৩. অন্যের প্রতি সহৃদয় অনুভূতি
ব্যক্তিগতভাবে মানুষের ক্ষমতার তারতম্য এবং জীবনের রূঢ় বাস্তবতার বিভিন্ন স্তর থাকে। অন্তর্দৃষ্টি ও ফিকহের জ্ঞানের পাশাপাশি অন্যের এই বাস্তবতার প্রতিও পরস্পরের সহৃদয় অনুভূতি থাকা আবশ্যক। আন্দোলনের ক্ষেত্রে সকলের কাছ থেক হযরত হামযাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের (রা) মতো শাহাদাতের শৌর্য প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। এটি এমন মহৎ গুণ, গভীরতম নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায় ছাড়া যার প্রকৃত মর্ম খুব কম লোকই অনুধাবন করতে পারে।
কেউ কেউ শান্তভাবে সত্যের পক্ষে কথা বলে তৃপ্তিবোধ করে; অন্যেরা তাদের ধারনণা অনুযায়ী বিরাজমান মারাত্মক অবস্থার প্রেক্ষিতে নীরব থাকই নিরাপদ মনে করে। আবার অনেকে মনে করেন আগা নয়, গোড়া থেক সংস্কার কাজ চালাতে হবে। এজন্যে তারা ব্যাক্তি বিশেষের প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তারা মনে করে, এসব লোকের দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কৃত ও পরিশুদ্ধ করতে পারলে কাঙ্খিত পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু এটা বলাবাহুল্য, পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা নির্মূল করতে হলে সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচীর ভিত্তিতে একটি ইসলামী সঙগঠনের নেতৃত্বে সম্মলিত সংগ্রাম ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবশ্য শরীয়ত এক মুন্কার থেকে যেন আরেকটি বড় মুনকারের সৃষ্টি না হয় সেজন্যে অনেক ক্ষেত্রে নীরবতাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল করীমে হযরত মূসার (আ)-এর ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়। মূসা (আ:) -কে তার স্থলাভিষুক্ত করে যান। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরপরই ইসরাঈলীরা সামেরিদের পরামর্শে একটি সোনার গো-মূর্তি বানিয়ে পূজো করতে শুরু করে। এই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে হারুন (আ)-এর বক্তব্য শুনতেও তারা অস্বীকার করে। কুর্আন বলছে:
“হারুন তাদেরকে আগেই বলেছিলেন, হে আমার স্বজাতি! তোমাদেরকে এর দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। তোমাদের দয়াময়; সুতরাং তোমরা আমাকে অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল। তারা বলেছিলো: আমাদের কাছে মূসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা পূজা হতে কিছুতেই বিরত হব না।” (২০:৯০-৯১)
তাদের অনমনীয়তা দেখে হারুন (আ) নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। মূসা (আ) ফিরে এসে ক্রোধে ও দুঃখে অগ্নিশর্মা হয়ে হারুন (আ)-কে রূঢ়ভাবে তিরস্কার করলেন। কুরআনের বর্ণনা, “মুসা বলল, ও হারুন! তুমি যখন দেখলে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছ তখন কিসে তোমাকে নিবৃত্ত করল- আমার অনুসরণ করা হতে? তবে কি তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে!” (২০:৯২-৯৩)
হারুন (আ) জবাব দিলেন : “হে আমার সাহোদর! আমার দাড়ি ও চুল ধরে টেনে না; আমি আশংকা করেছিলাম যে, তুমি বলবে, তুমি বনী ইসরাঈলেদের মধ্যে বিভদ সৃষ্টি করেছে এবং তুমি বলবে, তুমি আমার কথা পালনে যত্নবান হওনি।” (২০ : ৯৪) সুতরাং দেখা যাচ্ছে সামাজি ঐক্য ও সম্প্রীতির স্বার্থে হারুন (আ) হযরত মূসা (আ) ফিরে না আসা পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করেছেন। এই ঘটনার সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাদীসের সাজুয্য লক্ষ্যণীয়। তিনি বলেছিলেন, তাঁর অনুসারীরা সবেমাত্র পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে কা’বা নির্মাণ থেকে বিরত থেকেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনান্য আদেশ থেকেও এরূপ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়্। যেমন যদি অত্যাচারী-অনাচারী শাসককে হটিহটিয়ে সৎ ব্যাক্তির সরকার কায়েমের ক্ষমতা না থাকে তাহলে শাসকের অবিচার সহ্য করার কথা আছে। কেননা প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন বৃহ্ত্তর ফিতনার সৃষ্টি না হয়, মুসলমানদের অযথা রক্তপাত বা সামাজিক স্থিতিশীরতা যেন বিনষ্ট না হয় অথাৎ বাস্তব ফল ছাড়া কেবল অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে এমন প্রতিবাদের চেয়ে নীরবতাই কাম্য। অন্যথায় পরিস্থিতি এমনও হতে পারে যে, কুফরী অথবা রিদ্দাহর দিকেও মোড় নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “যতোক্ষণ না তুমি প্রকাশ্য কুফরী প্রত্যক্ষ কর যার পক্ষে তোমার কাছে আল্লাহ্র তরফ থেকে প্রমাণ আছে।” ((বুখারী, মুসলিম)
দু’টি দৃষ্টান্ত অনিশ্চিত সাফল্যের মুখে ঐক্য বজায় রাখার ওপর আলোকপাত করেছে। পক্ষান্তরে ইসলামী শিক্ষা পালনে ক্ষেত্রে যেসব ভাববাদী মুসলমান চরম পূর্ণতা দেখতে চায় অযথা যারা একেবারে বর্জন করতে চায় তাদের উভয়ের জন্যে এই ঘটনাগুলো শিক্ষণীয়। এদের কাছে কোনো মধ্যপন্থা নেই। ভাববাদীরা মুন্কার উচ্ছেদ শক্তি প্রয়োগকেই শেষ হাতিয়ার মনে করেন। তারা অন্য দু’টি পথ অর্থাৎ কথা ও হৃদয় দিয়ে প্রতিরোধের কথা বেমালুম ভুলে যান। মোটকথা, প্রতিটি উপায় প্রয়োগ নির্ভর করে ব্যাক্তির ক্ষমতা ও পরিস্থিতির ওপর। আশ-শরীয়াহ বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করার ওপর এতো দূর গুরুত্ব দিয়েছে যে, নিরূপায় অবস্থায় হারামও হালাল হয়ে যায় এবং ওয়াজিব স্থগিত হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) এবিষয়ে বুদ্ধিসীপ্ত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন:
“আল্লাহ্ তা#য়ালা কুরআনুল করীমে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন যে, তিনি ক্ষমতার বাইয়ে অতিরিক্ত বোঝা মানুষের ওপর চাপাতে চান না।” তিনি বলেন, “আল্লাহ্ কারো ওপর এমন কোন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত।” (২:২৮৬) “আমরা কাউকেই তার সাধ্যাতীত অর্পণ করি না।” (৭:৪২)
“কাউকেই তার সাধ্যতীত কার্যভার দেয়া হয় না এবং আল্লাহ যাকে যে সামর্থ দিয়েছেন তদপেক্ষা গুরুতর বোঝা তিনি তার ওপর চাপন না।” (৬৪:১৬) ঈমানদারই তাঁর কাছে প্রার্থনা করেছে: “হে প্রভু, আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যেমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন আমাদের ওপর তেমন দায়িত্ব অর্পণ করবেন না। হে প্রভু! এমন ভার আমাদের ওপর অর্পণ করবেন না যা বহন করার শক্তি ্আমাদের নেই।” (২:২৮৬)
আল্লাহ্ তাদের প্রার্থনা কবুল করেছেন। এসব আয়াত প্রমাণ করেছে যে, তিনি মানুষের ওপর এমন বোঝা চাপান না যা সে বহন করতে পারবে না। এটা নিশ্চিত যে, জাহমিয়া, কাদিরিয়া ও মুতাযিলা দর্শনের সাথে এর কোনো সংগতি নেই। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝে নিতে হবে যে, যদি কোনো শাসক, ইমাম, বুদ্ধিজীবি, ফকীহ অথবা মুফতী আল্লাহ্র খালেস ভয়ে তার সাধ্য অনুযায়ী যে ইজতিহাদ করবে তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহ তার কাছ থেকে এটাই চেয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, তাকে শাস্তি দেয়া হবে না। এর বিপরীত কাদিয়রা ও মুতাযিলারা যে ধারণা পোষণ করে তা বাতিল।
কাফিরদের বেলায়ও একই বিষয় প্রযোজ্য। যারা কুফরীর দেশে রাসূলের দাওয়াত পেয়ে তাঁকে রাসূল বলে স্বীকার করলেন এবং তাঁর ওপর অবতীর্ণ ওহীকে বিশ্বাস করে যথাসাধ্য আনুগত্য করলেন-যেমন নাজ্জাশী ও অন্যান্য, কিন্তু ইসলামের ভূখন্ডে যেতে না পরার দরুন শরীয়তকে সামগ্রিকভাবে মানতে পারলেন না; কারণ তাদেরকে দেশত্যাগের অনুতি দেয়া হয়নি অথবা প্রকাশ্যে আমলের সুযোগ পাননি এবং তাদেরকে সমগ্র শরীযাহ শিক্ষা দেয়ার মতো লোক ছিল না। এমন সকল মানুষের জন্যে আল্লাহ জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরূপ আরো উদাহরণ আছে। আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের লোকদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী ছিলো তাদের সম্পর্কে বলছেন: “এবং তোমাদের কাছে পূর্বে ইউসুফ এসেছিলেন স্পষ্ট নিদের্শন সহকারে, কিন্তু তিনি যা নিয়ে এসেছিলেন তাতে তোমরা বার বার সন্দেহ পোষন করতে। অবশেষে তিনি যখন ইন্তিকাল করলেন তখন তোমরা বলেছিলে, তারপরে আল্লাহ্ আর কাউকে রাসূল করে পাঠিবেন না।” (৪০-৩৪)
নাজ্জাশী খৃস্টানদের রাজা ছিলেন; কিন্তু তিনি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে বললে তারা অস্বীকার করলো। কেবল মুষ্টিমেয় লোক তাকে অনুসরণ করেছিলো। তিনি যখন মারা গেলেন তখন তার জানাযা পড়ারও কেউ ছিলো না। রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় তার জানাযা পড়েন এবং উপস্থিত সকলকে বলেন, “আবিসিনিয়ায় তোমাদের মধ্যেকার একজন সৎ কমর্মশীল ভাই মারা গেছেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
যদিও নাজ্জাশী ইসলামের অনেক শিক্ষা মানতে পারেননি, দেশত্যাগ করেননি, জিহাদে অংশ নেননি অথবা হজ্জ্ও করেননি। এটাও বর্ণিত আছে যে, তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামায, সিয়াম অথবা যাকাতের কতর্তব্য পালন করতে পারেননি; কেননা তার ঈমানের কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে জনগণ তার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। আমরা জানি, তিনি আল-কুরআনের বিধানও প্রয়োগকরেননি, যদিও আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে আহলে কিতাবরা চাইলে তাঁর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করার আদেশ দিয়েছিলেন। আবার আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে এই মর্মে সতর্কও করে দিয়েছেন, “আহলে কিতাবরা যেন তাকে ওহীর অংশ বিশেষ খথেকেও বিচ্যুত করার জন্যে প্রলুব্ধ করতে না পারে।” কঠোর ন্যায়পরায়ণতার জন্যে উমর ইবনে আবদুল আজীজ (রা)-কে অনেক বিড়াম্বনা সইতে হয়েছে। এজন্যে তাকে বিষ প্রয়োগও করা হয়েছিলো বলে জানা যায়। কিন্তু নাজ্জাশী এবং তার মতো অন্যরা এখন জান্নাতে শান্তিতে আছেন যদিও তারা শরীয়তকে পূর্ণরূপে পালন ও প্রয়োগ করার সুযোগ পাননি, বরং তাই করেছেন যা তাদের কাছে প্রযোজ্য মনে হয়েছে। (মাজমুয়া আল ফাতওয়া)
৪. আল্লাহর সৃষ্টি রীতির জ্ঞান
ইসলাম যুক্তি ও অনুসন্ধিৎসার ধর্ম। এ কারণে পর্যায়ক্রম, সহিষ্ণুতা ও ক্রমিক পূণর্ণতার তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। মানূষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে দ্রুতির প্রবণতা অন্তর্নিহিত। অবশ্য এটি আমাদের যুগেরও বৈশষ্ট্য। এজন্যে আজ ফসল বুনে কালই তা কাটতে চায়। কিন্তু আল্লাহ্র সৃষ্টিরীতি অনুযায়ী এরূপ দ্রুতির কোনো অবকাশ নেই। গাছ থেকে ফল আহরণ করতে হলে এর পর্যায়ক্রমে অতিক্রম করতে দিতে হবে। মানুষের সৃষ্টি ত এর প্রকৃষ।ট নজীর। কুরআন বলছে:
“অতঃপর আমি শুক্রকে পরিণত করি রক্তপিণ্ড, তারপর রক্তপিণ্ডকে পরিণত করি মাংসপিণ্ডে, তারপর মাংসপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপঞ্জরে, পরে অস্থিপঞ্জরকে মাংসে আবৃত করে দিই; অবশেষে তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ্ কত মহান!” (২৩-১৪)
এমনিভাবে মানুষও শিশু থেকে পর্যায়ক্রমে প্রাপ্তবয়স্ক পরিণত হয়। একইভাবে আল্লাহ্র সুনান অনুযায়ী মানুষের জীবনেও বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে। অনুরূপভাবে আল্লাহ্র দ্বীন বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে অবশেষে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। তখন এই আয়াত নাযিল হয়েছে:
“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, এই ইসলামকেই তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।” (৫:৩) বিষয়টি অন্তত্য সহজ সরল; কিন্তু চারদিকের অবস্থা দেখে উৎসাহী তরুণরা এতোই বিক্ষুব্ধ যে, এই জ্ঞান তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তারা রাতারাতি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করে সব সমস্যার সমাধানকরে ফোলতে চায়। তারা তাদের সম্মুখবর্তী বাধা-বিপত্তিকে লঘু দৃষ্টিতে দেখতে চায়। বস্তুত তাদের এই উভয় সংকটকে একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো যায়। এক ব্যক্তি আবু শিরিন (র) – কে একটি স্বপ্নের তাবির বলার অনুরোধ করেছিলো। সে স্বপ্ন দেখেছিলো যে, সে শুকনো জমিতে সাঁতার দিচ্ছে, ডানা ছাড়াই উড়ছে।” ইবনে শিরিন (র) তাকে বললেন, তিনিও এমন অনেক স্বপ্ন ও আকাংখা পোষণ করেন। হযরত আলী (রা) তার পুত্রকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, “…ইচ্ছার ওপর নির্ভর করা থেকে সাবধান, এগুলো হচ্ছে আহাম্মকের উপকরণ।” অতএব এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, বিপরীত বাস্তবতাকে কেবল ইচ্ছার হাতায়ার দিয়ে পাল্টানো যাবে না। প্রসঙ্গত একিট অমূল্য বইয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি: ‘হাত্তা ইয়ুগাইয়িরু মা বিআনফুসিহিম’ (যতোক্ষণ না তারা নিজেরা পরিবর্তিত হয়)। এটি লিখেছেন সিরীয় মনীষী জাওদাত সাঈদ (র) বইটিতে আত্মা ও সমাজের পরিবর্তন ধারা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে কুরআনের এই আয়াত : “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কোনো জাতার অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতোক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।” (১৩ : ১১)
এবং ‘কারণ, আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়কে প্রদত্ত সৌভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতোক্ষণ না তারা নিজেরাই পরিবর্তিত করে দেয় নিজের জন্য নির্ধারিত বিষয়।” (৮ : ৫৩)
বইটির ভূমিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে : “মুসলিম তরুণদের মধ্যে অনেকেরই ইসলামের জন্য জান ও মাল কুরবানীর দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদের মধ্যে মাত্র মুষ্টিমেয় সংখ্যক তরুন জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখায় অথবা দুর্বোধ্য সত্যকে উন্মোচিত করার লক্ষ্যে অধ্যয়নে উৎকর্ষ অর্জনে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ঈমান ও আমল তথা বর্ণনা ও বাস্তবের শ্রণীবিভাগ ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে। এসব বিষয় এমন সমস্যা সৃষ্টি করে যার বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যপূর্ণ সমাধান না হলে গঠনমূলক সংস্কার অসম্ভব। ইসলামী বিশ্ব এখনো গবেষণা ও লেখনীর র্মম উদ্ধার করেত পারছে না। কারণ তারা এখনো মনে করে যে, ‘মসির চেয় অসি শক্তিশালী।’ এজন্যেই আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা স্তবিরতায় পর্যবসিত হয়েছে। ‘ঝাঁপ দেয়ার আগে চিন্তা করার কথা আমরা ভুলেই গেচি। ফলত উপরিউক্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। এসবের মধ্যেকার পারস্পরিক সমন্বয় ও শৃংখলার বিষয়টি আমারা অধ্যায়ন বা উপলব্ধির চেষ্টা করছি না।
তদুপরি মুসলিম বিশ্বে ঈমানের অবস্থা সম্পর্কেও আমরা এখানে সতক”র্ পর্যালেচনা করছি না। এটার অর্থ এই নয় যে, মুসলমানদের ইমান ও ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান নেই। আমরা বরং মানসিক অবস্থার কথা বলতে চাই যা অবশ্যই মনের গহীন থেকে পরিবর্তন করতে হবে। আর ঐ পরিবর্তনই কেবল সৃষ্টিতে সক্ষম।
আত্মত্যাগ ও সাদকার প্রকৃত মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি না করে এখনো বিশ্বাস করা হয় যে, ঐ দু’টো সবচেয়ে মহত্তম পুণ্য। সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত কৌশলের অনুপস্থতিতে কেবল কুরবানী করলেই এর লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না। অবুঝ বিশ্বাস তরুণ মনে জানমাল কুরবানীর আবেগ সৃষ্টি করে বটে, এর তাৎপর্য অধ্যয়ন ও উপলব্ধির চেতনা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। তাৎক্ষণিক ভাবাবেগ বা চাপ থেকে কুরবানীর প্ররণা আসে; কিন্তু জ্ঞানের অন্বেষার জন্যে দাকার অবিশ্রান্ত অধ্যবসায়, চৈতন্য, অন্তদৃষ্টি ও সমীক্ষার মানসিকতা। আর এটিই পরিশেষে নিশ্চত সাফল্যের সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল করে।
অবশ্য কোনো কোনো তরুণ বিভিন্ন বিভাগে অধঘ্যয়ন-পঠনের কাজে মনোনিবেশ করলেও শেষাবধি একঘেঁয়ে ক্লান্তি অনুভব করে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং জ্ঞান-গবেষণা হিমাগারে আশ্রয় নেয়। আমাদেরকে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই জড়তা ও স্থাবিরতার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
আত্মোপলব্ধি ও আত্মসচেতনতা ছাড়াই দ্রুত পরিবর্তন সাধনের প্রবণতা অবান্তর। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতিক্রিয়া উলব্ধি এক জিনিস, আমাদের নিজস্ব ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা অন্য জিনিস। এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আল কুরআনের এই শিক্ষার ওপরেও আলোকপাত করা হয়েছে। কুরআনে সমস্যার অন্তস্থল হিসেবে খুদী বা অহমকে চিহ্নিত করা হয়েছে, বাইরের অসদাচরণ বা অনাচার নয়। কুরআনুল করীমে সম্পদের যে কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে তার মূল কথা হলো এটাই। এই সহজ সরল সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং এই তখন নৈরাশ্য, বৈরাগ্য ও স্বৈরাচারী দর্শনের উদ্ভব ঘটে।
অতএব মারাত্মক স্বআরোপিত অবিচার হচ্ছে মানুষ, মহাজগত ও সমাজের অন্ত র্নিহিত অনুষঙ্গ অনুধাবনে ব্যর্থতা। ফলত কোন্ অবস্থানে নিজেকে স্থাপিত করলে মানুষ আল্লাহ্র সুনান (রীতি) অনুযায়ী মানবীয় ও প্রাকৃতিক সম্ভাবনাকে সর্বোত্তম উপায়ে আহরণ করতে সক্ষম, তার বিচার করতে ভুল করে সে ব্যর্থতার গ্লানি বহন করে। এই দৃষ্টিতে, সমস্যার সম্মুখীন হলে দু’টি মানসিকতার উদ্ভব হয়। প্রথমত, এটা বিশ্বাস করা যে, সমস্যাটি নির্দিষ্ট ধারায় নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, এই বিশ্বাস দ্বারা চালিত হওয়া যে, এটি রহস্যময় ও অতিপ্রাকৃতিক, অতএব কোনো রীতি দ্বারা ্এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। এই দুই চরম মানসিকতার মাঝে বহুবিধ মধ্যবর্তী দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে যা মানুষের অনুসৃত পন্থা, আচার-আচরণ ও ফলাফল থেকে আঁচ করা যায়।
ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মুসলমানদের জীবন নির্বাহে ব্যর্থতা একটি সমস্যা যা সহজেই অনুমেয়। এটি মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গির কোন্টি মুসলমানদের পোষণ করা উচিত? বস্তুত এরূপ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সচেতনতা সৃষ্টি করলেই মুসলমানরা সমস্যার সমাধানে কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে এবং কোন্টি পরিহার করবে তা নির্ণয়ে সহায়ক হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দুই দৃষ্টিভঙ্গি গুলিয়ে গিয়ে প্রতিটিই অবান্তর হয়ে গেছে। সুতরাং এর সমাধান বহুলাংশে নির্ভর করে পরিচ্ছন্ন অন্তর্দৃষ্টি উপর।”
সুনান ও সাফল্যের শর্তে
নিচে আমার ও একজন তরুণ মুসলমানদের মধ্যকার সংলাপ তুলে দিলাম। আমি কি তার প্রশ্নের জবাব দিই।
প্রশ্ন: আমরা কি সত্যের অনুসরণ করছি এবং আমাদের বিরোধীরা কি বাতিলের অনুসরণ করছে?
উত্তর: জী, হ্যা।
প্রশ্ন: আমাদের প্রভু কি ওয়াদা করেননি বাতিলের ওপর হক এবং কুফরির ওপর ঈমানের বিজয় হবে?
উত্তর: অবশ্যই, আল্লাহ কখনো তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।
প্রশ্ন: তাহলে আমরা কিসের জন্যে অপেক্ষা করছি? আমরা বাতিলের বিরুদ্ধে কেন যুদ্ধ ঘোষণা করি না?
উত্তর: আমাদের ধর্ম শিক্ষা দেয় বিজয়ের জন্য শর্ত ও সুনান আছে। এটা আমাদের মানতে হবে। এই বিবেচনা না থাকলে রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কী যুগে প্রথমেই পৌত্তলিকতার বারুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। মূর্তি-অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও কা’বায় সালাত আদায় করা তাঁর পক্ষে অসহনীয় মনে হতো। প্রশ্ন: এই সুনান ও শর্ত কি?
উত্তর: প্রথমত, কেবল হক বলেই হক আল্লাহ্ বিজয়ী করেন না। তিনি সৎকর্মশীল লোকদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলেই বিজয় দান করেন। কুরআনে পরিষ্কার বলা হয়েছে: “তিনিই তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাঁদের পরস্পরের হৃদয়ে প্রীতি স্থাপন করেছেন।” (৮:৬২-৬৩)
প্রশ্ন: কোথায় সেই ফেরেশতা যাঁরা হকের পক্ষে ও বাতিলের বিরুদ্ধে সাহায্যে করেছিলেন-যেমন তাঁরা বদর, খন্দক ও হুয়ানের যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন?
উত্তর: আল্লাহ যখন ইচ্ছে করবেন তখন ফেরেশতারা মুমিনদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু তাঁরা শূন্যের মধ্যে অবতীর্ণ হবেন না। দুনিয়ায় হকের জন্য সংগ্রামরত সত্যিকার প্রয়োজন হবে এবং যাদেরকে শক্তিশালী করার জন্যে আল্লাহ্র সাহায্যের প্রয়োজন হবে। বদরের যুদ্ধের সময় নাযিলকৃত আয়াত থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়: “স্মরণ করো, তোমাদের প্রভু ফেরেশতাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন: আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং মুমিনদের অবিচলিত রাখ। যারা কুফরি করে আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করবো। (৮:১২)
প্রশ্ন: সত্যিকার ঈমানদার আছে কি? তাতেই কি বিজয় নিশ্চিত হবে?
উত্তর: তাদেরকে যথাসাধ্য ইসলামের প্রচার চালিয়ে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যাএ শত্রুর শক্তি সাথে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। একজনের পক্ষে একশ’ বা হাজারেরর বিরুদ্ধে লড়াই করা অযৌক্তিক হবে। কুরআনুল করীমে যে ভারসাম্যের কতা বলা হয়েছে তাতে একজন সত্যিকার মুমিন দশ জনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে:
“হে নবি! ঈমানদারদেরকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করুন। তোমাদের মধ্যে যদি বিশ জন ধৈর্যশীল থাকে তারা দু’শ জনের ওপর জয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে একশ’ জন থাকলে এক হাজার কাফিরের ওপর বিজয়ী হবে।” (৮:৬৬) প্রশ্ন: কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ সদা সতর্ক, তারা অন্তর্ঘাতী কৌশলে উৎকর্ষতা লাভ করেছে।
উত্তর: এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, এমন একটি অপরিহার্যশর্ত আছে যা ছাড়া বিজয় সুনাশ্চিত হতে পারে না। তা হচ্ছে, বিপদ ও কষ্টে সহিষ্ণুতা ও উস্কানির মুখে দৃঢ়তা। রাসূলুল্লাহ (সা) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)-কে বলেন, “সহিষ্ণুতা বিজয়ের একটি পূর্ব শর্ত।”
আল্লাহ্ পাক স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এই উপদেশ দিয়েছেন: “তোমার ওপর যে প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি তুমি তা অনুসরণ করো এবং তুমি ধৈর্য ধারণ করো যে পর্যন্ত না আল্লাহ্র বিধান আসে এবং আল্লঅহ্ই সর্বোত্তম বিধানকর্তা।” (১০:১০৯) অন্য আরকেটি আয়াতে বলা হয়েছে, “ধৈর্য ধারণ করো, তোমার ধৈর্য তো হবে আল্লাহ্রই সাহায্যঅ তাদের দরুন দুঃখ করো না এবং তাদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণ্ন হয়ো না। আল্লাহ্ তাদেকই সাথে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা ক্ষমাশীল।” (১৬:১২৭-১২৮)
আল্লাহ্ আরো বলেন: “অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর, নিশ্চই আল্লহ্র ওয়াদা সত্য। যারা দৃঢ় বিশ্বাসী নয় তারা যেন তোমাকে বিচলিত না করতে পারে।” (৩০-৬০) আল্লাহবলেন: “অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রসূলগণ।” (৪৬-৩৫)
এবং আল্লাহ্ আরো বলেন: ধৈর্য ধারণ কর তোমার প্রভুর আদেশের অপেক্ষায়। তুমি আমার চোখের সামেনই আছ। তুমি তোমার প্রভুর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর যখন তুমি শয্যা ত্যাগ কর। (৪৬:৩৫)
প্রশ্ন: কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাফল্য ছাড়া আমরা দীর্ঘদিন কি ধৈর্য ধারণ করতে পারব?
উত্তর: কিন্তু আপনারা কি ইতিমধ্যে একটি অজ্ঞ লোককেও শিখ্ষা দেবেন না, কাউকে কি সৎপথে আনবেন না অথবা কাউকে কি তওবায় অনুপ্রাণিত করবেন না? যখন সে ইতাবচক জবাব দিলো তখন আমি বললাম, এটাই হচ্ছে আমাদের বিরাট সাফল্য যা আমাদেরকে আমাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “আল্লহ্ যদি একটি লোককেও তোমার চেয়েও অনেক উত্তম।” তাছাড়া আমাদের কাছে দাওয়াত পৌছানোর ব্যাপারেই কৈফিয়ত চাওয়া হবে, আমরা নিজেরা তাতে সফল হলাম কিনা তা নয়। আমাদেরকে অবশ্যই ভালবাসার বীজ বপণ করতে হবে এবং আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করতে হবে যাতে উত্তম ফসল পাওয়া যায়। আল-কুরআন সবর্ত্রই আমাদের পথ-প্রদর্শক: “এবং বলো, তোমরা আমল করতে থাক। আল্লাহ্ তো তোমাদের কর্যকলাপ লক্ষ্য করবেন এবং তাঁর রাসূল ও মুমিনগণও করবে এবং তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতার নিকট, অতঃপর তিনি তোমরা যা করতে তা তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন।” (৯:১০৫)