ধর্মীয় চরমপন্থার ধারণা
ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতিকার করতে হলে সর্বপ্রথমে এর সঠিক সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা ও গভীর পর্যালোচনা প্রয়োজন। বিশুদ্ধ ইসলামী চেতনা ও শরীয়ার ভিত্তিতেই বিষয়টির বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। অন্য কোনো মানদন্ডে বিচার করলে তার কোনো মূল্য নেই, কেবল ব্যক্তিগত মতামতের কোন অবকাশ থাকতে পারে না। এ প্রসঙ্গে কুরআন বলছে: “যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয় তবে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে পেশ করো যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাকো।” (৪:৫৯)
মুসলিম উম্মাহর সমগ্র ইতিহাসে এ ব্যাপারে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের বিষয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে পেশ করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, আল কুরআন এবং মহানবী (সা)-এর সুন্নাহর মধ্যে এর সমাধান অন্বেষণ। শরীয়ভিত্তিক এরুপ অনুমোদন ছাড়া মুসলিম যুব সমাজ-যাদের বিরুদ্ধে চরমপন্থার অভিযোগ আনা হয়েছে-মুসলিম আলিমদের ফতোয়াবাজির প্রতি কর্ণপাত করবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে যাবে। অধিকন্তু তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই অজ্ঞতা ও মিথ্যাচারের অভিযোগ আনবে।
এখানে উল্লেখ্য, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আশ-শাফিঈর বিরুদ্ধে রাফেজী হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি কোনো পরোয়া না করে এই সস্তা অভিযোগের বিরোধিতা করে একটি শ্লোক পাঠ করেন যার অর্থ হচ্ছে: “আহালে বায়েতের সকলের প্রতি ভালবাসাই যদি হয় প্রত্যাখ্যান তবে মানুষ ও জিনকে সাক্ষী করে বলছি যে, আমি একজন প্রত্যাখ্যানকারী।” বর্তমান যুগের একজন ইসলাম প্রচারক তার বিরুদ্ধে “প্রতিক্রিয়াশীলতার” অভিযোগ শুনে বলেন “কুরআন ও সুন্নাহর সুনির্দিষ্ট অনুসরনই যদি প্রতিক্রিয়াশীলতা তাহলে আমি প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবেই বাঁচতে, মরতে ও পুনরুত্থিত হতে চাই।”
আসলে “প্রতিক্রিয়াশীলতা”, “অনমনীয়তা”,“গোড়ামী” ইত্যাদি শব্দের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণ করা অত্যাবশ্যক। তাহলেএক গ্রুপের বিরুদ্ধে আরেক গ্রুপের এসব শব্দের অপব্যবহার যেমন রোধ করা যাবে তেমনি ডান-বাম বলে পরিচিত বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও সামাজিক মহল এসব শব্দের সুবিধাবাদী মনগড়া ব্যাখ্যাও দিতে পারবে না। একইভাবে “ধর্মীয় চরমপন্থা” শব্দটির সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা নির্ণীত না হলে সবাই নিজ নিজ মর্জি মাফিক এর প্রয়োগ করবে। ফলত মুসলিম সমাজে বিভেদ ক্রমবিস্তৃত হতে থাকবে আল-কুরআন ঘোষণা করেছে:
“যদি সত্য তাদের ইচ্ছা মাফিক নির্ধারিত হতো তাহলে আকাশ ও পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যস্থিত সব কিছু বিভ্রান্তি ও দুর্নীতি পূর্ণ হয়ে উঠতো।” (২৩:৭১)
এখন আমি দু’টো গুরুত্বপূর্ন বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। প্রথম, একটি মানুষের সাধুতার (piety) মাত্রা এবং যে পরিবেশের মধ্যে তিনি বাস করেন তা বহুলাংশে অন্য মানুষের প্রতি তার মনোভাব গঠনের প্রভাবিত করে থাকে। কঠোর ধর্মীয় পটভুমি থেকে গড়ে ওঠা একজন মানুষ কারো মধ্যে সমান্যতম বিচ্যুতি বা অবহেলা দেখলে সহ্য করতে পারেন না। তার দৃষ্টিতে বিচার করে তিনি যদি দেখেন যে এমন মুসলমানও আছে যারা তাহাজ্জুদ পড়ে না বা নফল নামায পড়ে না তবে তার বিষ্ময়ের ঘোর কাটতে বেশ সময় লাগবে বৈ কি। এটা ঐতিহাসিকভাবেই খাঁটি কথা। মানুষের আমল ও আখলাকের পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, তাবেঈন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীদের নিকটবর্তী যুগের লোকদের আমলের তুলনায় পরবর্তী লোকদের (মুসলমানদের) আমল-আখলাক ততোটা উজ্জ্বল নয়। একটি প্রাবাদে আছে: “পরবর্তী লোকদের নেক কাজ পূর্ববর্তী লোকদের ত্রুটির সমতুল্য।” এখানে আনাস ইবনে মালিক (রা) তার সমসাময়িক তাবেঈনদের উদ্দেশ্যে যা বলতেন তা স্মর্তব্য “আপনারা তুচ্ছ জ্ঞান করে অনেক কাজ করছেন অথচ একই কাজ রাসূলুল্লাহ (সা) -এর আমলে ভয়ানক পাপ বলে গণ্য করা হতো।” একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন হযরত আয়েশা (রা)। তিনি বিখ্যাত কবি লাবিদ ইবনে রাবিয়ার একটি শ্লোক আবৃত্তি করতেন। তিনি তার এই শ্লোকে এই বলে বিলাপ করেছেন যে, সমাজে অনুকরণীয় সজ্জন ব্যক্তিদের অন্তর্ধানে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা স্থান দখল করেছে ছন্নছাড়ারা যাদের সঙ্গ মামড়ি-পড়া পশুদের মতোই বিষাক্ত। হযরত আয়েশা (রা) এই ভাবে বিস্মিত হতেন যে লাবিদ আজ বেঁচে থাকলে বর্তমান সমাজের চেহারা দেখে কী মনে করতেন! হযরত আয়েশা (রা) -এর ভাগ্নে উরওয়াহ ইবনে আল জুবায়েরও এই শ্লোকটি আবৃত্তি করে ভাবতেন আজ হযরত আয়েশা (রা) ও বেঁচে থাকলে এ যুগের অধঃপতনকে কী চোখে দেখতেন! এবার আমরা এর উল্টোটা দেখি। যে ব্যক্তির ইসলাম সম্পর্কে তেমন জ্ঞান বা আনুগত্যবোধ নেই কিংবা সে এমন এক পরিবেশে গড়ে উঠেছে যেখানে শরীয়ত উপেক্ষিত বরং আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তাই করা হয় নিদ্বির্ধায়, সেই ব্যক্তি ইসলামের প্রতি কারো সামান্য অনুরাগ দেখলেই তাকে গোঁড়া বা চরমপন্থী বলে মনে করবে। এমন ব্যক্তি সাধুতার ভান করতে অভ্যস্ত এবং সে ধর্মের কোনো কোনো বিষয়ের সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হবে না, এরা যৌক্তিকতাকেও অস্বীকার করে বসবে। ইসলামের প্রতি যারা অনুরক্ত তাদেরকে সে অভিযুক্ত করবে এবং কোনটা হারাম আর কোনটা হলাল সে বিষয়ে তর্ক করতে তার জুড়ি মেলা ভার। অবশ্য ইসলাম থেকে দুরত্বে অবস্থানের দরুনই এসব মানুষের এরুপ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। ভিন্ন আদর্শ ও জীবন ধারার প্রভাবের কারণে কোনো কোনো মুসলমানের কাছে পানাহার, সৌন্দর্যবোধ, শরীয়তের পাবন্দীর তাগিদ এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার মতো সুষ্পষ্ট ইসলামী মূল্যবোধগুলো ধর্মীয় গোঁড়ামী বা চরমপন্থা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। এমন ব্যক্তির চোখে শ্বশ্রুমন্ডিত মুসলমান তরুণ কিংবা হিজাব পরা মুসলিম তরুণী মাত্রই চরমপন্থী। এমনকি ভাল কাজের আদেশ ও খারাপ কাজের নিষেধকে গোঁড়ামী এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ বলে মনে করা হয়। আমরা জানি আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হচ্ছে একমাত্র ইসলামকেই সত্য বলে মেনে নেয়া এবং যারা এটা বিশ্বাস করে না তারা বিভ্রান্ত বলে স্বীকার করা। কিন্তু এ সমাজে এমন মুসলমানও দেখা যায় যারা এটা মানতে নারাজ। যারা ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মগ্রহণ করেছে তাদের কাফির গণ্য করতে তাদের ঘোরতর আপত্তি! এটাকেও তারা উগ্রতা ও গোঁড়ামী বলে মনে করে। আর এটা এমন একটা ইস্যু, যে ব্যাপারে আমরা কখনোই আপোস করতে পারি না।
দ্বিতীয়ত, কেউ জোরালো মতামত অবলম্বন করলেই তাকে “ধর্মীয় চরমপন্থী” বলে অভিযুক্ত করা অন্যায়। কেউ যদি তার মতামত সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হয় যে, এ ব্যাপারে শরীয়তেরও অনুমোদন রয়েছে তবে সে তার মত অনুযায়ী স্বাচ্ছন্দে চলতে পারে। তার পেছনে ফুকাহাদের সমর্থন দুর্বল বলে অন্যেরা মনে করলেও তাতে কিছু আসে যায় না। সে তো কেবল তার চিন্তা ও বিশ্বাসের জন্যে দায়ী। সে যদি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাকে সীমিত গন্ডিতে অনুশীলন না করে নিজের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে নেয়, কারো বলার কিছু নেই। কেননা সে হয়তো মনে করে অতিরিক্ত আমলের মাধ্যমে আল্লাহর রেজামন্দী হাসিল করা সহজ হবে। বস্তুত এসব বিষয়ে মত পার্থক্যের অবকাশ আছে। কেউ একটা বিষয়কে সহজভাবে নেয় আবার অনেকে এর বিপরীত আচরণে অভ্যস্ত। রাসূলে কারীম (সা) -এর সাহাবীদের বেলায়ও একথা সত্য। উদাহরণস্বরুপ, ইবনে আব্বাস (রা) ধর্মীয় বিষয়গুলোর প্রতি সহজতর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন, কিন্তু ইবনে উমর (রা) ছিলেন কঠোর মনোভাবাপন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, একজন মুসলমানের পক্ষে যথেষ্ট হবে যদি সে কোনো একটি মাযহাবের অনুসরণ করে অথবা কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক নির্ভরযোগ্য ইজতিহাদের পন্থা অনুসরণ করে। অতএব যদি কেউ চার ইমাম যথা শাফিঈ, আবু হানিফা, মালিক ও আহমদ ইবনে হাম্বলের (রা) মাযহাবের মধ্যে কোনো একটি অনুসরণ করে এবং তা যদি অন্য কিছু পন্ডিতের বিবেচনায় সমকালীন মতের বিরোধী হয় তাহলেই কি ঐ ব্যক্তিকে চরমপন্থী বা গোঁড়া বলে অভিহিত করা সঙ্গত হবে? আমাদের কি কোনো অধিকার আছে অন্য কোনো ব্যক্তির ইজতিহাদী পন্থা বেছে নেয়ার অধিকারকে খর্ব করার?
বহু ফকীহ এই রায় দিয়েছেন যে, মুখমন্ডল ও হাত বাদ দিয়ে মুসলিম মহিলারা সমগ্র দেহকে আবৃত করে- এমন পোষাক পরতে পারে। হাত ও মুখমন্ডলকে ছাড় দেয়ার পক্ষে তারা কুরানের এই আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন: “….. তাদের সৌন্দর্য ও অলঙ্কার প্রদর্শন করা উচিত নয়, তা ব্যতীত যা (অবশ্যই সাধারণভাবে) দৃষ্টিগোচর হয়।” (২৪:৩১)
এর পক্ষে তারা হাদীসের প্রামাণ্য ঘটনা এবং ঐতিহ্যের সমর্থনও পেশ করেছেন। বহু সমকালীন আলেমও এই মতের সমর্থক, আমি নিজেও।পক্ষান্তরে, অনেক আলেম যুক্তি পেশ করে বলেছেন যে, হাত এবং মুখও ‘আওরা’ অর্থাৎ অবশ্যই ঢাকতে হবে। তারাও কুরআন, আল-হাদীস ও প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য থেকে প্রমাণ পেশ করেন। সমসাময়িক বহু আলেম এই মতের সমর্থক। এদের মধ্যে পকিস্তান, ভারত, সউদী আরব ও উপসাগরীয় দেশের আলেমও রয়েছেন। তারা মুসলিম মহিলাদের মুখ ঢাকতে এবং হাত মোজা পরতে বলেন। এখন কোনো মহিলা যদি ঈমানের অঙ্গ হিসেবে এটা পালন করেন তবে তাকে কি গোঁড়া বলে চিহ্নিত করতে হবে? কিংবা কোনো ব্যক্তি যদি তার স্ত্রী কন্যাকে এটা মেনে চলার জন্য তাগিদ দেন তাহলে তাকেও কি চরমপন্থী বলে অভিহিত করতে হবে? আল্লাহর বিধান বলে কেউ যা মনে করে তা ছেড়ে দিতে কাউকে বাধ্য করার অধিকার কি আমাদের আছে? তা যদি করি তাহলে কি আমরা আমাদের খেয়ালখুশী চাপিয়ে দেয়া কিংবা চরমপন্থী বরে অভিযোগ এড়ানোর জন্যে আরেকজনকে আল্লাহর ক্রোধের দিকে ঠেলে দেয়ার অযাচিত নছিহত করব না? নাচ-গান, ছবি ও আলোকচিত্রের ব্যাপারে যারা কঠোর মনোভাব পোষণ করেন সে ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব কঠোর মত আমার ব্যক্তিগত ইজতিহাদ থেকে শুধু নয় বরং অন্যান্য প্রখ্যাত আলেমদের ইজতিহাদ থেকেও ভিন্নতর। কিন্তু স্বীকার করতেই হয় যে এসব মতামতের সাথে প্রাথমিক যুগ ও সমসাময়িক অনেক আলিমদের দৃষ্টিভঙ্গির সাজুয্য রয়েছে।
আমরা অনেকে শার্ট ও প্যান্টের পরিবর্তে ছওব (ঢিলা জামা-কাপড়) পরা অথবা মেয়েদের সাথে মোসাফাহা না করাকে গোঁড়ামি বলে সমালোচনা করি; কিন্তু খোদ উসূলে ফিকাহ এবং উম্মাহর ঐতিহ্যের মধ্যেই এসব বিষয়ে বিতর্কের বীজ নিহিত রয়েছে। মতপার্থক্য থাকার সুযোগের কারণেই সমসাময়িক আলিমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মত প্রকাশ করেন এবং জোর প্রচার চালান। ফলত, আল্লাহর রহমতের আশা এবং তাঁর শাস্তির ভয়ে কিছু নিষ্ঠাবান মুসলিম তরুণ এসব বিষয় মেনে নেন। সুতরাং ফকীহর রায়ের ভিত্তিতে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কেউ যদি ধর্মচর্চায় কঠোরতা অবলম্বন করে তবে সে জন্যে তাকে নিন্দা করা বা গোঁড়ামির অপবাদ দেয়া সমীচীন নয়। তার বিশ্বাসের পরিপন্থী আচরণে তাকে বাধ্য করার অধিকার আমাদের নেই। আমাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে প্রজ্ঞা, যুক্তি ও ধৈর্যের মাধ্যমে এমনভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা যাতে আমরা যেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করি তা গ্রহণে সে উদ্বুদ্ধ হয়।