৫. বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা
চরমপন্থীদের জ্ঞানের অগভীরতার আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে তারা ভিন্ন মতাবলম্বীর কথা শুনতে মোটেও রাজী থাকে না কিংবা কোনোরকম আলোচনায় বসতে চায় না। তাদের অর্থাৎ গোঁড়াদের মত যে অন্যের মতের আলোকে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ বা বর্জন করা যেতে পারে তাও তারা স্বীকার করে না। তারা বিশেষজ্ঞ আলিমদের কাছ থেকে কোনো শিক্ষা পায়নি। বই-পুস্তক, সংবাদপত্র ইত্যাদি হচ্ছে তাদের স্বল্প জ্ঞানের একমাত্র উৎস। এগুলো আলোচনা পর্যালোচনার সুযোগও পায় না। ফলে তারা যা পড়ে তা থেকে ইচ্ছামতো সিদ্ধান্তে পৌঁছে। সুতরাং তাদের পড়া ও সিদ্ধান্তে যে ভুল হবে তাতে আর সন্দেহ কী! কেউ কোথাও কখনো তাদের মতো যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করলেও এগুলোর প্রতি কেউ তাদে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আশ-শারূয়াহ বুঝতে হলে যে নির্ভরযোগ্য আলিমদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত সে প্রয়োজনীয়তাও তারা স্বীকার করে না।কোনো মুসলিম তরুণ যদি একা একা এরূপ প্রচেষ্টা চালায় তবে তা হবে আনাড়ি সাঁতারুর মতো গভীর পানিতে ঝাঁপ দেয়া।বিশেষজ্ঞদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছাড়া শারীয়াহর জ্ঞান পূর্ণ হতে পারে না, বিশেষ করে সেসব ক্ষেত্রে যেগুলো নিয়ে মতভেদ আছে। এ কারণে আমাদের অভিজ্ঞ আলিমরা তাদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন যারা বিষয়বস্তু উপলব্ধি ছাড়াই কেবল কুরআনের হাফিজ হয়েছেন কিংবা কিছু বইপত্র পাঠ করে যাদের অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর হয়েছে।
এক শ্রেণীর এই তরুণদের বিভ্রান্তির জন্যে পেশাদার আলিম ও পন্ডিতরা বহুলাংশে দায়ী। তারা মনে করে এই আলিমরা শাসকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়েছে। তাই তারা শাসকদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপের বিরোধীতা করার সাহস হারিয়ে ফেলেছে, বরং তারা মুনাফিকের মতো শাসকদের গর্হিত কাজের প্রশংসা ও সমর্থন করে। অথচ বাতিলকে সমর্থন না করে অন্তত তাদের নিশ্চুপ থাকাই নিরাপদ ছিল। সুতরাং তরুণরা বর্তমান এরূপ আলিমদের পরিবর্তে অতীতের আলিমদের অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে করলে অবাক হবার কিছু নেই। একাবর আমি তাদেরকে এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে তারা পরিষ্কার বলেছে, “নির্ভরযোগ্য আলিম আমরা পাব কোথায়? যারা আছে তারা তো শাসকদের ক্রীড়নক। তাদের মর্জি-মাফিক ফতোয়াবাজীতে ব্যস্ত। শাসক যখন সমাজতন্ত্রী হয়, আলিমদের দৃষ্টিতে তাই ইসলামী; শাসক যদি হয় পুঁজিবাদী, পুঁজিবাদও তখন হয় ইসলামী! তাঁরা ফতোয়া দেন শত্রুর সাথে সন্ধি হারাম; কিন্তু শাসক যখন যুদ্ধ ঘোষণা করেন তখন তাদের জন্যে দোয়া করেন। “তারা আল্লাহ্ যা নিষিদ্ধ করেছেন তা হালাল করতে পারে।” (৯:৩৭)
এসব আলিম মসজিদ ও গীর্জা এবং মুসলিম পাকিস্তান ও হিন্দু ভারতকে সমান চোখে দেখে। আমি এর জবাব দিয়েছি এভাবে: “ব্যপারটি সাধারণ সত্যে পরিণত করা উচিত নয়। নিশ্চয় এমন আলিমও আছেন যারা বাতিলের নিন্দা করেন, নির্যাতন রুখে দাঁড়ান, একনায়কদের সাথে আপোস করেন না ভয়-ভীতি ও প্রলোভন সত্ত্বেও। এসব আলিমদের অনেককে কারাবরণ করতে হয়েছে। তারা নির্যাতিত হয়েছেন। এমনকি ইসলামের জন্যে শাহাদত বরণ করেছেন।”
সেই তরুণটি এটা স্বীকার করলেও বলল, “নেতৃত্ব ও ফতোয়া দেয়ার ক্ষমতা এখনো ঐ শাসকদের হাতে,
আলিমদের নয়-এরাই হচ্ছে তথাকখিত পথবিচ্যুত আলিম।”
অবশ্য এটা কেউ স্বীকার করতে পারেন না যে, ঐ যুবকটি যা বলেছে তা অনেকাংশে সত্য। নেতৃত্ব-অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব “প্রখ্যাত” “আলিম” সরকারের বন্ধকী পণ্যে পরিণত হয়েছেন এবং ইচ্ছে মতো ব্যবহৃত হচ্ছেন। এ ধরনের আলিমদের জানা উচিত সত্য সম্পর্কে নীরব থাকা বাতিল সমর্থনের শামিল। দুটোই শয়তানী কাজ। একবার মিসরীয় টেলিভিশনে “পরিবার পরিকল্পনা” ও “জন্মনিয়ন্ত্রন” অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণকারী একজন সুপরিচিত মুসলিম বুদ্ধিজীবী তো প্রশ্নই করে বসলেন, এই বিতর্কের উদ্দেশ্য কী, বিরোধীতা না সমর্থন-যাতে তিনি নিজের গা বাঁচিয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন। বিতর্কের চেয়ারম্যান ঐ পণ্ডিতের প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। অথচ এর আগের আলিমরা মত প্রকাশে নির্ভীক ছিলেন, কারো পরোয়া করতেন না। আল্লাহ্ এদের ওপর রহম করুন! এদেরই একজন মিসর সরকারের একজন প্রভাবশালী সদস্যকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি কাজের খোঁজে পা বাড়ায় তার ভিক্ষের হাত বাড়াবার দরকার পড়ে না।” সমসাময়িক আলিম বা পণ্ডিতরা এ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে নিঃসন্দেহে জ্ঞান-সমৃদ্ধ করতে পারেন।
এখন আলিমদের জ্ঞানগরিমা এতোই সঙ্কীর্ণ যে, তরুণ মুসলমানরা তাদের সংস্পর্শে এসে হতাশ হয়ে পড়ে। এ ধরনের একজন আলিম একবার একটি পত্রিকায় লিখলেন, পিতা ও পুত্রের লেনদেনে যেহেতু কোনো সুদের ব্যাপার থাকতে পারে না। কিন্তু পিতা ও পুত্রের তুলনা দিয়ে তিনি যে যুক্তি খাড়া করেছেন তা বিতর্কিত। মোটকথা এসব আলিম বিভিন্ন বিষয়ে সর্বসম্মত প্রামাণিক সূত্র বাদ দিয়ে দুর্বল সনদের হাদীস দিয়ে নিজেদের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এগুলো সাধুতা সত্যতার খেলাফ। মুসলিম তরুণরা স্বভাবতই এসব কাণ্ড কারখানা দেখে হতাশ হয়ে পড়ে। কোনো কোনো আলিম অনেক সময় সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জিত হতে পারে এমন কাজও করে বসেন। এগুলো সচেতন তরুণদের নযর এড়াতে পারে না। আরেকটি ঘটনা।একবার মিশর সরকার বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তাদের অনেক সদস্যকে বন্দী করেন। একজন সুখ্যাত আলিম প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ইসলামী গ্রুপকে আল্লাহ্ পরিত্যাগ করেছেন। তার যুক্তি ছিল, তাঁরা যদি সঠিক পথের অনুসারী হতেন তবে আল্লাহ্র রহমতে তাদেরকে পুলিশ বা সৈন্য কেউই পরাজিত করতে পারতো না। হক ও বাতিলের এরূপ অদ্ভুত বিচার সম্পূর্ণরূপে ইসলাম বিরোধী। ইসলামের দৃষ্টিতে সত্যের সংগ্রামীদের বিজয় লাভে কতকগুলো শর্ত আছে। সেই শর্ত পূরণ না হলে তাদের পরাজিত হওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। অন্যদিকে পরিস্থিতির আনুকূল্যে বাতিলের বিজয় অর্জিত হলেও তা চিরস্থায়ী হতে পারে না, কিছুদিন টিকে থাকতে পারে মাত্র। সমকালীন ইতিহাসে এর অনেক জাজ্জল্যমান নযীর আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন সত্য ও মিথ্যা বা হক বাতিলের দ্বারা জয়-পারজয় নির্ধারিত হয় না। জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় বৃহৎ শক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ। আরবদের উপরে ইসরাঈলের ‘বিজয়’-এর একটি অত্যুজ্জ্বল নযীর।
আমরা কি জানি না, আতাতুর্ক ও তার দুষ্টচক্র মুসলমান জনগণ ও আলিমদের কী নির্মমভাবে দমন করেছে? খিলাফতের পাদপীঠ থেকে কিভাবে ইসলাম বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতা জবরদস্তি তুর্কী জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে! এখন বলুন, এ দু’পক্ষের মধ্যে কারা হক আর কারা বাতিল? সম্পতি একটি মুসলিম দেশে “পরিবার আইন” প্রবর্তনের বিরোধী বহু শ্রদ্ধাভাজন আলিমের উপর নির্যাতন চালানো এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। অথচ ঐ পরিবার আইন সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী। সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাচারী সরকার সন্ত্রাসী কায়দায় ঐ আইনের বিরোধী জনসাধারণ ও আলিমকে স্তব্ধ করে দেয়। এর অর্থ কি এই যে, সরকারের পদক্ষেপ সঠিক ছিল, আর শাস্তিপ্রপ্ত আলিমরা ভ্রান্ত? আরেকটি মুসলিম দেশে অমুসলিম সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু মুসলমানদের উপর শাসন চালায়। সেখানে সরকার বিরোধী তৎপরতা দমনের জন্যে প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার মুসলমান নর-নারীকে গ্রেফতার করা হয় এবং নিপীড়ন চালানো হয়। তদুপরি যেসব দৃঢ়চেতা মুসলমান যুলুম সহ্য করে টিকে থাকে তাদের উপর হালাকু ও চেঙ্গিস খানের মতো হিংস্র কায়দায় নির্যাতন চালানো হয় আর তাদের সামনে তাদের কন্যা, বোন বা স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হয়।
বস্তুত ইতিহাসে তথা ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের ওপর এমন নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার বহু নযীর আছে। হুসাইন ইবনে আলী (রা) পরাজিত হয়েছেন এবং ইয়াজিদ ইবনে আমীর মুয়াবিয়া তাঁর পবিত্র দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। পরিণামে বনু উমাইয়া বহুকাল শাসন করেছে; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বংশধাররা তাদের হাত থেকে নিষ্কৃত পাননি, এমনকি আব্বাসীয়দের শাসনামলেও নয়। এ থেকে কি এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজিদের কার্যকলাপ সঠিক ছিল আর হযরত হুসাইন (রা)-এর অনুসৃত পন্থা বাতিল? হে আল্লাহ, আপনি এদের যুলুমের সাক্ষী, এদের হাত থেকে উম্মাহকে রক্ষা করুন!
আরো ঘটনা আছে। কয়েক বছর পর বিজ্ঞ ও সাহসী সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ অনারবী হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের হাতে পরা জিত হয়েছিলেন; পরে হাজ্জাজ আরেকজন মহান মুসলিম সেনাপতি আবদুর রহমান ইবনে আল-আসাস এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের, আশশাবী, মুতরিয়াসহ একদল বিশিষ্ট আলিমকে হত্যা করে। এগুলো ছিল উম্মাহর জন্যে বিরাট ক্ষতি, বিশেষ করে সাঈদ ইবনে জুবায়ের সম্পর্কে ইমাম আহমদ (র) বলেন, তিনি এমন এক সময় নিহত হলেন যখন তাঁর খুব প্রয়োজন ছিল। প্রসঙ্গত একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়: “আল্লাহর কসম! হিংস্র নেকড়ে যদি আমাদের ছিন্নভিন্ন করে তবুও আমরা আমাদের সত্য বিশ্বাস ও তোমাদের মিথ্যাবাদিতা সম্পর্কে সংশয়ী হবো না।” ইবনে জুবায়ের ও তার সঙ্গী-সাথীরা মক্কায় অবরুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন: “আল্লাহর শপথ! সৎ মুত্তাকীদের কেউ অবনত করতে পারবে না যদি গোটা পৃথিবীও তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় আর বিপথগামীরা কখনোই যথার্থ সম্মান পাবে না যদি তাদের কপালে চন্দ্রও উদিত হয়। এসব উক্তি কুরআনে বর্ণিত নবীদের ঘটনাবলীর সাথে সংগতিপূর্ণ। কুরআন বলছে: “তবে কি যখনি কোনো রাসূল এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপূত নয় তখনই তোমরা অহংকার করেছে আর কতককে অস্বীকার করেছে এবং কতককে হত্যা করেছ!” (২:৮৭) এমন একজন নবীদের মধ্যে ছিলেন হযরত যাকারিয়া (আ) ও তাঁর পুত্র ইয়ারিয়া (আ)। এই নবীদের হত্যা এবং তাদের শত্রুদের সাফল্যকে কী পূর্বোক্তদের ভূমিকাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে? আমরা কুরআনুল করীমে আসহাবুল উখদুদের ঘটনাও জানি। তারা ঈমানদারদের জলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে সেই বীভৎস্য দৃশ্য উপভোগ করতো: “এবং অন্য কোনো কারণে নয়, কেবল তারা সর্বশক্তিমান ও সকল প্রশংসার যোগ্য আল্লাহ্ কে বিশ্বাস করতো বলেই (কাফিররা) তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে।” (৮৫:৮)
কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ঈমানদারদের কখনো কখনো বিপদাপদের মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং বেঈমানদেরকে সাময়িক সাফল্য দিয়ে প্রলুব্ধ করা করা হয়। আল্লাহ বলেন: “মানুষ কি মনে করে আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেয়া হবে? তাদের পূর্ববর্তীদেরও আমি পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী।” (২৯:২-৩)
ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর নিম্মোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়: “যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে তবে অনুরূপ আঘাত তাদেরও তো লেগেছে। মানুষের মধ্যে এই দিনগুলোর আমি পর্যায়ক্রমে আবর্তন ঘটাই, যাতে আল্লাহ মুমিনদেরকে জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।” (৩:১৪০)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “…আমি তাদেরকে এমনভাবে ক্রমে ক্রমে ধরব, তারা তা বুঝতেও পারবে না।” (৬৮:৪৪)
৬. ইতিহাস, বাস্তবতা ও আল্লাহর সুনান সম্পর্কে সচেতনতার অভাব
ইসলাম সম্পর্কে সঠিক সচেনতার অভাব ছাড়াও বাস্তবতা, জীবন, ইতিহাস এবং আল্লাহ্ র সৃষ্টির রীতি সম্পর্কেও যথার্থ সচেনতার অভাব রয়েছে। এর অভাবে কিছু লোক অসাধ্য সাধন করতে চায়। যা ঘটতে পারে না তারা তাই কল্পনা করে এবং পরিস্থিতি ও ঘটনা প্রবাহের ভুল বিচার করে বসে যা আল্লাহ্ র রীতি ও শরীয়তী চেতনার পরিপন্থী। তারা অসমসাহসিক পদক্ষেপ নেয়, এমনকি জীবনেরও ঝুঁকি নেয়। এর পক্ষে বিপক্ষে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তারা তা মোটেও বিবেচনা করে না। কারণ তারা মনে করে তাদের লক্ষ্য তো আল্লাহ্ ও তাঁর কালাম সমুন্নত করা। অতএব এসব লোকের পদক্ষেপকে অন্যরা “আত্মঘাতী” বা উম্মাদনাপূর্ণ বলে অভিহিত করলে আশ্চর্যের কিছু নেই।
বস্তুত এই মুসলমানরা যদি মুহুর্তের জন্যেও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতো তাহলে নিশ্চিতভাবে সঠিক পথ-নিদের্শ লাভ করতো। আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ১৩ বছরের মক্কী জীবন। তিনি শুধু দাওয়াত দিয়ে ক্ষান্ত হননি, ৩৬০টি মূর্তি থাকা সত্ত্বেও কা’বায় নামায ও তাওয়াফ করতে বলেছেন। কেন এরূপ করলেন? তিনি কাফিরদের তুলনায় তাঁর অনুল্লেখযোগ্য শক্তি ও অবস্থানের কথা ভেবে অতি বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি কখনোই কমান্ডো হামলা চালিয়ে পাথরের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার চিন্তা করেননি। তাহলে তো আসর উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে যেতো। ঐ পদক্ষেপে কাফিরদের মন থেকে তো বহু-ইশ্বরবাদের ভুত মুছে ফেলা যেতো না। তিনি সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন তাঁর স্বজাতির মনকে মুক্ত করতে-কা’বাকে মূর্তিমুক্ত করতে নয়। এ জন্যে তওহীদেরশিক্ষা দিয়ে প্রথম মুশরিকদের মন পবিত্র করার লক্ষ্যে এমন একদল ঈমানদার তৈরি করেন যারা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন এবং কঠোর অধ্যবসা ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তারা বাতিলৈর বিরুদ্ধে হকের লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম। এসব বিশ্বাসীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা নিরলস নির্বিকার চিত্তে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করে যায়, বিজয়ের উল্লাসে তারা মাদকতায় বিভোর হয়ে যায় না, আবার পরাজয়ে মুষড়ে পড়ে না। অবশ্য কখনো কখনো তারা কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু তিনি এখনো সময় আসেনি বলে তা অগ্রাহ্য করেছিলেন এবং আল্লাহ্ র নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারনের উপদেশ দিয়েছিলেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) আম্মার বিন ইয়াসির (রা) ও তাঁর পিতাকে নিগৃহীত হতে দেখলেন। তিনি তাঁদেরকে সহ্য করার জন্যে উৎসাহিত করলেন এবং তাঁদের জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। স্বাধীনতা ও ধর্মরক্ষার জন্যে আল্লাহ্ র আদেশ না পাওয়া অবধি ঘটনা এভাবে চলতে থাকে। অবশেষে আদেশ এলো। কুরআনের ঘোষণা: “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে। নিশ্চই আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম; তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে: আমাদের প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ্।” (২২:৩৯-৪০)
কিন্তু এই অনুমতি দেয়া হয়েছে কেবল তখনি যখন রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীরা নিজেস্ব আবাসভূমি স্থাপন করে নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারপরই তাঁদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছৈ। তাঁরা এরপর একর পর এক বিজয় অর্জন করেছেন যতক্ষণ না তাঁরা আল্লাহ্ র হুকুমের মক্কা বিজয় করেছেন। এই মক্কা থেকেই তিনি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন কাফিরদের অত্যাচারে।শৈষ পর্যন্ত তিনি মক্কার মূর্তি ধ্বংস করলেন এবং তিলাওয়াত করলেন এই আয়াত, “ বলো সত্র সমাগত এবং মিথ্যা বালুপ্ত হয়েছে। মিথ্যা তো বিলুপ্ত বাধ্য।” (১৭:৮১)
বিস্ময়ের ব্যাপার, জামায়াত আত-তাকফির আল-হিজরা ইতিহাসের এই ধারাকে অস্বীকার করে। এই অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অবশ্য গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ শুকরী ও আবদুর রহমান আবু আল-খায়েরের মধ্যে মতপার্থক্যও হয়েছিলো। আবু আল-খায়ের তাঁর “স্মৃতিকথায়” লিখেছেন যে, ইসলামের ইতিহিসের প্রতি শেখ শুকরীর অবস্থা ছিল না। তিনি এটাকে “অপ্রমাণিক ঘটনাবলী” বলে মনে করতেন। এটা ছিলো সাথে মতভেদের চতুর্থ বিষয়। তিনি কেবল কুরআন শরীফে বর্ণীত ঘটনাবলীকেই ইতহাসের উপাদান বলে মনে করতেন। তাই তানি ইসলামী খিলাফতের অধ্যায় পাঠ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
ধর্মীয় অজুহাতে ইতিহাস সম্পর্কে ও ধরনের সংকীর্ণ ও অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তারা ইসলামের ইতিহাসকেও হারাম ঘোষণা করেছিলেন। ইতিবাচক ও নেতিবাচক, জয় ও পরাজয় তথা সকল বিষয় সমন্বিত একটি জাতির ইতিহাস হচ্ছে সমৃদ্ধ খনির মতো যা থেকে সম্পদ আহরণ করে একটি জাতি তার বর্তমান গড়ে তোলে। যে জাতি ইতিহাসকে উপেক্ষা করে তার অবস্থা স্মৃতিভ্রংশ মানুষের সাথে তুলনীয়, যার কোনো মূল বা দিক-দর্শন নেই। কোনো গ্রুপ বা জনগোষ্ঠী কিভাবে এরূপ একটি অস্বাভাবিক শর্তকে টিকে থাকার ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করতে পারে? তাছাড়া ইতাহাস হচ্ছে এমন একটি আয়না যাতে আল্লাহ্র বিধান প্রতিবিম্বিত হয়েছে। এজন্যে আর কুরআনে গোটা সৃষ্টিলোক সাধারণ ভাবে এবং মানব জীবনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আর এ কারণেই আল কুরআন ইতিহাসের প্রেক্ষিত অনুধাবন এবং এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বর্ণনা: “তোমাদের পূর্বে বহু জীবন প্রণালী গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা দুনিয়া ভ্রমণ করো এবং দেখ মিথ্যাশ্রয়ীদের কি পরিণাম হয়েছে।” (৩:১৩৭)
আল্লাহ্ রীতির বৈশিষ্ট্য হলো স্থায়িত্ব, তার কখনো পরিবর্তন হয় না। আল কুরআন বলছে: “তারা আল্লাহ্ র নামে দৃঢ় অঙ্গীকার করে বলতে যে, তাদের কাছে কোনো সতর্ক বাণী এলে তারা অন্য সকল সম্প্রদায় অপেক্ষা সৎপথের অধিকতর অনুসারী হবে। কিন্তু যখন তাদের কাছে সতর্ক বাণী এলো তখন তা কেবল এদের বিমুখতাই বৃদ্ধি করলো, যমীনের বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং কূট-ষড়যন্ত্রের কারণে। কূট-ষড়যন্ত্র এর উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে। তবে কি তারা প্রত্যক্ষ করেছে পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত বিধানের? কিন্তু তুমি আল্লাহ্ র বিধানে কখনো কোন পরিবর্তন দেখতে পাবে না এবং আল্লাহর রীতিতে কোন ব্যাতিক্রম দেখবে না। (৩৫: ৪২-৪৩)
আল্লাহর রীতি যেহেতু অপরিবতর্নীয় ও স্থায়ী তাই যারা দুষ্কর্মে লিপ্ত হয় স্থান-কাল ও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি আচরণে তিনি একই রীতি প্রয়োগ করেন। এই নীতির একটি শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেথেছি ওহুদের যুদ্ধে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপদেশ উপেক্ষা করার দরুন তাদেরকে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিলো। কুরআনুল করীমে একথা উল্লিখিত হয়েছৈ: “কী ব্যাপার! যখন তোমাদের ওপর মুসীবত এল তখন তোমরা বললে এটা কোথা থেকে এলো! অথচ তোমরা তো দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। বলো এটা তোমাদের নিজেদেরই নিকট থকে। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিশালী। (৩:১৬৫)
আরেকটি আয়াতে যে কারণে মুসলমানদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে তার পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে: “আল্লাহ তোমাদের সাথে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহ্ র অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিনাশ করছিলে যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্বদ্ধে মতভেদ করলে এবং যা তোমরা ভালবাস তা তোমাদেরকর দেখবার পর তোমরা অবাধ্য হলে।” (৩:১৫২)
কিছু বিছিন্ন ঘটনার দরুণ ইতিহাসে অনেক সন্দেহজনক ঘটনা সংযোজিত হয় সত্য, কিন্তু মূল গটনা প্রবাহ সুরক্ষিত থাকে এবং একাধিক প্রামাণিক সূত্রে তা সমর্থিত হয়। আর সন্দেহপূর্ণ ঘটনাগুলো বিজ্ঞ ব্যাক্তি বিশ্লেষণ করতে পারেন। যাতে সত্য নিরূপণ করা যায়।
পক্ষান্তরে আমরা শুধু ইসলামের ইতিহাস নয়, সৃষ্টির পর থেকে মানব ইতিহাসের প্রতি আমাদের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করতে চাই। শুধু ঈমানদারদের ইতিহাস নয়, বরং নাস্তিকদের ইতিহাস থেকেও জ্ঞান আহরণ করা যায়। কেননা আল্লাহ্ র রীতিতে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই।তা তো তাওহীদ পন্থী ও পৌত্তলিক উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। বস্তুত জাহিলিয়ার ভ্রান্ত প্রকৃতি অনুধাবন করতে না পারলে আমরা কুরআনুল কারীমকে এবং ইসলামের বদৌলতে আমরা কী কল্যাণ লাভ করেছি তাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো না। কুরআনে বলা হয়েছে: “…যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রন্তিতে নিমজ্জিত ছিলো।” (৩:১৬৪) এবং “তোমরা অগ্নি গহবরের কিনারে দাঁড়িয়েছিলে, আল্লাহ তা হতে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন।” (৩:১০৩)
উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর একটি উক্তিতেও এই মর্ম প্রতিফলিত হয়েছে: “জাহিলিয়ার প্রকৃতি অনুধাবনে ব্যর্থতা শুরু হলে একে একে ইসলামের বন্ধনী বিছিন্ন হতে থাকবে।”
সত্য প্রকাশ যদি পুণ্য হয় তাহলে আমি বলবো ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ইতিহাস সঠিকভাবে অধ্যায়ন ও অনুধাবন করেননি। ইতিহাস পাঠের অর্থ শুধু বিশেষ বিশেষ সময়ের ঘটনাকে জানা নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এর মর্ম উপলব্ধি করা, শিক্ষা নেয়া এবং আল্লাহ্ র রীতিগুলো উদ্ভাসিত করা। নিছক পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসাবশেষ অবলোকন করলে কোনো ফায়দা হবে না। শুধূ দেখা আর শোনার মাধ্যমে ইতিহাসের মর্ম উপলব্ধি করা যায় না। এ প্রসঙ্গে কুরআন বলছে: “তারা কি দেশে ভ্রমন করেনি? তাহলে তারা জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারতো। আসলে চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।” (২২:৪৬)
ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং একটির সাথে অপরটির সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ এগুলো একই অপরিবর্তনীয় নিয়মে প্রবাহিত হয়। তাই পাম্চাত্য শিখিয়েছে: “ইতিহাসের চাকা ঘোরা” আর আরবারা বলে, “আজবকের রাত কালকের রাতের মতোই।”
আল কুরআনুল করীমে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-আচরণে সাদৃশ্যের কারণ হিসেবে অভিন্ন চিন্তা ও দৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে:
“যাদের জ্ঞান নেই তরা বলে, ‘আল্লাহ কেন আমাদের সাথে কথা বলেন না কিংবা কোন নিদর্শন আমাদের কাছে আসে না কেন? এর আগের লোকেরাও এ ধরনের কথা বলতো। তাদের হৃদয় একই রকম। আমি দৃঢ় প্রত্যয়শীলদের জন্য নিদর্শনাবলী স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।” (২:১১৮)
কুরায়েশ পৌত্তলিকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন: “এভাবে এদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনি কোনো রাসূল (সা) এসেছেন তারা তাঁকে বলেছে, ‘তুমি তো এক যাদুকর, না হয় এক উম্মাদ!’ তারা কি একে অপরকে এই মন্ত্রাণাই দিয়ে এসেছে? বস্তুত তারা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়।” (৫১:৫২-৫৩)
তাহলে দেখা যায়, আল্লাহ্ র নবীর প্রতি আগের ও পরের জাতিসমূহের দৃষ্টিভঙ্গির অভিন্নতা তাদের মধ্যে সমঝোতার ফলশ্রুতি নয়, বরং সাদৃশ্য হলো অন্যায় ও স্বচ্ছাচারী আচরণে। সুতরাং তাদের দৃষ্টভঙ্গি অভিন্ন কারণ হলো স্বেচ্ছাচারিতা।
যারা ইতিহাসের গুরুত্ব এবং আল্লাহর রীতির মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম কেবল তারাই অতীত জাতিসমূহের ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তারাই প্রকৃত সুখী। তারাই যারা এসব ভুলভ্রান্তি থেকে নিজেরা সতর্ক হয় বটে, কিন্তু অন্যের ভাল দিকগুলোকেও উপেক্ষা করে না। জ্ঞানই ঈমানদারের লক্ষ্য তা সে যেখান থেকেই অর্জন করুক না কেনো। কেননা অন্য যে কোন ব্যাক্তির চেয়ে এটা তারই প্রাপ্য।
৭. দু’টি গুরুত্বপূর্ণ
সাধারণ মুসলমান, বিশেষত ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদেরকে আল্লাহ্র দু’টি রীতি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রথম: সৃষ্টি ও বিধানের ক্ষেত্রে সুষ্পষ্ট পর্যায়ক্রমিকতা লক্ষণীয়। অথচ আল্লাহ্ পাক আঁখির পলক পড়ার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে বেহেশত ও সৃষ্টিতে সক্ষম! “হও আর তা হয়ে যায়।” (২:১১৭)
তিনি তাঁর (হিসেবে) ছয় দিনে এগুলো সৃষ্টি করেছেন অথাৎ পর্যায়ক্রমে যা কেবল তিনিই জানেন। কেননা “দিন” সংক্রন্ত আমাদের ধারনা থেকে তা ভিন্ন। সকল প্রাণীর বিকাশের ক্ষেত্রেও পর্যায়ক্রমিকতা লক্ষণীয়। ধীরে ধীরে এগুলো পূর্ণতা লাভ করে। দাওয়াতী কাজেও এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কার থেকে মনকে মুক্ত করার জন্যে প্রথমে সেখানে তওহীদের বীজ প্রোথিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবে ঈমানের ভিত্তি মজবুত হলে ওয়াজিবাত ও মুহাররামাতের প্রক্রিয়া চালু করা হয়। এরপর সালাত, যাকাত, সিয়াম ইত্যাদি প্রবর্তন করা হয়। এজন্যে আমরা মক্কী ও মাদানী আয়াতের মধ্যে পার্থ্ক্য লক্ষ্য করি।
আয়েশা (রা) শারীয়ার প্রবর্তন এবং কুরআন নাযীলের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন: প্রথমে কুরআনের যেসব আয়াত নাযিল হয়েছে তাতে জান্নাত ও জাহান্নামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (পরে) যখন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলো তখন হালাল ও হারামের বিধান নাযীল হলৌ। যদি প্রথমেই “মদ পান করো না” এবং “ব্যভিচার করো না” নাযিল হতো লোকেরা বলতো, ‘আমরা মদপান ও ব্যভিচার কখনোই ছাড়তে পারব না।’ (বুখারী) সুতরাং যারা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতাষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত তাদেরকে পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রতিবন্ধকতা, উপায়-উপকরণ ও সামর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে পর্যায়ক্রমে দাওয়াতী কাজ চালাতে হবে। এক্ষেত্রে খলীফা উমর ইবনে আবদুল আজীজের দৃষ্টান্ত স্মর্তব্য। তিনি খেলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ জীবন পুনর্গঠন করেছিলেন। কিন্তু পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সহজ ছিলো না। তার পুত্র আবদুল মালিক অত্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। তিনি তাঁর পিতাকে একবার বললেন, “হে পিতা, আপনি কেন হত্যা করেন না? আল্লাহ্ শপথ, সত্যের জন্যে আমরা বা আপনার প্রাণ গেলেও আমি পরোয়া করি না।” কিন্তু উমর জবাব দিলেন, “তাড়াহুড়া করো না আমার পুত্র। আল্লাহ্ পাক কুরআনুল কারীমে দু’বার মদ্যপানেরনিন্দা করেছেন এবং তৃতীয়বারে নিষিদ্ধ করেছেন। আমার ভয় হয়, একবারেই সব চাপিয়ে দিলে এক সাথেই তা প্রত্যাখ্যাত হয় কিনা। এতে ফিতনার সৃষ্টি হতে পারে।” (আল মুয়াফাকাত)
দ্বিতীয়: দ্বিতীয় রীতিটি হচ্ছে প্রথমটির পরিপূরক। প্রতিটি জিনিসের পূর্ণতা বা পরিণতি লাভের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ক্ষেত্রেই এই রীতি প্রযোজ্য। ফসল পাকার আগেই কাটা যায় না। অপরিপক্ক ফলমূল ও শাকসবজি উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি করতে পারে। ঠিক তেমনি মহৎ কাজের সুফল অনেক বছর পরেই পরিদৃশ্যমান হয়। পরিণত হতে যতো সময় লাগবে ততোই তা ফলপ্রদ হবে। এক পুরুষের চেষ্টা-সাধনা অন্য পুরুষে ফল দিতে পারে। মক্কা মুকাররমায় প্রথমদিকে কাফিররা আল্লাহর শাস্তির হুশিয়ারীকে অবিবেচকের মতো উপহাস করতো এবং দ্রুত শাস্তি আনার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি আহবান জানাতো। কিন্তু তারা এটা জানতো না যে, নির্দিষ্ট সময়েই তা আসবে। বিলম্বও নয়, দ্রুতও নয়।
“তারা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে। যদি নির্ধরিত সময় না থাকতো তবে শাস্তি তাদের ওপর আসবে আকস্মিকভাবে, অজ্হতসারে।” (২৯:৫৩)
“তরা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে, অথচ আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি কখনো ভঙ্গ করেন না, তোমাদের গণনার হাজার বছরের সামন।” (২২:৪৭)
এই পর্যায়ে আল্লাহ্ তায়ালা মহানবীর (সা)-এর প্রতি বিগত নবীদের মতো অধ্যবসায়ী হওয়ার উপদেশ দিলেন: “অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ।”(৪৬:৩৫) বিগত নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের কঠোর সঙগ্রাম ও ত্যাগ তিতিক্ষার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন:
“তোমরা কি মনে করো তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনও তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসেনি! অর্থ কষ্ট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিলো এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিলো। এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার অনুসারীরা বলে উঠেছিলো, আল্লাহ্র সাহায্য কখন আসবে; নিশ্চয় আল্লাহ্র সাহায্য নিকটবর্তী। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট সময় কেবল আল্লাহ্রই জানা আছে। এ জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদের ধৈর্য ধারণ করতে বলতেন এবং নিদির্ষ্ট সময়ের পূর্বে বিজয় প্রত্যাশা থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিতেন। একটি ঘটনা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার খারায ইবনে আল-আর্ত ইসলামের জন্যে তাঁর দুঃখকষ্ট বরণের কথা বলে আর্লাহ্ র সাহায্য প্রার্থনার আবেদন জানালে রাসূলুল্লাহ (সা) এতোই ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর মুখ লাল হয়ে যায়। তিনি বললেন: “তোমাদের আগে একজন বিশ্বাসীকে লোহা দিয়ে এমনভাবে পিষ্ট করা হয়েছে যে, হাড় ছাড়া তার শরীরের গোশ্ত ও শিরা-উপশিরা অবশিষ্ট ছিলো না। আর একজনকে করাত দিয়ে জীবন্ত অবস্থায় দু’ভাগে চিরে ফেলা হয়েছিলো। কিন্তু তাঁরা কেউই ধর্মত্যাগ করেননি। আল্লাহ্র শপথ, তিনি এমনভাবে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন যে, একজন ভ্রমনকারী সানা থেকে হাদ্রামাউত পর্যন্ত সফরের সময় এক আল্লাহ্ এবং তার ভেড়ার জন্যে নেকড়ে ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা অধৈর্য।” ( বুখারী)
৮. মুসলিম দেশ থেকে ইসলামের নির্বাসন
একজন নিষ্টাবান মুসলমানের কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে এসলামী শিক্ষা অনুসারণের অভাবে বিকৃতি, দুর্নীতি ও মিথ্যা ব্যাপাকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। মার্ক্সবাদের ও ধর্মনিরপেক্ষতার ছোবলে মুসলিম সমাজ বিপর্যস্ত। আধুনিক “ক্রুসেডাররা” ক্লাব, থিয়েটার, অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি, ছায়াছবি, নাচ-গান, মদ তথা সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে। সংবাদপত্রে তারা অনুপ্রবেশের জাল বিস্তার করেছে। রাস্তাঘাটে অর্ধোলঙ্গ নেশাসক্ত নারীদের অবাধে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। আর এসবই হচ্ছে মুসলিম সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দয়ার সুগভীর চক্রান্তের ফল।
এছাড়া মুসলিম দেশগুলোতে এমন সব বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে যা শরীয়তে নিষিদ্ধ অথচ ভাব দেখানো হয় উম্মার বিশ্বাস ও মূল্যবোধ উজ্জীবিত করাই এর লক্ষ্য। কিন্তু মূলত এসব আইনের উৎস শরীয়ত নয়,বরং ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন। সুতরাং এতে বিস্ময়ের কিছু নেই- এসব আইন আল্লাহ্ যা নিষিদ্ধ করেছেন তাকে সিদ্ধ করে আর আল্লাহ্ যা সিদ্ধ করেছেন তাকে অসিদ্ধ ঘোষণা করে। আর এসব তথাকথিত আধুনিক আইন সব রকম দুর্নীতি ও অনাচারকে প্রশ্রয় দেয়। অন্যদিকে শাষকদের কার্যকলাপও হতাশাব্যঞ্জক। তারা ইসরামের শত্রুদের সাথে সন্ধি করে আর ইসলামের কথা শোনা যায় নিছক ধর্মীয় উপলক্ষ্য ছাড়া তাও আবার সাধারণ মানুষকে ধোঁধা দেয়ার জন্যে।
মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থাপনা আরো করুণ। তরুণরা তাদের চোখের সামেন সামেন দেখেত পাচ্ছে ধনী ও দরিদ্রের কী অহসনীয় বৈষম্য! কেউ কোনোভাবে জীবন ধারণ করছে, এমনকি ওষুধপথ্যও সংগ্রহ করতে পারছে না কিংবা মাথা গোঁজারও ঠাঁই নেই। অন্যদিকে বিত্তবানরা লাখ লাখ টাকা মদ ও নারীর পেছনে ঢালছে, বড় বড় প্রাসাদে বাস করছে কিৎবা অনেক সময় খালিই পড়ে থাকে। বিদেশী ব্যাংকে তারা কোটি কোটি ডলার গোপনে সঞ্চয় করছে। তারা তেলের টাকা অপহরণ, পাশ্চাত্যের সাথে সহযোগিতা এবং আর্ন্তজাতিক কোম্পানীগুলোর সাথে লেনদেন করে বিত্তের পাহাড় গড়েছে। আর এই অর্থ তারা জুয়া এ নরীর পেছনে অকাতরে ব্যয় করছে। এর একটি অংশও যদি তারা দরিদ্র মানুষের জন্যে দান করতো তাহলে হাজার হাজার মানুষের অন্ন ও আশ্রয়ের সংস্থান হতো। অথচ এই সুবিধাভোগী শ্রেণী দিনে দুপুরে ডাকাতির মতো জনগণেরন সম্পত্তি অপহরণ করে চলছে। সুদ, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি তো আছেই কিন্তু এদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করার কেউ নেই। আইনের হাত থেকে বাঁচার রাস্তাও তাদের জন্য সহজ। সুতরাং এই নিদারুণ পরিস্থিতি সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে, এতে আর সন্দেহ কী! আর এই সুযোগের জন্যে ওৎ পেতে বেস থাকে সর্বনাশা মার্ক্সবাদীরা। তখন তারা বিকল্প হিসেবে শ্রেণী সংগ্রামের কাজ জারি করে দেয়।
এক্ষণে এই মর্মান্তিক অবস্থায় মূল কারণ সর্ম্পকে কোনো হেঁয়লির অবকাশ নেই। একটি পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্যময় ও সুবিচারপূর্ণ বিধান হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম আজ স্বদেশেই নির্বসিত। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্র পরিচালনা, মানুষ ও সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক তথা সর্বক্ষেত্রে আজ ইসলাম অপসারিত। খ্রীষ্টানদের অবক্ষয়ের সময় যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো এখন মুসলমানদের অবস্থা তাই। ইসলামকে শরীয়ত ছাড়া দ্বীন, রাষ্ট্র ছাড়া ধর্ম এবং কর্তৃত্ব ছাড়া আইনের কিতাবে পর্যবসিত করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে এমন পরিনামের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে যার সাথে তার নিজস্ব ইতিহাসের কোনো সাদৃশ্য নেই। ক্যাথলিক গীর্জা সব রকম অনাচারে নিমজ্জিত হয়েছিলো। তারা স্বৈরাচারী শাসকদের পৃষ্টপোষকতা করে সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিলো। সামান্য বিরোধিতা তারা সহ্যকরতে পারতো না। স্বাধীনভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছিলো নিষিদ্ধ। এ জন্যে তারা নিষ্ঠুর নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছিল। তারা বই পুড়িয়েছে, মানুষকেও পুড়িয়ে মেরেছে। সুতরাং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ খুব স্বাভাবিক এবং ইউরোপে তাই হয়েছে। তারা গীর্জার জোয়াল থেকে এমনভাবেই নিজেদের মুক্ত করেছে যে, এখন গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলেছে আরেক ধ্বংসের দাকে। যা হোক, মুসলমানদেরকে কেন এই কালো ইতিহাসের পরিণাম ভোগ করতে হবে? ইসলাম কেন নির্বসিত হবে স্রেফ মসজিদে কিংবা মানুষের বিবকের সীমিত পরিসরে? কিন্তু মসজিদও আজ নিরাপদ নয়। সেখানেও জিহ্বাকে আংটাবদ্ধ রাখতে হয়। কেননা গুপ্ত পুলিশের কড়া নযর থাকে এগুলোর ওপর। মোটকথা মসজিদেও আজকাল ইসলামের বিপ্লবী ব্যাখ্যা দেয়ার অনুমতি নেই।
এই সমস্যার মৌলিক কারণ, মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মকে রাষ্ট্র, আইন প্রণয়ন ও ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার শিক্ষা দেয়। মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক ইতিহাসে এরূপ অদ্ভুত শিক্ষার কোন নযীর নেই। কোননা আশ-শারীয়াহ শুধু ইবাদত-বন্দেগীর ভিত্তি নয়, বরং আইন, লেনদেন, ঐতিহ্য ও রীতি-নীতিরও উৎস। একথা সত্যি, কোনো কোনো মুসলমান শাসক সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন; কিন্তু অন্তত বিচার-আচারের ক্ষেত্রে শরীয়তকে উপেক্ষা করার তেমন নযীর নেই। এমনকি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো স্বেচ্ছাচারী শাসকও কুরআনুল কারীম ও সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রদত্ত রায়কে অগ্রাহ্য করার ধৃষ্টতা দেখাতেন না। এই পার্থক্যটা অনুধাবনযোগ্য। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি বা অবহেলার কারণে শরীয়ত থেকে বিচ্যুত হওয়া এক কথা আর আল্লাহর বিধান হিসেবে অন্যান্য মতবাদের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠতা অস্বীকার করা ভিন্ন কথা। এদিকেই ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ্ বলছেন: “নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান দানে আল্লাহ্ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর?” (৫:৫০)
আরেকটি ব্যতিক্রমী বিষয় মুসলিম তরুণদের পীড়া দেয়। অমুসলিম দেশগুলো তাদেরই আদর্শ ও দর্শন মোতাবেক জীবন ধারা গড়ে তুলছে, অথচ কেবল মুসলমানরাই তাদের বিশ্বাস ও বাস্তবতা, তাদের দ্বীন ও সমাজের মধ্যে সৎঘাত জারি রেখেছে। আমার একটি বইয়ে লিখেছি: “ধর্মনিরপেক্ষতা খৃষ্টানরা গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু তা মুসলমান সমাজে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।” খৃষ্টধর্ম জীবনের জন্যে পূর্ণাঙ্গ ঐশি বিধান পেশ করতে পারে না যার প্রতি তার অনুসারীরা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে পারে। খোদ বাইবেলে জীবনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: একটি ঈশ্বর অথাৎ ধর্ম অন্যটি সীজার অথাৎ রাষ্ট্র। এতে বলা হয়েছে: “সীজারের জন্যে নির্ধারিত বিষয় সীজারকেই চালাতে দাও আর ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দাও।” (ম্যাথিউ-২২:২১)
সুতরাং একজন খ্রীষ্টান বিবেকের কোনরূপ দংশন ছাড়াই ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া তাদের পক্ষে ধর্মীয় শাসনের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ শাসন গ্রহণ করার যুক্তি আছে। তাদের ধর্মীয় শাসনের অভিজ্ঞতা বড় নির্মম। অতীতে যাজকদের স্বেছ্ছাচারী শাসনের স্মৃতি তাদের মন থেকে মুছে ফেলা কঠিন। মুসলিম সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে নেয়া মানে আবাদত, বান্দেগী, আইন-কানুন, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুকে সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করার শামিল। তাছাড়া বর্তমান যুগের চাহিদা পূরণে শারীয়াহ সক্ষম নয়- এই মিথ্যা দাবীর কাছে নতি স্বীকার করা। বস্তুত মানুষের রচিত আইন মেনে নেয়া মানে ঐশী বিধানের পরিবর্তে মানুষের সীমিত জ্ঞানকে শ্রেয় মনে করা, অথচ আল-কুরআন বলছে: “বল! তোমরা কি বেশি জান, না আল্লাহ্?” (২:১৪০)
এ কারণে মুসরমানদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার দাওয়াত নাস্তিকতা ও ইসলাম পরিহারের দাওয়াতের সমতুল্য। শারীয়াহর পরিবর্তে একে শাসনের ভিত্তি বলে গ্রহণ করলে তা হবে সরাসরি রিদ্দাহ। এই বিচ্যুতি সম্পর্কে জনগণ নীরব থাকরে তা বড় ধরনের সীমালংঘন ও পরিষ্কার অব্াধ্যতার নযীর বলে গণ্য হবে। এর ফলে মুসলিম সমাজে অপরাধবোধ, দীনতা, হিংসা, ঘৃণা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হতে বাধ্য। বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষতা মূলত ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের নিজেস্ব ধ্যান-ধারণাই ফসল। এই মতবাদের দৃষ্টিতে ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন বটে, কিন্তু এর দেখাশোনার দায়িত্ব ত্যাগ করেছেন অথাৎ জগতের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্কে ঘড়ির সাথে ঘড়ি-নির্মাতার সম্পর্কের মতো। ঘড়ি-নির্মাতা ঘড়ি তৈরি করে দেয়ার পর নির্মাতার সাহায্য ছাড়াই চলতে পারে, তেমনি আল্লাহ পৃথিবী নির্মাণের পর তা আপন গতিতেই চলছে। এই ধারণা এসেছে গ্রীক দর্শন থেকে। এরিস্টলের মতে আল্লাহ পৃথিবী নিয়ন্ত্রন করেন না এবং এ সম্পর্কে কিছুই খবর রাখেন না। উইল ডুরান্ট এক ধাপ এগিয়ে তাকে বলেছেন অসহায় ঈশ্বর। সুতরাং এতে আর আশ্চর্যের কী আছে, যে ঈশ্বর তার সৃষ্ট জীবের খবরই রাখেন না তিনি কী করে তাদের জীবন যাত্রার বিধান তৈরি করবেন? এ দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া ছাড়া তো তার গত্যন্তর নেই! ইসলামের ধারনা থেকে এই ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা মুসলমানরা বিশ্বাস করি আল্লাহ্ একই সাথে জগতের সৃষ্টিকর্তা, বিধানদাতা ও পালনকর্তা : “… তিনি সবকিছুর বিস্তারিত হিসাব রাখেন।” (৭২:২৮)
তিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বদর্শী; তাঁর দয়া ও বদান্যতা সকলের জন্য যথেষ।ট। এই ক্ষমতা বলেই তিনি মানুষের ঐশী পথ রচনা করছেন, হালাল-হারাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং বান্দাদেরকে তাঁরই বিধান মেনে চলতে এবং সেই অনুযায়ী ফায়সালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি তারা না করে তবে তা হবে কুফরী ও সীমালংঘন।
নিষ্ঠাবান মুসলিম তরুণরা এ ধরনের অনাচার তাদের চোখের সামনেই দেখেছে কিন্তু কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা শক্তি প্রয়োগ কিংবা গলাবাজি করে এ সবের পরিবর্তন করতে পারছে না। তাদের একমাত্র উপায় মনের মণিকোঠায় গভীর অনুভূতি পোষণ যা ঈমানের দুর্বলতম অঙ্গ। অবশ্য, এই হৃদয়াবেগ চিরদিন চাপা থাকবে না। একদিন না একদিন তার বিস্ফোরণ ঘটবেই।
এছাড়া ইসলামী বিশ্ব ও মুসলমানদের পবিত্র স্থানসমূহ সর্বগ্রাসী হামলার শিকার। ইহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ, পৌত্তলিক, মার্ক্সবাদী তথা সকল ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের মত পার্থক্য ভুলে একযোগে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে ইসলামী পুনরুজ্জীবন, ইসলামী আন্দোলন অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হীন তৎপরতা চালিয়ে যাছ্ছে। এ কারণে সকল অনৈসলামী ইস্যু প্রাচ্য ও প্রতীচ্য, বিশেষত আমেরিকা ও রাশিয়ার নৈতিক ও বৈষয়িক মদদ পায়, কিন্তু ইসলামী ইস্যুতে তারা নির্বিকার। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজীদ বলছেন: “বেঈমনারা একে অন্যের সমর্থক।” (৮:৭৩)
কিন্তু ভাষা-বর্ণ-গোত্র-স্থান-কাল-নির্বিশেষে মুসলমানরা অন্য মুসলমানের বিপদাপদে, নিগ্রহ নিষ্পোষণ ও হত্যাযজ্ঞে নীরব থাকতে পারে না। কারণ তারা সেই সবূত্তোম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত যারা একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। কেননা যে মুসলমানের মনে অন্য মুসলমানের সম্পর্কে কোনো অনুভূতি নেই, সে মুসলমান নয়।
প্রতিদিন খবর আসছে ফিলিস্তিন, লেবানন, আফগানিস্থান, ফিলিপাইন, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, সাইপ্রাস ও ভারতে মুসলমানরা কিভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। অথচ আমরা দেখি আজকাল অন্য কোনো মুসলিম দেশ এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করে না, বরং সম্পূর্ণ উদাসীন। আরো মর্মান্তিক, কোনো কোনো শাসক ইসলামের শত্রুদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন। তারা স্রেফ গোত্রীয়, আঞ্চলিক বা জাতিগত স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত।
আল্লাহ, তাঁর রাসূল, দ্বীন, উম্মাহ ও এর স্বার্থের প্রতি তাদের কোনো আনুগত্য বা অনুভূতি নেই। তরুণরা আরো লক্ষ্য করছে, ইসলামের প্রতি শাসকদের এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির নেপথ্যে কাজ করছে ইহুদী, খ্রীষ্টান ও কম্যুনিজমের চক্রান্ত। কিন্তু শাসকদের মনে ভীতি সৃষ্টিকরে এবং তাদেরকে ইসলামী আন্দোলনদমনে প্ররোচিত করে।
বহুবিধ বিষয়ের মধ্যে আরেকটি বিষয় বিগত কয়েক বছরে মুসলিম তরুণদের মদ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। এটি হচ্ছে ১৯৬৭ সালের ৬ দিনব্যাপী মিসর-ইসরাঈল যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া রোধের লক্ষ্যে যুদ্ধের জন্য দায়ি ব্যক্তিরা এই আশ্বাস বাণী শোনালেন যে, এটা “পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন”- তেমন ক্ষতিকর কিছু নয়। অথচ আরব দেশগুলোর তরুণরা শৈশব থেকে এই অঞ্চলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এই এলাকাকে মুক্ত করা মুসলমানদের ধর্মীয় ও জাতীয় দায়িত্ব। ফিলিস্তিনের গ্রান্ড মুফতী মরহুম আমীন আল-হুসয়নী (র) -এ ব্যাপারে বলেছিলেন, “ফিলিস্তিন জনবসতিহীন জনপদ নয় যে, এখানে জনপদহীন লোকদের আশ্রয় দিতে হবে।” যা হোক ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর পরিস্থিত নতুন মোড় নিলো অথাৎ আগ্রাসনের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার নামে ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন কর হলো। এর অর্থ দাঁড়ায়, সাম্প্রতিক ইসরাঈলী আগ্রাসনে পুরানো আগ্রাসনকে বৈধ বলে স্বীকার করে নেয়া হয়। যদি তাই হয়, তাহলে ১৯৪৯, ১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের কী কারণ ছিল? গোড়াতেই ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দিলে মুসলিম উম্মাহ মারাত্মক পরিণতির হাত থেকে রেহাই পেতো। বস্তুত তথাকথিত “শান্তিপূর্ণ সমাধান” ও শান্তিচুক্তির অজুহাতে এসব অবমাননাকর উদ্যোগ নেয়া হয়। ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ সামরিক, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে তাদের নীতির পক্ষে সাফাই দেন। কিন্তু এসবই মুসলমানদের আশা-আকাংখায় তীব্র আঘাত হানে, বিশেষ কর ইসরাঈলের প্রতি সকর বৃহৎ শক্তির স্বীকৃতি ও সমর্থন এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি উপেক্ষা মুসলমানেদের আঘাত তীব্রতর করে। এসব ঘটনা থেকে এই উপসংহার টানা যায় যে, ইসলামের বিরুদ্ধে নতুন করে ক্রুসেড শুরু করা হচ্ছে। এসরামী বিশ্ব ও ইসরামী আন্দোলনের প্রতি পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক নেতাদের মনোভাবে এটা পরিস্ফুটিত। মুসলমানদের সাথে শতাব্দী প্রাচীন লজ্জাকর লড়াইয়ের স্মৃতি তাদের মনে এখন তরতাজা রয়েছে। তাই তাদের অন্তরে এখনো মুসরিম বুদ্ধিজীবি অবশ্য এই ধারণা বাতিল করে যুক্তি দেখাতে চান যে, পাশ্চাত্যে ক্রুসেড চেতনা নয়, তাদের জাতীয় স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্তিতি তাদের এই দাবীকে ভুল প্রমাণিত করেছে, বরং পাশ্চাত্যে ক্রুসেড চেতনা পূর্ণমাত্রায় জীবন্ত। আমি আমি এলেনবী অথবা জেনারেল গুরান্ডের কথা বলতে চাই না। আমাদের সমসাময়িকদের মনেই প্রশ্ন জেগেছে : কেন পাশ্চাত্য মুসলিম ভূখন্ডে ইসরাঈলের অস্তিত্ব বহাল রাখতে আগ্রহী? কেন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাঈলের নিন্দা সম্বলিত প্রতিটি জাতিসংঘ প্রস্তাবে ভেটো দেয়? কেন তারা ইরিত্রিয়ার বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদী ইথিওপিয়াকে সমর্থন যোগায়? কেন সংবাদপত্রে মুসলিম দেশের ঘটনাবলী গুরুত্ব সহকারে স্থান পায় না? অথচ বিশ্বের কোথাও একটি বিমান হাইজ্যাক হলে যেন তুলকালাম কান্ড শুরু হয়? কেন তারা অন্যদের চেয়ে আরবদের সস্তা মনে করে? আসলে এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ ও কম্যুনিজমের শয়তানী আঁতাত গড়ে উঠেছে।
বস্তুত মুসলিম তরুণদের মতে মুসলিম দেশগুলোর শাসকরা বিদেশী শক্তির দাবার গুটিমাত্র। তাদেরকে সামরিক অভ্যুথ্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এনে মুসলমানদের চৌখে ‘হীরো’ সাজানো হয়। এই ধারণার মধ্যে অতিশয়োক্তি থাকলে থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক ঘটনা প্রবাহের আলোকে একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। এসব ঘটনা চোখে আয়্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ইসলামী পুনর্জাগরণ অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্যেই এই শাসকরা শয়তানী চক্রের ফাঁদে পা দিয়েছে। এই নেতারা দৃশ্যত মুসলমান ও ইসলামের জন্যে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে, আসলে তারা মুসলিম উম্মাহর শত্রুদের পোষা এজেন্ট।
৯. ইসলামী দাওয়াতে প্রতিবন্ধকতা
আরেকটি বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি দেয়া দরকার। বিষয়টি হচ্ছে ইসলাম প্রচারে স্বাধীনতা। ইসলাম শুধু নিজেকে সৎ হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেয় না, অন্যকেও সংশোধনের তাগিদ দেয়। মানুষকে ভাল কাজের আদেশ দেয় ও খারাপ কাজ থেকে বিরত প্রচেষ্টাকে এ কারণে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানকে তার সামর্থ অনুযায়ী ইসলাম প্রচারের কাজে অংশ নিতে হবে। এ জন্যে কুরআনে বলা হয়েছে: “তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান করো।”…(১৬: ১২৫)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রত্যেক সাহাবী ছিলেন ইসলাম প্রচারক (দাইয়া)। কুরআন আরো বলছে: “বল, এটাই আমার পথ: আল্লfহর প্রতি মানুষকে আমি আহবান করি সজ্ঞানে। আমি ও আমার অনুসারীগণ।” (১২:১০৮)
অতএবসংস্কার কর্মীদের লক্ষ্য হচ্ছে: “নিজে সৎ হও অপরকে সৎ করো।” আলকুরআনের ভাষায়: “কে উত্তম আল্লাহ্র (সাহায্যের) হাত জামা’তের সাথেই থাকে।” তিনি আরো বলেন: “একজন ঈমানদার আরেকজন ঈমানদারের কাছে সেই ইমারতের মতো যার বিভিন্ন অংশ একে অপরের সাথে সংযুক্ত।” (বুখারী)
নিজেদের মধ্যে সহৃদয় সহযোগিতা এবং সৎ কাজের আদেশ কেবল একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একটি অপরিহার্য শর্ত। অতএব দাওয়াতী ক।ষেত্রে সামষ্টিক কাজ বাধ্যতামূলক- এছাড়া দায়িত্ব অপূর্ণ থাকে। বাস্তব কথা হচ্ছে ইসলাম বিরোধী শক্তি বিভিন্নভাবে সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করছে, অতএব মুসলমানদেরকেও সংঘবদ্ধ হয়েই ঐ শক্তির মোকাবিলা করতে হবে। আন্যথায় আমরা পিছিয়ে পড়তে থাকব যখন অন্যরা এগুতে থাকবে। অতএব যেসব মুসলিম দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত দাওয়াতী কাজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়, সরকারীভাবে এমনকি সেন্সরশীপের মাধ্যমে তারা মস্ত বড় গুনাহ করে। দাওয়াতী কাজে ভীতি প্রদান ও বাধা সৃষ্টিও চরমপন্থী মনোভাব সৃষ্টির প্রধান কারণ, বিশেষ করে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা ও মার্ক্সবাদ প্রচারে কোনো বাধা দেয়া হয় না; বরং সকর সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয় তখন এটাকে কিছুতেই সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এ কারণে যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী বিপ্লবের কাজে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই, কোনো সরকারেরও থাকতে পারে না।
বস্তুত মুসলিম দেশগুলোতেই ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্ঠা করতে গিয়ে সেন্সরশীপ ও নানা রকম দলনের শিকার হতে হচ্ছে। সেখানে ইসলামের চেহারা হচ্ছে পশ্চাদপদতা ও অবজ্ঞায় এবং আচার-অনুষ্ঠান, বিদাতী কাজ কাম, শাসক-তোষণ এবং শাসকদের গদী বহাল রাখার দেয়ার মধ্যে সীমিত। আর দুর্নীতিপয়ারণ শাসকরাও এ ধরনের ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় অতি উৎসাহী। এভাবে অন্যায়-অবিচার শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদকে তারা স্যাবোটাজ করার অপচেষ্টা চালায়। মার্কস সম্ভবত এই অর্থে দাবী করেছিলেন, “ধর্ম জনগণের জন্যে আফিম।”
কিন্তু কুরআনুল করীম, সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন যে ইসলাম রেখে গেছেন তা হচ্ছে সত্য, শক্তি, সম্মানান-মর্যাদা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জিহাদের প্রতিভূ। আর শাসকরা এই ইসলামকে ভয় পায়; কারণ তাদের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে কি জানি কখন বিদ্রোহ দেখা দেয়! পক্ষান্তরে এই ইসলাম তার অনুসারীদেরকে বলে: “তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করতো এবং তাঁকে ভয় করতো, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করতো না।” (৩৩:৩৯)
এই পরিছন্ন বিশ্বাসের আলোকে ঈমানদাররা মনে করে যেহেতু জীবন মেয়াদ আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত, অতএব কাউকে ভয় করার দরকার নেই, আর তিনি ছাড়া কারো কাছে পার্থনারও দরকার নেই। সমসাময়িক তুরস্কের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার একজন উপপ্রধান মন্ত্রীকে মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি একটি দলের নেতা। তাদের বিরুদ্ধে শরীয়ত প্রবর্তন করার দাবী জানানোর অভিযোগ আনা হয়। অথচ তুরস্কের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান! উক্ত নেতা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ খাড়া করা হয়। অভিযোগগুলোর মূল বিষয় ছিলো তারা ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ককে এসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। ধর্মনিরপেক্ষ আতাতুর্কের অনুসারী তুরস্কের তদানীন্তন সামরিক সরকার শরীয়ত তথা আসলামী জীবন বিধান পুনঃপ্রবর্তনের যে কোন প্রচেষ্টাকে অপরাধ বলে গণ্য করে। অথচ উক্ত গ্রুপ সর্বসম্মত আইনানুগ পন্থায় গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা শক্তি প্রয়োগ করে সহিংস পন্থায় সরকার উৎখাত করতে চাননি। সামরিক কৌশুলী তাদের বিরুদ্ধে নানা আপত্তিকর শ্লোগান তোলার অভিযোগও উথ্থাপন করে। শ্লোগানগুলো ‘আশাশারীয়াহ এবং ইসলাম এক ও অভিন্ন’ এবং আল-কুরআনই হচ্ছে সংবিধান।’
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মুসলমানই যিনি আল্লাহকে প্রভু, ইসলামকে দ্বীন ও হযরত মুহাম্মদ (সা) কে রাসূল হিসেবে স্বীকার করেন তার পক্ষে কী এগুলো অস্বীকার করা সম্ভব? যখন ঈমানের পরিবর্তে কুফর এবং হারামকে হালাল করা হয় তখন মুসলমানদের কীকরা উচিত? এসব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কী বাড়াবাড়ি ও চরমপন্থার মূল কারণ নয়? একটি আফ্রো-আবর দেশে কম্যুনিস্ট তৎপরতার জন্যে সাংবিধানিক সুযোগ ও নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলামী ভাবধারা জাগ্রত করার সকল প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ ঐ দেশটি নিজেকে তথাকথিত “স্বাধীন বিশ্বের অঙশ” বলে বিবেচনা করে। আরো মারাত্মক হচ্ছে ঐ দেশটির মুসলিম নেতা-কর্মীদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধেও একমাত্র অভিযোগ, তারা আল্লাহ্ কে প্রভু, সত্যকে লক্ষ্য, ইসলামকে একমাত্র পথ, কথাকে অস্ত্র এবং জ্ঞানকে তাদের একমাত্র খোরাক বলে ঘোষণা করেছিলো।
অতএব, হেকমত ও সুন্দর ভাষণের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তরুণরা যদি শক্তিকে ও সহিংসতাকে সহিংসতা দিয়ে মোকাবিলা করতে চায় তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যায়? এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। ইন্ শাআল্লাহ ইসলাম যেভাবে হোক সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবে। তাদেরকে সুস্থ ও স্বাধীন পরিবেশে কাজ করতে দেয়া উচিত। অন্যথায় ঘটনাবলী অবাঞ্ছিত বিপরীত খাতে প্রবাহিত হতে পারে। খোলাখুলি কাজ করতে না দিলে দাওয়াতী কাজ বিভ্রান্তিকর গোপন সহিংসতা কিংবা চরমপন্থার রূপ নিতে পারে। ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের মারাত্মক ভুল হচ্ছে তারা ইসলামী আন্দোলন দমনে বন্দী শিবির সহিংস মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। বন্দীশিবিরগুলোতে মানুষের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়। এ প্রনঙ্গে ১৯৫৪ ও ১৯৬৫ সালের মিসরের ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। সামরিক কারাগারে ইসলামী বিপ্লবের নেতা ও কর্মীদেরকে লোমহর্ষক ও অবিশ্বাস্য পন্থায় শাস্তি দেয়া হয়। এখনো এসব কথা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। তাদের দেহে আগুন ও সিগারেটের ছ্যাঁক দেয়া হয়, নারী ও পুরুষ বন্দীকে জবাই করা পশুর মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়, কারারক্ষীরা পালাক্রমে রক্ত ও পুঁজ জমে না ওঠা পর্যন্ত বন্দীদেরকে আগুনে ঝলসাতে থাকে। এই পাশাবিক আচরণে অনেকেই শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু শাস্তিদাতাদের দিল আল্লাহর ভয়ে এতোটুকু কেঁপে ওঠেনি। নাৎসীবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সমাজবাদের উদ।ভাবিত সকর নির্যাতন কৌশল তারা নির্বাচারে আল্লাহ্র পথের মুজিহিদদের ওপর প্রয়োগ করে।
এই বন্দীশালায় চরমপন্থা ও তাকফীরের প্রবণতা জন্ম নেয়। বন্দীদের মনে প্রশ্ন জাগে : আমরা কি অপরাধে হচ্ছি? আমরা আল্লাহর কালামের কথা ছাড়া আর কিছুতো বলিনি? আল্লাহর পথে জিহাদে আমরা কেবল আল্লাহ্ রই সাহায্য চেয়েছি, অন্য কারো কাছে তো পুরস্কার বা প্রসঙসা চাইনি? এই প্রশ্ন আরো প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই পশুরা কে যারা আমাদের নির্যাতন করে, আমাদের মানব সত্তাকে অপমানিত করে, আমাদের ধর্মকে অভিশাপ দেয়, আমাদের প্রভুরও অমর্যদা করার মতো ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে! একজন পদস্হ কর্মকর্তা একদিন বলে: ‘তোমাদের প্রভুকে আমার কাছে হাযির করো, তাকে আমি জেলে পুরব।” এই পশুগুলোকে কি মুসলমান বলা চলে? এরা যদি মুসলমান হয় তাহলে কুফরী কী? এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এরাই হচ্ছে কাফির, এদেরকে ইসলামের আওতা থেকে বিতাড়িত করতেই হবে। এরপর আরো প্রশ্নের উদয় হয়: এদের সম্পর্কে এই যদি হয় আমাদের বিচার, তাহলে এদের মনিব সম্পর্কে আমরা কি সিদ্ধান্ত নেবো? ক্ষমতার আসনে বসে যেসব নেতা ও শাসক ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদেরকেই বা কিভাবে বিচার করা উচিত? তুলনামূলক বিচারে তাদের অপরাধ অধিকতর মারাত্মক এবং তাদের রিদ্দাহ আরো স্পষ্ট- যে সম্পর্কে কুরআনুল করীমে বলা হয়েছে: “আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারা সত্যত্যাগী।” (৫:৪৭)
এই সিদ্ধান্তে আসার পর ঐ নির্যাতিত মুসলমানরা তাদের সহবন্দীদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: যেসব শাসক আল্লাহ্র বিধান মোতাবেক বিচার করে না এবং যারা শরীয়তের বাস্তয়নে সংগ্রামরত তাদের সাথে একমত হলো তাদেরকে শত্রু গণ্য করলো। এমনকি কাফিরও মনে করলো, কেনা কাফিরের কুফরী সম্পর্কে যে সন্দেহ পোষণ করে সে নিজেই কাফির। কিন্তু একানে শেষ নয়। যেসব লোক ঐরূপ শাসকের আনুগত্য করে তাদের সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠলো। জবাব তৈরি ছিলো: তাদের শাসকের আনুগত্য করে সে নিজেও কাফির।
এভাবে ব্যক্তি গ্রুপ বিশেষকে কুফরী ফতোয়া দেয়ার্ প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সহিংসতা শুধু সহিংসতার জন্ম দেয় না, সুস্থ চিন্তাকেও দূষিত করে এবং ঐ দলন-দমন অর্নিবার্য বিদ্রোহের জন্ম দেয়।
পরিভাষা সঙ্কেত
১. সুনান: রীতি, ধারা।
২. তালিব আল-হাদীস:
যে বৈশিষ্ট্য ও পরিস্থিতিতে হাদীস অশুদ্ধ হতে পারে সেই সংক্রান্ত শাস্ত্র।