর্যয় সূচিত হইয়াছে। এই হাদীস অনুযায়ী আমল করা হইলে সে বিপর্যয় হইতে মুসুলিম জাতিকে নিশ্চিত ধ্বংস ও অবক্ষয় হইতে আজিও রক্ষা করাযায়।
ইমামের দায়িত্ব ও জওয়াবদিহি
============================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন? যে ব্যক্তি (নামাযের) জামাআতে ইমামতি করিবে, তাহার উচিত আল্লাহকে ভয় করা এবং একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যে, মুক্তাদীদের নামাযের জন্যও সে-ই দায়ী ও যিম্মাদার। আর তাহাকে তাহার দায়িত্ব সম্পর্কে অবশ্যই সওয়াল করা হইবে। সে যদি ভালোভাবে নামায পড়াইবার কাজ করে তাহা হইলে তাঁহার পিছনে দাঁড়াইয়া যেসব মুক্তাদী নামায আদায় করে তাহাদের মোট সওয়াবের সমান তাহাকে দেওয়া হইবে। কিন্তু তাহাতে মুক্তদীদের সওয়াব একবিন্দু কমিয়া যাইবে না। আর নামাযে যে ত্রুটি ও দোষ হইবে, তাহা সম্পূর্ণ একা ইমামের উপরই বর্তিবে।
-তাবারানী ফিল-আওসাত, কানফুল উম্মল
ব্যাখ্যা হাদীসে ইমামের যে কঠিন দায়িত্ব ও সেইজন্য ওয়াবতিহির কথা বলা হইয়াছে, তাহা খুবই স্বাভাবিক এবং বাঞ্চণীয়। একটু ব্যাপক দৃষ্টিতে দেখিলে ইহা কেবল নামাযের ইমাম সম্পর্কেই সত্য, হইবে না, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের ইমামতি-তথা নেতৃত্ব সম্পর্কেও এই কথা সত্য। কাজেই নামাযের ইমাম ও সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রের ইমাম নেতা-উভয়েরই কর্তব্য হইল আল্লাহকে ভয় করিয়া ও তাহার নিকট জওয়াবদিহির অনুভূতি নিজের মধ্যে জাগ্রত রাখিয়া সব কাজ যথাযথভাবে আঞ্চায দেওয়া। অন্যথায় সব দোষ, অন্যায় ও ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য একা তাহাকেই দায়ী হইতে হইবে এবং আল্লাহর নিকট সেই জন্য শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।
ইমাম ও মুকতাদী
============================
হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ঘোড়ার পিঠ হইতে পড়িয়া গেলেন। ইহাতে তিনি কিছুটা আঘাত প্রাপ্ত হইলেন। পরে তিনি আমাদিগকে লইয়া বসা অবস্থায় নামায পড়িলেন। আমরাও তাহার সহিত বসিয়া বসিয়া নামায পড়িলাম। পরে তিনি মুখ ফিরাইলেন এবং বলিলেনঃ ইমাম-অথবা বলিলেন, ইমাম বাবানো হয়-শুধু এই উদ্ধেশ্যে যে, তাহার অনুসরণ করা হইবে। অতএব, ইমাম যখন আল্লাহ আকবার বলিবে তোমরাও তখন আল্লাহ আকবার বলিবে, যখন রুকূ দিবে তখন তোমরাও রুকূতে যাইবে, যখন মাথা তুলিবে তোমরাও উঠিয়া দাঁড়াইবে, আর যখন বলিবেঃ
============= আল্লাহ শুনিলেন যে তাঁহার প্রশংসা করিল।
তখন তোমরাও বলিবেঃ
========== হে আমার আল্লাহ। তোমার জন্যই সব প্রশংসা।
যখন ইমাম সিজদা করিবে, তোমারও তখন সিজদায় চলিয়া যাইবে। আর যখন বসিয়া নামায পড়িবে, তখন তোমরাও সকলে বসিয়া নামায পড়িবে।
-তিরমিযী, বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা হাদীসটি হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা)-এর বর্ণনা, তিনি রাসূলে করীমের খাদিম ছিলেন প্রথমেই তিনি রাসূলে করীম (স)-এর ঘোড়ার পিঠ হইতে পড়িয়া গিয়া আহত হওয়ার ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন। তিরমিযী বর্ণিত উপরোদ্ধৃত হাদীসে শুধু তাঁহার আহত হওয়ার কথাই বলা হইয়াছে। কিন্তু বুখারী উদ্ধৃত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
============= তাঁহার পায়ের মলা কিংবা বন্ধ আহত হইয়াছে। অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
========= তাঁহার ডান পার্শ্ব আহত হইয়াছে।
আবু দাউদ এই হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন হযরত জাবির (রা) হইতে। তাহাতে বলা হইয়াছে, এই ঘটনাটি মদীনা শরীফে সংঘটিত হয় এবং তাঁহার পা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মূলত ইহা একই ঘটনার বিভিন্ন বর্ণনা হইতে পারে, হইতে পারে একাধিক ঘটনার বর্ণনা।
আলোচ্য হাদীসটি হইতে ইমামের পেছনে জামাআতের সহিত নামায পড়ার নিয়ম জানা যাইতেছে। ইহা হইতে প্রথমে জানা যায় যে, মুক্তাদী নামাযে ইমামকে মানিয়া ও অনুসরণ করিয়া নামায পড়িবে। ইমাম তাকবীর করিলে তাহার পর মুক্তাদি তাকবীর বলিবে, তাহার পূর্বে নয়, সংঙ্গে সঙ্গেও নয়। কেননা হাদী ও অক্ষরটি ব্যবহৃত হইয়াছে। ইহার অর্থঃ ইমামের তাকবীর বলা শেষ হইলে পরে মুক্তাদী তাকবীর বলিবে। ইমাম যদি বসিয়া নামায পড়ে-অবশ্য কোন বিশেষ ওজরের কারণে-তাহা হইলে মুক্তাদী অনুরূপ অক্ষম না হইলেও তাহাদিগকে বসিয়াই নামায পড়িতে হইবে। ইহা হইতে ইমামের মর্যাদা ও ইমাকে সর্বতোভাবে মানিয়া ও অনুসরণ করিয়া নামায পড়ায় বাধ্যবাধকতা স্পষ্টস ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। এই পর্যায়ে হযরত, আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ নবী করীম (স) নিজের ঘরে নামায পড়িলেন- তিনি অসুস্থ থাকায় বসিয়া নামায পড়িলেন। তাঁহার পিছনে যাহারা সমবেত হইয়াছিল তাহারা প্রথমে দাঁড়াইয়া নামায পড়িতেছিল। তখন নবী করীম (স) তাহাদিগকে বসিয়া পড়িতে ইঙ্গিত করিলেন। পরে তিনি তাহাদের প্রতি ফিরিয়া উপরিউক্ত কথাটি বলিলেন (বুখারী, মুসলিম)। বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসের শুরু কথা হইলঃ
============================
ইমাম তো অনুসরণ করার জন্যই বানানো হয়। অতএব তাহার হইতে ভিন্নতর নিয়ম অনুসরণ করিয়া কোনরূপ বিরোধ করিও না।
মুসলিম, ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী (রা) হযরত জাবির (রা) হইতে এই হাদীসটিই বর্ণনা করিয়াছেন, তাহাতে কথা ও ভাষায় কিছুটা পার্থক্য রহিয়াছে। সেই বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ রাসূলে করীম (স) অসুস্থতার কারণে বসিয়া নামায পড়িলেন। আমরা তাঁহার পিছনে নামায পড়িলাম। তিনি বসা। আর বকর (রা) লোকদিগকে তাঁহার তাকবীর শোনাইতেছিলেন-মুকাবিরের কাজ করিতেছিলেন। তখন নবী করীম (স) আমাদের দিকে ফিরিলেন ও আমাদিগকে দাঁড়ানো দেখিতে পাইলেন। তখন তিনি আমাদিগকে বসিতে বলিলেন। পরে আমরা তাঁহার সহিত বসিয়া বসিয়া নামায পড়িলাম। সালাম ফিরাইবার পর তিনি আমাদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, একটু আগে তোমরা তো পারসিক ও রোমানদের মত কাজ করিতেছিলে। কেননা তাহারা দাঁড়াইয়া থাকে, আর তাহাদের রাজা-বাদশাহ-নেতারা বসিয়া থাকে। কাজেই তোমরা তাহা করিও না।
========== তোমরা তোমাদের ইমামগণকে অনুসরণ করিয়া চল।
এই হাদীসের মুল তাৎপর্য হইল, ইমামকে অণুসরণ করিয়াই নামায পড়িতে হইবে। ইমাম বসিয়া পড়িলে মুক্তাদীদিগকেও বসিয়া বসিয়া পড়িতে হইবে। তাহার বিরোধিতা করা যাইবে না। সব ফিকাহবিদের চুড়ান্ত মত ইহাই। চারজন প্রধান সাহাবীও এ মত প্রকাশ করিয়াছেন। কোন সাহাবীই ইহার বিপরীত মত দিয়াছেন বলিয়া জানা যায় নাই। তাবেয়ীদের মতও ইহাই। এই ব্যাপারে তাঁহাদেরও ইজমা হইয়াছে।
ইবনে আবু শায়বাহ মুহাদ্দিস এই হাদীসের সঙ্গে রাসূলে করীমের একটি বাক্য সহিত সনদে সংযোজিত করিয়াছেন। তাহা হইলঃ
==============
তোমরা রুকু বা সিজদায় ইমামের আগে-ভাগে চলিয়া যাইও না।
অর্থাৎ ইমামের আগে রুকুতে যাইবে না, তাহার সিজদায় যাওয়ার আগে সিজদায় যাইবে না। যদি কোন মুক্তাদী সিজদা হইতে মাথা তুলিয়া দেখে যে, ইমাম তখনো সিজদায় রহিয়াছেন, তাহা হইলে তাহাকে পুনরায় সিজদায় যাইতে হইবে এবং ইমাম যতক্ষণ সিজদায় থাকিবে ততক্ষণ তাহাকে সিজদায় থাকিতে হইবে।===========
পূর্বে বিবৃত বিশাল, বিস্তীর্ণ প্রেক্ষিতে এই হাদীসটিও পঠিতব্য।
ইমামকে ‘লোকমা’ দেওয়া
=======================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত নবী করীম (স) একবার নামাযে ইমামতি করিলেন। তিনি নামাযে কুরআন পড়িলেন। কুরআন পড়িতে তাঁহার একস্থানে বাধিয়া গেল। পরে নামায শেষ করিয়া তিনি মুক্তাদীদের প্রতি ফিরিলেন ও হযরত উবায় ইবনে কাব(রা)-কে বলিলেনঃ তুমি কি আমাদের সাথে নামায পড় নাই? তিনি বলিলেন, জি হ্যাঁ তখন তিনি বলিলেনঃ তাহা হইলে কে তোমাকে নিষেধ করিয়াছিল?
-আবুদাউদ
ব্যাখ্যা এই হাদীসটি হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম নামাযে কুরআন পড়াকালে ভুল করিয়া বসিল, কোন আয়াত ছাড়িয়া গেলে কিংবা এক আয়াতের পরিবর্তে অন্য আয়াত পড়িয়া ফেলিলে অথবা পড়া অগ্রসর না হইল-আটকাইয়া গেলে মুক্তাদী তাহার এই ভুল শোধরাইয়া দিতে পারে। অনেকের মতে ইহা মুস্তাহাব। করা যাইতে পারে, না করিলে কোন দোষ নাই। মনসুর বিল্লাহর মতে ইহা করা ওয়াজিব। যায়দ ইবনে আলী ও ইমাম আবু হানীফ (রা) ইহা করাকে মাকরূহ মনে করিয়াছেন। ইমাম খাত্তাবী লিখিয়াছেন, লোকমা দেওয়ার বিষয়ে লোকদের মধ্যে মত-বিরোধ রহিয়াছে। হযরত উসমান ইবনে আফকান (রা) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) সম্পর্কে বলা হইয়াছঃ
================ তাঁহারা দুইজন এই কাজ করায় কোনরূপ দোষ দেখেন নাই। আতা, হাসান বসরী, ইবনে সীরীন, ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় প্রমুখ ফকীহও এই মত পোষণ করিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) ইহাকে মাকরূপ মনে করিতেন আর ইমাম আবু হানীফা (র) বলিয়াছেনঃ
========================
ইমাম যদি চাহে যে, তাহার ভুল শোধরাইয়া দেওয়া হউক, তাহা হইলে তাহার ভুল শোধরাইয়া দাও।
হযরত আলী (রা) বলিয়াছেনঃ
================
ইমাম খাইতে চাহিলে তাহাকে খাওয়াও অর্থাৎ ভুল শোধরাইয়া দাও।
ইমাম শাওকীন লিখিয়াছেন, ইমামের ভুল শোধরাইয়া দেওয়ার পক্ষের দলীল অকাট্য। যে নমাযে কুরআন উচ্চস্বরে পড়া হয় তাহাকে যদি সে কোন আয়াত ভুলিয়া যায় তবে তাহা সরণ করাইয়া দেওয়া, কোন ‘রুকন’ থাকিয়া গেলে তসবীহ দ্বারা সেই ভুল সারাইয়া দেওয়া মুক্তাদীর উচিত।=============
মসজিদে নামায
============================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ সব রকমের জনপদ ও জনবসতির মধ্যে তথায় অবস্থিত মসজিদসমূহই আল্লাহ তাআলার নিকট অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় এং উহাদের হাট-বাজারগুলিই হইতেছে অধিক অপছন্দনীয়।-মুসলিম
ব্যাখ্যা নামায যে ধরনের ইবাদত, তাহাতে উহার জন্য সামষ্টিক ব্যবস্থা কায়েম হওয়াই শুধু বাঞ্জনীয় নয়, অপরিহার্যও। নামাযের এই সামষ্টিকে ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল হইল মসজিদ। মসজিদেই জামাআতের সহিত-বহু লোক একত্রিত হইয়া ও কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া সারিবদ্ধ হইয়া-নামায পড়া হয়। বস্তুত মুসলমানদের দ্বীনী যিন্দেগী গড়িয়া তোলার ব্যাপারে মসজিদ ও উহাতে জামাআতের সহিত নামাযের যে কতখানি গুরুত্ব তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়। এই কারণে নবী করীম (স) জামাআতের সহিত নামায পড়ার যেমন তাকীদ করিয়াছেন, তেমনি মসজিদসমূহের গুরুত্ব ও মর্যাদার কথাও নামাভাবে ও ভাষায় ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি কাবা ঘরের সাদৃশ্যে মসজিদকে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলিয়াছেন। উহাকেই মুসলিম জাতির মিলনকেন্দ্র বানাইয়াছেন।লোকদের দেহ যেখানেই থাকুক, তাহাদের দিল যেন মসজিদের প্রতি আকৃষ্ট ও মসজিদের নামাযের জন্য উন্মুক্ত-উদগ্রীব হইয়া থাকে, নবী করীম (স) তাহাই চাহিয়াছেন এবং সেইরূপ কথাই তিনি নানা সময় নানা ভাষায় প্রকাশ করিয়াছেন। উদ্ধৃত হাদীসটি এই পর্যায়েরই একটি বাণী।
এই হাদীসটির সঠিক তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য মনে রাখা দরকার যে, মানুষের জীবনের দুইটি দিক রহিয়াছে। একটি দিক মালাকৃতী ও অধ্যাত্মিক। মানুষের এই দিকটি জ্যোতির্ময়, অতীব সূক্ষ্ন। আর অপর দিকটি হইল বস্তুগত, পাশাবিক, অন্ধকারময় ও স্থল। মানুষের মালাকৃতী ও আধ্যাত্মিক দিকটির দাবি হইল আল্লাহর ইবাদ্ত ও তাঁহার যিকর-এ আত্মনিয়োগ। তাহা করা হইলেই মানুষের আধ্যাত্মিক দিকটির পরিমার্জনা ও পরিপূর্ণতা বিধান হয়। এই কারণেই মানুষ আল্লাহ তাআলার অসীম রহমত ও ভালোবাসার অধিকারী হইতে পারে। আর এই কাজের কেন্দ্রস্থল হইল মসজিদ। মসজিদে এইসব অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে বলিয়াই উহাকে আল্লাহর ঘর বলা হয়। দুনিয়ার জনপদ ও জনবসতিরসমূহের মধ্যে মসজিদ এই কারণেই আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।
পক্ষান্তরে হাট-বাজার-বন্দর ও বিকিকিনি কেন্দ্রসমূহ মূলত মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্র। আর এখানকার তৎপরতা এতই স্থুলও বস্তুগত যে, এখানকার ঝামেলায় পড়িয়া মানুষ সাধারণত আল্লাহ-বিমুখ হইয়া পড়ে। মানুষ এখানে আসিয়া প্রায়ই আল্লাহকে ভুলিয়া যায়। এইসব ক্ষেত্রের পরিবেশ মসজিদ সমূহের পরিবেশ হইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।
হাদীসটির মূল লক্ষ্য হইল, মানুষ যেন মসজিদসমূহের দিকেই আকৃষ্ট থাকে এবং উহাকেই যেন তাহাদের জীবনের কেন্দ্ররূপে গ্রহণ করে। কিন্তু তাহার অর্থ নিষ্চয়ই ইহা নয় যে, মানুষ মসজিদ সর্বস্ব হইয়া থাকিবে, মসজিদের বাহিরের বিশাল জগতের বিপুল তৎপরতা হইতে সমস্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও নিঃসম্পর্ক হইয়া যাইতে হইবে, বরং মসজিদও মসজিদ সংক্রান্ত তৎপরতাকেই জীবনের প্রধান ব্যস্ততায় পরিণত করিতে হইবে এবং উহার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে মসজিদের বাহিরে বিশাল বিস্তীর্ণ জীবন। হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত অপর একটি হাদীস হইলঃ
============================
নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোকই যে সময়ই-সকালে কিংবা সন্ধ্যায় নিজের ঘর হইতে বাহির হইয়া মসজিদের দিক গমন করে আল্লাহ তাআলা তাহার জন্য জান্নাতের মেহমানীর সামগ্রী প্রস্তুত করিয়া রাখেন-সেযতবারই-সকাল ও সন্ধ্যায় তথায় গমন করুন না কেন।
-বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা এই হাদীসেরস অর্থ মসজিদে যে লোকই যায় , সে-ই হয় আল্লাহর মেহমান এবং প্রত্যেকবারই সে আল্লাহর নিকট হইতে মেহমানীর সামগ্রী ও মর্যাদা পাইবে।
মসজিদের দোয়া
======================
আবু উসাইদ সাইদী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ হযরত নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ তোমাদের কেহ যখন মসজিদে প্রবেশ করিবে, তখন যেন সে বলেঃ
====================
হে আল্লাহ্! আমার জন্য তোমার রহমতের দুয়ার খুলিয়া দাও।
আর যখন সে মসজিদ হইতে বাহির হইতে থাকিবে, তখন যেন সে দোয়া করেঃ
=======================
হে আল্লাহ! তোমার নিকট তোমার অনুগ্রহ পাওয়ার প্রার্থনা করিতেছি-তুমি তাহা আমাকে দান কর।
ব্যাখ্যা কুরআন ও হাদীসে রহমত শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরকালীন, দ্বীনী ও আধাত্মিক নিয়ামত বুঝায়। আর ফযল শব্দটি রিযিক প্রভৃতি বৈষয়িক নিয়ামতের অবদান এবং উহার আধিক্য ও প্রাচুর্য বুঝাইবার জন্য ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এই কারণে নবী করীম (স) মসজিদে প্রবেশকালে রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য দোয়া করার শিক্ষা দিয়াছেন। কেননা মসজিদ হইল দ্বীনী, আধ্যাত্মিক ও পরকালীন নিয়ামতসমূহ হাসিল করার স্থান। আর মসজিদ হইতে বাহির হইবার সময় আল্লাহর নিকট বৈষয়িক নিয়ামতসমূহ হাসিলের জন্য দোয়া করার উপদেশ দিয়াছেন। আর এই উভয় দোয়াই যে নিজ নিজ পরিবেশ ও ক্ষেত্রের সহিত পুরাপুরি সঙ্গতিপূর্ণ, তাহা সকলের নিকট সুস্পষ্ট।
মসজিদে প্রথম নামায
=============================
আবু কাতাদা (রা) হইতে বর্ণিত, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের কেহ যখন মসজিদে প্রবেশ করে, তখন সে যেন প্রথমেই এবং বসিয়া পড়ার পূর্বেই দুই রাকআত নামায পড়িয়া লয়।
-বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী
ব্যাখ্যা মসজিদের সহিত আল্লাহর বিশেষ সম্পর্ক রহিয়াছে। এই কারণে মুসলমানদের উপর উহার একটা বিশেষ হকও রহিয়াছে, আছে উহার ব্যাপারে বিশেষ আদব কায়দা। আর তাহা এই যে, মসজিদে প্রবেশ করিয়াই আসন গ্রহণ করিবে না- বসিয়া পড়িবে না। বরং বসিবার পূর্বেই দুই রাক্আত নামায পড়িয়া লইবে। এই দুই রাক্আত নামাযকে পরিভাষায় তাহিয়্যাতুল মসজিদ ====== বলা হয়। ইহার অর্থ মসজিদের সম্মানে স্বীকারমূলক দুই রাক্আত নামায। তবে ইহা ওয়াজিব-ফরয কিছু নয়। ইহা সব ইমামের মতেই মুস্তাহাব নামায। এই হাদীস হইতে এই কথা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়া যে, মসজিদে প্রবেশ করিয়াই বসিয়া পড়া উচিত নয়, বরং প্রথমেই-বসিবার পূর্বেই-দুই রাকআত নামায মসজিদের খাতিরে পড়া আবশ্যক।
ইবনে হাজার আল-আসকালানী বুখারীর শরাহ ফতহুল বারী গ্রন্থে লিখিয়াছেন, হযরত কাতাদাহ (রা) বর্ণিত এই হাদীসটির বিশেষ কারণ হইল, তিনি মসজিদে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, নবী করীম (স) সাহাবিদের পরিবেষ্টনে বসিয়া রহিয়াছেন। ইহা ইহা দেখিয়া তিনিও বসিয়া গেলেন। তখন নবী করীম (স) তাঁহাকে বলিলেনঃ=========== নামায পড়িতে তোমাকে কে নিষেধ করিয়াছে?
তিনি বলিলেনঃ আমি আপনাকে ও অন্যান্য লোকদিগকে বসা দেখিতে পাইলাম, সেইজন্য নামায পড়ি নাই। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তোমাদের কেহ যখন মসজিদে প্রবেশ করিবে, সে যেন তখনই দুই রাকআত নামায পড়য়া লয় (মুসলিম)। নবী করীম (স) নিজেই বলিয়াছেন, মসজিদের হক হইল বসিবার পূর্বে দুই রাক্আত নামায পড়া।
মসজিদ নির্মাণের সওয়াব
=========================
হযরত উসমান (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ যে লোক আল্লাহর জন্য, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে এবং তাঁহার নিকট হইতে সওয়াব পাইবার আশায়-মসজিদ নির্মাণ করিবে, মসজিদ নির্মাণের জন্য চেষ্টা চালাইবে, আল্লাহ তাআলা তাহার জন্য জান্নাতের একটি জাঁকজমকপূর্ণ মহল নির্মাণ করিবেন।
-বুখারী মুসলিম
ব্যাখ্যা কুরআন মজীদ ও হাদীস হইতে এই কথা স্পষ্টভাবে জানা যায় যে,মানুষ দুনিয়ার খালিস নিয়্যতে যে কাজই করিবে, পরকালে উহার সওয়াব পাইবে। কাজেই দুনিয়ায় মসজিদ নির্মাণ হয় না। মসজিদ নির্মাণের মূল লক্ষ্য হইল, এমন একটা কেন্দ্র স্থাপন, যেখানে মুসলমান জনগণ দিন-রাত্রে পাঁচবার ও প্রতি শুক্রবার জুমআর সময় অবাধে ও নির্বিশেষে উপস্থিত ও একত্রিত হইয়া নামায পড়িতে ও সব রকমের দ্বীনী দায়িত্ব ও কর্তব্য পাল করিতে পারে। এই কাজের ফলে মুসলিম সমাজের জনগণ দ্বীনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত হইয়া উঠিবে। আর এই কাজ যে অতুলনীয়, তাহা নিঃসন্দেহ।
অবশ্য মুসলমানদের জন্য সমস্ত যমীনই মসজিদের মতো এই হিসাবে যে, সব পাক-জায়গায়ই নামায পড়া সম্পূর্ণ জায়েয রাসূলে করীমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হইল, পাক যমীনের যে কোন স্থানে নামায পড়া তাঁহার ও উম্মতের জন্য সম্পূর্ণ জায়েম করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
নামায ইসলামের ভিত্তি
=============================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ ইসলাম পাঁচটি জিনিসের উপর নির্ভরশীল। তাহা হইলঃ আল্লাহ ছাড়া কেহ ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর রাসূল- এই কথার সাক্ষ্যদান, নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা এবং রমযান মাসের রোযা রাখা।
-বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা এই হাদীসে ইসলামের মৌল ব্যবস্থার একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেশ করা হইয়াছে। বস্তুত কালিমায়ে তায়্যিবার প্রতি ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত-এই চারিটি কাজও মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। এইভাবেই ইসলাম পূর্ণত্ব লাভ করে। হাদীসের কথাটি দৃষ্টান্তমুক। একটি তাবু দাঁড় করাইতে হইলে উহার জন্য চারিদিকে চারটি এবং মাঝখানে একটি-এই পাঁচটি খুটিঁর আবশ্যক এই খুঁটি না হইলে তাঁবু দাঁড় করা যাইতে পারে না। ইসলামও এই পাঁচটি জিনিস ছাড়া রূপলাভ করিতে পারে না। এই পাঁচটি না হইলেও উহার খুঁটি বিশেষ। খুঁটিগুলি সরাইয়া দিলে যেমন তাঁবুটি নীচে পড়িয়া যাইবে, এই পাঁচটি না হইলেও ইসলাম খতম হইয়া যাইবে।
এই দৃষ্টান্তমূলক কথা হইতে বুঝা গেল যে, পাঁচটি জিনিস সম্পূর্ণ ইসলাম নয়, এই পাঁচটি জিনিস হইলেই ইসলামের সবকিছু হইয়া গেল না-ঠিক যেমন পাঁচখানি খুঁটিই একটি দাঁড় করা তাঁবুর সবকিছু নয়। পাঁচখানি খুঁটি হইলেই একটি পূণাঙ্গ তাঁবু বা ঘর দাঁড়াইয়া গেল না। ইসলামের ব্যাপারও তাই। উচু পাঁচটি কাজ করা হইলেই পূর্ণাঙ্গ ইসলাম হইয়া যায় না। যেমন এই পাঁচটিঁ কাজ কিংবা ইহার কোন একটি ছাড়াও ইসলামের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এই হাদীসটিতে একসঙ্গে কালিয়া-নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত এই সবকটির গুরুত্ব অকাট্য ও স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। তাই ইমাম নববী ইহার ব্যাখ্য্য় বলিয়াছেনঃ
=======================
জানিয়া রাখ, এই হাদীসটি দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানলাভের ব্যাপারে একটি বিরাট মুলকথা। দ্বীন ইহার উপর নির্ভরশীল, ইহাতে দ্বীনের সবকয়টি স্তস্ত একত্রে উল্লেখিত হইয়াছে।
মুসনাদে আহমদ-এ জিয়াদ ইবনে নয়ীম আল-হাজরামী বর্ণিত একটি হাদীস এই পর্যায়ে উল্লেখ্য। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
=============================
আল্লাহ তাআলা ইসলামে চারিটি ইবাদত মৌলিকভাবে ফরয করিয়াছেন। কেহ উহার মধ্য হইতে মাত্র তিনটি কাজ করিলে পূর্ণ ইসলাম পালনের দায়িত্বের দিক দিয়া তাহা কখনো যথেষ্ট হইতে পারে না, যতক্ষণ না এই সব কয়টিই সে পালন করিবে। সেই ইবাদত চারিটি হইলঃ নামায, যাকাত, রমযান মাসের রোযা ও আল্লাহর ঘরের হজ্জ।
নবী করীম (স)-এর অপর একটি হাদীসে এই কথাটি আরো স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে। হাদীসটি এইঃ
=============================
দ্বীন ইসলামের পাঁচটি কাজ এমন যে, উহার একটি ছাড়া অপর কোনটি আল্লাতাআলা কবুল করেন না। তাহা হইলঃ আল্লাহ ছাড়া কেহ মাবুদ নাই এবং মুহাম্মাদ তাঁহার বান্দা ও রাসূল, আল্লাহ তাঁহার ফেরেশতা, তাঁহার কিতাব, জান্নাত ও জাহান্নাম, মৃত্যুর পর জীবন-এই সব কয়টির প্রতি বিশ্বাসের সাক্ষ্যদান। ইহা পাঁচটির একটি আর পাঁচ ওয়াক্ত নামায হইল দ্বীন ইসলামের খুঁটি । আল্লাহ নামায না পড়িলে তাহার ঈমান কবুল করিবেন না। যাকাত হইল গুনাহ হইতে পবিত্রতা লাভের উপায়, আল্লাহ ঈমান ও নামায কবুল করিবেন না যাকাত আদায় না করিলে (অবশ্য যাহার উপর যাকাত ফরয তাহার সম্পর্কেই এই কথা)। যে লোক এই তিনটি করিল, কিন্তু রমযানের মাস আসিলে সে ইচ্ছা করিয়াই রোযা তরক করিল, আল্লাহ তাহার ঈমান, নামায ও যাকাত কবুল করিবেন না। যে লোক এই চারিটি কাজ করিল, পরে হজ্জ করা তাহার পক্ষে সহজ হইলেও তাহা করিল না, সেই জন্য কাহাকেও অসিয়ত করিয়াও গেল না এবং তাহার বংশের কোন লোকও তাহার পক্ষ হইতে হজ্জ করিল না, আল্লাহ তাহার পূবোর্দ্ধৃত চারিটি কাজ কবুল করিবেন না।
মুহাদ্দিস ইবনে আবু হাতিম তাঁহার পিতার নিকট হইতে জানিতে পারিয়াছেন যে, উপরোদ্ধৃত দীর্ঘ বাণীটি কোন হাদীস নয়, বরং বলা যায় ইহা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বর্ণিত উপরিউক্ত হাদীসেরই বিস্তারিত ব্যাখ্যা হিসাবেই এখানে ইহা উদ্ধৃত হইল। উপরন্তু এই ব্যাখ্যা যে নিঃসন্দেহে সত্য এবং ইসলামের মৌল ভাধারা ও পূর্ণাঙ্গ আদর্শের সহিত পুরামাত্রায় সঙ্গতিপূর্ণ, তাহা স্পষ্ট ও অকাট্য।=========
নামায আদায়ের গুরুত্ব
============================
ইমাম মালিক হইতে বর্ণিত, তিনি নাফে হইতে এবং তিনি ইবনে উমরের পুত্র আবদুল্লাহর মুক্ত দাস হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত উমর ইবনুল খাণ্ডব (রা) তাঁহার খিলাফতের কর্মচারীদের প্রতি লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন, যে, তোমাদের যাবতীয় ব্যাপারের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হইল নামায কায়েম করা। যে লোক উহাকে রক্ষা করে ও উহার সংরক্ষণ দায়িত্ব পুরাপুরি পালন করে, সে তাহার দ্বীনকে রক্ষা করে। আর যে লোক উহাকে বিনষ্ট করে, সে এই নামায ছাড়াও অন্যান্য সবকিছু অধিক নষ্ট করে।
-মুয়াত্তা মালিক
ব্যাখ্যা উপরে উদ্ধৃত বাক্যটি রাসূলে করীম (স)-এর মুখ নিঃসৃত বাণী নহে। ইহা হযরত উমর ফারুকের একটি ফরমান। এই ফরমান তিনি তাঁহার বিরাট খিলাফতের সরকারী কর্মচারীদের প্রতি লিখিয়াছেন। তাঁহার ফরমানটি দীর্ঘ ছিল, উহার প্রথম অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হইয়াছে। ইহা হযরত উমরের বলা বা লেখা হইলেও মুলত ইহা নবী করীম (স)-এরই বাণী। হযরত উমর ফারুক (রা) রাসূলে করীম (স)- এর কথার উপর ভিত্তি করিয়া এই বাণীটি তেয়ার করিয়াছেন। অতএব ইহাও হাদীস। কেননা হাদীস বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সাহাবীর কথাও হাদীস নামে অভিহিত হয়।
ইহা যে হযরত উমরের নিজস্ব কল্পনাপ্রসুত কোন কথা নয়, তাহার প্রমাণ এই যে, স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-এরই এতদৃসম্পর্কিত একটি বাণী উমর হইতে ইকরামা-এই সুত্রে হাদীসের মরফু বা রাসূলের নিজের কথা হিসাবে রায়হাকী কর্তৃক উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহাতে বলা হইয়াছেঃ এক ব্যক্তি রাসুলে করীম (স)-এর সমীপে প্রশ্ন করিল।
===========================
হে রাসূল। ইসলামে আল্লাহর নিকট কোন কাজটি সর্বাপেক্ষা বেশী প্রিয়? নবী করীম (স) বলিলেনঃ
===========================
সময় মতো নামায পড়া। যে লোক নামায তরক করে, তাহার দ্বীন (ধর্ম) বলিতে কিছুই নাই। আর নামায হইল দ্বীন-ইসলামের খুঁটি কিংবা দাঁড়াইবার ভিত্তি। যে লোক উহাকে রক্ষা করে এবং উহার পুরাপুরি হেফাযত করে, সে তাহার দ্বীনকে রক্ষা করিতে পারে। আর যে লোক উহাকে নষ্ট করে, সে উহা ছাড়াও অন্যান্য সব কিছুকে অধিক নষ্ট করে।
ইহা হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত ইহল যে, প্রথমোদ্ধৃত ফরমানটি হযরত উমরের নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত কোন কথা নহে, বরং নবী করীমের কথাকেই তাঁহার নিজের ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেন। রাসূলের বাণীকেই তিনি সরকারী পর্যায়ে একটি অর্ডিন্যান্স হিসাবে জারী করিয়াছিলেন মাত্র।
এই হাদীস হইতে দ্বীন-ইসলামে নামাযের গুরুত্ব অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। নামায দ্বীন-ইসলামের ভিত্তি, দ্বীন-ইসলামের খুঁটি। দ্বীন-ইসলামের সমগ্র বিধানটি এই নামযের উপরই দাঁড়াইয়া আছে। বস্তুত যে জিনিসের যাহা ভিত্তি, সেই ভিত্তি অক্ষত না থাকিলে সেই জিনিসটিও টিকিয়া থাকিতে পারে না, ইহা খুবই স্পষ্ট কথা। কাজেই নামায যদি দ্বীন-ইসলামের ভিত্তি বা খুঁটি হইয়া থাকে, তাহা হইলে নামায কায়েম না করা হইলে দ্বীন-ইসলাম থাকিবে কি করিয়া? এই কারণে হযরত উমর ফারুক (রা) তাঁহার সরকারী কর্মচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া ও এই সম্পর্কে তাহাদিগকে সতর্ক করিয়া দিয়া বলিয়াছেন, যে, তোমাদিগকে বহু দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করা হইয়াছে, নামাযও তোমাদের দায়িত্বের একটি কাজ। কিন্তু সমস্ত দায়িত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে নামাযের স্থান সবকিছুর উপরে। নামাযের গুরুত্ব সর্বাধিক। ইহাদ্বীনী কাজের মধ্যে সবচাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
নামায সংক্রান্ত রাসূলে করীম (স)-এর একটি বাণীকে হযরত উমর ফারুক (রা) সরকারী ফরমানরূপে জারী করিয়াছিলেন। ইহা হইতে স্পষ্ট হইয়া যায় যে, কুরআনের ন্যায় হযরতের বাণী (সুন্নাত)ও ইসলামের অন্যতম উৎস, সরকারী শক্তির সাহায্যে কার্যকর হওয়ার যোগ্য। শুধু যোগ্যই নয়, ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচালকদের দায়িত্বই হইল কুরআনের ন্যায় সুন্নাতকেও রাষ্ট্র ক্ষমতা-তথা সরকারী শক্তিবলে বাস্তবায়িত করিয়া তোলা, সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা কুরআন ও সুন্নাকে কার্যকর করা। সেই সঙ্গে নামায কায়েম করার জন্য চেষ্টা করা মুসলমানদের গভর্ণমেন্টের কর্তব্য। ইহা না করিলে ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালিত হইতে পারে না। বিশেষত কুরআন মজিদে তো ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই বলা হইয়াছে নামায কায়েম করাঃ
=============================
আমরা যাহাদিগকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করিব তাহারা অবশ্যই নামায কায়েম করার ব্যবস্থা করিবে। অর্থাৎ একজন মুসলিম ব্যক্তির যেমন প্রথম ও সর্বাদিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নামায ও কর্তব্য হইল সমগ্র রাষ্ট্রে নামায আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা কার্যকর করা। যে লোক নামায পড়ে না, সে দ্বীন-ইসলাম পালন করে না, তেমনি যে রাষ্ট্র বা সরকার নামায কায়েমের ব্যবস্থা করে না, তাহাও ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী সরকার নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য নয়।
হাদিসে বলা হইয়াছে। ====একই ======= শব্দের দুইটি রূপ। ========= অর্থ, যে সব কাজ না হইলে নামায শুধু হয় না, যেমন অযূ, সঠিক সময় এবং এ পর্যায়ের অন্যান্য জরুরী কার্যাবলী-তাহা নির্ভুলভাবে জানিয়া উহা যথাযথভাবে আদায় করা। ইহার পর বলা হইয়াছে========= অর্থাৎ নামায যথাযথভাবে আদায় করার পূর্ণ ব্যবস্থা করা, নামায কেহ তরক না করে-কেহ উহার প্রতি একবিন্দু অবজ্ঞা বা উপেক্ষা প্রদর্শন না করে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। এই দুইটি কাজই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বস্তুত নামায রীতিমত ও নিয়মিত আদায় করিলে নামাযীর মধ্যে যেমন দায়িত্ব-জ্ঞান, আল্লাহভীতি ও আল্লাহর নিকট জওয়াবদিহির চেতনা তীব্রভাবে বর্তমান থাকে তেমনি সেইসঙ্গে তাহার যাবতীয় বৈষয়িক (?) দায়িত্ব পালনেও সে সব সময় কর্মতৎপর হয়। কিন্তু যদি কেহ নামাযই সঠিকভাবে আদায় করিতে প্রস্তুত না হয়, তবে সে যে তাহার অন্যান্য দায়িত্বও পালন করিবে তাহার নিশ্চয়তা কি থাকিতে পারে।
যাহারা মনে করে যে, বেনামাযী লোকও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হয় ও দায়িত্ব পালন করে, তাহারা এক মারাত্বক বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত। তাহাদের দৃষ্টি স্থুল। প্রকৃতপক্ষে কি হইতেছে-বেনামাযীতাহার নিজের গোটা পরিবার, সমাজও রাষ্ট্রে যে কি সাংঘাতিক ক্ষতি করিতেছে তাহা বুঝিবার মতো কোন ক্ষমতাই তাহাদের নাই।
নামাযের পরকালীন মুল্য
==========================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস হইতে তাঁহার কর্তৃক নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, একদা তিনি নামাযের প্রসঙ্গ লইয়া আলোচনা করিলেন। বলিলেন, যে লোক এই নামায সঠিকভাবে ও যথাযথ নিয়মে আদায় করিতে থাকিবে তাহাদের জন্য কিয়ামতের দিন একটি নূর, অকাট্য দলীল এবং পূর্ণ মুক্তি নির্দিষ্ট হইবে। পক্ষান্তরে যে লোক নামায সঠিকভাবে আদায় করিবে না, তাহার জন্য নূর অকাট্য দলীল এবং মুক্তি কিছুই হইবে না। বরং কিয়ামতের দিন তাহার পরিণতি হইবে কারুন, ফিরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফ্ এর সহিত।
-আহমদ, দারেমী, বায়হাকী
ব্যাখ্যা আলোচ্য হাদীসটিতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায নিয়মিত ও যথাযথভাবে আদায় করিবার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে। ========= যে লোক নামায সংরক্ষণ করিল, ইহার অর্থ হইতেছে প্রতিটি ওয়াক্তের নামায সঠিক সময়ে ও যথানিয়ামে আদায় করিতে থাকা এবং কোন এক ওয়াক্তের নামাযও তরক না করা বা কামাই না দেওয়া। এই কাজ যে লোক করিবে, হাদীসে বলা হইয়াছে কিয়ামতের দিনে এই নামায তাহার জন্য নূর হইয়া দেখা দিবে। উহার আলোকে সেই কঠিনতম অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনে পুলসীরাত পার হইয়া সে তড়িৎবেগে ও নির্ভুলভাবে জান্নাতে চলিয়া যাইতে পারিবে। উহা তাহার জন্য অকাট্য দলীল হইয়া দেখা দিবে। সে যে প্রকৃত মুমিন ও মুসলিম, নিয়মিত ও যথাযথভাবে পড়া এই নামাযই হইবে উহার অকাট্য প্রমাণ। এই নামাযের দৌলতেই সে জাহান্নাম হইতে মুক্তি লাভ করিতে সক্ষম হইবে।
কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামায যে এইরূপভাবে সংরক্ষণ করিবে না, নিয়মিত ও পূর্ণ সর্তকতার সহিত পরিবে না, সে সেদিন চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত হইবে। তাহার মুমিন মুসলমান হওয়ারও কোন প্রমাণ পাওয়া যাইবে না এবং তাহার ভাগ্যে জাহান্নাম হইতে মুক্তিও জুটিবে না। শুধু তাহাই নয়, তাহাকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট পরিণতির সম্মুখীন হইতে হইবে।
এই নিকৃষ্ট পরিণতির কথা বুঝাইবার জন্য নবী করীম (স) এই হাদীসটিতে মানবেহিহাসের চারিজন নিকৃষ্টতম ব্যক্তির উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন, সে লোক কিয়ামতের দিন এই চার ব্যক্তির সঙ্গী হইবে। এই চার ব্যক্তির সঙ্গী হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল কায়্যিম লিখিয়াছেনঃ হয় সে তাহার ধন-সম্পদের ব্যাপারে বেশী মশগুল হওয়ার দারুন নামায সংরক্ষণ করিবে না, নয় দেশ শাসনের রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন অথবা ওজারতী ও সরকারী-বেসরকারী চাকুরীজনিত ব্যস্ততার কারণে কিংবা ব্যবসায়-বাণিজ্য কাজে ব্যতিব্যস্ততার দরুন। নামায সংরক্ষণ না করার প্রথম কারণটি হইলে তাহার পরিণতি কারুনের সহিত হইবে। দেশ শাসনে রাষ্ট্রীয় কাজের দরুন হইলে তাহার পরিণতি হইবে ফিরাউনের সঙ্গে। আর ওজারতী বা দায়িত্বপূর্ণ চাকুরীর কারণে হইলে সে পরকালে হামানের সঙ্গী হইবে। আর ব্যবসায়-বাণিজ্যের কারণে হইলে পরকাল তাহাকে উবাই ইবনে খালফের সাহচর্যে থাকিতে হইবে।========
কিন্তু ইহাদের সঙ্গী হওয়ার অর্থ কি? ইহারা যেমন চিরকাল জাহান্নামে থাকিতেবাধ্য হইবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায অসংরক্ষণকারী বা তরককারীকেও কি চিরকাল জাহান্নামে থাকিতে হইবে?
ইহার জওয়াব এই যে, যদি কোন মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাযকে ফরয বলিয়া বিশ্বাস না করে, তবে তাহাকে এই নিকৃষ্টতম ব্যক্তিদের সঙ্গে চিরকালই জাহান্নামে থাকিতে হইবে। ইহাদের সঙ্গী হওয়ার অর্থ ইহাই। কিন্তু যদি কেহ পাঁচ ওয়াক্ত ফরয বিশ্বাস করিয়াও উহা আদায় করিতে ত্রুটি করে, তাহা হইলেও সে ইহাদের সহিতই জাহান্নামী হইবে সন্দেহ নাই,-যদিও আযাবের মাত্রা ও পরিমাণে তাহাদের মধ্যে পার্থক্য হইবে এবং শেষ পর্যন্ত উহা হইতে মুক্তি পাইতে পারিবে বলিয়া আল্লাহর রহমতের প্রতি আসা পোষণ করা যাইতে পারে।
কিন্তু হাদীসটিতে নামায তরককারীর প্রতি কঠোর তিরষ্কার ও তীব্র ভীতির উল্লেখ প্রকট ও প্রচণ্ড হইযা উঠিয়াছে। ইহা হইতে একথাও জানা যায় যে, নামায নিয়মিত ও সুষ্ঠুভাবে আদায় করিতে না থাকিলে এবং মাঝে-মধ্যে বা কখনো কখনো পড়িলে সে নামাযের কোন অর্থও হয় না, নামাযী উহা হইতে পরকালে কোন ফায়দাই পাইতে পারিবে না।
হাদীস হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, নামায তরক করা নিশ্চিতউ কুফরি কাজ। ইমাম শাওকানী ইহার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, নামায ফরজ-একথা অস্বীকার করিয়া যদি কেহ নামায তরক করে তবে তাহার কাফির হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই-এই ব্যাপারে মুসলিম সমাজে কোন মতদ্বৈততাও নাই। তবে কোন নূতন মুসলমান যদি এরূপ করে, তাহা হইলে সঙ্গে সঙ্গেই তাহাকে কাফির বলা যাইবে না। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে সেই ব্যক্তি কাফির হইবে না। বটে, তবে নামায নিয়মিত না পড়ার অপরাধে তাহাকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হইবে। প্রয়োজন হইলে তাহাকে কয়েদ করিতে হইবে-যতদিন না সে নামায নিয়মিত পড়িতে প্রস্তুত হয়।=======
কোন কোন হাদীসবিদ বলিয়াছেন, মুসলমান হইয়াও যদি কেহ নামায না পড়ে তবে তাহাকে হত্যা করিতে হইবে। কেননা নবী করীম (স)-এর বাণীঃ
মুসলিম বান্দা ও কাফির ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য হইল নামায তরক করা-মুসলমান নামায তরক করে না, ফাফির তাহা করে।
এই ভিত্তিতে নামায তরককারী কাফির-উপযোগী ব্যবহার পাইবার যোগ্য। আর কোন মুসলমান যদি কাফির অর্থাৎ মুর্তাদ হইয়া যায়, তবে ইসলামী শরীয়ত তাহার শাস্তি-মৃত্যুদণ্ড।
মোটকথা, মুসলমান হইতে এবং মুসলমান থাকিতে হইলে নামায রীতিমত পড়িতেই হইবে। তাহা না পড়িলে কেহ মুসলিম বলিয়া গন্য হইতে পারে না এবং পরকালে সে জাহান্নামে যাইতে বাধ্য হইবে।
নামাজের তাকীদ
=============================
হযরত বুরাইদা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ নিশ্চয় আমাদের ও ইসলাম গ্রহণকারী সাধারণ লোকদের পরস্পরে নামাযে চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রহিয়াছে। কাজেই যে লোক নামায তরক করিবে, সে যেন কুফরির পথ গ্রহণ করিল।
-মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ্
ব্যাখ্যা এই অনুযায়ী কাফির ও মুসলমানদের মধ্যের পার্থক্যের ভিত্তি ও মানদণ্ড হইতেছে নামায তরফ করা। যে লোক নামায পড়ে না, সে ‘মুসলিম রূপে’ গন্য নয়। যে নামায পড়ে-তরক করে না সে মুসলমান। এই কারণে নবী করীম (স) ইসলাম গ্রহণকারী লোকদের নিকট হইতে নামায পড়ার ও তরক না করার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করিতেন। এই পর্যায়ের সাথে যে চুক্তি গৃহীত হইত তাহার ভিত্তি ছিল নামায। কেননা নামায পড়াই ঈমানের ও মুসলমান হওয়ার বাস্তব প্রমাণ। ইহাই ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
=============================
হযরত জাবির (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ্র বান্দা, কুফর ও শিরক-এর মাঝে নামায ত্যাগ করাই ব্যবধান মাত্র। – মুসলিম
ব্যাখ্যা ইমাম নববী লিখিয়াছেন, যে-যে কাজ না করিলে কুফরি হইয়া যায় তাহা দেখানোই এই ধরনের হাদীসসমূহের উদ্দেশ্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আল্লাহ্ তা’আলা ইবলীসকে বলিয়াছিলেন আদমকে সিজদা করার জন্য। কিন্তু ইবলীস এই আদেশ অমান্য করে। এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া কুরআন মজীদ বলিয়াছেনঃ
=============== সে কাফির হইয়া গেল।
নামায পড়ার জন্যও আল্লাহ্ তা’আলা বারবার নির্দেশ দিয়াছেন। বলিয়াছেনঃ
=========== নামায কায়েম কর।
এই নির্দেশ পালন না করিলে ও অমান্য করিলেও কাফির হইয়া যাওয়াই স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত। ইহা শুধু নামায তরফ করা বা না পড়া সম্পর্কে প্রযোজ্য। কিন্তু যদি কেহ ইবলীসের ন্যায় অহংকারবশতই নামায প্রত্যাখ্যান করে কিংবা নামাযকে ফরয মানিয়া না লয়, তাহা হইলে তাহার কাফির হইয়া যাওয়া অকাট্য ও অবধারিত। এইরূপ ব্যক্তি মুসলিম মিল্লাত হইতে বহিষ্কৃত হওয়ার যোগ্য। অবশ্য নিছক গাফিলতির কারণে যদি কেহ নামায না পড়ে; কিন্তু উহা ফরয হওয়ার প্রতি তাহার পূর্ণ বিশ্বাস অক্ষুণ্ন থাকে এবং মানে যে ফরয, তাহা হইলে এই ব্যক্তি ‘কাফির’ গন্য হইবে কিনা সে বিষয়ে মতভেদ রহিয়াছে। ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য অধিকাংশ ফিকাহবিদের মতে সে লোক কাফির নয়, সে ফাসিক। তাহাকে তওবা করিয়া রীতিমত নামায পড়িবার জন্য প্রস্তুত করা আবশ্যক। যদি স তওবা না-ই করে তাহা হইলেঃ
===================
আমরা তাহা মৃত্যুদণ্ড দিব-বিবাহিত ব্যক্তি জ্বিনা করিলে যেমন দণ্ড দেওয়া হয় ঠিক সেইরূপ।
কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (র) ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ মনীষী ভিন্ন মত প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন; তাহাকে মৃত্যুদণ্ড নয়, সাধারণ শাস্তি দানই বিধেয়।
===========================
হযরত আবূদ দারদা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমার প্রিয় বন্ধু ও সুহৃদ নবী করীম (স) আমাকে এই বলিয়া উপদেশ দিয়াছেনঃ (১) আল্লাহর সহিত এক বিন্দু পরিমাণও শির্ক করিবে না- তোমাকে ছিন্নভিন্ন ও টুকরা টুকরা করা কিংবা আগুনে ভস্ম করিয়া দেওয়া হইলেও। (২) সাবধান, কখনো ইচ্ছা বা সঙকল্প করিয়া কোন ফরয নামায ত্যাগ করিবে না। কেননা যে লোক ইচ্ছাপূর্বক নামায ত্যাগ করে, তাহার উপর হইতে আল্লাহ্ তা’আলার সেই দায়িত্ব শেষ হইয়া যায়, যাহা অনুগত ও ঈমানদার বান্দার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা গ্রহণ করিয়াছেন। (৩) আর কখনো মদ্য পান করিবে না। কেননা উহা সর্বপ্রকার অন্যায়, পাপ ও বিপর্যয়ের কুঞ্চিকা।
-ইবনে মাজাহ
ব্যাখ্যা হাদীসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের স্পষ্ট পথ-নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। প্রথম বলা হইয়াছেঃ আল্লাহ্র সহিত কাহাকে ও কোন জিনিসকেই শরীফ করিও না। এমনকি শির্ক না করার জন্য যদি নহত হইতে-ছিন্নভিন্ন ও টুকরা টুকরা অগ্নিকুন্ডলিতে নিক্ষিপ্ত হইতে হয়, তবুও তাহা করা যাইবে না। অন্ততঃ কোন ইমানদার ব্যক্তিই তাহা করিতে পারে না। ঈমান রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে হইলেও ইমানদার লোকদের অকুণ্ঠিত চিত্তে ও নির্ভীক হৃদয়ে সেইজন্য প্রস্তুত হওয়াই ঈমানের ঐক্যান্তিক দাবি।
প্রসঙ্গত মনে রাখা আবশ্যক, অনুরূপ অবস্থার মধ্যে পড়িয়া যদি কেহ কেবলমাত্র মুখে কুফরি কিংবা শির্কী কথার উচ্চারণ করে, তবে আল্লাহর নিকট সে নিশ্চয়ই কাফির বা মুশরিক হইয়া যাইবে না। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
============================
যে লোক আল্লাহ্র সহিত কুফরি করিবে তাহার ঈমান গ্রহণের পর’- তবে যাহাকে বাধ্য করা হইবে, অথচ তাহার দিল ইমানের ব্যাপারে পূর্ণ আশ্বস্ত ও নিশ্চিন্ত-কিন্তু যাহার হৃদয়, অন্তর কুফরিত পূর্ণ উন্মুক্ত, তাহাদের উপরই আল্লাহ্র গজব এবং তাহাদের জন্যই বড় আযাব নির্দিষ্ট।
-সুরা নহলঃ ১০৬
এই আয়াত প্রধানত দুইটি কথা বলা হইয়াছে। প্রথম, ঈমানের পর যাহারা কুফরি কবুল করিবে ও তাহাতেই তাহাদের হৃদয় মন নিষ্কন্ঠ ও আশ্বস্ত হইবে, আল্লাহর গজ তাহাদের উপরই এবং তাহাদের জন্যই বড় আযাব নির্দিষ্ট। আর দ্বিতীয় হইল, যাহাদিগকে কুফরি বা শির্ক করিতে বাধ্য করা হইবে, তাহাদের হৃদয় মন যদি আল্লাহ্র প্রতি ঈমানে পূর্ণ উন্মুক্ত নিশ্চিত ও আশ্বাস্ত থাকে, তাহা হইলে তাহারা আল্লাহ্র গজ ও আযাব হইতে নিষ্কৃতি পাইবে।
আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেন, যে লোক কেবলমাত্র মুখের ভাষায় আল্লাহ্র সহিত কুফরী বা শির্ক করিবে ও কেবল মৌখিক কথায় কাফির মুশরিকদের সহিত একাত্ম প্রকাশ করিবে-এই কারণে যে, তাহা করার জন্য তাহার উপর জোর-জবরদস্তি করা হইয়াছে, মারধোর করা হইয়াছে- কিন্তু আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি ঈমানের ব্যাপারে যাহারা হৃদয় মন অন্তর সম্পূর্ণ স্থির ও সম্পূর্ণ অবিচল থাকিবে, (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, এই আয়াতটি হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার (রা) সম্পর্কে নাযিল হইয়াছিল। তাহাকে মুশরিকরা নির্মমভাবে নিপীড়িত ও অত্যাচারিত করিয়াছিল হযরত মুহাম্মাদ (র)-এর প্রতি কুফরী করার জন্য। তিনি ইহাতে অতিষ্ঠ ও নিরুপায় হইয়া তাহাদের প্রতি ঐক্য প্রকাশ করেন। পরে তিনি রাসূলে করীমের নিকট এই ঘটনা বিবৃত করেন। ইহার পরই কিংবা এই প্রসঙ্গেই এই আয়াতটি নাযিল হয়।
তখন নবী করীম (স) হযরত আম্মার (রা)-কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
========== “তুমি তোমার মনের অবস্থা কিরূপ পাইতেছে?” তিনি বলিলেনঃ =========== ঈমানে অবিচল ও পূর্ণ আশ্বাস্ত। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ===== তাহা হইলে কোন আশংকাই নাই। তাহারা যদি আবার তোমাকে বাধ্য করে, তবে তুমিও মৌখিক ঐক্য জানাইবার কাজ করিতে পার।
আলোচ্য হাদীসে দ্বিতীয় বলা হইয়াছে ফরয নামায সম্পর্কে। ইচ্ছা করিয়া কখনই ফরয নামায তরক করিবে না। কেননা যে লোক ইচ্ছা করিয়া ফরয নামায তরক করে তাহার সম্পর্কে আল্লাহ্র গ্রহণ করা রহমত দান ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পরিত্যক্ত হইয়া যায়।
বস্তুত প্রত্যেক রাষ্ট্রের উপর প্রজা-সাধারণের অনেক কিছু অধিকার থাকে। থাকে প্রজা সাধারণের প্রতি রাষ্ট্র সরকারের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। ইহা স্বাভাবিকভাবেই হইয়া থাকে। প্রজাসাধারণ যতক্ষণ পর্যন্ত বিদ্রোহ পর্যায়ের কোন বড় ও কঠিন অপরাধ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র সরকার প্রজা-সাধারণের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করিতে থাকে এবং প্রজা-সাধারণও সেই অধিকারসমূহ পাইতে থাকে। ইহা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল কথা। আল্লাহ্ রাবুল আলামীনও সমস্ত ঈমানদার লোকদের জন্য কিছু বিশেষ অনুগ্রহ ও নিয়ামত দানের দায়িত্ব স্বীয় দয়া ও মেহেরবানীর কারণেই গ্রহণ করিয়াছেন। এই হাদীসে নামায পর্যায়ে বলা হইয়াছে, ইচ্ছাপূর্বক ফরয নামায ত্যাগ করা একটা সাধারণ, সামান্য ও নগন্য গুনাহ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইহা আল্লাহর বিরোধিতামূলক একটা অতিবড় অপরাধ, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই অপরাধ করিবার পর কোন লোকই আল্লাহ্র সেই বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহ লাভের অধিকারী থাকিতে পারে না। তখন আল্লাহ্র নিজের দয়ায় গ্রহণ করা দায়িত্ব আপনা আপনি নিঃশেষ হইয়া যায়। আলোচ্য হাদীসে ফরয নামায ইচ্ছাপূর্বক তরফ করিবার পরিনাম সম্পর্কে এই কথাই বলা হইয়াছে।
নামায সম্পর্কিত অপর একটি হাদীসের শেষভাগে রাসূলে করীম (স)-এর এই বাক্যাংশে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
=========================
যে লোক ইচ্ছা করিয়া ফরয নামায তরক করিবে, সে মুসলিম সমাজ ও জাতি হইতে-বাহির হইয়া গিয়াছে, বুঝিতে হইবে।
এইসব হাদীসে দুইটি মূল কথা বলা হইয়াছে। একটি এই যে, ফরয নামায তরক করা কুফরী পর্যায়ের কাজ। আর দ্বিতীয় হইল, ইহার দুরুন কার্যত মুসলিম মিল্লাত হইতে বাহির হইয়া যাওয়া হয়। ইহার কারণ এই যে, নামায ইসলামের সর্ব প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ইহা ইচ্ছাপূর্বক পরিত্যাগ করা এমন একটি সুস্পষ্ট ও অকাট্য প্রমাণ, যাহা হইতে নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারা যায় যে, আল্লাহ্, রাসূল ও দ্বীন-ইসলামের সহিত এই লোকটির কার্যত কোন সম্পর্ক নাই এবং সে নিজেকে নামাযী লোকাদের সমন্বয়ে গঠিত ইসরামী সমাজ ও মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত করে না। সেই নিজেই নিজেকে উহার বাহিরে লইয়া গিয়াছে। বিশেষত রাসূলে করীমের সোনালী যুগে কোন মুসলমান নামায তরফকারী হইতে পারে তাহা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। তাই সে কালে নামায পড়া মুসলমান হওয়ার এবং নামায তরক করা কাফির হওয়ার সুষ্পষ্ট নিদর্শন রূপে পরিগণিত হইত। তাবেয়ী আলিম আবদুল্লাহ ইবনে শফীক (র) সাহাবীদের এ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ
রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবিগণ কোন কাজ তরক করাকে কুফরী মনে করিতেন না। একমাত্র নামাযকেই এই পর্যায়ের কাজ বলিয়া মনে করিতেন।
অর্থাৎ নামায তরক করিলে কুফরী হয়, ইহাই ছিল সাহাবীদের বিশ্বাস, তৃতীয় বলা হইয়াছে মদ্যপান সম্পর্কে। ইহাতে মধ্যপান করিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কুরআনের আয়াতেই মদ্যপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও সম্পূণৃ বর্জনীয় বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছেঃ
========================
হে ঈমানদার লোকেরা! নিশ্চয় জানিও, মদ্য, জুয়া, পূজ্য দেবতা ও যাদু ইত্যাদি শয়তানী কাজের ঘৃণ্য ও মলিনতা। অতএব তোমরা উহার প্রত্যেকটিই পরিহার কর। সম্ভবত তোমরা কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করিবে।
আয়াতের বক্তব্য হইল, মদ্য প্রথমত অপবিত্র, দ্বিতীয়ত উহা পান করা সম্পূর্ণ শয়তানী কাজ। তৃতীয়ত উহা পরিহার কর- ইহা স্পষ্ট নির্দেশ এবং চতুর্থ উহা পরিহার করিলেই কল্যাণের আশা করা যায়। আর মদ্যপানে এই সমস্ত অন্যায় ও মলিনতায় নিমজ্জিত হওয়া অনিবার্য। পরবর্তী আয়াতে এই নিষেধের কারণ বলা হইয়াছেঃ শয়তান এই মদ্যপান ও জুয়া খেলার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি করে এবং আল্লাহ্র যিক্র ও নামায হইতে লোকদিগকে বিরত রাখে।
আলোচ্য হাদীসে মধ্যপান নিষিদ্ধ হওয়ার বহুবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম বড় কারণের উল্লেখ করা হইয়াছে। আর তাহা হইল, মদ সকল প্রকার পাপের ও অন্যায় অনাচারের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দেয়। বস্তুত যে লোক মধ্যপান করে, সে কেবল মদ্যপান করিয়া থামিয়া থাকে না। বরং রসাতলে ভাসিয়া যাওয়ার ইহাই হয় তাহার প্রথম পদক্ষেপ। অতঃপর লজ্জা-শরম, আল্লাহ্ ভীতি, ন্যায়রতা, মানবিকতা ও সাধারণ লোকচরিত্র-সব কিছুই এক এক এক করিয়া বিলীন হইয়া যায়। শুরু হয় চরম পাশবিকতা, কদর্যতা, নিষ্ঠুরতা ও শত্রুর হিংস্রতা। ব্যক্তি জীবন হইতে শুরু করিয়া পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, সর্বস্তরেই চরম বিপর্যয় নামিয়া আসে অতি দ্রুতগতিতে।
========================
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি রাসূলে করীম (স)কে বলিতে শুনিয়াছিঃ কিয়ামতের দিন বান্দার আমল পর্যায়ে সর্বপ্রথম তাহার নামায সম্পর্কে হিসাব লইবে। তাহার নামায যদি যথাযথ প্রমাণিত হয় তবে সে সাফল্য লাভ করিবে। আর যদি নামাযের হিসাবই খারাপ হয় তবে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। নামাযের ফরযের হিসাবে যদি কিছু কম পড়ে, তবে আল্লাহ্ রাবুল আলামীন তখন বলিবেনঃ তোমরা দেখ, আমার বান্দার কোন নফল নামায বা নফল বন্দেগী আছে কিনা, যদি থাকে, তাহা হইলে উহার দ্বারা ফরযের কমতি পূরণ করা হইবে। পরে তাহার অন্যান্য সব আমল উহারই ভিত্তিতে বিবেচিত ও অনুরূপভাবে কতি পূরণ করা হইবে।
– তিরমিযী
ব্যাখ্যা ইসলামী ইবাদতসমূহের মধ্যে নামায সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই নামায সঠিকভাবে ও রীতিমত আদায় করা না করার উপরই বান্দার পরকালীন মুক্তি ও সাফল্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। আর বান্দার উপর আল্লাহ্র হক্ সমূহের মধ্যে এই নামায সম্পর্কেই মিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হয় তবেই সে নষ্কৃতি পাইবে।, পাইবে কল্যাণ ও সাফল্য। বুঝিতে হইবে সেই লোক তাহার লক্ষ্যে পৌছিতে পারিয়াছেন। আর যদি কাহারো নামাযের হিসাবে দেখা যায় যে, সে তাহা পড়ে নাই কিংবা পড়িয়াছে বটে, কিন্তু নির্ভুলভাবে নয়, এমনভাবে পড়িয়াছে যাহা ভুল ও গ্রহণ অযোগ্য, তবে তাহার ব্যর্থতা ও ক্ষতিগ্রস্ততা অবধারিত। সে সাফল্য ও কল্যাণ লাভ হইতে বঞ্চিত হইবে। আযাব পাওয়া হইতে তাহার নিষ্কৃতি লাভ সম্ভব হইবে না।
নামায পড়িয়াছে এমন বান্দার হিসাবে যদি দেখা যায় যে, ফরয নামায আদায়ের ব্যাপারে কিছু কমতি পড়িয়াছে, মাত্রা কিংবা মান যথাযথ রক্ষিত হয় নাই, তখনই আল্লাহ্ তা’আলা তাহার নফল নামায বা নফল বন্দেগী দ্বারা সেই কমতি পূরণ করিয়া দিবেন। মুসনাদে আহমদ-এ এইখানে আল্লাহ্র হুকুমের ভাষা হইলঃ
======= সেই নফল দ্বারা তাহার ফরয সম্পূর্ণ করিয়া লও। এই সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
=================
আল্লাহ্ তা’আলার বান্দার সহীহ্ভাবে আদায় করা নফল নামায বা নফল বন্দেহীসমূহ ফরয নামাযের বদলে ও বিকল্পরূপে কবুল করিবেন।
ইহা যে একান্তভাবে আল্লাহ্ রাবুল আলামীনের ঐকান্তিক অনুগ্রহ মাত্র, তাহা বলার দরকার করে না।
============
পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয
==========================
আলহা ইবনে উবায়দুল্লাহ্ হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলেন, নজদের অধিবাসীদের মধ্য হইতে এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল। লোকটির মাথার চুল আউলানো-ঝাউলানো ছিল। তাহার মুখনিঃসৃত শব্দ আমরা শুনিতে পাইতেছিলাম কিনতু উহার কোন অর্থ আমরা বুঝিতেছিলাম না। পরে সেই লোকটি রাসূলে করীম (স)-এর নিকটে উপস্থিত হইল এবং সহসা সে ইসলামের দিক দিয়া (অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে) প্রশ্ন করিতে লাগিল। তখন রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ দিন রাত্রের মধ্যে পাঁচবার নামায পড়িতে হইবে। লোকটি জিজ্ঞাসা করিল, ইহা ছাড়া আরও নামায পড়া কি আমার কর্তব্য? বলিলেনঃ না, তবে তুমি যদি অতিরিক্ত কর। আর (দ্বিতীয় কর্তব্য হইল) রমযান মাসের রোযা পালন। লোকটি জিজ্ঞাসা করিল, ইহা ছাড়াও রোযা রাখা আমার কর্তব্য কি? বলিলেনঃ না, তবে তুমি যদি অতিরিক্ত কর। অতঃপর রাসূলে করীম (স) সেই লোকটিকে যাকাতের কথা বলিলেন। বলিল, ইহা ছাড়াও আমার উপর কর্তব্য আছে কি? বলিলেন, না, তবে তুমি যদি অতিরিক্ত কর। ইহার পর লোকটি এই কথা বলিতে বলিতে পিছনে সরিয়া গেল যে, আল্লাহ্র শপথ, আমি ইহার উপর কিছুই বাড়াইব না ও ইহা হইতে কিছুই কমাইব না। এই কথা শুনিয়া রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ যদি লোকটি সত্য বলিয়া থাকে, তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই কল্যাণ লাভ করিবে।
ব্যাখ্যা এই হাদীসে এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে রাসূলে করীম (স)-এর বলা কথাগুলি হইতে ইসলামের চরিটি প্রধান রুকনের মধ্যে তিনটির উল্লেখ পাওয়া গেল। তাহা হইলঃ নামায রোযা ও যাকাত। নামায পর্যায়ে জানা গেল, দিন রাত্রের মধ্যে মাত্র পাঁচ ওয়াক্তের নামায পড়া ফরয এবং ইসলামের আরোপিত অবশ্য কর্তব্য। রোযার পর্যায়ে জানা গেল, কেবলমাত্র রমযানের একটি মাস রোযা থাকা কর্তব্য। আর যাকাত পর্যায়ে বলা হইয়াছে, কেবল যাকাত আদায় করাই ফরয। ইহার পরও কিছু কর্তব্য আছে কিনা, প্রত্যেকটির উল্লেখের পর লোকটি রাসূলে করীম (স)-কে এই প্রশ্ন করিয়াছেন। প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাবে তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন। কথাটি হইলঃ
======= “না, তবে তুমি যদি অতিরিক্ত কিছু কর।” এই বাক্যটির দুটি অর্থ হইতে পারে। একটিঃ ===== তবে তুমি অতিরিক্ত আরো কিছু কর, ইহাই তোমার জন্য ভালো।
অর্থাৎ কেবল ফরয নামায পড়িয়াই ক্ষান্ত হইয়া থাকিও না। উহা ছাড়া অতিরিক্ত নফল হিসাবে তোমার আরও নামায পড়া উচিত, যেমন বিতর সূন্নাত এবং কিছু কিছু নফল নামায ইত্যাদি। কেবল রমজান মাসের রোযা থাকিয়া দায় এড়াইতে চাহিও না, বরং কিছু কিছু নফল রোযা রাখাও ভালো। আর কেবলমাত্র শতকরা চল্লিশ ভাগ হিসাব করিয়া ও গণিয়া গণিয়া যাকাত আদায় করিয়াই মনে করিও না যে, আর একটি পয়সাও কাহাকেও দিতে হইবে না। না, উহা আদায় করার পরও সাধারণ দান হিসাবে নফল স্বরূপ দান সাদকা করা উচিত। এই বাক্যটির দ্বিতীয় অর্থ হইলঃ
==========================
(নামায ও রোযার ফরয আদায়ের পর) কেহ যদি নফল নামায পড়িতে নফল রোযা রাখিতে শুরু করে, তাহা হইলে উহাকে সম্পূর্ণ করা তাহার উপর ওয়াজিব।
এই সব প্রশ্নোত্তর শেষ হওয়ার পর লোকটি চলিয়া যাইবার কালে যে কথাটি বলিয়াছিল, তাহা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। লোকটি বলিয়াছিলঃ আমি ইহার উপর কিছুই বাড়াইব না এবং ইহা হইতে কিছুই কমাইব না। ইহা প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত উক্তি। বস্তুত ইসলামের মৌল ভাবধারা যাহার হৃদয়ঙ্গম হইয়াছে, সে কখনও ইসলামের মূল বিধানের উপর নিজ হইতে কিছু বৃদ্ধি করে না, মূল বিধান হইতে কাট-ছাট করিয়াও লয় না। বরং মূল বধিান ও ব্যবস্থাকেই পূর্ণ আন্তরিকতা ও অপরিসীম আল্লাহ্-ভক্তি সহকারে অনুসরণ করিয়া চলিতে চেষ্টা করাই ঈমানদার লোকের কাজ। কেননা ইসলাম সম্পূর্ণত আল্লাহ্র নিকট হইতে অবতীর্ণ। ইহা কোন লোকের মনগড়া বিধান নয়। ইচ্ছা করিয়া কেহ ইহার উপর বৃদ্ধিও করিতে পারে না, কেহ কমও করিতে পারে না। তাহা করার কাহারো অধিকার নাই। বৃদ্ধি কিংবা কমতি যাহাই করা হউক না কেন, তাহাতে উহা আল্লাহর বিধান থাকিবে না। তাহার মনগড়া বিধান হইয়া যাইবে।
ঠিক এই কারণেই লোকটির উক্ত কথা শুনিয়া রাসূলে করীম (স) বলিয়াছিলেনঃ লোকটি সত্য বলিলে নিশ্চয়ই কল্যাণ লাভ করিবে। ‘সত্য বলিলে’ অর্থ বৃদ্ধি না করার ও কম না করার কথা যাহা লোকটি বলিতেছে তাহা যদি সত্যে পরিণত করে-যদি যেমন বলিতেছে তেমনই করে, তবে তাহার সাফল্য সন্দেহাতীত। কেননা যাহাই ইসলামের বিধান তাহা করাই সাফল্যের নিয়ামক।
মনে রাখা আবশ্যক, ‘আমি ইহার উপর কিছু বৃদ্ধি করিব না, ইহা হইতে কিছু কমও করিব না’ লোকটির এই কথার অর্থ এই নয় যে, এই নামায, রোযা ও যাকাত ছাড়া ইসলামের অন্যান্য আর কোন বিধান পালন করিব না। বরং ইহার অর্থ ইসলামের মূল বিধানের উপর আমি কিছু বৃদ্ধিও করিব না এবং মূল বিধান হইতে কিছু কমও করিব না। কেননা বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হাদীসটিতে লোকটির কথা এই ভাষায় বলা হইয়াছেঃ
=============================
আল্লাহ্ তা’আলা যাহা আমার প্রতি ফরয করিয়া দিয়াছেন, আল্লাহ্র শপথ আমি তাহার উপর কিছু বৃদ্ধিও করিব না, উহা হইতে কিছু কমও করিব না।
কেননা এই হাদীসে ইসলামে সম্পূর্ণ বিধান ও সব কয়টি ফরযের কথা উল্লেখিত হয় নাই। ইহার অর্থ এই নয় যে, হজ্জ বুঝি ইসলামের বিধান নয়। ইহার উল্লেখ এখানে না হওয়ার কারণ হইল, হাদীসটির বর্ণনাকারী সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়াছেন। সমস্ত কথার উল্লেখ করেন নাই। =====
নামায ফরয হওয়ার ইতিহাস
=============================
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স)-এর প্রতি মিরাজের রাতে প্রথমত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হইয়াছিল। পরে উহা কম করিয়া মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত করিয়া রাখা হয়। অতঃপর উদাত্তভাবে ঘোষণা করা হয়, হে মুহাম্মাদ! নিশ্চয় জানিও, আমার নিকট গৃহীত সিদ্ধান্ত কখনও পরিবর্তিত হয় না। তোমার জন্য এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমান।
-মুসনাদে আহমদ, নাসায়ী, তিরমীযি
ব্যাখ্যা উদ্ধৃত হাদীসটি ‘হাদীসুল-ইসরা’-মিরাজ সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদীসের অংশ বিশেষ। ইহা হইতে প্রথমত জানা যায় যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হইয়াছে মিরাজের রাত্রে, যখন নবী করীম (স) আল্লাহ্র অতীব নিকটে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিলেন এবং আল্লাহ্র সান্নিধ্য পূর্ণমাত্রায় লাভ করিয়াছিলেন। এই সময় আল্লাহ্ তা’আলা মুসলমানদের প্রতি প্রথমত দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করিয়া দেন। কিন্তু এত বেশী নামায যথারীতি আদায় করা মুসলমানদের পক্ষে অপরিসীম কষ্টকর হইবে বিধায় আল্লাহ্ তা’আলা দয়াপরবশ হইয়া শেষ পর্যন্ত শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই বহাল রাখিলেন এবং এই পাঁচ ওয়াক্ নামাযই পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমা সওয়াব বাহকহইবে, এই কথাও তিনি জানাইয়া দিলেন।
এই হাদীসটি হইতে এই কথাও জানা গেল যে, ফরয নামায কেবলমাত্র এই পাঁচ ওয়াক্ত। ইহা ছাড়া আর কোন নামায ফরয নয়। জুম’আর নামায শুক্রবার দিনের জুহরের স্থলাভিষিক্ত, জুহরের পরিবর্তে উহা পড়া হয় এবং উহাও ফরয।
পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয-ইহা অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। মিরাজের পূর্বে নবী করীম (স) নামায পড়িতেন। কিন্তু তখনকার নামায ছিল প্রধানত রাত্রিকালীণ এবং তখন নামাযের রাকআতও নির্দিষ্ট ছিল না, এমন কি তখন উহার জন্য সময়ও নির্ধারিত ছিল না। ============
পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের ফল
===========================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি রাসূলে করীম (স)-কে এই কথা বলিতে শুনিয়াছেন যে, তোমরা কি মনে কর, যদি কাহারও ঘরের দরজায় কোন খাল থাকে এবং তাহাতে সে প্রত্যেক দিন পাঁচবার করিয়া নিয়মিত গোসল করে তবে ইহা কি তাহার শরীরে কোন ময়লা থাকিতে দিবে?- তোমরা কি বল? সাহাবাগণ বলিলেনঃ না, তাহার দেহে কোন ময়লাই থাকিতে দিবে না। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের দৃষ্টান্তও ঠিক এইরূপ, আল্লাহ্ উহার সাহায্যে যাবতীয় গুনাহ-খাতা দূর করিয়া দেন।
-বুখারী
ব্যাখ্যা পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত ও সঠিকভাবে পড়ার গুরুত্ব ও উহার উপকারিতা বুঝাইবার জন্য রাসূলে করীম (স) আলোচ্য হাদীসে একটি চমৎকার দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ কেহ যদি তাহার ঘরের সম্মুখস্থ খালে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে, তবে তাহাতে যেমন তাহার শরীরে কোন ময়লা থাকিতে পারে না, অনুরূপভাবে দৈনিক পাঁচবার নামায পড়িলেও কাহারও মনে ও অন্তরে কোন পাপ চিন্তা ও পাপ কাজের কোন অভ্যাস থাকিতে পারে না। বরং পাঁচবার গোসলের ফলে যেমন দেহের মলিনতা ধুইয়া মুছিয়া পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন হইয়া যায়, অনরূপভাবে পাঁচবার নামায পড়িলে মনের সকল কুটিলতা, পাপচিন্তা ও যাবতীয় গুনাহ খাতা দূরীভূত হইয়া যায়। পানি দ্বারা ধৌত করার ফল দৈহিক মলিনতা দূর হওয়া, আর পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া হইতেছে মানসিক ও বাস্তব পাপ দূর করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। এখানে দেহের সহিত মনেরও পাঁচবার ধৌত করাকে পাঁচবার নামায পড়ার সহিত তুলনা করা হইয়াছে। কুরআন মজীদে এই নামাযের ফল বুঝাইবার জন্য বলা হইয়াছেঃ
======================
নিশ্চয়ই নামায (মানুষকে) লজ্জাষ্কর ও নিষিদ্ধ কাজ হইতে বিরত রাখে।
রাসূলে করীম (স) উপরিউক্ত হাদীসে এই আয়াতেরই অর্থ নিজস্ব ভাষায় ও দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বুঝাইয়া দিয়াছেন।
ঘরের দরজার সম্মুখস্থ খালের দৃষ্টান্ত দেওয়ার উদ্দেশ্য হইতেছে এই কথা বুঝানো যে, খাল যেমন ঘরের সম্মুখে বর্তমান এবং উহাতে আপনা-আপনি পানি আসতে থাকে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও আপনা-আপনি একজন নামাযীর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়। কোথাও হইতে তাহা টানিয়া আনিতে হয় না। আর ঘরের দরজার সম্মুখে সদা প্রবহমান খাল থাকিলেও যদি কেহ উহাতে গোসল করিয়া স্বীয় দেহের মলিনতা দূর না করে তবে বুঝিতে হইবে, সে ময়লাকেই ভালবাসে, ময়লাযুক্ত হইয়া থাকাকেই সে পছন্দ করে। দেহের ময়লা বিদূরণের স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সে উহাতে অবগাহন করিয়া মলিনতা হইতে মুক্তি লাভ করিতে প্রস্তুত নয়। অনুরূপভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য নর্দিষ্ট সময় একজনের নিকট একের পর এক আসিয়া উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও যদি সে নামায পড়ার ও নামায পড়িয়া নিজেকে পাপ মুক্ত করার কিছুমাত্র উদ্যোগী না হয়, তবে বুঝিতে হইবে যে, সে পাপকেই ভালবাসে এবং নিজেকে পাপী করিয়া রাখাকেই সে পছন্দ করে। অন্যথায় এই সুবর্ণ সুযোগ সে কিছুতেই হারাইতে প্রস্তুত হইত না।
ঝর্ণাধারা একটি প্রবহমান জিনিস, নামাযও একটি স্থায়ী আবর্তনশীল ও গতিবান ব্যবস্থা। ঝর্ণার স্বচ্ছ সলিলে অবগাহন করিলে যেমন দেহ ও কাপড় পরিষ্কার হইয়া যায়, নামাযও তেমনি মানুষের মনকে শান্ত-সুস্থ ও পবিত্র করিয়া দেয়। ইবনুল আরাবী বলিয়াছেনঃ
============================
নামাযসমূহ বান্দাকে পাপের মালিণ্য হইতে পবিত্র করিয়া দেয়, শেষ পর্যন্ত এই নামায কোন গুনাহই অবশিষ্ট রাখে না, বরং সবকিছুই দূর করিয়া দেয়- বিলীন করিয়া দেয়।
আলোচন্য হাদীসের প্রকাশ্য শব্দের দৃষ্টিতে যদিও মনে হয়, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়িলে সকল প্রকার গুনাহই মাফ হইয়া যাইবে। কিন্তু ইহার সঠিক ধারণা মেলে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীস হইতে। হাদীটি এইঃ
============================
পাঁচ ওয়াক্ত নামায উহাদের মধ্যবর্তী সময়ের সব গুনাহ মাফ করিয়া দেয়-যদি কবীরা গুনাহ না করা হয়।
– মুসলিম
ইবনে বাত্তাল বলিয়াছেনঃ হাদীস হইতে এই অর্থ গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয় যে, রীতিমত নামায পড়লে সব সগীরা গুনাই মাফ হইয়া যাইবে। কেননা আলোচ্য হাদীসে এই গুনাহকে তুলনা করা হইয়াছে ময়লার সাথে। আর অন্যান্য বড় বড় মলিনতার তুলনায় ইহা ছোট। তাই পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথারীতি পড়িলে ছোট ছোট গুনাহ সবই মাফ হইয়া যাইবে, যদি কবীরা গুনাহ না করা হয়। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামায যে পড়ে না, সে কবীরা গুনাহ হইতে বাঁচিতে পারে না। কেননা এই নামায তরক করাই কবীরা গুনাহ।
পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার গুরুত্ব
=========================
হযরত উবাদা ইবনুসসামেত (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি রাসূলে করীম (স)কে বলিতে শুনিয়াছিঃ পাঁচ ওয়াক্তের নামায আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাদের উপর ফরয করিয়াছেন। যে লোক ইহা যথাযথভাবে আদায় করিবে এবং উহার অধিকার ও মর্যাদার প্রতি অসম্মান দেখাইতে গিয়া উহার একবিন্দু নষ্ট হইতে দিবে না তাহার জন্য আল্লাহর নিকট প্রতিশ্রুতি রহিয়াছে, তিনি তাহাকে বেহশ্তে দাখিল করিবেন। আর যে লোক উহা পড়িবে না, তাহার জন্য আল্লাহ্র নিকট কোন প্রতিশ্রুতি নাই। তিনি ইচ্ছা করিলে তাহাকে যআযাব দিবেন, আর ইচ্ছা করিলে তাহাকে জান্নাতে দাখিল করিবেন।
-বাদায়েউস্সানায়েও
ব্যাখ্যা এই নামাযসমূহ ফরয হইয়াছে মহা অনুগ্রহকারীর সীমা সংখ্যা পরিমানহীন ও কল্পনাতীত নিয়ামত সমূহের শোকর আদায়স্বরূপ। প্রথম নিয়ামত বান্দাকে সৃষ্টি করা, সৃষ্টি করা অতীব উত্তম রূপ, আকার-আকৃতি ও গঠন-প্রভৃতিতে মানুষ ও মনুষ্যত্বকে তিনি সৃষ্টিকূলের মধ্যে সর্বোচ্চ দান করিয়াছেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলিয়াছেনঃ
===========================
আমরা মানুষকে অতীব উত্তম কাঠামো ও আকার আকৃতিতে সৃষ্টি করিয়াছি। তোমাদিগকে উত্তম আকার-আকৃতি দান করিয়াছেন।
প্রত্যেকটি মানুষ তাহার নিজের চেহারা ও মুখাকৃতিকে বেশী পছন্দ করে-অন্য লোকের দৃষ্টিতে তাহা যতই কৃৎসিত হউক না কেন। তিনি মানুষকে সুস্থ ও কর্মক্ষম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করিয়াছেন। এমন কোন খুঁত বা অপূর্ণতা রাখেন নাই, যাহার দরুণ মানুষ এইগুলি ব্যবহার করিতে অসমর্থ থাকিতে পারে। ইহাও মানুষের প্রতি আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ। অথচ ইহা মানুষের নিজের কৃত কোন কাজের ফল বা বিনিময় নয়। এই কারণে আল্লাহ্ তা’আলা বান্দার এই গোটা দেহ সত্তা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাঁহারই ইবাদতে সম্পূর্ণরূপে নিয়োগ করিবার জন্য নির্দেশ দিয়াছেন। ইহাও শোকর আদায়স্বরূপ। কেননা-
======================
নিয়ামতের শোকর হইল সেই নিয়ামতকে নিয়ামতকে নিয়ামতদাতার আরাধনা, উপাসনা ও আনুগত্যমূলক কাজে ব্যবহার করা।
নামাযে দাঁড়াইবার, রুকু-সিজদা করা, বসা ও বসা হইতে উঠিবার কাজ করিতে হয়। এই সব কাজেই বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহৃত হয়। আর আভ্যন্তরীণ শক্তি মন-মগজ, চেতনা, ইচ্ছা-বাসনা ইত্যাদি সব কিছুকে আল্লাহ্র দিকে রুজু করিতে হয়। তাঁহার শাস্তির ভয় ও রহমতে মাগফিরাত পাওয়ার আশা অন্তর ভরিয়া পোষণ করিতে হয়। বিবেক-বুদ্ধিকে সেই দিকে সদা সচেতন ও সক্রিয় রাখিতে হয়-যেন প্রত্যেক অঙ্গের আমল মহান দাতার শোকর স্বরূপ আদায় হইয়া যায়। দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গের জোড়াগুলি মসৃণ করা হইয়াছে। এই কারণেই সেইগুলি নামাযের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হইতেছে। এই কারণেই সেইগুলি নামাযের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হইতেছে। ইহারও শোকর করিতে হইবে নামাযে এইগুলিকে যথযথভাবে ব্যবহার করিয়া। কেননা কৃতজ্ঞতা-উপকারীর উপকার স্বীকার করা যুক্তি ও বিবেক-বুদ্ধির সব বিচারেই কর্তব্য। সব ইবাদতই আল্লাহ্ রাবুল আ’লামীনের নির্দেশ পালন! মানুষ আল্লাহ্র বান্দা-বান্দার কর্তব্য ও ফরয মা’বুদের সব নির্দেশ পালন করা। চব্বিশ ঘণ্টার প্রতিটি মুহূর্তই তাঁহার সম্মুখে বিনয়াবনতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিলেও এই কৃতজ্ঞতা সম্পূর্ণ হইতে পারে না। কিন্তু মা’বুদ বান্দার প্রতি সে আদেশ করেন নাই। বিশেষ বিশেষ ইবাদতের জন্য তিনি সময় ও মিয়াদ নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। ইহাও তাঁহারই অনুগ্রহ। অন্যথায় বান্দার পক্ষে তাহা করা কিছুতেই সম্ভবপর হইত না। মানুষ সাধারণত গুনাহ খাতায় নিমজ্জিত হইয়া থাকে। তাহা হইতে সম্পূর্ণ রক্ষা পাইয়া যাওয়া মানুষের সাধ্যতীত। এইজন্য পাঁচটি নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহ্ নামাযের কর্তব্য চাপাইয়া দিয়াছেন, যেন উহার বাহিরে যেসব গুনাহ বান্দার হয়, তাহা এই নামাযের দরুন মাফ হইয়া যায়। তাই বলা হয়ঃ
==========================
এইসব গুনাহ খাতা কাফ্ফারাস্বরূপ পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হইয়াছে। ======
পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময়
===========================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর -ইবনুর আ’স (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, জুহরের নামাযের সময় হয় তখন, যখন সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলিয়া পড়ে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির ছায়া তাহার দৈর্ঘ্যর সমান হয়। আর ইহা আসরের নামাযের সময় হওয়া পর্যন্ত থাকে। আসরের নামাযের সময় সূর্যের হলুদ বর্ণ ধারণ না করা পর্যন্ত স্থায়ী হয়, মাগরিবের নামাযের সময় অস্ত আকাশের লালিমা বিলীন হইয়া না যাওয়া পর্যন্ত থাকে। এশার নামাযের সময় থাকে মধ্যম রাত্রি পর্যন্ত। আর ফজরের নামাযের সময় প্রথম ঊষা লগ্ন হইতে সূর্যোদয় পর্যন্ত থাকে। কিন্তু যখন সূর্যোদয় হইতে থাকে তখন নামায পড়া হইতে বিরত থাক। কেননা উহা শয়দানের দুই শৃংগের মধ্যবর্তী স্থানে উদিত হয়।
-মুসলিম
ব্যাখ্যা এই হাদীসে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচবার নামায পড়ার সময় নির্ধারণ করা হইয়াছে এবঙ নামাযের ওয়াক্তের সূচনা ও শেষ সীমা স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে। এই ওয়াক্তসমূহ নিন্মরূপঃ
১. জুহরের সময় সূর্যের মধ্য আকাশ হইতে পশ্চিম দিকে ঢলিয়া পড়ার সময় হইতে আসরের নামাযের সময় উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত। সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলিয়াছে কিনা তাহা অনুমান করার জন্য হাদীসে একটি মানদণ্ডের উল্লেখ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, একজন মানুষের ছায়া যখন তাহার দৈর্ঘ্যের সমান হইবে, তখনি জুহরের নামাযের সময় হইয়াছে বলিয়া মনে করিতে হইবে।
২. আসরের নামাযের সময় হয় ইহার পর-সূর্যের দীপ্ত খরতাপ যখন কিছুটা নিস্তেজ হইয়া আসিবে এবং সূর্যরশ্মির ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করা পর্যন্ত তাহা স্থায়ী হইবে।
৩. মাগরিবের নামাযের সময় হয় সূর্যাস্ত হওয়ার পর মুহূর্ত হইতে এবং তাহা স্থায়ী থাকে পশ্চিম আকাশের লালিমা বিলনি না হওয়া পর্যন্ত।
৪. অস্ত্র আকাশের লালিমা বিলীন হইয়া গেলে তখন এশার নামাযের সময় উপস্থিত হয়। ইহা স্থায়ী থাকে অর্ধেক রাত্র পর্যন্ত।
৫. পূর্ব আকাশে প্রথম ঊষার উদয় হইলে ফজরের নামাযের সময় হয় ও সূর্যোদয়ের পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত তাহা স্থায়ী থাকে। সূর্যোদয় হইতে শুরু করিলে তখন নামায পড়া নিষেধ।
ইহার কারণস্বরূপ বলা হইয়াছেঃ উহা শয়তানের দুই শৃংগের মধ্যবর্তী স্থানে উদিত হয়ঃ ‘শয়তানের শৃংগ’ অর্থ, উহার সম্মুখভাগ, উহার ললাট দেশ। সূর্যোদয়ের সময় শয়তান উহার সম্মুখদেশে নিজেকে স্থাপন করে এবং সূর্যপূজারীদের নিকট হইতে পূজা গ্রহণ করে। কিন্তু কার্যত সূর্যের পরিবর্তে শয়তানের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শয়তান মনে করে, ইহারা সূর্যের নয়, তাহারই পূজা করিতেছে। এই জন্য টিক এই সময় নামায পড়িতে নবী করীম (স) নিষেধ করিয়াছেন। কেননা এই সময় নামায পড়িলে সূর্যপূজারীদের সহিত সাদৃশ্য হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে।
============================
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, প্রত্যেক নামাযেরই একটা প্রথম সময় রহিয়াছে এবং রহিয়াছে একটা শেষ সময়। উহার বিবরণ এই যে, জুহরের নামাযের প্রথম সময় শুরু হয় তখন, যখন সূর্য মধ্য আকাশ হইতে পশ্চিম দিকে ঢলিয়া পড়ে। উহার শেষ সময় তখন পর্যন্ত থাকে যখন সূর্যাস্তকালীন রক্তিম বর্ণের লালিমা নিঃশেষে মুছিয়া যায়। এশার নামাযের প্রথম সময় সূচিত হয় যখন সূর্যাস্তকালীন রক্তিম আভা নিঃশেষ হইয়া যায় এবং উহার শেষ সময় দীর্ঘায়িত হয় অর্ধেক রাত পর্যন্ত। আর ফযরের নামাযের প্রথম সময় শুরু হয় প্রথম ঊষার উদয়লগ্নে এবং উহার শেষ সময় সূর্যোদয় পর্যন্ত থাকে।
ব্যাখ্যা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময় এবং উহার আরম্ভ ও শেষ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই নবী করীম (স) এই হাদীসের কথাগুলিৱ বলিয়াছেন। হাদীসটি পাঠ করিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, নবী করীম (স) যাঁহাদের সম্মুখে নামাযের সঠিক সময়ে এই ব্যাখ্যা দিয়াছিলেন, তাঁহারা নামাযের সময় সম্পর্কে মোটামুটিভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। সেই কারণেই কথার ধরন এমন হইয়াছে, যেমন আসরের নামাযের প্রথম সময় শুরু সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ আসরের নামাযের সময় শুরু হয় টিক উহার সময় সূচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।’ ‘আসরের নামাযের শেষ সময় সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ উহা তখন পর্যন্ত থাকে, যখন সূর্যরশ্মি হরিৎ বর্ণ ধারণ করে অর্থাৎ সূর্যরশ্মি হরিৎবর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত আসরের নামাযের জন্য ভালো ও পছন্দসই সময়। কিন্তু উহার পর যে আসরের নামায আর পড়া যাইবে না এমন নহে! কেননা প্রয়োজনের সময় সূর্যাস্তকাল পর্যন্ত এই নামায আদায় করা যাইতে পারে। তবে সূর্যরশ্মি হরিৎবর্ণ ধারণ করার পূর্বেই আসরের নামায পড়িয়া লওয়া বাঞ্ছনীয়। আর যদি কাহারো পক্ষে কোনদিন যথাসময়ে আসরের নামায আদায় করিয়া লওয়া বিশেষ কোন কারণে সম্ভবপর না-ই হয়, তবে সে সূর্যাস্তকাল পর্যন্ত আদায় করিতে পারিবে। তাহাতেও নামায হইবে। এই পর্যায়ে নবী করীম (স)-এর অপর দুইটি বাণী স্মরণীয়। একটিতে তিনি বলিয়াছেনঃ
==========================
যে লোক সূর্যাস্তের পূর্বে আসরের এক রাক্’আত নামাযও পড়িতে পারিল, সে পুরা আসরই পাইল। অপর হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
=======================
যে লোক সূর্যাস্তের পূর্বে আসরের নামাযের একটি সিজদাও দিতে পারিল সে যে র্পূণ আসরই পড়িতে পারিল।
ইহার অর্থ এই যে, যদি কেহ যথাসময়ে আসরের নামায পড়িতে না-ই পারে, সময় যদি শেষ হইয়াই যায়, তাহা হইলে সে যে আসরের নামায পড়িবে না তাহা নয়, বরং অনতিবিলম্বে তাহাকে নামাযে দাঁড়াইয়া যাইতে হইবে। সূর্যাস্তের পূর্বে এক রাক’আত পড়িতে পারিলেও ধরা যাইবে যে, সে সেই দিনের আসরের নামায পড়িয়াছে।
জামা’আতের সহিত নামায
============================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ জামা’আতের সহিত পড়া নামায একাকী নামায অপেক্ষা সাতাশ গুণ অধিক উত্তম ও মর্যাদাসম্পন্ন।
-বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা এই হাদীসে জামা’আতের সহিত নামায পড়ার জন্য উৎসাহ দান করা হইয়াছে। বলা হইয়াছেঃ একাকী পড়া নামাযের তুলনায় জামা’আতের সহিত পড়া নামায অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। এই হাদীসে সাতাশ গুণ অধিক মর্যাদার উল্লেখ করা হইয়াছে। কিন্তু হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে পঁচিশ গুণ অধিক মর্যাদার উল্লেখ করা হইয়াছে। আসলে এই সংখ্যা পার্থক্যের কোন গুরুত্ব নাই। আর কুরআন ও হাদীসে আমলের ফয়ীলত প্রসঙ্গে যত সংখ্যারই উল্লেখ হইয়া থাকে, উহার মূল্য লক্ষ্য বিশেষ কোন সংখ্যা বোঝানো নয়, বরং পরিমাণ বা মাত্রার আধিক্য বুঝানোই উহার উদ্দেশ্য। ইহাও হইতে পারে যে, প্রথমে রাসূলে করীম (স) কম সংখ্যার উল্লেখ করিয়াছেন। পরে আল্লাহ তা’আলা তাঁহাকে অধিক সংখ্যা জানাইয়া দিয়াছেন কিংবা নামায ও নামাযীর অবস্থার পার্থক্যের দৃষ্টিতে জামা’আতের সহিত নামায পড়ার মর্যাদা মাত্রায়ও পার্থক্য হইতে পারে। ফলে কাহারো জামা’আত সহকারে নামায পড়ায় পঁচিশ গুণ অধিক মর্যাদা হইতে পারে, আর কাহারো হইতে পারে সাতাশ গুণ অধিক।
=============================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, কোন নামাযে নবী করীম (স) কিছু সংখ্যক লোককে দেখিতে পাইলেন না। তিনি বলিলেনঃ আমি স্থিরভােব মনস্থ করিয়াছি যে, একজনকে লোকদের লইয়া নামায পড়িতে আদেশ দিয়া আমি সেই সব লোকের নিকট চলিয়া যাইব, যাহারা নামাযে অনুপস্থিত থাকে। অতঃপর কাষ্ঠ জমা করিয়া তাহাদের ঘর জ্বালাইয়া দিতে বলিব। তাহাদের কেহ যদি জানিতে পারিত যে, তাহারা (নামাযে আসিলে) কোন চর্বিদার হাড় পাইতে পারিবে, তবে তাহারা অবশ্যই নামাযে অর্থাৎ এশার নামাযে উপস্থিত হইত।
– বুখারী মুসলিম
ব্যাখ্যা বুখারী শরীফে নবী করীম (স)-এর আলোচ্য কথার শুরুতে এই শপথ উদ্ধৃত হইয়াছেঃ ==== সেই আল্লাহর শপথ, যাঁহার মুঠির মধ্যে আমার প্রাণ নিবদ্ধ রহিয়াছে। ফলে এই হাদীসটি অত্যন্ত জোরদার হইয়াছে। ইহাতে জামা’আতে হাযির হওয়ার গুরুত্ব প্রকাশ করা হইয়াছে এবং যাহারা জামা’আতে হাযির হয় না, তাহাদের প্রতি রাসূলে করীম (স)-এর প্রবল অসন্তোষ প্রকাশ করা হইয়াছে। শুধু তাহাই নয়, যাহারা নামাযের জামা’আতে অনুপস্থিত থাকে, তাহাদের ঘরে আগুন লাগাইয়া দেওয়ার মত কঠিন শাস্তি দানেরও ভীতি প্রদর্শন করিয়াছেন। ইহা হইতে জামা’আতে হাযির হওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সুষ্পষ্টরূপে প্রমাণিত হইয়াছে।
এই হাদীস এবং এই পর্যায়ের অন্য কয়েকটি হাদীসের ভিত্তিতে বলা হইয়াছে যে, জামা’আতের সহিত নামায পড়া ওয়াজিব। কেননা উহা সুন্নাত হইলে উহার দরকারীর জন্য রাসূলে করীম (স) এতবড় কঠিন শাসন বাণী উচ্চারণ করিতেন না। আর যদি ‘ফরযে কিফায়া’ হইত, তবুও এইরূপ ভীতি প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল না। কেননা, কিছু লোক তো রাসূল (স)-এর সহিত জামা’আতে নামায পড়িতেই ছিলেন। কিছু সংখ্যক তাবেয়ী আলিম উহাকে ‘ফরযে আইন’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। মালিকী ও হানাফী মাযহাবের অনুসারী বহু আলিমের মতে ইহা ফরযে কিফায়া। আর অপরাপর আলিমদের মতে ইহা সুন্নাত। ইমাম মালিক ও ইমাম আবু হানীফাও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেনঃ জামা’আতে নামায পড়া যদি ফরয হইত, তবে নবী করীম (স) জামা’আতে অনুপস্থিত লোকগিতকে কেবল মৌখিক শাসন ও ভীতি প্রদর্শন করিয়াই ক্ষান্ত হইতেন না। আসলে ইহা কেবলমাত্র শাসন বাণী লোকদিগকে জামা’আতের গুরুত্ব বুঝাইবার ও জামা’আতে রীতিমত শরীক হইতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যেই এইরূপ কথা বলা হইয়াছে।
কাযী ইয়ায বলিয়াছেনঃ প্রথমে জামা’আতে নামায পড়া ফরয ছিল। পরে ইহা রহিত হইয়াছে। আবার কেহ বলিয়াছেন যে, আস এই কঠোর শাসন বাণী কেবলমাত্র জুম’আর নামাযে অনুপস্থিত লোকদের জন্যই উচ্চারিত হইয়াছে। অন্যান্য নামায সম্পর্কে ইহা প্রযোজ্য নহেত।
===========================
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন, মুনাফিকদের পক্ষে ফজর ও উশার নামায অপেক্ষা অধিক কষ্টদায়ক ও দুঃসাধ্য কাজ আর কিছু নাই। কিন্তু এই দুইটি নামাযের কি সওয়াব ও পুরস্কার এবং বরকত নির্দিষ্ট রাখা হইয়াছে তাহা যদি তাহারা জানিত, তাহা হইলে তাহারা এই নামাযে অব্শ্যই উপস্থিত হইত। সেই জন্য হাঁটুতে ভর দিয়া ও হামাগুড়ি দিয়া আসিতে হইলেও ইহা হইতে পিছ পা হইত না। (অতঃপর তিনি বলেন) আমার ইচ্ছা হয়, কোন দিন মুয়াযযিনকে জামা’আতের জন্য ইকামত বলিতে নির্দেশ দিয়া এবং আমার পরিবর্তে অপর একজনকে ইমামতি করার দায়িত্ব দিয়া আমি আগুনের মশাল হাতে লইয়া বাহির হইব এবং যাহারা আযান-ইকামত হওয়ার পরও জামা’আতে শরীক হইবে না তাহাদের সহ তাহাদের ঘরগুলি জ্বালাইয়া দিব।
-বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা এই হাদীসটিও পূর্বোক্ত হাদীসেরই অনুরূপ। দুইটি হাদীস একই বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত। ইহাতেও জামা’আতে অনুপস্থিত লোকদের জন্য কঠিন শাস্তির উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহা রাসূলে করীম (স)-এর সময়ের লোকদের সম্পর্কে তাঁহার উক্তি। হযরত উসামা (রা) হইতে বর্ণিত এই পর্যায়ের হাদীসটি অধিকতর স্পষ্ট। তাহাতে বলা হইয়াছেঃ
============================
জামা’আতের সহিত নামায পড়া হইতে বিরত থাকা লোকদের ত্যাগ করা উচিত। অন্যথায় আমি তাহাদের ঘরসমূহে আগুন ধরাইয়া দিব।
মোটকথা, জামা’আতের সহিত নামায পড়াই ইসলামের বিধান। জামা’আতে অনুস্থিত থাকা অতি বড় গুনাহ, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
জামা’আতের কাতার সোজা করা
==========================
হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ তোমরা সকলে নামাযের কাতারসমূহ সমান সমান করিয়া লইবে। কেননা কাতার সোজা ও সমান করার ব্যাপারটি সঠিকভাবে নামায কায়েম করারই একটা বিশেষ অংশ।
-বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা কুরআন মজীদে নামায কায়েম’ করার যে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, যাহা মুসলমান মাত্রেরই অবশ্য কর্তব্য, তাহা পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথভাবে আদায় করার অন্যতম শর্ত হইল জামা’আতের কাতারসমূহ সরল রেখার মত দাঁড় করা। সমান সমান ও সোজা করা। বস্তুত মুসলমানদের সামাজিক জীবনের প্রধান স্তম্ভ হইল জামা’আতের সহিত নামায। এইজন্য কাতারসমূহ সোজা ও ঠিক ঠিক ভাবে দাঁড় করানো অপরিহার্য শর্ত করা হইয়াছে। আর নামাযের মত উন্নত সামষ্টিক ইবাদতের জন্য ইহা যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ তাহাতে সন্দেহ নাই। সেইসঙ্গে ইহারও নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে য, নামাযের প্রথম কাতার সর্বপ্রথম পূর্ণ করিতে হইবে। পরে পর পর কাতারগুলো সমান ও সোজাভাবে দাঁড় করাইতে হইবে। একজন এক ইঞ্চি সম্মুখে ও একজন এক ইঞ্চি পিছনে দাঁড়াইবে না বরং কাধেঁ কাঁধ মিলাইয়া ও পায়ে পা মিলাইয়া দাঁড়াইবে। তাহা হইলে কাতার সোজা ও ঋজু হইবে।
আবূ দাউদ বর্ণিত অপর কয়েকটি হাদসি হইতে জানা যায় যে, নবী করীম (স) প্রত্যেক নামায কালে ডানদিকের লোকদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেনঃ তোমরা সোজা হইয়া দাঁড়াও। পরে বামদিকে মুখ করিয়াও অনুরূপ কথা বলিতেন।
==========================
হযরত নু’মান ইবনে বশীল (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) আমাদের নামাযের সারিগুলোকে এতদূর সমান ও সোজা করিতেন যে, ইহা দেখিয়া মনে হইত, তিনি বোধ হয় উহা দ্বারা তীরগুলোকে সোজা করিবেন। এইভাবে করিতে করিতে শেষ পর্যন্ত তিনি মনে করিলেন যে, আমরা হয়ত উহার গুরুত্ব বুঝিতে পারিয়াছি। পরে এতদিন একটা ঘটনা ঘটিল। নবী করীম (স) হুজরার বাহিরে আসিলেন এবং নামায পড়াইবার জন্য নিজের স্থানে আসিয়া দাঁড়াইয়া গেলেন। তাকবীর বলিয়া নামায শুরু করিয়া দিতে উদ্যত হইলেন। সহসা এক ব্যক্তির উপর তাঁহার নযর পড়িল, যাহার বুক কাতার হইতে কিছুটা সম্মুখের দিকে অগ্রসর দেখা যাইতেছিল। তখন তিনি বলিলেনঃ হে আল্লাহ্র বান্দারা! তোমরা তোমাদের কাতারসমূহ সমান ও সোজা কর। অন্যথায় আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদিগকে পরস্পর বিরোধী করিয়া দিবেন।
-মুসলিম
ব্যাখ্যা হাদীসের বাক্য ============ মনে হইতেছিল তিনি যেন কাতারগুলোর সাহায্যে তীর সোজা করিবেন।
এই কথার অর্থ বুঝিবার জন্য এই কথা জানিয়া লওয়া দরকার যে, তদানীন্তন আরববাসীরা শিকার বা যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য যেসব তীর তৈয়ার করত, তাহাকে সম্পূর্ণ সোজা ও ঋজু করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করা হইত। এই কারণে কোন জিনিস সোজা ও ঋজু হওয়ার গুন বর্ণনায় উদাত্তভাষী হইয়া বলা হইতঃ উহা এমন সমান ও ঋজু যে, উহার সাহায্যে তীরগুলোকে সোজা করা যাইতে পারে। অন্য কথায় তীরগুলিকে সোজা করার উহাই যেন মানদণ্ড। হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত নু’মান ইবনে বশীরের কথার তাৎপর্য শুধু এই যে, রাসুলে করীম (স) নামাযের কাতারগুলিকে সম্পূর্ণ রূপে সোজা করিতে চেষ্টা করিতেন এবং উহাতে এক চুল পরিমাণও বক্রতা থাকিতে দিতেন না। এ ভাবে দীর্ঘকাল পর্যন্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর রাসূলে করীম (স) বুঝিতে পারিলেন যে, আমরা কাতার সোজা করার গুরুত্ব ও তাৎপর্যন্ত বুঝিতে পারিয়াছি। এইরূপ অবস্থায় একদিন তিনি আমাদেরই একজনের দ্বারা কিছু ব্যতিক্রম হইতে দেখিয়া সম্ভবত খুবই দুঃখ পাইয়াছিলেন। তাই উদাত্ত কণ্ঠে সমবেতন লোকদের সম্বোধন করিয়া কাতার সোজা করিবার তাকীদ করিলেন এবং বলিলেন যে, এই ব্যাপারে তোমরা ত্রুটি করিলে তোমাদের দিলও বাঁকা হইয়া যাইবে, তোমাদের দিল পরস্পর বিরোধী হইয়া যাইবে। অন্যথায় ইসলামী আদর্শে গড়া সুসংবদ্ধ ও সুশৃংঙ্খলাপূর্ণ সমাজে ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিবে। আর এই সামাজিক ভাঙ্গন যে এক একটি জাতির জীবনে চরম বিপর্যয় আনিযা দিতে পারে, তাহা বলাই বাহুল্য।
নামাজের কাতারে পারস্পর্য বিধান
===========================
হযরত হযরত আবূ মাসউদ আল-আনসারী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন রাসুলে করীম (স) নামাযের জামা’আতে দাঁড়াইবার কালে আমাদিগকে সোজা হইয়া দাঁড়াইবার কাজে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে আমাদের স্বন্ধে হাত রাখিতেন এবং বলিতেনঃ সমান হইয়া দাঁড়াও এবং আগে-পিছে অসমান হইয়া দাঁড়াইও না। অন্যথায় আল্লাহ্ না করুন, উহার শাস্তিস্বরূপ মোতাদের দিল পরস্পর বিরোধী হইয়া দাঁড়াইবে। তিনি আরো বলিতেনঃ তোমাদের মধ্য হইতে বুদ্ধিমান ও সমঝদার লোক যাহারা, তাহারা যেন নামাযে আমার নিকট ও কাছাকাছি দাঁড়ায়। তাহাদের পর তাহারা দাঁড়াইবে যাহারা উক্ত গুণের দিক দিয়া প্রথোমোক্তদের নিকটবর্তী। আর তাহাদের নিকটবর্তী যাহারা, তাহারা দাঁড়াইবে ইহাদের পর।
-মুসলিম
ব্যাখ্যা এই হাদিসটিতে নবী করীম (স) প্রথমত নামাযের কাতার সমান করার তাকীদ করিয়াছেন। পরে এই কাতার রচনা সম্পর্কে একটি গুণমূলক বিধান জারী করিয়াছেন। তাহা হইল এই যে, রাসূলে করীম (স)-এর পিছনে প্রথম কাতারে দাঁড়াইবে সেই সব লোক, যাহারা জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিদ্যায় অপেক্ষাকৃতভাবে বিশিষ্ট। পরবর্তী কাতারগুলোও এই পারস্পর্য অনুসারেই রচনা করিতে বলিয়াছেন। আর এইরূপ পারস্পর যে খুবই স্বাভাবিক ও যুক্তিসম্মত তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। নামাযের মধ্যে জ্ঞানে-বুদ্ধিতে-বিদ্যায় অপেক্ষাকৃত অগ্রসর লোকদেরই নবী করীম (স)-এর নিকটে দাঁড়ানো উচিত। ইহা কোন শ্রেণীবিভেদ নহে। বরং সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়াও যেমন ইহার মূল্য রহিয়াছে, তেমনি রাসূলে করীম (স)-এর সব কাজেই যেহেতু সাধারণ শিক্ষা দানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত থাকে এবং সেই শিক্ষা গ্রহণ করিতে অধিকতর বুদ্ধিমান ও বিদ্বান লোকেরাই অধিক সক্ষম হইয়া থাকে, এই কারণেই এই নির্দেশের যৌক্তিকতা অনস্বীকার্য।
নামাযে কিবলামুখী হওয়ার গুরুত্ব
==========================
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, যে লোক আমাদের ন্যায় নামায পড়িল, আমাদের কিবলার দিকে মুখ করিল এবং আমাদের যবাই করা জন্তু আহার করিল, সে-ই মুসলমান। তাহার জন্য আল্লাহ্র ও তাঁহার রাসূলের দায়িত্ব রহিয়াছে। অতএব তোমরা আল্লাহ্র সহিত তাঁহার গ্রহণ করা দায়িত্বের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা বা ওয়াদা ভঙ্গ করিও না।
-বুখারী
ব্যাখ্যা হাদীসটিতে ইসলাম সমাজ বিধানের তিনটি মৌলিখ ভিত্তির উল্লেখ করা হইয়াছে। প্রথমটি হইল, আমাদের ন্যায় নামায পড়া। দ্বিতীয়টি আমাদের কিবলাকে কিবলা মানিয়া লওয়া ও সেই কিবলার দিকে মুখ করিয়া দাঁড়াইয়া নামায পড়া এবং তৃতীয় হইল, আমাদের নিজস্ব নিয়মে যবাই করা জন্তুর গোশত নিঃসংকোচে আহার করা-আহার করিতে প্রস্তুত থাকা। এই তিনটি কাজ যে লোক যথাযথভাবে করে, সে-ই মুসলমান এবং দুনিয়ার যে সব লোক এই কাজ তিনটি করে ও তাহাতে কোনরূপ সংকোচ বা ঘৃণা বোধ করে না, তাহারাই বৃহত্তর মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত। মুসলিমরূপে পরিচিত লাভ এবং মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত গণ্য হওয়ার জন্য এই তিনটি হইল মৌলিক শর্ত বিশেষ। এই শর্তত্রয়ের কোন একটিও যদি কেহ অস্বীকার বা অমান্য করে কিংবা এই কাজ তিনটি করিতে কোনরূপ সংকোচ বোধ করে, সে আর যাহাই হউক, মুসলিম হইতে পারে না। মুসলিম জাতির মধ্যে গণ্য হওয়ার তাহার যোগ্যতা নাই।
আমাদের ন্যায় নামায পড়ার অর্থ, রাসূলে করীম (স)-এর প্রদর্শিত ও অনুসৃত নিয়ম পদ্ধতিতে এবং অনুরূপ ভাবধারায় নামায পড়া। এই পদ্ধতি ও নিয়ম-নীতি রাসূলে করীম (স)-এর মনগড়া বা স্ব-কপোলকল্পিত নয়। আল্লাহ্ তাআলা হযরত জিবরাঈলের মাধ্যমে তাঁহাকে ইহা শিক্ষা দিয়াছেন। এই কারণেই তিনি দৃঢ়তার সহিত ঘোষণা করিয়াছেনঃ
=========================
তোমরা আমাকে যেভাবে ও যে নিয়ম-পদ্ধতিতে নামায পড়িতে দেখ, তোমরাও ঠিক সেইভাবে ও সেই নিয়ম-পদ্ধতিতে নামায পড়।
কেননা সেইভাবে নামায পড়িলে সরাসরি আল্লাহর মনোনীত নিয়ম-পদ্ধিতিতে নামায পড়া সম্পন্ন হইবে। অন্যথায় নয়।
বস্তুত যে লোক রাসূলে করীম (স)-এর নবুয়্যাত ও রিসালাতের প্রতি ঈমান আনে, সে তো সেই সব বিষয়ের প্রতি স্বতঃই ঈমান আনিবে যাহা তিনি আল্লাহর নিকট হইতে পাইয়াছেন। আর নামাযের যাবতীয় নিয়ম-পদ্ধতি যে আল্লাহর নিকট হইতেই পাওয়া, তাহা নিঃসন্দেহ। এই কারণে নামাযকে লোকদের ইসলাম গ্রহণের বাস্তব প্রমাণ ও প্রতীকরূপে নির্দিষ্ট করা হইয়াছে। আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের রিসালাতের প্রতি ঈমান আনার সাক্ষ্যদানের কথা এখানে উল্লেখ করা হয় নাই। কেননা তাহা নামাযের মধ্যেই শামিল রহিয়াছে। উহার পুনরুল্লেখ পুনরাবৃত্তি মাত্র এবং নিস্প্রয়োজন।
আমাদের কিবলার দিকে মুখ করিয়া নামায পড়ার অর্থ কাবা মুখী বা কাবার দিক মুখী হইয়া নামাযে দাঁড়ানো। কাবা আল্লাহর ঘর। ইহা দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য কিবলা। (যে বিশেষ জিনিসকে লক্ষ্য করিয়া ও উহার দিকে মুখ কিরয়া দাঁড়াইয়া নামায পড়া হয়, পরিভাষায় তাহাকেই কিবলা (============) বলা হয়। দুনিয়ার যেখানে যে মুসলমান রহিয়াছে, তাহাকেই এবং সেখান থেকেই কাবার দিকে মুখ করিয়া নামায পড়িতে হইবে। ইহা সর্বসম্মতভাবে ওয়াজিব। মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত ও হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হাদীসে নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
=============================
তুমি যখন নামায পড়িতে প্রস্তুত হইবে, তখন পুরাপুরিভাবে অযু করিবে। অতঃপর কিবলামুখী হইয়া দাঁড়াইবে এবং তাহার পর তাকবীর বলিবে।
বস্তুত কাবার দিকে মুখ করিয়া দাঁড়ানো নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য অপরিহার্য শর্ত বিশেষ। অবশ্য যদি কোন কারণে কিবলামুখী হওয়া না যায় কিংবা কিবলার দিক নিঃসন্দেহে জানা সম্ভবপর না হয়, তাহা হইলে অন্য যে কোন দিকে মুখ করিয়া নামায পড়া যাইবে। এই অবস্থায় যে দিকে ফিরিয়া নামায পড়িবে সেই দিকই কিবলা-একথা মনে দৃঢ়মূল করিয়া লইতে হইবে। হযরত আমের ইবনে রবীয়া (রা) বলিয়াছেনঃ আমরা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রে রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে ছিলাম, সেখানে কিবলা কোন দিকে, তাহা আমরা জানিতে পারি নাই। তখন আমাদের সঙ্গীদের মধ্যে প্রত্যেকে নিজ নিজ ধারণা মতে কিবলা ঠিক করিয়া সেই দিকে ফিরিয়া নামায পড়ে। সকাল বেলা বিষয়টি লইয়া রাসূলে করীমের সাথে যখন আলোচনা হইল, তখন আল্লাহর ফরমান আমাদের সামনে উপস্থিত হইলঃ
==========================
যেদিকেই তোমরা মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইবে, সে দিকেই আল্লাহ রহিয়াছেন।
ইহা ওযরের সময়ের পথ-নিদের্শ। কিন্তু সাধারণ অবস্থায কাবাই হইল একমাত্র কিবলা। কাবা শরীফকে মুসলমানদের কিবলা নির্দিষ্ট করার ইতিহাস কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত হইয়াছে। হযরত আনাস (রা) বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স) প্রথমে মসজিদে আকসার দিকে মুখ করিয়া নামায পড়িতেন। হযরত বরা ইবনে আযেব (রা)-এর বর্ণনায় ইহার মেয়াদ ১৬মাস কি ১৭ মাস উদ্ধৃত হইয়াছে।
-বুখারী
সেই সময় কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতটি নাযিল হয়ঃ
===========================
আকাশমণ্ডলের দিকে তোমার দৃষ্টির আবর্তন আমরা লক্ষ্য করিয়াছি। এই জন্য আমরা এমন কিবলার দিকে তোমাকে অবশ্য ফিরাইব, যাহা তুমি পছন্দ করিবে-সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করিবে। কাজেই তুমি তোমার মুখমণ্ডল মসজিদে হারামের কাবার-দিকে ফিরাও।
এই নির্দেশ শোনামাত্রই নবী করীম (স) ও মুসলমানগণ কাবার দিকে ফিরিয়া নামায পড়িতে শুরু করিলেন। অতঃপর মুসলিম জাহানের জন্য এই কাবা শরীফ্ই হইল চিরন্তন কিবলা। হযরত আদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা)-এর বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ কুবার মসজিদে লোকেরা নামায পড়িতেছিলেন। তখন একজন সাহাবী ঘোষণা করিলেনঃ গত রাত্রে রাসূলের প্রতি কুরআনের আয়াত নাযিল হইয়াছেঃ
==============================
এবং কাবাকে কিবলা বানাইয়া নামায পড়িতে আদেশ করা হইয়াছে। এই কথা শোনামাত্রই
==========================
তাহারা সিরিয়ার মসজিদ আকসার দিকে নামায পড়িতেছিলেন, এই কথা শুনিয়াই তাহারা কাবার দিকে ঘুরিয়া গেলেন।
-বুখারী
হযরত বরা ইবনে আযেব (রা) বলিয়াছেনঃ
================================
আমরা নবী করীম (স)-এর সাথে বায়তুল মাকদিসমুখী হইয়া ষোল কিংবা সতের মাস নামায পড়িয়াছি। পরে আমরা কাবার দিকে ফিরিয়া গেলাম।
আলোচ্য হাদীস অনুযায়ী কিবলামুখী হওয়া নামাযের শুদ্ধতার জন্য অপরিহার্য শর্ত। কিন্তু তাহার পর্ও কিবলার এই গুরুত্ব ঘোষণার কারণ হইল, কিবলা নামায অপেক্ষা অধিক পরিচিত। পরিচিত লাভের দিক দিয়া ইহা অধিকতর উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত। কেননা নামায না জানিলেও কিবলার কথা প্রত্যেকেই জানে। বিশেষত আমাদের নামাযের ন্যায় কিয়াম-দাঁড়ানো ও কিরাত-উপাসনায় আল্লাহর কালাম পাঠ প্রভূতি অন্যদের ইবাদতের অনুষ্ঠানেও রহিয়াছে। কিন্তু আমাদের কিবলা কেবলমাত্র আমাদেরই, আমাদের জন্যই নির্দিষ্ট। ইহা অন্য কাহারও কিবলা নয়। অন্য কেহ আমাদের কিবলারমুখী হইয়া উপাসনা করে না।
আলোচ্য হাদীসে তৃতীয় উল্লেখ করা হইয়াছে এমন একটা অভ্যাস বা ইবাদতের, যাহা মুসলমানকে অন্যদের হইতে স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ (==) করিয়া দেয়। তাহা হইল, আমাদের যবাই করা জীব ভক্ষণ করা, ভক্ষণ করিতে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ বোধ না করা। কেননা যাহারা এক আল্লাহর প্রতি ঈমানদার নয় কিংবা উহার প্রতি বিদ্বেষী দেখা গিয়াছে, তাহারা ইসলামী রীতিতে ও এক আল্লাহর নামে যবাই করা জীবের গোশত খাইতে সংকোচ বোধ করিয়া থাকে। (ইহার ব্যতিক্রম নাই এমন দাবি অবশ্য করা যাইতেছে না) এই কথাটি বিশেষভাবে ইয়াহুদী-আরো বিশেষভাবে তদানীন্তন মদীনার ইয়াহুদী সমাজের প্রতি প্রয়োজ্য। কেননা তাহারা বিশেষভাবে মুসলমানের যবাই করা জীবের গোশত খাইতে প্রস্তুত হইত না।
মনে রাখা আবশ্যক, মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য এখানে যে তিনটি বিষয়ে উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহা নিতান্ত মৌলিক এবং বুনিয়াদী পর্যায়ের। কিন্তু ইহাই চুড়ান্ত ও শেষ কথা নয়। এই তিনটিরও স্থান আল্লাহর তাওহীদ ও রাসূলের রিসালাতের প্রতি ঈমানের সাক্ষ্যদানের পর। এই সাক্ষ্যদানের উচ্চারণ ও ঘোষণা দানের পরই ইসলামে প্রবেশ প্রমাণিত হয় ব্যক্তির ইসলামী সমাজভুক্ত ও মুসলিমরূপে গণ্য হওয়া।
আলোচ্য হাদীসটির দৃষ্টিতে এই তিনটি কাজ যে করিবে, সে মুসলমানরূপে গণ্য হইবে। এই মুসলিমের প্রতি রহমত দান ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলা এবং তাঁহার রাসূল গ্রহণ করিয়াছেন। অপর একটি হাদীসে রাসূলে করীমের এই দায়িত্ব গ্রহণের কথা ঘোষিত হইয়াছে নিম্নের ভাষায়ঃ
===================================
এই মুসলমানদের রক্ত ও মাল-সম্পদ আমাদের জন্য হারাম। তবে শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী অন্য কোন আচরণ গ্রহণ করিতে হইলে তাহা স্বতন্ত্র কথা। আর তাহাদের হিসাবে গ্রহণের দায়িত্ব স্বযং আল্লাহর।
-বুখারী
আলোচ্য হাদীস হইতে আরও জানা যায়, মানুষের অন্তরের গভীর গহনে কি লুক্কায়িত রহিয়াছে তাহা সহসা জানিবার কোন নির্ভরযোগ্য উপায় না থাকায় মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখিয়াই তাহার সম্পর্কে সিন্ধান্ত গ্রহণ করিতে হয়। ইহাই ইসলামের নীতি। কাজেই যে লোক ইসলামের মৌল সংস্কৃতি অনুসরণ করিয়া চলে-তাহার কর্তৃক উহার বিপরীত আচরণ প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত তাহাকে মুসলমানরূপে গ্রহণ করিতে হইবে।
দ্বিতীয় জানা গেল, কিবলামুখী হইয়া নামায পড়া নামাযের বিশুদ্ধতার জন্য জরুরী শর্ত। কেননা নামায হইল আল্লাহর নৈকট্য লাভ-উপায়ের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন। নামাযে যে লোক ইচ্ছাপূর্বক কিবলামুখী হওয়া পরিহার করিবে, তাহার নামায সহীহ হইবে না। সে দ্বীন-ইসলামের অনুযায়ী নয়। কাজেই যাহারা কাবা শরীফের প্রতিবেশী, তাহারা তো কাবাকেই সম্মুখে রাখিয়া নামায পড়িবে। আর যাহারা কাবা হইতে দূরে অবস্থিত, তাহারা কাবা যে দিকে, সেই দিকে===========
ফিরিয়া নামায পড়িবে। কারখী, আবু বকর আররাযী ও হানাফী মাযহাবের আলিমগণ এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। বায়হাকী শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে।
================================
কাবা আল্লাহর ঘর-কিবলা সেই লোকদের যাহারা মসজিদে হারামে -কা’বার চতুম্পার্শের স্থানে নামায পড়ে। মসজিদে হারাম কা’বার চতুষ্পার্শের স্থান-কিবলা মক্কার অধিবাসীদের, যাহারা নিজেদের ঘরে নামায পড়ে তাহাদের জন্য। মক্কা নগর কিবলা বিস্তীর্ণ হেরেম অধিবাসীদের জন্য। আর বিস্তীর্ণ হেরেম এলাকা কিবলা হইল সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য।
হাদীসটি সনদের দিক দিয়া যয়ীফ হইলেও ইহার বক্তব্যের তাৎপর্য অনুধাবনীয়।
নামাযের শুরু ও শেষ
==================================
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন৬ নামায শুরু করার উপায় হইল পবিত্রতা অর্জন করা, নামাযের তাহরীমা বাঁধিতে হয় তাকবীর বলিয়া এবং উহাকে শেষ করিতে হয় সালাম ফিরাইয়া। আর নামায হয় না, যে আলহামদু সুরা পড়ার পর আর একটি সুরা না পড়ে- তাহা ফরয নামায হউক, আর অন্য।
-তিরামিযী, আবু দাউদ, বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ্
ব্যাখ্যা নামায শুরু করিবার একমাত্র অস্ত্র বা উপায় হইল পবিত্রতা অর্জন অর্থাৎ প্রথমে শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী পবিত্রতা অর্জন করিয়া-অযুও প্রয়োজন হইলে গোসল করিয়া-নামায শুরু করিতে হয়। ইহা ছাড়া নামাযে দাঁড়ানোই জায়েম নয়। নামাযের তাহরীমা বাঁধিতে হয় ‘আল্লাহ আকবার’ বলিয়া ও সেই সঙ্গে দুই হাত বাঁধিয়া। ইহাকে তাহরীমা বাঁধা বলা হয় এইজন্য যে, ইহার পর নামায ব্যতীত অন্যান্য যাবতীয় কাজ সম্পূর্ণ হারাম হইয়া যায়। আর নামায শেষ করিতে হয় সালাম করিয়া-ডান ও বাম দিকে ফিরিয়া আসসালামু আলাইকুম ওয়া-রাহমাতুল্লাহ বলিয়া।
এইখানে স্মরণীয় যে, হযরত নবী করীম (স)-এর নামায পড়া সংক্রান্ত যাবতীয় রীতি-নীতি ও আদেশ-উপদেশ পর্যায়ের সব হাদীস খুজিঁয়া দেখিলেও নামাযের পূর্বে প্রচলিত ধরনে গদবাঁধা আরবী ভাষায় নিয়্যত পড়ার কোন উল্লেখই পাওয়া যাইবে না। তিনি নিজে এইরূপ নিয়্যত পড়েন নাই, পড়িয়াছেন বলিযা কেহ বর্ণনা করেন নাই। সহীহ-যয়ীক কোন প্রকারের বর্ণনায়ই ইহার উল্লেখ করা হয় নাই। কোন সাহাবী বা তাবেয়ী কিংবা কোন ইমামও ইহা পড়েন নাই। ===========
তবে মনে মনে যে কিবলামুখী হওয়ার, ইমামের পিছনে ইকতিদা করার ও যে ওয়াকতের নামায পড়িতেছে তাহার কথা স্মরণ করিতে হইবে, তাহা নিঃসন্দেহ।
হাদীসের শেষ বাক্যে নামাযে অবশ্য পঠিতথ্য সুরার কথা বলা হইয়াছে অর্থাৎ তাহরীমা বাঁধার পর সুবনহানাকা পড়িতে হয় এবং তাহার পর প্রথমে সূরা ফাতিহা-যাহার শুরু হইল আলহমদুলিল্লাহ-পড়িতে হয় ও উহার পর আর একটি সূরা বা কুরআন মজীদের যে কোন আয়াত পাঠ করিতে হয়। ইহা না পড়িলে নামায হয় না। নামায হওয়ার জন্য ইহা অপরিহার্য শর্ত। এই ব্যাপারে ফরয নামায, ওয়াজিব নামায ও সুন্নাত বা নফল নামাযে কোনই পার্থক্য নাই। সব নামাযেরই এই একই ও অভিন্ন নিয়ম।
একটি হাদীসে নবী করীম (স)-এর নামায পড়ার নিয়ম বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ
===========================
নবী করীম (স) নামায শুরু করিতেন আল্লাহ আকবার বলিয়া এবং কুরআন পাঠ শুরু করিতেন- নামায শুরু করার পর কুরআনের অংশ হিসাবে সুরা আলহামদুলিল্লাহি রাবিল আলামীন পাঠ করিয়া।
হযরত রাফে ইবনে রাফায়াতা ও হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করিয়াছেন। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
=============================
আল্লাহ্ তা’আলা কোন ব্যক্তির নামায কবুল করেন না, যতক্ষণ না সে যথাযথভাবে পবিত্রতা অর্জন করিবে কবিলামুখী হইয়া দাঁড়াইবে ও আল্লাহ আকবার বলিবে।
অর্থাৎ তাহারাত অর্জনের পর কিবলামুখী হইয়া দাঁড়াইতে ও আল্লাহ আকবার বলিয়া নামায শুরু করিতে হইবে। নতুবা নামায কবুল হইবে না। (এই বর্ণনার ভাষা যথাযথ নয় বলিয়া মুহাদ্দিসগণ আপত্তি তুলিয়াছেন।) অপর বর্ণনার ভাষা এইরূপ, নবী করীম (স) নামাযীর নামায ঠিকভাবে হইতেছে না দেখিয়া শেষে বলিলেনঃ
=========================
যথাযথভাবে অয়ু করিয়া ও আল্লাহ আকবার বলিয়া শুরু করিলেই একজনের নামায পূর্ণ হইবে, নতুবানয়।
আবু হুমাইদের বর্ণনায় এই হাদীসের ভাষা নিম্নরূপঃ
================================
প্রথম উদ্ধৃত হাদীসে যে বলা হইয়াছেঃ ========= ইহার অর্থ ======
‘আল্লাহ আকবার’ শব্দটি বলা ও উচ্চারণ করা। হযরত আলী (রা) বলিয়াছেনঃ
=============================
নবী করীম (স) যখন নামাযে দাঁড়াইতেন তখন বলিতেনঃ আল্লাহ আকবার।
হযরত ইবনে উমর বলিয়াছেনঃ
=============== উঠাবসা করার প্রত্যেকটি সময়ে আল্লাহ আকবার বলা।
হযরত আবু হুরামরা (রা) বর্ণিত হাদীসে উদ্ধৃত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
===============================
তুমি যখন নামাযের জন্য দাঁড়াইতে যাইবে, তখন পূর্ণ মাত্রায় অযূ কর, পরে কিবলামুখী হইয়া দাঁড়াও অতঃপর তাকবীর বল।
‘তাকবীরে তাহরীমা’ জমহুর ফুকাহর মতে নামাযের রুকন। হানাফীদের মতে ইহা নামাযের শর্ত। শাফেয়ীরও একটি মত এইরূপ। কেহ সুন্নাত বলিয়াছেন। কিন্তু ইবনুল মুনষির বলিয়াছেনঃ
==================== তাকবীরে তাহরীমা সুন্নাত একথা যুহরী ছাড়া আর কেহই বলেন নাই। ইমাম নববী লিখিয়াছেন, হাদীসের ভাষাঃ
================== যখন নামাযে দাঁড়াইবে, তখন দুই হাত তুলিয়া তাকবীর বলিবে। ইহা হইতে তাকবীরে তাহরীমা প্রমাণিত হয়।
নবী করীম (স) তাঁহার মতই নামায পড়িতে বলিয়াছেন। আর তিনি বলিয়াছেনঃ
==========================
ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, তাকবীরে তাহরীমা ওয়াজিব। ইমাম করখী হানাফী মাযহাবের এই মত প্রকাশ করিয়াছেন, যে যে নামাযী ইমামকে রুকূতে পাইবে তাহার জন্য রুকূর তাকবীর বলিয়া রুকূতে চলিয়া যাওয়াই যথেষ্ট।================
নামায শুরু করার জন্য তাকবীরে তাহরীমা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইহা না বলিলে নামায শুরুই করা যায় না। সুফিয়ান সওরী, আবদুল্লাহ ইবনে যুবারক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ও ইসহাক ইবনে রাহওয়াই প্রমুখ ফিকাহবিদ এক বাক্যে বলিয়াছেনঃ
===========================
নামাযের তাহরীমা হইল তাকবীর বলা এবং এই তাকবীর না বলিয়া কেহ নামাযে প্রবেশই করিতে পারে না।
ইমাম মালিক বলিয়াছেনঃ
===================== ‘আল্লাহ আকবার’ না বলা পর্যন্ত নামায শুরুই হয় না।
ইমাম আবু হানীফার মতে ফাসী ভাষায় ইহার তরহমা বলিয়া নামায শুরু করিলেও জায়েয বা নামায শুরু করা হইবে। ================
==================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) যখন নামাযের জন্য দাঁড়াইতেন, তখন তাঁহার দুইখানি হাত দীর্ঘ করিয়া উপরের দিকে তুলিতেন।
-বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী
ব্যাখ্যা হাদীস হইতে তাকবীরে তাহরীমা বলার সময় দুই হাত উপরের দিকে তোলার নিয়ম জানা যায়। নবী করীম (স) নিজে ইহা করিতেন। এই পর্যায়ে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত ও গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে।
হাদীসটির শেষ শব্দটির (===========) দুইটি অর্থ হইতে পারে। একটি এই যে, তিনি তাঁহার হস্তদ্বয় তাঁহার মস্তকের দিকে দীর্ঘয়িত অবস্থায় উর্ধ্বে তুলিতেন অথবা উহার অর্থ তাঁহার হস্তদ্বয়কে উপরে মাথা পর্যন্ত উঁচু করিয়া তুলিতেন।
তাকবীরে তাহরীমা বলার সময় দুইখানি হাত উপরে তোলার শরীয়ত ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। ইহা বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস হইতে প্রমাণিত। অবশ্য দুইটি বিষয়ে বিভিন্ন মতের উল্লেখ করা হইয়াছে। একটি হইল, তাহ উপরে কতদুর তুলিতে হইবে এবং দ্বিতীয় হইল, তাকবীর বলা ও হাত তোলা এই দুই কাজের মধ্যে কতটা সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে হইবে।
কাহারো কাহারো মতে হাত দুইখানি কাঁধ পর্যন্ত তুলিতে হইবে। তাঁহাদের দলীল হইল হযরত ইবনে উমর বর্ণিত হাদীস। হাদীসটি প্রথম অংশ এইঃ
===========================
নবী করীম (স) নামাযের জন্য দাঁড়াইয়া দুইখানি হাত উপরে এতটা তুলিতেন, যে হাত দুইখানি তাঁহার দুই স্কন্ধের সমান উচ্চতায় পৌছিঁয়া যাইত।
-বুখারী, মুসলিম
আবার অপরাপর ফিকাহবিদরা মনে করেন, হাত দুইখানি দুই কান পর্যন্ত উপরে তুলিতে হইবে। তাঁহারা দলীল হিসাবে যহরত বরা ইবনে আযেব (রা) বর্ণিত হাদীসটির উল্লেখ করিয়াছেন। সেই হাদীসটির ভাষা হইলঃ
============================
আমি রাসূলে করীম (স)-কে নামায শুরু করার সময় তাঁহার দুই হাত তাঁহার দুই কানের নিকট পর্যন্ত উর্ধ্বে তুলিতে দেখিয়াছি।
-আবু দাউদ, দারে কুতনী
সনদের দিক দিয়া এই দুইটি হাদীসই সহীহ ও সপ্রমাণিত। তাকবীর বলা ও উর্ধ্বে হাত তোলার সময় আপেক্ষিকতা পর্যায়েও দুই ধরনের হাদীসের বর্ণনা রহিয়াছে। হযরত ওয়ায়েল ইবনে হাজার (রা) সম্পর্কে বলা হইয়াছে।
========================
তিনি রাসূলে করীম (স)-কে তাকবীর বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার হাত দুইখানি উর্ধ্বে তুলিতে দেখিতে পাইয়াছেন।
-মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ
শাফেয়ী ও মালিকী মাযহাব এই মতই সমর্থন করেন।
প্রথমে হাত তোলা ও পরে তাকবীর বলা কিংবা প্রথমে তাকবীর বলা ও পরে হাত তোলা-এই উভয় ধরনের হাদীসের বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে।
মালিক ইবনে হুয়াইরিস বর্ণিত হাদীসের ভাষা হইলঃ ===========
তিনি প্রথমে তাকবীর বলিয়াছেন এবং তাহার পর হাত দুইখানি উপরে তুলিয়াছেন। আর ইবনে শিহাব বর্ণিত হাদীসের ভাষা এইরূপঃ
========== প্রথমে হাত দুইখানি উপরে উঠায়াছেন ও তাহার পর তাকবীর বলিয়াছেন।
হানাফী মাযহাবের মতে প্রথমে হাত দুইখানি উপরে তোলা ও পরে তাকবীর বলা বিধেয়। হিদায়া গ্রন্থে ইহার যৌক্তিকতা প্রদর্শন প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ
===============================
হাত দুইখানি উর্ধ্বে তোলার তাৎপর্য হইল আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সবকিছুর শ্রেষ্ঠত্ব, প্রধান্য ও সাবূভৌমত্ব হরণ বা অস্বীকার করা। আর তাকবীর বলার তাৎপর্য, এইসব কেবলমাত্র এক আল্লাহর জন্য প্রমাণ ও ঘোষণা করা। আর কালিমায়ে শাহাদাত-এ যেমন রহিয়াছে, হরণ বা অস্বীকৃতির স্থান প্রথমে, তাহার পরই উহা নিরংকুশভাবে কাহারো জন্য প্রমাণ করা যাইতে পারে। ================
নামাযে হাত বাঁধা
===============================
হযরত আবু দারদা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি নবী করীমের এই কথাটি বর্ণনা করিয়াছেনঃ তিনটি কাজ নবুয়্যাতের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গণ্য। তাহা হইলঃ ইফতার ত্বরান্বিত করা, খুব বিলম্বে সেহরী খাওয়া এবং নামাযে বাম হাতের উপর ডান হাত বাঁধা।
-তাবারানী
ব্যাখ্যা তাকবীরে তাহরীমার পরই নামায শুরু হইয়া যায়।অতঃপর হাত দুইখানি কিভাবে রাখিতে হইবে, উপরিউক্ত হাদীসটিতে তাহাই বলা হইয়াছে। হাদীসটির বক্তব্য অনুযায়ী নামাযে হাত বাঁধিয়া দাঁড়াইতে হইবে এবং হাত বাঁধার নিয়ম হইল, বাম হাতের উপর ডান হাত বাঁধা। নামাযে এইরূপ হাত বাঁধিয়া দাঁড়ানো নবীগণের নৈতিক বৈশিষ্ট্য।
ইমাম মালিকের এক বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
==========================
নামাযে একটি হাত অপর হাতটির উপরে রাখা অর্থাৎ ডান তাহ বাম হাতের উপর রাখা নবী নির্দেশ।
ইয়ালা ইবনে মুররা রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি বর্ণনা করিয়াছেন এই ভাষায়ঃ
=========================================
তিনটি কাজ আল্লাহ তা’আলা খুবই পছন্দ করেন। তাহা হইলঃ ইফতার ত্বরান্বিত করা, সেহরী পিরীত করা এবং নামাযে দুই হাতের একখানা অপরখানার সঙ্গে যুক্ত করিয়া রাখা।-তাবারানী
প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসটিতে বা হাতের উপর ডান হাত রাখার কথা বলা হইয়াছে। আর তুতীয় হাদীসটিতে শুধু দুইটি হাত নামাযে মিলাইয়া রাখিবার কথা বলা হইয়াছেঃ
সহল ইবনে সাদ বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হইয়াছে।
============================
লোকদিগকে নামাযে বাম হাতের বাজুর উপর ডান হাত রাখিবার জন্য নির্দেশ দেওয়া হইত।
-মুয়াত্তা ইমাম মালিক
এই হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিস আবু হাযিম বলিয়াছেনঃ ইহা ‘মরফু’ হাদীস অর্থাৎ ইহা রাসূলে করীম (স)-এর কথা। এই হাদীসে নামায বাম হাতের বাজুর উপর ডান হাত রাখিবার কথা বলা হইয়াছে। ইহাতে নির্দেশ দেওয়া হইত শব্দ হইতে স্পষ্ট হয় যে, নির্দেশদাতা রাসূলে করীম (স) ছাড়া আর কেহই নয়। আর লোকদিগকে বলিতে সাহাবায়ে কিরাম (রা)-কে বুঝানো হইয়াছে।
কিন্তু হাত দুইখানি বুকের দিকে কোনখানে স্থাপন করিতে হইবে?-এই বিষয়ে ইবনে হুবাইব বলিয়াছেনঃ
================================
ইহার জন্য কোন নির্দিষ্ট স্থান নাই।
অর্থাৎ বুকের দিকে যে কোন স্থানে রাখিলেই চলিবে। আবদুল ওয়াহহাব বলিয়াছেনঃ
=========================
হাত দুইখানি বুকের নীচে ও নাভির উপরে রাখাই নিয়ম।
ইমাম আবু হানীফা (রা) বলিয়াছেনঃ
======================== হাত দুইখানি নাভীর নীচে রাখাই সুন্নাত। আর সেই সঙ্গে ইহাও বলিয়াছেন যে, ডান হাত দিয়া বাম হাতের কবজা চাপিয়া ধরিতে হইবে, যাহাতে বাম হাতের বাজুর কিছুটা অংশ ধরা হয়। কিন্তু উহাতে জোর প্রয়োগ করা বা শক্ত করিয়া ধরা যাইবে না। হাদীস ব্যাখ্যাকারীরা বলিয়াছেনঃ
===============================
নামাযে এইভাবে হাত ধরিয়া দাঁড়ানোর তাৎপর্য এই হয় যে, বিনয়াবনত প্রার্থনাকারী দাঁড়াইয়া আছে। ইহা নামাযীকে বাজে খেয়াল হইতে রক্ষা করে এবং নামাযে বিনয় বিহবলতা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি করে।=========
প্রত্যেক উঠা বসায় তাকবীর
============================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) যখন নামাযে দাঁড়াইতেন, তখন তাকবীর বলিতেন। আবার তাকবীর বলিতেন যখন রুকু করিতেন। পরে রুকু হইতে যখন তাঁহার পিঠ খাড়া করিতেন তখন তাকবীর বলিতেন হে এবং দাঁড়ানো অবস্থায় বলিতেন হে আল্লহ তোমার জন্যই যাবতীয় প্রশংসা। পরে আবার তাকবীর বলিতেন যখন নীচের দিকে চলিয়া যাইতেন। পরে তাকবীর বলিতেন যখন মাথা তুলিতেন। এইভাবে তাঁহার সমস্ত নামাযেই উহা সম্পূর্ণ করা পর্যন্ত করিতে থাকিতেন। দুই রাকাআতের পরে বসা হইতে যখন উঠিয়া দাঁড়াইতেন তখনও তাকবীর বলিতেন।
-বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা হাদীসটির বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরায়রা (রা)। তিনি ইহাতে নবী করীম (স)-এর নামায পড়ার ধরনের একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলিয়া ধরিয়াছেন। ইহাতে বিশেষভাবে তাকবীর বলার বিস্তারিত বিবরণ উদ্ধৃত হইয়াছে।
এই হাদীসে দেখা যায়, নামাযের শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি উঠা বসায় রাসূলে করীম (স) তাকবীর বলিতেন। কেবলমাত্র রুকু হইতে উঠার সময় ছাড়া আর প্রত্যেকটি কাজের সময় আল্লাহ আকবার বলিতেন। আল্লাহ আকবার না বলিয়া তিনি না দাঁড়াইতেন, না রুকুতে যাইতেন, না সিজদায় যাইতেন না সিজদা হইতে মাথা উঠাইতেন, না বসিতেন, না বসা অবস্থা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইতেন। কেবলমাত্র রুকু হইতে মাথা উঠাইয়া ও সোজা হইয়া দাঁড়াইবার কালে বলিতেনঃ
================================ আল্লাহ তাহার কথা শুনিয়াছেন, যে তাঁহার প্রশংসা করিয়াছে। হাদীসের শব্দ ও ভঙ্গী হইতে এই কথাও বুঝিতে পারা যায় যে, যখনই কিছু করিতে শুরু করা হয়, তখনই তাকবীর বলিতেও শুরু করিতে হয় এবং উহা দীর্ঘ হইবে-যতক্ষণ না সেই কাজের শেষ পর্যন্ত পৌছা যাইবে। অনুরূপভাবে রুকু হইতে উঠা শুরু করিতেই ================ বলিতে শুরু করিতে হয় এবং তাহা উঠিয়া সোজা* হইয়া দাঁড়ানো পর্যন্ত দীর্ঘ করিতে হয়। কিন্তু ইহা সর্বসম্মত কথা নয়। হযরত উমর উবনে আবদুল আযীয সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
দুই রাআতের পর উঠিয়া যতক্ষণ সোজা হইয়া না দাঁড়াইতেন, ততক্ষণ তিনি তাকবীর বলিতেন না।
অর্থাৎ তিনি সম্পূর্ণ উঠিয়া দাঁড়াইবার পরই তাকবীর বলিতেন, তাহার পূর্বে নয়। ইমাম মালিকও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
এখানের মুল হাদীসটি মিশকাত শরীফ হইতে উদ্ধৃত হইয়াছে। কিন্তু বুখারী শরীফের মুল গ্রন্থে এই হাদীসটির এখানে অতিরিক্ত কথা হইলঃ
=========================
অতঃপর সিজদায় যাওয়ার পূর্বে রাবানা ওয়া-লাকাল-হামল।
হে আমার আল্লাহ এবং তোমার জন্যই যাবতীয় প্রশংসা-বলিতেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, ইমাম রকু হইতে উঠিবার কালে বলিবেঃ ========== আর উঠিয়া দাঁড়ানোর পর সিজদায় যাওয়ার আগে বলিবেঃ ===============। কিন্তু এই বিষয়ে ইমামগণের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। ইবনুল হুম্মাম বলিয়াছেন মুক্তাদী ======== বলিবেন না। আর ইমাম আবু হানীফার মতে ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ই এই দুইটি কথা বলিবেঃ
============================
তবে ইহা তখন, যখন এক ব্যক্তি একাকী নামায পড়ে তখনকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একাকী নামাযীর একসঙ্গে, এই দুইটি বাক্য বলার ব্যাপারে ইজমা-সম্পূর্ণ ঐক্যমত রহিয়াছে। আর ইমাম আবু হানীফার মতে ইমাম প্রথম বাক্যটিই বলিবে, দ্বিতীয়টি নয়। ============
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) যখন নামায শুরু করিতেন, তখন বলিতেনঃ হে আমাদের আল্লাহ। তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করিতেছি এবং তোমার হামদ সহকারে, তোমার নাম মহান বরকতওয়ালা, তোমার ময়দা অনেক উচ্চ ও বিরাট এবং তুমি ছাড়া ইলাহ কেহই নাই-হইতে পারে না।
-তিরমিযী
ব্যাখ্যা নামাযের তাহারীমা বাঁধার পর দোয়া পাঠ করা একান্তই জরুরী। নবী করীম (স) নিজে ইহা নিয়মিত পড়িতেন। দোয়ার অর্থের দিকে তাকাইলে ইহার গুরুত্ব সহজেই বুঝিতে পারা যায় । বুঝিতে পারা যায়, নবী করীম (স) এই দোয়া কেন নিয়মিত পড়িতেন।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, তাহরীমা বাঁধিয়া নামায শুরু করার পূর্বে মুসল্লীর উপর নামাযের স্থানে দাঁড়াইয়া ও কিবলামুখী হইয়া সর্বপ্রথম পড়িতে হয়ঃ
============================================
আমি নিজের সত্তা ফিরাইতেছি সেই মহান আল্লাহর দিকে, তিনি আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন। আমি অন্য সব দিক হইতে নিজের মন ও সত্তাকে ফিরাইয়া আল্লাহর দিকে একমুখী হইয়া দাঁড়াইতেছি। আর আমি আল্লাহর সহিত শিরককারীদের মধ্যে সামিল নই।
এই দোয়াটি মুলত কুরআনের আয়াত। ইহা হযরত ইবরাহীমের আল্লাহর তাওহীদের সাহিত পরিচিত হওয়ার পর তাঁহার উদান্ত ঘোষণা হিসাবে কুরআন মজীদে উদ্ধৃত হইয়াছে। বস্তুত শিরক অস্বীকার ও আল্লাহর একত্বে নিজেকে পুরাপুরি সমপর্ণ করার জন্য ইহাপেক্ষা বড় বিপ্লবী ঘোষণা আর কিছুই হইতে পারে না। অতএব তাওহীদবাদীদের কর্তব্য নামায পড়ার পূর্বক্ষণেই কিবলামুখী হইয়া সর্বপ্রথম এই দোয়া পাঠ করা। এহা নামায পড়ার নিয়মের মধ্যে বিধিবদ্ধ। মুসলিম শরীফে হযরত আলী বর্ণিত হাদীসে এই দোয়া পাঠের উল্লেখ হইয়াছে। (ইহা ফরয ও নফল সব নামাযের পূর্বেই পঠনীয়।)=======
==============================
নবী করীম (স) যখন নামাযের জন্য দাঁড়াইতেন ও তাকবীর বলিতেন, তাহার পর শেষ পর্যন্ত বলিতেন।
-আবু দাউদ
এই হাদীসেও এই দোয়াটি পাঠ করার উল্লেখ করা হইয়াছে, অবশ্য ইহাতে বর্ণনায় কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। প্রথমে তাকবীর বলা, তাহার পর এই দোয়া পড়ার তাৎপর্য দুর্বোধ্য। সম্ভবত বর্ণনাকারী আগে পরে নির্বিশেষে নামাযের শুরুতে রাসূলে করীম (স) কিকি পড়িতেন তাহার মোটামুটি উল্লেখ করিতে চাহিয়াছেন।
অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে বর্ণনাটি এই ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
==========================
রাসূলে করীম (স) নামায পড়ার জন্য দাঁড়াইতেন তখন এই দোয়া পড়িতেন। ইহাই যথাযথ বর্ণনা।
দাঁড়াইয়া এই দোয়াটি পড়া বিধেয়। ইহার প্রভাব ও ফল সুদুরপ্রসারী।
নামাযের অন্তনিহিত ভাবধারা
================================
হযরত উবাদাহ ইবনুল সামেত (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ পাঁচ ওয়াক্তের নামায আল্লাহ আলা ফরয করিয়াছেন। কাজেই যে ব্যক্তি এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের অযু উহাদের নির্দিষ্ট সময়ে অতি উত্তমভাবে সম্পন্ন করিবে এবং সেই নামাযসমূহের রুকু এবং আল্লাহভীতি বিনয় সংজ্ঞাত পূণর্মাত্রায় আদায় করিবে, তাহার জন্য আল্লাহ তা’আলার অবশ্য পালনীয় প্রতিশ্রুতি রহিয়াছে যে, তিনি তাহাকে মাফ করিয়া দিবেন। আর যে লোক তাহা করিবে না, তাহার জন্য আল্লাহর অবশ্য পালনীয় কোন ওয়াদা নাই। তিনি ইচ্ছা করিলে তাহাকে ক্ষমা করিয়া দিবেন, আর ইচ্ছা করিলে তাহাকে আযাব দান করিবেন।
– মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ।
ব্যাখ্যা এই হাদীসটির প্রথম বক্তব্য হইল, আল্লাহ তা’আলা দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরয করিয়া দিয়াছেন। কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, যেন- তেন প্রকারে এই নামায সমূহ পড়িলেই বুঝি নামায পড়িবার সমস্ত দায়িত্ব পালন হইয়া যাইবে ও নামায ফরয করার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বুঝি অজির্ত হইয়া যাইবে। এমন কথা চিন্তা করা ও নামায সম্পর্কে সেরুপ মনোভাব পোষণ করা নিতান্তই বাতুলতা মাত্র। নামাযের আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জন করিবার জন্য উহার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে। নামায মূলতই কি জিনিস এবং উহা আদায় করার সঠিক ভাবধারা কি,তাহা গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে। সেই সঙ্গে উহা আদায় করিবার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ নিয়ম-কানুন নিভুর্লভাবে জানিতে হইবে।
এই পর্যায়ে প্রথম কথা, মানুষের জন্য অযু করিতে হইবে। অযুহীন অবস্থায় নামায পড়া তো দূরের কথা, সেই জন্য দাঁড়ানোও যাইতে পারে না। পরন্তু, অযূ অর্থ নির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ শুধু ধৌত করা নয়। অযূ অর্থ, নিজেকে নামাযে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড় করার যোগ্য বানাইবার উদ্দেশ্যে মনে-মগজে পবিত্র ভাবধারা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর নির্দিষ্ট করা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ তাঁহার রাসূলের শিখানো নিয়মে ধৌত করা। হাদীসের শব্দ প্রয়োগ ভঙ্গী হইতে স্পষ্ট হয় যে, প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাযের জন্য নূতন করিয়া অযূ করাই বাঞ্চনীয়। অযূ থাকিলে নূতন করিয়া অযূ করার শরীয়তের পক্ষ হইতে কোন বাধ্যবাধকতা নাই। অনেকে ইহাকে ইসরাফ বা বেহুদা কাজ বলিতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাযের জন্য নূতন করিয়া অযূ করার একটা বিশেষ মূল্য আছে এবং একটা বিশেষ সওয়াব পাওয়ার সুযোগ। উহাকে কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না।
দ্বিতীয়ত মূল নামায আদায়ের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হইবে। নামাযের কার্যাবলী এই মনোভাব লইয়া সম্পন্ন করিতে হইবে যে, আমি বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহ তা’আলার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছি। তিনিই আমার একমাত্র মাবুদ। আমি কেবলমাত্রা তাঁহারই নিকটই জবাবদিহি করিতে প্রতি মুহুর্তেই আমি বাধ্য। বস্তুত নামাযের অন্তনির্হিত ভাবধারা ইহাই। নামাযে কিয়াম, রুকু, সিজদা, বসা ইত্যাদি বহু কয়টি বড় বড় কাজ রহিয়াছে। কিন্তু এই হাদীসে কেবলমাত্র রুকুরই উল্লেখ করা হইয়াছে এবং উহাকে সম্পূর্ণতা দান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হইয়াছে। ‘রুকু’ শব্দের অর্ত নতি স্বীকার। দাঁড়ানো অবস্থা হইতে নামাযীকে আল্লাহর সম্মুখে সর্বপ্রথম মাথা নত করিতে হয় এই রুকুতে। ইহার পর সিজদা। ইহাও আল্লাহর সম্মুখে নতি স্বীকার তবে রুকু নতি স্বীকারের প্রথম দৃষ্টান্ত, আর চুড়ান্ত নতি স্বীকারের প্রতীক হইল সিজদা। এখানে কেবলমাত্র রুকু’র উল্লেখ হইলেও নতি স্বীকারের সব কয়টি কাজই এখানে লক্ষ্য। আর সব কয়টি কাজই যথাযথভাবে সম্পন্ন করার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হইয়াছে। রুকুর সঙ্গে বলা হইয়াছেঃ
************** শব্দের অর্থ।
*****************************
মনের এমন একটা অবস্থা, যাহাতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ধীরস্থির ও বিনয়-নম্রতার ভাব পরিব্যপ্ত ও পরিস্ফুট হয়।
কাতাদাহ বলিয়াছেনঃ
****************************
খুশু’ একটা মানসিক ভাবধারা। ভীতি ও আতঙ্কের অনুভূতি এবং নামাযে চক্ষু অবনতকরণ।
সুফিয়ান সওরী বলিয়াছেনঃ
**************************
প্রত্যেকটি ফরয কাজে- যাহা আল্লাহ তা’আলা তোমার প্রতি ফরয করিয়া দিয়াছেন- আল্লাহকে ভয় কর।
এই সব তাৎপর্যই নিহিত রহিয়াছে আল্লাহর বাণীতে উদ্বৃত শব্দে।
কুরআনের আয়াতঃ
*************************************
যেসব লোক তাহাদের নামাযে আল্লাহর ভয় সহকারে অবনত মস্তকে দাঁড়ায়, তাহারাই মুমিন এবং এই মুমিন লোকেরাই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করিতে পারে।
**********************************
বস্তুত এই রূপ খুশু’র কথাই বলা হইয়াছে আলোচ্য হাদীসে। নামাযে এইরূপ খুশু না হইলে নামাযের মূল লক্ষ্য অর্জন করা যায় না। নামাযে এই খুশুকে পূর্ণ মাত্রায় জাগরূক রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করাই এই হাদীসের উদ্দেশ্য। আর এইভাবে যাহারা নামায আদায় করিবে, তাহাদিগকে ক্ষমা করার ওয়াদা আল্লাহ তা’আলা করিয়াছেন। – এইরূপ নামাযীরাই যে আল্লাহর নিকট ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য তাহাতে সন্দেহ নাই।
কিন্তু যাহারা এইরূপ অন্তর্নিহিত ভাবধারা সম্বলিত নামায আদায় করিবে না, তাহাদিগকে ক্ষমা করার কোন ওয়াদা আল্লাহর নিকট হইতে আসে নাই। সাধারণভাবে ক্ষমা করা কিংবা না করিয়া আযাব দেওয়া সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। এই লোকদের ব্যাপারে এই কথাই প্রযোজ্য।
**************************************
হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ হে আনাস। তোমার সিজদার স্থানে তোমার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখ।- বাহহাকী।
ব্যাখ্যা নামাযে দৃষ্টি যাহাতে দিগ্বিদিক ঘুরিতে না থাকে ও মনের একাগ্রতা ও ঐকান্তিকতা যাহাতে বিঘ্নিত হইতে না পারে, সেই জন্য নবী করীম (স) নির্দেশ দিয়াছেন যে, নামাযে সিজদার স্থানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিবে। অন্যথায় গভীর নিবিষ্টভাবে নামায আদায় করা সম্ভব হইবে না।
বস্তুত নামাযে দাঁড়াইয়া এদিক-ওদিক তাকানো বানানা দিকে চোখ ঘোরানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই পর্যায়ে বহু হাদীস বর্ণিত ও গ্রন্থাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত আনাস (রা) হইতে অপর একটি বর্ণনায় মহানবীর উক্তি হইলঃ
***********************************
হে প্রিয়া বালক। নামাযে এদিক-ওদিক তাকানো ও লক্ষ্য দেওয়া হইতে নিজেকে সতর্কতার সহিত সংযত রাখ। কেননা নামাযে এদিক ওদিক তাকানো ও লক্ষ্য দেওয়া ধ্বংসের কারণ হইয়া থাকে।
কুরআন মজীদে এই নামায প্রসঙ্গেই নির্দেশ দেওয়া হইয়াছেঃ
**********************
তোমরা আল্লাহর জন্য (নামাযে) বিনয়াবনত ও নীরব নিস্তব্ধ হইয়া- কুনূত সহকারে- দাঁড়াও। আর ‘কুনূত’ অর্থঃ
*************************
রুকু দীর্ঘময় করা, খুশু গভীর করা, দৃষ্টি নিম্নদিকে নিবদ্ধ রাখা এবং বাহু নম্র ও অবনত করা। রাসূলে করীম (স)-এর এইসব বাণী কুরআন মজীদের এই স্পষ্ট নির্দিশের সহিত পুরাপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
উপরোদ্ধৃত হাদীস ও কুরআনের আয়াতের প্রেক্ষিতে এই কালের মুসলমানদের নামায পড়ার অবস্থা বিচার করিলে দুঃখ ও লজ্জার সীমা থাকে না। অনেককে খুব তাড়াহুড়া করিয়া অযূ করিতে, সব কয়টি অঙ্গ যথার্থভাবে ধৌত হইল কিনা সেদিকে লক্ষ্য না দিতে, নামাযে আল্লাহর সম্মুখে দুর্বিনীত, অনমনীয় ও অবজ্ঞা ভরা ভঙ্গীতে দাঁড়াইতে এবং মোরগের আধার খাওয়ার ন্যায় খুব দ্রুততার সহিত রুকু সিজদার কাজ সারিতে দেখা যায়। কিন্তু এইভাবে আর যাহাই হউক, নামায পড়া যে হয় না, তাহা আমাদের মনে রাখিতে হইবে।
নামায পড়ার নিয়ম
********************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইত বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করিল। রাসূলে করীম (স) তখন মসজিদের এক কোণে উপবিষ্ট ছিলেন। সেই ব্যক্তি নামায পড়িল। পরে রাসূলে করীম (স)-এর নিকটে আসিয়া তাঁহাকে সালাম করিল। রাসূলে করীম (স) সালামের জওয়াব দিয়া বলিলেনঃ তুমি ফিরিয়া যাও এবং আবার নামায পড়। কেননা তুমি নামায পড় নাই। লোকটি এই কথা শুনিয়া ফিরিয়া গেল এবং আবার নামায পড়িল। পরে ফিরিয়া আসিয়া রাসূলে করীম (স) কে আবার সালাম বলিল। রাসূলে করীম (স) সালামের জওয়াব দিলেন এবং বললেনঃ তুমি আবার গিয়া নামায পড়িয়া আস, কেননা তুমি যে নামায পড়িয়াছ তাহা হয় নাই। পরে তৃতীয় কিংবা চতুর্থবার লোকটি বলিলঃ হে রাসূল। কিভাবে নামায পড়িতে হইবে, তাহা আমাকে শিখাইয়া দিন। তখন নবী করীম (স) নামায পড়া শিক্ষা দেওয়া প্রসঙ্গে বলিলেনঃ তুমি যখন নামাযের জন্য প্রস্তুত নিবে, তখন প্রথমেই খুব ভালো ও পূর্ণমাত্রায় অযূ করিবে। তাহার পর কিবলামুখী হইয়া দাঁড়াইবে। ইহার পর ‘আল্লাহ আকবার’ বলিয়া হাত বাঁধিয়া দাঁড়াইবে। পরে নামাযে কুরআনের আয়াত যতটা তোমার পক্ষে পাঠ করা সম্ভব পাঠ করিবে। তাহাপর পর রুকু দিবে- উহাতে সম্পূর্ণ প্রশান্ত হইয়া যাইবে। তাহার পর মাথা তুলিয়া একেবারে সমান হইয়া দাঁড়াইয়া যাইবে। তাহার পর সিজদায় যাইবে- সিজদায় একেবারে স্থিত হইয়া থাকিবে। পরে মাথা তুলিয়া উঠিয়া ধীরস্থির হইয়া বসিবে। পরে আবার সিজদায় যাইবে- উহাতেও স্থিত হইয়া থাকিবে। পরে উঠিয়া বসিবে। অপর এক বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ অতঃপর মাথা তুলিয়া উঠিয়া একেবারে সমান হইয়া দাঁড়াইবে। ইহার পর নামাযের অন্যান্য সব কাজ অনুরূপ স্থিতি ও ধীরতা সহকারে সম্পন্ন করিবে।
ব্যাখ্যা এ দীর্ঘ হাদীসে যথাযথভাবে নামায পড়ার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে। শিক্ষা দিয়াছেন স্বয়ং নবী করীম (স)। রাসূলের জনৈক সাহাবী মসজিদে প্রবেশ করিয়া প্রথমেই নামাযে দাঁড়াইয়া গেলেন। এই নামায ছিল ‘তাহায়্যাতুল মসজিদ’- এর নামায। আর লোকটি ছিলেন খাল্লাদ ইবনে রাফে, ইবনে আবূ শায়বা এই কথা বলিয়াছেন। তিনি নামায পড়িয়া রাসূলের সামনে আসিয়া তাঁহাকে সালাম করিলেন। মনে হয়, লোকটি প্রথমে আল্লাহর হক আদায় করিয়া পরে রাসূলের হক আদায় করিলেন। আর স্বয়ং রাসূলে করীমের ইহাই শিক্ষা। অপর একটি হাদীসে বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) মসজিদে উপবিষ্ট ছিলেন। এই সময় একটি লোক মসজিদে প্রবেশ করিয়া প্রথমেই নামায না পড়িয়া রাসূলে করীম (স) -কে সালাম করেন। তখন তাহাকে তিনি বলেনঃ
**********************************
তুমি আগে গিয়া নামায পড়, তাহার পর আমাকে সালাম করিবে।
উপরিউক্ত লোকটি বারবার নামায পড়া সত্ত্বেও বারে বারে নবী করীম (স) তাঁহাকে বলিলেনঃ তুমি যাও, আবার নামায পড়। কেননা তুমি নামায পড় নাই। ‘নামায পড় নাই’ ইহার অর্থ নামায যে রীতি- পদ্ধতি ও ভাবধারা সহকারে পড়িতে হয়, তুমি সেইভাবে নামায পড় নাই। কাজেই তোমাকে আবার নামায পড়িতে হইবে। বারবার পড়া সত্ত্বেও তাঁহার নামায হইতেছে না কেন, তাহা লোকটি বুঝিতে পারেন নাই। শেষ কালে ইহার আসল কারণ বুঝিতে পারিয়া তিনি নিজেই রাসূলে করীমের নিকট নামায পড়ার সঠিক পদ্ধতি জানিতে চাহিলেন। তিনি এই পর্যায়ে যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহা হইতে স্পষ্ট হয় যে, এখানে নামাযের মোটামুটি নিয়ম পদ্ধতি বলিয়া দেওয়াই তাঁহার উদ্দেশ্যে ছিল। ইহাতে নামাযে যে বড় বড় কয়টি কাজের কথা স্পষ্ট হইয়াছে, তাহা হইলঃ পূর্ণাঙ্গভাবে অয়ূ করা, কিবলামুখী হইয়া দাঁড়ানো, তাকবীরে তাহরীমা, সূরা ফাতিহা ও অপর কিছু আয়াত পাঠ, রুকু, সিজদা এবং রুকু সিজদায় পূর্ণ তা’দীলে আরকান পালন করা রুকুর পর সোজা হইয়া দাঁড়ানো ও দুই সিজদার মাঝে ধীরস্থির হইয়া বসা। বস্তুত এই কাজগুলি রাসূলে করীমের শিখানো পদ্ধতি অনুযায়ী সুসম্পন্ন করা না হইলে প্রকৃত নামায যে যথাযথভাবে আদায় হইতে পারে না তাহা বলা নিষ্প্রয়োজন। এই কয়টি কাজই ফরয পর্যায়ের- যদিও তা’দিলে আরকান কাহারো কাহারো মতে ওয়াজিব এবং কাহারো কাহারো মতে সুন্নাত। সে যাহাই হউক, নামায পড়ার এই পদ্ধতিই রাসূলে করীম (স) শিক্ষা দিয়াছেন এবং এই পদ্ধতি অনুযায়ীই সব মুসলমানের নামায পড়া কর্তব্য।
নামাযে কুরআন পাঠ
************************************
হযরত উবাদাহ্ ইবনে সামেত (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত নবী করীম (স) বলিয়াছেন, যে লোক (নামাযে) সূরা ফাতিহা পড়ে নাই, তাহার নামায (হয়) নাই।- সিয়াহ্ সিত্তাহ
ব্যাখ্যা নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া না হইলে নামায হয় না, ইহাই হইল হাদীসটির আসল বক্তব্য। এই পর্যায়ে আরও বহু বর্ণনা বহু সূত্রে হাদীস গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে। দারে কুতনী হাদীস গ্রন্থে এই হাদীসটির ভাষা হইলঃ
*********************
যে লোক সূরা ফাতিহা পড়ে নাই, তাহার নামায যথার্থ হয় নাই।
মুসলিম, আবূ দাউদ ও ইবনে হাব্বান হাদীস গ্রন্থসমূহে উক্ত কথার শেষে একটি শব্দ অতিরিক্ত উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহা হইল ********* অতঃপর উহারও বেশী। ইহার অর্থ দাঁড়ায়, যে লোক নামাযে সূরা ফাতিহা এবং উহারও বেশী কুরআন পড়ে না তাহার নামায (যথেষ্ট) হয় না।
দারে কুতনী বলিয়াছেন, এই হাদীসটির সনদ সহীহ। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত এই হাদীসটি ইবনে খুযায়মা ও ইবনে হাব্বান নিজ নিজ হাদীসগ্রন্থে উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাহা দারে কুতনী বর্ণিত ভাষার সত্যতার সাক্ষী। মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে হাদীসটির ভাষা হইলঃ
***************************
উম্মুল কুরআন অর্থাৎ সূরা ফাতিহা পড়া হয় না যে নামাযে, তাহা গৃহীত হয় না।
এই ভাষার হাদীস মুসলিম ও তিরমিযী শরীফে হযরত আনাস (রা) হইতে আবূ দাউদ ও নাসায়ী গ্রন্থে হযরত আবূ কাতাদাহ হইতে, ইবনে মাজাহ গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে, মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ ও ইবনে মাজাহ্ গ্রন্থে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) হইতে, ইবনে মাজাহ্ ও নাসায়ীতে হযরত আবূ দারদা হইতে, ইবনে মাজাহ্ গ্রন্থে জাবির (রা) হইতে এবং বায়হাকী শরীফে হযরত আলী, হযরত আয়েশা ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে। ইহা হইতে হাদীসটির বিরাট গুরুত্ব ও মহান মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা করা যাইতে পারে।
এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক নামাযের জন্যসূরা ফাতিহা নির্দিষ্ট। উহা ছাড়া কোন নামাযই হয় না। উহা পড়া ফরয। অন্য কিছু উহার বিকল্পও হইতে পারে না। ইমাম শাফেয়ী এবং সাহাবী ও তাবেয়ীনের অধিকাংশ এই মত পোষণ করেন।
ইমাম আবূ হানীফা (র) নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব মনে করিয়াছেন। তিনি ফরয মনে করেন নাই। তিনি দলী হিসাবে পেশ করিয়াছেন কুরআন মজীদের আয়াতঃ
******************* কুরআনের যাহা এবং যতটুকু পড়া সহজ ও সম্ভব তাহাই তোমরা পড়। ইহাতে কোন সূরা বা আয়াত নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয় নাই। কুরআনের যে কোন অংশ পড়িলেই নামাযে কুরআন পড়ার ফরয আদায় হইয়া যাইবে। কাজেই সূরা ফাতিহা নির্দিষ্টভাবে নামাযে পড়া ফরয হইলে কুরআন মজীদের দেয়া এই অনির্দিষ্ট নির্দেশ বাতিল হইয়া যায়। ইমাম আবূ হানীফার মতে ইহা জায়েয নয়।
এই কথা প্রমাণের জন্য কতিপয় হাদীসও উদ্ধৃত করা হইয়াছে। এই কারণে সূরা ফাতিহা পড়া না হইলে নামায একেবারে হইবেই না- এমন কথা বলিতে হানাফী মাযহাবের লোকেরা রাযী নহেন। তাঁহারা বলেন, সূরা ফাতিহা ছাড়াও নামায হইয়া যায়। তবে সূরা ফাতিহা পড়ার তাকীদ সম্বলিত হাদীসসমূহের দৃষ্টিতে বলা যাইতে পারে যে, সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায সম্পূর্ণ ও নিখুঁত হয় না। দ্বিতীয়ত সূরা ফাতিহা পড়াকে নামাযের শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্তমনে করাও ঠিক নয়। কেননা নির্দিষ্টভাবে সূরা ফাতিহা পড়ার যত তাকীদই হউক না কেন, তাহা কেবলমাত্র হাদীস ও সুন্নাত হইতেই প্রমাণিত। আর যাহা ছাড়া নামায হয় না, এমন জিনিস ফরয ছাড়া কিছু নয় এবং কুরআন- বহির্ভূত কোন দলীল দ্বারা এই ফরয প্রমাণিতও হয় না।
কুরআনের উপরিউক্ত আয়াত ও উপরোদ্ধৃত পর্যায়ের হাদীসমূহের ভিত্তিতে কতিপয় বিশেষজ্ঞ মত দিয়াছেন যে, সূরা ফাতিহা ও উহার সহিত কুরআনের অন্য কোন অংশ পড়া উভয়ই কর্তব্য। নতুবা নামায হইবে না। হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) হইতে আবূ দাউদ শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে।
তিনি বলিয়াছেনঃ
*******************************
সূরা ফাতিহা ও কুরআনের অপর যে অংশ পড়া সহজ এই উভয়ই পড়ার জন্য আমাদিগকে আদেশ করা হইয়াছে।
এই হাদীসের সনদ সহীহ্ এবং ইহার বর্ণনাকারী সবাই সিকাহ, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য *******
***********************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি হযরত রাসূলে করীম (স)- কে বলিতে শুনিয়াছি, যে লোক যে কোন নামায পড়িল, কিন্তু তাহাতে সূরা ফাতিহা পড়িল না তাহার সে নামায অসম্পূর্ণ- পঙ্গু। – মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ্ ।
ব্যাখ্যা এই হাদীসটির বক্তব্য হইল, সূরা ফাতিহা ছাড়া কোন নামায ফরয কিংবা সুন্নাত বা নফল- পড়া হইলে তাহা পূর্ণাঙ্গ ও নিখুঁত হইবে না, তাহা পঙ্গু হইবে, ক্ষতিসম্পন্ন হইবে, অসম্পূর্ণ হইবে। আর বিশেষজ্ঞদের মতে এই অপূর্ণাঙ্গতা, পঙ্গুতা, অসম্পূর্ণতা ও ক্ষতিসম্পন্নতা এমন, যাহাতে মূল নামাযই বাতিল হইয়া যায়। ইমাম খাত্তাবী লিখিয়াছেনঃ (উপরিউক্ত হাদীসের ভাষা)।
*****************************
উহা পঙ্গু, অসম্পূর্ণ অর্থাৎ পঙ্গু ও অসম্পূর্ণ যে উহার দরুন মূল নামাযই বাতিল ও বিনষ্ট হইয়া যায়।
বায়হাকী হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
**************************************
যে নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া হয় না তাহা সম্পূর্ণ হয় না। আমি বলিলাম- আমি যদি জামা’আতে ইমামের পিছনে নামায পড়ি তাহা হইলেও কি আমাকে সূরা ফাতিহা পড়িতে হইবে? এই কথা শুনিয়া তিনি আমার দুই হাত ধরিয়া ফেলিলেন ও বলিলেন, হে পারস্যদেশবাসী, তুমি তোমার মনে মনেই তাহা পড়।
এই সব হাদীস হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায পড়া হইলে তাহার এমনই অঙ্গহানী হইবে যে, তাহাতে নামায হইল বলিয়া মনে করা যাইতে পারে না। ইহা হইতে এই কথাও প্রমাণিত হয় যে, কেবল সূরা ফাতিহাই নয় উহার সহিত কুরআনের অপর কিছু আয়াত পড়াও একান্তই জরুরী, তাহা হাদীসে স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে।
*****************************
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ প্রত্যেক রাক’আত নামাযে যে লোক সূরা ফাতিহা ও সেই সঙ্গে অপর কোন সূরা না পড়ে, তাহার নামায হয় না।
ব্যাখ্যা এই হাদীস হইতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক রাক’আত নামাযে সূরা ফাতিহা তো পড়িতে হইবেই, সেই সঙ্গে কুরআনের অপর কোনসূরা বা কিছু আয়াত পড়াও অবশ্য কর্তব্য। নামায হইবে না। ইহা অবশ্য দুই রাক’আত বিশিষ্ট ফরয নামায সম্পর্কে প্রযোজ্য। কিন্তু নামায যদি তিন বা চার রাক’আতের হয়, তাহা হইলে প্রথম দুই রাক’আতে সূরা ফাতিহার সঙ্গে কুরআনের অপর কিছু পড়িতে হইবে। আর পরবর্তী রাক’আতে বা রাক’আত দ্বয়ে শুধু সূরা ফাতিহা পড়িতে হইবে। ইহাই নামায পড়ার নিয়ম, যাহা রাসূলে করীম (স) শিক্ষা দিয়াছেন।
************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ ইমাম তো অনুসরণ করার জন্যই নিযুক্ত করা হয়। কাজেই ইমাম যখন তাকবীর বলিবে, তোমারাও তখন তাকবীর বলিবে এবং ইমাম যখন কুরআন পড়িবে, তোমরা তখন গভীর মনোযোগ সহকারে ও নীরবে তাহা শ্রবণ কর।
– বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ,নাসায়ী, ইবনে মাজাহ্।
ব্যাখ্যা ইমামের পিছনে জামা’আতে শামিল হইয়া নামায পড়িলে নামাযের প্রত্যেকটি কাজে ও ব্যাপারে মুক্তাদীকে ইমামের অনুসরণ করিতে হইবে। ইমাম বানাইবার মূল উদ্দেশ্য ইহাই। কাজেই কোন ব্যাপারে ইমামের বিরোধিতা করা, ইমামের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ও তাহাকে ছাড়াইয়া যাওয়া এবং তাঁহার আগে কোনকাজ করা জায়েয নয়। তবে শরীয়ত যে কাজের অনুমতি দিয়াছে, তাহা অবশ্য করা যাইতে পারে। যেমন দাঁড়ানো ইমামের পিছনে ওযরের কারণে বসিয়া নামায পড়া। ইমামের সঙ্গে সঙ্গেও কোন কাজ মুক্তাদী করিতে পারিবে না, করিতে হইবে তাঁহার করিবার পর। ********* শব্দের শুরুতে যে ****** অক্ষরটি রহিয়াছে তাহাই এই কথা প্রমান করে। অতএব ইমাম তাকবীর বলিলে তাহার পর মুক্তাদী তাকবীর বলিবে। রুকু সিজদায় যাওয়া ও উহা হইতে উঠার কাজ ইমামের আগে তো করা যাইবে না, সঙ্গে সঙ্গেও নয়। বরং পরে পরে করিতে হইবে।
হাদীসের শেষ কথাটি হইল, ইমাম যখন কুরআন পড়িবে- তাহা সূরা ফাতিহা হউক কিংবা অন্য কোন অংশ- তখন মুক্তাদীদিগকে নীরবে ও গভীর মনোযোগ সহকারে তাহা শুনিতে হইবে। তাহার পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তাদী কিছুই পড়িবে না, শুধু শুনিবে। যায়দ ইবনে আলী, হাদী, কাসেম আহমদ ইবনে ঈসা, ইসহাক ইবনে রাহওয়াই, ইমাম আহমদ ও ইমাম মালিক প্রমুখ ফকীহ মনে করেন, ইহা কেবল উচ্চস্বরে কুরআন পড়া হয় যে নামাযে সেই নামাযের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু হানাফী মাযহাবের মনীষিগণ মনে করেন, নিঃশব্দে কুরআন পড়িবার নামায ও উচ্চস্বরে কুরআন পড়িবার নামায- এই উভয় ক্ষেত্রেই রাসূলে করীম (স)-এর এই নির্দেশ অনুসরণীয়। এই পর্যায়ে একটি দলীল এইঃ হযরত জাবিরের কথাঃ
******************************
যে লোক সূরা ফাতিহা ছাড়া এক রাক’আত নামাযও পড়িল, যেস যেন আদপেই নামায পড়িল না। তবে ইমামের পিছনে যে নামায পড়িল, তাহার কথা স্বতন্ত্র।
অর্থাৎ ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের কুরআন বা সূরা ফাতিহা পড়িবার দরকার নাই। ইমামের পড়াই তাহার জন্য যথেষ্ট।
আবূ দাউদ ও তিরমিযী হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে এই পর্যায়ে একটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাহাতে বলা হইয়াছেঃ উচ্চস্বরে কুরআন পড়া হয়- এমন নামায সমাপ্ত করিয়া নবী করীম (স) মুক্তাদীদের প্রতি ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ এইবার নামাযের মধ্যে তোমাদের কেহ কি আমার সঙ্গে সঙ্গে কুরআন পড়িয়াছে? এক ব্যক্তি বলিলঃ ইয়া রাসূল। আমি পড়িয়াছি। তখন তিনি বলিলেন, কি ব্যাপার, আমি কি কুরআন লইয়া ঝগড়া বাঁধাইয়াছি? ইহার পর যেহরী নামাযের সঙ্গে সঙ্গে কুরআন পড়া লোকেরা পরিত্যাগ করিল। তখন তাহারা রাসূলের কুরআন পড়া মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করিত।
এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয়, যে নামাযে কুরআন উচ্চস্বরে পড়া হয়, তাহাতে ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের কুরআন পড়া জায়েয নয়। ইমাম শাওকানী লিখিয়াছেন। এই ব্যাপারে কোনই বিতর্ক নাই। বিতর্ক হইল যে নামাযে কুরআন নিঃশব্দে পড়া হয় তাহাতে মুক্তাদীরও কুরআন পড়া সম্পর্কে। *******************
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের কুরআন পড়া সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য তিন পর্যায়ের। এক, ইমাম যখন নিঃশব্দে কুরআন পড়ে কেবল তখন মুক্তাদী সূরা ফাতিহা পড়িবে। ইহা ইবনুল কাসিমের মত। দুই, মুক্তাদী ইমামেরপিছনে কখনই সূরা ফাতিহা পড়িবে না। ইবনে ওহাব ও আশহব এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। তিন, ইমামের পিছনে মুক্তাদী সূরা ফাতিহা সর্বাবস্থায় পড়িবে। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল হাকীম এই মত দিয়াছেন। তিনি ইহাও বলিয়াছেন যে, মুক্তাদী সূরা ফাতিহা না পড়িলেও নামায হইয়া যাইবে। সম্ভবত তিনি উহা পড়া মুস্তাহাব মনে করিয়াছেন। কিন্তু আমার মতে নির্ভূলতর মত হইল নিঃশব্দে কুরআন পড়া নামাযে মুক্তাদীর পক্ষে সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব। আর উচ্চস্বরে পড়া হয় যে নামাযে, তাহাতে সূরা ফাতিহা পড়া হারাম।
ইহার কারণ দর্শাইয়া তিনি আরও বলিয়াছেন, ইমাম যখন উচ্চস্বরে কুরআন পড়ে, তখন তাহা মনোযোগ সহকারে ও নীরবে শ্রবণ করা মুক্তাদীর কর্তব্য। তবে কোন মুক্তাদী যদি ইমাম হইতে অনেক দূরবর্তী স্থানে থাকে ও ইমামের কণ্ঠস্বর সে শুনিতে না পায়, তখন সে যেন সেই নামায পড়িতেছে যে নামাযে কুরআন নিঃশব্দে পড়া হয়।
*******************************
হযরত জাবির (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেনঃ যে লোক ইমামের পিছনে নামায পড়ে, ইমামের কুরআন পড়াই তাহার জন্য যথেষ্ট। – মুয়াত্তা আবূ হানীফা- উমদাতুলকারী।
ব্যাখ্যা এই হাদীস হইতে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, জামা’আতের নামাযে ইমামের কুরআন পড়াই মুক্তাদীদের জন্য যথেষ্ঠ। মুক্তাদীকে কুরআন পড়িতে হইবে না। এমনকি সূরা ফাতিহাও নয়। এই ব্যাপারে নীরবে কুরআন পড়ার নামায ও উচ্চস্বরে কুরআন পড়ার নামায উভয়ই সমান। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী এই পর্যায়ে লিখিয়াছেন যে, আশি জন বড় বড় সাহাবী ইমামের পিছনে কুরআন পড়িতে নিষেধ করিয়াছেন। হযরত আলী, আবদু্ল্লাহ ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) তাঁহাদের অন্যতম। তাঁহাদের এই সর্বসম্মত মত শরীয়তে ইজমার সমতুল্য। *****************
নামাযে কুরআন পাঠ সংক্রান্ত এই দীর্ঘ বিস্তারিত আলোচনা শেষে একটি হাদীস কর্তব্য। হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
*************************
নবী করীম (স) নামাযে কুরআন পাঠ শুরু করার পূর্বেই আয়ুজুবিল্লাহ পড়িতেন, নবী করীমের এই আয়ুজু পড়া মূলত কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশেরই বাস্তব অনুসরণ। কুরআনের নির্দেশ।
***************************
তুমি যখনই কুরআন পড়িতে প্রস্তুত হও তখনই আল্লাহর নিকট শয়তান হইতে পানাহ চাও।
নামাযে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানো ও অধিক রুকু- নিজদা করা
*****************************
হযরত জাবির (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করা হয়ঃ কোন ধরনের নামায উত্তম? উত্তরে তিনি বলিয়াছেনঃ দীর্ঘক্ষণ বিনয়াবনত অবস্থায় দাঁড়াইয়া থাকা। – তিরমিযী,- আহমদ, মুসলিম, ইবনে মাজাহ।
ব্যাখ্যা ’কুনুত’ শব্দের কয়েকটি অর্থ হইতে পারে। কিন্তু এখানে উহার অর্থ কিয়াম-দাঁড়ানো।
কুরআনে আল্লাহর নির্দেশঃ
******************* আল্লাহরই জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে নীরব নিস্তব্ধ ও বিনয় হইয়া দাঁড়াও। দাঁড়ানো এই নির্দেশই পালন করা হয় নামাযে দাঁড়াইয়া। আব্দুল্লাহ ইবনে হাবশী বর্ণিত হাদীসের ভাষা এইরূপঃ
******************************
নবী করীম (স)-কে জিজ্ঞাসা করা হইল, কোন ধরনের নামায উত্তম? তিনি বলিলেনঃ নামাযে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকা।
************** একই অর্থবোধক শব্দ এবং ইহা হাদীসের বিশেষ পরিভাষা। একই কথা বুঝাইবার জন্য এই দুইটি শব্দ হাদীসে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে।
বস্তুত নামাযের একটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ রুকন হইল কিয়াম বা দাঁড়ানো। এই দাঁড়ানো ঐকান্তিক গভীর, বিনয় ও আনুগত্যের ভাবধারা সহকারে এবং এই ধীরস্থির মনোভাব লইয়া যে, আমি আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছি, আমি তাঁহাকে দেখিতেছি, অন্ততঃ তিনি আমাকে দেখিতেছেন। বস্তুত বান্দার মনের এই ভাবধারাই হইল ইবাদতের মূল কথা, ইবাদতের প্রাণশক্তি। এই ভাবধারা মনে না থাকিলে একটি কাষ্ঠখন্ডের মত দাঁড়াইয়া থাকার কোনই তাৎপর্য নাই। এইরূপ ভাবধারা মনে লইয়া দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকা এবং বিনয়াবনতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া যে নামায আদায় করা হয়, রাসূলে করীম (স) এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী তাহাই উত্তম নামায।
কিন্তু এই দাঁড়ানোটা নিছক দাঁড়ানো মাত্র নয়। কেবলমাত্র চুপচাপ নির্বাক নিস্পন্দ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকা নয়। সেই সঙ্গে কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াত পাঠ করাও জরুরী। অর্থাৎ দীর্ঘক্ষণ বিনয়াবনত অবস্থায় আল্লাহর ভয় ও তাঁহার রহমত পাওয়ার আকুল আগ্রহ সহকারে দাঁড়াইয়া থাকিয়া কুরআন মজীদ পাঠ করিতে থাকা হয় যে নামাযে, বস্তুত সেই নামাযই আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। যে নামাযে এইরূপ দাঁড়ানো হয় না- যে নামায এইরূপ কিয়াম সহকারে সম্পন্ন করা হয় না, বরং দায়সারা গোছের দাঁড়ানো দ্বারাই নামায শেষ করা হয়, তাহা কখনও আল্লাহর পছন্দনীয় নামায হইতে পারে না।
এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, নামাযের অন্যান্য কাজের তুলনায় এইভাবে কিয়াম করা রুকু-সিজদা অপেক্ষাও অধিক উত্তম। বস্তুত এই ‘কিয়াম’ ফরয। একটি প্রশ্নের জবাবে নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ ******************* দাঁড়াইয়া নামায পড়।’ – বুখারী।
আবূ দাউদ ও নাসায়ী আব্দুল্লাহ ইবনে হুবশী ও আনাস ইবনে মালিক হইতে এবং আহমদ, ইবনে হাব্বান ও হাকেম হযরত আবূ যর (রা) হইতে এই মর্মের হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন।
*******************************************
মা’দান ইবনে তালহা আল-ইয়া’মুরী বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি রাসূলে করীম (স)-এর মুক্ত দাস সওবান (রা)-এর সহিত সাক্ষাৎ করলাম এবং তাঁহাকে বলিলাম যে, আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলুন, যাহার দুরুন আল্লাহ আমাকে উপকৃত করিবেন ও তিনি আমাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। আমার কথা শুনিয়া তিনি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিলেন। আমার জিজ্ঞাসার কোন উত্তর দিলেন না। পরে তিনি আমার প্রতি তাকাইলেন এবং বলিলেন, বহু সিজদা করা তোমার কর্তব্য। কেননা আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি, যে বান্দাই আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করে, আল্লাহ তা’আলা উহার দরুন তাহার মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি করিয়া দেন। উহার দরুন তাহার গুনাহ খাতা মার্জনা করেন।
– তিরমিযী, আহমদ, মুসলিম, আবূ দাউদ।
ব্যাখ্যা এই হাদীসটির বর্ণনাকারী মা’দান একজন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য তাবেয়ী। আর সওবান হইলেন রাসূলে করীম (স)-এর আযাদ করা গোলাম। তিনি রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবী ছিলেন এবং তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে রহিয়াছেন। উদ্ধৃত হাদীসটির প্রথম কথা, একজন তাবেয়ী রাসূলের একজন সাহাবীর নিকট কল্যাণকর ও পরকালে জান্নাতে যাওয়ার নিমিত্ত যে সব কাজ সেই বিষয়ে জানিতে চাহিয়াছেন। প্রশ্ন শুনিয়া তিনি সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না; কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিলেন। কেননা প্রশ্নটি ছিল অত্যন্ত ব্যাপক ও বিরাট বিষয়ের। ঠিক কোন্ কথাটি বলিলে প্রশ্নকারীর জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব হইতে পারে ইহা তাঁহাকে বিশেষভাবে চিন্তা করিতে হয়। অতঃপর তিনি যাহা বলিলেন তাহা হইল সিজদার বিশেষ মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের কথা। কিন্তু তাহাও তিনি নিজের জবাবে যে কথাটি বলিরেন, কল্পনা বা ধারণা বিশ্বাসারে ভিত্তিতে বলেন নাই। তিনি রাসূলে করীমের মুখে যাহা শুনিয়াছেন, তাহার ভিত্তিতেই তিনি জিজ্ঞাসার জবাব দিলেন। এই কথাটি আহমদ, মুসলিম ও আবূ দাউদের হাসীদ গ্রন্থসমূহের একটি বর্ণনায় নিম্নোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
************************************
তোমার বেশী বেশী সিজদা কর্তব্য। কেননা তুমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে সিজদাই কর না কেন, তাহা একটি হইলেও আল্লাহ তা’আলা উহার সাহায্যে তোমরা মর্যাদা অনেক উচ্চ ও উন্নত করিয়া দিবেন।
ইমাম শাওকানী এই হাদীসের ভিত্তিতে লিখিয়াছেনঃ
***********************************
এই হাদীস প্রমাণ করে যে, ইসলামী শরীয়তে খুব বেশী সিজদা করার জন্য উৎসাহ দান করা হইয়াছে। আর এই সিজদা বলিতে নামাযের সিজদাই বুঝানো হইয়াছে। এই জন্যই এই কাজে উৎসাহ দেওয়া হইয়াছে।
আর তাহার অর্থ, বেশী নামায পড়া, যাহাতে বেশী বেশী সিজদা করা হয়।
সিজদার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত একটি হাদীসের অংশ উল্লেখ্য। তাহা হইলঃ
***********************************
সিজদাকারী ব্যক্তিই আল্লাহর অত্যন্ত নিকটবর্তী হইয়া থাকে।
আর এই কথাটি আল্লাহু তা’আলার এই ফরমানের অনুরূপঃ
**************************** সিজদা কর এবং নিকটবর্তী হইয়া যাও। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য লাভের সবচাএত বড় উপায় হইল সিজদা এবং যে যত সিজদা করিবে, সে তত বেশী আল্লাহর নৈকট্য লাভে সমর্থ হইবে। এই কারণে অনেক মনীষী মনে করেন, দাঁড়ানোর তুলনায় সিজদা করা অধিক উত্তম ও অধিক মাহাত্ম্য ও মর্যাদাপূর্ণ। ইমাম তিরমিযী তাই এই হাদীসটির উদ্ধৃতির পর লিখিয়াছেনঃ
*********************************
দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানোর তুলনায় বেশী বেশী রুকু’ সিজদা করা অধিক উত্তম।
আলোচ্য হাদীসটি এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানোর মর্যাদা বর্ণনাকারী পূর্বোদ্ধৃত হাদীসের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য বা বিরোধ নাই। বরং প্রত্যেকটিই নিজস্ব পরিসরে উত্তম হওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ কিয়াম ও সিজদা- দুইটিই আল্লাহর নৈকট্য বিধানকারী কাজ। দুইটি কাজই আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।
রুকু ও সিজদার তসবীহ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত নবী করীম (স) বলিয়াছেন, তোমাদের কেহ যখন রুকুতে যাইবে তখন সে তাহার রুকুতে ’সুবহানা রাব্বীয়াল আযীম’- ‘আমার মহান আল্লাহর পবিত্রতা বলিতেছি আমি’ তিনবার বলিবে, তাহা হইলে তাহার রুকু সম্পূর্ণ হইবে। আর ইহাই তাহার নিকটবর্তী। আর যখন সে সিজদায় যাইবে, তখন সে তাহার সিজদায় ‘সুবাহানা রাব্বীয়াল আ’লা’- ‘আমার মহান উচ্চ আল্লাহর পবিত্রতা প্রকাশ করিতেছি’ তিনবার বলিবে। তাহা হইলে তাহার সিজদা সম্পূর্ণতা লাভ করিবে। আর ইহাই তাহার নিকটবর্তী। – তিরমিযী
ব্যাখ্যা হাদীসে রুকু ও সিজদায় যে দুইটি তসবীহ পড়ার নির্দেশ করা হইয়াছে আসলে উহা কুরআন মজীদেরই দুইটি আয়াতের দুইটি নির্দেশের বাস্তব অনুসরণের ব্যবস্থা। উকবা ইবনে আমের (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ
***********************************************
কুরআনের আয়াত (যাহার অর্থ) ‘অতঃপর তোমরা উচ্চ আল্লাহর নামে তসবীহ কর, নাযিল হইল, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ উহাকে তোমাদের রুকু’তে স্থাপন কর। অতঃপর যখন ‘তোমার মহান আল্লাহর নামে তসবীহ কর’ নাযিল হইল, তখন তিনি বলিলেনঃ ইহাকে তোমাদের সিজদাসমূহে পড়িবার জন্য নির্দিষ্ট করিয়া লও।
উপরিউক্ত হাদীসে তিনবার করিয়া এক একটি তসবীহ পড়িবার কথা বলা হইয়াছে এবং বলা হইয়াছে ‘ইহা তাহার নিকটবর্তী’ অর্থাৎ এই তিনবার সংখ্যা পূর্ণত্বের নিকটবর্তী। আর পূর্ণত্ব জ্ঞাপক সংখ্যা হইল সাতবার এবং মধ্যম সংখ্যা পাঁচবার।
মা ওয়াদী বলিয়াছেনঃ পূর্ণত্ব লাভের সংখ্যা হইল ১১ কিংবা ৯ বার এবং মধ্যম মানের সংখ্যা পাঁচবার। আর একবার করিয়া পড়িলেও তসবীহ পড়া হইয়া যায়। এই পর্যায়ে হযরত আনাস (রা)- এর একটি কথা উল্লেখ্য বলিয়াছেন।
*******************************
রাসূলে করীম (স)- এর পরে তাঁহার সদৃশ নামায এই যুবক উমর ইবনে আবদুল আযীয ছাড়া আর কাহারও পিছনে পড়ি নাই। আমরা ধারণা করিয়াছি, তিনি তাঁহার রুকুতে দশ তসবীহ ও সিজদায় দশ তসবীহ করিয়া পড়িতেন।
দশ তসবীহ করিয়া পড়িলে রুকু ও সিজদা পূর্ণতা লাভ করে- এই মত যাহাদের হযরত আনাসের এই কথাটি তাঁহাদের দলীল। তবে অধিক সত্য কথা এই যে, একাকী নামায পড়িরে বেশী সংখ্যায় বেশী বার তসবীহ পড়া সঙ্গত। তখন যত বেশী তসবীহ করিবে ততই উত্তম। তাহাও নবী করীম (স) হইতে তাঁহার একাকী নামাযের যত সংখ্যা প্রমাণিত আচে ততটাই পড়া উচিত, তাহার অধিক নয়। কিন্তু ইমামের পক্ষেন নামায সংক্ষিপ্ত করা তো একান্তই কর্তব্য। কেননা তাহার মুক্তাদীদের শক্তি ও অবসর সম্পর্কে তাহার কোন ধারণা থাকার কথা নয়। আর অধিক সময় রুকু’ সিজদায় থাকার শক্তি মুক্তাদীদের আচে- এরুপ জানা সত্ত্বেও নামায সংক্ষিপ্ত করাই ইমামের কর্তব্য। কেননা নামাযে অধিক সময় অতিবাহিত হইলে কাহার কি অবস্থা দেখা দিবে বা কাহার কি ক্ষতি হওয়ার আশংকা আছে, তাহা কখনই নিশ্চয় করিয়া বলা যাইতে পারে না।
ইমাম তিরমিযী লিখিয়াছেনঃ হাদীস বিশারদগণ এই হাদীস অনুযায়ী আমল করেন এবং
******************************
তিন তসবীহর কম পড়া তাঁহার কাহারও জন্য পছন্দ করেন না।
ইহাই মুস্তাহাব। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************
ইমাম পাঁচ তসবীহ পড়িলে মুক্তাদীরা অন্ততঃ তিনটি তসবীহ পড়িতে পারিবে। এই কারণে ইহাই আমি পছন্দ করি।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিয়াছেনঃ
*******************************************
রাসূলে করীম (স) যখন রুকু হইতে পিঠ সোজা করিয়া দাঁড়াইতেন, তখন ******************* যে লোক আল্লাহর হামদ করিল, আল্লাহ তা’আলা তাহার হামদ শুনিতে পাইয়াছেন’ বলিতেন। পরে দাঁড়ানো অবস্থায় বলিতেন ************ ‘আমাদের আল্লাহ। তোমার জন্যই সমস্ত হামদ, নামাযে এইরূপ বলাই বিধেয়।
এই রুপ বলিলেই রাসূলের অনুরূপ নামায পড়া হয়। রিফায়াতু ইবনে রাফে বলিয়াছেনঃ আমরা একদিন রাসূলে করীম (স)-এর পিছনে নামায পড়িতেছিলাম। নামাযে এক মুক্তাদী রুকু হইতে উঠিয়া বলিলঃ
*******************************
হে আল্লাহ! তোমার জন্য সব হামদ, বহু হামদ অতি পবিত্র উত্তম এবং বরকতওয়ালা হামদ। নামাযে শেষে নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ এইরূপ কে বলিয়াছে? লোকটি বলিলঃ আমি! তখন তিনি বলিলেনঃ
****************************
আমি ছত্রিশ জন ফেরেশতাকে দেখিলাম ইহার দিকে দৌড়াইতেছেন যে, কে উহা সকরের আগে লিখিবে।
নামাযে তাশাহহুদ পাঠ
******************************************
হযরত আবদুল্লাহ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর পিছনে নামায পড়িতে গিয়ে আমরা বলিতামঃ আল্লাহর প্রতি সালাম, অমুকের প্রতি সালাম। এই সময় একদিন রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে বলিলেনঃ নিঃসন্দেহে আল্লাহই হইতেছেন সালাম। কাজেই তোমাদের কেহ যখন নামাযে বসিবে তখন সে যেন আত্তাহিয়্যাতু পড়ে, বলেঃ আল্লাহর জন্যই সব সালাম সম্বর্ধনা, সব নামায দোয়া ও সব পবিত্র বাণী। হে নবী! তোমার প্রতি সালাম, আল্লাহর রহমত এবং বরকত সর্ববিষয়েই শ্রী-বৃদ্ধি। সালাম ও শান্তি-নিরাপত্তা আমাদের প্রতি ও আল্লাহর সব নেক বান্দার প্রতিও। এই কথা যখন বলা হইবে, তখন এই বাক্যসমূহ আসমান ও জমীনে অবস্থিত আল্লাহর সব নেক বান্দার জন্যই ইহা যথার্থভাবে পৌঁছিবে। (ইহার পর বলিবেঃ) আমি সাক্ষ্য দিতেছিঃ আল্লাহু ছাড়া ইলাহ্ কেহই নাই এবং সাক্ষ্য দিতেছি, মুহাম্মদ (স) আল্লাহর বান্দা ও তাঁহার রাসূল। অতঃপর যে কোন বিষয়ে ইচ্ছা প্রার্থনা পেশ করিবে।
ব্যাখ্যা নামাযের এক বা দুইটি বৈঠকেই এই দোয়া পড়ার নিয়ম। ইহাকে প্রচলিত ভাষায় ‘আত্তাহিয়্যাতু’ বলা হয়। আর হাদীসের পরিভাষায় বলা হয় তাশাহ্হুদ’ অথাৎ সাক্ষ্যদান।
এই তাশাহহুদ পড়া ওয়াজিব, না সুন্নাত -এ সম্পর্কে ফিকাহবিদগণ বিভিন্ন কথা বলিয়াছেন। ইমাম শাফেয়ী ও অপর কতিপয় হাদীসবিদ বলিয়াছেন, প্রথম বৈঠকের পথম তাশাহহুদ সুন্নাত এবং দ্বিতীয় বৈঠকের তাশাহহুদ ওয়াজিব। বেশীর ভাগ মুহাদ্দিসের মতে এই দুইটির ওয়াজিব। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) প্রথমটি ওয়াজিব ও দ্বিতীয়টি সুন্নাত মনে করেন। ইমাম মালিক (র)-এর স্পষ্ট মতে এই দুটিই ওয়াজিব। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেন রাসূলে করীম (স)-এর কথাঃ
*************************************
সে যেন আত্তাহিয়্যাতু বলে- ইহা হইতে জানা গেল যে, নামাযের শেষে তাশাহহুদ পড়া ওয়াজিব। কেননা নবী করীম (স) বলিয়াছেন ‘সে যেন বলে, ইহা আদেশ। আর রাসূলের আদেশ অবশ্য পালনীয় ওয়াজিব।
এই দোয়াটিকে তাশাহহুদ বলা হয় এই জন্য যে, ইহাতে তাওহীদ ও রিসালাত সম্পর্কে স্পষ্ট সাক্ষ্য উচ্চারিত হইয়াছে। ‘আল্লাহই ‘সালাম’ অর্থ ‘সালাম’ আল্লাহর অন্যতম একটি নাম। অর্থাৎ তিনি সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি, অভাব-অসম্পূর্ণতা, নিত্য পরিবর্তন ও শিরক হইতে মুক্ত ও পবিত্র। আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহ অর্থ যাবতীয় সম্মান মর্যাদা স্থিতি সার্বভৌমত্ব, বিরাটত্ব ও মাহাত্ম্য একমাত্র আল্লাহরই জন্য। এসবে আল্লাহ ছাড়া আর কাহারও একবিন্দু অংশ নাই, অধিকার নাই। ইহাতে নবীর প্রতি সালাম বর্ষিত হওয়ার কথাও রহিয়াছে। সালাম বর্ষণের পর কথা রহিয়াছে সব নামাযীদের ও আল্লাহর সব নেক বান্দার প্রতিও। ইহার অর্থ আল্লাহর নিকট এই সবের জন্য আশ্রয় ও সংরক্ষণ প্রার্থনা করা হইতেছে সবরকম বৈষয়িক পারলৌকিক অশান্তি ও দুঃখ বিপদ হইতে। এইভাবে একই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর হক ও বান্দাদের হক উভয়ই একসঙ্গে আদায় করা হয়। ‘তাশাহহুদের’ শেষ কথাটি- যে কোন বিষয়ে ইচ্ছা প্রার্থনা করার অনুমতি- হইতে জানা যায়, তাশাহহুদের পরে এবং শেষ সালামের পূর্বে যে কোন দোয়া করা মুস্তাহাব- অতীব পছন্দনীয় কাজ। উপরুন্ত পরকালীন ও বৈষয়িক যে কোন কল্যাণের জন্য এই সময় দোয়া করা বৈধ। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা (র) বলিয়াছেনঃ
******************************
এই সময় কুরআন ও হাদীসে উদ্ধৃত দোয়া ছাড়া অন্য কোন দোয়া করা জায়েয নয়।
হে নবী! তোমার প্রত সালাম- ‘এই কথাটিতে সরাসরি নবী করীম (স) কেই সম্বোধন করা হইয়াছে। শুধু নবীর প্রতি ‘সালাম’ এইরূপ পরোক্ষে বলার পরিবর্তে প্রত্যক্ষভাবে সম্বোধন করার মূলে কি মাহাত্ম্য নিহিত রহিয়াছে? ইহাতে রাসূলে করীম (স)-কে কি সম্মুখে উপস্থিত মনে করা হয় না এবং ইহা কি দূষনীয় নয়? হাদীস ব্যাখ্যাতা তায়্যিবী এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। বলিয়াছেনঃ
*********************************
আমরা তো রাসূলের হুবহু সেই শব্দগুলিই পড়ি যাহা সাহাবায়ে কিরাম পড়িতেন।
কাজেই ইহাতে প্রত্যক্ষ সম্বোধন থাকিলে তাহাতে কোনই দোষ হইতে পারে না। কুরআনের আয়াতে এইরূপ প্রত্যক্ষ সম্বোধন অনেক রহিয়াছে এবং তাহা নামাযেও পড়া হয়। আর তাহাতে যখন কোন দোষ হয় না, তখন সরাসরি নবী করীম (স)-এর শেখানো দোয়া হুবহু পড়িলে দোষ হইবে কেন?
তাশাহহুদে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে প্রথমে বলা হইয়াছে ‘আল্লাহর বান্দা’ ও পরে ‘তাঁহার রাসূল’ এই পর্যায়ে উল্লেখ্য, একদা নবী করীম (স) সাহাবীদিগকে তাশাহহুদের এই দোয়া শিক্ষা দিতেছিলেন, তখন একজন বলিলেনঃ আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুহু ওয়া-আবদুহু। নবী করীম (স) ইহার প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, আবদু-হু-ওয়া রাসূলুহু’ বল। কেননা আমি তো প্রথমে আল্লাহর বান্দা, তাহার পরে আল্লাহর রাসূল।
নামাযে দরূদ পাঠ
************************************
হযরত আবূ মাসউদ (রা) ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমাদের নিকট রাসূলে করীম (স) এমন সময় আসিলেন, যখন আমরা সা’দ ইবনে উবাদাহ (রা)-এর মজলিসে বসিয়াছিলাম। তখন বশীর ইবনে আদ রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ আমাদিগকে আল্লাহ তা’আলা আপনার প্রতি দরুদ পড়িতে নির্দেশ দিয়াছেন। কিন্তু আমরা কিভাবে ও কেমন করিয়া আপনার প্রতি দরুদ পড়িব? অতঃপর রাসূলে করীম (স) চুপ করিয়া থাকিলেন। তখন আমাদের মনে হইল, তাঁহাকে যেন কিছুই জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। কিছুক্ষণ পর রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তোমরা বলঃ হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ ও মুহাম্মাদের লোকদের প্রতি দরুদ পৌঁছাও যেমন তুমি ইবরাহীমের প্রতি দরুদ পাঠাইয়াছ এবং মুহাম্মদের প্রতি বরকত দাও, যেমন তুমি ইবরাহীম ও ইবরাহীমের লোকদের প্রতি বরকত দিয়াছ। নিশ্চয়ই তুমি উচ্চ প্রশংসিত ও মহান পবিত্র। ইহার পর সালাম- যেমন তোমরা জান। – মুসনাদে আহমদ, মুসলিম, নাসায়ী, তিরমিযী।
ব্যাখ্যা রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি দরূদ পাঠাইবার জন্য আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে নির্দেশ দিয়াছেন। বলিয়াছেনঃ
**********************************
তোমরা সকলে নবীর প্রতি দরূদ পাঠাও পূর্ণ মাত্রায় সালাম পেশ কর।
দরূদ পড়ার ইহা সাধারণ নির্দেশ এবং এই নির্দেশ পালনে প্রত্যেক মুসলমান বাধ্য। আলোচ্য হাদীসে রাসূলে করীম (স) নিজে তাঁহার প্রতি দরূদ পাঠাইবার জন্য মুসলমানগণকে নির্দেশ দিয়াছেন। নাসায়ী শরীফে এই দরূদের ভাষা ও কথা অনেকটা ভিন্ন রকমের এবং তাহা এইঃ
***********************************
এইসব হাদীসের ভিত্তিতে বলা হইয়াছে, নামাযে তাশাহহুদের পর দরূদ পড়া ওয়াজিব। হযরত উমর (রা), আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা), হযরত ইবনে মসউদ, জাবির ইবনে যায়দ (রা), শা’বী মুহাম্মাদ ইবনে কায়াব কুরাজী আবূ জাফর বাকেরা, শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ মুহাদ্দিস ফকীহ এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিস ফকীহর মতে ইহা ওয়াজিব নয়। ইমাম মালি, ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ সওরী আওযায়ী প্রমুখ ফকীহ এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইবনে জরীব, তাবারী ও তাহাভী মুহাদ্দিসদ্বয় বলিয়াছেনঃ
*********************************
প্রাথমিক কালের ও পরবর্তী কালের ইমাম ফকীহগণ এই কথায় ইজমা করিয়াছেন যে, নামাযে দরূদ পড়া ওয়াজিব নয়।
উপরন্তু ইমাম শাফেয়ী ছাড়া আর কেহই ইহাকে ওয়াজিব বলেন না।
রাসূলে করীম (স)-এর দরূদ পড়ার নির্দেশ যে প্রশ্নের জবাবস্বরূপ বর্ণিত হইয়াছে হযরত ইবনে মাসউদের (রা) বর্ণনায় তাহা হইলঃ
*************************************
আমরা যখন নামাযে আপনার প্রতি দরূদ পাঠাইতে চাহি তখন কিভাবে দরূদ পড়িব?- বায়হাকী, দারে কুতনী
অপর একটি বর্ণনায় প্রশ্নটি হইলঃ
****************************
আমরা আমাদের নামাযে আপনার প্রতি কিভাবে দরূদ পাঠাইব?
এই প্রশ্নের জবাবেই নবী করীম (স) দরূদ শিক্ষা দিয়াছেন ও নামাযে উহা পড়িতে বলিয়াছেন। নবী করীম (স) এই দরূদের জন্য বিশেষ তাকীদ করিয়াছেন। একটি হাদীসে তিনি বলিয়াছেনঃ
*************************
যে লোকের নিকট আমার উল্লেখ হইবে সে যদি আমার প্রতি দরূদ না পড়ে, তবে বুঝিবে, সে নিতান্তই কৃপণব্যক্তি।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে তিনি বলিয়াছেনঃ
*******************************
পূর্ণ মাত্রায় পবিত্রতা ও আমার প্রতি দরূদ পড়া নাই হইলে নামায হয় না।- বায়হাকী, দারে কুতনী।
হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************
যে লোকের নিকট আমার উল্লেখ হয় সে যদি তখনি আমার প্রতি দরূদ না পড়ে তবে সে হতভাগ্য-পাষাণ হৃদয়। – তাবারানী
যেহেতু তাশাহহুদ পড়ার মধ্যেই হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উল্লেখ হইয়া থাকে সেহেতু উহার পরেই তাঁহার প্রতি দরুদ পাট করা বাঞ্চনীয়।
নামাযের শেষ দোয়া
*****************************
হযরত আয়েশা (রা) নবী করীম (স)-এর স্ত্রী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি সংবাদ জানাইয়াছেন যে, রাসূলে করীম (স) নামাযে এই দোয়াটি পড়িতেনঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাহি কবর আযাব হইতে আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাহি দাজ্জাল মসীহর বিপদ-জাল হইতে এবং আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাহি জীবন ও মৃত্যুর বিপদ জালা হইতে। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাহি (খারাপ) পাপ হইতে ও ঋণ হইতে। একজন লোক রাসূলের নিকট প্রশ্ন করিলঃ ইহা রাসূল! ঋণ হইতে আপনি অনেক বেশি পানা চাহিয়া থাকেন, ইহার কারণ কি? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ এক ব্যক্তি যখন ঋণগ্রস্থ হয়, তখন কথা বলিলে মিথ্যা বলে এবং ওয়াদা করিলে তাহা ভঙ্গ করে, বিরোধিতা করে। – বুখারী, আবূ দাউদ, নাসায়ী
ব্যাখ্যা আলোচ্য হাদীসে একটি দোয়া উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত আয়েশা (রা) বলিয়াছেন, নবী করীম (স) এই দোয়াটি নামাযে পড়িতেন। কিন্তু কখন, কোনখানে কোন সময়ে? ইমাম বুখারী ইহার শিরোনাম দিয়াছেনঃ
*********************
সালাম ফিরাইবার পূর্বে পড়ার দোয়া। বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারী কিরমানী বলিয়াছেনঃ নামাযে প্রত্যেকটি স্থানের জন্য একটি বিশেষ দোয়া বা যিকর রহিয়াছে। এই দোয়াটির স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে সবকিছু হইতে অবসর লওয়ার পর। আর তাহা হইল, নামাযের সর্বশেষ স্থান। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ নামাযে দাঁড়ানো আছে, রুকূ সিজদা আছে ও বসা আছে। দাঁড়ানো অবস্থায় কুরআন পড়িতে হয়, রুকূ সিজদার জন্য নির্দিষ্ট দোয়া-তসবীহ আছে। বসা অবস্থায় তাশাহহুদ পড়িতে হয়। অতএব এই দোয়াটির জন্য নির্দিষ্ট স্থান হইল তাশাহহুদের পর ও সালামের পূর্বে এবং ইহাই সেই দোয়া’। ইবনে খুজায়মা উদ্ধৃত একটি হাদীসে ইহার স্থান নির্দিষ্ট করা হইয়াছে। তাউস বলিয়াছেনঃ
***********************
নবী করীম (স) তাশাহহুদের পর খুব বেশী বড় মর্যাদা ও গুরুত্বপূর্ণ কতগুলি বাক্য বলিতেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
*************** তোমাদের প্রত্যেকে যেন তাশহহুদের পর এই দোয়া পড়ে। আরও স্পষ্ট ভাষায় ইহার স্থান নির্দিষ্ট করা হইয়াছে ইমাম আওযায়ী বর্ণিত হাদীসেঃ
***********************
তোমাদের প্রত্যেকে যেন শেষ তাশাহহুদ পড়ার পড় চারিটি জিনিষ হইতে আল্লাহর নিকট পানাহ চায়।
অন্য কথায় নামাযের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পর দরূদ এবং তাহার পর এই দোয়া পড়িতে হয়। এই দোয়ায় প্রথমে কবর আযাব হইতে পানাহ চাওয়া হইয়াছে। দ্বিতীয় পানাহ চাওয়া হইয়াছে মসীহ দাজ্জালের বিপদ-জাল হইতে। ‘দাজ্জাল শেষ যামানায় আত্মপ্রকাশ করিবে। সে হইবে সর্বাপেক্ষা বড় প্রতারক। তাহাকে ‘মসীহ’ বলা হয় এইজন্য যে, সমস্ত কল্যাণ তাহার নিকট হইতে দূরে পালাইয়া গিয়াছে কিংবা এইজন্য যে, তাহার একটি চক্ষু মুখাবয়বে মিশিয়া একাকার হইয়া থাকিবে। তৃতীয় পানাহ চাওয়া হইয়াছে জীবন ও মৃত্যুর ফেতনা-বিপদ জাল হইতে। জীবনের বিপদ যে কত রূপে আসে তাহা প্রত্যেকেই বুঝিতে পারে। আর মৃত্যুর বিপদ বলিতে মৃত্যুকালীন কিংবা মৃত্যু পরবর্তী কালের আযাব বুঝায়। চতুর্থ পানাহ চাওয়া হইয়াছে খারাপ পাপ ও ঋনগ্রস্ততা হইতে। খারাপ পাপ অর্থ যে পাপ মানুষকে কঠিন বিপর্যয়ে নিক্ষেপ করে ও যাহার দরুন কঠিন আযাবে ভুগিতে হইবে। আর ঋণ- গ্রস্ততার আযাব যে কতটা সাংঘাতিক, তাহা স্বয়ং নবী করীম (স)-ই আলোচ্য হাদীসে এক প্রশ্নের জবাবে ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেন। তাঁহার ব্যাখ্যা হইল, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলিতে বাধ্য হয়। কেননা সে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে নানা কথা বলিতে বাধ্য হয় কিন্তু কোন কথাই যথার্থ হয় না। আর সে ঋণ শোধ দেওয়ার বারে বারে নির্দিষ্ট ওয়াদা করে। কিন্তু কোন ওয়াদা রক্ষা করাই তাহার পক্ষে সাধারণত সম্ভবপর হয় না। তাই ওয়াদা খিলাফ করে।
বস্তুতঃ এই দোয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইহাতে যেসব বিষয় হইতে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি অত্যন্তা ভয়ানক ও সাংঘাতিক। আর নামাযের সর্বশেষে ইহা পড়ার জন্য নির্দিষ্ট হওয়ার কারন এই যে, এই কথাগুলি যেন নামাযীর মনে-মগজে সব সময় জাগরূক হইয়া থাকে এবং নামাযের বাহিরে বিশাল জীবনের বিপুল কর্মব্যস্ততার মধ্যেও ইহা হইবে বাঁচিবার জন্য বাস্তব কর্মনীতি অবলম্বন করিতে সদা সচেষ্ট হয়।
রাসূলে করীম (স)-এর শিখানো এই দোয়াটিতে কবর আযাব অবশ্যম্ভাবী বলিয়া প্রমাণিত। শেষকালে দাজ্জাল বাহির হইবে, ইহারও সুস্পষ্ট ঘোষণা হইহাতে উদ্ধৃত হইয়াছে। ইহা ছাড়া সব রকমের বিপদ-আপদ হইতে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়ার শিক্ষাও ইহাতে রহিয়াছে এবং উহা হইতে বাঁচিবার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা রহিয়াছে। ইহা হইতে এই ধারনা জাগ্রত করাই উদ্দেশ্য যে, বিপদ-আপদ হইতে মানুষকে আল্লাহ ছাড়া আর কেহই উদ্ধার বা রক্ষা করিতে পারে না। অতএব উহা হইতে কেবল তাঁহার নিকটই পানাহ চাহিতে হইবে। শেষ বাক্যে ঋণ-গ্রস্ততার ভয়াবহ পরিণতির কথা বলিয়া লোকদিগকে ইহা হইতে দূরে থাকার শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে। বলা হইয়াছে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত মুনাফিক হইতে বাধ্য হয়। কেননা মিথ্যা কথা বলা ও ওয়াদা খিলাপ করা সুস্পষ্টরূপে মুনাফিকীর লক্ষণ। (আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে এই সব ফেতনা হইতে রক্ষা করুন, আমীন।) ********************
জুম’আর নামায
**********************************
হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন যে, তোমরা জুম’আর নামাযে হাযির হও এবং ইমামের নিকটে দাঁড়াও। কেননা যে ব্যক্তি জুম’আর নামাযে সকলের পিছনে উপস্থিত হইবে, পারিনামে সে জান্নাতে প্রবেশ করার ব্যাপারেও সকলের পিছনে পড়িয়া থাকিবে। অথচ সে নিশ্চয়ই উহারই উপযুক্ত। – মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা উপরিউক্ত হাদীসটিতে জুম’আর নামাযে হাজির হওয়া সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশ উল্লেখিত হইয়াছে। ইসলামে কেবলমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই ফরয নহে, তাহার পর প্রতি জুম’আর দিনে জুম’আর নামাযও ফরয, সন্দেহ নাই।
জুম’আর দিন নামাযে হাজির হওয়া সম্পর্কে আদেশ দানের পর রাসূলে করীম (স) এই নামাযে ইমামের কাছাকাছি দাঁড়াইয়বার নির্দেশ দিয়াছেন এবং এই ব্যাপারে কোন প্রকার গড়িমসি করিতে কিংবা পিছনে ও বিলম্বে মসজিদে যাইতেও নিষেধ করিয়াছেন। ইহার কারণস্বরূপ রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন যে, জুম’আর নামাযে আগে-ভাগে হাযির হওয়া বিশেষ ফযীলতের কাজ। যে তাহা করিবে, সে জান্নাতেও সর্বাগ্রে প্রবেশ করিতে পারিবে। আর যে ‘পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে’ সে জান্নাতে প্রবেশ করার সময়ে অগ্রগামী লোকদের সঙ্গী হইতে পারিবে না, বরং এই কারণে সে সকলের পিছনে থাকিয়া যাইবে ও বহু বিলম্বে প্রবেশ করিতে পারিবে। কাজেই যে লোক অগ্রগামীদের সহিত বেহেশতে দাখিল হইতে ইচ্ছুক, সে যেন জুম’আর নামাযে বিলম্বে উপস্থিত না হয়। বরং সে যেন সর্বাগ্রে মসজিদে হাযির হয় ও যথাসম্ভব ইমামের নিকট আসন গ্রহণ করিতে চেষ্টিত হয়।
বস্তুত জুম’আর নামায মুসলিম জাতির জন্য এক অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। বহু মুসলিমের একত্রিত হইয়া আল্লাহর সম্মুখে সিজদায় অবনত হওয়ার ও নিজেদের মধ্যে ঐক্যগ্রন্থি অধিকতর মযবুত করার জন্য ইহা এক বিশেষ সামাজিক ও সামষ্টিক অনুষ্ঠান।
বিনা ওযরে এই নামায ত্যাগ করা অন্যতম কবীরা গুনাহ। এই সম্পর্কে রাসূলের নিকট হইতে অত্যন্ত কঠোরবাণী বর্ণিত হইয়াছে। যদি কেহ বিনা ওযরে জুম’আর নামায ত্যাগ করে, তবে তাহাকে যেমন ‘জুহর আদায় করিতে হইবে’ তেমন হযরত সামুরা বর্ণিত এক হাদীস অনুযায়ী তাহার কাফফারাও আদায় করিতে হইবে। জুহর আদায় করার সঙ্গে সঙ্গে কাফফারাও না দিলে সে কঠিন শাস্তির যোগ্য হইবে। ******************
জুম’আর নামাযের গুরুত্ব
**************************************
হযরত তারেক ইবনে শিহাব (রা) হইতে বর্ণিত হয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন, জুম’আর নামায সঠিক সত্য বিধান। ইহা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জামা’আতে আদায় করা ওয়াজিব। তবে চারি পর্যায়ের মানুষ এই বাধ্যবাধকতা হইতে মুক্ত। তাহারা হইলঃ ক্রীতদাস, স্ত্রীলোক, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক এবং রোগাক্রান্ত ব্যক্তি। – আবূ দাউদ
ব্যাখ্যা প্রত্যেক শুক্রবার জুহরের নামাযের সময় উহার পরিবর্তে জামা’আতের সহিত যে দুই রাক’আত নামায পড়া হয় তাহাকেই জুম’আর নামায বলে। দিন-রাত্রির মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। ইহা জামা’আতের সহিত আদায় করা আবশ্যক, কিন্তু যদি কেহ বিশেষ কোন কারণে জামা’আতে যোগ দিতে না পারে, তাহা হইলে সে একাকী পড়িবে এবং ইহাতেও নামাযের ফরজিয়াত আদায় হইয়া যাইবে। কিন্তু সপ্তাতে একটি দিনের এক ওয়াক্ত নামাযের ব্যবস্থা আল্লাহ তা’আলা এমনভাবে করিয়াছেন যে, তাহার একমাত্র জামা’আতের সহিতই পড়িতে হয়। জামা’আত না পাইলে জুম’আর নামায পড়ার আর কোন ব্যবস্থা নাই। তখন উহার পরিবর্তে জুহর পড়িতে হয়। বস্তুত আল্লাহ তা’আলা এক স্থানের মুসলমান জনগণকে পরস্পর নিকটবর্তী ও ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে পাঁচ ওয়াক্তের নামায জামা’আতের সহিত ফরয করিয়াছেন। আর সপ্তাহের একটি সময় প্রত্যেক এলাকার অধিক সংখ্যক মুসলমানকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে জুম’আর নামায জামা’আতের সহিত পড়া ফরয করিয়াছেন। ইহাতে বেশী সংখ্যক লোক বাধ্যতামূলকভাবে শরীক হয় বলিয়াই এই নামাযকে সালাতুল জুম’আত বা জুম’আর নামায বলা হয় অর্থাৎ ইহা সেই নামায, যাহা কেবলমাত্র জাম’আতের সহিতই আদায় করিতে হয়- জামা’আত ছাড়া আদায় করা যায় না।
আল্লাহ তা’আলা এই জুম’আর নামায সমস্ত মুসলমানদের উপর ফরয করিয়া দিয়াছেন। অবশ্য চারি ধরনের লোকের পক্ষে ইহাতে রীতিমত উপস্থিত হওয়া অসুবিধাজনক বলিয়া তাহাদের উপর ইহা ফরয করা হয় নাই। ক্রীতদাসের পক্ষে মালিক মুনিরের অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়া-আসা করা সম্ভব হয় না। নিজ গৃহে বা জেলখানায় বন্দী লোকদের সম্পর্কেও এই কথা প্রযোজ্য। নারীদের পক্ষে বেশী সময়ের জন্য নিজেদের বাড়ী ও সন্তান-সন্তুতি ছাড়িয়া জুম’আর মসিজিদে উপস্থিত থাকা বড়ই কষ্টকর হইয়া পড়ে। শিশুদের উপর তো শরীয়াতের কোন বিধি-নিষেধই আরোপিত হয় না। আর রুগ্ন ব্যক্তিদের পক্ষে নিজেদের বাড়ী হইতে দূরে মসজিদে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। ইসলাম যেহেতু মানুষের কল্যাণ সাধন ও রহমতের জন্য আসিয়াছে, দুঃসহ ও দুঃসাধ্য কাজের দায়িত্ব চাপাইয়া দিয়া মানুষকে কষ্ট দিতে বা অসুবিধায় নিক্ষেপ করিতে আসে নাই। এই কারণে উহার কোন বিধানই এমন হইতে পারে না, যাহাতে মানুষ বাস্তবিকই কোন কষ্টের সম্মুখীন হইয়া পড়িতে পরে। ইমাম খাত্তাবী লিখিয়াছেনঃ
মুসাফির ব্যক্তি আযান শুনিতে পাইলে জুম’আর নামাযে উপস্থিত হওয়া তাহার কর্তব্য।
এই হাদীস হইতে বুঝা যায় জুম’আর নামায ফরযে আইন। কোন কোন ফকীহ উহাকে ফরযে কিফায়া বলিয়াছেন বটে, কিন্তু উহার পক্ষে কোন দলীল নাই।
বস্তুত জুম’আর নামায মুসলমানদের সার্বিক কল্যাণ সাধন ও সামাজিক মেরুদন্ড দৃঢ়তরকরণের জন্য এক চিরন্তন ব্যবস্থা। সপ্তাহের একটি দিন এলাকার সমস্ত মুসলমান এক স্থানে মিলিত হইয়া যেমনি আল্লাহর ইবাদত করিবে, তেমনি দেশের, দুনিয়ার, সামাজি, রাষ্ট্রীও, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও উহার প্রেক্ষিতে বাস্তব কর্মনীতি গ্রহণ করিবে ও সকলকে তাহা জানাইয়া দিবে। সামষ্টিকভাবে কুরআন-হাদীস ও ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অধ্যয়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে এলাকার জনগণকে ইসলাম ও আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ ও সংস্কৃতিবান করিয়া তুলিবে। জুম’আর এই সাপ্তাহিক নামাযের সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ইহাই। এক কথায় বলা যায়, জুম’আর নামায ইসলামী দাওয়াতের সহিত সঙশ্লিষ্ট লোকদের একটি সাপ্তাহিক সম্মেলন বিশেষ। এই কারণে এখানে কেবল নামায পড়িতে হয় না, ইমামকে উপস্থিত জনতার সামনে ‘খুতবা’ ও পেশ করিতে হয়। ‘খুতবা’ অর্থ মান্ধাতার আমলে অবোধ ভাষায় লিখিত কোন শ্লোকবাক্য পাঠ করা নয়। ইহার সঠিক অর্থ ‘ভাষণ দান’। যদিও বর্তমানে ইহা অতীব হাস্যকর পরিস্থিতিতে পড়িয়া সাধারণ গণ-মানুষের জন্য একেবারে নিরর্থক হইয়া গিয়াছে এবং জনগণের কোন কল্যাণই সাধন করিতে পারিতেছে না। এই অবস্থার পরিবর্তন একান্তই আবশ্যক।
***************************************
হযরত আবূ জায়াদ যামরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে. তিনি বলিয়াছেন হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি পরপর তিনটি জুম’আ বিনা ওযরে ও উপেক্ষাবসত ছাড়িয়া দিবে-পড়িবে না, আল্লাহ্ তা’আলা তাহার দিলে মোহর লাগাইয়া দিবেন।
-আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মালিক
ব্যখ্যা হাদিসটি হইতে জুম’আর নামাডযের গুরুত্ব প্রমাণিত হয় এবং বিনা ঠেকায় জুম’আর নামায না পড়া যে অতিবড় অপরাধ তাহাপ স্পষ্ট হইয়া উঠে। পরপর তিনটি জুম’আ পরিহার করা এবং বিনা কারণে (স) এর কথা হইতে জানা যায়, এই অপরাধের পরিণামে তাহার দিলের উপর আল্লাহ্ তা’আলা মোহর লাগাইয়া দিবেন।
হাদীসের শব্দ ************ অর্থ **************** ‘বিনা ওযরে বিনা কারণে পরিহার করা’। আর মোহগর করার অর্থঃ
তাহার দিলটা মুনাফিক হইয়া যাইবে। অর্থাৎ উহার দ্বার রুদ্ধ হইয়া যাইবে,উহা অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া যাইবে। উহার সব কোমলতা বিলুপ্ত হইবে। ফলে কোন কল্যাণই উহা হইতে নিঃসৃত হইবে না। মুর্খতা, বর্বরতা হিংসা-দ্বেশ ও নির্মমতা উহাতে পূঞ্জীভূত হইয়া উঠিবে। যে লোক কোনরূপ ওযর বা কারণ ব্যতীতই জুম’আর নামায পরিত্যাগ করে, সে যে উহার গুরুত্ব স্বীকার করে না বরং উহার প্রতি উপেক্ষা পোষণ করে অথবা এমন চরম এক গাফিলতিতে তাহাকে পাইয়া বসিয়াছে যে, সে জুম’আর ন্যায় এতবড় গুরুত্বপূর্ন নামাযেও যাইতে প্রস্তুত ও তৎপর হয় না, তাহ স্পষ্ট। আলোচ্য হাদীসটি অত্যন্ত মূল্যবান। ইহা বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে। এখানে কয়েকটি বর্ণনা উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ
ইমাম মালিক এই হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন এই ভাষায়ঃ
***********************************************************************
যে লোকের তিনবার বিনা ওযরে ও বিনা কারণে জুম’আর নামায পরিহার করিবে আল্লাহ্ তাহার দিলের উপর মোহার করিয়া দিবেন।
ইবনে আবদুল বার হযরত কাতাদাহ হইতে এই বর্ণনাটি উদ্ধৃত করিয়াছেন এই ভাষায়।
যে লোক জুম’আর নামায তিনবার তরক করিল বিনা প্রয়োজনে-
**************************************************************************
হযরত ইবনে আব্বাস- এর বর্ণনার ভাষা হইলঃ
**************************************************************************
যে লোকের পরপর তিনটি জুম’আ পরিত্যাগ করিবে, সে ইসলামকে পিছনের দিকে নিক্ষেপ করিয়াছে।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) যে নামায সম্পর্কে ঘোষণা করিয়াছেন যে, উহাতে যে, উপস্থিত হয় না, আমি তাহার ঘরবাড়ী জ্বালইয়া দিব, তাহা এই জুম’আর নামায।
**************************************************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তাঁহারা দুই জনই বলিয়াছেনঃ আমরা রাসূলে করীম (স)- কে তাঁহার মিস্বরে দাঁড়াইয়া বলিতে শুনিয়াছি যে, জুম’আ ত্যাগকারী লোকেরা হয় নিজেদের এই খারাপ কাজ হইতে বিরত থাকুক নতুবা আল্লাহ তা’আলা তাহাদের এই গুনাহের শাস্তিতে তাহাদের দিলের উপর মোহর করিয়া দিবেন। পরে তাহারা আত্মভোলা হইয়া যাইবে আর সংশোধন লাভের সুযোগ হইতে বঞ্চিত হইয়া যাইবে। – মুসলিম
ব্যাখ্যা এই হাদীসে জুম’আর নামায তরককারীদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর শাসন ও সাবধান বাণী উচ্চারিত হইয়াছে। অন্য কথায় ইহা নবী করীম (স)-এর পক্ষ হইতে তাহাদের জন্য চুড়ান্ত চ্যালেঞ্জ বিশেষ। ইহার সারকথা হইলঃ জুম’আর নামায কখখনই এবং কিছুতেই পরিহার করিও না। অন্যথায় তোমাদের দিলকে আল্লাহ তা’আলা মোহর করিয়া দিবেন। এই কথা বলিবার জন্য এখানে *********
শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে। ********** অর্থ শেষ করা, বন্ধ করা। মানুষ যখনবাতিল মতেও নাফরমানীর কাজে চরমে পৌঁছায়, সত্য মত ও সঠিক কাজের দিকে যখন মানুষ লক্ষ্য ও উৎসাহ হারাইয়া ফেলে, তখন পাপ ও নাফরমানীর কাজই তাহার ভালো লাগে, সে সেইদিকেই চলিতে থাকে এবং কোন বাধা-নিষেধ মানিতে রাজী হয় না। তখন বলা হয়ঃ ‘তাহার দিলের উপরে মোহর করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ‘ অর্থাৎ সৎ চিন্তা ও সৎকাজের প্রবণতা তাহার দিল হইতে নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে। এই দিক দিয়া তাহার দিলের দুয়ার বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। বস্তুত বারবার দ্বীন-ইসলাম কবুল করার দাওয়াত দেওয়ার পরও যাহারা তাহা গ্রহণ করে নাই এবং আল্লাহর অস্বীকৃতি ও আল্লাহদ্রোহিতার দিকেই দ্রুতগতিতে আগাইয়া চলিয়াছে কুরআন মজীদে তাহাদের সম্পর্কেই বলা হইয়াছেঃ
*************************
আল্লাহ তা’আলা তাহাদে দিলসমূহ তাহাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ের উপর ‘মোহর’ বসাইয়া দিয়াছেন। বস্তুত ব্যক্তির নিজের মানসিকতার দরুন এই রূপ করিয়া দেওয়াই আল্লাহ তা’আলার স্থায়ী নিয়ম। জুম’আ তরককারীদেরও এইরূপ পরিণতি অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী। ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ দিলের উপর মোহর করিয়া দেওয়ার অর্থ দিলের সব কোমলতা-দয়ার্দ্রতা ও কল্যাণের সব ভাবধারা নিঃশেষ হইয়া যাওয়া। আর ইহাই কুফরী চরিত্র। ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, যে লোক কোনরূপ কারণ ব্যতীতই নিতান্ত উপেক্ষা ও অবহেলাবশত জুম’আর নামায পরিহার করে, তাহার চরিত্র ও মানসিকতা কুফরী পর্যায় পর্যন্ত পৌছিয়া যায়।
হাদীসের বর্ণনাভংগী ও শব্দ প্রয়োগ হইতে স্পষ্ট হয় যে, জুম’আর নামায ‘ফরয আইন’- প্রত্যেক ব্যক্তির উপর প্রত্যক্ষভাবে ফরয। আল্লামা কুরতুবী লিখিয়াছেনঃ
******************
জুম’আর নামায ওয়াজিব ও ফরয, এই হাদীসটি তাহার সুস্পষ্ট দলিল।
দ্বিতীয়ত নবী করীম (স) মিম্বরের কঠোর উপর দাঁড়াইয়া এই কথা বলিয়াছেন, এইরূপ উল্লেখ করায় এই কথাও স্পষ্ট হয় যে, মিম্বরের উপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া জুম’আর খুতবা দেওয়া অতীব উত্তম। রাসূলে করীম (স) এর ইহাই নিয়ম ছিল। অতএব সুন্নাত এই ব্যাপারে কোন দ্বিমত নাই।
*******************************
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যে লোকের ঈমান আছে, জুম’আর দিন জুম’আর নামায পড়া তাহারই কর্তব্য। তবে রুগ্ন পথিক কিংবা স্ত্রীলোক, বালক কিংবা ক্রীতদাস এই কর্তব্য হইতে মুক্ত। অতএব যে লোক খেলা-তামাসা কিংবা ব্যবসায় সংক্রান্ত ব্যস্ততায় মশগুল হইয়া এই নামাযে অনুপস্থিত থাকিবে, আল্লাহ তা’আলা তাহার দিক হইতে বিমুখ হইয়া যাইবেন। আর আল্লাহ তা’আলা বস্তুতই পরমুখাপেক্ষীহীন এবং পূর্ণ মাত্রায় স্বতঃইপ্রশংসিত। – দারে কুতনী
ব্যাখ্যা হাদীসে উল্লেখিত পাঁচ ধরনের লোক ছাড়া আর সব মুসলমানের উপরই যে জুম’আর নামায ফরয তাহাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ নাই। এই পর্যায়ে এই হাদীসটিতে অত্যন্ত কঠোর বাণী উচ্চারিত হইয়াছে। আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার মাত্রেরই জুম’আর নামায পড়া কর্তব্য। যে লোক জুম’আর নামাযে যায় না, নামাযের সময় আনন্দ-ফূর্তি ও খেলা-তামাসায় কিংবা ব্যবসায় বাণিজ্যের কাজে ব্যস্ত হইয়া থাকে, সে প্রকারন্তরে এই মনোভাব ও মানসিকতাইরই প্রকাশ ঘটায় যে, সে আল্লাহর বা আল্লাহর কোন নির্দেশের পরোয়া করে না। আর যাহারই এইরূপ মানসিকতা সে যে কত বড় পাষণ্ড, কত বড় আল্লাহদ্রোহী তাহা বলার অবকাশ রাখে না। এইরূপ ব্যক্তির পক্ষে হিদায়তের পথে ফিরিয়া আসা সুদূর পরাহত ব্যাপার। কাজেই আল্লাহ তা’আলাও এই ব্যক্তি দিক হইতে তাঁহার রহমতের দৃষ্টি ফিরাইয়া নিবেন। তিনি এই লোকটির প্রতি বিন্দুমাত্র মুখাপেক্ষি নন। এই ব্যক্তির নামায পড়ার কোন প্রয়োজনই আল্লাহর নাই। এই লোকটির জুম’আর নামায না পড়িলে আল্লাহর একবিন্দু ক্ষতি নাই। তিনি তো স্বতঃই মুখাপেক্ষীহীন। কাহারও নামায পড়া তো দূরের কথা- কোন কিছুর প্রতি আল্লাহর একবিন্দু মুখাপেক্ষিতা নাই। তিনি স্বতঃ প্রশংসিত।
জুম’আর দিনের ফযীলত
*************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ সূর্যোদয় হওয়ার সবগুলি দিনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হইল জুম’আর দিন। এই জুম’আর দিনেই আদম (আ) কে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করিয়াছেন, এই জুম’আর দিনেই তাঁহাকে জান্নাতে দাখিল করা হইয়াছে এবং এই জুম’আর দিনেই তাঁহাকে জান্নাত হইতে বাহির করিয়া এই দুনিয়ায় পাঠানো হইয়াছে (যেখানে তাঁহার হইতে মানব বংশের ধারা সূচিত হইয়াছে) এবং কিয়ামতও এই জুম’আর দিনেই অনুষ্ঠিত হইবে। – মুসলিম
ব্যাখ্যা হাদীসটিতে জুম’আর দিনের ফযীলতের একটি দিক তুলিয়া ধরা হইয়াছে। তাহা এই যে, এই দিনে মানব ইতিহাসে কতগুলি বড় বড় ঘটনা অতীতে সংঘটিত হইয়াছে এবং ভবিষ্যতেও হইবে। মনে রাখা কর্তব্য যে, হাদীসে যে সব বড় বড় ঘটনার উল্লেখ করা হইয়াছে তাহা জুম’আর দিনের ফযীলত বর্ণনার উদ্দেশ্যে বলা হয় নাই। কেননা আদমকে বেহেশত হইতে বহিস্কৃত করা ও কিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়াই ফযীলতের ব্যাপার নহে। এই সবের উল্লেখ করা হইয়াছে এই দৃষ্টিতে যে, এই সব বড় বড় ঘটনা জুম’আর দিনে ঘটিয়াছে বা ঘটিবে। আর তাহাও এইজন্য যে, মানুষ আল্লাহর রহমত লাভের এবং তাহার আযাব হইতে রক্ষা পাইবার উদ্দেশ্যে এই দিনটিতে খুব বেশি বেশি নেক আমল করিবে। ইহা মনীষী কাযী ইয়াযের ব্যাখ্যা। কিন্তু আবূ বকর ইবনুল আরাবী তাঁহার তিরমিযী’র ব্যাখ্যা ‘আল আহওয়াযী’ গ্রন্থে লিখিয়াছেনঃ এই সব কয়টিই ফযীলতের ব্যাপার, সন্দেহ নাই। আর আদমের জান্নাত হইতে বাহির হওয়াই দুনিয়ার মানব বংশের এই বিরাট সয়লাব প্রবাহিত হওয়ার মূল কারণ। ইহার ফলেই দুনিয়ায় নবী-রাসূল, সালেহ ও অলী লোকদের অস্তিত্ব সম্ভবপর হইয়াছে। আদম যদি দুনিয়ায়ই না আসিতেন, তাহা হইলে এই সবের কিছুই হইতে পারিত না। আর আদমকে জান্নাত হইতে বিতাড়িত করা হয় নাই; বরং তাঁহার বৈষয়িক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে তাঁহাকে দুনিয়ায় পাঠানো হইয়াছিল এবং তাহাও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। পরে আবার তাঁহাকে জান্নাতে পৌঁছানো হইবে।
কিয়ামতও জুম’আর দিনে হইবে। ইবনে আরাবীর মতে ইহাও এই দিনটির ফযীলতের ব্যাপার। কেননা দুনিয়ায় নেক আমলকারীদের পরকালীন পুরস্কার লাভের একমাত্র উপায় হইল কিয়ামত সংঘটিত হওয়া। কিয়ামত না হওয়া পর্যন্ত তাহারা তাহাদের নেক আমলের প্রকৃত প্রতিফল কিছুই পাইবে না। কাজেই ইহাও এই দিনের এক মহা মঙ্গল ও কল্যাণময় দিক যে, এই দিনই কিয়ামত হইবে এবঙ এই দিনই আল্লাহর নবী-রাসুল, অলী-শহীদ ও অন্যান্য নেক আমলকারীদিগকে তাহাদের প্রাপ্য মর্যাদা সম্মান ও সওয়াব দেওয়া হইবে। ইমাম নববী এই দিকে লক্ষ্য করিয়াই লিখিয়াছেনঃ
*************************
এই হাদীসটি জুম’আর দিনের ফযীলত এবং অপরাপর সব দিনের তুলনায় ইহার উচ্চ মর্যাদা হওয়ার অকাট্য দলীল।
কিন্তু প্রশ্ন হইল, জুম’আর দিনটির নাম ********** ‘জুম’আর দিন’ নির্দিষ্ট করা হইয়াছে কেন? এই পর্যায়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত একটি হাদীসের উল্লেখ করা হইয়াছেঃ তিনি বলিয়াছেনঃ
*************************
কেননা আল্লাহ তা’আলা এই দিনে আদম (আ) সৃষ্টিকে একত্রিত করিয়াছেন।
অর্থাৎ ইহা মানুষের আদি পিতার একত্রিত হওয়ার দিন। ‘জুম’আ শব্দের অর্থ একত্রিত হওয়া, দলবদ্ধ হওয়া। একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
************ এই দিন তোমাদের পিতা (আদম) একত্রিত হইয়াছেন। এইদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হইবে বলিয়া ইহার অপর এক নাম ******* কিয়ামতের দিন।
জাহিলিয়াতের যুগে এই দিনটির নাম ছিল ******** আল-আরুবা। এই দিনের ‘জুম’আর দিন’ নামকরণ ইসলামের অবদান। মদীনায় উপস্থিত হওয়ার পর মুসলমানরাই এই নাম দিয়াছেন।
*************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছেনঃ আমরা সর্বশেষ, আর কিয়ামতের দিন সর্বাগ্রবর্তী। পার্থক্য শুধু এই যে, অন্যান্যকে কিতাব দেওয়া হইয়াছে আমাদের পূর্বে। পরে এই দিনের সম্মান করা তাহাদের জন্য ফরয করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু তাহারা এই বিষয়ে পরস্পর মতবিরোধে লিপ্ত হয়। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা আমাদিগকে পথ দেখাইলেন। অতএব এই ব্যাপারে অন্যান্য লোকেরা অনুগমনকারী। ইয়াহুদীদের দিন আগামীকাল এবং খৃষ্টানদের দিন আগামীকল্যের পরের দিন-পরশু। – বুখারী, নাসায়ী
ব্যাখ্যা এই হাদীসে জুম’আর দিনের সম্মান ও জুম’আর নামায ফরয হওয়ার কথা ঘোষিত হইয়াছে। ‘আমরা সর্বশেষ আর কিয়ামতের দিন সর্বাগ্রবর্তী’ এই কথার অর্থ, কালের হিসাবে আমরা হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাহার উম্মত সর্বশেষে দুনিয়ায় আসিয়াছি; কিন্তু কিয়ামতের দিন আমরাই সর্বাগ্রবর্তী হইব, সর্বপ্রথম আমরাই আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হইব। অথবা ইহার অর্থঃ কালের হিসাবে আমরা সর্বশেষে আসিলেও মর্যাদার দিক দিয়া অন্যান্য সকলের তুলনায় আমরাই সর্বাগ্রবর্তী। দ্বিতীয়, এই হিসাবেও আমরা সর্বশেষের যে, আমাদিগকে আল্লাহর কিতাব অন্যান্য সকলের শেষে দেওয়া হইয়াছে, অন্যদিগকে দেওয়া হইয়াছে আমাদের পূর্বে। আর আমরা সর্বাগ্রবর্তী এই কারণেও যে, এই জুম’আর দিনের জন্য আল্লাহ তা’আলা আমাদিগকে হিদায়ত দিয়াছেন, ফলে আমরাই এই দিনটিকে বিশেষ ইবাদতের জন্য নির্দিষ্টভাবে গ্রহণ করিয়াছি সকলের আগে। আর জান্নাতে সর্বপ্রথম ও সকলের অগ্রভাবে আমরাই প্রবেশ করিব।
আমাদের মুসলমানদের অন্যান্যের তুলনায় অগ্রবর্তী হওয়ার সর্বাপেক্ষ বড় প্রমাণ হইল সপ্তাহের দিনগুলির মধ্যে যে দিন কয়টি সারা দুনিয়ায় জাতীয় সাপ্তাহিক ইবাদতের দিন হিসাবে নির্দিষ্ট, তন্মধ্যে আমাদের জাতীয় দিনটি অন্যান্যদের জাতীয় দিনের আগে আসে। আমাদের দিন শুক্রবার, ইয়াহুদীদের দিন শনিবার ও খৃষ্টানদের দিন রবিবার।
এই দিনটি অর্থাৎ শুক্রবারের দিনটি অন্যান্যদের প্রতি ফরয করা হইয়াছিল অর্থাৎ এই দিনে শরীয়াত পালনের জন্য তাহাদের নিকট প্রস্তাব হিসাবে উপস্থাপিত করা হইয়াছিল; কিন্তু তাহারা পারস্পরিক মতবিরোধের কারণে এই দিনটিকে গ্রহণ করিতে পারেন নাই। তাহাদের মধ্যে মতবিরোধ হইয়াছিল এই বিষয়ে যে, আল্লাহ তা’আলা এই দিনটিকে তাহাদের জন্য অকাট্যভাবে নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, না উহার পরিবর্থে অন্য কোন দিন গ্রহণ করার সুযোগ আছে। এই বিষয়ে তাহারা ইজতিহাদ করিতে গিয়া ভুল করিয়াছে। এই দিনকে তাহারা গ্রহণ করে নাই (নববী)। তাহারা উহার পরিবর্তে শনিবার ও রবিবার গ্রহণ করিয়াছে। ইবনে আবূ হাতিম বর্ণনা করিয়াছেনঃ
******************************
আল্লাহ তা’আলা ইয়াহুদীদের প্রতি জুম’আর দিনটি ফরয করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহারা উহা গ্রহণ করিতে অস্বীকার করে। তাহারা বলে, হে মূসা। আল্লাহ তা’আলা শনিবার দিন কিছুই সৃষ্টি করেন নাই। অতএব এই দিনটিকে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করিয়া দিন। ফলে এই দিনটি তাহাদের জন্য নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইল।
অবশ্য ইহা ইয়াহুদীদের পক্ষে খুবই সম্ভব। কেননা ‘শুনিলাম; কিন্তু মানিলাম না-অমান্য করিলাম’ ইহাই তাহাদের জাতীয় চরিত্রের বিশেষ পরিচিতি।
পরে আল্লাহ তা’আলা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উম্মতকে এই দিনটির হিদায়ত দান করেন। অন্য ভাষায় বলা যায়ঃ আল্লাহ তা’আলা এই দিনটির জন্য তাহাদিগকে ও আমাদিগকে হিদায়ত দেন। কিন্তু তাহারা পথভ্রষ্ট হয় আর আমরা হিদায়ত লাভ করি।
এই কথাটির সারমর্ম হইলঃ
**************************
আমরা মর্যাদায় সকললে ছাড়াইয়া গিয়াছি। কেননা আমরা জুম’আর দিনটির হিদায়ত লাভ করিয়াছি- এই দিনটিকে ইবাদতের দিনরূপে গ্রহণ করিয়াছি, যদিও কালের হিসাবে আমরা পশ্চাদবর্তী। ইহার কারণ এই যে, তাহারা কালের হিসাবে অগ্রে আসিয়াও এ দিনটির ব্যাপারে তাহারা পথভ্রষ্ট হইয়াছে ও পিছনে থাকিয়া গিয়াছে।
********
জুম’আর নামায শহরে ও গ্রামে
*******************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স)-এর মসজিদে জুম’আর নামায আদায় করিবার পর সর্ব প্রথম জুম’আর নামায পড়া হয় বাহরাইনের জাওয়াসাই নামক স্থানে অবস্থিত আবদুল কাইস মসজিদে। – বাখারী, নাসায়ী, আবূ দাউদ।
ব্যাখ্যা রাসূলে করীম (স)-এর মসজিদ মদীনায় অবস্থিত। এই মসজিদেই সর্বপ্রথম জুম’আর নামায পড়া হয়। ইহার পর সর্বপ্রথম অন্য যে মসজিদে জুম’আর নামায পড়া হয়, তাহার নাম ‘মসজিদে আবদুল কাইস’- আব্দুল কাইসের মসজিদ। এই মসজিদটি বাহরাইন নামক দেশের ‘জাওয়াসাই’ নামক স্থানে অবস্থিত। ‘আব্দুল কাইস’ একটি গোত্রের নাম। ইহারা বাহরাইনে বাস করিত। আর বাহরাইন হইল আম্মার সাগরের নিকটবর্তী একটি স্থান। বর্তমানে ইহা একটি উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র। আবূ দাউদের উস্তাদ উসমান বর্ণনা করিয়াছেনঃ
*************************
জাওয়াসাই আব্দুল কাইস গোত্রের গ্রামসমূহের মধ্যের একটি গ্রাম।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************* ইহা বাহরাইনের গ্রামসমূহের মধ্যে একটি গ্রাম। হাদীসটির মূল কথা, আব্দুল কাইস গোত্রের ‘জাওয়াসাই’ নামক স্থানে জুম’আর নামায পড়া হইয়াছে। ‘জাওয়াসাই’কে ********* বলা হইয়াছে। আর ******** শব্দটি আমাদের ভাষানুযায়ী গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। আরবী সাহিত্যে এইরূপ ব্যবহার বিরল নয়। আবশ্যবলা যাইতে পারে, শহরকে গ্রাম বলা আভিধানিক অর্থে যথার্থ হইতে পারে, ব্যবহারিক অর্থে নয়।
‘জাওয়াসাই’ নামক স্থানে জুম’আ পড়া হইয়াছে। অতএব এই ধরনের স্থানে জুম’আর নামায পড়া জায়েয। কিন্তু প্রশ্ন হইল ‘জাওয়াসাই’কে আমাদের ব্যবহার অনুযায়ী শহর বলিব,না গ্রাম? যাঁহারা ইহাকে প্রচলিত অর্থে গ্রাম মনে করিয়াছেন, তাহারা এই হাদীসের ভিত্তিতেই বলিয়াছেন, গ্রামে জুম’আ পড়া যাইতে পারে। শুধু তাহাই নয়, সেখানেও তাহা শহরের মতই ফরয।
ইমাম শাফেয়ী (রা) এই হাদীসের ভিত্তিতেই বলিয়াছেনঃ
*********************
যে গ্রামে চল্লিশজন স্বাধীন নাগরিক স্থায়ীভাবে বসবাসকারী হইবে, তাহাতেই জুম’আর নামায কায়েম করা যাইবে।
কিন্তু আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী ‘জাওয়াসাই’কে সাধারণ অর্থে গ্রাম মানিতে প্রস্তুত নহেন। তিনি বলিয়াছেন, প্রচলিত অর্থে ইহা একটি শহর বিশেষ। কেননা সেখানে চার হাজারেরও বেশি লোক বসবাস করিত বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে আর গ্রাম তো এ রকম হয় না। অর্থাৎ গ্রামে চার হাজার লোক একত্রে কোথাও বসবাস করে না। এই কথা অনুসারে যেখানেচার হাজার লোক একত্রে বসবাস করে তাহাকে গ্রাম বলা হউক, কি শহর- সেখানেই জুম’আর নামায পড়া যাইবে।
ইমাম মালিক (র) বলিয়াছেনঃ
******************************
যে গ্রামেই জামে’ মসজিদ আছে কিংবা হাট-বাজার আছে, সেখানকার বসবাসকারী লোকদের উপর জুম’আ পড়া ওয়াজিব (বা ফরয) যাযাবরদের সংখ্যা যত বেশীই হউক না কেন, তাহাদের জন্য জুম’আ ওয়াজিব বা ফরয নয়। কেননা তাহারা তো পথিক বা পরিব্রাজকদের পর্যায়ে গণ্য।
ইমাম আবূ ইউসুফ এমন প্রত্যেক স্থানকেই ‘শহর’ ও তথায় জুম’আ ফরয বলিয়াছেনঃ
**********************
যেখানে সকল প্রকার পেশাদারী লোক থাকে, মানুষের স্বাভাবিক জীবন জীবিকার যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার ব্যবস্থা আছে এবং শাসন ও বিচার ব্যবস্থা চালু রহিয়াছে- (তাহাইশহর)।
অন্য একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছে, যে স্থানের সর্বাপেক্ষা বড় মসজিদে সেখানকার সব লোক একত্রিত হইলে সংকুলন হয় না, এমন সব স্থানে জুম’আ পড়া যাইবে। এমন সব স্থানকে ********* বিপুল জনসমাবেশের শহর মনে করা যায় এবং হযরত আলী (রা)-এর কথাঃ
**********************
‘বিপুল জনসমাবেশের শহর ব্যতিরেকে অন্য কোন স্থানে জুম’আ জায়েয নহে’- অনুযায়ী ঐসব স্থানেই জুম’আ পড়া যাইতে পারে। *****
কাজেই জুম’আ হয় না- এমন স্থান বর্তমান যুগে আমাদের এতদাঞ্চলে কোথাও আছে কি?
হযরত উমর (রা) বাহরাইনবাসীদের প্রতি লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেনঃ
***********
তোমরা যেখানেই অবস্থান কর না কেন, সেখানেই জুম’আ কায়েম কর। হযরত উমরের এই কথায় শহর ও গ্রামে কোনই পার্থক্য নাই। (ইবনে আবূ শায়বা) লাইস ইবনে সা’য়াদ বলিয়াছেনঃ ‘শহর ও গ্রাম যেখানেই জামা’আত হয় সেখানেই জুম’আর নামায পড়। কেননা হযরত উমর (রা) ও উসমান (রা)-এর সময় তাহাদের আদেশে সব শহর ও উপকূলবর্তী লোকেরাই জুম’আর নামায পড়িত। ******
জুম’আর আযান
**************************
সায়িদ ইবনে ইয়াযীদ হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স), হযরত আবূ বকর ও উমর (রা)-এর সময়ে জুম’আর দিনের ঘোষণা বা ডাক প্রথম দেওয়া হইত তখন, যখন ইমাম মিম্বরের উপর বসিত। পরে হযরত উসমানের আমলে যখন লোকসংখ্যা বিপুল হইয়া গেল, তখন তিনি তৃতীয় ঘোষণা যাওয়া’র উপর দেওয়ার প্রচলন বৃদ্ধি করিলেন।- বুখারী, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী
ব্যাখ্যা হাদীসে ****** শব্দ বলা হইয়াছে। ইহার অর্থঃ ডাক বা ঘোষণা । কিন্তু এই শব্দ বলিয়া বুঝানো হইয়াছে ‘আযান’। কুরআন মজীদেও এই আযানকে ‘নিদা’ বলা হইয়াছে।
*******************
জুমা’আর দিনের নামাযের জন্য যখন ঘোষণা বা আযান দেওয়া হইবে।
এই হাদীসে জুম’ার দিনের মোট তিনটি আযানের কথা বলা হইয়াছে। তন্মধ্যে প্রথমটি দেওয়া হইত ইমাম যখন মিম্বরের উপর উঠিয়া বসিত, তখন। আর দ্বিতীয় আযান কোনটি? তাহার উল্লেখ ইহাতে করা হয় নাই। তবে তাহা যে, ‘ইকামত’ এবং ‘ইকামত’কেও একটি আযান বা ঘোষণা বলা হইয়াছে তাহা সুস্পষ্ট। ইবনে আযীযি’র বর্ণনায় একথা পরিস্কার ভাষায় বলা হইয়াছেঃ
*********************
রাসূলে করীম (স) এবং আবূ বকর ও উমর (রা)-এর যুগে জুম’আর দিনের আযান ছিল দুইটি।
ইহার প্রথমটি ইমাম মিম্বরের উপর বসিলে দেওয়া হইত। আর দ্বিতীয়টি হইল নামাযের ইকামত। ইমাম যুহরীর বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
*********************
নবী করীম (স) যখন মিম্বরের উপর বসিতেন, তখন হযরত বিলাল (রা) আযানদিতেন। আর তিনি যখন মিম্বরের উপর হইতে নামিতেন তখন তিনি ইকামত বলিতেন। পরে হযরত আবূ বকর ও উমর (রা)- এর সময়েও এই নিয়মই চলিয়াছে।
আবূ দাউদের বর্ণনার বলা হইয়াছেঃ
**********************
হযরত বিলাল (রা) রাসূলে করীম (স) এবং হযরত আবূ বরক ও উমর (রা)-এর সামনে মসজিদের দরজায় দাঁড়াইয়া আযান দিতেন।
আবদ ইবনে হুমাইদ তাঁহার তফসীরে লিখিয়াছেনঃ
****************************
রাসূলে করীম (স), আবূ বকর, উমর ও উসমানের খিলাফতের এক বছর কাল পর্যন্ত এই নিয়মই চলিয়াছে। কিন্তু পরে যখন লোকদের ঘরবাড়ী দূরে দূরে হইতে লাগিল ও লোকসংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পাইয়া গেল, তখন হযরত উসমান তৃতীয় ঘোষণার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সেই জন্য কেহই তাঁহার দোষ ধরিল না।
ইবনে আবূ যি’র এর বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
*************************
পরে হযরত উসমান (রা) প্রথম আযান ‘যাওরা’র উপর দেওয়ার ব্যবস্থা প্রবর্তন করিলেন।
ইহার সারকথা হইল, রাসূলে করীম (স)-এর সময় হইতে হযরত উসমানের খিলাফতের প্রথম এক বৎসরকাল পর্যন্ত মসজিদের ভিতরে ইমাম মিম্বরে উঠিলে পর আযান এবং নামাযের ইকামত দেওয়ার রীতিই প্রচলিত ছিল। বর্তমানে সর্বপ্রথম যে আযান দেওয়া হয়, তাহা সেই কালে চালু ছিল না। হযরত উসমান (রা)-ই প্রয়োজনের বশবর্তী হইয়া সর্বপ্রথম উহা চালু করেন।
কিন্তু এই সব বর্ণনাকে ছাপাইয়া উঠিয়াছে অপর একটি বর্ণনা। তাহাতে বলা হইয়াছে, হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতকালেই এই প্রথম আযানটি চালু হইয়াছে। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
**************************
জুম’আর দিনের প্রথম আযান আমরাই সর্ব প্রথম প্রবর্তন করিয়াছি মুসলমানদের সংখ্যা খুব বেশী হওয়ার কারণে। ইহাও রাসূলে করীম (স)- এর প্রচলিত সুন্নাতের পর্যায়ে গণ্য।
মোটকথা, জুম’আর দিনের প্রথম আযান যাহা মসজিদের বাহিরে দাঁড়াইয়া দেওয়া হয়-পূর্বে ইহার রেওয়াজ ছিল না। হযরত উমরের যামানায় মুসলমানদের সংখ্যা বেশী হইয়া পড়ার কারণে তিনি সর্বপ্রথম ইহার প্রবর্তন করেন। আর ইহাও রাসূলে করীম (স)-এর প্রবর্তিত সুন্নাতের মতই অনুসরণীয়। আলোচ্য হাদীসে ইহাকে ********* ‘তৃতীয় ঘোষণা’ বলা হইয়াছে যদিও ইহা দেওয়া হয় সর্বপ্রথম। কিন্তু চালু করার ক্রমিকতার হিসাবে ইহা তৃতীয়। পূর্বে দুইটি আযান ছিল, পরে প্রবর্তিত হইয়াছে এই তৃতীয়টি। কিন্তু ঘোষণা দেওয়ার বর্তমান ক্রমিকতার দিক দিয়া ইহা প্রথম।
*********
আলোচ্য হাদীস অনুযায়ী এই তৃতীয় প্রবর্তিত আযানটি যাওয়া’র উপর দেওয়া হইত। যাওর হইলঃ
************** মসজিদের দ্বারদেশে রক্ষিত বিরাট পাথর।
আর ইবনে মাজাহর বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
*************** ইহা বাজারের একটি ঘর, যাহাকে ‘যাওরা’ বলা হইত।
তাবারানীর বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
*********************
প্রথম আযানটি এমন একটি ঘরের উপর দাঁড়াইয়া দিবার নির্দেশ দিলেন যাহার নাম ‘যাওরা’। অতঃপর ইহার উপরই এই আযান দেওয়া হইত।
অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
*******************
পরে এই আযান যাওরা’য় দিলেন ইমামের বাহির হইয়া আসার পূর্বে, যেন লোকদিকে জানাইয়া দেওয়া যায় যে, জুম’আর নামাযের সময় সুমপস্থিত। *******
আর যাওরা নামক ঘরের উপর আযান দেওয়া হইত এইজন্য যেঃ
*********************
মদীনায় মসজিদের নিকটে ইহা অতীব উচ্চ ঘর ছিল। কিংবা ইহা ছিল একটি মিনারা।
******************
জুম’আর দিন সর্বপ্রথম মসজিদের বাহিরে যে আযান দেওয়া হয়, উহা নবী করীম (স)-এর যামানায় প্রচলিত ছিল না। হযরত উমর (রা) ইবনে হাজার আসকালানী লিখিয়াছেনঃ হযরত উমর (রা) এই আযান প্রবর্তিত করিয়াছেন- এই বর্ণনা দুর্বল সনদের কারণেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা উহা মকহুল মুআয হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। আর মকহুল মুআযের সাক্ষাৎ পান নাই। ******* কিংবা হযরত উসমান (রা)-ই ইহা প্রথম চালু করেন। এই কারণে অনেকে ইহাকে ‘বিদআত’ বলিতে চাহিয়াছেন। কিন্তু মূলত ইহা মোটেই ‘বিদআত’ নয়। কেননা একে তো আযান দেওয়ার রেওয়াজ রাসূলে করীমের জীবদ্দশায় তাঁহারই কর্তৃক প্রবর্তিত হইয়াছিল এবং যে উদ্দেশ্যে সেই ‘আযান’ প্রবর্তিত হইয়াছিল সেই উদ্দেশ্য তখন পূর্ণ হইত সেই আযান দ্বারা যাহা ইমামের মিম্বরের উপর বসার পর দেওয়া হইত। কেননা তখন লোকসংখ্যা অনেক কম ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে লোকসংখ্যা বেশী হইয়া যাওয়া ও লোকদের বসতি অনেক দূরে দূরে অবস্থিত হওয়ায় ইমামের সম্মুখে দেওয়া আযান দ্বারা সেই উদ্দেশ্য সফল হইতে পারিতেছিল না। তখন মসজিদের বাহিরে দাঁড়াইয়া অধিক উচ্চ ও বলিষ্ট কণ্ঠে একটা আযান বা ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। আর এই আযানের প্রবর্তন করায় সেই সময়ে উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে কেহই ইহার বিরুদ্ধে কোনরূপ আপত্তি জানান নাই। ফলে স্পষ্ট বোঝা গেল যে, এই আযানের বৈধতা সম্পর্কে সাহাবীদের ‘ইজমা’- ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। কাজেই ইহাকে বিদআত বলার কোন কারণ নাই।
এতদ্ব্যতীত কুরআন মজীদের যে আয়াতে জুম’আর নামায ফরয হইয়াছে, তাহাতেও এই প্রথম আযানের কথাই- যাহা মসজিদের বাহিরে দেওয়া হয়- বলা হইয়াছে। আয়াতটি হইলঃ
******************
জুম’আর দিনে নামাযের জন্য যখন ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর যিকরের দিকে প্রস্তুত হইয়া যাও এবং ক্রয়-বিক্রয় ছাড়িয়া দাও।
এই ঘোষণাই হইল সেই আযান, যাহা মসজিদের বাহিরে দেওয়া হয়। হানাফী ফিকাহতে বলা হইয়াছেঃ
**********************
কুরআনের এই আয়াত অনুযায়ী প্রথম আযান শোনা মাত্রই ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কেনা-বেচা পরিহারও নামাযের জন্য দৌড়ানো ওয়াজিব। এই প্রথম আযানই কুরআনের বলা ঘোষণার বাস্তব রূপ। এই কারণে যে প্রকৃত প্রথম জানান তো এই আযান দ্বারাই সম্পন্ন হইয়া থাকে। হানাফী মাযহাবের আলিমদের ইহাই মত। *************
জুম’আর সুন্নাত নামায
******************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ তোমাদের কেহ যদি জুম’আ পড়ে, তবে সে যেন উহার পর আরও চার রাক’আত পড়ে। – মুসলিম, তিরমিযী
ব্যাখ্যা এই হাদীসে জুম’আর নামাযের পরে আনুসঙ্গিক সুন্নাত নামায সম্পর্কে বলা হইয়াছে। এই পর্যায়ে বহুসূত্রে বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। উপরোদ্ধৃত হাদীসে চার রাক’আত বা’দাল -জুম’আ-জুম’আ-পরবর্তী চার রাক’আত সুন্নাত- পড়ার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে এবং সেই জন্য উৎসহা দান করা হইয়াছে। অবশ্য একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
***************
নবী করীম (স) জুম’আর নামাযের পর দুই রাক’আত (সুন্নাত) পড়িতেন।
অনেকে এই হাদীসটির ভিত্তিতে জুম’আ পরবর্তী সুন্নাত দুই রাক’আত বলিয়াছেন। কিন্তু ইহা রাসূলে করীম (স)-এর নিজের আমল। তিনি সাধারণ মুসলমানকে চার রাক’আতই পড়িতে বলিয়াছেন। এই পর্যায়ের হাদীসগুলির ভাষা হইলঃ
*******************
তোমাদের মধ্যে যে লোক জুম’আর পরে নামাযী হইবে- নামায পড়িবে, সে যেন চার রাক’আত পড়ে।
এই হাদীসটির বর্ণনাকারী ও হযরত উবূ হুরায়রার (রা) অপর একটি হাদীসে সরাসরি আদেশের ভঙ্গীতে বলা হইয়াছেঃ
*****************
তোমরা যখন জুম’আর ফরযের পর নামায পড়িবে, তখন তোমরা চার রাক’আত পড়িবে।
তিরমিযী শরীফে প্রথমোক্ত হাদীসটির উদ্ধৃতির পর বলা হইয়াছেঃ
*****************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতেবর্ণিত হইয়াছে, তিনি জুম’আর (ফরযের) পূর্বে চার রাক’আত এবং পরে চার রাক’আত (সুন্নাত) পড়িতেন।
ইহা হইতে হযরত ইবনে মাসউদ (রা)- এর নিজের আমল জানা গেল।
ইবনুল হাজার আল আসকালনী অবশ্য এই হাদীসটির সনদের দুর্বল ও পরস্পর ছিন্ন হওয়ার কথা উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু ইহার সমর্থনে আরও বহু হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ
**********************
নবী করীম (স) জুম’আর (ফরয নামাযের) পূর্বে চার রাক’আত পড়িতেন এবং এই চার রাক’আতের মধ্যে কোন জিনিস (সালাম) দ্বারা ব্যবধান করিতেন। না
অর্থাৎ একসঙ্গে ও একই সালামে চার রাক’আত পড়িতেন। দুই রাক’আত করিয়া চার রাক’আত নয়। এই পর্যায়ে হযরত উবূ হুরায়রা (রা) হইতে অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
******************
নবী করীম (স) নিজে জুম’আর (ফরযের) পূর্বে দুই রাক’আত ও উহার পরে দুই রাক’আত নামায পড়িতেন।
হযরত জাবির ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা) একই ভাষায় বলিয়াছেন, মুলাইকুল গাতফানী নাকম এক সাহাবী মসজিদে প্রবেশ করিলেন। নবী করীম (স) তখন খুতবা দিতেছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া তিনি বলিলেনঃ
**************
এখানে আসার পূর্বে তুমি দুই রাক’আত নামায পড়িয়াছ কি?
জবাবে তিনি বলিলেন না। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
********** তাহা হইলে তুমি দুই রাক’আত নামায পড়িয়া লও। এই সব উদ্ধৃতি হইতে বুঝা যায়, জুম’আর পূর্বে ও পরে সুন্নাত নামায পড়ার ব্যবস্থা স্বয়ং নবী করীম (স)-ই করিয়া দিয়াছেন। তিনি নিজেও ইহা পড়িতেন এবং সকলকে পড়িতে বলিতেন। অবশ্য তিনি কত রাক’আত পড়িতেন এবং আমাদেরই বা কত রাক’আত পড়িতে হইবে সেই বিষয়ে বিভিন্ন রাক’আতের উল্লেখ হওয়ায় বিশেষ মতভেদ সৃষ্টি হইয়াছে। ইমাম শাফেয়ীর ‘কিতাবুল উম’ হইতে জানা যায়, তিনি বা’দ জুম’আ চার রাক’আত পড়িতেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলিয়াছেনঃ
********************
ইচ্ছা হইলে বা’দ জুম’আ দুই রাক’আতও পড়িতে পারে, আর ইচ্ছা হইলে চার রাক’আতও পড়া যাইতে পারে।
অপর একটি বর্ণনায় তিনি ছয় রাক’আতের কথা বলিয়াছেন। কিন্তু ইহা খোদ নবী করীম (স) হইতে কোন সূত্রেই প্রমাণিত নয়। আর ইমাম আবূ হানীফা (র) এর মতে জুম’আর পূর্বেও চার রাক’আত এবং পরেও চার রাক’আত সুন্নাত পড়িতে হয়। তবে জুম’আর ফরযের পরবর্তী চার রাক’আত অকাট্য হাদীসের প্রমাণিত।
জুম’আর খুতবা
**********************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ হযরত নবী করীম (স) মিম্বরের উপর দাঁড়াইয়া ভাষণ দিতেন। পরে বসিতেন এবং তাহার পর উঠিয়া দাঁড়াইতেন- যেমন তোমরা আজকাল করিতেছ।
– বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী
ব্যাখ্যা এই হাদীস হইতে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, জুম’আর নামাযের পূর্বে মিম্বরের উপর দাঁড়াইয়া ইমামকে নামাযীদের সম্বোধন করিয়া ভাষণ দিতে হয়। এই ভাষণই হইল জুম’আর খুতবা। নবী করীম (স) প্রত্যেক নামাযের পূর্বে মিম্বরের উপর দাঁড়াইয়া এই খুতবা পেশ করিতেন।
হাদীসের ভাষায় স্পষ্ট উল্লেখ হইয়াছে যে, নবী করীম (স) প্রথমে মিম্বরের উপর উঠিয়া বসিতেন। এই সময় মুয়াযযিন আযান দিত। বর্তমানে এই আযান যদিও দ্বিতীয় আযান; কিন্তু নবী করীম (স) এর যুগে ইহাই ছিল প্রথম আযান। আযান হইয়া গেলে তিনি মিম্বরের উপর দাঁড়াইতেন ও খুতবা শুরু করিতেন। কিছুক্ষণ খুতবা দেওয়ার পর তিনি মিম্বরের উপর বসিয়া পড়িতেন ও কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করিতেন। তাহার পর আবার দাঁড়াইয়া খুতবা দিতেন। এইভাবে দুইটি খুতবা পেশ করা হইত। এই খুতবা যে জুম’আর খুতবা বুখারীর উপরোদ্ধৃত হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় তাহার উল্লেখ নাই। কিন্তু ইহাতে যে জুম’আর খুতবার কথাই বলা হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। কেননা ঠিক এই কথাটাই ইমাম আহমদ, তাবারানী ও বাযযার হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেন নিজের নিজের হাদীস গ্রন্থে এই ভাষায়ঃ
***********************************
নবী করীম (স) জুম’আর দিনে দাঁড়াইয়া খুতবা দিতেন। ইমাম যখন খুতবা দিবে তখন সে নামাযীদের দিকে মুখ করিয়া দাঁড়াইবে নামাযীগণ ইমামের দিকে মুখ করিয়া বসিবে এবং ইমামের খুতবা গভীর মনোযোগ সহকারে শুনিতে থাকিবে। ইমাম বুখারী এই পর্যায়ের হাদীসের শিরোনামা দিয়াছেনঃ
****************************
ইমাম যখন খুতবা দিবে তখন সে জনগণের দিকে সে জনগণের দিকে মুখ করিয়া দাঁড়াইবে এবং জনগণ মুখ করিয়া থাকিবে ইমামের দিকে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ
***********************************
রাসূলে করীম, (স) যখন মিম্বরের উপর সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া যাইতেন, তখন আমরা আমাদের মুখমন্ডল তাঁহার দিকে ফিরাইয়া বসিতাম।
ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম সুফিয়ান সওরী বলিয়াছেনঃ রাসূলের সাহাবিগণ খুতবা দেওয়ার সময় ইমামের দিকেমুখ ফিরাইয়া বসিতে খুবই ভালোবাসিতেন। আল্লামা বদরুদ্দীন লিখিয়াছেনঃ
***************************************
ইমামের খুতবা দানের সময় তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়া বসার মূল উদ্দেশ্যে হইল নামাযীরা তাহার উপদেশবাণী শুনিবে, তাহার কথাগুলি গভীরভাবে অনুধাবন ও চিন্তা-বিবেচনা করিবে এবং ইহা ছাড়া অন্য কোন দিকে মনোযোগ দিবে না।
খুতবার ধরন ও বিষয়বস্তু
*********************************************
হযরত জাবির ইবনে সামুরাতা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) দাঁড়াইয়া খুতবা দিতেন। দুই খুতবার মাঝখানে বসিতেন, খুতবায় কুরআনের আয়াত পাঠ করিতেন ও জনগণকে উপদেশ- নসীহত দিতেন।
– মুসলিম, আবূ দাউদ
ব্যাখ্যা এই হাদীসে খুতবা দানের আসল রূপ ও পদ্ধতি বর্ণিত হইয়াছে। উপরন্তু রাসূলে করীমের খুতবার বিষয়বস্তু কি হইত- জুম’আর ভাষণে তিনি কি বলিতেন, তাহারও উল্লেখ আছে।
খুতবার ভাষণে রাসূলে করীম (স) কুরআন মজীদের আয়াত পড়িতেন এবং জনগণকে নানা জরুরী বিষয়ে উপদেশ দিতেন। এই খুতবা দুই ভাগে বিভক্ত হইত। দুই খুতবার মাঝখানে তিনি মিম্বরের উপর কিছুক্ষণের জন্য বসিতেন।
কিন্তু সেই ভাষণ খুব দীর্ঘ হইত না। হযরত জাবির (রা) হইতে বর্ণিত অপর এক হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************
নবী করীম (স) জুম’আর দিন খুব দীর্ঘ ওয়ায করিতেন না। বরং সহজ সরল কতিপয় বাক্য ও বাণী পেশ করিয়াই ভাষণ সমাপ্ত করিতেন।
ইমাম শাওকানী এই হাদীসের ভিত্তিতে বলিয়াছেনঃ জুম’আর খুতবায় জনগণকে উপদেশ দান বিধেয় এবং উহাকে দীর্ঘায়িত করার পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত করাই উত্তম। নবী করীম (স) নিজে বলিয়াছেনঃ
**************************
অতএব তোমরা নামায দীর্ঘ কর এবং খুতবা সংক্ষিপ্ত কর। এই খুতবার শুরুতে আল্লাহর হামদ ও কালিমায়ে শাহাদাতের উল্লেখ একান্তই জরুরী। নতুবা খুতবা নিখুঁত ও সুন্দর হইতে পারে না। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস হইতে তাহা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
*******************************
রাসূলে করীম (স) যখন খুতবা দিতেন, তখন তাঁহার চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ হইত, উচ্চমার্গে পৌছিয়া যাইত এবং ক্রোধ তীব্র হইয়া উঠিত। মনে হইত তিনি যেন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদেরকে ভীতি প্রদর্শন করিতেছেন। ************
ইহা হইতে খুতবা দানের যে ধরন স্পষ্ট হইয়া উঠে তাহাই বিধেয়। মরা মানুষের মত নিস্তেজ কণ্ঠে খুতবা দেওয়ার কোন অর্থ নাই কেননা জুম’আর নামাযের এই খুতবা তিনি রাষ্ট্রপ্রধান ও সমাজপ্রধান হিসাবেই দিতেন। কাজেই তাহা নিশ্চয়ই এমন ভাষায় দেওয়া বাঞ্চনীয় যাহা শ্রোতৃবৃন্দ হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম। অন্যথায় সব কথাই মাঠে মারা যাইবে। এই খুতবা ওয়াজিব। কুরআনের দৃষ্টিতে ইহা জুম’আর নামাযেরই অংশ। কুরআনের নির্দেশঃ
****************** আল্লাহর যিকরের দিকে প্রস্তুত হইয়া যাও। ‘যিকরুল্লাহ’ বলিতে নামায ও খুতবা দুইটিই বুঝানো হইয়াছে। আল্লামা কুরতুবী লিখিয়াছেনঃ
*************************
যিকর অর্থ নামায। কাজেই খুতবা নামাযেরই অংশ।
বিতরের নামায
*****************************************
হযরত বুরায়দা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি নবী করীম (স) কে বলিতে শুনিয়াছি যে, বিতরের নামায সত্য, যে লোক বিতরের নামায পড়িবে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে ঘণ্য নহে।
– আবূ দাউদ
ব্যাখ্যা বিতর শব্দের অর্থ বেজোড়, একক। উপরিউক্ত হাদীসে নবী করীম (স) বিতরের নামায পড়ার জন্য তাকীদ করিয়াছেন ও সেইজন্য উৎসাহ প্রদান করিয়াছেন। অপর এক হাদীসে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
***************************
নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তোমাদিগকে এমন এক নামায দ্বারা শক্তিশালী করিয়াছেন, যাহা তোমাদের জন্য বহুমূল্যবান লাল বর্ণের উষ্ট্র অপেক্ষাও উত্তম। আর তাহা হইতেছে বিতরের নামায।
– তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ
আবূ দাউদ বর্ণিত অপর এক হাদীসে রাসূলের নিম্নোক্ত কথাটি উদ্ধৃত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ
*************************
তোমরা সকলে বিতরের নামায অবশ্যই পড়িবে, কেননা আল্লাহ তা’আলা ‘বিতর’ বেজোড় ও একক এবং তিনি বিতর খুব পছন্দ করেন।
প্রথমোক্ত হাদীসে ‘বিতরকে ‘হক্কুন’ ****** বলা হইয়াছে। অর্থাৎ বিতরের নামায প্রমাণিত এবং সত্য। এই নামায মুসলিম মাত্রেরই পড়া উচিত।
বিতরের নামায কখন পড়িবে উহার সময় সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস ও হাদীসের অংশ হইতে স্পষ্ট জনা যায়। আবূ দাউদ ও তিরমিযী বর্ণিত উপরে উল্লিখিত হাদীসের শেষাংশে বলা হইয়াছেঃ
***************************
আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য এই নামায এশার নামায হইতে ফজর হওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পড়ারব্যবস্থা করিয়াছেন।
বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
********************* রাত্রিবেলা বিতরকে তোমাদের শেষ নামায বানাইয়া লও। অর্থাৎ বিতরের নামায পড়ার সময় হইতেছে রাত্রে এশার নামাযের পর। এই এশার নামাযেই দিন-রাত্রের পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মধ্যে সর্বশেষ নামায এবং এই এশার পরই বিতরের নামায পড়িতে হয়।
কিন্তু বিতরের নামায পড়া কি ফরয? ওয়াজিব? সুন্নাত? এই সম্পর্কে হাদীস ও ফিকাহবিদদের বিভিন্ন মতের উল্লেখ হইয়াছ্ ইমাম খাত্তাবী আবূ দাউদ বর্ণিত একহাদীসে ‘আহলুল কুরআনদের সম্বোধন দেখিয়ে বলিয়াছেনঃ ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, বিতর ওয়াজিব নহে। কেননা ওয়াজিব হইলে সর্বসাধারণ মুসলিমকেই সম্বোধন করা হইত। আর পরিভাষায় আহলুল কুরআন’ বলিতে বুঝায় কুরআনের হাফেয, কারী ও আলিম। জনসাধারণ উহার অন্তর্ভুক্ত নহে। অপর এক হাদীসে এক বেদুঈনের প্রশ্নের জবাবে নবীকরীম (স) বলিয়াছেনঃ
*************** ইহা বিতর তোমার জন্যও নহে, আর তোমার সঙ্গী-সাথীদের জন্যও নহে।
*******************
উপরে উদ্ধৃত এক হাদীসে বিতর সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) এর ব্যবহৃত শব্দ হইতেছে ****** তায়্যিবা ও মৃল্লা আলী কারীর মতে ইহার অর্থঃ
*****************************
বিতরকে তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা আমলের মধ্যে এক অতিরিক্ত নামায বানাইয়া দিয়াছেন। তিরমিযী শরীফে একটি পরিচ্ছেদই এই অর্থে রাখা হইয়াছে। উহার শিরোনামা হইতেছে।
******************** বিতর ফরয নহে এই মর্মের হাদীসসমূহের পরিচ্ছেদ। অতঃপর হযরত আলী (রা) এর নিম্নোক্ত উক্তি উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
*********************************
বিতরের নামায ফরয নহে যেমন তোমাদের অন্যান্য ফরয নামায রহিয়াছে। বরং নবী করীম (স) ইহাকে সুন্নাতরূপে কায়েম করিয়া গিয়াছেন।
বস্তুত বিতরের নামায যে অন্যান্য ফরয নামাযের মত ফরয নহে তাহা সর্ববাদীসম্মত কথা। কোন আলিম বা কোন ইমামই উহাকে ফরয বলেন নাই। ইমাম আবূ হানীফা উহাকে ওয়াজিব বলিয়াছেন মাত্র। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত আলিমই উহাকে সুন্নাত বলিয়াছেন। আবূ হামিদ বলিয়াছেনঃ বিতর সুন্নাতেমুয়াক্কাদাহ- ফরয নহে।’ আবূ হানীফা ব্যতীত অপরাপর ইমামগণেরও এই মত। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারে বিতরের নামায সুন্নাত নহে, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ নহে, বরং ইহা ওয়াজিব। ইমাম আবূ হানীফার এই মত বিশেষ অকাট্য দলীলের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত আবূ দাউদ বর্ণিত আলোচ্য হাদীস। ইহাতে যেমন বিতরকে বলা হইয়াছে হক্কুন .*********** (প্রমাণিত- সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য) তেমনি কঠোর ভাষায় বলা হইয়াছেঃ
******************* যে লোক বিতরের নামায পড়ে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নহে।
রাসূলে এই কথাটি তিন তিনবার বলিয়াছেন। ইহা বাস্তবিকই অত্যন্ত কঠোর বাণী এবং এইরূপ কথা রাসূলে করীম (স) যে আমল সম্পর্কে বলিয়াছেন, তাহা ফরয না হইলেও ওয়াজিব অবশ্যই হইবে। কোন সুন্নাত কাজ সম্পর্কে রাসূলের এইরূপ তাকীদবাণী উচ্চারিত হয় নাই। আল-মৃগনী ও আল-মুসান্নাফ গ্রন্থে ইমাম আহমদ ও মুজাহিদ হইতে বলা হইয়াছেঃ
************* বিতরের নামায ওয়াজিব, ইহা ফরয করা হয় নাই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা), হযরত ইবনে মাসউদ (রা), ছযায়ফা (রা), ইবরাহীম নাখয়ী এবং ইমাম শাফেয়ীর উস্তাত ইউসুফ ইবনে খালিদ উহাকে ওয়াজিব বলিয়াছেন। সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব, আবূ উবায়দাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও দহহাক প্রমুখ বড় বড় ফিকাহবিদের মতও ইহাই। যাঁহারা উহাকে সুন্নাত বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলিয়াছেন, তাঁহারা প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নহনে। আর
*************************
এক ব্যক্তির অজ্ঞতা অপর ব্যক্তির জ্ঞানের অনস্তিত্ব প্রমাণ করে না।
রাসূলে করীম (স) যে হাদীসে ‘আহলুল কুরআন’ দের সম্বোধন করিয়াছেন, ইহাতে স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে ******* বিতরের নামায পড় বলিয়া। আর এই নির্দেশই উহার ওয়াজিব হওয়ার কথা প্রমাণ করে। কেননা ‘অহলুল কুরআন’ বলিতে সেই সমস্ত লোকদেরই বুঝায়; যাহাদের নিকট কুরআনের কোন অংশ মজুদ আছে। একটি আয়াত থাকিলেও সে ইহার অন্তর্ভুক্ত মনেকরিতে হইবে। দ্বিতীয় বলা হইয়াছেঃ ‘আল্লাহ বিতর তিনি বিতর ভালোবাসেন’। ইমাম তাহাভী বর্ণিত অপর এক হাদীসেও বিতরের নামাযের জন্য তাকীদকরা হইয়াছে এবং উহা সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীস। রাসূলে করীমের ব্যবহৃত শব্দ ********* হইতে ইমাম খাত্তাবী মনে করিয়াছেনঃ ইহা অতিরিক্ত নামায, ওয়াজিব নহে, দরকারী নহে। কিন্তু তাহা ঠিক নয় একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যাইবে যে, এই নামাযের ব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহ করিয়াছেন, রাসূল নিজের তরফ হইতে করেন নাই। আর যে কাজ আল্লাহর তরফ হইতে করিতে বলা হয়, তাহা অবশ্যই ওয়াজিব হইবে, নফল নহে।
অতঃপর দেখিতে হইবে বিতরের নামায কত রাক’আত। এই রাক’আতের সংখ্যা লইয়াইও ইমামগণের মধ্যে বিভিন্ন দলীলের ভিত্তিতে বিভিন্ন মত রহিয়াছে। কেননা এই পর্যায়ে হাদীসের বর্ণানাও বিভিন্ন।
ইমাম শাফেয়ীর মতে বিতরের নামায এক রাক’আত। তাঁহার দলীল হইতেছে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীস। তাহাতে নবী করীম (স)-এর রাত্রিকালীন নামাযের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ
********** কিন্তু আসলে এখানে এক রাক’আত অর্থ করাই ঠিক নহে। কেননা হযরত আয়েশারই বর্ণিত অপর এক হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছেঃ
********************
নবী করীম (স) তিন রাক’আত বিতরের নামায পড়িতেন এবং একেবারে শেষ রাক’আত পড়িয়া সালাম ফিরাইতেন।
এই হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তানযায়ী সহীহ। যদিও ইহাকে তাঁহাকে নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেন নাই। ইমাম হাকেম ইহাকে তাঁহার ‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করিয়াছেন। যাঁহারা বলিয়াছেন কোন হাদীস দশজন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হইলে তাহা ‘মুতাওয়াতির’। এই হিসাবেও এই হাদীসটি মুতাওয়াতির। কেননা হাদীসটি বারোজন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। যদিও উহার ভাষা ও সনদ বিভিন্ন এবং সে সনদে বহুযয়ীফ ও আপত্তিজনক বর্ণনাকারী রহিয়াছেন। তবু কয়েকটি বর্ণনার সনদ অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নবী করীম (স) সইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেনঃ
*********************************
দিনের বেজোর নামায হইতেছে মাগরিবের নামায, আর রাত্রের বেজোর নামায হইতেছে তিন রাক’আত বিতর।
ইমাম দারে কুতনী ও ইমাম বায়হাকী এই হাদীসকে নিজ নিজ কিতাবে উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইমাম নাসায়ী হযরত ইবনে উমরের সনদে উল্লেখ করিয়াছেনঃ
*********************************
মাগরিবের নামায দিনের বেলার নামাযের বিতর-বেজোর। অতএব তোমরা রাত্রেও বিতরের নামায পড়।
এখানে মাগরিবের নামাযের সহিত তুলনা করা হইয়াছে রাত্রের বিতরের নামাযকে। আর মাগরিবের নামায যখন সর্বসম্মতভাবে তিন রাক’আত, তখন রাত্রের বিতরের নামাযও তিন রাক’আত হইবে। হাসানুল বসরী ও ইমাম করখী বলিয়াছেনঃ
***********************************
সমস্ত মুসলমানের ইজমা এই যে, বিতরের নামায তিন রাক’আত, উহার শেষ রাক’আত পড়িয়া সালাম ফিরাইতে হইবে, তাহার পূর্বে নয়।
**************************
বিতরের নামাযে দোয়া কুনুত পাঠ
***************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স) বিতরের নামাযে রুকু দেওয়ার পূর্বে দোয়া কুনূত পড়িতেন।
– ইবনে আবূ শায়বাহ, দারে কুতনী
ব্যাখ্যা নবী করীম (স) দোয়া কুনূত কখনো কখনো নামাযে পড়িয়াছেন, ইহা অসংখ্য হাদীস হইতে প্রমাণিত। কিন্তু সে পর্যায়ে যত বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা হইতে একথা স্পষ্ট যে, বিশেষ ঘটনা দুর্ঘটনাকালে নবী করীম (স) নামাযে কুনূত পড়িয়াছেন, কুনূত পড়িয়াছেন জুহর, আসর, এশা ও মাগরিবের নামাযে। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ সহীহ হাদীসসমূহের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, এই সব নামাযে নবী করীমের কুনূত পাঠ নিতান্তই সাময়িক ছিল এবং কিছু দিন পরই তিনি উহা ত্যাগ করিয়াছেন। কিন্তু আলোচ্য হাদীসে কথা স্পষ্ট হইয়াছে যে, নবী করীম (স) বিতরের নামাযে দোয়া কুনূত স্থায়ীভাবে পাঠ করিয়াছেন। কখন কুনূত পাঠ করিয়াছেন, রুকুর পূর্বে না রুকু হইতে উঠিবার পর, এই পর্যায়েও বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত ও গ্রন্থসমূহের উদ্ধৃত হইয়াছে। বহু হাদীসে বলা হইয়াছে, রাসূলে (স) রুকু হইতে মাথা তুলিয়া দোয়া কুনূত পড়িতেন। হযরত আনাস (রা) বলিয়াছেনঃ
*****************************************
রাসূলে করীম (স) রুকু দেওয়ার পর-রুকু হইতে মাথা তুলিয়া উঠিয়াই সোজা দাঁড়াইয়া গিয়া দোয়া কুনূত পড়িতেন।
কিন্তু উপরোদ্ধৃত হাদীসে স্পষ্ট ভাষার বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বিতরের নামায শেষ রাক’আতে রুকুতে যাইবার পূর্বে দোয়া কুনূত পড়িয়াছেন। এই মর্মের হাদীস হযরত ইবনে মাসউদ ছাড়া হযরত আলী ও হযরত ইবনে আব্বাস হইতেও বর্ণিত হইয়াছে।
নামাযের কোন রাক’আতের রুকুতে যাওয়ার পূর্বে দোয় কুনূত পড়িয়াছেন, এই সম্পর্কে হযরত আলী (রা) বর্ণিত হাদীসে স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ
***************************************
রাসূলে করীম (স) বিতরের নামাযের শেষ রাক’আতে (রুকুতে যাওয়ার পূর্বে) দোয়া কুনূত পাঠ করিয়াছেন।
– দারে কুতনী, নায়লুল আওতার
কুনূত পাঠের সময় হাত তুলিয়া তাকবীর বলিতে হইবে। হযরত আলী (রা) সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছেঃ
***************************
তিনি যখন কুনূত পাঠ করার ইচ্ছা করিতেন, তখন তাকবীর বলিতেন ও কুনূত পড়িতেন।
অপর একটি যয়ীফ বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, তাকবীর বলার সময় হাত উপরে তুলিতে হইবে।
*****************************
ঈদের নামায
****************************************************
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল-আজহার দিন ঈদের ময়দানে চলিয়া যাইতেন। সর্বপ্রথম তিনি নামায পড়াইতেন। নামায পড়ানো শেষ করিয়া লোকদের দিকে ফিরিয়া খুতবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়াইতেন। তখন লোকেরা যথারীতি নিজেদের কাতারে বসিয়া থাকিত। এই সময় নবী করীম (স) লোকদিগকে ওয়াজ ও নসীহত করিতেন, শরীয়াতের আদেশ-নিষেধ শোনাইতেন। তখন যদি কোন সৈন্যবাহিনী গড়িয়া তুলিয়া কোন দিকে পাঠাইবার ইচ্ছা করিতেন, তাহা হইলে তিনি (দুই ঈদের খুতবার পরে) তাহা পাঠাইয়া দিতেন কিংবা কোন বিশেষ কোন নির্দেশ জারী করা তাঁহার লক্ষ্য হইত, তবে এই সময় তিনি তাহাও সম্পন্ন করিতেন। অতঃপর তিনি (ঈদগাহ হইতে) প্রত্যাবর্তন করিতেন।
– বুখারী, মুসলিম।
ব্যাখ্যা হাদীস হইতে স্পষ্ট জানা যায় যে, নবী করীম (স) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামায পড়ার জন্য ঘর হইতে বাহির হইয়া ময়দানে চলিয়া যাইতেন। ইহাও ছিল তাঁহার সাধারণ নিয়ম। ঈদের নামাযের জন্য তিনি মদীনার বাহিরে অবস্থিত কোন খোলা মাঠ মনোনীত করিয়া লইতেন এবং সেখানেই নামাযের জন্য লোকদিগকে সমবেত হইবার নির্দেশ দিতেন। অবশ্য বৃষ্টি ইত্যাদির কারণে ময়দানে সমবেত হওয়া সম্ভব না হইলে ঈদের নামায মসজিদেও পড়া যাইতে পারে। স্বয়ং নবী করীম (স) ও এইরূপ অবস্থায় তাহাই করিয়াছেন।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
************************************************
একবার ঈদের দিন বৃষ্টি হওয়ায় নবী করীম (স) লোকদিগকে লইয়া মসজিদে নববীতেই ঈদের নামায আদায় করিলেন। – আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ।
হাদীসটি হইতে প্রথমত দুই ঈদের নামায পড়ার কথা জানা যায়। সেই সঙ্গে জানা যায় যে, নামাযের পরে সমবেত নামাযীদের সামনে ইসলামী হুকুম- আহকাম ও ওয়াজ নসীহত সমন্বিত ভাষণ পেশ করার রীতিও স্থায়ীভাবে বর্তমান। বস্তুত ঈদ যেমন সার্বজনীন আনন্দোৎসব তেমনি এ উৎসবের প্রধানতম কার্যসূচী হইল উন্মুক্ত ময়দানে সমবেত হইয়া বিরাট জামা’আত সহকারে আল্লাহর সম্মুখে সিজদায় অবনমিত হওয়া- দুই রাক’আত নামায পড়া। শুধু নামায পড়াই নয়; সেই সঙ্গে যাবতীয় জাতীয় ও সামষ্টিক বিষয়ে ঈদের মজলিসে আলোচনা করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণও বিধেয়- বরং বাঞ্চনীয়। নবী করীম (স) তাহাই করিয়াছেন।
ঈদের দিনের কর্মসূচী
****************************************************
হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, ঈদের নামাযের জন্য পায়ে হাটিয়া যাওয়া এবং বাহির হওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া সুন্নাত- রাসূলে করীম (স) এর রীতি।- তিরমিযী।
ব্যাখ্যা ঈদের দিনে ময়দানে নামাযের জন্য পায়ে হাটিয়া যাওয়া এবং পায়ে হাটিয়াই ফিরিয়া আসা বাঞ্চনীয়। কেননা এই দিনটি সর্বসাধারণ মানুষের মহামিলনের দিন। এই দিন পায়ে হাটিয়া ময়দানে যাতায়াত করিলেই সাধারণ মানুষের এই মহামিলনের উৎসবে পূর্ণ মাত্রায় অংশ গ্রহণ বাস্তবায়িত হইতে পারে। এই দিন যাহারা উষ্ট্রের পিঠ কিংবা আধুনিক যানবাহনে চড়িয়া ময়দানে যায় তাহারা সাধারণত জন-মানুষ হইতে বিচ্ছিন্নই থাকিয়া যায়। জনগণের কাতারে দাঁড়ানো তাহাদের ভাগ্যে কখনই সম্ভব হয় না। আর ইহা কখনই বিশ্বনবীর আদর্শ হইতে পারে না। বরং সত্যকথা এই যে, ঈদের এই সার্বজনীন উৎসব ও মহামিলনের ব্যবস্থাই তাহাদের নিকট অর্থহীন হইয়া দাঁড়ায় যাহারা এই দিনটিতেও বড়লোকী যানবাহন পরিহার করিয়া সাধারণ মানুষের কাতারে আসিয়া দাঁড়াইতে পারে না, পারে না সমস্ত মানুষের সাথে একাকার হইয়া মিলিয়া মিশিয়া যাইতে। ইহাতে ঈদের এই মহান ব্যবস্থার উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হইয়া যাইতে বাধ্য। তাই রাসূলে করীম (স) এই দিনে পায়ে হাটিয়া যাতায়াত করার সুন্নাতের প্রচলন করিয়াছেন। হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত হাদীসে তাই বলা হইয়াছেঃ
*******************************************
রাসূলে করীম (স) ঈদের নামাযের ময়দানে পায়ে হাটিয়া যাইতেন এবং পায়ে হাটিয়া প্রত্যাবর্তন করিতেন। – ইবনে মাজাহ
কেবল তিনি নিজে পায়ে হাটিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। নির্বিশেষে সর্বসাধারণ মুসলমানও যাহাতে এই আদর্শ বাস্তবভাবে অনুসরণ করিয়া চলে সেই জন্য তিনি বলিয়াছেনঃ
********************************
ঈদের দিনে তোমরা যখন নামাযের জন্য যাইবে তখন অবশ্যই পায়ে হাটিয়া চলিয়া যাইবে।
ঈদুল ফিতরের দিনে সকাল বেলা-নামাযের জন্য বাহির হওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়াও রাসূলে করীম (স) এর প্রতিষ্ঠিত ও অনুসৃত নীতি। হযরত আনাস (রা) বলিয়াছেনঃ
******************************************
রাসূলে করীম (স) ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খাইয়া সকাল বেলা নামাযের জন্য রওয়ানা হইতেন না।- বুখারী, ইবনে মাজাহ
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলিয়াছেনঃ
**************************************
নবী করীম (স) ঈদুল ফিতরের দিন ময়দানের দিকে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে আহার করিতেন।
ঈদুল ফিতরের সকাল বেলা কিছু খাওয়ার রীতির তাৎপর্য সুস্পষ্ট। দীর্ঘ একমাস কাল রোযা পালন করা হইয়াছে। এই মাসের মধ্যে সকাল বেলা ও সারাটি দিনে কিছুই পানাহার করা হয় নাই। আজকার এই ঈদের দিনের সকাল বেলাও- যে দিনে রোযা রাখা হইতেছে না, রোযা রাখা হারাম- কিছুই না খাইলে এই দিনটিও রোযার মতই মনে হইবে। অথচ মন ও মানসিকতা বা মনস্তত্বের দিক দিয়াও ইহা বাঞ্চনীয় নয়।
ঈদের নামাযের জন্য ময়দানে যাতায়াত প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (স) এর আর একটি নিয়ম ছিল যাতায়াতের পথ পরিবর্তন। নিম্নোদ্ধৃত হাদীসে এ বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা রহিয়াছেঃ
**********************************
হযরত জাবির (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ঈদের দিনে ময়দানে যাতায়াতের পথ পরিবর্তন করিতেন।
ব্যাখ্যা ঈদের দিনে রাসূলে করীম (স) ময়দানে যাওয়া-আসার পথ পরিবর্তন করিতেন অর্থাৎ যে পথে ময়দানে যাইতেন সেই পথে ফিরিয়া আসিতেন না। ফিরিয়া আসিতেন অন্য এক পথা দিয়া। ইহা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, সন্দেহ নাই। ইহার দরুণ উভয় পথই এবং তাহাতে চলাচালকারী জনগণ সহজেই রাসূলে করীমের সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারিত। তাঁহার গমনাগমনের ফলে উভয় পথ ও উভয় পথের জনগণ সমান মর্যাদা, সমান অধিকার ও সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করিত। যাতায়াতকালে তাঁহার সঙ্গী-সাথী অসংখ্য মানুষের দলবদ্ধতা চতুর্দিকে ইসলামের বিজয় ডংকা বাজাইত ও সমস্ত মানুষ ইসলামের প্রতাপ ও প্রাণচাঞ্চ্ল্য স্বচোখে দেখিতে পারিত। এই যাতায়াতের পথে মুসলমানরা উচ্চস্বরে তাকবীর করিতেন, এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে আসার ফলে উভয় পথের আকাশ বাতাস তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হইয়া উঠিত। বস্তুত এই সব কারণে ও উদ্দেশ্যে নবী করীম (স) ঈদের দিনে এক পথ ধরিয়া ময়দানে যাইতেন এবং অন্য পথ ধরিয়া ফিরিয়া আসিতেন। মুসলমানদের ইহাই আদর্শ। ঈদের দিনে উচ্চস্বরে তাকবীর বলা রাসূলে করীম (স) এর আমল হইতে প্রমাণিত। এই প্রসঙ্গে তাঁহার নির্দেশও উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা তোমাদের ঈদসমূহকে তাকবীর বলার সাহায্যে সুন্দর-আনন্দমুখর ও জাকজমকপূর্ণ করিয়া তোল।
ইমাম যুহুরী বলিয়াছেনঃ
***************************************
নবী করীম (স) ঈদুল ফিতরের দিনে ঘর হইতে বাহির হইয়া যাওয়ার সময় হইতে নামাযের স্থানে পৌছা পর্যন্ত তাকবীর বলিতে থাকিতেন।
সাহাবাযে কিরাম (রা) ঈদের দিনে পথে চলাকালে উচ্চস্বরে তাকবীর বলিতেন। নাফে’ হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
******************************************
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ঈদের দিন সকালে মসজিদ হইতে নামাযে যাইতেন এবং উচ্চস্বরে তাকবীর বলিতে থাকিতেন-নামাযের স্থানে পৌছা ও ইমামের উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত।
কিন্তু ঈদুল-আযহার দিনে তিনি কি করিতেন?- এই পর্যায়ে হযরত বুরাইদা (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
**********************************
রাসূলে করীম (স) ঈদুল ফিতরের দিন কিছুই না খাইয়া সকাল বেলা নামাযের জন্য যাইতেন না এবং ঈদুল আযহার দিন ময়দানে নামাযের পর ফিরিয়া আসার পূর্বে কিছুই খাইতেন না।- তিরমিযী, ইবনে মাজাহ
বায়হাকীর উদ্ধৃতিতে অতিরিক্ত শব্দ হইলঃ
************************************ ফিরিয়া আসিয়া কুরবানী করা জন্তুর কলিজা আহার করিতেন। ইহা হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, ঈদুল আযহার দিন কুরবানী জন্তুর পোগশই হওয়া উচিত মুসলমানের প্রথম খাবার। অর্থাৎ নামাযের পূর্বে কিছুই খাইবে না। নামায পড়িয়া ফিরিয়া আসিয়াই যাহা পাওয়া যায় তাহাই খাইবে না বরং অবিলম্বে কুরবানী করিয়া সেই কুরবানীর জন্তুর গোশত খাইবে। ইহাই হইবে সেদিনের প্রথম খাবার। – বুখারী
বস্তুত ইহাই ছিল বিশ্বনবীর আদর্শ। সাহাবায়ে কিরাম (রা)-ও এই নীতিই অনুসরণ করিয়াছেন এবং তদানীন্তন মুসলিম সমাজকেও এই নীতি অনুসরণের জন্য আহবান জানাইতেন এবং অনুপ্রাণিত করিতেন।
ঈদের সূচনা
*******************************
হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) যখন মদীনায় উপস্থিত হইলেন, তখন তিনি দেখিতে পাইলেন মদীনাবাসীরা (যাহাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক লোক পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করিয়াছেন) দুইটি জাতীয় উৎসব পালন করিতেছে। আর এই ব্যাপদেশে তাহারা খেলা তামাসার আনন্দ অনুষ্ঠান করিতেছে। নবী করীম (স) তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমরা এই যে দুইটি দিন জাতীয় উৎসব পালন কর, ইহার মৌলিকত্ব ও তাৎপর্য কি? তাহারা বলিলঃ ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এই উৎসব এমনি হাসি-খেলা ও আনন্দ উৎসবের মাধ্যমেই উদযাপন করিতাম, এখন পর্যন্ত তাহাই চলিয়া আসিয়াছে। ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ আল্লাহ তা’আলা তোমাদের এই দুইটি উৎসব দিনের পরিবর্তে উহা হইতে অধিক উত্তম দুইটি দিন- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দান করিয়াছেন। অতএব পূর্বের উৎসব বন্ধ করিয়া এই দুইটি দিনের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করিতে শুরু কর।
– আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা জাতিসমূহের উৎসব ও আনন্দ-অনুষ্ঠানাদি সাধারণত তাহাদের আকীদা বিশ্বাস, ধারণা-মানসিকতা এবং ইতিহাস ও ঐতহ্যি অনুযায়ী হইয়া থাকে। উহাতেই তাহার অভিব্যক্তি ঘটে বাস্তভাবে এবং উহা জাতীয় মেজাজ ও প্রকৃতির সহিত পুরোপুরি সমঞ্জস্যশীল হইয়া থাকে। এই কারণে দেখা যায়, ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতের জামানায় মদীনাবাসীরা যে দুইটি জাতীয় উৎসব পালন করিত তাহা তাহাদের তদানীন্তন জাতীয় ধারণা, মনোভাব, স্বভাব-প্রকৃতি ও জাহিলী ভাবধারা ও ঐতিহ্যানুযায়ী ছিল। ইহার একটি দিনের নাম ছিল ‘নিরোজ’ এবং আর একটির নাম ‘মেহেরজান’। হাদীসের স্পষ্ট ভাষণ হইতে জানা গেল, ইসলামের তাওহীদী যুগে জাহিলী যুগের এই উৎসব সম্পূর্ণ অচল ও সামঞ্জস্যহীন বিধায় আল্লাহ তা’আলা উহা বন্ধ করিয়া দিলেন। কিন্তু উৎসব ও আনন্দানুষ্ঠান মানুষের প্রকৃতিগত। উহা একেবারে বন্ধ করিয়া দেওয়া মানুষের শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ করিয়া দেওয়ায়র মতই মারাত্মক। তাই আল্লাহ তা’আলা জাহিলী যুগের দুইটি উৎসব বন্ধ করিয়া দিয়া অনুরূপ দুইটি জাতীয় উৎসবের সূচনা করিয়া দিলেন। এই দুইটি উৎসব হইল দুই ঈদের উৎসব। একটি ঈদুল ফিতর আর অপরটি ঈদুল আযহা। ঈদুল ফিতর একাধারে একটি মাস কাল ধরিয়া একনিষ্ঠভাবে রোযা পালন ও কৃচ্ছ সাধনের পর উহা অবসানের আনন্দ উৎসব। আর ঈদুল আযহা হইল হজ্জ করার পর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু যবাই করার অনুষ্ঠান। আর এই দুইটি রোযা ও হজ্জ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এতদুভয়ে রোযা ও হজ্জ পালনকারীদের সার্বিক কল্যাণের জন্য বিশেষ মুনাজাত করা হয়। সেই সঙ্গে উৎসব আনন্দের মূল উৎস হইল সমবেতভাবে ইমামের পিছনে দুই রাক’আত নামায পড়াও খুতবা শ্রবণ। পক্ষান্তরে জাহিলিয়াতের জামানায় দুইটি দিনে যে অনুষ্ঠান হইত তাহা খেলা-তামাসার অর্থহীন স্থুল ও অন্তঃসারশূন্য আনন্দ উল্লাস মাত্র। তাহাতে যেমন ছিল লালসার বহ্নি প্রজ্বলনের সমস্ত আয়োজন, তেমনি হইত প্রকৃতি পূজার পংকিল উৎকট অভিব্যক্তি। কাজেই ইসলাম গ্রহণ করিবার পর কোন মুসলমানই এই ধরনের কোন উৎসবে অংশ গ্রহণ করিতে পারে না।
বস্তুত ইসলামের যুগে ইসলাম- পূর্ব জাহিলী যুগের তাহযীব-তমদ্দুন ও সাংস্কৃতিক উৎসব যেমন চলিতে দেওয়া যাইতে পারে না, অনুরূপভাবে কোন লোকের বা জাতির ইসলাম কবুল করিবার পর ইসলাম-পূর্বকালের অনৈসলামিক বা ইসলাম বিরোধী আনন্দ-উৎসব ও অনুষ্ঠান পালন করা কোনক্রমেই বৈধ ও বিধেয় হইতে পারে না। হাদীসে ইহারই বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়।
পরন্তু ইসলাম মানুষের জীবনে কতগুলি বিধি-নিষেধের দূরতিক্রম্য প্রতিবন্ধকতা চাপাইয়া দিতে আসে নাই, জীবনের স্বচ্ছন্দ গতিকে স্তব্ধ করিয়া দেওয়াই উহার লক্ষ্য নয়। বরং উহা যেমন পাপ ও অন্যায়ের পথ বন্ধ করিয়া দেয়, তেমনি উন্মুক্ত করিয়া দেয় কল্যাণময় ও সার্বজনীন অপর বহু পথ ও পন্থা।
জাহিলিয়াতের দুইটি আনন্দোৎসব বন্ধ করিয়া তদস্থলে অপর দুইটি আনন্দোৎসব অনুষ্ঠানের প্রর্বতন করিয়া দেওয়ায় ইসলামের সত্যিকার রূপ ও প্রকৃতিই উদঘাটিত হইল।
ঈদের সার্বজনীন উৎসব
**********************************
উম্মে আতীয়া (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) দুই ঈদেরর ময়দানে নাবালিকা, পূর্ণ বয়স্কা সাংসারিক ও হায়েযসম্পন্না মহিলাদিগকেও উপস্থিত করিতেন। তবে হায়েযসম্পন্না মহিলারা নামায হইতে দূরে সরিয়া থাকিত; কিন্তু সর্বসাধারণ মুসলমানদের যখন দ্বীনী দাওয়াত (খুতবা) দেওয়া হইত, তখন তাহারা তাহাতে পুরাপুরি অংশ গ্রহণ করিত।
একজন মহিলা জিজ্ঞাসা করিল, মহিলাদের বাহিরে যাওয়ার জন্য যে মুখাবরণের প্রয়োজন তাহা যদি কাহারো না থাকে, তখন কি করা যাইবে হে রাসূল? জওয়াবে তিনি বলিলেন, ‘কাহারো তাহা না থাকিলে তাহার অপর এক বোন যেন তাহাকে নিজের মুখাবরণ ধারস্বরূপ দিয়া দেয়।
– তিরমিযী
ব্যাখ্যা উম্মে আতীয়া বর্ণিত এই হাদীসটি মুসনাদে আহমদেও উদ্ধৃত হইয়াছে। কিন্তু উপরোদ্ধৃত বর্ণনার শুরুতে যেখানে বলা হইয়াছে, ******************** নবী করীম (স) এ সব মহিলাদের বাহির করিয়া লইয়া যাইতেন, সেখানে মুসনাদে আহমদে বলা হইযাছেঃ
******************************
উম্মে আতীয়া বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) তাঁহার জন্য আমার মা ও বাপ উৎসর্গীত হউক- আমাদিগকে (এই সব মহিলাদের) ঈদের দিনে বাহির করিয়া লইয়া যাইতে নির্দেশ দিয়াছেন। বর্ণনা ও ভাষায় এই পার্থক্যে মূল বক্তব্যে কোনই পার্থক্য হয় নাই বরং পার্থক্য হইতে একথা স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, নবী করীম (স) নিজে যেমন সব পর্যায়ের ও সব রকমের ও সব অবস্থায় মহিলাদিগকেও ঈদের দিনে ময়দানে হাযির করিতেন, তেমনি নেতৃস্থানীয় মহিলাদিগকেও এই কাজের নির্দেশ দিতেন। ঈদের দিনে সব পুরুষ ও সব মহিলার ময়দানে হাযির হওয়া মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির অংশরূপে গণ্য। কেননা ঈদের দিনের এই অনুষ্ঠান সার্বজনীন। ইহাতে সব শ্রেণীর, সব পর্যায়ের ও সব অবস্থার পুরুষ ও স্ত্রীলোকদিগের উপস্থিত থাকাই বাঞ্চনীয়।
তবে হায়েযসম্পন্না মহিলাদের জন্য নামায পড়া জায়েয নহে, এই কারণে তাহারা নামাযের সময় আলাদা সরিয়া বসিবে। কিন্তু ইহার পরই ইমাম যে ভাষণ দিবে, তাহা শুনিবার জন্য তাহারা পুণরায় মজলিসে আসিয়া শামিল হইবে।
মহিলাদের বাহিরে-ঈদের ময়দানেও যাইবার জন্য মুখমন্ডল আবৃত করিয়া যাওয়াই বাঞ্চনীয়।ইসলামে ইহা স্থায়ী বিধান। কিন্তু যদি কাহারও বোরকা বা এমন কোন কাপড় না থাকে, যাহা দ্বারা মুখাবয় আবৃত করা যাইতে পারে, তাহা হইলে কি করা যাইবে? তখন কি ময়দানে যাওয়া বন্ধ করিবে? ইহার জওয়াব স্বয়ং নবী করীম (স) দিয়াছেন। তাঁহার এই জওয়াবের সারকথা হইল, ঈদের মত জাতীয় ও সার্বজনীন উৎসবের ক্ষেত্রে ইহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ইহাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সকলেই উপস্থিত থাকা কর্তব্য। আর যদি কোন মহিলার বোরকা নাই বলিয়া ময়দানে যাইতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়, তবুও যাওয়া বন্ধ করা চলিবে না। তখন অপর কোন মহিলার নিকট হইতে তাহার অতিরিক্ত কোন বোরকা বা কাপড় উপস্থিত ধার বাবদ গ্রহণ করিতে হইবে এবং তাহা লইয়া ময়দানে বাহির হইতে হইবে।
ঈদের নামাযের জন্য ময়দানে বাহির হওয়ার ব্যাপারে মহিলাদের কর্তব্যের কথা খুব সামান্য ও নগণ্যভাবে দেখিলে চলিবে না। বরং ইহার গুরুত্ব অবর্ণনীয়। হাদীসে এ পর্যায়ে রাসূলে করীমের অসংখ্য বাণী উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
***************************************
রাসূলে করীম (স) দুই ঈদের নামাযে ময়দানে যাওয়ার জন্য তাঁহার কন্যা ও অন্যান্য মহিলাদের আদেশ করিতেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাতুল আনসারীর ভগিনী উমরাতা বিনতে রাওয়াহাতুল আনসারী বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
************************************************
ঈদের দিন ময়দানে যাওয়া কর্তব্য প্রত্যেক বাকশক্তিসম্পন্ন মানুষরেই।
কিন্তু তাহা সত্ত্বেও সামাজিক অবস্থা ও নৈতিক পরিবেশ শৃঙ্খলাহীন ও বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে ইসলামী শরীয়াতের বিশেষজ্ঞগণ বিশেষভাবে যুবতী মেয়েলোকদের ঈদের জামা’আতে শরীক হওয়া হারাম ঘোষণা করিয়াছেন। কেননা উহার পরিণতিতে হারাম সংঘটিত হইতে পারে। আর যে কাজের পরিণতি হারাম স্বয়ং সেই কাজও অবশ্যই হারাম হইবে। ***********************
ঈদের খুতব
*****************************************
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি এক ঈদে নবী করীম (স) এর সাথে নামাযে শরীক ও উপস্থিত হইয়াছিলাম। দেখিলাম, তিনি কোনরূপ আযান ও ইকামত ছাড়াই এবং খুতবা দেওয়ার পূর্বে নামায শুরু করিয়া দিলেন। নামায যখন সম্পূর্ণরূপে আদায় হইয়া গেল, তখন তিনি হযরত বিলালের কাঁধে ভর করিয়া ভাষণ দেওয়ার জন্য দাঁড়াইলেন। শুরুতেই তিনি আল্লাহর হামদ করিলেন, তাঁহার প্রশংসা ও গুণাবলী বয়ান করিলেন, লোকদের দ্বীনী তত্ত্ব ও জরুরী কথাবার্তা বলিলেন। তাহাদিগকে দ্বীন ও পরকালের কথা স্মরণ করাইয়া দিলেন। আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য উৎসাহিত ও উদ্ধৃত করিলেন। অতঃপর তিনি মহিলাদের সমাবেশের দিকে চলিয়া গেলেন। হযরত বিলাল তখন তাঁহার সাথেই ছিলেন। সেখানে উপস্থিত হইয়া তিনি তাহাদিগকে আল্লাহর ভয় করিয়া চলিবার নির্দেশ দিলেন, তাহাদিগকেও অনেক জরুরী দ্বীনী কথা বলিলেন এবং অনেক উপদেশ দিলেন।
– নাসায়ী
ব্যাখ্যা এই হাদীসে ঈদের দিনের ময়দানের কার্যসূচী স্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছে। এইদিন ময়দানে প্রথম কাজ হইল দুই রাক’আত নামায জামা’আতের সহিত পড়া। ইহার পূর্বে আযান ও ইকামত বলা হইবে না। নামায শেষ হইয়া যাওয়ার পর ইমাম দাঁড়াইয়া খুতবা পেশ করিবে। খুতবার শুরুতে আল্লাহর হামদ ও রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করিতে হইব এবং লোকদিগকে দ্বীনী নসীহত ও সমাজ ও রাষ্ট্রের অবস্থা সম্পর্কে দ্বীনি হিদায়ত পেশ করিবে।
ঈদের নামায ও জামা’আতে মহিলারাও শরীক হইবে। তবে তাহাদের আসন পুরুষদের হইতে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন হইতে হইবে। যেমন এই হাদীসটি হইতে স্পষ্ট জানা যায়।
ইমামের ভাষণ সকলেই শ্রুতিগোচর করিতে হইবে। মজলিসের কোন অংশ না শুনিতে পাইলে প্রয়োজন মত তাহাদের নিকেট উপস্থিত হইয়া নসীহতের কথা শোনানো বাঞ্চনীয়- যেমন আলোচন্য হাদীসের বর্ণনানুযায়ী নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
ঈদের নামাযে আযান-ইকামত নাই
***********************************************
হযরত জাবির ইবনে সামুরাতা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি রাসূলে করীম (স) এর সঙ্গে ঈদের নামায একবার দুই বার নয় (বহুবার) আযান ও ইকামত ছাড়াই পড়িয়াছি।
– মুসলিম, মুসনাদে আহমদ আবূ দাউদ, তিরমিযী।
ব্যাখ্যা এই হাদীস হইতে স্পষ্ট হয় যে, ঈদের নামাযের জন্য না আযানা দিতে হয় না ইকামত বলিতে হয়। হযরত জাবির ইবনে সামুরাতা (রা) আযান-ইকামত ছাড়াই ঈদের নামায পড়িয়াছেন বলিয়া উপরোদ্ধৃত হাদীসে সাক্ষ্য দিয়াছেন। এই পর্যায়ে একটি দুইটি নয়, বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত ও গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে। এই ব্যাপারে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামাযের মধ্যে কোনই পার্থক্য নাই। হযরত ইবনে আব্বাস ও হযরত জাবির (রা) বলিয়াছেনঃ
*******************************
না ঈদুল ফিতরের নামাযে আযান দেওয়া হইত, না ঈদুল আযহায়।
– বুখারী, মুসলিম
এই পর্যায়ে হযরত সা’দ ইবনে আবূ আক্কাস (রা) হইতে বর্ণিত হাদীস আরও স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ। ইহার ভাষা হইলঃ
****************************************
নবী করীম (স) ঈদের নামায আযান-ইকামত ছাড়াই পড়িয়াছেন। তিনি এই সময় দাঁড়াইয়া দুইটি খুতবা দিতেন এবং দুই খুতবার মাঝখানে আসন গ্রহণ করিয়া পার্থক্য সূচিত করিতেন।
– মুসনাদে বাযযার
আবূ দাউদ হযরত ইবনে আব্বাস হইতে ইবনে মাজহ হযরত সা’দ ইবনে আবূ আক্কাস হইতে, তাবারানী হযরত বরা ইবনে আযিব হইতে ও হযরত রাফে’ হইতে, ইবনে আবূ শায়বা মুগীরা ইবনে শু’বা দহাক ও যিয়াদ হইতে এই একই কথার বর্ণনা করিয়াছেন।
কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ইমাম শাফেয়ী প্রমুখ। ফিকাহবিদের মতে আযান-ইকামত না বলিয়াও ************* নামাযে দাঁড়াইয়া গিয়াছে, বলিয়া উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ দেওয়া যাইতে পারে। আর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছে, এইরূপ ধ্বনি দেওয়ার জন্য মুয়াযযিনকে নির্দেশ দেওয়া ইমামের কর্তব্য বলিয়া ইমাম শাফেয়ী মত প্রকাশ করিয়াছেন। তিনি এতদূর বলিয়াছেনঃ ***********************
কিংবা ****************** অথবা ****************** ‘নামাযের দিকে আস’ ‘নামাযের জন্য আস’ অথবা ‘নামায দাঁড়াইয়া গিয়াছে’ বলিয়া ধ্বনি দিলেও কোনই দোষ নাই। কেননা এখনও নামাযের স্থানে আসিয়া পৌছাতে পারে নাই, কাছাকাছি আসিয়া গিয়াছে এমন বহু লোক এই আওয়াজ শুনিয়া দ্রুত চলিয়া আসিতে পারে নামাযে শরীক হইতে পারে। বিশেষত এই নামায হইয়া গেলে আবার এই নামায পড়ার অবকাশ থাকে না বলিয়া যত বেশী লোককে ইহাতে শরীক হওয়ার সুযোগ দেওয়া যায় ততই মঙ্গল এবং সেইজন্য শরীয়াতের মধ্যে থাকিয়া যতটা চেষ্টা করা চলে তাহা অবশ্যই করা উচিত। *******************
দুই ঈদের নামাযের পূর্বে এইরূপ আওয়াজ দেওয়ার জন্য স্বয়ং নবী করীম (স) মুয়াযযিনকে নির্দেশ দিতেন। এই মর্মে একটি হাদীস ইমাম শাফেয়ী যুহরীর একটি বর্ণিনা উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইমাম বায়হাকী ও ইমামা শাফেয়ীর সূত্রে নিজ গ্রন্থে ইহার উল্লেখ করিয়াছেন।
******************************
ঈদের নামাযে তাকবীর
*************************************************
আমর ইবনে শুআইব তাঁহার পিতা হইতে- তাঁহার দাদা হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ নবী করীম (স) ঈদের নামাযে বারোটি তাকবীর বলিয়াছেন। তন্মধ্যে সাতটি প্রথম রাক’আতে ও পাচটি দ্বিতীয় রাক’আতে দিয়াছেন। ইহার পূর্বেও নামায পড়েন নাই, ইহার পরও না। – মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ
ব্যাখ্যা ঈদের দুই রাক’আত নামাযে অতিরিক্ত কতটি তাকবীর দিতে হইবে এবং তাহা কোন কোন সময় দিতে হইবে এই পর্যায়ে বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত ও গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে। ইহার ফলে হাদীসবিদদের মধ্যেও এই উভয় পর্যায়ে-কতটি তাকবীর দিতে হইবে এবং কোন কোন সময় দিতে হইবে বিরাট মতভেদের উদ্ভব হইয়াছে এবঙ বিভিন্ন লোক বিভিন্ন মত প্রকাশ করিয়াচেন। আমরা এই মতসমূহের উল্রেখ করিতেছ্
১. প্রথম রাক” আতে কুরআন পাঠের পূর্বে সাতটি এবং দ্বিতীয় রাক’আতে কুরআন পাঠের পূর্বে পাচটি এই মোট বারোটি তাকবীর দিতে হইবে। মুহাদ্দিস আল-ইরাকী বলিয়াছেন, সাহাবা, তাবেয়ী ও ফিকাহর ইমামদের অধিকাংশেরই এই মত। হযরত উমর, হযরত আলী, হযরত আবূ হুরায়রা, হযরত সাঈদ, হযরত ইবনে উমর, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত আবূ আইয়ুব, হযরত যাঈদ ইবনে সাবিত ও হযরত আয়েশা (রা) হইতেও এই মতই বর্ণিত হইয়াছে। মদীনার সাতজন ফিকাহবিদ এবং উমর ইবনে আবদুল আযীয, যুহুরী, মকহুল, মালিক, আওযায়ী, ইশাফেয়ী, আহমদ, ইসহাক প্রমুখ হাদীস ও ফিকাহ বিশারদ মনীষীও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
২. প্রথম রাক’আতে তাকবীরে তাহরীমাসহ মোট সাতটি এবং দ্বিতীয় রাক’আতে সাতটি তাকবীর বলিতে হইবে। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদ এই মত দিয়াছেন।
৩. প্রথম রাক’আতে সাতটি এবং দ্বিতীয় রাক’আতেও সাতটি তাকবীর দিতেহইবে। এই মত হযরত আনাস ইবনে মালিক, মুগীরা ইবনে শু’বা ইবনে আব্বাস, সাঈদ ইবনুল মুসিয়্যিব ও নখয়ী হইতে বর্ণিত।
৪.প্রথম রাক্’আতে তাকবীরে তাহরীমার পরে তিনটি তাকবীর কুরআন পড়ার পূর্বে দিতে হইবে এবং দ্বিতীয় রাক্’আতে কুরআন পাঠের পর তিনটি তাকবীর দিতে হইবে। সাহাবার একটি জামা’আত-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবূ মূসা আল-আশআরী, আবু মাদউদ আল-আনসারী (রা) হইতে ইহা বর্ণিত হইয়াছে। ইমাম সওরী, ইমাম আবূ হানীফা প্রমুখ ইমাম এই মতই গ্রহণ করিয়াছেন।
৫.প্রথম রাক্’আতে তাকবীরে তাহরীমার পর ও কুরআন পাঠের পূর্বে ছয়টি এবং দ্বিতীয় রাক্’আতে কুরআন পাঠের পর পাঁচটি তাকবীর বলিতে হইবে।
৬.প্রথম রাক্’আতে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া আরও চারটি তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাক্’আতে চারটি তাকবীর দিতে হইবে। মুহাম্মদ ইবনে সিরীন এই মত সমর্থন করিয়াছেন।
৭.সপ্তম মতটি প্রথম মতের অনুরূপ। পার্থক্য এই যে, প্রথম রাক্’আতের তাকবীরের পর কুরআন পড়িবে এবং দ্বিতীয় রাক্’আতে কুরআন পাঠের পর তাকবীর বলিবে।
৮.ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামাযে তাকবীরের ব্যাপারে পার্থক্য করা হইবে। ঈদুল ফিতরে মোট এগারোটি তাকবীর বলিবে। ছয়টি প্রথম রাক্’আতে ও পাঁচটি দ্বিতীয় রাক্’আতে। আর ঈদুল আযহার নামাযে প্রথম রাক্’আতে তিনটি ও দ্বিতীয় রাক্’আতে দুইটি তাকবীর বলিবে।
ইবনে আবূ শায়বা ইহাকে হযরত আলীর মত রূপে উল্লেখ করিয়াছেন।
৯.এই দুই নামাযে অন্য একভাবে পার্থক্য করিতে হইবে। আর তাহা হইল, ঈদুল ফিতরে এগারোটি তাকবীর ও ঈদুল আযহায় ৯টি তাকবীর বলিবে।
১০.দশম মত প্রথম মতের অনুরূপ। তবে তাকবীর দেওয়া হইবে কুরআন পড়ার পর।
প্রথম মতটি উপরে উদ্ধৃত ও এই অর্থে বর্ণিত অপর কয়টি হাদীসের ভিত্তিতে গড়িয়া উঠেয়াছে। হযরত হাসসানের সূত্রেও বর্ণিত হইয়াছে যে, নবী করীম (স) দুই ঈদের নামাযেই প্রথম আক্’আতে সাতটি ও দ্বিতীয় আক্’আতে পাঁচটি তাকবীর বলিয়াছেন। মূলত এই হাদীসটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর, ইবনে আমর, জাবির ও হযরত আয়েশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত। দ্বিতীয় মতটি হাদীসসমূহের সাধারণ বর্ণনার ভিত্তিতে গৃহীত। তৃতীয় মতটির উৎস যে হাদীস, তাহা জানা নাই। চতুর্থ মতটির উৎস হযরত আবূ মুসা ও হুয়ায়ফা (রা) বর্ণিত হাদীস। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) প্রথম এই মতের সমর্থনে ফতোয়া দিয়াছিলেন। এই মতের ব্যাখ্যা এই যে, হাদীসে মোট চারটি তাকবীরের উল্লেখ হইয়াছে, তাকবীরে তাহরীমাও উহার মধ্যে গণ্য। ফলে অতিরিক্ত তাকবীর হয় মাত্র তিনটি। অবশ্য দ্বিতীয় আক্’আতের ব্যাপারে এই ব্যাখ্যা অচল। পঞ্চম মতের সমর্থনে কোন হাদীসের উল্লেখ হয় নাই। ষষ্ঠ মত হযরত আবূ মুসা ও হযরত হুযায়ফা বর্ণিত হাদীস হইতে গৃহীত। সপ্তম মতের উৎস হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত হাদীস। অষ্টম মতটি হযরত আলী (রা)-এর উক্তি হইতে সমর্থিত। নবম ও দশম মতের সমর্থনে কোন দলীল পেশ করা হয় নাই।
তাকবীরসমূহ একসঙ্গে ও পরপর মিলিতভাবে দেওয়া হইবে, না কোন হামদ বা তসবীহ পাঠ দ্বারা উহাদের মঝে পার্থক্য করা হইবে এই পর্যায়ে ইমাম মালিক, ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আওযায়ী (র) বলিয়াছেনঃ তাকবীরসমূহ রুকু, সিজদার তসবীহ পড়ার মতই মিলিত ও পরপর দিতে হইবে। কেননা হাদীসের বর্ণনাসমূহে তাকবীরগুলির মাঝে পার্থক্য করার ও পরপর না দেওয়ার কোন কথা বলা হয় নাই। অবশ্য ইমাম শাফেয়ী তাকবীরসমূহের মাঝে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বা সুবহানা-আল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্ ইত্যাদি দোয়া তাসবীহ পাঠ করিয়া পার্থক্য করার পক্ষে মত প্রকাশ করিয়াছেন। ===========
সাহু সিজদা
======================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুহায়না (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) কোন এক নামাযের দুই আক্’আত আমাদের লইয়া পড়িলেন। পরে তিনি দাঁড়াইয়া গেলেন, বলিলেন না। মুক্তাদী লোকেরাও তাঁহার সহিত দাঁড়াইয়া গেল। পরে তিনি যখন নামায সমাপ্ত করিলেন এবং আমরা তাঁহার সালাম ফিরানোর অপেক্ষা করিতে থাকিলাম, এই সময় তিনি তাকবীর বলিলেন। সালাম ফিরোনোর পূর্বে তাকবীর বলিলেন। বসা থাকা অবস্থায় দুইটি সিজদা দিলেন। অতঃপর তিনি সালাম ফিরাইলেন।
– বুখারী, মুসলিম
=======================
কোন বিষয়ে বেখেয়াল হইয়া যাওয়া ও সেদিক হইতে অন্য দিকে মন চলিয়া যাওয়া।
ইহা কোন নামাযে ঘটিয়াছিল? তিরমিযী শরীফের বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
=======================
নবী করীম (স) যুহরের নামাযে যেখানে বসিতে হইত সেখানে দাঁড়াইয়া গেলেন।
আর যুহরের ফরয নামায যে চার আক্’আত তাহা সর্বজনজ্ঞাত। দুই আক্’আত পড়ার পর বসিয়া তাশাহ্হুদ পড়িতে হইত; কিন্তু এই সময় নবী করীম (স)-এর মন বেখেয়াল হইয়া গিয়াছিল ও বসার কথা তাঁহার মন হইতে মুছিয়া গিয়াছিল। আর এইরূপ হওয়া কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। কেননা তিনিও মানুষ ছিলেন, সাধারণ মানুষের ন্যায় তাঁহারও মন হইতে মুছিয়া গিয়াছিল। আর এইরূপ হওয়া কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। কেননা তিনিও মানুষ ছিলেন, সাধারণ মানুষের ন্যায় তাঁহারও ভুল-ভ্রান্তি হইতে পারিত। বিশেষত সাধারণ মানুষকে যখন সর্ব ব্যাপারে রাসূলে করীম (স)-কেই অনুসরণ করিতে হইবে-আর সাধারণ মানুষের এইভাবে ভুল-ভ্রান্তি হওয়া তো খুবই সাধারণ ব্যাপার-তাই রাসূলে করীমেরও ভুল ঘটাইয়া তদবস্থায় কি করণীয় তাহা লোকজনকে শিখাইবার ব্যবস্থা করার একান্তই প্রয়োজন ছিল। রাসূলে করীমের আলোচ্য ভুল হইতে সেই প্রয়োজনই পূর্ণ হইল।
ইহা হইতে জানা গেল, যে এই ধরনের ভুল হইলে নামাযের শেষে সালাম ফিরানোর পূর্বে দুইটি সিজদা দিতে হইব। শাফেয়ী মাযহাব অনুযায়ী ইহা সুন্নাত। মালিথী মাযহাব অনুযায়ী নামায কম পড়া হইলে সাহু সিজদা করা ওয়াজিব, বেশী হইলে নয়। হানাফী মাযহাব অনুযায়ী ইহা ওয়াজিব। তাঁহাদের দরীল হইল হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত হাদীসের বাক্যঃ
=============== অতঃপর যেন দুইটি সিজদা দেওয়া হয়। বাকটি করীম (স) নিজেই যন এই ধরনের ভুলের জন্য সিজদা করিয়া বলিয়াছেন হাদীসে উদ্ধৃত হইয়াছে, তখন ইহাকে ঘটনার বর্ণনা কর্তব্য পালনের বিবরণ-মনে করিতে হইবে। আর কর্তব্যের বর্ণনা অনুযায়ী কাজ করাও কর্তব্য বিবেচিত। বিশেষত তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
=====================
তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়িতে দেখিতে পাইতেছে, তোমরাও ঠিক সেইভাবেই নামায পড়িবে।
সাহু সিজদায় তাকবীর সহ দুইটি সিজদা করিতে হয়। যদি কেহ ভুলবশত একটি সিজদা করে, তাহা হইলে তাহাতে দোষ হইবে না। কিন্তু ইচ্ছা করিয়া মাত্র একটি সিজদা দিলে তাহার গোটা নামাযই বাতিল হইয়া যাইবে। ইবনে শিহাবের বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ ====== প্রত্যেকটি সিজদা কালে ‘আল্লাহু আকবর’ বলিতে হইবে। কেননা এই সিজদা ঠিক নামাযের সিজদার মতই।
ইহা হইতে এই কথাও প্রমাণিত হয় যে, ইমাম ভুল করিলে যখন সাহু সিজদা দিবে, তখন তাহার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তাদিগণকেও এই সিজদা দিতে হইবে-যদিও মুক্তাদিগণের কোনই ভুল হয় নাই। ইহাই ‘ইজমা’। নবী করীম (স) মৃত্যু পর্যন্ত এইরূপ আমলই করিয়াছেন।
এ পর্যায়ে আরও জানিবার বিষয় হইল, চার রাক্’আত নামাযে দুই রাক্’আতের পর বসিয়া তাশাহহুদ পড়িতে হয়। কিন্তু যদি কেহ এইখানে না বসিয়া সোজা উঠিয়া দাঁড়াইয়া যায়, তাহার পরই ভুল ধরা পড়িলেও তখন ফিরিয়া বসা যাইবে না। কেননা এই বসাটা ফরয নয়, ফরযের ক্ষেত্রও ইহা নয়। যদি কেহ সোজা দাঁড়াইয়া যাওয়ার পরও বসে, তাহা হইলে তাহার নামায নষ্ট হইয়া যাইবে-এমন কোন কথা নয়। কেননা এই বসাটা দ্বারা সেই কাজই করা হইয়াছে যাহা মূলতই করণীয় ছিল।
======================
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের কেহ যদি এই সন্দেহে পড়িয়া যায় যে, সে কয় রাক্’আত পড়িয়াছে- তিন রাক্’আত না চার রাক্’আত; তখন সে যেন সন্দেহ ঝাড়িয়া ফেলে এবং যে কয় রাক্’আত পড়িয়াছে বলিয়া দৃঢ় প্রত্যয় হয় তাহার উপর সে যেন ভিত্তি স্থাপন করে। অতঃপর সালাম ফিরাইবার পূর্বে সে যেন দুইটি সিজদা দেয়। সে যদি আসলে পাঁচ রাক্’আত পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে এই সিজদা দুইটি মিলাইয়া তাহার নামায জোড়যুক্ত করিয়া দেওয়া হইবে। আর যদি সে চার রাক্’আত পূর্ণই পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে এই সিজদা দুইটি শয়তানের পক্ষে লাঞ্ছনাকারী ও উহার ক্রোধ উুদ্রেককারী স্বরূপ হইবে।
– মুসলিম, আবু দাউদ
ব্যাখ্যা নামায পড়িতে থাকা অবস্থায় কয় রাক্’আত পড়া হইয়াছে তাহা ভুলিয়া যাওয়া মানুষের পক্ষে কিছু মাত্র অস্বাভাবিক নয়। নামাযীকে প্রায়শই এইরূপ অবস্থার সম্মুখীন হইতে হয়। এইরূপ অবস্থায় পড়িলে নামাযীকে কি করিতে হইবে। আলোচ্য হাদীসে তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। এইরূপ অবস্থায় তাহাকে মুহূর্তে একটি বিশেষ সংখ্যার উপর মনকে দৃঢ় করিতে হইবে। সন্দেহের সব ধুম্রজাল দূর করিয়া দৃঢ় প্রত্যয়ের আলো মনের লোকে ফুটাইয়া তুলিতে হইবে। অতঃপর সালাম ফিরানোর পূর্বে দুইটি সিজদা দিতে হইবে। ইহা সাহু সিজদা। ইমাম নববী বলিয়াছেনঃ
=========================
সন্দেহ হইলে রাক্’আতের সংখ্যা সম্পর্কে একটা দৃঢ় প্রত্যয় জন্মানো ওয়াজিব। এই হাদিসটি এই সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশ দিতেছে।
ইমাম শাফেয়ীর এই মত! ইমাম মালিক (রা) এই হাদীসটিকে ‘মুরসাল’-তাবেয়ী কর্তৃক সরাসরি রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণনাকৃত-মনে করিয়া ইহাকে গ্রাহ্য করিতে রাযী নহেন। কিন্তু আসলে তাহা নয়। এই হাদীসটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত হাফেযে হাদীস কর্তৃক মুক্তাসিল সনদে বর্ণিত হইয়াছে। আর দ্বিতীয় কথা এই যে, সনদের দিক দিয়া হাদীসটি ‘মুরসাল’ হইলেও উহা যে গ্রহণ করা যাইবে না এমন কথা নয়।
নামাযে সাময়িক বিভ্রান্তির কারণে দুইটি অতিরিক্ত সিজদা দিতে হইবে। এই সিজদা দুইটির ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কে স্বয়ং নবী করীম (স)-ই বলিয়া দিয়াছেনঃ যদি সে পাঁচ রাক্’আত পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে এই সিজদা দুইটি তাহার নামাযের সহিত মিলিয়া জোড়যুক্ত হইয়া যাইবে। আর যদি সে চার রাক্’আত পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার নামায পূর্ণ হইয়া গেল। আর সিজদা দুইটি শয়তানের পক্ষে অপমান ও লাঞ্ছনার কারণ হইবে। কারণ এই দুইটি সিজদা দেওয়ায় শয়তান রাগে জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিবে। কেননা, শয়দানই নামায়ীকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলিয়াছে। তাহার নামায নষ্ট করিবার উদ্দেশ্যেই তাহাকে প্রতারিত করিয়াছে। কিন্তু সাহু সিজদা দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়া দিয়া আল্লাহ্ তা’আলা তাহার নামাযের কমতি পূরণ করিয়া দিয়াছেন, বিভ্রান্তি দূর করার পন্থা বলিয়া দিয়াছেন এবং সেই সঙ্গে শয়তানের অধিক লাঞ্ছনা ও ব্যর্থতার কারণ সৃষ্টি করিয়া দিয়াছেন।
এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস উল্লেখ্যঃ
=========================
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি নবী করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছিঃ তোমাদের কেহ যদি নামাযে বিভ্রান্ত হইয়া পড়ে এবং ঠিক করিতে না পারে এক রাক্’আত, পড়িয়াছে বলিয়া মনে প্রত্যয় জাগায়। যদি সন্দেহ হয় যে, দুই রাক্’আত পড়িয়াছে, না তিন রাক্’আত তখন দুই রাক্’আত ঠিক করিবে, আর যদি তিন রাক্’আত পড়িয়াছে, না চার রাক্’আত তাহা ঠিক করিতে না পারে, তবে যেন তিন রাক্’আত পড়িয়াছে বলিয়া মনকে শক্ত করে এবং সালাম ফিরাইবার পূর্বে যেন দুইটি সিজদা দেয়।
ব্যাখ্যা সাহু সিজদা পর্যায়ে এই হাদীসটি অন্যান্য যাবতীয় হাদীসের তুলনায় অনেক বিস্তারিত কাজেই যে সব হাদীসে এই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কথা উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাও এই হাদীসের আলোকেই বুঝিতে হইবে।
==================
উপরোদ্ধৃত হাদীস কয়টিতে সাহু সিজদা দেওয়ার পদ্ধতি বিস্তারিত বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। হাদীস কয়টি নবী করীম (স)-এর নির্দেশমূলক। দ্বিতীয়ত তিনি স্বয়ঙ এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা) প্রয়োজন দেখা দিলেই সিজদায়ে সাহু দিয়াছেন। ইহাতে কোনই ব্যতিক্রম দেখা যায় নাই। বিনা ওযরে উহার গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়।
‘সিজদায়ে সাহু’ সংক্রান্ত হাদীস ২৯ জন সাহাবী হইতে বর্ণিত হইয়াছে এবং ঐক্যমতের ভিত্তিতে বলিয়াছেনঃ ‘সিজদায়েসাহু’ ফরয।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে ভিন্নতর ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
===========================
যে লোক তাহার নামাযে সন্দেহে পড়িয়া যাইবে-তিন রাক্’আত, তখন যেন সে সঠিক সংখ্যাটি স্থির করিয়া লয়-কেননা ইহাই সঠিক অবস্থার নিকটবর্তী পদ্ধতি এবং উহার উপর ভিত্তি করে। অতঃপর সাহুর দুইটি সিজদা দিবে।
-বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী
ব্যাখ্যা ভুল ধরা পড়িলে সঠিক ও নির্ভুল কি তাহা নিমেষের মধ্যে নির্দিষ্ট করিয়া সেই হিসাবে পরবর্তী নামায পড়িতে ও সম্পূর্ণ করিয়া লইতে হইবে এবং এই ভুলের হিসাবে পরবর্তী নামায পড়িতে ও সম্পূর্ণ করিয়া লইতে হইবে এবং এই ভুলের নিমিত্ত আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে সিজদা দিতে হইবে। সাহু সিজদার এই ব্যবস্থার একটা প্রবল মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া সুস্পষ্ট। ইহা দ্বারা নামাযী আল্লাহ্র নিকট স্বীকার করে যে, হে আল্লাহু! আমার ভুল হইয়াছে, আমি সে ভুল স্বীকার করিতেছি। স্বীকার করিতেছি এই ভুল হওয়া-নামাযে দাঁড়াইবার পরও মনের লক্ষ্য অন্য কোন দিকে আকৃষ্ট হওয়া-আমার অপরাধ। সে অপরাধ তুমিই মার্জনা করিতে পার; কেননা এই ভুল তোমারই নিকটে হইয়াছে। কিন্তু আমি যেহেতু তোমারই বান্দা। সব ভুল অতিক্রম করিয়া আমি আবার তোমারই সমীপে অবনত হইতেছি।
কাযা নামায
==========================
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেনঃ যে লোক কোন নামায ভুলিয়া যাইবে, সে যেন তাহা পড়ে তখনই ইহা স্মরণ হইবে। সেইজন্য কোন কাফফারা দিতে হইবে না। শুধু উহাই পড়িতে হইবে। (কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে) ‘নামায কায়েম কর আমার স্মরণের জন্য’।
-বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ
ব্যাখ্যা প্রত্যেক নামাযের জন্য সময় নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং সেই নির্দিষ্ট সময়েই নির্দিষ্ট নামায আদায় করা পূর্ণ বয়স্ক মুসলমান মাত্রেরই কর্তব্য। কিন্তু মানুষ স্বাভাবতই দুর্বল। নানা কারণে অনেকের পক্ষেই নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট নামায পড়া কোন কোন সময় সম্ভব নাও হইতে পারে। নামায কাযা হইয়া যাইতে পারে। ইহা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইসলাম আল্লাহ্ তা’আলার বিধান। ইবাদত-বন্দেগীর বিধান তিনি যে মানুষের জন্য দিয়াছেন, সেই মানুষের এই স্বাভাবিক দুর্বলতা ও অক্ষমতার কথা তিনি ভাল করিয়াই জানেন। সেই জন্য যথাসময়ে নির্দিষ্ট নামায কোন কারণে পড়া না হইলে কি করিতে হইবে, তাহার ব্যবস্থা দেওয়া হইয়াছে- পরে নামায ’কাযা’ করা-পড়া।
কোন মুসলমান ইচ্ছা করিয়া নামায কাযা পড়িবে না, ইহা ধারণাতীত ব্যাপার। তবে স্বাভাবিক কারণে বাদ পড়িয়াও যাইতে পারে। তন্মধ্যে একটি কারণ হইল নামাযের কথা ভুলিয়া যাওয়া। উপরিউক্ত হাদীসে এই ভুলিয়া যাওয়ার কথা বলা হইয়াছে। ইহার আর একটি কারণ হইল, নামাযের সময় ঘুমাইয়া থাকা এবং সেই কারণে যথাসময়ে নামায পড়িতে না পারা। হযরত কাতাদা (রা) হইতে বর্ণিত হাদীসে সেই কথা বলা হইয়াছেঃ ====== কিংবা নামায না পড়িয়া ঘুমাইয়া থাকিলে-ঘুমাইয়া থাকার দরুন নামায না পড়িয়া থাকিলে ঘুম হইতে উঠিয়াই সেই নামায পড়িতে হইবে। মুসলিম শরীফেরই অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
========================
তোমাদের কেহ যদি নামায না পড়িয়া ঘুমাইয়া থাকে, তবে যখন ঘুম হইতে জাগিবে, তখন কিংবা যদি বেখেয়াল হইয়া পড়ার দরুন নামায যথাসময়ে না পড়িয়া থাকে তবে যখন উহার কথা স্মরণ হইবে, তখন তাহা পড়িবে। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা বলিয়াছেনঃ ‘আমার কথা স্মরণ হইলেই নামায কায়েম কর।’
নাসায়ী শরীফে উদ্ধৃত হাদীসের ভাষা হইলঃ
==========================
কিংবা যদি নামায সম্পর্কে বেখেয়াল হইয়া থাকে, তাহা হইলে উহার কাফফারা হইল-যখনই স্মরণ হইবে তখনই তাহা পড়িবে।
প্রশ্ন হইতে পারে, এইসব আয়াত ও হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, স্মরণ হওয়া মাত্রই কাযা নামায পড়িয়া ফেলিতে হইবে অথচ কাযা নামায পড়ার জন্য বিশাল সময় রহিয়াছে, যে কোন সময় পড়িলেই হয়। ইহার জওয়াব এই যে, উহার কথা যখন স্মরণ হইবে ও দীর্ঘ সময় এই স্মরণ জাগরূক থাকিবে, এই সময়ের মধ্যে যে কোন সময় উহা পড়িলেই আয়াত ও হাদীস অনুযায়ী কাজ হইবে। স্মরণ হইলে ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই ও এক মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়াই যে পড়িতে হইবে, শরীয়াত এমন কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নাই, একথা সত্য। তবে নামায ‘কাযা’ হইয়াছে-পড়া হয় নাই, কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নাই, একথা যদি স্মরণই না থাকে, তাহা হইলে উহা যে কখনই পড়া হইবে না ইহাতেও কোন সন্দেহ নাই। কাজেই কুরআন ও হাদীসে যে এই স্মরণের কথা বলা হইয়াছে, তাহা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
‘উহার জন্য কোন কাফফারা দিতে হইবে না-শুধু উহাই পড়িতে হইবে’ কথাটির অর্থ হইল, নামায সময়মত পড়া হয় নাই কিংবা ঘুমাইয়া থাকার দারুণ পড়া হয় নাই-এই অপরাধের জন্য কোন কাফফারা-কোন দান-খয়রাত দিতে হইবে না। বেশী নামাযও পড়িতে হইবে না। না-পড়া নামায পরে যে কোন সময় পড়িয়া ফেলিলেই এতদসংক্রান্ত যাবতীয় করণীয় সম্পন্ন হইয়া যাইবে ইবরাহীম নখয়ী বলিয়াছেনঃ
=================
যে কোন কোন এক নামায বিশ বছর পর্যন্ত পড়ে নাই, সেও সেই এক নামায ছাড়া আর কিছুই পড়িবে না।
এই হাদীস হইতে জানা যায়, ভুলিয়া যাওয়া কিংবা ঘুমের কারণে না পড়া নামায পড়িবার জন্য ইসলামে-কুরআন ও হাদীসে-বিশেষ তাকীদ রহিয়াছে। এইজন্য অবশ্য কোন গুনাহ হইবে না। সেই নামায সংখ্যায় বেশী হউক, কি এম হউক।
===================
সমগ্র শরীয়াতবিদদের ইহাই মত এবং এই সম্পর্কে তাঁহাদের মধ্যে পূর্ণ মতৈক্য বিদ্যমান।
আর যদি কেহ ইচ্ছা করিয়াও কোন নামায সময়মত না পড়ে, তবে তাহারও কাযা করা কর্তব্য। কোন বিষয়ে ওযরের কারণেও যদি নামায ‘কাযা’ হইয়া যায়, তবে সেই ওযর দূর হইয়া গেলে তাহা পড়িতে হইবে।
এই হাদীস হইতে এই কথাও স্পষ্ট হয় যে নামাযে ক্ষতিটা কোন ধনমাল বা টাকা-পয়সা দ্বারা পূরণ হইতে পারে না-যেমন রোযার ক্ষতিপূরণ হইতে পারে। তবে যদি কাহারও অনেক নামায আদায় থাকিয়া যাওয়া অবস্থায় মৃত্যু ঘটিয়া যায় এবং উহার ফিদইয়া দেওয়ার জন্য সে অসীয়ত করিয়া গিয়া থাকে তবে তাহার কথা স্বতন্ত্র। এই ফিদইয়া দেওয়া না-জায়েয নয়। ======
কাযা নামায পড়ার পরস্পরা
=======================
হযরত জাবির (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত উমর (রা) পড়িখা যুদ্ধের দিন কুরাইশ কাফিরদিগকে গালমন্দ বলিতে লাগিলেন এবং বলিলেনঃ হে রাসূলুল্লাহ! আমি আসরের নামায পড়িতে পারি নাই, ইতিমধ্যে সূর্য অস্ত গিয়াছে। অতঃপর আমরা বুতহান উপত্যকায় উপস্থিত হইলাম। তখন হযরত উমর নামায পড়িলেন সূর্য অস্ত যাওয়ার পর। তাহার পরই মাগরিব পড়িলেন।
-বুখারী
ব্যাখ্যা এই হাদীসে হযরত উমর (রা)-এর আসরের নামায কাযা হইয়া যাওয়ার স্পষ্ট উল্লেখ রহিয়াছে। ইহা খন্দক বা পরিখা যুদ্ধকালীন ঘটনা। এই যুদ্ধ হিজরতের চতুর্থ বৎসরে অনুষ্ঠিত হয়। সারাদিন ঘোরতর যুদ্ধ চলে এবং মুসলিম বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া থাকে। এইভাবে আসরের নামায যথাসময়ে পড়া তাঁহাদের পক্ষে সম্ভবপর হয় নাই। তখন হযরত উমর (রা) কুরাইশ কাফিরদের প্রতি গালমন্দ বর্ষণ করিতে লাগিলেন। কেননা আসরের নামায সময়মত পড়িতে না পারা ও উহা কাযা হইয়া যাওয়ার একমাত্র কারণ তাহারাই। তখন নবী করীম (স)-কে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলিলেন; ইয়া রাসূল। আমি আসরের নামায পড়িতে পারি নাই, ইতিমধ্যে সূর্য অস্ত গিয়াছে। হযরত জাবির বর্ণিত ও বুখারী উদ্ধৃত অপর একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
=============== আল্লাহ্র কসম! আমিও তো আসর পড়িতে পারি নাই।
অতপর মুজাহিদদের এইক কাফেলা বুতহান নামক মদীনার এক উপত্যকায় উপনীত হয় এবং সেখানেই আসরের নামায হয়। এই দিন আসলে কত ওয়াক্ত নামায কাযা হইয়াছিল, এই বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে। ‘মুয়াত্তা’ হাদীস গ্রন্থে বলা হইয়াছেঃ
================ এই দিন যুহর ও আসর-এই দুই নামাযই কাযা হইয়াছিল। আর হযরত আবূ সাউদ খুদরী বর্ণিত এই হাদীসে বলা হইয়াছে, যুহর, আসর ও মাগরিব-এই তিন ওয়াক্তের নামায কাযা হইয়াছিল। নাসায়ী উদ্ধৃত বর্ণনার ভাষা হইলঃ
=========================
আমরা এইদন যুহর, আসর, মাগরিব ও এশা-এই চার ওয়াক্তের নামায হইতে বিরত থাকিতে বাধ্য হইয়াছিলাম।
ইহারই সমর্থন পাওয়া যায় তিরমিযী উদ্ধৃত হাদীসে। তাহাতে বলা হইয়াছেঃ
========================
পরিখা যুদ্ধের দিন মুশরিকরা নবী করীম (স) ও সাহাবীদিগকে চার ওয়াক্তের নামায পড়িতে দেয় নাই।
প্রথমোদ্ধৃত হাদীস হইতে জানা যায়, হযরত উমর (রা)-এর একার আসরের নামায কাযা হইয়া গিয়াছিল। সূর্যাস্তের পর তিনি প্রথমে আসর পড়িলেন ো পরে মাগরিব। আর অপর বর্ণনাটি হতে জানা যায়, রাসূলে করীম (স)সহ সব মুসলমানেরাই শুধু আসর কিংবা যুহর-আসর-মাগরিব-এশা এই কয় ওয়াক্তের নামায কাযা হইয়া গিয়াছিল এবং পরে বুতহান উপত্যকায় উপস্থিত হইয়া সকলে জামা’আতের সহিত এই সব নামায একেরপর এক আদায় করিলেন। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
=====================
এই হাদীস হইতে জানা যায় যে, না-পড়া নামায ও উপস্থিত সময়ের নামায পরস্পরা সহকারে আদায় করা কর্তব্য।
অর্থাৎ প্রথমে না-পড়া নামায একের পর এক পড়িতে হইবে এবং তাহার পর পড়িবে উপস্থিত সময়ের নামায। হযরত উমর (রা) হইতে ইমাম বায়হাকী উদ্ধৃত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ যদি এমন হয় যে, কেহ কোন নামায ভুলবশত পড়ে নাই। পরবর্তী নামায ইমামের সঙ্গে পড়ার সময় সেই কথা তাহার স্মরণ হয়, তবে সে চলতি নামায সম্পূর্ণ করার পর সেই কাযা নামায পড়িবে। তাহার পর আবার সেই ওয়াক্তের নামায দুহ্রাইবে।
নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
===========================
যাহার কোন নামায না-পড়া রহিয়াছে উহা না পড়া পর্যন্ত পরবর্তী কোন নামায তাহার আদায় হইবে না।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল অবশ্য এই হাদীসটির যথার্থতা অস্বীকার করিয়াছেন।
কসর নামায
==============
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, সর্বপ্রথম নামায দুই রাখ্’আত করিয়া ফরয করা হইয়াছিল। পরে বিদেশ ভ্রমণকালীন নামায এই দুই রাক্’আত-ই বহাল রাখা হয় এবং ঘরে উপস্থিতকালীন নামায সম্পূর্ণ করা হয়।
-বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী
ব্যাখ্যা নামাযের রাক্’আত নির্দিষ্ট হওয়ার ইহা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই হাদীস স্পষ্ট ভাষায় বলিতেছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রত্যেক ওয়াক্তে প্রথমত দুই দুই রাক্’আত করিয়া ফরয করা হইয়াছিল। অবশ্য মাগরিবের নামায ইহার বাহিরে ছিল। উহা শুরুতেই তিন রাক্’আত নির্দিষ্ট হয়। পরে মাগরিব ও ফজর ছাড়া অবশিষ্ট তিন ওয়াক্তের নামায চার চার রাক্’আত করিয়া ফরয করিয়া দেওয়া হয়। ্ হাদীস হইতে এই কথাও জানা যায় যে, অবস্থার পার্থক্যের প্রতি লক্ষ্য করিয়াই এইরূপ করা হইয়াছে। ফযরকালে মাগরিব ছাড়া আর সব ফরয নামাযই দুই রাক্’আত করিয়া পড়িতে হয়। এই পর্যায়ে হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হ্ইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ
=========================
রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি সর্বপ্রথম মাগরিব ছাড়া অন্যান্য নামায দুই দুই রাক্’আত করিয়া ফরয করা হইয়াছিল।
রাক্’আত বৃদ্ধি করার ইতিহাস বলিতে গিয়া তিনি বলিয়াছেনঃ
==========================
আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি মক্কা শরীফে মাগরিব ছাড়া অন্যান্য সব নামায দুই-দুই রাক্’আত করিয়া ফরয করেন। পরে তিনি যখন মদীনায় হিজরত করেন, তখন ফজরের নামায ছাড়া অন্যান্য নামাযে দুই-দুই রাক্’আত করিয়া অতিরিক্ত বৃদ্ধি করিয়া দেন।
দোলাবী বলিয়াছেন, হিজরত করিয়া মদীনায় পৌঁছার এক মাস পরেরবীউসসানী মাসের ১২ তারিখ সোমবার দিনগত রাত্রে যুহর নামাযের দুই রাক্’আতের সহিত আরও দুই রাক্’আত যোগ করিয়া উহাকে সম্পূর্ণ করিয়া দেওয়া হয়। আর সফরকালীন নামায পূর্ব নির্ধারিত দুই রাক্’আতই বহাল রাখা হয়।
মহলব বলিয়াছেন, মাগরিবের নামায প্রথমেই এককভাবে তিন রাক্’আত ফরয করা হইয়াছিল।
এইসব হাদীসের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞগণ মত প্রকাশ করিয়াছেন, সফরকালে মূলত দুই রাক্’আত নামাযই ফরয। এই সময় দুই রাক্’আতের পরিবর্তে চার রাক্’আত পড়া কাহারও পক্ষে জায়েয হইতে পারে না-চার রাক্’আত বিশিষ্ট নামাযে। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে অকাট্য ভঙ্গীতে বলিয়াছেন, মুসাফিরের জন্য মাত্র দুই রাক্’আত নামাযই ফরয। আর সে কয় রাক্’আত ফরয তাহাই তো পড়া যাইতে পারে। উহার বেশীও নয় কমও নয়। নিজের ঘরেও নিজের দেশে উপস্থিত ব্যক্তির জন্য যেমন চার রাক্’আতের স্থানে পাঁচ রাক্’আত কিংবা তিন রাক্’আত পড়া জায়েয নয়-পড়িলে নামায হইবে না। ঠিক তেমনি নিজের ঘরের বাহিরে বিদেশ গমনকারী ব্যক্তির জন্যও চার রাক্’আতের স্থানে দুই রাক্’আতের বেশী পড়া জায়েয হইতে পারে না।।
হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) বলিয়াছেনঃ
========================
সফরকালে চার রাক্’আতের নামাযে মাত্র দুই রাক্’আত নামায। ইহার অন্যথা কিছুতেই সহীহ হইতে পারে না।
ইমাম আবু হানীফা (র) ও তাঁহার সঙ্গীদ্বয় এবং ইমাম মালিক এই রায় প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম মালিক (রা) বলিয়াছেনঃ
=====================
সফরকালে যে লোক পূর্ণ নামায পড়িবে (কসর করিবে না, দুই রাক্’আতের পরিবর্তে চার রাক্’আত পড়িবে), সে যেন যথাসময়ে উহা আবার ঠিকমত পড়িয়া লয়।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) এই বক্তব্যই রাখিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
======================
তোমাদের নবীর (স) কথা অনুযায়ী সফরকালে দুই রাক্’আত নামাযই সম্পূর্ণ নামায, সম্পূর্ণ নয়।
ইহারই সমর্থন পাওয়া যায় হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর কথায়। তিনি বলিয়াছেনঃ
=======================
আল্লাহ্ তা’আলা নিজ বাড়ীতে উপস্থিত থাকা অবস্থায় তোমাদের নবীর (স) প্রতি চার রাক্’আত আর সফলকালে দুই রাক্’আত নামায ফরয করিয়াছেন।
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
==========================
সফরকালীন নামায দুই রাক্’আত। যে লোক এই নিয়ম তরক করিবে সে কুফরী করিবে। ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য কতিপয় ফকীহ মত ব্যক্ত করিয়াছেনঃ
================
ইহা রিয়াত দেওয়া হইয়াছে মাত্র। কিন্তু পূর্ণ রাক্’আতের নামায পড়াই উত্তম।
ইহারা হাদীসের ==== শব্দের অর্থ করিয়াছেন ==== অর্থাৎ তাঁহারা বলেন, দুই রাক্’আত ‘ফরয করা হয় নাই, পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হইয়াছে মাত্র।’ আর ইহা অবশ্যই পালনীয় নয়। পালন না করিলে গুনাহ হইবে এমন কথাও নয়।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম লিখিয়াছেনঃ নবী করীম (স) যখনই সফরে বাহির হইয়া গিয়াছেন, সেই সময় হইতে পুনরায় মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার সময় পর্যন্ত চার রাক্’আতের স্থানে চিরকাল দুই রাক্’আতই পড়িয়াছেন। তিনি এই সময় কখনও চার রাক্’আত পড়িয়াছেন, তাহা কোন বর্ণনাসূত্রে প্রমাণিত হয় নাই। ============
======================
ইয়া’লা ইবনে উমাইয়্যা হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)-কে কুরআন মজীদের আয়াতঃ ‘নামায কসর’ করিলে তোমাদের কোন দোষ হইবে না। ’যদি তোমরা ভয় পাও যে, কাফিররা তোমাদিগকে বিপদে ফেলিবে’ সম্পর্কে বলিলামঃ এখন তো লোকেরা সম্পূর্ণ ভয়মুক্ত হইয়াছে (এখন ইহার ব্যবহারিকতা কি?) তখন তিনি বলিলেন তুমি যেরূপ বিস্ময় বোধ করিতেছ, আমিও এই আয়াত সম্পর্কে বিস্ময় বোধ করিয়াছিলাম। পরে আমি রাসূলে করীম (স)-কে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি। উত্তরে তিনি বলিয়াছিলেনঃ ইহা এমন একটি বিশেষ দান, যাহা আল্লাহ্ তা’আলাই তোমাদিগকে দিয়াছেনঃ অতএব তোমরা আল্লাহ্র এই দান গ্রহণ কর।
-মুসলিম
ব্যাখ্যা হাদীসটিতে কুরআন মজীদের যে আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, তাহা এইঃ
=======================
তোমরা যখন সফরে বাহির হইবে তখন নামায ‘কসর’ করিলে তোমাদের কোন দোষ হইবে না যদি তোমরা ভয় পাও যে, কাফিররা তোমাদিগকে বিপদে ফেলিবে। নিশ্চয়ই কাফিররা তোমাদের জন্য প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট শত্রু!
এই আয়াতটি ‘কসর’ নামাযের মূল ভিত্তি। কিন্তু ইহাতে নামায ‘কসর’ করার অর্থ চার রাক্’আতের স্থলে দুই রাক্’আত পড়ার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে একটি সুস্পষ্ট শর্তের ভিত্তিতে। শর্তটি হইলঃ ‘যদি তোমরা ভয় পাও যে কাফিররা তোমাদিগকে বিপদে ফেলিবে’। ইহার অর্থ দাঁড়ায় যে, কাফিরদের পক্ষ হইতে বিপদের কোন ভয় না থাকিলে নামাযের ‘কসর’ করার অনুমতি নাই। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সাধারণ বিদেশ সফর ব্যাপদেশে কোনরূপ ভয় ভীতি বা বিপদ কষ্ট ব্যতিরেকেই ‘কসর’ নামায পড়া হইতেছে। ইহার দরুন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। ইয়া’লা ইবনে উমাইয়্যা তাবেয়ী’র মনে এই প্রশ্ন জাগিয়াছিল। তিনি ইহা নিরসনের জন্য হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)-কে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলেন। এই জিজ্ঞাসার জওয়োব তিনি বলিয়াছিলেনঃ তোমার ন্যায় আমার মনেও এইরূপ প্রশ্ন বা বিস্ময়ের উদ্রেক হইয়াছিল। ইহার মীমাংসার জন্য আমি স্বয়ঙ রাসূলে করীম (স)-এর সম্মুখে বিষয়টি পেশ করি। রাসূলে করীম (স) জওয়াবে শুধু এতটুকুই বলিলেনঃ সফরকালে ‘কসর’ নামাযের অনুমতিটা আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ। অতএব তোমাদের প্রতি দেওয়া আল্লাহ্র এই অনুগ্রহ তোমাদের সাদরে ও সাগ্রহে গ্রহণ করা উচিত।
রাসূলে করীম (সা)-এর এই জওয়াব হইতে দুইটি কথা জানা যায়। একটি এই যে, নিরাপদকালীন সফলকালে ‘কসর’ নামায পড়ার অনুমতি উদ্ধৃত আয়াত হইতে প্রমাণিত নয়। কেননা আয়াতে তো এই অনুমতি শর্তহীন, শর্তভিত্তিক নয়। কাজেই ভয়-ভীতিহীন সময়ের সফরে নামায ‘কসর’ করা কুরআন হইতে প্রমাণিত, এই কথা কিছুতেই বলা যায় না।
বরং বলিতে হইবে যে উহা রাসূলে সুন্নাত-রাসূলের অনুসৃত নীতি ও কার্যক্রম হইতে প্রমাণিত। এই কারণে ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ
=========================
ভয়-ভীতিমুক্ত সফরকালে নামায ‘কসর’ করা রাসূলের সুন্নাত হইতে প্রমাণিত (কুরআন হইতে নয়); আর ভয়-ভীতি সংকুল সফরে ‘কসর’ নামায কুরআন ও সুন্নাত উভয় দলীলের দ্বারা প্রমাণিত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-কে একটি লোক জিজ্ঞাসা করিলঃ আমরা কুরআনে ভয়কালীন নামাযের কথা ও নিজ বাড়ীতে উপস্থিত থাকাকালীন নামাযের কথা পাই। কিন্তু সফরকালীন নামাযের কথা পাই না। ইহার কারণ কি? আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলিলেনঃ
=========================
হে ভ্রাতুষ্পুত্র! আল্লাহ্ তা’আলা হযরত মুহাম্মাদ (স)-কে আমাদের প্রতি প্রেরণ করিয়াছেন- আমরা কিছুই জানিতাম না। কাজেই আমরা তাঁহাকে যেভাবে যাহা করিতে দেখি আমরা তাহাই সেইভাবে করি।
এই হাদীস অনুযায়ীও ভয়হীন সফরকালের কসর নামায রাসূলের ‘সুন্নত’ হইতে প্রমাণিত, কুরআনে উহার উল্লেখ নাই।
হযরত উমরের বর্ণিত যে হাদীসটি উপরে উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা হইতে দ্বিতীয় কথাটি জানা যায়। কসর-সংক্রান্ত আয়াতটি সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি ভয়মুক্ত সফরকালীন ‘কসর’ নামায সেই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত সে দাবি করেন নাই। তিনি বলিয়াছেনঃ ইহা আল্লাহ্র অনুগ্রহের দান। ইহা হইতে বুঝা যায়ঃ
===========================
আল্লাহ্ তা’আলা একটি কাজ কুরআনে মুবাহ বা জায়েয করেন শর্তাধীন। পরে তাঁহার নবীর মুখের কথার মাধ্যমে উহাকেই মুবাহ করেন সেই শর্ত ব্যাতিরেকেই।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এক প্রশ্নের জওয়াবে এই ‘কসর’ নামাযকে ===== ‘নবী করীমের সুন্নাত’ নামে অভিহিত করিয়াছেন।
সফরকালে নামায ‘কসর’ করা সম্পর্কে আর একটি প্রশ্ন হইল, এই সফর কতটা দূরের হইতে হইবে? নিজের বাড়ী হইতে কতটা দূরে যাওয়ার জন্য বাহির হইলে নামায কসর করা জায়েয হইবে?
ইয়াহ্ইয়া ইবনে ইয়াযীদ হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা)-কে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি বলেনঃ
===========================
রাসূলে করীম (স) যখন তিন মাইল কিংবা তিন ফরসখ পথ চলিয়া যাইতেন, (শু’বা জনৈক বর্ণনাকারী; তাঁহার মনে এ বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক হইয়াছে) তখন তিনি চার আক্’আতের স্থলে দুই রাক্’আত পড়িতেন।
এই হাদীসটিতে ‘তিন মাইল’ কি ‘তিন ফরসখ’ [‘ফরখস’ অর্থ তিন মাইল কিংবা বারো হাজার গজ। ইহা প্রায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ।] ========= বলিয়া সন্দেহ প্রকাশ করা হইয়াছে বিধায় ইহার ভিত্তিতে দূরত্বের বিশেষ কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট করা যায় না। হযরত আনাস (রা) সম্পর্কে বলা হইয়াছে, তিনি পনেরো মাইল পথের দূরত্বের জন্য সফরে বাহির হইলে ‘কসর’ করিতেন। হযরত আলী (রা) সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি ‘নখলিস্তান’ নামক স্থানে গমন করিয়াছেন এবং সেখানে তিনি যুহর নামায দুই রাক্’আত পড়াইয়াছেন। আবার সেই দিনই মদীনায় প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। হযরত জাবির (রা) বলিয়াছেনঃ
আমি মক্কা হইতে আরফা ময়দানে গেলেও ‘কসর’ নামায পড়ি।=====================
হযরত ইবনে আব্বাস ও হযরত ইবনে উমর (রা) ৪৮ মাইল পথের সফরে ‘কসর’ নামায পড়িতেন ও রোযা ভাঙ্গিতেন।
– বুখারী
দাউদ যাহেরী বলিয়াছেনঃ
====================
সব রকমের সফরেই ‘কসর’ পড়া যাইবে, তাহা ছোট হউক কি দীর্ঘ হউক।- তফসীরে কুরতুবী
ইহা হইতে স্পষ্ট হয় যে, ‘কসর’ নামায পড়ার সফরের দূরত্ব সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরামের নিকট কোন নির্দিষ্ট পরিমাপ বা পরিমাণ ছিল না। তাই মনে হয় দুরত্বটারও কথা নয়। যাহা সফর নামে অভিহিত হইতে পারে তাহাতেই ‘কসর’ করা যাইবে। ইমাম ইবনে কায়্যিম এবং বর্তমান কালের প্রখ্যাত ও বিশেষজ্ঞ আলিমদের এহাই স্থির সিদ্ধান্ত। ===============
জানাযার নামায
======================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) নাজাশীর মৃত্যুসংবাদ পাইলেন ও লোকদিগকে জানাইলেন, যেদিন তিনি মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। পরে নবী করীম (স) নামায পড়ার স্থানে বাহির হইয়া আসিলেন। অতঃপর লোকদের কাতারবন্দী করিলেন এবং চার তাকবীর বলিলেন।
– বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ্
ব্যাখ্যা প্রখ্যাত সিহাহ্ সিত্তা-ছয়খানি প্রধান সহীহ্ হাদীসগ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে। বুখারী শরীফে ইহা দুইটি স্থানে উদ্ধৃত হইয়াছে। ইহা হইতে হাদীসটির গুরুত্ব সহজেই বুঝিতে পারা যায়।
নাজাশী আবিসিনিয়ার বাদশাহ ছিলে। তাঁহার নাম আস্হামা কিংবা আস্মাখা অথবা সাহমা। আবিসিনীয় ভাষায় ইহার অর্থ ‘দান’। সেই দেশের সর্বোচ্চ শাসককে ‘নাজাশী’ নামে অভিহিত করা হইত, যেমন বর্তমান কালে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী বলা হয়। ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ লিখিয়াছেন, নবী করীম (স) ষষ্ঠ হিজরী সনে হুদায়বিয়া হইতে প্রত্যাবর্তন করার পর সপ্তম হিজরীর মুহররম মাসে হযরত আমর ইবনে উমাইয়া আজ-জামারী (রা)-কে চিঠিসহ নাজাশীল নিকট পাঠাইয়াছিলেন। তিনি উহা হাতে লইয়া চোখের উপর রাখিলেন, সিংহাসন হইতে নামিয়া মাটিতে বসিলেন এবং চিঠির উত্তর পাঠাইলেন। তিনি হযরত জা’ফর ইবনে আবূ তালিবের হাতে ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। নবম হিজরী সনের রজব মাসে তাবুক যুদ্ধ হইতে ফিরিয়া আসার পর তাঁহার মৃত্যুর সংবাদ আসে এবং নবী করীম (স) তখন সাহাবাদের সঙ্গে লইয়া তাঁহার জন্য গায়েবানা জানাযার নামায পড়েন।
এই হাদীস হইতে জানা গেল, নাজাশীর মৃত্যুসংবাদ পাইয়া নবী করীম (স) ইহা সাধারণ্যে প্রচার করেন। অতএব কাহারও মৃত্যুসঙবাদ সাধারণ্যে প্রচার করা নাজায়েয নয়! কেননা ইহার ফলেই আত্মীয় অনাত্মীয়, নিকটবর্তী ও দূরবর্তী লোকদের পক্ষে জানাযার নামাযে শরীক হওয়া সম্ভবপর হয় এবং ইহার দরুন জানাযার নামাযে লোকসংখ্যার আধিক্য হইতে পারে। আর ইহা খুবই কল্যাণকর। হযরত যায়দ ও হযরত জা’ফরের শাহাদত প্রাপ্তির সংবাদ নবী করীম (স) নিজেই সাধারণ্যে প্রচার করিয়াছিলেন। অবশ্য জাহিলিয়াতের যুগে প্রচলিত মৃত্যুসংবাদ প্রচার-পদ্ধতি সাধারণভাবেই নিষিদ্ধ। কেননা উহাতে যেমনি বিলাপ করা হইত তেমনি চীৎকার করিয়া বলা হইতঃ আমরা ধ্বংস হইয়া গিয়াছি, কেননা আমাদের অমুক লোকটি মরিয়া গিয়াছে। দ্বিতীয়ত, অনেকের ধারণা ছিল, নাজাশী ইসলাম কবুল করেন নাই। নবী করীম (স) তাঁহার মৃত্যুর খবর প্রচার করিয়া ও সকলকে সঙ্গে লইয়া গায়েবানা জানাযার নামায পড়িয়া এই ধারণার অপনোদন করিলেন।
নবী করীম (স) নাজাশীর মৃত্যুসংবাদ যখন পাইয়াছিলেন তখন তিনি মসজিদে অবস্থান করিতেছিলেন। তখন তিনি সকলকে সঙ্গে লইয়া মসজিদের বাহিরে চলিয়া গেলেন ও বাহিরেই জানাযার নামায পড়িলেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, মসজিদে জানাযার নামায জায়েয নয়। ইমাম আবূ হানীফা (রা) এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম মালিক ও ইবনে আবূ যিব’ও এই মত সমর্থন করিয়াছেন। তবে ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ও আবূ সওর প্রমুখ ফিকাহবিদ বলিয়াছেন, মসজিদে লাশ লাইয়া আসিলে তাহাতে যদি কোনরূপ মালিন্য ও আবর্জনা সৃষ্টির কারণ না ঘটে তাহা হইলে মসজিদে জানাযার নামায পড়ার কোন দোষ নাই। ইহাদের দলীল হইল একটি বর্ণনা। তাহাতে বলা হইয়াছে, হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা) ইন্তেকালে করিলে হযরত আয়েশা (রা) লাশ মসজিদে লইয়া যাইতে নির্দেশ দিলেন এবং সেখানেই জানাযার নামায পড়া হইল। অতঃপর হযরত আয়েশা (রা) জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মসজিদের ভিতরে জানাযার নামায পড়ার লোকেরা কি কিছু আপত্তি জানাইয়াছেন? তাঁহাকে বলা হইল হ্যাঁ। তখন তিনি বলিলেনঃ
================
স্বয়ং নবী করীম (স) হযরত সুহাইয়া ইবনুল বাইদা’র জানাযার নামায মসজিদেই পড়িয়াছিলেন, এই কথা লোকেরা এত শীঘ্র ভুলিয়া গেল কি করিয়া —?
ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, মসজিদে জানাযার নামায স্বয়ং নবী করীম (স) পড়িয়াছেন এবং পরবর্তীকালে হযরত আয়েশা (রা)-ও তদনুসারে ও উহারই দলীলের ভিত্তিতে এই কাজ করিয়াছেন।
অন্য পক্ষ হইতে তাঁহাদের মতের সমর্থনে হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত আরও একটি হাদীস পেশ করা হয়। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
=====================
যেলোক মসজিদে জানাযার নামায পড়ে, তাঁহার জন্য কিছুই নাই।
ইবনে মাজাহ্র বর্ণনায় ইহার ভাষা হইলঃ ==== অর্থ একই। আর ইবনে আবু শায়বার বর্ণনার ভাষা হইল। ===== তাহার নামায নাই-হয়না।
জায়েয ও নাজায়েয প্রমাণকারী এই দলীলদ্বয়ের দ্বন্দ্ব চূড়ান্তভাবে মীমাংসার উদ্দেশ্যে ইমাম তাহাভী বলিয়াছেন, এই দুইটির মধ্যে কোনটি আগে ও কোনটি পরে তাহা জানিতে হইবে। তাহাতে পরেরটি দ্বারা আগেরটি বাতিল হইয়া যাইবে। হযরত আয়েশা বিশুদ্ধ হাদীস নবী করীম (স)-এর একটা আমলের বর্ণনা দিয়াছেন এবং জানা গিয়াছে যে, উহা মুবাহ-নামাযের নয়। এই পর্যায়ে ইহার পূর্বে আর কোন ঘটনা ঘটে নাই। আর হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হাদীসটি র্ব্ণনা করে যে, নবী করীম (স) এই কাজ করিতে নিষেধ করিয়াছেন। অথচ এই নিষেধের পূর্বে ইহার অনুমতি ছিল। ফলে রাসূলের এই বিষেধে হযরত আয়েশা বর্ণিত হাদীসের অনুমতি বাতিল হইয়া গেল। উপরন্তু হযরত আয়েশার কাজ সাহাবায়ে কিরাম সমর্থন করেন নাই বলিয়া এই নিষেধটি আরও বলিষ্ঠ হইয়া উঠে। আর একই বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বর্ণনার মাঝে সামঞ্জস্য সৃষ্টির ইসলামী নীতিসম্মত পন্থা ইহাই হইতে পারে।
এই হাদীস হইতে তৃতীয়ত জানা যায়, জানাযার নামাযেও অন্যান্য নামাযের ন্যায় নামাযীদের কাতার বাঁধিতে হইবে। ইহা সুন্নাত। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
=========================
যে লোকের জানাযা নামায তিন কাতারের নামাযীরা পড়ে, তাহার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়।
চতুর্থ, এই হাদীস হইতে জানা যায় যে, গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েয। ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম নববী বলিয়াছেনঃ ‘মাইয়্যেত যে শহরের বা যে গ্রামের, সেই শহর বা গ্রাম-অর্থাৎ কাছাকাছি এলাকার লোকদের জন্য গায়েবানা জানাযা জায়েয নয়। কিন্তু এই পর্যায়ে একটা বড় প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। তাহা এই যে, রাসূলে করীম (স) নিজেই যখন শরীয়াতের কোন আমল করিয়াছেন, তখন উহা নাজায়েয হইবে কেন? ইহাতে তো রাসূলের অনুসরণ করা এবং সেই কাজকে কোনরূপ খারাপ মনে না করাই কর্তব্য। আর সেই কাজটি কেবলমাত্র রাসূলের জন্য জায়েয ছিল, অন্য কাহারও জন্য জায়েয নয়, এইরূপ বলারও কোন দলীর নাই।
পঞ্চম, জানাযার নামাযে চারিটি তাকবীর। আলোচ্য হাদীস হইতে একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। নবী করীম (স) শেষ পর্যন্ত ইহাই প্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছেন। শিয়া মাযহাবে পাঁচটি তাকবীর স্বীকৃত। ইমাম আহমদ বলিয়াছেন, তাকবীর চারটির কম হওয়া উচিত নয়।
ইমাম বুখারী (র) ‘জানাযা’ পর্যায়ে বর্ণিত হাদীসসমূহের ভিত্তিতে কতকগুলি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। তাহা এইঃ (১) ‘জানাযা’র নামায অন্যান্য নামাযের মতই নামায। কেননা নবী করীম (স) ইহাকে নামায বলিয়াছেন।
একটি হাদীসঃ
============ যে লোক জানাযার উপর নামায পড়ে ———-
দ্বিতীয় হাদীসঃ
================== তোমাদের মৃত সঙ্গীর উপর নামায পড়
তৃতীয় হাদীসঃ
============= নাজাশীর উপর নামায পড়
এই সব কয়টি হাদীসেই জানাযার নামাযকে নবী করীম (স) ‘নামায’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন বুখারী মন্তব্য হইলঃ
===============
নবী করীম (স) ইহাকে নামায বলিয়াছেন। অথচ ইহাতে রুকূ ও সিজদা নাই।
অতএব এই ‘নামায’ পড়াকালে কথাবার্তা বলা যাইবে না। ইহাতে তাকবীর আছে, সালাম ফিরাইয়া নামায শেষ করার ব্যবস্থাও আছে-যেমন সাধারণ নামাযে রহিয়াছে। পরন্তু জানাযার নামায বিনা অযূতে পড়া যায় না। এই ব্যাপারে প্রাচীনকালের ও পরবর্তীকালের সকল ফিকাহবিদই সম্পূর্ণ একমত। আর সাধারণ নামাযের ন্যায় সূর্যোদয়ের ও সূর্যাস্তকালের জানাযার নামায পড়া যায় না। ইহাতে হাত তুলিয়া ==== তাহরীমা বাধিতেঁ হয় সাধারণ নামাযের মতই। হযরত উক্বা ইবনে আমের (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
====================
তিনটি সময়ে (জানাযার) নামায পড়িতে ও আমাদের মৃতদের দাফন করিতে নবী করীম (স) নিষেধ করিতেন। তাহা হইলঃ সূর্যোদয় কাল-যতক্ষণ না সূর্য উপরে উঠিয়া যায়, ঠিক দ্বিপ্রহর কাল-যতক্ষণ না সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলিয়া পড়ে এবং সূর্য যখন অন্ত যাইতে থাকে-যতক্ষণ না পূর্ণমাত্রায় অস্তে চলিয়া যায়।
-মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ
অবশ্য ইমাম শাফেয়ী মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, নামায মাকরুহ হওয়ার এই তিনটি সময়ে জানাযার নামায পড়ার কোন দোষ নাই।
জানাযার নামাযে হাত তুলিয়া তাকবীর বলা কেবলমাত্র শুরুতেই তাহরীমা বাঁধিবার সময় করিতে হয়। পরবর্তী তাকবীরসমূহ বলার সময় হাত তুলিতে হয় না। এই সময়ে হাত তুলিবার সমর্থনে কোন অকাট্য দলীল বা ইজমা’র উল্লেখ করা যায় না। ============
জানাযার নামায ও দাফনে শরীক হওয়া
============================
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোক কোন মুসলমানের জানাযার সহিত ঈমান ও সচেতনতা সহকারে চলিবে এবং তাহার উপর জানাযার নামায পড়া ও তাহাকে দাফন করা পর্যন্ত তাহার সঙ্গে থাকিবে, সে দুই ‘কীরাত’ সওয়াব লাইয়া ফিরিয়া আসিবে। একটি ‘কীরাত’ ওহুদ পাহাড়ের মত বড়। আর যে জানাযার নামায পড়িয়া উহার দাফনের পূর্বেই চলিয়া আসিবে, সে এক ‘কীরাত’ পরিমাণ সওয়াব লইয়া ফিরিয়া আসিবে।
-বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা হাদীসটি হইতে মুসলমানের জানাযার নামায পড়া ও দাফন কার্যে শরীক হওয়ার বিরাট সওয়াবের কথা জানাযায়। একজন মুসলমানের মৃত্যু ঘটিলে অন্যান্য মুসলমান হয় ঘটনাস্থলে যাইবে, গোসল ও কাফটন করানো পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়া এবং জানাযার নামাযে শরীক হইয়াই চলিয়া যাইবে না; বরং কবরস্থান পর্যন্ত গম করিবে ও দাফন কার্যে শরীক ও উপস্থিত থাকিবে। নতুবা জানাযার নামায পড়িয়াই ফিরিয়া আসিবে। এই দুইটি কাজই নিজ নিজ পরিসরে জায়েয। তবে দুইটির মধ্যে সওয়াবের তারতম্য রহিয়াছে। প্রথম ধরনের কাজে-হাদীস অনুযায়ী-দুই ‘কীরাত’ পরিমাণ সওয়াবের অধিকারী হইবে। আর দ্বিতীয় ধরনের কাজে পাইবে মাত্র এক ‘কীরাত’ পরিমিত সওয়াব। ‘কিরাত’ কি, তাহার ব্যাখ্যা মূল হাদীসেই রহিয়াছে। বলা হইয়াছেঃ ====== প্রত্যেকটি কিরাত ওহুদ পর্বত সমান।
ইহা কীরাত-এর শব্দার্থ নয়। কীরাত বলা হয় তদানীন্তন মুদ্রা দীনার-এর একটি অংশ-সাধারণভাবে প্রচলিত এক দীনার-এর এক-দশমাংশের অর্ধেক। আবার কোথাও চব্বিশ ভাগের এক ভাগ। এক থায় কীরাত অর্থ ‘একটি বিরাট অংশ।’ সওয়াব জিনিসটি অবস্তু, আর ওহুদ পর্বত বস্তু। অবস্তু সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে একটা মোটামুটি ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই রূপকের ব্যবহার। আর ওহুদ পর্বতের উল্লেখ এইজন্য যে, মদীনার আশেপাশের পর্বতগুলির মধ্যে ওহুদ পর্বতই সর্বোচ্চ ও প্রকাণ্ড। হাদীসের শব্দে ==== -এর তরজমা করা হইয়াছে ‘ঈমান ও সচেতনতা সহকারে’। অর্থাৎ বর্ধিত সওয়াব পাওয়া যাইবে এই শর্তে যে, প্রথম আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি যথাযথ ঈমান থাকিতে হইবে এবং দ্বিতীয়ত এই কাজটি সওয়াব পাওয়ার নিয়্যতে ও উদ্দেশ্যে হইতে হইবে-লোক দেখানোভাবে কিংবা কোন বিশেষ ব্যক্তির বা শক্তির মনস্তুষ্টি সাধনের উদ্দেশ্যে হইলে চলিবে না। পত্রিকায় ছবি প্রকাশ বা সহৃদয় ব্যক্তিরূপে খ্যাতি অর্জনের মতলবে হইলে কোন সওয়াব পাওয়া যাইবে না। ===========
জানাযা নামাযে চার তাকবীর
=========================
আবদুর রহমান ইবনে আবূ লায়লা হইতে বর্ণিত, তিনি বলিয়াছেন; হযরত যায়দ ইবনে আরকাম (রা) জানাযা নামাযে চারটি তাকবীর বলিতেন। কিন্তু কোন একটি জানাযার নামাযে তিনি পাঁচটি তাকবীর বলিলেন। তখন আমি তাঁহাকে প্রশ্ন করিলাম। জবাবে তিনি বলিলেন, রাসূলে করীম (স) এই কয়টি তাকবীর বলিতেন।
– মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ
ব্যাখ্যা হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছে, হযরত যায়দ ইবনে আরকাম (রা) সাধারণত জানাযার নামাযে চারটি তাকবীরই বলিতেন; কিন্তু একবার পাঁচটি তাবীর বলায় আমি কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম; জবাবে তিনি বলিলেন, নবী করীম (স) এই পাঁচটি তাকবীরই বলিতেন।
ইবনে আবদুল বার তাঁহার ===== গ্রন্থে একটি হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাহাতে বলা হইয়াছেঃ
=======================
নবী করীম (স) জানাযার নামাযে চার, পাঁচ, সাত, আট তাকবার বলিতেন। পরে নাজাশীর মৃত্যু সঙবাদ আসিলে নবী করীম (স) বাহির হইয়া জানাযার নামায পড়িলেন ও তাহাতে চার তাকবীর বলিলেন। অতঃপর এই নিয়মের উপরই তিনি মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল থাকিয়াছেন।
ইহা হইতে বুঝা যায়, প্রথম দিকে জানাযার নামাযে চারটির অধিক তাকবীর বলিলেও নবী করীম (স)-এর শেষ ও স্থায়ী নিয়ম হইল চারটি তাবীর বলা। হযরত জাবির (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
==========================
তোমরা তোমাদের মৃতদের উপর জানাযার নামায পড় রাত্রদিনে। সে ছোট-বড়, নাচ ও ধনী যে-ই হউক-চার তাকবীর সহকারে।
জানাযার নামায প্ড়ার জন্য ইহা নবী করীম (স)-এর সুষ্পষ্ট নির্দেশ। এই নির্দেশ পালন করা মুসলিম জনগণের কর্তব্য। ইহা ফরযে কিফায়া। এই নামাযের জন্য সময় নির্দিষ্ট নাই। দিন-রাত্র যখনই জানাযা আসবে, তখনই জানাযার নামায পড়িতে হইবে। মৃত ব্যক্তি ছোট হউক, বড় হউক, হীন-নীচ বংশের লোক হউক, কি উচ্চ বংশীয় ও ধনী লোকই হউক, তাহাতে কোন পার্থক্য করা যাইবে না। নির্বিশেষে সকল মৃত মুসলমান ব্যক্তির উপরই জানাযার নামায পড়িতে হইবে।
জানাযার নামায চার তাকবীরে সম্পূর্ণ করিতে হয়। ইহাই নবী করীম (স)-এর শেষ হিদায়ত।
ইমাম শাওকানী লিখিয়াছেনঃ
==========================
জানাযার নামাযে চারটি তাকবীর বলার বিধিব্যবস্থা হওয়াই সর্বসাধারণ ফিকাহ্বিদের মত। ইমাম তিরমিযী বলিয়াছেনঃ
========================
রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবী ও অন্যান্য অধিকাঙশ বিশেষজ্ঞের মতে জানাযা নামাযের ইহাই সঠিক নিয়ম। তাঁহারা সকলেই জানাযার নামাযে চারটি তাকবীর দেওয়ার মত পোষণ করিতেন।
কাযী ইয়ায লিখিয়াছেনঃ জানাযার নামাযে তিন হইতে নয়টি তাকবীর দেওয়ার বিভিন্ন মত সাহাবীদের মধ্যে বর্তমান ছিল।
ইবনে আবদুল বার বলিয়াছেনঃ
=======================
শেষ পর্যন্ত চারটি তাকবীর বলার উপরই তাঁহাদের ইজমা হইয়াছে।
সমস্ত ফিকাহ্বিদেরও এই মত। ইবনে আবূ লায়লা ছাড়া আর কেহই চারটির স্থলে পাঁচটি তাকবীর বলার কথা বলেন নাই। =================
জানাযার নামায পড়ার নিয়ম
=====================
আবূ আমামা ইবনে সহল হইতে বর্ণিত, তাঁহাকে রাসূলে করীম (স)-এর একজন সাহাবী সঙবাদ দিয়াছেন যে, জানাযার নিয়ম হইল, ইমাম তাকবীর বলিবে ও প্রথম তাবীরের পর সূরা ফাতিহা পড়িবে নিঃশব্দে ও মনে মনে। ইহার পর নবী করীম (স)-এর উপর দরুদ পড়িবে ও পরবর্তী তাকবীরসমূহ বলার পর মৃতের জন্য খালিস দোয়া করিবে। এই তাকবীরসমূহে অন্য কিছু পড়িবে না। পরে নিঃশব্দে ও মনে মনে সালাম করিবে।
-মুসনাদে শাফেয়ী।
ব্যাখ্যা এই হাদীসে জানাযার নামায পড়ার বিস্তারিত নিয়ম বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। তাহাতে প্রথম তাকবীরের পর সূরা ফাতিহা পড়া, দ্বিতীয় তাকবীরে রাসূলের প্রতি দরুদ পড়ার এবং তৃতীয় তাকবীরের পরে মৃতের জন্য খালিস দোয়া করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। তাবীর ও শেষ সালাম ছাড়া সবই নিঃশব্দে এবং তাহাতে বিভিন্ন দোয়ার উল্লেখ হইয়াছে। হযরত আবু কাতাদাহ (রা) সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছে।
জানাযার নামাযে কি কি পড়া হইবে এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) হইতে বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে এবং তাহাতে বিভিন্ন দোয়ার উল্লেখ হইয়াছে। হযরত আবূ কাতাদাহ (রা) সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছেঃ
===========================
তিনি (হযরত কাতাদাহ) রাসূলে করীম (স)-কে একজন মৃতের জানাযা নামায পড়িতে দেখিলেন। তিনি বলিয়াছেনঃ তখন আমি তাঁহাকে এই দোয়া পড়িতে শুনিলামঃ (উহার অর্থ) হে আল্লাহ্! তুমি ক্ষমা কর আমাদের জীবিত লোকদের, আমাদের মৃত লোকদের, উপস্থিত লোকদের, অনুপস্থিত লোকদের, ছোট বয়স্কদের, বড় বয়স্কদের, আমাদের পুরুষদের ও আমাদের স্ত্রী লোকদের।
– মুসনাদ আহমদ
আবু সালমা’র বর্ণনায় দোয়ার পরবর্তী অংশ এইরূপঃ
=========================
হে আল্লাহ্! তুমি আমাদের মধ্যে যাহাকে বাঁচাইয়া রাখ, তাহাকে ঈমান সহকারে মারো।
এই হাদীসটির সব বর্ণনাকারী বিশ্বাস্য ও নির্ভরযোগ্য বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহা ছাড়া জানাযা নামাযের আরও দোয়া হযরত ইবনে আব্বাস, আবূ হুরায়রা, ইয়াযীদ ইবনে রুকানা ও ওয়াসিলা ইবনে আস্কা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে।
হযরত আবূ মূসা (রা) বলিয়াছেনঃ
=========================
আমরা নবী করীম (স)-এর সহিত ও তাঁহার ইমামতিতে জানাযার নামায পড়িয়াছি। তিনি নামাযের শেষে ডানে ও বামে সালাম ফিরাইয়াছেন।
ইহা হইতে জানা গেল যে, জানাযার নামাযের শেষে সাধারণ নামাযের মতই সালাম ফিরাইতে হয়। কিন্তু এই নামাযে রুকূ ও সিজদা নাই, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।
কবরের উপর জানাযা নামায
=========================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) এমন একটি কবরের নিকট গমন করিলেন, যাহাতে রাত্রিকালে মুর্দার দাফন করা হইয়াছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেনঃ এই মুর্দার কবে দাফন করা হইয়াছে? লোকেরা বলিল, গত রাত্রে। তখন নবী করীম (স) বলিলেন। তোমরা আমাকে জানাও নাই কেন? তাহারা বলিলঃ আমরা ইহাকে রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে দাফন করিয়াছি। সেই সময় আপনাকে নিদ্রা হইতে সজাগ করাটা আমরা অপছন্দ করিয়াছিলাম। অতঃপর তিনি দাঁড়াইলেন, আমরাও তাঁহার পিছনে কাতার বাঁধিলাম। তখন নবী করীম (স) তাহার উপর জানাযার নামায পড়িলেন।
-বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা হাদীসটি হইতে কয়েকটি বিষয়ে শরীয়াতের নীতি জানা যায়। প্রথমত, জানা গেল, রাত্রিকালে মুর্দার দাফন করা জায়েয-তাহাতে কোন দোষ নাই। কেননা নবী করীম (স)-কে যখন বলা হইল, ‘এই মুর্দার রাত্রিকালে, দাফন করা হইয়াছে, তখন তিনি এজন্য কোন আপত্তি জানান নাই বা এমন কোন কথা বলেন নাই, যাহা হইতে বুঝা যাইতে পারে যে, রাত্রিকালে মুর্দার দাফন করা জায়েয নহে। অবশ্য তাঁহাকে না জানাইয়া দাফন করার কারণে তিনি ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন। বলিয়াছেনঃ ‘তোমরা আমাকে জানাইয়া দাফন করিলে না কেন? দ্বিতীয় নীতি এই যে, দাফন করার পর কবরের উপর জানাযার নামায পড়া যায় এবং তৃতীয় এই যে, জানাযার নামায জামা’আতের সহিত পড়া অতীব উত্তম কাজ। আর এই কয়টি বিসয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে কোন মতভেদ নাই। কেবলমাত্র ইমাম হাসান বসরী এই ক্ষেত্রে ভিন্ন মত প্রকাশ করিয়াছেন এবং কতিপয় শাফেয়ী আলিম তাঁহার মতকে সমর্থন জানাইয়াছেন।
এই হাদীসটির মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত বর্ণনায় উল্লেখ করা হইয়াছে যে, রাত্রিকালেই কোনরূপ ওযর না থাকা সত্ত্বেও লোকটিকে জানাযার নামায না পড়িয়াই দাফন করা হইয়াছিল বলিয়াই নবী করীম (স) লোকদিগকে তীব্র ভাষায় ধমকাইয়াছেন। এই ধমকানো রাত্রিকালে দাফন করার কারণে নয়, বরং জানাযার নামায না পড়িয়াই যদি মুর্দার দাফন করা হয়, তাহা হইলে পরে কবরের উপর জানাযার নামায পড়া জায়েয, আলোচ্য হাদীস হইতে একথা প্রমাণিত। ======