ধর্মীয় চরমপন্থার ত্রুটি
বস্তুত সকল উগ্রতা ও বাড়াবাড়ির মধ্যে মারাত্মক ত্রুটি অন্তর্নিহিত থাকে। এ কারণে এর বিরুদ্ধে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। প্রথম ত্রুটি হচ্ছে সাধারণ মানবীয় প্রকৃতি বাড়াবাড়ির (excessivenes) সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়; এই প্রকৃতি কোনো বাড়াবাড়িকে বরদাশত করতে পারে না। যদি মুষ্টিমেয় লোক স্বল্প সময়ের জন্যেও বাড়াবাড়ি সহ্য করতে পারে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তা করতে সক্ষম হবে না। আল্লাহর বিধান সমগ্র মানুষের জন্যে, মুষ্টিমেয় হঠকারীর জন্যে নয় যাদের তথাকথিত সহন ক্ষমতা বেশি বলে আপাতত প্রতীয়মান হয়। একবার রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর একজন বিশিষ্ট সাহাবী মুয়াযের ওপর ক্রদ্ধ হয়েছিলেন। কারণ তিনি নামাযের ইমামতিতে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করেছিলেন বলে একজন মুসল্লী অভিযোগ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে বললেন: “হে মুয়ায! তুমি কি মুসল্লীদের পরীক্ষা করছ? তিনি তিনবার এ কথার পুনরুক্তি করলেন।” (বুখারী) আরেকবার মহানবী (সা) অস্বাভাবিক ক্রুদ্ধ হয়ে একজন ইমামকে লক্ষ্য করে বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাল কাজের (নামায) প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা সৃষ্টি কর। তাই তোমরা যখনি নামায পড়াবে তখন তা সংক্ষিপ্ত করা উচিত, কারণ মুসল্লীদের মধ্যে দুর্বল ও বৃদ্ধ এবং কর্মব্যস্ত লোক থাকে। ” (বুখারী) রাসুলুল্লাহ (সা) মুয়ায ও আবু মূসাকে ইয়ামানে প্রেরণের প্রাক্কালে এই উপদেশ দিয়েছিলেন:“(জনগণের কাছে ধর্মীয় বিষয়গুলো) সহজ করে তুলে ধরো, কঠিনরূপে নয়। একে অপরকে মান্য করো, বিভেদে লিপ্ত হয়ো না।” (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত)
উমর ইবনে খাত্তাব (রা) এর ওপর জোর দিয়ে বলেছেন: “নামাযের ইমামতিতে দীর্ঘসূত্রিতা করে বান্দার কাছে তার কাজকে (আমল) এবং আল্লাহকে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করো না”।
বাড়াবাড়ি দ্বিতীয় ত্রুটি হচ্ছে, এটি ক্ষণস্থায়ী। যেহেতু মানুষের সহ্য ক্ষমতা ও অধ্যবসায় স্বভাবত সীমিত তাই সহজে সে একঘেঁয়েমি অনুভব করে। দীর্ঘ সময় ধরে বাড়াবাড়িমূলক ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত থাকা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। এমন একটা সময় আসবে যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়বেই, দৈহিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে। এমনকি স্বভাবসম্মত নূন্যতম কাজটিও সে পরিত্যাগ করবে। অথবা অতিরিক্ত আমলের উল্টো এমন এক পথ বেছে নেবে যা হবে শেষ পর্যন্ত চরম অবহেলা ও শৈথিল্যের শামিল। এমন কিছু লোকের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে যাদেরকে দৃশ্যত গোঁড়া ও কঠোর মনে হয়েছে। পরে আমি তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি যে, তারা হয় পথভ্রষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে চলতে শুরু করেছে কিংবা ন্যূনপক্ষে হাদীসে বর্ণিত হঠকারী চরিত্রের লোকদের মতো সবেগে পিছু হটে এসেছে। এ সম্পর্কিত হাদীসটি হচ্ছে: “যে (হঠকারী জল্লাদবাজ লোক) (নির্দিষ্ট) দূরত্বও অতিক্রম করতে পারে না এমনকি পারে না তার বাহনের পিঠটাকেও ঠিক রাখতে।” (জাবিরের সনদে আল-বাজ্জাজ)
রাসূলুল্লাহর (সা) আরেকটি হাদীসেও এরূপ ইঙ্গিত রয়েছে: “সেই সব সৎকর্মে প্রবৃত্ত হও যা সহজে সম্পন্ন করা যায়; কেননা আল্লাহ তায়ালা (পুরষ্কার দানে) ক্লান্ত হন না যতোক্ষণ না তুমি (নেক আমলে) ক্লান্ত ও অবসন্ন হও… এবং আল্লাহর কাছে সেই আমলই সবচেয়ে প্রিয় যা নিয়মিত সম্পাদন করা হয় তা যতই ছোট হোক না কেন।” (হযরত আয়েশার (রা) বরাতে বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও আন-নাসাঈ) ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: “মহানবী (সা) -এর একজন সেবক দিনে রোযা রাখতেন আর সারা রাত নামায পড়তেন। রাসূলুল্লাহ (সা) কে এ বিষয়ে জানান হলে তিনি বললেন, “প্রতিটি কাজের একটি শীর্ষ বিন্দু থাকে এবং তাকে অনিবার্যভাবে অনুসরণ করে শৈথিল্য। যে তার স্বাভাবিক সরল জীবনে আমার সুন্নাহকে অনুসরণ করে সে সঠিক পথে আছে আর যে শৈথিল্যের কারণে অন্যের পথ নির্দেশ অনুসরণ করে সে (ভুল করল) এবং (আল্লাহ পাক প্রদত্ত সরল পথ থেকে) বিচ্যুত হলো।” (আল বাজ্জাজ)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বলেন: “ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতে থাকতে ক্লান্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) কে অবহিত করা হলে তিনি বললেন: ‘এটা হচ্ছে ইসলামের কঠোর অনুশীলন এবং আমলের সর্বোচ্চ পর্যায়। প্রতিটি গোঁড়া ক্রিয়াকলাপের একটি শীর্ষ পর্যায় থাকে এবং সেই সাথে থাকে অনিবার্য শৈথিল্য.. যার সহজ-সরল আমল কিতাব (কুরআনুল কারীম) ও সুন্নাহর আলোকে নিষ্পন্ন হয় সে-ই সঠিক পথের ওপর কায়েম থাকে আর যার অবসন্নতা অবাধ্যতায় পর্যবসিত হবে তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।” (আহমাদ এবং আবু শাকির সমর্থিত)
ইবাদতের ক্ষেত্রে চরমপন্থা বর্জনের এবং মধ্যপন্থা অবলম্বনের কী চমৎকার তাগিদ এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলমানদেরকে দিয়েছেন! তিনি আরো বলেছেন: “ধর্ম খুব সহজ আর সে নিজের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে নেয় সে তা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। সঠিক পথে চলো (বাড়াবাড়ি বা অবহেলা কোনটাই না করে), (পূর্ণতার) নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করো এবং (তোমার সৎকর্মের পুরষ্কার লাভের জন্যে) সুসময়ের অপেক্ষা করো।” (বুখারী ও নাসাঈ, আবু হুরায়রা বর্ণিত)
তৃতীয়ত, হঠধর্মী বাড়াবাড়ি অন্যের অধিকার ও কর্তব্যকে বিপন্ন করে। এ প্রসঙ্গে একজন বুযুর্গ বলেন: “প্রত্যেক বাড়াবাড়ির মধ্যে কারো কারো অধিকার হারানোর বেদনা জড়িত আছে।” আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ইবাদত-বন্দেগীতে এমন মশগুল থাকতেন যে, তার স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যও উপেক্ষিত হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) একথা জানতে পেরে বললেন, “হে আবদুল্লাহ, আমি কি শুনিনি যে, তুমি সারাদিন রোযা রাখো আর সারারাত বন্দেগী করো?” আবদুল্লাহ বলেন, “জী হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল! মহানবী (সা) বললেন, “এরূপ করো না, কয়েকদিন রোযা রাখো আবার কয়েক দিনের জন্যে ছিড়ে দাও, রাতে বন্দেগীও করো আবার ঘুমোতেও যাও। তোমার ওপরে তোমার শরীরের অধিকার আছে, তেমনি তোমার ওপরে তোমার স্ত্রীর দাবী আছে এবং তোমার ওপর তোমার অতিথিরও দাবী আছে……।” (বুখারী)
এ ব্যাপারে প্রখ্যাত সাহাবী সালমান ফারসী এবং তাঁর অন্তরঙ্গ আবু দারদার মধ্যেকার ঘটনাটিও প্রণিধানযোগ্য। রাসূলুল্লাহ (সা) সালমান ও আবু দারদার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন কায়েম করে দিয়েছিলেন। একদা সালমান আবু দারদার বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। দেখলেন আবু দারদার স্ত্রী উমআল দারদা জীর্ণবসন পরিহিতা। তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে উমআল দারদা বললেন আপনার ভাই দুনিয়াবী (সাজগোজে) আগ্রহী নন। ইতিমধ্যে আবু দারদা এলেন এবং সালমানের জন্যে খাবারের আয়োজন করলেন। সালমান তার সাথে আবু দারদাকে খেতে বললে তিনি বললেন, ‘আমি রোযা আছি’। তখন সালমান বললেন, ‘তুমি না খেলে আমিও খাব না।’ সুতরাং আবু দারদাও সালমানের সাথে খেলেন। রাতে আবু দারদা নামাযের জন্যে উঠলে সালমান তাকে ঘুমোতে যেতে বললেন। দারদা তাই করলেন। আবু দারদা পুনরায় শয্যাত্যাগ করলে সালমান আবার তাকে ঘুমোতে যেতে বললেন। শেষরাতে সালমান আবু দারদাকে উঠতে বললেন এবং উভয়ে নামায আদায় করলেন। পরে আবু দারদাকে সালমান বললেন, “তোমার ওপরে তোমার প্রভুর অধিকার আছে, তোমার ওপর তোমার আত্মার অধিকার আছে, তোমার ওপর তোমার পরিবারের অধিকার আছে, সুতরাং প্রত্যেককে তার ন্যায্য অধিকার দাও।” আবু দারদা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এ ঘটনা বিবৃত করলেন। তিনি বললেন: “সালমান সত্য কথাই বলেছে।” (বুখারী ও তিরমিযী)