যাকাত
==============================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত নবী করীম (স) যখন হযরত মু’আয (রা) কে ইয়েমেন পাঠাইয়াছিলেন, তখন তাঁহাকে বলিয়াছিলেনঃ তুমি আহলি কিতাবদের এক জাতির নিকট পৌঁছিবে। তাঁহাদিগকে এই কথার সাক্ষ্য দিতে আহ্বান জানাও যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেহ মা’বুদ নাই এবং আমি আল্লাহ তা’আলার রাসূল। তাহারা যদি তোমার এই কথা মানিয়া লয়, তাহার পর তাহাদিগকে জানাইয়া দাও যে, আল্লাহ তা’আলা তাহাদের প্রতি রাত দিনের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করিয়াছেন। তোমার এই কথাও যদি স্বীকার করিয়া লয়, তবে তাহাদিগকে জানাও যে, আল্লাহ তা’আলা তাহাদের প্রতি তাহাদের ধনসম্পত্তির উপর যাকাত ফরয করিয়া দিয়াছেন। ইহা তাহাদের ধনী লোকদের নিকট হইতে গ্রহণ করা হইবে ও তাহাদেরই গরীব-ফকীর লোকদের মধ্যে বন্টন করা হইবে। তোমার এই কথাও তাহারা মানিয়া লইলে তাহাদের উত্তম মালই যেন তুমি যাকাত বাবত আদায় করিয়া না লও। আর তুমি মজলুমের দোয়াকে সব সময় ভয় করিয়া চলিবে। কেননা মজলুমের দোয়া ও আল্লাহর মাঝখানে কোন আবরণ অন্তরাল বর্তমান নাই। -বুখারী, মসুলিম, মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা রাসূলে করীম (স) দশম হিজরী সনে বিদায় হজ্জে গমনের পূর্বে হযরত মু;আয (রা) কে ইয়েমেন পাঠাইয়া ছিলেন (বুখারী, কিতাবুল মাগাযী)। অবশ্য কাহারো মতে নবম হিজরী সনে তাবুক যুদ্ধ হইতে প্রত্যাবর্তনের সময়ে হযরত মু’আযকে ইয়েমেন হইয়াছিল। আবার কেহ বলিয়াছেন যে, অষ্টম হিজরী সনে মক্কা বিজয়ের বৎসর তাঁহাকে পাঠানো হয়।
==========================
অতঃপর হযরত মু’আয ইয়েমেনেই অবস্থান করিতেছিলেন। তিনি কথা হইতে হযরত আবু বকরের ফিলাফতকালে ফিরিয়া আসেন। তাঁহাকে ইয়েমেনে শাসনকর্তা হিসাবে পাঠানো হইয়াছিল, কি বিচারপতি হিসাবে, এই সম্পর্কে ঐতিহাসিক মুহাদ্দিসদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। ইবনে আবদুল বা’র দ্বিতীয় মত পোষণ করেন, আর গাসানী প্রথম মত সমর্থন করেন।
তখন ইয়েমেনে প্রধানত আহলি কিতাব, ইয়াহুদী ও কৃষ্টানরাই বসাবস করিত। তাহাদের উপর কেবল আইনের শাসন কায়েম করাই নয়, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াত তাহাদের সম্মুখে পেশ করাও হযরত মু’আযের কর্তব্য ছিল। এই জন্যই ইয়েমেন গমনের পূর্বে নবী করীম (স) তাঁহাকে বিশেষ নসীহতের মাধ্যমে দাওয়াতের বিষয় ও পদ্ধতি শিক্ষাদানের প্রয়োজন অনুভব করিয়াছিলেন। বিশেষত এই আহলি কিতাবগণ ছিল শিক্ষিত; তাহাদের সাথে জহেল-মুর্খ লোকাদের ন্যায় কথা বলা সঙ্গত নয় বিধায় ইসলামী দাওয়াতের ক্রমিক নীতিও তাঁহাকে শিক্ষা দেওয়া হয়।
হযরত মু’আযকে আহলি কিতাবদের সম্মুখে সর্বপ্রথম আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনিবার দাওয়াত পেশ করিতে বলা হয়। কেননা ইসলামী ঈমানের মূল ভিত্তিই হইতেছে এই দুইটি। এই দুইটি বিষয়ে ঈমান সর্বপ্রথম আনা না হইলে ইসলামের অপর কোন কাজই শুদ্ধ হইতে পারে না। আর আহলি কিতাবদের মধ্যে কিছু লোক তাওহীদ বিশ্বাসী থাকিলেও প্রথমত তাহাদের ঈমান সুস্পষ্ট ও দৃঢ়ভিত্তিক ছিল না এবং দ্বিতীয়ত আল্লাহকে বিশ্বাস করিলেও হযরত মুহাম্মাদ (স)-কে আল্লাহর রাসূলরূপে মানিয়া না লইলে সে তাওহীদ বিশ্বাসের কোনই মূল্য হয় না। এই কারণে আল্লাহর ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনিবার দাওয়াত সর্বপ্রথম দেওয়ার কথা শিক্ষা দেওয়া হয়। বস্তুত এয কোন সময়ে, যে কোন যুগে যে কোন সমাজের লোকদের সম্মুখে ইসলামের ইহাই প্রথম দাওয়াত। তাহার পরই তদনুযায়ী আমল করার-শরীয়াতের হুকুম আহকাম মানিয়া লওয়া ও পালনে করার নির্দেশ দেওয়া যাইতে পারে, তাহার পূর্বে নহে। এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, ঈমানের পরই যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া, তেমনি ঈমানদার ধনী লোকদের উপর নিয়মিত যাকাত আদায় করা ফরয হয় এবং ইসলামী গভর্ণমেন্ট, হয় নিজস্ব ক্ষমতা সরাসরিভাবে কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধির মাধ্যমে এই যাকাত আদায় করিবার অধিকারী হয়। এমতাবস্থায় কোন মুসলিম ধনী ব্যক্তি যদি যাকাত আদায় না করে কিংবা যাকাত আদায় করিতে রাযী না হয়, তবে ইসলামী গভর্ণমেন্ট রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করিয়া ইহা আদায় করিতে পারিবে।
এখানে মূল হাদীসে ‘সাদকা’ ======== শব্দ উল্লেখিত হইয়াছে। এখান ‘সাদকা’ অর্থ যাকাত, যাহা আদায় করা ফরয, সাধারণ দান-খয়রাত নয়। কেননা কুরআন মজীদের ‘সাদকা’ এই অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছ। আর দ্বিতীয়ত সাধারণ দান খয়রাত কখনো ফরয নহে এবং তাহার জোর প্রয়োগে আদায় করিবার নিয়ম নাই। অথচ এখানে বলা হইয়াছে, আল্লাহ তা’আলা তাহাদের প্রতি ‘সাদকা’ ফরয করিয়া দিয়াছেন।
কুরআন মজীদে ‘সাদকা’ অর্থাৎ যাকাত ব্যায়ের আটটি খাত ঘোষণা করা হইয়াছে, কিন্তু আলোচ্য হাদীসে তন্মধ্যে মাত্র একটি খাতেরই উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহা হইতে ইমাম মালিক এই মত গ্রহণ করিয়াছেন যে, আটটি খাতের যে কোন একটি খাতে যাকাত ব্যয় করিলে তাহা অবশ্যই জায়েয ও যথেষ্ট হইবে। তবে ইবনে দাকীকুল ঈদ এইখানে একটি মাত্র খাতের উল্লেখ করিবার কারণ দর্শাইয়া বলিয়াছেন যে, প্রধানত ও সাধারণত ফকীর-গরীব লোকদিগকেই যাকাত দেওয়া হয় বলিয়া এখানে তাহারই উল্লেখ করা হইয়াছে অথবা ধনীদের মুকাবিলায় যাকাত পাওয়ার যোগ্য ফকীরদের উল্লেখ করা হইয়াছে। নতুবা ইহার অর্থ কখনো এই নয় যে, কেবল একটি খাতে যাকাত ব্যয় করিলেই উহা যথেষ্ট হইবে।
ইমাম খাত্তাবী, এই হাদীসের ভিত্তিতেই বলিয়াছেন যে, ঋণগ্রস্ত লোকদের উপর যাকাত ফরয নহে। কেননা এই ঋণ পরিমাণ সম্পদ বাদ দিলে যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণ সম্পদ তাহার নিকট অবশিষ্ট থাকে না। ফলে সে ধনী বলিয়া গণ্য হইতে পারে না। তবে ঋণ আদায় করা বা ঋণ পরিমাণ সম্পদ বাদ দেওয়ার পর যে পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট্য থাকিবে, তাহা যদি যাকাত ফরয হওয়া পরিমাণ =========== হয়, তবে উহার উপর অবশ্যই যাকাত ফরয এবং তাহা অবশ্যই আদায় করিতে হইবে।
হাদীসে উল্লেখিত ======== (কারায়েম) অর্থ, ‘উত্তম ও উৎকৃষ্ঠ মাল’। এই হাদীসের ভিত্তিতে প্রমাণিত হইয়াছে যে, যাকাত আদায়কারী কর্মচারীর পক্ষে যাকাত দাতার উত্তম ও উৎকৃষ্ট মালই বাছাই করিয়া লওয়া জায়েয নহে। কেননা যাকাত হইতেছে গরীবদের সাহায্য ব্যবস্থা। কাজেই মূল সম্পদের মালিকের সনেতাষ ব্যতীত উহা গ্রহণ করার কখনো জায়েয হইতে পারে না। আর কোন সম্পদ মালিকই নিজের সম্পদ হইতে বাছিয়া বাছিয়া উত্তম মালসমূহ দিয়া দিতে সাধারণত রাযী হইতে পারে না।
হযরত মু’আযকে মজলুমের বদদোয়া হইতে দূরে থাকিতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। ইহার অর্থ এই যে, ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসাবে তিনি যেন জনগণের উপর বিন্দুমাত্র জুলুম না করেন। কেননা কাহারো উপর জুলূম করা হইলে তাহার নিপীড়িত অন্তর যে আর্তচিৎকার করিয়া উঠিবে, তাহা আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছিয়া যাইবে। রাসূলে করীমের এই নির্দেশ একটি সাধারণ মুলনীতি নির্ধারণ পর্যায়ের। সকল প্রকার ক্ষমতাশীল ব্যক্তির প্রতিই ইহা প্রযোজ্য এবং মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সব জুলুমকেই ইহাতে সমানভাবে গণ্য করা হইয়াছে।
নবী করীম (স) অপর একটি ঘোষণায় বলিয়াছেনঃ
===========================
মজলুম কাফির হইলেও তাহার ফরিয়াদ প্রত্যাখ্যাত হয় না।
অপর এক হাদীসের ভাষা হইলঃ
==========================
মজলুম গুনাহগার ব্যক্তি হইলেও তাহার বদদোয়া কবুল হয়। তাহার গুনাহের জন্য সে কাফিরের হইলেও বদদোয়া প্রত্যাখ্যাত হয় না।
অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা জুলুম সহ্য করেন না। তাহা মুমিনের উপর করা হউক, কি কাফিরের উপর।
আর উত্তম মাল গ্রহণ না করিতে বলার পরই জুলুম করিতে নিষেধ করায় ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, বাছিয়া বাছিয়া কেবল উত্তম মাল যাকাত বাবদ-যাকাত দাতার মর্যীর বিপরীত-আদায় করিয়া লওয়া জুলুমেরই শামিল। আর যাকাত বাবদ যদি উত্তম মাল বাছিয়া লওয়া জুলুম হয় তবে কৃষিজমির উপর সাধ্যতীত পরিমাণে কর ধার্য করাও কি জুলুম নয়?
এই হাদিসটি সম্পর্কে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। তাহা এই যে, ইহাতে রোযা ও হজ্জ্বের উল্লেখ করা হয় নাই অথচ হযরত মু’আযকে ইয়েমেনে প্রেরণের পূর্বেই ইসলামের এই দুইটি কাজ ফরয করা হইয়াছিল।
ইহার জওয়াবে ইবনু সালাহ বলিয়াছেন, রাসূলে করীমের মূল ফরমানে এই দুটি বিষয়েরও উল্লেখ ছিল; কিন্তু হাদীস বর্ণনাকারী এই দুইটি বাদ দিয়াই যাকাতের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যে হাদীস সংক্ষেপ করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। আর কিরমানী বলিয়াছেনঃ মূল হাদীসে রোযা ও হজ্জ্বের উল্লেখ না থাকিলেও কোন ক্ষতি নাই। কেননা শরীয়াতে নামায ও ডাকাতের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে বিধায় এখানে এই দুইটিরই উল্লেখ হইয়াছে। আর এই দুইটির উল্লেখ এখানে না থাকলেও রোযা এবং হজ্জ্বও উহার অন্তর্ভুক্ত মনে করিতে হইবে। কুরআন মজীদেরও বিভিন্ন স্থানে নামায ও যাকাতের এক সঙ্গেই উল্লেখ হইয়াছে, কিন্তু সেখানে রোযা ও হজ্জ্বের উল্লেখ হয় নাই, যদিও এই দুইটিও ইসলামের রোকনের মধ্যে শামিল। যেমন কুরআন মজীদের নিস্লোদ্ধৃত আয়াতে বলা হইয়াছেঃ
=============================
তাহারা যদি তাওবা করে, নামায কায়েম করে, ও যাকাত দান করে, তবেই তাহরা মুসলিমদের দ্বীনী ভাই বলিয়া গণ্য হইবে।
আয়াতটিতে রোযা ও হজ্জের উল্লেখ নাই অথচ এই আয়াতটি নাযিল হওয়ার পূর্বেই রোযা ও হজ্জ্ব ফরয করা হইয়াছে। তাহা সত্ত্বেও শুধু নামায কায়েম করিলে ও যাকাত আদায় করিলে একজন লোক মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত হইল বলিয়া আয়াতটিতে ঘোষণা করা হইয়াছে।
========================
তায়্যিবী ও অন্যান্য হাদীসবিশারদগণ আলোচ্য হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন, ‘উহা তাহাদের ধীনের নিকট হইতে গ্রহণ করা হইবে।’ বাক্যাংশ প্রমাণ করে যে, না-বালেগদের উপরও যাকাত ফরয। কেননা এর কথা সাধারণভাবে সর্বশ্রেণীর ধনীদেরই শামিল করে। শাফেয়ী মাযহাবের মতে বালকদের উপর নয়, তাহাদের ধন মাল থাকিলে তাহার উপর যাকাত ফরয হইবে। পাগল ও বুদ্ধিহীন লোকদের সম্পর্কেও এই কথা। দলীল হিসাবে একটি হাদীস উদ্ধৃত করা হইয়াছে। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
==========================
তোমরা জানিয়া রাখ, যে লোক কোন ইয়াতিমের অভিভাবক হইয়া বসে, সে যেন সেই ইয়াতীমের ধন-মাল মানুফাজনক কাজে নিয়োগ করে এবং উহা যেন যাকাত দিয়া শেষ হইয়া যাওয়ার জন্য ফালাইয়া না রাখে।
বস্তুত ইয়াতীমের মাল-সম্পদ হইতে যে যাকাত দিতে হয়-তাহা কোন লাভজনক কাজে নিয়োজিত করা হউক বা না হউক, যাকাত দিতে দিতে মূল সম্পদ নিঃশেষ হউক না বা হউক এই কথা হাদীস হইতে স্পষ্ট হইয়া উঠে। কিন্তু হানাফী মাযহাবে এই কথা স্বীকৃত হয় নাই। তাঁহারা বলিয়াছেন, যাকাত ফরয হওয়ার জন্য ধন সম্পদের মালিকের সুস্থ জ্ঞান-বৃদ্ধি সম্পন্ন ও পূর্ণ বয়স্ক হওয়া অনিবার্য শর্ত। অতএব নাবালেগ ও অসুস্থ মস্তিষ্ক ব্যক্তির ধান-মালে যাকাত ফরয নয়। দলীল হিসাবে তাঁহারা হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসের উল্লেখ করিয়াছেন। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
তিন জনের উপর শরীয়াতের কোন দায়িত্ব অর্পিত হয় নাই। (১) নিদ্রিত ব্যক্তি, যতক্ষণ না সে জাগ্রত হইবে; (২) অপূর্ণ বয়স্ক বালক, যতক্ষণ না পূর্ণ বয়স্ক হইবে এবং (৩) পাগল যতক্ষণ না সে সুস্থমস্তিষ্ক হইবে।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ
========================
ইয়াতীমের মালে কোন যাকাত নাই।
তাঁহারা আরো বলেন যে, তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত উপরিউক্ত হাদীসটি-যাকাতে নাবালেগ ও পাগলের উপর যাকাত ফরয হয় বলিয়া মনে করা হইয়াছে-সনদের দিক দিয়া যয়ীক। উহার সনদে আল-মুসান্ন ইবনে সাবাহ ্রকেজন বর্ণনাকারী। সে ইমাম আহমদ, ইমাম নাসায়ী ও ইমাম তিরমিযী-তিনজন মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে বর্ণনা গ্রহণে অযোগ্য ব্যক্তি। মান্দেল বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর বাণী হইলঃ
=========================
ইয়াতীমের ধন-মাল সংরক্ষণ কর, যাকাত যেন তাহা নিঃশেষ করিয়া না ফেলে।
কিন্তু এই মান্দেল ইবনে আলীকেও ইমাম আহমদ ও ইবনে হাব্বান ‘যয়ীফ’ ও ‘হাদীস গ্রহণ অযোগ্য’ বলিয়াছেন। সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব সূত্রে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
=========================
ইয়াতীমের ধন-মালের ব্যাপারে সদ্দিচ্ছাভাজন হও। যাকাত যেন উহা খাইয়া নিঃশেষ করিয়া না দেয়।
কিন্তু সাঈদ ইবনুল মুসায়্যির সরাসরি হযরত উমর হইতে হাদীস শুনিতে পান নাই, তাহা সর্বজনস্বীকৃত। এই কারণে ইহা গ্রহণ অযোগ্য।
ইহা ছাড়া এই শেষোক্ত হাদীসদ্বয়ের উদ্দশ্য উহার উপরও যাকাত ফরয হওয়ার পক্ষে হইতের পারে। কেননা এই কথা বলিয়া ইয়াতীম নাবালেগের ধন-মাল মুনাফামূলক কাজে নিয়োগ করি ত বলা হইয়াছে বলিয়াও মনে করা যায়। এতদসত্ত্বেও ইয়াতীমের মালে যাকাত ফরয হওয়া পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য দেখা যায়। বহু সাহাবী মালে যাকাত ফরয বলিয়া বিশ্বাস করেন। হযরত উমর. আলী, আয়েশা, ইবনে উমর প্রমুখ এই পর্যায়ে বলিয়াছেন। ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ও ইসহাকও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইহার বিপরীত ইয়াতীমের মাল-সম্পদে যাকাত ফরয না হওয়ার পক্ষে মত দিয়াছেন সুফিয়ান সওরী, আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক, ইমাম আবু হানিফা ও তাঁহার সঙ্গিগণ, আবু ওয়ায়েল, সাঈদ ইবনে যুবায়র, নখয়ী, শাবী হাসান বসরী প্রমুখ ফিকাহবিদ। ইহারা তাঁহাদের এই মতে সাহাবীদের ‘ইজমা’ হইয়াছে বলিয়াও দাবি করিয়াছেন। সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলিয়াছেনঃ
==========================
যাহার উপর নামায রোযা ফরয, তাহাদের ছাড়া অন্যদের উপর যাকাত ফরয নয়।
হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত আলী ও জাফর ইবনে মুহাম্মাদও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও মূল কথা থাকিয়া যায়, তাহা হইল, নামায রোযা ফরয হয় ব্যক্তির উপর, আর যাকাত ফরয হয় ধন-মালের উপর। অতএব বক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ বয়ষ্ক ও সুস্থ মন-মগজ না হইবে, ততক্ষণ তাহার উপর নামায রোযা ফরয না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি ধন-মাল যাকাত ফরয হওয়া পরিমাণ হয়-উহার মালিক নাবালেগ হইলেও-সেই ধন-মালের উপর যাকাত ফরয হওয়ার পথে কোন বাধা থাকিতে পারে না। বিশেষত যাকাত একান্তভাবে গরীব লোকদের বা নির্দিষ্ট খাতসমূহের অনস্বীকার্য হক। মালিক নাবালেগ হইলেও উহা হইতে যাকাত আদায় করাই বাঞ্ছনীয় এবং যাকাত ফরয করার উদ্দেশ্যের সহিত পুরাপুরি সামঞ্জস্যশীল।
‘তাহাদের ধনীদের নিকট হইতে গ্রহণ করা হইতে’ বাক্য হইতে এই কথা প্রমাণিত হয় যে, যাকাত ব্যক্তিগতভাবে গরীবদের মধ্যে বন্টন করিবার মাধ্যমে আদায় করা যাইবে না, সরকারী ব্যবস্থাধীন আদায় করাই শরীয়াতের আসল বিধান। এই জন্য রাষ্ট্রের তরফ হইতে বিশেষ বিভাগ স্থাপন এবং আদায়, উসুল ও বিলি-বন্টনের দায়িত্ব পালনের জন্য কর্মচারী নিয়োগ করা বিধেয়। রাসূলে করীমের ও পরবর্তী ইসলামী যুগে যাকাত সরকারী ব্যবস্থাধীনেই আদায় ও বন্টন করা হইত। সরকারী কর্মচারীদের হাতে তাহা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হইত এবং যাকাতদাতারা তাহাই করিত। সা’দ ইবনে আবু আব্বাস, উমর, আবু সাইদ খুদরী, আবু হুরায়রা, আয়েশা প্রমুখ সাহাবী এবং হাসান বসরী, শা’বী মুহাম্মাদ ইবনে আলী, সাঈদ ইবনে যুবায়র, আবু রুজাইন আওযায়ী ও ইমাম শাফেয়ী প্রমুখ ফিকাহ বিশারদ একবাক্যে বলিয়াছেনঃ
========================
যাকাত সরকার নিয়োজিত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নিকট সোপর্দ করা যাইবে (দিতে হইবে)।
ফিকাহবিদ আতা বলিয়াছেনঃ
==========================
যদি তাহারা (সরকারী দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা) উহা যথাযথভাবে ব্যয় ও বন্টন করে, তবে তাহাদের হাতে যাকাত দেওয়া যাইবে।
আর ফিকাহবিদ আয়ুম বলিয়াছেনঃ
=======================
সরকারী দায়িত্বশীলরা যদি যাকাত যথাযথভাবে ব্যয় ও বন্টন না করে, তাহা হইলে যাকাত তাহাদের হাতে দেওয়া যাইবে না। =================
=========================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইতেছে, তিনি বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স) যখন ইন্তেকাল করিলেন ও তাঁহার পর হযরত আবু বকর (রা) খলীফা (নির্বাচিত) হইলেন, আর আরব দেশের কিছু লোক ’কাফির’ হইয়া গেল, তখন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) হযরত আবু কবর (রা)-কে বলিলেনঃ আপনি এই লোকদের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করিতে পারেন, অথচ নবী করীম (স) তো বলিয়াছেনঃ ‘লোকেরা যতক্ষণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ (এক আল্লাহ ছাড়া আর কেহ মা’বুদ নাই) মানিয়া না লইবে, ততক্ষণ তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমি আদিষ্ট হইয়াছি। যদি কেহ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ স্বীকার করে, তবে তাহার ধন-সম্পদ ও জানপ্রাণ আমার নিকট পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করিবে। অবশ্য ইহার উপর ইসলামের হক কখনো ধার্য হইলে অন্য কথা। আর উহার হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব আল্লাহর উপর ন্যাস্ত। তখন হযরত আবু বকর (রা) বলিলেনঃ আল্লাহর শপথ, যে লোকই নামায ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করিবে, তাহারই বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করিব; কেননা যাকাত হইতেছে মালের হক। আল্লাহর শপথ, তাহারা যদি রাসূলের সময় যাকাত বাবদ দিত-এমন এক গাছি রশিও দেওয়া বন্ধ করে, তবে অবশ্যই আমি উহা দেওয়া বন্ধ করার কারণে তাহাদের বিরুদ্ধে লড়াই করিব।
তখন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলিলেনঃ আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি, ইহা আর কিছু নয়, আমার মনে হইল, আল্লাহ যেন আবু বকরের অন্তর যুদ্ধের জন্য উম্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন এবং বুঝিয়া পারিলাম যে, ইহাই ঠিক (তিনি নির্ভুল সিদ্ধান্তই করিয়াছেন)।
– বুখারী মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা এই হাদীসটি দ্বীন ইসলামের এক ভিত্তি বিশেষ। ইহাতে কয়েক প্রকারের জরুরী উলম সন্নিবেশিত হইয়াছে। ফিকাহর কয়েকটি জরুরী মাসালাও ইহা হইতে প্রকাশিত হইয়াছে।
প্রথম হাদীসটির ঐতিহাসিক পটভূমিক বিশ্লেষণীয়। রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর আরবের কয়েকটি গোত্র মুর্তাদ হইয়া যায়। ইহারা প্রধানত দুই ধরনের লোক ছিল। এক ধরনের লোক, যাহারা মূলত দ্বীন-ইসলাম ত্যাগ করিয়া পুরাপুরি কাফির হইয়া গিয়াছিল এবং সম্পূর্ণ কাফিরী সমাজের সহিত মিলিত হইয়াছিল। আলোচন্য হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা (রা) আরবের কিছু লোক কাফির হইয়া গেল বলিয়া ইহাদের কথাই বুঝাইয়াছেন। আর মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হাদিসের ভাষা হইলঃ ========== কিছু লোক মুর্তাদ হইয়া গেল। এই লোকগুলি আবার দুই দলে বিভক্ত ছিল। একটি দল মুসায়লামাতুল কাযযাব ও আসওয়াদুল আনাসীর মিথ্যা নবুয়্্যত দাবিকে সত্য বলিয়া মানিয়া লইয়াছিল। ইহারা সকলেই হযরত মুহাম্মাদের নবুয়্যত অমান্য করিয়াছিল এবং তাঁহার বিরোধী ব্যক্তিদের নবুয়্যত দাবি সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া লইয়াছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) ইহাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছিলেন। এই যুদ্ধের ফলে মুসায়লামা ও আসওয়াদ উভয়ই নিহত হয় এবং তাহাদের দলবল নির্মূল হইয়া যায়।
আর দ্বিতীয় দলে ছিল সেইসব লোক যাহারা দ্বীন-ইসলামের আইন বিধান পালন করিতে অস্বীকার করে। তাহারা নামায ও যাকাত ইত্যাদি শরীয়াতের যাবতীয় হুকুম-আহকাম অমান্য করে ও জাহিলিয়াতের যুগের মতই সম্পূর্ণ বে-দ্বীন হইয়া জীবনযাপন করিতে শুরু কর্ ইহার দরুন তখনকার সময়ে পৃথিবীর বুকে মক্কার মসজিদ, মদীনার মসজিদ ও বাহরাইনের জাওয়াসাই’ নামক গ্রামে অবস্থিত ‘মসজিদে আবদুল কাইস’-এই তিনটিই একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করার জন্য অবশিষ্ট থাকে।
দ্বিতীয় ধরনের লোক ছিল তাহারা, যাহারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করিত। তাহারা নামাযকে ফরয মানিত। কিন্তু যাকাত আদায় করা ও তাহা বায়তুলমালে জমা করানো ফরয মানিত না। আসলেই হারাই ছিল বিদ্রোহী দল। কিন্তু সেকালে তাহাদিগকে ‘বিদ্রোহী’ নামে আখ্যায়িত করা হয় নাই। কেননা তখন ইহারা সাধারণ মুর্তাদের মধ্যেই গণ্য হইত। ইহাদের মধ্যে এমন লোকও অবশ্য ছিল, যাহারা যাকাত দিতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু তাহাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা এই জন্য তাহাদিগকে বাধা দান করিতেছিল।
যে বিদ্রোহী লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকার করিত, তাহাদের মনে একটা ভুল ধারনার সৃষ্টি হইয়াছিল। তাহারা কুরআনের একটি আয়াতকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করিয়াছিলঃ আয়াতটি এইঃ
=============================
হে নবী! তাহাদের ধন-মাল হইতে যাকাত গ্রহণ কর। উহার সাহায্যে তুমি তাহাদিগকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ কর।
তাহারা ধরিয়া লইয়াছিল যে, এই আয়াত অনুযায়ী যাকাত আদায় করার অধিকার কেবলমাত্র রাসূল করীম (স)-এর এবং তাঁহার ইন্তেকালের পর এই অধিকার ও ক্ষমতা অন্য কাহারো থাকিতে পারে না। অতএব এখন আর যাকাত দিতে হইবে না। কিন্তু আসলে ইহা ছিল তাহাদের একটা মারাত্মক ভুল। কেননা কুরআন মজীদে ডাকাত আদায় করার এই নির্দেশ প্রত্যক্ষভাবে রাসূলে করীম (স)-কে সম্বোধন করা হইলেও ইহা ছিল এক সাধারণ হুকম। এই নির্দেশ পালনের দায়িত্ব কেবলমাত্র রাসূলে করীম (স) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁহার অন্তধানের পর যাকাত আদায়ের দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি পাওয়ারও কোন যৌক্তিকতা থাকিতে পারে না। রাসূলে করীম (স)-এর উপস্থাপিত ছিল না। এমন কি হযরত উমর ফারুকের ন্যায় বিচক্ষণ ও ধীশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিও যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানানোর সৃদূর প্রসারী কুফল অনুধাবন করিতে প্রথমে সক্ষম হন নাই। এইজন্যই হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) যথন এই সকল মুর্তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করিলেন, তখন হযরত উমর ফারুক (রা) আপত্তি উত্থাপন করিলেন। বলিলেনঃ ‘আপনি এই লোকদের’ বিরুদ্ধে কি করিয়া যুদ্ধ করিতে পারেন? অথচ রাসূলে করমি (স) তো ‘যে সব লোক লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে না’ কেবল তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নির্দেশিত ছিলেন এবং যে তাহা বলে তাহার জান-মাল পূর্ণ নিরাপত্তা পাইয়া যায় ===== অবশ্য এই সময়ও যদি শরীয়াতের কোন অধিকার উহার উপর প্রতিষ্ঠিত হয় তাহা হইলে অন্য কথা। মুসনাদে আহমদে এই কথাটির ভাষা এইরূপ উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
======================
আপনি এই লোকদের বিরুদ্ধে কি করিয়া যুদ্ধ করিতে পারেন, অথচ তাহারা নামায পড়ে?
এই ভাষা অনুযায়ী হযরত উমর (রা)-এর ধারণা ছিল যে, যেসব ঈমানদার লোক নামায পড়ে তাহাদের জান-মাল সম্পূর্ণ নিরাপত্তা পাইবার অধিকারী।
উপরে উদ্ধৃত মূল হাদীসে হযরত উমর যে হাদীসটির উপর ভিত্তি করিয়া হযরত আবু বকরের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাইয়াছিলেন, তাহা অসম্পূর্ণ। সম্ভবত এই অসম্পূর্ণ হাদীসই তাঁহার জানা বা স্মরণে ছিল। আর আপত্তি জানানোর মূল কারণও ইহাই। সম্পূর্ণ হাদীসটি তাঁহার সম্মুখে থাকিলে তিনি এই আপত্তি জানাইতে পারিতেন না। উহার প্রয়োজনও মনে করিতেন না। কেননা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের বর্ণনানুযায়ী এই হাদীসটির সম্পূর্ণ রূপ এইঃ রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
=========================
আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হইয়াছি যতক্ষণ না তাহারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এই সাক্ষ্য দিবে, নামায কায়েম করিবে ও যাকাত দিবে।
এই বর্ণনাটির অপর একটি রূপ (version) হইলঃ
==========================
যতক্ষণ না ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সাক্ষ্য দিবে ও আমি যে দ্বীন লইয়া আসিয়াছি তাহার প্রতি ঈমান আনিবে।
এই দুই বর্ণনা-ভাষায়ই পূর্ণ দ্বীন ও পূর্ণ শরীয়াত শামিল রহিয়াছে এবং ইহাতে ঈমানের সঙ্গে নামায ও যাকাত উভয়ই অবিচ্ছিন্ন হইয়া আছে। ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, যে ব্যক্তি নবী করীম (স)-এর প্রচারিত পূর্ণ দ্বীন বা দ্বীনের কোন অংশ অমান্য বা অস্বীকার করিবে সে-ই দ্বীন অমান্যকারী সাব্যস্ত হইবে এবং জান-মালের নিরাপত্তা লাভের অধিকার হইতেও বঞ্চিত হইবে। এই কারণে হযরত আবু বকর (রা) বলিয়াছিলেনঃ
=========================
যে লোকই যাকাত দেওয়ার দায়িত্ব হইতে মুর্তাদ-অস্বীকৃত হইবে, আল্লাহর শপথ, আমি তাহার বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্দ করিব।
বুখারী, মুসলিম ও মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে হযরত আবু বকরের জওয়াবের ভাষা ছিল এইঃ
========================
যে লোক নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করিবে, আল্লাহর শপথ, আমি তাহার বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করিব।
ইহার কারণস্বরূপ তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ ‘যাকাত ধন-মালের ইবাদত হইল যাকাত। এই হিসাবে হযরত উমরের নিজের দলীয় স্বরূপ পেশ করা হাদীসটির শেষাংশেই এই যাকাত আদায়ের বাধ্যবাধকতা শামিল রহিয়াছে। কেননা ======== বাক্যাংশের অর্থ হইলঃ
==========================
ইসলামের বিধান অনুযায়ী নরহত্যা, নামায তরক করা ও যাকাত না দেওয়ার অপরাধে শাস্তি বিধান হিসাবে যদি জান ও মালের নিরাপত্তা বিনষ্ট হয়, তাহা হইলে অন্য কথা।
ইজার জওয়াবে হযরত আবু বকর সিদ্দক (রা) যাহা বলিয়াছেন, তাহার সারমর্ম হইল, রাসূলে করীম (স)-এর ঘোষণানুযায়ী জনগণের জান-মালের প্রতি দেওয়া নিরাপত্তা দুইটি শর্ত, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আর দ্বিতীয় শর্ত, নামায কায়েম করা ও যাকাত দেওয়া। এমতাবস্থায় কেহ যদি একটি শর্ত পালন করে, আর অন্যটি পালন করিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহা হইলে সে এই নিরাপত্তা লাভ হইতে অবশ্যই বঞ্চিত হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা অবৈধ হইবে না। বস্তুত হযরত আবু কবরের এই বিশ্লেষণ শ্রবণের পরই হযরত উমরের বোধোদয় হয় এবং তিনি স্পষ্টভাবে বুঝিতে পারেন যে, তাঁহার আপত্তি ভিত্তিহীন ও হযরত আবু বকরের নীতিই যুক্তিসংগত ও দলীল ভিত্তিক। এই কারণে শেষ পর্যন্ত হযরত উমর (রা) বলিতে বাধ্য হইলেন- স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলিয়া উছিলেনঃ
================
আমি উপলব্ধি করিতে পারিলাম যে, হযরত আবু বকরের অনুসৃত নীতিই যথার্থ ও নির্ভুল।
আলোচ্য হাদীসের ভাষা হইতে এই কথাও জানা যায় যে, রাসূলে করীম (স)-এর বর্ণিত কথায় নামায ও যাকাতও যে শামিল রহিয়াছে, তাহা যেমন হযরত উমরের জানা বা স্মরণে ছিল না কিংবা সেদিকে তিনি লক্ষ্য দেন নাই, তেমনি হযরত আবু বকরেরও তাহা অগোচরে ছিল। নতুবা তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ইহা পেশ করিয়া হযরত উমরকে লা-জওয়াব করিয়া দিতে পারিতেন অথবা তিনি এই আয়াতটিও পেশ করিতে পারিতেনঃ
=======================
নামায কায়েম করিলে ও যাকাত আদায় করিলেই দ্বীনী ভাই-তথা মুসলমান গণ্য হইতে পারে।
যে ইহার একটিও অস্বীকার করিবে সে মুসলমান ও দ্বীনী ভাইরূপে গণ্য হইবে না। সে মুর্তাদ হইয়া গিয়াছে বুঝিতে হইবে। অতএব এই আয়াতের ভিত্তিও হযরত আবু বকরের সিদ্ধান্ত নির্ভুল ছিল। কিন্তু হযরত আবু বকর (রা) এই সব দলীয় পেশ না করিয়া তিনি যুক্তির আশ্রয় নিলেন ও হযরত উমরেরই পেশ করা হাদীসের শেষ শব্দ ==========-র ব্যাখ্যা করিতে বাধ্য হইলেন। ইহা হইতে একটা মূলনীতি নিঃসৃত হয়। তাহা হইলঃ
কোন কোন সাধারণ জ্ঞানশালী ব্যক্তির নিকট এমন সব তত্ত্ব পাওয়া যাইতে পারে, যাহা বিশিষ্ট ও অভিজ্ঞ লোকদের নিকটও পাওয়া যায় না।
এই ব্যাপারের আরো একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। হযরত উমর (রা) হয়ত মনে করিয়াছেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) যাকাত দিতে অস্বীকারকারী দিগকেও কাফির মনে করিয়াই বুঝি তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছেন, কেবলমাত্র যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানাইবার কারণে নয়। এই কারণেই তিনি রাসূলে করীম (স)-এর উপরিউক্ত বাণীকে দলীয় হিসাবে পেশ করিয়াছিলেন। আর হযরত আবু বকর সিদ্দীক উহার জওয়াব দিলেন এই বলিয়া যে, আমি তাহাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করিয়াছি। তাহাদিগকে কাফির মনে করিয়া নয়, তাহারা যাকাত দিতে অস্বীকার করিয়াছে, কেবলমাত্র এই কারণেই। আর ইহাই ইসলামের নীতি। সম্ভবত হযরত আবু বকর (রা) পূর্বোদ্দৃত আয়াতের আলোকেই এই যুক্তি দেখাইয়াছিলেন।
বস্তুত যাকাত দেওয়া যে কত বড় ফরয এবং তাহা না দিলে বা দিতে অস্বীকার করা হইল ইসলামী রাষ্ট্রকে যে তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিতে হয়, এই হাদীস হইতে তাহা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইতেছে।
মূল হাদীসে হযরত উমরের বর্ণিত হাদীসের শেষ শব্দ ========== -এর অর্থ হইল তাহারা কুফর ও গুণাহ নাফরমানী যাহা গোপন করিতেছে; তাহা আল্লাহই জানেন। আমরা তো মানুষের ঈমানের দৃষ্টিতে ফয়সালা করি এবং তাহাদের বাহ্যিক অবস্থার দৃষ্টিতে যাহা অনিবার্য সেই অনুপাতেই আমরা ইসলামের অধিকার দিয়া থাকি ও ইসলামের অধিকার তাহাদের নিকট হইতে দাবি করি। কিন্তু কোন লোকটির মনের অবস্থা কিরূপ, কে নিষ্ঠাবান, আর কে মুনাফিক, তাহা জানা ও সেই অনুযাযী শাস্তি বা পুরস্কার দানের ক্ষমতা কেবলমাত্র আল্লাহরই রহিয়াছে। অন্য কাহারও নাই।
বস্তুত রনবোদ্ভুত পরিস্থিতিতে কুরআন ও সুন্নাতের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করিয়া কর্মনীতি নির্ধারণ ইসলামী রাষ্ট্রচালকদের পক্ষে সব জায়েয তাহাই নয়, ইহা তাহাদের কর্তব্যও। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রাধিনায়ক তাহার অনুসৃত কর্মনীতির জন্য জনগণের নিকট জওয়াবদিহি করিতে বাধ্য, এই কথাও এই দীর্ঘ হাদীস হইতে স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে।
=====================
যাকাত না দেওয়ার পরিণতি
========================
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেন,র হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা যাহাকে ধন-মাল দান করিয়াছেন, সে যদি উহার যাকাত আদায় না করে, তাহা হইল কিয়ামতের দিন তাহার ধন-মাল তাহার জন্য অধিক বিষধর সপের আকার ও রূপ ধারণ করিবে। উহার কপালের উপর দুইটি কালো চিহ্ন কিংবা দুইটি দাঁত বা দুইটি শৃঙ্গ থাকিবে। কিয়ামতের দিন উহা তাহার গলায় পেচাইয়া দেওয়া হইবে। অতঃপর উহা তাহার মুখের দুই গাল কিংবা দুই কর্ণলগ্ন মাঙসপিণ্ডের গোশত খাইবে ও বলিতে থাকিবেঃ আমিই তোমার মাল-সম্পদ, আমিই তোমার সঞ্চিত বিত্ত-সম্পত্তি। অতঃপর নবী করীম (স) এই আয়াতটি তিলাওয়াত করিলেনঃ (উহার অর্থ) যাহারা কার্পণ্য করে তাহাদের সম্পর্কে ধারণা করিও না। -বুখারী, নাসারী
ব্যাখ্যা হাদীসটির সর্বপ্রথম প্রতিপাদ্য হইল, দুনিয়ায় যাহার নিকট যতটুকু কম বা বেশী ধন সম্পদ রহিয়াছে তাহা সবই আল্লাহর দান। আল্লাহ তা;আলা তাহাকে তাহা দিয়াছেন বলিয়াই সে তাহা পাইতে পারিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা না দিলে কাহারও পক্ষে কিছু পাওয়া সম্ভবপর হইত না। অতএব ধন-সম্পত্তির যে-কেহ মালিক হইবে তাহারই প্রথম কর্তব্য হইল উহাকে আল্লাহর দান মনে করা।
দ্বিতীয়ত যে আল্লাহ্ উহা দিয়াছেন, তিনিই উহার প্রকৃত মালিক। যাহার নিকট উহা এখন আছে সে উহার প্রকৃত মালিক নয়। কেননা সে উহা সৃষ্টি করে নাই। আর যে যাহা সৃষ্টি করে নাই, সে তাহার প্রকৃত মালিক হইতে পারে না। অতএব আল্লাহর এই মালিকানায় আল্লাহরই মর্যী চলিবে। আল্লাহর আইন-বিধান অনুযায়ীই উহার বন্টন ও ব্যয় নিয়োগ হইতে হইবে। উহার উপর অন্য কাহারও নিরংকুশ কর্তৃত্ব চলিতে পারে না।
আল্লাহ্ মানুষকে ধন-সম্পত্তি দান করিয়াছেন, তিনি উহার উপর সর্বপ্রথম যাকাত ধার্য করিয়াছেন। ======== শব্দটির অভিধানিক অর্থ ====== শ্রী-বৃদ্ধি। ক্ষেতের ফসল যখন সবুজ শ্যামল সতেজ হইয়া উঠে, তখন আরবী ভাষায় বলা হয়ঃ ==== ‘কৃষি ফসল শ্রী-বৃদ্ধি লাভ করিয়াছে। ইহার আর একটি অর্থঃ ==== পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, পরিশুদ্ধতা।
কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তা’আলা বলিয়াছেনঃ
================
যে লোক পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা ও পরিশুদ্ধতা লাভ করিয়াছে, সে-ই সম্পূর্ণ কল্যাণ লাভ করিতে পারিয়াছে।
এই পবিত্রতা অর্জনকেই যাকাত বলা হয়। ইহার নাম ‘যাকাত’ রাখা হইয়াছে এইজন্যঃ
==================
কেননা যাকাত আদায়কারী আল্লাহর দিকে পরিশুদ্ধতা লাভ করে অর্থাৎ নেক ও কল্যাণকর কাজের সাহায্যে সে আল্লাহর নৈকিট্য অর্জন করে।
আর যে লোক কল্যাণকর কাজের সাহায্যে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে, সে আসলে আল্লাহর দিকেই পরিশুদ্ধতা পায়। ধন-মালের যাকাত দেওয়ার ফলে উহাতে যে শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, যে বরকত পরিদৃষ্ট হয়, সেই দৃষ্টিতেই এই নামকরণ করা হইয়াছে।
শরীয়াতের পরিভাষায় যাকাত’ বলিতে বুঝায়ঃ
==========================
বাৎসরিক যাকাত পরিমাপের একটা অংশ যাকাত গ্রহণ করিতে পারে এমন ব্যক্তিকে আদায় করিয়া দেওয়া।
এই দেওয়ার মূল কথা হইল ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য – আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে-আল্লাহর বিধান অনুযায়ী দেওয়া।
যাকাত ফরয হয় এমন পরিমাণ ধন-মাল নিরবচ্ছিন্নভাবে একটি বৎসরকালে যাহার মালিকানাধীন থাকিবে, তাহাকেই যাকাত আদায় করিতে হইবে।
যাকাত দানের চরম লক্ষ্য হইলঃ
==================
দুনিয়ার বুকে অব্শ্য কর্তব্য পালন এবং পরকালে প্রতিফল লাভ।
এই যাকাত নিয়মিত আদায় করা আল্লাহ্ তা’আলার দেওয়া ফরয-অবশ্য করণীয় কর্তব্য। কুরআন মজীদ বহুবার ======= ’যাকাত দাও’ বলিয়া প্রত্যক্ষভাবে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। রাসূলে করীম (স) যাকাত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ও অপরিহার্য কর্তব্য ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নানাভাবে, বহুবিধ ভাষায় করিয়াছেন।
উপরোদ্ধৃত হাদীসটিতে যাকাত না দেওয়ার পরকালীন কঠিন পরিণতির কথা বলা হইয়াছে। বলা হইয়াছেঃ কিয়ামতের দিন তাহার ধন-মালকে একটি বিষধর সর্পের রূপ ও আকার-আকৃতি দিয়া তাহার গলায় চেপাইয়া দেওয়া হইবে। কথার ভঙ্গী হইতে স্পষ্ট মনে হয়, ইহা নিছক রূপক কথা নয়। প্রকৃত এবং বাস্তবিক পক্ষেই যাকাত না দেওয়া ধন-মাল একটি বিষধর সর্পের রূপ ও আকৃতি লাভ করিবে ও গলায় পেচাইয়া মুখটা লোকটির মুখামুখি হইয়া থাকিবে। এই সাপের আকৃতি সম্পর্কে বলা হইয়াছে ========= উহার দুইটি চোখের উপর দুইটি কালো চিহ্ন কিংবা মুখের ভিতর হইতে বাহির হওয়া দুইটি দাঁত অথবা উহার মস্তকের উপর শৃঙ্গের ন্যায় দুইটি ফনা থাকিবে। (ব্যবহৃত শব্দটির এই কয়টি অর্থই হইতে পারে।) ইহা অত্যন্ত মারাত্মক পুরুষ সর্পের লক্ষণ। এই সাপটি লোকটির গলায় পেচাইয়া দেওয়া হইবে। আল্লাহ তা’আলাই পেচাইয়া দিবেন। তখন সাপটি লোকটির দুই গাল কিংবা দুই কর্ণসংলগ্ন মাংসপিণ্ড ঠুকরাইয়া খাইতে থাকিবে এবং লোকটিকে সম্বোধন করিয়া বলিতে থাকিবেঃ ‘আমি বাহ্য দৃষ্টিতে একটা সাধারণ সাপ হইলেও আসলে আমি তোমারই ধন-মাল। সেই ধন-মাল, যাহা তুমি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিলে অথচ উহার যাকাত আদায় কর নাই। এইরূপ বলিবার ফলে লোকটির মনে দুঃখ হতাশা এবং আযাবের মাত্রা বৃদ্ধি পাইবে। অর্থাৎ তুমি এখন হাতে-নাতে ধরা পড়িয়া গিয়াছ। এমন অনুতাপ করিলে কোন ফল হইবে না।
এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) যে আয়াতটি পাঠ করিয়াছেন তাহা হইলঃ
==========================
আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার অনুগ্রহের দান হিসাবে যাহা কিছু দেন, তাহা লইয়া যাহারা কার্পন্য করে, তাহারা যেন ধারণা করে যে, উহা তাহাদের জন্য কল্যাণময়। বরং উহা তাহাদের জন্য অকল্যাণের কারণ। কিয়ামতের দিন তাহাদের এই কার্পণ্য সঞ্চিত ধন-মাল অবশ্যই তাহাদের গালর বেড়ি বানাইয়া দেওয়া হইবে।
এই আয়াতটি এবং আলোচ্য হাদীসটির মর্মার্থ প্রায় এক। আয়াতটি স্বয়ং আল্লাহর কালাম। আর হাদীসটি রাসূলে করীম (স) এর নিজ ভাষায় প্রদত্ত ব্যাখ্যা। কেননা আয়াতটিতে যে কার্পণ্যের পরিণতির কথা বলা হইয়াছে, উহার অর্থঃ
=========================
ধন-মালের উপর যে হক ধার্য হয় তাহা না দেওয়া-দিতে অস্বীকার করাই কার্পণ্য।
এই দৃষ্টিতে যাকাত না দেওয়া বা দিতে অস্বীকার করা এমন অপরাধ, যাহার অনিবার্য পরিণতি তাহাই যাহা এই হাসীসটিতে ব্যাখ্যা করিয়া বলা হইয়াছে। এখানে স্বয়ং রাসূলের এই আয়াতটি পাঠ করায় এই কথা স্পষ্ট হয় যে, যাহারা যাকাত দেয় না, আয়াতটি তাহাদের সম্পর্কেই নাযিল হইয়াছিল। এই মত অধিকাংশ তাফসীরকারের।
হযরত জাবির-ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণিত হাদীসে উপরিউক্ত কথাটি বলা হইয়াছে এই ভাষায়ঃ
============================
এবং কোন পুঁজি মালিক যদি উহার উপর ধার্য হক আদায় না করে তবে কিয়ামতের দিন তাহার এই পুঁজি এক শক্তিশালী বিষধর সাপের রূপ ধারণ করিয়া আসিবে ও গ্রাস ব্যাদান করিয়া তাহার পঞ্চাদ্ধাবন করিবে। যে যখন সেইটি দেখিতে পাইবে, তখন সে পলায়ন করিতে চেষ্টা করিবে। এই সময় তাহার আল্লাহ্ তাহাকে ডাকিয়া বলিবেনঃ দুনিয়ায় তুমি যে ধন-সম্পদ পুঞ্জিভুত করিয়া রাখিয়াছিলে তাহা আজ গ্রহণ কর। আমি আজ উহার কারণে তোমার ব্যাপারে দায়িত্বমুক্ত। শেষ পর্যন্ত সে যখন দেখিবে যে, উহা হইতে নিষ্কৃতি নাই, তখন সে তাহার হাত উহার মুখের মধ্যে ঢুকাইয়া দিবে। সাপটি সে হাত খানা খাইয়া ফেলিবে-বলদ যেমন ঘাষ চর্বন করিয়া খাইয়া ফেলে -মুসনাদে আহমদ
এই হাদীসে ======= বা ‘পুঞ্জিকৃত ধন-সম্পদ’ জলিয়া সেই ধন-সম্পদের পরিণতিই দেখানো হইয়াছে, যাহার যাকাত যথাযথভাবে আদায় করা হয় নাই। কেননা যে ধন-মালের যাকাত আদায় করা হইয়াছে, হাদীসের পরিভাষায় তাহা ====== নয়। উহাকে পূঞ্জীকৃত বলা যাইবে না।
============================
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে, তিনি রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোকই তাহার ধন-মালের যাকাত আদায় করিবে না, তাহারই মাল-সম্পদ কিয়ামতের দিন বিষধর সর্পের রূপ পরিগ্রহণ করিবে। শেষ পর্যন্ত সেই সর্পটি তাহার গলায় পেচাইয়া দেওয়া হইবে।
-ইবনে মাজাহ
ব্যাখ্যা উপরোদ্ধৃত কয়টি হাদীস হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, যাকাত ফরয। উহা যথাযথভাবে আদায় না করার পরিণাম নামায আদায় না করার পরিণতি হইতেও অধিক ভয়াবহ ও সাংঘাতিক। কেননা যাকাত আদায় না করার যে কঠিন, কঠোর ও নির্মম পরিণতির কথা কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় ষোষিত হইয়াছে, তাহা নামায আদায় না করা পর্যায়ে ঘোষিত হয় নাই। এই পর্যায়ে কুরআনের নিস্নোদ্ধৃত আয়াতটি স্মরণীয়। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
========================
যাহারা স্বর্ণ ও রৌপ্য (ধন-মাল) সঞ্চয় করিয়া রাখে এবং উহা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না (যাকাত দেয় না) তাহাদিগকে এক কঠিন পীড়াদায়ক আযাবের সুসঙবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের আগুনে উহা উত্তপ্ত করা হইবে, অতঃপর উহা দ্বারা ‘তাহাদের কপাল, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দিয়া দেওয়া হইবে। (তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলা হইবে)ঃ ইহা তাহাই যাহা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিলে। অতএব তোমাদের সঞ্চয়ের স্বাদ গ্রহণ কর।
যাকাত সম্পদ পবিত্রকরণের মাধ্যম
=================
খালিদ ইবনে আসলাম হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমরা একদা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর সঙ্গে বাহির হইলাম। তখন ্রকে আরব বেদুঈন বলিলঃ আল্লাহ্র বাণী ‘যাহারা স্বর্ণ ও রোপ্য সঞ্চয় করিয়া রাখে এবং আল্লাহ্র পথে খরচ করে না’ ইহার প্রকৃত তাৎপযর্ কি, তাহা আমাকে বলুন। তখন ইবনে উমর বলিলেনঃ যে লোক উহা সঞ্চয় করিয়া রাখে এবং উহার যাকাত আদায় করে না, তাহার জন্য বড়উ দুঃখ। আসলে এই কথা প্রযোজ্য ছিল যাকাতের হুমুক নাযিল হওয়ার পূর্বে। পরে যখন যাকাত সম্পর্কেত বিধান নাযিল হইল, আল্লাহ্ তা’আলা উহা ধন-সম্পদকে পবিত্রকরণের মাধ্যম বানাইয়া দিলেন।
– বুখারী, নাসায়ী
ব্যাখ্যা হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা)-এর নিকট জনৈক বেদুঈন মুসলমান কুরআনের উল্লেখিত আয়াতটির তাৎপর্য বুঝিতে চাহিয়াছেন। উহার জওয়াবে তিনি তিনটি কথা বলিয়াছেন। একটি হইল, কুরআনের ব্যবহৃত ======= শব্দটির প্রয়োগ ও ব্যবহারিক অর্থ। দ্বিতীয়টি হইল, এই আয়াতটির প্রয়োগক্ষেত্র বা সময়সীমা এবং তৃতীয় হইল, যাকাতের ব্যবহারিক মূল্য। হযরত ইবনে উমর প্রথম যাকাত না-দেওয়া লোকদের জন্য ===== ‘অয়লুন’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। উহার অর্থঃ দুঃখ, ধ্বংস, আযাবের জ্বালা-যন্ত্রণা-কষ্ট। আর তাঁহার কথা অনুযায়ী আয়াতটির অর্থ হইলঃ ‘যাহারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করিয়া রাখে এবং উহা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাহাদের জন্য দুঃখ-ধ্বংস, আযাবের জ্বালা-যন্ত্রণা ও কষ্ট রহিয়াছে অর্থাৎ যাকাত না-দেওয়া সঞ্চিত সম্পদকে পরিভাষায় ===== বলা হয়।
এই পর্যায়ে হযরত ইবনে উমরের স্পষ্ট উক্তি হইলঃ
===========================
যে সম্পদের যাকাত আদায় করা হয় তাহা সাত তবক জমির নীচে থাকিলেও তাহা হইবে না। (যে === এর কথা কুরআনের আয়াতে বলা হইয়াছে।)
– বায়হাকী
দ্বিতয়ি বলিয়াছেনঃ এই আয়াতটির প্রয়োগকাল যাকাত সম্পর্কিত আয়াত ও বিধান নাযিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। এই সময়ে-যাকাতের বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে ধন-সম্পদ বা স্বর্ণ-রৌপ্যের যে কোন সঞ্চয় সম্পর্কেই আল্লাহ তা’আলার এই আয়াতটিতে কঠিন আযাব নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু যখন যাকাতের বিধান নাযিল হইল, স্বর্ণ-রৌপ্য বা ধন-সম্পদের যাকাত আদায় করা শুরু হইল, সে ক্ষেত্রে এই আযাবের ভীতি কার্যকর নয়। যাকাত রীতিমত আদায় করা হইলে অতঃপর যে সঞ্চয় হইবে তাহাতে শরীয়াতের কোন আপত্তি নাই এবং সেইজন্য কোন আযাব হইবে না। বায়হাকী শরীফে এই বর্ণনার যে অতিরিক্ত অংশ উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাকে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় এই কথা বলা হইয়াছে। সেই অতিরিক্ত অংশটুকু এইঃ
=======================
অতঃপর আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেনঃ ওহোদ পর্বত সমান স্বর্ণস্তুপও যদি আমার থাকে আর উহার পরিমাণ ও সংখ্যা যদি আমার জানা থাকে, এবং আমি যদি উহার যাকাত আদায় করি ও উহার দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজ করি তাহা হইলে (এই আয়াত সত্ত্বেও) আমি কোনই ভয় করি না।
আর তৃতীয় কথাটি হইলঃ যাকাত আল্লাহ তা’আলা ফরয করিয়াছেন ধন-সম্পদ পবিত্রকরণের উদ্দেশ্যে। বস্তুত যাকাত যুগপতভাবে দাতা ও সম্পদ উভয়ের জন্যই পবিত্রকারী। সঞ্চিত ধন-সম্পদ মূলত অপবিত্র। কেননা উহাতে আল্লাহর ’হক’ রহিয়াছে। আল্লাহর এই ‘হক’ যথাযথভাবে আদায় না করা পর্যন্ত উহা মালিকের জন্য পবিত্র বা হালাল নয়। উহার সঠিক হিসাব করিয়া যখন রীতিমত যাকাত আদায় করিয়া দেওয়া হয়, ঠিক তখনই তাহা পবিত্র হয় এবং উহার মালিকের জন্যও তাহা হালাল হয়। যাকাত দিলে যাকাতদাতা বা ধন-সম্পদ মালিকের হৃদয় মন পবিত্র হইয়া যায়। পবিত্র হয় যাকাতদাতার চরিত্র। চূর্ণ হইয়া যায় তাহার কার্পণ্যের দুর্ভেদ্য দুর্গ-প্রাকার।
বস্তুত যাকাতের কল্যাণ ও উপকারিতার তিনটি দিক স্পষ্ট ও জাজ্জ্বল্যমান। একটি এই যে, মুমিন বান্দা নামাযে দাঁড়াইয়া ও রুকু সিজদা করিয়া আল্লাহর সম্পর্কে নিজের দাসত্ব বন্দেগী ও বিনয় অবনত ভাবের বাস্তব প্রকাশ ঘটায়, আল্লাহর সন্তোষ, রহমত ও নৈকট্য লাভের জন্য মন-মানসিকতা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আকুল আকুতি জানায়, যাকাত আদায় করিয়া বান্দা টিক অনুরূপভাবে আল্লাহ্র দরবারে নিজের ধন-সম্পদের অর্ঘ্য পেশ করে। সেই সঙ্গে এই কথারও বাস্তব প্রমাণ উপস্থাপিত করে যে, যেসব ধন-সম্পদ তাহার করায়ত্ত তাহার প্রকৃত মালিক সে নিজে নয়, স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। যাকাত এই হিসাবেই ইসলামের মৌল ইবাদতের মধ্যে গণ্য।
যাকাতের দ্বিতীয় দিক হইল, উহার সাহায্যে আল্লাহর অভাবগ্রস্ত দরিদ্র বান্দাদের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন করা হয়। বস্তুত যাকাত একটা নিছক দান-অতএব ঘৃণ্য-মনে করা তত্ত্ব ও মন-মানসিকতার দিক দিয়া একটা মৌলিক ভুল। কেননা আসলে উহা ধনীর ইচ্ছা বা মযীর উপর নির্ভরশীল কোন ব্যক্তিগত দান-খয়রাতের ব্যাপার নয়। ধন-সম্পদ সঞ্চিত হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে উহাতে আল্লাহর হকও পুঞ্জীভূত হইয়া উঠে। সম্পদের এই অংশ ধনীর হাতে থাকিলেও আসলে সে উহার মালিক বা অধিকারী নয়। সে যখন এই অংশ ধনীর হাতে থাকিলেও আসলে সে উহার মালিক বা অধিকারী নয়। সে যখন এই অংশ মূল সম্পদ হইতে আলাদা করিয়া নির্দিষ্ট উপায়ে আদায় করিয়া দিবে যখন এই অংশ মূল সম্পদ হইতে আলাদা করিয়া নির্দিষ্ট উপায়ে আদায় করিয়া দিবে তখনই সে সেই মূল সম্পদ হালালভাবে ব্যয়-ব্যবহার করার অধিকারী হইবে, তাহার পূর্বের নয়। এই দিক দিয়া যাকাত মানুষের নৈতিকতার একটা বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
তৃতীয় দিক হইল, যাকাতদাতার মন-মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তন ও সংশোধন। ধন-সম্পদের প্রেম একদিকে সম্পদ পুজার মানসিকতা সৃষ্টি করে। ফলে ব্যক্তি ধন-সম্পদকেই উপাস্যের উচ্চ পর্যায়ের সংস্থাপন করে। অপরদিকে উহা মানুষকে বানায় হাড়-কৃপণ। আর এই দুইটি ব্যক্তির ইমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী-ঈমানের পবিত্র ভাবধারার পক্ষে উহা অত্যন্ত মারাত্মক। উহা ব্যক্তির মন মানসিকতা ও চরিত্রকে কঠিন রোগে আক্রান্ত করে। মানুষকে যেমন বানায় অর্ধগৃধু, তেমনি দয়া-মায়াহীন কৃপণ। তাহার চরিত্রকে চরমভাবে পংকিল ও কলুষিত করিয়া দেয়। নিয়মিত যাকাত আদায় একদিকে তাহার মনের এবম্বিধ যাবতীয় রোগের চিকিৎসা করে। অপর দিকে উহার প্রতি-গন্ধময় বিষাক্ত প্রভাব হইতে ব্যক্তির প্রবৃত্তি ও মাসকিতাকে পরিচ্ছন্ন পবিত্র ও মহান করিয়া তোলে। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়ে সেই কথাই অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বলা হইয়াছেঃ
==========================
তাহাদের নিকট হইতে তুমি যাকাত গ্রহণ কর। উহার ফলে তাহাদের প্রবৃত্তি ও মন-মানসিকতার পবিত্র ও বিশুদ্ধিকরণ হইবে।
==========================
আর সেই মুক্তাকী বান্দারা জাহান্নামের আগুন হইতে রক্ষা পাইয়া যাইবে, যাহারা নিজেদের ধন-মাল আল্লাহর জন্য দিবে এই উদ্দেশ্যে যে, উহার দরুন তাহাদের আত্মাও পরিশুদ্ধি লাভ করিবে। নবী করীম (স) নিজেই বলিয়াছেনঃ
==========================
আল্লাহ, তা’আলা যাকাত ফরয করিয়াছেন কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যে যে, যাকাত দেওয়ার পর অবশিষ্ট ধন-মাল উহার মালিকের জন্য পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করিয়া দিবেন।
হযরত ইবনে উমরের বক্তব্যে যাকাত ফরয হওয়ার সময়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট। কিন্তু ঠিক কোন সময় ইহা ফরয হইয়াছে, উহাতে তাহার সুস্পষ্ট উল্লেখ বা সময় নির্দেশ করা হয় নাই। যাকাত যে ঠিক কখন প্রথম ফরয হইয়াছে, সেই বিষয়ে বিশেষ মতবিরোধ দেখা যায়। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের মতে হিজরতের পর পরেই যাকাত ফরয হইয়াছে। কাহারও মতে ইহা হিজরী দ্বিতীয় সনের ঘটনা-রোযা ফরয হওয়ার পূর্বের। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলিয়াছেন, হিজরীর নবম বৎসরে। কিন্তু বহু সংখ্যক হাদীসের উল্লেখ মতে যাকাত নবম হিজরী সনের অনেক পূর্বেই ফরয হইয়াছে। কুরায়শ সরদার আবু সুফিয়ান হেরাক্লিয়াসের সঙ্গে কথোপকথন ব্যাপদেশে যাকাতের উল্লেখ করিয়াছিল এই ভাষায়ঃ
========================
এবং তিনি [হযরত মুহাম্মাদ (স)] আমাদিগকে নামায ও যাকাত দেওয়ার আদেশ দিতেন।
আর এই কথোপকথন যে সপ্তম হিজরীর শুরুতে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহা অকাট্য। কিন্তু মুহাদ্দিস ইবেন খুযায়মা দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ
===========================
হিজরতের পূর্বেই যাকাত ফরয হইয়াছিল।
তিনি দলীল হিসাবে হযরত উম্মে সালমা বর্ণিত সাহাবিদের আবিসিনীয়া হিজরতের কাহিনী উল্লেখ করিয়াছেন। তাহাতে স্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে, হযরত জা’ফর ইবনে আবূ তালিব (রা) কর্তৃক নাজাশীর রাজদরবারে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলিয়াছেনঃ
=================
রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে নামায ও যাকাতের আদেশ করেন।
কিন্তু এই কথাও আপত্তির ঊর্ধ্বে নয়।
========================
তবে উহার সমন্বিত ব্যাখ্যা এই দেওয়া যাইতে পারে যে, যাকাত মূলত ইসলামের অন্যতম রুকন হিসাবে শামিল ছিল সেই মূল দাওয়াতের সঙ্গে, যাহা নবী করীম (স) প্রথম দিন হইতেই দিয়াছেন। কিন্তু উহার বাস্তব কার্যকরতার জন্য নবী করীম (স) -কে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হইয়াছে। কেননা ব্যক্তির মন-মানসিকতা ও তাহাদের সমন্বয়ে সমাজপরিবেশ গঠিত না হইলে কোন বিধানের কথা বলিয়া কোন লাভ পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন নিশ্চিতভাবে বুঝিতে পারিলেন যে, ইসলামী জনতা ও সমাজ যাকাতের বিধান পালনের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়াছে, ঠিক তখনই উহার কার্যকরতা (Practical implementation)আমলে জানিলেন। আর ইহা নবী করীম (স) এর পক্ষে অননুমিত ছিল না। এই ব্যাখ্যায় যাকাত ফরয হওয়া সংক্রান্ত যাবতীয় মতবিরোধের স্থায়ী মীমাংসা হইয়া যায় (গ্রন্থকার)। [এই কথাটি গ্রন্থকার নিজের বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির ফলশ্রুতি হিসাবেই লিখিয়াছিলেন। কিন্তু মূলত ইহা গ্রন্থকারের স্বকল্পিত নয়। বরঞ্চ এই কথাটিই আল্লামা ইবনুলআরাবী এই আয়াতের ভিত্তিতে যাকাত ফরয হওয়ার সময় সংক্রান্ত মতবিরোধ মীমাংসার্থে লিখিয়াছেন। তাঁহার কথা এইঃ]
=============================
আল্লাহ তা’আলা যাকাত ফরজ করিয়াছেন মুলত মক্কা শরীফেই। কিন্তু তাহা ছিল মোটামুটিভাবে ফরজ করার কথা হইতে যাকাত যে ফরজ এই বিশ্বসটা দৃঢ় সংস্থাপিত হইল। কিন্তু উহার কার্যকারিতা স্থাগিত থাকিল। উহার ধরণ পরিমাণ ও সময় সম্পর্কে তখন মক্কী জীবনে কিছুই বলা হইল না । পরে মদীনায় ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হইল এবং এখানেই যাকাত সংক্রান্ত যাবতীয় কথা প্রকাশ করিয়া বলা হইল তদানুযায়ী আমলও হইল।ইহা এমন একটা মীসাংসার কথা, যাহা কুরআনী বিধানের মূলনীতি জানা লোকেরা ছাড়া অন্যরা বুঝিতে পারে না।
আল্লামা ইবনে আসীরও তাঁহার তাফসীরে লিখিয়াছেনঃ
==========================
যাকাত ফরয হওয়ার হুকুম মক্কা শরীফে নাযিল হইয়াছে। তবে নিয়ম ও বিধি-কোন্ জিনিসে যাকাত দিতে হইবে তাহার বিস্তারিত বিধান মদীনায় নাযিল হইয়াছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ কুরআনের আয়াতঃ যাহারা স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করিয়া রাখে ও উহা আল্লাহর পথে খরচ কর না-যখন নাযিল হইল, (-ইহাতে ধন-সম্পদ সঞ্চয়কারীদের পরকালে কঠিন শাস্তি হওয়ার কথা বলা হইয়াছে,) এই কারণে সাহাবায়ে কিয়ামের মনের উপর ভীষণ চাপ পড়িল এবং তাঁহারা চিন্তা ভারাক্রান্ত হইয়া পড়িলেন। হযরত উমর (রা) তাহা বুঝিতে পারিয়া বলিলেনঃ আমি তোমাদের এই চিন্তা ও উদ্বেগ দূর করিতে চেষ্টা করিব। অতঃপর তিনি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া পড়িয়াছেন। রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ আল্লাহ তা’আলা যাকাত এই উদ্দেশ্যে ফরয করিয়াছেন যে, ইহা আদায় করার পর অবিশিষ্ট ধন-মাল যেন পবিত্র হইয়া যায়-অনুরূপভাবে উত্তরাধিকার আইন জারী করিয়াছেন এই উদ্দেশ্যে যে, উহার দরুন তোমাদের পরবর্তী লোকদের জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হইবে। হযরত উমর (রা) রাসূলে করীম (স)-এর এই ব্যাখ্যা শুনিয়া আনন্দে ‘আল্লাহ আকবার’ বলিয়া উঠিলেন। ইহার পর রাসূলে করীম (স)-এর এই ব্যাখ্যা শুনিয়া আনন্দে ‘আল্লাহু আকবার’ বলিয়া উঠিলেন। উহার পর রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ আমি কি তোমাদিগকে ইহাপেক্ষাও উত্তম সঞ্চয়ের কথা বলিব?- তাহা হইল পবিত্র স্বভাব-চরিত্রের স্ত্রী, যাহার দিকে সে যখন তাকাইবে, সে তাহাকে সন্তুষ্ট করিয়া দিবে, যখন তাহাকে কোন কাজের আদেশ করিবে, যে তাহা পালন করিবে। আর যখন সে তাহার নিকট হইতে অনুপস্থিত থাকিবে তখন সে তাহার সংরক্ষণ করিবে।
ব্যাখ্যা মানুষ স্বভাবতই সঞ্চয়শীল। উপার্জন করিয়া তাহা সবই সঙ্গে সঙ্গে ব্যয় না করিয়া নিজের ভবিষ্যতের জন্য এবং নীজ বংশধরদের জন্য বিন্দু বিন্দু করিয়া সঞ্চয় করিয়া রাখা মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। এই প্রবণতাও আল্লাহ্রই সৃষ্টি। মানুষের ইতিহাসে কোন কালের কোন দেশের বা কোন জাতীর মধ্যে উহার ব্যতিক্রম দেখা যায় নাই। নবী করীম (স) যে আদর্শ সমাজ গঠন করিয়াছিলেন, সেই সমাজের লোকেরা পরার্থপরতা ও দানশীলতার দিক দিয়া বিশ্বমানবের পটভূমিতেও অতুলনীয়। কিন্তু তাঁহাদের মধ্রে এমন বহু লোক ছিলেন, যাঁহারা নিজেদের সকল প্রকার নিত্য-নৈমিত্তিক প্রয়োজন পূরণ ও সর্বপ্রকার দায়িত্ব পালনের পরও কিছু কিছু না সঞ্চয় করিয়া রাখিতেন। কিন্তু এই সমাজের সম্মুখে কুরআন মজীদের উদ্ধৃত আয়াতটি যখন নাযিল হইল, তখন সমাজের বিশেষ করিয়া সঞ্চয়শীল লোকেরা অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িলেন। কেননা এই আয়াতের ধন-সম্পদ সঞ্চয় করিয়া রাখাকে একটা ভয়ানক পরিণতির ভীষণ অপরাধ বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে এবং পরকালে তাহার দরুন কঠিনতম শাস্তির সম্মুখীন হইতে হইবে বলিয়া জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অথচ তাঁহারা ধন-সম্পদের কিছু না কিছু পরিমাণ সঞ্চয় করিয়া থাকেন। আর ইহা প্রত্যেক মানুষের জন্যই অপরিহার্য ও স্বাভাবিক। তাঁহাদের এই মানসিক উদ্বেগ ও চিন্তা-ভারাক্রান্ত অবস্থার কথা জানিতে পারিয়া হযরত উমর ফারুক (রাঃ) উদ্যোগী হইয়া আসিলেন। তিনি স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-এর নিকট হইতে বিষয়টির বিশ্লেষণ চাহিলেন। তাঁহাকে সাহাবীদের চিন্তা ও ভয়ভীতির কঠিন উদ্বেগের কথা বিস্তারিত জানাইলেন এই আয়াতের কারণে তাঁহারা কিছুই সঞ্চয় করিতে পারিবেন না-না নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য, না ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য কিছু রাখিয়া যাইতে পারিবেন, তাঁহাদের এই আশংকার কথাও জানাইলেন। তখন নবী করীম (স) যাহা কিছু বলিয়াছেন, পরিপ্রেক্ষিতের দৃষ্টিতে তাহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ‘এই আয়াতের কারণে লোকদের ভীত-সন্ত্রস্ত ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে হতাশ হওয়ার কোনই কারণ নাই। কেননা এই আয়াতটি নাযিল হইয়াছে সেই সব পূঁজি সঞ্চয়কারীদের সম্পর্কে, যাহারা উহা হইতে রীতিমত যাকাত আদায় করে না। যাহারা সঞ্চিত ধন-সম্পদ হইতে রীতিমত যাকাত দেয়, তাহাদের সঞ্চয় কাজে কোন বাধা নাই। আয়াতের ভীতিপ্রদ পরিণতির কথাও তাহাদের জন্য নয়।
বস্তুত পূর্ণ আয়াতটি বিবেচনা করিলে সেই আয়াতেই এই জওয়াব নিহিত পাওয়া যায়। কেননা আয়াতে বলা হইয়াছেঃ
===========================
যাহারা স্বর্ণ-রৌপ্য-ধন-সম্পদ পূজিঁ ও সঞ্চয় করে এবং তাহাতে আল্লাহর পথে ব্যয় করে না-।
আল্লাহর পথে ব্যয় না করিয়া যাহারা ধন-সম্পদ বা স্বর্ণ-রৌপ্য পূঁজি করে, তাহাদের কথাই আয়াতটিতে বলা হইয়াছে। কিন্তু যাহারা সঞ্চয় করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ্র পথে ব্যয়ও করে তাহাদের সম্পর্কে এই আয়াত প্রযোজ্য নয়। আর ‘আল্লাহর পথে ব্যয়’ করার অর্থ হইল প্রধানত যাকাত দেওয়া। সমস্ত ধন-সম্পদ বা স্বর্ণ-রৌপ্য ব্যয় করিয়া দেওয়া এই আয়াতের লক্ষ্য নয় কখনো।
এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) যাকাত ফরয করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ যাকাত আল্লাহ্ তা’আলা ফরয করিয়াছেন কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যেঃ
============================
যাকাত আদায়ের পর তোমাদের যে ধন-সম্পদ অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা যেন পবিত্র ও হালাল হইয়া যায়।
ইহাতে জনগণের মনে সঞ্চায়িত আশংকার একটি দিকের জওয়াব পাওয়া গেল। সে দিকটি হইল বর্তমানের আশংকা। আশংকার দ্বিতীয় দিকটি সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) যাহা বলিয়াছেন তাহার সারমর্ম হইলঃ তোমরা সঞ্চয় করিয়া তোমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য কিছুই রাখিয়া যাইতে পারিবে না-এই আশংকাও অমূলক। কেননা যাকাত আদায় করিতে থাকিলে সঞ্চয়ও করিতে পারিবে, আর সঞ্চয় করিতে পারিলে তাহা তোমাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য রাখিয়াও যাইতে পারিবে। এই উদ্দেশ্যেই তো আল্লাহ্ তা’আলা মীরাসী বিধান কার্যকর করিয়া দিয়াছেন।
=-========================
তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পদ-সম্পত্তির উপরই তো এই মীরাসী আইন কার্যকর হইবে।
বস্তুত যাকাত দেওয়ার পর সম্পদ-সম্পত্তি সঞ্চয় করা নিষিদ্ধ হইলে মীরাসী আইনের কোন কার্যকরতা থাকিতে পারে না। কেননা সম্পদ ও সম্পত্তি একজনের হাতে সঞ্চিত হইলেই তো তাহার মৃত্যুর পর তাহার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করার প্রশ্ন উঠিতে পারে। আর একজনের ধন-সম্পত্তি তাহার বংশধরনের জন্য হালাল হইতে পারে যদি রীতিমত যাকাত আদায় করার পরই উহা সঞ্চয় করা হইয়া থাকে। মোটকথা সঞ্চয় করিয়া রাখার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইলে আল্লাহ তা’আলা কখনো যাকাত ফরয করিতেন না এবং মীরাসী বিধান জারী করিতেন না।
হযরত উমর ফারুক (রা) রাসূলে করমি (স)-এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ শুনিয়া এবং সমস্যার এমন প্রাঞ্জল সমাধান জানিতে পারিয়া উৎফুল্ল হইয়া উঠিলেন ও আনন্দের আতিশয্যে স্বতঃস্ফুর্তভাবে উচ্চস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ বলিয়া উঠিলেন।
প্রসঙ্গকথা এইখানেই শেষ হইয়া গিয়াছে। হযরত উমরের মিশন সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছে। কিন্তু নবী করীম (স) জনগণের মনস্তাত্ত্বিক সংশোধনের এই সুযোগকে হাতছাড়া করিতে প্রস্তুত হইলেন না। এই উদ্দেশ্যে তিনি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা উত্থাপন করিলেন।
মূল প্রশ্ন জাগিয়াছিল সঞ্চয় লইয়া। নবী করীম (স) বলিলেন, কেবলমাত্র ধন-সম্পদ সংগ্রহ ও করায়ত্ত করাই প্রকৃত সঞ্চয় নয়। মানুষ নিজের ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য যাহা কিছু সঞ্চয় করে, তন্মধ্যে উত্তম স্থায়ী ও অধিক কল্যাণকর সঞ্চয় হইল এমন একজন স্ত্রী, যে দৈহিক ও আন্তরিক উভয় দিক দিয়াই সৌন্দর্যের অধিকারিণী ও মহত্তম গুণাবলীতে ভূষিতা হইবে। এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) স্ত্রীর তিনটি বড় ও মৌলিক গুণের উল্লেখ করিয়াছেন। (১) স্বামী যখন তাহার দিকে তাকাইবে, সে তাহাকে মুগ্ধ, বিমোহিত ও আনন্দিত করিয়া দিবে। (২) সে যখন তাহাকে কোন কিছু করিতে বলিবে সে তাহা যথাযথভাবে পালন করিবে। (৩) এবং সে যখন স্ত্রী ও ঘরবাড়ী হইতে দূরে চলিয়া যাইবে তখন সে স্বামীর অধিকার, ঘর-বাড়ী, ধন-মাল ও সন্তান-সন্তুটির রক্ষণাবেক্ষণ করিবে।
সৌন্দর্যমণ্ডিত স্ত্রী সম্পর্কে রাসূলে করীমের বলা এই তিনটি মৌলিক গুণের কথা এখানে আলোচনার দিকদিয়া অপ্রাসংগিত। তাই আমরা এখানে এই কথা কয়টি ব্যাখ্যা করিব না। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, নবী করী (স) এখানে বাহ্যত অপ্রাসংগিক এই কথাটি কেন বলিলেন?
আল্লামা কাযী ইয়ায ইহার জওয়াবদান প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স) যখন বলিলেন যে, যাকাত আদায় করিতে থাকিলে ধন-সম্পদ সঞ্চয় ও পুঁজি করাতে কোনই দোষ নাই এবং বুঝিলেন যে, ইহাতে তাহাদের মনে সঞ্চারমান ভয় ও আশংকার মেঘপুঞ্জ দূরীভূত হইয়া গিয়াছে ও তাহারা আনন্দিত উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছে, তখন এই সঞ্চয় অপেক্ষাও অধিক স্থায়ী সম্পদ ও সঞ্চয়ের জন্য তাহাদিগকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে এই কথাটি এখানে বলিয়াছেন। কেননা স্বর্ণ ও রৌপ্য ধন-সম্পদ-যতই সঞ্চয় করা হউক, উহা হস্তান্তরিত না করা পর্যন্ত ব্যক্তির নিকট উহার ব্যবহারিক মূল্য কিছুই নাই। কিন্তু বর্ণিত শুনাবলী সম্পন্ন স্ত্রী-সঞ্চয় এখনই এক মহামূল্য সম্পদ, যাহা ব্যক্তির নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া চলিয়া যায় না, স্থায়ীভাবে তাহার সঙ্গী ও সাথী সহযাত্রী ও সহধর্মিনী হইয়া থাকে। অর্থ-সম্পদ ব্যয় করিলেই তুমি উহার কল্যাণ নিরতা। তোমাকে আনন্দ দান করে, তোমার মনের ও দেহের প্রয়োজন পূরণ করে। তোমার সুবিধা-অসুবিধায় অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে তোমাকে শুভ পরামর্শ দেয়। তোমার গোপন কথা অন্যদের হইতে গোপন রাখে, সর্বক্ষেত্রে তোমাকে বলিষ্ঠ সাহায্য ও সহযোগিতা দান করে। আর তুমি যখন তোমার বাড়ীতে অনুপস্থিত থাক, তখন একদিকে সে নিজের সংরক্ষণ করে যেন তোমার ‘হক’ একবিন্দুও ব্যাহত ও ক্ষুণ্ন হইতে না পারে। তোমার ঘর-বাড়ী, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির হেফাযত করে। কার্যত সে হয় তোমার সহকারী, পৃষ্ঠপোষক ও প্রধান উপদেষ্টা। তোমার জীবন ক্ষেত্রে এবং তোমার বড় প্রতিনিধি তোমার অনুপস্থিতিতে, তোমার মৃত্যুর পর।
ইহার দ্বিতীয় ব্যাখ্যা এই হইতে পারে যে, নবী করীম (স) যখন বলিলেন যে, ধন সম্পদ সঞ্চয় করা যাকাত আদায় করার শর্তে সম্পূর্ণ জায়েয, তখন এই শেষের কথাটি বলিয়া লোকদের মনে এই ধারণা জন্মাইতে চাহিয়াছেন যে, সঞ্চিত ধন-সম্পদ সঞ্চয় করিয়া রাখা নয়-উহা দ্বীন ও দুনিয়ার অধিকতর কল্যাণকর কাজে ব্যয় করাই অধিক উত্তম ও স্থায়ী ফলপ্রদ। ইহা দ্বারা পরোক্ষভাবে ধন সম্পদ সঞ্চয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করার চেষ্টা হইয়াছে। কেননা সেকালে সমাজে সাধারণত নারী সমাজের প্রতি বিশেষ উপেক্ষা ও অবহেলা প্রদর্শন করা হইত। স্ত্রীর কোন মর্যাদাই স্বামীর নিকট ছিল না। তাহারা স্ত্রী-পুত্র পরিজনের প্রতি চরম অবজ্ঞা দেখাইয়া কেবলমাত্র ধন-সম্পত্তি সঞ্চয়ের দিকেই সমস্ত লক্ষ্য সাধনা নিয়োজিত করিয়া দিয়াছিল। নবী করীম (স) এতদসংক্রান্ত শেষ কথাটি বলিয়া লোকদের এই কঠিন মানসিক ও সামাজিক রোগের সংশোধন করিতে চাহিয়াছেন।
==========================
যাকাত ফরয হওয়ার ন্যূনতম পরিমাণ
============================
হযরত আবু সাঈদ খুরদী (রা) হইত বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ পাঁচ অসক-এর কম পরিমাণ খেজুরে যাকাত নাই। পাঁচ ‘আওকিয়া’র কম পরিমাণ রৌপ্যে যাকাত নাই এবং পাঁচটি উষ্ট্রের কম সংখ্যার যাকাত নাই।
– বুখারী, আবু দাউদ
ব্যাখ্যা নবী করীম (স)-এর সময়ে মদীনা ও আশেপাশের যে লোক সচ্চল ও ধনশালী ছিল, তাহাদের নিকট সাধারণত তিন প্রকারের কোন এক প্রকারের সম্পদ থাকিতঃ (১) তাহাদের বাগানের খেজুর (২) রৌপ্য এবং (৩) উষ্ট্র। রাসূলে করীম (স) উপরিউক্ত হাদীসে এই তিন প্রকারের সম্পদের উপরই যাকাত ধার্য হওয়ার ন্যূনতম পরিমাণের উল্লেখ করিয়াছেন। অর্থাৎ হাদীসে প্রত্যেকটি জিনিসের যে পরমাণ বা সংখ্যার উল্লেখ হইয়াছে, তাহা কাহারো নিকট থাকিলে তাহাতে যাকাত ফরয হইবে। সেই পরিমাণ বা সংখ্যার কম সম্পদ কাহারো নিকট থাকিলে তাহাতে যাকাত ফরয হইবে না।
খেজুর সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, উহার পাঁচ অসক-এর কম পরিমাণ হইলে যাকাত দিতে হইবে না। এক ‘অসক’ প্রায় ছয় মণ। এই হিসাবে পাঁচ ‘অসক’ ত্রিশ মণের কাছাকাছি। রৌপ্য সম্পর্কে তিনি বলিয়াছেনঃ পাঁচ ‘আওকিয়ার’ কম পরিমাণে যাকাত নাই এক ‘আওকিয়া’ পাঁচ ‘দিনহাম’ সমান। এই হিসাবে পাঁচ আওকিয়া দুইশত দিরহামের সমান। আমাদের দেশে চলতি ওজন হিসাবে ইহাতে সাড়ে বায়ান্ন (৫২) তোলা হয় অর্থাৎ কাহারো নিকট সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য থাকিলে এবং এই মালিকানায় এক বৎসর কাল অতিক্রান্ত হইলে উহার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত বাবদ দিতে হইবে, ইহাই ফরয।
আর উষ্ট্র সম্পর্কে নবী করীম (স) বলিয়াছেন, পাঁচটির কমে যাকাত হয় না। সেকালে ত্রিশ মণ খেজুর একটা ছোঁট-খাটো পরিবারের সম্বাৎসরিক খরচের জন্য যথেষ্ট হইত। অনুরূপভাবে দুইশত দিরহাম পরিমাণের নগদ অর্থে বছরের খরচ চলিয়া যাইত। এই মূল্যমানের দৃষ্টিতে পাঁচটি উষ্ট্রের মালিককেও সচ্ছল অবস্থার ও যাকাত দিতে সক্ষম ব্যক্তি মনে করা হইত।
যাকাত দেওয়ার নির্দিষ্ট তারিখে যে লোক ৮৭.৫ গ্রাম স্বর্ণ কিংবা ৬১২.৫ গ্রাম রৌপ্যের কিংবা এই পরিমাণের মূল্য নগদ অর্থ থাকিবে, কিংবা বিক্রয়ার্থে প্রস্তুত পণ্য দ্রব্যের মালিক থাকিবে, তাহার উপরই যাকাত ফরয, সে নিসাব পরিমাণের মালিক (গ্রন্থকার)
রৌপ্য ও স্বর্ণের যাকাত
===========================
হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ আমি তোমাদিগকে ঘোড়া ও ক্রীতদাসের যাকাত আদায় হইতে নিষ্কৃতি দিলাম; কিন্তু তোমরা রৌপ্যের যাকাত অবশ্যই আদায় করিবে। প্রত্যেক চল্লিশ ‘দিরহামে’ এক ‘দিরহাম’ যাকাত দাও। একশ নব্বই দিরহাম পর্যন্ত কোন যাকাত নাই। কিন্তু সম্পদ-পরিমাণ যখন দুইশত ‘দিরহাম’ পর্যন্ত পৌঁছিবে, তখন উহাতে পাঁচ ‘দিরহাম’ যাকাত ধার্য হইবে।
– তিরমিযী, বুখারী, মুসনাদে আহমদ, তাবারানী হাকেম, বায়হাকী, ইবনে মাজাহ্
ব্যাখ্যা ক্রীতদাস রাসূলে করীম (স)-এর সময়ের সামাজিক অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। কিন্তু উহার উপর কোন যাকাত ধার্য হয় নাই আর ঝোড়া সেকালে প্রধানত জিহাদের কাজে ব্যবহারের জন্য পালন ও রাখা হইত। বলিতে গেলে উহা ছিল প্রতিরক্ষা কার্যের একটা উপকরণ। এই হিসাবে উহার উপরও যাকাত ধার্য হয় নাই। ত ব ব্যবসায় পণ্য হিসাবে ঘোড়া পালন করা ও রাখা হইলে উহাতে যাকাত ওয়াজিব হইবে।
নবী করীম (স)-এর ব্যবহৃত শব্দ ==== অর্থ ‘ক্ষমা করিয়া দিলাম’-এই শব্দটির ব্যবহার হইতে বুঝা যায় ঘোড়া ও উহার যাকাত হইবে না বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে। আর ইহা হইতে এই কথার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যেঃ
=========================
প্রত্যেক সম্পদ মূলতই এমন যে, উহা হইতে যাকাত আদায় করা বাঞ্ছনীয়।
(যদিও এই দুইটি মাল-সম্পদের উপর যাকাত ধার্য না করার সিদ্ধান্ত হইয়াছে।)
=============== অর্থ ======রৌপ্য। মুল্লা আলী আল-কারীর মতে ========== শিরমোহন অংকিত রৌপ্যমুদ্রা।
আর ইবনে হাজার আল-আসকালানী বলিয়াছেনঃ
=======================
নিরেট রৌপ্য, উহার উপর মুদ্রা-চিহ্ন অংকিত হউক কি নাই হউক।
হাদীসটি হইতে রৌপ্যের উপর যাকাত ফরয হওয়ার কথা প্রমাণিত হয়। ইহা সর্বসম্মত। আর উহার হার হইল প্রত্যেক চল্লিশ দিরহামে এক দিরহাম যাকাত। ইহার অর্থ, চল্লিশ ভাগের এক ভাগ। এই ব্যাপারেও কোন মতভেদের কথা জানা যায় নাই। এই ব্যাপারেও ঐকমত্য রহিয়াছে যে, রৌপ্যের যাকাত হিসাব গণ্য করা হইবে। আর তাহা হইল দুইশত দিরহাম। আর একশত নব্বই দিরহাম পর্যন্ত যাকাত না হওয়ার কথা বলার কারণ, নব্বই হইল একশ’র পূর্ববর্তী দশম সংখ্যা। আর হিসাবের অংক এককের উপর গেলে দশক দ্বারাই গণনা কার্য চালানো হয়ঃ একক, দশক, শতক ইত্যাদি। একশ’ নব্বই’র সংখ্যা দ্বারাই বুঝানো হইয়াছে যে, পূর্ণ দুইশ’র কমে ১৯৯ দিরহাম হইলেও-কোন যাকাত নাই। পরবর্তী কথা হইতে তাহা কারো স্পষ্ট হইয়াছে।
আল্লামা শাওকানী লিখিয়াছেন, দিরহাম বা রৌপ্যমুদ্রার উপর ওজন হিসাবে যাকাত ফরয হইবে, সংখ্যা হিসাবে নয়। অবশ্য ইবনে হুবাইব আল-আন্দালুসী বলিয়াছেনঃ মুদ্রামান বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন হইয়া থাকে। আর ইবনে আবদুল বার-এর মতে দিরহামের ওজনে পার্থক্য হইয়া থাকে। কোন কোন লোকের মতে যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণ নিসাব সংখ্যা হিসাবে নির্দিষ্ট করিতে হইবে, ওজন হিসাবে নয়। কিন্তু এই সব কথাই ইজমা-ঐক্যমতের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপন্থী।
==========================
হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমার যখন দুইশত দিরহামের সম্পদ হইবে এবং উহার এই অবস্থায় একটি বৎসরকাল অতিবাহিত হইবে তখন উহার যাকাত হইবে পাঁচ দিরহাম। আর স্বর্ণের কোনই যাকাত হইবে না যতক্ষণ না উহার অর্থমূল্য বিশ দিনার হইবে। তাই তোমার সম্পদ যখন বিশ দীনার হইবে ও উহার এই অবস্থায় একটি বৎসর অতিবাহিত হইয়া যাইবে, তখন উহাতে অর্থ দীনার (যাকাত ফরয) হইবে।
-আবূ দাউদ
ব্যাখ্যা দুইশত দিরহামের মালিকানা এক বৎসর কাল পর্যন্ত থাকিলে তাহা হইতে পাঁচ দিরহাম যাকাত বাবদ দিতে হইবে। ইহা সর্ববাদীসম্মত আর অধিকাংশ ফিকাহ্বিদের মতে স্বর্ণের ‘নিসাব’-যাকাত হওয়ার নিম্নতম পরিমাণ ‘বিশ দীনার’ অর্থ ২০ মিসকাল। কেননা এক দীনারের স্বর্ণমুদ্রার ওজন এক মিসকাল। এই হিসাবে ২০ দীনারের ওজন বিশ মিসকাল হইবে। এক মিসকাল ৪মাশা। আর মিসকালে ৭তোলা ওজন হইবে। এই হিসাবে কোন দ্বিমত নাই। আর আড়াই ভাগ যাকাত ৪০ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ কাহারো মালিকানায় ৭তোলা স্বর্ণ একটি বছর কাল অতিবাহিত হইলে উহার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত বাবদ আদায় করা ফরয।
আমর ইবনে শুআইব তাঁহার দাদার নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
========================
দুইশত দিরহামের কম পরিমাণে কোন যাকাত ফরয নয়।
মকহুম হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
========================
দুইশতের উপরে আরো চল্লিশ দিরহাম পর্যন্ত না পৌঁছিলে উহার উপর যাকাত হইবে না। হযরত আলী (রা) হইতে অপর এক বর্ণনায় রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি বর্ণিত হইয়াছেঃ
=========================
বিশ দীনার (৭তোলা স্বর্ণের) -এর তমে কোন যাকাত নাই। বিশ দীনার (৭তোলা) হইলে অর্ধ দীনার (আধা মিসকাল) যাকাত দিতে হইবে। আর চল্লিশ দীনারে এক দীনার (পূর্ণ এক মিসকাল) যাকাত দিতে হইবে।
নবী করী (স) এই হিসাবে যাকাত আদায় করিতেন বলিয়া হযরত উমর ও হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করিয়াছেন।
-ইবনে মাজাহ্
স্বর্ণের নিসাব বর্ণিত এই সব হাদীস সনদের বিচারে যয়ীক! কিন্তু সব ফিকাহবিদ নীতি হিসাবে ইহাকেই গ্রহণ করিয়াছেন। স্বর্ণের যাকাত আদায়ে উহার ওজন ভিত্তি হিসাবে গৃহীত, উহার মূল্য নয়। কিন্তু হাদীস সমূহের সনদ দুর্বল হওয়ায় প্রাচীনদের মধ্যে আতা, ভায়ুস, যুহূরী, সালমান ইবনে হারব ও আইয়ুব সখতিয়ানী প্রমুখ ফিকাহবিদের মত হইল স্বর্ণের নিজস্ব কোন নিসাব (যাকাত ফরয হওয়ার ন্যূনতম পরিমাণ) নির্দিষ্ট নাই। যখনই স্বর্ণমূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য মূল্যের সমান হইবে, তখনই উহাতে যাকাত ফরয হইবে।
স্বর্ণ ও রৌপ্যের যে পরিমাণ নির্দিষ্ট নিসাবের বেশী হইবে, তাহা হইতে ২% হিসাবে যাকাত আদায় করা হইবে। এই পরিমাণ কম হউক, আর বেশী হউক।
রহযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
========================
দুইশত দিরহামের কম পরিমাণের উপর কোন যাকাত নাই। উহার বেশী যাহা কিছু হইবে, তাহা হইতে এই (২%) হিসাবেই যাকাত গ্রহণ করা হইবে।
এই কথাটি স্বয়ং নবী করীমের, না হযরত আলীর নিজের সেই বিষয়ে মতভেদ থাকিলেও অধিকাংশ আলিম নীতি হিসাবে ইহাকেই গ্রহণ করিয়াছেন। হযরত উমর (রা) ও হযরত আলী (রা) ইহাই বর্ণিত। কোন সাহাবী ইহার বিপরীত মত দিয়াছেন বলিয়া জানা যায় নাই। অবশ্যই ইমাম আবূ হানীফা ও অন্যান্য ফিকাহবিদদের মত এই যে, স্বর্ণ নিসাব পরিমাণ (২০ দীনার বা ৭) এর বেশী হইবে, তাহাতে তখন পর্যন্ত যাকাত হইবে না, যতক্ষণ উহা (এ অতিরিক্ত স্বর্ণ) চার দীনার (১তোলা) পরিমাণ না হইবে। আর যে রৌপ্য নিসাবের (২০০ দিরহাম-৫২) তোলার) অধিক হইবে, উহার পরিমাণ ৪০ দিরহাম (১০তোলা) না হওয়া পর্যন্ত তাহাতে যাকাত হইবে না।
========================
হাদীসে স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাতের কথা আলাদা আলাদাভাবে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু কাহারও নিকট স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয় থাকিলে ও উহার কোন একটির পরিমাণ হিসাব-পরিমাণ না হইলে তখন যাকাত আদায় করা হইবে কিনা সে বিষয়ে হাদীসে কোন স্পষ্ট উদ্ধৃতি না থাকিবার কারণে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতবিরোধ হইতেছে। ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল, ইবনে আবূ লাইলা ও আবু উবাইদ প্রমুখ বলিয়াছেন, স্বর্ণ ও রৌপ্য দুই ভিন্ন জাতের ধাতু। এই জন্য উহাকে একত্রিত করিয়া যাকাত দেওয়া যাইবে না। পক্ষান্তরে ইমাম মালিক, আওয়ায়ী, সুফিয়ান সওরী, ইমাম আবু হানীফা ও তাঁহার সঙ্গীদ্বয়ের মতে এরূপ অবস্থায় স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয় মিলাইয়া কোন একটির নিসাব পরিমাণ হইলে যাকাত দিতে হইবে। তাঁহাদের কথা হইল, স্বর্ণ ওরৌপ্য উভয়ই একই জাতের ধাতু। আর উভয় মিলিয়া নগদ অর্থ সম্পদ হইয়া যায়। ===============
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নবী করীম (স) -এর সময়ে স্বর্ণ রৌপ্য দীনার ও দিরহামরূপে নগদ মুদ্রা হিসাবে ব্যবহৃত হইত। সেকালে কাগজের নোটের প্রচলন ছিল না। বর্তমান সময়ের ধাতুর মুদ্রা ও কাগজের নোট থাকিলেও তাহা স্বর্ণ ও রোপ্যের স্থলাভিষিক্ত। এই জন্য তাহারও নিকট ধাতুর মুদ্রা ও কাগজের নোট থাকিলেও উহার মূল্যমান স্বর্ণ ও রৌপ্যের নিসাব পরিমাণ হইলে এবং তাহাতে পূর্ণ একটি বৎসর অতিক্রান্ত হইলে উহার উপর যাকাত ফরয হইবে। তাহা নিজের হাতে থাকুক, তাহাতে কোন পার্থক্য নাই।
অলংকার ব্যবহৃত স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত
==========================
আমর ইবনে শুআইব তাঁহার পিতা হইতে-তাঁহার দাদা হইতে-বর্ণিত হইয়াছে, দুইজন স্ত্রীলোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল। তাহাদের দুইজনের হাতে স্বর্ণের অলংকার কংকন ছিল। তখন রাসূলে করীম (স) তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমরা দুইজন তোমাদের এই অলংকারের যাকাত দাও কি? তাহারা বলিলঃ না। তখন রাসূলে করীম (স) সেই দুইজনকে বলিলেনঃ তোমরা দুইজন কি পছন্দ করিবে যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের দুইজনকে আগুনের দুইটি বালা পরাইয়া দিবেন? তাহারা দুইজন বলিল, না। রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তাহা হইলে তোমরা দুইজন এই স্বর্ণের যাকাত আদায় কর। -তিরমিযী
ব্যাখ্যা স্ত্রীলোকদের অলংকারস্বরূপ ব্যবহৃত স্বর্ণ বা রৌপ্যের যাকাত সম্পর্কে এই হাদীস। ইমাম তিরমিযী তাঁহার সুনান গ্রন্থে এই হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর লিখিয়াছেন, এই হাদীসটি আমর ইবনে শুআইব হইতে মুনান্না ইবনুল সাবাহ বর্ণনা করিয়াছেন, আর মুসান্না ও ইবনে লাহিয়াতা উভয়ই যয়ীক বর্ণনাকারী। অতঃপর লিখিয়াছেনঃ
======================
এই পর্যায়ে নবী করীম (স) হইতে কোন কিছুই সহীহরূপে বর্ণিত হয় নাই।
কিন্তু ইমাম তিরমিযীর উক্তি যথার্থ নয়। আবু দাউদে আমার ইবনে শুআইব হইতে এই কথাগুলিই নিম্নোদ্ধৃত ভাষায় বর্ণিত হইয়াছেঃ
=============================
একটি স্ত্রীলোক রাসূলে করীমের নিকট আসিল। তাহার সঙ্গে ছিল তাহার কন্যা। তাহার কন্যার হাতে ছিল স্বর্ণ নির্মিত মোটা-পুরু বালা। যখন নবী করিম (স) হাতাকে বলিলেনঃ তুমি কি ইহার (অলংকারের)যাকাত আদায় কর? সে বলিলঃ না। নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি কি আনন্দ পাইবে আল্লাহ তা’আলা যদি কিয়ামতের দিন এই দুইটির স্থলে দুইটি আগুনের কাঁকন তোমাকে পরাইয়া দেন? অতঃপর স্ত্রীলোকটি কাঁকন দুইটি খুলিয়া ফেলিল এবং নবী করীমের দিকে ফেলিয়া দিল ও বলিলঃ এই দুইটি আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের জন্য (দান করিলাম)।
ইবনুল কাতান বলিলেন, এই হাদীসটির সনদ সহীহ। মূনযেয়ী বলিয়াছেনঃ ইহার সনদে কোন আপত্তি উঠে নাই।
মুসনাদে আহমদে এই হাদীসটির ভাষা নিম্নরূপঃ
========================
নবী করীম (স) -এর নিকট দুইজন স্ত্রীলোক আসিল। তাহাদের দুইজনের হাতে স্বর্ণের কাঁকন ছিল। তখন নবী করীম (স) তাহাদের দুইজনকেই বলিলেনঃ তোমরা দুইজন কি পছন্দ কর যে, আল্লাহ, তা’আলা কিয়ামতের দিন তোমাদের দুইনকে আগুনের কাঁকন পরাইয়া দিবেন? সে দুইজন বলিলঃ না। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তাহা হইলে তোমাদের হাতে পরা জিনিসের হক তোমরা আদায় কর।
ব্যাখ্যা স্ত্রীলোকদের ব্যবহৃত রৌপ্য ও স্বর্ণের অলংকারের যাকাত সম্পর্কে এই হাদীস। এই পর্যায়ে আরো বহু হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। হযরত আসমা ও হযরত আশো (রা) হইতেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।
এই পর্যায়ে বর্ণিত হাদীসসমূহের সারকথা এই যে, স্ত্রীলোকদের স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত অলংকারের যাকাত আদায় করা ফরয। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ও আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) অলংকারের যাকাত দেওয়া ফরয বলিয়াছেন। ইমাম আবু হানীফাও অন্যান্য হাদীস হইতে দলীল পেশ করেন। বিশেষত কুরআন মজীদের আয়াতঃ
======================
যাহারা স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করিয়া রাখে। এবং রাসূলের বাণী-
============== সোনা-চাদিঁর চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত দেয়। হইতেও অলংকারের যাকাত আদায় করা ফরয প্রমাণিত হয়।
আর এক শ্রেণীর লোকের মতে অলংকারের যাকাত দেওয়া ওয়াজিব নহে। তাঁহারা হইতেছেনঃ ইবনে উমর, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ, আয়েশা (রা), কাসেম শা’বী কাতাদাহ, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, উমরাতা এবং ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল। তাঁহাদের দলীল হইতেছে দারে কুতনী উদ্ধৃত ও হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত হাদীসঃ
================ অলংকারের কোন যাকাত নাই।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই শেষোক্ত (অলংকারের যাকাত না হওয়া সংক্রান্ত) হাদীসের কোন ভিত্তি নাই-ইহা বাতিল। ইমাম বায়হাকীর মতে এই হাদীসের র্বণনাকারীদের মধ্যে আফীয়া ইবনে আয়ুব অজ্ঞাত ব্যক্তি =========। তিনি বলিয়াছেনঃ
========================
এই হাদীসটিকে মরফু মনে করিয়া যে উহাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করিবে, সে তাহার দ্বীনের ব্যাপারে প্রতারিত হইবে এবং বিরোধীরা যেমন বলে- মিথ্যাবাদীদের বর্ণনাকে দলীল মানিয়া লওয়া দোষে দোষী হইবে।
উপরের উদ্ধৃত হাদীসও এই পর্যায়ের। অন্যান্য হাদীসের মূল প্রতিপাদ্য কথা এই যে, অলংকার হিসাবে ব্যবহৃত স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপরও হক রহিয়াছে-উহারও যাকাত দিতে হইবে। যাকাত না দিলে জাহান্নমে যাওয়ার জন্য উহাই যথেষ্ট হইবে।
হযরত আসমা বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ নবী করীম (স) তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত মেয়েলোক দুইজনকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
========= তোমরা দুইজন কি এই অলংকারের যাকাত দাও? তাঁহারা বলিলেনঃ না। তখন রাসূল (স) বলিলেনঃ
========================
আল্লাহ্ যে তোমাদের দুইজনকে আগুনের অলংকার পরাইয়া দিবেন, তাহা কি তোমরা ভয় কর না? ভয় করিলে উহার যাকাত দাও।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছে, একদা রাসূলে করীম (স) হযরত আয়েশার হস্তে স্বর্ণ বা রৌপ্যের অলংকার দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ উহা কি? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ
========================
আমি এইগুলি তৈয়ার করাইয়াছি আপনার জন্য আমার সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
============ তুমি কি এইগুলির যাকাত আদায় কর?
উত্তরে হযরত আয়েশা (রা) ‘না’ বলিলে নবী করীম (স) বলিলেনঃ
=========== জাহান্নামে যাওয়ার জন্য ইহাই তোমার পক্ষে যথেষ্ট। প্রসঙ্গত হযরত উম্মে সালমা (রা) বর্ণিত হাদীসের প্রতিও ইঙ্গিত করা আবশ্যক। তিনি স্বর্ণের নানা অলংকার পরিধান করিতেন। তিনি রাসূলে করীম (স)- জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ইহাকে কি কুরআনে ধিকৃত ==== সঞ্চয় বলা যায়? উত্তরে নবী করীম (স) বলিলেনঃ
=========================
উহার ওজন বা মূল্য যাকাত পরিমাণ পর্যন্ত পৌছিলেঁ ও উহার যাকাত আদায় করা হইলে উহা আর ‘সঞ্চয়’ ==== থাকে না। (এবং উহার জন্য নির্দিষ্ট আযাবও ভোগ করিতে হয় না)।
অলংকার হিসাবে ব্যবহৃত স্বর্ণ ও রৌপ্যে যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে অতঃপর আর কোন সন্দেহই থাকিল না। ========================
কৃষি ফসলে যাকাত
======================
সালেম ইবনে আবদুল্লাহ্ তাঁহার পিতার নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি (আবদুল্লাহ) বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ বৃষ্টি, খাল বা ঝর্ণার পানি হইতে সিক্ত কিংবা নিজস্বভাবে সিক্ত জমির ফসলে ওশর ধার্য করা হইয়াছে। আর যে কোন সেচ ব্যবস্থার ফলে সিক্ত জমির ফসলের অর্ধেক ওশর দিতে হইবে। -আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ্
ব্যাখ্যা কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে কেবল নগদ টাকা, স্বর্ণ-রৌপ্য বা পণ্যদ্রব্যের উপরই যাকাত ফরয নয়, কৃষিজাত ফসল ও শস্যের উপরও যাকাত ধার্য হইয়াছে। হাদীসের পরিভাষায় এই যাকাতকে ‘ওশর’ বা ‘অর্ধ-ওশর’ বলা হয়। উহার অর্থ মোট উৎপন্ন ফসলের এক-দশমাংশ কিংবা বিশ ভাগের এক ভাগ। এই ওশর বা অর্ধ ওশরও সাধারণ যাকাতের মতই ফরয। কুরআনে মজীদে বলা হইয়াছেঃ
========================
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমাদের পবিত্র ও হালাল উপার্জন হইতে এবং তোমাদের জন্য জমি হইতে যে ফসল উৎপন্ন করি, তাহা হইতে তোমরা ব্যয় কর।
এই আয়াতে যে ব্যয় করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, উহার অর্থ সর্বসম্মতভাবে যাকাত এবং ওশর দেওয়া। ইহা এই আয়াতের দৃষ্টিতেও স্পষ্টভাবে ফরয। দ্বিতীয়ত, জমির কেবল উঃপন্ন ফসলই নয়, জমির গভীরে লুক্কায়িত ধন-সম্পদ ও খনি ইত্যাদির ক্ষেত্রেও যাকাত ফরয করার কথা বলা হইয়াছে। আল্লামা ইবনুল আবারী লিখিয়াছেনঃ মানুষের উপার্জন দুই প্রকারের। এক প্রকার উপার্জন জমির উপরিভাগ বা উহার গর্ভ হইতে। সমস্ত প্রকার উদ্ভিদ, গাছপালা, গুল্ম-লতা ইহার অন্তর্ভুক্ত। আর দ্বিতীয় প্রকার জমির উপর চলাচল করিয়া করা হয়। যেমন ব্যবসায়র, যুদ্ধ, শিকার ইত্যাদি। এই প্রেক্ষিতে উপরিউক্ত আয়াতে ধনী ও স্বচ্ছল অবস্থার লোকদিগকে তাহাদের গরীব ভাইদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে! এই ব্যয়টা কি নিয়মে ও কি পরিমাণে করিতে হইবে, নবী করীম (স) তাঁহার উপরোদ্ধৃত হাসীসে তাহাই বলিয়াছেন। এই জন্য তিনি একটি মূলনীতি নির্ধারিত করিয়া দিয়াছেন।
কুরআনে এই পর্যায়ের দ্বিতীয় আয়াত হইলঃ
=========================
তোমরা গাছ-গাছালির ফল ও ফসল খাও, যখন উহা ফল ও ফসল দিবে। আর উহার কাটাই-মাড়াইর দিনই উহার হক আদায় করিয়া দাও এবং এই ব্যাপারে সীমালংঘনমূলক কাজ করিও না। কেননা আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালোবাসেন না।
আয়াতটিতে প্রথম ফল-ফসলের মালিককে আহার করিতে বলা হইয়াছে। পরে উহার হক আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। নিয়ামতের ব্যাপারে এই দুইটি আল্লাহর নির্দেশ। দ্বিতীয় নির্দেশটি পালনের পন্থা হইল যাকাত বা ওশর দেওয়া। ইহা ফরয যাকাত বা ওশর সঙক্রান্ত নির্দেশ। প্রথম উদ্ধৃত আয়াতে জমির উৎপন্ন যাবতীয় সম্পদে যাকাতের কথা মোটামুটি বলা হইয়াছে। দ্বিতীয় আয়াতে উহার বিশেষ নির্ধারণ হইয়াছে জমির ফসল-ফলাদি সম্পর্কে। কিন্তু পরিমাণ বলা হয় নাই। আর পরিমাণ ও যাকাত আদায়ের নিয়ম রাসূলে করীম (স) নিজে হাদীসের মাধ্যমে বলিয়া দিয়াছেন। তবে শেষোক্ত আয়াতে ফল-ফসলের যাকাত আদায়ের সময় নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে ‘উহা কাটাই-মাড়াইর দিন সঙ্গে সঙ্গে আদায় করিতে হইবে। মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিমাতা এই মত দিয়াছেন। দ্বিতীয় মত, ফসল পাকার পর আদায় করিতে হইবে। কেননা ফসল পরিপক্ষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উহা ঘাসের সমপর্যায়ের-খাওয়ার অনুপযুক্ত। নিয়ামত পূর্ণ হইলেই উহার হক আদায়ের প্রশ্ন উঠে, তাহার পূর্বে নয়।
তৃতীয় মত, কাটাই-মাড়াই সম্পূর্ণ হইয়া যাওয়ার পর উহার পরিমাণ করা হইলে তবে যাকাত বা ওশর দিতে হইবে। কেননা ইহা না হওয়া পর্যন্ত ওশর বাবত যে কত দিতে হইবে, তাহা জানিবার উপায় নাই। ইমাম শাফেয়ী ও আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ ইমাম ও জমহুর ফিকাহবিদের মত ইহাই। ইমাম আবু হানীফা ও তাঁহার সঙ্গীদ্বয়-ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মত হইল ফসল ও ফলাদি যখন ফলিত শুরু করে, ওশর দেওয়ার ফরয সেই সময়ই ধার্য হইয়া যায়, কার্যত আদায় করা যখনই সম্ভব হউক না কেন। ================
জমিতে ফসল ফলাইবার জন্য পানি অপরিহার্য। এই কারণে জমির অবস্থা বিভিন্ন হইয়া থাকে। কোন কোন জমি স্বতঃই সিক্ত ও চাষোপযোগী হইয়া থাকে। উহাতে পানি সেচের কোন প্রয়োজন হয় না। কোন কোন জমি বৃষ্টি কিংবা খাল-নালা-ঝর্ণা ইত্যাদির পানিতে সিক্ত হয়। উহাতে পানি সেচ করার জন্য উৎপাদককে কোন শ্রম করিতে বা অর্থ ব্যয় করিতে হয় না। এই কারণে এই উভয় প্রকারের জমির মোট ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ-ওশর-যাকাত বাবত দিতে হইবে।
পক্ষান্তরে অনেক জমিতে কৃত্রিম উপায়ে পানি সেচ করিতে হয়। সেইজন্য বলদ কিংবা কোন যন্ত্র খাটাইতে হয় অথবা কায়িক শ্রমে নিজেকে কিংবা মজুরীর বিনিময়ে লোকের দ্বারা পানি সিঞ্চন করিতে হয়। এই কারণে উহার মোট ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ অর্ধ ওশর, ==== যাকাত বাবত দিতে হইবে। এইরূপ পার্থক্যের কথা নবী করীম (স) নিজেই উপরিউক্ত হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছেন। আল্লামা খাত্তাবী এই পার্থক্যের কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ
==========================
[স্বরণীয়, উপরিউক্ত আয়াতের শেষ অংশে সীমালংঘন করিতে নিষেধ করা হইয়াছে। এই বিষেধ ইহার পূর্ববর্তী দুইটি নির্দেশ সম্পর্কেই প্রযোজ্য অর্থাৎ নিজের খাওয়ার ব্যাপারে সীমালংঘন করা যেমন নিষিদ্ধ, অনুরূপভাবে আল্লাহ্র দেওয়া নিয়ামত লাভের দরুন উহার সহিত গরীব জনগণের যে হক মুক্ত হইয়াছে, তাহা না দেওয়াও সীমালংঘন। আর এই দুইটিই নিষিদ্ধ।]
যে জমিতে ফসল ফলাবার জন্য অল্প পরিশ্রম করিতে হয় ও অল্প পরিশ্রমে অধিক পরিমাণে মুনাফা বা ফসল লাভ করা যায়, তাহাতে রাসূলে করীম (স) দ্বিগুণ যাকাত (ওশর) ধার্য করিয়াছেন। এইরূপ ধার্য করার মূলে গরীব মিসকীনদের প্রাপ্য পরিমাণ বৃদ্ধি ও প্রশস্ত করাই উদ্দেশ্য। আর যেসব জমিতে অধিক শ্রম বা অর্থ ব্যয় করিতে হয়, তাহাতে জমি মালিক (উৎপাদক)-দের প্রতি সহনযোগ্য করার জন্য উহার অর্ধেক পরিমাণ (বিশ ভাগের এক ভাগ) যাকাত (ওশর) ফরয দিয়াছেন।
বস্তুত মূল হাদিসিটিতেই জমির সেচ ব্যবহার পার্থক্যের কারণে যাকাত (ওশর) ধার্য করিয়াছেন। এইরূপ ধার্য করার মূলে গরীব-মিসকীনদের প্রাপ্য পরিমাণ বৃদ্ধি ও প্রশস্ত করাই উদ্দেশ্য। আর যেসব জমিতে অধিক শ্রম বা অর্থ ব্যয় করিতে হয়, হাতাতে জমি মালিক (উৎপাদক) দের প্রতি সহনযোগ্য করার জন্য উহার অর্ধেক পরিমাণ (বিশ ভাগের এক ভাগ) যাকাত (ওশর) ফরম করিয়া দিয়াছেন।
বস্তুত মূল হাদিসিটিতেই জমির সেচ ব্যবস্থার পার্থক্যের কারণে যাকাত (ওশর) পরিমাণে পার্থক্য করা হইয়াছে। ইহা হইতে স্বতঃই জানা যায়, যেসব জমিতে উভয় পদ্ধতিতে (স্বাভাবিকভাবে ও কৃত্রিমভাবে) সেচ কার্য সমাধা হয়, সে সব জমির ফসলের দশ ভাগের এক ভাগের তিন চতুর্থাংশ যাকাত বাবত দিতে হইবে। ইহা সর্ববাদীসম্মত। ===================
বলা বাহুল্য, ওশরের ব্যাপারে স্বয়ং নবী করীম (স)-ই যখন খরচ বাদ দিয়া পরিমাণ ধার্য করিয়া দিয়াছেন, তখন অন্য কোন দিক দিয়া খরচ বাদ দেওয়ার কোন প্রশ্ন উঠিতে পারে না।
শস্য ও ফলের যাকাত
===========================
হযরত আবূ মুসা ও হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) যখন তাঁহাদের দুইজনকে ইয়েমেনে সেখানকার লোকদিগকে দ্বীন-ইসলামের বিষয়াদি শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে পাঠাইয়াছিলেন, তখন এই নির্দেশ দিয়াছিলেন যে, এই চার প্রকারের ফসল ছাড়া অন্য কিছু হইতে যাকাত গ্রহণ করিবে নাঃ যব, গম, কিশমিশ ও খেজুর। -মুস্তাদ্রাক হাকেম
ব্যাখ্যা প্রথমত হাদীসটি হইতে জানা যায়, নবী করীম (স) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে সেখানকার জনগণকে দ্বীন ইসলামের জরুরী বিষয়াদি শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে নির্বাচিত ও মনোনীত লোকদের পাঠাইতেন এবং বিভিন্ন অঞ্চল-রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে যেসব শাসনকর্তা প্রেরণ করিতেন, দ্বীন-ইসলামের ব্যাপক আইন বিধানের প্রচার ও উহা কার্যকর করণের দায়িত্ব তাহাদের উপর অর্পণ করিতেন। হাদীসটিতে উদ্ধৃত হযরত আবূ মুসা ও হযরত মু’আয ইবনে জাবাল এই পর্যায়েরই লোক ছিলেন।
দ্বিতীয় জানা যায়, জমি ও বাগানে উৎপন্ন শস্য, দানা, বীজ ও ফল-ফলাদির উপর যাকাত ধার্য হইয়াছে। উদ্ধৃত হাদীসে মাত্র চার প্রকারের ফসলের উল্লেখ হইয়াছেঃ যব, গম, কিশমিশ ও খেজুর। হাদীসের ভাষা হইতে মনে হয়, এই কয়টি ছাড়া অন্য কোন ফল বা ফসলে যাকাত নাই। কিন্তু হয় এই হাদীসটির বর্ণনাকারী পঞ্চম জিনিসটি ভুলিয়া গিয়াছেন, না হয় ইয়েমেন তখনকার সময় এই কয়টিই প্রধান ফসলরূপে পরিজ্ঞাত ছিল। কেননা হযরত উরম (রা) বর্ণিত এবং দারে কুতনী ও ইবনে মাজাহ গ্রন্থদ্বয়ে উদ্ধৃত হাদীসে একটি অতিরিক্ত জিনিস ==== এর উল্লেখ হইয়াছে। তাহার ভাষা হইলঃ
========================
নবী করীম (স) গম, যব, খেজুর, কিশমিশ ও দানা শস্যের উপর যাকাত চালু করিয়াছিলেন।
এই হাদীসসমূহ হইতে শস্য ও ফল-ফলাদিতে যাকাত ধার্য হওয়ার কথা- কোনরূপ পরিমাণ নির্ধারণব্যতীতই- জানা যায়। শস্য ফল-ফলাদির কত পরিমাণ হইলে যাকাত আদায় করিতে হইবে, ইহার উল্লেখ হয় নাই। এই ক্ষেত্রে দশ ভাগের এক ভাগ কিংবা বিশ ভাগের এক ভাগ জমির সেচ ব্যবস্থার পার্থক্যের কারণে যাকাতের পরিমাণে পার্থক্য এই যে, যহরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণিত হাদীসে এইসব ফসল ও ফল-ফলাদির ‘নিসাব’ উল্লেখ করা হইয়াচে। উহার ভাষা এইঃ
==========================
পাঁচ অসক খেজুর বা বীজদানার কম পরিমাণে যাকাত নাই।
হযরত আবু সাঈদ খুদরীরই অপর এক বর্ণনায় উদ্ধৃত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
=============== এক অসক-এ ষাট সা’ হয়। [এক অসক=১২০ কিলোগ্রাম।]
ইহা সর্বসম্মত। কিন্তু এক সা’র হিজারী পরিমাণ ৫রতল এবং ইরাকী পরিমাণ ৮ রতল। আর এক রতল-এ সর্বসম্মতভাবে ৭ছটাক। ফলে পাঁচ অসকে হিজাযী ওজনে ১৮ মণ ৩০ সের এবং ইরাকী ওজনে ২৮ মণ ৫ সের। ইমাম আবু হানীফা এবং কুফা’র অন্যান্য ফিকাহবিদগণ ইরাকী ওজন গ্রহণ করিয়াছেন। আর ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও অন্যান্য ইমামগণ হিজাযী ওজন অনুযায়ী হিসাব লাগাইয়াছেন। আলোচ্য হাদীসের আলোকে যাহার অন্ততঃ ১৮ মণ ৩০ সের ফসল উৎপন্ন হইবে, উহাতে ওশর দিতে হইবে। আর হানাফী ওজন মতে যাহার অন্ততঃ ২৮ মণ ৫ সের ফসল হাতে আসিবে তাহাকে ওশর দিতে হইবে। স্মরণীয় যে, ইমাম আবু হানীফা জমির ফসল ফলাদিতে কোন ন্যূতম পরিমাণ মানেন না।
=================
আল্লামা কাসানী লিখিয়াছেনঃ
=============================
ইমাম আবূ হানীফার মতে জমির ফসল ফলাদি কম হউক বা বেশী হউক তাহা হইতে ওশরদিতে হইবে। তাঁহার মতে ইহা নিসাব-ন্যূনতম পরিমাণ কিছু নাই। কিন্তু ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে পাঁচ অসক-এর কম পরিমাণ ফসল-ফলাদিতে ওশর দেওয়া ওয়াজিব নয়।
হযরত ইবনে আব্বাস, যায়দ ইবনে আলী ও নখয়ীর নিকটও জমির উৎপন্ন ফসলে যাকাত হওয়ার কোন নিসাব নির্দিষ্ট নাই। এই পর্যায়ে ইহাদের প্রথম দলীল হইল কুরআনের দুইটি আয়াত।
একটিঃ =======================
হে ইমামদারগণ। তোমরা যে পবিত্র সম্পদ উপার্জন কর এবং আমরা যে ফসল-ফলাদি তোমাদের জন্য জমি হইতে উৎপন্ন করিয়া দেই উহা হইতে ব্যয় কর।
দ্বিতীয় আয়াতঃ
=======================
এবং ফসল-ফলাদি কাটাই-মাড়াইর দিনইউহার হক যাকাত অর্থাৎ ওশর আদায় করিয়া দাও। দ্বিতীয় দলীল হাদীস। এমন বহু হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে, যাহাতে ওশর ফরয হওয়ার কথা বলা হইয়াছে; কিন্তু কোন নিসাব বা ন্যূনতম পরিমাণের উল্লেখ নাই। যেমনঃ
================
বৃষ্টির পানিতে সিক্ত জমির ফসলে ওশর এবং যাহা কোনরূপ সেচ ব্যবস্থার সাহায্যে সিক্ত হয়, তাহাতে অর্ধ-ওশর-বিশ ভাগ দিতে হইবে।
বস্তুত এইসব হাদীসে ওশর বা অর্ধ ওশর ফরয হওয়ার কথাই ঘোষিত হইয়াছে; কিন্তু নিসাবের কোন পরিমাণের উল্লেখ হয় নাই। কাজেই এই দলীল অনুযায়ী ফসল-ফলাদির পরিমাণ যাহাই হউক না কেন ওশর দিতে হইবে।
যেসব হাদীসে নিসাবের উল্লেখ হইয়াছে, যেস সম্পর্কে ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্য হইল, উহা ব্যবসায় পণ্যের যাকাতের নিসাবের পরিমাণ। কেননা সেকালে লোকেরা শস্য ও ফল-ফলাদির ব্যবসায় এই হিসাব অনুযায়ী করিত; আর এক অসক-এর মূল্য ৪০ দিরহাম ও পাঁচ অসক-এর মূল্য ২০০ দিরহাম ব্যবসায় পণ্যের নিসাব গণ্য হইত। এই কারণে সেসব হাদীস হইতে নিসাব নির্ধারিত হয় না। দ্বিতীয় এইসব গরীব বা খবরে ওয়াহিদ [===== ‘গরীব’ ও ====== ‘খবরে ওয়াহিদ’ এই দুইটি শব্দ ইলসে হাদীসের বিশেষ পরিভাষা। ==== ‘গরীব’ বলা হয় সেই হাদীসকে যাহার বর্ণনা পরস্পরা ধারায় কোন এক স্তরে কেবলমাত্র একজন বর্ণনাকারী, কিন্তু যে হাদীসের বর্ণনা পরস্পরা ধারার সকল পর্যায়ে একজন মাত্র বর্ণনাকারী এবং সেই হাদীসটি অন্য কোন বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত হয় নাই, ইহা ’খবরে ওয়াহিদ’-এর এক প্রকার। আর ‘খবরে ওয়াহিদ’ সেই হাদীস যাহা একক বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত। =================] পর্যায়ের। আর খবরে ওয়াহিদ পর্যায়ের হাদীস দ্বারা কুরআন ও অন্যান্য সহীহ হাদীসের বিপরীত কিংবা অতিরিক্ত কথা প্রমাণ করা যায় না।
ইমাম আবু হানীফার মতে জমিতে উৎপন্ন যে কোন জিনিস হউক-ফল-শস্য ও ঘাস বা শাক-সবজি-সব কিছুতেই ওশর ফরয হয়। কেননা কুরআন ও হাদীসের উপরোদ্ধৃত দলীলসমূহে সাধারণভাবে জমিতে উৎপন্ন সব কিছুর উপর ওশর ফরয হওয়ার কথা বলা হইয়াছে। কোন জিনিসকেই উহা হইতে বাদ দেওয়া (Exempted) হয় নাই। দ্বিতীয়ত, ওশর ওয়াজিব হওয়ার মূল ভিত্তি হইল উৎপন্ন উর্বর জমি।
কিন্তু এখানে সর্বপ্রথম যে হাদীসটি উদ্ধৃত করা হইয়াছে, তাহা হইতে বুঝা যায় যে, ঘাস ও শাক-সবজি ইত্যাদির ওশর দিতে হইবে না। আতা ইবনে সাযেব বর্ণনা করিয়াছেন, আবদুল্লাহ্ ইবনে মুগীরা ঘাস ও শাক-সবজির ওশর আদায় করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু মুসা ইবনে তাল্হা তাহাতে বাধা দান করিলেন। বলিলেনঃ আপনার এইরূপ করার অধিকার নাই। কেননা নবী করীম (স) বলিতেনঃ
==================== এইগুলিতে ওশর ধার্য হয় না।
অবশ্য এই পর্যায়ে আরো বহু হাদীস বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত উমর (রা) হইতেও বর্ণিত হইয়াছে।
=================== শাক-সবজিতে ওশর নাই।
হযরত আলী (রা) হইতেও বর্ণিত হইয়াছে।
=============
ঘাস ও শাক-সবজিতে ওশর দিতে হয় না।
এই পর্যায়ের হাদীসসমূহের সনদ সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপিত হইয়াছে। তবে উহার জওয়াবে বলা হইয়াছে যে, এই হাদীসসমূহ বহু সূত্র হইতে বর্ণিত হইয়াছে বিধায় ইহা গ্রহণযোগ্য।
ফল-ফরাদির যাকাত সম্পর্কে নবী করীম (র) হযরত আবু বকর, হযরত উমর (রা) ও পরবর্তী খলীফাদের হইতে বর্ণিত হইয়াছে, এইগুলির পরিমাণ বা সংখ্যা অনুমানের ভিত্তিতে ওশর আদায় করাই নিয়ম।
কিন্তু এই ক্ষেত্রে এই কথাও স্মরণীয় যে, সব রকমের ফল-ফলাদিতে ওশর ফরয নয়। ইহা ফরয কেবল সেই সব ফল-ফলাদিতে যাহা লওয়ার পর অন্তত এক বৎসরকাল টিকিয়া থাকে, নষ্ট হয় না বা পঁচিয়া যায় না। যেসব ফল-ফলাদি এক বৎসরকাল টিকে না-যেমন আম, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস ইত্যাদি, তাহাতে ওশর ফরয নয়। তবে এদেশের নারিকেল, সুপারী ইত্যাদিতে ওশর ধার্য হইতে পারে বলিয়া মনে হয়। আল্লামা বদরুদ্দন আইনী লিখিয়াছেঃ
==========================
যেসব ফল-ফলাদি এক বৎসরকাল টিকিয়া থাকে-নষ্ট হয় না-পচে না, কেবল তাহাতেই ওশর ফরয হয়।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলিয়াছেনঃ
=========================
যেসব ফল-ফলাদির স্থিতি আছে- সহসা পচিয়া যায় না-কেবল তাহাতেই ওশর ফরয হয়।
ব্যবসায় পণ্যের যাকাত
============================
হযর সামুরাতা ইবনে জুনদুব (রা) হইতে বর্ণিত হ্ইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ অতঃপর বক্তব্য এই যে, রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে সেই সব জিনিস হইতে-যাহা আমরা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে তৈয়ার করি-যাকাত দিতে আদেশ করিয়াছেন। -আবু দাউদ, দারে কুতনী, রায়হাকী
ব্যাখ্যা ইমাম শাওকানী এই হাদীসের ভিত্তিতে লিখিয়াছেন, ব্যবসায় পণ্যের যাকাত দেওয়া ফরয। এই সম্পর্কে ফিকাহ্বিদদের মধ্যে ‘ইজমা’-মতৈক্য রহিয়াছ্ এই ব্যাপারে মতবিরোধ করিয়াছেন কেবলমাত্র যাহেরী মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণ। তাঁহার ভাষা এইরূপঃ
=========================
আল্লাহ্র নামে যিনি দয়াময় করুণশীল। সামুরাতা ইবনে জুনদুব হইতে তাহার পুত্রের প্রতি তোমাদের প্রতি সালামঃ নিশ্চিত জানিও, নবী করীম (স) আমাদিগকে আদেশ করিতেন যে,- ব্যবসায় পণ্য হিসাবে রাখা ক্রীতদাসেরও যাকাত আদায় করিতে হইবে।
হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয় তাঁহার খিলাফত আমলে এই হাসীসের ভিত্তিতে ব্যবসায় পণ্যের যাকাত আদায় করার নির্দেশ জারী করিয়াছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) সম্পর্কেও বর্ণিত হইয়াছেঃ
===========================
তিনি বলিতেন, প্রত্যেক পণ্যে তাহা ক্রীতদাস হউক, কিংবা জন্তু-জানোয়ার যাহা ব্যবসায়ের পণ্য হিসাবে গৃহীত, প্রত্যেক বৎসর উহার উপর যাকাত আবর্তিত হইবে।
ওরওয়া ইবনুয যুবাইর, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, কাসেম প্রমুখ ফিকাহ্বিদ বলিয়াছেনঃ
======================
পণ্য দ্রব্যে প্রত্যেক বৎসর যাকাত অবর্তিত হইবে। এক বৎসর যে মাসে যাকাত আদায় করা হইল, পরবর্তী বৎসর সেই মাসে আবার যাকাত আদায় করা হইবে, তাহার পূর্বে নয়।
হযরত ইবনে উমরের আর একটি উক্তি হলিঃ
=======================
যেসব জিনিসপত্র ব্যবসায় পণ্যরূপে তৈয়াব করা হইয়াছে যাহাতে যাকাত ধার্য হইয়াছে। যাহা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে নয় উহাতে যাকাত নাই।
আমর ইবনে হিশাম তাঁহার পিতার নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, ‘আমি চামড়া ও তীর বিক্রয় করিতাম’। একদিন হযরত উমর (রা) আমাকে বলিলেনঃ ‘তোমার মালের যাকাত দাও। এই বর্ণনার ভিত্তিতে হাম্বলী মাযহাব অনুযায়ী যাকাত বাবদ মূল্য গ্রহণ করা হয় দ্রব্য নয়-হানাফী মাযহাবে উভয়ই গ্রহণ করা যাইতে পারে।
==============
গরু-মহিষের যাকাত
=========================
হযরত মু;আয ইবনে জাবাল (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) যখন তাঁহাকে ইয়েমেনে পাইলেন, তখন তাঁহাকে নির্দেশ দিলেন যে, গরুর প্রত্যেক ত্রিশটি হইতে এক বৎসর বয়স্ক একটি দামড়া বা দামড়ি যাকাত বাবদ গ্রহণ করিতে হইবে এবং প্রত্যেক চল্লিশটি হইতে দুই বৎসর বয়স্ক একটি দামড়ি লইতে হইবে। আর প্রত্যেক অমুসলিম পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির নিকট হইতে জিযিয়াস্বরূপ এক দীনার কিংবা উহার স্থলে ইয়েমেনে তৈরী মুআফিরী কাপড় গ্রহণ করিতে হইবে।- আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, বায়হাকী
ব্যাখ্যা হাদীসটি হইতে গরুর যাকাত সম্পর্কে বিধান জানা গেল। ইয়েমেনের শাসনকর্তা ও যাকাত আদায়কারীরূপে হযরত মু’আযকে রাসূলে করীম (স) পাঠাইয়াছিলেন। এই সময় গরুর যাকাত আদায় করার নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উহার নিসাবও জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহা হইতে জানা গেল যে, গরুর সংখ্যা যতক্ষণ পর্যন্ত উহার উপর যাকাত ধার্য হইবে না। আর যখনই উহার সংখ্যা ত্রিশটি হইবে, তখনই উহা হইতে এক বৱসর বয়সের একটি দামড়া বা দামড়ি যাকাত বাবদ গ্রহণ করিতে হইবে। ত্রিশটির পর চল্লিশ সংখ্যা পর্যন্ত না পৌঁছিলে ত্রিশের অতিরিক্ত গরুর উপর যাকাত হইবে না। যখনই সংখ্যা চল্লিশটি হইবে, তখনই উহার উপর যাকাত হইবে এবং উহা হইতে দুই বৎসর বয়স্ক একটি দামড়ি গ্রহণ করিতে হইবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
=========================
নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, প্রত্যেক ত্রিশটি গরুতে একটি এক বৎসর বয়ষ্ক দামড়া কিংবা দামড়ি এবং প্রত্যেক চল্লিশটি হইতে দুই বৎসর বয়স্ক দামড়ি গ্রহণ করিতে হইবে।
============== যে বাছুরের বয়স এক বৎসর পূর্ণ হইয়াছে ও দ্বিতীয় বৎসরে পদার্পণ করিয়াছে। এই বয়স্ক বাছুরের এইরূপ নামকরণের কারণ হইল, উহা মা হইতে বিচ্ছিন্ন হয় না, মা’র সঙ্গে সঙ্গে থাকে। আর ===== বলা হয় সেই বাছুরকে যাহার বয়স দুই বৎসর পূর্ণ হইয়াছে এবং তৃতীয় বৎসরে পদার্পণ করিয়াছে। হযরত ইবেন আব্বাস (রাঃ) হইতে তাবারানীতে এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে।
হাদীসটি হইতে নিঃসন্দেহে জানা গেল যে, গরুর যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। আর উহার নিসাব তাহাই যাহা এই হাদীসে বলা হইয়াছে। আল্লামা ইবনে আবদুল বার লিখিয়াছেনঃ
===========================
হযরত মু’আয (রা) বর্ণিত এই হাদীসটি অনুযায়ী গরুর যাকাত আদায় করা রাসূলে করীম (স)-এর প্রতিষ্ঠিত নিয়ম, এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোনই মতবিরোধ নাই।
উল্লেখ্য, চার ইমামের ঐকমত্য এই যে, গরুর মত মহিষেরও যাকাত হইবে এবং এই দুইটি জন্তুর নিসাব একই হিসাবে চলিবে।
=========================
এখানে এই কথাও স্মরণীয় যে, শুধু চাষাবাদ বা বোঝা টানার উদ্দেশ্যে যে গরু-মহিষ রাখা হয়, তাহার সংখ্যা নিসাব মাত্রার সমান বা তদুর্ধ হইলেও তাহাতে যাকাত ফরয নয, যাকাত কেবল সেই সব গরু-মহিষে যাহা বংশ বৃদ্ধি ও ব্যবসায় তথা মুনাফার উদ্দেশ্যে রাখা ও পালা হইবে। অবশ্য কোন কোন ফকীহর মতে প্রথমমোক্ত গরু-মহিষের অন্ততঃ একবার যাকাত দেওয়া উচিত।
ছাগল ভেড়ার যাকাত
=============================
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) যাকাতের বিধান লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার ইন্তেকালের পূর্বে তাঁহার কর্মচারীদের সম্মুখে পেশ করেন নাই। তাঁহার পর হযরত আবু বকর (রা) উহা বাহির করিয়া তদানুযায়ী যাকাত আদায় করার কাজ সম্পন্ন করেন। তাঁহার ইন্তেকালের পর হযরত উমর (রা) উহা বাহির করিয়া তদানুযায়ী কাজ করেন। তিনি যখন শহীদ হন তখন উহা তাঁহার অসীয়তনামার সহিত নথি করা অবস্থায় পাওয়া যায়। উহাতে উটের যাকাত সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনার পর ছাগল সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ ছাগলের চল্লিশটির মধ্য হইতে একটি ছাগী যাকাত বাবদ গ্রহণ করা হইবে। একশ বিশটি ছাগল পর্যন্ত এই যাকাত। ইহার বেশী হইলে দুইটি ছাগল যাকাত বাবদ দিতে হইবে, ইহা দুইশতটি পর্যন্ত চলিবে। ইহার বেশী হইলে তিনটি দিতে হইবে। ইহা তিনশতটি পর্যন্ত চলিবে। ইহার বেশী হইলে চারশত না হওয়া পর্যন্ত কোন যাকাত নাই। ইহারও বেশী হইলে প্রতি একশত ছাগলে একটি করিয়া ছাগী দিতে হইবে। এইভাবে একত্রিত ছাগলগুলিকে যাকাত ফরয হওয়ার ভয়ে ছিন্ন ভিন্ন করা যাইবে না। দুই শরীফের মালিকানার ছাগলের উপর সমান প্রত্যাবর্থিত হইবে। যাকাত বাবদ অধিক বয়সের ছাগল গ্রহণ করা যাইবে না, দোষমুক্ত ছাগলেও নয়। – আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমদ
ব্যাখ্যা উদ্ধৃত এই দীর্ঘ হাদীসটি রাসূলে করীম (স) কর্তৃক লিখিত যাকাতের বিরাট বিস্তারিত বিধানের একটা অংশ। উহা হইতে বিশেষ করিয়া উটের যাকাত সংক্রান্ত অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হয় নাই। কেননা উটের ব্যাপারটি এতদ্দেশীয় লোকদের জন্য কার্যত অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক। উহা এখানে উদ্ধৃত করিলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হইয়া যাইত।
উদ্ধৃত হাদীসাংশ হইতে ছাগলের যাকাত সংক্রান্ত কথা বিস্তারিত জানা গিয়াছে এবং উহা স্পষ্ট, ব্যাখ্যা অপ্রয়োজনীয়। তবে তিনশতটি ছাগল পর্যন্ত তিনটি ছাগী যাকাত বাবদ দেওয়ার কথা বলার পর চারশতটি না হওয়া পর্যন্ত কোনই যাকাত নাই, বলা হইয়াছে। ইহাই সর্বসাধারণ কিফাহবিদের মত। কিন্তু হাসান ইবনে সালেহ ও ইমাম আহমদের অপর একটি বর্ণনার বক্তব্য হইলঃ তিনশতটির উপর একটি হইলেই চারিটি ছাগী যাকাত দিতে হইবে।
হাদীসটির শেষাং যাকাত ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারে লোকাদের অনুসৃত একটি কৌশলের উল্লেখ করা হইয়াছে। যেমন তিন ব্যক্তির প্রত্যকেরই মালিকানায় চল্লিশটি করিয়া ছাগল রহিয়াছে। তাহারা নিজ নিজ ছাগল একত্র করিয়া রাখিল এবং উহা সবই একজনার মালিকানায় দেখান হইল। তখন মোট সংখ্যা দাঁড়াইল ১২০টি। আর উহাতে মাত্র একটি ছাগী যাকাত দিতে হইবে। অথচ আলাদা থাকিলে প্রত্যেকটি ছাগল-সমষ্টি হইতে একটি করিয়া মোট তিনটি ছাগী দিতে হইত। অথবা দুই শরীফের মোট দুইশত একটি ছাগল রহিয়াছে। এই সংখ্যার দরুন দুইজনের উপর সামষ্টিকভাবে তিনটি ছাগী যাকাত বাবদ দেয়। তাহারা যদি উহা দুই ভাগে ভাগ করিয়া লয়, তাহা হইলে প্রত্যেকে মাত্র একটি করিয়া ছাগী যাকাত বাবদ দিতে বাধ্য হইবে। আর দুইজনার মিলিত সম্পদে একটি ছাগী বাঁচিয়া গেল। বস্তুত যাকাত ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হইত। ইহা ঠিক সেইরূপ সামাজিক ব্যাধি, যেমন বর্তমানকালে বিভিন্ন দেশে সরকারকে দেয় আয়কর ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রে চলিত আছে। এই ক্ষেত্রেও অনুরূপ কৌশলই অবলম্বিত হইয়া থাকে। হাদীসটিতে এইরূপ করিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হইয়াছে।
ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন, মূল হাদীসের বাক্যাংশ ‘যাকাত ফরয হওয়ার ভয়ে’ কথাটি ছাগল-মালিক ও যাকাত আদায়কারী উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। ইহার অর্থ এই যে, যাকাত দেওয়া যাহার কর্তব্য, সে যেন যাকাতের পরিমাণ কম করা ও বেশী যাকাত দেওয়া হইতে নিষ্কৃতি লাভের উদ্দেশ্যে মূল পণ্য একত্রিত কিংবা বিচ্ছিন্ন না করে। অনরূপভাবে যাকাত আদায়কারী (Collector) যেন যাকাতের পরিমাণ বাড়াইবার ও উহার পরিমাণ যাহাতে কম হইয়া না যায় সেই উদ্দেশ্যে না একত্রিত করিয়া হিসাব করিবে, না বিচ্ছিন্ন বিভক্ত করিয়া হিসাব করিবে। যাকাত আদায়কারীদের জন্যও রাসূলে করীম (স)-এর এইরূপ সাবধান বাণী উচ্চারিত হওয়ার একান্তই জরুরী ছিল।
এই হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম আহমদ বলিয়াছেন, এক ব্যক্তির মালিকানার ছাগল যদি দুইটি দূরবর্তী স্থানে থাকে উভয় স্থানেই আলাদাভাবে যাকাত ফরয হওয়ার সংখ্যার কম ছাগল থাকে; কিন্তু এই দুই স্থানের ছাগল একত্রিত করিলে যাকাত ফরয হয়, এইরূপ অবস্থায় যাকাত আদায় করার উদ্দেশ্যে এই দুই স্থানে ছাগল একত্র করিয়া গণনা করা যাইবে না। যদিও অধিকাংশ ফিকাহ্বিদের মত হইল, মূল মালিকের যাবতীয় সম্পদ-তাহা যেখানে যতটা থাকুক না কেন-একত্রিত করিয়াই যাকাতের হিসাব করিতে হইব।
=============================
যাকাত ফরয হওয়ার মেয়াদ
=========================
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোক কোন ধন-সম্পদ লাভ করিল, উহার মালিকের নিকট উহার পূর্ণ একটি বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে তাহার উপর যাকাত ফরয হইবে না।
– তিরমিযী, বায়হাকী, দারে কুতনী
ব্যাখ্যা হাদীসটি হইতে জানা গেল যে, কোন ধন-সম্পদের মালিক হইলেই অনতিবিলম্বে যাকাত দিতে হইবে, এমন কথা শরীয়তে নাই। যাকাত ফরয হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হইল, ঠিক যে সময় সম্পদের মালিকানা লাভ হইল, সেই সময় হইতে পূর্ণ একটি বৎসরকাল উহার মালিকানা সেই মালিকের নিকটই থাকিতে হইবে। এইভাবে যদি একটি বৎসর অতিক্রান্ত হয়, তাহা হইলেই উহার যাকাত দিতে হইবে। কোন সম্পদের মালিকানার বয়স পূর্ণ এক বৎসর না হইলে উহার উপর যাকাত ফরয হইবে না।
‘এক বৎসরকাল অতিবাহিত হওয়া’ পর্যায়ে চারিটি মাযহারের বক্তব্য এখানে উল্লেখ।
হানাফী মাযহাবে বৎসরের মধ্যখানে নিসাব পরিমাণেরও কম হইয়া গেলে তাহা ধর্তব্য হইবে না। কোন মাল-সম্পদ যদি বৎসরের শুরুতে নিসাব পরিমাণ থাকে, পরে সারাটি বৎসরই তদ্রুপ থাকে তবে উহাতে যাকাত অবশ্যই ধার্য হইবে। উহার পরিমাণ বৎসরের কোন এক সময় যদি কম হইয়া যায়, আর বৎসরের শেষে উহা পুনরায় নিসাব পরিমাণ হইয়া যায়, তবে তাহাতেও যাকাত দিতে হইবে। কিন্তু বৎসরের শেষ পর্যন্ত যদি উহার পরিমাণ নিসাব হইতে কম হইয়া দাঁড়ায়, তাহা হইলে উহাতে যাকাত ফরয হইবে না।
মালিকী মাযহাবেরও ইহাই মত। কোন মাল যদি বৎসরের শুরুতে কম পরিমাণ থাকে; কিন্তু বৎসরের মধ্যে মুনাফার দরুন পূর্ণ পরিমাণ হইয়া যায় এবং বৎসরের শেষ পর্যন্ত তাহাই থাকে, তাহা হইলে উহাতে যাকাত ফরয হইবে।
শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবে সারাটি বৎসর পূর্ণ নিসাব পরিমাণ সম্পদ সমানভাবে বর্তমান থাকা যাকাত ফরয হওয়ার জন্য জরুরী। কোন সম্পদ যদি বৎসরের শুরুতে হিসাবের কম পরিমাণ থাকে আর বৎসরের শেষে উহা পূর্ণ হইয়া যায়, তাহা হইলে যে দিন হইতে নিসাব পরিমাণ পূর্ণ হইল, সেই দিন হইতে পূর্ণ একটি বৎসর এই অবস্থায় অতিবাহিত হইতে হইবে।
========================
বৎসরকালের মধ্যে অর্জিত হওয়া সম্পদের দুইটি অবস্থা হইতে পারে। একটি, পূর্বসঞ্চিত সম্পদের সমজাতীয় সম্পদ। দুই, পূর্ব সঞ্চিত সম্পদ হইতে ভিন্ন জাতীয়। দ্বিতীয় অবস্থায় উভয় সম্পদকে একত্রিত করিয়া যাকাতের হিসাব করা হইবে না। প্রথম অবস্থার সম্পদ দুই রকমের হইতে পারে। হয় উহা মূল সম্পদ বা ধন হইতেই লব্ধ হইয়াছে, যেমন ব্যবসায়ে মুনাফা বা পশুর বাচ্চা। বৎসরের শেষে উহাকে মূল সম্পদের সহিত একত্রিত করিয়াই হিসাব করিতে হইবে এবং যাকাত দিতে হইবে। এই দুইটি কথায় কোনই মতভেদ নাই। দ্বিতীয় অবস্থা এই যে, বৎসরের পূর্ণ সময়ের মধ্যে পাওয়া মাল-সম্পদ উত্তরাধিকার কিংবা হেবা বা ক্রয় ইত্যাদি উপায়ে লব্ধ হইবে। ইমাম আবু হানীফার মতে বৎসর শেষে এইসব সম্পদের একত্রে হিসাব করিয়া যাকাত দিতে হইবে। কিন্তু ইমাম মালিক ও আহমদ ইবনে হাম্বল একত্র করিয়া যাকাতের হিসাবে না করার পক্ষে মত প্রকাশ করিয়াছেন।
=========================
যাকাত আদায় করার পরও আর্থিক দায়িত্ব
=========================
হযরত ফাতিমা বিনতে কাইস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেন, ধন-সম্পদে যাকাত ছাড়াও ‘হক’ রহিয়াছে। অতঃপর তিনি সূরা বাকারার আয়াত পাঠ করিলেনঃ তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল পূর্ব বা পশ্চিমে ফিরাইবে ইহাই কোন নেক কাজ নয়-
– তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, নাসায়ী
ব্যাখ্যা হাদীসটি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিতেছে যে, যাকাত দেওয়াই ধনশালী ব্যক্তির একমাত্র অর্থনৈতিক দায়িত্ব নয়। এমন নয় যে, কড়ায় গণ্ডায় হিসাব করিয়া যাকাত দিয়া দেওয়ার পর অন্য কোন কিছুর জন্য আর এক পয়সাও ব্যয় করিতে হইবে না। বরং এই হাদীসটির দৃষ্টিতে যাকাত আদায় করার পরও ধনীকে অনেক অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করিতে হয়। এই কথায় সন্দেহ নাই যে, একটি দেশে সকল ধনশালী ব্যক্তি হিসাবে করিয়া যাকাত দিলে এবং উহা দেশের দরিদ্র জনগণের মধ্যে সঠিকভাবে বন্টন করা হইলে অর্থনৈতিক অভাব অনটন অনেকাংশ দূর হইয়া যাইবে ও সর্বহারা লোকেরা আর্থিক নির্ভরতা পাইবে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে কিংবা জাতীয়-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন হাজারো প্রয়োজন দেখা দিতে পারে যখন দেশের ধনী লোকদিগকে উন্মুক্ত হস্তে অর্থদান করিতে হইবে। তখন এই কথা বলার অধিকার কাহারো থাকিতে পারে না যে, ‘আমি তো যাকাত দিয়াছি, আমি আর কিছুই দিতে পারিব না।‘
নবী করীম (স) তাঁহার এই কথাটির সমর্থনে সূরা আল-বাকারার যে আয়াতটি পাঠ করিয়াছেন, তাহার পূর্ণ রূপ এইঃ
=============================
তোমরা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখমন্ডল ফিরাইবে-ইহাই আসল পূণ্য কাজ নয়। বরং আসল পূর্ণবান হইল সেই লোক যে ইমান আনিল আল্লাহ্র প্রতি, পরকালের প্রতি, ফেরেশতা, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং ধন-মালের মায়া থাকা সত্ত্বেও তাহা দিবে নিকটাত্মীয়দের, ইয়াতীম, মিসকীন, পথিক, প্রার্থী ও ক্রীতদাসদিগকে। আর নামায কায়েম করিবে ও যাকাত আদায় করিবে।
এই দীর্ঘ আয়াতের শেষদিকে একসঙ্গে নামায কায়েম করা ও যাকাত আদায় করার কথা বলা হইয়াছে। আর ইহার পূর্বে আয়াতের শুরুতে- আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব ও নবীগণের প্রতি ঈমান আনার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, পথিক, প্রার্থী ও ক্রীতদাসের মুক্তির জন্য অর্থদানের কথা বলা হইয়াছে। এই অর্থ দান যে ফরয যাকাতের বাহিরের কর্তব্য এবং সেই কর্তব্য মূল ইমানের সহিত সম্পৃক্ত, তাহা অতীব স্পষ্ট। আর উহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, ধন-সম্পদে যাকাত আদায় করার পরও অভাবগ্রস্ত জনগণের অধিকার রহিয়াছে এবং সেই অধিকার প্রত্যেক ইমানদার ধনশালী ব্যক্তিকে অবশ্যই আদায় করিতে প্রস্তুত থাকিতে হইবে। আল্লাহর বাণীঃ
========== এবং ধন-মাল দিল তাঁহার ভালোবাসায়।
ইহার একটি অর্থঃ ধন-মালের মায়া থাকা সত্ত্বেও তাহা দিবে। আর দ্বিতীয় অর্থঃ দিবে আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাস পোষণ করিয়া। ইহা যাকাতের বাহিরের জিনস। অতএব, উপরোদ্ধৃত হাদীসটির সনদে কিছু দুর্বলতা থাকিলেও ইহা যে কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা এবং অকাট্য তাহাতে কোনই মতভেদ নাই। আল্লামা তায়্যিবী এই হাদীসটির ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ হক ও অধিকার দুই প্রকারের। একটি, যাহা আল্লাহ্ তা;আলা নিজে ধার্য করিয়াছেন। আর দ্বিতীয়টি, ধনশালী ব্যক্তি স্বীয় আত্মার পবিত্রতা লাভ ও প্রকৃতিগত কার্পণ্যের আবর্জনা হইতে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে নিজের উপর চাপাইয়া লয়। এই দান সেই পর্যায়ের।
===========================
ধনীদের সম্পদে গরীবদের হক
============================
হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা মুসলমান ধনী লোকদের ধন-মাল হইতে এমন পরিমাণ দিয়া দেওয়া ফরয করিয়া দিয়াছেন, যাহা তাহাদের গরীব-ফকীরদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হইতে পারে। ফলে ফকীর গরীবরা যে ক্ষুধার্ত কিংবা উলঙ্গ থাকিয়া কষ্ট পায় তাহার মূলে ধনী লোকদের আচরণ ছাড়া অন্য কোন কারণই থাকিতে পারে না। এই বিষয়ে সকলের সাবধান হওয়া উচিত। নিশ্চয়ই জানিও, আল্লাহ্ তা’আলা এই লোকদের খুব শক্তভাবে হিসাবে গ্রহণ করিবেন এবং তাহাদিগকে তীব্র পীড়াদায়ক আযাব দিবেন। -তাবারানী আস-সগীর ও আল্-আওসাত
ব্যাখ্যা হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত এই হাদীসটি সহীহ্ সনদে উদ্ধৃত হইয়াছে। উহার মূল কথা, গরীব লোকদের অভুক্ত ও বস্ত্রহীন হইয়া থাকার জন্য ধনী লোকরাই দায়ী। কেননা ধনী লোকরা যদি তাহাদের ধন-সম্পদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ দিয়া দিত, তাহা হইলে গরীবদিগকে খাওয়া-পরার অভাবে কোনরূপ কষ্টের সম্মুখীন হইতে হইত না।
ধনী লোকেরা সাধারণত মনে করে তাহাদের ধন-সম্পদ কেবলমাত্র তাহাদেরই ভোগ ব্যবহার ও যথেচ্ছ ব্যয় বিনিয়োগের জন্য। তাহাতে অন্য কাহারো কোন অধিকার নাই। এইরূপ মনোবৃত্তি ইসলামের সামাজিক অর্থনীতিক দর্শনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভূল ও মারাত্মক। ইহা আগাগোড়া পূঁজিবাদী দৃষ্টিভংগী। আর ইসলামে ইহা সর্বাধিক ঘৃণ্য ও অভিশপ্ত। ইসলামের ঘোষণা হইল-আল্লাহ্তা’আলা এই দুনিয়ায় যত মানুষ-যত জীব সৃষ্টি করেন, তাহার রিয্ক-খাওয়া পরা ইত্যাদি পূরণের সুব্যবস্থা সঙ্গে সঙ্গে তিনিই কার্যকর করেন। সাধারণভাবে এই দুনিয়ায় খাদ্য ও বস্ত্রের অভাবজনিত কোন সমস্যা থাকিতে পারে, ইসলাম তাহা স্বীকার করে না। ইসলামের কথা হইল, একজনের কিছুই না থাকিতে পারে; কিন্তু অনেক বেশী পরিমাণে আছে এমন লোক তাহারই আশেপাশে রহিয়াছে অনেকজন। অতএব যাহার আছে, সে প্রয়োজন পরিমাণ যাহার নাই, তাহাকে দিবে। অনুরূপভাবে একটি ভূখণ্ডে কোনরূপ অভাব দেখা দিতে পারে-বণ্যা, প্রচণ্ড খরা,পৌঁকায় কাটা ইত্যাদি কারণে। ইহা কিছু মাত্র বিচিত্র নয়। কিন্তু উদার ব্যাপক দৃষ্টিতে কাতাইলে দেখা যাইবে, দুনিয়ার বহু কয়টি দেশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক বেশী পরিমাণ ফসল জন্মিয়াছে। তখন এই দেশগুলির কর্তব্য, অভাবগ্রস্ত দেশগুলির অভাব সিটে-এমন পরিমাণ শস্য সাহায্য বাবদ কিংবা মূল্যের বিনিময়ে দেওয়া।- যদি না দেয়, তাহা হইলে সংশ্লিষ্ট সকল লোককে সেই জন্য আল্লাহ্র নিকট কঠিন জওয়াবদিহির সম্মুখীন হইতে হইবে। কেননা আল্লাহ্ তো কোন না কোনভাবে দুনিয়ার মানুষের প্রয়োজন পূরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন। ইহা সত্ত্বেও যদি কোন লোক, কোন পরিবার বা কোন দেশ খাওয়া-পরার অভাবে কষ্ট পায়, তবে সেইজন্য এই সম্পদশালী দেশ বা লোকেরাই দায়ী। এই লোকাদের বা দেশগুলির কার্পণ্যের কারণেই লোকেরা এই কষ্ট ভোগ করিতে বাধ্য হইয়াছে। এই ধনী ও স্বচ্ছল অবস্থার লোকেরা যদি তাহাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করিত, যদি বুঝিত যে, তাহাদের সম্পদে গরীব-ফকীরদের অংশর রহিয়াছে এবং সে অংশ আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দিষ্ট, তাহা হইলে গরীব লোকেরা কস্মিনকালেও এই কষ্ট ভোগ করিতে বাধ্য হইত না।
======================
যাকাত বায়তুলমালে দিতে হইবে
=========================
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, বনু তামীম গোত্রের একজন লোক রাসূলে করীম (স)-এর কিনট উপস্থিত হইল এবং বলিলঃ ইয়া রাসূল! আমি বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী লোক। আমার পরিবার পরিজন রহিয়াছে। আর আমার বাড়ীতে যথেষ্ট মেহমান আসে। এরূপ অবস্থায় আমাকে বলুন আমি ধন-সম্পদ কিবাবে ব্যয় করিব এবং কিভাবে কাজ করিব? জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তোমার ধন-মালের যাকাত অবশ্যই দিবে। কেননা এই যাকাত ধন-মালের পবিত্রতাকারী, ইহা তোমাকে রক্ষা ও পবিত্র করিবে। আর তোমার নিকট সম্পর্কের লোকদের সহিত ‘ছিলায়ে রেহ্মী’ করিবে। প্রার্থী, প্রতিবেশী ও মিস্কীনের অধিকার অবশ্যই চিনিবে। লোকটি বলিল; ইয়া রাসূল। আমার জন্য স্বল্প করুন। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ অতঃপর নিকটাত্মীয়ের, মিসকীন ও পথিকের হক তাহাকে দিয়া দাও। আর বেহুদা খরচ করিও না। লোকটি বলিলঃ ইয়া রাসূল। আমি যদি আপনার প্রতিনিধির নিকট যাকাত আদায় করিয়া দেই, তাহা হইলে আমি এই ব্যাপারে আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের নিকট দায়িত্বমুক্ত হইতে পারিব কি? ইহাই কি আমার জন্য যথেষ্ট হইবে? জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ হ্যাঁ, তুমি যদি আমার প্রতিনিধির নিকট যাকাত আদায় করিয়া দাও, তাহা হইলে তুমি ইহা হইতে দায়িত্বমুক্ত হইয়া যাইবে। অতঃপর তুমি উহার শুভ প্রতিফল পাইবে। যে লোক উহার ক্ষেত্র পরিবর্তন করিবে, উহার গুনাহ তাহারই উপর বর্তিবে।
– মুসনাদে আহমদ, তাবারানী
ব্যাখ্যা বিপুল অর্থ-সম্পদশালী একজন মুসলমান কিভাবে আল্লাহ্র হক আদায় করিবে এবং পরিবারবর্গের ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করিবে তাহা জিজ্ঞাসা করার জন্য রাসূলে করীম (স) এর নিকট উপস্থিত হয়। কেননা ইহা জানিয়া লওয়া তাহার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। ইহা কর্তব্য সর্বকালের এবং সব ধনী ব্যক্তিরই। কেননা মুসলমান হিসাবে জীবন যাপন করিতে হইলে এই সর্ববিধ দায়িত্ব পালন করা ছাড়া গত্যন্তর থাকিতে পারে না। জওয়াবে নবী করীম (স) তাহাকে একদিকে যাকাত আদায় করিতে বলিলেন এবং অপরদিকে পরিবারর্ ও নিকটাত্মীয়দের সহিত ‘ছিলায়ে রেহমী’ রক্ষা করিতে ও সমাজের বিভিন্ন লোকদের, প্রতিবেশীর সাহায্য প্রার্থীর ও মিসকীনের হক জানিতে ও তাহা রীতিমত আদায় করিতে বলিলেন। ‘ছিলায়ে রেহ্মী’ ইসলামের একটা বিশেষ পরিভাষা। ‘রিহম’ অর্থ রক্ত সম্পর্ক। এই সম্পর্ক আপনা আপনিই স্থাপিত হয়। ইহা কাহারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। আল্লাহ্ তা’আলা মানব সমাজকে সুদৃঘ ভিত্তিতে গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে এই সম্পর্ককে একটা প্রাথমিক ও মৌল ভিত্তি হিসাবে গণ্য করিয়াছেন এবং এই সম্পর্কের অধিকার যথাযথভাবে আদায় করা অবশ্য কর্তব্য দিয়াছেন। ইসলামী পরিভাষায় ইহাকেই বলা হয় ‘ছিলায়ে রেহ্মী’ রক্ষা করা।
লোকটি রাসূলে করীম (স)-এর জওয়াব শুনিয়া বলিলঃ ইয়া রাসূল, আমার জন্য ‘স্বল্প’ করুন। ‘স্বল্প’ করার কথা দ্বারা লোকটি কি বুঝাতে চাহিয়াছিল? দায়িত্ব ও উহার প্রসারতা কমাইয়া দিতে তো বলিতে পারে না। কেননা রাসূলে করীম (স) তো প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্যকে বাড়াইয়া অতিরিক্ত বোঝা চাপাইয়া দেন নাই। এরূপ ধারণা করাও যায় না। কাজেই এ কথা অর্থ হইবে।
==========================
সম্ভবত লোকটি রাসূলে করীম (স)-কে স্বল্প কথায় সমস্ত কিছু বুঝাইয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিল। রাসূলে করীম (স) ইহার জওয়াবে যাহা বলিয়াছেন তাহা মূলত কুরআন মজীদের একটি আয়াতের অংশ। আয়াতটি হইল সূরা বনী ইসরাঈলের ২৬ নম্বরের আয়াত। এই আয়াতে মূলত সেই কথাই বলা হইয়াছে, যাহা তিনি প্রথম বলিয়াছিলেন। এই জওয়াব শুনিয়া লোকটি এই বিষয়ে আর কোন কথা বলিল না। মনে হইতেছে, লোকটি রাসূলে করীম (স)-এর মুখে কুরআনের আয়াত শুনিয়া বুঝিল, ইহা যেমন সংক্ষিপ্ত, তেমনি বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ। আর তাহাতে কোন কিছু কম করার তো প্রশ্ন উঠে না। লোকটি সম্ভবত এই রকম স্বল্প কথায় বেশী তাৎপর্যপূর্ণ বাক্যই শুনিতে চাহিয়াছিল।
বস্তুত কেবলমাত্র যাকাত আদায় করিলেই যে অর্থশালী ব্যক্তির দায়িত্ব আদায় হইয়া যায় না, ইহার পরও তাহার উপর একদিকে নিকট আত্মীয়দের প্রতি এবং অপরদিকে সমাজের অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রতি কঠিন দ্বায়িত্ব রহিয়াছে, তাহা এই হাদীস হইতেও নিঃসন্দেহে জানা যাইতেছে।
পরবর্তী পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) ও লোকটির মাঝে যে কথোপকথন হইয়াছে, তাহা হইতে তিনটি কথা অকাট্যভাবে জানা যাইতেছে। একটি এই,র রাষ্ট্র প্রধানকে দেশের ধনী ও অর্থশালী লোকদের নিকট হইতে রীতিমত যাকাত আদায় করার স্থায়ী ব্যবস্থা করিতে হইবে। এই জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিনিধি নিযুক্ত করিতে হইবে। তাহারা যাকাত আদায়ের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসাবে জনগণের নিকট হইতে যাকাত আদায় করার স্থায়ী ব্যবস্থা করিতে হইবে। এই জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিনিধি নিযুক্ত করিতে হইবে। তাহারা যাকাত আদায়ের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসাবে জনগণের নিকট হইতে যাকাত আদায় করিবে ও বায়তুল মালে জমা দিবে। দ্বিতীয় কথা, জনগণ এই রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের হস্তে যাকাত-সম্পদ ব্যস্ত করিবে। তাহা করিলেই বুঝিতে হইবে, যাকাত দেওয়া হইয়াছে, ফরয আদায় হইয়াছে। অতঃপর এই ব্যাপারে তাহাদের আর কোন দায়িত্ব থাকিবে না। রাসূলে করীম (স) ও খিলাফতে রাশেদার আমলে এইরূপ ব্যবস্থা ছিল। জনগণ এইভাবেই যাকাত আদায় করিত। বস্তুত যাকাত আদায়ের ইহাই ইসলামী নিয়ম।
তৃতীয় কথা এই যে, সরকারী প্রতিনিধি হিসাবে যাকাত আদায়কারী লোকদের কর্তব্য হইল, যাকাত জনগণের নিকট হইতে আদায় করার পর উহা যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয় বায়তুলমালে জমা করিয়া দেওয়া। যদি কোন সরকারী আদায়কারী তাহা না করে আত্মসাৎ করে কিংবা অন্য খাতে ব্যয় করে, তাহা হইলে এইরূপ করার জন্য সেই কর্মচারীই দায়ী হইবে। সেইজন্য কোন দায়িত্ব নাই। তাহাদের কোন ভাবনা চিন্তারও কারণ নাই। ======================