রোযা
রমযান মাসের আগমন
=============================
হযরত সালমান ফররসী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) শাবান মাসের শেষ দিন আমাদের-সাহাবাদের-সম্বোধন করিয়া ভাষণ দেন। তাহাতে তিনি বলিলেন জনগণ! এক মহাপবিত্র ও বরকতের মাস তোমাদের উপর ছায়া বিস্তার করিয়াছে। এই মাসের একটি রাত্র বরকত ও ফযীলত-মাহাত্ম্য ও মর্যাদার দিক দিয়া সহস্র মাস অপেক্ষাও উত্তম। এই মাসের রোযা আল্লাহ্ তা’আলা ফরয করিয়াছেন এবং ইহার রাত্রগুলিতে আল্লাহ্র সম্মুখে দাঁড়ানোকে নফল ইবাদতরূপে নির্দিষ্ট করিয়াছেন। যে লোক এই রাত্রে আল্লাহ্র সন্তোষ ও তাঁহার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোন অ-ফরয ইবাদত-সুন্নাত বা নফল-আদায় করিবে, তাহাকে ইহার জন্য অন্যান্য সময়ের ফরয ইবাদতের সমান সওয়াব দেওয়া হইবে। আর যে লোক এই মাসে ফরয আদায় করিবে, সে অন্যান্য সময়ের সত্তরটি ফরয ইবাদতের সমান সওয়াব পাইবে।
ইহা সবর, ধৈর্য্য ও তিতিক্ষার মাস। আর সবরের প্রতিফল আল্লাহ্র নিকট জান্নাত পাওয়া যাইবে। ইহা পরস্পর সহৃদয়তা ও সৌজন্য প্রদর্শনের মহিমা। এই মাসে মুমিনের রিয্ক প্রশস্ত করিয়া দেওয়া হয়। এই মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাইবে, তাহার ফলস্বরূপ তাহার গুনাহ ক্ষমা করিয়া দেওয়া হইবে ও জাহান্নাম হইতে তাহাকে নিষ্কৃতি দান করা হইবে। আর তাহাকে আসল রোযাদারের সমান সওয়াব দেওয়া হইবে: কিন্তু সেজন্য আসল রোযাদারের সওয়াব কিছুমাত্র কম করা হইবে না। আমরা নিবেদন করিলাম, হে রাসূল! আমাদের মধ্যে প্রত্যেকই রোযাদারকে ইফতার করাইবার সামর্থ রাখে না। (এই দরিদ্র লোকেরা এই সওয়াব কিভাবে পাইতে পারে? তখন রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ যে লোক রোযাদারকে একটি খেজুর, দুধ বা এক গণ্ডুষ সাদা পানি দ্বারাও ইফতার করাইবে, সে লোককেও আল্লাহ্ তা’আলা এই সওয়াবই দান করিবেন। আর যে লোক একজন রোযাদারকে পূর্ণ মাত্রায় পরিতৃপ্ত করিবে, আল্লাহ্ তা’আলা তাহাকে আমার ‘হাওয’ হইতে এমন পানীয় পান করাইবেন, যাহার ফলে জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সে কখনো পিপাসার্ত হইবে না।
ইহা এমন এক মাস যে, ইহার প্রথম দশদিন রহমতের বারিধারায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় দশদিন ক্ষমা ও মার্জনার জন্য এবং শেষ দশদিন জাহান্নাম হইতে মুক্তি লাভের উপায়রূপে নির্দিষ্ট।
আর যে লোক এই মাসে নিজের অধীন লোকদের শ্রম-মেহনত হাল্কা বা হ্রাস করিয়া দিবে, আল্লাহ্ তা’আলা তাহাকে ক্ষমা দান করিবেন এবং তাহাকে দোযখ হইতে নিষ্কৃতি ও মুক্তিদান করিবেন।
-বায়হাকী-শুআবিল ইমান
ব্যাখ্যা উপরোদ্ধৃত হাদীসটি হযরত রাসূলে করীম (স)-এর একটি দীর্ঘ ভাষণ। ভাষণটিতে রমযান মাস আগমনের সুসংবাদ প্রদান করা হইয়াছে। ইহাকে এই মাসটির সম্বর্ধনা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। রমযান মুসলিম জাহানের জন্য এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসের আগমনে মুসলিম জীবন ও সমাজে একটা বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এই দৃষ্টিতেই রাসূলে করীম (স)-এর এই মূল্যবান ভাষণটি বিবেচ্য।
ভাষণটি প্রাঞ্জল। ইহার তাৎপর্যের তেমন কোন জটিলতা নাই। ইহা সত্ত্বেও কয়েকটি অংশের ব্যাখ্যা প্রদান করা আবশ্যক।
এই ভাষণে সর্বপ্রথম রমযান মাসকে ‘একটি বিরাট মর্যাদাপূর্ণ মাস’ বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে। বস্তুত রমযান মাসের অপরিসীম গুরুত্ব কুরআন মজীদেও স্বীকৃত। আল্লাহ্ তা’আলা নিজেই ইরশাদ করিয়াছেনঃ
=========================
রমযান মাস এমন একটি মাস যে, এই মাসেই কুরআন মজীদ নাযিল হইয়াছে।
কুরআনের এই বাক্য হইতেই রমযান মাসের বিরাট মাহাত্ম্য স্পষ্ট হইয়া উঠে। এই মাসে কেবল যে কুরআন শরীফ নাযিল হইয়াছে তাহাই নয়, অন্যান্য বহু আসমানী কিতাবও এই মাসেই অবতীর্ণ হইয়াছে। রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
===========================
হযরত ইবরাহীমের সহীফাসমূহ রমযান মাসের প্রথম রাত্রিতে নাযিল হইয়াছে। তওরাত কিতাব রমযানের ছয় তারিখ দিবাগত রাত্রে, ইনজীল এই মাসের তের তারিখে এবং কুরআন শরীফ রমযান মাসের চব্বিশ তারিখে নাযিল করা হইয়াছে।
বস্তুত আল্লাহ্র কিতাবসমূহ নাযিল হওয়ার সহিত রমযান মাসের বিশেষ সম্পর্ক রহিয়াছে। এই কারণে এই মাসের রোযা থাকাও ফরয দেওয়া হইয়াছে। কুরআনের পূর্বোদ্ধৃত আয়াতের পরবর্তী বাক্যে বলা হইয়াছেঃ
=======================
যে লোক এই মাসটি পাইবে, সে যেন অবশ্যই এই মাসের রোযা রাখা ফরয করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহা দ্বিতীয় হিজরী সনের কথা। মুসলমানগণ ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ও আল্লাহ্র হুকুম-আহকাম পালনে দৃঢ় এবং আল্লাহর আনুগত্যে অপরিসীম নিষ্ঠাবান হইয়া গড়িয়া উঠার পরই রোযার মত একটি কষ্টসাধ্য ফরয পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ইহাতে আল্লাহ্র বিজ্ঞানসম্মত কর্মনীতির মাহাত্ম্য স্পষ্ট হইয়া উঠে।
আলোচ্য হাদীসে রমযান মাসের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা সম্পর্কে প্রথম যে কথাটি বলা হইয়াছে, তাহা হইলঃ ‘এই মাসে এমন একটি রাত আসে, যাহা হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম।’ এই রাত্রিটি হইল ‘কুদর’-এর রাত্রি। এই সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে।
====================== ‘কদর’ রাত্রি হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। এক হাজার মাসে প্রায় ত্রিশ হাজার রাত্রি আসে। কদর রাত্রিটি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম হওয়ার অর্থ এই যে, আল্লাহ্নুহত্য ও আল্লাহ্র সন্তোষ লাভেচ্ছু লোকেরা এই একটি মাত্র রাত্রিতে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের দূরত্ব এত সহজে অতিক্রম করিতে পারে যাহা অন্যান্য হাজার হাজার রাত্রিতেও সম্ভবপর হয় না। আধুনিক কালের দ্রুতগামী যান-বাহনের সাহায্যে এক ঘণ্টার সময়ে এতটা পথ অতিক্রম করা যায়, যাহা প্রাচীনকালে শত শত রাত্রিতে অতিক্রম করা সম্ভব হইত। ইহা সর্বজনজ্ঞাত। অনুরূপভাবে ‘কদর’ রাত্রিতে আল্লাহ্র সন্তোষ ও তাঁহার নৈকট্য লাভ এতটা সহজ ও দ্রুত সম্ভব হয় যাহা সত্যানুসন্ধিৎসুরা শতশত মাসেও লাভ করিতে পারে না।
এই দৃষ্টিতে রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটির তাৎপর্যও অনুধাবনীয় যে, তিনি বলিয়াছেনঃ ‘এই পবিত্র মাসে যে লোক কোনরূপ নফল ইবাদত করিবে, সে এই নফল ইবাদতে অন্যান্য সময়ের ফরয আদায়ের সমান সওয়াব লাভ করিবে। আর এই মাসের একটি ফরয আদায় করার সওয়াব অন্যান্য সময়ের সত্তরটি ফরয আদায়ের সমান হইয়া থাকে। বস্তুত কদর রাত্রির বিশেষত্ব রমযান মাসের মাত্র একটি বিশেষ রাত্রির বিশেষত্ব হইলেও নেকআমলের সওয়াব সত্তর গুণ বেশী হওয়া রমযান মাসের প্রত্যেকটি দিন ও প্রত্যেকটি রাত্রির বরকত ও মর্যাদার ব্যাপারে ইহা যে কত বড় কথা, তাহা অবশ্যই অনুধাবনীয়।
রমযান মাসে কোন আমলের অধিক সওয়াব হওয়ার কথাটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সম্পর্কে স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, এই মাস শুরু হইতে শেষ হওয়া পর্যন্ত যে লোক যে নেক-আমলেই করুণ-না কেন, তাহা কেবল এই সময়ের মধ্যে হওয়ার কারণেই বহু বেশী ও বড় সওয়াব লাভের অধিকারী হইয়া গেল-এই কথা এখানে বলা হয় নাই এবং যাহা বলা হইয়াছে তাহার মূল তাৎপর্যও ইহা নয়। আসল কথা হইল, একটি আমল-তাহা যে সময়ই করা হউক না কেন, উহার বাহ্যরূপ সর্বাবস্থায় একই থাকে। কিন্তু কোন মন ও কোন ধরনের ভাবধারা লইয়া সেই কাজটা করা হইয়াছে, এই দৃষ্টিতে উতক্তকালের মূল্যমানে অনেক বেশী পার্থক্য হইয়া যায়। কোন আমল করার সময় আমলকারীর অন্তরে যে ধরনের ভাবধারার সৃষ্টি হয় তাহাই উহার মূল্য হ্রাস করিয়া দেয়, আবার ঊর্ধ্ব হইতেও ঊর্ধ্বতর পর্যায়ে লইয়া যায়। অন্য কথায়, রোযার মাস মনের আর্দ্রতা লাভ, মন নরম, বিনয়ী ও আনুগত্যের ভাবধারায় পূর্ণ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট মৌসুম। এই সময়ে যে আধ্যাত্মিক ভাবধারা জাগ্রত হয়, উহার ফলে লোকদের প্রত্যেকটি আমলে অধিকতর আল্লাহ্-ভীতি ও আল্লাহ্নুগত্যের ভাবধারা জাগিয়া উঠে। ফলে এই মাসে কৃত আমলসমূহ গুণগত দিক দিয়া অনেক বৃদ্ধি পাইয়া যায় এবং অন্যান্য মাসে কৃত এই একইকালের তুলনায় এই মাসে অনেক বেশী সওয়াব পাওয়ার অধিকারী হইয়া যায়।
এই ভাষণে রমযান মাস সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ ‘এই মাস সবর-এর মাস’। অর্থাৎ এই মাসের করণীয়-রোযা পালন-‘সবর’ অর্থাঃ ধৈর্য, সহনশীলতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাস। বস্তুত ‘সবর’ না হইলে রোযা পালন কিছুতেই সম্ভব নয়। লোভ সংবরণ না করিলে সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার হইতে নিজেকে বিরত রাখা অসম্ভব। ত্যাগ-তিতিক্ষা ও ধৈর্য না থাকিলে ক্ষুৎ-পিপাসার জ্বালা-যন্ত্রণা কেহই সহিতে পারে না। অনুরূপভাবে এই মাসের একটানা দীঘর্ সময়ের রোযা পালন মানুষকে ধৈর্য শিক্ষা দেয়, সহনশীলতার গুণ উজ্জীবিত ও সমৃদ্ধ করে। ক্ষুৎ-পিপাসা মানুষকে কতখানি কষ্ট দেয় তাহা রোযা পালনের মাধ্যমে হাড়ে হাতে অনুভব করা যায়। সমাজের সাধারণ দরিদ্র লোকদিগকে যে কি কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাতকরিতে হয়, সে বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পাওয়া যায় রোযা রাখার মাধ্যমে। ফলে দরিদ্র ও ক্ষুধা-কাতর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি ও সহৃদয়তা জাগ্রত হওয়া রোযা পালনের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি। রোযার সামাজিক কল্যাণের ইহা একটি দিক মাত্র।
‘এই বরকতের মাসে ইমানদার লোকদের রিয্ক বৃদ্ধি করিয়া দেওয়া হয়-রাসূলে করীম (স) একথা ঘোষণা করিয়াছেন। বস্তুত রিয্ক দান একা আল্লাহর নিজস্ব ক্ষমতা-ইখ্তিয়ারের ব্যাপারে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হইয়াছেঃ
=================== আল্লাহ্ যাহার ইচ্ছা রিয্ক প্রশস্ত করিয়া দেন। কাজেই তিনি যদি কাহারও রিযক প্রশস্ত করিয়া দেন, তবে তাহাতে বাধাদানের ক্ষমতা কাহারও থাকিতে পারে না। আর এটা যে একটা প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-পর্যায়ের তাহাও নিঃসন্দেহ। প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তি বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই এই কথার সত্যতা যাচাই করিতে পারেন। বস্তুত রোযার মাসে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে যতটা প্রশস্ততা আসে, ততটা অন্যান্য সময় কল্পনাও করা যায় না। এই মাসে একে অন্যকে উদারভাবে খাদ্যদান করে এবং একজন অপরজনের জন্য অকুণ্ঠভাবে অর্থ ব্যয় করে। ইহার ফলে সাধারণ সচ্ছলতা সর্বত্র পরিলক্ষিত হইতে থাকে। আর গোটা সমাজও এই প্রাচুর্যে বিশেষভাবে লাভবান হয়। ইহা দ্বারা জনগণকে এই শিক্ষা দেওয়া যাইবে, উহার সাধারণ কল্যাণ ততই ব্যাপক হইবে এবং প্রত্যেকের স্বচ্ছলতাও বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাইবে। আল্লাহ্রই সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে রোযা পালনকারীদের প্রতি ইহা যে তাহার একটা বিশেষ অনুগ্রহমূলক ব্যবস্থা, তাহা স্বতঃসিদ্ধ।
ভাষণটি শেষভাগে বলা হইয়াছেঃ রমযান মাসের প্রাথমিক অংশ রহমতে পরিপূর্ণ। মধ্যম অংশ মাগফিরাত লাভের বিরাট অবকাশ এবং তৃতীয় অংশ জাহান্নাম হইতে বিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়। ইহা হইতে স্পষ্ট হয় যে, তিনটি অংশের প্রত্যেকটি-পরবর্তী অংশ পূর্ববর্তী অংশ হইতে অনেক বৃদ্ধিপূর্ণ।
এই কথাটির মোটামুটি তাৎপর্য এই হইতে পারে যে, রমযান মাসের বরকত ও ফযীলত লাভেচ্ছু লোক তিন প্রকারের হইতে পারে। এক শ্রেণীর লোক, যাহারা স্বতঃই তাকওয়া-পরহেজগারী সম্পন্ন এবং গুনাহ্-খাতা হইতে বাঁচিয়া থাকার জন্য প্রতি মুহূর্ত যত্নবান হইয়া থাকে। তাহারা কোন ভুলত্রুটি করিলে চেতনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তওবা ইস্তিগফার করিয়া নিজেদেরকে সংশোধন ও ত্রুটিমুক্ত করিয়া লয়। এই ধরনের লোকদের প্রতি রমযান মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রমযানের প্রথম রাত্রিতেই রহমতের বারিবর্ষন শুরু হইয়া যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে সেইসব লোক, যাহারা প্রথম শ্রেণীর লোকদের মত উচ্চমানের তাকওয়া-পরহেজগারী সম্পন্ন না হইলেও একেবারে খারাপ লোক নয়, তাহারা রমযান মাসের প্রথম ভাগে রোযা পালন, তওবা-ইস্তিগফার, কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য নেক-আমলের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থা উন্নত এবং নিজদিগকে আল্লাহ্র রহমত ও মাগফিরাত পাওয়ার যোগ্য করিয়া লয়। তখন এই মাসের মধ্যম অংশে ইহাদেরও ক্ষমা করিয়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত করা হয়।
তৃতীয় পর্যায়ে সেইসব লোক, যাহারা সাধারণত গুনাহের মধ্যে নিমজ্জিত হইয়া থাকে এবং নিজেদের অব্যাহত পাপ কার্যের দরুন জাহান্নামে যাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়, তাহারাও যখন রমযান মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশে অন্যান্য মুসলমানদের সঙ্গে রোযা রাখিয়া, তওবা ইস্তিগফার করিয়া নিজেদের পাপ মোচন করাইয়া লয়, তখন শেষ দশদিনে-আল্লাহ্র রহমত যখন সর্বাত্মক হইয়া বর্ষিত হয়-তাহাদিগকে জাহান্নাম হইতে মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত করা হয়।
এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী রমযান মাসের প্রথমাংশের রহমত, দ্বিতীয়াংশের মাগফিরাত এবং শেষাংশের জাহান্নাম হইতে মুক্তিলাভ উপরোল্লিখিত লোকদের সহিতই সঙশ্লিষ্ট জানিতে হইবে।
=========================
কিন্তু ইহার একটি ক্রমিক তাৎপর্যও রহিয়াছে। রোযার বরকত মাস শুরু হইতেই সূচিত হয়। কিন্তু মানুষ যখন এই ট্রেনিং কোর্সের প্রথম দশ দিন-রাত ক্রমাগত অতিবাহিত করিয়া পরবর্তী দশকে উপনীত হয়, তখন সে সেই লোক থাকে না যাহা মাস শুরু হওয়ার সময় ছিল। বরং তখন তাহার মধ্যে মুমিন সুলভ মহৎ গুণাবলী পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী বৃদ্ধি পাইয়া যায়। ইহার পর দ্বিতীয় দশ দিন-রাতের ট্রেনিং তাহার এই গুণাবলী অধিকতর সমৃদ্ধ করিয়া তোলে এবং তৃতীয় দশকে সে এক অধিক উন্নত গুণাবলী ভূষিত মু’মিনরূপে অনুপ্রবেশ করে। ইহার পর সে যখন এই মহা বরকতের মাসের তৃতীয় দশকের ট্রেনিংও পূর্ণ করিয়া লয়, তখন তাহার নফস সম্পূর্ণরূপে পবিত্র হইয়া যায় এবং সে ঈমানের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে, সেখানে পৌঁছার পর জাহান্নামের আগুন তাহার জন্য হারাম হইয়া যায়।
এই মাসের চারটি কাজ গুরুত্ব সহকারে করা আবশ্যক-আল্লাহ্র ইলাহ, ভৌহীদ ও মা’বুদ (দাস) হওয়ার কথা বারবার স্বীকার ও ঘোষণা করা, তাঁহার নিকট ক্ষমা ও মাগফিরাতের প্রার্থনা করা, জান্নাত পাওয়ার জন্য দোয়া করা এবং জাহান্নাম হইতে বেশী বেশী পানা চাওয়া। অন্য কথায়, আল্লাহ্র আল্লাহ্ হওয়া ও উহার মুকাবিলায় নিজের বান্দা হওয়ার অনুভূতি বেশী হওয়া এবং নিজের জীবনের সমস্যাবলী বারবার আল্লাহ্র সামনে পেশ করা আবশ্যক।
রমযান মাসের মাহাত্ম্য
========================
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের নিকট রমযান মাস সমুপস্থিত। ইহা এক অত্যন্ত বরকতময় মাস। আল্লাহ্ তা’আলা এই মাসে রোযা তোমাদের প্রতি ফরয করিয়াছেন। এই মাসে আকাশের দুয়ারসমূহ উন্মুক্ত হইয়া যায়, এই মাসে জাহান্নামের দরজাগুলি বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় এবং এই মাসে বড় বড় ও সেরা শয়তানগুলি আটক করিয়া রাখা হয়। আল্লাহ্রই জন্য এই মাসে একটি রাত আছে, যাহা হাজার মাসের অপেক্ষাও অনেক উত্তম। যে লোক এই রাত্রির মহাকল্যাণ লাভ হইতে বঞ্চিত থাকিল, সে সত্যই বঞ্চিত ব্যক্তি।
-নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী
ব্যাখ্যা এই হাদীস হযরত সালমান (রা) বর্ণিত পূর্বোক্ত হাদীসের মতই রমযান মাসের অসীম মাহাত্ম্যের কথা জানাইতেছে। এ পর্যায়ে ‘রমযান’ শব্দটির ব্যাখ্যা প্রথমে আলোচিতব্য।
‘রমযান ==== হইতে গৃহীত। ইহার অর্থ ‘দহন’, ‘জ্বলন’। রোযা রাখার দরুন ক্ষুৎ পিপাসার তীব্রতায় রোযাদারের পেট জ্বলিতে থাকে। এই অবস্থা বুঝাইবার জন্য আরবী ভাষায় বলা হয় ==== ‘রোযাদার দগ্ধ হয়’। ইহা হইতে গঠিত হয়, ===== ‘উত্তাপের তীব্রতা।’ এই অর্থই প্রকাশ করে নিম্নের হাদীসেঃ
======================
সূর্যোদয়ের পর সূর্যতাপে প্রাচীর যখন জ্বলিয়া উঠে, তখনি আওয়্যাবীন সুন্নাত নামায পড়ার সময়। আর সূর্যতাপের তীব্রতা পায়ে জ্বলন ধরাইয়া দেয় এবং ক্রমে সূর্যতাপ তীব্র হইতেও তীব্রতর হইয়া উঠে। মোটকথা === অর্থ দহন, তীব্রতা। এই অর্থের দিক দিয়া ‘রামাযান’ মাসটি হইল অব্যাহত তীব্র দহনের সমষ্টি।
আরবী মাসের নাম নির্ধারণকালে যে সময়টি সূর্যাতাপ তীব্র হওয়ার দরুন দহন বেশী মাত্রায় বৃদ্ধি পাইয়াছিল, সেই সময়টিরই নামকরণ করা হইয়াছে ‘রামাযান’ মাস। তখনকার সময়ের তাপমাত্রার তীব্রতার সহিত এই নামকরণের পূর্ণমাত্রায় সামঞ্জস্য রহিয়াছে। -ইহা এক শ্রেণীর ভাষাবিদের ব্যাখ্যা।
অন্য লোকদের মতে এই মাসটি ‘রমযান’ নামকরণের কারণ হইলঃ
========================
এই মাসে যে সব নেক আমল করা হয়, তাহা সমস্ত গুনাহ খাতা জ্বালাইয়া ভস্ম করিয়া দেয়। অপর লোকদের মতে এই নামকরণের কারণ।
========================
এইজন্য যে, এই মাসে লোকদের হৃদয়-মন ওয়ায-নসীহত ও পরকাল চিন্তার দরুন বিশেষভাবে উত্তাপ গ্রহণ করিয়া থাকে-যেমন সূর্যতাপে বালুরাশি ও প্রস্তরসমূহ উত্তপ্ত হইয়া থাকে।
আর একটি মত হইল, আরব জাতির লোকেরা রমযান মাসে তাহাদের অস্ত্রশস্ত্র শানিত করিয়া লইত, যেন শওয়াল মাসে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পারে। কেননা যেসব মাসে যুদ্ধ করা হারাম, তাহার পূর্ববর্তী মাস হইল শাওয়াল-আর ইহাই রমযান মাসের পরবর্তী মাস। আল্লামা মা-ওয়ার্দী লিখিয়ানে, প্রাক-ইসলামী যুগে এই মাসটির নাম ছিলঃ ======================
এহেন অর্থ ও তাৎপর্যবহ মাসটি সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ =========== ইহা অত্যন্ত ‘বরকতপূর্ণ’ মাস। ‘বরকত’ শব্দের অর্থ আধিক্য, প্রাচুর্য। আর রমযান মাসকে মুবারকে মাস বলা হইয়াছে এই জন্য যে, এই মাসে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার বান্দাদের প্রতি অশেষ কল্যাণ এবং অপরিমেয় সওয়াব ও রহমত নাযিল করেন। এইজন্য যে, বান্দা এই মাসেই আল্লাহ্র ইবাদতে সর্বাধিক কষ্ট ভোগ করে। ক্ষুধা ও পিপাসার মত জ্বালা ও কষ্ট আর কিছুই হইতে পারে না। আর এই কষ্ট ও জ্বালা অকাতরে ভোগ করাই হইল রমযান মাসের বড় কাজ। রমযান মাসের রোযার ন্যায় আল্লাহ্র নির্দিষ্ট করা অন্য কোন ইবাদতে এত কষ্ট ও জ্বালা ভোগ করিতে হয় না। এই জন্য আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সওয়াবও এই ইবাদতে অনেক বেশী। আসমাসের দুয়ার খুীরয়া ওয়ার কথাটি দুই দিক দিয়াই তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ্র তরফ হইতে দুনিয়ার রোযাদার বান্দাদের প্রতি রহমত ও অনুগ্রহের অজস্র ধারা বর্ষণের দিক দিয়া এবং বান্দার দোয়া ও ইবাদত-বন্দেগীসমূহ ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ ও আল্লাহ্র দরবারে গৃহীত হওয়ার দিক দিয়া তাৎপর্যপূর্ণ। আর যেসব বড় বড় শয়তান আল্লাহ্র ঊর্ধ্বলোকের গোপন তথ্য সংগ্রহেৱ জন্য নিরন্তন চেষ্টারত হইয়া থাকে, এই মাসে তাহারা বন্দী হইয়া থাকে। তাহাদের ঊর্ধ্বগমন রুদ্ধ হইয়া যায়। অথবা বলা যায়-প্রকৃত নিষ্ঠাবান সচেতন সতর্ক রোযাদারের উপর শয়তানের প্রতারণা-প্ররোচনা নিষ্ফল হইয়া যায়। তাহাদের ই রোযাই তাহা প্রতিরোধ করে।
এই মাসেই কদর-রাত্রি। যে রাত্রিটি একান্তবাবে আল্লাহ্রই জন্য উৎসর্গীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই রাত্রিতে আল্লাহ্র তরফ হইতে এত অধিক কল্যাণ বর্ষিত হয়, যাহার সহিত হাজার মাসের রাত্রিগুলিরও কোন তুলনা হয় না এবং এই রাত্রির এই অফুরন্ত ও অপরিমেয় কল্যাণের কোন অংশই যে লোক লাভ করিতে পারিল না, তাহার মত বঞ্চিত ও হতভাগ্য আর কেহই হইতে পারে না। এই ধরনের লোক সকল প্রকার কল্যাণ ও আল্লাহর রহমত হইতে চিরকালই বঞ্চিত থাকিয়া যাইবে।
হযরত আনাস ইববে মালিক (রা) বর্ণিত হাদীসেও এই কথাই ধ্বনিত হইয়াছে। রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
========================
রমযান মাসের একটি রাত্রি আছে, যাহা হাজার মাসের তুলনায় উত্তম। যে লোক এই রাত্রির কল্যাণ হইবে বঞ্চিত হইবে, সে সমগ্র কল্যাণ হইতে বঞ্চিত হইয়া যাইবে। আর ইহার কল্যাণ হইতে বঞ্চিত হয় কেবলমাত্র সেই ব্যক্তি, যে সবকিছু্ হইতে বঞ্চিত হইয়া গিয়াছে।
-ইবনে মাজাহ্
=========================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ রমযান মাসের প্রথম রাত্রি উপস্থিত হইলেই শয়তান ও দুষ্টতম জ্বিনগুলিকে রশি দিয়া বাঁধিয়া ফেলা হয় এবং জাহান্নামের দুয়ারগুলি বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। অতঃপর উহার একটি দুয়ারও খোলা হয় না এবং জান্নাতের দুয়ারগুলি খুলিয়া দেওয়া হয়। অতঃপর উহার একটি দুয়ারও বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষণাকারী ডাকিয়া বলিতে থাকে, ‘হে কল্যাণের আকাঙ্খী। অগ্রসর হইয়া আস এবং হে অকল্যাণ পোষণকারী। বিরত হও- পশ্চাদপসরণ কর। আর আল্লাহ্র জন্য জাহান্নাম হইতে মুক্তি পাওয়া বহুোক রহিয়াছে। এইভাবে (রমযানের) প্রত্যেক রাত্রিতেই করা হয়।
-তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে হাব্বান, বায়হাকী
ব্যাখ্যা এই হাদীসে রমযান মাসের মাহাত্ম্য ও মর্যাদার দিক প্রকাশ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, রমযান মাসের প্রথম রাত্রিতে আল্লাহ্র তরফ হইতে বিশেষ কতগুলি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তন্মধ্যে প্রথম ব্যবস্থা হইল, শয়তান ও অধিক দুষ্ট প্রকৃতির জ্বিদিগকে বাঁধিয়া ফেলা হয়। রমযানের পূর্ব পর্যন্ত তাহারা যথেচ্ছা বিচরণ করিয়াছে ও স্বাধীনভাবে স্বেচ্ছাচারিতা চালাইয়াছে। কিন্তু রোযার মাসের প্রথম রাত্রিতেই তাহাদিগকে বন্দী ও রুদ্ধ করিয়া দেওয়া হয়, যেন তাহারা রোযাদারকে ধোকা ও প্রতারণা দিয়া বিভ্রান্ত ও অন্যায়ে প্ররোচিত করিবার সুযোগ না পায়। এই কথাটির বাস্তবতা নিজেদের চক্ষে দেখিতে না পারিলেও ইহার কার্যকারিত ও অনিবার্য পরিণাম আমরা উপলব্ধি করিতে পারি। আমরা দেখিতে পাই, রোযার মাসে বহু বড় বড় গুণাহগার ও পাপীষ্ঠ ব্যক্তিও পাপের কাজ হইতে বিরত থাকে এবং তওবা করিয়া আল্লাহ্র দিকে রুজু হইয়া যায়। ইহা যে শয়দানদিগকে বাঁধিয়া রাখার ও তাহাদের ওয়াস্ওয়াসা হইতে দূরে থাকার দরুন হয় নাই, তাহা কেহ জোর করিয়া বলিতে পারে না।
অবশ্য ইহার বিপরীত অবস্থাও পরিলক্ষিত হয়। সেই সম্পর্কে প্রথমত বলা যাইতে পারে যে, রোযার মাসে রোযাদার কর্তৃক যে সব অন্যায় ও দুষ্টকৃতি অনুষ্ঠিত হয়, তাহা সেই প্রতারণা, প্রলোচনা ও প্রভাব-প্রলোভনের জের, যাহা এগার মাসকাল ধরিয়া তাহাদের মন-মগজ ও রক্তমাংশের সহিত মিলিয়া-মিশিয়া একাকার হইয়া গিয়াছে এবং এই মুহূর্তে উহার প্রভাব নিঃশেষ হইয়া যায় নাই। দ্বিতীয়ত বলা যাইতে পারে শয়তান ও জ্বিনদের বন্ধ করিয়া রাখার কথা রূপক অর্থে বলা হইয়াছে। এই কথার আসল তাৎপর্য হইল, এই মাসব্যাপী শয়তান ও দুষ্ট জ্বিনেরা রোযাদারকে খুব কমই প্রতারিত ও প্ররোচিত করিতে পারে। এই মাসে তাহাদের প্ররোচনা ও পথভ্রষ্টকরণ অভিযান খুবই দুর্বল হইয়া যায়। হাদীস ব্যাখ্যাতা ইবনে হাজার আল-আসকালানীর মতে, ইহা পুরাপুরি বাস্তব। প্রকৃতপক্ষেই এইরূপ হইয়া থাকে। ফেরেশতাদের পক্ষ হইতে এই মাসের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার এবং মুমিন বান্দাগণকে কষ্টদান হইতে শয়তান গুলিকে বিরত রাখার ইহা বাস্তব নিদর্শন। বলা যাইতে পারে, এই মাসে সৎকাজের সওয়াব বিপুল হওয়ার, আল্লাহ্র ক্ষমা ব্যাপক হওয়ার এবং শয়তানের প্রতারণা-কার্য অনেকটা মুলতবী থাকার কথাই ইঙ্গিত-ইশারায় বলা হইয়াছে। ফলে শয়তানের ঠিক বন্দী কার মতই হইয়া যায়। মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হাদীস ইহার সমর্থক। তাহাতে বলা হইয়াছে ===== ‘রহমতের দুয়ার উন্মুক্ত করিয়া দেওয়া হয়।’ জান্নাতের দুয়ারসমূহ খুলিয়া দেওয়ার অর্থ হইলঃ জান্নাতলাভ সহজতর করিয়া দেওয়া। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার বান্দাদের জন্য এই মাসে ইবাদত-বন্দেগীর বিপুল সুযোগ করিয়া দেন। ইহা জান্নাতে প্রবেশ সহজতর হওয়ার কারণ হইয়া দাঁড়ায়। আর জাহান্নামের দ্বার বন্ধ হওয়ার অর্থ, জাহান্নামে লইয়া যাওয়ার মত গুনাহ খাতার প্রতি মানব মন এই মাসে বিমুখ হইয়া থাকে। নেক-আমলের দিকেই তাহাদের সব চিন্তা-ভাবনা ও চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত হয়। আর শয়তানগুলিকে বন্দী করার তাৎপর্য হইল, তাহারা প্রতারণা প্ররোচনা ও লালসা-পংকিলতা ও পাপের আকর্ষণ সৃষ্টির ব্যাপারে অক্ষম ও শক্তিহীন হইয়া পড়ে।
শয়তান ও জ্বিনদের বন্দী হওয়ার কথা যর্থাথ ও বাস্তব বলিয়া মানিয়া লইলে প্রশ্ন উঠে, তাহা হইলে রমযান মাসে এত অন্যায়, অত্যাচার ও পাপ কি করিয়া অনুষ্ঠিত হইতে পারিতেছে? শয়তানরা বন্দী হইয়া থাকিলে এইরূপ তো হওয়ার কথা নয়? ইহার উত্তরে বলা যায়, যেসব রোযাদার প্রকৃতই রোযার জরুরী শর্তাবলী যথাযথভাবে পালন করে ও উহার নিয়ম-নীতি ও আদব-কায়দা রক্ষা করিযা চলে, উহার দরুন তাহাদের দ্বারা ইহা খুব কমই অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। অথবা ইহাও হইতে পারে যে, সব শয়তানই তো আর বন্দী হয় না, বন্দী হয় উহাদের শ্রেষ্ঠরা। চেলা-চামুণ্ডারা তো ওয়াসওয়াসার কাজ যথারীতি চালাইতেই থাকে কিংবা শয়তানের দুষ্টমী ও প্ররোচনার মাত্রা খুবই হ্রাস পাইয়া যায়। এতদ্ব্যতীত বলা যায় যে, রমযান মাসে শয়তান ও দুষ্ট জ্বিনেরা বন্দী হইলেও অন্যায়, অনাচার ও পাপানুষ্ঠান যে সম্পূর্ণ বন্ধ হইয়া যাইবে এমন কথাও নয়। কেননা উহার অন্য বহুবিদ কারণ থাকিতে পারে। বস্তুত আসল শয়তান ও প্রকৃত দুষ্ট জ্বিনদের ছাড়াও মানুষের নিজের সত্ত্বাও নিহিত দুষ্ট স্বভাব-প্রকৃতি ও মানবরূপী শয়তানদের দুষ্কৃতিও তো কোন অংশে কম হয় না।
হাদীসের শেষে ঘোষণাকারীর কথা বলা হইয়াছে, ঘোষণাকারী হয়তো ফেরেশতা হইবেন। মুসনআদে আহ্মদ-এ উদ্ধৃত একটি হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছেঃ
======== রমযান মাসে একজন ফেরেশতা ঘোষণা করিবেন। এই ঘোষণা হয়ত বাস্তবভাবে শ্রুতিগোচর হয় না। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ঈমানদার লোকদের যখন একথা জানা থাকে যে, রমযান মাসে এইরূপ ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন এই কথাটি স্মরণ করিয়াই তাহারা সচেতন ও সতর্ক হইতে ও উহার ফলে ডাকে সাড়া দিতে মনে-প্রাণে প্রস্তুত থাকিতে পারে। ইহাই এই ডাকের ফায়দা। কিংবা-নেক-কাজের ইচ্ছুক লোকদের মনে আল্লাহ্ তা’আলা এই কথা জাগাইয়া দেন-কল্যাণের আকাঙ্খী অগ্রসর হও’ অর্থ, যাহারা সত্যই নেক আমল করিতে চাও, তাহারা আল্লাহ্র দিকে অগ্রসর হও। আল্লাহ্র বন্দেগীতে খুব বেশী বেশী চেষ্টা কর। তাহা হইলে অল্প কাজের ফলে অশেষ সওয়াব লাভ করিতে পারিবে। কিংবা যাহারা নেক-আমলে ইচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও এতদিন সেদিকে কার্যত পদক্ষেপ গ্রহণ কর নাই, তাহারা আর নিষ্ক্রীয় হইয়া থাকিও না। এবার সব অবসাদ-অকর্মন্যতা পরিহার করিয়া কর্মের জন্য প্রস্তুত হও। কেননা আসল কল্যাণ তো আমরাই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বাধীন। আমিই তোমাদিগকে কর্মের অবাধ সুযোগ দান করিব। ‘হে অকল্যাণ পোষণকারী! পাপকার্য হইতে বিরত থাক। আল্লাহ্র দিকে প্রত্যাবর্তন কর।‘ কেননা তওবা কবুল হওয়ার ও মাগফিরাত লাভ করার স্বর্ণোজ্জ্বল মুহূর্ত তোমার দ্বারদেশে সমুপস্থিত। সম্ভবত আল্লাহ্র অনুগত বান্দাদের রমযান মাসে আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হওয়া এবং অপরাধপ্রবণ ও পাপীষ্ঠ লোকদের পাপ হইতে বিরত থাকা এই ঘোষণারই পরিণাম। আর তাহাও হয় এ কারণে যে, আল্লাহ্ তা’আলা এই রমযান মাসে তাঁহাকে পাইতে চায় এমন লোকদের জন্য অনুগ্রহের রুদ্ধদ্বারা উন্মুক্ত করিয়া দেন। ঠিক এই জন্যই নামায-রোযা তরককারী অনেক মুসলমান-এমনকি ছোট ছোট শিশু ও বালকরা পর্যন্ত নামায রোযায় মগ্ন হইয়া থাকে। রোযা নামায হইতেও অধিক কষ্টসাধ্য। উহার ফলে দেহ শক্তিহীন হইয়া পড়ে। ফলে ইবাদতের কাজে অবসাদ দেখা দেয়, নিদ্রার চাপে, সমস্ত শরীর ভাঙ্গিয়া আসে। এতদ্সত্ত্বেও মসজিদগুলি দেখা যায় নামাযীদের দ্বারা পরিপূর্ণ, আর রাত্রিগুলি ইবাদত-বন্দেগী, কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর যিকরে মুখরিত হইয়া উঠে।
আল্লাহ্র অনুগ্রহে জাহান্নাম হইতে নিষ্কৃত পাওয়া লোকদের সংখ্যা বিপুল। ইচ্ছা ও চেষ্টা করিলে তুমিও তাহাদের মধ্যে নিজেকে শামিল করিতে পার।
বস্তুত রমযান মাসের ফযীলত পর্যায়ে বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে এই হাদীসটির গুরুত্ব ও মর্যাদা যে অনন্য তাহা বলাই বাহুল্য।
===================
হযরত আবূ আমামাহা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি বলিলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (স)! আমাকে এমন এক কাজের কথা বলিয়া দিন. যাহা দ্বারা আল্লাহ্ আমাকে কল্যাণ দিবেন। জওয়াবে নবী করমি (স) বলিলেনঃ তোমার রোযা পালন করা কর্তব্য। কেননা রোযার কোন তুলনা নাই।
ব্যাখ্যা হাদীসের বক্তব্য হইল, রোযা এক অতুনীয় ইবাদত। অতএব রীতিমত রোযা পালন এমন এক কাজ, যাহা বাস্তবিকই তোমাদের কল্যাণ দান করিবে। বস্তুত রোযা যে এক তুলনাহীন ইবাদত, কুরআন ও হাদীসের ঘোষণাসমূহ হইতে তাহা স্পষ্টভাবে জানা যায়। তাহার কারণ এই যে,রোযার কোন বাহ্যিক ও দৃশ্যমান রূপ নাই। ইহা সঠিকরূপে পালন করা হইতেছে কিনা তাহা রোযাদার নিজে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কেহই জানিতে পারে না। এই জন্যই আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ ’উহা কেবলমাত্র আমারই জন্য অতএব আমিই উহার প্রতিফল দিব।-ইমাম কুরতুবী লিখিয়াছেনঃ
=========================================
রোযা নফসের লোভ-লালসা ও স্বাদ-আস্বাদন প্রবৃত্তি দমন করে, যাহা অন্য সব ইবাদত এইরূপ করে না।
চাঁদ দেখিয়া রোযা রাখা-চাঁদ দেখিয়া রোযা ভাঙ্গা
==========================================
আবদুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনুল খাত্তাব হইতে বর্ণিত, তিনি সেই দিন ভাষণ দিলেন, যে দিন রোযা রাখা হইবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ হইতেছিল এবং বলিলেনঃ তোমরা জানিয়া রাখ, আমি রাসূলে করীম(স)-এর সাহাবীদের মজলিসে বসিয়াছি এবং এই ধরনের বিষয়ে আমি তাঁহাদের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াছি। এই ব্যাপারে তোমরা সতর্ক হও। তাঁহারা আমাকে বলিয়াছেন যে, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ তোমরা চাঁদ দেখিয়া রোযা রাখিতে শুরু কর এবং চাঁদ দেখিয়া রাষা ভঙ্গ কর। আর এইভাবে কুরবানী ও হজ্জের অনুষ্ঠানাদি পালন কর। (ঊনত্রিশ তারিখ) আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইরৈ (ও চাঁদ দেখা না গেলে) তোমরা সেই মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ কর। আর যদি দুইজন মুসলমান-সাক্ষ্যদাতা সাক্ষ্য দেয় তবে তোমরা তদানুযায়ী রোযা ও রোযা ভাঙ্গ।
ব্যাখ্যা চাঁদ দেখিয়া রোযা রাখিতে শুরু করা ও চাঁদ দেখিয়া রোযা ভঙ্গ করা অসংখ্য হাদীসের মধ্যে ইহা একটি। এই সমস্ত হাদীসের মূল কথা হইল, রমযানের চাঁদ দেখিয়া রোযা রাখিতে হইবে এবং রোযা ভাঙ্গিতে হইবে। শওয়ালের চাঁদ দেখিয়া রোযা রাখা বন্ধ করিয়া ঈদুল-ফিতর পালন করিতে হইবে। তাহাতে শাবান মাস ও রমযান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ হউক, কি ঊত্রিশ দিনের অপূর্ণ মাসই হউক-না কেন। রাসূলের বাণীঃ ‘চন্দ্রোদয় দেখিয়া রোযা থাক, চন্দ্রোদয় দেখিয়া রোযা ভাঙ্গ’ হইতে এই কথা স্পষ্ট ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। ইহা হইল ইতিবাচক কথা। এই পর্যায়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) ও হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত হাদীসে স্পষ্ট ভাষায বলা হইয়াছেঃ
=========================
তোমরা রোযা রাখিবে না যতক্ষণ চাঁদ দেখিতে পাইবে না। (২৯ তারিখ) আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকিলে সেই মাসের দিন পূর্ণ করিযা লও।
হযব আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসটির ভাষা এইঃ
=============================
চাঁদ দেখিয়া রোযা থাক। চাঁদ দেখিয়া রোযা ভাঙ্গ। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহা হইলে শাবান মাসের দিনের সংখ্যা ত্রিশ পূর্ণ কর।
ইহার স্পষ্ট অর্থ হইলঃ রোযা রাখিতে হইবে যখন চাঁদ দেখা যাইবে এবং রোযা ভাঙ্গি ত হইবে যখন শয়ালের চাঁদ দেখা যাইবে।
আলোচ্য হাদীসের শেষভাগে দুইজন মুসলমানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দানের কথা বলা হইয়াছে। চাঁদ ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের চোখে দেখিতে হইবে এবং তাহা হইলেই রোযা রাখা বা ভাঙ্গা যাইবে, অন্যথায় নয়-এমন কথা শরীয়াতে নাই। নিজ চোখে না দেখিলেও অন্যদের নিকট চাঁদ দেখার সাক্ষ্য পাইলে তাহার ভিত্তিতে রোযা রাখেও হইবে এবং ভাঙ্গিতে হইবে। ইহাই শরীয়াতের বিধান। ইবনুল কায়্যিম লিখিয়াছেন, নবী করীম (স) একজন সাহাবী-হযরত ইবনে উমরের বর্ণনানুযায়ী একজন মরু বেদুইনের ঈদের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য পাইলেও রোযা রাখিতেন। আর চাঁদ দেখিতে না পাইলে বা দেখার সাক্ষ্য না পাইলে তিনি চলতি মাসের-শাবান বা রমযানের ত্রিশটি দিন পূর্ণ করিয়া লইতেন।
ইমাম আবূ হানীফার মতে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকিলে একজন বিশ্বস্ত লোকের চাঁদ দেখার সাক্ষ্যানুযায়ী রোযা থাকা যাইবে। ইমাম শাফেয়ীরও ইহা একটি মত। ইমাম আহমদের মতে সর্বাবস্থা একজন লোকের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রোযা থাকা যাইবে। আর ইমাম মালিকের মতে চাঁদ না দেখিলে রোযা রাখা যাইবে না।
চাঁদ দেখার সাক্ষ্য
========================================
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেন, তিনি বলিয়াছেন, একজন বেদুঈন নবী করীম (স)-এর সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলঃ আমি চাঁদ দেখিয়াছি। তখন নবী করীম (স) লোকটিকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, এক আল্লাহ্ ছাড়া মা’বুদ নাই এবং তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মাদ (স) আল্লাহ্র রাসূল? লোকটি বলিলঃ হ্যাঁ। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ হে বিলাল। লোকদের মধ্যে ঘোষণা প্রচার করিয়া দাও যে, তাহারা যেন আগামীকাল হইতে রোযা খাকে।
-তিরমিযী
ব্যাখ্যা উপরের হাদীসে নিশ্চয়ই এমন এক দিনের কথা বলা হইয়াছে, যে দিন নবী করীম (স) নিজে কিংবা তাঁহার নিকটস্থ লোকজন চাঁদ দেখিতে পান নাই। আর চাঁদ দেখিতে না পাওয়ার দরুন পরবর্তী দিনের কোন কার্যসূচী ঠিক করা সম্ভবপর হয় নাই। চাঁদ দেখিতে না পাওয়ার কারণ সম্ভবত এটা ছিল যে, সে দিন চাঁদ দেখার সময় সেখানকার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। আর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার দরুন চাঁদ দেখিতে না পাওয়া বিচিত্রি কিছুই নয়। তখন একজন মরু অধিবাসী- বেদুঈন রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া সংবাদ দিল যে, আমি চাঁদ দেখিতে পাইয়াছি।-এই চাঁদ রমযান মাসের চাঁদ, তাহা রাসূলে করীম (স)-এর পরবর্তী নির্দেশ হইত স্পষ্ট বুঝা যায়। বস্তুত এক স্থানে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার দরুন চাঁদ দেখিতে না পাইলে অন্যত্রও তাহা দেখা যাইবে না, এইরূপ অবস্থা সব সময় হয় না। সে দিন অন্য যে কোন স্থানে চাঁদ দেখিতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সেই কারণে নবী করীম (স) এই কথাটি শুনিবামাত্র লোকটির ঈমান-আকীদার পরিচয় গ্রহণের প্রয়োজন মনে করিলেন, অন্য কোন বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করিলেন। না। লোকটি মুসলমান কিনা তাহাই জানিতে চাহিলেন। লোকটি যখন স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিল যে, সে মুসলমান-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর বিশ্বাসী ও ঈমানদার, তখন নবী করীম (স) লোকটির চাঁদ দেখা সংক্রান্ত সংবাদ বিশ্বাস করিলেন এবং সিন্ধান্ত করিলেন যে,রমযানের চাঁদ সত্যই দেখা গিয়াছে এবং পরের দিন হইতেই রোযা থাকিতে হইবে। তাঁহার এই সিন্ধান্ত জনসাধারণকে অবিলম্বে জানাইয়া দিবার জন্য তিনি হযরত বিলাল (রা)-কে নির্দেশ দিলেন।
এই হাদীস হইতে জানা গেল যে,চাঁদ দেখা সংক্রান্ত সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য সাক্ষ্যদাতার মুসলমান হওয়া জরুরী শর্ত। সনদের দিক দিয়া এই হাদীসটি সম্পর্কে প্রশ্ন উঠিলেও এবং মতভেদ থাকিলেও মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে বিশেষ মতভেদ নাই। অধিকাংশ ফিকাহবিদের মত হইলঃ
=================================
রোযা রাখার ব্যাপারে এক ব্যক্তির চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করা যাইবে।
ইবনুল মুবারক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু ইসহাক রাহ্ওয়াই বলিয়াছেনঃ
====================
দুই ব্যক্তির চাঁদ দেখার সাক্ষ্য না পাইলে রোযা রাখা যাইবে না। ইমাম মালিক,লাইস,আওযায়ী, সওরী ও ইমাম শাফেয়ীর অপর একটি উক্তি এই মতের সমর্থনে রহিয়াছে। তাঁহাদের দলিল হইল আবদুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনুল খাত্তাব বর্ণিত একটি হাদসি। তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবিগণ হাদীস বর্ণনা করিয়া আমাকে শোনাইয়াছেনঃ
=========================================
তোমরা চাঁদ দেখিয়া রোযা থাক, চাঁদ দেখিয়া রোযা ভাঙ্গ। চাঁদ দেখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা কর। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে ও চাঁদ দেখা না যায়. তাহা হইলে চলতি শাবান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ কর। আর দুইজন মুসলমান যদি চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেন, তবে সেই অনুযায়ী রোযা থাকিবে ও রোযা ভাঙ্গিবে।
মুসনাদে আমহদ ও নাসায়ী-উভয় গ্রন্থেই এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে, কিন্তু নাসায়ীর বর্ণনায় =======দুইজন মুসলমান বলা হয় নাই।
মক্কার শাসনকর্তা হারিস ইবনে হাতিব বলিয়াছেনঃ
===========================================
রাসূলে করীম (স) চাঁদ দেখার জন্য চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি আমাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছেন। যতি চাঁদ আমরা দেখিতে না পাই এবং দুইজন বিশ্বস্ত সাক্ষী চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেয়, তাহা হইলে তদানুযায়ী আমরা রোযা পালন করিব।
-আবু দাউদ, দারে কুতনী
দুইজন সাক্ষী শর্ত করার জওয়াবে বলা যায়, দুইজনে সাক্ষ্য পাওয়া চুড়ান্ত কথা। কিন্তু একজনের সাক্ষ্যে রোযা রাখা যাইবে না। এমন কোন নিষেধ উহাতে নাই। ইমাম তিরমিযী লিখিয়াছেনঃ
===============================================
দুইজন লোকের সাক্ষ্য ছাড়া যে রোযা খোলা যাইবে না।, এই ব্যাপারে শরীয়াতের আলিমদের মধ্যে কোন মতবৈষম্য দেখা যায় নাই।
ইমাম নবতী লিখিয়াছেনঃ শওয়াল মাসের চাঁদ দেখার ব্যাপারে মাত্র একজন বিশ্বস্ত লোকের সাক্ষ্য গ্রহণ করা যাইবে না। ইহা সর্বজন সমর্থিত মত। তবে একমাত্র্ আবু সওর বলিয়াছেন, সাক্ষ্য যদি নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত হয়, তাহা হইলে একজনের সাক্ষ্যও যথেষ্ট।
তাবেয়ী তাউস বলিয়াছেনঃ আমি মদীনায় হযরত ইবনে উমর ও ইবনে আবাস (রা)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন তাঁহাদের নিকট এক ব্যক্তি রমযান মাসের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেয়। তাঁহারা দুইজন তাহা গ্রহণ করিলেন এবং বলিলেনঃ
=========================================
রাসূলে করীম (স) রমযান মাসের চাঁদ দেখার ব্যাপারে একজনের সাক্ষ্য গ্রহণের অনুমতি দিয়াছেন। কিন্তু রোযা খোলার ব্যাপারে দুইজনের সাক্ষ্য ছাড়া রোযা খোলার অনুমতি দিতেন না।।
ইমাম দারে কুতনী বলিয়াছেনঃ এই হাদীসটির সনদে এক পর্যায়ে হাফস ইবনে উমর আল আয়েলী একক বর্ণনাকারী। আর তিনি যয়ীফ।
কিন্তু এই দিক দিয়া হাদীসটি যয়ীফ হইলেও পূর্বোদ্ধৃত হাদীস দুইটি, যাহাতে রোযা খোলার চাঁদ দেখার ব্যাপারে দুইজন সাক্ষীর শর্ত করা হইয়াছে, তাহা হইল এই মতের আসল ভিত্তি। অতএব গ্রহণযোগ্য।===============
রোযার নিয়্যত
=======================================
হযরত হাফসা হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেনঃ যে লোক ফজরের পূর্বেই রোযার সংকল্প করিল না, তাহার রোযা নাই।
-তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ্, মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা হাদীসটিতে রোযার নিয়্যত করার আবশ্যকতা সম্পর্কে বলা হইয়াছে। হাদীসের ভাষা হইতে দুইটি কথা স্পষ্ট হয়। একটি হইল রোযার নিয়্যত অবশ্যই করিতে হইবে। নিয়্যত করা না হইলে রোযাই হইবে না। আর দ্বিতীয় কথা হইল ফজরের পূর্বে নিয়্যত করিতে হাইবে। উভয় বিষয়ে ফিকাহ্বিদ্দের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে।
উপরে যে হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে, ইবনে খুযায়মা ও ইবনে হাব্বান হাদীস সংগ্রহকারীদ্বয় ইহা নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাঁহারা ইহাকে নবী করীম (স)-এরই বাণীরূপে সহীহ সনদে উল্লেখ করিয়াছেন। ইমাম দারে কুতনীও নিজ গ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইমাম আবু দাউদ হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন, ইহাকে নবী করীম (স)-এর কথা মনে করা ঠিক নয়। আর ইমাম তিরমিযী বলিয়াছেন, হাদীসটিকে হযরত ইবনে উমরের কথা মনে করাই যর্থাথ। ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’ গ্রন্থে হযরত ইবনে উমর (রা) সম্পর্কে সহীহ সনদে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
====================
তিনি বলিতেন, যে লোক ফজরের পূর্বে নিয়্যত করিয়াছে, সে ছাড়া অন্য কেহই (যেন) রোযা না রাখে।
মোটকথা, বহু সনদে হাদীসটি বর্ণিত হইলেও কেবলমাত্র একটি সনদ হইতেই উহাকে রাসূলে করীম (স)-এর কথা বলিয়া জানা যায়। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও মুহাদ্দিসগণ ইহাকে নবী করীম (স)-এর কথা ও অবশ্য গ্রহণীয় বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল ও সকল মুহাদ্দিসীনের ইহাই মত। কেননা সাহাবীরা মনগড়া কথা বলেন না, রাসূলের নিকট হইতে শোনা কথাই বলেন, ইহা হাদীসশাস্ত্রের একটি মূলনীতি বিশেষ।
ইমাম যুহরী, আতা ও যুফার-এর মতে রমযান মাসের রোযার জন্য নিয়্যতের প্রয়োজন নাই। কেননা রমযানে রোযা না থাকার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না। অবশ্য রোগী ও মুসাফির যাহাদের জন্য রোযা ফরয নয়, তাহাদের জন্য নিয়্যত জরুরী। ===========
ইমাম আবূ হানীফার মতে, যে রোযার দিন নির্দিষ্ট, উহার নিয়্যত সেই দিনের দ্বিপ্রহর পর্যন্ত করিলেই চলে। কিন্তু যে রোযার দিন নির্দিষ্ট নয়, সেই দিনের রোযার নিয়্যত ফজর উদয় হওয়ার পূর্বে হওয়া আবশ্যক। এই মূলনীতির দৃষ্টিতে রমযান মাসের রোযার ও নির্দিষ্ট দিনের জন্য মানত করা রোযার নিয়্যত সেই দিনের দ্বিপ্রহর পর্যন্ত করিলেই কর্তব্য সম্পাদন হইবে। কিন্তু কাফ্ফারা, কাযা ও অনির্দিষ্ট মানতের রোযার নিয়্যত রাত্রিকালেই করিতে হইবে। তাঁহার দলীল হইল হযরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনা। একজন বেদুঈন নবী করীম (স)-এর নিকট চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেয়। ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) ঘোষণা করাইয়া দিলেন যে, যে লোক কোন কিছু খাইয়াছেন, সে যেন দিনের অবশিষ্ট সময়ে কিছই না খায়। আর যে লোক এখন পর্যন্ত কিছুই পানাহার করে নাই, সে যেন রোযা রাখে।
-আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, নাসায়ী
হযরত হাফ্সা বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে হানাফী ফিকাহ্বিদদের বক্তব্য হইল, প্রথমত উক্ত হাদীসটি রাসুলে করীম (স)-এর কথা, ==== না সাহাবীর কথা =-==== এই বিষয়েই মতভেদ রহিয়াছে। উহাকে যদি সহীহ্ হাদীস মানিয়াও লওয়া যায়, তবুও বলা যায়, উহাতে রোযা আদৌ না হওয়ার কথা বলা হয নাই, বরং বলা হইয়াছে রোযার ফযীলত না হওয়ার কথা। অর্থাৎ কোন লোক যদি রমযানের রোযার নিয়্যত রাত্রে না করিয়া দিনের দ্বিপ্রহরের মধ্যে করে, তবে সে রোযার মাহাত্ম্য লাভ হইতে বঞ্চিত থাকিবে। রোযা তাহার হইয়া যাইবে। তবে উহার শুভ প্রতিফল পাইবে সে সময় হইতে, যখন সে নিয়্যত করিবে।====================
অন্যান্য ফিকাহ্বিদদের মতে হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসটি অনুযায়ী আমল করা যাইবে কেবল তখন, যখন দিনের বেলাই রোযা শুরু হওয়ার কথা জানিতে পারিবে। কেননা তখন তো আর রাত্রিকাল ফিরাইয়া পাওয়া যাইবে না। ইমাম যাইলায়ী ও হাফেয ইবনে হাজার আসকালানীও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
ইমাম শাওকানী লিখিয়াছেন, হযরত হাফসা বর্ণিত হাদীসটি হইতে রাত্রিকালেই রোযার নিয়্যত করা ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। হযরত ইবনে উমর ও জাবির ইবনে ইয়াযীদ এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। রোযা ফরজ কিংবা নফল এই ব্যাপারে তাঁহারা কোন পার্থক্য করেন নাই। আবূ তাল্হা, আবূ হানীফা, শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল বলিয়াছেনঃ
============= নফল রোযার নিয়্যত রাত্রিকালে করা ওয়াজিব নয়। হযরত আয়শা (রা)-এর মত হইলঃ
============ দ্বিপ্রহরেরও পর নিয়্যত করিলে রোযা সহীহ্ হইবে।
রোযার মূল্য ও মর্যাদা
==============================
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ আদম সন্তানের প্রত্যেকটি নেক আমলের সওয়াব দশগুণ হইতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা বলিয়াছেনঃ রোযা এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। কেননা উহা একান্তভাবে আমারই জন্য। অতএব আমিই (যেভাবে ইচ্ছা) উহার প্রতিফল দিব। রোযা পালনে আমার বান্দা আমারই সন্তোষ বিধানের জন্য স্বীয় ইচ্ছা-বাসনা ও নিজের পানাহার পরিত্যাগ করিয়া থাকে। রোযাদারের জন্য দুইটি আনন্দ। একটি আনন্দ ইফতার করার সময় এবং দ্বিতীয়টি তাহার মালিক-মুনিব আল্লাহ্র সহিত সাক্ষাৎ লাভের সময়। আর নিশ্চয়ই জানিও, রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মিশ্কের সুগন্ধি হইতেও অনেক উত্তম। আর রোযা ঢাল স্বরূপ। তোমাদের একজন যখন রোযা রাখিবে, তখন সে যেন বেহুদা ও অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং চীৎকার ও হট্টগোল না করে। অন্য কেহ যদি তাহাকে গালাগাল করে কিংবা তাহার সহিত ঝগড়া-বিবাদ করিতে আসে, তখন সে যেন বলেঃ আমি রোযাদার।
ব্যাখ্যা মুমিন ব্যক্তির প্রত্যেকটি নেক আমলের সওয়াব দশ গুণ হইতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, হাদীসটির প্রথম কথা ইহাই। এই কথাটি রাসূলে করীম (স)-এর নিজস্ব ও স্বকল্পিত নয়। ইহার ভিত্তি কুরআন মজীদেই পেশ করা হইয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেন।
==============
যেলোক একটি নেক আমল করে তাহার জন্য উহার অনরুপ দশটি কাজের সওয়াব নির্দিষ্ট রহিয়াছে।
কিন্তু ইহা হইল বৃদ্ধি লাভের নিম্নতম পরিমাণ। হাদীসে দশ গুণ হইতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধির কথা বলা হইয়াছে। কুরআনের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে এই সংখ্যাটি বলা হয় নাই। বলা হইয়াছেঃ
=====================
যে লোকই আল্লাহ্কে উত্তম ‘করয’ দিবে, আল্লাহ্ তাহাকে উহা বহু গুণ বেশী করিয়া দিবেন। অন্য আয়াতে বলা হইয়াছেঃ
================== আল্লাহ্ যাহাকে ইচ্ছা বহুগুণ বেশী করিয়া দেন। এই আয়াতদ্বয়ের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিটি নেক কাজের সওয়াব আল্লাহ্ তা’আলা কতগুণ বেশী করিয়া দিবেন, তাহা নির্দিষ্টও নয়, সীমাবদ্ধও নয়। আল্লাহ্ যত ইচ্ছা বেশী বেশী বৃদ্ধি করিয়া দিতে পারেন। রোযার প্রসংগে আলোচ্য হাদীসে আল্লাহ্র কথাটির ইহাই তাৎপর্য। অতএব রোযার সওয়াব কত হইবে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেহই উহার পরিমাণ পরিমাপ করিতে পারে না। ইহার কারণ এই যে, রোযার এমন কতগুলি বিশেষত্ব রহিয়াছে যাহা অন্য কোন ইবাদতে পাওয়া যায় না। এই কারণে ইহার সওয়াবদানের ব্যাপারটি আল্লাহ্ তা’আলার সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাধীন করিয়া রাখিয়াছেন। অর্থাৎ উহার কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট করিয়া ঘোষণা করেন নাই।
আল্লামা তায়্যিবী বলিয়াছেনঃ রোযার এই মর্যাদা ও বিশেষত্বের দুইটি কারণ হইতে পারে। একটি এই যে, রোযার বাস্তবতা আসলে একটা গোপন ব্যাপার। এই কারণে উহা একান্তভাবে আল্লাহ্র জন্যই হইয়া থাকে। অন্যান্য ইবাদত সেরূপ নয়। আল্লাহ্র এই ব্যাক্যাংশ সেই দিকেই ইংগিত করে।
=========================
উহা একান্তভাবে আমারই জন্য হইয়া থাকে। অতএব আমিই উহার প্রতিফল দিব।
কেননা রোযার কোন বাস্তব ও দৃশ্যমান অস্তিত্ব নাই। অন্যান্য ইবাদত-নামায-হজ্জ্ব-যাকাত ইত্যাদির একটা বাহ্যিক দৃশ্যমান অবয়ন রহিয়াছে। আর রোযা হইল পানাহার ইত্যাদি হইতে বিরত থাকা। উহার পশ্চাতে অন্তর্নিহিতত থাকে শুধু নিয়্যত। আর নিয়্যত হইল একটা মানসিক অবস্থা-একটা মানসিকতা মাত্র। উহা অন্য কেহ দেখিতে পায় না। কেহ যদি মুখে বলে যে আমি রোযাদার, তবুও সে প্রকৃতপক্ষে রোযাদার কিনা তাহা অকাট্য ও অনস্বীকার্যভাবে কেহই বুঝিতে ও ধরিয়া দেখিতে পারে না। তাহা নিঃসন্দেহে জানিতে ও দেখিতে পারেন একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা। তাই আল্লাহ্র এই বাক্যটির তাৎপর্য হইলঃ কেহ প্রকৃতই রোযা রাখিয়াছে কিনা তাহা একমাত্র আমিই জানিতে পারি। একমাত্র আমার জন্যই রোযা রাখা হইয়াছে কিনা তাহাও আমি ছাড়া অন্য কাহারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়। অতএব কাহার রোযার কি প্রতিফল হইতে পারে, তাহাও আমি ছাড়া আর কেহ জানিতেও পারে না। আর উহার যথাযথ প্রতিফল দেওয়া আমি ছাড়া আর কাহারো পক্ষেই সম্ভব নয়। উহার সাধ্যও কাহারও নাই।
দ্বিতীয় কারণ এই যে, রোযায় আছে কৃচ্ছ্র সাধন, প্রবৃত্তি দমন ও দৈহিক অবক্ষয়তা। আর তাহার জন্য প্রয়োজন ক্ষুৎ-পিপাসায় অপরিসীম ধৈর্য ধারণ; কিন্তু এতদ্ব্যতীত অন্যান্য ইবাদত-নামায-হজ্জ্ব-যাকাত-আদায়ে থাকে অর্থ ব্যয় ও দৈহিক ব্যস্ততা। ফলে এই দুই ধরনের ইবাদত-রোযা এবং নামায-হজ্ব-যাকাত আদায়ে-আকাশ পাতালের ব্যবধান। হাদীসে উক্ত আল্লাহ্র বাণীঃ
====================
রোযাদার আমারই কারণে-আমারই নির্দেশ পালনে ও আমারই সন্তোষ বিধানের উদ্দেশ্যে-তাহার প্রবৃত্তি দমন করে ও পানাহার পরিহার করে।
এই কথা হইতে স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, নিছক পানাহার ও স্ত্রী সহবাস পরিত্যাগ করাকেই রোযা বলা যায় না। এই সবের সঙ্গে সঙ্গে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইল নিয়্যত-আল্লাহ্র জন্য প্রকৃত্রিম একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা, কেবল আল্লাহ্র জন্যই এইসব পরিত্যাগ করা। সেই সঙ্গে ইহাও প্রতিভাত হইয়া উঠে যে, রোযার আদৌ কোন রিয়াকারী বা দেখানোপনার স্থান নাই। কেননা একজন প্রকৃত রোযাদার না হইয়াও যদি নিজেকে রোযাদার প্রকাশ করে, তাহা হইলেই সে আসলে রোযাদার হয় না।
এই বাক্যের আর একটি অর্থ এই হইতে পারে যে, এই রোযা একান্তভাবে আমারই জন্য রাখা হইয়াছে। ইহাতে অন্য কেহই আমার সঙ্গে শরীক নাই এবং রোযা রাখিয়া রোযাদার আমার ছাড়া আর কাহারও ইবাদত করে না। আর কাহারও সন্তষ্টিলাভ তাহার লক্ষ্য নয়। আর কাহারও নিকট হইতে সে ইহার প্রতিফল পাইতে চাহে নাই। কেননা অন্যান্য যেসব ইবাদত দ্বারা আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করা যায়, তাহা মুশরিকরাও তাহাদের মা’বুদের জন্য করে এবং করিতে থাকে। কিন্তু রোযা সেরূপ নয়। বস্তুত কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই রোযা রাখা হইয়াছে কিনা, পাহানার স্ত্রী সহবাস পরিহার কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে ও তাঁহারই বিধানমত করা হইয়াছে কিনা, তাহা সেই আল্লাহ্ ছাড়া আর কেহই জানিতে পারে না। আল্লামা ইবনুল কায়্যিমের মতে ইহাই রোযার হাকীকত-রোযার মর্মকথা। অধিকন্তু অন্যান্য সব ইবাদতে কৃতিমতা ও রিয়াকারী সম্ভব, কিন্তু রোযার তাহার কোন অবকাশ নাই। ======
রোযাদারের জন্য দুইটি সুখ-আনন্দ ও স্ফুর্তির মুহূর্ত রহিয়াছে। উহার একটি এই দুনিয়ার জীবনে-একটি মুহূর্ত ও ক্ষেত্র রোযা কাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসে। আর দ্বিতীয়টি কেবলমাত্র পরকালে প্রাপ্তব্য। প্রথম সুখ ও স্ফুর্তিটি লাভ করা যায় ইফতার করার সময়। কেননা একে তো একটানা ১৩-১৪ ঘন্টা পর্যন্ত ক্ষুধা ও পিপাসার দুঃসহ জ্বালা সহ্য করার পর পানাহার করার অবাধ সুযোগ আসে ইফতারের মুহূর্তে। আর দ্বিতীয়ত একটি রোযা যথাযথভাবে সম্পন্ন করিতে পারার ও আল্লাহর নিকট হইতে অসীম সওয়াবের অধিকারী হওয়ার সাফল্য ও সার্থকতার শোকর মিশ্রিত আনন্দ। এই মুহুর্ত সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
======================================
ক্ষুৎ-পিপাসার অবসান হইল এবং প্রতিফলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইল। হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
====================================
ইফতারের সময় রোযাদারের দোয়া আল্লাহর নিকট অবশ্যই কবুল হয়।
আর দ্বিতীয় সুখ-স্ফুর্তি ও আনন্দ লাভ হইবে আল্লাহর সহিত সাক্ষাৎ লাভকালে। ইহা হইবে কিয়ামতের দিন, হাশরের ময়দানে।বস্তুত মুমিন বান্দার পক্ষে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ অপেক্ষা অধিক আনন্দ-সুখ ও স্পূর্তির ব্যাপারে আর কিছুই হইতে পারে না। কেননা সারাটি জীবন যাঁহার বন্দেগীতে অতিবাহিত করিয়াছে দুনিয়ায় সে তাঁহাকে দেখিতে পায় নাই। না দেখিয়াই আনুগত্য আরাধনা করিয়াছে, তাঁহাকে দেখিতে পাওয়ার বাসনাও আকংক্ষা যে অসাধারণভাবে তীব্র হইবে তাহাতে আর সন্দেহ কি? কিন্তু শত কামনা, শত ইচ্ছা সত্ত্বে ও এই দুনিয়ায় তাঁহাকেও দেখা যাইবে না। কিয়ামতের দিন আল্লাহ্তা আলা নিজেই সেই সাক্ষাৎ পিপাসুদের সামনে সমুদ্ভাসিত হইবেন।
রোযাদারের মুখে একটা তীব্র গন্ধ জাগে। এই গন্ধটি অন্য একজনের পক্ষে দুঃসহ ও ঘৃণ্য হ্ইলেও আল্লাহর নিকট ইহার মূল্য অপরিসীম। কেননা কেবলমাত্র রোযা থাকার কারণেই এই গন্ধ। আর রোযা যেহেতু কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য আল্লাহ নিজেই উহার প্রতিফল দিবেন। এই কারণে আল্লাহর নিকট উহা অতটা সুগন্ধ, মানুষের নিকট যতটা সুগন্ধ মিশক আতর। কিন্তু সে জন্য রোযার দিনে দাঁত মাজা ও মিস্ওয়াক করা বন্ধ করিতে হইবে-এমন কথা নয়। কেননা এখানে যে গন্ধের কথা বলা হইতেছে তাহা দাঁত মাজা ও মিসওয়াকে করার পরও নিঃশেষ হইয়া যায় না।
হাদীসের ঘোষণাঃ রোযা ঢাল স্বরূপ। ঢাল শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ ও প্রতিহত করে। দুনিয়ার জীবনে রোযাদারকে গুনাহ খাতা হইতে রক্ষা করে। আর পাকালে ইহা বাঁচায় জাহান্নাম হইতে। অতএব রোযার মর্যাদা রক্ষার্থে গুনাহের কাজ হইতে বিরত থাকিতে হইবে এবংঅশ্লীল কথাবার্তা ও বাজে বকাবকি ও উচ্চস্বরে চিৎকার হট্টগোল সম্পূর্ণরূপে পরিহার করিতে হইবে। তবেই রোযা নিখুঁত, ত্রুটিমুক্ত ও সম্পূর্ণ হইবে। তখনই রোযার ঢাল হওয়ার বাস্তবতা প্রামণিত হইবে। বুখারীর বর্ণনায় এখানে ব্যবহৃত শব্দ হইল। ================== মুর্খতা করিবে না’ জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক বিরোধী কাজকেই মুর্খতা বলে। ইহা অত্যন্ত ব্যাপক কথা। রোযা রোযাদারের জন্য বড় ঢাল হইয়া দেখা দেয় তখন, যখন কেহ তাহাকে গালমন্দ বলে কিংবা ঝগড়া-ঝাটি করিয়া মারিতে উদ্যত হয়, তখন সে বলিবেঃ আমি রোযাদার’। অর্থাৎ, আমি রোযাদার হওয়ার কারণে তোমার গালমন্দের জওয়াবে আমি তোমাকে গালমন্দ বলিব না এবং তোমার আঘাতের জওয়াবেও আমি তোমার উপর আঘাত হানিব না-তোমার সহিত মারামারিতে লিপ্ত হইব না। এই কথা শোনার পর প্রতিপক্ষ অবশ্যই শান্ত.হীনবীর্য ও নিরুদ্যম হইয়া পড়িবে। রোযাদারের জন্য রোযা বাস্তবিকই অতিবড় ঢাল,তাহা এই সময়ে মর্মে মর্মে অনুভব করা যায়।===============
রোযাদারের সৌভাগ্য
=================================================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ আমার উস্মতকে রমযান মাসে পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করা হয়, যাহা তাহাদের পূর্বের কোন উস্মতকে দেওয়া হয় নাই। সে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য হইলঃ রোদারের মুখের বিকৃত গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধি হইতেও উত্তম, যতক্ষণ না ইফতার করে ফেরেশতাগণ তাহাদের জন্য ক্ষমা চাহিতে থাকে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক দিন তাঁহার জান্নাতকে সুসজ্জিত করিয়া রাখেন; অতঃপর (জান্নাতকে সম্বোধন করিয়া) বলিতে থাকেনঃ আমার নেক বান্দাদের বৈষায়িক শ্রম,দায়িত্ব ও কষ্ট-নির্যাতন শীঘ্রই দুর করা হইবে। তাহারা তোমার নিকট পরিণতি পাইবে। এই মাসে প্রধান দুষ্কৃতিকারী শয়তানদিগকে রশি দিয়া বাঁধিয়া রাখা হইবে। অতঃপর তাহরা মুক্ত হইবে না যেমন তাহারা মুক্ত থাকে রমযান ছাড়া অন্য সময়ে। আর নেক বান্দাদের জন্য শেষ রাত্রে মাগফিরাত দান করা হইবে। প্রশ্ন করা হইল, হে রাসূল্লাহ। ইহা কি কদর রাত্রির কথা? বলিলেনঃ না, কিন্তু আমলকারী যখন তার আমল সম্পূর্ণ করিবে, তখন তাহার প্রতিফল তাঁহাকে পুরাপুরি আদায় করিয়া দেওয়া হইবে।-মুসলাদে আহমদ,বায়হাকী,আল-মুনযেরী
ব্যাখ্যা হাদীসটি রোযাদারদের জন্য বিশেষ উৎসাহব্যঞ্জক এবং পরম সৌভাগ্য সুসংবাদদাতা। রাসূলে করীম (স)-এর উষ্মতকে রমযান মাসের রোযা রাখার ফলে পাঁচটি বিশেষ সৌভাগ্য দানের কথা বলা হইয়াছে। এই উষ্মত কাহারা?-যাহারা রাসূলে করীম (স)-এর দ্বীনের দাওয়াত সর্বান্তঃ করণে কবুল করিয়াছে ও সেই অনুযায়ী জীবন-যাপন করিতেছে এবং দ্বীনের সব আদেশ নিষেধ যথাযথভাবে পালন করিতেছে।
প্রথম সৌভাগ্য হইল, রোযাদারের মুখে বিকৃত গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশক-এর গন্ধ হইতেও অধিক প্রিয়। রোযাদার সারাদিন কিছুই পানাহার করে নাই। এইজন্য মুখে এক প্রকার গন্ধ স্বাভাবিকভাবেই জন্মে; উহা আল্লাহর নিকট সাধারণ সুগন্ধি হউতেও অধিক প্রিয়। কেননা মুখের এই গন্ধ বিকৃতি ঘটিয়াছে আল্লাহর আদেশ পালন করিতে গিয়া রোযা পালনের ফলে সারাদিন কিছুই পানাহার না করার দরুন। আর এই কাজ যে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় হইবে তাহাতে আর সন্দেহ কি।
দ্বিতীয় সৌভাগ্য হইল, তাহারা যতক্ষণ রোযাদার থাকিবে ইফতার করিবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তাহাদের জন্য আল্লাহর নিকট মাঘফিরাত চাহিতে থাকিবে। রোযাদারের জন্য ফেরেশতাদের এই মাগফিরাত চাওয়া যে তাহাদের বড়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার, তাহা বলাই বাহুল্য।
তৃতীয় সৌভাগ্যের বিষয় হইল, আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক দিন তাঁহার জান্নাতকে সুন্দরভাবে সাজাইয়া রাখিবেন, প্রত্যেক দিন উহাকে নতুন করিয়া সজ্জিত করিবেন এবং জান্নাতকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে থাকিবেন, আমার নেক বান্দাদের সব বৈষায়িক কষ্ট-শ্রম ক্লেশ ও পীড়ন দুর হইয়া গেলে তাহারা এই জান্নাতে আসিয়া প্রবেশ করিবে। দুনিয়ার জীবন শেষ হওয়ার পর এই জান্নাতই হইবে তাহাদের শেষ পরিণতি, শেষ আশ্রয়স্থল। এখানে নেক বান্দা বলিয়া যে রোযাদার -রীতিমত রোযা পালনকারীমুসলমানদের-কথা বলা হইয়াছে,তাহাতে সন্দেহ নাই। বস্তুত দুনিয়ার সব মানুষকেই-আল্লাহর নেক বান্দাদেরকেও-সন্তান পালনও পরিবার বহনের জন্য প্রাণ্যন্তকর খাটা-খাটনি করিতে হয়। সেইজন্য অনেক কষ্ট ও ক্লেশ স্বীকার করিতে হয় এবং দুনিয়ার জীবনে নানা প্রতিকূল অবস্থায় অনেক অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করিতে হয়। কিন্তু ইহা অশেষ নয়। ইহার চুড়ান্ত অবসান হয় মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে। আর মৃত্যু অবধারিত। এই মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার পরই রোযাদার নেক-বান্দারা জান্নাতবাসী হইবে। দুনিয়ার শত শত কষ্ট ও দুঃখের মাঝেও তাহারা যে রোযা পালনের কষ্ট স্বীকার করিয়াছে, এই জান্নাত হইবে তাহাদের এই আমলের পরিণাম।
চতুর্থ এই যে, রোযাদার মাসে শয়তানের দলের প্রধান প্রধান দুষ্কৃতিকারীদিগকে বাধিঁয়া রাখা হয়- সব শয়তানকে নয়। তাহাদিগকে বাঁধিয়া রাখার ফলে আল্লাহর নাফরমানীর কাজ এই মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক কম হইয়া থাকে। ফলে সমগ্র পরিবেশ ঈমানদার লোকদের জন্য খুবই অনুকূল হইয়া পড়ে। নেক আমলের পথে প্রতিকূলতা অনেকখানি হ্রাস পাইয়া যায়।
পঞ্চম এই যে সারা রোযার মাসের শেষরাত্রে তাহাদের জন্য গুনাহ নাফী দেওয়া হয়। রোযার মাসে তাহারা যেন নেক কাজ করে, এই মাফী তাহারই প্রতিফল। কিন্তু ইহা কদর রাত্রিতে প্রাপ্তব্য ক্ষমা হইতে ভিন্নতর। এই মাফী কেবল তাহারাই পাইবে, যাহারা রমযান মাস রোযা রাখিবে ও প্রতিমুহুর্তে আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমাসমূহ রক্ষা করিয়া চলিবে। কিন্তু যাহারা রোযা রাখিবে না, তাহারা এই মাফী পাইবে না। তাহারা পাইবে অপমান ও লাঞ্জনা-দুনিয়াও আখিরাত-উভয়ক্ষেত্রেই।
রোযার পরকালীন ফল
===========================================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইবে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ঘোষণা করিয়াছেনঃ যে লোক রমযান মাসের রোযা রাখিবে ঈমান ও চেতনাসহকারে, তাহার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে।
-বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসারী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা রমযানের রোযা ফরয রোযা। এই রোযা যথাযথভাবে রাখার জন্য এই হাদীসে বিশেষ উৎসাব্যঞ্জক সুসংবাদ দান করা হইয়াছে। এই পর্যায়ে দুইটি শব্দের উল্লেখ হইয়াছে। একটি =======আর দ্বিতীয়টি ======= এখানে প্রথম শব্দটির অর্থ, নিয়্যত এবং দ্বিতীয় শব্দটির অর্থ দৃঢ়সংকল্প। অর্থাৎ রোযা রাখিতে হইতে ঈমান সহাকারে, এই বিশ্বাস সহকারে যে, রোযা আল্লাহ তা আলাই ফরয করিয়াছেন এবং মসুলমান হিসাবে ইহা আমার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়ত এই রোযা রাখিতে হইবে একান্তভাবে আল্লাহর সন্তোষ বিধানের উদ্দেশ্যে,লোক দেখানোর জন্য নয় এবং রাখিতে হইবে এই আশায় যে, এই জন্য আল্লাহতাআলার নিকট হইতে বিশেষ সওয়াব ও প্রতিফল পাওয়া যাইবে। উপরন্ত এইজন্য মনে দুরন্ত ইচ্ছা বাসনা ও কামনা থাকিতে হইবে। রোযা রাখার প্রতি একবিন্দু অনীহা ও বিরক্তিভাবে থাকিতে পারিবে না, উহাকে একটা দুর্বহ বোঝা মনে করিতে পারা যাইবে না-রোযা রাখা যতই কষ্টকর হউক না কেন। বরং রোযার দিন দীর্ঘ হইলে ও রোযা থাকিতে কষ্ট অনুভুত হইলে উহাকে আল্লাহর নিকট হইতে আরো বেশী সওয়াব পাওয়ার কারণ মনে করিতে হইবে। বস্তুত এই ধরনের মন ও মানুসিকতা সহকারে রোযা রাখা হইলে উহার ফলস্বরূপ অতীতের যাবতীয় গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে।
রোযার বিনিময়ে গুনাহ মাফ হইবে। হাদীসের শাব্দিক ঘোষণার আলোকে স্পষ্ট হয় যে, সগীরা-কবীরা সর্বপ্রকার গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে। আল্লাহর অনুগ্রহ সীমা-শেষহীন। কিন্তু এ পর্যায়ে হাদীসবিদদের সিদ্ধান্ত এই যে, কেবলমাত্র সগীরা গুনাহই মাফ হইবে, কবীরা নয়। কেননা কবীরা গুনাহ তওবা ছাড়া মাফ না হওয়া সম্পর্কে কোন দ্বিধা বা সন্দেহ নাই ইমাম নবতী অবশ্য হাদীসের সাধারণ ঘোষণার প্রেক্ষিতে কেবল সগীরা গুনাহ মাফ হইবে বলার আপত্তি জানাইয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ গুনাহ মাফীর কাজ গুলি যদি সমস্ত গুনাহ মাফ করাইবার মত হয় তবে উহা তাহাই করিবে। কবীরা গুনাহ মাফীর মত আমল হইলে তাহাও মাফ হইয়া যাইবে। আর কবীরা গুনাহ্ না থাকিলে ইহার দরুন জান্নাতে রোযাদারের মর্যাদা অনক বৃদ্ধি পাইবে। কোন কোন হাদীসবিদ মনে করেন,সগীরার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু কবীরা গুনাহও যে মাফ হইবে না-সেইরূপ ধারণা ঠিক নয়। বরং কবীরা গুনাহের মাফী পাওয়ারও আশা মনে মনে করা আবশ্যক।
[উদ্ধৃত হাদীসটির শেষ শব্দটি ==================== কেবলমাত্র মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় বড়তি শব্দ হিসাবসে আসিয়াছে । অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে এই শেষ শব্দটি নাই।]
==================================================
হযরত সহল ইবনে সা’দ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ বেহেশতের একটি দুয়ার আছে, উহাকে রাইয়্যান বলা হয়। এই দ্বারপথে কিয়ামতের দিন কেবমাত্র রোযাদার লোকেরাই বেহেশতে প্রবেশ করিবে। তাহাদের ছাড়া অন্য কেহ এই পথে প্রবেশ করিবে না। সেদিন এই বলিয়া ডাক দেওয়া হইবেঃ রোযাদার কোথায়? তাহারা যেন এই পথে প্রবেশ করে; এইভাবে সকল রোযাদার ভিতরে প্রবেশ করার পর দুয়ারটি বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে। অতঃপর এই পথে আর কেহই প্রবেশ করিবে না।
-বুখারী, মুসলিম
ব্যাখ্যা রোযাদার ত্যাগ ও তিতিক্ষা অনুপাই যে তাহাকে রোযার প্রতিফল দেওয়া হইবে, উপরিউক্ত হাদীসটিতে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় তাহা বলা হইয়াছে। বস্তুত রোদারের পিপাসার্ত থাকাই তাহার সর্বাপক্ষা বড় ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার। এই কারণে তাহাকে উহার যে প্রতিফল দেওয়া হইবে, তাহাতে পিপাসার বিপরীত অধিক বেশী পানীয় পান করার পান করিয়া পিপাসার জ্বালা নিবৃত্ত করার ব্যবস্থা থাকা একান্তই বাঞ্জনীয়। হাদীসটিতে জান্নাতের যে দরজা দিয়া প্রবেশ করার কথা বলা হইয়াছে, পিপাসার্তের প্রতিফলের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া উহার নামকরণ করা হইয়াছে ’রাইয়্যান’==========ইহার অর্থ ‘সদা-প্রবহমান প্রসবণ’। ইহার বিপরীত শব্দ========খুব বেশী পিপাসার্ত,’পিপাসা-জর্জরিত। রোযাদার থাকিয়া দুনিয়ার জীবনে নিরতিশয় পিপাসা কষ্ট ভোগ করিয়াছে-করিয়াছে একান্তভাবে আল্লাহর জন্য। এই কারণে তিনিই তাহাদিগকে পরকালে ‘চিরনিঝর দ্বারপথে জান্নাতে প্রবেশ করাইবেন। যেন তাহারা জান্নাতে প্রবেশ করিলেই চির জীবনের পিপাসা নিবৃত্ত করার সার্থক সুযোগ লাভ করিতে পারে। নাসায়ী ও ইবনে খুযায়মা উদ্ধৃত হাদীসে তাই বলা হইয়াছেঃ
=====================================================
যে লোকই সেই দ্বারপথে প্রবেশ করিবে, সে-ই পান করিবে। আর যেই পান করিবে,সে আর কোন দিনই পিপাসার্ত হইবে না।
হাদীসের ভাষা হইল===========জান্নাতের মধ্যে =======জান্নাতের জন্য বলা হয় নাই। এইভাবে বলিয়া বুঝানো হইয়াছে যে, জান্নাতের এই বিশেষ দরজাটিতে এমন সব নিয়ামত ও সুখ-আনন্দ সমগ্রী রহিয়াছে, যাহা জান্নাতের ভিতরে নাই। সেই সঙ্গে উহার প্রতি অধিকতর উৎসাহী ও আগ্রহান্বিত হইয়া উহা লাভ করার জন্য জনগণকে উৎসাহিত ও করা হইয়াছে।
কিয়ামতের দিন এই দ্বারপথে কেবলমাত্র রোযাদাররাই প্রবেশ করিবে। হাশরের ময়দানে রোযাদার কে কোথায় রহিয়াছে তাহাদিগকে ডাকিয়া আনা হইবে ও সেই দরজা দিয়া জান্নাতে প্রবেশ করানো হইবে। এইভাবে সব রোযাদারের প্রবেশ সম্পূর্ণ হইয়া যাওয়ার পর-প্রবেশ করার মত আর একজনও যখন বাহিরে পড়িয়া থাকিবে না, তখন সেই দরজাটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে। অতঃপর সেই পথে আর কেহই প্রবেশ করিবে না। এই সম্পূর্ণ কথাটিই রোযাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও নিয়ামতদানের ব্যবস্থা করার কথাই বুঝাইয়াছে। বস্তুত যে ধরনের উত্তম ও বিষেশ প্রতিফল রোযাদারগণকে দেওয়া হইবে তাহা আর কাহাকেও দেওয়া হইবে না।================ ==================================হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছিঃ যে লোক একটি দিন আল্লাহর পথে রোযা রাখিবে, আল্লাহ্ তাহার মুখমণ্ডলকে জাহান্নাম হইতে সত্তর বৎসর দূরে সরাইয়া রাখিবেন।
-বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ্ , মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা এই হাদীসটিতে রোযার পরকালীন শুভফলের একটি দিক ঘোষিত হইয়াছে। যে লোক একটি দিন রোযা রাখিবে, আল্লাহ্ তাহাকে কখনো জাহান্নামে যাইতে দিবেন না। জাহান্নাম হইতে তাহাকে বহুদুরে সরাইয়া রাখিবেন। কিন্তু এই রোযা ফী-সাবিলিল্লাহ্-আল্লাহর উদ্দেশ্য ও আল্লাহর সন্তুষ্টি পাইবার আশায়-রাখিতে হইবে।এই রোযা রাখার দরুন তাহাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা চলিবে না, কোন ‘হক’ বা অধিকার নষ্ট করা চলিবে না। এমনকি রোযার মাসে কাফিরদের সহিত যুদ্ধ বাধিলে যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়া ইহার কারণে বাধাগ্রস্থ হইয়া পড়িতে পারিবে না।
এইরূপ রোযাদারকে আল্লাহ তা’আলা জাহান্নাম হইতে দূরে রাখিবেন’ অর্থ তাহাকে জাহান্নাম হইতে নিষ্কৃতি দিবেন। ‘সত্তর খরীফ’ অর্থ সত্তর বৎসর। ‘আর সত্তর বৎসর’ পরিমাপ পথের দূরত্ব হয় ২১০ মাইল। এখানে এই নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বই আসল উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য বহু-বহু দূরত্বে রাখার, তাহার গায়ে জাহান্নামের একবিন্দু আচঁও না-লাগানোর কথা বুঝানো হইয়াছে।
রোযা না রাখার অনুমতি
=======================================================
কুরআন মজীদের আয়াতঃ যাহারা রোযা রাখিতে সমর্থ (বা সমর্থ নয়), এক দরিদ্র ব্যক্তির খাবার বিনিময় মূল্য হিসাবে দেওয়া তাহাদের কর্তব্য সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস বলিয়াছেনঃ থুরথুরে বৃদ্ধ ও খুব বেশী বয়সের বৃদ্ধার জন্য রোযা রাখিতে সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও এই সুবিধাদান করা হইয়াছে যে, তাহারা দুইজন রোযা ভাঙ্গিবে (রোযা রাখিবে না) আর প্রত্যেকটি দিনের রোযার পরিবর্তে একজন গরীব-ফকীর ব্যক্তিকে খাওয়াইবে। এবংগর্ভবতী ও যে স্ত্রীলোক শিশুকে দুগ্ধ সেবন করায়-এই দুইজন যদি তাহাদের সন্তানদের ব্যাপারে আশংকাবোধ করে, তবে তাহারা রোযা ভাঙ্গিবে ও মিসকীন খাওয়াইবে।
-আবূ দাউদ
ব্যাখ্যা কুরআন মজীদের এই আয়াতটি সূরা আল-বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াত। এই আয়াতটি সম্পর্কে তফসীরকার ও হাদীসসিবদদের মধ্যে বিশেষ মতভেদের উদ্ভব হইয়াছে। উপরিউক্ত হাদীসটিতে হযরত ইবনে আব্বাসের অভিমত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিবৃত হইয়াছে। তাঁহার মত হইল, এই আয়াতটি শাশ্বত। ইহার অর্থ ও তাৎপর্য চির কার্যকর। এই আয়াত অনুযায়ী গর্ভবতী বা যে মেয়েলোক নিজের গর্ভজাত সন্তানকে দুগ্ধ সেবন করায় তাহাদের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রহিয়াছে। যে বৃদ্ধ বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রোযা রাখার সামর্থ্য রাখে, তাহাকে রোযা রাখিতে হইবে। সে বিনিময় মূল্য-ফিদইয়া-দিয়া রোযা রাখার দায়িত্ব এড়াইতে পারিবে না। কিন্তু গর্ভবতী ও দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা-যে দুগ্ধ সেবন করায়-রোযার মাসে রোযা ভাঙ্গিলে প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে একজন করিয়া ফকীর খাওয়াইতে হইবে এবং অসুবিধার সময় অতিবাহিত হইয়া যাওয়ার পর রোযা কাষা করিতে হইবে। তাহাদের উপর না-রাখা রোযা কাষা করিবার বাধ্যকতার সঙ্গে সঙ্গে মিসকীন খাওয়াইবার দায়িত্ব এইজন্য চাপানো। হইয়াছে,যে তাহারা নিজেদের নয়, অন্যের কারণে রোযা ভাঙ্গিতেছে। রোযা রাখিলে গর্ভস্থ কিংবা দুগ্ধপোষ্য শিশুর ক্ষতি হইবে’ এই ভয় ও আশংকাই তাহাদের রোযা ভাঙ্গার মূল কারণ, পক্ষান্তরে থুরথুরে নড়বড়ে বৃদ্ধকে রোযা ভাঙ্গার অনুমতি দেয়া সত্ত্বেও মিসকীন খাওয়ানোর দায়িত্ব আরোপ করা হাইয়াছে। কেননা সে রোযা ভাঙ্গিতেছে নিজের দৈহিক অক্ষমতার কারণে। ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল ও মুজাহিদ এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
কিন্তু যে থুরথুরে নড়বড়ে বৃদ্ধ রোযা থাকিতে অক্ষম, সে শুধু মিসকীন খাওয়াইবে। তাহাকে রোযা কাষা করিতে হইবে না। হযরত আনান (রা) হইতে এই কথাই বর্ণিত হইয়াছে। তিনি যখন খুব বেশী বয়োবৃদ্ধ হইয়াছিলেন, তখন তিনি নিজেই ইহা করিয়াছেন। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আওযায়ীর এই মত। ইমাম আওযায়ী, সওরী এবং হানাফী মাযহাবের লোকেরা বলিয়াছেন, গর্ভবতী ও দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা না-রাখা রোযা শুধু কাষা করিবে, মিসকীন খাওয়াইতে হইবে না। এই দুইজনের অবস্থা রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মত। হাসান বসরী, আতা,নখয়ী ও যূহুরী হইতেও ইহাই বর্ণিত হইয়াছে। ইমাম মালিক ইবনে আনাস বলিয়াছেন, গর্ভবতী নারী রোগীর মতই শুধু রোযা করিবে, মিসকীন খাওয়াইবে না। আর শিশুকে দুগ্ধ সেবন করাইবার কারণে যে স্ত্রীলোক রোযা ভাঙ্গিবে, সে মিসকীনও খাওয়াইবে এবং রোযা কাযাও করিবে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
থুরথুরে নড়বড়ে বৃদ্ধকে রোযা ভাঙ্গার প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে একজন মিসকীন খাওয়ানোর সুযোগ দেওয়া হইয়াছে। তাহাকে না-রাখা রোযা কাষা করিতে হইবে না।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হইয়াছে, একজন গর্ভবতী কিংবা দুগ্ধপোষ্য শিশুর জননীকে তিনি বলিয়াছিলেনঃ
=========================================
যাহারা রোযা রাখিতে অসমর্থ, তুমিতো তাহাদের মধ্যে গণ্য। অতএব তোমার ফিদইয়া দেওয়াই যথেষ্ট। কাষা করিবার প্রয়োজন নাই।
দুদ্ধপোষ্য শিশুর এক জননীকে তিনি বলিয়াছিলেনঃ তুমি রোযা ভাঙ্গ। তোমাকে কাষা করিতে হইবে না।
এই বর্ণনা কয়টির সনদ খুবই মজবুত এবং গ্রহণযোগ্য।==================
রোযা ও কুরআনের শাফা’আত
==========================================================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ রোযা ও কুরআন রোযাদার বান্দার জন্য শাফা’আত করিবে। রোযা বলিবে, ‘হে আল্লাহ্। আমিই এই লোকটিকে রোযার দিনগুলিতে পানাহার ও যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা হইতে বিরত রাখিয়াছে। অতএব তুমি ইহার জন্য আমার শাফা’আত কবুল কর। আর কুরআন বলিবেঃ ‘হে আল্লাহ। আমিই তাহাকে রাত্রিকালে নিদ্রামগ্ন হইতে বাধাদান করিয়াছি। কাজেই তাহার জন্য আমার শাফা’আত গ্রহণ কর। [রাসূলে করীম (স) বলিলেন] অতঃপর এই দুইটি জিনিসের শাফা’আত কবুল করা হইবে।
-বায়হাকীঃশুআবিল ঈমান
ব্যাখ্যা যে লোত সত্যই রোযা পালন করিবে, তাহার জন্য স্বয়ং রোযাই কিয়ামতের দিন শাফা’আত করিবে। জাহান্নামের আগুন হইতে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর নিকট আবেদন জানাইবে। বস্তুত রোযা আল্লাহ্রই ফরয করা কর্মানুষ্ঠান। দুনিয়ায় ইহার কোন দৈহিক অস্তিত্ব পরিলক্ষিত না হইলেও কিয়ামতের দিন ইহা শরীরী হইয়া দাঁড়াইবে এবং কাহারও পক্ষে তাঁহার কোন আবেদন নিবেদন যে আল্লাহর নিকট গ্রাহ্য হইবে, তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।
অনুরূপভাবে যে লোক রোযার রাত্রিগুলিতে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করিবে বা অন্যের তিরলাওয়াত মনোযোগ সহকারে শুনিবে এবং এই কুরআন তিলাওয়াতের জন্যই যে লোক রাত্রির মধু নিদ্রা পরিহার করিবে, কুরআন শরীফ নিজেই তাহার পরকালীন মুক্তি জন্য আল্লাহ্র নিকট বলিষ্ঠ সুপারিশ পেশ করিবে।
কুরআন শরীফ আল্লহ্র নিজের কালাম। উহা যাহার মুক্তির জন্য আল্লাহ্র দরবারে সুপারিশ রাখিবে, তাহা যে তাঁহার নিকট সাদরে গৃহীত হইবে, তাহা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
বস্তুত যে বান্দা কিয়ামতের দিন এই দুইটি মহান জিনিসের সুপারিশ ও শাফা’আত লাভ করিবে, সেই লোক যে কত বড়ই সৌভাগ্যবান, তাহা বর্তমান সময়ে অনুধাবন করিতে না পারিলেও কিয়ামতের দিনে অত্যন্ত প্রকট হইয়া উঠিবে। অতএব এই সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য এই দুনিয়ায় যেমন রোযা থাকা আবশ্যক, তেমনি রাত্রিকালে কুরআন তিলাওয়াত করাও বাঞ্চনীয়।
ব্যর্থ রোযা
===================================================
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোক মিথ্যা কথা ও মিথ্যার আমল পরিত্যাগ করিল না, তাহার খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করায় আল্লাহ্র কোনই প্রয়োজন নাই।
-বুখারী
ব্যাখ্যা রোযার মোটামুটি ও সোজাসুজি ব্যবস্থা হইল পানাহার পরিত্যাগ করা। কিন্তু মূলত কেবলমাত্র পানাহার পরিত্যাগ করারই নাম রোযা নয়। এই পানাহার পরিত্যাগ করিতে হইবে কেবলমাতো আল্লাহ্র জন্য, আল্লাহ্র সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্য এবং আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপনের স্থির সংকল্প সহকারে। কেহ যদি এই ভাবধারার সহিত রোযা রাখে, তাহা হইলে মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা আমল করা-ঊভয়ই তাহাকে অবশ্যই পরিত্যাগ করিতে হইবে। সর্বোপরি, রোযা, যে আল্লাহ্র জন্য, সেই আল্লাহ্র পূর্ণাঙ্গ বিধান পালন করিয়া জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে পূর্ণমাত্রায় সহতি ও সামঞ্জস্য সংস্থাপন করিতে হইবে। রোযা রাখা ও সেই সঙ্গে মিথ্যা কথা বলা মিথ্যা ও অশ্লীল কাজ-কর্ম করা সম্পূর্ণরূপে পরষ্পর বিরোধী ব্যাপার। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধানের উদ্দেশ্যই হইল মানব জীবনের সবদিকের সহিত সামঞ্জস্য স্থাপন। কিন্তু যে লোক রোযা রাখিয়াও মিথ্যা কথা বলে ও মিথ্যা কাজ করে, সে সে কার্যত রোযার অপমান করে, লোকদের সামনে রোযাকে উপহাসের বস্তুতে পরিণত করে।
আরবী ভাষায় =========শব্দটির শাব্দিক অর্থঃ কোন এবদিকে ঝুকিঁয়া পড়া। এই হিসাবে উহার ব্যবহারিক অর্থঃ মিথ্যা, অসত্য বাতিল। ইহাকে =====বলা হয় এইজন্যই যে, এই কয়টিই সত্য বিরোধী, সত্য হইতে বিচ্যুত। ইমাম কুরতুবী লিখিয়াছেনঃ
=============================
যাহাই সত্যের পরিপন্থী, তাহাই মিথ্যা, বাতিল ও বিপরীত দিকে বুকিঁয়া পড়া।
নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ========================
মিথ্যা সাক্ষ্যদান আল্লাহ্র সাথে শির্ক করার সমান অপরাধ।
অপর এক হাদীসে নবী করীম (স)-এর বাণী উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
=============================
আল্লাহ্র সহিত শিরক করা, পিতামাতার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দান ও মিথ্যা কথা বলা- এইসব কয়টিই হইল সবচাইতে বড় কবীরা গুনাহ্।
এই ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে আলোচ্য হাদীসটির মূল কথাঃ যে লোক রোযা থাকিয়া মিথ্যা কথা ও মিথ্যা আমল পরিহার করিতে পারিল না, তাহার এই পানাহার ত্যাগ করার আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নাই। অর্থাৎ আল্লাহ্র নিকট এই পানাহার পরিহার ’রোযা রূপে গৃহীত হইবে না। আর আল্লাহ্র নিকটই যদি তাহা গৃহীত না হইল, তবে ক্ষুধা পিপাসায় কষ্ট পাওয়া নিতান্তই অর্থহীন। একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
==================================================
যে লোক অশ্লীল কথাবার্তা ও মিথ্যা পরিত্যাগ করিল না, তাহার পানাহার পরিত্যাগ করা আল্লহ্র কিছুমাত্র পছন্দনীয় নয়।-=========================
এই হাদীসটির উদ্দেশ্য হইল রোযাদারের চরিত্র সংশোধন করা, রোযা রাখার ফলে রোযাদারকে পুরাপুরি ইসলামী আদর্শবাদী ও ইসলামী চরিত্রে মহীয়ান করিয়া তোলাই হইল রোযা উদ্দেশ্য। রোযাদার রোযা রাখিবে আল্লাহ্র জন্য। আল্লাহ্কে ভয় করিয়াই সমস্ত মিথ্যা ইসলামের পরিপন্থি কাজকে-সম্পূর্ণ পরিহার করিয়া চলিবে। রাসূলে করীম(স) ইহাই চাহিয়াছেন।
সফরে রোযা
============================================
হযরত ইবনে আবূ আওফা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমরা কোন এক সফরে রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে ছিলাম। এক সময় রাসূলে করীম (স) এক ব্যক্তিকে বলিলেনঃ অবতরণ কর ও আমার জন্য ছাতু তৈরী কর। লোকটি বলিলঃ ‘হে রাসূল। ঐ দেখুন সূর্য (এখনো অস্ত যায় নাই)।‘ (পরে আর এক সময়) বলিলেনঃ অবতরণ কর ও আমার জন্য ছাতু তৈরী কর। লোকটি বলিল, ‘ইয়া রাসূলে। সূর্যের দিকে তাকান। (পড়ে আর এক সময়) বলিলেনঃ অবতরণ করও আমার জন্য ছাতু তৈরী কর। লোকটি অবতরণ করিয়া ছাতু তৈরী করিল। নবী করীম (স) তাহা পান করিলেন। পরে তাঁহার হাত দ্বারা ঈঙ্গিত করিয়া একদিকে দেখাইলেন ও বলিলেনঃ তোমরা যখন দেখিবে, এইদিক হইতে রাত্র অগ্রসর হইয়া আসিয়াছে, তখন যেন রোযাদারের ইফতার করা হইয়া যায়।
-বুখারী,মুসলিম,আবূ দাউদ, নাসায়ী
ব্যাখ্যা হাদীসে একটি সফরকালীন ঘটনার উল্লেখ হইয়াছে। এই সফর যে রমযান মাসে সংঘটিত হইয়াছিল, তাহা হাদীসের পরবর্তী কথা-রাসূলে করীম (স)-এর ইফতার করার-উল্লেখ হইতেই জানা যায়। বিশেষত মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এই কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত হইয়াছে। তাহা হইলঃ
=================================================
আমরা রমযান মাসে অনুষ্ঠিত এক সফরে রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গী ছিলাম।
কিন্তু রমযান মাসে অনুষ্ঠিত এই সফর কোনটি?-রমযান মাসে তো তিনি একটি সফর করেন নাই, দু্ইটি করিয়াছেন। একটি বদর যুদ্ধকালে আর একটি মক্কা বিজয়ের সময়ে। কিন্তু বদর যুদ্ধকালীন সফরে হযরত ইবনে আবূ আওফা রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে ছিলেন না। তাহা হইলে ইহা নিশ্চয়ই মক্কা বিজয় উপলক্ষে গৃহীত সফর সংক্রান্ত ঘটনা হইবে।
হাদীসে এক ব্যক্তিকে ছাতু তৈরী করার জন্য নির্দশ দেওয়ার উল্লেখ হইয়াছে। এই ব্যক্তির নামরে উল্লেখ উপরোদ্ধৃত বর্ণনায় না থাকিলেও তিনি ছিলেন হযরত বিলাল (রা)। আবূ দাউদের বর্ণনার ভাষা হইলঃ
============================================
বলিলেন, হে বিলাল, অবতরণ কর।
আর এই অবতরণ করিয়া ছাতু তৈরী করার নির্দেশ দিয়াছিলেন তখন, যখন তিনি মনে করিয়াছিলেন যে, সূর্য বুঝি অন্ত গিয়াছে এবং ইফতার করিবার সময় হইয়া গিয়াছে। মুসলিম শরীফের বর্ণনায় ইহার উল্লেখ হইয়াছেঃ
======================================সূর্য যখন অদৃশ্য হইয়া গেল-
কিন্ত সূর্য তখন পর্যন্ত অস্ত যায় নাই। এইজন্যই হযরত বিলাল (রা) প্রথম দুইবারে দৃশ্যমান সূর্যের প্রতি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন। পরে সূর্য যখন বাস্তবিকই অস্তমিত হইয়া গেল, তখন উষ্ট্রপৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিয়া ‘ছাতু’ তৈরী করিয়া দিলেন। দুগ্ধ বা সাদা পানির সাথে যবের গুড়া গুলিয়া ছাতু তৈরী করা হইত এবং উহা দ্বারাই নবী করীম (স) ইফতার করিয়াছেন বলিয়া এখানে উল্লেখ করা হইয়াছে।
হাদীসরে শেষাংশে নবী করীম (স)-এর যে বাক্য উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাতে ইফতার করার সময় নির্দেশ করা হইয়াছে। পূর্বদিগন্থের দিকে হাত দ্বারা ইঙ্গিত করিয়া তিনি বলিয়াছিলেনঃ তোমরা যখন এই দিক হইতে রাত্র অগ্রসর হইয়া আসিতে দেখিবে-আর হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
======================================================
রাত্র যখন অগ্রসর হইয়া আসিবে, দিন যখন পশ্চাদপসরণ করিবে ও সূর্য যখন অস্তগমন করিবে, তখনই ইফতার করা সম্পন্ন করিয়া ফেলিবে।
বস্তুত ‘রাত্রি অগ্রসর হওয়া’ ও দিনের ‘পশ্চাদপসরণ করা’ এবং সূর্যের অস্তগমন এই তিনটি ব্যাপারই পরস্পর সংযুক্ত। একই সময় কালে একসঙ্গে সংঘটিত তিনটি ঘটনা। একটি অপরটির পরিপূরক। কেননা রাত্র অগ্রসর হইয়া আসে কেবল তখনই, যখন দিন অপসৃত হয়। আর দিন অপসৃত হয় না যতক্ষণ সূর্য অস্ত না যায়। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দিন অপসৃত হয়। কার্য ইয়ায বলিয়াছেনঃ অনকে সময় সূর্যের মূল অস্তগমনটি পর্যাবেক্ষিত হয় না। শুধু দেখা যায় অন্ধকারের পূঞ্জীভূত হইয়া আসা। ইহাতেই প্রত্যয় হয় যে, সূর্য অস্ত গিয়াছে। তখনই ইফতার করা জায়েয হয়। আর এই তিনটি ব্যাপারে যে কোন একটির সংঘটিত হওয়া পর্যবেক্ষিত হইলেই সেই সঙ্গে অপর দুইটিও সংঘটিত হইয়াছে বলিয়া বিশ্বাস করা যায়। এই কারণে হযরত ইবনে আবী আওফা বর্ণিত আলোচ্য হাদীসে এই তিনটি কাজের একটি কেবল রাত্রির অগ্রসর হইয়া আসার কথাই বলা হইয়াছে। অন্য দুইটির উল্লেখ্ উপরোদ্ধৃত হাদীসটিতে নাই।
আলোচ্য হাদীস হইতে জানা গেল, নবী করীম (স) সফরে থাকিয়াও রোযা রাখিয়াছেন। এইজন্যই তো ইফতারের ব্যবস্থা করার জন্য নবী করীম (স) বারবার নির্দেশ দিয়াছেন। অথচ সফলকালে রোযা না রাখার অনুমতি স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলাই দিয়াছেন। বলিয়াছেনঃ
==============================================
(রমযান মাসে) যে লোক রোগাক্রান্ত হইবে কিংবা বিদেশ সফরে থাকিবে, তাহার জন্য ভিন্ন দিনের রোযা রাখা বৈধ।
আর রোযা ভঙ্গের এই অনুমতি দেওয়া হইয়াছে যে জন্য, তাহাও আল্লাহই বলিয়া দিয়াছেন :
=================
আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজতর আচরণ করিতে চাহেন, কাঠিন্য ও কষ্টের আচরণ করিতে চাহেন না।
কিন্তু আল্লাহ তা’আলার তরফ হইতে বিদেশ সফরে ব্যস্ত ব্যক্তির পক্ষে রোযা না রাখার অনুমতি সত্ত্বেও আলোচন্য হাদীস হইতে নিঃসন্দেহে জানা যায় যে, রাসূলে করীম (স) মক্কা বিজয় সংক্রান্ত কষ্টসাধ্য সফরকালেও রোযা রাখিয়াছেন। ইহা হইতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, রমযান মাসে সফরকালেও রোযা রাখা রোযা না-রাখা অপেক্ষা অনেক উত্তম। এই পর্যায়ে সাহাবী হইতে পরবর্তী কালের ফিফাহবিদদের পর্যন্ত ইসলামী বিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হইয়াছে। হযরত ইবনে আব্বাস, আনাস, আবু সাইদ, ইবনুল মুসাঈয়্যির, আতা, সাঈদ ইবনে যুবায়র, হাসান বসরী, নখুয়ী, মুজাহিদ, আওযায়ী ও লাইস প্রমুখ ফিফাহবিদের মত হইল, এ ব্যাপারে ব্যক্তির ইচ্ছা ও ইখতিয়ারের উপরই সবকিছু নির্ভর করে। ইচ্ছা করিলে রোযা রাখিতেও পারে, আবার ইচ্ছা হইলে রোযা ভাঙ্গিতে এবং না রাখিতেও পারে। এই ব্যাপারে দলীলস্বরূপ অপর একটি হাদীসও উল্লেখ করা যায়। একটি লোক বলিলঃ
======
হে রাসূল। আমি তো রোযা রাখার লোক। জানিতে চাহি যে, আমি সফরেও কি রোযা রাখিব? জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ
=========== ইচ্ছা হইলে রোযা রাখ, ইচ্ছা হইলে রোযা ভাঙ্গ।- মুয়াত্তামালিক
অপর কিছু লোকের মতে রোযা রাখা না রাখার তুলনায় উত্তম। উমর ইবনে আবদুল আযীয, শা’বী, কাতাদাহ, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইসহাক এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন। ইবনুল আরাবীর বর্ণনানুযায়ী শাফেয়ী মাযহারের লোকেরা বলিয়াছেঃ
=========== সফরকালে রোযা না রাখা উত্তম। কিন্তু কাযী ইয়ায বলিয়াছেঃ
=========== শাফেয়ী মাযহাবে সফরেও রোযা রাখা উত্তম।
হযরত হুযায়ফা (রাঃ) রোযার মাসের সফরে কখনো রোযা রাখিতেন না। আসওয়াদ ইবন ইয়াযীদ, ইমাম আবু হানীফা ও তাঁহার সঙ্গিগণও এই মতেরই সমর্থন করিয়াছেন। [এ বিষয়ে ভিন্নতর মত হইলঃ আইম্মা-ই-মুজতাহিদগণের সম্মিলিত মতামত এই যে, সফরকালে রোযা রাখা এবং না-রাখা-উভয়ই বৈধ। কিন্তু রোযা রাখা উত্তম, না রোযা না রাখার উত্তম এই বিষয়ে মতভেদ। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালিক এবং ইমাম শাফেয়ী বলেন, যাহার রোযা রাখিবার শক্তি আছে, তাহার রোযা রাখা উত্তম। কেহ বলেন, যাহার জন্য যাহা সহজ সে পদ্ধতি অবলম্বন করাই উত্তম।] হযরক আমর, আবু হুবায়রা ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলিয়াছেনঃ
===========
সফরে রোযা রাখিলে তাহা যথেষ্ট হইবে না। সফর শেষ করিবার পর উহা কাযা করিতে হইবে।
আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলিয়াছেনঃ
============
সফরকালে রোযা ব্যাক্ত অ-সফরকালে রোযা ভঙ্গকারী ব্যক্তির ন্যায়।
পক্ষান্তরে হযরত আয়েশা (রাঃ) কাইস ইবনে উব্বাদ, আবুল আসওয়াদ, ইবনে সিরীন, ইবনে উমর, সালেম, আমর ইবনে মায়মুন, আবু ওয়ায়েল প্রমুখ সফরেও রোযা রাখিতেন; রোযা ভাঙ্গিতেন না। হযরত আলী (রা:) বলিয়াছেনঃ
===============
যে লোক নিজের বাড়ীতে থাকিয়া রমযান মাস পায় এবং পরে সফর করে, তাহার পক্ষে রোযা থাকা আবশ্যক। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ যে লোক এই রমযান মাস পাইবে, সে যেন এই মাসকাল ব্যাপী রোযা রাখে। ইসবীজাবী বলিয়াছেনঃ সফরকালে যদি কষ্ট না হয়, তাহলে হইল রোযা রাখাই উত্তম। অবশ্য কষ্ট না হওয়া সত্ত্বেও সফরকালে রোযা না রাখিলে কোন গুনাহ হইবে না।
এই হাদীস হইতে অনতিবিলম্বে ও সূর্যাস্তের সংঙ্গে সংঙ্গে ইফতার করা উত্তম বলিয়া জানা যায়।
===========
হযরত আবু হুরায়ারা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত (স) বলিয়াছেনঃ যে লোক রোগ-অসুখ ও শরীয়তসম্মত ওযর ছাড়া রমযান মাসের একটি রোযাও ত্যাগ করিবে, সে যদি উহার পরিবর্তে সারা জীবন রোযা রাখে, তাহ হইলেও সে যাহা হারাইয়াছে তাহা কখনও পরিপূরণ হইবে না। – তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ
ব্যাখ্যা হাদীসটির বক্তব্য হইল, রোযা মুসলমানের জন্যই ফরয। এই ফরয শরীয়াত সম্মত কোন কারণ ছাড়া কিছুতেই ভাঙ্গা (বা না রাখা) যাইতে পারে না। উহা ভাঙ্গার জন্য শরীয়াতে কয়েকটি ওযরের উল্লেখ করা হইয়াছে। তন্মধ্যে প্রধান ওযর হইল দুইটি। একটি বিদেশ সফর। দ্বিতীয়টি রোগ-অসুখ। কুরআন মজীদেই এই ওযর দুইটির উল্লেখ হইয়াছে ও এই কারণে রোযা ভঙ্গের অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু এই ওযর ছাড়া রোযা ভঙ্গ করিলে আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ লংঘন ও তাঁহার অমার্জনীয় অবাধ্যতা করা হইবে। কিন্তু ইহার আর একটি দিক হইল, বিনা কারণে রোযার মাসে রোযা ভঙ্গ করিলে সে আল্লাহর অপার রহমত হইতে এতখানি বঞ্চিত হইয়া যাইবে যে, অতঃপর সারাজীবন রোযা রাখিয়াও ইহার ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হইবে না। কেননা রমযান মাসের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম-মুক্তির যে বিশেষ ঘোষণা রহিয়াছে, তাহা অন্য কোন সময়ের জন্য নাই। কেবলমাত্র রমযান মাসে রোযা রাখিলেই তাহা পাওয়া যাইতে পারে। অন্য সময় তাহা পাওয়ার কোনই কারণ নাই।
ইফতার ও সেহরীর সময়
============
হযরত আবু যর গিফারী (রা) হইতে বর্ণিত হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ রাসূলে করীম করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন, আমার উম্মত যতদিন পর্যন্ত ইফতার ত্বরান্বিত করিবে এবং সেহরী বিলম্বিত করিবে, ততদিন তাহারা কল্যাণময় হইয়া থাকবে। -মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা রোযা ইফতার করার নির্দিষ্ট সময় সূর্যাস্ত হওয়ার পর-মুহূর্ত। এই মুহূর্ত উপস্থিত হওয়া মাত্রই রোযা খুলিয়া ফেলা কর্তব্য। ইহাতে কোনরূপ বিলম্ব করা উচিত নয়। এক শ্রেণীর লোক সূর্যাস্ত হওয়ার পরও রোযা খুলিতে অকারণে বিলম্ব করে। তাহারা মনে করে, ইহাতেই বুঝি অধিক সওয়াব হইয়া থাকে কিংবা এইরূপ করিলে অধিক তাকওয়া দেখানো হয়। কিন্তু নবী করীম (স) রোযার যে বিধান পেশ করিয়াছেন, তাহাতে এইরূপ করিবার কোন সুযোগ নাই। হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর এক হাদীসে নবী করীমের এই বাক্যাংশ উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
============
রোযাদাররা যতদিন পর্যন্ত ইফতার ত্বরান্বিত করিবে, ততদিন দ্বীন-ইসলাম স্পষ্ট, অম্নান ও বিজয়ী হইয়া থাকিবে।
ইহার কারণ এই যে, ইফতার ত্বারান্বিত করা রাসূলে করীম (স)-এর নিয়ম ও আদর্শ। মুসলমানরা ইহা করিলে তাঁহারই বাস্তব অনুসরণ করা হয় এবং কার্যত তাঁহার আদেশ পালন করা হয়। বস্তুত রাসূলের কথা ও কাজের বাস্তব অনুসরণই হইল ইসলাম। ইফতার ত্বারান্বিত করা কেবল রাসূলেরই পছন্দ নয়, আল্লাহর নিকটও ইহা অধিকতর প্রিয়। হাদীসে কুদসীরূপে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
=============
আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ ইফতার ত্বারান্বিতকারী বান্দাগণই আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। কেননা ইহাতে রাসূলের পূর্ণ অনুসরণ করা হয় এবং আল্লাহর ঘোষণা হইলঃ
===============
বল হে নবী, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে তোমরা আমার বাস্তব অনুসরণ কর। তাহা হইলেই আল্লাহ্ তোমাদিগকে ভালোবাসিবে।
তিরমিযী শরীফে হযরত সহল ইবনে সা’দ বর্ণিত হাদীসটির ভাষা হইলঃ
=====
মানুষ যতদিন ইফতার ত্বারান্বিত করিবে ততদিন তাহারা কল্যাণ লাভ করিতে থাকিবে।
‘সেহরী’ খাওয়া বিলম্বিত করিবার জন্যও হাদীসে তাকীদ আসিয়াছ। বস্তুত রোযা রাখার জন্য শেষ রাত্রে কিছু পানাহার করা চাই। রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
============== সেহরী খাওয়ায় নিশ্চয়ই বরকত রহিয়াছ।
অপর হাদীসে উদ্ধৃত হইয়াছে, নবী করীম (স) তাকীদ করিয়া বলিয়াছেনঃ
====================
যে লোক রোযা রাখিতে চাহে, তাহার কোন কিছু খাইয়া সেহরী পালন করা কর্তব্য।
অপর এক হাদীসে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ ‘মুসলমানদের ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের রোযা রাখিবার মাঝে পার্থক্য হইল সেহরী খাওয়া। অর্থাৎ মুসলমানরা সেহরী খাইয়া রোযা থাকে। আর অমুসলিমরা সেহরী না খাইয়া রোযা থাকে। এই পার্থক্য সুস্পষ্ট।
সেহরী খাওয়ার শেষ সময় হইল সুবহে সাদিক উদয় হওয়া। এই শেষ সময় পর্যন্ত সেহরী খাওয়া বিলম্বিত করাই সুন্নাত-রাসূলের আদর্শ। তিনি সেহরী খাইবার জন্য যেমন তাকীদ করিয়াছেন, তেমনি উহা বিলম্বিত করার জন্য-শেষ মুহূর্তে খাওয়ার জন্যও-উৎসাহ দান করিয়াছেন। সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার বহু পূর্বে-প্রায় মধ্যরাত্রে সেহরী খাওয়া ইসলামে পছন্দনীয় কাজ নয়। ইহাতে আল্লাহ ও রাসূলের সন্তোষ নিহিত নাই। ইহাতে রাসূলের অনুসৃত ও আচরিত রীতি অনুসরণ হয় না। রাসূলে করীম (স) তাকীদ করিয়াছেনঃ
=================== তোমরা রাত্রির শেষদিকে সেহরী গ্রহণ কর।
=================
হযরত আদী ইবনে হাতিম (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) আমাকে নামায ও রোযা (পালনের নিয়ম-কানুন) শিক্ষা দিয়াছেন। তিনি বলিলেন, নবী করীম (স) এইভাব ও এই নিয়মে নামায পড়িয়াছেন। আর (তিনি বলিয়াছেনঃ) তোমরা রোযা রাখ। যখন সূর্য অস্তমিত হয়, তখনই তোমরা খাও, পান কর, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার সামনে ‘সাদা সুতা’ ‘কালো সুতা’ হইতে স্পষ্টরূপে পৃথক হইয়া না যায়। আর রোযা থাক ত্রিশ দিন, তবে উহার পূর্বে যদি তুমি চাঁদ দেখিতে পাও, (তাহা হইলে তখনি রোযা ভাঙ্গ)।
এই কথা শুনিয়া আমি সাদা ও কালো দুইটি পশম সম্মুখে রাখিয়া উহার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিলাম। কিন্তু উহাতে আমার নিকট কিছুই স্পষ্ট হইল না। পরে এই কথা রাসূলে করীমের নিকট পেশ করিলাম। তিনি শুনিয়া হাসিয়া উঠিলেন এবং বলিলেনঃ হে হাতীমের পুত্র। (তুমি যাহা বুঝিয়াছ তাহা নয়, আসলে) উহা রাত্রির অন্ধকার কালো হইতে দিনের দিনের শ্বেত-ঔজ্জ্বল্য প্রকাশিত হওয়া মাত্র। -মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা নামায ও রোযা ইসলামের ইবাদত সমূহের প্রধান দুইটি স্তম্ভ। যাকাত ও হজ্জ তো ধনী লোকদের কর্তব্য, কিন্তু নামায ও রোযা মুসলমান মাত্রের উপরই চিরস্থায়ী ফরয। নবী করীম (স) অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় নামায-রোযার নিয়ম-কানুন বিস্তারিতভাবে শিক্ষা দিয়াছেন। শিক্ষা দিয়াছেন মুখে বলিয়া এবং নিজে কাজ করিয়া। আলোচন্য হাদীসে রোযার কথাই প্রধান; রোযার পদ্ধতি শিক্ষাদান প্রসঙ্গে তিনি বলিয়াছেনঃ সকাল হইতে রোযা রাখিতে শুরু কর। আর রোযা শেষ হইবে সূর্যাস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। অতঃপর সারারাত্রি ধরিয়া খাওয়া-দাওয়া অবাধে চলিতে পারিবে। এই খাওয়া-দাওয়ার শেষ সময়ই হইল পরবর্তী দিনের রোযা শুরু করার প্রথম মুহূর্ত। উহাই সেহরী খাওয়ার শেষ সময়। সেহরী খাওয়ার শেষ সময় ও রোযা শুরু করার প্রথম সময় বুঝাইবার জন্য কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ
===============
ফজরকালের কালো সুতা হইতে সাদা সুতা যখন স্পষ্টরূপে পৃথক হইয়া দেখা দিবে-তখন পর্যন্ত।
হাদীসের বর্ণনাকারী আদী ইবনে হাতিম বলেন, কুরআনের এই কথাটিই রাসূলে করীম (স) আমাকে বলিলেন। আমি ইহাকে শাব্দিক অর্থেই গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং কালো ও সাদা পশম রাখিয়া এই কথার যথার্থতা বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। কিন্তু আসলে ইহা আমার বুঝিবার ভুল। আসলে ‘সাদা সুতা’ কালো সুতার’ কথা নয়। ইহা হইল প্রভাত-আলো ও রাত্রির অন্ধকার অর্থাৎ রাত্রির অন্ধকার কালো হইতে দিনের শ্বেতশুভ্র আলো যতক্ষণ না স্পষ্টভাবে ফুটিয়া উঠে ততক্ষণ খাওয়া-দাওয়া চলিতে পারিবে। আর তখনই তাহা স্পষ্ট হইয়া উঠে, তখনই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করিতে হইবে এবং রোযা রাখা শুরু করিতে হইবে। আমার বোকামির কথা জানিতে পারিয়া নবী করীম (স) হাসিলের ও আমাকে আসল কথাটি ভালোভাবে বুঝাইয়া দিলেন।
হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা) বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীস হইতে জানা যায়, তিনি রাসূলে করীম (স)-এর সহিত সেহরী খাইয়াই মসজিদে নামায পড়িতে গিয়াছেন। একজন স্রোতা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
========= প্রভাত উদয় হওয়ার পরই কি এই কাজ করিয়াছেন? জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ
=============
হ্যাঁ, উহা প্রভাত উদয়কালেই ছিল, তবে তখনও সূর্য উদয় হইয়া যায় নাই।- মুসনাদে আহমদ
এই হাদীস হইতে জানা গেল, সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পরও সেহরী খাওয়া চলে এবং চলে সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত, যখন দিনের ঔজ্জ্বল্য চতুর্দিককে উদ্ভাসীত করিয়া তোলে এবং অন্ধকারের অস্পষ্টতা কিছুমাত্র বাকী থাকে না। [কিন্তু ইহা উলামাদের নিকট নির্ভরযোগ্য নয়।] একটি হাদীসের শব্দ হইলঃ
=============
সেই সময়টা ছিল দিন, তবে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, তখনও সূর্যটা উদিত হয় নাই।
একটি হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, জুর ইবনে হুবাইশ হযরত হুযাইফা (রা) কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
==========
আপনারা রাসূলে করীম (স)-এর সং্গে ঠিক কোন সময়ে সেহরী খাইয়াছেন? জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ
===========
সময়টা ছিল দিন। তবে তখনও সূর্য উদয় হয় নাই।
হযরত আবু হুরাইয়া (রা) হইতে বর্ণিত, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
==================
তোমাদের কেহ যদি এমন সময় ফজরের আযান শুনিতে পাও যখন তোমাদের কেহ পাত্র হাতে লইয়া খাদ্য গ্রহণ করিতেছে, তাহা হইলে সে যেন সে পাত্র থেকে প্রয়োজন মত খাদ্য গ্রহণ সম্পূর্ণ না করিয়া উহা রাখিয়া না দেয়।
আম্মার বলিয়াছেনঃ
===========
ফজর উদয় হওয়ার সময়ও খাদ্য গ্রহণের জন্য সাহাবীগণ অনুমতি দিতেন।
হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত, তিনি দেখিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) ও জায়দ ইবনে সাবিত (রাঃ) রোযার নিয়্যতে সেহরী খাইয়াছেন। অতঃপর দুই রাক’আত নামায পড়িয়াছেন। তাহার পর মসজিদে গিয়াছেন। আর তখনই ইকামত বলা হইয়াছে।
হযরত আবু বকর (রা) সালেম ইবনে উবাইদকে বলিতেনঃ
===========
তুমি আমার ও ফজর উদয় হওয়ার মাঝখানে আড়াল হইয়া দাঁড়াও যেন আমি সেহরী গ্রহণ করিতে পারি।
অপর বর্ণনায় বলা হইয়াছে, হযরত আবু বকর (রা) বলিতেনঃ
==========
তোমরা দরজা বন্ধ করিয়া রাখ যতক্ষণ আমার সেহরী খাওয়া শেষ না হয়।
==========
এই পর্যায়ের হাদীসসমূহ মোট ১১ জন সাহাবী থেকে বর্ণিত। ইহাদের বিপরীত কোন বর্ণনা নাই।
অন্য কথায় হাদীস হইতে স্পষ্ট ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইল যে, সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সেহরী খাওয়া চলে। তবে ইহাই শেষ সময়, পানাহারের অনুমতি প্রাপ্ত সময়ের শেষ সীমান্ত কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই সীমান্তকে এড়াইয়া চলা এবঙ ইহার পূর্বেই খাওয়া-দাওয়া শেষ করাই উত্তম। [‘শরহে বেফায়া’ গ্রন্থে উল্লেখ হইয়াছে যে, সুবহে সাদিক না হওয়া পর্যন্ত সেহরী খাওয়া দূরন্ত আছে।]
এই হাদীস হইতে এই কথাও জানা গেল যে, রোযার মাস সাধরণত ত্রিশ দিনের হইবে। তবে উহার একদিন কমও হইতে পারে। ঊনত্রিশ দিনের সন্ধ্যায় যদি শাওয়ালের চাঁদ দেখা যায়, তাহা হ্ইলে রোযা ঊনত্রিশটি হইবে এবঙ পরের দিন ঈদুল ফিতর হইবে। আর ঊনত্রিশ তারিখ চাঁদ দেখা না গেলে রোযা ত্রিশটা পূর্ণ করিতে হইবে। অতঃপর চাঁদ দেখা না গেলেও কোনই অসুবিধা থাকিবে না। কেননা আরবী মাস ত্রিশ দিনের বেশী হয় না।
ইফতার করাইবার সওয়াব
==================
হযরত যায়দ ইবনে খালিদ আল-জুহানী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোক একজন রোযাদারকে ইফতার করাইবে, তাহার জন্য সেই রোযাদারের মতই সওয়াব লিখা হইবে। কিন্তু তাহাতে মূল রোযাদারের শুভ প্রতিফল হইতে একবিন্দু কম হইবে না। – মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ।
ব্যাখ্যা এই হাদীসটিতে রোযাদারকে ইফাতার করাইবার সওয়াবের কথা বলা হইয়াছে। হাদীসের ঘোষণানুযায়ী যে লোক কোন রোযাদারকে ইফতার করায় সে সেই রোযাদারের সমান সওয়াব লাভ করিবে। কিন্তু তাহাতে মূল রোযাদারের জন্য নির্দিষ্ট সওয়াবের পরিমাণ কিছুমাত্র হ্রাস পাইবে না।
হযরত সালমান ফারসী (রা) বর্ণিত হাদীসটিতে রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি অধিকতর বলিষ্ঠ ভাষায় ব্যক্ত হইয়াছে। তাহা হইলঃ
==============
যে লোক কোন রোযাদারকে কিছু হালাল জিনিস খাওয়াইয়া ও পান করাইয়া ইফতার করায় ফেরেশতাগণ রমযান মাসের সমস্ত সময় ধরিয়া তাহার প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং জিবরাঈল (আ) কদর রাত্রিতে তাহার জন্য রহমতের দোয়া করেন। – তাবারানী ইবনে হাব্বান
ইবনে হাব্বানের বর্ণনায় ইহার শেষাংশে অতিরিক্ত কথা হইলঃ
************
জিবরাঈল (আ) যাহার সহিত করমর্দন করেন, তাহার কদল নম্র হয় এবং তাহার অশ্রুধারা প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়।
এই কথার পর নবী করীম (স)-এর নিকট প্রশ্ন করা হয় ইফতার করাইবার মত যাহার কিছুই নাই, সে কি করিবে? তিনি বলিলেনঃ ====== ‘সে একমুঠি খাবার দিয়া ইফতার করাইবে’। এক লোকমা রুটি বা খাদ্য না থাকিলেও কি করা যাইবে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেনঃ ========== দুগ্ধ দিয়া ইফতার করাইবে। আর ইহাও না থাকিলে =======‘পানি দিয়াই রোযা খোলাইবে।’
মোটকথা, রোযাদারের রোযা যাহাই তওফীকে জোটে তাহা দিয়া খোলানোর বিরাট-বিপুল সওয়াব নিহিত রহিয়াছে।
রোযার দিনে ভুল করিয়া পানাহার করা
=========
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইবে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোক ভুল করিয়া কিছু খাইল বা পান করিল, সে যেন রোযা না ভাঙ্গে। কেননা সে যাহা খাইয়াছে বা পান করিয়াছে, উহা এমন বিষয়ক যাহা আল্লাহ তা’আলাই তাহাকে দিয়াছেন।
– বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী
ব্যাখ্যা হাদীসটির বক্তব্য স্পষ্ট। রোযাদার ভুল করিয়া কিছু খাইলে বা পান করিলে রোযা নষ্ট হইয়া যায় না। রোযা নষ্ট হইয়া গিয়াছে মনে করিয়া রোযাটি ভাঙ্গিয়া ফেলা ঠিক নয়। কেননা সে ইচ্ছা করিয়া ও রোযার বিধান লংঘন করিবার উদ্দেশ্য লইয়া পানাহার করে নাই। সে ভুল করিয়া পান বা আহার করিয়াছ। হাদীসে এইরূপ খাওয়া-পান করাকে আল্লাহর দেওয়া রিযক বলা হইয়াছে।
এইরূপ পানাহারকারী ব্যক্তির প্রতি নবী করীম (স)-এর নির্দেশ হইল, সে রোযা ভাঙ্গিবে না, রোযা পূর্ণ করিবে। বুখারী শরীফে উদ্ধৃত অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ ========== তাহার রোযা যেন সে সম্পূর্ণ করে।
এই হাদীসে ভুলবশত পানাহারকারীকে ইহার পরও ‘রোযাদার’ বলিয়া স্বীকার করে হইয়াছে এবং রোযাদার রোযা সম্পূর্ণ করিবে-ইহাই স্বাভাবিক।
রোযাদার ভুল করিয়া যাহা পান করে বা খায়, উহাকে আল্লাহর দেওয়া রিযক বলা হইয়াছে। বুখারী শরীফের বর্ণনায় ইহার ভাষা হইলঃ
=============
ইহা আর কিছু নয়। আল্লাহই তাহাকে খাওয়াইয়াছেন ও পান করাইয়াছেন।
হযরত উম্মে ইসহাক (রা)-এর একটি ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে। তিনি নবী করীম (স)-এর নিকট বসা ছিলেন। এই সময় একপাত্র সরীদ (এক বিশেষ ধরনের খাবার) উপস্থিত করা হইল। তখন তিনিও তাঁহার সাথে উহা খাইলেন। পরে তাঁহার মনে পড়িল যে, তিনি রোযাদার। যুল-ইয়াদাইন তখন তাঁহাকে বলিলেনঃ ==== খাইয়া পূর্ণ তৃপ্ত হওয়ার পর এখন মনে পড়িয়াছে যে, তুমি রোযাদার?
তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
===============
তুমি তোমার রোযা পূর্ণ কর। কেননা তুমি যাহা খাইয়াছ, উহা তো একটা রিযক, আল্লাহই উহা তোমার পর্যন্ত পৌঁছাইয়াছেন।
ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ যাহারা অল্প খাওয়া ও বেশী খাওয়ার মধ্যে পার্থক্য করিয়া বলেন, অল্প খাইলে রোযা নষ্ট হয় না, বেশী খাইলে রোযা নষ্ট হয়, এই হাদীসটি উহারই প্রতিবাদ। আমর ইবনে দীনারের নিকট একটি লোক আসিয়া বলিলঃ আমি সকাল বেলা পর্যন্ত রোযাদার ছিাম অতঃপর ভুলিয়া গিয়া খাইয়াছি। এখন কি হইবে। বলিলেনঃ কোন দোষ হয় নাই।
ইমাম সওরী, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ও ইমাম আবু হানীফা প্রমুখ ফকীহ একবাক্যে বলিয়াছেনঃ
================
যে লোক ভুলবশত কিছু খায় বা পান করে সে যেন তাহার রোযা পূর্ণ করে। এই রোযা তাহাকে কাযা করিতে হইবে না এবং এই জন্য কোন কাফকারাও দিতে হইবে না।
অবশ্য ইমাম মালিক ইবনে আনাস বলিয়াছেনঃ ভুল করিয়া খাইলে রোযা কাযা করিতে হইবে। কিন্তু এই মত খোদ মালিকী মাযহাবের আলিমগণই প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। ===========
সূর্যাস্তের পূর্বেই ইফতার করা
========
আমাকে যায়দ ইবনে আসলাম জানাইয়াছেন যে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) রমযান মাসের এক মেঘাচ্ছন্ন দিনে ইফতার করিলেন। তিনি ভাবিয়াছিলেন যে, সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে; কিংবা সূর্য অস্ত গিয়াছে। এই সময় একটি লোক আসিয়া বলিলঃ ‘হে আমীরুল মু’মিনীন। সূর্য তো বাহির হইয়াছে, দেখা যাইতেছে। তখন হযরত উমর (রা) বলিলেনঃ ইহার প্রতিকার খুবই সহজ। অথচ আমি যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছি। – মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ
ব্যাখ্যা যায়দ ইবনে আসলাম একজন তাবেয়ী। তিনি হযরত উমরের সূর্যাস্তের পূর্বেই ইফতার করিবার ঘটনার বর্ণনা দিয়াছেন। এই দিনটি ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সূর্য অস্ত গিয়াছে কিনা, তাহা নিঃসন্দেহে জানিবার উপায় ছিল না। ইহার ফলে সন্ধ্যায় হইয়াছে বা সূর্য অস্ত গিয়াছে মনে করিয়া ইফতার করিয়া বসিলেন। সূর্য অস্ত গিয়াছে কিনা তাহা জানিবার জন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছুই জানিতে পারিলেন না। কিন্তু আসলে সূর্য অস্ত্ যায় নাই। পরে একটি লোক যখন বলিল যে, সূর্য অস্ত যায় নাই, মেঘের আড়াল হইতে উহা বাহির হইয়াছে, তখন তিনি নিঃসন্দেহে জানিতে পারিলেন যে, ইফতারের সময় হওয়ার পূর্বেই-দিন থাকিতেই তিনি ইফতার করিয়া বসিয়াছেন। ইহাতে তাঁহার রোযাটি নষ্ট হইয়া গিয়াছে। অতএব এই রোযাটি তাঁহাকে কাযা করিতে হইবে। তাই লোকটিকে তিনি বলিয়া দিলেন যে, সূর্যাস্ত হইয়াছে কিনা তাহা জানিতে চেষ্টা করিয়াও জানিতে পারি নাই। এখন কাযা করা কর্তব্য হইয়াছে। আর ইহা কটিন কিছুই নয়।
ইমাম মুহাম্মাদ (রা) বলিয়াছেনঃ সূর্যাস্ত হইয়াছে মনে করিয়া যদি কেহ ইফতার করে; কিন্তু পরে জানিতে পারে যে, সূর্যাস্ত হয় নাই, তাহা হইলে অতঃপর সে অবশিষ্ট সময়ে কিছুই পানাহার করিতে পারিবে না। রোযাদারের মতই তাহাকে ইফতারের সময় পর্যন্ত অতিবাহিত করিতে হইবে এবং পরে এই রোযাটি কাযা করিতে হইবে। ইমাম আবু হানীফা (রা) ও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
তিনটি কাজে রোযা ভঙ্গ হয় না
===========
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তিনটি কাজ রোযা ভাঙ্গি দেয় নাঃ শিঙ্গা লাগানো মাকরূহ সেই রোযাদারের জন্য, তাহা হইলে ইহার মাকরূহ হওয়ার মাত্রা অনেক বেশী তীব্র হইবে।
শরীরের বিশেষ অবস্থার কারণে বমি হইলে রোযা নষ্ট হইবে না। তবে যদি কেহ ইচ্ছা করিয়া বমি করে, এই সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
=============
যে রোযাদার নিজের ইচ্ছায় বমি করিবে, তাহাকে রোযা কাযা করিতে হইবে। কেননা, এই বমির জন্য সে নিজে দায়ী।
ইবনুল মালিক বলিয়াছেনঃ
========
অধিকাংশ শরীয়াতবিদের মতে এইরূপ ব্যক্তিকে কোন কাফ্ফারা দিতে হইবে না। (শুধু রোযা কাযা করিতে হইবে)।
কিন্তু বমি যদি মুখ ভরিয়া বাহির হয়, তবে হানাফী মাযহাব অনুযায়ী রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে। আর বমি করিতে করিতে যদি কেহ ক্লান্ত-শ্রান্ত হইয়া শুইয়া পড়িতে বাধ্য হয়, তাহা হইলে তাহার রোযা থাকিবে না। =========
রোযার অবস্থায় স্ত্রীর সহিত মাখামাখি ও চুম্বন করা সঙ্গত এবং উহাতে রোযা বিনষ্ট হয় কিনা সেই বিষয়ে এই প্রসঙ্গেই আলোচিতব্য। একটি হাদীসঃ
===================
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) হইত বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমরা রাসূলে করীম (স)-এর মজলিসে বলিয়াছিলাম। এই সময় একজন যুবক আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলঃ ইয়া রাসূল, আমি কি রোযা থাকা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করিতে পারি? নবী করীম (স) বলিলেনঃ না। অতঃপর ্রকেজন বয়ঃবৃদ্ধ ব্যক্তি আসিয়া প্রশ্ন করিলঃ আমি কি রোযাদার অবস্থায় স্ত্রী চুম্বন করিতে পারি? নবী করীম (স) বলিলেনঃ হ্যাঁ। বর্ণনাকারী বলেনঃ এই কথা শুনিয়া আমরা পরস্পরের দিকে তাকাইলাম। ইহা দেখিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ তোমরা পরস্পরের দিকে কেন তাকাইলে তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি। বয়ঃবৃদ্ধ ব্যক্তি তা আত্মসংযম করিতে সক্ষম।
– মুসনাদে আহমদ, তাবারানী-কবীর
ব্যাখ্যা রোযা থাকা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করা জায়েয কিনা এবং তাহাতে রোযার কোন ক্ষতি হয় কিনা এই বিষয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে বহু সংখ্যক হাদীস রাসূলে করীম (স) হইতে বহু সংখ্যক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে কতকগুলি হাদীস হইতে জানা যায়, মোটামুটিভাবে ইহা জায়েয। আর কতকগুলি হাদীসে এই বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধ উচ্চারিত হইয়াছে। আবার কতকগুলি হাদীস হইতে জানা যায়, নবী করীম (স) একই বৈঠকে যুবককে ইহা করিতে নিষেধ করিয়াছেন এবং বয়ঃবৃদ্ধকে অনুমতি দিয়াছেন। উপরোদ্ধৃত হাদীসটি তন্মধ্যে একটি। এই ধরনের বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হওয়ার কারণে এই বিষয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হইয়াছে। হাদীস ব্যাখ্যায় ইমাম নববী বলিয়াছেনঃ শুধু চুম্বনে যে রোযা নষ্ট হয় না, তাহা সর্বসম্মত। তবে ইহার দরুন শুক্র নির্গত হইলে রোযা নষ্ট হইবে। আবদুল্লাহ ইবেন শাবরামাতা কু’ফার একজন ফিকাহবিদ। তিনি ফতওয়া দিয়াছেন, যে কোন রোযা অবস্থায় চুম্বন করিল, তাহার রোযা নষ্ট হইয়া গিয়াছে। ইমাম ইবনে হাজম বলিয়াছেন, আলিঙ্গন ও চুম্বন উভয়ই মাকরূহ। হযরত ইবনে উমর (রা) হইতে এই সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছেঃ
===============
তিনি রোযা থাকা অবস্থায় আলিঙ্গন, মাখামাখি, ডলাডলি ও চুম্বন উভয় কাজকে মাকরূহ মনে করিতেন।
কিন্তু এই সবের বিপরীত দিকে রহিয়াছে নবী করীম (স)-এর নিজের আমল সম্পর্কিত বহু সংখ্যক বর্ণনা। তিনিই তো নিজের কথা ও কাজ উভয়ের দ্বারাই শরীয়াতের বিধান স্পষ্ট করিয়া তুলিয়াছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
=================
নবী করীম (স) রোযা থাকা অবস্থায় চুম্বন করিতেন।
হযরত আয়েশা (রা) বলিয়াছেন, একদা নবী করীম (স) ঘরে আসিয়া বলিলেনঃ গোশতের টুকরা আছে কি? তিনি একটি টুকরা পেশ করিলেন। নবী করীম (স) উহা মুখের উপর রাখিলেন এবং বলিলেনঃ (তাবারনী, আল আওসাত)
==================
হে আয়েশা, ইহার কোন কিছু কি আমার পেটে প্রবেশ করিয়াছে? – রোযাদারের চুম্বনও এইরূপ।
(পেটে কিছু প্রবেশ করিলেই রোযা যায় নতুন না) কতিপয় ফিকাহবিদ বলিয়াছেনঃ চুম্বন রোযার সওয়াব কম করিয়া দেয়, রোযা নষ্ট করে না। এতসত্ত্বেও তাঁহারা বলিয়াছেনঃ নিজেকে সঙ্গম হইতে বাঁচাইতে পারিলে চুম্বন বৈধ। আর সঙ্গম পর্যন্ত যাওয়ার আশংকা হইলে চুম্বন হইতে বিরত থাকা কর্তব্য।=============
রোযা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস
===============
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলঃ ‘ইয়া রাসূল’ আমি ধ্বৱংস হইয়া গিয়াছি। তিনি বলিলেনঃ তোমাকে কিসে ধ্বংস করিল? বলিলঃ আমি রমযান (দিনের বেলায়) আমার স্ত্রীর উপর নিপতিত হইয়াছি। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি কি একটি ক্রীতদাস মুক্ত করিবার সামর্থ রাখ? বলিলঃ না। বলিলেনঃ তাহা হইলে তুমি কি ক্রমাগত দুইমাস কাল রোযা করিতে পারিবে? বলিলঃ না। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ষাটজন মিসকীন খাওয়াইবার মত সাধ্য কি তোমার আছে? বলিলঃ না। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ সব। লোকটি বসিয়া থাকিল। এই সময় রাসূলে করীম (স)-এর নিকট একটি পাত্র আনা হইল। পাত্রটি ছিল ওজনের (মোটা) যন্ত্র। তাহাতে খেজুর ভর্তি ছিল। নবী করীম (স) বলিরেনঃ এই পাত্রের খেজুরগুলি তুমি দান করিয়া দাও। তখন লোকটি বলিলঃ মদীনায় আমাদের অপেক্ষা অধিক গরীব ও এই পাত্র ভরা খেজুর পাইবার অধিকযোগ্য আর কেহ নাই। ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) হাসিয়া দিলেন। ইহাতে তাঁহার দন্তরাজি প্রকাশিত হইয়া পড়িল। তিনি বলিলেনঃ তুমি ইহা লইয়া যাও এবং তোমার ঘরের লোকদিগকে ইহা খাওয়াও। – তিরমিযী
ব্যাখ্যা রমজান মাসের রোযার দিনে রোযা থাকা অবস্থায় ঘটনাচক্রে স্ত্রী সহবাস হইয়া গেলে একজন ইমানদার মুসলমানের মানসিক অবস্থা কি দাঁড়ায় এবঙ সেই অবস্থায় কি করণীয়, উভয় কথাই উপরোদ্ধৃত হাদীসটি হইতে জানা যায়।
তিরমিযী উদ্ধৃত এই হাদীসটিতে বলা হইয়াছেঃ ‘এক ব্যক্তি রাসূলের নিকট আসিয়া বলিল’। কিন্তু বুখারী উদ্ধৃত হাদীসের ভাষা হইলঃ আমরা রাসূলে করীম (স)-এর নিকট বসাছিলাম। এই সময় ্রকেজন লোক আসিল। এই লোকটি কে এবং তাহার নাম কি, তাহা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় নাই। তবে হাদীসের ব্যাখ্যায় আবদুল গনী দৃঢ়ভাবে বলিয়াছেন যে, এই লোকটির নাম সালমান কিংবা সালমাহ ইবনে সখর আল-বিয়াজী ছিল। এই লোকটির আগমনের অবস্থা সম্পর্কে অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
===================
একটি লোক আসিল। সে তাহার মাথার চুল ছিড়িতেঁছিল ও বুকের উপর থাপড়াইতে ছিল।
অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ ======= ‘নিজের মুখের উপর চপেটাঘাতে করিতেছিল।‘ আর একটি র্বণনায় বলা হইয়াছেঃ
========= সে তাহার মথার উপর মাটি ছড়াইতেছিল। এই সব বিভিন্ন বর্ণনার উল্লেখ করিবার পর ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ যে লোক এই ধরনের বিপদে পড়ে তাহার পক্ষে এই ধরনের কাজ করা বিধেয়। ইহার দ্বারা দুনিয়ার সাধারণ বিপদাপদ এবঙ ধর্ম ও পরকালের দিক দিয়া আসা বিপদের মাঝে পার্থক্য হইয়া যায়। ধর্ম ও পরকালের দিক দিয়া যে লোক এই ধরনের বিপদের মধ্যে নিপতিত হয়, সে যদি এমন কাজ করে যাহার দ্বারা তাহার চরম লজ্জা ও অনুতাপ এবং অন্তরের তীব্র ক্ষোভ ও বেদনা প্রকাশ পায় তবে তাহা অবৈধ বা অবাঞ্ছিত নয়। অবশ্য ইহা এই ধরনের কাজ নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বেকার ঘটনাও হইতে পারে।
লোকটি বলিলঃ ======= ‘আমি ধ্বঙস হইয়া গিয়াছি।‘ হযরত আয়েশার এক বর্ণনার শব্দ হইলঃ === ‘আমি ভম্ম হইয়া গিয়াছি।’ এই সব শব্দ হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়, লোকটি সচেতনভাবেই এই কাজ করিয়াছিল ও এই সব কথা বলিতেছিল। কেননা সে যে পাপ করিয়াছে তাহার পরিণতি ধ্বংস ও ভস্ম হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। আর এই কথা যদি স্থিরীকৃত হয়, তাহা হইলে বলা যায়, নবী করীম (স) লোকটির পাপের কাফফারা আদায়ের জন্য যে প্রস্তাব করিয়াছিলেন, তাহার ভিত্তিতে ভুলবশত এই কাজ করিলেও কাফফারা দিতে হইবে, এমন কথা বলা যায় না। ইমাম মালিক অবশ্য সে দলীলই দিয়েছেন।
ইহার জওয়াবে বলা যায়, লোকটি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া যাহা বলিতেছিল-‘ধ্বংস হইয়া গিয়াছি’, ‘ভস্ম হইয়া গিয়াছি’-ইহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, লোকটি ইচ্ছাপূর্বক ও সচেতনভাবেই স্ত্র সহবাসে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। ইহা ভুলবশত করা কাজ নয়। রমযান মাসে দিনের বেলা একজন রোযাদারের পক্ষে স্ত্রী সহবাস করা কল্পনাতীত।
লোকটি ঘটনার বিবরণ দান প্রসঙ্গে বলিলঃ
========= আমি আমার স্ত্রীর উপর আপতিত হইয়াছি। হযরত আশেয়া (রা)-এর বর্ণনার ভাষা হইলঃ
======== আমি আমার স্ত্রীর সহিত সঙ্গম করিয়াছি
অতঃপর নবী করীম (স) লোকটিকে কাফফারা আদায়ের পরামর্শ দিলেন। ইহার অর্থ, রোযাদার দিনের বেলা স্ত্রী সহবাস করিলে তাহাকে কাফফারা আদায় করিতে হইবে। পরপর তিনি ধরনের কাফফারার প্রস্তাব করা হয়। ক্রীতদাস মুক্ত করিবার বা ক্রমাগত দুইমাস রোযা রাখিবার কিংবা ষাটজন মিসকীন খাওয়াইবার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু ইহার প্রত্যেকটি প্রস্তাবেই সে নিজের অক্ষমতার কথা বলে। ইহা হইতে বুঝা যায়, এই ধরনের অপরাধের ইহাই কাফফারা-যেটা যাহার পক্ষে সম্ভব, সে সেটাই করিবে। ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য অনেকেই এই মত দিয়াছেন। ইমাম মালিক বলিয়াছেনঃ এই ধরনের অপরাধী উপরোক্ত তিনটি কাজের যে কোন একটি কাফফারা আদায় করিতে পারে। একটি ভাষা এইরূপঃ
*********************************************
হয় একটি গোলাম আযাদ করিবে কিংবা একাধারে দুইমাস রোযা থাকিবে, অথবা ষাটজন মিনকীন খাওয়াইবে।
অন্যান্য হাদীসবিদ বলিয়াছেন, কোনটি কাহার পক্ষে সম্ভব তাহা এই ক্রমিকতা সহকারে যাচাই করিতে হইবে। ক্রমিকতা অনুযায়ী সেটা যাহার পক্ষে সম্ভব তাহাকে সেটাই করিতে হইবে। হযরত আলী (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
==================
ষাটজন মিসকীন খাওয়াইবে। প্রত্যেক মিসকীনকে এক ‘মদ্দ’ পরিমাণ খাদ্য দিতে হইবে।
হানাফী মাযহাবের মতে ষাটজন মিসকীনের খাদ্য যদি ষাট দিনে একজন মিসকীনকে খাওয়াইয়া দেওয়া হয়, তবে তাহা জায়েয হইবে। কেননা আলোচ্য হাদীসের লোকটিকে নবী করীম (স) শেষ পর্যন্ত বলিয়াছেনঃ ===== এই খাদ্য তোমার পরিবারবর্গকে খাওয়াইয়া দাও’, ইহাই হানাফী মতের দলীল। ============
নাপাক অবস্থায় রোযাদারের সকাল হওয়া
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হ্ইয়াছে, এক ব্যক্তি আসিয়া বলিলঃ ইয়া রাসুল, নামাযের সময় উপস্থিত হয়, তখন আমি নাপাক থাকি। অতঃপর আমি রোযা রাখি। এই অবস্থায় কি বাঞ্ছনীয়? রাসূলে করীম (স) বলিলেন, এই রূপ অবস্থা আমারও হইয়া থাকে। আমারও নাপাক অবস্থায় নামাযের সময় হয়। অতঃপর রোযাও রাখি। অতঃপর রোযাও রাখি। লোকটি বলিলঃ হে রাসূল! আপনি তো আমাদের মত নহেন। আপনার তো সামনে ও পিছনের সব গুনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ আল্লাহর নামে শপথ, আমি নিশ্চয়ই আশা করি যে, আমি তোমাদের অপেক্ষা আল্লাহকে অধিক ভয় করি এবং যে বিষয়ে আমি ভয় করি, সে বিষয়ে তোমাদের তুলনায় অনেক বেশী জানি।
ব্যাখ্যা রোযার মাসে নাপাক অবস্থায় ফজর হইয়া গেলেও রোযা রাখায় কোন অসুবিধা নাই এবং এই রোযার কাযা করিতে হইবে না। সে নাপাকী স্ত্রী-সহবাসের হউক, কি অন্য কিছুর দরুন, ইহাই হাদীসটির প্রতিপাদ্য। সব ফিকাহবিদদেরও ইহাই মত। ইমাম নববী দৃঢ়তার সহিত দাবি করিযাছেন যে, এই মতের উপর ইজমা-ঐক্যমত স্থাপিত হইয়াছে। অবশ্য হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে এই মতের বিপরীত মতের হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
==============
যে লোক নাপাক অবস্থায় সকাল করিল-সকাল র্যন্ত নাপাক থাকিল, তাহার জন্য রোযা নাই।
-বুখারী, মুসলিম
কিছু সংখ্যক তাবেয়ী এই মতের উপর আমল করিতেন। কিন্তু ইবনে হাজার আল-আসকালানী বলিয়াছেন, হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত এই হাদীসটির সনদ দুর্বল। কেননা ইহার সনদে আবুল মাহজাম নামে একজন বর্ণনাকারীর বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। হাসান বসরী ও সালেম ইবনে আবদুল্লাহ হযরত ইবনে উমর (রা) সম্পর্কে বর্ণনা করিয়াছেন।
===========
(এইরূপ অবস্থায়) ‘তিনি [আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)] রোযা পূর্ণ করিতেন এবং পরে উহার কাযাও করিতেন।
ইবনে আবদুল বার ও নখয়ী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, ফরয রোযায় এইরূপ হইলে উহা কাযা করা ওয়াজিব, নফল রোযার নয়। মাওয়ার্দী লিখিয়াছেন, স্ত্রী-সহবাসজনিত নাপাকীর ব্যাপারেই এই মতভেদ, স্বপ্নদোষজনিত নাপাকীর ক্ষেত্রে নয়। কেননা তাহা কাযা করিতে হইবে না বলিয়া সকলেই মত দিয়াছেনঃ কিন্তু এই ক্ষেত্রেও হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
===================
স্বপ্নদোষের দরুন নাপাক অবস্থায় সকাল হইয়া গেলে সে যেন রোযা ভাঙ্গে বলিয়া তিনি ফতওয়া দিয়াছেন।
কিন্তু মূল মতবিরোধের বিষয়ে দেখা যায়, স্বয়ং নবী করীম (স)-এরও এইরূপ অবস্থায় হইয়াছে। উপরিউক্ত হাদীসে যেমন এই কথা বলা হইয়াছে, তেমনি আরো স্পষ্ট ভাষায় এই কথা বর্ণিত হইয়াছে হযরত আয়েশা (রা) ও হযরত উম্মে সালমা (রা) হইতে। বর্ণনাটির ভাষা এইরুপঃ
========================
নবী করীম (স) -এর ফজর হইত অথচ তিনি স্ত্রী সহবাসজনিত নাপাক অবস্থায় থাকিতেন। তখন তিনি গোসল করিতেন ও রোযাও রাখিতেন।
এই সাক্ষ্য দিয়াছেন রাসূলে করীম (স)-এর দুইজন স্ত্রী। ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেনঃ অধিকাংশ বিজ্ঞ লোকের সর্বসম্মত মত ইহাই এবং এই অনুযায়ী তাঁহাদের আমল। এইরূপ অবস্থায় রোযা রাখা রাসুলে করীম (স)-এর জন্য কোন বিশেষ অনুমতির ব্যাপারে ছিল না। লোকটির জিজ্ঞাসার জওয়াবে তিনি নিজের অবস্থা বলিয়া এই বিষয়ে তাঁহার কোন বিশেষ সুয়োগ থাকার প্রতিবাদ করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, আমি তোমাদের তুলনায় প্রকৃত বিষয়ে বেশী জানি এবং আল্লাহকেও বেশী ভয় করি। তাহা সত্ত্বেও আমার এইরূপ অবস্থা হইলেও আমি সেই ফজর কালে গোসল করিয়া নামায পড়ি ও রোযা থাকি। ইহাতে শরীয়াতের বিধান লংঘন করা হয় না।
কতিপয় মুহাদিস এই দুই ধরনের হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য বলিয়াছেনঃ ‘হযরত আবু হুরায়রার বর্ণনায় যাহা বলা হইয়াছে, তাহা উত্তম পন্থার নির্দেশ। অর্থাৎ ফজরের পূর্বে গোসল করিয়া পবিত্র হওয়া ভালো। কিন্তু উহার বিপরীত হইলেও যায়েয হইবে -হযরত আয়েশা বর্ণিত এই হাদীসটিতে সেই জায়েয হওয়ার কথাই বলা হইয়াছে। ইবনে দকীকুল-ঈদ বলিয়াছেঃ প্রথম দিকে রোযার রাত্রে স্ত্রী সহবাস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। পরে এই আয়াত নাযিল হয়ঃ
====================
রোযার রাত্রিতে স্ত্রী সহবাস তোমাদের জন্য জাযেয করা হইয়াছে।
এই অনুমতি অনুসারে ফজর হওয়ার নিকটবর্তী সময় পর্যন্ত স্ত্রীসঙ্গম জায়েয হইয়া গিয়াছে। ফলে নাপাক অবস্থায় ফজর হইয়া যাওয়া বিচিত্র কিছুই নয় এবং এইরূপ হ্ইলে তাহার রোযা নষ্ট হওয়ার কোন কারণ থাকিতে পারে না।
==============
তারাবীহর নামায
======================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি রমযান মাসের রাত্রিতে ঈমান ও সতর্কতা সহকারে নামায আদায় করিবে, তাহার পূর্বের যাবতীয় গুনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইবে।
ব্যাখ্যা হাদীসে উল্লেখিত ‘কিয়ামে রমযান’ ======== অর্থঃ তারাবীহর নামায পড়া ‘তারবীহা’ ‘তারবীহাতুন’ ======== এর বহুবচন। ইহার আসল অর্থঃ আরাম করা, বিশ্রাম করা। বিশেষ নামাযের নাম ‘তারাবীহ’ রাখা হইয়াছের এইজন্য যে, ইহাতে প্রতি চার রাক’আত নামায অন্তর কিছুক্ষণ বসিয়া বিশ্রাম গ্রহণ করা হয়, ফলে প্রতি চার রাক’আত নামাযেরই নাম করা হইয়াছে ‘তারাবীহ।‘
=====================
‘তারাবীহা’ প্রতি চার রাক’আত নামাযের নাম। আর ইহার আসল অর্থ বসিয়া বিশ্রাম করা বা বিশ্রাম দেওয়া।
এই নামায রমযান মাসে ‘এশার ফরয ও সুন্নাতের পর পড়িতে হয়।
====================
কেননা তারাবীহ নামায পড়িবার নিয়ম সাহাবীদের কাজ দ্বারা জানা গিয়াছে। অত্রবে ঠিক যে সময়ে তাঁহারা উহা পড়িয়াছেন, তাহাই উহার জন্য সঠিক সময়। আর তাঁহারা উহা পড়িয়াছেন এশার ফরয নামাযের পর বিতরের নামাযের পূর্বে।
নবী করীম (স) এই নামায পড়িয়াছেন; কিন্তু তাহা রীতিমত প্রত্যেক রাত্রে পড়েন নাই। ইহার কারণস্বরূপ তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
=======================
রাত্রের এই (তারাবীহ) নামায তোমাদের প্রতি ফরয হইয়া যাওয়ার ভয় করিতেছি আমি। তার এই ভয়েরও কারণ ছিল এই যেঃ
=================
যেসব -অ-ফরয কাজ নবী করীম (স) আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ও কাছাকাছি সময়ে স্থায়ীভাবে করেন, তাহাই তাঁহার উম্মতের উপর ফরয হইয়া যায়।
কিন্তু নবী করীমের যুগে ইহা মুসলমানগণ নিজস্বভাবে ও নিজ নিজ ঘরে বসিয়া পড়িতেন। মুহাদ্দিসগণের সম্মিলিত মতে ইহা মুস্তাহাব অর্থাৎ ইহা ফরয বা ওয়াজিব নহে। ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আহমদ এবং মালিকী মাযহাবের কিছু ফিকাহবিদের মতে এই নামায জামা’আতের সহিত পড়া উত্তম। হযরত উমর ফারুক ও সাহাবিগণ এই নামায এইভাবেই পড়িয়াছেন এবং মুসলিম জাতি চিরদিনই এই নামায এই নিয়মেই পড়িয়া আসিয়াছে। ফলে ইহা ঈদের নামাযের মতই মুসলমানদের জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হইয়াছে। [ কতক আলিমের মতে ইহা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং কতকের মতে ইহা মুস্তাহাব। হিদায়ার মূল ইবারতে ====== শব্দের উল্লেখ আছে। জামে সগীরেও অনুরূপ উল্লেখ আছে। কিন্তু হিদায়া প্রণেতা লিখিয়াছেন যাহার অর্থঃ সহীহ এই যে তারাবীহ সুন্নাত। ইমামর আবু হানীফা (র) হইতে হাসান এরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। কেননা খুলাফায়ে রাশেদীন ইহা সর্বদা পড়িতেন এবং হযরত মুহাম্মাদ (স) সর্বদা পড়েন নাই। কেননা তিনি উহা আমাদের উপর ফরয হইয়া পড়িবার আশঙ্কা করিতেন।]
আলোচ্য হাদীসে নবী করীম (স) এই তারাবীহ নামাযের ‘ফযীলত’ বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, ঈমান ও ‘ইহতিসাব’ সহকারে যে লোক রমযান মাসের এই নামায পড়িবে, তাহার পূর্বের গুনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইবে। ‘ঈমান’ অর্থ উহাকে সত্য বলিয়া জানা এবং উহার মর্যাদা ও ফযীলত সম্পর্কে পূর্ণ আস্থাবান ও বিশ্বাসী হওয়া। আর ‘ইহতিসাব’ অর্থ উহার দ্বারা কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিপুলর সওয়াব লাভের ইচ্ছা পোষণ করা, ইখলাসের বিপরীত-লোক দেখানো কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে এই কাজ না করা। ============== ‘পরবর্তী গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে বলা হইয়াছে। বাহ্যত ইহাই মনে হয় যে, তারাবীহ নামায সঠিকভাবে পড়িলে সগীরাকবীরা সব রকমের গুনাহই মাফ হইয়া যাইবে। কিন্তু ইমামুল হারামাইনের সুচিন্তিত মতে কেবলমাত্র সগীরা গুনাহই উহার দ্বারা মাফ হইবে, কবীরা গুনাহ নহে।
তারাবীহ নামাযে রাক’আত সংখ্যা বিভিন্ন হাদিসে বিভিন্ন রকম উদ্ধৃত হইয়াছে। সায়েব ইবনে ইয়াযীদ হইতে বায়হাকী বর্ণনা করিয়াছেনঃ
================
আমরা হযরত উমরের সময় বিতরের নামাযসহ বিশ রাক’আত নামায পড়িতাম। তাবারানী হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
==========================
নবী করীম (স) রমযান মাসে বিতর ছাড়া বিশ রাক’আত নামায পড়িতেন। কিন্তু এই হাদীসদ্বয়ের সনদ দুর্বল।
তবে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীস ইহার বিপরীত। তাহা হইতে তারাবীহর নামায মাত্র আট রাক’আত-ই প্রমানিত হয়। হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ
========================
রাসুলে করীম (স) রাত্রি বেলা আট রাক’আত নামায পড়িতেন, অতঃপর বিতর পড়িতেন। ইহার পর বসিয়া বসিয়া দুই রাক’আত পড়িতেন।
এই হাদীস হইতে বুঝা যায় যে, নবী করীম (স) তারাবীহর নামায মাত্র আট রাক’আত পড়িতেন, ইহার পর বিতরের নামায পড়িতেন। আর সর্বশেষ বসিয়া বসিয়া দুই রাক’আত পড়িতেন। ইহা হইতেও তারাবীহ নামায আট রাক’আতই প্রমাণিত হয়। ইমান ইবনে তাইমিয়া বলিয়াছেনঃ তারাবীহ নামাযের নির্দিষ্ট রাক’আত সংখ্যা নবী করীম (স) হইতে প্রমাণিত হইয়াছে বলিয়া মনে করাই মূলগতভাবে বুল। কেননা তিনি সত্যই রাক’আতের এমন কোন সঙখ্যা বিশ বা আট নির্দিষ্ট করিয়া যান নাই। বরং তাঁহার ও সাহাবীদের হইতে বিভিন্ন সংখ্যা বর্ণিত হইয়াছে। =============
তারাবীহ নামাযের মর্যাদা ও সওয়াব
=================
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা রমজান মাসের রোযা থাকা তোমাদের প্রতি ফরয করিয়া দিয়াছেন। আর আমি তোমাদের জন্য সুন্নাতরূপে চালু করিয়াছি রমযান মাসব্যাপী আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়ানো। কাজেই যে লোক এই মাসের রোযা পালন করিবে আর আল্লাহর সামনে দাঁড়াইবে ঈমান ও চেতনাসহকারে, যে তাহার গুনাহ হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়া সেই দিনের মত নিষ্পাপ হইয়া যাইবে, যেদিন তাহার মা তাহাকে প্রসব করিয়াছিল।
– মুসনাদে আহমদ, নাসায়ী
ব্যাখ্যা হাদীসটির প্রথম কথা রমযান মাসের রোযা আল্লাহ তা’আলা ফরয করিয়াছেন। কুরআন মজীদে আয়াত দ্বারা, রাসূলে করীম (স)-এর মৌখিক ঘোষণা ও সুনিয়মিতভাবে ও গুরুত্বসহকারে উহা আদায় করার দ্বারা এবং গোটা মুসলিম জাতির একবিন্দু মতবিরোধহীন ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত ও অব্যাহত আমল দ্বারা ইহার ফরয অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে।
রমযান মাসের ‘কিয়াম’-দাঁড়ানোকে রাসূলে করীম (স) চালু করিয়াছেন। হাদীসের ভাষা হইলঃ ========= ইহার (রমযানের) দাঁড়ানো আমি রীতিবদ্ধ করিয়া দিয়াছি।
‘কিয়ামে রমযান’ হাদীস ও ফিকাহর একটা বিশেষ পরিভাষা। ইহার অর্থ, রমযান মাসের রাত্র গুলিতে আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়ানো। আর রমযানের রাত্রিতে আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়ানো, অর্থ রাত্রিতে এশার নামাযের পর তারাবীহ নামায পড়া।’ ‘তারাবীহ’ নামায শরীয়াতের ব্যবস্থা। ইহার ব্যবস্থা করিয়াছেন রাসূলে করীম (স), আল্লাহ তা’আলা করেন নাই। আল্লাহ তা’আলা ‘রিতবদ্ধ’ করিলে উহা আদায় করা ফরয হইয়া যাইত। তিনি করেন নাই বিধায় ইহা ফরয নয়-‘সুন্নাত’ অর্থাৎ সুন্নাতে কুয়াক্কিদাহ।
এখানে প্রথম প্রশ্ন, রাসূলে করীম (স) ইহা কিভাবে ‘রীতিবদ্ধ’ করিলেন? তিনি কি ইহা নিজের ইচ্ছামত চালু করিয়াছেন, না ইহার পিছনে আল্লাহর অনুমতি রহিয়াছে? ইহা জওয়াবে বলা বাহুল্য, শরীয়াতের কোন কিছুই নবী করীম (স) নিজের ইচ্ছা ও মর্যীমত চালু করেন নাই। যাহা কিছুই করিয়াছেন, তাহা হয় কুরআনের আয়াত হইতে জানিতে পারিয়া করিয়াছেন, না হয় আল্লাহর কোন গোপন ইঙ্গিতে (===========) জানিতে পারিয়া করিয়াছেন। তিনি হয়ত ওহীর মাধ্যমে রমযান মাসের রাত্রিগুলিতে তারাবীহ নামায পড়ার অশেষ সওয়াব ও অতুলনীয় মর্যাদার কথা জানিতে পারিয়াছেন। অতঃপর উহা জনসমাজে চালু করিয়াছেন। অবশ্য নবী করীম (স) ইজতিহাদের সাহায্যেও শরীয়াতের ব্যবস্থা চালু করিতে পারেন। সেই অধিকার তাঁহাকে আল্লাহ তা’আলাই দিয়াছেন যে আল্লাহ তাঁহাকে নবী ও রাসূল বানাইয়াছেন এবং কুরআন মজীদ তাঁহার নিকট নাযিল করিয়াছেন। ইজতিহাদ ভুল ও নির্ভুল-উভয়ই হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নবী করীম (স)-এর ইজতিহাদে যে এক বিন্দু ভুল হইতে পারে না-হইলেও মুহূর্তের জন্য, পর মুহূর্তে আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক তাহা সংশোধিত হইয়া গিয়াছে ও ভুলের উপর তাহাকে থাকিতে দেওয়া হয় নাই, তাহা সর্বজনস্বীকৃত সত্য। কাজেই তারাবীহ নামায যেখাবেই হউক, নবী করীম (স) কর্তৃক রীতিবদ্ধ ও চালু হইয়াছে, আল্লাহ তা’আলা ইহা ফরয বা ওয়াজিব করেন নাই, তাহা চূড়ান্ত।
এই পর্যায়ে ‘তারাবীহ নামায’ চালু হওয়ার ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচিতব্য। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) এক রাত্রে মসজিদে নামায পড়িলেন। তখন অনেক লোক সামাযে তাঁহার সহিত শরীক হইয়া গেল। দ্বিতীয় রাত্রেও তিনি নামায পড়িলেন। এবারেও অনেক লোক তাঁহার সহিত শরীক হইল। পরে তৃতীয় রাত্রেও এই রকম হইল। মসজিদে নামাযে অনেক লোক একত্র হইয়া গেল। চতুর্থ রাত্রে মসজিদে এত লোকের সমাবেশ হইয়া গেল যে, ==========
মসজিদে লোক সংকুলান না হওয়ার উপক্রম হইল।
কিন্তু সেই রাত্রে নবী করীম (স) ঘর হইতে বাহির হইলেন না। লোকেরা ‘নামায’ ‘নামায’ বলিয়া অনেক ডাকাডাকি করিল। কিন্তু তাহাতেও তিনি বাহিরে আসিলেন না। রাত্র শেষ হইলে ফজরের নামাযের পর নবী রকীম (স) দাঁড়াইয়া সমবেত লোকদের সম্মুখে ভাষণ দিলেন। বলিলেনঃ
=======================
গত রাত্রে তোমাদের যে অবস্থা হইয়াছিল, আমার নিকট উহা কিছুমাত্র গোপন থাকে নাই। কিন্তু আমি ভয় করিতেছি যে, উহা তোমাদের প্রতি ফরয করিয়া দেওয়া না হয়। কেননা ফরয করিয়া দেওয়া হইলে তোমরা উহা আদায় করিতে অক্ষম হইয়া পড়িবে।
এই হাসীদটি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ ও মুয়াত্তা মালিক গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে। বুখারী ও মুসলিম প্রভৃতি গ্রন্থে হযরত আয়েশার এই বর্ণনার শেষ বাক্য উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
=============== এই ঘটনা রমযান মাসের (রাত্রিতে) সংঘটিত হইয়াছিল। অপর এক বর্ণনায় রাসূলে করীম (স)-এর ভাষণের শেষ কথাটি উদ্ধত হইয়াছেঃ
==================
কিন্তু আমি ভয় করিতেছি, এই নামায তোমাদের উপর ফরয হইয়া না যায়। তাহা হইলে তোমরা এমন একটা কাজের চাপ নিজেদের উপর চাপাইয়া লইয়া বসিবে, যাহা করার সামর্থ তোমাদের হইবে না। কেননা তোমরা নিজেরা কোন কাজে যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত না হইবে, আল্লাহ ততক্ষণ তোমাদের উপর কোন কষ্টের কাজ চাপাইয়া দিবেন না।
অর্থাৎ রমযানের দিনের বেলা একাধারে ১২-১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত থাকিবার পর ইফতার করা ও পানাহার করা হইলে শরীর আপনি নিঃশক্তি হইয়া ঢলিয়া পড়িতে চায়। তখন তারাবীহ নামায পড়া খুবই কষ্টকর। তোমরা এমন কোন আমল পছন্দ করিয়া নিয়মিত করিতে থাকিবে। তোমাদের অবস্থা দেখিয়া আল্লাহ তা’আলা যদি উহা তোমাদের প্রতি ফরয করিয়া দেন, তখন কিন্তু উহা আদায় করা তোমাদের পক্ষে অসম্ভব বা অতিশয় কষ্টকর হইয়া পড়িবে। কাজেই এখন উহা নিয়মিত ও অব্যাহতভাবে করিতে থাকিও না।
কিন্তু তাহা সত্ত্বেও যদি কেহ সচেতনভাবে, আল্লাহর নিকট হইতে অশেষ সওয়াব পাওয়ার আশায় তারাবীহ নামায পড়ে, তাহা হইলে সে গুনাহমুক্ত হইতে পারিবে যেমন গুনাহমুক্ত থাকে সদ্যজাত শিশু। ==========
রোযার ফিতরা
====================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, হযরত রাসূলে করীম (স) রমযান মাসের রোযার ফিতরা এক সা’ পরিমাণ শুষ্ক খেজুর কিংবা এক সা’ পরিমাণ যব মুসলমান সমাজের প্রত্যেক স্বাধীন, মুক্ত কিংবা দাস পুরুষ দাস পুরুষ কিংবা স্ত্রীলোকের উপর ফরয করিয়া দিয়াছেন।
– মুসনাদে আহমদ, আবু দাুদ
ব্যাখ্যা হাদীসটিতে রমযান মাসের রোযার ফিতরা সম্পর্কে বলা হইয়াছে। শরীয়াতের দৃষ্টিতে ‘ফিতরা’ বলা হয় এমন পরিমাণ অর্থ বা সম্পদকে যাহারা যাকাত গ্রহণ করিতে পারে এমন গরীব ব্যক্তিকে বিশেষ পদ্ধতিতে দেওয়া হয়। হিজরতের দ্বিতীয় বৎসর ঈদুল ফিতরের দুই দিন পূর্বে ইসলামী সমাজে এই ফিতরা সর্বপ্রথম বাধ্যতামূলকভাবে ধার্য ও প্রচলন করা হয়। কাইম ইবনে সা’দ বলিয়াছেনঃ
==================
যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বেই রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে সদকায়ে ফিতরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়াছেন।
ইহার পর যাকাত ফরয হয়, কিন্তু সদকায়ে ফিতর সম্পর্কে নূতন কিছু বলা হয় নাই। ==============
কিন্তু তাহাতে একথা প্রমাণিত হয় না যে, যাকাত ফরয হওয়ার পর রোযার ফিতরা দিতে হইবে না। বরঙ ইহার বাধ্যবাধকতা পূর্বের মতই চালু থাকার কথা ইহা হইতে প্রামণিত হয়। অর্থাৎ সদকায়ে ফিত পূর্বে যেমন ওয়াজিব ছিল, তেমনি ওয়াজিব থাকিয়া গেল। হাদীসের ভাষা হইলঃ ‘ফরয’ করিয়া দিয়াছেন। অর্থাৎ ধার্য করিয়াছেন, বাধ্যতামূলক করিয়াছেন ও ওয়াজিব করিয়া দিয়াছেন। এই দৃষ্টিতে ফিতরা যাকাত সমতুল্য। এ দুইটি একই উৎস হইতে ধার্য হইয়াছে এবং উভয়ের অর্থনৈতিক ফায়দা অভিন্ন। কেননা উহা আল্লাহর ধার্য করা ফরয যাকাতের মতই। বস্তুত ফিতরা আদায় করার কর্তব্য সম্পর্কে ইসলামী শরীয়াতে পূর্ণ ঐকমত্য বা ইজমা রহিয়াছে। ইহাতে কাহারও কোন দ্বিমত নাই। ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব অনুযায়ী ইহা সুন্নাত-সুন্নাতে মুয়াক্কিদা-ওয়াজিব বা ফরয নয়। তাঁহাদের মতে আলোচ্য হাদীসের শব্দ ‘ফরয করিয়াছেন’ কথাটির অর্থ হইল ‘পরিমাণ নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন’ কিংবা ধার্য করিয়া দিয়াছেন। ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মাযহাবে ইহা ‘ফরয’ নয়-‘ফরয’ বলিতে যাহা বুঝায় তাহা নয় বরং ইহা ‘ওয়াজিব’। হানীফী মাযহাবে ‘ফরয’ ও ‘ওয়াজিব’ শব্দ দুইটির মধ্যে পার্থক্য রহিয়াছে।
হাদীসের ভাষা হইল ‘যাকাতুল ফিতর’-অর্থাৎ রোযা খোলার যাকাত। রোযা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইহা আদায় করা ওয়াজিব হইয়া যায়। ইহাকেই ‘সদকায়ে ফিতর’ বলা হয়। এই দুইটি শব্দের অর্থ একই।
ইহা স্বাধীন-মুক্ত পুরুষ, স্ত্রী ও ক্রীতদাত নির্বিশেষে সব মুসলমানের উপর ওয়াজিব। ‘ক্রীতদাস’ কথাটি এখানে তদানীন্তন আরব সমাজের প্রেক্ষিতে বলা হইয়াছে। বর্তমান স্থায়ী গৃহভৃত্য ইহার স্থলে পণ্য হইবে এবং বাড়ীর কর্তাকে তাহার ফিতরাও আদায় করিতে হইবে। মুসলিম শরীফের হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
=======================
ক্রীতদাসের জন্য মনিবকে সদকায়ে ফিতর ছাড়া অন্য কোন সদকা দিতে হয় না।
‘সদকায়ে ফিতর’ মুসলমান মাত্রেরই আদায় করা কর্তব্য। পুরুষদের ব্যাপারে তো কোন অস্পষ্টতা নাই। মেয়েলোক বিবাহিতা হইলে স্বামীই তাহার সদকায়ে ফিতর আদায় করিবে। অবিবাহিতা হইলেও তাহার নিজের সামার্থ্য থাকিলে সে নিজেই আদায় করিবে। অন্যথায় তাহার এবং অন্যান্য না-বালেপদের ফিতরা আদায় করিবে তাহাদের পিতা বা অলী বা অভিভাবক। অবশ্য যাহার পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয ও হালাল, তাহার পক্ষে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয় বলিয়া বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
=================
ফকীর গরীবের পক্ষেও ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। সে যাহা দিবে আল্লাহ তাহাকে তাহার দেওয়া পরিমাপণর বেশী ফিরাইয়া দিবেন। ================
কিন্তু ইহা বাধ্যবাধকতামূলক নয়; বরং স্বেচ্ছামূলক ও অধিক সওয়াব পাওয়ার আশায় বান্দার আত্মোৎসর্গের ব্যাপার।
ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব এমন মুসলমানের পক্ষে, যে নিজে রোযা রাখিয়াছেন। উহার পরিমাণ হাদীসে বলা হইয়াছে এক সা’-সা’ একটা বিশেষ পরিমাণের ওজর। এক সা’ ওজনে চার মুদ্দ হয়। সা’ দুই ধরনের, একটি হিজাযী আর অপরটি ইরাকী। হিজাযী সা’র ওজন ৫রতল এবং এক ইরাকী সা’ ৮ ‘রতল’। এক ‘রতল’ আমাদের দেশী ওজনে প্রায় অর্ধসের। অত্রবে এক হিজাযী সা’ আমাদের দেশে চলতি ওজনে প্রায় পৌনে তিনসের। আর ইরাকী সা’র ওজনে প্রায় ৪ সের। এই ওজনের খাদ্যশস্য কিংবা উহার বিক্রয় মূল্যই দেয়।
সা’র ওজন বিভিন্ন হওয়ায় ফিতরার পরিমাণ কিছুটা মতভেদ হইয়াছে। এই দেশের মুফতী সাহেবদের ফিতরা সংক্রান্ত একটি ঘোষণা ইহার দৃষ্টান্তঃ বায়তুল মুকাররম মসজিদের তরফ হইতে ঘোষণা করা হইয়াছেঃ এই বারের (১৯৭৪ সনে) ফিতরা দুই টাকা ৫০ পয়সা। লাল বাগ শাহী মসজিদের পক্ষ হইতে ঘোষিত হইয়াছেঃ পূর্ণ রেশনিং এলাকায় পৌনে দুই সের আটার মূল্যে মাথাপিছু আড়াই টাকা এবং যেখানে রেশনিং ব্যবস্থা নাই সেখানে স্থানীয় বাজারের গম বা আটার মূল্যের ফিতরা দান করিতে হইব। বংশালের আহলি হাদীস মসজিদের পক্ষ হইতে প্রচার করা হইয়াছে যে, ২ সের ১১ ছটাক চাউল অথবা গমের মূল্যে ফিতরা দিতে হইবে। কন্ট্রোল দরে এই পরিমাণ চাউলের দাম ৪ টাকা ৩ পয়সা এবং গমের দাম টাকা ৩৪ পয়সা। (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪-১০-৭৪)।
ফিতরার পরিমাণ সম্পর্কে বহু হাদীস গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে। এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস এইঃ
===================================
আবদুল্লাহ ইবনে সা’লাবাতা ইবনে ছুগাইর আল-উযরী তাঁহার পিতা (ছুগাইর উল উযরী) হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত নবী করীম (স) তাঁহার ্রকে ভাষণে বলিয়াছেনঃ তোমরা প্রত্যেক স্বাধীন, ক্রীতদাস, ছোট কিঙবা বড়’র তরফ হইতে অর্ধ সা’ গম কিংবা এক সা’ যব কিংবা এক সা’ খেজুর ফিতরা বাবদ আদায় কর। -আবু দাউদ, আবদুর রাজ্জাক, দারে কুতনী, তাবারানী, হাকেম
ইলমে হাদীসের দৃষ্টিতে এই সব হাদীস ‘খবরে ওয়াহিদ’। ইহাতে রাসূলে করীম (স)-এর ‘আদায় কর’ স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ উদ্ধৃত হইলেও ইহা হইতে ‘ফরয’ প্রমাণিত হয় না; ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। কেননা ইহা (===============) অকাট্য প্রমাণ নয়।
হাদীস হইতে এই কথা জানা যায় যে, সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন শর্ত নাই। কিন্তু হানাফী মাযহাবে ==== বা স্বাধীন হওয়ার শর্ত করা হইয়াছে। ইহার উদ্দেশ্য হইল, স্বাধীন হইলে তাহার ইসলাম পালন ও মালিকানা গ্রহণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়, ক্রীতদাস হইলে তাহা হয় না। তাহার সদকা দান আল্লাহর নৈকট্য লাভের কারণ হয়। আর স্বচ্ছলতারও শর্ত করা হইয়াছে। একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
=======================
বাহ্যত স্বচ্ছলতা ও ঐশ্বর্যশীলতা ছাড়া সদকা ওয়াজিব হয় না।
কিন্তু ইমাম শাফেয়ী এই মত সমর্থন করেন নাই। তাঁহার মতেঃ
==========================
যে লোক (ঈদের দিন) তাহার নিজের ও পরিবারবর্গের সেই দিনের খাদ্য পরিমাণের অধিক সম্পদের মালিক হইবে তাহার উপরই ফিতরার সদকা ওয়াজিব।
ফিতরার লক্ষ্য
==============================
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হয়িাছে, তিনি বলিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) ফিতরার ‘যাকাত’ রোযাদারকে বেহুদা অবাঞ্ছনীয় ও নির্লজ্জতামূলক কথাবার্তা বা কাজকর্মের মলিনতা হইতে পবিত্র করার এবং গরীব মিসকীনদের (অন্ততঃ ঈদের দিনের উত্তম) খাদ্যের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে অবশ্য আদায়যোগ্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। যে লোক উহা ঈদের নামাযের পূর্বে আদায় করিবে, তাহা ওয়াজিব যাকাত বা সদকা হিসাবে আল্লাহর নিকট গৃহীত হইবে। আর যে লোক উহা ঈদের নামাযের পর আদায় করিবে, তাহা তাহার সাধারণ দান রূপে গণ্য হইবে।
-আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ
ব্যাখ্যা এই হাদীসটিতে সদকায়ে ফিতর-এর আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণের কথা বলা হইয়াচে। উহার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ এই যে, প্রথমত ফিতরা আদায়কারী ব্যক্তি শরীয়াত লংঘনকারী কোন কাজে লিপ্ত হইবে না ও অর্থের অপচয় করিবে না। আর যদি অলক্ষ্যে ও অসতর্কতার কারণে কোন শরীয়াত বিরোধী কাজ হইয়া যায়, কোন অশ্লীল কথা মুখ হইতে বাহির হইয়া যায় বা কোন পাপ কাজ করিয়া ফেলে, তবে আল্লাহ তা’আলা এই সদকার দৌলতে তাহা মাফ করিয়া দিবেন। আর সামাজিক অর্থনৈতিক কল্যাণ এই যে, ইহার দরুণ সমাজের গরীব-মিসকীন লোকেরা সাময়িকভাবে হইলেও এমন পরিমাণ অর্থ পাইতে পারে, যাহার দ্বারা তাহাদের ও পরিবারবর্গের ঈদের দিনের ভালো কিংবা সাধারণ মানের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা সম্ভব হইতে পারে।
হাদীসটি হইতে ইহাও জানা গেল যে, সাদকায়ে ফিতর আদায় করার সঠিক সময় হইল ঈদের নামাযের পূর্বে। আর ‘ঈদের নামাযের পূর্বে’ বলিতে ঈদের দিনের সকাল বেলাও বুঝায়, একদিন দুইদিন আগের সময়ও বুঝায়। এই সময় আদায় করিলে তাহা সঠিকরূপে ও যথার্থভাবে আদায় করা হইল মনে করিতে হইবে। এই সময় আদায় করিলে তাহা সঠিকরূপে ও যথার্থভাবে আদায় করা হইল মনে করিতে হইবে। আর নামাযের পরে আদায় করিলে উহা সাধারণ দান পর্যায়ে গণ্য হইবে। হাদীসের শব্দ ব্যবহার ভঙ্গী হইতে মনে হয়, এই আদায়কে নিতান্তই ‘দান’ মনে করা যাইবে, সদকায়ে ফিতর যেভাবে আদায় হওয়া উচিত সেভাবে আদায় করা হইল বলিয়া মনে করা যাইবে না। হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণিত হাদীসের শেষাংশের ভাষা হইলঃ
===========
নবী করীম (স) সদকায়ে ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়াছেন লোকদের ঈদের নামাযের জন্য বাহির হওয়ার পূর্বে।
এই নির্দেশ যে অবশ্য পালনীয় পর্যায়ের তাহা নিঃসন্দেহ। এতদসত্ত্বেও আল্লামা তাইয়্যেবী বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স)-এর এই নির্দেশ ওয়াজিব নহে; বরং মুস্তাহাব-অতীব উত্তম ও পছন্দনীয় পর্যায়ের। কেননা জমহুর শরীয়াতবিজ্ঞ অধিকাংশ লোকের মতে ঈদের নামাযের পরও- সেই দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত ফিতরা দিয়া দিলে তাহা আদায় হইল বলিয়া মনে করা যায়। তবে ঈদের নামাযের পূর্বে যে কোন সময় আদায় করিয়া দেওয়াই উত্তম।
হযরত ইবনে উমর বর্ণিত অপর একটি হাদীসে সাহাবীদের সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
==================================
সাহাবায়ে কিরাম সদকায়ে ফিতর ঈদের একদিন বা দুই দিন পূর্বেই আদায় করিয়া দিতেন।
ইহা উত্তম এই জন্যও যে, একদিন পূর্বে এই অর্থ গরীব-মিসকীনদের হাতে আসিলে তাহারা উহার দ্বারা ঈদের দিনের খাওয়া-পরার ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত গ্রহণ করিতে পারে।
অবশ্য ইমাম মালিক বর্ণনা করিয়াছেনঃ
================
ইমাম মালিক দেখিতে পাইয়াছেন যে, অভিজ্ঞ লোকেরা রোযার ফিতরা ঈদের দিন সূর্যোদয়ের পর নামাযে যাওয়ার পূর্বে আদায় করিয়া দেওয়াই পছন্দ করিতেন ও ভালোবাসিতেন।- মুয়াত্তা মালিক
ইতিফাক
=============================
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, (তিনি বলিয়াছেন), হযরত নবী করীম (স) রমযান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করিতেন এবং ইহা চলিতেছিল যতক্ষণ না আল্লাহ তা’আলা তাঁহার জান কবজ করিলেন। -তিরমিযী
ব্যাখ্যা ই’তিকাফ সম্পর্কিত এই হাদীসটি মূলত তিনটি সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে। একটি সূত্র বর্ণনাকারী হইতেছেন ওরওয়া-আয়েশা (রা)। দ্বিতীয় সূত্রে রহিয়াছেন সাঈদ, ইবনুল মুসায়্যিবরু- আবু হুরায়রা (রা) এবং তৃতীয় সূত্র বর্ণনাকারী উবাই ইবনে কাব, আবু লাইলা আবু সাঈদ, আনাস ও ইবনে উমর (রা) প্রমুখ সাহাবী। এই সব কয়টি সূত্রেই হাদীসটি সংগ্রহ করিয়াছেন ইমাম যুহরী; ইহাতে হাদীসটির মর্যাদা সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা চলে।
’ই’তিকাফ’ ====== শব্দের আভিধানিক অর্থঃ কোন জিনিসকে বাধ্যতামূলকভাবে ধরিয়া রাখা। কোন জিনিসের উপর নিজেকে শক্তভাবে আটকাইয়া রাখা। আর শরীয়াতের পরিভাষায় ই’তিকাফ বলা হয়ঃ
=========================
মসজিদে কোন বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ ধরনের অবস্থান-অবস্থিতি গ্রহণ।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ === শব্দের আভিধানিক অর্থঃ===== ‘শুধু অবস্থান করা।‘ যে লোক মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করিয়াছে, তাহাকে বলা হয় ==== অবস্থানকারী। আর শরীয়াতের পরিভাষায় ইহার অর্থঃ
==========================
আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে থাকা ও অবস্থান গ্রহণ করা।
কুরআন মজীদের দুইটি আয়াতে এই ই’তিকাফ শব্দটি উল্লেখিত হইয়াছেঃ
========================
তোমরা হইতেছ মসজিদসমূহে অবস্থানকারী।
=====================
তোমরা দুইজনে আমার ঘরকে তওয়াফকারী ও অবস্থানকারীদের জন্য পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করিয়া রাখ।
‘ই’তিকাফ’ শব্দের মূল ভাবধারা হইলঃ কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যবিন্দুতে মন-মগজ দৃঢ়ভাবে নিবদ্ধ রাখিয়া অবস্থান করা এমনভাবে যে সেই দিক হইতে অন্য কোন দিকে দৃষ্টি আদৌ ফিরিবে না।
==================
উপরিউক্ত হাদীস হইতে স্পষ্টভাবে জানাযায়- নবী করীম (স) নিয়মিতভাবে রমযান মাসের শেষ দশদিন মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করিতেন। তাঁহার এই কাজ তাঁহার ইন্তেকাল পর্যন্ত চলিয়াছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই কাজ চালাইয়া গিয়াছেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হাদীসের ভাষা হইলঃ
=======================
রাসূলে করীম (স) ই’তিকাফ করিতেন যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁহার ওফাত করিয়াছেন। তাঁহার চলিয়া যাওয়ার পর তাঁহার স্ত্রীগণ ই’তিকাফ করিয়াছেন।
ইবনুল হুম্মাম বলিয়াছেন, নিরবচ্ছিন্ন ও ক্রমাগতভাবে রাসূলের এই কাজ করা এবং তাহা একবার (বিনা কারণে) পরিত্যাগ না করা এবং সাহাবীদের মধ্যে যাহারা এই কাজ করেন নাই তাঁহাদিগকে ইহা না করার জন্য অভিযুক্ত না করা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, ইহা সুন্নাত। যদি অন্যথা হইত, তাহা হইলে ইহা হইতে ইহার ওয়াজিব প্রমাণিত হইত।
এই সম্পর্কে অন্যদের বক্তব্য হইল, বাহ্যত মনে হয় নবী করীম (স) এই কাজ কখনো পরিহার করেন নাই। কিন্তু আসলে তাহা ঠিক নহে। কেননা আমরা স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি, নবী করীম (স) ইহা কখনো কখনো ত্যাগ করিয়াছেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে ইহার উল্লেখ রহিয়াছে। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসের শেষ শব্দ হইলঃ
===============================
নবী করীম (স) অতঃপর সেই (রমযান) মাসের ইতিকাফ পরিহার করেন এবং শওয়াল মাসের দশদিন ইতিকাফ পালন করেন। -বুখারী
রাসূলে করীম (স) নিয়মিত ই’তিকাফ পারন করিলেও এবঙ ইহা অতীব সওয়াবের কাজ বলিয়া ঘোষিত হইলেও ইহা প্রমাণিত যে, অধিকাংশ সাহাবীই ই’তিকাফ করেন নাই। ইমাম মালিক (রা) বলিয়াছেনঃ
========================
হযরত আবু বকর, উমর, উসমান (রা) ও ইবনুর মুসায়্যিব এবং মুসলিম জাতির পূর্ববর্তী মহান ব্যক্তিগণের কেহউ ই’তিকাফ পালন করিয়াছেন বলিয়া আমার নিকট কোন সংবাদ পৌঁছায় নাই। একমাত্র আবদুর রহমানের পুত্র আবু বকর ছাড়া। আমি তাঁহাদিগকে দেখিতে পাইতেছি, তাঁহারা সকলেই ইতিকাফের তীব্রতা ও কঠোরতার কারণে উহা ত্যাগ করিয়াছেন। কেননা উহার রাত্র ও দিন অভিন্ন।
============================
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) যখন ই’তিকাফের ইচ্ছা করিতেন, তখন ফজরের নামায পড়িতেন ও পরে তাঁহার ই’তিকাফ স্থানে প্রবেশ করিতেন। – তিরমিযী
ব্যাখ্যা এই হাদীস হইতে বাহ্যত জানা যায়, নবী করীম (স) ফজরের নামায পড়িয়া ইতিকাফ শুরু করিতেন। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হইল, তিনি তো পূর্ণ দশ দিনের জন্য ই’তিকাফ করিতেন। আর সেই জন্য রমযান মাসের একুশ তারিখ ফজর পড়িয়া নয়-উহার পূর্বের রাত্রি সূচনায়- বিশ তারিখ মাগরিবের সময় হইতে- ই’তিকাফ স্থানে উপস্থিত হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় চান্দ্রমাসের হিসাবে দশ দিন পূর্ণ হইতে পারে না। এই কারণে মুহাদ্দিসদের মধ্যে দুইটি মতের উদ্ভব হইয়াছে। কয়েক জনের মত হইল বিশ তারিখ মাগরিবের সময়ই ই’তিকাফ কেন্দ্রে অবস্থান গ্রহণ করিতে হইবে। তাঁহারা অত্র হাদীসের ব্যাখ্যা করিয়াছেন এইভাবে যে, আসলে তিনি আগের দিন মাগরিবের সময় হইতেই ই’তিকাফ শুরু করিয়াছেন। পরবর্তী ফজরের নামায পড়িয়া তিনি ই’তিকাফ কেন্দ্রে তাঁহার জন্য নির্দিষ্ট হুজরায় প্রবেশ করিয়াছেন মাত্র।
এই পর্যায়ে আরো একটি প্রশ্ন উঠিয়াছে। তাহা হইল ই’তিকাফ দশদিন না দশ রাত? হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত এক হাদীসের ভাষা হইলঃ
=============================
নবী করীম (স) রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করিতেন।
প্রথমোক্ত হাদীস হইতে দশ রাত্র প্রমাণিত হয়। আর শেষোক্ত হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় দশদিন। এই কারণে মুহাদ্দিসগণ বিশ তারিখ দিনগত রাত্র শুরু-মাগরিবের সময়-হইতেই ই’তিকাফ ধরিয়াছেন। ইহাতে এই উভয় হাদীস অনুযায়ী আমল হওয়ার পথ উন্মুক্ত হইয়াছে।
মহাদ্দিস ও ফকীহ আবু সওর বলিয়াছেনঃ
===========================
দশরাত্রি ই’তিকাফ করার ইচ্ছা হইলে আগেরদিন-বিশ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে ই’তিকাফ কেন্দ্রে প্রবেশ করিতে হইবে।
এইখানে আর একটি প্রশ্ন হইল, দশ দিনের ইতিকাফ শেষে-ঈদের রাত্রে ই’তিকাফ কেন্দ্রেই অবস্থান করিতে হইবে ও ঈদের নামাযের জন্য ময়দানে যাওয়ার পূর্বে মসজিদ হইতে বাহির হইবে না, না মাসের শেষ দিন ঈদের চাঁদ দেখার বা সূর্যস্তের পরই মসজিদ হইতে চলিয়া যাওয়া জায়েয? এই পর্যায়ে শরীয়াত বিশেষজ্ঞদের উক্ত দুই প্রকারের কথাও উদ্ধৃত হইয়াছে। প্রথম মতটি ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদ প্রমুখ প্রদান করিয়াছেন। আর ইমাম শাফেয়ী, লাইস ও আওযায়ী প্রমুখ ঈদের রাত্রিতে মসজিদ হইতে বাহির হইয়া যাওয়া জায়েয বলিয়াছেন।
ই’তিকাফ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ হইতে একথাও জানা যায় যে, ই’তিকাফের জন্য মসজিদ জরুরী শর্ত-ই’তিকাফ মসজিদেই করিতে হইবে। ===========
কুরআন মজীদ ই’তিকাফ’ শব্দটি ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে এই মসজিদের সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়াই উদ্ধৃত হইয়াছে। অতএব, ই’তিকাফ’ মসজিদে অনুষ্ঠিত হওয়াই যে আল্লাহর ইচ্ছা ও পছন্দ, তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। দ্বিতীয়ত নবী করীম (স) সাধারণত মসজিদেই ই’তিকাফ করিয়াছেন- অন্যত্র নহে। সর্বব্যাপারের ন্যায় এ ব্যাপারেও তিনিই মুসলমানদের একমাত্র ও পূর্ভাং্টগ অনুসরণীয় আদর্শ।
===========================
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) যখন মসজিদে ই’তিকাফ করিতেন, তখন তিনি মসজিদে থাকিয়াই আমার দিকে তাঁহার মাথাটি নিকটবর্তী করিয়া দিতেন। তখন আমি তাঁহার মাথা আঁড়াইয়া দিতাম এবং তিনি এই সময় নিতান্ত মানবীয় প্রয়োজন ছাড়া কখনও ঘরে আসিতেন না। -মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ
ব্যাখ্যা রাসূলে করীম (স) মসজিদেই ই’তিকাফ করিতেন। এই সময় প্রকৃতির ডাক ছাড়া তিনি কখনও ঘরে আসিতেন না। অবশ্য মসজিদে দাঁড়াইয়া থাকিয়া খিড়কির পথে মসজিদ সংলগ্ন ঘরে মাথা লাগাইয়া দিতেন। তখন হযরত আয়েশা (রা) তাহার মাথা আঁচড়াইয়া তিনে। মাথা আঁচড়ানোর প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট এবং অন্য কেহ-নিজের স্ত্রীও-তাহা করিয়া দিতে পারে। ইমাম আবু হানীফা (র) বলিয়াছেন, ই’তিকাফ থাকা অবস্থায় কেবলমাত্র পায়খানা পেশাব কিংবা অযু গোসল ছাড়া অন্য কাজের জন্য মসজিদের বাহিরে যাইব না। খাওয়া দাওয়াও মসজিদের ভিতরে সম্পন্ন করা বাঞ্ছনীয়।
লাইলাতুল কদর
=============================
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, তোমরা রমযান মাসের শেষ দশকের বেজোড় তারিখে কদর রাত্রির সন্ধান কর। – বুখারী
ব্যাখ্যা কদর রাত্রি খুঁজিয়া বাহির করার জন্য এই হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। খুঁজিবার কাজ সহজ করার জন্য নবী করীম (স)-এর এই সংক্ষীপ্ত বাণীতে দুইটি স্পষ্ট নিদর্শনের দিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছ্ একটি এই যে, এই রাত্রিটি রমযান মাসের শেষ দশকের কোন একটি হইবে। আর দ্বিতীয় এই যে, এই রাত্রিটি বেজোড় তারিখের হইব, জোড় তারিখের নয়। শেষ দশকের বেজোড় রাত্রি বলিতে ২১-২৩-২৫-২৭-২৯-এই তারিখ সমূহ বুঝায়। উদ্ধুত হাদীস অনুযায়ী ইহারই কোন এক দিনের রাত্রিটি কদর রাত্রি হইবে।
‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘কদর রাত্রি’ অথৃ কি? ইহা বলিতে কি বুঝায়? আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
========================
‘লাইলাতুল কদর’ অর্থ এমন রাত্রি বুঝায়, যাহাতে যাবতীয় ব্যাপারের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, উহার চূড়ান্ত রূপ দান করা হয় এবং একটি বৎসর কালের জন্য আল্লাহ তা’আলা এই রাত্রে সব বিধান ও মর্যাদার ফয়সালা করিয়া দেন।
এই রাত্রিটির নিজস্ব মাহাত্ন্যের জন্যই ইহার এই নামকরণ করা হইয়াছে। ইমাম যহরী বলিয়াছেনঃ
==================
ইহা (অতীব) উচ্চমান, মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের রাত্রি।
আবুবকর আল-আররাক বলিয়াছেনঃ
===================
এই রাত্রিটির নাম ’কদর রাত্রি’ রাখা হইয়াছে এইজন্য যে, যে লোক মূলত মান-মর্যাদা সম্পন্ন নয় সে যদি এই রাত্রিটি যথাযথভাবে গ্রহণ করে ও রাত্র জাগরণ করিয়া আল্লাহর ইবাদত করে, তাহা হইলে সেও সম্মান ও মর্যাদাবান হইয়া যাইবে।
আবার কেহ বলিয়াছেনঃ
=======================
এই নামকরণের কারণ হইল, এই রাত্রিতে মু’মিন ব্যক্তি যে নেক আমল করে, তাহা আল্লাহর নিকট গৃহীত হওয়ার কারণে সমধিক মূল্য ও মর্যাদার অধিকারী হইয়া থাকে।
আল্লাহর মর্যাদাবান কিতাব কুরআন মজীদ এই রাত্রিতে নাযিল হইয়াছে বলিয়াই ইহার নাম ‘কদর রাত্রি’ রাখা হইয়াছে এরূপ মতও অনেকে প্রকাশ করিয়াছেন। সহল ইবনে আবদুল্লাহর মতে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার মুমিন বান্দাদের প্রতি রহমত বর্ষণের পরিমাণ এই রাত্রিতে নির্ধারণ করেন বলিয়া এই নামকরণ হইয়াছে। আমার এই মতও ব্যক্ত করা হইয়াছে যে, এই রাত্রিতেই আল্লাহ তা’আলা নিজেই বলিয়াছেনঃ
====================
এই মহান রাত্রিতে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের চূড়ান্ত ফয়সালা করিয়া দেওয়া হয়।
ইমাম হাসান (রা) কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিলঃ
===============
কদর রাত্রি কি প্রত্যেক রমযান মাসেই হয়? — এই বিষয়ে আপনার মত কি?
জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ
====================
যে আল্লাহ ছাড়া ইলাহ্ কেহই নাই, তাঁহার নামে বলিতেছি, প্রত্যেক রমযান মাসেই এই রাত্র রাত্র আসে। ইহা এমন একটি রাত্র, যাহাতে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চূড়ান্ত মীমাংসা করা হয়। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার সৃষ্টিকূলের হওয়া-মরা, রিয্ক ও কাজ-সর্ববিষয়ে ফয়সালা করিয়া দেন এই রাত্রিতে।
বস্তুত সময় ও কাল-দিন ও রাত্রির ধারা অব্যহত, একটানা। ইহার মধ্যে কোন এক অংশের-মাত্র একটি রাত্রিকাল সময়ের-মর্যাদা ভিন্নতর হওয়ার ব্যাপারটি সাধারণত যেমন দুর্বোধ্য, তেমনই তাৎপর্যপূর্ণও। কিন্তু কদর রাত্রির অসাধারণ অনামান্য মান মর্যাদা ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের এত অধিক ও বলিষ্ঠ ঘোষণা রহিয়াছে, যাহা আয়ত্ত করা কটিন। এই ব্যাপারে দুইটি কথা বলা যাইতে পারেঃ হয় আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এই রাত্রিকালব্যাপী সময়টুকু একটা ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা রহিয়াছে। যে কারণে এই রাত্রে এতসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ দূর-অতীত কাল হইতে সম্পন্ন হইয়া আসিয়াছে, এখনও হইতেছে ও অনাদি অনন্তকাল পর্যন্ত তাহা হইতে থাকিবে। অথবা অনাদি অনন্তকাল হইতে এই সময়টুকুতে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ সুসম্পন্ন হইয়া আসিয়াছে বলিয়াই ইহার এই মর্যাদা লাভ সম্ভব হইয়াছে। কিংবা বলা যায়, এই রাত্রি সম্পর্কে এই দুইটি কথাই একসঙ্গে সত্য।
উপরোদ্ধৃত হাদীসটিতে হযরত নবী করীম (স) রাত্রিটি খুঁজিয়া বাহির করার জন্য চেষ্টা করিতে মসুলমানদের নির্দেশ দিয়াছেন। রাত্রিটি খুঁজিয়া বাহির করার প্রয়োজন এইজন্য দেখা দিয়াছে যে, কুরআন হাদীসে এই রাত্রির মর্যাদা ও সম্মানের কথা উচ্চকণ্ঠে ঘোষিত হইয়াছে বটে, কিন্তু সে রাত্রি যে কোনটি, অখণ্ড অব্যাহত কালস্রোতের মধ্য হইতে কোন অংশটি কদর রাত্রি’ নামে অভিহিত, তাহা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয় নাই। তাহা দিলে তো কোন ঝামেলাই থাকিত না। কিন্তু খুঁজিয়া বাহির করার কাজ সহজতর হওয়ার পক্ষে কতগুলি কথা উদ্ধৃত হইয়াছে। প্রথমত কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ ‘কদর রাত্রিতে কুরআন নাযিল হইয়াছে’ দ্বিতীয়ত বলা হইয়াছেঃ ‘কদর রাত্রি রমযান মাসে আসিয়া থাকে’। পরবর্তী জরুরী নির্দেশনা পাওয়া যায় হাদীসে। আলোচ্য হাদীসের প্রথম নির্দেশনা হইলঃ ইহা রমযান মাসের শেষ দশকে তালাশ করিতে হইবে। তাহার পর বলা হইয়াছে, শেষ দশকের যে কোন রাত্রিই কদর রাত্রি নয়। শেষ দশকের যে কোন বেজোড় তারিখের (২১-২৩-২৫-২৭-২৯ এর) যেকোন একটি রাত্রিই হইবে কদর রাত্রি। অতএব এই তারিখসমূহে এই রাত্রিটি খুঁজিতে হইবে। অবশ্য আরো স্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায় আর একটি হাদীসে, বুখারী ও নাসায়ী শরীফে উদ্ধৃত এবং হযরত উমর ও হযরত আবু যর (রা) বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসের শব্দ হইলঃ
============== শেষ সাত দিনের কোন একটিতে —-।
আর আবু বকরতা বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) বলিয়াছেন।
==========================
রমযান মাসের শেষ নয় দিন কিংবা পাঁচ দিন অথবা তিন দিন, অবশিষ্ট থাকিতে কিংবা সর্বশেষ রাত্রিতে কদর রাত্রি তালাশ কর।
ইমাম তিরমিযী, নাসারী ও হাকেম একবাক্যে বলিয়াছেন, হাদীসটি উত্তম সনদে বর্ণিত হইয়াছে এবং এই নির্দেশনা আরো স্পষ্ট ও মূল ব্যাপারে অতীব নিকটবর্তী। ইহার ফলে কদর রাত্রির খোঁজ পাওয়া কিছুমাত্র কটিন বা অসুবিধাজনক থাকিল না।
=======================
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হইতে তিনি নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ যে লোক রমযান মাসের রোযা থাকিবে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁহার নিকট সওয়াব পাইবার বাসনা মনে রাখিয়া, তাহার অতীতের গুনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইবে। আর যে লোক কদর রাত্রিতে জাগ্রত থাকিয়া আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করিবে তাহারও অতীত গুনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইবে। – বুখারী
ব্যাখ্যা কদর রাত্রির অধিকতর মর্যাদা ও সম্মানের কথা বলিবার পর এই রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগীর মর্যাদার কথা এই হাদীসে বলা হইয়াছে। রমযান মাসের রোযা রাখা সম্পর্কে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা তো স্পষ্ট ও বিশ্লেষণ সাপেক্ষ নয় কেননা রমযান মাসের রোযা মুসলমানদের প্রতি ফরজ করা হইয়াছে। আর ফরজ পালনের প্রতিফল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। তিরমিযী শরীফে এই বর্ণনাটির ভাষায় খানিকটা অতিরিক্ত উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহা হইলঃ
=======================
যে লোক রমযানের রোযা থাকিবে ও সারা রমযান ধরিয়া কিয়াম করিবে অর্থাৎ তারাবীহ নামায পড়িবে, তাহার অতীত গুনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইবে।
কদর রাত্রির ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কেও অনুরূপভাবে গুনাহ খাতা মাফ করিয়া দেওয়ার সওয়াবের কথা বলা হইয়াছে। এইসব ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হইল ‘ইমান’ ও ‘ইহতিসাব’। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি-তাঁহার আদেশের প্রতি ও তাঁহার সওয়াব দানের প্রতি এবং তাঁহার নিকট হইতে গুনাহ মাফী ও বিপুল সওয়াব পাওয়ার সন্দেহ মুক্ত সুদৃঢ় আশাবাসনা মনে ধরিয়া তাহা রাখা থাকিলেই এই সব আমলের সঠিক কল্যাণ লাভ করা সম্ভব। কাজেই নিছক আনুষ্ঠানিক ও লোক দেখানো নেক আমলের যে কোন-ই ফল পাওয়া যাইবে না, তাহা নিশ্চিত।
রমযানের শেষ দশকে রাসূলে করীম (স)-এর আমল
==========================
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ রমযান মাসের শেষ দশক শুরু হইলেই নবী করীম (স) তাঁহার কোমর শক্ত করিয়া বাধিঁয়া লইতেন এই সময়ের রাত্রিগুলিতে জাগ্রত থাকিতেন এবং তাঁহার ঘরের লোকদিগকে সজাগ করিতেন।
– বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ নাসায়ী, ইবনে মাজাহ
ব্যাখ্যা কুরআন মজীদে কদর রাত্রিতে যে মর্যাদার কথা বলা হইয়াছে এবং রাসূলে করীম (স) নিজে যে সব কথা বলিয়াছেন, তাহা তাঁহার নিজেকে বাদ দিয়া অন্য সব লোকের জন্য নয়, বরং সেই সব অনুসারে রাসূলে করীম (স) নিজেই আমল করিয়াছেন সর্বাধিক। তাঁহার সহধর্মিনী হযরত আয়েশার এই হাদীসটিই উহার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। হাদীস অনুযায়ী, রমযান মাসের শেষ দশক আসিলেই নবী করীম (স) চূড়ান্ত মাত্রার ইবাদতের জন্য কোমর বাঁধিতের অর্থাৎ পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করিতেন। আর কেবল তিনি একাই ইবাদত করিতেন তাহাই নয়, ঘরের অন্যান্য লোকদেরও নিজের সঙ্গে রাত্রিকালে জাগ্র থাকিয়া ইবাদত করার জন্য প্রস্তুত করিতেন।
প্রশ্ন হইতে পারে, নবী করীম (স) রমযানের শেষ দশকে তো ই’তিকাফে থাকিতেন, আর ই’তিকাফকালে মসজিদেই অতিবাহিত করিতেন। তাহা হইলে তিনি কদর রাত্রি ইবাদত করার জন্য তাঁহার ঘরের লোকদিগকে কি করিয়া সজাগ করিতেন। তিনি তো আর মসজিদ হইতে বাহির হইয়া ঘরে আসিতেন না। ইহার জওয়াবে বলা যায়, হয়ত তিনি জাগ্র করিতেন সেই লোকদিগকে যাহারা তাঁহার সঙ্গে ই’তিকাফে থাকিতেন। অথবা তাঁহার হুজরার যে খিড়কি মসজিদের দিকে খুলিত, মসজিদে দাঁড়াইয়া সেই খিড়কি হইতে ঘরের লোকদিগকে ডাকিয়া সগাজ করিতেন। অথবা তিনি ই’তিকাফে যাওয়ার আগেই ঘরের লোকদিগকে এই রাত্রিতে জাগ্রত থাকিয়া ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করার জন্য গুরুত্ব সহকার উপদেশ দিয়া যাইতেন।
তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত হাদীসের ভাষা এইরূপঃ
==========================
নবী করীম (স) রমযান মাসের শেষ দশকে তাঁহার ঘরের লোকজনকে ইবাদত ও নামাযের জন্য জাগ্রত করিয়া দিতেন।
হযরত আয়েশার অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
========================
‘রাসূলে করীম (স) রমযান মাসের শেষ দশকে ইবাদত বন্দেগীর কাজে এতই কষ্ট স্বীকার করিতেন, যাহা অন্যান্য সময়ে করিতেন না। -মুসলিম, তিরমিযী
আর যয়নব বিনতে সালমার বর্ণনায় এই কথাটি আরো বলিষ্ঠ ভাষায় ব্যক্ত হইয়াছেঃ
===========================
রমযানের শেষ দশকে তাঁহার ঘরের লোকদের মধ্যে রাত্র জাগরণ করিয়া ইবাগত করিতে পারে এমন কাহাকেও ঘুমাইতে দিতেন না বরং প্রত্যেকেই জাগ্র থাকিয়া ইবাদত করিবার জন্য প্রস্তুত করিতেন।
=========================
হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, যখন কদর রাত্রি আসে, তখন হযরত জিবরাইল (আ) ফেরেশতাদের বাহিনী সমন্বয়ে অবতীণর্ হন এবং দাঁড়াইয়া কিংবা বসিয়া আল্লাহর যিকর-এ মশগুল থাকা প্রত্যেক বান্দার জন্য রহমতের দোয়া করেন।
— বায়হাকীঃ শুআবুল ইমান
ব্যাখ্যা কদর রাত্রিতে জিবরাঈল (আ) ফেরেশতা পরিবেষ্ঠিত হইয়া পৃথিবীর লোকদের মধ্যে অবতরণ করেন ও আল্লাহর যিকর কাজে দাঁড়াইয়া বসিয়া ব্যস্ত থাকা লোকদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। এই হাদীস হইতে কদর রাত্রির মর্যাদা এবং এই রাত্রিতে ইবাদত বন্দেগী, কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায ও ইসলামী আলাপ আলোচনা ও জ্ঞান-চর্চার মর্যাদা স্পষ্টভাবে জানিতে পারা যায়। নবী করীম (স) নিজেও তাঁহার ঘরের লোকদিগকে এই রাত্রিটি যথাযথভাবে পাইবার জন্য রমযানের শেষ দশকের সব কয়টি রাত্রিই আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হইতেন ও মশগুল রাখিতেন। এই রাত্রিটির বরকত যেন কোন প্রকারে হারাইয়া না যায় ও ইহা হইতে বঞ্চিত থাকিতে না হয়, এই উদ্দেশ্যেই তাহার এই ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি, ইহা সকল মুসলমানদের জন্য অনুসরণীয়।