তৃতীয় অধ্যায়
চরমপন্থার প্রতিকার
এখন আমরা চরমপন্থার প্রতিকার এবং তার উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো। প্রথমেই এ বিষয়টি বুঝে নেয়া দরকার যে, প্রতিকার চরমপন্থার কারণ থেকে অবিচ্ছিন্ন। এর কারণগোলো যেমন বিভিন্ন ও জটিল তেমনি এর প্রতিকারগুলোও। বলা বাহুল্য, কোনো যাদুস্পর্শে চরমপন্থার অবসান ঘটানো যাবে না কিংবা তাদেরকে মধ্যপন্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমাদের কাছে চরমপন্থা ও গোঁড়ামি-এর মনস্তাত্ত্বিক, সামজিক ও রাজনৈতিক দিকসহ একটি অদ্ভুত ধর্মীয় সমস্যা। সুতরাং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এর সবগুলো দিক বিবেচনা করতে হবে।
আমি তাদের সাথে একমত নই যারা কেবল সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থাকে এই অদ্ভুত সমস্যার কারণ বলে চিহ্নিত করে যুব সমাজের আচরণ ও পদক্ষেপগুলো উপেক্ষা করতে চান। আবার সমাজ, সরকার, সরকারী বিভাগ, বিশেষত শিক্ষা ও প্রচার মাধ্যমকে সকল দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে কেবর যুব সমাজকে দোষ দেয়া অন্যায়। দায়িত্বটা আসলে পারস্পরিক এবং প্রতিটি পক্ষের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “তোমরা সকলে তোমাদের সন্তান-সন্ততি ও অধীনস্থ ব্যক্তিদের অভিভাবক এবং দায়িত্বশীল।” (বুখারী)
আমরা এখন চরমপন্থা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে সমাজের পরিপূরক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবো। আমি আগেই বলেছি, বর্তমান যুগের অন্তর্গত পরস্পর বিরোধিতা ও অরাজক অবস্থা এবং ইসলাম থেকে মুসলমানদের বিচ্যুতি চরমপন্থা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। অতএব, এই সামজকেই এর প্রতিকারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে, ইসলামের প্রতি তাদের আন্তরিক, সুদৃঢ় ও সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার নবায়ন করা। এটা কেবল মৌখিক ঘোষণা, কিছু মনোহর শ্লোগান অথবা সংবিধানে ‘ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করে নয়, বরং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ঘনিষ্ঠ অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব।
আমরা জানি, ইসলাম এমন একটি সার্বিক জীবন বিধান যা মানুষের মধ্যে ঐশী বৈশিষ্ট্যকে বিকশিত করতে চায়। এ জন্যে ইসলাম জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনা ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষার লক্ষ্যে আদর্শিক কাঠামো, পথ-নির্দেশ ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছি। এর আওতায় থাকলে মানুষের এবাদত-বন্দেগী, মনমানস, আইন-বিধান এক সৌন্দর্যময় রূপ লাভ করে, এক সুবিচারপূর্ণ সমাজ গড়ে ওঠে। তাই প্রকৃত ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন করতে হবে। ইসরাঈলদের মতো খন্ডিতভাবে নয়। আল্লাহ তায়লা কুরআনুল করীমে বলেন:
“তাহলে তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করো এবং কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান করো? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে জিল্লতি আর কিয়ামতের দিনে তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে।” (২:৮৫)
সুতরাং ইসলামী চরিত্রের সমাজ কায়েম করতে হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তথা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে আল্লাহ্ র বিধান ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ প্রয়োগ করতে হবে। এটাই ঈমানের প্রকৃত দাবী। কুরআনের ঘোষণা:
“কিন্তু না, তোমার প্রভুর শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের ভার তোমার ওপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।”(২৪:৫১)
আমরা ইসলামকে ঐশী বিধান হিসেবে মানি। কিন্তু বাস্তব জীবনে শরীয়াহকে প্রয়োগ করি না। তার জায়গায় আমরা পূর্ব ও পশ্চিম থেকে ধার করা ব্যবস্থা চালু করেছি, তবুও আমরা মুসলমান বলে দাবী করি! সমাজ থেকে এই সুষ্পষ্ট পরস্পর বিরোধিতা অবশ্যই দূর করতে হবে।
সুতরাং আমেদের শাসকদের অনুধাবন করতে হবে যে, তারা মুসলিম ভূখন্ড শাসন করছেন এবং মুসলমানদের তাদের ধর্মীয় বিধান অনুসারে শাসিত হওয়ার অধিকার আছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, বুদ্ধিবুত্তিক, সাংস্কৃতিক, আন্তর্জাতিক তথা সকল ক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
সকল ও আন্তর্জাতিক নীতি এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রণয়ন করতে হবে। মুসলিম শাসকরা যদি এই ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হন তবে তা হবে চরম ইসলাম বিরোধিতার শামিল। বস্তুত এ বিষয়টির প্রতি মুসলিম শাসকদের উপেক্ষা ও ঔদাসীন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ প্রকাশ্যে ইসলামী আন্দোলনকারীদের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন। এই শাসকরা মসজিদকেও তাদের মতলব হাসিলের কাজে লাগান। কেউ এর বিরোধিতা করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। আবার কিছু কিছু শাসক মুসলমান বলে দাবী করেন এবং যা তাদের ধারণা নেহায়েত মনগড়া এবং শয়তানী খেয়ালখুশীর নামান্তর। যা তাদের মতলব হাসিলের অনুকূল তা গৃহণ করেন এবং তাদের পছন্দসই নয় তা নির্দ্বিধায় নাকচ করে দেন। তারা যা বিশ্বাস করেন তাকেই “সত্য” বলে ঘোষণা করেন এবং এর বিপরীত সবকিছু বাতিল। তারা কুরআন ও হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা অস্বীকার করে নিজেরাই এ সবের ব্যাখ্যাতা সাজেন। তারা কোনো বিজ্ঞ আলিম-ওলামার সাথে পরামর্শ করার ধার ধারেন না। তারা প্রত্যেক নিজেকে একেকজন ফকীহ, মুফাসসির, মুতাকাল্লিম ও দার্শনিক ভেবে বসেন।
এ ধরনের মুসলমান শাসক মনে করেন তাদের বিকল্প দ্বীতিয় ব্যক্তি নেই। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা) থেকেও কিছু শেখার প্রয়োজন অনিভব করেন না। কুরআন ব্যাখ্যার জন্যে তিনি নিজেকেই যথেষ্ট মনে করেন। অথচ আল্লাহ্ বলেন: “রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহ্র আনুগত্য করে।” (৪:৮০)
অবশ্য এসব শাসক ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী শরীয়াহ প্রয়েগের অনুমতি দেন। রেডিও-টেলিভিশনে ইসলাম সম্পর্কে আলোচনার কিঞ্চিত সুযোগ দিয়ে থাকেন আর সংবাদপত্রে শুক্রবারের জন্যে একটি কালাম বরাদ্দ করেন। এখানে অলোচ্য বিষয় হচ্ছে ধর্ম কেবল ব্যক্তি সত্তা ও স্রষ্টার সম্পর্কের মধ্যে সীমিত। সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এটাই হচ্ছে অধুনা মুসলিম শাসকদের বিশ্বাস অথাৎ আইন ছাড়া ঈমান, রাষ্ট্র ছাড়া দ্বীন, দাওয়াত ছাড়া ইবাদত এবং সত্যের আদেশ ও মিথ্যার নিষেধ ছাড়া জিহাদের ডাক। এখন কোনো নাগরিক যদি এদের বিরোধিতা কের ইসলামী জীবন বিধান চালুর ডাক দেয় তবে তার বিরুদ্ধে ধর্ম ও রাজনীতি সংমিশ্রণের অভিযোগ আনা হয়। মোটকথা, শাসকদের কর্যকলাপ আল্লাহ্, আল্লাহ্ র রাসূর ও তাঁর সাহাবীদের পথের বিপরীত। মুসলিম বিশ্ব এক চরম সন্ধিক্ষণে। অতএব, প্রকৃত ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে তা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া সমাজে স্থিতিশীলতা আসতে পারে না. পারে না জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে। উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বলেন, “আমরা নিকৃষ্টতম জাতি ছিলাম। কিন্তু ইসলাম দিয়ে আল্লাহ আমাদেরকে স্মানিত করেছেন। যদি আমরা ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য পন্থায় মর্যাদা হাসিল করতে চাই তবে আল্লাহ্ আমাদের গোড়া কেটে দেবেন।” সুতরাং শারীয়াহ প্রয়োগ না করা পর্যন্ত আমাদের সমাজে চরমপন্থার বিস্তার ঘটবেই।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে, তরুণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আইভরি টাওয়ার থেকে তাদের উদ্দেশ্যে মুরব্বীসুলভ ভাষণ দিলে চলবে না। তাদের মনমানসিকতা ও বাস্তবতা উপলব্ধি করে কথা বলতে হয়। নইলে তারা কথা শুনতেই অস্বীকার করবে। তাদের শুধু দোষ দিয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, তাদের গুণগুলো উপেক্ষা করে দোষগুলোই প্রচার করা হয়।
তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে আরেকটি প্রবণতা রয়েছে। একটা গোষ্ঠীর কেউ একজন দোষ করলে তা সাধারণভাবে সকলের ওপর চাপানো হয়। তরুণদের বেলায় এটি আরো বেশী প্রযোজ্য। একজন তরুণ করলো কী করলো না, অমনি তা সকল তরুণদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। তাছাড়া ঘটনা ভাল করে না জেনে হুট করে রায় দেয়ারও প্রবণতা আমাদের রয়েছে। ভাল করে না জেনে না শুনে সংখ্যালঘৃর দোষ সংখ্যাগুরুর ওপর চাপিয়ে দেয়া ন্যায় বিচার নয়। এজন্যে মুসলিম ফকীহরা রায় দিয়েছেন, সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে যে রায় দেয়া হয় তা সার্বিকভাবে প্রযোজ্য, কিন্তু এর বিপরীতটা নয় অর্থাৎ মুষ্টিময়ের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায় সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে প্রযোজ্য হতে পারে না। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজনের সামগ্রিক কর্মকান্ডের বিচার হতে পারে না। তার সামগ্রিক আচরণের মূল্যায়ন করেই তার সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। কারণ কুরআন বলছে: “যার (সৎকর্মের) পাল্লা ভারী, সেই মুক্তি পাবে।” (২৩:১০২)
চতুর্থ, নিছক ব্যক্তিগত বিশ্বাস দিয়ে তরুণদের বিচার করা ঠিক নয়। তাদেরকে অনেক মানসিক রোগজনিত খামখেয়ালি বলে ভাবেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা সত্য হতে পারে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে সন্দেহাতীত। আসলেই তাদের ঈমান ও আচরণে কোনো দ্বৈততা নেই। আমি অনেক মুসলিম দেশের অনেক তরুণের কথা জানি, তারা ঈমানী জযবায় সুদৃঢ় এবং আমলে-আচরণে সত্যনিষ্ঠ। সত্যের প্রতি তাদের নিষ্ঠা ও মিথ্যার প্রতি তাদের র্ঘণাকে আমি প্রশংসাকরি। তারা সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ ও শারীয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্যে কঠোর জিহাদে নিমগ্ন। এই তরুণদের সাথে মেলামেশা করে আমার স্থির বিশ্বাস জম্মেছে যে, আমাদের পোচলিত ইসলামী ধ্যান-ধারণার সাথে তাদের চিন্তাধারার মৌলিক পার্থক্য আছে। তারা এক নতুন উদ্দীপ্ত ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ যে ইসলাম আমাদের মতো জরাজীর্ণ নয়; তাদের ঈমান সতেজ, আমাদেরটা ঠন্ডা; তাদের সাধুতা সুদৃঢ়, আমাদেরটা করুণ। তাদের হৃদয়ে আল্লাহ্ র ভয় সদাজাগ্রত- তাদের হৃদয় কুরআনের তিলাওয়াতে সদা স্পন্দিত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সারা রাত ইবাদতে মগ্ন থাকে, দিনে রোযা রাখে, প্রত্যুষে আল্লহ্ র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এসব দেখে আমার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মেছে যে, ইনশাআল্লাহ্ ইসলাম আবার স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। এ জন্যেই আমি মিসরে বিভিন্ন উপলক্ষে ঘোষনা করেছি, এই তরুণ গোষ্টীই মিসরের প্রকৃত আশার আলো। যে কোনো বৈষয়িক সম্পদের চেয়ে এরা অধিক মূল্যবান।
তাই আমি বিশ্বাস করি, চরমপন্থার প্রতিকার অন্বেষণে আমাদের কথাবার্তায় আচরণে বারসাম্য, সুবিবেচনা ও উদারতা থাকতে হবে। এলোপাথাড়ি অতশয়োক্তি এই অদ্ভুত সমাধানের সহায়ক হবে না, করং এই প্রকণদা ত্রাস সৃষ্টি করে। সবচেয়ে বড় কথা, সত্য ও প্রকৃত ঘটনাকে বিকৃত, বিচারের মানদন্ডকে দোদুল্যমান এবং সুস্থ চিন্তাকে দূষিত করে। ফলত কনো, তা অন্যায় কিংবা অন্তত অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য।
তাথাকথিত “ধর্মীয় চরমপন্থা” এবং সরকার ও তরুণদের মধ্যে সংঘাতের ফলে উদ্ভুত সংকট মুকাবিলার প্রক্ষিতে যা কিছু বলা বা লেখা হচ্ছে তা বাড়াবাড়ি ও অতিশয়োক্তি মুক্ত নয়। তরুণদের বিরুদ্ধে অনেক মানুষ অসদুদ্দেশ্য-প্রণোদিত মনোভাব পোষন করে। ঐসব বক্তব্যে এর প্রভাব লক্ষণীয়। এই প্রসঙ্গ নিয়ে একজন সমাজবিজ্ঞানী ড. সাদ আল দ্বীন ইবরাহীম ‘আল-আহরাম’ পত্রিকায় লিখেছেন: যারা এই প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন তারা আসল সত্যের ধারে কাছেও নেই। তাদের যুক্তির কোনো সুনিদৃষ্ট ভিত্তিও নেই। তাদের বক্তব্যে অজ্ঞতা ও চরম অবিবেচনাপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকট। প্রকৃতপক্ষে এই সমস্যার প্রশ্নে এদের নিশ্চুপ থাকাই শ্রয় ছিলো, নতুবা বাস্তব দৃষ্টিকোন থেকে সমস্যার বিশ্লেষণ করা উচিত ছিলো। কিন্তু এই গুণ বৈশিষ্ট্য তো এদের মধ্যে নেই। এ ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ধর্মীয় ব্যাপারে এসব লোকের মুক্তকচ্ছ, শিথিল ও ঔদাসীন্যের চরমপন্থী মনোভাবই ধর্মীয চরমপন্থা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। মোটকথা, এক শ্রেনির লোকের চরম বিরাগ আরেক শ্রণিকে চরম অনুরাগী করেছে। যদা কোনো বিজ্ঞ প্রচেষ্টা উভয়পক্ষের মতভেদ দূর করে তাদেরকে একত্র করতে ব্যর্ত হয় তাহলে এটাই প্রমানিত হয় যে, সমাজে ভারসাম্য সৃষ্টর জন্যে এক চরমপন্থা নির্মূলে আরেক চরমপন্থারই প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে একটি ধারণা পাওয়া যায়:
“যদি আল্লাহ্ তায়ালা একটি জনগোষ্টী দিয়ে আরেকটি জনগোষ্টিকে প্রতিহত না করতেন তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেতো; কিন্তু আল্লাহ্ জগতসমূহের প্রতি অনুগ্রহশীল।” (২: ২৫১)
সুতরাং তরুণ মুসলমানদের প্রতি অভিযোগ অযৌক্তিক, যখন প্রতিপক্ষ চরমপন্থীরা ধর্ম ও নৈতিকতা বিগর্হিত জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। যেসব তরুণ ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী তাদের জীবন গড়ে তুলতে প্রয়াসী তাদেরকে হেয় করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ অযৌক্তক ও অন্যায়। যেসব তরুণ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছে, রোযা রাখছে, দাড়ি রাখছে, গিরার উপর কাপড় পরছে, হালাল হারাম বিবেচনা করছে, ধুমপান থেকে বিরত থাকছে তাদেরকে দোষ দেয়ার বা নিন্দা করার কী যুক্তি থাকতে পারে। অথচ আমরা নীরবে চোখের সামনে দেখি একদল লোক জীবনকে উপভোগ করে চলেছে নির্বিচারে। নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে পাশ্চাত্যের এই মানসপুত্ররা সম্পূর্ণ উচ্ছন্নে গেছে। অতএব ধর্মীয় “চরমপন্থার” বিরুদ্ধে “গেলো গেলো রব” তোলা আর “ধর্মহীন চরমপন্থা” র পক্ষে চোখ কান বুজে থাকা যুক্তির কোন্ মানদন্ডে সঙ্গত? মেয়েরা পর্দা করে চলাফেরা করলে উপহাসের পাত্রী হতে হয়; কিন্তু যখন আরেক দল মেয়ে রাস্তাঘাচে, সৈকতে, থিয়েটারে, সিনেমায় প্রায় উলঙ্গভাবে নিজেকে প্রদর্শন করে তখন তাকে “সংবিধানসম্মত ব্যক্তি স্বাধীনতা” ভোগ বলে পার পাওয়া কী উচিত? তাহলে কী ধরে নিতে হবে, সংবিধানে নগ্নতা ও বেহায়াপনার জন্যে ব্যক্তি স্বাধীনতার অনুমতি দেয়া হয়েছে, আর সতীত্ব ও শালীনতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে? সমাজ যদি অনৈতিক ও ধর্মহীন তৎপরতা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতো তাহলে আমাদের দেশে ধর্মীয় চরমপন্থা’র উদ্ভব হতো না, যদিও কোনো না কোনো কারণে চরমপন্থা বিরাজ করতে তাহলে এর প্রবাব হতো নগণ্য। আমাদের এটা স্বীকার করতে হবে ‘চরমপন্থা’ একটি বিশ্বজনীন ঘটনা; কিন্তু মজার ব্যাপার বিভিন্ন দেশে আন্যান্য চরমপন্থী গ্রুপ বা সংগঠন থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে এ রকম চরম পদক্ষেপ নেয়া হয় না। কিন্তু যত দোষ কেবল মুসলমানদের বেলায়। তারা চরমপন্থী হলে তাদের বিরুদ্ধে নানা অজুহাতে চরম নির্যাতনের পথ বেছে নেয়া হয়। ইসরাঈলের চরমপন্থী ইহুদীরা মনে করে ঐ ভূমিতে তাদের ঈশী অধিকার রয়েছে এবং এই লক্ষ্যে তারা সকল রকম হিংস্র তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ খোদ ইসরাঈলের সৃষ্টিটাই অবৈধ এবং সন্ত্রাসী কাজ। লেবাননে খ্রীস্টান ফালাজির চরম সহিংস পন্থায় মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মুসলমানদের যবাই করছে, তাদের লাশ ক্ষতবিক্ষত করছে, গুপ্ত অঙ্গ কেটে তাদেরই মুখে পুরে দিচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মীয় বইপুস্তক পুড়িয়ে ফেলছে। খ্রীস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থে বলা হয়েছে, “তোমার শত্রুকে ভালবাসো, তোমাকে যারা ঘৃণাকরে তাদের ভাল করো, কেউ তোমার ডান গালে চড় মারলে বাম গালও পেতে দাও।” (লুক ৬ : ২৭-২৯)।
এছাড়া আমরা অন্যান্য দেশ, যেমন সাইপ্রাস, ফিলিপাইন ও হিন্দুস্থানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্তাসী তৎপরতা দেখতে পাই। মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক খ্রীস্টানী সন্ত্রাস শুরু হয়েছে যাকে বলা যায় নতুন ক্রুসেড। প্রতি বছর হিন্দু চরমপন্থীরা মুসলমানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। পরিহাসের বিষয়, হিন্দুরা প্রাণী হত্যাকে নির্দয় নিষ্ঠুর কাজ বলে মনে করে। এ জন্যে তাদের ধর্মে গরু যবাই নিষিদ্ধ। কিন্তু এরাই আবার ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যা করে চলেছে বেধড়ক! একই কারণে তারা আবাদী জমিতে নাকি কীটনাশক ব্যবহার করে না। লাখ লাখ একর জমির ফসল তাই ইঁদুরের পেটে চলে যায়। তাদের দৃষ্টিতে এসব প্রাণীরও আত্মা আছে, তাই তাদের আঘাত করা যাবে না। তাদের দৃষ্টিতে বোধ হয় একমাত্র মুসলমান নামক প্রাণীরই আত্মা নেই!
একথাও আমাদের স্বীকার করতে হবে, বস্তুবাদ মানুষের চিন্তাও আচরণকে বিকৃত করে ছেলেছে। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের চরম উন্নতি হয়েছে, মানুষ চাঁদেও গেছে, গ্রহান্তরে আধিপত্য বিস্তার করছে। কিন্তু এসব বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি আত্মার উন্নতি হয়নি। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের চরম উন্নতি হয়েছে, মানুষ চাঁদেও গেছে, গ্রহান্তরে আধিপত্য বিস্তার করছে। কিন্তু এসব বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি আত্মার উন্নতি হয়নি। ফলে মানুষ আজ মনের সুখ পাচ্ছে না। এক সমায় তারা মনে করেছিলো বস্তুগত আরাম-আয়েশ লাভ করতে পারলে মনের শান্তিও পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের সে আশার গুড়ে বালি! তাদের মধ্যে চরম নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। হিপ্পি জাতীয় নানা গ্রুপ নিত্য নতুন গজাচ্ছে তাদের কাছে আধুনিক সভ্যতা অর্থহীন হয়ে পড়েছে, তারা এখন প্রকৃতিতে ফিরে যেতে চায়। তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে : আমি কে? আমার লক্ষ্য কি? আমি কোথা থেকে এসেছি? এখন থেকে আমাকে কোথায় যেতে হবে? কিন্তু পাশ্চাত্যের কাছে এসব প্রশ্নের জবাব নেই। এমনি নৈরাজ্যের প্রতিধ্বনি আমাদের দেশেও শোনা যায় এই প্রশ্নের জবাব নেই। এই প্রশ্নের জবাব পেতে গিয়ে কেউ চরম বিধর্মি হয়ে গেছে, আবার কেউবা সত্য পথের সন্ধান পেয়ে ইসলামের সুশীতল চায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সুখের বিষয়, বহু মুসলিম তরুণ সকল প্রশ্নের সছিক উত্তর ইসলামের মধৈই খুঁজে পেয়ে নিজেদের জীবনকে ইকামতে দ্বীনের জন্যে কুরবানী করতে প্রস্তুত।
আজকের বিশ্বে চারদিকে হিংসা আর বিদ্রোহের বহ্নি। এর মাঝে শান্তি, নমনীয়তা ও ভারসাম্য প্রত্যাশা করা অসঙ্গত। উৎসাহী তরুণদের কাছ থেকে মিরব্বীদের মতো প্রজ্ঞা ও পরিণত চিন্তা আশা করা যুক্তিসঙ্গত নয়। মানুষ প্রাথমিকভাবে পরিবেশেই সৃষ্টি। গুপ্ত পুলিশকে কঠোর ব্যবস্থা, নির্যাতন ও গুপ্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনতা, সমালোচনা ও পারস্পরিক পরামর্শের অধিকার দিয়ে সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগী হতে হবে। হযরত উমর (রা)-এর একটি কথায় আমরা এর নযীর পাই: “আল্লাহ্ তাদের রহম করুন যারা আমার ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দেয়।” তাই তিনি তাকে পরামর্শ দানে ও তার সমালোচনা করতে সকলকে উৎসাহ দিতেন। একদিন এক ব্যাক্তি হযরত উমর (রা) কে বলেন, “হে খলীফা, আল্লাহ্ কে ভয় করুন!” উমর (রা)-এর সঙ্গীরা ত্রুদ্ধ হলেন। কিন্তু হযরত ওমর (রঅ) লোকটিকে নির্দ্বিধায় বলতে দিলেন এবং তাঁর সঙ্গীদেরকে বললেন, “তোমরা যদি (এই লোকটির মতো) কথা না বলো তাহলে তাতে কল্যাণ নেই এবং আমাদের (শাসকদের) মধ্যেও কোনো কল্যাণ নেই যদি আমরা তোমাদের (পরামর্শ ও সমালৌচনা) না শুনি।” আরেকবার উমর (রা) শ্রোতাদের উদ্দেশ্য বললেন, “তোমাদের মধ্যে বিচ্যুতি দেখে তাহলে আমকে সঠিক পথে আনার দায়িত্ব তারই।” এ কথা শুনে একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আল্লাহর শপথ, আপনার মধ্যে আমরা যদি আমার মধ্যে বিচ্যুতি দেখি তাহলে এই তোলয়ার দিয়ে আপনাকে ঠিক করব। (অথাৎ বল প্রয়োগ)।” উমর (রা) রাগ না খুশী হয়ে বললেন: “আলহ্মদুলিল্লাহ, মুসলমানরা তলোয়ার দিয়ে উমরকে ঠিক পথে আনার জন্যে তৈরি আছে।” বস্তুত স্বাধীন পরিবেশ থাকলে নানা মতের উদ্ভব ঘটে এবং সেগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষসহ বিচক্ষণ ব্যাক্তিরা আলাপ-আলোচনা করে ভালটা গ্রহণ ও মন্দটা বর্জন করতে পারেন। ফলে অপ্রীতিকর মতভেদের আশাঙ্কাও তিরোহিত হয়।
অন্যথায় চরমপন্থী ভাবধারা গোপনে সুপ্ত বীজের মতো বাড়তে বাড়তে মহীরুহে পরিণত হয়। অবশেষে একদিন সহিংস তৎপরতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে সকলকে হতবাক করে দেয়। মন ও মেধা চরমপন্থী চিন্তাধারার উৎস। এর মুকাবিলায়ও মন ও মেধা প্রয়োজন। শক্তি প্রয়োগ করে এর মুকবিলা করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়। সতর্কতা, ধৈর্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল অবলম্বন করেই চরমপন্থী মনোভাব পাল্ঠাতে হবে। কিন্তু সাময়িক অভ্যুথ্থানের নেতৃবৃন্দ এখানেই ভুল করে বসেন। তারা তাদের গুপ্ত পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে তাদের প্রতিপক্ষের ওপর নিষ্ঠুর কায়দায় নির্যাতন চালান। এতে তারা সাময়িক সাফল্য অর্জন করেন বটে, কিন্তু চরমপন্থা দমনে শেষতক চরমভাবে ব্যর্থ হন। কেননা একটা চরমপন্থা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
অতএব, এই পর্যায়ে আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে বুদ্ধিদীপ্ত ফিকাহর ভিত্তিতে যুক্তিগ্রাহ ইসলামী জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। এই ফিকহ শুধু ছোটখাট বিষয় নয়, বরং অপরিহার্য দিকগুলোর প্রতি মনোযোগ দেবে এবং খন্ড ও অখন্ড, শাখা ও মূল, মূর্ত ও বিমূর্ত বিষয়গুলোর যথার্থ রূপভেদ ব্যাখ্যা করবে। এ ধরনের ফিকহর বিকাশ সহজ কাজ নয়। মানুষের ধ্যান-ধরণায় পরিবতর্ন তথা কোন্টি সঠিক, কোন্টি ভুলতা বিচারের মানসিকতা গড়ে তোলার জন্যে আন্তরিক প্রয়াস, পচন্ড ধৈর্য এবং আল্লাহ্ তায়ালার সাহায্য দরকার।
ক্ষমতাসীনরা মনে করে, রেডিও-টিভিকে কাজে লাগিয়ে তাদের ইচ্ছা মাফিক গণমানস পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু মানুষ এ ধরনের সরকারী প্রচার কৌশলে আস্থা আনতে পারে না। বিভিন্ন দেশের সরকার কিছু ওলামা ও বাগ্মীকে এই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন, বিশেষ করে বন্দীদের চিন্তাধারা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সকল প্রচেষ্টা নিদুরুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। একমাত্র সরকারী প্রভাবমুক্ত হাক্কানী আলিমরাই এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন। এসব মুক্ত হাক্কানী আলিম তাদের জ্ঞানের মৌলিকতা ও গভীরতার জন্যে যুব সামাজ তথা সাধারণ মানুষের আস্থা ও শ্যদ্ধাভাজন। কিন্তু এ জন্যে সন্ত্রাসমুক্ত স্বাভাবিক পরিবেশ দরকার। মুক্ত ও গঠনমূলক আলোচনা, পারস্পরিক যোগাযোগ ও ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমেই সঠিক চিন্তার বিকাশ ঘটা সম্ভব। আদেশ-নিষেধ জারি করে রাতারাতি মনের রূপান্তর সম্বব নয়।
এ প্রসঙ্গে আমি যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে চাই তা হচ্ছে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাসকে আরেকটি বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাস দিয়ে মুকাবিলার বিপদ অথাৎ একগুয়েমির সাথে একগুয়েমি, গোঁড়ামির সাথে গোঁড়ামি এবং অপকর্মের সাথে অপকর্মের মুকাবিলা। উদাহরণস্বরূপ পরস্পরের বিরূদ্ধে কুফরীর অভিযোগের কথা উল্লেখ করা যায়। এর সপক্ষে একটি হাদীসের কথা বলা হয়, “যে ব্যক্তি একজন মুসলমানকে কাফির বলে সে নিজেই কুযফরী করে।” কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যার ভুল, সন্দেহ বা ভূল সিদ্ধান্তের জন্যে একজন মুসলমানকে উক্ত হাদীসের আলোকে কাফির বলে অভিযুক্ত করা যায় না। হাদীস ও সাহাবীদের জীবন থেকে আমরা এর প্রমাণ পেতে পারি। হযরত আলী (রা) খারিজীদের কেবল নিন্দাই করেছেন কিন্তু কাফির বলেননি। খারিজীরা তাকে কাফির বলে ফতোয়া দিয়েছিল। তিনি তাদের নিয়তকে ভাল মনে করে তাদেরকে ইসলামের আওতার মধ্যেই রেখেছিলেন। তাই তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল খারিজীরা কাফির কিনা তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, তারা কুফরঅ থেকে বেঁচে গেছে, তারা অথীতে আমাদের ভাই ছিল, আজ তারা ভূল করেছে। এর অর্থ আলখাওয়ারিজকে কাফির বা মুরতানিন না বলে বাগী বলে গণ্য করা যায়। এই ক্ষত্রে বুগাতের তাৎপর্য দাঁড়ায় ভুল ব্যাখ্যা ভিত্তিতে যে ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণ মুসলিম ইমামের আনুগত্য করে না। এ ধরনের বাগীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ করা সমীচীন নয়, বরং সকল পন্থায় তাদেরকে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যদি তারা বিপর্যস্ত হয় তাহলে তাদের সাথে কর্কশ আচরণ-নির্যাতন করাও উচিত হবে না। কেননা তাদেরকে নির্মূল করা নয়, বরং ইসলামের আওতায় ফিরিয়ে আনাই সকল প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য। অতএব তাদেরকে মুসলমান হিসেবেই গণ্য করতে হবে।
হযরত আলী (রা)-এর আমলে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও ছিল নজিরবিহীন, সে অবস্থায় পৌঁছতে অনান্য দেশকে আরো বহু শত্বাদী অপেক্ষা করতে হয়েছেল। আলখাওয়ারিজ হযরত আলী (রা)-এর আপোস মীমাংসা নাবচ করেছিল এই দাবীতে যে, ‘সিদ্ধান্ত কেবল আল্লাহ্রই’। আলী (রা) তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, “বাতিলের স্বার্থে এটা সত্যের বিকৃতি।”তাদের চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও আলী (রা) বলিষ্ঠ ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন: “আমরা তোমাদেরকে মসজিদে নামায আদায়ে বাধা দেব না, গনমতের মাল থেকে বঞ্চিত করব না, তোমরা যুদ্ধ শুরু না করলে আমরা করব না।”আলী (রা) এমনিভাবে খারিজীদের অথাৎ বিরোধী দলকে সকল অধিকার দিয়েছিলেন অথচ তিনি জানতেন তারা পূর্ণরূপে প্রশিক্ষিত সশস্ত্র সৈন্য, যে কোনো মুহূর্তে অস্ত্র ধারণে সক্ষম।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। আলখাওয়ারিজকে (খারিজীদের) কাফির বলে চিহ্নিত না করা সম্পর্কে আলিমদেরও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল, যদিও প্রামাণিক হাদীসে এরূপ লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ও তদেরকে হত্যা করার অনুমতি রয়েছে। এমাম শাওকানী ‘নায়লুল আওতারে’ লিখেছেন, অধিকাংশ সুন্নী ফকীহ মনে করেন, কালিমা পাঠ ও ইসলামের মূল আহকাম মেনে চলায় খারিজীরা মুসলমান। তারা অন্য মুসলমানকে কাফির বলে অভিহিত করে, তারা নিজেরাই নিজেদের ভুল ব্যাখ্যার ফাঁদে পড়ে। তাদের পাপ ঐ ভুলেরই পরিণতি। আল-খিতাবী বলেন যে, যতোক্ষণ তারা ইসলামের মূলনীতিগুলো মেনে চলে ততোক্ষণ তাদের কাফির বলা ডাবে না। তাদের সাথে আন্তঃবিবাহ, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি করা যেতে পারে বলে আলিমরা একমত হয়েছেন।
ইয়াদ বলেন, মুতাকাল্লিমুনদের জন্যে একটি এটি অত্যন্ত জটিল বিষয় ছিল। ফকীহ আবদুল হক এমাম আবু মা’লীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি একজন কাফিরকে এসলামের মধ্যে অথবা একজন মুসলমানকে এর আওতা থেকে বহিষ্কার করার মতো জটিল ধর্মীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অস্বীকার করেন। কাজী আবু বকর আল-বাকিল্লানীও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন বলে তিনি জানান। তবে তিনি বলেন, আল-খাওয়ারিজ প্রকাশ্য কুফরী করেনি কিন্তু কুফরীর মতো কথাবার্তা বলেছে। আল-গাযালী (র) তার আত-তাফরিকাহ বাইনাল ইমাম ওয়াল জান্দাকাহ গ্রন্থে লিখেছেন, “কাউকে কাফির চিহ্নিত করার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। একজন মুসলমানের রক্তপাতের চেয়ে এক হাজার কাফিরের জীবন বাঁচানো অপেক্ষাকৃত কত মারাত্মক ভুল।”
ইবনে বাত্তাল (র) বলেছেন, অধিকাংশ আলিম আল-খাওয়ারিজকে ইসলামের আওতার বাইরে রাখেননি। নাওরাওয়ানের খারিজীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে আলী (রা) বলেছেন যে, তারা কুফরী এড়িয়ে গেছে। বাত্তাল তাদেরকে বুগাত বলে বিবেচনা করা যায় বলে মত প্রকাশ করেন। আলিমরা এ ব্যাপারে একমত যে, তাকফীর (কাউকে কাফির বলে চিহ্নিত করা) এমন একটি মারাত্মক বিষয় যা মারাত্মক পরিণাম ডেকে আনতে পারে।মুসলিম মনীষীরা মূল প্রামাণিক সূত্র থেকে বিভিন্ন বিষয় সিদ্ধান্তে নেয়ার নির্দিষ্ট নীতি ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এ থেকে উসুল আল-ফিকাহ বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিজ্ঞানের এই অতুলনীয় শাখা ইসলামের প্রামাণিক সূত্র থেকে আইন প্রণয়নের পদ্ধতিগত ভিত্তি নির্মাণ করেছে। এ জন্যে মুসলমানরা গর্ববোধ করতে পারে। এছাড়া উসুল থেকে কোনো নীতি সূত্র পাওয়া না গেলে উসুল আত-তাফসীর ও উসুল আল-হাদীসে তার সন্ধান পাওয়া যেতেপারে। শারীয়াহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্য ঈমান, হাদীসের ব্যাখ্যা ও আইন সংক্রান্ত অসংখ্য বই পুস্তকের সাহায্যও নেয়া যেতে পারে।
অতএব জ্ঞানের এসব সূত্রের বিদ্যমানতায় কুরআনের আয়াত ও হাদীসের মর্ম গভীরভাবে উপলদ্ধি করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধে থাকতে পারে না। অগভীর ভাসাভাসা জ্ঞানের কোনো অবকাশ নেই। এই লক্ষ্যে নিম্মোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে:
প্রথম: ইসলামের সার্বিক সত্যের প্রেক্ষিতে সকল বিশেষ বিশেষ দিক বিবেচনা ব্যতিরেকে শারীয়াহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি পরিপক্ক হতে পারে না। কুরআনের একটি আয়াত অথবা একটি হাদীস অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে অন্য আরেকটি হাদীস হাদীস, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ, সাহাবীদের জীবন ও উসূল আত-তাফরীরে আলোকে। এছাড়া সার্বিক প্রেক্ষাপট ও শারীয়াহর উদ্দেশ্যকেও সামনে রাখতে হবে। অন্যথায় উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভ্রান্তির ফলে শরীয়তে পরস্পর বিরোধীতার আপদ দেখা দেবে। এ কারণে ইমাম আশ-শাতিবি (র) ইজতিহাদের ক্ষেত্রে দু’টি শর্ত আরোপ করেছেন: (ক) সামগ্রিক চৈতন্যে শরীয়ত অনুধাবন ও (খ) সেই উপলব্ধির আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। এই শর্ত পূরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে কুরআনের ও হাদীসের গভীর জ্ঞান এবং সেই সাথে কারণ, ঘটনাবলী, পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং প্রতিটি আয়াত ও হাদীসের উদ্দেশ্যে সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে হবে। এছাড়া চিরন্তন অপরিবর্তনীয় এবং সাময়িক চাহিদা পূরণ, প্রচলিত প্রথা ও ঐতিহ্য, বিশেষ বিশেষ সময়ের ঘটনাবলী এবং পরিবর্তিত অবস্থায় এসবের পরিবর্তন ইত্যাদির রূপভেদ নির্ণয়ের ক্ষমতা থাকতে হবে।
একদিন আমি মহিলাদের ইসলামী পোশাক সম্পর্কে বক্তৃতা করছিলাম। একজন শ্রোতা বললেন, কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী হিযাবের সাথে একটি অতিরিক্ত বহিরাবরণ থাকতে হবে। আমি জবাব দিলাম, হিযাব নিজেই একটি উদ্দেশ্য নয়, বরং শরীরের শরীয়ত নিষিদ্ধ অংশগুলো শালীনভাবে আবৃত করার উপায় মাত্র এই সময় ও স্থানভেদে এর ধরন বিভিন্ন রকম হতে পারে। কিন্তু লোকটি অগ্নিশর্মা হয়ে চিৎকার করে বলল, কুরআন শরীফে পোশাক সুস্পষ্টত নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এটা পরিবর্তনের অধিকার আমাদের নেই বলে সে কুরআনের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলো:
“হে নবী! আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও ঈমানদারদের নারীদের বলুন, যেন তারা তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে; ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৩৩:৫৯)
আমি বললাম, কুরআনুল করীমে কখনো কখনো ওহী নাযিলের সমসাময়িক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে উপায় ও পদ্ধতি বাতলে দেয়া হয়েছে। এর চেয়ে উত্তম বা অনুরূপ অন্য কোনো উপায় উদ্ভাবিত হলে ঐটাই স্থায়ীভাবে মানতে হবে এমন ধরা বাঁধা তাৎপর্য ঐ আয়াতে নিহিত নেই। এর পক্ষে নিম্মোক্ত উদাহরণটিই যথেষ্ট: কুরআনুল করীম বলছে: “তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে। এতদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদেরকে, যাদেরকে তোমরা জান না, আল।রাহ জানেন।” (৮:৬০)
এই আয়াত নাযিলের সময় ঘোড়া ছিল যুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাহলে এখন কি মুসলমানরা ট্যাংক, জঙ্গী বিমান, বোমা ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারবে না? এটা যদি ঠিক না হয় তাহলে এই আলোকে মুসলিম মহিলারাও শ্লীলতার উদ্দেশ্য সামনে রেখে যে কোনো বহিরাবরণ ব্যবহার করতে পারে।
আল-হাদীসকেও একইভাবে মূল্যায়ন করা যায়। আল-হাদীস ও শিক্ষায় জীবনের নানা ক্ষেত্রের প্রণালী-প্রক্রিয়া বিধৃত হয়েছে যার কতকাংশ আইন এবং অনেকাংশ আইন নয়; কিছু সাধারণ, কিছু নির্দিষ্ট, কিছু অপরিবর্তনীয়, কিছু পরিবতর্নীয়।পানাহার, পোশাক ইত্যাদি ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন আছে। আবার নির্দিষ্ট আইন নয় এমন সুন্নাহ ও রীতি-প্রথাও রয়েছে। যেমন- চামচের পরিবর্তে হাত দিয়ে খাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সময়ে হাত দিয়ে খাওয়া আরবদের সাধারণ জীবনযাত্রার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। এর অর্থ এই নয় যে, চামচ ব্যবহার হারাম। কিন্তু সোনা- রূপোর তৈজসপত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একইভাবে ডান হাত ব্যবহারের অভিন্ন প্রথা প্রবর্তন এর উদ্দেশ্য। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “বিসমিল্লাহ বলো (খাওয়ার আগে) এবং ডান হাত দিয়ে খাও।” (অনুমোদিত হাদীস) আরেকটি হাদীসে তিনি বলেন, “তোমাদের বাম হাতে পানাহার করা উচিত নয়। কারণ শয়তান বাম হাতে পানাহার করে।” (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সময় চালুনি সম্পর্কে কোনো ধারনা ছিল না। তাই বলে এটার ব্যবহার এখন বিদআত হতে পারে না।
অনেক তরূণ খাট ইজার বা ছওব পরিধানকে ইসলামের মৌলিক বিষয় মনে করে। তাদের প্রথম যুক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবারা এটা পরিধান করেছিলেন। দ্বিতীয়ত হাদীসে গোড়ালির নিচে পর্যন্ত ইজার বা ছওব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাদীসটি হচ্ছে: “গোড়ালির নিচে ইজার পরিধানকারী ব্যাক্তি দোযখে যাবে।” (বুখারী)
প্রথম যুক্তিটির ব্যাপারে বলা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি তাতে দেখা যায় তিনি যখন যেমন পেয়েছেন তেমনিই পরেছেন। তাকে কোর্তা, ঢিলে জামা এবং এজারও পরতে দেখা গেছে। তিনি এয়েমেন ও পারস্য থেকে প্রাপ্ত (কিনারে সিল্কের নক্শা করা) কাপড়ও পরেছেন। পাগড়ি ছাড়া বা পাগড়[ইসহ টুপিও পরেছেন।
ইমাম ইবনূল কাইয়েম (র) তাঁর আল-হাদী আন-নববী বইয়ে লিখেছেন: পোশাক সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সর্বোত্তম রীতি তাই যা তিনি নিজে ব্যবহার করেছেন, করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং উৎসাহিত করেছেন।-তিনি উয়েমেনের পোশাক, সবুজ কাপড় চোপড়, জুব্বাহ, ফুলহাতা জামা এবং জুতা-স্যান্ডেলও পরেছেন। তিনি কখনো কখনো বাবরিও রেখেছেন।
তখন বস্ত্রকল অজ্ঞাত ছিল। ইয়েমেন, মিসর ও সিরিয়া থেকে কাপড় আমদানী করা হতো। এখন আমরা বিভিন্ন ধরনের অর্ন্তবাস ব্যবহার করি। তখন তা ছিল না। অতএব এসব নিয়ে অহেতুক শোরগোল কেন?
দ্বিতীয়: কুফফারের অনুকরণ সংক্রান্ত যুক্তি প্রশ্ন বলা যায়, আমাদেরকে আসলে কুফফারদের (অন্য ধর্মের অনুসারীদের) বৈশিষ্ট্য অনুসরণে নিষেধ করা হয়েছে; যেমন-ক্রস, ধর্মীয় পরিচ্ছদ, দর্মীয় আচার-সিরাত আল-মুসতাকিম মুখলিফাত আহলিল জাহীম” পুস্তকে এগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এখন একজন মুসলমান যদি ইচ্ছাকৃত কুফফারকে অনুসরণ করে তবে তা দোষনীয়। কিন্তু কেউ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রয়োজনের তাকিদে করে তবে তা দোষনীয়। যেমন কোনো ফ্যক্টরী শ্রমিক বা ইঞ্জিনিয়ার কাজের সুবিধার্থে “ওভারঅল” পরলে দৌষের যথাসম্ভব নিজেস্ব বৈশিষ।ট্য ফুটিয়ে তোলা উচিত। সারকথা, খাটো ছওব পরা বাঞ্ছনীয়, কিন্তু ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক না হলে লম্বা কাপড় পরা নিষিদ্ধ নয়।
উপরের উদাহরণগুলো নির্ভেজাল ব্যাক্তিগত ব্যাপার। অথচ আমরা বৃহত্তর জাতীয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জটিল বিষয়গোলো নিয়ে এতো মাথা ঘামাই না যদিও তা গোটা উম্মাকে হুমকির মুখে ঠেলে দৈয়া এসব সমস্যা সমাধানে বরং আমাদেরকে ইসলামী আইনের গভিরে প্রবেশ করা উচিত।
আমাদের এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এখন আমরা এক জটিলতম জগতে বাস করছি। নানা মত ও আদর্শের নজিরবীহিন প্রসারের ফলে পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। সমাজে দুর্বল-শক্তিশালী, মহিলা-পুরুষ, সৎ ও সীমালংঘকারী ইত্যাদি রয়েছে। অতএব ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুনরুজ্জাঈবনের আন্দলনের প্রতি মানুষকে আহবান জানানো এবং কোনো বিষয়ে ফতোয়া দেয়ার সময় এই জটিল প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে। আল্লাহর রেজামন্দি প্রত্যাশী একজন মুসলমান ব্যক্তি জীবনে চরমপন্থী মত পোষণ কিংবা কঠোর নিয়মশৃখলার মনে চলতে পারে। গান-ব্দ্য, নাটক এসবের স্থান তার জীবন নেই। কিন্তু কোনো আধুনিক রাষ্ট্র টিভি, রেডিও, আলোকচিত্র, সংবাদপত্র বা সংবাদ মাধ্যম ছাড়া চলতে পারে না। ইমিগ্রেশন, পাসপোর্ট, ট্রিফিক, শিক্ষা ও আইন শৃংখলার ক্ষেত্রে ছবি এখন অপরিহার্য। অপরাধ ও জালিয়াতি প্রতিরোধে এর ব্যবহার এখন ব্যাপক ও অত্যাবশ্যক। অতএব আধুনিক কোনো রাষ্ট্র ও সমাজ কি টিভির গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারে? অথচ ফটোভিত্তিক বলে অনেকে এটাকে হারাম বলে মনে করেন।
সংক্ষেপে আমি যা বলতে চাই, নিছক ব্যক্তি জীবনে কড়াকড়ি সহনীয়; কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্রের উপর তা চাপিয়ে দেয়াএ চিন্তা অবাস্তব। একানে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাদীসটি আবার স্মতূব্য: “যে নামাযের ইমামতি করে তার উচিত নামায সংক্ষিপ্ত করা। কেননা জামাতে দুর্বল, বৃদ্ধ এবং ব্যস্ত লোকও থাকে।” (বুখারী)
একটি মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে অনেকে এটা স্বীকার করতে চান না যে, শরীয়তের সকল আহ্কাম সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আহ্কামের বিভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে এটাও তারা মানতে চান না। প্রথা, আচার-আচরণ ও দৈনন্দিন লেনদেনের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় আনুমানিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। এগুলো ইজতিহাদ সাপেক্ষ এবং স?ঠিক ইজতিহাদ থেকে উৎসারিত সিদ্ধান্তবলীতে মতানৈক্য ক্ষতিকর নয়, বরং এটি শরীয়তে নমনীয়ত ও ফিকাহর ব্যাপকতার প্রমাণ এবং উম্মার জন্যে আশীর্বাদ। এসব বিষয় সাহাবায়ে কিরাম (রা) এবং তাদের উত্তরর্সরীদের মধ্যেও মতভেদ ছিল। কিন্তু এগুলো কখনোই তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারেনি। অন্যদিকে ঈমান ও ইবাদত সম্পর্কিত আহকাম কুরআন ও সুন্নাহতে সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত। এটা মুসলিম উম্মার মানসিক ও আচরণগত ঐক্যের প্রতীক। এগুলো থেকে বিচ্যূতি শুধু পাপ নয়, একজনকে কুফরীর দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এছাড়া আরো কিছু আহকাম আছে যেগুলো প্রত্যাখ্যান করা আল্লাহ ও রাসূলকে অস্বীকার করার নামান্তর। পক্ষান্তের এমন সব বিষয় আছে যেগুলো ব্যাখ্যা নিয়ে ফকীহরা মতভেদ করেছেন। যেমন, কেউ বাধ্য হয়ে একজন মুসলমানকে হত্যা করলে, হত্যাকারী, না যে হত্যা করালো, কে শাস্তি পাবে? না-কি উভয়ে শাস্তি ভোগ করবে? এই জটিল প্রশ্নের বিভিন্ন মিজহাবের ফীকহ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেবল ইমাম আহমদ (র)-এর হাম্বলী মাজহাবেই এ ব্যাপারে এতো মতভেদ রয়েছে যে, তারা এ নিয়ে ১২ খন্ডের বই লিখেছেন। বইটির নাম: আল-ইনসাফ ফীর রাজিহ মিনাল ইখতিলাফ।
এই প্রেক্ষিতে মুসলিম তরুণদেরকে মতানৈক্য ও মতৈক্যের বিষয়গুলো এবং মতানৈক্য নিরসনের মনদন্ড সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। এই লক্ষ্যে আমাদের আলিম ও উলামার কাছ থেকে প্রাপ্ত মতভেদ নীতি বা আদাব আল-ইখতিলাফের সাথে পরিচিত হওয়া আবশ্যক। তাহলে আমরা বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে উদার ও পরমতসহিষ্ণু হওয়ার শিক্ষা লঅভ করতে পারব। ভ্রাতৃত্ব বজায় রেখেও আমরা কিভাবে মতভেদ করতে পারি? প্রথমেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, প্রান্তিক বিষয়ে মতনৈক্য স্বাভাবিক। সুস্পষ্ট আহকাম ও অস্পষ্ট আহকাম সৃষ্টির পেছনেও ঐশী প্রজ্ঞা রয়েছে। অস্পষ্ট আহকাম ও বিভিন্নমুখী হওয়া সত্ত্বেও এর মধ্যে ভ্রাতৃত্বসুলভ মতভেদেরও সম্ভ।আবনা থাকে। এটাও আল্লাহ্ তায়ালার আর্শীবাদ, বিশেষ করে সেই সব আলিমের উপর যারা মজহাব নির্বিশেষে একটি বিষয়ের সকল দিক বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এরূপ বিশিষ্ট আয়েম্মোর সারিতে যারা রয়েছেন তাঁদের কয়েকজনের নাম উল্লেখযোগ্য: উবনে দাকীক আল ঈদ, ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়েম, ইবনে কাছীর, ইবনে হাজার আল আছকালানী, আল দাহলাবী, আশ-শাওকানী, আল-সানানী (র) বলতেন: “আমি কখনোই কামনা করিনি যে, সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে মতনৈক্য না থাক। তাদের মতনৈক্য রহমতস্বরূপ।”
এমনকি রাসূলুল্লাহ্ (সা) -এর জীবদ্দশায়ও একটি বিষয়ের বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যেতো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এগুলো অনুমোদন করতেন এবং তিনি ব্যক্তি বিশেষ বা গ্রুপকে দোষী বলে চিহ্নিত করতেন না। জঙ্গে আহযাবের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করে সে যেন বানু কুরাইজায় (বসতা) না পৌঁছা পর্যন্ত সালাতুল আসর আদায় না করে।” (বুখারী ও মুসলিম) কতিপয় সাহাবী এটাকে অসম্ভব মনে করে গন্তব্যে পৌঁছার আগেই সালাত আদায় করে নিলেন। অন্যরা অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থ গ্রহণকারীরা বানু কুরাইজার পৌঁছে নামায পড়লেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে এটা জানানো হল, তিনি উভয় পক্ষের কাজ অনুমোদন করলেন যদিও একপক্ষ ভুল করেছিল। এ থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি, নিরেট প্রমাণের ভিত্তিতে প্রণীত ব্যাখ্যাকেই মেনে চললে তাতে পাপ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
দুভার্গজনকভাবে আজকার একদল লোক আছেন যারা দাবী করেন তারাই সকল সত্যের আধার এবং সব প্রশ্নের জবাব তাদের কাছেই আছে এবং অন্যের উপর তা চাপি’য়ে দদিতে চান। তারা মনে করে তারা সকল মাযহাব ও মতভেদ নির্মূল করে এক আঘাতেই সকলকে একই প্লাটফর্মে হাযির করতে সক্ষম। তারা এ কথা বেমালুম ভুলে যান যে তাদের সিদ্ধান্তটাও অনুমান নির্ভর এবং তা ভুল বা শুদ্ধ উভয়ই হতে পারে। মোটকথা কোনো মানুষ অথবা কোনো আলিম অভ্রান্ত নন। একমাত্র নিশ্চিত ব্যাপার হচ্ছে, তার ইজতিহাদের জন্যে তিনি পুরস্কার পাবেন ভুল বা শুদ্ধ যাই হোক। অবশ্য তার নিয়ত সৎ থাকতে হবে। সুতরাং উপরোল্লিখিত ব্যক্তিরা একটা অতিরিক্ত মাহযাব সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই আশা করত পারেন না! এটা অদ্ভুত যে, তারা মাহযাবের অনুসৃতি অনুমোদন করেন না, কিন্তু অন্যকে নিজেদের নতুন মাহযাব অনুসরণে প্রলুবাধ করেন। তারা চান তাদের সৃষ্ট ‘একমাত্র’ মাহযাব সকলেই মেনে নিক। একবার এই ‘একমাত্র’ মাহযাবের একজন অনুসারী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: কেন সকল মুসলমান একটি মাত্র ফিকহী মতের অনুসারী হতে পারেন না? আমি জবাবে বললাম যে, মৌলসূত্রের ভিত্তিতে সকলের ঐকমত্য চাই। তা হতে হবে প্রামাণিক, অভিন্ন ও নির্বিরোধ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। এর বিরোধিতায় আর কোনো মৌলসূত্র উথ্থাপিত হতে পারবে না এবং পূর্বোল্লিখিত তিনটি বিষয়ে সকল আয়েম্মায়ে হাদীসের মতৈক্য থাকতে হবে। সংক্ষেপে, এই বিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর “রাফআল মালাম আনিল আয়েম্মাইল আলাম,শাহ ওয়ালীউল্লঅহ দেহলভীর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ও আল-ইনসাফ ফী আসবাবিল ইখতিলাফ এবং শেখ আলী আল-খলীফার আসবাব ইখতিলাফীল ফুকাহা” গ্রন্থে যেসব শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে তা পূরণ করতে হবে। এখন আসুন আমরা নিচের হাদীসগুলো পর্যালোচনা করি:
১. যে নারী সোনার হার পরবে তাকে কিয়াতমের দিনে অনুরূপ একটি আগুনের তৈরি হার পরানো হবে এবং যে নারী সোনার দুল পরবে তাকে কিয়ামতের দিন অনুরূপ একটি আগুনের তৈরি দুল পরানো হবে। (আবু দাউদ, নাসায়ী)
২. কেউ যদি তার প্রিয়জনকে কিয়ামতের দিন আগুনের দুল পরাতে চায় তবে সে যেন তাকে সোনার দুল পরেত দেয় এবং কেউ যদি তার প্রিয়জনকে কিয়ামতের দিন আগুনের বালা পরাতে চায় সে যেন তাকে সোনার বালা পরতে দেয়। কিন্তু তোমারা পছন্দ মতো রূপা ব্যবহার করতে পারো। (আবু দাউদ)
৩.ছওবান (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর কন্যা ফাতিমাকে (রা) সোনার চেন পরার জন্যে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। এতে সাড়া দিয়ে তিনি সেটা বিক্রি করে একটি গোলাম খরিদ করলেন এবং তাকে আযাদ করে দিলেন। যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এ কথা জানানো হলো তখন তিনি বললেন, আলহামদু লিল্লাহ! তিনি ফাতিমাকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে নিলেন।
ফকীহরা এসব হাদীস সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন: কেউ কেউ এগুলোর এনসান (হাদীসের বর্ণনা সূত্র) দূর্বল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং নিষিদ্ধ করার জন্যে অপর্যাপ্ত বিবেচনা করেছেন। কেউ কেউ ইসনাদকে সঠিক বললেও অন্য সূত্র থেকে প্রমাণ করেছেন যে, মেয়েরা সোনার অলংকার ব্যবহার করতে পারে। আর-বায়হাকী ও অনান্য ফকীহ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন বলে লিখেছেন এবং একে স্বীকৃত প্রচলন বলে ফিকায় মেনে নেয়া হয়েছে।
অন্য ফকীহরা অন্য হাদীসের ভিত্তিতে, যারা মজুদ সোনার যাকাত আদায় করেননি, তাদের ক্ষেত্রে এই হাদীস প্রযোজ্য বলে রায় দিয়েছেন। এই অন্য হাদীসগুলো আবার সমালোচনার উর্ধ্ব নয়। আবার, মহিলাদের গহণার যাকাত সম্পর্কেও বিভিন্ন মাযহাবে মতভেদ রয়েছে।
কেউ কেউ আবার যুক্তি দেখিয়েছেন, যেসব মহিলা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অহংকারবশত সোনার অলঙ্কার পরে এই হাদীসে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আন নাসাঈ এই বিষয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ কতিপয় হাদীস উল্লেখ করে “বাবুল কারাহিয়াহ লি নিসা এজার আলহালি জাহাব” শীষর্ক পস্তুক রচনা করেছেন। অনান্য ফকীহ বলেছেন, অহংকারবশত অতিরিক্ত সোনা ব্যবহার প্রশ্নের হাদীস জড়িত।
আধুনিক কালে শেখ নাসিরুদ্দীন আর-আলবানী (র) গত ১৪শত বছরেএ সকল মাযহাবের রায় বাতিল করে দিয়ে বলেছেন, হাদীসগুলোর ইসনাদ শুধু প্রমাণিকই নয়, এগুলো অন্য হাদীস দ্বারা বাতিলও হয়নি। সুতরাং গলার হার ও কানের দুল পরা নিষিদ্দ।
অতএব মতনৈক্যের যে দুর্বার স্রোত এগিয়ে চলছে তা কি বালির বাধ দিয়ে রুখা সম্ভব? প্রশ্নের জবাব অতি পরিষ্কার: “মতাভেদের অসংখ্য স্রোতধারা প্রবাহিত হতেই থাকবে, কিন্তু তা আমাদেরকে নিসজ্জিত করতে পারেবে না ইনশাআল্লাহ।” আল্লাহ্ তায়ালা বলেন: “প্রত্যেকেরই একটা দিক আছে, যার দিকে সে মুখ করে দাঁড়ায়।” (২:১৪৮)
এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই আধুনিক কালে একজন মাত্র ধর্মীয় নেতা মতভেদের নীতি ও তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি ইমাম হাসান আল-বান্না (র)। মুসলিম উম্মাহর সংগতি লক্ষ্যে নিবেদিত হয়েও তিনি তার অনুসারীদের এর নূন্যতম মর্ম উপলব্ধি করাতে পেরেছিলৈন এবং ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে ঐক্যমত সৃষ্টি তাদেরকে এক প্লাটফর্মে সমবেত করার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি মতভেদের অনিবার্যতা সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হয়েছিলেন। তার বিখ্যাত উসুল আল-ইশরুন গ্রন্থ থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়। এ বিষয়টি তিনি দক্ষতার সাথে তার বিভিন্ন বাণীতে তুলে ধরেছেন। ‘আমাদের দাওয়াত’ শীষর্ক বাণীতে তিনি বলেন যে, তার আহবান সর্বসাধারণের প্রতি, কোনো বিশেষ গ্রুপের প্রতি নয় এবং কোনো বিশেষ চিন্তাধারার প্রতিও নয়। দ্বীনের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করাই আমাদের কাম্যঅ এজন্যে বৃহত্তর কল্যাণে সকল প্রচেষ্টা সম্মিলিত খাতে প্রবাহিত করাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা মতৈক্য চাই, খামখেয়ালী নয়। কারণ সকল দুর্ভাগ্যের জন্যে দায়ী ভ্রান্তিপূর্ণ মতভেদ। আমরা বিশ্বাস করি বিজয় অর্জনের জন্যে ভালবাসা একটি বড় উপাদান অতএব ব্যার্থতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে এমন বিষয় পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি লিখেছেন:
“নানা কারণে ছোটখাট ধর্মীয় বিষয়ে মতভেদ অনিবার্য। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারনগুলো হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তির মাত্রা ও জ্হানের গভীরতার তারতম্য, বহুবিদ বাস্তব ঘটনা ও থথ্যের পারস্পারিক সম্পর্কে এবং ভাষায় অন্তর্নিহিত দ্ব্যর্থতা। এসব কারণে মূলসূত্রের ব্যাখ্যার বিভিন্নতার দরুন মতভেদের উদ্ভব অপরিহার্য।
ইসলামী বিশ্বের কোনো অংশে জ্ঞানের উৎসের প্রাচুর্য আবার অনান্য জায়গায় দুষ্পাপ্যতাও একটি বড় কারণ। এমাম মালিক (র) আবু জাফরকে (র) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীরা বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়েপড়েছিলেন, প্রত্যেকের কাছে জ্হান সঞ্চিত ছিল। তুমি যদি একটিমত অনুসরণে জবরদস্তি করো তাহলে ফিতনা সৃষ্টি করবে।”
পরিবেশগত পার্থকও রয়েছে। ইমাম শাফিঈ (র) ইরাক ও মিসরের বিরাজমান অবস্থার প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন ফতোয়া দিতেন। উভয় ক্ষেত্রে তিনি যা সত্য বলে রা’বীর প্রতি ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি মতপার্থক্যের আরেকটি কারণ। একজন রা’বীকে একজন এমাম নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করেন, আরেকজন তাতে সংশয় প্রকাশ করেন।
এসব কারণে আমরা বিশ্বাস করি, ধর্মীয় গৌণ বিষয়ে সর্বসম্মত মত অসম্ভব নয়, দ্বীনের প্রকৃতির সাথে অসংতিপূর্ণ। কেননা এরূপ দাবী কঠোরতা ও বাড়াবাড়ি জন্ম দেবে। আর এটা ইসলামের সরলতা, নমনীয়তা ও উদারতার পরিপন্থী। নিঃসন্দেহে এই মূল্যবোধগুলোর কারণেই ইসলাম যুগের দাবী মেটাতে সক্ষম।
অধিকন্তু, যেহেতুঋ আমরা সকলে ইসলামের সুবিস্তৃত কাঠিমোর আওতাধীন তাই গৌণ বিষয়ে মতভেদ আমাদের পারস্পারিক ভালবাসা ও সহযোগিতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে না। আমরা যদি মুসলমান হই তাহলে আমরা কি মুসলমান ভাইদের পোষণ করে যাওয়ার সম্ভাব্য প্রীতিপূর্ণ পরিবেশ গড়তে পারি না? অন্তত এ প্রশ্নে তো একমত হতে পারি।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীরা ফতোয়ায় মতভেদ পোষণ করেছেন কিন্তু তা অনৈক্য সৃষ্টি করেনি। সালাহ ও বনু কুরাইজার ঘটনাটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তারা আমাদের চেয়ে ভালভাবে জানা সত্ত্বেও যদি মতভেদ করে থাকেন তাহলে এটা কি অবাঞ্ছিত নয় যে, আমরা তুচ্ছ ব্যাপারে বিদ্বেষবশত মতনৈক্যে লিপ্ত হই? যদি আমাদের ইমামগণ বিভিন্ন বিষয়ে মতদ্বৈততা পোষণ করেন তাহলে আমাদেরও তা হতে পারে। যদি প্রাত্যহিক আযানের মতো প্রতিষ্ঠিত গৌণ বিষয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে তাহলে অন্যান্য জটিল বিষয়ের কি দৃশ্য হবে?
আমাদেরকে এটাও স্মরণ রাখতে হয় যে, খিলাফত আমলে বিরোধীয় বিষয়গুলো খলিফার কাছে পেশ করা হতো। এখন যেহেতু খলীফা নেই সেহেতু এমন নির্ভরযোগ্য সূত্র বা ব্যক্তিত্ব খুঁজতে হবে যেন সেখানে বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধান করা যায়; নতুবা মতবিরোধ আরেকটি মতবিরোধের জন্ম দবে। পরিশেষে,আমাদের ভ্রাতাগণ এসব বিষয়ে পূর্ণ সচেতন এবং তাদের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও উদারতা থাকা আবশ্যক। তারা বিশ্বাস করেন প্রতিটি গ্রুপের দাওয়াতের মধ্যে কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা উপাদান থাকতে পারে। তারা সতর্ক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সত্যকে গ্রহণ করেন এবং যারা ভুল উপলব্ধি করেন, তাহলে খুব ভালো, আর যদি না করেন তবুও তাঁরা আমেদর মুসলিম ভাই। আমরা আল্লাহর কাছে সঠিক পথের দিশা চাই!”
ফিকাহর মতভেদ সংক্রান্ত একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। রমযান মাসে একদিন তিনি মিসরের একটি ছোট গ্রামে বক্তৃতার দাওয়াত পান। সেকানে দু’দল লোক তারাবীর নামাযের সংখ্যা নিয়ে বাকবিতণ্ডা করছিল। একদল বলল, উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর দৃষ্টান্ত অনুযায়ী ২০ রাকাত। আরেক দল ৮ রাকাতের উপর জোর দিচ্ছিল। তাদের যুক্তি ছিল রাসূলুল্লাহ (সা) কখনো আট রাকাতের বেশি তারাবীহ পড়েননি। উভয় পক্ষ একে অপরকে বিদাতের অভিযোগে অভিযুক্ত করল। পরিস্থিতি এক পর্যায়ে হাতাহাতির উপক্রম হলো। তারা আল-বান্না (র)-এর কাছে বিষয়টি পেশ করল। তিনি প্রথম প্রশ্ন করলেন: তারাবীহ কী ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান? জবাব এলো: সুন্নাত, পালন করলে সওয়াব, না করলে গুনাহ। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন: মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে কী মত? তারা জবাব দিল: বাধ্যতামূলক এবং ঈমানের অন্যতম মৌলিক বিষয়। কখন আল-বান্না (র) বললেন: তাহলে শরীয়তের দ্রষ্টিতে ফরয অথবা সুন্নতের মধ্যে কোন্টি পরিত্যাগ করা যুক্তিযুক্ত? অতঃপর তিনি বললেন: আপনারা যদি ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য চান তাহলে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে নিজেদের বিশ্বাস মোতাবেক তারাবীহর নামায পড়ুন। তর্ক করার চেয়ে এটাই উত্তম।
ঘটনাটি আমি কিছু লোকের কাছে বর্ণনা করলে তারা বললেন, আল-বান্নার পদক্ষেপ সত্য এড়িয়ে যাওয়ার শামিল। তিনি সুন্নাত ও বিদাতের পার্থক্য নিরূপণ করেননি। আমি বললাম, এ বিষয়ে মত বিরোধের অবকাশ আছে। আমি নিজে যদিও তারাবীহর নামায আট রাকাত পড়ি, কিন্তু যারা বিশ রাকাত পড়ে তাদেরকে বিদাতীর দায়ে অভিযুক্ত করি না। তারা অনমনীয়তা ব্যক্ত করে বলল, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়া মুসলমানদের কর্তব্য। আমি যুক্তি দেখালাম, এটা হালাল ও হারামের ব্যাপারে সত্য; কিন্তু ফিকহী মাসলার ক্ষেত্রে নয়। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ আছে, অতএব প্রত্যেক পছন্দ অনুযায়ী একটি মত বেছে নিতে পারেন, কিন্তু এ ব্যাপারে গোঁড়ামি অনাবশ্যক।
অনেক বিজ্ঞ আলিম এটি স্বীকার করেছেন। হাম্বালী কিতাব ‘শারহে গায়াত আল-মুনতাহা’য় বলা হয়েছে:
কেউ যখন ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত নাকচ করে তখন সে মুজতাহিদুনের মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞতাবশত এরূপ করে, যাদেরকে আল্লাহ্ ভুল বা শুদ্ধ পরিশ্রম সাপেক্ষ সিদ্ধান্তের জন্যে পুরস্কৃত করবেন। তাদেরকে অনুসরণ গুণাহ হবে না। কেনা তারা যে ইজতিহাদে পৌঁছেছেন তা আল্লাহ্র নির্ধারিত পথ ধরেই এগিয়েছে; ফলে তা শরীয়তের অংশ হয়ে যায়। একটি উদাহরণ, প্রয়োজনে মৃত প্রাণীর গোশত খাওয়ার অনুমতি আছে, কিন্তু ইচ্ছাকৃত খাওয়া নিষিদ্ধ। দুটোই সুপ্রতিষ্ঠিত ফিকহী সিদ্ধান্ত।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) তাঁর ‘আল-ফাতাওয়াল মিসরীয়া’ বইয়ে বলেছেন, ঐক্যের কথা বিবেচনা করাই সঠিক পথ। অবশ্য সম্প্রতীতি ও সখ্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পছন্দনীয় জিনিস পরিহার করাও সংগত। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত ইবরাহীম (আ)-এর স্থাপিত ভিত্তির উপর কা’বা নির্মাণ পরিত্যাগ করেছিলেন*। ইমাম আহমদ (র)-এর মতো ইমামগণ ঐক্য রক্ষার স্বার্থে পছন্দনীয় বিষয় পরিহার করে মতৈক্যের বিষয় মেনে নেয়ার পক্ষপাতী।
ইবনে তাইমিয়া ৯র) কা’বা নির্মাণ সংক্রান্ত নিম্মোক্ত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আয়েশা (রা)-কে বলেন: তোমাদের জনসাধারণ সম্প্রতি যদি জিহিলিয়ার মধ্রে না থাকতো তআহলে আমি (হযরত) ইবারাহীম (আ)-এর ভিত্তির উপর কা’বা পুনঃনির্মাণ করতাম। ইবনুল কাইয়েম সালাতুল ফজরে কুনুতের বিষয়টিও তুলেছেন। কেউ এটাকে বিদাত বলেন আর কেউ এটা দুর্দিনে আমল করার পক্ষে। তিনি তাঁর বই ‘যাদুল মাদে’ বলেছেন, আপকালে এটা আমল করা রাসূলের সুন্নাত। হাদীস বিশারদরাও এটা সুন্নাত জেনে আমল করেছেন; আর যারা এটাকে রাসূলের সুন্নাত বলে জানতে পারেননি তারা এটাকে আমল করেননি। ইবনুল কাইয়েম লিখেছেন: “নামাযে রুকু থেকে ওঠার পর আল্লাহর রহমত কামনা ও তাঁর শুকরিয়া আদায়ের উপযুক্ত মুহূর্ত।”
রাসূলুল্লাহ (সা) এই অবস্থায় দু’টি কাজেই করেছেন। এ সময় ইমামের সশব্দে দোয়া পাঠ গ্রহণযোগ্য যাতে মোক্তাদিরা শুনতে পায়। উমর ইবনে খাত্তাব (রা) ও ইবনে আব্বাস (রা) ও এরূপ করতেন যাতে মানুষ সুন্নাহ জানতে পারে। উমর ইবনে খাত্তাব (রা) শব্দে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করতেন এবং ইবনে আব্বাস (রা) জানাযার নামাযেও এরূপ করতেন। এগুলো গ্রহণযোগ্য মতভেদ সাপেক্ষ কাজ। যারা এরূপ করেন বা যারা করেন না কেউই দোষণীয় নন। যেমন নামাযে হাত তোলা, কিরান ও তামাত্তুর বিভিন্ন প্রক্রিয়া।
আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসূলের সুন্নাত তুলে ধরা। কোন্টি জায়েয, কোন্টি নাজায়েয তা চিহ্নিত করার চেষ্টা আমি করিনি, বরং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সর্বোৎকৃষ্ট সুন্নাত তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্যঅ আমরা যদি বলি রাসূলুল্লাহ (সা)-নেই, তার অর্থ এই নয় যে, তিনি অন্যকে ও ব্যাপারে নিয়মিত করতে বলেছেন কিংবা কেউ পালন করলে তা রিদ্দাহর পর্যায়ভুক্ত হবে।
এক মাযহাবের অনুসারী অন্য মাযহাবের ইমামের পেছনে নামাযও আদায় করতে পারে; যদিও ঐ মুক্তাদি মনে করে যে, এতে তার মাযহাবে তা সিদ্ধ। এবনে তাইমিয়াহ (র) ‘আল-ফাওয়াকিহুল আদিদাহ’ পুস্তকে লিখেছেন: সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন এবং চার ইমামের রীতি অনুসারে পরস্পরের পেছনে নামায পড়া সিদ্ধ বলে মুসলমানরা সর্বসম্মত। যে এটাকে অগ্রাহ করে সে বিপথে চালিত মুবতাদী এবং কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা ও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত থেকে বিছু্যত হয়।
কোনো কোনো সাহাবী ও তাবিঈন জোরে বাসমালাহ উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু অন্যরা করেননি, এতদসত্ত্বেও তারা পরস্পরের পেছনে নামায আদায় করে?ছেন। আবু হানিফা (র) ও তার অনুসারীরাও তাই করেছেন। শাফিঈরা মদীনায় মালিকীদের পেছনে নামায পড়তেছিলেন। কারণ, ইমাম মালিক (র) ফতোয়া দিয়েছিলেন এই অবস্থায় নতুন করে অযু করার দররকার নেই।
অবশ্য ইমাম আহমদ আবনে হাম্বল (র) শরীর বা নাক থেকে রক্ষক্ষরণহলে অবশ্যই গোসর করতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোন মুসল্লী যদি ইমামের শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হতে দেখে তাহলে তার পেছনে সে নামায গড়ে যাবে কিনা এ প্রশ্নে ইমাম হাম্বাল (র) বলেন: “সাঈদ আবনে মুসাইয়াবের ও মালিকের (র) পেছনে নামায না পড়া অচিন্ত্যনীয়। অতঃপর তিনি দু’টো বিবেচ্য বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন:
(ক) ইমামের কোনো আচরণ সালাতকে বাতিল করলেও তা যদি মোক্তাদির দৃষ্টি এড়ায় তাহলে মোক্তাদিকে নামায চালিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী ওলামা ও চার ইমাম একমত। (খ) কিন্তু ইমাম নাপাক হতে পারেন এমন কিছু যদি করেন আর সে ব্যাপারে মোক্তাদি যদি নিশ্চিত হয় তবে সে তার মর্জি মাফিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কেননা এ ব্যাপারে ব্যাপক মোনৈক্য রয়েছে। আমাদের পূর্ববর্তী বুযর্গদের মতে এরূপ ইমামের পেছনে নামায পড়া জায়েয। মালিকী মাযহাবও তাই মনে করে; কিন্তু শাফিঈ ও আবু হানিফা (র) ভিন্ন মত পোষণ করেন। আহমদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে এই মতের প্রতিই সমর্থন পাওয়া যায়। (আল ফাওয়াকিহ আলাআদিদা; কারাজাতি, ফতোয়া মুয়াসিরাহ।)