দ্বিতীয় অধ্যায়
চরমপন্থার কারণ
চরমপন্থা বা গোঁড়ামী বিক্ষিপ্ত ঘটনাবলী থেকে উৎপন্ন হয়নি। এর অবশ্যই কারণ ও উদ্দেশ্য আছে। সকল প্রণীর মতো ঘটনা ও কার্যাবলী ও শূন্য থেকেউদ্ভব হয় না- বীজ ছাড়া যেমন চারা হয় না। প্রতিটি ঘটনার পেছনে থাকে কার্যকারণ। এটা আল্লাহর সৃষ্টিরও রীতি (সুনাম)। কোনো রোগের প্রতিকার করতে হলে প্রথমে দরকার রোগ নির্ণয় (ডায়াগনোসিস)। আবার এর জন্যে অত্যাবশ্যক হচ্ছে রোগের কার গুলো জানা আর কারণ জানা না গেলে রোগের ডায়াগনোসিস অসম্বম- অন্তত খুব কষ্টকর। এ কথা স্মরণ রেখেই আমরা চরমপন্থর (গোড়ামীর) কারণ ও উদ্দেশ্য নির্ণয়ে প্রয়াসী হবো। এখানে চরমপন্থা শব্দটি গুলু অর্থাৎ ধর্মীয় বাড়াবড়ির সমার্থবোধক।
প্রথমেই আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, কোনো একটা মাত্র কারণ গোঁড়ামী বিস্তারের জন্যে সামগ্রিকভাবে দায়ী নয়। এটা একটা জটিল অদ্ভুত বিষয়। এর পেছনে নানা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কারণ রয়েছে। এগুলোর কোনো কোনোটি প্রত্যক্ষ, কোনোটি পরোক্ষ, কোনোটির গোড়া সূদুর অতীতে আবার কোনোটির উৎপত্তি বর্তমানে। সুতরাং একটি বিশেষ কারণের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অনান্য কারণগুলো উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। কোনো কোনো মতের প্রবক্তারা এরূপ একপেশে দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণে অভ্যস্ত। উদাহরণস্বরূপ মনোবিজ্ঞানী, বিশেষত মনস্তত্ত্ববিদরা অবচেতন মন থেকে উদ্ভূত কারণগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞানীরা সামজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের মুখে মানুষের অসহায়ত্বের দিকে ইঙ্গিত দেন। তাদের দৃষ্টিতে মানুষ হচ্ছে সমাজের হাতে বন্দী প্রাণহীন পুতুল। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রবক্তারা যুক্তি দেখান, অর্থনৈতিক শক্তিই ঘটনাবলীর স্রষ্টা এবং এটাই ইতিহাসের গতডি পরিবর্তন করে।
পক্ষান্তরে আরেক দল অপেক্ষাকৃত ব্যাপক ও ভারসাম্যময় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তাদের মতে কারণসমূহ অত্যাধিক জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এগুলো নানবিধ ক্রিয়া উৎপন্ন করে এবং একটা থেকে আরেকটার রূপ ভিন্ন। কিন্তু শেষ বিশ্লষণে এগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। গোঁড়ামির কারণসমূহ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক অথবা সবগুলোর সমন্বয়ও হতে পারে। পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অথবা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে সমাজে অথাৎ সেই সমাজের বিশ্বাস ও আচরণ,কল্পনা ও বাস্তব, ধর্ম ও রাজনৈতিক, কথা ও কাজ, আকাঙ্ক্ষা ও সাফল্য অথবা দ্বীন ও দুনিয়ার অসংগতির মধ্যে এর কারণসমূহ বিদ্যমান থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবে এসব পরস্পর বিরোধিতা বৃদ্ধরা মেনে নিলেও তা সাময়িকমাত্র।
ক্ষমতাসীন সরকারের দুর্নীতির দরুনও চরমপন্থা বিস্তার লাভ করতে পারে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, স্বার্থপরতা, তোষামোদপ্রিয়তা, মুসলিম উম্মাহর শত্রুদের প্রতি সেবাদাসবৃত্তি, স্বদেশের জনগণের অধিকার হরণ ইত্যাদি মানুষের মাঝে চরমপন্হী মনোভাবের জন্ম দেয়। মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের ক্রিয়াকলাপ শেষ পযর্ন্ত ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
গোঁড়ামির আরেকটি প্রধান কারন হচ্ছে, দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব অথাৎ এর উদ্দেশ্যে ও মূল চোতনার গভীর তাৎপর্য উপলদ্ধিতে ব্যর্থতা। এই উপলদ্ধির অর্থ সার্বিক অজ্ঞাতাকে বোঝায় না। সার্বিক অজ্ঞতা বাড়াবাড়ি বা গোঁড়ামির জন্ম দেয়। আসলে অল্পবিদ্যা হচ্ছে ভয়ঙ্করী। এসব লোক মনে করে সেসব কিছু জানে এবং নিজেই যেন ফকীহ। আসলে সে নানা অজীর্ণ জ্ঞানের জগাখিচুড়ি। সে বিভিন্ন খন্ডের রূপ এবং তার সাথে অখন্ডের সম্পর্ক নির্ণয়ে ব্যার্থ। ফলে তার সামগ্রিক দৃষ্টভঙ্গি কখনো পরিচ্ছন্ন হতে পারে না। অতএব তার পক্ষে কনো সুনির্দৃষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অসম্ভব। এমন ব্যক্তি যদি নিজেকে ফকীহ বলে দাবী করে তাহলে দীনের অবস্থা কী হবে! ইমাম আবু ইসহাক আশ-শাতিবী তার আল-ইতিশাম গ্রন্থে অল্পবিদ্যার বিপদ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। বিদআত এবং মুসলিম উম্মাহর অনৈক্যের মূল কারণ হলো আত্মজ্ঞানের অহঙ্কার, বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান আছে মনে করে কেউ যখন ইচ্ছা মাফিক ইজতিহাদ শুরু করে রায় দিতে থাকে তখন তাকে অবশ্যই মুবতাদী (নতুন কিছু উদ্ভাবনকারী) বলতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) এ ধরনের লোক সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন: “আল্লাহ জ্ঞান কেড়ে নেন না জনগনের (হৃদয়) থেকে। কিন্তু যখন কোনো আলিম থাকে না তখন তিনি তা কেড়ে নেন এবং জনগণ অজ্ঞ লোকদেরকে তাদের নেতা বানাবে যারা জ্ঞান ছাড়াই রায় দেবে, সুতরাং তারাও বিপথগামী হবে, জনগণকেও বিপথগামী করবে।” (বুখারী)
এ থেকে বিজ্ঞাজনেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, খাঁটি আলিমরা জনগণকে বিভ্রান্ত করেন না। কিন্তু তাদের অভাবে আলিমের বিশ্বাসভাজন কখনোই বিশ্বাস ভঙ্গ করে না, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক তা পারে। এর সাথে যোগ দিয়ে বলা যায় খাঁটি আলিম কখনোই বিদআতের জন্ম দেয়। আনাস ইবনে মালিক (রা) বর্ণনা করেন, রাবিয়া একদিন খুব কাঁদছিলেন। তার ওপর কোনো মুসিবত এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, “না, এ জন্যে কাঁদছি যে, মানুষ তাদের কাছ থেকে ফতোয়া তালাশ করেছে যাদের কোনো জ্ঞান নেই।”
বস্তুত সার্বিক অজ্ঞতার চেয়ে অহংকারযুক্ত অল্পবিদ্যার পন্ডিত কখনোই তার সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে না। এদের একটি লক্ষণ হলো এরা আক্ষরিক অর্থের প্রতি বেশী জোর দেয়, তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য উপলব্ধির চেষ্টা করে না। আলজাহিরিয়া মতাবরম্বীরা এ ধরনের পণ্ডিতী করতো। তারা আত-তালিল ও কিয়াস অগ্রাহ্য করতো।
“সমকালীন জাহিরিয়া” মতালম্বীরা পূর্বসূরীদের পথ ধরে যুক্তি প্রদর্শন করে যে, বাধ্যতামূলক কাজকর্মের কোনো গভীর অর্থ খোঁজা উচিৎ নয়। অবশ্য নব্যজাহিরিয়ারা পূর্বসূরীদের মতো তালিল পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে না। আমার ও অন্যান্য আলিমের মতে ইবাদত হচ্ছে এমন বাধ্যতামূলক কর্তব্য যার কারণ ও উদ্দেশ্য কখনোই বিশ্লেষণযোগ্য নয়। তবে যেসব শিক্ষা আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রন করতে চায় সেগুলো অবশ্যই বিশ্লেষণ করতে হবে।
সুতরাং কোনো মুসলমান দান-খয়রাত করে বলে তার হজ্জ করা উচিত কিংবা হজ্জের সময় কুরবানীর অর্থ সদকা করে দেয়া উচিত-এই দাবী করা ভুল হবে। তেমনিভাবে এটাও অচিন্তনীয় যে, আধুনিক কর যাকাতের স্থান দখল করবে, রমযানের পরিবর্তে অন্য যে কোনো মাসে রোযা কিংবা শুক্রবারের স্থলে অন্য যে কোনো দিন জুমআ’র নামায আদায় করা যাবে। এসব বাদ দেওয়া যাবে না। এগুলো সবই মুসলমানের জন্যে অবশ্য পালনীয়। কিন্তু এ ধরনের আনুষ্ঠানিক ইবাদত প্রক্রিয়া ব্যতীত অন্য যে কোনো বিষয়ের কারণ ও উদ্দেশ্য আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সঠিক উপলব্ধির পর ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।
এখন আমরা কতিপয় প্রামাণিক বিষয় পর্যালোচনা করতে পারি:
ক. একটি বিশ্বস্ত হাদীসে বলা হয়েছে, কাফিরের দেশে কুরআন শরীফ নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণ পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, কাফিররা কুরআনের ক্ষতি বা অবমাননা করতে পারে এই আশংকায় রাসূলুল্লাহ (সা) এরূপ আদেশ দিয়েছেন। এরূপ আশংকা না থাকলে যেখানে ইচ্ছে কুরআন শরীফ নেয়া যেতে পারে। তাছাড়া দাওয়াতী কাজের জন্যে এটা তো অপরিহার্য।
খ. আরেকটি হাদীসে মাহরাম (অথাৎ বিষয় অযোগ্য পুরুষ আত্মীয়) সঙ্গী ছাড়া মুসলিম নারীকে সফর করতে নিষেধ করা হয়েছে। নারীর নারাপত্তা ও সফরের কষ্ট লাঘবই এর উদ্দেশ্য। আধুনিক যুগে যেহেতু সফরের এতো ঝুঁকি নেই তাই কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে গাড়িতে তুলে দিতে পারেন। গন্তব্য স্থানে কোনো মাহরাম ব্যক্তি তাকে স্বাগত জানালে দোষের কিছু নেই। বস্তুত রাসূলুল্লাহ (সা) যোগাযোগ ব্যবস্থার এরূপ উন্নতির আভাস দিয়ে বলেছিলেন, এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করেই ইরাক থেকে মক্কা ভ্রমন করতে পারবে।
গ. রাসূলুল্লাহ (সা) দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর রাতে বাড়ি ফেরা নাষিদ্ধ করেছেন। তিনি নিজেও সক্লে বা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। এর দু’টো কারণ। প্রথম, আকস্মিকভাবে স্বামীর রাতে বাড়ি ফেরার মধ্যে স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাস ইসলাম সমর্থন করে না। দ্বিতীয়ত, স্ত্রী যেন নিজেকে পরিপাটি করে রাখতে পারে সে জন্যে স্বামীর আগমনের সময় জানার অধিকার তার আছে। কিন্তু এখন এসব আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ খুব কম। মানুষের যাতায়াতের সময়সূচী মেনে চলতে হয়। কে কখন কোথায় যাবে তা আগেভাগেই নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে বাড়ি যাওয়া আগে টেলিফোন বা চিঠিতে জানানো উচিত। সুতরাং আমাদেরকে স্থান ও কালের প্রেক্ষাপটে উক্ত নিষেধাজ্ঞার কারণ ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করতে হবে।
যাকাতকে ইবাদত মনে না করে অনেকে এটাকে কেবল অর্থ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গণ্য করতে চান। যাকাত ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং ধর্মীয় কর্তব্য। এটা ইসলামী শরীয়ত ব্যবস্থার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও স্থায়ী আয়ের সূত্র, সেই হিসেবে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থারও স্তম্ভ। তাই এটার বাধ্যবাধকতাকে খর্ব করার কোনো উপায় নেই। যাকাতের সামাজিক সম্ভাবনার দিকে লক্ষ্য করে সকল মাযহাব-এর আহকামের ব্যপারে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ফসলের (ফল ও শস্য) দ অথবা পাঁচ ভাগ গরীবদের দান করা বাধ্যতামূলক- সে ফসল শুকনোই হোক আর তাজা হোক। সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশ হচ্ছে – এর মূল লক্ষ্য। ধনীর সম্পদে গরীবের সুনির্দিষ্ট হিস্যা আছে। আর এর লক্ষ্য হচ্ছে পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা: “তাদের সম্পদ থেকে তুমি সাদকা গ্রহন করো। এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করবে।”
একজন আধ্রনিক পন্ডিত “খাদ্যশস্যের ওপর সাদকা নেই” এই হাদীস উদ্ধৃত করে উপরোল্লিখিত যুক্তি অস্বীকার করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আমলে খাদ্যশস্যের ওপর যাকাতের বিধান প্রচলিত ছিল না বলেও তিনি দাবী করেন। কিন্তু হাদীসটি দুর্বল বিধায় তার যুক্তি মিথ্যা এবং বলেছেন এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর (সা) কোনো প্রামাণিক হাদীস নেই। দ্বিতীয় যুক্তিটিও দু’টি কারণে মিথ্যা। প্রথম কারণ, ইমাম ইবনুল আরবীর ভাষায় এ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে বর্ণিত সুস্পষ্ট বিধানের মুকাবিলার অন্য কোনো প্রমাণ অগ্রাহ। কুরআন বলছে : “মৌসুমের ফলমূল থেকে খাও; কিন্তু ফসল সংগ্রহের দিনে ন্যায্য হিস্যা দান করে দাও।” (৬ : ১৪১)
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবদ্দশায় এ ব্যবস্থার প্রচলন না থাকলেও আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে, তিনি হয়তো বিষয়টি তাঁর উম্মতের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। কেননা সে যুগে ফলমূল ও খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করা কষ্টকর ছিলো।
অবশ্য উক্ত পন্ডিত স্বীকার করেছেন যে, একটি হাদীসে কেবল খেজুর, গম, কিসমিস ও বার্লির ওপর যাকাত সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ হাদীসটিও দুর্বল এবং কোনো কোন হাদিস বিশারত এর প্রামাণিকতা স্বীকার করেননি বিধায় কোনো মাযহাব একে প্রমাণিক বলে গ্রহণ করেনি। সুতরাং সকল ফলসের ওপর যাকাতের বাধ্যতামুলক বিধানকে কিভাবে অস্বীকার করা যায় যখন কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছে : “তিনিই লতা ও বৃক্ষ উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর বৃক্ষ বিভিন্ন স্বাদ বিশিষ্ট খাদ্য শস্য, জলপাই ও ডালিম র্সষ্টি করেছেন। এগুলো একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও। যখন এটা ফলবান হয় তখন ফল খাবে আর ফসল তুলবার দিনে এর দেয় প্রদান করবে। ” (৬:১৪১)
আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে: “হে ইমানদারগন, তোমরা যা কিছু উপার্জন করো এবং আমি যা ভূমি থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদান করে দিই তার মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো।” (২:২৬৭)
একটি প্রমানিক হাদীসেও যাকাত প্রদানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “নদী অথবা বৃষ্টির পানি বিধৌত জমি থেকে এক-দশমাংশ; (সেচের) পানি সিঞ্চিহত জমি থেকে শতকরা পাঁচ ভাগ।” (ইমাম আবু হানিফা: আহকামুল কুরআন)
এই হাদীসে কোনো বিশেষ ফসলের মধ্যে যাকাতকে সীমিত করা হয়নি। এখানে বাধ্যতামূলক হার পরিষ্কারভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে উমর ইবনে আবদুল আজিজ ও ইমাম আবু হানিফা (রহ) এ ব্যাপারে কুরআনী আয়াতের (৬:১৪১)
ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইমাম আবু হানিফা (রহ)-র মতগুলোকে অপেক্ষাকৃত সুদৃঢ় বলে উল্লেখ করেছেন। অনান্য মাযহাবের প্রমাণগুলোকে দুর্বল আখ্যায়িত করে ইবনুল আরবী (রহ) বলেছেন, “ আবু হানিফা (রহ) (পূর্বোউল্লিখিত) মূল সূত্রগুলোকে আয়নার মত ব্যবহার করেসত্যকে অবলকন করেছেন।” শরাহ আত-তিরিমিযীতে আরবী (রহ) বলেন, “(যাকাতের ব্যাপারে) আবু হানিফা (রহ)-এর মাযহাব সূদৃঢ় প্রমাণ পেশ করেছে।” আহকাম ও তাদের কারনগুলোর মধ্যেকার সঙ্গতি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে মারাত্মক স্ববিরোধিতার আশংকা থাকে। তখন আমরা একই বিষয়কে ভাগ ভাগ করে দেখি। আবার বিভিন্ন বিষয়কে এক করে ফেলি। এটা হচ্ছে সুবিচারের পরিপন্থী যার ওপরে আশ-শারীরাহ প্রতিষ্ঠিত পাণ্ডিত্যভিমানীরা কোনো জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি ছাড়াই আহকামের কারন খুঁজতে গিয়ে বিষয়গুলোকে জটিল করে তোলেন। এ জন্যে জনগণের কছে সত্য স্পষ্ট করে তুলে ধরতে আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে অথবা বিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের জন্যে ইজতিহাদের দ্বার খুলে দিতে হবে। সেই অনধিকার চর্চাকারী পরজীবীদের বিরুদ্ধেও সতর্ক থাকা দরকার।
১. ছোট খাট বিষয় নিয়ে মেতে থাকা
বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধাত্বের একটি লক্ষন হচ্ছে বড় বড় বিষয় উপেক্ষা করে ছোটখাট বিষয় নিয়ে মেত থাকা। অথচ বৃহৎ বিষয়গুলৌ এতো গুরুত্বপূর্ন যে, এগুলোর প্রতি উদিসীন উম্মাহর অস্তিত্ব, আশা-আকাক্ষা, পরিবেশ তথা সামগ্রিক সত্তাকে বিপন্ন করতে পারেঅ দাড়ি রাখা, গোড়ালীর নিচে পযর্ন্ত কাপড় পরা, তাশাহুদের সময় আঙ্গুল নাড়ানো, আলৌকচিত্র রাখার মতো ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে অবিরাম বাড়াবাড়ি চলছে।এমন এক সময় এসব নিয়ে হৈ চৈ করা হচ্ছে যখন মুসলিম উম্মাহ ধর্ম নিরপেক্ষবাদ, ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদের নিরবচ্ছিন্ন বৈরিতা ও অনুপ্রবেশের সম্মুখীন। ক্রীশ্চান মিশনরীরা মুসলমানদের ঐতিহাসিক ও ইসলামী চরিত্র ক্ষুণ্ণ করার জন্যে নতুন ক্রুসেড শুরু করেছে। দুনিয়ার বিভিন্ন আংশে মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলিম ধর্ম প্রচারকরা চরম ভীতি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমি দেখছি, যারা শিক্ষাদীক্ষা আথবা জীবিকা অর্জনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপে এসেছেন, তাঁরাও ছোটখাট বিতর্কিত বিষয়গুলো সাথে নিয়ে এসেছেন এবং এ নিয়ে মাথা ঘামান। এটা এক কথায় র্মমান্তিক! আমি নিজে দেখেছি এবং শুনেছি এসব বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্য অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিষয়গুলো ইজতিহাদ সাপেক্ষ। এগুলো এমন বিষয় যা নিয়ে ফকীহদের মত সর্বস্মত হয় না। আমি নিজেও এগুলের ওপর বক্তব্য রেখেছি। যা হোক এসব নিরর্থক মাসলা-মাসাকয়েল নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ না করে প্রবাসীদের উচিত ইসলামের মূল সত্যকে আঁকড়ে ধরা। বিশেষ করে মুসলিম তরুণদের এদিকে আকৃষ্ট করা, তাদেরকে অবশ্য পালনীয় কাজগুলো করতে এবং কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করা। এই দায়িত্ব পালনে সফল হলে ইসলাম প্রচারে এক নতুন আশার সঞ্চার হেব।
এটা দুঃখজনক যে, যারা এ ধরনের বিতর্ক ও সংঘাতের সূত্রপাত করেন তারাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিধি পালনে উদাসীন বলে অভিযোগ রয়েছে। মাতা-পিতার প্রতি কতব্য, স্ত্রী ও সন্তান প্রতিপালন, প্রতিবেশির সাথে সদ্ভাব, সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব পালন, বৈধ ও অবৈধ বিচারে সতর্কতা ইত্যাদি প্রশ্নে তাদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু তারা নিজেদের মান উন্নত করার পরিবর্তে বিতর্ক সৃষ্টি করে খুব মজা পান। শেয় পর্যন্ত তাদেরকে এর দরুন বৈরিতা অথবা মুনাফিকীর ন্যায় আচরণ করতে হয়। একটি হাদীসে এরূপ বাক-বিতন্ডার কথা উণ্ণখ করা হয়েছে : “যারা (সঠিক) পথ পেয়েছে তারা কখনো বিভ্রান্ত হবে না যতক্ষন না তারা বাক-বিতন্ডায় নিমজ্জিত হয়।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী) এ রকমও দেখা যায়, কেউ কেউ আহলে কিতাবদের জবাই করা পশুর গোশত মুসলমানদেরকে খেতে নিষেধ করেন যদিও বর্তমান ও অতীতে এর বৈধ হওয়া সম্পর্কে ফতোয়া আছে। অথধচ এ রকম লোকদেরই দেখা যাবে এর চেয়ে বড় বড় নিষিদ্ধ কাজ করতে তারা সিদ্ধহস্ত। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের একটা ঘটনার কথা আমি শুনেছি। এক ব্যক্তি খুব বড় গলায় বলছিল ইহুদী ও খৃষ্টানদের জবাই করা পশুর গোশত খাওয়া যাবে না। কিন্তু সে নির্লজ্জের মতো অন্যদের সাথে একই টেবিলে বসে মদ সহযোগে ঐ গোশত ভক্ষণ করছিলো। অথচ সে নির্দ্বিধায় একিট অনিশ্চত ও বিতর্কিত বিষয়ে গোঁড়া বক্তব্য রাখছিলো। ঠিক এ রকম পরস্পর বিরোধী আচরণ দেখে একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। হযরত হুসাইনের (রা) শাহাদাতের পর ইরাক থেকে এক ব্যক্তি এসে তাকে মশা মারা হালাল কি হারাম জিজ্ঞেস করলো। ইমাম আহমদ তাঁর মসনদে বর্ণনা করছেন:
আমি ইবনে উমরের সাথে বসেছিলাম। একিট লোক এসে তাকে মশার রক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞস করলো। ইবনে উমর (রা) তাকে বললেন, “তুমি কোত্থেকে এসেছ?” সে জবাব দিল, “ইরাক থেকে।” তখন ইবনে উমর বললেন, “দেখ লোকটির দিকে! সে আমাকে মশার রক্ত সম্পর্কে প্রশ্ন করছে, অথচ তারা (ইরাকিরা) রাসূলুল্লাহ (সা)- এর পৌত্রকে [আল-হুসাইন ইবনে আলী (রা)] হত্যা করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ (সা) – কে বলতে শুনেছি : “তারা (হাসান ও হুসাইন) এই জগতে আমার দু’টি মিষ্টি মধুর সুরবিত ফুল।” (আহমাদ)
২. নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাড়াবাড়ি
ইসলামী আইনশাস্র ও শরীয়াহর জ্ঞানের অবাবে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্র নিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি দেখা যায়। কুরআন ও সুন্নায় এর বিরুদ্ধে পরিস্কার সতর্ক বাণী রয়েছে। কুরআন বলছে :
“তোমাদের মুখ থেকে যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে তেমনি করে তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বলো না যে, এটি হালাল এবং ওটি হারাম।” (১৬: ১১৬)
রাসূলুল্লাহ (সা) – এর সাহাবী এবং প্রাথমিক যুগোর বুজর্গানে দ্বীন নিশ্চত না হওয়া পর্যন্ত কনো জিনিসকে নিষিদ্ধ বা হারাম বলে ফতোয়া দিতেন না। কিন্তু চরমপন্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে হারাম ফতোয়া দিতে যেন এক পায়ে খাড়া থাকে। ইসলামী আইনশাস্ত্রে কোন বিষয়ে যদি দুটো মত থাকে যদি এক পক্ষ বলে মুবাহ, আন্য পক্ষ বলে মাকরূহ; চরমপন্থীরা এক্ষেত্রে মাকরূহকে সমর্থন করে পরহেযগারী যাহির করে। এক পক্ষ যদি একটি বিষয়কে মাকরূহ এবং অন্য পক্ষ হারাম বলে ঘোষণা করে সে ক্ষেত্রে গোঁড়া ব্যক্তিরা হারামের পক্ষ নিয়ে সাধুতার প্রমাণ রাখতে চায় অর্থাৎ সহজ ও কঠিনের মধ্যে তারা শেষোক্তটাকে বেছে নেয়াই অধিকতর তাকওয়ার লক্ষণ বলে মনে করে। তারা ইবনে আব্বাসের (রা) কঠোর মত গ্রহণে বেশি আগ্রহী। বস্তুত এই প্রবণতা মধ্যমপন্থার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই ফসল। বিষয়টি বোঝায় সুবিধার্থে আমি একটি প্রত্যক্ষ ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
একদিন এক গোঁড়া লোক অপর এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে দেখে তার পাক সাফ হওয়ার
জন্যে তৎক্ষণাৎ বমি করতে বলল। আমি তখন গোঁড়া লোকটিকে নম্রবাবে বললাম, “এজন্য এতো কঠোর ব্যবস্থার দরকার পড়ে না। এটা একটা চোট ব্যাপার।” সে বলল, হাদীসে এটা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। আর কেউ যদি ভুলক্রমে করে বসে তবে সহীহ হাদীসে বমির বিধান আছে।” আমি জবাব দিলাম, “কিন্তু দাঁড়িয়ে পানি খাওয়ার পক্ষে যে হাদীস আছে তা অধিক প্রমাণিত এবং বুখারীর একটি অধ্যায় আছে যার শিরোনাম হলো, “দাড়িয়ে পানি পান করা।” ঐ ব্যক্তি নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে কোনো হাদীসের উদ্ধৃতি দিতে পারলো না। অথচ এটা সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বিদায় হজ্জের সময় দাঁড়িয়ে পানি পান করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম)
এছাড়া একবার হযরত আলী (রা) দাঁড়িয়ে পানি পান করতে করতে বলেছিলেন, “এটা অনেকেই পছন্দ করে না, কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এরূপ করতে দেখেছি যেমন তোমরা আমাকে দেখছ।” (বুখারী, মুসলিম)
ইবনে উমরের (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে ইমাম তিরমিযী বলছেন, “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগে আমরা চলন্ত অবস্থায় খাবার খেতাম এবং দাঁড়িয়ে পানি পান করতাম।” কাবশাহ (রা) বলেন, “আমি একবার রাসূলুল্লাহ (সা) -কে ঝুলন্ত মশক থেকে পানি পান করতে দেখেছি।”
মোটকথা নির্ভরযোগ্য হাদীস বিশারদদের ব্যাখ্যা থেকে আমরা দেখতে পাই বসে পানি পান করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ নেই। আর দু’টো ব্যাপারই প্রমাণিত। অতএব, কেউ দাঁড়িয়ে পান করলেও নিষেধ নেই। কেউ দাঁড়িয়ে পানি পান করলেই বমির বিধান জারি করাটা সম্পুর্ণ ভুল।
একইভাবে, আজকাল অনেক তরুণ ইসলামী পোশাক নিয়ে জল্পনা কল্পনায় লিপ্ত। হাদীসে এর দৃঢ় ভিত্তি আছে: “(পোশাকের) যে অংশ গোঁড়ালির নিচে (ঝুলে থাকে) তা আগুনে (পুড়বে)।” (বুখারী)
এ জন্য অনেক তরুণকে গোঁড়ালির উপরে পোশাক পরতে দেখা যায় এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের উপরেও এটা চাপাতে চায়। কিন্তু এরূপ চাপাচাপির ফলটা এই হবে যে, একপক্ষ অপরপক্ষের বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবেই গোঁড়ামির অভিযোগ আনবে। এটা সত্য যে, কিছু হাদীসে গোড়ালির নিচে কাপড় পরিধানের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আবার অন্য হাদীসে এই নিষেধাজ্ঞার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। একদা এভাবে কাপড় পরাকে অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য ও অপচয়ের লক্ষণ মনে করা হতো। দৃষ্টান্তস্বরুপ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ কিয়ামতের দিনে সেই ব্যক্তির দিকে থাকবেন না যে অহঙ্কারবশত তার কাপড়কে (পেছনে) টেনে নিয়ে যায়।” (মুসলিম)
হযরত আবু বকর (রা) রাসুলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, “আমার ইজার অসাবধানতাবশত নিচে নেমে যায়।” রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন “যারা গর্বোদ্ধত হয়ে এরূপ করে তুমি তাদের মধ্যে নও।” (বুখারী) এ কারনে আন-নববী ও অন্যান্য মুসলিম মনীষীরা তম প্রকাশ করেছেন যে, এরূপ কাপড় পরা মাকরূহ। কিন্তু মাকরূহ অনিবার্য কারণে মুবাহ হতে পারে।
৩. ভ্রান্ত ধারণা
ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে অগভীর জ্ঞান থেকেই মূলত বিতর্কের সূত্রপাত। এ জন্যে ইসলাম, ঈমান, কুফর, নিফাক ও জাহিলিয়াত ইত্যাদির সঠিক সংজ্ঞা ও পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ভাষাগত জটিলতা, বিশেষত আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তির অভাব বহুলাংশে বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত ধারণার জন্যে দায়ী। ফলত অনেকেই রূপক ও প্রকৃত অর্থের মধ্যে তারতম্য উপলদ্ধি করতে পারেন না। ঈমান ও পূর্ণ ইমান, ইসলাম ও প্রকৃত ইসলাম, বিশ্বাসে মুনাফেকী ও কর্মে মুনাফিকী, ছোট ছোট শিরক ও বড় বড় শিরকের মধ্যে তারা পার্থক্য করতে অক্ষম। এখন আমি এসব বিষয়ের একিট সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি। এতে এ সম্পর্কে আমারা সতর্ক হতে পারব। বস্তুত অনুভূতি, কথা ও কাজের সমন্বয়ে ঈমান পূণৃ রূপ লাভ করে।
কুরআনে এই ঈমান সম্পর্কে বলা হয়েছে :
“মুমিন তো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি করে দেয়।” (৮:২)
“সেসব ঈমানদারই সফলকাম হয়েছে যারা বিনয়াবনত চিত্তে নামায আদায় করে।” “তারাই ঈমানদার যারা আল্লাহ ও রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তারপর কখনোই সন্দেহ পোষন করেনি এবং আল্লাহর রাস্তায় জান ও মাল দিয়ে লড়াই করেছে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।” (৪৯: ১৫) নিম্মোক্ত হাদীসেও ঈমানের এই রূপ তুলে ধরা হয়েছে:
“যারাই আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের ওপর ঈমান এনেছে তাদের উচিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা … যা ভাল তাই তাদের বলা উচিত নতুবা চুপ থাকা (উত্তম)।” (বুখারী)
আরেকটি হিদীসে ঈমানের নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে : “সেই ব্যক্তি ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না সে তার (মুসলমান) ভাইয়ের জন্যে তাই ভাল মনে করবে যা সে তার নিজের জন্য ভাল মনে করেব।” (বুখারী)
এখানে লক্ষণীয়, শোষোক্ত হাদীসে দু’টিতে ঈমানের নেতিবাচক রূপ তুলে ধরে প্রকুতপক্ষে ঈমানের পূর্ণ রূপ তুলে ধরা হয়েছে।; সেরূপ ঈমান নয় যেমন বলা হয়: “যে তার জ্ঞান কাজে লাগায় না সে বিদ্বান নয়।” এখানে সীমিত জ্ঞান নয়, বরং পূর্ণ জ্ঞানের নেতিবাচক দিকটির প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এই হাদীসেও পূর্ণ ঈমানের পরিচয় বিধৃত হয়েছে: ঈমানের সত্তরটি শাখা আছে, তার মধ্যে একটি শাখা হচ্ছে লজ্জা বা হায়া। ইমাম আবু বকর আল-বয়হাকী তাঁর ‘আল -জামি’লী শুয়াব আল- ঈমান’ কিতাবে ঈমনকে একটি গাছের সাথে তুলনা করা হয়েছেন। গাছের কান্ড হচ্ছে ঈমানের মৌলিক অঙ্গের প্রতীক। যেহেতু গাছ এর কিছু শাকা-প্রশাখা নিয়ে ইসলামের আওতায় তাকতে পারে। ফেরেশ্তা ও তকদীরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা।”
আল-হাফিজ আল-বায়হাকী ফতহুল বারীতে লিখেছেন: “আমাদের বুজর্গ পূর্বপুরুষরা বলেছেন : ঈমান হলো হৃদয়ে বিশ্বাস স্থাপন, মুখে উচ্চারণ ও কর্মে রূপায়ণ। এর অর্থ বাস্তব জীবনে রূপায়ণ ছাড়া ঈমান পূর্ণ হতে পরে না। এ জন্যে তারা মনে করতেন ঈমান বাড়াতে ও কমাতে পারে। আল-মাজিয়াহ মনে করেন, ঈমান শুধু মনে ও উচ্চারণে; আল-করামিয়াহ বিশ্বাস করেন, উচ্চারণই যথেষ্ট; আল-মুতাযিলাহর ধারণা, ঈমান হলো বিশ্বাস, উচ্চারন ও বাস্তাবায়নের সমন্বত রূপ।… এ ব্যাপারে তাঁদের ও পূর্ববতী বুজর্গদের মধ্যে পার্থক্য এটাই যে, পূর্বোক্তরা আমলকে ঈমানের প্রমাণ হিসেবে মনে করেন। আর শেষোক্তরা আমলকে পূর্ণতার শর্ত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু পূর্ণ সত্তা কেবল আল্লাহ তায়ালাই। আমাদের কাছে ঈমানের মৌলিক ঘোষণাই যথেষ্ট। কেননা পরিপূর্ণ পরম সত্তা কেবল আল্লাহ জাল্লা জালালুহু। একবার যে মুখে ঈমানের ঘোষনা দেয় তখন থেকেই আল্লাহ শানুহুর দৃষ্টিতে তাকে মুসলমান হিসেবে গণ্য করা হয। যতোক্ষণ না সে এমন আচরন করে যাতে মনে হয় সে বেঈমান, যেমন মূর্তির কাছে মাথা নত করা। কেউ যখন পাপ কাজ করে তখন তাকে আমরা ঈমন সংক্রান্ত স্ব স্ব ধারণার আলোকে ঈমানদার ভাবতে আবার নাও ভাবতে পারি। পূর্ণ ঈমানদার। কারো বিরুদ্ধে যদি কাফির হওয়ার অভিযোগ ওঠে তবে এ কারণেই যে সে কুফরীর আচরণ করে।’
একজন কাফির যখন এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল, তখুনি সে মুসলমান হয়ে যায। তৎখণাত সে নামায আদায় করলো কিনা সেটা বড় কথা নয়। যাকাত ইত্যাদি এগুলো সে মেনে নিলো সেটাই বড় কথা। আমল কতটুকু করলো সেটা পরে লক্ষণীয়। কালেমার মৌখিক উচ্চারণের সাথে সাথেই সে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পেয়ে গেলো। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “যারা কালেমা (শাহাদাত) উচ্চারণ করলো, তারা আমার কাছ থেকে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পেলো… তাদেরকে আল্লাহর কাছেই জবাবদিহি করতে হবে।” (বুখারী)
ইসলাম শব্দটিও ইবনে উমর (রা) বর্নিত পাঁটি স্তম্ভেকেই বোঝায়: “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত – এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল; নামায আদায় করা যাকাত দেয়া, রোজা রাখা এবং হজ্জ আদায় করা।” হাদীস শাস্ত্রেও জিবরাঈল (আ)-এর মুখে ইসলামের সংঙা দেয়া হয়েছৈ। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন তাঁকে বলেন, “ইসলাম কী?” তখন তিনি বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা, নামায আদায় করা যাকাত দেয়া এবং রমযান মাসে রোজা রাখা।” (বুখারী)
জিবরাঈল (আ) এর কথা থেকে আমরা ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য বুঝতে পারি। এটাও পিরষ্কার যে, দু’টি শব্দকে এক অর্থেও ব্যবহার করা যায়। দু’টির একত্র সমাহারে দেখা যাবে একটির মধ্যে আরেকটির অর্থ লুক্কায়িত আছে, অথাৎ ঈমান ছাড়া ইসলাম নেই। ইসলাম ছাড়া ঈমান নেই। ঈমনের স্থান হৃদয় কন্দরে আর ইসলামের রূপায়ণ হচ্ছে আবেগ ও আচরণের সংমিশ্রণে। নিম্মোক্ত হাদীস থেকে আমরা এটাই উপলব্ধি করতে পারি: “ইসলাম হচ্ছে প্রকাশ্য আর ঈমান হচ্ছে অন্তরে (বিশ্বাসের বিষর)।”(আহমদ, আলবাজ্জাজ)
ঈমানের এই সংজ্ঞা আমরা কুরআনেও দেখতে পাই : “বেদুঈনরা বলে, ‘আমরা ঈমান আনলাম; বল, তোমরা ঈমান আননি বরং, তোমরা বল, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি, কেননা তোমাদের হৃদয়ে এখনও ঈমান প্রবেশ করেনি।” (৪৯:১৪)
আর ইসলামের পূর্ণ পরিচয় দিয়ে হাদীসে বলা হয়েছে: “ইসলাম হলো (সেই অবস্থা) যখন তোমার হৃদয় (সম্পূর্ণরূপে) আল্লাহ্ র কাছে সমর্পিত হয় এবং যখন তুমি মুসলমানদেরকে তোমার যবান ও হাত দিয়ে ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকো।” অন্য দু’টি হাদীসেও বলা হয়েছে: “সেই হচ্ছে মুসলমান যার যবান ও হাত দিয়ে অন্য মুসলমানের ক্ষতি হয় না” এবং তুমি নিজের জন্য যা ইচ্ছে করো অপরের জন্যে তাই করলেই তুমি মুসলমান।”
ফিকাহর ভাষায় কুফরের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর কালামের প্রতি অকৃতজ্ঞতা ও অস্বীকৃতি। আল-কুরআনে এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়: “কেউ আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল এবং কিয়ামত দিবমকে অস্বীকার করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।” (৪:১৩৬)
কুফর রিদ্দাকেও বোঝায় ফলশ্রুতিতে ঈমান সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়: “কেউ ঈমান ত্যাগ করলে তার আমল নিষ্ফল হবে এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত হবে।” (৫:৫)
“তোমাদের মধ্যে কেউ যখন দ্বীন থকে ফিরে যায় এবং বেঈমান হয়ে মরে যায়, ইহকালে ও পরকালে তাদের আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে। তারাই দোযখী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।” (২:২১৭) কুফরের অর্থ সীমালংঘনও হয় যা পুরোপুরি ইসলামকে প্রত্যেখানের শামিল নয়, কিংবা আল্লাহ্-রাসূলের অস্বীকৃতিও বোঝায় না।
মনষী ইবনুল কাইয়েম কুফরকে ছোট ও বড় এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। বড় কুফরের শাস্তি স্থায়ী জাহান্নাম আর ছোট কুফরের শাস্তি জাহান্নমের অস্থায়ী বাস। একটি হাদীস লক্ষণীয় : “আমার উম্মাহর মধ্যে কুফরীর দু’টি (লক্ষণ) প্রচলিত আছে: “বংশ পরিচয় কলংকিত করা এবং মৃত্যে জন্য বিলাপ” এবং কেউ যদি গণকের খৌঁজ করে এবং তাকে বিশ্বাস করে তবে সে মুহাম্মদ (সা)-এর অবতীর্ণ ওহীর সাথে কুফরী করে।” হাদীসে আরো বলা হয়েছে: “(আমার পরে) পরস্পরকে হত্যা করে কুফরীর দিকে ফিরে যেয়ো না।” কুরআনের একটি আয়াতের এটা হচ্ছে ইবনে উমর (রা) ও অনান্য বিশিষ্ট সাহাবীর ব্যাখ্যা, আয়াতটি হচ্ছে: “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই অবিশ্বাসী।” (৫:৪৪) আয়তটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: “এটা সেই কুফরী নয় যা একজনকে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত করে, বরং এটি হচ্ছে কুফরীর একটি উপাদান; কারণ যে ব্যক্তি এরূপ করে সে আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে অবিশ্বাস করে না।” তাউস একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। আতা বলেন, এটা হচ্ছে কুফর অথবা অন্যায় অথবা ফিস্ ক যা অপরটির চেয়ে ছোট অথবা বড় হতে পারে। ইকরামার মতো অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন: আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার করে না তারা কুফরী করে। কিন্তু এই যুক্তিটা দুর্বল। কারণ এক ব্যক্তি শরীয়াহর আলোকে বিচার করুক আর নাই করুক, নিরেট অস্বীকৃতিই কুফর। এ প্রসঙ্গে ইবনুল কাইয়েম বলেন: আল্লাহ্র বিধানের পরিপন্থী বিচার বিবেচনার মধ্যে ছোট ও বড় দুই ধরনের কুফরী হয়ে থাকে। আর এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। যদি সে বিশ্বাস করে যে, বিচার আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ীই হতে হবে এবং শাস্তির সিদ্ধান্ত নিলো কিন্তু তা করা থেকে বিরত খাকলো তাহলে সে ছোট কুফরী করে। কিন্তু যদি কোন বিশ্বাসী মনে করে যে, এটা বাধ্যতামূলক নয় এবং ঈমানের পরিপন্থী যা খুশী তাই করতে পারে তাহলে সে বড় পাপ করে। কিন্তু যদি সে অজ্ঞতা ও অনিচ্ছাবশত ভুল করে বসে তবে তাকে কেবল “ভুল করেছে” এতটুকু বলা যাবে।
যা হোক বিষয়টির সারাংশ হচ্ছে, সকল সীমালংঘন ছোট কুফরের লক্ষণ, এই অর্থে অকৃতজ্ঞতা; কারণ মান্য করা বা আনুগত্যের মধ্যেই কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। অতএব মানবীয় প্রচেষ্টা কৃতজ্ঞতা অথবা কুফর কিংবা এ দুয়ের মাঝখানে কোনো কিছু দিয়ে প্রকাশ পায়-প্রকৃত সত্য আল্লাহ্ পাকই জানেন।
শিরকও দু’ভাগে বিভক্ত: ছোট ও বড়। বড় শিরক হলো আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা অথবা তাঁর সাথে অন্য কাউকে শিরক করা। আল-কুরআনের একটি আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: “আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক করলে তিনি মাফ করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ যাকে ইচ্ছা করেন।” (৪:৪৮)
ছোট শিরক হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা অথবা দুর্ভাগ্য সৌভাগ্য পরিণত করার জন্যে তাবিজ-তুমারের ক্ষমতায় বিশ্বাস করা। এই শিরক সম্পর্কে এক হাদীসে বলা হয়েছে, “যে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কারো নামে শপথ করে সে শীরক করে এবং যে তাবিজ পরে সে শিরক করে।” (আহমাদ, আলহাকিম) এছাড়া “যাদু, তাবিজ ও ম্যাসকট (কোনো কিছু কে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মানা) বিশ্বাস হচ্ছে শিরক।” (ইবনে হাবান, আলহাকিম)
নিফাকও (মুনাফিকী) ছোট ও বড়-দু’ভাগে বিভক্ত। বড় মুনাফিকী হলো হৃদয়ে কুফরী পোষণ আর বাইরে প্রতারণার উদ্দেশ্যে ঈমানের ভাব করা। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে: “মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করি, কিন্তু তারা বিশ্বসী নয়।আল্লাহ্ ও ঈমানদারদের তারা ভাঁওতা দিতে চায়। তারা নিজেদের ছাড়া কাউকে প্রতারিত করে না এটা তারা বুঝতে পারে না।”(২:১৪)
এ ধরনের নিফাকের কথা সূরা আল-মুনাফিকুনে এবং কুরআনের অনান্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নিফাকের জন্যে আল্লাহ জাহান্নামের শাস্তির ওয়াদা করেছেন।
“মুনাফিকরা তো দোযখের নিকৃষ্টতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্যে তুমি কখনো কোনো সহায় পাবে না।” (৪:১৪৫)
ছোট নিফাকের লক্ষণ হচ্ছে আল্লাহ্ ও পরকালের প্রকৃতই বিশ্বাস আছে কিন্তু মুনাফিকের বৈশিষ্ট্যও আছে। ও ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হাদীস হচ্ছে:
“মুনাফিকীর তিনটি লক্ষণ: সে যখন কথা বলে, (সর্বদা) মিথ্যা বলে; যখন সে প্রতিজ্ঞা করে (সর্বদা) ভঙ্গ করে; যদি তাকে বিশ্বাস করা হয় তবে (সর্বদা) সে অসাধু বলে প্রমাণিত হবে।” (অনুমোদিত হাদীস)
“যার মধ্যে (৪টি বৈশিষ্ট্য) আছে যে নির্ভেজাল মুনাফিক, যার মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে নিকাফের একটি উপাদান আছে যতক্ষণ না সে একটি উপাদান আছে যতক্ষণ না সে এটা পরিত্যাগ করে: যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে; বিশ্বাস করা হলে বিশ্বাসঘাতকতা করে; চুক্তি করা হলে খেলাফ করে এবং যদি সে ঝগড়া করে তবে খুব হঠকারী, অশালীন ও অপমানজনক আচরণ করে।”( অনুমোদিত হাদীস)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবাগণ ও বুজুর্গানে দ্বীন এ ধরনের নিফাককে সবচেয়ে বেশি ভয় করতেন। তাঁরা বলতেন, এ ধরনের নিফাক নিফাক নিয়ে কেবল মুনাফিক ছাড়া আর কেউ নিশ্চিত বোধ করবে না, প্রকৃত ঈমানদারই কেবল যার ভয় করে।
৪. রূপকের ওপর গুরুত্ব প্রদান
বর্তমান ও অতীতে অনেক গোঁড়ামি ও ভুল বোঝাবুঝির মূল কারণ হলো স্পষ্ট ভাষণের প্রতি উপেক্ষা করে রূপক অর্থের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া। রূপক আয়াত হচ্ছে যেগুলোর গূঢ় অর্থ আছে। আক্ষরিক অর্থই শেষ কথা নয়। আর সুস্পষ্ট আয়াত হচ্ছে পরিষ্কার স্বচ্ছ দ্ব্যর্থহীন যার অর্থ বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কুরআনুল করীম বলছে: “তিনিই তোমার কাছে এই কিতাব পাঠিয়েছেন, যার কতক আয়াত সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন; এগুলো কিতাবের মূল অংশ আর অন্যগুলো রূপক। যাদের অন্তরে সত্য লংঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিত্ না এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে যা রূপক তার অনুসরণ করে। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানেন না।” (৩:৭)
প্রচীন বিদাতী ও গোঁড়া লোকেরা এই রূপক আয়াতগুলোকে চূরান্ত প্রমাণ বলে মনে করেছে। তারা স্পষ্ট মৌলিক বক্তব্যগুলোকে উপেক্ষা করেছে। বর্তমান চরমপন্থীরাও তাই করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে তারা এর আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাল-মন্দ, শত্রু-মিত্র ও কাফির-ঈমানদার নির্ধারণ করেছে। ফলে এক মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সতর্ক পর্যালোচনা ও পরীক্ষা- নিরীক্ষা ছাড়া কেবল রূপক আয়াতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া জ্ঞানে অগভীরতা ছাড়া আর কিছু নয়। আল-খাওয়ারিজ এভাবে আত-তাকফিরের ফাঁদে পড়েছিলো। তারা তো সকাল মুসলমানকে কাফির বলে মনে করতো কেবল নিজেরা ছাড়া। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা হযরত আলীর (রা) বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, অথচ তারা তাঁরই সহচর ও সৈনিক ছিলো। তাদের মত পাথর্ক্যের মূল কারণ ছিল আমীর মুয়াবিয়ার সাথে হযরত আলীর (রা) আপোস রফা। হযরত আলী (রা) সৈন্যদের সঙহতি ও মুসলমানদের জীবন রক্ষার জন্যে এ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু আল-খাওয়ারিজ কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েআপোস অগ্রাহ করে। আয়াতটি হচ্ছে… “আল্লাহ ছাড়া কারো আদেশ দেয়ার ক্ষমতা নেই।” (১২:৪০০)
আলী (রা) তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে জবাব দিলেন, “একটি সত্য বাণী বাতিলের জন্যে ব্যবহৃত।” বস্তুত সকল আদেশ ও কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহ্ র জন্যে- এর অর্থ এই নয়- মানুষ ছোটখাট ব্যপারে শরীয়াহর কাঠামোয় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) আল-খাওয়ারিজের যুক্তি খন্ডন করেছেন। আপোস – সমঝোতা ইত্যাদি অনুমোদন করে কুরআনে যেসব আয়াত রয়েছে তিনি সেগুলোর উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতা সংক্রান্ত আয়াতে বলা হয়েছে: “তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশংকা করলে তোমরা তার পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিয়োগ করবে; তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন।” (৪:৩৫)
কোনো হজ্জযাত্রী হজ্জের পোশাকে শিকার করলে সালিশরা তার ব্যাপারেও মীমাংসা করে দিতে পারে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। কুরআন বলছে:
“হে মানদারগণ! ইহরামে থাকাকালে তোমরা শিকার জন্তু বধ করো না; তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা বধ করলে তার বিনিময় হলো অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দু’জন ন্যায়বান লোক-বিনিময়ের জন্তুটি কা’বায় পাঠাতে হবে কুরবানীরূপে অথবা তার কাফফারা হবে দরিদ্রকে খাওয়ানো কিংবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা যাতে সে আপন কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে পারে।” (৫:৯৫)
অতএব কুরআন ও সুন্নাহকে গভীরভাবে ও সতর্কতার সাথে অনুধাবন না করলে বিপথগামী হওয়ার আশংকাই সমধিক। বাড়াবাড়ি ও অগভীর জ্ঞানের ফাঁদে পড়ে আজকাল এক শ্রেণীর লোক খারিজীদের মতে শরীয়াহর তাৎপর্য সঠিকভাবে বোধগম্য না হওয়ার দুণই এরূপ গোঁড়ামির উদ্ভব হয়ে থাকে। অন্যদিকে গভীর জ্ঞানের অধিকারী লোক কখনোই হঠকরী আচরণ করতে পারে না। কুরআন-হাদীস সঠিক প্রেক্ষাপটে অধ্যয়ন করলে এর সুসংলগ্ন ও সুমহান অর্থ অনুবাধন করা অসম্ভব নয়। আর এর বিপরীত পন্থায় কুরআন পাঠের অর্থ হবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভাষায় তাদের মতো “যারা কুরআন তিলাওয়াত করে কিন্তু অর্থ তাদের হৃদয়ে স্পর্শ করে না।”
সম্ভবত এর মানে এই দাঁড়ায়- আল্লাহ ভাল জানেন- তাদের মৌখিক তিলাওয়াত শারীরিক কসরতের মতো যা কখনো হৃদয়কে প্রভাবিত করে না। এই কথাটি পূর্বে উদ্ধৃত “জ্ঞান ছিনিয়ে নেয়া” সংক্রন্ত হাদীসটির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যার সাথে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর ব্যক্তব্যের সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। আবু উবায়েদের ফাযায়েলে কুরআন ও ইবরাহীম আত-তায়িমীর বর্ণনার ভিত্তিতে সাঈদ আবনে মনসুরের ব্যাখ্যায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেন: “একদা একাকী বসে থাকার সময় উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, যারা এক রাসূলের অনুসরণ করে এবং কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়ে তারা কেন মতভেদে লিপ্ত হয়। উমর (রা) তখন ইবনে আব্বাস (রা)-কে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “এই উম্মাহ কেন মতভেদে লিপ্ত হয় যখন তারা এক রাসূল (সা) ও এক কিবলাহ্র অনুসারী?” (সাঈদ-এর সাথে “এবং একই কিতাব” কথাটি যোগ করেছেন)। ইবনে আব্বাস (রা) জবাব দিলেন: “আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এবং আমরা তা পাঠ করে ঐশী বাণীর মর্ম উপলব্ধি করেছি। কিন্তু এমন লোক আসবে যারা কুরাআন তিলাওয়াত করবে অথচ এর শানে নুযূল ও বক্তব্য বিষয় উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে। ফলে তারা বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দেবে এবং মতানৈক্যে জড়িয়ে পড়বে।”
ইবনে আব্বাসের (রা)-এর জবানীতে সাঈদ আরো বলেন, “প্রতিটি গ্রুপের একটি মত থাকবে, তারপর মতবেদ থেকে সংঘাত সৃষ্টি হবে।” কিন্তু সেখানে উপস্থিত উমর ও আলী (রা) তাঁর এই অশুভ ব্যাখ্যা পছন্দ করলেন না এবং তাকে ভৎসনা করলেন। কিন্তু ইবনে আব্বাস (রা) চলে যাওয়া মাত্র তার মনে হলো যে, তার কথায় কিছু সত্য থাকতে পারে। তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন এবং তার কথার পুনরাবৃত্তি করতে বললেন, সতর্ক বিবেচনার পর উমর (রা) ইবনে আব্বাস (রা)-এর সাথে একমত হলেন।
আশ-শাতিবী লিখেছেন: ইবনে আব্বাস (রা) সঠিক ছিলেন। যখন এক ব্যক্তি একটি সূরা নাযিলের কারণ জানে তখন সে এটাও বুঝতে পারে যে, এর ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য কী। কিন্তু এ সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে তারা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মতভেদে লিপ্ত হয় এবং তাদের মতামতের পেছনে শারীয়াহর কোনো সমর্থন না থাকায় তারা বিভ্রান্ত হয়। এর একটি নযীর পাওয়া যায় ইবনে ওয়াহাবের বর্ণনায়: বাকির জিজ্ঞেস করলেন নাফিকে, “ইবনে উমর (রা) আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে কি চিন্তা করেন? (আল-খাওয়ারিজিকে আল-হারুরিয়াও বলা হয়। কারণ তারা হারাওয়া নামক একটি স্থানে দেখতে পান)। জবাব দিলেন, “ তিনি তাদেরকে খুব খারাপ লোক বলে মনে করেন। কুফফার সংক্রান্ত আয়াত তারা ঈমানদারদের ওপর প্রযোজ্য করে।” সাঈদ এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, আল-খাওয়ারিজ যেসব রূপক আয়াতের অপব্যাখ্যা দেয় তাদের মধ্যে রয়েছে: “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী।” (৫:৪৪) এর সাথে তারা জুড়ে দেয় এই আয়াতটি, তথাপি কাফেররা স্বীয় পালনকর্তার সংগে অন্যকে সমতুল্য করে। (৬:১)
সুতরাং তারা এই উপসংহার টানে যে, কোনো শাসক যদি ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন না করে সে কুফরী করে। আর যে কুফরী করলো সে অন্যকে আল্লাহর সাথে শরীক করলো। অতএব সে শিরক করলো। আর এই ভুল বিচারের ভিত্তিতে তারা অন্যকে মুশরিকুন বলে ঘোষণা করে, তাদের সাথে যুদ্ধ করে এবং হত্যা করে। আবনে আব্বাস (রা) এই ধরনের অপব্যাখ্যা ও ভ্রান্ত ধারণার বারুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। আর এর উৎপত্তি হয় ওহীর অর্থ বুঝতে অক্ষমতার দারুন।
নাফি বলেন, যখনি ইবনে উমর (রা)-কে আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো তিনি বলতেন: “তারা মুসলমানদেরকে কুফফার ঘোষণা করে, তাদের রক্তপাত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির অনুমোদন কের; তারা নারীর ইদ্দাহর সময় তাকে বিয়ে করে এবং স্বামীর বর্তমানে বিবাহিত মেয়েদের বিয়ে করে। আমি জানি না তাদের চেয়ে আর কে আছে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়।” (শাতিবী, আলইতিসাম)